রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্র প্রজাতন্ত্র নাগরিকতন্ত্র


রিপাবলিক অর্থে প্রজাতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। রাজতন্ত্র শেষ, এখন প্রজার বা নাগরিকের তন্ত্র  চলবে, এটাই প্রজাতন্ত্রের মর্মকথা। আধুনিক কালের স্বাধীন দেশের এ ঘোষণা মূল্য অপরিসীম। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি দেশই প্রজা অর্থে নাগরিকগণের অধিকার সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আইনের দ্বারা, নৈতিক বিবেচনায় এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে নাগরিকগণের জয় ঘোষণা করাই গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। নাগরিক অধিকারের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়াই বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
কিন্তু সকল দেশে নাগরিক অধিকার সমান নয়। সকল দেশ নাগরিকদের সকল ধরনের সুবিধা দিতে পারে নি। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক অধিকার যতটুকু সমুন্নত রয়েছে, অনুন্নত দেশে ততটুকু নয়। কোথাও নাগরিক নিগ্রহের চিত্র ভয়াবহ। উদাহরণ বাড়ানোর দরকার হয় না। সকলের সামনে নানারূপ আতঙ্কের চিত্র বিদ্যমান। নাগরিক অর্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উপযুক্ত সেবা, নিরাপত্তা ও সম্মানজনক অধিকার পাওয়া এখনো বিভিন্নভাবে দুরূহ। বরং নাগরিক অধিকারের নানা রকম পদদলনের চিত্রই দেখা যায়। সাম্প্রতিক পত্র-পত্রিকায় বিষয়গুলো উপস্থাপিতও হচ্ছে। এতে সামগ্রিক মানবাধিকারে ধস নামার আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে আইনের ন্যায্য প্রয়োগের ক্ষেত্রটিও সঙ্কুচিত হয়ে আসার ভয় থাকছে। এই পরিস্থিতি তাত্ত্বিকভাবে হলেও, বহুদলীয় ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, বিবিধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বহুস্বর সংবাদমাধ্যমের মুক্ত পরিসরে আঘাত হানবে। গণতন্ত্রের সৌধ, প্রজাতন্ত্রের গৌরব, শাসনের সুকৃতিকেও ম্লান করবে। অতএব, প্রজা বা নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বসময়েই চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের ভাবিত করেছে; নাগরিক অর্থে জনগণকে ভরসায় ও নিরাপত্তায় রাখার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বও পেয়েছে এ কারণেই। 
তাত্ত্বিক ক্ষেত্র থেকে বাস্তবে চোখ রাখলে, কিংবা নেতৃবর্গকে দেখলে বা তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে নাগরিক অধিকারের বিষয়ে সংশয় গভীর হওয়ার কারণ ঘটে। ভাবার দরকার হয় যে, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নেতৃবর্গ কি সত্যই মনে করেন যে, নাগরিকরাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী? আর তাঁরা জনপ্রতিনিধি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরূপে সেই ক্ষমতার অছি বা প্রতিনিধি মাত্র? সেই বোধ সংশ্লিষ্টদের কথায়, কাজে, বিশ্বাসে, আচরণে, অন্তরে থাকলে প্রতি মুহূর্তে নাগরিকদের উপর দাপট দেখানোর এতো উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারতো না। দাপট যখন সাধারণ মানুষের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপদ্রব ও অত্যাচারের শামিল হয়, তখন তা নিয়ে কথা হয়, মিডিয়া ও নানা আলোচনায় কিছু সমালোচনাও হয়, ক্ষমতাবানরা অন্তর হতে না হউক, লোকলজ্জায় দুঃখ প্রকাশ করেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনরায় ভোট-প্রাপ্তির ভয় না থাকলে মৌখিক ক্ষমা চাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। উল্টা নাগরিক নিপীড়নকেই নানা বাহানায় জায়েজ করা হয়। এতে প্রজাতান্ত্রিকতার বদলে রাজতান্ত্রিকতারই যে উৎকট প্রকাশ ঘটে, সে খেয়ালও রাখার তোয়াক্কা করা হয় না। গণতন্ত্রের সঙ্গে, প্রজাতান্ত্রিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ আচরণ হর-হামেশাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতি উগ্রতার লক্ষণবাহী এবং নাগরিক বা প্রজা পালনের প্রতিষ্ঠিত শিষ্টতার সঙ্গে বেমানান এবং সম্পূর্ণ পরিপন্থী। 
এ কারণেই শাসনের মর্মসত্য ও প্রকৃত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে হয়; শাসনের রূপ-চরিত্র উপলব্ধির জন্যও অপেক্ষার দরকার হয়। সেই অপেক্ষা যদি ভয়াবহতায় হাবুডুবু খেতে থাকে, তাহলে নাগরিক সংস্কৃতিতে বেদনার কালো ছায়াপাত অবশ্যম্ভাবী। তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সত্য এবং ন্যায়ের অবস্থান কোথায়? শুধু বিচারালয়ের রায়ে? নেতার বক্তৃতায়? সুবচনে? আশ্বাসে? হুমকিতে? ধমকিতে? না। তা মোটেও নয়। বস্তুত আইন এবং বিচার এবং প্রশাসন যেখানে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে, সেখানে অনাচারের আশঙ্কা কম। ক্ষমতার বৃত্ত যখন আইন, বিচার ও শাসন ইত্যাদি নানা শাখায় সুসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যপূর্ণ থাকে, তখনই নাগরিকগণ গণতন্ত্রের স্বাদ লাভ করেন; নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রটিকে চাক্ষুষ দেখতে পান। কিন্তু যখন সকল ক্ষমতা এক হাতে বা এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়, তখনই আসে গলদ। এককেন্দ্রীক ক্ষমতার প্রবাহ বহুমাত্রিক সুশাসনের সামনে কালাপাহাড়ের বিঘœ ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা শিষ্টের উদ্দেশে দুষ্টের হুমকি প্রবৃত্তিগত ভাবে স্বাভাবিক হতে পারে, তাকে দমিয়ে রাখার কাজ বর্তায় কিন্তু ক্ষমতার বলয়ে অধিষ্ঠিত সকলের উপরই। এখানে ফাঁক তৈরি হলে দুষ্টরাই শিষ্টের বারোটা বাজাতে পারে। নাগরিকদের নানাভাবে হেনস্তা করতে পারে। পারে নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করতে।
অতএব, রাষ্ট্র এবং নাগরিকের অলিখিত সম্পর্ক হলো, নাগরিক সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে রাষ্ট্রের প্রতি। বিনিময়ে রাষ্ট্র নাগরিককে দেবে সার্বিক স্বাভাবিক নিরাপত্তার বলয়। নানা প্রজাতির দুষ্ট যদি আকাশে আতঙ্ক এবং সংশয়ের মেঘকে ঘনিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন সেটাকে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, দমনের দায়িত্ব নিতে হয়। এই জরুরি দায়িত্বে শৈথিল্য দেখা গেলেই দুষ্টতন্ত্র বহাল হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে দুষ্টামী, উৎপীড়ন, অত্যাচার ইত্যাদি কুকর্মকেই নিয়মে পরিণত করে। যদিও এরূপ পরিস্থিতি কাম্য নয়, তথাপি গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বা প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেও আগাছার মতো এই দুষ্টচক্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। সেই আগাছাই এক সময় গণতন্ত্র নামক বৃক্ষের বারোটা বাজায়। অতএব, কর্তাব্যক্তিবর্গ যদি অনিয়ম ও আগাছা সম্পর্কে সতর্ক না হোন তাহলে বিপদ। আর কখনো যদি বিশেষ কোনো কারণে উচ্চতর স্তর হতে সুযোগ ও পক্ষপাত এইসব কুপক্ষকে দেখানো হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠতে বাধ্য; নাগরিকগণ এদের পীড়নে অতিষ্ঠ হবেই। 
প্রায়োগিক অর্থে, শিল্পবাণিজ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক পরিসরে, সমাজে, রাজনীতিতে, তথা সর্বত্র শাসনের দীর্ঘ বাহু নানা ব্যক্তি ও প্রশাসনের দ্বারা প্রসারিত।  বাধ্য করার নামে বা অধীনস্থ করার কুপরিকল্পনায় বজ্রমুষ্টিতে নিয়ন্ত্রণের রশি ধরে রাখার অপতৎপরতায় যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অগ্রণী হয়, তারা সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাগামছাড়া হয়ে যায় এবং সেই ঝাপ্টা সাধারণের ওপর ঝড়ের বেগে প্রবাহিত হয় এবং নাগরিক অধিকারকে ন্যূব্জ করে। মূলত মুষ্টি যখন অতিপ্রবল হয়, তখন দাপটের অতি ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটে। এমন উদাহরণ দুর্লভ্য নয় মোটেই। কখনো এইসব বাড়াবাড়ির বিপক্ষে শোরগোল ওঠে, নিন্দা-সমালোচনার ঝড় ওঠে বটে। কিন্তু শীর্ষ যখন  অকারণ-অপ্রয়োজনীয়-অনৈতিক হস্তক্ষেপের যে নীতি এবং রীতি তাকে নিজস্ব শক্তির উৎস রূপে ‘স্বাভাবিক’ বলে গণ্য করে বা স্বীকৃতি দেয়, তখন সেটার অবসান না হলে ব্যাধি সারবে না; প্রজাতন্ত্র সঠিক অর্থে নাগরিকতন্ত্র হয়ে উঠবে না। বিশ্বব্যাপী ভঙ্গুর, অ-অংশগ্রহণমূলক, অ-স্বীকৃত গণতন্ত্রের অধীনে নাগরিকতন্ত্র ও মানবাধিকারের যে শনির দশা চলছে, সেটা অতিক্রম করতে না পারলে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র-এর পক্ষে যথাযথ অর্থে বিকশিত বা কার্যকর হওয়া দুঃসাধ্য। উন্নয়নের দামামা বাজিয়েও এসব অসম্পূর্ণতাকে চাপা দেয়া অসম্ভব। কারণ, সব কিছুর আগে মানুষের অধিকার, স্বার্থ, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নটি এসে যাবেই। তাত্ত্বিক অসঙ্গতিতে আক্রান্ত কাজ-কর্মের দ্বারা প্রায়োগিক সফলতা আসতে পারে না, এ কথাটিও বুঝতে হবে। বিশ্ববিশ্রুত বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরও একই অভিমত। 
তাই, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আর বাস্তবের আলোকে বার বার ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো এদেশেও যে মানুষ ভাবছে না, তা নয়। সঙ্কটের উদাহরণ আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকেই দেয়া সম্ভব। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলেই নানা নিরাপত্তার ঘাটতিজনিত চিত্র দেখা যায়; ভয়াবহ খবর পাওয়া যায়। কে কারে মেরেছে, কে কাকে ধরে নিয়েছে, কে কাকে শাসাচ্ছে, ইত্যাদির সঙ্গে রয়েছে রক্ষকের ভক্ষক হওয়ার বিচিত্র কাহিনী। তাই, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আর বাস্তবের আলোকে বার বার ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। কি হওয়ার কথা আর কি হচ্ছে, এই সমীকরণ যত তাড়াতাড়ি মেলানো যাবে, তত তাড়াতাড়িই সঙ্কট মুছে যাবে। নাগরিক স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা বলবো কিন্তু নাগরিক দায়িত্ব রক্ষায় সচেষ্ট হবো না কিংবা অধিকার প্রয়োগ করবো না; তাহলে তো সমস্যা সুরাহা হবে না! সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সেটা সবাইকে মিলে-মিশেই করতে হবে।

শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বেগম জিয়ার উক্তি আর যাই হোক দেশদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে না


বিএনপি প্রধান এবং ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ দেশের মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটি। যখন তখন যে সে ব্যক্তি যার তার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই মামলা করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি সম্পূর্ণ আলাদা। এটি করতে গেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা সরকারের অনুমতি নিতে হয়। সরকার অনুমোদন না দিলে সেই মামলা আদালত আমলে নেয় না। একটি মামলা আমলে নিতে গেলে প্রাথমিকভাবে তার কিছু মেরিট থাকা দরকার। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের যে মামলা করা হয়েছে তার কি কোনো মেরিট আছে? এ কথা ঠিক যে, মেরিট আছে কি না আছে সেটি চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবে আদালত। যে কোন শিক্ষিত মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের আইনী এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানেন। সেই সব সংজ্ঞার আওতায় বেগম জিয়ার মামলা পড়ে না। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই কথাটিই কি রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ হয়ে গেল? শহীদের সংখ্যা নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে কোনো আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো না। বেগম জিয়া বলেছেন যে, সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। সরকারের অফিসিয়াল স্ট্যান্ড হলো এই সংখ্যা ৩০ লাখ। বেগম জিয়া কি বলেছেন যে, ঐ সংখ্যা ৩০ লাখের কম? নাকি তিনি বলেছেন যে, ঐ সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি? এই মামলা যদি অগ্রসর হয় তাহলে সেখানে তার আইনজীবীরা অবশ্যই বেগম জিয়ার পক্ষে বক্তব্য দেবেন। কেন এই সংখ্যা বিতর্কিত সেটিও তারা বলবেন।
বাংলাদেশের বিগত ৪৪ বছরের পত্রপত্রিকা এবং নেতা নেত্রীর বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা এবং বিবৃতি পাঠ করলে অথবা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে মুক্তিযুুদ্ধে শহীদের পরিসংখ্যান নিয়ে নানান রকম তথ্য পাওয়া যায়। এগুলি আমাদের আজকের বিষয় নয়। এগুলো বেগম জিয়ার আইনজীবীদের কাজ। এগুলো বেগম জিয়ার তথ্য শাখা বা গবেষণা শাখার কাজ। তারা তাকে তথ্য উপাত্ত বা পরিসংখ্যান দেবেন। আমাদের বক্তব্য হলো, শহীদের সংখ্যা বিতর্কিত, এই কথা বললে যদি কোনো অপরাধ হয়েই থাকে, তাহলে সেটি আর যাই হোক না কেন, সেটি রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অপরাধ নয়। সকলেই জানেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শহীদের সংখ্যা বিতর্কিত, এই কথা বললে কি কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসি হতে পারে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে মামলা যেন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একুশে টেলিভিশনের মালিকানার হাত বদল হয়েছে। কিভাবে হয়েছে সেটি একটি ভিন্ন বিষয়। ঐ টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করতেন এক ভদ্র লোক। নাম ড. কনক সরোয়ার। অফিসে তার কি কাজ ছিল সেটি আমরা জানি না। তবে তিনি ‘জনতার চোখ’ অথবা ‘একুশের চোখ’ এই রকম একটি নামে ঐ চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেন। দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন সেসব কথা ঐ  অনুষ্ঠানে প্রচার করা হতো। জনাব কনক সারোয়ার আর কি করতেন সেগুলো আমরা জানি না। কিন্তু  একদিন দেখা গেল, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জেলখানায় পাঠানো হয়েছে। আরো জানা গেল যে, তাকে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কি কাজ করেছেন সেটি অবশ্য পত্র পত্রিকায় আসেনি। তাই আমরা সেটি জানিও না। তবে কয়েকদিন আগে শুনলাম যে, তিনি নাকি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তার মুক্তিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে আদতেই কি কোনো চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে? করা হয়ে থাকলে তিনি কি অপরাধ করেছেন? করা হয়ে না থাকলে তার বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অপরাধের অভিযোগ কেন আনা হলো?
॥দুই॥
এসব কথা বলতে হলো বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ শুনে। জনগণ আশা করেন যে, সরকার মামলাটি ঝুলিয়ে রাখবেন না। বেগম জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কি কি অপরাধ করেছেন সেগুলোর একটি তালিকা জনগণ জানতে চায়। সেই মামলা হবে প্রকাশ্যে। কোনো ক্যামেরা ট্রায়াল নয়। সরকার যা বলবেন সেগুলোর খুটিনাটি আসতে হবে পত্র পত্রিকায়। তেমনি বেগম জিয়ার তরফ থেকে যা বলা হবে সেগুলোও বিস্তারিত আসতে হবে পত্র পত্রিকায়। এই প্রসঙ্গে যারা প্রবীণ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্র মামলার কথা। যখন মামলা শুরু হয় তখন সেটি হয় প্রকাশ্যে। সরকার পক্ষ অভিযোগের সপক্ষে যতকথা বলেন তার প্রতিটি কথা যেমন দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলনসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় তেমনি আসামী পক্ষে অর্থাৎ শেখ মুজিবের পক্ষের আইনজীবীরা যত কথা বলেন তার প্রতিটি কথা তেমনি দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলনসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, শেখ মুজিবের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছিল বৃটিশ এমপি এবং ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে। তবে শেষ মুহূর্তে শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান আইনজীবী হিসাবে মামলা পরিচালনা করেন সেই সময়কার বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান। ঐ মামলার প্রতিদিনের কার্য বিবরণী যেমন বিস্তারিতভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে এসেছে তেমনি বেগম জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার প্রতিদিনের কার্য বিবরণী বিস্তারিতভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে আসতে হবে। কারণ পাকিস্তান আমলসহ এদেশে রাজনীতির অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে যারা খুটিনাটি জানেন তারা বুঝতে পারছেন যে বেগম জিয়ার এই মামলা যদি এগিয়ে যায় তাহলে এটি হবে একটি ঐতিহাসিক মামলা। এই মামলা হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতির অনেক কিছুই পাল্টে দেবে।
জনগণ ইতোমধ্যেই ধারণা করতে শুরু করেছেন যে এটি কোনো রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়নি, এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। কেন এই কথা বললাম সেটি অনুধাবন করতে হলে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা এবং আনুষঙ্গিক বিষয় জানতে হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Treason. কোনো কোনো অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে Sedition. মূলত বাংলায় রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা, বিরুদ্ধাচরণ অর্থাৎ যে ব্যাপকতা এবং সার্বিক বিরোধিতা প্রকাশ পায় ইংরেজি শব্দগুলো দিয়ে তা সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না। আমরা রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহকে যেভাবে দেখি, পাশ্চাত্যে সে রূপ নয়। রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে। ব্রিটিশরা আমাদের শিখিয়েছে তাদের সৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলা কওয়া অন্যায়। অপর দিকে, পশ্চিমা লক্ষ্য রাষ্ট্র নয়, শাসক। সুতরাং অক্সফোর্ড অভিধানে Treason অর্থ, The crime of betraying one’s country, especially by attempting to kill or overthrow the sovereign or government. বিশ্বকোষ এবং সমর্থক শব্দকোষ থেকে প্রাপ্ত আরো দুটো সংজ্ঞা এরকম : A revolt or an incitement to revolt against established authority, usually in the form of Treason or Defamation against government. আরেকটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Incitement of resistance to or insurrection against lawful authority.
॥ তিন ॥
এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, ইউরোপ-আমেরিকায় দেশ জাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত আইন শৃঙ্খলা, বৈধ কর্তৃত্ব ইত্যাদি বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাষ্ট্রদ্রোহকে সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সাথে এক করে দেখা হয়েছে। যেমন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘রাজনীতির অভিধান’-এ রাষ্ট্রোদ্রোহ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্যের অভাব বা বিরুদ্ধাচরণ।’ আর আমাদের এখানের ‘রাজনীতি কোষ’-এ প্রায়োগিক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কাজকেই বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘রাজনীতির অভিধান’-এ রাষ্ট্রোদ্রোহ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্যের অভাব বা বিরুদ্ধাচরণ।’ আর আমাদের এখানের ‘রাজনীতি কোষ’-এ প্রায়োগিক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কাজকেই বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ। কলকাতার অভিধান মোতাবেক বেগম জিয়া বা তার দল বিএনপি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের প্রতি কি আনুগত্যের অভাব দেখিয়েছেন? নাকি ঐ উক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন? বাংলাদেশের অভিধান মোতাবেক বেগম জিয়া বা তার দল বিএনপি কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কোনো কাজ করেছেন? করে থাকলে উদাহরণসহ জনগণের কাছে তা পেশ করার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গতকাল ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে বলেছেন, ‘‘কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, ক্ষমতাসীনগোষ্ঠী তাদের প্রতিপক্ষের সব কর্মকাণ্ডকে ঢালাওভাবে দেশদ্রোহ আখ্যায় আখ্যায়িত করে শ্বেতসন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে অবদমিত করার প্রয়াস পায়।’ পাশ্চাত্য এবং আমাদের দেশজ সংজ্ঞাগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, আমরা রাষ্ট্র ও সরকারকে গুলিয়ে ফেলেছি। রাষ্ট্র একটি  নৈর্ব্যক্তিক সত্তা। অপর দিকে, সরকার হচ্ছে একটি বাস্তব সংগঠন। রাষ্ট্র সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে অবস্থিত সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ও রাজনীতি এক জিনিস নয়। রাষ্ট্রের সাথে মত ভিন্নতা থাকতে পারে না। অপর দিকে রাজনীতি মানেই হচ্ছে ভিন্ন মত-ভিন্ন পথ।’’
রাষ্ট্রদ্রোহিতা একটি গুরু গম্ভীর বিষয়। যেখানে সেখানে এটির অপব্যবহার করে বিষয়টির গাম্ভীর্যকে হাল্কা করে ফেলা উচিত নয়। আজ আওয়ামী সরকারের বিরোধিতা করলেই হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। অথচ কোনো মানুষ বিশ্বাস করছে না যে, তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারেন। রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চাইলে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনই তো ক্ষতি করতে পারতেন। অথচ তখন তার সমস্ত কাজই ছিল দেশপ্রেমিকতায় উজ্জীবিত। আজ যখন তিনি ক্ষমতাহীন, যখন সরকারের রাজদ- তার মাথার ওপর ডেমোক্লিসের তলোয়ারের মতো ঝুলন্ত এবং দোদুল্যমান, যখন তিনি দন্তনখরবিহীন ব্যাঘ্র তখন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব দেখে শুনে বিএনপির একজন নেতা সেদিন বলেছেন, ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে।’

শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রসঙ্গ একদলীয় শাসন


ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে বলে ইদানীং জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের ভেতরে শুধু নয়, আলোচনা চলছে বিদেশেও। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্রমেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বলা বাহুল্য, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোতে থাকা সরকার সাধারণত ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ একবার পাওয়া গিয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সময়কালে, যখন জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন চাপানো হয়েছিল। সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোরই নাকি চেষ্টা শুরু হয়েছে! প্রসঙ্গক্রমে জানুয়ারি মাস সম্পর্কেও বলা দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাকশালী শাসন শুরু হয়েছিল।
সে আলোচনায় যাওয়ার আগে জানুয়ারি মাসেরই অন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি- যাকে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামকরণ করা হয়েছে। ২০০৭ সালের এই দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের আড়াল নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সামনে রেখেছিলেন মাঝারি মানের ব্যাংকার ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে। এ দুই উদ্দিনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে জড়িত অন্যজনরা সংবিধান নির্দেশিত সময়ে ও পন্থায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বানচাল করে ক্ষমতা তো দখল করেছিলেনই, তারা বেশি বলেছিলেন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। ভাবখানা এমন ছিল যেন রাজনীতিকরা দেশের শুধু ক্ষতিই করেছেন, ভালো কিছু দেননি। শুনে মনে হয়েছিল যেন ‘উদ্দিন’ সাহেবরা ভালো কাজের বন্যা বইয়ে দেবেন, রাজনীতির ‘লাইনচ্যুত ট্রেনকে’ও লাইনের ওপর দাঁড় করিয়ে দেবেন!
অন্যদিকে ‘উদ্দিন’ সাহেবদের সরকার জাতীয় জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটানোর বাইরে কিছুই করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অযৌক্তিক হুকুম চাপানোর মাধ্যমে অনেক ওলট-পালট করার চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। ‘সংস্কার’ ও ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র’ এবং ‘জাগো বাংলাদেশ’ ধরনের আহামরি অনেক স্লোগান শুনিয়েছেন। ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ‘জাতীয় সনদের’ মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির এবং তাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানকে যুক্ত করে দেয়ার মতো সাংবিধানিক কিছু ব্যবস্থার কথাও বলেছিলেন তারা। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের অনেককেই তারা ‘জেলের ভাত’ খাইয়ে গেছেন। ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান দুদককে দিয়ে মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের অসম্মানিত করেছেন তারা যথেচ্ছভাবে। ‘উদ্দিন’ সাহেবদের দু’ বছরের মধ্যে ছয় মাসের বেশি সময় দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। কোনো জিনিসের দামই মানুষের নাগালের কাছাকাছি অসেনি। ওদিকে আয় বাড়া দূরে থাকুক, বহু মানুষকে চাকরি হারাতে হয়েছিল। অসংখ্যজনের ব্যবসা-বাণিজ্য ‘লাটে’ উঠিয়েছিলেন ‘উদ্দিন’ সাহেবরা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টির ব্যাপারেই তারা বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। এর ফলে অর্থনীতির সকল সূচক হয়েছিল নিম্নমুখী। ‘উদ্দিন’ সাহেবরা এমন অনেক মৌলিক ও নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ও সেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছিলেনÑ যেগুলো কেয়াটেকার সরকারের এখতিয়ারে পড়ে না।  তাদের আমলে ছয় থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত দেশ থেকেছে বিদ্যুৎহীন অবস্থায়। এ সময় আইনশৃংখলা পরিস্থিতিতেও মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু ‘উদ্দিন’ সাহেবরা কোনো প্রতিকারই করতে পারেননি। তারা পেরেছিলেন শুধু মানুষের বাড়ি ও ভবন ভেঙে ফেলতে এবং হকার উচ্ছেদের নামে মানুষের পেটে লাথি মারতে!
এসব কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ‘উদ্দিন’ সাহেবদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু প্রতিবারই সরকারের পক্ষ থেকে সুকৌশলে ‘উদ্দিন’দের রেহাই দেয়া হয়েছে। এমনকি পাল্টা প্রশ্নের পাশাপাশি ‘স্বাধীন’ আদালতে মামলা করার পরামর্শও দিয়েছিলেন এমন একজন, যার কথার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য নেই ক্ষমতাসীনদের কারো।। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতাসীনদেরই কেউ কেউ এমনকি সাফাই পর্যন্ত গেয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই সাংবাদিকদের কাছে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ১/১১-এর জন্য রাজনীতিকরাই দায়ী। আমরা, রাজনীতিকরাই খাল কেটে ‘কুমির’ এনেছিলাম। দেশকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়ে গেলেও ‘কুমির’ নামের ‘উদ্দিন’ সাহেবদের প্রতি উদারতা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। বলেছিলেন, ‘কুমির’ কী করলো তা নাকি দেখার বিষয় নয়! এখানেই রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের মনের কথাটুকু। কারণ, এ কথা ‘উদ্দিন’ সাহেবদের প্রাথমিক দিনগুলোতেই জানাজানি হয়েছিল যে, নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত চার দলীয় জোটের সামনে আওয়ামী শিবির দাঁড়াতে পারতো না বলেই লগি-বৈঠার তান্ডব শুরু করা হয়েছিল। এর পর ছিল ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের পালা। অন্য অনেকের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফ নিজেও সে প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সুদূর লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কথাটা বলে গেছেন নওগাঁর আবদুল জলিল- সৈয়দ আশরাফ যাকে ঠ্যালা-ধাক্কা মেরে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর প্রচারণা রয়েছে। ওদিকে আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় পার্টনার জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো বেশ কিছু উপলক্ষেই জানান দিয়েছেন, সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে মইন উ ‘সহযোগিতা’ না করলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও’ ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। একই কারণে ক্ষমতা পাওয়ার পর ‘ঋণ’ পরিশোধ করার প্রশ্ন এসেছে। ক্ষমতাসীনরাও সে কারণে ‘কুমির’ নামধারীদের সকল কর্ম-অপকর্মের দায়দায়িত্ব বহন করার ‘সদিচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে একথা বলতেই শুধু বাকি রাখা হয়েছে যে, ‘উদ্দিন’ সাহেবদের বিচার তারা করবেন না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য একটি ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারি। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন।
বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে অনেক যুক্তিই দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শেখ মুজিব নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন! এ কথাও বলা হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল জাতীয় সংসদে। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয় তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, সরকারের রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাকশাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে।
সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল। কারণ, বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেয়া হয়নি! অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র দুই দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবির শোচনীয় পরিণতির উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই দল দু’টি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে এসেছে, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দল দু’টিকে নিয়ে শেখ মুজিব ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’ও গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাকশালের ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্বের অবস্থান পাননি এমনকি কমরেড মনি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো দলীয় প্রধানরাও। এই দু’জনকেসহ দু’দলের মাত্র ছয়জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। তাদের ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০-এর ঘরে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে ১৯৭৪ সালের জুন থেকে সন্তোষে গৃহবন্দী রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিরোধী অন্য নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশেও চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ গঠনের যুক্তিকে রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘সাময়িককালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল ধরনের যুক্তিকেও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ধরনের কোনো বিধান চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো পন্থা বা বিধানেরই উল্লেখ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ছিল না সংবিধানেও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একথাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন।
একথা অবশ্য ঠিক যে, চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য হলো, ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্যÑ যেমনটি পরবর্তীকালে করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করেছিল সরকার। কিন্তু বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি। 
প্রসঙ্গক্রমে এখানে পঞ্চম সংসদের সেই অধিবেশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যে অধিবেশনে শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীকে কফিনে ঢোকানো এবং তার পরিবর্তে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর অর্থ প্রকৃতপক্ষে ছিল শেখ মুজিবের আরো একটি মৃত্যু। কিন্তু তারপরও সংসদে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমপিরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছিলেন, একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে নৃত্য করেছিলেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনন্দ-উল্লাস স্বাভাবিক হলেও মরহুম শেখ মুজিবের মনোভাব ও চিন্তাধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কিন্তু মানতেই হবে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো মুজিববিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তত এত বেশি উল্লসিত হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’কেই প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এমপিদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা মরহুম নেতার কোনো চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন!
এটা তাদের পরাজয় বরণ করে নেয়ার গণতন্ত্রসম্মত কৌশল হতে পারে। কিন্তু এভাবেই তারা একের পর এক মরহুম নেতার ‘কীর্তি’ ও চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করে এসেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাকশাল এবং সমাজতন্ত্রের মতো মৌলিক বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে পরিত্যক্ত হয়েছে। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারিকে নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্য করেননি। দিনটিকে সুকৌশলে পার করে দেয়ার মধ্য দিয়ে বরং একথারই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের পদক্ষেপ ছিল গণতন্ত্র বিরোধী এবং চরম ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক। এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তোফায়েল আহমদের মতো নেতা ও এমপিরা- যারা বাকশাল গঠন করার সময় যেমন, তেমনি দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার সময়ও জাতীয় সংসদে উপস্থিত থেকেছেন এবং প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। মরহুম নেতার সম্মান বাঁচানোর জন্য এখন তারা অনেক কথাই বলতে চাইতে পারেন, কিন্তু একথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না যে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদের মতো ১৯৭৩-৭৫ সালের প্রথম সংসদে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠতে পারেননি। পারেননি অন্যজনদের জড়িয়ে ধরে নৃত্য করতেও। কারণ, পরিবেশ তখন এত খোলামেলা ছিল না। পরিস্থিতি বরং ছিল বিশেষ রকমের এবং বদ্ধ ওই সংসদে বিনা বাক্য ব্যয়ে শেখ মুজিবের হুকুম পালন করা ছাড়া কারো কোনো উপায় ছিল না।
বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিনটিকে পার করেছে নীরবে। দিনটির স্মরণে দলটি প্রকাশ্যে কখনো কোনো অনুষ্ঠান করেনি, এমনকি শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কোনো বছর একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। এবারও নীরবই থেকেছেন তিনি। মাঝে-মধ্যে দু’চারজন নেতাকে অবশ্য খুবই দুর্বল কণ্ঠে বাকশালের পক্ষে কৈফিয়ৎ দিতে বা ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার কসরত করতে দেখা গেছে। কিন্তু কারো পক্ষেই শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’ বাকশালকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা আসলে হওয়ারও কথা নয়।
এত কিছুর পরও কথা থাকার একটি কারণ হলো, অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। সেটা টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখনো সে টানাটানির শেষ হয়নি। সুতরাং ইতিহাস স্মরণে রাখলে এবং নতুন পর্যায়ে একই ধরনের ভুল পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা না করলে আওয়ামী লীগই কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এককালের জনপ্রিয় ও প্রচন্ড ক্ষমতাদর্পী নেতাকে আবারও জনগণের মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ে আসতে কতটা বছর লেগেছে ও লাগছে- সে হিসাবও মাথায় রাখা দরকার।
আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট


আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে ওঠার তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। গত বুধবার প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে ‘বাংলাদেশ : গভর্নমেন্ট শাটস ডাউন ক্রিটিকস’ শিরোনামের অধ্যায়ে নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থাটি বলেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্রমেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। দেশটিতে বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, হত্যা ও গুম হওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছে। সরকারের সমালোচনা করার কারণে গণমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিক ও সম্পাদকদের অভিযুক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দু’জন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকেও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। কারণ, বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মনে হচ্ছে, সংসদের বাইরেও কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না শেখ হাসিনার সরকার। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার আতংকে রয়েছে। গত বছর বিরোধী দলের আন্দোলনের আগে সহিংসতা ঠেকানোর নামে রাজপথে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করে সরকার। এ সময় হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে আটক করার পাশাপাশি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ রাখা হয়। এভাবে সব মিলিয়েই দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে সরকার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠেছে। 
ব্লগার হত্যা এবং ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের ন্যায্য সমালোচনার পক্ষ নেয়ার কারণে ৪৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার মতো আরো অনেক তথ্যও রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই বার্ষিক রিপোর্টে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রিপোর্টে কোনো বিষয়েই সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়নি। বস্তুত সরকার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে ওঠার কারণে বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করতে পারছে না। তাদের এবং আক্রান্ত অন্য সকলের জন্যও ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। রিপোর্টে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য সঠিকভাবেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী তথা নিরাপত্তাবাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর রিম্যান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন, প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেফতারের জন্য বাসা বাড়িতে তল্লাশি এবং গুম ও খুনের মতো বিভিন্ন তথ্য স্মরণ করলে স্বীকার করতেই হবে, রিপোর্টে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সত্য ও সঠিক চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে উপর্যুপরি আহবান জানানো ও তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও গত বছর গুম ও গুপ্তহত্যাসহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের ব্যাপারেও সরকার তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। হত্যার পাশাপাশি নিরাপত্তা হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতন, ঢালাও গ্রেফতার অব্যাহত থেকেছে। 
গণমাধ্যম প্রসঙ্গেও রিপোর্টে বাড়িয়ে বলা হয়নি। কারণ, সরকার সব দিক থেকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে ফেলেছে। দৈনিক আমার দেশ এখনো প্রকাশিত হতে পারছে না, এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে মিথ্যা মামলায় আটকে রেখেছে সরকার। ওদিকে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি এখনো বন্ধ রয়েছে। সরকারের গণমাধ্যম বিরোধী নীতি ও কর্মকা-ের সর্বশেষ একটি উদাহরণ হিসেবে এসেছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বন্ধ করার পদক্ষেপ, যা আধুনিক বিশ্বে কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে নিজেরা ডিজিটাল যুগের ঘোষণা দিলেও সরকার দীর্ঘদিন পর্যন্ত ফেসবুক এবং অন্য কিছু মাধ্যমকে নিষিদ্ধ রেখেছে। এখনো কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রয়েছে। এসব কারণেই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রচিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টের কোনো একটি বিষয়ের সঙ্গেই ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। বলা বাহুল্য, রিপোর্টটি সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে সুখবর হয়ে আসেনি। তা সত্ত্বেও অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করাটাই যথেষ্ট হতে পারে না। কারণ, সবই ঘটে চলেছে জনগণের চোখের সামনে, আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তও তারাই হচ্ছে। তাছাড়া সব দিক থেকেই রিপোর্টটিতে সত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সুতরাং কেবলই ঘাড় বাঁকিয়ে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে সরকারের জন্য রেহাই পাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। তেমন চেষ্টা করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের বরং রিপোর্টের মূলকথা ও সুর অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করা দরকার। কারণ, প্রতিটি বিষয়েই তারা গণতন্ত্রের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন, তাদের বাড়াবাড়ির ফলে দেশে মানবাধিকারের লেশমাত্রও আর অবশিষ্ট নেই। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত প্রত্যেককেই এখন নির্যাতনের কবলে পড়ার- এমনকি বেঘোরে প্রাণ হারানোর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকতে হয়। 
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যখন অভিযোগ উত্থাপন করে তখন বোঝা দরকার, এমন অবস্থা কোনো সরকারের ভবিষ্যতের জন্য শুভ হওয়ার নয়Ñ দেশের ভাবমর্যাদার কথা না হয় বাদই দেয়া গেলো। সুতরাং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মামলা ও গ্রেফতারসহ বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন বন্ধ করার পাশাপাশি সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচন নিয়েও এখনই উদ্যোগী হওয়া। কারণ, আলোচ্য রিপোর্টে সত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে বলা হয়েছে, দেশটির সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই এবং বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে সে লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়ার মধ্যেই সরকারের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে বলে আমরা মনে করি। ক্ষমতাসীনদের অনুধাবন করা উচিত, ‘সংসদের বাইরেও কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না শেখ হাসিনার সরকার’- রিপোর্টের এই কথাটুকু তাদের জন্য অশুভ পরিণতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আহ্বান


মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট রাজনৈতিক দলগুলোকে অবাধে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত সোমবার বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর দেয়া এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার দেশটির উন্নয়নে একটি প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখেছে। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া দরকার। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত একতরফা সংসদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের সরকার গঠন থেকে সর্বশেষ পৌর নির্বাচন এবং বিরোধী দলের ওপর চালানো দমন-নির্যাতন পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করে বেগম খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি বলে এই সরকারের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনও অনুপস্থিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে আরো জানানো হয়েছে, গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা যত উন্নয়নের কথাই বলুন না কেন, গণতন্ত্রহীনতার কারণে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বর্তমানে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দুর্বিষহ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক সঙ্কটও কাটিয়ে উঠতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে বেগম খালেদা জিয়া যে সমাধানের পন্থা উপস্থাপন করেছেন এবং ক্ষমতাসীনরা যে তার কোনো একটিও গ্রহণ করেননি- সে বিষয়েও জানানো হয়েছে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে।
আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাটের মূলকথা এবং অন্তরালের মনোভাবকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি অকারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘অবাধে’ মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানাননি। বস্তুত বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রধান উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এ আহ্বান জানিয়েছেন। তার বক্তব্যে সরকারের দমন-নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিও এসেছে পরোক্ষভাবে। না হলে ‘অবাধে’ শব্দটির প্রয়োগ করতেন না তিনি। বলা দরকার, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বৃটেন, জার্মানি, কানাডাসহ আরো অনেক রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ড ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। মূলত সে কারণেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ পরোক্ষ বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতি-মনোভাব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বর্তমান সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে।
কিছুটা ঘুরিয়ে বললেও দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট প্রসঙ্গেও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট। গণতন্ত্রই যে বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য; সে কথাটারই প্রকাশ ঘটেছে তার আহ্বানের মধ্য দিয়ে। স্মরণ করা দরকার, অন্য অনেক দেশের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তাছাড়া পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচারণাসহ আরো অনেক কারণেই বর্তমান সরকারের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মধ্যেই সরকারের জন্য সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমরা মনে করি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘অবাধে’ মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানানোর আড়ালে তিনি আসলে সব দল ও পক্ষের অংশগ্রহণে এমন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দিয়েছেন, যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সহিংসতামুক্ত। এ লক্ষ্যে সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলারও পরামর্শ রয়েছে তার বক্তব্যে; যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও হয় এবং সব দল যাতে সে নির্বাচনে অবাধে অংশ নিতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তার দেশ চায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত অবিলম্বে তার নীতি ও অবস্থানে পরিবর্তন ঘটানো এবং বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে জানানো হয়েছে এবং একথা সত্যও যে, বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সমাধানের পন্থা উপস্থাপন করে রেখেছেন। সে কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সংলাপ এবং নির্বাচনসহ কোনো ব্যাপারেই কোনো সমস্যা হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা আশা করতে চাই- ক্ষমতাসীনরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মূলকথাগুলো অনুধাবন করবেন এবং তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবেন।

মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এসআই মাসুদ এগিয়ে চলো ॥ রাষ্ট্র আছে তোমার সাথে


আমি একটা মিছিলের জন্য এখন প্রতিদিন অপেক্ষা করছি। আমি যেখানে থাকি, সেটা আওয়ামী লীগের মিছিল জোন। নির্বিঘ্নে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা মাইক বাজানোর জোন। এখানে প্রায় প্রতিদিন মঞ্চ-প্যান্ডেল সাজানো হয়। কখনও সকালে এক মঞ্চওয়ালারা আসেন। গোটা এলাকা কাঁপিয়ে হাবিজাবি বক্তৃতার প্র্যাকটিস করেন। সেখানে কিছু টোকাই যোগাড় করা হয়। এদের কাউকে রাজনৈতিক কর্মী বলে তো মনেই হয় না, বরং ভাড়াকরা দিনমজুর মনে হয়। তথাকথিত জনসমাবেশে আগতদের বেশিরভাগই থাকে চঞ্চল শিশু। কোনো কোনো পার্টি আগতদের জন্য অর্থের অতিরিক্ত আকর্ষণ হিসেবে দুপুরে তেহারির আয়োজন করে। সেটার বণ্টন নিয়ে মাঝে মধ্যে কিলাকিলি হয়। আবার মাইকে এলাকা কাঁপিয়ে সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে খাবার সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়। এর মধ্যে এক আধজন চেনাজানা আওয়ামী নেতা আসেন। তারা জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে গালিগালাজ করে তাদের বক্তৃতা শেষ করেন।
দুপুরের মধ্যে এরা প্যান্ডেল ফ্যান্ডেল গুটিয়ে চলে গেলে নতুন পার্টি এসে জায়গা দখল করেন। তখন ‘যেমন খুশি গাও’ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সময় থাকলে প্যান্ডেল সাজানো হয়। না হলে খোলা মঞ্চ সাজানো হয়। আওয়ামী সমর্থকরা নানা ধরনের গানের প্র্যাকটিস করে। শিশুদেরও নিয়ে আসা হয়, তাদের সঙ্গীত প্রতিভা এলাকার মানুষদের শোনানোর জন্য। তারা বেগম খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান, তারেক রহমানকে নিয়ে নানা অশ্লীল গান গায়। এই শব্দদূষণ থেকে বাঁচার জন্য এলাকার সকল মানুষকে শীত-গ্রীষ্ম সবসময় বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হয়। তাতে আর শব্দ কতটা রোখা যায়। শুক্রাবাদ, তল্লাবাগ, ধানমন্ডি, কলাবাগান এলাকার  বাসিন্দারা কী ভাষায় অশালীন শোরগোলকে স্বাগত জানায়, সেটা জানা-বোঝার চোখ-কান বা ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদের নেই। উপরন্তু ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোড কোন এখতিয়ারে কোন কারণে বছরের পর বছর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে রাখা হবে? কেনো এই পথ দিয়ে যান চলাচল করতে পারবে না, তার জবাব কেউ দেয় না। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ওপরের নির্দেশ। কিন্তু এই রাস্তা বন্ধ রাখার ফলে ৩২ নম্বরের উত্তরে মেট্রো শপিং মলের পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে, সেটি পেরিয়ে আবার ৩২ নম্বরে উঠতে তীব্র যানজটের মুখোমুখি হতে হয় হাজার হাজার মানুষকে। অথচ ৩২ নম্বর খোলা থাকলে এই অসহনীয় যানজটের মুখোমুখি হতে হতো না। একি তবে কোনো সামন্ত যুগের জমিদার বাড়ি? এর সামনে দিয়ে কোনো সাধারণ মানুষ যানবাহন নিয়ে ঢুকতে পারবে না।
এ এলাকার বাসিন্দারা হামেশাই ৩২ নম্বরে লেকের সামনে এমন মিছিলের আয়োজন দেখেন। টোকাই সভার আয়োজন দেখেন। বক্তৃতার প্র্যাকটিসের আয়োজন দেখেন, শোনেন। অশ্রাব্য গান শোনেন। বলা ভালো, শুনতে বাধ্য হন। সামন্ত জমিদারবাড়ির মতো ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে দিয়ে গাড়ি চালাতে পারেন না। ফলে শুক্রাবাদের মেট্রো শপিং মলের উত্তর পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে সে রাস্তায় এবং কলাবাগান থেকে শুক্রাবাদ পর্যন্ত রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। মেট্রোর উত্তর পাশের রাস্তার পেছনে আছে একাধিক স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে এমনিতেই ডজন ডজন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। অপরদিকে মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে এসে এসব গাড়ি ধানমন্ডির ভেতরে ঢুকতে চায় তাদেরও রাস্তা প্রধানত ওটিই। আবার কলাবাগানের দিক থেকে যেসব গাড়ি ধানমন্ডির ভেতরে ঢুকতে চায় তাদেরও পথ ৩২ নম্বর ও তার উত্তরের রাস্তা। ফলে মেট্রোর পাশে দু’দিক থেকেই যানবাহন ঢুকে এবং একদিক দিয়ে বেরিয়ে আসে। দুঃসহ ও অকল্পনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ৩২ নম্বরের রাস্তা যদি যান চলাচলের জন্য খোলা থাকতো তাহলে এই অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। কিন্তু এদিকে কারো মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না।
তবে এখানে আমি একটি মিছিলের অপেক্ষা করি। সে মিছিলের সামনে বহুসংখ্যক গাঁদাফুলের মালা গলায় দিয়ে থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনকারী মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ সিকদার। তার পেছনে প্রথম সারিতে থাকবেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তার পেছনে থাকবেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ মন্ত্রী-এমপিরা। আরো পেছনে থাকবেন লুঙ্গি পরা ভাড়াটে জয়বাংলা পার্টি। তার পেছনে লাফাতে লাফাতে আসবে অর্ধনগ্ন হাড্ডিসার শিশুরা। তাদের মুখের স্লোগান থাকবে ‘এসআই মাসুদ এগিয়ে চলো, রাষ্ট্র আছে তোমার সাথে।’ এখনো সে রকম মিছিল দেখিনি, কিন্তু হতে বোধকরি বেশি দেরি নেই।
গত ৯ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের ওই কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী একটি এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে বেরিয়ে আসছিলেন। তখন সেখানে ছিল মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের একটি টহল দল। তাদের একজন গোলাম রাব্বীকে কলার চেপে ধরে এসআই মাসুদের কাছে নিয়ে যায়। এসআই মাসুদ বলেন, তোর কাছে ইয়াবা আছে, সার্চ করতে হবে। গোলাম রাব্বী বার বার বলতে থাকেন যে, তার কাছে কোনো ইয়াবা নেই এবং তিনি তাকে সার্চ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন তাকে টেনে-হিঁচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়া হয়। এর পর রাব্বী তার পরিচয় দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইডি কার্ড দেখান। ছাত্রলীগ সভাপতি ও বিসিএস কর্মকর্তাদের পরিচয় দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আরেফিন সিদ্দিক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউরের সঙ্গে তাদের কথা বলতে বলেন কিংবা কথা বলার সুযোগ দিতে বলেন। তার বদলে তাকে অবিরাম লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। এর মধ্যে পথে যাকে পায় প্রায় তাকেই আটক করে পুলিশ টাকা আদায় করে। টাকা না থাকলে থানায় নিয়ে যায়। এর সব দৃশ্যই দেখেছেন রাব্বি। তার পর এসআই মাসুদ রাব্বীর কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। নইলে ক্রসফায়ারে দিয়ে তার লাশ বেড়িবাঁধে ফেলে দেবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। ইতোমধ্যে তিন-চার ঘণ্টা চলে গেছে। রাব্বী তার ছাত্রলীগ বন্ধুদের ফোন করার সুযোগ পান এই বলে যে, তারা টাকা নিয়ে আসবে। এ খবর পেয়ে তার ছাত্রলীগের ১০-১২ জন বন্ধু পুলিশ ভ্যানের কাছে এসে হাজির হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এসআই মাসুদ তাকে ছেড়ে দেন।
পরদিন রাব্বী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে আতঙ্কে তিনি প্রলাপ বকতে থাকেন। ঘুম নেই, বন্ধুরা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন। সে রাতের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে দিতে আঁৎকে উঠতে থাকেন রাব্বী। পরদিন পুলিশ প্রধানের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর এসআই রাব্বীর শাস্তি চেয়ে একটি চিঠি দেন। ঘটনার  বিবিরণে জানা যায়, রাব্বীর অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে মোহাম্মদপুর থানা। তখন মামলাটি গ্রহণের জন্য রাব্বী হাইকোর্টে যান। হাইকোর্ট এসআই মাসুদকে একজন ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে অভিহিত করে মামলাটি গ্রহণের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। তখন এক তাক লাগানো কথা বলে বসেন পুলিশ বাহিনীর প্রধান। তিনি বলেন, রাব্বী পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছে এবং অসহযোগিতা করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। পুলিশের কি কাজে বাধা দিলেন রাব্বী? তিনি পুলিশকে তার পকেটে ইয়াবা ঢোকাতে বাধা দিয়েছেন। এত সাংঘাতিক অপরাধ! পুলিশকে তার পকেটে হাত ঢোকাতে দেননি। হাত দিতে পারলেই ইয়াবা ঢুকিয়ে দেয়া যেত। এটি পুলিশের জন্য একটি সাধারণ ঘটনা। আগে তো ঘটেছেই। এরপর চট্টগ্রামে তিন এসআইয়ের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছে পুলিশ নিজেই। কারণ তারা তিনজন এসএ পরিবহন কাউন্টারে রাখা সাউন্ড বক্সে চারটি ইয়াবা রেখে ওই প্রতিষ্ঠানকে ফাঁসানোর জন্য চেষ্টা করেছিল গত ২২ অক্টোবর। সেটি প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসএ পরিবহন প্রভাবশালী মালিকের প্রতিষ্ঠান। তাদের ফাঁসানো সহজ হয়নি। কিন্তু রাব্বী একজন সাধারণ নাগরিক। তাকে ফাঁসানো সহজ কাজ ছিল। অথচ পুলিশ প্রধান একেই বললেন পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছে ও অসহযোগিতা করেছে।
হাইকোর্টের মামলা নেয়ার ওই আদেশের আগেই প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় এসআই রাব্বীকে প্রথমে ‘ক্লোজড’ ও পরে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন। কিন্তু এই অভিযুক্ত পুলিশ এসআই মাসুদ সিকদারের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল গোটা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে ছুটে গেলেন চেম্বার আদালতে। সেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নেয়ার যে আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, তা স্থগিত করে দেন চেম্বার আদালত। আর সে কারণেই আমি ওরকম একটি মিছিলের অপেক্ষা করছি। যার সামনে গলায় ফুলের মালা নিয়ে গর্বিতভাবে হেঁটে যাচ্ছেন এসআই মাসুদ। আর তার পেছনে বজ্র মুষ্ঠি তুলে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ‘এস আই মাসুদ এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’।
কিন্তু রাষ্ট্র কার পক্ষে দাঁড়াবে? একজন বিপন্ন নাগরিকের পক্ষে, নাকি একজন অভিযুক্ত সম্ভাব্য অপরাধীর পক্ষে? রাষ্ট্র অভিযুক্তের পক্ষেই দাঁড়ালো। আর দেশের কোটি কোটি মানুষকে এক আতঙ্কের মধ্যে ত্রাসের মধ্যে নিক্ষেপ করলো। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্ব মহলে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান রাষ্ট্র অভিযুক্তের পক্ষ নেয়ার ঘটনাকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘রিট আবেদন পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়নি, হয়েছে পুলিশের এক সদস্যের বিরুদ্ধে। যার বিরুদ্ধে এক সরকারি কর্মচারীকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাই রাষ্ট্র যখন তার পক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটাকে ঠিক আইনের শাসন বলা যায় না। রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে নির্যাতন করে ওই পুলিশ কর্মকর্তা স্পষ্টত ফৌজাদারি অপরাধ করেছেন এ জন্য তার বিরুদ্ধে দ-বিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধির নির্দিষ্ট ধারায় মামলা হওয়া অবশ্যই উচিত’। এ বিষয়ে রিট আবেদনকারী ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের পক্ষে আপিল আবেদনে আইন সচিব স্বাক্ষর করেছেন। এছাড়া মোহাম্মদপুর থানার ওসি ও বরখাস্তকৃত মাসুদ সিকদার হাইকোর্টের আদেশ স্থগিতের আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে না গিয়ে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রথামিকবাবে প্রমাণিত হয়েছে তার পক্ষে দাঁড়ানোর ঘটনায় আইন বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত হয়েছেন। এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ইদানীং হাইকোর্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আদেশ দিলেই সরকার আপিল বিভাগে যাচ্ছে। সব আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার হাইকোর্টের গুরুত্ব ক্ষুণ্ন করেছে। তিনি বলেন, পুলিশের নির্যাতনের ঘটনায় রাব্বীর অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। আর সে আদেশ স্থগিত করতে রাষ্ট্র চলে আপিল বিভাগে। সাধারণ নাগরিক যেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করতে পারে না, তাদেরকে আদালতে আশ্রয় নিতে হয়, সেখানে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে যাওয়া মানে পুলিশকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখতে চাচ্ছে সরকার। এর ফলে কোনো সাধারণ নাগরিক ভবিষ্যতে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারবে না, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আর রাষ্ট্রের এই ধরনের আইনী পদক্ষেপে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এমনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন অন্যান্য সিনিয়র আইনজীবীও।
আমরা শুধু লক্ষ্য করছি, কীভাবে একটি অনির্বাচিত সরকার অত্যন্ত নগ্নভাবে ক্রমেই জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর চিন্তা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অস্ত্রধারী বাহিনী দিয়ে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে। এমন চিন্তা ফ্যাসিবাদী হিটলারও করেছিল। হিটলারের শেষ রক্ষা হয়নি। অপর কোনো ফ্যাসিবাদী সরকারেরও শেষ রক্ষা হবে- এমন মনে করার কারণ নেই।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ও আহমদিয়াদের বিভ্রান্তি


স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদের সংখ্যাকে বিতর্কিত বলে অভিহিত করায় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। বলা বাহুল্য, একজন আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত বৃহস্পতিবার এ মামলা করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন আহমদ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অনুমোদন চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪৫ বছর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দুইবারের বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্বাধীনতার ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের অধিনায়ক এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের এ মামলাকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন। এই মামলার মেরিট থাকুক বা না থাকুক বেশিরভাগ বিশ্লেষকের মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে পেশীশক্তি ও কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এসে দেশে গণতন্ত্র হত্যা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ব্যভিচার ও নৈরাজ্যের যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারবিরোধী জনরোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা প্রতিহত করার জন্য বিরোধী দলসমূহকে নেতৃত্বহীন ও নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যেই সরকারের ইঙ্গিতে এই মামলা করা হয়েছে।
একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগণিত শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা কখনো নিরূপণ করা হয়নি এবং স্বয়ং সরকারের হাতেও এর নিশ্চিত কোনো পরিসংখ্যান নেই। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তানী কারাগার থেকে ফিরে আসার পথে লন্ডনে সাংবাদিকদের এই যুদ্ধে নিহত লোকের সংখ্যা তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। দেশে ফেরার সময় তার অন্যতম সাথী ছিলেন বিবিসির খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং বাংলাদেশেরই নাগরিক সিরাজুর রহমান। সিরাজুর রহমান তার এক লেখায় এই মর্মে এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব প্রকৃতপক্ষে তিন লাখই বলতে চেয়েছিলেন এবং ইংরেজিতে তিন লাখকে তিন মিলিয়ন বলে ফেলায় এই পরিসংখ্যান বিভ্রাট ঘটেছে। আসলে এই উপমহাদেশের দেশগুলো মিয়ানমার, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো দেশে ‘লাখ’ শব্দের ব্যবহার নেই। তারা ‘মিলিয়ন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আমাদের  হিসেবে এক মিলিয়ন সমান দশ লাখ। এ প্রেক্ষিতে তার তিন মিলিয়ন নিহত হবার পরিসংখ্যান ত্রিশ লাখে পরিণত হয়েছে বলে ঐ সময় এবং এর পরেও পত্র-পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। এ ব্যাপারে তৎকালীন আওয়ামী লীগের এম.এল.এ ও পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক আবদুল মোহাইমেন তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করেছিলেন এবং আব্দুল মুবিন চৌধুরী ত্রিশ লাখ শহীদের পরিসংখ্যানের সত্যতার ওপর প্রশ্ন তুলে একটি বিশ্লেষণধর্মী পুস্তক রচনা করেছিলেন। যশোর নিবাসী মাওলানা আবুল খায়েরের একটি বিশ্লেষণধর্মী তথ্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক সালাহউদ্দিন জহুরীর ‘ত্রিশ লাখের তেলেসমাতি’ শীর্ষক একটি বই এখনো বাজারে পাওয়া যায়।
স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কোনো সমীক্ষা বা শুমারি পরিচালনায় তৎকালীন সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে দশ জানুয়ারি দেশে ফেরার পথে অথবা পাকিস্তান অবস্থানকালে কে বা কারা এই তথ্য দিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য ও জনশ্রুতি তথ্য-পরিসংখ্যান এক নয় এবং এই জাতের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতাও ভিন্ন। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে প্রতিটি থানায় সার্কেল অফিসারদের আহ্বায়ক করে সারা দেশে এই সংখ্যা নিরূপণের জন্য ঋধপঃ ঋরহফরহম কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি বিস্তারিত জরিপ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার রিপোর্টও জমা দিয়েছিলেন। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানসমূহ একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যানও এই মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য এক লাখেরও কম ছিল বিধায় তা আর জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি বলে পত্র-পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়।
বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও তাদের পরিবারবর্গকে ভাতা দিয়ে থাকেন। সমাজকল্যাণ বিভাগের তরফ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০১০ সালে এর সংখ্যা ছিল এক লাখের নিচে। ২০১৫ সালের নবেম্বরে এসে এই সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার এ বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধনের ন্যায় কিছু কারসাজি আছে বলে মনে করেন। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ লোকের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ ও তা প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। তারা আমাদের ইতিহাসের অংশ এবং তাদের রক্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাদের সংখ্যা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। দেশবাসী আশা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় সরকারের তরফ থেকে ত্রিশ লাখ শহীদের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা প্রভৃতি আদালতে দাখিল করে সরকার প্রমাণ করবেন যে, এই পরিসংখ্যান সত্য এবং সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সাথে সাথে শহীদদের পরিবারসমূহের জন্য অন্যান্যদের ন্যায় ভাতার ব্যবস্থা করে ইনসাফের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। এতে বেগম জিয়ার মতো দেশের কোটি কোটি মানুষ সন্দেহমুক্ত হবেন।
॥ দুই॥
গত রোববার ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ দেখে পাঠক-পাঠিকাদের অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। সংবাদটি হচ্ছে আহমদিয়া মুসলিম জামাত কর্তৃক আয়োজিত একটি শান্তি সম্মেলন সংক্রান্ত। ঢাকায় আহূত এ সম্মেলনে সকল ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের সন্ত্রাস প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ আহ্বানটি যৌক্তিক, মানবাধিকার এবং ইনসাফবান্ধব। ধর্ম কখনো মানুষকে সন্ত্রাসী হতে উৎসাহিত করে না বরং শান্তি প্রতিষ্ঠাতেই উজ্জীবিত করে। এ প্রেক্ষিতে  আলোচনার বিষয়বস্তুকে আমি সঠিক এবং সময়োপযোগী বলে মনে করি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। সারা দুনিয়ার আলেম সমাজ আহমদিয়া সম্প্রদায়কে মুসলমান মনে করেন না। ওআইসির ফিকাহ একাডেমি আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি দেশের মধ্যে ৩৭টি মুসলিম দেশ ইতোমধ্যে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করছে। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায় খতমে নবুওয়্যাতে বিশ্বাস করেন না এবং মির্জা গোলাম মোহাম্মদ কাদিয়ানীকে নবী হিসেবে মানেন। যে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে এবং বিশ্বাস করে মুসলমান হতে হয় তারা তাতে বিশ্বাস করেন না। আগেই বলেছি তাদের মুসলমান না হওয়া সম্পর্কে বিশ্বের সকল খ্যাতনামা আলেম একমত। আমাদের দেশেও তাদের একই অবস্থা। কিন্তু গত রোববার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে তারা বাংলাদেশ আহমদিয়া মুসলিম জামাতের নামে যে সিম্পোজিয়ামটির আয়োজন করেছেন তাতে মুসলিম শব্দটির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা তো মুসলিম নন, মুসলমান হবার প্রাথমিক শর্ত পালন করে না, তাদের আকীদা বিশ্বাসও মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাসের পরিপন্থী। আবার এতে দেখা যায় যে, ড. কামাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। ঘাদানিক সভাপতি শাহরিয়ার কবীর, বাড্ডার বৌদ্ধ মন্দিরের ভেন শুনানন্দপ্রিয় ভিক্ষু, ফাদার তপন ডি রোজারিও এবং সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক এতে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আব্দুর রশীদও এতে বক্তব্য রেখেছেন। কে প্রধান অতিথি ছিলেন, কে বিশেষ অতিথি অথবা কারা কারা বক্তব্য রেখেছেন এটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাদিয়ানীদের মুসলিম শব্দ ব্যবহার নিয়ে। আগেই বলেছি তারা মুসলিম নন। তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে এ দেশের মুসলমান এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন বলে মনে হয়। এ বিভ্রান্তি পরিকল্পিত এবং সরকারি অনুগ্রহপ্রাপ্ত। ইসলাম সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, খুন, রাহাজানি, হত্যায় বিশ্বাস করে না। এর বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে এবং রাসূল (সা.)-এর অসংখ্য হাদীসও রয়েছে। আমার জানা মতে অনেকগুলো ইসলামী দল সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েও তা পায়নি। এই অবস্থায় কাদিয়ানীদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে অনুষ্ঠান করার পেছনে ইসলামবিরোধী তৎপরতা এবং ষড়যন্ত্র নেই এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কাদিয়ানীরা কাদিয়ানী হিসেবেই থাকুক, তাদের নামের সাথে মুসলিম শব্দটি সংযোজন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি কেউ না করুক এটাই আমাদের কাম্য।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

শনিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রসঙ্গ অবসরে গিয়ে রায় লেখা : প্রধান বিচারপতির মন্তব্য নিয়ে সারা দেশে আলোচনার ঝড়


প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সম্প্রতি দুটি বিষয়ে প্রকাশ্যে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। মতামত দুটি শুনে মনে হলো, দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে তিনি দুটি শক্তিশালী বোমা ফাটিয়েছেন। প্রথমে তিনি বললেন যে, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছে। তিনি এতদূরও বললেন যে, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করার চেষ্টা করছে। তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে, বিশেষ করে আইনজীবীদেরকে, এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করার আহ্বান জানান। লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, এই ধরনের অত্যন্ত সিরিয়াস কথা এসেছে দেশের অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখ দিয়ে যিনি বাংলাদেশের সমগ্র বিচার বিভাগের প্রধান। দেশের আইনসভা বা সংসদের প্রধান হলেন স্পিকার। নির্বাহী বিভাগের প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। আর বিচার বিভাগের প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি। যে দেশে এই তিন বিভাগ তথা তিনজন বিভাগীয় প্রধানের মধ্যে সমন্বয় এবং সম্প্রীতি থাকে সে দেশে আইনের শাসন এবং সুশাসন উভয়ই বজায় থাকে। যে দেশে এই তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকে না সে দেশকে নানাবিধ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়।
নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং সম্প্রীতি নেই, এমন কথা আমরা বলব না। তবে প্রধান বিচারপতি অতি সম্প্রতি এই ধরনের যে দু’একটি কথা বলছেন তার ফলে ধারণা করা অন্যায় হবে না যে, কোথায় যেন সমন্বয় সূতাটি ছিঁড়ে গেছে বা দুর্বল হয়ে গেছে। তা না হলে প্রধান বিচারপতির নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করছে, এটুকু বলেই তিনি ক্ষান্ত থাকতেন। কিন্তু তিনি সেই অশুভ হস্তক্ষেপ বা স্বাধীনতা হরণের প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানাতেন না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। ইতোমধ্যেই সুধী মহলে বলাবলি শুরু হয়েছে যে, ‘Something is grossly wrong somewhere’।
এছাড়া গত মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে ভূমিকম্পের মতো কম্পন সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বর্ষপূতিতে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।’ তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আদালতের নথি সরকারি দলিল (পাবলিক ডকুমেন্ট)। একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের নিকট সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে দস্তখত করার অধিকার হারান। আশা করি, বিচারকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকবেন।’
একটি সভায় বক্তৃতা আরম্ভ করার প্রারম্ভে তার মনে হলো, আর তিনি ঐ কথা বলে দিলেন, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। বরং পরবর্তীতে তার ভূমিকা থেকে বোঝা যায় যে, প্রধান বিচারপতি জেনে শুনে এবং চিন্তা ভাবনা করেই ঐ কথা বলেছেন। কারণ গত শুক্রবার ২২ জানুয়ারি মৌলভীবাজারেও তিনি সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং আইন ও সংবিধান পরিপন্থী কোন কাজ করতে দেয়া হবে না বলে তার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১০ টার দিকে মৌলভীবাজার জেলা বার এসোসিয়েশনের ‘বার্ষিক নৈশভোজ ও সভা-২০১৬’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি পুনরায় বলেন, আইন ও সংবিধান রক্ষায় আমাদের সংশোধিত হতে হবে। দেশে এখন গণতন্ত্র আসছে, সংবিধান আছে, এখন আমরা আইনে চলবো। সেই সামরিক আইন চলবে না। আইনকে সমুন্নত রেখে চলবো। আইন ও সংবিধান পরিপন্থী কোনো কাজ হতে দেয়া হবে না। অতীতে চললেও এখন থেকে অবসরে যাওয়ার পর আর কোনো বিচাপতিকে রায় লিখতে দেয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর আর কোনো রায় লিখতে দেয়া হবে না। আমরা আজব দেশে বাস করি। বিশে^র অন্যান্য দেশে বিচারকরা অবসরে যাওয়ার পর আর কোনো মামলার রায় লিখতে পারেন না। আমাদের দেশে অতীতে এ রকম রায় দিলেও এখন থেকে আর এ সুযোগ দেয়া যাবে না। ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন’।
মৌলভীবাজারের এই বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।
এ সময় সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, অনেক বিচারপতি ছুটি পেয়ে সরকারি খরচে বিদেশ চলে যান। অথচ পাঁচ-সাত বছরেও রায় লেখেন না। তিনি বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা দয়া করে আইন ভঙ্গ করবেন না। আপনারা যদি আইন ভঙ্গ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষজন কী করবে?
॥দুই॥
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার এই বক্তব্য সরকারের আঁতে ঘা দিয়েছে। কারণ তিনি যা বলেছেন, সেটিকে যদি কাজে পরিণত করা হয় তাহলে মৌচাকে ঢিল পড়বে। কারণ বিগত ১৪-১৫ বছরে সুপ্রিম কোর্ট যেসব রায় দিয়েছে, বিচারপতি এসকে সিনহার কথা মেনে চললে তো বাংলাদেশের অতীতের অনেক রায় শুধু পাল্টেই যাবে, সেগুলো বাতিল হবে, আর না হয় গণেশ উল্টে যাবে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন শুক্রবার বলেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর কোনো আইনজীবী যদি রিভিউ বা রিট পিটিশন দায়ের করেন তাহলে বিগত দিনগুলোতে অবসরে যাওয়ার পর যে রায় লেখা হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ ও সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি করবে।
হুমকির মুখে পড়েছে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী (’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারকে বৈধতা দান) ও ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায়সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক মামলার রায়। ‘বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী’ বলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্যের পর ঐতিহাসিক অনেক মামলার রায় সাংবিধানিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এসব মামলা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিও। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের রায়ে স্বাক্ষর করতে না দিতে প্রধান বিচারপতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে সংবিধানের ১৫তম, ১৩তম, পঞ্চম, সপ্তম সংশোধনীর মামলার রায়, জেল হত্যা মামলার রায়, মাজদার হোসেনের মামলার রায়সহ অনেক সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ এসব মামলার রায় বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছেন। ফলে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের কারণে এসব রায় প্রশ্নবিদ্ধ হলে দেশে চরম সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রধান বিচারপতির এই সব উক্তি তো হলো তাঁর মন্তব্য। তাঁর মন্তব্য মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে সেটিকে ভার্ডিক্ট বা রায় হিসাবে আসতে হবে। আর সেটা করতে হলে দেশের কোনো একজন বৈধ নাগরিককে রিট পিটিশন দায়ের করতে হবে।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, একজন বিচারক সাংবিধানিকভাবে আইন সংরক্ষণের জন্য শপথ নেন। বিচারক যখন অবসরে যান, তখন তার আইন রক্ষা করার সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই। প্রধান বিচারপতি তো অনেক উপরে। কারণ তিনি আইন ও সংবিধান রক্ষা করার জন্য শপথ নিয়ে এ পদে ঢোকেন। অতীতে কিছু বিচারক কাজে ভুল করেছেন। তারা জানতেন না বা জেনেও প্রধান বিচারপতি যেটা চাপিয়ে দিয়েছেন, সেটা করেছেন। প্রধান বিচারপতি নিজেও সেটা করেছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি, বিচারপতিদের কাছে আবেদন করব আপনারা যদি আইন ভঙ্গ করেন তাহলে সাধারণ মানুষ কি করবে? আইন ভঙ্গ করবেন না।’
॥ তিন॥
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আরও বলেন, একজন বিচারক যখন রিটায়ার করেন তখন আপনি (সাধারণ নাগরিক) আর আমি (বিচারক) সমান হয়ে যাই। আমার কিন্তু আর কারো রক্ষা করার সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই। সিভিল প্রশাসনের কেউ রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার পর আর বাকি কোনো কাজ করার সুযোগ থাকে না। উদাহরণ হিসাবে দেখান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন চিফ সেক্রেটারি রিটায়ারমেন্টে চলে গেলে তিনি আর অফিসে ঢুকতেই পারবেন না। তারাতো কোনো শপথ নেন না। আর বিচারপতিরা আরও উপরে। আইন সংবিধান রক্ষা করার জন্য শপথ নেন। তাই রিটায়ার করার পর বিচারকের রায় লেখার কোনো অধিকার নেই। আমি এটি এলাও করবো না। এই সময় তিনি বলেন, আমাদের কিছু আইনজীবী তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে বক্তব্য দেন। এই সময় তিনি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেন। এই প্রসঙ্গে ভারতের একটি বিখ্যাত রায়ের প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন সেই (ভারতের) মামলায় ১৩ জন বিচারপতি দিয়ে কন্সটিটিউশনাল বেঞ্চ হয় সুপ্রিম কোর্টে। প্রায় ছয় মাস এক নাগারে চলে মামলা। এই মামলার রায় কয়েক হাজার পাতার। এটি একটি ইতিহাস। ১৩ জন বিচারপতি যে দিন রায় দেন ঠিক তার পর দিন প্রধান বিচারপতি সিক্রি রিটায়ার করেন। আরও ২ জন বিচারক মারা যান। রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার কারণে প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষর করতে রাজি হননি রায়ে। রিটায়ারমেন্টের পর প্রধান বিচারপতি বলেন আমি সাধারণ নাগরিক। সেই রায়ে ১৩ জন বিচারকের মধ্যে নয়জনের স্বাক্ষর ছিল। এটি একটি ইতিহাস। সারা বিশ্ব এই রায়কে ফলো করে। আমরা অনেক কিছু জানি না। আমাদের সংশোধিত হতে হবে। তিনি আরও বলেন কিছু বিচারক আগে ভুল করেছেন। তারা জানতেন না বা তারা জেনেও প্রধান বিচারপতি এটি চাপিয়ে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি নিজেও রায় লিখে যেতে পারেননি। শ্রদ্ধার সঙ্গে বিচারপতি যারা আছেন তাদের কাছে আমি আবেদন করবো আপনারা  যদি আইন ভঙ্গ করেন তবে সাধারণ নাগরিকরা কি করবে? আইন ভঙ্গ করবেন না। আমি কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে দেখেছি তারা কল্পনাই করতে পারে না একজন বিচারক রিটায়ারমেন্টের পর রায় লিখবে। আমাদের দেশ একটি আজব দেশ। রিটায়ারমেন্টের পর বিচারক রায় লেখেন। এখানে তার ব্যক্তিগত কি ইন্টারেস্টে? তিনি এই সময় আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান লেখাপড়া করার জন্য। প্রধান বিচারপতি সিনহা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর বই থেকে উদ্ধৃতি পড়ে শোনান। সম্প্রতি রিটায়ারমেন্টে যাওয়া এক বিচারপতি (শরিফ উদ্দিন চাকলাদার) আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করার জন্য। তার এই অধিকার আছে। তবে তিনি প্রাকটিসও করবেন আবার রায়ও লিখবেন, এটি কেমন করে হবে? অতীতে কোনো কোনো বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখেছেন। কিন্তু এটি এখন কোর্টের রায়।  না জানার কারণে এটি হয়েছে। মার্শাল ল-এর আমলে এরকম অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু এখন  দেশে আইনের শাসন আছে। গণতন্ত্র আছে।
এটি একটি হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। আইনশাস্ত্র সম্পর্কে প্রচুর পড়াশুনা না থাকলে এবং বিশে^র বিভিন্ন দেশের বড় বড় মামলার রায় জানা না থাকলে এ সম্পর্কে সঠিক কোন মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে আমরা একটি বাংলা ট্যাবলয়েডের গত শনিবারের সংখ্যায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রধান সংবাদের অংশ বিশেষ নিচে উদ্ধৃত করছি, “অবসরে গিয়ে রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থী এই মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ৫২ বছর আগে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ. আর কর্নেলিয়াসের দেয়া রায়ের প্রতিধ্বনি করেছেন। কাজী মেহের দীন বনাম মিসেস মুরাদ বেগম মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রায় দেন যে, অবসরে গিয়ে রায় লেখা যাবে না। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, রায় লেখা একটি বিচারিক কর্ম বা জুডিশিয়াল ওয়ার্ক। কোনো বিচারক অবসরে গেলে আর বিচারক থাকেন না। তাই অবসরে রায় লেখা বৈধ নয়। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট এ প্রসঙ্গে দেওয়ানি কার্যবিধি সিপিসির অর্ডার ২২ এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, সিপিসি অবসর পরবর্তী রায় প্রদানকে সমর্থন করে না। কারণ একজন বিচারক অবসরে গেলে তিনি ফাংটাস অফিসিও হয়ে যান। লাতিন আইনি পরিভাষা অনুযায়ী ফাংটাস অফিসিও মানে তিনি আর অফিসে থাকেন না। তাই অফিসে থাকার যে এখতিয়ার সেটা তিনি হারিয়ে ফেলেন।’’
আসিফ আরসালান

শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জুমার খুতবায় রাজনৈতিক বক্তব্যে নিষেধাজ্ঞা হিতে বিপরীত হতে পারে


ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, জুমার খুতবায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অবশ্য রাজনৈতিক বক্তব্যের সংজ্ঞা তারা নির্ধারণ করে দেননি। রাজনৈতিক বক্তব্য কাকে বলা হয় তা নির্ধারণ না করে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বিরাট একটি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। কারণ নিষেধাজ্ঞা যারা জারি করছেন এবং যাদের উপর জারি করছেন তারা সবাই খুব ভালভাবেই জানেন যে এখানে ইসলামী রাজনীতির কথাই বুঝানো হচ্ছে। ইসলামী রাজনীতির কথা ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ কখনো মসজিদে রাজনীতির কথা বলেননি এবং তা মসজিদে বলার অনুমতিও ইসলাম দেয় না। এবং ইসলামী রাজনীতির কথা মসজিদে বলা হয় এবং সেটা বলার অনুমতিও ইসলামে আছে। আর সেটাই বন্ধ করার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি চালু আছে, যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ইসলামী রাজনীতি। অন্য কথায় বলতে গেলে, কেউ তাদের জীবনে আব্রাহাম লিঙ্কন এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে, আর কেউ লেনিন, মাওসেতুং এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে, আবার কেউ রাসূল সঃ এর দর্শন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক বক্তব্য বলতে যদি লেনিন, মাওসেতুং বা আব্রাহাম লিঙ্কন এর রাজনীতি বুঝানো হয়, তাহলে এই রাজনৈতিক বক্তব্য মসজিদে দেয়া যাবে না। এতে কোনো মুসলমানের দ্বিমত নাই, থাকতে পারে না। আর যদি রাজনৈতিক বক্তব্য বলতে ইসলামী রাজনীতি বুঝানো হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে রাসূল সঃ এর আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার কথা মসজিদে বলা যাবে না। এখানে মুসলমানদের ঘোর আপত্তি আছে এবং থাকবে। কারণ মসজিদ মুসলমানদের জন্য আল্লাহর ইবাদাত করার স্থান। আর রাসূল সঃ এর আদর্শ মুসলমানদের জীবনে বাস্তবায়ন করার নামই হচ্ছে ইসলাম। এবং রাসূল সঃ যেমন নামাজ রোজা করেছেন ও এর নিয়ম কানুন আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনাও তিনি করেছেন এবং এর সমস্ত নিয়ম-কানুনও তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর রাসূল সঃ এর আদর্শ সমস্ত মুসলমানদের জীবনে বাস্তবায়ন করার আদেশ আল্লাহ্ কুরআন মজিদে দিয়েছেন। হুজুর সঃ এর জীবনের সিংহভাগই রাজনীতি। হুজুর সঃ এর আদর্শ মুসলমানদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেয়াকে রাজনীতি বলা হোক বা ওয়াজ নসিহত বলা হোক, এটাকে নিষেধ করা যেতে পারে না। এটাকে নিষেধ করার অর্থ হলো পুরো ইসলাম ধর্মকেই নিষিদ্ধ করে দেয়া। এটা কোনো মুসলমান মানতে পারে না। আর ইসলামী রাজনীতির কথা মসজিদে বলা যাবে না বলে যারা ঘোষণা দেবে এবং বিশ্বাস করবে যে ইসলামের মধ্যে রাজনীতি নাই বা ইসলামী রাজনীতি অস্বীকার করবে, তারা পক্ষান্তরে পুরো কুরআনকেই অস্বীকার করল। কারণ কুরআনে যেমন নামায রোজার কথা বলা হয়েছে, তেমন বিচার ব্যবস্থা ও দেশ পরিচালনার কথাও বলা হয়েছে। ইসলাম শুধুমাত্র নামায রোজার মতো কিছু নির্দিষ্ট ইবাদাতের নাম নয়। ইসলাম ধর্ম হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো মানবজাতির জন্য জীবনবিধান। আর ইসলামে নির্দিষ্ট কিছু ইবাদাত পালন করে বাকি অংশকে অস্বীকার করার সুযোগ নাই। তবে ইসলামের সমস্ত বিধানকে স্বীকার করে তার সবটুকু পালন করতে না পারলেও আল্লাহর কাছে তওবা করার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু ইসলামের কিছু অংশকে অস্বীকার করলে সে আর মুসলমানই থাকে না। যেমন কেউ যদি বলে যে, ইসলাম ধর্ম আমি পালন করব, তবে কুরআনের যে সমস্ত আয়াতে রাজনীতির কথা বলা হয়েছে তা আমি মানব না বা স্বীকার করব না, এমনকি সেইসব বিধান যারা পালন করবে তাদেরকে আমি বাধা দেব- তাহলে সবাই জানে যে সে মুসলমান হতে পারবে না। অর্থাৎ তার ঈমান থাকবে না। আবার কেউ যদি বলে যে, ইসলামে নামায রোজা যেমন আছে সেরকম রাজনীতিও আছে। তবে আমি নামায রোজাতে অবহেলা করলে যেমন আল্লাহর কাছে লজ্জিত হই, সে রকম ইসলামী রাজনীতি করতে না পারার কারণেও আমি আল্লাহর কাছে লজ্জিত। তাহলে সে গোনাহগার হলেও মুসলমান। তার ঈমান নষ্ট হবে না।
একইভাবে আবার নামায রোজাতে বাধা দিলে যেমন ঈমান নষ্ট হয়ে যায়, সেরকম ইসলামী রাজনীতিতে বাধা দিলেও ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। কারণ ইসলামে নামায রোজা যেমন ইবাদত, তেমনি ইসলামে ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করাও ইবাদত। এখানে একটা পালন করার অনুমতি দিয়ে অন্যটাকে বাধা দেয়া মানেই ইসলামকে অস্বীকার করা। কেউ ইসলামকে অস্বীকার করলে সে আর মুসলমান থাকে না। আল্লাহ্ বলেন- অর্থাৎ, “তবে কি তোমরা (আল্লাহর প্রেরিত) গ্রন্থটির কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন।” (সূরা বাকারা, ৮৫)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- অর্থাৎ, “হে ইমানদারগণ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা, ২০৮)।
কুরআনের আয়াত থেকে বুঝা যায়, কিছু বিষয়ে ইসলাম পালন করা আর কিছু বিষয়ে পালন না করার অনুমতি আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেননি। ইসলামী রাজনীতি করা যাবে না শুধু নামায রোজা করা যাবে- এরকম বলার অর্থ দাঁড়ায় ইসলাম পরিপূর্ণভাবে মানা যাবে না। তবে খণ্ডিতভাবে মানা যাবে। আর আল্লাহ্ বলছেন ইসলাম পরিপূর্ণভাবেই মানতে হবে। তাহলে যারা বলছেন মসজিদে ইসলামী রাজনীতি করা যাবে না, তারা তো বলতে গেলে এক প্রকার আল্লাহর সাথে যুদ্ধই ঘোষণা করে ফেলেন।
কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, মসজিদে রাজনৈতিক কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, ইসলামী রাজনীতি বলে কথা নাই, সব ধরনের রাজনীতির কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি যে, সব ধরনের রাজনীতি বন্ধ করলে ইসলামী রাজনীতিও বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া মসজিদে কেউ লেনিনবাদ আর সমাজতন্ত্রের কথা বলে না। বলে শুধু ইসলামী রাজনীতির কথা। সেটাই বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইসলামী রাজনীতি শুধু মসজিদে নয়, সভা-সেমিনারেও বন্ধ করার জন্য নজরদারির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে, ইসলামী রাজনীতি বন্ধ করার জন্যই এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যে ইসলামে রাজনীতি নাই সেরকম ইসলাম পালন করতে পারবেন আর যে ইসলামে রাজনীতি আছে সেরকম ইসলাম পালন করা যাবে না- এটাই তারা বলতে চাচ্ছেন। তো আল্লাহ্ যে ইসলাম আমাদের জন্য দিয়েছেন সেটাতে তো রাজনীতি আর ইসলাম একটার সাথে একটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা রাজনীতিমুক্ত ইসলাম পাব কোথায়?
কয়েক বছর আগে আদালত থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ। এ রায় শুনে  সারা দেশের মুসলমানগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সারা দেশ উত্তাল হয়ে পড়েছিল এই রায়ের বিরুদ্ধে। বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে তারা, কিন্তু আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়েছিল এই কথা বলতে যে ফতোয়া বৈধ।
আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ 

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ব্রিটেনের উদ্বেগ ও পরামর্শ


পুলিশ তথা আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লংঘনের অব্যাহত ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নবনিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেক। গত বুধবার নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্রিটিশ হাইকমিশনার বিশেষ করে সরকারের প্রতি সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তারা অব্যাহতভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং করতে থাকবেন। সতর্ক করতে গিয়ে এলিসন ব্লেক আরো বলেছেন, তার দেশ কোনো দেশের এমন কোনো সংস্থা বা বাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করে না, যারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। সংবাদ সম্মেলনে দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচন প্রসঙ্গেও স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। বলেছেন, ব্রিটেন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক অতীতে নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে ব্রিটেনের যে উদ্বেগ ছিল সেটা গোপন করার কিছু নেই। কারণ, এসব নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটার জনগণ ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সব দল ও সব ভোটারের অংশগ্রহণ থাকা উচিত। কেন না, এটাই একটি দেশের জন্য সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আনে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সব পর্যায়ের সব নির্বাচনে সব পক্ষের অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে ব্রিটেনের সহায়তা থাকবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন দেশটির হাইকমিশনার। 
আমরা ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেকের প্রতিটি বক্তব্যকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। পুলিশ এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টিকে সামনে আনা হলে স্মরণ করতেই হবে যে, শুধু ব্রিটেন নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডাসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পুলিশের বাড়াবাড়ির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ড ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। মূলত সে কারণেই ব্রিটিশ হাইকমিশনারের এ সংক্রান্ত বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি-মনোভাব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। পরিষ্কার হয়েছে, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি পুলিশ রাষ্ট্র হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের জন্য অসম্মানজনক হলেও ব্রিটিশ হাইকমিশনার বা অন্য কারো সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। সে সুযোগ সরকারই রাখেনি। কারণ, বর্তমান সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই পুলিশকে দিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে। ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ প্রকৃত বিরোধী কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দিচ্ছে না সরকার। এ সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও এত বেশি যে, সেগুলো সম্পর্কে পৃথকভাবে উল্লেখের দরকার পড়ে না। সরকারের প্রশ্রয়ে থাকায় এবং কোনো অপরাধের বিচার না হওয়ায় পুলিশ শুধু বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি, অনেক ব্যক্তির ওপরও হামলা ও নির্যাতন চালাতে শুরু করেছে। 
নবাগত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আসলে সেসব ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছেন, তার দেশ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে এবং পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে। এ প্রসঙ্গে তার হুশিয়ারিও লক্ষ্য করা দরকার। কারণ, তিনি বলেছেন, তার দেশ কোনো দেশের এমন কোনো সংস্থা বা বাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করে না, যারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। উল্লেখ্য, পুলিশ ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর জন্য ব্রিটেন অর্থনৈতিক এবং প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসহ নানা ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকে। এই সাহায্যের পরিমাণ ইতিমধ্যেই অনেক কমে এসেছে। পুলিশের লাগাম না টেনে ধরা হলে ভবিষ্যতে হয়তো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। সে কথাটাই জানিয়ে কিছুটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন হাইকমিশনার এলিসন ব্লেক। 
দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচন প্রসঙ্গেও তার বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন এবং একথা সত্যও যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে ব্রিটেন আদৌ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন সম্পর্কেও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তিনি। এই প্রতিক্রিয়াকে দেশটি যে গোপন রাখেনি বা রাখছে না সে কথাটাও জানিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তিনি সেই সাথে সব দল ও পক্ষের অংশগ্রহণে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠান করার তাগিদ ও পরামর্শ দিয়েছেন, যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সহিংসতামুক্ত। এ লক্ষ্যে সরকার এবং সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি, যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হয় এবং সব দল যাতে সে নির্বাচনে বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এলিসন ব্লেকের বক্তব্যের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তার দেশ চায়, বাংলাদেশে অচিরেই সকলের অংশগ্রহণমূলক নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। 
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত অবিলম্বে অবস্থানে পরিবর্তন ঘটানো এবং বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই একাধিক উপলক্ষে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সমাধান দিয়ে রাখায় সংলাপের ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এখন দরকার আসলে ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছার। আমরা আশা করতে চাই, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের মূল কথাগুলো অনুধাবনে ক্ষমতাসীনরা কোনো ভুল করবেন না।

বুধবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের এ কেমন আমলনামা!


উক্তিটি শুধু ঔদ্ধত্যপূর্ণ নয়, ভয়ঙ্করও বটে! ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে নির্যাতনকালে পুলিশ কর্মকর্তার ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’- বক্তব্যকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। ১৬ জানুয়ারি ঢাকা ল্যাবএইড হাসপাতালে বিকাশকে দেখতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ঔদ্ধত্যপূর্ণ এই উক্তিটি ভয়ানক উক্তি। দেশে যে অবস্থা চলছে, তা এখনই বন্ধ করা না হলে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া না হলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে; যার পরিণতি ভালো হবে না। বিকাশকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান, সাংবিধানিক অধিকার এবং নির্যাতনবিরোধী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তার চিকিৎসার ব্যয় রাষ্ট্রের বহন করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর ক্ষত না শুকাতেই বিকাশ চন্দ্র দাসকে পেটালো পুলিশ। এদিকে গোলাম রাব্বীকে মধ্যরাতে ছদ্মবেশে হাসপাতালে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পেয়েছে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে পুলিশের সক্ষমতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন জেগেছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে পুলিশের বিরুদ্ধে রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে শাস্তি দেয়া হয়েছে ১০ হাজার পুলিশ সদস্যকে। এদের মধ্যে ৭৬ জনকে করা হয়েছে চাকরিচ্যুত। পুলিশ সদর দফতরের প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড এন্ড ডিসিপ্লিন (পিএসডি) শাখা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। লঘুদণ্ড, গুরুদণ্ড ও বিশেষ দণ্ড- এই তিন ক্যাটাগরিতে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিজস্ব আইনে ব্যবস্থা নেয় পিএসডি। প্রসঙ্গত, এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০১৫ সালের ১৯ ও ২১ জুন দুই দফা নির্দেশনা দিয়ে থানায় সিভিল টিম বা সাদা পোশাকে অভিযানে পুলিশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। কিন্তু কমিশনারের নির্দেশনা অমান্য করে বিভিন্ন থানায় সিভিল পোশাকে ডিউটি পালন চলছে। সাদা পোশাকে অভিযানের নামে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গ্রেফতার-বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সিভিল পোশাকে দায়িত্ব না পালনের যে নির্দেশনা রয়েছে, সেই নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় থানা পুলিশের সিভিল টিমগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কখনও কখনও পুলিশের কতিপয় সদস্য সিভিল টিম হিসেবে আটকের নামে অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করছে। এ ব্যাপারে মানবজমিন পত্রিকার ১৭ জানুয়ারি সংখ্যায় বিশদ বিবরণ রয়েছে।
দেশের মানুষ আইনের শাসন চায়, সুশাসন চায়- এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খোদ পুলিশই যখন মানুষের আস্থা হারিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন তা দেশের জন্য এক বড় সঙ্কট হয়ে ওঠে। এই সঙ্কট দূর করার দায়িত্ব সরকারের এবং পুলিশ প্রশাসনের। পুলিশের অনাকাক্সিক্ষত এবং বেপরোয়া ভূমিকায় পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা বলেছেন, পুলিশের বিধান অনুযায়ী পুলিশকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা দেয়া হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। পুলিশকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কিংবা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হলে এই বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা জানি, সরকারের দায়িত্ব দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যেই পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কোনো সরকার যদি পুলিশ বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে কিংবা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-অবদমনে উস্কে দেয়, তখন ওই বাহিনীর নৈতিকতা ও পেশাগত দায়িত্ববোধে অবক্ষয় দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত ভূমিকা আশা করা যায় না। বর্তমান অবস্থায় আমরা তেমন চিত্রই লক্ষ করছি। এমন চিত্র পরিবর্তনে সরকার অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনেরও করণীয় আছে। কাক্সিক্ষত সে দায়িত্ব পালনে তারা এগিয়ে আসে কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
‘ওরা কেন গডফাদার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ। ১৬ জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত প্রবিদেনটিতে বলা হয়, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েকজন রাজনীতিক নিজ নিজ এলাকায় গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে হাতে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম। এমনকি কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক চোরাচালানের অভিযোগ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও তাদের হাতে জিম্মি।
জনপ্রতিনিধিদের এমন আমলনামা খুবই ভয়ঙ্কর। যারা জনগণের প্রতিনিধি, তাদের তো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে কাজ করার কথা। কিন্তু আলোচ্য প্রতিবেদনে কিছু জনপ্রতিনিধির কর্মকাণ্ডের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা তো গণআকাক্সক্ষার একেবারে বিপরীতে। এমন আমলনামা নিয়ে তারা গণপ্রতিনিধি হিসেবে থাকেন কেমন করে? আর এমন প্রশ্নও জাগে যে- জনপ্রতিনিধিরা গডফাদার হয়ে উঠছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, জনপ্রশাসনবিষয়ক গবেষকসহ বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তারা বলছেন, অতিমাত্রায় ক্ষমতার লোভ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়া, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া এবং ক্ষমতা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের আকাক্সক্ষা থেকে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় জনপ্রতিনিধিরা গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সমাজে বড় রকমের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমরা এখানে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানের বক্তব্যকে তুলে ধরতে পারি। তিনি নেতাদের গডফাদার হয়ে ওঠাকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, জাতি আজ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর প্রধানতম কারণগুলো হলো- সরকারগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহার, অসৎ ব্যক্তিদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, অগণতান্ত্রিক-অস্বচ্ছ ও দায়বদ্ধতাহীন রাজনৈতিক দল, দুর্বল নির্বাচন কমিশন, অকার্যকর সংসদ, রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চার অভাব ইত্যাদি।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্লেষণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, যেসব জনপ্রতিনিধি এখন গডফাদার হয়ে উঠছেন, সেজন্য শুধু তারাই দায়ী নন। তাদের পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে আরো অনেকের দায়দায়িত্ব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার, অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ রাজনীতি, দুর্বল নির্বাচন কমিশন ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। মূলত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ধস নামায় রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের যে দৌরাত্ম্য চলছে, তাতেই সর্বক্ষেত্রে সঙ্কটের মাত্রা বাড়ছে। বিষয়টি শুধু যে বিশ্লেষকরাই উপলব্ধি করছেন, তা নয়; সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীকরাও তা জানেন। এখন রাজনীতিতে সুবাতাস ফিরিয়ে আনতে হলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন সরকারের এবং বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারাই।
তবে এ ব্যাপারে সাফল্যের জন্য চাতুর্যের বদলে প্রয়োজন নৈতিক দায়িত্ববোধ। এ বিষয়টিতে আমাদের রাজনীতিবিদদের দারিদ্র্য রয়েছে। সেই দারিদ্র্য থেকে এবার তারা মুক্ত হতে পারেন কিনা- সেটাই দেখার বিষয়। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের চাইতেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে আমাদের রাজনৈতিক দারিদ্র্য। রাজনৈতিক দারিদ্র্য দূর না হলে, কোনো উন্নতিই টেকসই হতে পারে না। বিষয়টি যাদের বোঝা উচিত, তারা বুঝলেই মঙ্গল।

মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মাসতুতো ভাইদের গল্প


চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ এই প্রবাদ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে বহুদিন, প্রায় অনাদিকাল থেকে। এ প্রবাদ হাজার হাজার বছর ধরে অমোঘ সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত আছে। বর্তমান সরকারের আমলে এ আরও সর্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছে। এই মাসতুতো ভাইদের একসূত্রে গ্রথিত করার জন্য রিমডেলিং করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটিকে। শুরুতে বিএনপির শাসনামলে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণই করা হয়েছিল স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন হিসেবে। তাতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সমাজের সম্মানিত সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাগরিকদের। কিন্তু ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কারণে তা স্থিতিশীল হবার আগেই বিএনপি সরকারকে বিদায় নিতে হয়। ভাটা পড়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজে। বেশ কিছুকাল দুর্নীতি দমন কমিশন প্রায় নিশ্চুপ হয়ে থাকে। তারপর আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রে এদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ক্ষমতায় আসীন হয় স্বঘোষিত জেনারেল সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ছদ্মবেশি সামরিক সরকার।
দেশি-বিদেশি চক্রান্তের মধ্য দিয়ে এই বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্রঘাতী ভিনদেশি পদলেহি জে. মইন-ফখরুদ্দিন আহমদ ভিনদেশি নাগরিককে ছদ্মবেশে সামনে রেখে সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। আর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই গণতন্ত্রঘাতককে আঁচল বিছিয়ে স্বাগত জানালেন। বললেন, বিএনপিকে একেবারে পিটিয়ে তুষ বানিয়ে দাও। এর জন্য সংবিধানের তোয়াক্কা করার কোনো দরকার নেই। কারণ এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে যদি তারা ক্ষমতায় বসায়, তবে  জে. মইন সরকার যতো সংবিধানবিরোধী কাজই করুক না কেনো, আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তার বৈধতা দেবে। অর্থাৎ, তাদের সকল অপকর্মের জন্য দেওয়া হবে দায়মুক্তি। যে দায়মুক্তি নিয়ে কতো কথা বলেছেন শেখ হাসিনা, সেই শেখ হাসিনাই ঘোষণা দিলেন অবৈধতার দায়মুক্তির এবং সে দায়মুক্তি তিনি এই অপরাধীদের দিয়েছেন। আর তাদের নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে গিয়ে আশ্রয় নেবার সুযোগ করে দিয়েছেন।
একইভাবে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে ১৯৮২ তে যখন সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখনও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। তারপর এরশাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি সব কিছুই করেছেন। এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাবার সর্বদলীয় ঘোষণা সত্ত্বেও এরশাদ ঘোষিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাকে সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়েছেন। সে কথা শেখ হাসিনাকে এরশাদ মাঝেমধ্যেই স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করেন না। এরশাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সেই গাঁটছড়া এখনও অব্যাহত আছে। এরশাদের ক্ষয়িষ্ণু দল জাতীয় পার্টি এখনও আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের একটি প্রধান শরিক দল। এ ক্ষেত্রে মেনন-ইনু এমনই মাইক্রোস্কোপিক দল যে, তাদের কথা মুখে না আনলেও চলে। তারাও এক সময় তুমুল এরশাদ ও জাতীয় পার্টি বিরোধী ছিলেন। এখন শুধু পাশাপাশি নয়, গলায় গলায় আছেন এরশাদের। এর সবই মাসতুতো ভাইদের গল্প।
এখন আমাদের সমাজে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় পুলিশের ধারাবাহিক অনৈতিক আচরণ। পুলিশ ডাকাতি করছে। পুলিশ জিম্মি করছে। পুলিশ মুক্তিপণ আদায় করছে। রাত হলেই এরা দল বেঁধে হিং¯্র হায়েনার মতো শিকারের সন্ধানে রাজপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে রকম অবস্থার শিকার হয়েছেন সম্প্রতি দু’জন সরকারি কর্মকর্তা। এদের একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বি। অপরজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশ দাস। বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি নেবার আগে গোলাম রাব্বি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপকের কাজ করেছেন। সংবাদপত্রে ফিচার লিখেছেন। সমাজে মোটামুটি পরিচিত মুখ গোলাম রাব্বি। গত ৯ জানুয়ারি রাতে একটি এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে বের হওয়া মাত্রই মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদের নেতৃত্বে একটি পুলিশ ভ্যানে কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে তাকে জোর করে তুলে নেওয়া হয়। রাব্বিকে বলা হয়, তার কাছে ইয়াবা আছে। রাব্বি যতো অস্বীকার করেন, ততো তাকে পিটায় পুলিশ। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো জায়গাই বাদ রাখে না। আর তার কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে এসআই মাসুদ। টাকা না পেলে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে ক্রস ফায়ারে দিয়ে হত্যা করে ভেরি বাঁধে ফেলে দেয়ারও হুমকি দিতে থাকে। ঘণ্টা পাঁচেক তারা মাসুদকে আটকে রাখে। কিন্তু থানায় নিয়ে যায় না। এই সময়ে রাব্বি যা দেখতে পান, তা আরও ভয়ঙ্কর। এই পুলিশের দল রাস্তা থেকে যাকে-তাকে ধরছে। গাড়িতে তুলছে। টাকা আদায় করছে। টাকা দিতে না পারলে নির্যাতন করছে। লকআপে ভরছে। আবার শিকারের সন্ধানে বের হচ্ছে।
রাব্বি সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, ঐ ঘরানার বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকেও ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তাকে নির্যাতনের সময় তিনি এসব ব্যক্তিকে ফোন করার সুযোগ চান। বার বার নিজের পরিচয়পত্রও দেখান। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। এসআই মাসুদের এক দাবি, টাকা দাও চলে যাও। নইলে ইয়াবা রাখার ‘দায়ে’ ক্রসফায়ারে মরো। তার  এতোসব পরিচয় ব্যবহার করে রাব্বি যেন বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলছিলেন। আরও অশ্রাব্য গালিগালাজ তাকে শুনতে হচ্ছিল। গোলাম রাব্বির কাছে ছিল এ এক দুঃস্বপ্ন। হাসপাতালের বেডেও তাই তিনি অবিরাম প্রলাপ বকছেন নির্ঘুম রাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানও পুলিশ প্রধানের কাছে এর বিচার দাবি করেছেন। এ সম্পর্কে মোহাম্মদপুর থানার ওসি সেই মাসতুতো ভাইয়ের মতোই আচরণ করেছেন। বলেছেন, পুলিশ তাকে সার্চ করতে চেয়েছিল। তিনি সহযোগিতা করেননি। উল্টো রিঅ্যাক্ট করেছেন। পুলিশ কোনো দোষ করে থাকলে তদন্ত করে দেখা হবে। ব্যস, ওসির দায়িত্ব শেষ। এদিকে দু’দিন আগে গভীর রাতে রাব্বির কেবিনে গিয়ে অজ্ঞাত পরিচয় দু’জন লোক তাকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবার হুমকি দিয়ে এসেছে। অন্যথায় তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। পুলিশ মাসতুতো ভাইদের এভাবেই রক্ষা করার চেষ্টা চালায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বিকে নিয়ে এই তুলকালাম কাণ্ডের পর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে পুলিশ ঘটিয়েছে আর এক ঘটনা। গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারিবাগ খালপাড় এলাকায় ভোর পাঁচটার দিকে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পরিদর্শক বিকাশ কুমার দাশকে নির্মমভাবে পিটিয়ে একেবারে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে রাখে। বিকাশ ভোরে মোটর সাইকেলে করে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। ঐ পুলিশ দল তার পথ আটকালে তিনি তাদের ছিনতাইকারী ভেবে মোটর সাইকেল জোরে টান দিয়ে এলাকা পার হয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। তখন পুলিশেরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। তিনিও তার পরিচয় দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। এরপরও পুলিশ তাকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। তখন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এগিয়ে এসে তার পরিচয় নিশ্চিত করেন। কিন্তু তাতেও পুলিশ নিবৃত্ত হয়নি। পিটাতেই থাকে। তখন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তাদের পায়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকেন। তবুও শোনেনি পুলিশ কারও কথা। পুলিশ বরং বলেছে, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ’। পুলিশ দেশের রাজা হয়ে গেছে। অতএব সাবধান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হয়ে বিকাশ এখন ল্যাবএইড-এর ইনটেনসিভ কেয়ারে চিকিৎসাধীন। রাব্বি ও বিকাশ উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাব্বির মামলা গ্রহণ করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছেন, এসআই মাসুদ একজন ক্রিমিনাল, তাকে বহিষ্কার করুন। সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে, পুলিশ আর সাদা পোশাকে ডিউটি করতে পারবে না। অন্তত কোটি গায়ে দিতে হবে। এর আগেও আমরা দেখেছি, পুলিশ-র‌্যাবের কোটি গায়ে দিয়ে অপহরণ ডাকাতির ঘটনা অহরহ ঘটেছে। তবে ব্যবস্থা হিসেবে প্রথমে রাব্বি ও বিকাশের হামলাকারীকে ‘ক্লোজড’ করা হয়। কিন্তু তার অন্য সহযোগীরা আছে বহাল তবিয়তে। আর  ক্লোজড করা কোনো শাস্তি নয়। তাকে কোনো কাজ না দেওয়া। এভাবে ক্লোজড করার নামে হামেশাই অপরাধী পুলিশদের নিষ্কৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা চালু আছে পুলিশ বিভাগে। ডামাডোল কিছুটা কমে এলে তাদের আবার স্বপদে বহাল করা হয়। কিংবা দূরে কোথাও বদলি করে দেওয়া হয়। মাসতুতো ভাইদের কাহিনী এ রকমই। কিন্তু গত সোমবার ঢাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিশাল মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের দাবি, বিকাশ দাশের ওপর হামলাকারীদের বিচার না হলে তারা রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা বন্ধ করে দেবেন।
এর মধ্যে ঘটেছে আর এক ঘটনা। গত ১৬ জানুয়ারি বরিশালের আগৈলঝাড়ায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও কাঠ ব্যবসায়ী আবু সেরনিয়াবাতের ছেলে বাবু সেরনিয়াবাত রাস্তার পাশে কাঠ রেখে পাশের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তখন ঐ পথ দিয়ে একটি পিকআপে যাচ্ছিলেন থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। পিকআপের সঙ্গে কাঠের ধাক্কা লাগায় ‘দেশের রাজা’ ওসি গাড়ি থেকে নেমে বাদলকে বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন। বাদলকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা এমপি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর বাসার সামনে নিয়ে যান। ওদের সেখানে দেখে ওসির নির্দেশে তার গাড়ি চালক বাদলকে আর এক দফা পেটায়। তখন  তাকে স্থানীয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। বিষয়টি পুলিশ সুপার আখতারুজ্জামানকে জানালে তিনি গাড়ির চালককে যথারীতি ক্লোজড করেন। ওসি আছেন বহাল তবিয়তে। পুলিশ বলেছে, বাদল ‘সামান্য’ আহত হয়েছে মাত্র।
আজকের মতো মাসতুতো ভাইদের শেষ গল্প ঘুষের টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে। নাটোরের গুরুদাসপুরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নামে চাঁদা নিয়েছিলেন যুবলীগ নেতা ইউনুস আলী বাবু। সেই টাকা ফেরত দিয়ে এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস। প্রত্যেককে খামে করে টাকা ফেরত দেয়ার সময় তিনি বলেছেন, ‘সরকারের উন্নয়নমূলক কোনো কাজে গুরুদাসপুরে কোনো নেতাকে টাকা দিতে হবে না।’ বিনামূল্যে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার নিয়ম থাকলেও ঐ যুবলীগ নেতা গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। এ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। ঐ যুবলীগ নেতা ৪০ জন গ্রাহকের প্রত্যেকের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা আদায় করে। এর আগেও এক সরকার সমর্থক নেতা টাকা আদায় করেছিল। তাও ফেরত দেয়া হয়। এবার টাকা ফেরত দিতে ছয় মাস গড়িমসি করেন ঐ যুবলীগ নেতা। ফলে সবকিছু ঠিক থাকলেও গ্রাহকদের বিদ্যুৎ  পেতে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। এলাকায় এমপির নামে ধন্য ধন্য পড়লেও এর মধ্যে কোনো যোগসাজশ নেই, সেকথা কেউ বিশ্বাস করছে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মেয়র নজরুলের গ্রেফতার গণতন্ত্র ও সরকারের আত্মতৃপ্তি


সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র হিসেবে ঐ জেলারই জামায়াত আমীর জনাব নজরুল ইসলাম বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত ঘোষণাও করেছেন। কিন্তু মেয়র হিসেবে নির্দিষ্ট তারিখে তাকে শপথ নিতে দেয়া হয়নি পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয় তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তার সাথে জামায়াত সমর্থিত বিপুল ভোটে নির্বাচিত তিনজন মহিলা কমিশনারকেও সরকারি নির্দেশে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং তাদের শপথ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছে। দেশে পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলসমূহে এই খবর ফলাওভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। কি কারণে এবং কি অপরাধে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদসমূহে তার কোনো উল্লেখ ছিল না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার গত ত্রিশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এখানে যারা পৌর চেয়ারম্যান অথবা পৌর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বেশিরভাগ সময় জামায়াত মনোনীত প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়ে এ দায়িত্ব পালন করেছেন আবার ওয়ার্ড কমিশনার বা কাউন্সিলর হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন জামায়াতেরই প্রতিনিধি। বলাবাহুল্য, জামায়াত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি দল এবং এ প্রেক্ষিতে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং জনগণের সামনে তাদের কর্মসূচি তুলে ধরা ও তাদের সেবা করাকে জামায়াতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে মানুষ শুরু থেকেই লক্ষ্য করে আসছে। এবারের নির্বাচনের আগেও জামায়াতের একজন প্রতিনিধি নবাবগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে কিছুটা সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় জামায়াত থেকে তিনি বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। এই অবস্থায় ঐ বহিষ্কৃত ব্যক্তি অন্য দলে যোগ দিয়ে মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় এবং এবং সরকারি নির্দেশে জামায়াতের নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন বাতিল করায় দলটি দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারেনি বরং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বেশকিছু এলাকায় নির্বাচনে অংশ নেয়। সরকার ও সরকারি দল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও জামায়াত প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেয়নি। কিন্তু তথাপিও জামায়াত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হন এবং সরকারের বিরাগভাজন হন। নির্বাচিত মেয়রসহ তিনজন মহিলা কাউন্সিলরকেও তারা গ্রেফতার করেন। মহিলাদের বিশেষ করে পর্দানশীন মহিলাদের সম্মান করা এবং সামাজিক কাজে তাদের উৎসাহ প্রদান এ দেশের একটি ঐতিহ্য ছিল। Gender Development -এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোপেনহেগেন বেইজিং ও উন্নত অনুন্নত  বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে এবং সেইসব দেশে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহেও স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের প্রতি সরকারি অবজ্ঞা ও তাদের গ্রেফতার-নির্যাতন বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে যেমন ধূলিসাৎ করছে এমনটি আর কোথাও হতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মালিক জনগণ এবং ক্ষমতার উৎসও তারা। এই কথাটি আমাদের সংবিধানে অত্যন্ত সুন্দরভাবে লেখা রয়েছে। আমরা আমাদের দেশের নাম রেখেছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অর্থাৎ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক শাসিত একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। Government of the people, by the people and for the people এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। জনগণ যাকে নির্বাচিত করেছে সরকার তাদের ভোটাধিকার ও রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান পোষণ করার এটিই নিয়ম। বাংলাদেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতীতে এই নিয়মের ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না এবং তার ওপর পদাঘাত করা হচ্ছে। সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা বদরুদ্দীন আহমদ কামরান অসংখ্য অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জেলে ছিলেন। কিন্তু বিপুল ভোটে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হবার পর জনরায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যথারীতি শপথ নেন এবং মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। এ ধরনের ঘটনা স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে এ অঞ্চলে আরও ঘটেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর যা ঘটছে তা নজিরবিহীন। বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন, তাদের এলাকার প্রতি বরাদ্দ বৈষম্য, কারণে-অকারণে তাদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও বরখাস্তকরণ সর্বোপরি তাদের স্থলে শাসক দলের গণধিকৃত ও পরাজিত প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজীপুরসহ সিটি করপোরেশনসমূহে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নতুন নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে; ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা-মামলা, গ্রেফতার-নির্যাতন, কারচুপি, ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই ও ক্ষমতাসীন প্রার্থীদের অনুকূলে সিল মারা প্রভৃতিসহ নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীদের বিজয় দেখিয়ে আসন দখল করা হয়েছে। জনাব নজরুলের গ্রেফতার ও মহিলা কমিশনারসহ গণপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণে বাধা প্রদান সরকারের চ-নীতিরই একটি অভিব্যক্তি। এর ফল শুভ হতে পারে না।
গত পৌরসভা নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থীদের তালিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ নাটোরের বনগ্রাম, পৌরসভার মেয়রের নামের ওপর এসে আমার দৃষ্টি থেমে গেল। মনে হচ্ছিল, এই ভদ্রলোককে চিনি এবং পত্র-পত্রিকায় তার নাম এর আগে দেখেছি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম এই ব্যক্তিটি বহুল আলোচিত সমালোচিত আওয়ামী লীগের কুখ্যাত একজন নেতা। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মরহুম চেয়ারম্যান ছানাউল্লাহ বাবু হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামী জাকির হোসেন। টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় পিটিয়ে বাবুকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার দৃশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে। সরকারের মন্ত্রী এমপিরা ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। কেন করেননি তা আজও মানুষের কাছে অজানা। প্রধান আসামীসহ এ হত্যাকাণ্ডের সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের যারা জড়িত ছিল তাদের গ্রেফতার করে আবার ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে আরও হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে মানুষের মধ্যে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকলে তারা যত অপরাধই করুক না কেন তাদের কোন শাস্তি হয় না। তাদের সাত খুন মাফ। নারায়ণগঞ্জ এখন নতুন একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। ক্ষমতাসীন দল সেখানে সকল অপরাধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য সারা দেশের অবস্থাও একই। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, র‌্যাবের সিনিয়র কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সরাসরি সম্পৃক্ততা কে না জানে? সাত খুন বলা হলেও নদীতে ফেলে দেয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শী একজন মাঝিকে হত্যার পর এটি আট খুনে রূপান্তরিত হয়েছে। কয়েকদিন আগে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্যও নারায়ণগঞ্জে নিহত হয়েছেন। তাদের হত্যাকারীদের বিচার আদৌ হবে কিনা মানুষ সন্দিহান।
কিছু কিছু বিচারের ক্ষেত্রে সরকার বলেছিলেন যে, ঐ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়নি। বিচার হলে কলঙ্কমুক্ত হবে এবং অপরাধ প্রবণতা, খুন-খারাবি কমে যাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আগের আমলের অপরাধের বিচার হয়েছে কিন্তু অপরাধের মাত্রা, খুন-খারাবি বর্তমান আমলে কয়েকশ গুণ বেড়ে গেছে। এর সাথে সরকারি দল এমনকি থানা-পুলিশের সম্পৃক্ততাও অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, অপরাধীদের পরিবর্তে যারা নিরপরাধ তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছে অথবা বিচারের নামে প্রহসন চলেছে। অবস্থা যাই হোক আমরা মনে করি ভদ্র ও সভ্য সমাজ ছেড়ে অসভ্য ও ইতর সমাজের প্রতি ধাবিত হচ্ছি। এর আশু পরিবর্তন প্রয়োজন।
একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা এখানে না বলে পারছি না। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইদি আমিন। তার মুখে এমন অনেক কথা শোনা যেত যা একজন রাষ্ট্র্ বা সরকার প্রধানের ভাব-মর্যাদার সাথে সঙ্গতিশীল ছিল না। অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তিনি এমন সব কথা বলতেন যা সাধারণ মানুষের মধ্যে হাস্যরস সৃষ্টি করত কিন্তু বিবেকবান মানুষকে আহত করত। কেননা, তার কথার মধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রমাণ পাওয়া যেত না। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তাকে কমনওয়েলথ সভায় যোগদানের জন্য দাওয়াত পাঠিয়েছিলেন। তিনি রানীর কাছে তার জুতার মাপ দিয়ে এই মর্মে পত্র পাঠিয়েছিলেন যে, যদি তার পায়ের মাপ অনুযায়ী জুতা বানিয়ে তার কাছে পাঠানো না হয় তাহল তিনি সম্মেলনে যোগ দেবেন না। এই ইদি আমিন পরবর্তীকালে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন এবং সৌদি আরবে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের দেশসহ সারা দুনিয়ার স্বাধীন দেশগুলোর সরকার পরিচালনার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের বেপরোয়া কথাবার্তা না বলাই ভালো এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলা প্রয়োজন। গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র হত্যা করে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থেকে অশালীন ও গর্হিত আচরণ শোভনীয় হতে পারে 
মোঃ নূরুল আমিন

Ads