রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বন্ধুত্বের দায়িত্ব উপলব্ধি করতে হবে


‘বন্ধু’ শব্দটি মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ মানুষের জীবনকে আনন্দ ও সুখে মন্ডিত করতে পারে। এ কারণে মানুষ বন্ধুত্বের সম্পর্ককে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আর এ বিষয়টির গুরুত্ব ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই অস্বীকার করতে পারে না। মানুষ তো প্রতিবেশীর কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণই আশা করে থাকে। রাষ্ট্রও প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আশা করে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। আমাদের সৌভাগ্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পেয়েছিলাম। এই কারণে আমরা কৃতজ্ঞ বটে।
বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর বন্ধুত্বকে দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিষয়টি সেভাবে অগ্রসর হতে পারছে না। তাহলে কি শাসকরা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী দেশ পরিচালনায় সমর্থ হচ্ছে না। আমরা জানি, বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অনেক বড় দেশ। তাদের শক্তি-সামর্থ্যও অনেক বেশি। ফলে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সাথে উদার আচরণ করতে পারে। কিন্তু কি কারণে যেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারতের শাসকগোষ্ঠী উদারতা প্রদর্শনে সক্ষম হচ্ছে না। এ বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণকে আহত করেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের উজানে ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের কথা উল্লেখ করা যায়।
প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অহঙ্কারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও ভারত থেকে তেমন সম্মানজনক আচরণই আশা করে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, প্রায় প্রতিদিনই ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএএসএফ) যেভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুলী করে হত্যা করে চলেছে তাতে বিস্মিত হতে হয়। কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের আচরণ তো এমন হতে পারে না। গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবারেও কুড়িগ্রামের রৌমারী ও ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে দুই বাংলাদেশী ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। রৌমারী উপজেলার গয়টাপাড়া সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত গরু ব্যবসায়ীর নাম দুখু মিয়া (২৮)। আর ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বাঘাডাঙ্গা সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলীতে নিহত বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ীর নাম জসিম ম-ল (২৭)। আমরা জানি, সীমান্ত এলাকায় যারা বসবাস করেন তারা জীবন ধারণের লক্ষ্যে ব্যবসাসহ নানা পেশায় জড়িয়ে আছেন। যারা গরুর ব্যবসায় জড়িত আছেন তাদের কেউ কেউ ভুল করতে পারেন, আইন লঙ্ঘনের মত অপরাধও করতে পারেন। সীমান্ত এলাকায় যে কোনো দেশের নাগরিক আইন লঙ্ঘন করলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা যায়। বিচারের মাধ্যমে শাস্তিও প্রদান করা যায়। কিন্তু দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করার বিষয়টিকে কোনো বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বহুবার প্রতিবাদ জানিয়েছে, পতাকা বৈঠক করেছে। সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও সীমান্তে হত্যা প্রসঙ্গে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। আর গুলি করে হত্যা করা হবে না বলে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস বাণীও শোনানো হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বন্ধু রাষ্ট্রের কথায় ও কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি তা ভারত বিরোধিতার জন্য বলছি না। বরং নিজেদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চেতনাকে সমুন্নত রেখে উভয় দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে অর্থবহ করে তোলার জন্যই আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে চাইছি।
আমরা মনে করি, এ বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের মত ভারতের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণও উপলব্ধি করতে সমর্থ হবেন। তবে ভারত সরকার বিষয়টি সেভাবে উপলব্ধি করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বান কি মুনের উপলব্ধি এবং আহ্বান


বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মানুষের জীবনে যে সুখ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারতো, তা হয়নি। বরং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহারে মানব জাতির বৃহত্তর অংশ এখন শোষিত-বঞ্চিত এবং বিপর্যস্ত। ভারসাম্যহীন এই বিশ্বে এখন দাপুটে কয়েকটি রাষ্ট্রের হুমকি-ধমকিতে বাকি রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অকার্যকর হয়ে উঠেছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন বিশ্বব্যবস্থায় জাতিসংঘের ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালনের কথা ছিল। কিন্তু তেমন ভূমিকা পালনে জাতিসংঘ সমর্থ হয়নি। এমন ব্যর্থতার কারণ জাতিসংঘের গঠন-কাঠামো এবং বিধি-বিধানের মধ্যেই নিহিত। ফলে জাতিসংঘ তার সমীহ ও মর্যাদা সবই হারিয়ে বসে আছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো শুধু ভুক্তভোগি সংক্ষুব্ধ মানুষ নয়, জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুনও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘গুটি কয়েক ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের হাতেই আমাদের এই সমগ্র বিশ্ব জিম্মি থাকবে কিনা?’ বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন, ‘সমালোচনাকারীদের বন্দী করবেন না। তাদের নির্যাতন করবেন না।’ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গত ২০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ ভাষণে মুন এসব কথা বলেন। ডেইলি ন্যাশন পরিবেশিত খবরে বলা হয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সর্বময় ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে জাতিসংঘের সংস্কার প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে এনেছেন মুন। তাঁর মতে, এই সংস্থার ক্ষমতা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের হাতে কুক্ষিগত থাকায় গোটাবিশ্ব ওই কয়েকটি রাষ্ট্রের হাতে জিম্মি। বিশ্বের সবদেশের সম্মতিই যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। মুনের মতে, জাতিসংঘের স্বচ্ছ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। পরবর্তী মহাসচিবকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বময় ক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে বান কি মুন বলেন, ‘প্রায়শই আমি দেখেছি যে, বিশ্বের বহু দেশের সমর্থিত কোনো প্রস্তাব সাধারণ সম্মতির নামে গুটিকয়েক রাষ্ট্র বাতিল করতে পারে। ভেটো ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে মুন বলেন, ‘কখনো কখনো একটি রাষ্ট্রই অনেক দেশের সমর্থিত একটি প্রস্তাব বাতিল করে দিতে পারে।’ গুটিকয়েক রাষ্ট্রের সাধারণ সম্মতিকে কোনোভাবেই সর্বসম্মতি ধরে নেয়া যায় না উল্লেখ করে মুন আরো বলেন, ‘যে বিশ্বসংস্থাকে নিয়ে আমাদের এতো আশা-আকাক্সক্ষা, তা ঠিক কেমন করে পরিচালিত হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে বিশ্বের সব মানুষের। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিদায়ী ভাষণে বান কি মুন বিশ্বের সব মানুষের অধিকারের কথা বললেন। কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশ্বের সব মানুষের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কাজ করতে পারেননি। জাতিসংঘের গঠন-কাঠামো ও বিধি-বিধান তাকে সক্ষম হতে দেয়নি। ফলে বিদায় বেলায় তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জাতিসংঘের গঠন-কাঠামো ও পরিচালনার বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
জাতিসংঘের স্বচ্ছ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে সংস্কারের আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সংস্কারের উদ্যোগ নেবে কে? জাতিসংঘের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কি এমন উদ্যোগ নেবে? এমন সুমতি তাদের হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ পৃথিবীকে ইচ্ছেমতো শাসনের স্বাদ যারা পেয়েছেন, তা তারা নৈতিকবোধের কারণে ছেড়ে দেবেন- এমনটি তাদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। কারণ সাম্প্রতিককালে তারা তেমন কোনো উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেননি। তাই এক্ষেত্রে গুটিকয় রাষ্ট্রের বাইরে বাকি যে রাষ্ট্রগুলো আছে তাদেরই কার্যকর ভূমিকা পালনে বুদ্ধিদীপ্ত পথে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান জাতিসংঘে সংস্কারের কাজে নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে না এলে তাদের হয়তো বিকল্প সংস্থার কথাও ভাবতে হতে পারে। সেই পথে যাওয়া অবশ্যই চ্যালেঞ্জের, তবে অসম্ভব কিছু নয়। মানবজাতির কল্যাণে এই পৃথিবীকে শান্তিময় আবাসস্থলে পরিণত করতে হলে সঙ্গত ও যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প আছে কী?

শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ধর্মনিরপেক্ষতার এ কেমন উদাহরণ!


প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে মানব সভ্যতায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা সংকট। তবে ভারতে গরুর গোস্ত খাওয়া নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা অবাক হওয়ার মত। ১৫ সেপ্টেম্বর এনডিটিভি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াটে গরুর গোস্ত খাওয়ায় দুই বোনকে ধর্ষণ করা হয়। এবার পশ্চিম বাংলার সোন্ডালিয়া স্টেশনে ঘটলো আরেক নৃশংস ঘটনা। ঈদের দিন গরুর গোস্ত নিয়ে ট্রেনে ওঠায় ৩ শিশু ও ৪ মহিলাকে চলন্ত ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই আরপিএফ জওয়ানের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন ২ শিশুসহ ৭ জন। ঘটনার প্রতিবাদে এবং দোষী রেল পুলিশের শাস্তির দাবিতে সোন্ডালিয়া স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করে ঘণ্টা দুয়েক ধরে বিক্ষোভ পালন করে স্থানীয় বাসিন্দারা। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব রেলের বারাসাত-হাসনাবাদ শাখার সোন্ডালিয়া স্টেশনে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওইদিন সোন্ডালিয়া গ্রামে কোরবানির গোস্ত আনতে গিয়েছিলেন হাড়ওয়া এলাকার ৪ জন মহিলা, তাদের সঙ্গে ৩টি বাচ্চাও ছিল। গোস্ত নিয়ে ফেরার পথে তারা ওই ঘটনার শিকার হন।
আলো ঝলমলে বিজ্ঞান-মনস্ক বর্তমান সভ্যতায় শুধুমাত্র গরুর গোস্তের কারণে নারীদের ধর্ষণ করা হবে এবং চলন্ত ট্রেন থেকে নারী ও শিশুদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন লাথি মেরে ফেলে দেবে, তা কোনো বিবেকবান মানুষ কি মেনে নিতে পারবেন? কিন্তু বাস্তবতা হলো, এমন নৃশংস ও অমানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে। সাংবিধানিকভাবে ভারত তো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও বটে। কিন্তু গরুর গোস্ত খাওয়া নিয়ে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের ওপর একের পর এক যে নৃশংস ঘটনা ঘটছে, তারপরেও কি মানুষকে এ কথা মেনে নিতে হবে যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর ধর্মীয় কারণে যে নির্যাতন চলছে তা ভারতের সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। তাই ভারতের মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় বর্তমান বিজেপি সরকারের ওপর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানসহ যে কোনো নাগরিকের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান তথা সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালন থেকে তিনি গাফেল থাকতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শুধু সংবিধানের কাছে নয়, ইতিহাসের কাঠগড়ায়ও তিনি দোষী বলে সাব্যস্ত হবেন।
ধর্ম তো শান্তির কথা বলে, মানবিকতার কথা বলে। ধর্মের লক্ষ্য তো হিংসা-বিদ্বেষ, দূর করে, প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে যথার্থ মানব পরিগঠন এবং পরিণতিতে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিভিন্ন সমাজে এর ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুবাদী সংগঠনগুলো গরু জবাই নিষিদ্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছে। তবে গত বছরের (২০১৫) মে মাসে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে গরু রক্ষা আন্দোলন আরো জোরদার হয়েছে। তখন থেকে এ পর্যন্ত ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাই ও গোস্ত বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
আমরা সবাই তো এ কথা জানি যে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। এ পৃথিবীর মানুষ আমিষ ও নিরামিষ উভয় প্রকার খাদ্যই খেয়ে আসছে মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই। আর আমরা এ কথাও জানি যে, আমিষের উৎস পশু ও মৎস্য এবং নিরামিষ খাদ্যের উৎস তরুলতা-বৃক্ষ। এবং আমরা এ কথাও জানি যে পশু ও মৎস্যের মত তরুলতা-বৃক্ষেরও জীবন আছে। তাই প্রশ্ন জাগে, আমিষের উৎস পশু জবাই-এর ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? এই বাধা কি মানবিক চেতনা কিংবা ধর্মীয় নির্দেশনার কারণে? ভারতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ধর্মীয় ভাবনার কারণে মুসলমানদের গরু জবাইতে বাধা দেয়া হচ্ছে। তাহলে তো আমাদের ধর্মের কাছেই ফিরে যেতে হয়। আসলেই কি গরু জবাইতে ধর্মের বাধা নিষেধ আছে? প্রকৃত ব্যাপার হলো, হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলো আমিষ তথা মাংস ভক্ষণের অনুমতি দেয়। ধর্মগ্রন্থসমূহে উল্লেখ আছে যে, হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা, আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতেন। হিন্দু ধর্মের আইনের গ্রন্থ মনুশ্রুতি’র ৫ম অধ্যায়ে ৩০ নং শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে- “খাবার গ্রহণকারী সে সব পশুর মাংসই খায় যা খাওয়া যায়, তবে এতে সে কোনো মন্দ কিছু করে না। এমন কি সে যদি এটা দিনের পর দিনও করে যায়; কেননা ঈশ্বরই কতককে ভক্ষিত হওয়ার জন্য এবং কতককে ভক্ষক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।” মনুশ্রুতি’র একই অধ্যায়ে ৩১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে “উৎসর্গের শুদ্ধতার জন্য মাংস ভক্ষণ যথার্থ, এটা ঈশ্বরের বিধান হিসেবে প্রচলিত।” এছাড়া মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ৮৮ নং অধ্যায়েও শ্রাদ্ধের সময় গরুর মাংস পরিবেশনের কথা বলা হয়েছে। উদ্ধৃতির সংখ্যা আরো বাড়ানো যেতে পারে, তবে এর বোধহয় আর প্রয়োজন নেই। আসলে আমিষ ও নিরামিষ উভয় জাতীয় খাদ্যই মানুষের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ। মানুষ তার রুচি-অভিরুচিও প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করবে। ধর্ম এখানে অযৌক্তিক কোনো বাদ সাধেনি। খাদ্য নিয়ে বিভিন্ন সময় যে বিতর্ক বা বিতন্ডা বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পেছনে মদদ জুগিয়েছে মতলববাজ কিছু সমাজপতি, ধর্মগুরু ও রাজনীতিবিদ। এদের ব্যাপারে মানুষের সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক দায়িত্ব পালনও মানবিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের গরুর গোস্ত খাওয়ার বিরুদ্ধে কুরআনের অপব্যাখ্যা দিয়ে যে বিলবোর্ড টানানো হয়েছে তা মোটেও ধর্মসম্মত কাজ হয়নি। কারণ হিন্দু ধর্মের আইনের গ্রন্থ মনুশ্রুতিতেও পশুর মাংস খাওয়ার পক্ষেই কথা বলা হয়েছে। আসলে ওইসব বিলবোর্ড বা প্রচারণা অনাকাক্সিক্ষত সাম্প্রদায়িক চেতনা কিংবা রাজনীতির মন্দ মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হতে পারে। আমরা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি আহ্বান জানাবো- ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ধর্মের বিধিবিধান জেনে শুনেই ধর্ম পালন করুন। ধর্ম জ্ঞান অর্জনের কথা বলে, জ্ঞানের আলো না থাকলে ধর্মের আলো পাওয়া যায় না। অতীতে অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে মতলববাজ সমাজপতি, ধর্মগুরু ও রাজনীতিবিদরা মানব সমাজের অনেক ক্ষতি করেছেন। এই সুযোগ আর তাদের দেওয়া যায় না।

মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নতুন হাওয়া?


বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যেগুলো দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোন দিকে গড়াচ্ছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে না যে বিশ্বশক্তি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নতুন করে কোনো মেরুকরণ করছে কিনা। এ ব্যাপারে সঠিকভাবে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না এজন্য বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে যারা প্রধান অভিনেতা তারা পৃথিবীর একটি ট্রাবল স্পটে একটি বিশ্ব শক্তির সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। আবার অন্য ট্রাবল স্পটে অন্য একটি বিশ্ব শক্তির সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। সবচেয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে ভারতের ভূমিকা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে গিয়ে। পৃথিবীর এই এলাকায় অর্থাৎ এশিয়ার রঙ্গমঞ্চে ভারতকে আমেরিকার পার্টনার হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে তাকে বলতে গেলে কোনো ভূমিকাতেই দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গিবাদ নিয়ে ভারত তার নিজ দেশের অভ্যন্তরে যতখানি কঠোর বিশ্বের অন্যত্র একই প্রশ্নে তাদের ভূমিকা সোচ্চার নয়। ভারতের ভূমিকা দেখে এক সময় মনে হয় সে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আবার অন্য সময় মনে হয় যে রাশিয়ার সাথে (প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী) তার সেই ৬ দশকের সম্পর্ক তারা অটুট রাখতে চায়। বিশ্লেষকরা বলেন, এশিয়া মহাদেশে নেতৃত্ব নিয়ে চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু দৈনন্দিন কার্যকলাপে দেখা যাচ্ছে ভারতের সাথে কথা বলার সময় চীন যেমন শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করছে তেমনি ভারতও যখন চীনের সাথে কথা বলছে তখন ভারতও শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ভারত বর্তমানে এমন একটি দেশ যে অপর তিনটি বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনের সাথেও সম দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে মনে হচ্ছে যে ভারত ঠিক সম দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। ভারত যেটা করার চেষ্টা করছে সেটিকে ইংরেজীতে বলা যায় Tight Rope Walking, অর্থাৎ টান টান দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া।
॥দুই॥
তবে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলী দেখে মনে হচ্ছে যে সেখানে সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে একটি নতুন মেরুকরণ অথবা জোট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই উদীয়মান জোটটি সিরিয় সংকট সমাধানের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সিরিয়া নিয়ে একাধিক বিশ্ব শক্তি তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করে যাচ্ছে। কার পথটি সঠিক আর কার পথটি বেঠিক সেটি এখনো নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। কারণ সমগ্র সিরিয়া এখন একটি রক্তাক্ত রণাঙ্গন। তবে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়।
সিরিয়ায় অবস্থিত আইএসের ঘাঁটিগুলোতে বিমান হামলা করার জন্য রাশিয়া এখন ইরানের হামেদান বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করছে। এটি এখন আর কোন অনুমান নয়। বরং এটি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। রাশিয়া কর্তৃক ইরানের বিমান ঘাঁটি ব্যবহার এ কথা প্রমাণ করে যে রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। একই সাথে দেখা যাচ্ছে যে রাশিয়ার সাথে তুরস্কও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। ইরানের সাথেও তুরস্ক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পারদ উর্ধ্বমূখী। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু রাশিয়াই ইরান এবং তুরস্কের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ছে না। বরং এই তিনটি দেশের মধ্যে এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। আমরা জানি না, শেষ পর্যন্ত এই তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তবে দুই এক দশক আগেও এই তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন যতটুকু ঘনিষ্ঠ ততটুকুও কল্পনা করা যেত না। এমন একটি সময় ছিল যখন রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরানকে এক কাতারে কল্পনা করা তো দূরের কথা, বরং তুরস্ক এবং ইরান পশ্চিমা ক্যাম্পের সক্রিয় সদস্য ছিল। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সামরিক জোট গঠিত হয়। এটির নাম ছিল বাগদাদ চুক্তি বা সেন্টো (CENTO) চুক্তি। এই চুক্তির সদস্য ছিল বৃটেন, ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও পাকিস্তান। সেই সময় আরেকটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়। সেই জোটের নাম ছিল আরসিডি, অর্থাৎ আঞ্চলিক উন্নয়ন সহযোগিতা। আরসিডির সদস্য রাষ্ট্র ছিল তিনটি। এসব দেশ হল তুরস্ক, ইরান এবং পাকিস্তান। সেই তুরস্ক এবং ইরান এখন রাশিয়ার সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগান ইতোমধ্যেই রাশিয়া সফর করেছেন। এর মধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন যে অত্যন্ত নিকট ভবিষ্যতে তিনি ইরান সফরে যাবেন।
তেহরানে তুর্কি প্রেসিডেন্টের আসন্ন সফরকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হয়েছে যে ইরান সফরকালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইরানের নেতাদের সাথে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তার মধ্যে একটি রয়েছে সিরিয় যুদ্ধের অবসান। দুটি দেশ ভাবছে যে তাদের সাথে রাশিয়াকে জড়িয়ে কিভাবে সিরিয়ার রক্তক্ষয় বন্ধ করা যায়। সংবাদ সংস্থা ফার্স জানাচ্ছে যে সিরিয়া সম্পর্কে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের মধ্যে একটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। তিন দেশের নেতৃবৃন্দের বৈঠক ঐ জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে ফার্স নিউজ এজেন্সী জানাচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ইরান, তুরস্ক এবং রাশিয়ার এই উদীয়মান জোটকে আমেরিকার পাল্টা জোট হিসেবে দেখছে। সকলেই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছেন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মধ্য প্রাচ্যের রাজনীতিতে সশব্দে এবং দ্রুত গতিতে প্রবেশ করছেন। ইরানী ঘাঁটি থেকে রুশ বিমানের সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের ওপর বোম বর্ষণ একটি নতুন ইঙ্গিত দেয়। সেই ইঙ্গিতটি হলো এই যে ইরান এবং রাশিয়া এখন সিরিয়াতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। পর্যবেক্ষকরা আরো অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে রাশিয়া সিরিয় রণাঙ্গনে প্রবেশের পর আমেরিকার প্রভাব সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে অনেক কমে গেছে। রাশিয়া আমেরিকাকে এই বার্তাও দিয়েছে যে তারা এবার মধ্যপ্রাচ্যে এসেছে খেলা করতে নয়, তারা এখানে থাকতে এসেছে।
আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে রুশ ইরান সহযোগিতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে সিরিয় রণাঙ্গনে সামরিক অভিযান চালানোর সময় আমেরিকা একটি বড় ভুল করেছে। তারা তাদের সামরিক অভিযানের সময় কোন নিরাপদ অঞ্চল (Safe zone) সৃষ্টি করেনি বা আলাদাভাবে চিহ্নিত করেনি। যদি সেটা করত তাহলে রাশিয়া এখানে ঢোকার কোনো সুযোগ পেত না। গবেষকরা বলছেন যে ইরান কর্তৃক রাশিয়াকে তার সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়ার অনুমতি প্রদানকে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি শুধু রুশ জঙ্গি বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণের বিষয়ই নয়, বরং সিরিয় সংকট মীমাংসার জন্য একটি বৃহত্তর রুশ, ইরান, তুর্কি পরিকল্পনারই অংশ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে এখন মার্কিন প্রশাসনের জেগে ওঠার সময় হয়েছে। কারণ এটি আমেরিকার বিরুদ্ধে তুরস্ক এবং ইরানের যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে রাশিয়ার সহযোগিতায় সেটিই একটি সামরিক অক্ষ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
॥তিন॥
আরেকটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করেছে যে ইরান-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাশিয়া আর সময় নষ্ট করেনি। তারা ইরানের কাছে বিমান বিধ্বংসী এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রয় করার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফরাসি ‘দৈনিক লাফিগারও’ বলেছে যে রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে একটি সামরিক আঁতাত করার বাসনা অনেক দিন ধরেই সুপ্ত ছিল। মার্কিন ইরান পারমাণবিক চুক্তির পর তাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যায় এবং সামরিকভাবে রুশ ইরান অক্ষ শক্তি গড়ে ওঠে। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে যে দুর্বল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল রাশিয়া সেটির সুযোগ গ্রহণ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে আমেরিকা হটাতে চেয়েছিল। কিন্তু এজন্য বাশারের বিরুদ্ধে যত শক্তিশালী সামরিক অভিযানের প্রয়োজন ছিল এবং বাশার বিরোধীদেরকে যে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের প্রয়োজন ছিল ততখানি তারা করেনি।
ইরান এবং রাশিয়া উভয়েই বাশারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য কয়েক বছর আগে থেকেই চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু সিরিয় সংকটে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ তারা পাচ্ছিল না। যে মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে গেল সেই মুহূর্তে তারা সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করল। এবং এখন সিরিয় সংকটে রাশিয়াকেই প্রধান খেলোয়াড় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনভাবে ডেভেলপ করছে যে রাশিয়াকে বাদ দিয়ে সিরিয় সংকট সমাধানে কোন চিন্তা এখন আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
এখন এই সংকটে সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্ক কতদূর যাবে সেটি দেখার বিষয়। তুরস্ক আমেরিকার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখেই চলছিল। কিন্তু আমেরিকার মাথা ব্যথা হলো, কেন এরদোগান এবং তার দল এ কে পার্টি ইসলামের কথা বলে। এজন্য তারা ভেতরে ভেতরে অনেকদিন থেকেই এরদোগান সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছিল। কিন্তু এরদোগানের পেছনে রয়েছে জনসমর্থন। তাই তাকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই সেদিন আমেরিকা তুরস্কের সেনাবাহিনী দিয়ে এরদোগানকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। জনগণের প্রতিরোধে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর এরদোগান আর কতখানি আমেরিকার দিকে থাকবে আর কতখানি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে যেসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে তুরস্কও সম্ভবত ইরানের পথেই হাঁটবে। হয়তো সেটিতে সময় নেবে। কারণ তুরস্কের এক অংশ ইউরোপে এবং অপর অংশ এশিয়ায়। তাই পরিবর্তন সেখানে সময় নেবে। 

শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ঘর থেকে জেল উত্তম!


মাঝে-মাঝে কিছু অদ্ভুত খবরও প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রের পাতায়। এমন একটি খবরের শিরোনাম, ‘স্ত্রী থেকে রেহাই পেতে ব্যাংক ডাকাতি!’ এএফপি পরিবেশিত খবরটিতে বলা হয়, ৭০ বছর বয়স্ক এক বুড়ো ব্যাংক-ডাকাতি করেছেন। কারণ তিনি স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকতে চান। তার মনে হয়েছে কারাগারে যাওয়াই সে ইচ্ছে পূরণের একমাত্র উপায়। আদালতের নথিপত্র অনুযায়ী আমেরিকার ক্যান্সাস অঙ্গরাজ্যের ওই ব্যক্তির নাম লরেন্স রিপল। স্ত্রী রেমে ডিওসের সঙ্গে তার বেশ বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছিল। ‘বরং জেলখানায় যাব, তবুও বাড়ি ফিরবো না’- রেগেমেগে এই ঘোষণা দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান রিপল। এরপর সোজা গিয়ে ঢোকেন ক্যান্সাস সিটির এক ব্যাংকে। কাউন্টারে গিয়ে টাকা-পয়সা দাবি করে বলেন, তার কাছে একটা বন্দুক আছে। নিজের সম্ভাব্য পরিণতি জানাই ছিল আনাড়ি ডাকাত রিপলের। আর তিনি চেয়েছিলেন সেটাই। তাই ৩ হাজার মার্কিন ডলার নগদ হাতে পেয়েও পালিয়ে যাননি। বরং গ্রেফতার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন। পুলিশ এলে বললেন, স্ত্রীর সঙ্গে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভবই হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত লরেন্স রিপলের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। এখন তিনি কারাগারে।
ঘটনাটি আসলেই বেশ অদ্ভুত। একজন মানুষ স্ত্রী ও ঘর-সংসার ছেড়ে কারাগারে থাকতে চাইবেন কেন? স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ বা আলাদা থাকাটাও তার সমস্যার একটা সমাধান হতে পারতো। কিন্তু রিপল ওই পথে গেলেন না। কারণ একা থাকতে নাকি তার ভয় লাগে। কারাগারে তাকে একা থাকতে হবে না। কারাগারের বাড়িতে নতুন অনেক বন্ধু মিলেছে এই বৃদ্ধের। সেখানে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগও আছে। রিপলের ডাকাতি করে পাওয়া ৩ হাজার ডলার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে ব্রাদার-হুড ব্যাংক এন্ড ট্রাস্টকে। কি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তার ঝগড়া লেগেছিল সেটা অবশ্য আদালতের নথিতে লিপিবদ্ধ হয়নি। আর তার পক্ষে কোনো উকিলও দাঁড়ায়নি।
আলোচ্য খবরটি শুধু অদ্ভুত নয়, সেখানে রয়েছে অনেক প্রশ্ন এবং বার্তাও। স্ত্রীর হাত থেকে রেহাই পেতে এই বৃদ্ধ জেলে যেতে চাইলেন কেন? স্ত্রীর সঙ্গ কি এতই খারাপ যে, তার চাইতে জেলের কয়েদীদের সঙ্গই তার কাছে উত্তম মনে হলো? জেলে তিনি এখন অনেক বন্ধু পেয়েছেন, তাদের সাথে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তিনি ভালই আছেন। তাই প্রশ্ন জাগে, গৃহে কি তার বন্ধুর অভাব ছিল? অথচ দুই মানব-মানবী মিলে বিয়ের মাধ্যমে যে সংসার জীবনের যাত্রা শুরু হয়, সেখানে তো বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকতে হয়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলে পরস্পর পরস্পরকে উপলব্ধি করতে পারে, সহমর্মী হতে পারে এবং ভাগ করে নিতে পারে সুখ এবং দুঃখকেও। রিপলের সংসারে কি এসব বিষয়ের অভাব ছিল? মিসেস রিপলের কোনো বক্তব্য অবশ্য আমরা পাইনি। তার বক্তব্য পেলে আমাদের তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতো। পুরো বিষয়টা উপলব্ধি করাও আমাদের জন্য সহজ হতো। কিন্তু তেমন সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। আসলে সংসার গড়ার যেমন লক্ষ্য থাকে, তেমনি তা ভাঙ্গারও কারণ থাকে। সংসার জীবনে স্বামী বা স্ত্রী লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সংসার তো ভাঙ্গবেই তাই সংসার জীবনে পরস্পরকে অভিযুক্ত না করে বরং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালনটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া ব্যক্তিত্বের সংঘাত, অহংবোধ, ভোগবাদ এবং স্বার্থপরতাও সংসারে ভাঙ্গন ধরায়। এসব বিষয়েও নর-নারীর সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

খবর নেই সেই বিশেষজনের


কে সেই বিশেষজন এবং কেন তার খোঁজ-খবরের জন্য এত আগ্রহ সে সম্পর্কে জানানোর আগে অতি সংক্ষেপে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকেন্দ্রিক একটি বিষয়ের উল্লেখ সেরে নেয়া যাক। গত ২৯ আগস্ট মাত্র ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এ সফর অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রায় এক ঘণ্টার পৃথক বৈঠক। কারণ, খালেদা জিয়া এই সময়ে তেমন কেউ নন, যার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পৃথক বৈঠক করতে হবে। বৈঠকে কি আলোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে জানা গেছে বিএনপির মহাসচিবের কাছ থেকে। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, বৈঠকে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জন কেরি বলেছেন, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার এবং দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন অর্জন করবে তেমনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জন কেরি।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, কথাটার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এ সত্যই প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার দাবি করলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। স্মরণ করা দরকার, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র বৈধতা দেয়নি। ফলে পরোক্ষভাবে হলেও বর্তমান সরকারও দেশটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্কের বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে জানাজানি হয়েছে। জন কেরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জানিয়ে দেয়া মনোভাব ও অবস্থানের মূল কথা অনুধাবন করে সরকার সে অনুযায়ী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের পথে পা বাড়াবে কি না তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে হতে পারে যেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে লেখার জন্যই আজকের নিবন্ধটি পরিকল্পিত হয়েছে। অন্যদিকে নিবন্ধের উদ্দেশ্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য জানানো। তথ্যটি হলো, প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করলেও জন কেরি কিন্তু সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক দূরে থাকুক, সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি। রওশন এরশাদ অবশ্য প্রতারণামূলক কৌশলে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। তার প্রেস সেক্রেটারির স্বাক্ষরিত বিবরণীতে জানা গেছে, জন কেরির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রওশন এরশাদ নাকি নারীর উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আসল সত্য জানাজানি হয়েছে পরদিনই। অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকদের বদৌলতে জানা গেছে, ধানমন্ডির একটি মিলনায়তনে জন কেরি গিয়েছিলেন সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। নিজে ‘সুশীলা’ না হলেও সেখানে রওশন এরশাদও গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সভাশেষে জন কেরি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে রওশন নিজের পরিচয় দিয়ে ‘কেমন আছেন’ ধরনের দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এটুকুকেই তিনি তার প্রেস সেক্রেটারিকে দিয়ে  বৈঠকের খবর বানিয়ে ছেড়েছেন! বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতুক-তামাশা কম হয়নি।
হঠাৎ রওশন এরশাদকে টেনে আনার পেছনে কারণ সৃষ্টি করেছেন আসলে তার স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং এখনো জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বেশ কিছুদিন ধরে তার কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অথচ সুযোগ বা উপলক্ষ পেলে সরকারকে তো বটেই, তিনি এমনকি নিজের স্ত্রী এবং এককালের ‘ফার্স্ট লেডি’ রওশন এরশাদকেও আক্রমণ করতে ছাড়েন না। নানা কারণেই সাবেক এ স্বৈরশাসককে সাধারণভাবে একটি ‘ফানি ক্যারেক্টার’ হিসেবে তুলে ধরার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টিতে আমার কিন্তু ভিন্নমত রয়েছে। কারণ, ঘটনাক্রমে কখনো কখনো কৌতুক অভিনেতার মতো কাজকর্ম করলেও বাস্তবে এ এরশাদই ভারতীয়করণ থেকে সেনাবাহিনীকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বানানো পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ‘অবদান’ রেখে গেছেন। পরবর্তীকালে জেনারেল (অব.) মইন উ তাকে অনুসরণ করেছেন মাত্র। সে ব্যাপারেও এরশাদের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ।
কথাটা আমাদের নয়, বিভিন্ন সময়ে এ সম্পর্কে জানান দিয়েছেন স্বয়ং এরশাদ। যেমন গত ১২ এপ্রিল দলীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ জানাতে গিয়ে বলেছেন, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে অর্থাৎ জনাব এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে মর্মে চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে জাতীয় পার্টিকে আনুপাতিক হারে মন্ত্রিত্ব দেয়ারও শর্ত ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ জাপার সঙ্গে ওয়াদা বরখেলাপ করে। এ পর্যন্ত এসেই থেমে যাননি সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল’। অর্থাৎ এরশাদ এবং (আওয়ামী লীগসহ) তার অন্য সঙ্গীরাই ওয়ান-ইলেভেন ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতারণা করায় তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। এরশাদ প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, ‘আমি ডার্টি পলিটিক্স (নোংরা রাজনীতি) করি না। যেটা সত্য তা-ই বলি। সেটা অপ্রিয় হলেও বলি, প্রিয় হলেও বলি।’
বলা দরকার, যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হলেও জনাব এরশাদের এসব বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিন্তু তেমন আলোড়ন ওঠেনি। কারণ, তিনি আসলে নতুন কোনো কথাই বলেননি। শুধু একটি কথা নিয়ে অবশ্য বিশেষ কারণে কিছুটা আলোচনা হয়েছে। সে কথাটা হলো, ‘আমাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল’। এটা সত্য হলে ২০০৬ সালের অক্টোবরে সংঘটিত লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের দায়দায়িত্বও এরশাদদের ওপরই বর্তায়। আর সাবেক এ জেনারেল যেহেতু ‘ডার্টি পলিটিক্স’ করেন না এবং অপ্রিয় হলেও সত্য কথাই বলেন সেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষেও দায় এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না।
এটা খুবই গভীর একটি বিষয় বলেই এখানে বরং এরশাদ-বর্ণিত সেই চুক্তি বা সমঝোতার ব্যাপারে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। বস্তুত মিথ্যাচারের কারণে যতো অভিযোগই তার বিরুদ্ধে থেকে থাকুক না কেন, এই একটি বিষয়ে তিনি সত্য বলেছেন। কারণ, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। এ ব্যাপারে এরশাদ নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর। সে সময়ও গুঞ্জনে শোনা গিয়েছিল, শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনে এরশাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছাড়াও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, আওয়ামী মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। রাষ্ট্রপতি বানানোর শর্তেই জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন!
এরশাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও ঘোষণা সে সময় ১৪ দলীয় জোটে তীব্র টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছিল। বাম দলগুলো ১৪ দলে না থাকার হুমকি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ অবশ্য প্রথম থেকেই কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এরশাদকে ‘কোনোক্রমেই’ বাদ দেয়া সম্ভব নয়। এমন এক কঠোর অবস্থান থেকেই ১৪ দলকে ‘অটুট’ রেখে জোটের সম্প্রসারণ করার অর্থাৎ একই সঙ্গে ১৪ দল এবং আওয়ামী মহাজোট নিয়ে তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। দুটিরই নেতৃত্ব গিয়েছিল আওয়ামী লীগের দখলে।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এভাবেই এক বিচিত্র কৌশল নিয়ে এগিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে যুক্তি দেখাতে গিয়ে দলটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘বড় অপরাধীর’ বিরুদ্ধে ‘ছোট অপরাধীকে’ সঙ্গে নেয়ায় দোষের কিছু থাকতে পারে না। এক প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক ‘বড় অপরাধী’ বিএনপির তুলনায়  স্বৈরশাসক এরশাদকে ‘ছোট অপরাধী’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্বাচনে হারানোর লক্ষ্য নিয়ে দলটি এরশাদের সঙ্গে ঐক্য করেছিল। সে সময় একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের টকশোতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, জাতীয় পার্টিকে মহাজোটে নেয়ার বিষয়টি নাকি ‘ভোটের বোঝাপড়া’- এটা আদর্শগত কোনো জোট নয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়াটাই ছিল বড়কথা। ‘হর্স ট্রেডিং’ বা দর-কষাকষি কাকে বলে, সে কথা আওয়ামী লীগের ‘ঝানু’ নেতাদের শিখিয়ে ছেড়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগকে ৫০টি আসন ছাড়তে হয়েছিল। এরশাদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা রাখ-ঢাক না রেখে বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় যেতে চান। আর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ তৎকালীন চারদলীয় জোটকে নির্বাচনে হারাতে হলে এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ অনেকভাবেই করে দেখেছিলেন তারা। ১/১১-এর পর কিছুদিন পর্যন্ত মনে হয়েছিল যেন দমন-নির্যাতনে দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে আসার পাশাপাশি দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেখানে মইন-ফখরুদ্দিনদের ‘নিয়ে আসা’সহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল, বিএনপি সেখানে ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। বিএনপিতে ভাঙন ঘটানোর এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে জোট থেকে বের করে আনার কোনো চেষ্টা ও পরিকল্পনাও সফল হয়নি। ঘটনাপ্রবাহে চারদলীয় জোট বরং আরো ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছিল। সে কারণে আওয়ামী লীগকে শুধু নয়, বিএনপি বিরোধী অন্য সকল পক্ষকেও নতুন করে হিসাব মেলাতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর কারণ, নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী অন্য দলগুলোর তুলনায় জাপা ছিল বেশি সম্ভাবনাময় একটি দল। সে সময় পর্যন্ত সর্বশেষ তথা অষ্টম সংসদেও জাতীয় পার্টির ১৪ জন এমপি ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট করেছিল একমাত্র রাশেদ খান মেনন ছাড়া সে দলগুলোর প্রধান নেতারাও কখনো নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি।
ঘটনাপ্রবাহের ওই পর্যায়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা, জনপ্রিয়তা ও উদ্দেশ্যসহ নানাদিক। কারণ, ‘বড় দল’ আওয়ামী লীগ সাধারণত খুব সহজে কারো সঙ্গে হাত মেলায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এসে সে দলটিই যখন আগ বাড়িয়ে নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। কথাটা কঠিন সত্যও ছিল। কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে অসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কথায় কথায় হরতাল চাপানো থেকে দিনের পর দিন ধরে বর্জনের মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করে ফেলার মতো বিভিন্ন উদাহরণের ভিড়ে যাওয়ার পরিবর্তে অল্প কথায় বরং বলা যায়, বিরোধী দলের নেত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা কোনো একটি প্রশ্নেই জনগণের স্বার্থে সামান্য ‘অবদান’ রাখার প্রমাণ দিতে পারেননি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজীরও শেখ হাসিনাই বারবার স্থাপন করেছিলেন। এভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেননি বলেই শেখ হাসিনা জনগণের আস্থা অর্জন করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। নিজেদের তো বটেই, ‘বন্ধুরাষ্ট্র’সহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়ছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। মূলত এই হতাশা থেকেই ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে এসে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নাম সর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সামনে এসেছিল অন্য একটি সত্যও- আওয়ামী লীগ যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়।
এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বানচাল করে দেয়ার কর্মকাণ্ড থেকে। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পর নির্দলীয় এবং দুর্বল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেই কেন লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালানো হয়েছিল- এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটু চিন্তা করলেই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের দিকটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ, নির্বাচনে অংশ নেয়ার সামান্য ইচ্ছা থাকলেও যে কারো তখন নির্বাচনমুখী কার্যক্রমেই ব্যস্ত হয়ে ওঠার উচিত ছিল। অন্যদিকে লগি-বৈঠার হত্যা ও তাণ্ডব চালানোর পাশাপাশি দাবির পর দাবি তুলে আওয়ামী লীগ এবং তার সঙ্গি-সাথীরা শুধু ঝামেলাই বাড়িয়েছিল। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করেছিল তারা পাল্লা দিয়ে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক দিনগুলোতে এমন কোনো বড়ো দাবির কথা বলা যাবে না যা পূরণ করা হয়নি। কিন্তু অযৌক্তিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক প্রতিটি প্রধান দাবি পূরণ করার পরও আওয়ামী জোট ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিটি উদ্যোগকেই তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ব্যর্থ করে দিয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে সেই সঙ্গে বঙ্গভবন অবরোধ করার এবং বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গৃহযুদ্ধেরও ভয় দেখিয়েছিলেন। সব মিলিয়েই আওয়ামী জোটের উদ্যোগে পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছেও তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথিত পরিবেশ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য হলে আর যা-ই হোক মানুষ হত্যার মতো নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড চালানো এবং দাবির পর দাবি তুলে ঝামেলা বাধানো হতো না। শেখ হাসিনা নিজেও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, জেনারেল মইন উ ও ড. ফখরুদ্দিনদের সরকার তাদেরই আন্দোলনের ‘ফসল’- তারাই তাদের ক্ষমতায় এনেছেন!
কিন্তু বিএনপিকে অনুসরণ করে ১৪টি দলকে নিয়ে জোট গঠন করলেও আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়নি। এজন্যই আওয়ামী লীগ এরশাদের দিকে হাত না বাড়িয়ে পারেনি। এরশাদও সুযোগ নিতে ছাড়েননি। নিজে রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছেন, জাপার জন্য আদায় করেছেন কম-বেশি ৫০টি আসনের নিশ্চয়তা। শুধু তা-ই নয়, পাছে এরশাদ বেঁকে বসেন- এই ভয়ে জাপা নেতাদের ‘সুধা সদনে’ ডেকে আনার ঝুঁকি এড়াতে আওয়ামী লীগের নেতারাই সে সময় এরশাদের ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে’ গিয়ে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন!
কিন্তু দলটি আওয়ামী লীগ বলেই ‘চুক্তি’ অনুযায়ী এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানায়নি। আরেক ‘বৃদ্ধ’ জিল্লুর রহমানের কাছে তাকে হেরে যেতে হয়েছিল। এসব দুঃখ-বেদনা এরশাদ আরো অনেক উপলক্ষেই প্রকাশ করেছেন। যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের পর আওয়ামী লীগের এমপিরা যখন জাতীয় সংসদে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বক্তব্য রাখার পাল্লা দিচ্ছিলেন তখন, ৩ মার্চ জাতীয় পার্টির এক অনুষ্ঠানে অনেকটা গোপন তথ্য ‘ফাঁস’ করে দেয়ার ঢঙে এরশাদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনী ‘সহযোগিতা না করলে’ আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও’ ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। এজন্যই সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের ‘কৃতজ্ঞ’ থাকা উচিত। সেবারও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিলেন এরশাদ।
বর্তমান পর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে অবশ্য অন্য কারণে। কে জানে, ঠিক কোন কাজে ব্যস্ত রয়েছেন তিনি, যার জন্য তার কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ের কারণ হলো, এরশাদ সাধারণত ‘অকাজ’ই বেশি করেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচারণা রয়েছে।

আশিকুল হামিদ 

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কী বার্তা দিয়ে গেলেন জন কেরি


গত ২৯ আগস্ট ’১৬ইং তারিখে বাংলাদেশে মাত্র নয় ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সুধী সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারীরা সেসব বৈঠকে নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এসব আলোচনায় জঙ্গিবাদ যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে সুশাসনের বিষয়ও। কেরি তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রভূত উন্নতি সাধন করতে হবে। তবে একথা ঠিক যে বিশ্বে বর্তমানে নানানবিধ কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। কেরি আভাস দিয়ে গেছেন যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসদমনে সাফল্য অর্জন করতে হলে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করতে হবে। আর অংশগ্রহণমূলক সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবার একথাও ঠিক যে, কোনো রাষ্ট্র স্বৈরতন্ত্রে থাকবে, নাকি গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, সে সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র নিতে পারে। স্বৈরতন্ত্রের ব্যক্তির স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। আর গণতন্ত্রে নাগরিকদের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। বাংলাদেশেও শাসকদের উপলব্ধি করার দরকার আছে যে, তাদের গণতন্ত্রের পথেই ফিরতে হবে। আর তা করতে হবে খুব শীগগীরই।
বাংলাদেশে সরকার -অনুগত মিডিয়া ও তাদের চোঙ্গাবাজ পন্ডিতরা যেভাবে সর্বক্ষেত্রে সরকারের ‘বিরাট’ সাফল্যের কথা প্রচার করছেন, তা যে প্রকৃত সত্য নয়, সেটা বিদেশিদের বুঝতে দেরি হচ্ছে না। এক সময় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়ভার ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এতে দ্বিমত করার বোধকরি কিছু নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন এখন দেখতে পাচ্ছে যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তেমন কিছুই করতে পারছে না। আর তার ফলে এই জঙ্গিবাদ শহরগুলো থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। গত পহেলা জুলাই গুলশানের হোলে আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় ২২ জন নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত পুলিশ এ সম্পর্কে কোনো খবরই জানতো বলে মনে হয় না। আর তার ফলেই ওবামা প্রশাসন দিল্লির ওপর আর ভরসা না করে বাংলাদেশের ব্যাপারটা নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আর সে কারণেই জন কেরি তার ঢাকা সফরকালে জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জন কেরি আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের জিহাদিরা এ দেশের লোক হলেও তাদের সঙ্গে আইএস সহ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। কেরি আরও জানিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। এই তথ্য জন কেরি জোর দিয়েই প্রকাশ করেছেন। এই তথ্যে সরকার অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কারণ তারা বরাবরই বলে আসছিল যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই বা আইএসের কোনো তৎপরতা নেই। এরপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জন কেরির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের জঙ্গি সঙ্কট সম্পূর্ণ স্থানীয়। আর এগুলো করছে স্থানীয় ইসলামপন্থীরাই। তবে প্রধানমন্ত্রী মনে হয়, তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তিনি এখন বলতে শুরু করেছেন যে, বিএনপিই এই জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী। তারাই জঙ্গিদের মদত দিচ্ছে।
আবার জন কেরির সফরের পরপরই তার দলের চোঙ্গাবাজরা এখন দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছেন। এর আগে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক কেড়ে নেওয়া হবে, যেন তিনি মুক্তিযুদ্ধই করেননি। আবার জন কেরির ঢাকা সফরের পরপরই জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তা কার্যকর করা হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এর আগে জন কেরি মীর কাসেম আলীকে ফাঁসি না দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন। এ কথা মনে রাখা ভালো যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। আর তাই তার ঢাকা সফরের আগে সরকার জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্যের একটা দৃশ্যপট তৈরি করার চেষ্টা করেছে। তার ঢাকা আসার আগেই গুলশান হামলার কথিত অন্যতম  ‘হোতা’ তামিম চৌধুরীকে এক অপারেশনে বধ করেছে। পুলিশের ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এই অভিযান পরিচালনা করেছে। জানা যায়, এই ইউনিটে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। এদিকে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মরহুম জামায়াত নেতা গোলাম আযমের পুত্র আবদুল্লাহিল আযমীকে ডিবি পুলিশ তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে পরিবার  থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ তার গ্রেফতার সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সহযোগিতার সম্পর্ক তা অনেকটা রুটিনের মতো। কিন্তু এখন সকল স্বাধীন দেশের একমাত্র শত্রু ‘মৌলবাদী ইসলামীরা’। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলা বহুগুণে বেড়ে গেছে। ঐ নির্বাচনে দেশের কোনো বিরোধী দল অংশগ্রহণ করেনি। কারণ অবাধ নির্বাচন হওয়ার সকল রাস্তা সরকার নির্বাচনের আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা থেকে এটা নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, এখানকার সরকার সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের পথ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। অথচ সেই নির্বাচনই এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ সকল সভ্য দেশও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিরাম এই আহ্বানই জানিয়ে আসছে। এমন কি জাতিসংঘও ২০১৪ সালের ঐ অংশগ্রহণহীন হতাশাব্যঞ্জক নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের উদার সমর্থন এখন বেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক নৌ-শ্রমিক ধর্মঘটে আশুগঞ্জে ভারতের বিপুল পরিমাণ করিডোর পণ্য আটকা পড়ে যায়। আবার বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতীয় ঋণে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। প্রতিদিনই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে।
এদিকে আবার জন কেরির ঢাকা ও দিল্লি সফরের সময়ই ভারত তার বিহার প্রদেশের বন্যার পানি সরিয়ে দিতে ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেয়। ফলে বাংলাদেশে হঠাৎ করেই ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। আর তাতে প্রায় চার কোটি মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। তারা হারিয়েছেন ফসল, ঘরবাড়ি, জমি, গবাদি পশু, সহায় সম্পদ। সুতরাং কেরি কি ভারতকে এ কথা বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, বাংলাদেশে দ্রুত কেনো একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দরকার। ভারতের সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো, তারা আওয়ামী সরকারকে বোঝাতে পারে যে, অবিলম্বে সরকার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করুক। দ্বিতীয় পথটি হলো, দিল্লি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আরও বেশি করে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করতে পারে এবং আরও বেশি গুম-খুনের পরিবেশ সৃষ্টি করে সন্ত্রাসবাদের পথ প্রশস্ত করতে পারে। এটিও দিল্লির জন্য স্বস্তি এনে দেবে না।
আবার সরকার যদি নির্বাচন দিতে চায়ও, তাহলেও তাতে চালাকির চেষ্টা করলে তাতে ফল কিছুই হবে না। সরকার যদি বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন দিতে চায় এবং এমপিরা এমপি পদে বহাল থেকেই নির্বাচন করে, তা হলে সে নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেবে না। সেক্ষেত্রে এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে সরকার ও বিরোধী দল সমান সুযোগ পায়। এদিকে সরকার এমন চেষ্টাও করতে পারে, যাতে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হয়ে পড়েন। তখন খণ্ডিত বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার চেষ্টাও হতে পারে। আর জামায়াতকে তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর জামায়াত আর নির্বাচনে নিজেদের নির্বাচনের যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেনি। এর মাজেজাও সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। বিএনপি চরম পন্থা নেওয়ার দল নয়। কিন্তু তাদের কৌশল হবে, কেউ যদি এই সরকারকে হঠাতে পারে, তবে বিএনপি তাদের সমর্থন করবে।
তবে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছে না। তাদের এই ভুল উপলব্ধি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা হয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচনে আ’লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়


কত টপিক জমা হয়ে আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো। গত বৃহস্পতিবার বিএনপি সভানেত্রী ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার দলের ৩৮ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে একটি ভাষণ দেন। ঐ ভাষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ লোকের কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার অনেকগুলো কাগজের পৃষ্ঠা উল্টালাম। একমাত্র ‘দৈনিক ইনকিলাব’, ‘দৈনিক সংগ্রাম’, ‘দৈনিক নয়া দিগন্ত’ এবং ‘দৈনিক দিনকাল’ ছাড়া আর কেউ প্রথম পৃষ্ঠা তো দূরের কথা, শেষ পৃষ্ঠাতেও তার বক্তৃতা কাভার করেনি। কিছু কিছু পত্রিকা দ্বিতীয় এবং চতুর্থ পৃষ্ঠায় সংবাদটি প্রকাশ করেছে এবং সেটিও নেহায়েত দায় সারা ভাবে। দ্বিতীয় বা চতুর্থ পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলামে ছোট ছোট টাইপের শিরোনাম দিয়ে ওরা সংবাদটি ছেপেছে, যেটি সহজেই পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখনো দেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে মেজরিটি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সরকার বিরোধী। এই সরকার নিজেদের আন্ডারে ভোট না করে একটি কেয়ার টেকার সরকার বা নিরপেক্ষ সরকারের আন্ডারে ভোট করে দেখুক, কয় শতাংশ ভোট তাদের নৌকায় পড়ে। আর কয় শতাংশ ভোট ধানের শীষে পড়ে। এগুলো কোন ধরনের সাংবাদিকতা? অথচ এরাই রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে সংবাদ ছাপানোর দাবিতে পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ এবং বাংলাদেশ আমলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তারা তাদের জান কুরবান করে। যারা বিএনপির ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণটি হেলায় ফেলায় ছাপিয়েছে তারাও ভাষণের আসল কথাটি বাদ দিয়েছে। অবাক হই তখন যখন এরা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বুলি আওড়ায়।
গত ২/৩ দিন ধরে ওরা আরেক ধরনের নিউজ ছাপছে। সেটি হলো, আগামী বছরে নাকি আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে ভোট করবে। তারা ফলাও করে বলেছে যে সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার পপুলারিটি, নাকি অনেক বেড়ে গেছে। সেই পপুলারিটির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এই সরকার নাকি ভোট করবে। এসব কথা বিশেষ করে ২০১৯ সালের আগে এই সরকার ভোট করবে, সেটি আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। যাই হোক, তবুও যদি তারা ভোট করে সেটি ভাল কথা। কিন্তু সেই ভোটও কোন্ সরকারের অধীনে হবে? আওয়ামী সরকার? আওয়ামী সরকার ভোট করলে কি রকম ভোট হবে সেটি তো জনগণ গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে এ বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের ভোট, মিউনিসিপ্যালিটির ভোট, উপজেলা পরিষদের ভোট, ইউনিয়ন পরিষদের ভোট প্রভৃতি ভোটে দেখেছে। আওয়ামী লীগই অতীতে একটি স্লোগান দিয়ে সারা দেশের আকাশ বাতাস ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেটি হলো, “আমার ভোট আমি দেব, যাকে ইচ্ছা তাকে দেব”। কিন্তু গত এপ্রিল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ যেসব শ্লোগান দিচ্ছে তার মর্মার্থ হলো, “আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব”। তো এই ধরনের ভোট করলে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দেখানো যাবে। সেই ভোট করার আগেও মামলা মোকদ্দমার জালে জড়িয়ে তারেক রহমানকে শাস্তি দিয়ে যেরূপ অযোগ্য করা হয়েছে, সেই ভাবে বেগম জিয়াকে শাস্তি দিয়ে তাকে যদি ডিসকোয়ালিফাই করা হয় এবং তার সাথে বিএনপির আরো কয়েকজন বড় নেতা, যারা কোন দিন ইলেকশনে হারেন না, তাদেরকেও যদি ডিসকোয়ালিফাই করা হয় তাহলে তো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে। এই রকম একটি ইলেকশনের চিন্তা ভাবনা নাকি আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের মাথায় ঘোরা ফেরা করছে। এই ধরনের ইলেকশন হলে কারো কিছু বলার থাকবে না। কারণ এই ধরনের ইলেকশন বানচাল করতে গেলে ভাল ভাল কথায় হবে না। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে পর্যুদস্ত করে তবেই একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে। সেই নির্বাচনেই জনমত যথার্থ প্রতিফলিত হবে। সেই ধরনের নির্বাচন করা শুধু বিএনপি কেন, কোন বিরোধী দলের পক্ষেই এখন সম্ভব হবে বলে আমার তো মনে হয় না।
॥দুই॥
কিভাবে সম্ভব হবে? প্রধান বিরোধী দল বলতে দুইটি। একটি হলো বিএনপি, আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। আরো হাজার হাজার নেতাকর্মী হুলিয়া মাথায় নিয়ে বিগত ৬/৭ বছর হলো পলাতক জীবন যাপন করছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক বক্তৃতায় জানিয়েছেন যে, তাদের কর্মীরা পলাতক জীবন যাপন করতে করতে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে তারা নিজের জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে গেছেন এবং সেই জেলায় গিয়ে রিক্সাওয়ালা বা হকারের কাজ করছেন।
জামায়াতের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। ইতোমধ্যেই সাবেক আমীর মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ইতোমধ্যেই ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। আরেকজন কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময়ের মধ্যেই কার্যকর হবে অথবা হয়ে গেছে। জামায়াতের নায়েবে আমীর বিশ্ব বরেণ্য মুফাস্সিরে কোরআন আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদি কারাদ- ভোগ করছেন। সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি এটিএম আজাহারুল ইসলাম এবং আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা মওলানা আবদুস সোবহান মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় রয়েছেন। বাংলাদেশে জামায়াতের প্রধান নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম কারাদন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারেই শাহাদৎ বরণ করেছেন। অপর নেতা মওলানা একেএম ইউসুফ কারাগারেই শাহাদৎ বরণ করেছেন। এছাড়াও অনেকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ রয়েছে।
এখনো জামায়াতের ৩০/৪০ হাজার নেতা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পলাতক এবং মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অসংখ্য কর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে তাদেরকে শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এমন অমানবিক নির্যাতন অতীতে আর কখনো কোনো সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের ওপর করেনি। এই দলটি যে টিকে আছে এটিই সবচেয়ে বড় কথা। একজন সেক্যুলার ও বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীর নাম হলো আফসান চৌধুরী। তিনি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা ‘নিউ এজে’ ৮ কলাম ব্যাপী বিশাল পোস্ট এডিটরিয়াল লিখে বলেই দিয়েছেন যে জামায়াতকে ক্রাশ করা হয়েছে। যারা অবশিষ্ট আছেন তাদেরও ক্রাশ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এই দলের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তিনি তার আলোচ্য নিবন্ধে এই কথাটিও বলেছেন যে ঢাকায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সামনে ছিল সবচেয়ে বড় থ্রেট। এখন বিএনপির সমর্থন অনেক রয়েছে। কিন্তু সংগঠন হিসেবে তারা ছিন্ন ভিন্ন। তাই তাদের অবস্থা এখন পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির এই সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগের সামনে পরবর্তী থ্রেট এবং পটেনশিয়াল থ্রেট ছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এবং শিবিরকে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্রুট ফোর্স দিয়ে শুধু ক্রাশ করা নয়, রীতিমত লিকুইডেট করা হয়েছে। জামায়াতের মাজা ভেঙ্গে গেছে। তার পক্ষে আর আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার রাজনীতিতে থ্রেট হিসেবে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আফসান চৌধুরীর পুরো বক্তব্য জানতে হলে পড়তে পারেন, Is JMB going to be new threat to AL, instead of BNP? (OP-ED, page- 9, New Age, August 24, 2016.)
॥তিন॥
বিগত ৭ বছর ৮ মাস হলো বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর আওয়ামী সরকার জুলুমের যে স্টিম রোলার চালাচ্ছে তারপরেও বিএনপি ও জামায়াত তথা বিরোধী দলীয় জোট আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইংরেজীতে যেটিকে বলা হয়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সেই সমতল ক্ষেত্র, সেটি প্রস্তুত করতে হবে। আর সেই দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। এত জেল জুলুম নির্যাতনের পরেও বিরোধী দল রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু সেক্ষেত্রে সারা বিশ্বে প্রচলিত রাজনৈতিক প্রথা মোতাবেক আওয়ামী সরকারকেও নি¤েœাক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
 (১) নির্বাচনের অন্তত তিন মাস পূর্বে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এমনিতেই এই জাতীয় সংসদ বৈধ নয়। কারণ সংসদের ১৫৩ জন অর্থাৎ মেজরিটি সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত। এছাড়া আর যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। তবুও আমরা বৈধতার প্রশ্ন না তুলে পার্লামেন্টারী প্র্যাকটিস অনুযায়ী দাবি করছি যে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এটি একটি সাধারণ নিয়ম যে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলে তার আর কোন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় না। কিন্তু জাতীয় সংসদ যদি বিলুপ্ত না হয় তাহলে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে অধিবেশন আহ্বান করে কালা-কানুন জারি করতে পারে।
 (২) নির্বাচনের পূর্বে সমস্ত রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। নির্বাচনকালে প্রতিটি দলের নেতা ও কর্মীরা যাতে অবাধে চলাচল করতে পারে এবং যাতে বিনা ভয় ভীতিতে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারে।
 (৩) বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের তিন মাস পূর্বে পদত্যাগ করতে হবে। এটাই সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশের নিয়ম। যেসব দেশে এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও দলীয় সরকারের সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় সেসব দেশেও দলীয় সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। তারা শুধুমাত্র দেশের বা সরকারের দৈনন্দিন রুটিন কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এই ব্যবস্থাও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মেনে নিতেন যদি সরকার ভোট চুরি, কারচুপি এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের কর্মীদের ওপর ফ্যাসিবাদী নির্যাতন না চালাতেন। মাগুরার একটি মাত্র এলাকায় প্রার্থীদের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সমগ্র নির্বাচনকে অস্বীকার করেছিল এবং কেয়ারটেকার সরকারের দাবি করেছিল। এখন বিগত নির্বাচনগুলোতে একটি নয়, দুটি নয়, দেশ ও জাতির প্রতিটি স্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই ভোট ডাকাতির আশ্রয় নিয়েছে। এবং সেই ভাট ডাকাতি করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাই জনগণ এই সরকারকে আর বিশ্বাস করে না। তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে যাচ্ছে।
 (৪) আজ যে জঙ্গিবাদ নিয়ে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস গরম করা হচ্ছে সেই জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে ঢোকা এবং মাথা চাড়ার সুযোগ পেয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাবে। এটি শুধু আমাদের কথা নয়। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির কথা। কয়েক দিন আগে বিশ্ব বিখ্যাত ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা তার সম্পদকীয় নিবন্ধে এই কথাটিরই প্রতিধ্বনি করেছে।
আসিফ আরসালান

Ads