বুধবার, ২১ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

খাদ্যের মজুদ ও চালের মূল্য

দেশে খাদ্যের মজুদ যে কমতে কমতে অত্যন্ত আশংকাজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে- এ সম্পর্কে জানানো হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পরিসংখ্যানসহ একথাও জানানো হয়েছে যে, মজুদ একেবারে তলানিতে ঠেকেছে এবং দেশ এখন মারাত্মক খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একই সঙ্গে আশা ও ধারণা করা হয়েছিল, সরকার নিশ্চয়ই বিষয়টির প্রতি যথোচিত গুরুত্ব দেবে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত রাখা ছাড়া আর কোনো প্রচেষ্টাই লক্ষ্য করা যায়নি। সরকার এমনকি লাভজনক তথা আকর্ষণীয় মূল্য দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সম্প্রতি ওঠানো বোরো ধান সংগ্রহের জন্যও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। 
ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে লাভজনক মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা গ্রামীণ মহাজন এবং মিলারদের কাছেই সব ধান বিক্রি করেছে। সীমান্ত দিয়েও পাচার হয়ে গেছে হাজার হাজার মণ ধান। সব মিলিয়েই সরকারি গুদামের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এক মণ ধানও গুদামে আসেনি। সর্বশেষ বুধবার প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, চালের মজুদ এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশে কম পক্ষে ১০ লাখ টন খাদ্যের মজুদ থাকা জরুরি। গত বছরের ৩০ এপ্রিলও সরকারি গুদামগুলোতে চাল ও গমের মজুদ ছিল ১০ লাখ ২২ হাজার টনের বেশি। অন্যদিকে চলতি বছরের একই সময়ে মজুদের পরিমাণ কমতে কমতে প্রথমে চার লাখ ৭৭ হাজার টনে নেমে এসেছিল। সরকার তখনও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। যার ফলে মজুদ নেমে এসেছে মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টনে।
এমন অবস্থার কারণ হিসেবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং দফতর-অধিদফতরের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছেন বলেই নাকি মজুদ কমে গেছে। সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে কর্মকর্তারা নাকি খাদ্যের আপৎকালীন মজুদ থেকেও সাড়ে সাত লাখ টন চাল বের করে এনেছেন। ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা ছাড়াও ওই সব চাল ভিজিএফ এবং ওএমএস ও কাবিখা ধরনের কিছু অপরিকল্পিত কর্মসূচিতে বিলি-বন্টন করা হয়েছে। এরই পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকার দলীয় নেতা-কর্মী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী টাউট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন বা দ্বিতীয় কোনো ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাওর অঞ্চলের আকস্মিক বন্যা। ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢলে সুনামগঞ্জের ছয়টি উপজেলার সম্পূর্ণ ফসল পচে গেছে। দেশের অন্যসব এলাকাতেও বোরোর আবাদ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষকদের লাভজনক মূল্য দেয়া হলে তারা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী হয়ে উঠতো। এর ফলে সরকারি গুদামগুলো অনেকাংশে পূর্ণ হতে পারতো। অন্তত এখনকার মতো ভয়ংকর বিপদে পড়তে হতো না। 
কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগই সরকারের পক্ষে নেয়া হয়নি। তাছাড়া চাল আমদানির ব্যাপারেও সরকারকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। আমদানির নীতি-কৌশল নির্ধারণ করার নামে আসলে একটি ব্যাপারেই কর্তা ব্যক্তিরা বেশি ব্যস্ত থেকেছেনÑ আমদানির সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব যাতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের হাতে থাকে। এর ফলে আমদানির ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়েছে সরকার। ওদিকে পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি রেখেছে অতি মুনাফাখোর টাউট ব্যবসায়ীরা, যাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দহরম-মহরম রয়েছে। চাল সহজে আমদানি করা হচ্ছে না মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই ওই টাউট ব্যবসায়ীরা রাতারাতি চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। ফলে পবিত্র রমযান শুরু হতে না হতেই সব ধরনের চালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়ে গেছে পাঁচ-সাত থেকে ১০-১৫, এমনকি ২০-২৫ টাকা পর্যন্তও। এখনো চালের দাম শুধু বাড়ছেই। অন্যদিকে চার থেকে ছয় লাখ টন পর্যন্ত চাল আমদানি করার কথা শোনানো হলেও তার কোনো শুভ প্রভাব পড়ছে না বাজারের ওপর। একই কারণে একদিকে মজুদের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, অন্যদিকে চালের দাম কমবে বলেও আশা করা যাচ্ছে না। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, খাদ্য মজুদের বর্তমান অবস্থার জন্য সরকারের পক্ষে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, শিল্পায়নসহ বাস্তবসম্মত বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির পাশাপাশি কাবিখা, ওএমএস ও ভিজিএফ ধরনের এমন কিছু কর্মসূচি সরকার গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, যেগুলোর কারণে খাদ্যের মজুদই শুধু কমেছে। ধান-চাল সংগ্রহ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যও সরকারকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। চাল আমদানির ব্যাপারেও একই কথা সত্য। এসবই দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়েই ব্যবসায়ীরা যথেচ্ছভাবে দাম বাড়িয়ে চলেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, বিশেষজ্ঞদের অনেকে এমনকি দুর্ভিক্ষের আশংকাও প্রকাশ করেছেন। বাস্তবেও অত্যধিক এবং অনিয়ন্ত্রিত দামের কারণে  ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ এখন পেট ভরে ভাত খেতে পারছে না। দেশে চাকরির সুযোগ নেই, হু হু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। প্রতিটি জিনিসের দাম চলে গেছে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। কিন্তু সরকার এখনো ভুল ও বানোয়াট তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। 
আমরা মনে করি, সত্য এড়ানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে প্রায় নিশ্চিত দুর্ভিক্ষের কবল থেকে দেশকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নেয়া। এ লক্ষ্যে দলীয় লোকজনকে দিয়ে খাদ্য আমদানি করালে এবং মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও টাউট ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিলে চলবে না, অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে লাভজনক মূল্য দিয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান কেনার পদক্ষেপ নিতে হবে। টাউট ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে বাজারও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে চালের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। এভাবে খাদ্যের মজুদ বাড়ানোও সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আদম টিজিং বন্ধ না হলে ইভটিজিং বন্ধ হবে না

আমরা জানি প্রথম মানব হচ্ছেন হযরত আদম এবং প্রথম মানবী  হাওয়া (আ.)। এ নাম আল কুআনুল কারীম ও হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে। তবে খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেল তথা ইনজিলে হাওয়া (আ.)কে ইভ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইভ বলতে সমগ্র নারী জাতিকেই বুঝানো হচ্ছে। এর বিপরীতে আমরা আদম বলতে সমগ্র পুরুষ জাতিকে বুঝাতে পারি।
টিজ শব্দের অর্থ হল বিরক্ত করা, জ্বালাতন করা, উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি। পরিভাষায় পুরুষ কর্তৃক নারীকে অশালীন কথাবার্তা বলা, প্রেমপত্র, মোবাইল ফোনে শ্রুতিকটূ আলাপ, জনতার ভিড়ে ইচ্ছাকৃত ধাক্কাধাক্কি করা, স্পর্শ করা, চোখের ভাষায় অশুভ ইঙ্গিত করা, তাকে বশে আনার জন্য ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা ইত্যাদি যে কোন ধরনের নারীর কাছে আপত্তিকর কথা-বার্তা, অঙ্গ-ভঙ্গি, চাহনি, ইশারা-ইঙ্গিত ইভটিজিং হিসেবে গণ্য। এটি এক ধরনের যৌন আগ্রাসন।
বর্তমানের সমাজে ইভটিজিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কন্যা সন্তানের মাতা-পিতা অশান্তিতে ভোগছে। স্কুেল পাঠিয়ে ফিরে না  আসা পর্যন্ত তাদেরকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। না জানি কোন খারাপ খবর আসে কি না। তার কারণ পুরুষ শাসিত সমাজে সব দোষ নারীর। ছেলে-মেয়ের মধ্যে কিছু ঘটলে মেয়েরা অচ্ছুত হয়ে যায়। তাদেরকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আর ছেলেরা হয় তুলসি পাতায় ধোয়া। এক অসৎ চরিত্রের ছেলেও মেয়ের চরিত্র খুঁজে, কিন্তু সে তার নিজের চরিত্রের দিকে তাকায় না। কন্যাপক্ষও ছেলের চরিত্রের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান করে না। বরং সে দেখে ছেলে বড় চাকরি করে কি না, তারা বড় লোক কি না ইত্যাদি।
সভ্যতা বিবর্জিত আরব সমাজে নারীরা কতটা অসহায় ও নিরাশ্রয় ছিল তা সহজেই অনুমেয়। পুত্র সন্তান তাদের জন্য ছিল গর্বের বিষয়। পক্ষান্তরে কন্যা সন্তান ছিল তাদের জন্য লজ্জাজনক, লাঞ্ছনাকর ও অমর্যাদাকর। আল কুরআনুল কারীমের সূরাতুন নাহলের ৫৭-৫৮ নম্বর আয়াতে সে অবস্থার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন - “ওয়া ইযা বুশশিরা আহাদুহুম বিল উনসা জল্লা ওয়াজহুহু মুসওয়াদ্দান ওয়াহুয়া কাযীম ইয়াতাওয়ারা মিনাল কাওমি মিন সু-ই-মা বুশশিরা বিহি আ ইউমসিকুহু আলা হূনিন আম ইয়াদুসসুহু ফিত তুরাবি আলা মা সা-আ মা ইয়াহকুমুন” অর্থাৎ তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে এবং মনোকষ্টে তার হৃদয় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। লোকচক্ষু থেকে সে নিজেকে আড়াল করে চলতে থাকে। কারণ এ সুসংবাদ লাভের পর কি করে সে মানুষকে মুখ দেখাবে। সে তখন ভাবতে থাকে, লাঞ্ছনা বহন করে তাকে জীবিত রেখে দিবে, না মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে? তাদের ফয়সালা কতই না নিকৃষ্ট! বর্তমান সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের ন্যায় পুুুরুষের মুখ কালো হয় না বটে কিন্তু বয়প্রাপ্ত হলেই তাদেরকে বড় ভাবনায় পড়তে হয় এই চিন্তায় যে, কখন কি যেন ঘটে যায়। তারা কোন একটি ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচে। ইভটিজিং এ ভয়ে স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা রাস্তাঘাটে নিরাপত্তার অভাববোধ করে। মেয়েদের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরা আত্মহত্যাও করে।
বর্তমানে ইভটিজিং প্রকট আকার ধারণ করার কারণ হল আমাদের যুব সমাজের নৈতিক অধপতন। নারী পুরুষের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ সহজাত প্রবৃত্তি তথা এটি সৃষ্টিগত স্বভাব। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিবেক ও নৈতিকতা দিয়ে। একটি শিশু এই পৃথিবীতে চক্ষু মেলেই প্রথমত তার পরিবার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। যত বড় হয় ততই তার শিক্ষার ক্ষেত্র বড় হতে থাকে। পরিবার ছাড়িয়ে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকমন্ডলী, সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সে প্রভাবিত হয়। এ সমস্ত পরিবেশের সবকিছুই নৈতিক চরিত্র বিধ্বংসী উপাদানে ভরপুর। যে দিকেই সে তাকাবে সে দেখতে পাবে যৌন উম্মাদনা সৃষ্টিকারী উপকরণ, যা আদমকে (পুরুষকে) সদা প্ররোচিত করছে।
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন খুবই কলুষিত। চলচিত্র বলি, আর নাটকই বলি সেগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যাই হোক না কেন, নায়ক-নায়িকার প্রেম থাকতেই হবে। একজন নায়ক কি করে একজন নায়িকার মন ভুলাবে, কি করে তাকে খুশী করবে, কি করে তাকে বশে আনবে, এ জন্য যত ধরনের উন্নত অঙ্গভঙ্গি করতে হয়, প্রেম বিষয়ক যত উন্নত ভাষা ব্যবহার করতে হয়, তা সবই করে থাকে। এসব দেখে একজন যুবক আদম এগুলো রপ্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর চলচিত্র ও নাটক থেকে লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। সেও একজন মেয়ের নিকট ঐ ধরনের অভিনয়, কথা-বার্তা, অঙ্গ-ভঙ্গি শুরু করে । এটিই ইভটিজিং হিসেবে পরিগণিত হয়।
চলচিত্রে যখন নায়ক নায়িকারা একে অপরে জড়িয়ে ধরে প্রেম নিবেদন করে, যখন একে অপরে চুমু খায়, যখন একে অপরের উপর গড়া-গড়ি করে, যখন স্পর্শকাতর কয়েক ইঞ্চি জায়গায় মাত্র কয়েক টুকরা কাপড় পরিহিত অবস্থায় অশ্লীল ড্যান্স আরম্ভ করে, বিশেষত যখন চলচিত্রে ধর্ষণের চিত্র প্রদর্শিত হয় তখন একজন যুবক আদমের মনোজগতে কি ঘটে? তখন একজন যুবক আদমের মনে কিসের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে?  সংস্কৃতির অন্যতম একটি অর্থ হল উৎকর্ষ সাধন। তখন একজন যুবক আদমের কোন  জিনিসের উৎকর্ষ সাধন হয়? নিশ্চয়ই তখন একজন  যুবক আদমের যৌন উম্মাদনার উৎকর্ষ সাধিত হয়, যৌন পাগলামীর উৎকর্ষ সাধিত হয়, কামনা-বাসনার আগুন জ্বলে উঠে। এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে? অনেকে বলেন - সিনেমায় অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। এটা আমিও অস্বীকার করি না। কারণ সিনেমায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক বিষয় উপজীব্য হয়ে ফুটে উঠে। শুধুমাত্র রুচিশীর পরিবেশ বহাল থাকলে সেগুলো অবশ্যই সকলের উপকারে আসত। এমন রুচিশীল পরিবেশ বহাল থাকা উচিত ছিল যেখানে পিতা-পুত্র-কন্যা একই সাথে বসে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু যখন অশ্লীল কার্যকলাপ আরম্ভ হয় তখন পিতা-পুত্র-কন্যার মধ্যে কে বসে থাকবে আর কে লজ্জায় মুখে রুমাল দিয়ে উঠে পালাবে? টিনেজ বয়সের যুবক যুবতীরা কি সামাজিক জ্ঞান অর্জনের জন্য চলচিত্র দেখে, নাকি অশ্লীলতা দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে এবং সেগুলো দেখে নাকি নায়ক নায়িকা সাজতে চায়? সাম্প্রতিক কালের বস- ২ সিনেমায় নুসরাত ফারিয়ার ড্যান্স যে আদমের দেখার সৌভাগ্য হবে তার মনের যে কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। কি চমৎকার! গানের প্রথম শব্দও আল্লাহ এবং বস-২ সিনেমার বাংলাদেশ অংশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধানের নামের শেষাংশও আল্লাহ। ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশে এ ধরনের নাচ প্রদর্শিত হলে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে আইন করা এবং আদমদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। 
 বাল্য বিবাহ নিশ্চয়ই ভাল কাজ নয়। কিন্তু এই সমস্ত চলচিত্র ও নাটক দেখে কি যুবক-যুবতীরা বাল্য বিবাহের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে না বা ইভটিজিং এ জড়িয়ে পড়ছে না? এই সমস্ত চলচিত্র চালু থাকলে বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ নয় বরং বাল্য বিবাহ ফরজ করা দরকার এবং লেখা-পড়ার কোর্স এমনভাবে ডিজাই করা দরকার যাতে করে একজন যুবক-যুবতী ১৫/১৬ বছরে পদার্পন করেই সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতে পারে এবং চাকরি পেয়ে যায়। ফলে সে বিয়ে করে ঘরসংসার করতে পারে। তাহলে ইভটিজিং বন্ধ সম্ভব।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সচিত্র খবর দেখার জন্য টিভির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সে খবর দেখতে গিয়েও স্বস্তি নেই। বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। খবরের ফাকে ফাকে খবর নয়, মনে হয় যেন বিজ্ঞাপনের ফাকে ফাকে খবর। সে বিজ্ঞাপনগুলোও অশ্লীলতায় ভরপুর। একজন সুন্দরী রমণীকে পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এক কোম্পানীর সুরেষ খাঁটি সরিষার তেল যে খুব ভাল, তা নাকি একজন সুন্দরী নারীর উথাল-পাথাল ড্যান্স ছাড়া বুঝা যাবে না। তার তেলের ভাল গুণ বুঝাবার আর কোন ভাষা নেই বা অন্য কোন প্রক্রিয়া নেই। লাক্স সাবানের কি গুণ, তা একজন রমনী শরীর অনাবৃত করে শরীরে না মাখলে এবং মাখার শেষে একজন পুরুষ তার শরীরে শরীর ভিড়িয়ে জড়িয়ে না ধরলে এবং তার শরীর থেকে ঘ্রাণ না নিলে নাকি বুঝা যাবে না। হায়রে নারী জাতি! তারাকে আজ পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে পরিণত করা হয়েছে, তারাকে আজ ভোগের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। এটা কি নারীর অধিকার? এটা কি নারীর মর্যাদা? এ সমস্ত চিত্র দেকে কি একজন যুবক আদম ইভটিজিং এর দিকে ধাবিত হচ্ছে না?
আমরা যদি মনে করি যে, টিভিতে অশ্লীলতা প্রদর্শিত হচ্ছে কাজেই পেপার-পত্রিকা পড়ব। সেখানেও কি আমি নিরাপদ? হায়রে সভ্য সমাজ। পেপারের বিরাট একটি অংশ জুড়ে নায়ক-নায়িকাদের ছবি ও বন্দনা। নায়ক-নায়িকাদের কে কার সাথে প্রেম করছে, কিভাবে প্রেম করছে, কোথায় গিয়ে প্রেম করছে ইত্যাকার বিষয়ে খুব ছড়াছড়ি। অনেক সময় মনে হয় এগুলো কি খবরের পেপার নাকি প্রেমের পেপার তা বুঝা মুশকিল। অনলাই পত্রিকার তো অবস্থা আরো খারাপ। আমি না চাইতেই অনেক কিছু এসে হাজির। একটি প্রবন্ধ পড়ার জন্য বের করলাম। দেখা গেল প্রবন্ধটির চতুর্দিকে সুন্দরী রমনীদের অশ্লীল ছবি শোভা পাচ্ছে। এ সমস্ত পেপার পড়ে আমাদের আদমেরা (যুবক ভাইয়েরা) কি প্রেমের দিকে ধাবিত হবে না? একজন ছেলে একজন মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেতো তা ইভটিজিং।
গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই যাত্রাপালা বিস্তার লাভ করেছে। যাত্রাপালায় যে কাহিনীটি মঞ্চস্থ হবে তাতে অবশ্যই অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকতে পারে। কিন্তু যাত্রার মূল কাহিনী অভিনয়ের আগেই যুবকদেরকে পাগল করা ড্যান্স প্রদর্শিত হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানের ভ্যারাইটি সো এর নামে অশ্লীলতার এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। এগুলো কি আদমকে ইভটিজিং করতে উৎসাহিত করছে না?
উপন্যাস মানেই প্রেমের কাহিনী। সেগুলো পড়ে যুবক-যুবতীরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্রে যারা ছিল তাদের মত আচরণ করার চেষ্টা করে, ইহাই ইভটিজিং এ পরিণত হয়। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, এমনকি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকরাও অনৈতিক আচরণের জড়িয়ে পড়ছে।
দেশের বিভিন্ন পার্ক স্থাপন করা হয়েছে বিনোদনের জন্য। কিন্তু বর্তমানের কাদের বিনোদন হয় সেখানে? সেখানে যুবক-যবতীদের প্রেম নিবেদন হয় ও যৌন বিনোদন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে সময় কাটায়? তাদের নির্লজ্জতা আইয়ামে জাহিলিয়্যাতকে ছাড়িয়ে গেছে। এগুলো কি ইভটিজিংকে উৎসাহিত করে না? ফেসবুক নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম! কিন্তু বর্তমানে দেখি ফেসবুক অশ্লীলতা ও বেহায়পনার এক কৃষ্ণ সাগর। ফেসবুকের অশ্লীলতা দেখে কি একজন অবিবাহিত আদমের মাথা ঠিক থাকতে পারে? এগুলোই কি ইভটিজিং এর মূল কারণ নয়?
বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুুক্তির যুগ। তথ্য প্রযুুক্তি উন্নয়নের ফলে গোটা বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজ তথা বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। এর সুবাদে সমগ্র বিশ্বের ভাল খবর যেমন মুহূর্তের মধ্যে আমাদের কাছে এসে হাজির হচ্ছে তেমনি, খারাপ খবরও এসে হাজির হচ্ছে। যুবসমাজের নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংসকারী হিসেবে সবচেয়ে যেটি বেশি সর্বগ্রাসী তা হল পর্নোগ্রাফি। অমুসলিমরা বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব পর্নোগ্রাফিকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাভিচারের চিত্রসমূহ সহলভ্য করে দেয়া হয়েছে। মোবাইলে ইচ্ছা করলেই একজন যুবক সেগুলো দেখতে পায়। ব্যাভিচারের চিত্র দেখে একজন অবিবাহিত আদম কি করে নিজেকে সংবরণ করবে? সে তো ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য। এটি হচ্ছে ব্যাভিচারের প্রথম ধাপ। সে কারণেই আজকাল চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণ, চলন্ত বাসে ধর্ষণ ইত্যাকার বহুঘটনা বিস্তার লাভ করেছে। অতীব দুঃখের বিষয় হল একটি মুসলিম প্রধান দেশে কেন পর্নোগ্রাফি অবাধে দেখার সুযোগ থাকবে? শুধু কি তাই কেই যদি ভাল থাকতে চায় তার সে সুযোগও নেই। অনলাইনে একটি ভাল জিনিস খুজতে গিয়ে এমনিতেই খারাপ জিনিস বেরিয়ে চলে আসে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষা অন্তর্র্ভুক্ত করেছেন। সে জন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। দেশে ইভটিজিং বিরোধী আইন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ইভটিজারদের শাস্তি ব্যবস্থা করা হচ্ছে এটিও খুব ভাল খবর। কিন্তু সাথে সাথে পর্নোগ্রাফিকে চালু রাখা হয়েছে, এটি অতীব দুঃখের বিষয়। উক্ত উদ্যোগগুলো নেয়ার সাথে সাথে পর্নোগ্রাফি বন্ধ করা উচিত ছিল। পর্নোগ্রাফি চালু রেখে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অশ্লীলতা বহাল রেখে ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি এমন যে, একজন ব্যক্তি একটি ক্ষুধার্ত ছাগলের সামনে এক হাতে তাজা কষকষে শামার ঘাস ধরে আছে, আর অপর হতে লাঠি নিয়ে উঁচু করে ধরে আছে যে, সে খেলেই তাকে প্রহার করবে। আমাদের দেশের অবস্থা এইরূপ।
আমরা বিনোদনের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলা দেখে থাকি। বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হল ক্রিকেট। এই খেলা দেখতে গিয়েও আমরা ফাকে ফাকে অশ্লীল নাচ দেখতে পাই। বিশেষত আন্তর্জাতিক মানের কোন খেলা উদ্বোধনের শুরুতে যে ধরনের অশ্লীলতা প্রদর্শিত হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এগুলো দেখে একজন যুবক আদমের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে সে ইভটিজিং এর দিকে ঝুকে যায়।
সুতরাং ইভটিজিং বন্ধ করতে হলে প্রথমে আদম টিজিং এর সমস্ত পথ রুদ্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফিকে পুরাপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে এবং পরিমার্জিত, পরিশীলিত ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ আইন করে বা আদমদেরকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব হবে না। পরিশেষে বলতে চাই আদম টিজিং বন্ধ না হলে ইভটিজিং বন্ধ হবে না।

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংবাদ মাধ্যমের কালোদিবস

আজ ঐতিহাসিক ১৬ জুন। বাংলাদেশে দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে সংবাদপত্রের তথা গণমাধ্যমের কালোদিবস হিসেবে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় দেশের চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়েছিল। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস- এই চারটি দৈনিককে টিকিয়ে রেখেছিল সরকার। কিন্তু সরকারের মালিকানায় নেয়ার ফলে এসব দৈনিকে ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির গুণকীর্তন ছাড়া অন্য কোনো খবর পাওয়া যেতো না। সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার এই পদক্ষেপের ফলে বেকার হয়ে পড়েছিলেন শত শত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী। জাতি বঞ্চিত হয়েছিল সঠিক সংবাদ জানার মৌলিক অধিকার থেকে। 
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক ও স্বৈরশাসকদের কায়দায় স্বাধীন বাংলাদেশেও সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে একদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা দমন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, অন্যদিকে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশও। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ নানা নামের বাহিনীকে বিরোধী দলকে দমনের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিল সরকার। পল্টন ময়দানের জনসভায় বিরোধী দলের ওপর ‘লাল ঘোড়া দাবড়ায়া’ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। দলের কর্মীদের ‘সুন্দরী কাঠের লাঠি’ হাতে নেয়ার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে, প্রথম আওয়ামী লীগ এবং বাকশাল সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। 
রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সংবাদপত্রের ওপরও সরকার প্রচ- দমনের অভিযান চালিয়েছিল। জেনারেল আইয়ুব খান প্রবর্তিত ১৯৬০ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স নামের কালাকানুনটিকেই ১৯৭৩ সালে সে ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা একদিকে সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছেন, অন্যদিকে নিষিদ্ধ করেছেন একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা। ১৯৭২ সালেই নিষিদ্ধ হয়েছিল মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’, সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’, ‘লাল পতাকা’, ‘নয়াযুগ’, মুখপত্র’ ও ‘স্পোকসম্যান’ এবং চট্টগ্রামের দৈনিক ‘দেশবাংলা’। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের মূল দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। ‘হক-কথা’ সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী এবং ‘গণকণ্ঠ’ সম্পাদক কবি আল মাহমুদসহ কয়েকজন সম্পাদককেও গ্রেফতার করেছিল সরকার। এ পর্যন্ত এসেও যথেষ্ট মনে করেননি ক্ষমতাসীনরা, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সব সংবাদপত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন তারা। 
সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে নেয়া এই পদক্ষেপ ছিল প্রথম সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী সামগ্রিক নীতি ও কর্মকাণ্ডের অনিবার্য অংশ। সীমাহীন লুণ্ঠন, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, আওয়ামীকরণ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিণতিতে দেশ ততদিনে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। ১৯৭৪ সালের সে দুর্ভিক্ষে কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অমন এক পরিস্থিতিতে দরকার যখন ছিল সব দলকে সঙ্গে নিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা ও উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো তখন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ আড়ালে প্রধান নেতার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সরকার বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদকে দিয়ে প্রথমে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়, সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় দেশের একমাত্র দল বাকশাল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে চেয়ারম্যান করে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। এরই ধারাবাহিকতায় চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয় ১৬ জুন। 
বলা হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও প্রথম সরকারের পথেই এগিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমও। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এখনো দৈনিকটিকে প্রকাশ করতে দেয়া হচ্ছে না। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কয়েকবার শুধু গ্রেফতার করা হয়নি, রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনও চালানো হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দু’বার নির্বাচিত সভাপতি শওকত মাহমুদসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকেও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নানা কৌশলের আড়ালে চাপানো হচ্ছে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের আড়াল নিয়ে অনলাইন পত্রিকাগুলোর ওপরও খবরদারি চালানো হচ্ছে।
অর্থাৎ বর্তমান সরকারও বাকশাল সরকারের মতোই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই কারণে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাকশালের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, 

শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভাত খাওয়া কমছে!

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ বলে বছর কয়েক আগে পর্যন্তও যে প্রবাদ বাক্যটি বাংলাদেশে চালু ছিল সেটা এখন ইতিহাসের বিষয় হতে চলেছে। কারণ, মাছ বহু বছর আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। খুব কম সংখ্যক মানুষই আজকাল মাছ খাওয়ার সুযোগ পায়। রুই-কাৎলা ধরনের বড় বড় মাছের তো প্রশ্নই ওঠে না, সাধারণ মানুষ এমনকি ছোট কোনো মাছও সহজে কিনে খেতে পারে না। কই ও বোয়ালের মতো মাছগুলোও মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এতকিছুর পরও মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভাত- তা সে ভাত যতো মোটা ও কম দামের চালেরই হোক না কেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের নয় বছরে সে চালও সাধারণ মানুষের নাগালের তথা ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সে কারণে বাধ্য হয়ে মানুষ চাল কেনা এবং ভাতের পরিমাণ কমাতে শুরু করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকের খবরের শিরোনামেই জানানো হয়েছে, ‘ভাত কম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ’। বেশ কয়েকজন চাকরিজীবী নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, কারো বেতন যদি বছরে দেড় হাজার টাকা বেড়ে থাকে তাহলে অন্যদিকে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল এবং বাড়ি ভাড়া বেড়ে গেছে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এসবের সঙ্গে রয়েছে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য। সবকিছুর দাম শুধু বাড়ছেই। 
এ প্রসঙ্গেই এসেছে চালের দামের কথা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা গেছে, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কোনো কোনো চালের দাম বেড়েছে এমনকি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশÑ টিসিবিও স্বীকার করেছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশের বেশি। গত বছর যে চাল ৩০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যেতো সেটাই এখন ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে মোটা চাল মানভেদে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫০ থেকে ৫৪ টাকা এবং সরু চাল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল দীর্ঘদিন পর্যন্ত ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সে মিনিকেটের দামই বাড়তে বাড়তে এখন ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায় উঠে গেছে। আরো উন্নত মানের নাজিরশাইলের দাম এখন ৬০ টাকার বেশি। 
এমন অবস্থায় আয় যেহেতু বাড়েনি এবং বাড়ার সম্ভাবনাও নেই, সে কারণে বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষ নিজেরাই রেশনিং তথা খাদ্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। তারা ভাতের পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আগে যারা দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতো এখন তারাই এক বেলা আধাপেটা খেয়ে থাকছে। কারণ, এ ছাড়া উপায় নেই তাদের। ওদিকে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল ও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না হওয়ায় এবং মাঝখানে হাওর এলাকায় বিষাক্ত ভারতীয় ইউরেনিয়ামযুক্ত পানিতে ফসল ও জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চালের মজুদ কমে যাওয়ার বিষয়টি। শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সরকার কাবিখা ধরনের কর্মসূচির পাশাপাশি ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করার ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলেও চালের মজুদ তলানিতে এসে ঠেকেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়েই চালের সরবরাহ বাড়ার যেমন সম্ভাবনা নেই তেমনি নেই দাম কমার সম্ভাবনাও। একই কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে ভাতের পরিমাণ বাড়ানোও সম্ভব হবে না। মানুষ এমনকি এক বেলাও পেট ভরে ভাত খেতে পারবে কি না তা নিয়েও এরই মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। 
আমরা মনে করি, এমন অবস্থা সকল বিচারেই অত্যন্ত ভীতিকর এবং এ ব্যাপারে সরকারের জন্য দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। কারণ, চালসহ কোনো পণ্যের দামই রাতারাতি বাড়ায়নি ব্যবসায়ী-মহাজনরা। দাম বেড়ে আসছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু কোনো পর্যায়েই লোক দেখানো ধমক দেয়ার এবং লম্বা আশ্বাস শোনানোর বাইরে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি বলেই একদিকে দাম শুধু লাফিয়ে বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। তারা এমনকি ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিতেও বাধ্য হয়েছে। বলা দরকার, অবস্থা এমন হতে পারতো না, সরকার যদি সময় থাকতে এ বিষয়ে তৎপর হতো। অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য হলো, চাঁদা ও কমিশনসহ সহজবোধ্য কিছু কারণে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সাধারণত নেয়ও না। একই কারণে ব্যবসায়ী-মহাজনরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যথেচ্ছভাবে। এবারও করতে শুরু করেছে রমযানের আগে থেকেই। একই কারণে দামও চলে যাচ্ছে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। সব কিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের প্রশ্রয়। অতীতেও একই কারণে মানুষকে কষ্ট ও ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়েছে। সাধারণ মানুষের তো বটেই, নাভিশ্বাস উঠেছে এমনকি মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্তের মানুষদেরও। 
আমরা মনে করি, অসৎ ও মুনাফাখোর টাউট ব্যবসায়ী-মহাজনদের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত এখনই জরুরি ভিত্তিতে এবং কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা ও চালসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া। আমদানি করে হলেও বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো দরকার। না হলে এক বেলা ভাত খাওয়ার মতো অবস্থাও থাকবে না মানুষের।

বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচন প্রশ্নে শুভাকাঙ্খী দেশগুলোর আহ্বান

সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও এরই মধ্যে জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচনকেন্দ্রিক জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তো বটেই, এমনকি যে দলটিকে ঘিরে এখনো নানা সংশয় রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান সেই দল বিএনপির নেতা-কর্মীরাও নির্বাচনী কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতাও লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিশেল বার্নিকাট প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন। বৈঠকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বৈঠক ও আহবান নিয়ে রাজনৈতিবক অঙ্গনে আলোচনা জমে ওঠার আগেই গত মঙ্গলবার (৬ জুন) সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করতে গিয়েছিলেন ব্রিটেনের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। তিনি একা যাননি, তার সঙ্গে ছিলেন আরো তিনজন উচ্চ পদস্থ কূটনীতিক। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনও সব দলের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও তার সঙ্গে যাওয়া প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার সারাসরি জবাব না দিলেও বৈঠকে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে জানা গেছে নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সিইসির প্রতি আহবান জানিয়েছেন। হাইকমিশনার বলেছেন, ব্রিটেন চায় আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক এবং দেশের সব রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক আরো বলেছেন, তারা বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করতে এবং যারা এ লক্ষ্যে কাজ করছেন তাদের প্রতি সমর্থন জানাতে এসেছিলেন। কমিশনের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তিনি একই সঙ্গে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে অনুষ্ঠিত কর্মকান্ডের নেতিবাচক বিভিন্ন দিকেরও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ব্রিটেন আবারও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনা সম্পর্কে না জানালেও ব্রিটিশ হাইকমিশনার অল্প কথায় তার মূল কথাগুলো ঠিকই জানিয়ে গেছেন। এসবের প্রধান কথাটুকু হলো, দেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং সে নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে।  কথাটার অর্থ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত একদলীয় এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের উদাহরণ উল্লেখ করার মধ্য দিয়েও হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্রিটেন আর অমন নির্বাচন দেখতে চায় না। এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, ব্রিটেন এবারই প্রথম এমন মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালেও বিভিন্ন উপলক্ষে ব্রিটেন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থার মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত হিসেবে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর একাধিকবার ঢাকা সফরকালেও ব্রিটেন মহাসচিবের উদ্যোগের প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিল। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গেও ব্রিটেন তৎপরতা চালিয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, জাতিসংঘ মহাসচিব তথা তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথেরিন অ্যাশটন যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, ব্রিটেন তার সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতিসংঘ মহাসচিবের পাঠানো দূতের প্রচেষ্টাসহ নানাভাবে বহু উদ্যোগ নেয়ার পরও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মতো পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি তারা। এসব কারণেই নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ইইউ। 
বিবৃতিতে সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল, যাতে ভোটাররা তাদের পছন্দ বেছে নিতে ও পছন্দের প্রার্থী ও দলকে ভোট দিতে পারে। উল্লেখ্য, এই বিবৃতিরও অনেক আগে থেকে ইইউ নির্বাচনের ব্যাপারে একই তাগিদ দিয়ে এসেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্রিটেন এবং ইইউ-এর অন্য প্রতিনিধিরা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। তারা এ কথাও জানিয়েছিলেন, সব দল অংশ না নিলে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে পারে। শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ইইউ। এর সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল ব্রিটেন। উল্লেখ্য, ইইউ-এর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ৫ জানুয়ারির সে নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। 
এভাবেই আন্তর্জাতিক সকল মহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা খুইয়েছিল। সেই থেকে প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার এখনো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি। এখনো বরং কথা উঠলেই ওই নির্বাচনের উদাহরণ টেনে আনা হয়। যেমনটি এনেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মাত্র সেদিনের এই অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই আমরা মনে করি, বর্তমান পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দরকার সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করা। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই। আমরা আশা করতে চাই, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সরকার সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিকে নিশ্চিত করবে। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে অবিলম্বে সকল প্রকার দমন-নির্যাতন এবং মামলা ও গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে দেশে যেমন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, অন্যদিকে তেমনি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর আহবান ও পরামর্শের প্রতিও যথাযথ সম্মান দেখানো যাবে। সরকারের উচিত, গণতন্ত্রসম্মত এ পথটিকেই অগ্রাধিকার দেয়া।

Ads