বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ফ্লাইওভারই সমাধান নয়


গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে মগবাজার চৌরাস্তা হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের একটি অংশের উদ্বোধন করেছেন। তার আগে ফলক উন্মোচন করে দেয়ায় অংশ নিয়েছেন এবং পরে বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত ফ্লাইওভারের এ অংশটির দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ১১ কিলোমিটার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার কারণ এবং পথচারীসহ সাধারণ মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, শুধু চালককে দোষ দিলে চলবে না। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিরও দোষ আছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। সড়ক ব্যবহারের সময় পথচারীরা নিয়মকানুন মেনে চলছে কি না সেটাও দেখা দরকার। সেটা না করে কেবলই চালকদের দোষ দেয়ার এবং গাড়ি ভাঙচুর করার ও গাড়িতে আগুন দেয়াসহ চালককে মারধর করার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির। এ উদ্দেশ্যে স্কুল পর্যায় থেকেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। ট্রাফিক পুলিশের প্রতিও সচেতন হওয়ার এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মূল কথাগুলোকে যথার্থ ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, দুর্ঘটনার জন্য সব সময় আসলেও চালকরাই কেবল দায়ী থাকে না, পথচারীদের ভুলের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকেই কোনো দিকে না দেখেই রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করে, অন্যদিকে যান্ত্রিক যানবাহন বলে যখন তখন গাড়ি থামানো সম্ভব হয় না বলে পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হয়। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পারাপারের পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শ সঠিক হলেও আমরা কিন্তু মনে করি, রাজধানীতে যথেষ্টসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস এখনো তৈরি করা হয়নি। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শপিং মল ও মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকা ও সড়কের বেশিরভাগই রয়ে গেছে আগের অবস্থায়। বাস্তবে ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসের সংখ্যা বরং হাতে গুণে গুণেই বলা সম্ভব। সুতরাং কেবলই পথচারীদের দোষারোপ করার পরিবর্তে একদিকে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকাগুলোতে যথেষ্টসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা দরকার, অন্যদিকে চালকদের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশকেও কঠোরতার সঙ্গে সতর্ক করতে হবে। কারণ, পথচারী ও সাধারণ মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য রেখেছেন, বেপরোয়া চালকরা তাকে দুর্ঘটনার জন্য ‘ওপেন লাইসেন্স’ হিসেবে ধরে নিতে ও ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যাই কেবল বাড়তে থাকবে না, সাধারণ মানুষের বিপদও বহুগুণে বেড়ে যাবে। ওদিকে ট্রাফিক পুলিশও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সুযোগ নিতে ছাড়বে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমনিতেই রাজধানীর নিত্যদিনের যানজটের পেছনে প্রধান একটি কারণ হিসেবে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি। তারা এমনকি নিজেদের আইন নিজেরাই ভঙ্গ করে থাকে। লাল বাতি জ্বললেও তারা গাড়ি যেতে দেয় আবার সবুজ বাতি জ্বলে থাকা অবস্থায় বন্ধ করে গাড়ির চলাচল। কথাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন, তিনি বলেছেনও। এজন্যই ব্যবস্থা নেয়া দরকার সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। 
প্রসঙ্গক্রমে যানজট প্রসঙ্গেও না বলে পারা যায় না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করার অনেক আগে থেকেই বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী, মগবাজার, তেজগাঁও সাতরাস্তা, মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল প্রভৃতি এলাকায় মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। যানজট ছিল বুধবার সারাদিনই। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ত্রুটিপূর্ণ এই ফ্লাইওভার রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এমনকি বাংলামোটরের দিক থেকে মৌচাক পর্যন্ত এবং মৌচাক থেকে মালিবাগ চৌধুরী পাড়া পর্যন্ত ফ্লাইওভারের বাকি দুটি অংশ চালু হওয়ার পরও যানজট আরো প্রকটই হতে থাকবে। কারণ, ফ্লাইওভার থেকে যে স্থান তিনটিতে গাড়িগুলো নামবে তার প্রতিটি স্থানেই নিচ দিয়ে আসা শত শত গাড়ির ভিড় জমবে। ফলে ফ্লাইওভারটুকু দিয়েই শুধু কিছুটা সহজে যাতায়াত করা যাবে, নিচের সড়ক দিয়ে নয়। বহুদিন ধরে এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মহাখালি ফ্লাইওভারে। আজকাল সকাল-সন্ধ্যায় তো বটেই, গভীর রাত পর্যন্তও ফ্লাইওভারটিতে গাড়ি আটকে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ অভিজ্ঞতার আলোকেই বলা হচ্ছে, কেবলই ফ্লাইওভার তৈরি করে রাজধানীকে যাজটমুক্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। ট্রাফিক পুলিশ যাতে স্বয়ংক্রিয় সিগনাল মেনে সে অনুযায়ী গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে তা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিসহ ভিভিআইপিদের যাতায়াতের জন্য প্রতিদিন যে যানজটের সৃষ্টি হয় এবং যে যানজট সমগ্র রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে তার ব্যাপারেও বিশেষ নজর দেয়া দরকার। আমরা আশা করি, ফ্লাইওভার নির্মাণের কর্মকান্ডকে সাফল্য ও কৃতিত্ব জাহির করার বিষয়বস্তু বানানোর পরিবর্তে সরকার যানজট নিরসনের ব্যাপারে আন্তরিকতার সঙ্গে সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হবে।

বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কেলেঙ্কারির ওই অর্থে পদ্মাসেতু করা যেত


দুর্নীতি ও আত্মসাতের ঘটনা কমছে না বরং বাড়ছে। ‘সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা’- শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে প্রথম আলো পত্রিকায়। ২৭ মার্চ তারিখে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, গত সাত বছরে ঘটেছে ছয়টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। এসব কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ অর্থ দিয়েই অনায়াসে একটি পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত। এসব বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি লাখ লাখ ক্ষুদ বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের একটি অংশ ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছে, নিজেরাও লাভবান হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাড় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, একটি কেলেঙ্কারিরও বিচার হয়নি। সাজা পাননি অভিযুক্তদের কেউ। প্রাথমিক তদন্ত হয়েছে। বছরের পর বছর মামলা চলছে। অভিযুক্তদের কেউ জেলে আছেন, কেউ চিকিৎসার নামে হাসপাতালে আরাম-আয়েশে আছেন। অনেকে জামিন পেয়েছেন।
আর্থিক কেলেঙ্কারির এমন চিত্র জনমনে হতাশার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন মূলত সুশাসনের অভাব থেকেই একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে। আর ব্যবস্থা না নেয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, হলমার্ক থেকে শুরু করে বেসিক ব্যাংক বা বিস্মিল্লাহ্ গ্রুপ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত লোকজন জড়িত ছিলেন বলেই কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেশের সর্বশেষ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা রিজার্ভ চুরি। ৫ ফেব্রুয়ারি চুরি করা হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, টাকার অংকে যা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। স্বয়ংক্রিয় লেনদেন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ বা হ্যাক করে এই রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশ্বজুড়ে এক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে এর দায়দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। সরিয়ে দেয়া হয়েছে দুই ডেপুটি গবর্নরকেও।
দেশের জনগণ আর্থিক কেলেঙ্কারির এইসব ঘটনা মেনে নিতে পারছে না। তারা এইসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চায়। ভবিষ্যতে যাতে এসব ঘটনা আর ঘটতে না পারে তারও নিশ্চয়তা চায় সরকার ও প্রশাসনের কাছে। আর্থিক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতি কমাতে তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ। ১. যারা অপরাধী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে বরখাস্ত বা বদলি নয়, অপরাধের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। ২. সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সঠিক জায়গায় বসাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে যেসব সদস্য নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে। ৩. ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে, এ প্রতিষ্ঠানটিকে মূল ব্যাংকিং এর দিকে নজর দিতে হবে। তিনি আরো মনে করেন, ব্যাংক খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ দেয়া উচিত। আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ন্ত্রণে সাবেক গবর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর আগেও কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের স্বার্থে পরামশের্র যথাযথ বাস্তবায়ন। কিন্তু দলীয় স্বার্থ এবং শৃঙ্খলা ও সুশাসনের অভাবে উত্তম পরামশের্র বাস্তবায়নও লক্ষ্য করা যায় না। দুষ্টের দমনে শাস্তি প্রদানের আগ্রহও তেমন দেখা যায় না। কিন্তু অন্যান্য দেশে শাস্তি প্রদানের নজির রয়েছে বলেই সেখানে কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাকের সাবেক চেয়ারম্যান বার্নার্ড মেডফের শেয়ারবাজারে আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হয়। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ সালের জুন মাসে বিচারে ৭১ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীকে ১৫০ বছর জেল দেয়ার পাশাপাশি ১৭০ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়। দল ও স্বজনপ্রীতি পরিহার করে যদি শাস্তির এমন নজির স্থাপন করা হয়, তাহলে আমাদের দেশেও আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা হ্রাস পেতে পারে, হতে পারে কাক্সিক্ষত উন্নয়নও তবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে সঙ্গত ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে ক্ষমতার রাজনীতি ত্যাগ করে আমাদের রাজনীতিবিদদের আবার ফিরে আসতে হবে আদর্শের রাজনীতিতে। কারণ একমাত্র আদর্শের রাজনীতিতেই নিহিত রয়েছে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ। এমন রাজনীতিতে ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় জ্ঞানচর্চা ও নিষ্ঠার। এইসব গুণাবলী আমাদের রাজনৈতিক বাতাবরণে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। এমনটি হলে আমাদের ছাত্ররাজনীতির চেহারাও পাল্টে যাবে।
বর্তমান সময়ে বহুলশ্রুত একটি বিষয় হলো উন্নয়ন।
উন্নয়ন প্রসঙ্গে অনেক কথাবার্তা শোনা যায়। ‘উন্নয়ন’ বিষয়টি শুনতেও ভাল লাগে, ভাবতেও আনন্দ হয়। তবে বাস্তব কারণেই এমন প্রশ্নও জাগে যে, দৃশ্যমান সব উন্নয়ন কি আসলেই উন্নয়ন? দেশের উন্নয়ন বলতে তো আমরা দেশের জনগণের উন্নয়নকেই বুঝি। কিন্তু সব উন্নয়নেই কি জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়? আর বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছি যে, যে উন্নয়নে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয় না, সেই উন্নয়নে দেশও সমৃদ্ধ হয় না। বরং এ ধরনের উন্নয়নের রকমফেরে আখেরে দেশ ও জনগণের স্বার্থই বিপন্ন হয়। আমরা জানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যুতের অভাব রয়েছে। তাই বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বলে সুন্দরবনের ক্ষতি করে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করতে হবে- এমন উদ্যোগকে মেনে নেয়া যায় না। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তো প্রবোধ দিয়ে আসছেন যে, এমনভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করা হবে, যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা তাদের এমন প্রবোধ মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু এখন তো সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও স্বীকার করে নিলেন যে, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু এ স্থান পরিবর্তন করা যাবে না। এমন কথায় শুধু অবাক নয়, বিস্মিত হতে হয়। উল্লেখ্য যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতীয় হেভি ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর সাথে চুক্তির ব্যাপারে জোর আয়োজন চলছে।
আমরা জানি, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র-প্রকল্পের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরেই দেশের পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রেখে আসছেন। এখন তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের এই অতুলনীয় সম্পদ ও আশ্রয় ধ্বংস হবে জেনেও কেন সরকার এই বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে?
কোথায় তাদের হাত-পা বাঁধা? কেউ কেউ তো বলছেন- অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, যাদের হাত-পা বাঁধা নেই তাঁদের এই সর্বনাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাই দায়িত্ব। সেজন্যই সুন্দরবন বিনাশী এই প্রকল্প বাতিলসহ সাত দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ সংঘটিত করেছিল তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। দাবি পূরণ না হওয়ায় এই কমিটি থেকে আবারও ১০ থেকে ১৫ মার্চ জনযাত্রা তথা বৃহত্তর লংমাচের্র কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও সংগঠন বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য, যুক্তিসহ সরকারের কাছে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক এসব প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। প্রবল জনমতও তৈরি হয়েছে এসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, মহাপ্রাণ সুন্দরবনের আঙ্গিনায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রকল্পটি অস্বচ্ছ ও অসম। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে যে সুন্দরবন বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করে, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে, সেই সুন্দরবনকে এই প্রকল্প ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। সুন্দরবন আছে বলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের লাখ-লাখ মানুষের জীবন বাঁচে। সুন্দরবন বিনষ্ট হওয়া মানে বহু মানুষের জীবিকা হারানো, উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষকে মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বন, এক অতুলনীয় ইকোসিস্টেম, পরিবেশ শোধনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা অনন্য সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা আমাদের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান চাই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সুন্দরবনকে বিপন্ন করে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করতে হবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে আমাদের যথাযথ রোডম্যাপে অগ্রসর হতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছে- সর্বজনের সম্পদে শতভাগ জাতীয় মালিকানা ও শতভাগ সম্পদ দেশের কাজে ব্যবহার, দুর্নীতি করার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ আইন’ প্রণয়ন, পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসকেন্দ্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান; রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়ন, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন, দীর্ঘমেয়াদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর গুরুত্ব প্রদান। এই রোডম্যাপে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই, সুলভ, নিরাপদ ও জনবান্ধব উন্নয়ন ধারা তৈরি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। সরকার এসব প্রস্তাব ভেবে দেখতে পারেন।
সবশেষে আমরা বলতে চাই, বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারের যথাযথ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাবো। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট সমাধান করতে গিয়ে কোনোভাবেই যেন সুন্দরবনের ক্ষতি করা না হয়। এমনটি হলে শুধু উন্নয়ন নয়, আরও অনেক কিছুর ক্ষতি হবে।

মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলাদেশ ব্যাংক তাসকিন আর তনু হত্যা


সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন তরুণ সমাজের প্রাণ। দিনরাত তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহার করছে। স্ট্যাটাস, কমেন্ট, লাইক, মন্তব্যে ভরিয়ে তুলছে। এ অনেকটা নেশার মতো। তাছাড়া নানা ধরনের ইন্টারেস্টিং বিষয়ও তারা আপলোড করছে। তুলে ধরছে নানা ধরনের সামাজিক সঙ্গতি অসঙ্গতির কথাও। এ মাধ্যম অপ্রতিরোধ্য। ভিন্নমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণু এ সরকার মাঝে মাঝে নানা ধরনের এলান জারি করে তরুণ সমাজের কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে খুব বেশি ফলোদয় হয়নি। তরুণরা পথ বের করেই নেয়। তাদের মত নানা কৌশলে প্রকাশ করে। এই নিয়ম না মানাই তারুণ্যের ধর্ম। কোটি কোটি তরুণ প্রাণের আত্মপ্রকাশের এই আকাক্সক্ষাকে বালির বাঁধ দিয়ে রোধ করা যায় না। হিন্দি সিরিয়ালের মতো এতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন লক্ষ লক্ষ গৃহবধূও। যে যা এনজয় করেন, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সব কিছুই পাওয়া যায়।
সে ক্ষেত্রে আমি প্রবীণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব কিছু আমি ঠিক মতো বুঝিও না, চালাতেও পারি না। মাঝে মাঝে ফেসবুকে বসে দেখেছি, কোথা দিয়ে দু’ তিন ঘণ্টা সময় কেটে যায়, বোঝা যায় না। এতো সময়ও আমার নেই। ফলে ভয়ে বসি না এসব যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু তারুণ্যই আমাদের শক্তি। তার তেজেই, তার অমিত বিক্রমেই নির্মিত হয় দেশের ভবিষ্যৎ। কোনো বিষয়কে আমি যেভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তরুণরা তা করে না। সেটাও খুব স্বাভাবিক। তা যদি করতো, তা হলে এদেশে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হতো না। তারুণ্য নদীর গতিধারার মতো আপন বেগে চলেছে বলে এদেশে এক একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন হয়েছে। এক একটি নায্য দাবি আদায় হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদি সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তারুণ্য সারা রাত ধরে সংগঠিত হয়ে সকালে ১৪৪ ধারা ভেঙে বসলো। গুলী হলো। তারুণ্যই প্রাণ দিল। প্রতিষ্ঠিত হলো রাষ্ট্রভাষার অধিকার।
একইভাবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধও হয়েছে। ঐ বছর ২৪ মার্চও যখন রাজনৈতিক সমঝোতার আশা করছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ততোক্ষণে ছাত্রসমাজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করে তা উত্তোলন করে ফেলেছে। লুঙ্গি কাছা দিয়ে কাঠের বন্দুক কাঁধে লেফট-রাইট করতে শুরু করেছে। কারণ সে সময়কার তারুণ্য উপলব্ধি করেছিল যে, যেহেতু জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল পিছিয়ে দেয়া হলো, যখন বোঝা গেল শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক-বেসামরিক আমলারা আর জুলফিকার আলী ভুট্টো গং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে না, তখন তারুণ্য উপলব্ধি করেছিল, স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। আর সে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে যুদ্ধ করেই। অতএব তৈরি হয়ে গিয়েছিল তারুণ্য, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেক আগেই। আর তাই দেশে দেশে কালে কালে কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন। বলেছেন, ওরে তরুণ, ওরে আমার কাঁচা, আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। আসলে তারুণ্যই বাঁচায়।
আর তাই সকল দেশের সকল স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতায় আসীন হয়েই প্রথমেই তারুণ্যের শক্তিকে ধ্বংস করতে চায়। প্রথমে চালায় দমন-পীড়ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই দমন-পীড়ন কোনো কাজ দেয় না। দমন-পীড়নে আরও উত্তাল হয়ে ওঠে তারুণ্যের শক্তি। এই শক্তি কখনও কখনও স্বৈরাচারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এমন কি পতন ঘটায় স্বৈরাচারী শক্তির। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। সে অভ্যুত্থানে পতন ঘটেছিল আইউব খানের স্বৈরশাসনের। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন আইউব খান। বাংলাদেশে গণতন্ত্রঘাতক স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারেরও পতন ঘটিয়েছিল তরুণ সমাজই। এরশাদের পতনের ব্যাপারে চূড়ান্ত আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন নানা দোটানায়, তখন ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের দুর্বার আন্দোলনের মুখে শেষমেষ রাজনৈতিক নেতৃত্বও সে আন্দোলনে শরিক হয়। আর তাতে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। সে কারণে স্বৈরশাসকেরা অনেক সময় তারুণ্যকে বিপথে-কুপথে ঠেলে দিতে তাদের সামনে লোভ-লালসা চরিতার্থ করার পথ অবারিত করে দেয়। ধ্বংস করে দিতে চায় তারুণ্যের শক্তি। এরশাদও সে চেষ্টা করেছিলেন। শেখ হাসিনাও করছেন।
গত কয়েক দিনে এ সময়ের তরুণদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা হলো। আমার কিংবা আমার বয়েসিদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে যে তাদের চিন্তার খুব একটা সাজুয্য পাওয়া যাবে না, সেটা ধরেই নিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমিটির নির্লজ্জ ষড়যন্ত্র, তাসকিনকে খেলার অযোগ্য ঘোষণা, বাংলাদেশ দলকে জরিমানা এবং সর্বশেষ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ আছে। এখন তার বয়স্ক পিতা-মাতা, ভাই-বোনকে নিয়ে যা করা হচ্ছে, সেটিও আমার দৃষ্টিতে চরম নির্যাতন। কিন্তু তরুণরা সবগুলো ঘটনাকে একই সূত্রে গেঁথে নিয়েছে।
তারা বলতে চাইছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির সঙ্গে অবশ্যই সরকারের কোনো না কোনো প্রভাবশালী মহল জড়িত আছে। সেটা তো অর্থমন্ত্রীর কথার মধ্য দিয়েও প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ৮০০ কোটি টাকা চুরির সঙ্গে ব্যাংকের কর্মকর্তারা শতভাগ জড়িত। তরুণদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর বিষয়টা লুকিয়ে রেখে ঐ টাকা চুরিতে সহায়তা করেছেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি টাকা চুরির পর তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে টাকাটা ফিলিপিন্সের মার্কেটে ছিল। তারপর সেটা পাচার হয়ে গেছে হংকং-এ। অর্থাৎ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে যে, আতিউর ৭ ফেব্রুয়ারিই ঘটনাটা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও কি তবে আতিউরকে এই টাকা চুরির ব্যাপারটা চেপে যেতে বলেছিলেন? বললে, কেনো বলেছিলেন? অথচ সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে এই টাকা উদ্ধার সম্ভব হতো। নিউ ইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকের এই টাকা লেনদেনে সুইফট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। বলা হলো সুইফটের প্রযুক্তি হ্যাকড হয়েছে। সুইফটের বিশেষজ্ঞরা ঢাকা এসে সরকারকে নিশ্চিত করে গেছেন যে, সুইফটের প্রযুক্তি হ্যাকড হয়নি। হবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। বরং এই টাকা চুরি হয়েছে। আর এর সঙ্গে যুক্ত আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কর্মকর্তারা, যারা ফেডারেল রিজার্ভ থেকে টাকা লেনদেনের অন্ধিসন্ধি সব জানেন।
সুইফটের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে বলা হয়েছিল, ঐ কক্ষ থাকবে সংরক্ষিত। সেখানে কোনো আইটির লোক ঢুকবে না। যে কম্পিউটারের মাধ্যমে লেনদেন হবে, সে কম্পিউটার অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ ড. আতিউর তাদের সাড়ে তিন হাজার কম্পিউটারের সঙ্গে সুইফটের সংযোগ দেন। সুইফট দেখিয়ে দিয়েছে, ঐ কম্পিউটারে গান শোনা হয়েছে, গেম খেলা হয়েছে। সেখানে আইটির লোকদের নিয়োজিত করা হয়েছে। যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন সুইফটের লোকেরা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর জায়গায় কেন রাকেশ আস্তানা নামের একজন ভারতীয় নাগরিককে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে? কেন দুজন মুসলমান ডেপুটি গভর্নর বরখাস্ত হলেন? কেন সংখ্যালঘু বাকি দুজন বরখাস্ত হলেন না? দোষ হলে চারজনেরই হয়েছে। না হলে কারও হয়নি। আবার রাকেশ জাতিসংঘের ডেপুটি তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। তাকে কেন আইটি বিশেষজ্ঞ বলে চালিয়ে দেয়া হলো?
বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকেরা জড়িত, এটা যখন একেবারে প্রমাণের দ্বারপ্রান্তে, তখন এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য অপহরণ করা হলো আইটি বিশেষজ্ঞ তানভীর আহমদ জোহাকে। এর লক্ষ্য ছিল, মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে দেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরির টাকা উদ্ধারের বদলে যাতে মানুষ দাবি করতে থাকে যে, জোহার উদ্ধার বা সন্ধান চাই। আবার জোহা উদ্ধারের দাবি যখন জোরদার হয়ে উঠলো, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সব বিরক্তিকর হেঁয়ালি করতে থাকলেন যে, সেটা সহ্য করাও কঠিন। শেষ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জোহাকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে গেল বটে, তবে বন্ধ করে দেয়া হলো জোহার মুখ। অথচ এই জোহাই টাকা চুরির রহস্য উদঘাটনে র‌্যাব-পুলিশকে সহায়তা করছিলেন। তরুণরা আমাকে বোঝাতে চাইলো এই টাকা চুরির সঙ্গে ভারতেরও হাত আছে। এই কথাটা আমার কাছে নতুন। বললাম, কীভাবে? তারা বললো, এই যে রাকেশ আস্তানা। এটা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট। নইলে ফেডারেল রিজার্ভে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা লেনদেন করছে বহুকাল ধরে। কখনও তো এমন ঘটনা ঘটেনি। রাকেশ আসার পরপরই কেন চুরি হয়ে গেল বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা। আর চুরি হতে হতে বেঁচে গেল প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।
তারা জানালো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা সাধারণত কারেন্ট ইস্যু নিয়েই লেখালেখি করি। টাকা চুরির মূল হোতারা যখন ধরা পড়ে পড়ে, তখন আইসিসির মাধ্যমে বাংলাদেশ দলের তাসকিনকে টি-২০ ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করিয়ে দিল। আইসিসি তো ভারতের পা-চাটা। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তাসকিনকে নিয়ে তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে উঠল। তাসকিন ও বাংলাদেশ দলের প্রতি আইসিসি যেন যুদ্ধ ঘোষণা করল? ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করলেন যে, আইসিসি ভারতের প্রতি বড় বেশি দুর্বল। যে কারণে বাংলাদেশের তাসকিনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, একই কারণে ভারতের অনেক ক্রিকেটারকেও নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু আইসিসির লক্ষ্য ছিল, যে করেই হোক ভারতকে জেতাতে হবে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা যা করার তা করেই ফেললো। একজন তো ঝটপট মোবাইলে সার্চ দিয়ে আমাকে দেখালো যে, বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের রান যোগ করলে দাঁড়ায় ১৪৬। অথচ আইসিসি স্কোর বোর্ডে তা দেখানো হয় ১৪৫। সে হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ খেলা ড্র হবার কথা। এটাও ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র।
এর মধ্যে গত ২০ মার্চ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের আবাসিক এলাকায়     শ্লীলতাহানির পর খুন করা হলো অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে। এই খুনের ঘটনা নিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-সংস্কৃতিসেবী সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলো। কিন্তু গত ১০ দিনেও কোনো অপরাধী গ্রেফতার হয়নি। বরং এই হত্যাকা- নিয়ে তনুর পরিবারকেই হয়রানি করা হচ্ছে। তার প্রবীণ পিতামাতা আর ভাই-বোনকে মধ্যরাতে তুলে এনে ভোর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কেন এই অত্যাচার? কেন এই চাপ সৃষ্টি? কেউ কেউ বললেন, ভারত শেখ হাসিনা সরকারকে কোরামিন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটাও তাদেরই ষড়যন্ত্র। সেটা দুভাবে। প্রথমত, তনু হত্যাকা- নিয়ে সারাদেশে যে তোলপাড় হবে, সেটা জানত ভারত সরকার। ফলে আড়াল হয়ে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা। আর ঘটনাটা সেনানিবাসের ভেতরে হওয়ায় সাধারণ মানুষ যাতে সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইল ভারত।
আমি মনোযোগ দিয়ে তাদের এই চিন্তার ধারাটা শুনলাম। আমার চিন্তা বা দ্রোহের সঙ্গে কোথায়ও তাদের কথা মিলে গেল। কোথায়ও মনে হলো, আমি পশ্চাৎপদই রয়ে গেছি। কিন্তু জীবনভর তো দেখলাম শেষ বিচারে তারুণ্য ও তাদের চিন্তা চেতনা লড়াইয়েরই জয় হয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এবারও হবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মন্ত্রীদের জরিমানা ও কলিকালের বৈশিষ্ট্য


বিষয়টি বাংলাদেশ কেন উপ-মহাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই বারই প্রথম ঘটেছেঃ মন্ত্রিসভার দু’জন মন্ত্রী আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের দু’জনই পূর্ণমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী নন।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ এই রায় দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি এবং বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় তাদের এই শাস্তি প্রদান করা হয়। আদালত বলেছেন যে, তারা সংবিধানও লংঘন করেছেন। ইতোপূর্বে সংবিধান লংঘন ও আদালত অবমাননার দায়ে কোনও মন্ত্রীকে শাস্তি দেয়া না হলেও অন্য অপরাধে পাকিস্তান আমলে একজন মন্ত্রীকে ১০ টাকা জরিমানা এবং বাংলাদেশ আমলে একজন প্রধানমন্ত্রীকে আদালত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় Wrong headed বলে আখ্যায়িত করে মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। এখন যে দু’জন মন্ত্রীকে শাস্তি দেয়া হলো তারা হচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এদের উভয়েই প্রবীণ এবং তাদের এই শাস্তি ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে অনেকে মনে করেন।
বিষয়টি শুধু আমি নই, সারা জাতির জন্যই দুঃখজনক ও লজ্জাকর। কেবিনেটের দু’জন মন্ত্রী (একজনের নামের আগে এডভোকেট শব্দটি জড়িত আছে, অর্থাৎ তিনি আইন পেশার সাথেও জড়িত) আদালতের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত নন এটা বিশ্বাস করা যায় না। মন্ত্রী নির্বাসিত হবার পর শপথবাক্য পাঠ করে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, মন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। তারা শপথ নিয়ে বলেছেন যে, দেশের সংবিধান রক্ষা করবেন, কিন্তু মন্ত্রী হয়ে তা ভুলে গেছেন এবং শপথ ভঙ্গ করে সংবিধান লংঘন করেছেন এটা যেমন বিস্ময়কর তেমনি মন্ত্রী সভার জন্যও কলংকজনক। আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু শাস্তিপ্রাপ্ত এই দুইজন কেবিনেট সদস্য নন পুরো কেবিনেটেরই এখন পদত্যাগ করা উচিত। এই কেবিনেটে এমন আরো মন্ত্রী আছেন যারা শপথ এবং সংবিধান দু’টোই যথাক্রমে ভংগ ও লংঘন করে যাচ্ছেন। অনেকের আচার আচরণ ও কথাবার্তা শুধু যে মন্ত্রীর মতো নয় তা নয় বরং মন্ত্রণালয়ের পিয়ন চাপরাশিদের আচরণ থেকেও নিকৃষ্ট বলে কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন। কালপরিক্রমায় আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, শিষ্টাচারী ভদ্রলোক ও মার্জিতমনা লোকের সংখ্যাও কম নয়। তথাপিও কেবিনেটের সদস্য বা এমপি নির্বাচনের বেলায় আমাদের এই দৈন্যদশা কেন? সম্রাট আকবর একবার একজন তবলাবাদককে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার নবরত্ন সভার সদস্যরা রাজ সিংহাসন যমুনায় বিসর্জন দেয়ার লক্ষ্যে শব মিছিল বের করেছিলেন। আমরা আমাদের পার্লামেন্ট ও কেবিনেটে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, নর্তক-নর্তকী, সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করেছি। এতে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বাড়েনি, বরং কমেছে। যে শ্রেণীর লোকদের কথা আমি উল্লেখ করেছি দেশের কোনো কোনো মানুষ তাদের পেশাদার চিত্তবিনোদক হিসেবে পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু মন্ত্রী, পরামর্শদাতা বা আইন প্রণেতা হিসেবে নয়। দেখা যাচ্ছে যে আমরা এই সাধারণ বাস্তবতাটুকুও ভুলে যাই। আর মন্ত্রী এমপিরা যা বলেন তা যদি তারা রেকর্ড করে নিজেরাই শোনেন, যাদের লজ্জা আছে তারা নিশ্চয়ই লজ্জিত না হয়ে পারবেন না।
আগের দিনে সরকারি চাকরি অথবা মন্ত্রীত্ব কিংবা জনগুরুত্বসম্পন্ন পদে প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় খান্দান ও পারিবারিক মর্যাদা দেখা হতো। এর কারণ ছিল খান্দানি কোনও লোক শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনও কাজে সংশ্লিষ্ট হবার আগে নিজের, খান্দানের এবং দেশের কথা চিন্তা করতেন। এখন তা আর নেই। আমরা এখন অধঃপতনের এতো নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছি যে আমি কে, কাকে কি বলছি তাও ভুলে যাচ্ছি। এই তো দু’দিন আগে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী একজন মন্ত্রী প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি দেশে বোমা হামলার জন্য স্বচ্ছন্দে জামায়াত-বিএনপি নেতা-কর্মীদের দায়ী করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিলেন। তার ডিগ্রি তাকে জংলি আচরণ থেকে বিরত রাখতে পারছে না। নোংরা অতীতের অনেকেই উচ্চ পদের বর্তমানের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না। আমি এই স্তম্ভে একবার ভারতের একটি সম্প্রদায়ের কথা বলেছিলাম, এরা রাজপুতদের উত্তরসুরি। অনেকেই অবগত আছেন যে, রাজপুতরা এক সময় ভারতের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অবস্থানে ছিলেন। এদের বেশির ভাগই ছিলেন যোদ্ধা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ২৭ বছর দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে এদের পুরুষদের অনেকেই নিহত হয়েছিলেন। ফলে এই সম্প্রদায়টির অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে তারা তাদের মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র সংকটে নিপতিত হয়। এই অবস্থায় এদের বৃহত্তর অংশ চাকরবাকরদের সাথে বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। চাকররা আবার মনিব কন্যাদের বিয়ে করার সুযোগ পেলেও নিজেদের অতীতকে ভুলতে পারেনি। তারা এক অদ্ভূত কালচারের সৃষ্টি করে এবং সেটা হচ্ছে স্ত্রীদের সাথে রাত্রিযাপনকালে তারা তাদের সাথে পালঙ্কে না শুয়ে স্ত্রীদের (মনিব কন্যা) পালঙ্কে শোয়ায়ে নিজেরা মেঝেতে ঘুমানো শুরু করে। আবার স্ত্রীরাও তা মেনে নেয়। রাজপুতদের এই সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো এই কালচার চালু আছে বলে জানা যায়।
আমাদের সমাজে বর্ণপ্রথা নেই, কিন্তু অভ্যাস ও অবস্থানগত পরিমণ্ডলের কারণে কিছু লোক আছেন যারা পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে নিজেদের নীচু অবস্থান থেকে উপরে উঠাতে পারেননি। অভ্যাস আচার আচরণ ও শিষ্টাচারের দিক থেকে তারা নীচুই রয়ে গেছেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বদৌলতে ‘কৌলিন্যের’ পজিশনে এসে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছেন। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তারা নিজেরা ছাড়া অন্য কাউকে মানুষই মনে করতে চান না। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মানুষ খুনের মাধ্যমে যাদের উত্থান, বন্দুকের নলে যারা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতেন, জাতীয় নির্বাচনে যারা কখনো জামানত রক্ষা করতে পারতেন না, আওয়ামী লীগের লেজ ধরে বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে তারা এখন যেভাবে কথা বলেন তার ধরন দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ একটা প্রাণী লেজ নাড়ে, না লেজ প্রাণীটাকে নাড়ায় তা বুঝা যায় না।
দেশ এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রীরা যেমন আইন আদালত ও সংবিধানের তোয়াক্কা করেন না, তেমনি ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও দেশকে নিজেদের জমিদারী বলে গণ্য করে চলছেন। জমিদারী আমলে প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে তাদের জমিজমা জমিদাররা কেড়ে নিতেন। আবার কোনো কোনো জমিদার দয়াপরবশ হয়ে খাজনা পরিশোধের অবকাশও দিতেন। জমিদারী প্রথা এখন নেই, এখন আওয়ামী লীগ শাসনামলে তাদের থেকেও দোর্দণ্ড প্রতাপ চাঁদাবাজ কাউন্সিলরের জন্ম হয়েছে যারা প্রকাশ্য দিবালোকে অন্যের সম্পত্তি দখল করে বুক ফুলিয়ে তা ভোগ করছে। ভোগের অর্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃত্ব ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, আপনি বিক্ষুব্ধ অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তি হিসেবে আইন আদালত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার, আইজি কারোর কাছ থেকেই কোনও সাহায্য পাবেন না। থানা আপনার জিডি গ্রহণ করবে না। পুলিশ পয়সা ছাড়া আপনার সঙ্গে কথা বলবে না। আপনি প্রতিবাদ করতে গেলে জঙ্গী সন্ত্রাসী হিসেবে জেলে যাবেন। পয়সার শ্রাদ্ধ হবে। পয়সা না দিতে পারলে হয়তো লাশ হয়ে বাড়িও ফিরতে পারবেন না। বিশ্বাস না হলে মতিঝিল ৯নং ওয়ার্ডের আরামবাগের ৮৯, ৮৯/১নং হোল্ডিং এ অবস্থিত বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স-এর ৯ তলা বিশিষ্ট একটি এবং ৪ তলা বিশিষ্ট দু’টি ভবনের অবস্থা দেখতে পারেন। ২০০৮ সাল থেকে ক্রয় সূত্রে ভবনগুলোর মালিকানা গ্রহণ করে বিপিএল এগুলো ভোগ দখল করে আসছে। বিপিএল হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার শেয়ার হোল্ডারের মালিকানাধীন একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি। আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় একজন কাউন্সিলর তার দলবল নিয়ে ভবনগুলো জবর দখল করে গত জুলাই থেকে মাসে প্রায় দশ লক্ষ টাকা ভাড়া আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সরকারের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে কিন্তু প্রতিকার নেই। রাজধানীর বুকে এতো বড় জবর দখল ও অবিচার চলছে। সরকার নির্বিকার। তারা আইনের শাসনের কথা বলেন, কিন্তু তাদের জুলুম অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পরের সম্পত্তি দখলের এই জঘন্য অপরাধ তারা ঢাকবেন কিভাবে? চোর, গু-া, বদমাশ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ছাড়া কি সরকার চলতে পারেন না? এই বিষয়টি তাদের জন্য ভবিষ্যতে যে বুমেরাং হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
এসব ঘটনা কেন ঘটছে তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দলে কি যোগ্য ও সৎ এবং ভদ্র লোক নেই; আমি মনে করি আছে। কিন্তু তারা এখন কোণঠাসা হয়ে আছেন।
শেষ করার আগে হিন্দু শাস্ত্রের কিছু কথা মনে পড়লো। এই শাস্ত্র পৃথিবীর স্থিতিকালকে চারটি যুগে বিভক্ত করেছে। যুগগুলো হচ্ছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। কলি যুগের একটি বৈশিষ্ট্য তারা বলেছেন। এই যুগে নাকি, ‘অমানুষ মানুষ হবে, তেলি হবে পাল। নাপিত বৈদ্য হবে কে কাটিবে .....’ল। শেষের শব্দটি আমাদের সমাজে অশ্লীল হিসেবে গণ্য করায় আমি তা লিখলাম না। এর বাংলা অর্থ চুল। শ্লোকে চুলের হিন্দি বা উর্দু প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যারা কলি কালের বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাস করেন তারা এই শ্লোকে মনের খোরাক পেতে পারেন বলে আমি মনে করি। তবে আমার বিশ্বাস শ্লোকের উপর ছেড়ে না দিয়ে অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। তা হলে অন্তত চেয়ারের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

শনিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সুচি’র আর একদিক


আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। দেশটির কিছু কর্মকা- মানুষের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। দেশের নেতৃবৃন্দও এই প্রশ্নের বাইরে নয়। তবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচিকে নিয়ে মানুষের মনে এক ধরনের আশাবাদ ছিল। নিজ দেশ মিয়ানমারের কল্যাণে ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকায় পশ্চিমাদের কাছে ন্যায় পরায়ণতার বিশুদ্ধ বাতিঘর হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছেন সুচি। কিন্তু তার অন্য একটি দিক আছে যা তার দেবীতুল্য ইমেজের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিবিসি টুডের বিখ্যাত উপস্থাপক পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত সাংবাদিক মিশাল হুসেনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে সুচি তার চরিত্রের অপর দিকটি নিজেই উন্মোচন করে দেন। ফলে বিষয়টি বিশ্বের গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব পায়।
বিবিসি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে সুচি মেজাজ হারান এবং তাকে বিড় বিড় করে ক্রোধের সাথে বলতে শোনা যায়, ‘একজন মুসলিম যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে এটা আমাকে কেউ বলেনি’। এশিয়ার এই দুই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় মিশাল যখন সুচিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বৌদ্ধদের নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন করেন। সুচিকে এই নির্যাতনের ঘটনায় নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান মিশাল। উল্লেখ্য যে, ৭০ বছর বয়সী সুচি তার দেশে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কখনও একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সুচির অন্ধ সমর্থকরাও এ কথা স্বীকার করেন যে, রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বৌদ্ধদের বর্বর নির্যাতনের ব্যাপারে সুচি’র আচরণ সন্দেহজনক।
সাক্ষাৎকারে মিশাল যখন সুচিকে ইসলাম বিরোধিতা ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার ব্যাপারে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান তখন তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেন। সুচি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি অনেক বৌদ্ধও বিভিন্ন কারণে দেশত্যাগ করেছে। এটা আসলে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের ফল’। ভাবতে অবাক লাগে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী একজন নেত্রী কী করে প্রকৃত সত্যকে এভাবে অস্বীকার করেন? বৌদ্ধদের দেশত্যাগের সাথে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশত্যাগের বিষয়টিকে তিনি এক কাতারে সামিল করলেন কোন কাণ্ড-জ্ঞানে? আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তার সাম্প্রদায়িক চেতনা। তিনি কী করে বললেন, ‘একজন মুসলিম যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে এটা আমাকে কেউ বলেননি’। বিবিসিতে তো নানা ধর্মের লোকজন কাজ করেন। কিন্তু তিনি আপত্তি প্রদর্শন করলেন একজন মুসলিম উপস্থাপকের বিরুদ্ধে। এমন চেতনার মানুষ কী করে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন তা এখন এক বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে? বর্তমান সভ্যতার চিত্রটা কি এমন যে, এখানে কথা ও কাজে মিল না থাকলেও চলে? স্বার্থের যোগ-বিয়োগই কী বর্তমান সভ্যতার চালিকা শক্তি? পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই তো চায় মানুষের বসবাস-উপযোগী ন্যায়ভিত্তিক এক বিশ্ব-সমাজ। এমন আকাক্সক্ষার অনুকূলে যারা কাজ করবেন তারাই হবেন আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। বর্তমান পৃথিবীর ভ্রষ্ট রাজনীতির কারণে ইতোমধ্যে ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ার জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারেও শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে বহু নর-নারী ও শিশু ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন এবং অনেকে উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। মানুষের সমাজে মানুষের এমন করুণ পরিণতি তো কোনো বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারেন না। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচিও বিষয়টি না বোঝার কথা নয়। তিনি হয়তো মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের অন্যায় আচরণকে সমীহ করে চলছেন। ভোটের রাজনীতির কারণেই হয়তো তিনি অন্যায়ের কাছে মাথানত করেছেন। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি যে ধৈর্য ও ত্যাগের কিছু নিদর্শন দেখিয়েছেন তাতে আমরা এমন আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই যে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও তিনি ন্যায়ের দৃষ্টিতে কিছু করার চেষ্টা করবেন।

শুক্রবার, ২৫ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মহান স্বাধীনতা দিবসের ভাবনা


মহান স্বাধীনতা দিবসের এই শুভলগ্নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রিয় এই জনপদের সব মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। এই জনপদের সংগ্রামী মানুষ স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে। জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির যুদ্ধ বিজয় লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর। জাতি প্রতিবছর গভীর শ্রদ্ধার সাথে ২৬ মার্চ পালন করে মহান স্বাধীনতা দিবস। আমাদের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্ণ হবে এই মার্চে। জাতীয় ইতিহাসের পাতায় বিগত ৪৫ বছরে যুক্ত হয়েছে আনন্দ-বেদনার নানা ঘটনা। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার উল্লাস প্রকাশের পাশাপাশি আমাদের পালন করতে হবে আত্মসমালোচনার দায়িত্বও। কারণ আত্মসমালোচনা ছাড়া কোনো জাতি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।
ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই একথা জানেন যে, এই জনপদের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা দীর্ঘদিনের একটি লালিত বিষয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার দীর্ঘ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব সলিমউল্লাহ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আরও অনেক মহান নেতাকে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। আমরা জানি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতেও কঠিন বিষয় হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এক্ষেত্রে সফল না হলে স্বাধীন রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে। এই বিষয়টি জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তারা দেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা জানতেন যে, স্বল্প সম্পদ নিয়েও ঐক্য ও সংহতির বদৌলতে জাতিকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া যায়। এমন চেতনাকে সমুন্নত রাখাই ছিল দেশের রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব।
স্বাধীনতার ৪৫ বছরে আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তথা সহিষ্ণুতার অভাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। এই ব্যর্থতার কারণে আমরা কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, জীবনমান, সুশাসন ও নিরাপত্তা লাভে সমর্থ হইনি। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, পরমত সহিষ্ণুতার অভাবে বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট আজ দেশে-বিদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে দেশ বিদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, পত্র-পত্রিকার বিশ্লেষণ এবং রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের নানা উপদেশে জর্জরিত হতে হচ্ছে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের। এমন চিত্র কোনো স্বাধীন দেশের জন্য সম্মানজনক নয়। দেশের মানুষ তো চায় সরকার ও রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত হবে। দেশের মানুষ মৌলিক অধিকারও চায়, চায় নিরাপত্তা এবং জীবনমানের উন্নয়ন। কিন্তু জনগণের এমন আকাক্সক্ষা পূরণে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড কতটা যৌক্তিক পথে পরিচালিত হচ্ছে? স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তির এই সময়ে তাই আত্মসমালোচনার দায়িত্ব পালনও আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজ দমন-পীড়ন, গুম ও হানাহানির পরিবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে; নির্বাচনে যেভাবে সন্ত্রাস ও ভোট জালিয়াতি হয়, ব্যাংক-বীমা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেভাবে লুটপাট চলছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে যেভাবে জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বিপর্যস্ত হচ্ছে, ভোগ-বিলাস ও নৈতিক অবক্ষয়ের বাতাবরণে আমাদের মেরুদণ্ড যেভাবে জীর্ণ হচ্ছে, তাতে স্বাধীনতার লক্ষ্যগুলো সব নাগরিকের আবার পুনঃপাঠ প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সচেতন না হলে আমাদের স্বাধীনতার আনন্দ-অনুষ্ঠান অর্থবহ হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। আত্মসমালোচনা, আত্মোপলব্ধি ও কর্তব্য নির্ধারণের দায়িত্ব পালন আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। এব্যাপারে সময়ের দাবি পূরণে আমরা এগিয়ে আসতে পারি কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মা মাটি মুক্তিযুদ্ধ


ইদানীং আর মাকে স্বপ্নে দেখি না, আব্বাকেও না। হজ্বের আগে মাকে অনেকবার স্বপ্নে দেখেছি। পরে আর দেখি নাই। হজ্বের পরেও মক্কাতে ৮দিন ছিলাম। মাকে দেখার পরে আব্বাকেও স্বপ্নে দেখলাম। তিনি আমার কাছে আসছেন না। দূর দিয়ে আমাকে দেখছেন, কথাও বলছেন,সৎ উপদেশ দিচ্ছেন যেভাবে দিতেন জীবিত থাকাকালে। স্বপ্ন দেখেই জেগে উঠলাম। অজু করে সোজা কাবা শরীফে চলে গেলাম। পথিমধ্যেই তাহাজ্জুদ নামাজের আজান হলো। তাহাজ্জুদ পড়ে অপেক্ষা করলাম। ফজরের আজান হলো। নামাজ শেষ করে বার বারই স্বপ্নের হেতু খোঁজার চেষ্টা করলাম। শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমার আব্বা আমার কাছে কিছু প্রত্যাশা করছেন। আব্বার জন্য কি করা যায় তার উপায় বের করলাম। বাবা-মা দুজনের নামে একটা নফল ওমরা করবো, আর পবিত্র কাবা শরিফ এবং মসজিদে নববীতে একটি করে কুরআন শরীফ দান করবো।
সিদ্ধান্ত মতে ঐদিনই জোহরের নামাজের সময় কুরআন শরিফ একটা কিনে কাবা শরীফে দিয়ে দিলাম আর মদীনাতে গিয়ে অবশ্য প্রথম নামাজের সময়ই একটি কুরআন শরিফ দিয়েছি । স্বপ্ন দেখার পরের দিনই নফল ওমরা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জেদ্দাতে আমার এক বন্ধু বার বারই তার বাসায় দাওয়াত খেতে বলছিলেন। ভাবলাম এইবার এক ঢিলে দুই পাখি মারার একটা সুযোগ হবে। তার নাম আর আমার নামও এক। মিতাকে ফোনে বললাম আজ রাতে আপনার বাসায় আসছি। অন্যান্য সাথীরাও জেদ্দা যাবেন। উদ্দেশ্য কিছু কেনা কাটা এবং ওমরার জন্য সেখান থেকে এহরাম বাঁধা। মাইক্রোবাস ভাড়া করে গেলাম। কেনাকাটা শেষ করে ‘মা হাওয়ার’ কবর দেখা, কেসাস মসজিদ (শিরশ্ছেদ মসজিদ) দেখা, সমুদ্র সৈকত দেখা এবং সর্বশেষ এহরাম বাঁধা। এসব করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল। সাথীরা সবাই ফাতিমা মসজিদ থেকে এহরাম বেঁধে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। আমি ফাতেমা মসজিদেই রয়ে গেলাম। মিতা আমার জন্য গাড়ি পাঠাবেন । তার গাড়িতে তার বাসায় যেতে হবে। সাগরের মধ্যেই মসজিদ। জোয়ারের সময় চারদিকে পানিতে ভরে যায়। এক দর্শনীয় মসজিদ বটে। এখান থেকে মানুষ এহরাম বেঁধে হজ্জ বা ওমরা করে থাকে।
গাড়ি আসছে আসছে করে অনেক সময় পেরিয়ে গেল।আরব সাগরের গর্জন রাতের নীরবতা ভাঙ্গছে। একে একে সব পর্যটক চলে গেছে। পুরো সমুদ্র সৈকতই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। আমি একা। রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কারণ এমন অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। অপরিচিত এক জনশূন্য সমুদ্র সৈকতে আমি একা। রাস্তায় একজন বাংলাদেশী ক্লিনার পেলাম। ওর নাম আশরাফ, বাড়ি কুমিল্লা। পরিচয় পেয়েই ওর ব্যাগ থেকে আমাকে বের করে দিল ফান্টার ক্যান,সাথে ৭/৮শ গ্রাম ওজনের বিশাল এক ডালিম। মিতা গাড়ি পাঠিয়েছেন কিন্তু চালক লোকেশন খুঁজে পাচ্ছে না। আর আমারও অপরিচিত জায়গা। তাই চালকের সাথে যোগাযোগ ও সঠিক লোকেশনের জন্য আশরাফই যোগাযোগ করতে লাগলো। কারণ তখন আরো বিপদ ঘনিয়ে আসছিল এজন্যই যে আমার মোবাইলের চার্জও  অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আশরাফের লোকেশন  নির্দেশনামতে শেষ পর্যন্তু গাড়ি আসলো। ততক্ষণে ওর দেয়া ডালিম খেয়ে সাদা পাঞ্জাবী লাল করে ফেলেছি।
মিতার বাসায় তার দামি গাড়িতে করে পৌঁছাতেই আরো ৪০ মিনিট লেগে গেল।গিয়ে দেখি ঈদের আয়োজন। হাজিরা ঈদের আনন্দ এবং খাওয়া দাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। সেটা মিতার জানা আছে। কারণ ঈদের দিনই হাজিদের সবচেয়ে ব্যস্ততম ও কষ্টের দিন। সূর্যোদয়ের পরে মুজদালেফা থেকে হেঁটে মিনার তাঁবুতে আসতে হবে, তারপর জামারায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে কঙ্কর নিক্ষেপ,তারপর কুরবানি করা ইত্যাদি সবই কষ্টসাধ্য। সর্বোপরি কুরবানির গোশতও হাজিদের খাওয়ার সুযোগ হয় না। মিতার সেটা জানা আছে বিধায় আয়োজনটা সেভাবেই করেছেন। খাওয়ার পরে ঘটলো আরেক বিপদ। বাথরুমে হাত ধুতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল পাঞ্জাবী। মিতা যাতে টের না পায় সেজন্য বাথরুম থেকে একবারেই ওজু করে বের হলাম। তার চোখকে ফাঁকি দিয়েই কাপড় পাল্টে এহরামের পোশাক পরে নিলাম। দু’রাকাত নামাজ পড়ে জোরে জোরে লাব্বাইক পড়ে জানান দিলাম যে আমি এখন ওমরার জন্য প্রস্তুত। তারপরেও কিছু কথা থাকেই। সাংবাদিক বলে কথা। দেশের খবর, রাজনীতির খবর,ইসলামী আন্দোলনের খবর, নেতৃবৃন্দের অবস্থা জানতে চান তিনি। গল্প করতে করতে আরো পৌনে এক ঘণ্টা। তারপর বিদায় নিলাম। তবে আবারো ড্রাইভার দিয়ে ট্রাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত পেঁৗঁছে দিলেন। ট্যাক্সির ভাড়াটাও ড্রাইভারের পকেটে গুঁজে দিলেন। আমি আপত্তি জানালে তিনি বললেন স্যার যা বলেছেন আমি তাই করছি। 
ট্যাক্সি আমাকে পবিত্র কাবা শরীফে পৌছে দিল অত্যন্ত সম্মানের সাথে। এহরাম পরা যেহেতু ড্রাইভার জানে আমি ওমরা করবো। আমি আল্লাহর মেহমান।সে আমাকে নামিয়ে দিল বায়তুল্লাহর চত্বরে।তাওয়াফ ও সাঈ করে ওমরার সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে করতে তাহাজ্জুদের আজান হয়ে গেল। তাহাজ্জুদ এবং ফজর পড়ে তারপর বাসায় এসে ঘুমালান।
বাবা ও মায়ের জন্য এই ওমরাহ পালনের পর থেকে আর মাকে স্বপ্নে দেখিনা। আমার মনে হয় সে আমার কাছে এই প্রত্যাশাই করেছিল। যদি তাই হয় তবে মায়ের মৃত্যুর পরেও আমি তার প্রত্যাশা পূরণ করতে যৎকিঞ্চিৎ সক্ষম হয়েছি। বাবা মায়ের ঋণ কোন সন্তানের পক্ষেই শোধ করা কখনো সম্ভব নয়। আল্লাহ আমার এই খেদমত কবুল করুন।
আমার মায়ের মৃত্যু হয় ২৪ আগস্ট ২০১৩ সালে। তার জানাযা হয় পরের দিন ২৫ আগস্ট সকাল ১০ টায় আমাদের গ্রামের ঈদগাহ ময়দানে। জানাযায় যে বিপুল লোক সমাগম হয় তা না দেখলে হয়তো বুঝতামই না যে আমার মা মানুষের হৃদয়ে কতটা স্থান করে নিয়েছিল।আত্মীয় স্বজন ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এসেছিল তার জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য। জানাজা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকে এসেছেন। এত লোক সমাগমের কারণ হলো ২টা । প্রথমত আমার মা যে গ্রামের মেয়ে সেই গ্রামেরই বধূ। ৯০ টি বছর কেটেছে তার এক গ্রামে। ফলে গ্রামের সবাই তার কোন না কোনভাবে আত্মীয়। আমার দাদা সামাদ মোল্লার বেটার বৌ আর নেহাল উদ্দিন শেখের একমাত্র কন্যা ছিল আমার মা। এই দুই ব্যক্তিই এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিলেন।আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার এবং বিশেষ করে আমার মায়ের ত্যাগ,কষ্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানসহ অন্যান্য অবদান।
১৯৭১ সাল, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বছর। আমার বয়স তখন মাত্র সাড়ে ৭ বছর। আমার ছোট ভাইটা তখন সবে বসা শিখেছে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চের কালো রাতে বর্বরোচিত কায়দায় হামলা চালালো হায়েনা পাক বাহিনী। তারপর শুরু হলো প্রতিরোধ যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তা।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পেলাম নতুন পতাকা, নতুন দেশ,নতুন মানচিত্র।২৫ মার্চ রাতেই সেনা বাহিনীতে কর্মরত আমার বড় ভাই রোস্তম মোল্লা অন্যান্য বাঙ্গালি সৈন্যদের ন্যায় রংপুর সেনানিবাস থেকে অস্ত্রসহ বিদ্রোহ করে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু ভাগ্য তাকে সহযোগিতা করেনি। তাই অস্ত্রসহ ধরা পড়ে যান পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। ক্যান্টনমেন্টেই তাকে কয়েদ করা হয়। অনেককেই হত্যা করা হয়। কিন্তু এক পাকিস্তানী মেজরের খুব প্রিয়পাত্র হওয়ায় তার কেস ডায়রিতে শুধু একটি শব্দ পরিবর্তন করে লেখা হয় উইথ আউট আর্মস। তাই ফাঁসির পরিবর্তে তাকে কয়েদ করা হয়। আর পাঠিয়ে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা কারাগারে। 
বড় ভাইয়ের এই অবস্থার কথা আমরা কেউই জানতাম না। বরং সমস্ত খবরাখবর পর্যালোচনা করে সবাই নিশ্চিত ছিল যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এক সাথে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হওয়া তার সহকর্মীরাও খবর দিয়েছিল যে,রোস্তমকে আমি অস্ত্রসহ বের হতে দেখেছি। তবে সে ধরা পড়ে যায়। এমন নিশ্চিত খবরের পরে তার বেঁচে থাকার কথা আর ভাবা যায় কি? বড় ছেলের এরুপ নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কা করে কাঁদতে কাঁদতে আমার মা প্রায়ই বেহুশ হয়ে যেতেন। আর আব্বা মাঝে মধ্যেই যেখানে সেখানে শুয়ে বা বসে পড়তেন এবং বিলাপ করতে করতে আছাড়ি বিছাড়ি করতেন। এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। কখনো তারা থাকতো, অভিযানে যেত, আবার ফিরে আসতো। আমাদের বাড়িটা গ্রামের মধ্যখানে এবং বিশাল একটা ঝাকড়া আমগাছ ছিল বাড়ির সামনে। সারা বছরই গ্রামের ছেলেদের আড্ডা চলতো গাছের নিচে।বাঁশ দিয়ে তৈরী ছিল মাচাং যাতে চলতো তাস খেলা, লুডু, দাবা, সাত গুটি-বাঘ বন্ধ ইত্যাদি খেলা। মুক্তিযুদ্ধের বছরে কেউ কোন অভিযান থেকে ফিরে আসলে তার কাছ থেকে খবর নেয়ার জন্য পাড়ার মানুষের ভিড় জমে যেত। আমাদের দুইটি শোয়ার ঘর আর গোয়াল ঘর বাদে সব ঘর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। মেঝে ভাই মকবুল হোসেন তখন হাইস্কুলের ছাত্র। তাকে আমার আব্বা মা কেউ নিষেধ করতেন না মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অভিযানে যেতে। আমাদের বাড়িতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা থাকতো তাদের নেতা ছিলেন আমারই মামাতো ভাই আহম্মদ হোসেন। তার ডাক নাম ছিল পচা। সবাই পচা ভাই বলেই ডাকতো। 
একদিনের কথা মনে পড়ে। সেদিন দুপুরে পচা ভাই কোন এক অভিযান শেষে আসলেন, সাথে আরো ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। দূর থেকেই তার স্বভাবসুলভ ডাক “ফুপু ! খুব খিদে লেগেছে খেতে দাও”। মা বললেন, তুই কি আমারে খবর দিয়ে আইছির। এতগুলো মানুষের ভাত তরকারি কি তৈরী থাকে। ঠিক আছে অস্ত্রপাতি রেখে গোছল সেরে আসো।পুকুর থেকে গোসল করে এলেন তারা।এরই মধ্যে খিচুড়ি রান্না করে আমার মা তাদের খেতে দিলেন।এভাবেই চলছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। 
একটি হিন্দু পরিবার আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার আব্বা বলেছিলেন,“আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথায়ও যাব না। বাঁচলেও এখানে মরলেও এখানেই। সহমরণ চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারো। কারণ আমার বড় ছেলেই যখন নেই,তখন আর কার জন্য পালাবো। আমাদের সাথে মুক্তিবাহিনী আছে।” হিন্দু স্বামী-স্ত্রী থাকতো একটি আলাদা রুমে। তবে তারা কখনো আমাদের রান্না করা খাবার খেতনা। মা তাদেরকে চাল,ডাল দিতেন। তারা আলাদা একটা চুলায় রান্না করে খেত। এমনকি তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে টয়লেট পর্যন্ত গোবর মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে তার উপর দিয়ে যেত। আমাদের কাজের লোক অতি প্রত্যূষেই এক দইয়ের পাতিল গোবরপানি তাদের রুমের সামনে রেখে আসতো।
ডিসেম্বর মাসের ১১ কি ১২ তারিখ হবে। ঐদিন সকাল বেলা খবর এলো যে পাকিস্তান আর্মি কামারখালী ঘাট পার হয়ে আমাদের দিকে আসছে। তারা নাকোল বাজার, কমলাপুর ঘাসিয়াড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে বাড়িঘর, বাজারের দোকানপাট, স্কুল ঘর ইত্যাদি গান পাওডার দিয়ে পুড়িয়ে দিল।ঐ গ্রামগুলো আমাদের নোহাটা গ্রাম থেকে অন্তত ৪ কিলোমিটার দুরে। তারপরেও এই খবর আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা আমার আব্বার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো যে আমরা এখান থেকেই প্রতিরোধ করবো। সে মোতাবেক আমাদের বাড়ির তিন দিকে বাঙ্কার খোড়া হলো। গ্রামের অনেকেই আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে গর্ত খুঁড়ে বড় বড় ট্রাংকে করে মূল্যবান মালামাল রেখে মাটিচাপা দিয়ে নিরাপদ এলাকায় চলে গেল। আমার মা আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বাঙ্কারের মধ্যে ঢুকে গেল। আমরা বাঙ্কারের নিচে আর মুক্তিযোদ্ধারা উপরে পজিশন নিয়ে থাকলো। পাক আর্মি আসলে তারাও ভিতরে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ করবে এই ছিল সিদ্ধান্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম পর্যন্ত এলো না। দুপুর পর্যন্ত বাঙ্কারে অবস্থান শেষে আমরা বেরিয়ে এলাম। ঐ বয়সে মাটির নিচে আমাকে ধরে রাখতে মাকে যে কি পরিমাণ জ্বালিয়েছিলাম তা এখনো মনে আছে। পচা ভাইর ভয় দেখিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করতেন মা। বলতেন, তোর পচা ভাই বন্দুক নিয়ে বসে আছে উপরে। উঠলেই মারবে।
আশ্চর্যজনক হলেও ঐদিন আমরা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে আর সেই হিন্দু পরিবারটিকে পাইনি। কয়েকদিন পরেই ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলো পাক বাহিনী। দেশ স্বাধীন হলো সব শঙ্কা যখন কেটে গেল তখন আমার আব্বা ঐ হিন্দু পরিবারটির খবর নিতে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেলেন। তাদেরকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। তারা না জানিয়ে কেন এলো কিভাবে এলো জানতে চাইলে তারা আব্বাকে বললো বাঙ্কার খোঁড়ার দিন তারা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিল।কি আশ্চর্য! তাই তোমরা আমাকে একটু বলেও এলেনা? আব্বার এ প্রশ্নের সদুত্তর তারা দিতে পারেনি।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব মুক্তিযোদ্ধারা একে একে ফিরে আসছে। কিন্তু বড় ভাইর কোন খবর আসে না। তিন সপ্তাহ বা আরো পরে এলো বড় ভাইয়ের খবর। কোয়েটা কারাগার থেকে রেড ক্রসের(বর্তমান রেড ক্রিসেন্ট) একটি ফর্মে ১৪ শব্দের মধ্যে ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি। তাতে লেখা আমি বেঁচে আছি কোয়েটা কারাগারে, তোমরা বেঁচে আছো কিনা জানি না। ঐ ফর্মেরই উল্টো পিঠে ১৪ শব্দের মধ্যে আব্বা উত্তর পাঠালেন, আমরা সবাই বেঁচে আছি, তোমার বেঁচে থাকার বিষয় নিশ্চিত ছিলাম না। পরবর্তীতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ত্রিদেশীয় চুক্তির পর বড় ভাই দেশে ফিরে আসেন। ঢাকায় আর্মি হেড কোয়ার্টারে জয়েন করার পর পরই তিন মাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়।
আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন, তোমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এটাকে কখনো স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করবে না। তাহলে তোমাদের অবদান খাটো হয়ে যাবে। আমি যতদূর জানি আমাদের বাড়িতে যারা থাকতেন সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই কোন সার্টিফিকেট নেননি।আব্বার কথা তারা মেনেছেন। আমার বাবা ১৯৮৭ সালে আর মা ২০১৩ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পরে গার্ড অফ অনারও দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের একদিনও পাওয়া যায়নি তাদের অনেকে সার্টিফিকেট নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের দেখা না গেলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার আব্বার নামে বরাদ্দকৃত রিলিফের খাদ্য সামগ্রী,কম্বল ইত্যাদি আত্মসাৎকারীদের অনেককেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।
শহীদুল ইসলাম 

বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ইতিহাসের বার্তা কখনো ভুলতে নেই


অন্য বিষয়ে না হলেও একটি বিষয়ে মানুষের মধ্যে মিল রয়েছে। মানুষ কথা বলে। কখনো ঠিক কথা বলে, কখনো বলে ভুল কথা। মানুষ চাপে পড়েও কথা বলে, আবার কখনো-বা বলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এ কারণে মানুষের সব কথা সরলভাবে বিবেচনা করা যায় না। কথার মর্মকথা উপলব্ধি করতে হলে চিন্তাভাবনার যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি কখনো কখনো প্রয়োজন হয় গবেষণারও। তাই কথা বলা সহজ হলেও বোঝার কাজটা সবসময় সহজ হয়ে ওঠে না। এরপরও মানুষের সমাজে কথা বলা চলতেই থাকবে এবং সেই কথা শোনার মতো মানুষেরও অভাব হবে না।
প্রসঙ্গত, হিন্দুস্তান টাইমস-এর একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা যায়। গত ১৭ মার্চ নয়াদিল্লীতে বিশ্ব সুফি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে একটারও অর্থ হিংসা নয়। ইসলামের বৈচিত্র্য হলো ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অথচ বিজেপি সরকারের একাধিক মন্ত্রী বহুবার বলেছেন, ইসলাম মানেই সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর। কেউ গরুর গোশত খেলে তিনি যেন পাকিস্তানে চলে যান- এমন হুমকিও এসেছে কারও কারও পক্ষ থেকে। তবে সম্মেলনে মোদি বললেন, ‘সন্ত্রাসের নানা উদ্দেশ্য থাকে। যার পেছনে কোনো যুক্তিই খাটে না। আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনো বিশেষ ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় কিন্তু। তা কখনো হতেই পারে না।’ সুুফি সম্মেলনে এসে সর্বধর্ম-সমন্বয় নিয়ে কথা বলেছেন মোদি। বলেছেন, ‘হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি, আস্তিক, নাস্তিকসহ সকলেই ভারতের অংশ।’ এরপর পবিত্র কুরআনের প্রসঙ্গ টেনে এনে মোদি বলেছেন, ‘কুরআনে বলা হয়েছে, কেউ যদি একজন মানুষকে হত্যা করে, তাহলে তা গোটা মানবতাকে হত্যা করার শামিল।’ মোদির মতে, বর্তমান বিশ্বে মানবতাই সংকটের মুখে।
সুফি সম্মেলনে এসে নরেন্দ্র মোদি যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা বেশ উদার। তবে তার সব বক্তব্যের সাথে সবাই যে একমত হবেন, তেমনটি না-ও হতে পারে। তবে ‘বর্তমান বিশ্বে মানবতাই সংকটের মুখে’, মোদির এই বক্তব্যের সাথে কারো দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। ফিলিস্তিনে, ইরাকে, আফগানিস্তানে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় মানবতার সংকটের কথা আমরা জানি। তবে ভারতে এবং বিশেষ বিশেষ রাজ্যে কেন কী কারণে মানবতার সংকট চলছে, তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারেরই ভালো জানার কথা। এখন তারা মানবতার সংকট সমাধানে কী কী যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন- সেটাই দেখার বিষয়। তবে হিন্দুস্তান টাইমস-এর রিপোর্টে শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, গরুর গোশত আর মুসলিমবিদ্বেষ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার। ভারতের ভেতর থেকেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে। দেশের প্রথম সারির লেখক-লেখিকা থেকে শুরু করে বলিউডের অভিনেতারাও প্রতিবাদ করেছেন। কেউ কেউ পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ আবার দাবি করেছেন, এদেশে মুসলমানদের থাকার মতো পরিস্থিতি নেই। মুসলিমবিরোধী মন্তব্য করে খবরের শিরোনামে এসেছেন নরেন্দ্র মোদির দলের একাধিক নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রী। মোদি নীরব থেকে কার্যত তাতে সমর্থন জুগিয়েছেন বলে মনে করেন অনেকেই। এমন ধারণা দূর করার দায়িত্বটা এখন বর্তেছে মোদির কাঁধেই। সুফি সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের আলোকে তিনি কাক্সিক্ষত পথে এগুতে পারেন।
নরেন্দ্র মোদি ঠিকই বলেছেন, চলমান বিশ্বে মানবতাই সংকটের মুখে; তবে এ ব্যাপারে বলবান বিশ্বনেতারা কোনো দায় স্বীকার কতে চান না। প্রচারযন্ত্রও নানাভাবে তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে। বর্তমান সভ্যতায় প্রচারযন্ত্রের চরম বিকাশ ঘটেছে। তবে এই বিকাশকে কখনো কখনো দৌরাত্ম্য বলেও মনে হয় এবং এমনটি মনে করার বাস্তব কারণও রয়েছে। গত শতাব্দীতে আমরা সামরিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কিছু আওয়াজ শুনেছি। তবে সাম্রাজ্যবাদের পেছনে মিডিয়া-মাফিয়াদের সমর্থনের কথা তেমনভাবে উল্লেখিত হয়নি। কিন্তু বর্তমান সময়ে ভদ্রবেশী মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের দৌরাত্ম্য হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সভ্যতার শাসকদের ইশারায় মিডিয়া-মাফিয়ারা বেশ সফলভাবেই পৃথিবীতে এমন একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে, যার একপক্ষে তথাকথিত উদার-গণতন্ত্র এবং অপরপক্ষে রয়েছে সন্ত্রাস ও মৌলবাদ। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। শক্তিমানরা নিজেদের স্বার্থে যখন যেটা প্রয়োজন হয়, সেটাই করেন এবং তার গায়ে যুক্ত করে দেন গণতন্ত্রের নামাবলী। প্রসঙ্গত এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়Ñ মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি কি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিলেন না? কিন্তু তাকে কেন উৎখাত করা হলো এবং কারা করলো?
মুরসিকে উৎখাতের ব্যাপারে সম্প্রতি মিডলইস্ট মনিটর-এ একটি লেখা মুদ্রিত হয়েছে। লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে স্বীকার করেছেন যে, মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত ও জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসিকে ক্ষমতায় বসানো কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, পরিকল্পিতভাবেই এটি ঘটানো হয়েছিল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের সমর্থক সবচেয়ে বড় ইহুদি লবি এআইপিএসির বার্ষিক সম্মেলনে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বক্তব্য রাখছিলেন। সম্মেলনে ইয়ালন আরো বলেন, মিসর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর জেনারেলদের এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় মুরসিকে উৎখাত করা হয়। আরব বিশ্ব; বিশেষ করে মিসরে সামরিক সরকার থাকলেই ইসরাইলের স্বার্থ সবসময় সবচেয়ে ভালোভাবে সুরক্ষিত থাকে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, সামরিক সরকারগুলো মিসরে গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করলেও এআইপিএসির উচিত হবে আল সিসির প্রতি সমর্থন জোরদার করার চেষ্টা করা। তিনি স্পষ্ট ভাষায় আরো স্বীকার করেন, ‘ওই সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনরত জেনারেল সিসিকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। কৌশলগত স্বার্থ থাকার কারণে পশ্চিমারাও এটি মেনে নয়।’ ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এমন স্বীকারোক্তিতে উপলব্ধি করা যায়, বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র নিয়ে কারা খেলা করছে এবং সন্ত্রাস ও মৌলবাদ শব্দগুলো ব্যবহারের পেছনে কাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনেতা এবং শক্তিশালী মিডিয়াগুলোর কণ্ঠে প্রায়ই ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা শোনা যায়। কিন্তু এই স্বাভাবিকীকরণ বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে? ন্যায় ও সঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলা হচ্ছে, নাকি এখানে অন্য কিছু রয়েছে? লক্ষণীয় বিষয় হলো, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বলতে তারা আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময় এবং রাজনৈতিক বৈরিতার প্রেক্ষাপটেও শত্রুকে গ্রহণ করার সংস্কৃতির বিস্তারকে বোঝাতে চাইছেন। এক্ষেত্রে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বলতে শুধু ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি এবং আধিপত্যবাদ ও বসতি স্থাপনের মধ্যে অত্যাচারীর সাথে মজলুমের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক উন্নয়নকেই বোঝানো হয়নি; উপরন্তু এ কথাও বলা হচ্ছে যে, যারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তারা স্বেচ্ছায়ই ইসরাইলের শরীর থেকে শত্রুর তকমা মুছে ফেলছে। আর যারা ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা তাদের গায়েই শত্রুর তকমা জুড়ে দিচ্ছে। যে সভ্যতায় এসব বিষয় বাস্তবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, সেই সভ্যতাকে মানুষের সভ্যতা বলে বিবেচনা করা যায় কিনা- সেই প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে উঠেছে।
তাই বর্তমান সভ্যতার শাসকরা যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে নসিহত করেন, তখন মনে হয় আমরা বোধহয় পরিহাসপূর্ণ এক পৃথিবীতে বসবাস করছি। জানি না, ন্যায়বঞ্চিত মজলুম মানুষগুলো কখন শঠতাপূর্ণ এই সভ্যতার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে। আমাদের চারপাশে কিংবা বিশ্ববাতাবরণে তেমন কোনো বাতিঘর লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে মজলুম মানুষ তো পৃথিবীর সব জনপদেই আছে। মানবিক মর্যাদার চেতনায় এবার বাতিঘর তাদেরই নির্মাণ করতে হবে। নিজেদের ছোট ভাবলে চলবে না। শাসকরা তাদের ছোট করে রাখলেও তারা আসলে ছোট নয়। ছোটরা ঐক্যবদ্ধ হলে অনেক বড় হয়ে যায়- শাসকদের চাইতেও বড়। ইতিহাসের এই বার্তা কখনো ভুলতে নেই।

মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ইস্ দুনিয়া মে সব চোর চোর


সম্ভবত পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নির্মিত হয়েছিল হিন্দি সিনেমা ‘ভাই ভাই’। সে সিনেমা আমি দেখিনি। তবে ছেলেবেলায় হাটের দিন কোথা থেকে নানা ঢঙের অদ্ভুত পোশাক পরে বিনোদন দিতে আসতো কিছু লোক। তারা নানা হিন্দি-উর্দু গান গাইতো। ঢোল-ডগরা, খোল-করতাল বাজাতো। নাচতো। আর আমরা গোল হয়ে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে সে গান শুনতাম। আমাদের জন্য সেটা একটা দারুণ মজাদার ব্যাপার ছিল। মুরুব্বিরা বলতেন, ওদিকে যাসনে। ওরা সব পকেটমারের দল। আমাদের পকেটে থাকতোই দু’এক পয়সা। তার আর পকেট মার কি হবে। আমরা যেতাম। গানওয়ালারাও বারবার সতর্ক করতেন : ভাই সাহেবেরা, মিয়া ভাইরা, দাদাবাবুরা, যার যার পকেট সাবধান। গান-বাজনা শেষ করে তারা খুব দ্রুত সন্ধ্যার আগেই সব গুটিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু পরে শোনা যেতো অনেকেরই পকেট কাটা গিয়েছে হাটের মধ্যে।
‘ভাই ভাই’ ছবিতে লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া বিখ্যাত গানও তারা গাইতো। ছবিটাও সম্ভবত পকেটমারদের নিয়েই তৈরি হয়েছিল। হিন্দি উর্দু ভাষা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা আমাদের ছিল না। কিন্তু যেসব শব্দ বাংলার কাছাকাছি, সেগুলো আমরা বুঝতাম। গানটির প্রথম চরণটি ছিলো এ রকম, ‘ইস দুনিয়া মে সব চোর চোর’। সিনেমাটির নায়িকা ছিলেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে হিন্দি ছবির সাড়া জাগানো নায়িকা নিম্মি। ঘাগড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই গান গেয়ে নাচতেন। আর তার দলের লোকেরা মানুষের পকেট কাটতো, মানিব্যাগ তুলে নিয়ে যেতো। ছবির অন্যান্য চরণ মোটামুটি এরকম : কেউ পয়সা চোর, কেউ মুরগি চোর আউর কেউ দিল কা চোর। ইস দুনিয়া মে সব চোর চোর। কেউ চুরি করে খাওয়ার পয়সার জন্য। কেউ বা এক আনা, দুই আনা। কেউ ছোট চোর, কেউ বড় চোর। কেউ রাতে ডাকাতি করে, কেউ সিঁদ কাটে। কেউ কেউ ফর্সা চোর, কেউ কেউ কালা চোর, আউর লাট সাহাব কা শালা চোর। ইস দুনিয়া মে সব চোর চোর। আমি দিল চুরির জন্য এসেছি। কোথায়ও কি এমন কোনো দিলওয়ালা চোর আছে? ইস দুনিয়ামে সব চোর চোর। আমরা খুব মজা পেতাম যখন খিলাড়িরা গাইতো, আউর লাট সাহাব কা শালা চোর- এই লাইনটি শুনে। সব চোর বুঝলাম। তাই বলে লাট সাহেবের শালাও চুরি করবেন?
এখন বাংলাদেশের অবস্থা ভাই ভাই ছবির চেয়েও করুণ। বাংলাদেশ মে সব চোর চোর। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক এবিএম মূসা টেলিভিশন টক-শোতে বলেছিলেন, সমাজের ভেতরে সর্বত্র চুরি একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তাই দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের দেখলে আমরা যেন তাদের ‘চোর চোর’ বলে ধাওয়া দেই। মূসা ভাই জীবিত থাকলে হয়তো জিজ্ঞাসা করতাম, মূসা ভাই, কাকে ধাওয়া দেব, এই সরকারের সবই যে ‘চোর চোর’। বাংলাদেশের পরিচয় এখন চুরি ডাকাতি ছিনতাই মুক্তিপণ খুন গুম অপহরণ। আর তাতে কে না যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর থেকে শুরু করে সকল সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা চেয়ারম্যান, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ নানা লীগ টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি দখলবাজিতে লিপ্ত। সবার কাছেই নারীরা শিশুরা অনিরাপদ। সাধারণ নাগরিকের কারও কাছে যাবার জায়গা নেই। এই চোরদের কাছে এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছে গোটা দেশবাসী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় আট হাজার কোটি টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সকল চোরা মিলে ‘মাত্র’ ৮০০ কোটি টাকা চুরি করতে পেরেছে। পৃথিবীর ব্যাংকিং ইতিহাসে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এভাবে টাকা চুরির ঘটনা এটাই প্রথম। এ নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় চলছে। কোনো বিখ্যাত গণমাধ্যম এমনও লিখেছে যে, চোরদের ফাউন্ডেশন বানানটি ভুল হওয়ার জন্য তারা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা চুরি করতে পারেনি। চোরদের এখন উচিত, নিজেদের পাছায় লাত্থি মারা। কিন্তু কী আশ্চর্য নির্বিকার ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি এক মাস নয় দিন এই বিশাল চুরির কথা গোপন রেখে হাওয়ার ভেতরে টাকা অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। কিন্তু হাওয়ায় কি আর চোরাই টাকা ওড়ে! ঐ ৮০০ কোটি টাকা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে চলে যায় ফিলিপিন্স আর শ্রীলঙ্কার ব্যাংকে। এ ঘটনা নিয়ে সেখানকার পত্রপত্রিকায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, তাও এক মাস পরে। তার আগে টাকা চুরি যাওয়ার পরও ফুরফুরে মেজাজে গবর্নর ড. আতিউর বিদেশে ভ্রমণ করতে থাকেন। শেষমেষ ভারতে চার দিনের প্রমোদ ভ্রমণ শেষে ১৪ মার্চ ঢাকা ফিরে আসেন। তার আগেই সব কিছু ফাঁস হয়ে যায়। সকল নিয়ম ভেঙে পরদিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। অশ্রুশিক্ত নয়নে প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার আগে আতিউর এক আবেগ-তাড়িত ‘বিদায় ভাষণ’ দেন। সেখানে ‘আমি যখন যাচ্ছি...’, ‘আমি যখন যাচ্ছি...’, ‘আমি যখন যাচ্ছি..’ এমনিভাবে তার ‘সাফল্যে’র এক কাল্পনিক ফিরিস্তি তুলে ধরেন। যা ছিল নিতান্তই বগি আওয়াজ। ভ্রমণ আর বক্তৃতা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে আতিউরের আর কোনো সাফল্য নেই। তবু তার পদত্যাপত্র নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন!
প্রথম প্রথম স্বাভাবিকভাবেই আতিউরকেই দূষলো সবাই। কিন্তু শাহবাগীদের এক গ্রুপ অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করলো। আর আস্তে আস্তে থলের বিড়াল বের হতে শুরু করলো। একটি ঘোর সরকার সমর্থক পত্রিকা ২০ মার্চ রিপোর্ট করলো যে, ড. আতিউর ৪ ফেব্রুয়ারি টাকা চুরি হওয়ার পর ৭ ফেব্রুয়ারি ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীকে জানান। অর্থাৎ ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হওয়ার একমাস আগেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও টাকা চুরির ব্যাপারে অবহিত ছিলেন। তারপরও তারা ‘যুক্তি করে’ চুপটি করে বসে ছিলেন। আশা ছিল বাতাসে ভেসে ভেসে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা আবার নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকে ঢুকে যাবে। এই ধোকা না বোঝার মতো বোকা নেই মানুষ।
পত্রিকাগুলো গোটা বিষয়টাকে সরকারি মর্জি মাফিক ধামাচাপা দেবার মিশনে লেগেছে। ঘটনা প্রকাশিত হবার পরপরই নাকি ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকে জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ যদি চুপ করে থাকে, তবে তারা চুরি যাওয়া টাকার পুরোটাই ফেরত পাবে। এ যেন স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মতো। কিংবা শ্রীপুরের আশ্চর্য বড়ি। গিললেই সর্ব রোগের সমাধান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর আর ও প্রধানমন্ত্রী এই ধোঁকায় বিশ্বাস করে চুপ করে রইলেন। আর গোটা টাকাটা ক্যাসিনো বা জুয়ার খেলাধূলা আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে চলে গেল হংকং। শ্রীপুরের বড়িতে কোনো কাজ হলো না। এখন ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। আর টাকাটা হংকং পাচার নিশ্চিত হওয়ার পর ‘সৎ সাহসী’ আতিউর পদত্যাগ করলেন। মিশন অ্যাকমপ্লিশড।
এরপর অর্থমন্ত্রী এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। গবর্নর আতিউরকে দায়ী করলেন এবং তিনি জানালেন যে এই টাকা চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা শতভাগ জড়িত। এমন কি প্রক্রিয়ায় নিউ ইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংক থেকে টাকা হস্তান্তরের আদেশ দেয়া হয়, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করেন। ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকেই কেউ এই কাজ করেছে। তারা তো ভেতরেই আছে। যাদের আঙুলের ছাপ দেখে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এই টাকা ছাড় করেছে। তারা তো ব্যাংকেরই কর্মকর্তা। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, তাদের আটক না করে ঘটনার ৪০ দিন পর অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নামমাত্র মামলা দায়ের করেছে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে। তাহলে এই আঙুলের ছাপওয়ালা কর্মকর্তারা কি আতিউরের মতোই? অর্থমন্ত্রীর চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী? এখন প্রমাণিত হচ্ছে তাই।
এরপর গত ২০ শে মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্র্বাহী সংসদে বৈঠক বসেছিল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে প্রধানমনস্ত্রীর নেতৃত্বেই। সেখানে আওয়ামী নেতারা একযোগে অর্থমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত কেন গবর্নর আতিউরের বিরুদ্ধে কথা বললেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে নিজেও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে রোববার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে একই ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নেতারা অর্থমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিা নীরব থাকেন। তিনি কোনো মন্তব্য না করে নেতাদের বক্তব্য শোনেন। তবে গবর্নর আতিউরের সমালোচনা করায় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিনকে ভর্ৎসনা করেন। পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরে লেনিন কেন এমন মন্তব্য করলেন তা জানতে চান প্রধানমন্ত্রী । এরপর প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংকের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ। তিনি অর্থমন্ত্রীরও কড়া সমালোচনা করেন। তাকে সমর্থন করেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। তারা একই সঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন। ড.মিজান বলেছিলেন, আতিউর বলির পাঁঠা হয়েছেন। অর্থাৎ আতিউরের অযোগ্যতার প্রতি পুরো সমর্থন জানান প্রধানমন্ত্রী নিজে।
এখন যেহেতু শেখ হাসিনা আতিউরের পক্ষে, অতএব চাপাবাজ কলমবাজের দল একেবারে কাছা দিয়ে নেমে পড়েছেন মুহিতের বিরুদ্ধে। তারা বলছেন, ক’টাই তো মাত্র টাকা। তা নিয়ে আতিউরের বিরুদ্ধে এত কথা বলার যৌক্তিকতা কি? এর আগে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে খেয়েছে চার হাজার কটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর কারসাজিতে লুট হয়ে গেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাংকের সব অর্ডার যদি পার পেয়েও যেত, তাহলে মাত্র আট হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হতো। সেটা আর কয়টা পয়সা। আবার ড. আতিউরের আকাশছোঁয়া যোগ্যতার ফলে মাত্র আট শ’ কোটি টাকা চুরি হয়েছে, তার জন্য এতো কথা কেন। মুহিতের কথায় যেমন ‘চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না’ সেখানে আট শ’ কোটি টাকা তো কানাকড়ির সমান। সুতারাং আতিউরকে নিয়ে এতো তোলপাড়ের কিছু নেই। আর সে কারণেই বেচারা আতিউরের শোকে নাকি টাকার শোকে প্রধানমন্ত্রীর চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছিল।
তাহলে আর বসে থাকা কেন? এবার জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা দিলকুশার লোকাল অফিস থেকে এফডিআরের অর্থ তুলে আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে তার কাছ থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। জনতা লোকাল অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজিব হাসান ধীর ধীরে ঐ শাখার এফডিআর অনুবিভাগে কাজ করে আসছেন। সেখানে বেশ আগে থেকে ভাউচার দিয়ে টাকা তুলছিলেন তিনি। এত দিন বিষয়টা কেউ বুঝতে না পারলেও গত রোববার ভাউচারে গরমিল পাওয়ায়, তা মিলিয়ে দেখতে গিয়েই বেরিয়ে আসে বিপুল টাকা চুরির কাহিনী। এরপর সোমবার রাজিব হাসানের ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে বস্তা ভর্তি টাকা উদ্ধার করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তার ড্রয়ার ভর্তি ছিল লাখ লাখ টাকা। দুই কোটি টাকা উদ্ধার করলেও তিনি ঠিক কত কোটি টাকা চুরি করেছেন তার কোনো হিসাব ব্যাংকের কাছে নেই। এখানেও আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, এই চোর কর্মকর্তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। কোনো জিডি বা মামলাও করা হয়নি। রাজিব আহসানের বাড়ি ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানায়। ৫ বছর আগে তিনি জনতা বাংকে যোগদান করেছেন। আর সর্বশষ সংবাদ হলো গত মঙ্গলবার এই রাজিব আহসানকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর না করে নিরাপদে বাড়িতে চলে যেতে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি টাকা চুুরির মামলা দায়ের করা হয়েছে। অর্থাৎ এই চোর রাজিব আহসান জনতা বাংকের সব প্রশাসন, আইন-শৃংখলা বাহিনী-সবার উপর অনেক বেশি শক্তিশালী। অতএব যে যেখানে আছেন ’হরি বোল’ বলে চুরি ডাকাতি দুর্নীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। কেননা ‘ইস্ বাংলাদেশ মে সব চোর চোর।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অর্থ কেলেঙ্কারি ॥ আতিউরের পদত্যাগ প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে অমিল


বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহার অপহরণ বা গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে। ইতোমধ্যে সকলেই জেনে গেছেন যে, তানভীর জোহার অন্তর্ধানের বিষয়টি একদিকে আতঙ্ক ও অন্যদিকে রহস্যের সৃষ্টি করেছে। এ সম্পর্কে তানভীরের চিকিৎসক স্ত্রী কামরুন্নাহার বলেছেন যে, তার স্বামী বুধবার রাত থেকে নিখোঁজ। স্বামীর ব্যাপারে ডায়েরি করার জন্য তিনি রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট, কাফরুল, কলাবাগান ও ভাষানটেক থানায় যান। কিন্তু কেউ তার ডায়েরি গ্রহণ করেনি। এটি অত্যন্ত রহস্যজনক। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে রাজধানীর কচুক্ষেত নামক স্থান থেকে। তার সাথে ছিল তার বন্ধু ইয়ামির আহমেদ। বন্ধুর সাথে বাড়ি ফেরার জন্য তিনি একটি সিএনজি ডাকেন। তখন সেখানে ৩টি মোটরগাড়ি এসে সিএনজিকে ঘিরে ফেলে। একটি গাড়ি থেকে মুখোশধারী কয়েক ব্যক্তি নামে। ওরা তানভীরকে একটি গাড়িতে তোলে এবং তার বন্ধুকে অন্য গাড়িতে তোলে। কিছুদূর যাওয়ার পর তানভীরের বন্ধু ইয়ামিরকে মানিক মিয়া এভিনিউতে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন আনুমানিক রাত ১টা থেকে দেড়টা। কিন্তু যে গাড়িটি তানভীরকে বহন করছিল সেই গাড়ি আর ফেরত আসেনি। গতকাল শনিবার পর্যন্ত পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক তানভীর জোহার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আমরা এ সম্পর্কে কিছুই জানি না এবং এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে যে প্রশ্নটি এসে দাঁড়ায় সেটি হলো- তানভীর জোহা সাইবার বিশারদ হিসেবে সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করছিলেন। এই বিষয়টি মোটেও আমাদের বোধগম্য নয় যে, যিনি এই বিশাল অর্থ কেলেঙ্কারির তদন্ত টিমের সাথে জড়িত ছিলেন তাকে অপহরণ করা হয়েছে কেন? তার স্ত্রী ৪টি থানায় ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো থানা তার জিডি গ্রহণ করেনি কেন? যিনি অন্যতম হাকিম তাকেই যদি আসামী করা হয়, তাহলে সেই জট খোলে, কার সাধ্য? ঐদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে যে, তানভীর জোহা কোনোকালেই ঐ মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কোনো বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না এবং এখনো নেই। পক্ষান্তরে তানভীর জোহা বলেছেন যে, তিনি ঐ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি বিভাগের পরিচালক এবং সেই সুবাদে এ সম্পর্কে গঠিত অন্যতম তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই কিছু তদন্ত কাজ করেছেন। সরকার এবং তানভীর জোহার বক্তব্য পড়লে মনে হয় এরা যেন শুধু দু’টি পক্ষই নয়, যেন তারা ২টি বিপরীত মেরু। একটি উত্তর মেরু এবং আরেকটি দক্ষিণ মেরু। সুমেরু এবং কুমেরুর এই গোলক ধাঁধাঁ থেকে জনগণকে বের করে আনার উদ্দেশ্যে সরকার বিষয়টি আরো স্বচ্ছ করবেন বলে মানুষের প্রত্যাশা।
॥ দুই ॥
এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিতের একটি সাক্ষাৎকার নতুন কতগুলো গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে গত শুক্রবার দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদ হিসেবে। তিনি বলেছেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই জড়িত। তার কথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এই কা- ঘটতে পারতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক গবর্নর আতিউর রহমানের পদত্যাগকে এই বলে প্রশংসা করেছেন যে, আতিউর রহমান বীরের বেশে চলে গেছেন। পক্ষান্তরে ঐ সাক্ষাৎকারে আব্দুল মুহিত বলেছেন যে, আতিউর রহমান পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আতিউর রহমান তার পদত্যাগপত্রে এবং পদত্যাগ পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে তার সাফল্যের এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন। ঐ ফিরিস্তির এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, ৭ বছর আগে তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে গবর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৬০০ কোটি ডলার। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে সেই রিজার্ভ আজ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৬০ কোটি ডলার। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত ব্যাংকের সাবেক গবর্নরের এই দাবিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আতিউর রহমানের অবদান প্রায় শূন্য। রিজার্ভ বৃদ্ধির কৃতিত্ব মোটেই আতিউর রহমানের নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, রিজার্ভ বৃদ্ধির কৃতিত্ব আতিউর রহমানের নয়, এই কৃতিত্ব প্রবাসী শ্রমিকদের। এখানে আতিউর রহমান যেটুকু করেছেন, সেটি হলো জনসংযোগ। যেখানে আতিউর রহমানসহ অনেকেই বিরাট আশা করছেন যে, লুণ্ঠিত অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে, সেখানে অর্থমন্ত্রী বলছেন যে, লোপাট হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সেটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তিনি আরো বলেন, আতিউর রহমান সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তিনি একটুও লজ্জিত হননি। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন বাড়িতে এবং দুই দফা। একবার পদত্যাগের আগে, আরেকবার পদত্যাগের পর। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, দু’জন ডেপুটি গবর্নরের চাকরি গেছে আতিউরের কারণে। আতিউর বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি একা দায়ী নন। দু’জনের বাইরে আরও কয়েকজনের চাকরি খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তা আর হয়নি, হবেও না। মন্ত্রী আরো বলেন, টাকা আসলে উদ্ধার হবে কিনা, আমি নিশ্চিত না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কিছু টাকা পাওয়া গেছে বরং শ্রীলঙ্কার কল্যাণে। আতিউর রহমান সংকটটির গভীরতাই বুঝতে পারেননি। আমার মনে হয়, তিনি চিন্তাই করতে পারেননি যে, এই ঘটনাটি এত বড়। খবর পাওয়ার পরেও তিনি দেশের বাইরে বাইরে ঘুরেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আতিউরের অবদান প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আতিউরের অবদান প্রায় শূন্য (অলমোস্ট জিরো)। তিনি শুধু পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন আর লোকজনকে অনুরোধ করেছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্য তাকে সুযোগ দিতে ও দাওয়াত দিতে। এখন বেরোচ্ছে এগুলো। আতিউর রহমান বলার চেষ্টা করেছেন যে, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, এগুলো ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত বিষয়। বেসিক ব্যাংক পুরনো বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকই তো বেসিক ব্যাংকের সব কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিল।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না। তবে ব্যবস্থা ঠিকই নেয়া হবে।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারি উকিলরা বিষয়টিতে খুব একটা মনোযোগী নন। দুই দিন আগেও তিনি বলেছেন, প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের কৃতিত্ব তার। রিজার্ভের কৃতিত্ব মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের।
মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় যে, রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে ছুটির দিন শুক্রবারে, তাই পদক্ষেপ নিতে দেরি হয়েছে, আতিউর রহমানের এমন ব্যাখ্যাকে তিনি কীভাবে দেখবেন, উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। শুক্রবারেও লোক থাকবে না কেন? ফোন ধরা ও তথ্য দেয়ার জন্য ছুটির দিনেও লোক থাকা উচিত।
মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় যে, আপনার কি মনে হয়, এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও কি যোগসাজশ রয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই। শতভাগ জড়িত। স্থানীয়দের ছাড়া এটা হতেই পারে না। ছয়জন লোকের হাতের ছাপ ও বায়োমেট্রিকস ফেডারেল রিজার্ভে আছে। নিয়ম হলো- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ষষ্ঠ ব্যক্তি পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্লেটে হাত রাখার পর লেনদেনের আদেশ কার্যকর হবে।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, আতিউর আমার নিয়োগ করা গবর্নর, অথচ তিনি সবসময়ই বলে এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি পদত্যাগপত্রও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছেন। এটা তিনি পারেন না। তার পদত্যাগপত্রটিও হয়নি। আমাদের দেশে তো ওইভাবে নিয়ম-কানুন মানা হয় না, অন্য দেশ হলে তো আমার অনুমতি ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাই করতে পারতেন না।
অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এটা কি ‘চেইন অব কমান্ড’ সমস্যা? উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘অবশ্যই। তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেননি, আমি নিয়োগ দিয়েছি। আমার কাছেই পদত্যাগপত্র দিতে হবে’’।
রিজার্ভে অর্থ চুরির বিষয়টি নিয়ে সরকারকে যতটা সোচ্চার হতে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতের টাকা লুটপাটের সময় সেগুলোর ক্ষেত্রে অতটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি, কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘আসলে অন্য লুটপাট ধরার বিষয়ে কোনো নির্দেশক (ইনডিকেটর) নেই, যার মাধ্যমে তথ্য পেতে পারি।’’
এনবিআরের চেয়ারম্যান সঠিকভাবে কাজকর্ম করছেন না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান এত বক্তৃতা দেন যে তাকে আসলে তথ্য সচিব বানিয়ে দেয়া উচিত। সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর একান্ত সচিব ছিলেন তো, তাই তারই প্রভাব পড়েছে এনবিআর চেয়ারম্যানের ওপর। এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে আছেন শক্তিশালী আমলা। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, তাকে নিয়ে কাজ করা মুশকিল। তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
॥তিন॥
বিষয়টি কত দিন ধরে ঝুলবে সেটা আমরা জানি না। কিন্তু একটা দেশের অর্থমন্ত্রী যখন দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসাররা অবশ্যই জড়িত এবং যখন দেখা যায় যে, তার কথাটি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হচ্ছে না, তখন তখন বুঝতে হবে যে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
তাই যদি না হবে তাহলে এতগুলো ঘটনা ঘটলো, এত হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো, অথচ কোনো ব্যক্তির সাজা হলো না কেন? জেএসডি নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেছেন যে, হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক এবং বেসিক ব্যাংকের কথা মানুষ ভুলে গেছে। বড় সাহেবরা কি চাচ্ছেন যে, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক প্রভৃতি ব্যাংকের মতো আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুকুর চুরির কথাও ধীরে ধীরে ভুলে যাই?
আসিফ আরসালান

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নিরাপত্তা হুমকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাংলাদেশ


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ হ্যাকড এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচাইতে আলোচিত ঘটনা। ব্যাংকিং সেক্টরে সারা পৃথিবীতে এটাই সম্ভবত সবচাইতে বড় হ্যাকিং। যা বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে স্বাভাবিকভাবেই মারাত্মক অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে ফেলবে বলে মনে করছেন দেশী-বিদেশী বিশ্লেষকরা।
পৃথিবীর বিখ্যাত বাটপারদের জুয়ার আসর ফিলিপাইনে আজ গড়াগড়ি খাচ্ছে বাংলাদেশের গণমানুষের রক্ত ঘামে অর্জিত কোটি কোটি টাকা। বিদেশীরা যখন ৮০৮ কোটি ডলার নিয়ে ফুর্তি করছে তখন আমরা উদ্ধার নিয়ে অপরাজনীতি করছি; দোষারোপ করছি একে অপরকে। পদত্যাগ করে দায়িত্ব আড়াল করার চেষ্টা করছি।
এ দৃশ্য আজ জাতির অংশ হিসেবে যখন অবলোকন করি তখন নিজেদের স্থির রাখার অবিরাম প্রচেষ্টা অস্ফুট আর্তনাদে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। যাদের কাছে রক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছিলাম আজ তাদের দিকে তাকাতে গেলে একটি কুৎসিত ও বীভৎস চেহারা দেখতে পায়। এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দিশেহারা আমরা।
অন্যদিকে নিরাপত্তা ইস্যুতে অষ্ট্রেলিয়ার পর এবার ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি ফ্লাইটগুলোতে কার্গো পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ব্রিটিশ পরিবহন দফতর। একই সাথে অতিদ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে যাত্রী বহনকারী বিমানও বন্ধ করে দেয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে দেশটি।
সম্প্রতি চলমান হ্যাকড হওয়া অর্থ ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হুমকির ঘটনা দুটি অবশ্যই বাংলাদেশের জাতীয় প্রেক্ষাপটে অশুভ ইঙ্গিত বহন করছে। আর এ প্রেক্ষিতে পর্যালোচনার টেবিলে বসে হ্যাকিংয়ের এ ঘটনাকে দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করছেন অর্থনীতি বিশারদরা।
 কারণ দেশের বেসরকারী সেক্টরের ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যে চারশ কোটি টাকা সিকিউরিটি জামানত হিসেবে গচ্ছিত রাখে তা দেশের মানুষের জমানো সঞ্চিত অর্থ। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে বিনা সুদে নেয়া ধারের টাকাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আর এই অর্থই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের একাউন্টে জমা রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যা ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের বার্তা বা সংকেত ব্যবহার করে ৩৫টি অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ বা অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফট পদ্ধতি ব্যবহারের ব্যাংক অফিসে কর্মরত আট কর্মকর্তা ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবারও কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিলেন। ওই কার্যালয়ে এসে তাঁরা কম্পিউটার খুলতে পারেননি। কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত প্রিন্টারগুলোও অকেজো দেখতে পান। কিন্তু তাঁরা ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে এই ‘বিপদ সংকেতটি’ পৌঁছাননি। আর এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে চলে যায় শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে। এরপর ফিলিপাইনের ‘দ্য ডেইলি ইনকোয়ারার’ পত্রিকায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
ঘটনার দায় কাঁধে নিয়ে গত ১৫ মার্চ বেলা সোয়া ১১ টায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর পরই পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। যাকে সাধুবাদ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। (সূত্র: শীর্ষ নিউজ, ১৫ মার্চ)
বাংলাদেশের মতো একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে এতবড় অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা যখন অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা ঠিক সেই মুহূর্তে অর্থমন্ত্রীর ‘সব ঠিক হয়ে গেছে মন্তব্য জাতির কাছে বোধগম্য মনে হয় না। তাহলে কি গবর্নরের পদত্যাগের সাথে সাথেই হ্যাকড হওয়া আটশো আট কোটি ডলার ফিরে এসেছে? এ প্রশ্নের উত্তর অর্থমন্ত্রী কি দিতে পারবে?
বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অর্থ হাকডের এ ঘটনা বিদেশী চক্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ উচ্চপদস্থ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগসাজশে হতে পারে।
এছাড়া আরোও উল্লেখ করা হয়, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারে সরকারের দুই মেরু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় একে অপরকে দোষারোপ করে পাচারকারী গোষ্ঠীকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন বলে প্রশ্ন উঠেছে।
 তবে ইতিমধ্যেই সাবেক গবর্নর ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবিরকে। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ১৮ মার্চ দেশে ফিরলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকে নিয়োগ দেয়া হবে। এছাড়া অন্তর্বর্তী গবর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ব্যাংকের ডেপুর্টি গবর্নর আবুল কাশেমকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টীম গঠন করেছে সরকার। এছাড়া র‌্যাবের এ্যাডিশনাল ডিআইজি কর্ণেল জিয়াউদ্দিন আহসানের নেতৃত্ব আরো একটি তদন্ত দল কাজ করছে। কিন্তু কোন তদন্ত কমিটিই এখন পর্যন্ত জড়িত সন্দেহে দেশীয় কোন সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। অথচ দেশী চোর ছাড়াই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশী চোররা নিয়ে চলে গেল এটি একটি নির্বোধ ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
এমন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আর একটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। হ্যাকডর এ ঘটনা তদন্তে সরকারের পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে ভারতীয় নাগরিক সাইবার বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ফায়ারআইকে। আর এই নির্দেশনা গত ৭ মার্চ সদ্য বিদায়ী গবর্নর আতিউর রহমান একটি অফিস আদেশ জারি করেন। যেখানে উল্লেখ করা হয় র‌্যাকেশ আস্তানার মৌখিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সকল বিভাগ, ইউনিটে ও সার্ভারসমূহে তার সরবরাহকৃত সফটওয়্যার (সিকিউরিটি প্যাচ) ইনস্টল করা হোক।
আর এ আদেশের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান, বাংলাদেশের খ্যাতিমান অর্থনীতি বিশারদরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন ওনার (রাকেশ আস্তানা) মৌখিক পরামর্শে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল পিসিতে ও সার্ভারে সফটওয়্যার বসানো হয়েছে। ভিনদেশি একজন নাগরিকের কাছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দেশের আর্থিক খাতের সকল নিরাপত্তা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এটা দেশের আর্থিক খাতের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।’
এদিকে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, নিউইয়র্কের রিজার্ভ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৮৫ কোটি ডলার ঠেকানো গেছে। তবে হদিস মিলছে না চুরির সিংহভাগ অর্থের। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট ম্যাসেজিং সিস্টেম হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে হ্যাকডের মাধ্যমে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার প্রসেস হয়ে ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় চলে যায়। এর মধ্যে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকে সরিয়ে ফেলা হয়।
সামগ্রিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি নিরাপত্তার ঘাটতির কারণেই রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম নিজেও এই অদক্ষতার কথা সাংবাদিকদের বলেছেন। (দৈনিক যুগান্তর, ১৪ মার্চ ২০১৬)
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যেমন বিষয়টি সময়মতো জানাননি, তেমনি বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লুকিয়ে রেখেছে সরকারের প্রায় সব পক্ষের কাছ থেকেই। অর্থমন্ত্রীকে জানানো হয়নি, জানতেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও। ফলে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় মুখোমুখি অবস্থানে। শুদ্ধ ভাষায় দুই সরকারের যুদ্ধ।
হ্যাকিংয়ের ঘটনায় যখন কাঁদছে গোটা দেশ সেই মুহূর্তে সংবাদ এল বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৪,১৫১ কোটি টাকা।
এছাড়া দীর্ঘদিন লাভে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সময়ে নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ২,৬২২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৪-১৫ এর বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
 বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বিপুল অর্থ লোকসানের খবর এমন সময় প্রকাশ হলো যখন নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ডলারের বেশি অর্থ লোপাটের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে।
ফরেক্স রিজার্ভ হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিদেশি মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে বেচাকেনা থেকে লোকসান হয়েছে ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বিদেশি মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে অর্থবছর শেষে লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। স্বর্ণ ও রৌপ্যের পুনর্মূল্যায়নের ফলে লোকসান হয়েছে যথাক্রমে ৪৮২ কোটি ও ৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ফলে রিজার্ভ থেকে লোকসান দাঁড়িয়েছে মোট ৪,১৫১ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, মুদ্রার অবমূল্যায়নে এমনটি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে ডলারের দাম তো সেভাবে কমেনি। বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন অনেক হয়ে গেছে, অর্থনীতিও বড় হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের অফিস সময়ে ট্রেড করে তো ভালো কিছু করা যাবে না। সপ্তাহের সাতদিনই ২৪ ঘণ্টা ফরেক্স ট্রেড খোলা থাকা উচিত। এজন্য পৃথক প্রশিক্ষিত জনবলও থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে যে ধরনের ব্যাবস্থাপনা চলছে, তা দিয়ে তো ভালো কিছু আশা করা যায় না। ফলে লোকসান হবেই। তবে বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতেই হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট মুনাফা হয় ৫৯৮ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ৫৩০ কোটি, ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে ৬৩৪ কোটি, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ৭৭০ কোটি, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ৭৮৬ কোটি ও ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ৭৯৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়। ২০০০-০১ অর্থবছরে ৭১৫ কোটি, ২০০১-০২ অর্থবছরে ৯৪৯ কোটি, ২০০২-০৩ অর্থবছরে ৭৬০ কোটি, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৯৩৯ কোটি, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ১,৮৯১ কোটি, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ২ হাজার ৪০৪ কোটি, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৩,৪৬০ কোটি, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৩,১৫২ কোটি, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২, ৫০৫ কোটি, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১,২৮৭ কোটি, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৮,৮৪২ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭,০৩১ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩০৪ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩, ৩৫১ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়।
তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নিট লোকসান দাঁড়ায় ২,৬২২ কোটি টাকা।
 কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নিট মুনাফা হিসাব করা হয় রিজার্ভের মুনাফা বা লোকসান ধরে। তবে চূড়ান্ত হিসাবে রিজার্ভের হিসাব থাকে না। ফলে সরকারকে মুনাফা ও কর্মকর্তাদের বোনাস দেয়া সম্ভব হয়। চূড়ান্ত হিসাবে রিজার্ভের হিসাব থাকলে মুনাফা বা বোনাস দেয়া সম্ভব হতো না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে ফরেক্স ট্রেড হয় শুধু অফিস সময়ে। এ সময় পৃথিবীর বড় অর্থনীতির দেশগুলোয় ট্রেড বন্ধ থাকে। ফলে লোকসান আরো বেড়েছে।
ওই কর্মকর্তারা জানান, ২৪ ঘণ্টা ট্রেডিং চালু থাকলে রিজার্ভে হ্যাকিংয়ের ঘটনাও রোধ করা যেত। কারণ বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক থেকে আসা অ্যালার্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে রবিবার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন অবশ্য বলেছেন, যখন রিজার্ভ থেকে ভালো মুনাফা হয়েছিল, তখন তো ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার বিষয়টি আসেনি। কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। বিশ্বব্যাপী সুদের হার কমছে, অনেক দেশে মাইনাসও হয়ে গেছে। স্বর্ণের দামও কমছে, বিনিয়োগে থাকা অন্যান্য মুদ্রার মানও কমছে। ফলে রিজার্ভ থেকে লোকসান হয়েছে। তবে বিশ্বের সঙ্গে সময় মিলিয়ে ফরেক্স ট্রেড অফিস সময়ের বাইরেও চালু থাকা প্রয়োজন।
হ্যাকিং এর ঘটনায় যখন শোকে আচ্ছন্ন গোটা দেশ সেই মুহূর্তে ঘোষণা এল যুক্তরাজ্য তাদের দেশে বাংলাদেশের পণ্যবাহী কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর ফলে যুক্তরাজ্যের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন দেশী তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। গত ১০ মার্চ জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এমন শঙ্কার কথা জানান তিনি।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, যুক্তরাজ্য আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। এ বাজারে কোন রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়–ক তা কাম্য নয়। যখনই আমরা নতুন নতুন বাজারে অনুপ্রবেশ করছি, তখনই একটি তৈরি হওয়া বাজার পেছনের দিকে হাঁটবে তা কখনই কাম্য নয়।
তবে এর মধ্যেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেছে ব্রিটিশ প্রতিনিধি দল। যার প্রেক্ষিতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ইস্যুতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে বদলির পরদিনই বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও সরিয়ে দেওয়া হলো।
এদিকে নিজের দেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা দেশের নিরাপত্তা ব্যাবস্থাকে আরো বেশী হুমকির মুখে ফেলছে বলে মনে করেন সুশীল সমাজের বোদ্ধারা।
তাছাড়া রাজনৈতিক সংঘাত, হানাহানি, বিভক্তি, দুর্বল অর্থনীতি প্রভৃতি অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশকে অনেকবেশী নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। আর এগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার একটাই পথ গণতন্ত্রের পথে হেঁটে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কারণ একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা কখনই দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ সাধন করতে পারে না।
লাল সবুজের পতাকা যেমন ছিনিয়ে এনেছিল এদেশের সূর্য সন্তানেরা ঠিক তেমনি ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা এদেশের পতাকার নিরাপত্তা বিধান করা সরকারসহ প্রতিটি নাগরিকের একান্ত কর্তব্য।
পরিসমাপ্তি দেওয়ার আগে একটি কথা উল্লেখ করতে হবে, ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ান বোনার্পোট মিসর আক্রমণ করতে আসার পিছনে তার কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, আমি মিসরের সিনাই পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে দেখতে চাই। অর্থাৎ মিসর এমন একটি রাষ্ট্র যার চতুর্দিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অবস্থান। সুতরাং ভৌগোলিক ও পারিপার্শি¦ক কারণে মিসরের ক্ষমতা গ্রহণ করা ছিল নেপোলিয়ানের সুপরিকল্পিত মিশন।
ঠিক তেমনি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে নিরাপত্তার অজুহাতে কেউ যেন গ্রাাস করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। একই সাথে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হ্যাকিংয়ে দেশী-বিদেশী চক্র যেই জড়িত থাক তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
হাসান ইলিয়াছ তানিম 

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজকোষ লুট যুক্ত হলো দুর্নীতির নতুন মাত্রা


অবশেষে রাজকোষেও লুণ্ঠন। এমন দুঃসংবাদ দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে উঠে এসেছে। বর্তমানে দুর্নীতির মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশ। কোন প্রান্তে নাই দুর্নীতি। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ঊর্ধ্ব-অধঃ এমনকি পাতালেও দুর্নীতির নিনাদ ধ্বনিত হয়। ব্যাংকের পর ব্যাংকের থলি ফোকলা করে ফেলছে দুর্নীতির ‘ইঁদুর’ সম্প্রদায়। দু’চার দিন হৈচৈ, যদি কোনোভাবে খবরটি বাইরে চলে আসে। এমতাবস্থায় শুরু হয় সলাপরামর্শ, কৌশল আবিষ্কার। দেশবাসীর মগজ থেঁতলা করা অন্য একটি কাণ্ড দিয়ে লুণ্ঠনের খবরটি কবরস্থ করা। এই সিলসিলাই যেন চলছে অহর্নিশ। বুুদ্ধি-বিবেচনার তারিফ করতেই হয়। বুদ্ধি না থাকলে এমনটা করাও অসম্ভব। ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা’ কবির নাম অজানা। তবে কবি যদি জীবিত থাকতেন বা থাকেন তিনি দেখতেন তার চিন্তা অনেকটাই অসার। ধরা পড়লেও কুচপরওয়া নেহি। বরং পুরস্কার তার পদপ্রান্তে এসে লুটোপুটি খায়। কেউ বিবেকবান আবার কেউ দেশপ্রেমী এমনসব উপাধিতে আচ্ছাদিত হয়। 
ক. চমৎকার দেশ, কী চমৎকার সমাজ। রাজকোষ, লুণ্ঠনের ব্যাপারটাও যথাপূর্বং তথাপরংই যে হবে না তা হয়তো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া ‘উদর পি-ি বুধোর ঘাড়ে’ এ রকমের একটি প্রবাদ তো আছেই। খবর মাধ্যমগুলোর বাক্যবিন্যাসে এমন আলামতই যেন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। রাজকোষ বলে কথা। রাজা, রাজপরিবার এবং রাজ দরবারের উচ্চ পর্যায়ের অমাত্যবর্গ এ ব্যাপারে অধিক ওয়াকিফহাল থাকেন। তাছাড়া মুরগির খোয়াড়ে যদি শিয়াল পাহারাদার নিযুক্ত করা হয় তবে তো মুরগির ভবলীলা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা বাড়বেই। চোর পালালে নাকি বুদ্ধি বাড়ে। এমন বাড়ন্ত বুদ্ধিতে কতটা সুফল আসে জানাটা মুশকিল হয় প্রায়শই। এখানে বুদ্ধির বিভাজনটাই লক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োগটা সুবুদ্ধির না কুবুদ্ধির। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব, রাজকোষের যে কক্ষে অতি গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদান হয় সেসব তথ্যও নাকি লোপাট। মাশাআল্লাহ। স্বীকার করতেই হবে অতি বুদ্ধিমান ‘চোরের’ কবলে পড়েছে রাজকোষ। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলেন, অপরাধীরা নাকি অপরাধের কিছু না কিছু আলামত ফেলে যায়। যা থেকে ধরা পাড়ে চোর বা অপরাধী। তবে যারা ধরবেন বা ধরার দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল সমস্ত বিষয়টি। সুবিবেচনা এবং কুবিবেচনা দেশবাসী অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বিজয়ের পাল্লাটি কোন দিকে ঝুলে।
খ. দুর্নীতি দুর্ভাবনা দুঃস্বপ্ন আর দুঃসময় যেন দেশ এবং জনগণের ভবিতব্য। জীবন বিনাশের খবর তো বর্তমানে পান বিড়ি থেকেও সুলভ। লাশ মিলছে ক্ষেত খামারে, আবর্জনার ডিব্বায়। আইনের লোকদের বন্দুক যুদ্ধ তো একটি মশহুর শব্দ। প্রায় প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় দেখা মিলে। পাঠক এমন খবর পাঠ করে, সন্দেহের চোখে। গ্রামের একটি প্রবাদ আছে ‘কার গলা কে কাটে ধুলায় অন্ধকার। বাংলাদেশেরও এমনটাই অবস্থা। অন্ধকার যেন কাটতেই চাচ্ছে না। দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে নতুন উপসর্গ। শিশু নিপীড়ন এবং হত্যার মহাযজ্ঞ। মা হত্যা করছে প্রিয় সন্তান। মানুষের মন-মানসিকতা কতটা নি¤œগামী হলে সমাজে এমনটা ঘটতে পারে। অপসারিত হচ্ছে বিবেক-বিবেচনা। বলা যাবে না। শিক্ষার অভাবে এই দৃশ্য দেশের। তেমনটাতো নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতজনরাই ঘটাচ্ছে অঘটন। দুর্নীতিবাজদের অধিকাংশই তো শিক্ষার উচ্চতর ডালটিতে বসে থাকে বা আছে। তাই শিক্ষা কোনো ফ্যাক্টর নয়। শিক্ষিত হলেই যে সাধু সজ্জন বনে যাবে তা নাও হতে পারে। হয়ও না বেশিরভাগ সময়। কারণ ইদানিং পাঠ্যসূচিতে যা থাকে তা একজন শিক্ষার্থীকে সুমানুষরূপে গড়ে তুলতে যথেষ্ট নয় বরং এর অন্তরায়। ভুল শিক্ষা অসত্য ইতিহাস আর অতিকথন চর্বন করতে করতে একটি শিশু বেড়ে উঠে। তাই পরবর্তী জীবনে যা হবার তাই হয়। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়। এই নিমজ্জন থেকে উদ্ধারে যা সহায়ক শক্তিরূপে কাজে আসতে পারে সেই নৈতিক শিক্ষা পাঠক্রমে রাখা হয় না। অসত্য থেকে সত্যকে কিভাবে বিভাজিত করতে হয় সেরকম শিক্ষা থাকে অনুপস্থিত। তাই জাগ্রত হয় না বিবেক-সুবিবেচনা। এছাড়া যারা শিক্ষা দেন তাদের বর্ণচোরা স্বভাবে শিক্ষার্থীগণ হয় বিভ্রান্ত। মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশের সমাজপতিদের মগজেও পচন ধরেছে। যার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়। উড়ে যাচ্ছে মায়া-মমতা। কেবল খুনাখুনি নয় শিশুহত্যা চলছে অবলীলায়। চুরি ডাকাতি আর দুর্নীতি আছড়ে পড়ছে সমগ্র জাতির বিবেক বিবেচনায়। অপসারিত হচ্ছে সত্য, অধঃপতিত হচ্ছে নীতিনৈতিকতা। সুসম্পর্কের বিপরীতে উথলে উঠছে হিংসাবিদ্বেষ। যে স্বভাবগুলো একটি জাতির অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। ইতিহাস এমন পাঠই দেয়। আফসোসের খবর হলো সঠিক ইতিহাস পাঠ থেকেই দূরে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলছে বর্তমানে। দেশ এবং সমাজের শীর্ষে যারা অবস্থান নেয় কি ক্ষমতাবান কি বুদ্ধিমান(?) তাদেরই অনাচার এবং কুবুদ্ধি একটি উজ্জীবিত দেশ এবং জাতির অধঃগতির জন্য যথেষ্ট। এমন কি ধ্বংসও অনিবার্য হয়ে উঠে আসে কোনো কোনো সময়। যা আলামত দৃষ্ট হচ্ছে চারপাশ ঘিরে তাতে তো বাড়িয়ে তুলছে বিবেকবানদের দুশ্চিন্তা। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক অতিক্রম করে এসেও কমলো না জাতির হা-হুতাশ, থামছে না আতংক। সুশাসন সুবিচার এবং সুবিবেচনার যেন খরা বইছে। যে কারণে স্নেহময়ী মা তার প্রিয় সন্তানকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। কাঁপছে না হৃদয়। পশুও সন্তানকে আগলে রাখে জীবন দিয়ে। পশুর কাছে মানুষের পরাজয়। ডানে বাঁয়ে নজর ঘুরালে এমন দৃশ্য দৃশ্যমান সমাজের কোণাকানছায়। সুবিবেক আর সুবিচার সমাজ থেকে যেন অপসারিত। যার প্রতিক্রিয়া ভয়াবহরূপে দেশ ও জাতিকে আলোড়িত করছে। লুণ্ঠিত হলো রাজকোষ যেখানে প্রধান পাহারাদারকে জবাবদিহিতায় আনা উচিত, পরিবর্তে মিলল বিবেকবান উপাধি, সাথে সাথে ফিরত পেল পুরনো চাকরিও। হায়রে বিচার বিবেচনা। এমনটাই তো নিয়ম বাসাবাড়ি বা অফিস আদালতে কোনো অঘটন ঘটলে প্রথম সন্দেহের আওতায় আনা হয় বাড়ির দারোয়ান এবং প্রধান দায়িত্ববানকে। এখানে ঘটলো ভিন্ন আয়োজন। সবখানে রাজনীতির প্রলেপ শুভ ফল বয়ে আনে না। অপরাজনীতি এবং অপবিবেচনা দেশ ও সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। অপরাধী চিহ্নিত করতে গেলেও প্রয়োজন সততা এবং সত্যের প্রতি অনুগত মন। কিন্তু মুশকিলের বার্তা হলো সততা এবং সত্য নামক শব্দ দুটি বর্তমানে অন্ধকারে নিমজ্জমান। এমনটা না হলে দুর্নীতির হস্ত রাজকোষ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারতো না। এই দুঃসাহসের কারণ ক্ষমতাবানদের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি। রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকতে পারলেই হলো, তখন সাতখুনও মাফ, রাজকোষ লুটতো কোনো ব্যাপারই নয়। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে ঠেকে।
গ. দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাবনা দেশ ও সমাজের সদর অন্দরে সদর্পে হাঁটছে। এই বলদর্প হাঁটা রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নাই, আয়োজনেও কেউ এগিয়ে আসছে না। সাহসী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বড় বেশি অভাব। দেশ, সমাজ এবং চরিত্র বিধ্বংসী এতো কিছু ঘটছে কিন্তু ঠোঁটে আঙ্গুল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের। যারা নিজেদেরকে জাহির করেন বুদ্ধিমান বলে। কবি সাহিত্যিকদের কোলাহলও হঠাৎ শব্দহীন। কোনো জাতি যখন সর্বদিক দিয়ে নিঃস্ব হবার পথে এগোতে থাকে তখন নাকি এ ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করে। এমনি পরিস্থিতির মুখোমুখি কি দেশ ও জাতি? সত্যের প্রতি অনুগত না থাকলে যে চিত্র অংকিত হয়, ক্ষমতা আর লোভ লালসার রাজনীতির কাছে নিঃশর্ত প্রণতি জানালে যেরকম দৃশ্য দৃশ্যমান হয় ঠিক তেমনটাই ঘটছে দেশে। এক শ্রেণীর কবি সাহিত্যিক এবং বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের আচরণ সে রকমেরই ছবি তুলে আনছে নিরীহ জনগণের কাছে। ঘরে আগুন লেগেছে ওরা নির্বিকার। আনন্দ ফুর্তিতে মগ্ন। ওদের আচরণ দেখে লজ্জায় লজ্জারও যেন আনত মুখ।
সাজজাদ হোসাইন খান 

বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কারও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই


বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার উধাও করে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরো জটিল হতে শুরু করেছে। সেইসাথে একদিকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের ভূমিকা নিয়ে যেমন অসংখ্য প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি তদন্ত, বিচার এবং শাস্তির ব্যাপারেও দেখা দিচ্ছে গভীর সংশয়। প্রসঙ্গক্রমে বেশি আলোচিত হচ্ছে গবর্নর আতিউর রহমানের আকস্মিক পদত্যাগ এবং সরকারের কিছু পদক্ষেপ। কারণ, কোনো রকম কারণ না দেখিয়ে এবং ব্যাখ্যা না দিয়েই গত সোমবার হঠাৎ পদত্যাগ করেছেন গবর্নর আতিউর। তিনি অবশ্য পরদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। বলেছেন, তিনি নাকি কিছুই জানতেন না এবং জানার পর নাকি ‘পাজল্ড’ তথা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন! এটা নাকি তার জন্য ছিল ‘ভূমিকম্পের’ মতো একটি ভয়ংকর বিষয়। ড. আতিউর আরো একটি তথ্যও প্রকাশ করেছেন। সে তথ্যটি হলো- অর্থ পাচারের ঘটনা গত ৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত হলেও তিনি তা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেননি এবং জানার পর পর ১ মার্চই প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। এখানে ঘটনাক্রমের তারিখগুলো লক্ষ্য করা দরকার। কারণ, সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জানার পরও দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন ১৪ মার্চ তারিখে। আর গবর্নর পদত্যাগ করেছেন ১৫ মার্চ।
এখানে অন্য একটি খবরও রহস্যের সৃষ্টি করেছে। এত বড় একটি চুরির ঘটনা জানার পরও গবর্নর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে ভারত সফরে গেছেন, যে সফর তার স্থগিত করা উচিত ছিল। এদিকে গবর্নর আতিউর পদত্যাগ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের দু’জন ডেপুটি গবর্নরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সরিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যাংকিং সচিবকেও। আরো কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘটনার বিশালত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের পদক্ষেপ মোটেও যথেষ্ট হতে পারে না। কারণ, দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলেও ধরে নেয়া যায়, গবর্নর ও ডেপুটি গবর্নরসহ উচ্চ পদস্থরা নিশ্চয়ই সরাসরি অপরাধটি সংঘটিত করেননি। এর পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ কোনো বিরাট দেশী-বিদেশী চক্র। তারাই আসলে মূল হোতা। এদের পরিচিতি সম্পর্কেও জানিয়েছেন তথ্যাভিজ্ঞরা। চক্রটির লোকজন নাকি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে আধিপত্য বিস্তার করেছে। বিভিন্ন সময়ে তারা বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে নিজেদের পছন্দমতো লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ সকল পদে নিযুক্তি দিয়েছে।  সব মিলিয়েই তারা এমনভাবে ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে যাতে অর্থ পাচারের মতো অপরাধ সংঘটনে তাদের কোনো অসুবিধা না হয়। এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সরকারের অবস্থান। কারণ, চক্রটির নানা অপকর্ম সম্পর্কে সরকারের জানা না থাকার কারণ নেই। এজন্যই বলা হচ্ছে, যত ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন, সবই লোক দেখানোর জন্য। রাঘব-বোয়ালরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।
আমরাও বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার পক্ষপাতী নই। কারণ, বিশ্বের কোনো দেশেই এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এত বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেনি। এমন ঘটনা তাই অস্বাভাবিক শুধু নয়, বিস্ময়করও। একই কারণে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এটা অসম্ভবও নয়। কারণ, এরই মধ্যে এমন কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, উদ্দেশ্যে সততা থাকলে যেগুলোর ভিত্তিতে সহজেই অপরাধীদের পাকড়াও করা যেতে পারে। 
একই কারণে আমরা মনে করি, পদত্যাগের মাধ্যমে কেউই দায় এড়াতে পারেন না। চুরির ঘটনা সংঘটিত হবার মাসখানেকেরও বেশি পরে তদন্ত কাজ শুরুর ব্যবস্থা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক আলামত হারিয়ে গেছে, মুছে ফেলা হয়েছে। এটা কিভাবে ঘটল। গভর্নর আতিউর রহমান সব জানেন। তার সব কথা বলা উচিত। মানুষের সব জানা উচিত। যার ফলে চোর চক্রকে ধরা সম্ভব হবে। এই সম্ভব-সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কথিত রাঘব-বোয়ালসহ জড়িত কারো পক্ষেই শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না হয়। বলা বাহুল্য, শাস্তি হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। একইসঙ্গে লুণ্ঠিত সমুদয় অর্থ ফিরিয়ে আনারও জোর চেষ্টা চালাতে হবে।

Ads