শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন ।


নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সে বিষয়ে গত ২৫ জুলাই বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের ভেতরে শুধু নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও চলছে এই আলোচনা। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ওই সরকারের ব্যাপারে একটি মাত্র শর্ত দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, সরকারকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে হবে। সরকারের নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, খালেদা জিয়া এমন একটি সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন যে সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে। ২০ দলীয় জোটের নেত্রী একই সাথে আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। এজন্যই তিনি নির্বাচনের সময় ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের দাবি জানিয়েছেন।  স্মরণ করা দরকার, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক সম্ভাবনার কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনরত তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটারবিহীন ও একতরফা নির্বাচন বর্জন করেছিল এবং ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। এর কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার মাধ্যমে সংকটের শুরু করেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। বিরোধী দল প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাড় দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা ওই সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং গণচীনও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিল। এজন্য প্রধান দুটি দলকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছিল। অন্যদিকে সংলাপের নামে একের পর এক নাটক সাজিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করলেও তার পেছনের কূটিল ও নোংরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়তে সময় লাগেনি। সর্বশেষ উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা।
এভাবে সব মিলিয়েই সরকারের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল, সমঝোতার ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে একতরফা নির্বাচনের পথেই এগিয়ে যাবেন তারা। নির্বাচন কমিশনও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটও তাই ঘনীভূত হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে পালিত অবরোধে অচল হয়ে পড়েছিল সারা দেশ। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের একদিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অবরোধ এবং নির্বাচন বাতিলের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার অন্তত ১২২ জনকে হত্যা করেছিল। দমন-নির্যাতন এবং হত্যা ও গ্রেফতারের অভিযান চালানোর পাশাপাশি সরকার বেগম খালেদা জিয়াকেও তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। দলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন ওঠে না, পুলিশ এমনকি বিদেশি সাংবাদিকদের পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। খালেদা জিয়া নিজেও বাইরে আসতে পারেননি। ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ উপলক্ষে নয়া পল্টনস্থ বিএনপি অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অসম্মানিত হতে হয়েছিল। বিএনপির সংসদীয় প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরও নেত্রীকে বাইরে আসতে দেয়া হয়নি। এভাবে তাকে অবশ্য আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। ৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট না দেয়ার এবং প্রহসনের নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৮ দলীয় জোট ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছিল। সে হরতালের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম সংসদের নির্বাচন, যা গণতন্ত্রের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক অধ্যায় ও দৃষ্টান্তের সৃষ্টি করেছিল। ওই নির্বাচন পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। একটি মাত্র রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের সরকারও প্রকাশ্যে একে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়নি।
মূলত মাত্র সেদিনের এমন ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাব অত্যধিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রকামী সকল মহলই তার এ প্রস্তাবকে ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় বলে আখ্যা দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কথা অবশ্য আলাদা। কারণ, বেগম জিয়ার বক্তব্যের সবটুকু না শুনেই কিংবা অর্থ না বুঝেই ক্ষমতাসীনরা তার দাবি ও প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। ১৪ দলীয় আওয়ামী জোট তো বটেই, সরকার সমর্থক নাম সর্বস্ব ১০টি দলের জোটও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এর মধ্যে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ‘পরাজয়’ও আবিষ্কার করে বসেছে! এক ধাপ এগিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, সরকার পতনের আন্দোলনে লজ্জাকর ব্যর্থতার পর এতদিনে খালেদা জিয়া নাকি সংবিধানসম্মত পথে ফিরে এসেছেন! আর ফিরে যখন এসেছেনই তখন তার উচিত হবে নির্বাচনের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কারণ জানাতে গিয়ে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা আরো বলেছেন, দেশে কোনো আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়নি, যাচ্ছেও না। উদাহরণ দেয়ার জন্য ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র ২৮ জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়র উল্লেখ করা যায়। ‘খালেদার নমনীয়তা অচলাবস্থা নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে দৈনিকটি এমন একাধিক মন্তব্য করেছে যেগুলোর কোনোটিই ক্ষমতাসীনদের জন্য উৎসাহজনক নয়। যেমন বাংলাদেশের চলমান সংকটের কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে ‘দ্য হিন্দু’ লিখেছে, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ‘এক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায়’ পরিণত হয়েছিল! পরবর্তীকালে সৃষ্ট সংকট ও সহিংসতার জন্যও দৈনিকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অগণতান্ত্রিক অনমনীয়তাকে’ই দায়ী করেছে। বলেছে, প্রধান দুই দলের বৈরিতা ও অবিশ্বাসের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এমন এক অবস্থার মধ্যে যথেষ্ট ছাড় দিয়েছেন বলেই বেগম খালেদা জিয়ার নতুন প্রস্তাবকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেছে ‘দ্য হিন্দু’। বলেছে, খালেদা জিয়ার এই নমনীয়তা বাংলাদেশে বিদ্যমান সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য চমৎকার সুযোগের সৃষ্টি করেছে। ‘দ্য হিন্দু’র মতে শেখ হাসিনার সরকারের উচিত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অচলাবস্থার অবসান ঘটানো এবং নির্বাচনের আগে অধিক সমঝোতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা। সরকার এবং বিরোধী দলের কার্যকর ঐকতান যে বাংলাদেশের মতো নবীন গণতন্ত্রের জন্য জরুরি সে কথাটাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই উল্লেখ করেছে ‘দ্য হিন্দু’।
উদাহরণ হিসেবে ভারতের একটি মাত্র দৈনিকের সম্পাদকীয়র উদ্ধৃতি দেয়া হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন সকল দেশই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘের রূপরেখাও এসেছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে। সে কারণেই ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া দেশে-বিদেশে কোনো সরকার বা মহলের সমর্থন পায়নি। কেউই এই প্রতিক্রিয়াকে গণতন্ত্রের জন্য শুভ মনে করেনি। সবাই বরং খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যের দিকটিকে প্রাধান্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন, যার মূল কথায় তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করারই আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্যই নির্বাচনকালীন সরকারের নাম প্রসঙ্গে ছাড় দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, নাম যা-ই হোক না কেন, ওই সরকারকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে হবে। উল্লেখ্য, এবারই প্রথম নয়, এরও আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরেও তিনি সরকারের নামের আগে তত্ত্বাবধায়ক না রাখার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছিলেন। সেবার উপস্থাপিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখায় বেগম জিয়া বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। শুধু রূপরেখা পেশ করেই থেমে যাননি বেগম খালেদা জিয়া। সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে পরদিনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সংসদেও তার সে রূপরেখা পেশ করা হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বেগম জিয়া সেবার বলেছিলেন, দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রথমে দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এগিয়েছিলেন নিজেদের সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ‘সর্বদলীয়’ নামের এক বিচিত্র সরকার গঠন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে ‘সর্বদলীয়’ নাম দেয়া হলেও বাস্তবে সেটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারেরই সম্প্রসারিত সংস্করণ। উল্লেখ্য, নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবির পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নটিকেও সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনে যাতে কারো সন্দেহ না থাকে সেটা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চান। সে সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলেরও অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। এজন্য বিরোধী দলের নেতার কাছে অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়ার কাছে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নাম পাঠানোর জন্য প্রস্তাব পাঠাবেন তিনি। তবে প্রধানমন্ত্রী জানাননি, পরিকল্পিত ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রধান কে হবেন এবং কিভাবে তাকে বাছাই বা মনোননীত করা হবে। মন্ত্রিসভায় কোন মাপকাঠিতে কোন দলের কতজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এতে বিরোধী দলকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বের কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে এ সম্পর্কেও নীরব থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সরকার কখন কিভাবে গঠন করা হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা থাকবে এবং সরকারের মেয়াদ কতদিন হবেÑ এসব বিষয়েও কোনো কথা পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।
আপাতদৃষ্টিতে তখন মনে হয়েছিল, যেন প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন, প্রকাশ ঘটিয়েছেন সদিচ্ছারও। মনে হয়েছিল যেন সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন ও নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আসলেও উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ভাষণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কিন্তু তেমন সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণটিরই ধারেকাছে যাননি প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দল তখন আন্দোলন করছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবিতে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের নামের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বলেছিলেন,  যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে ‘নির্দলীয়’ হতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। কিন্তু এ দুটি বিষয়েও ‘এক চুল’ পরিমাণ ছাড় দেননি প্রধানমন্ত্রী। তার পরিকল্পিত সরকারকে ‘সর্বদলীয়’ বলেছিলেন সত্য কিন্তু সে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার জন্য এমনভাবেই বিরোধী দলের কাছে নাম চেয়েছিলেন যা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সবই তার একার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী পদে তিনিই বহাল থাকবেন। অমন কোনো সরকারে বিরোধী দল যে অংশ নেবে না সে কথাটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীও সুনির্দিষ্টভাবেই জানতেন। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী আদৌ চান না যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলকে নিয়ে সত্যিই তেমন কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার তাকে গঠন করতে হোক। একথাই বরং পরিষ্কার হয়েছিল, ‘সর্বদলীয়’ নামে যে সরকার তিনি গঠন করতে চাচ্ছেন সেটা আসলে হবে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারেরই অন্য রূপ- সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসহ যার নেতৃত্বে থাকবেন শেখ হাাসিনা নিজেই। থেকেছিলেনও তিনিই।
অর্থাৎ রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আসলে ‘সর্বদলীয়’ নামে নিজেদেরই অন্য এক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। অমন একটি নির্বাচন করেও ছেড়েছেন তিনি। একই কারণে বিরোধী কোনো দলই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে স্বাগত জানায়নি। অনেকে সেই সাথে না বলে পারেননি যে, প্রধানমন্ত্রী আসলে সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেকটিই ঠুকে দিয়েছেন। ঠিক সে পর্যায়েই আরো একবার দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা পেশ করে বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ‘সর্বদলীয়’ সরকারের প্রস্তাবটিকেও নাকচ করেছিলেন।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শুধু বেগম খালেদা জিয়ার এ ফর্মুলাকেই প্রত্যাখ্যান করেননি, একই সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোটারবিহীন ও একতরফা এমন এক  নির্বাচনও করেছিলেন ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ যাকে ‘এক ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্মরণ করা দরকার, নির্বাচন নামের ওই কর্মকান্ডে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেণ প্রধানমন্ত্রীর মনোনীতজনেরা। তারাই এখনো এমপি হিসেবে বহাল রয়েছেন! এত কিছুতেও অবশ্য কোনো লাভ হয়নি, দেশের রাজনৈতিক সংকট বরং ক্রমাগত আরো ভয়ংকর হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর এরই মধ্যে দীর্ঘ ১৯ মাস পার হয়ে গেলেও সংকট কাটিয়ে ওঠার শুভ কোনো  উদ্যোগই নেয়া হয়নি ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। তারা বরং বিএনপি জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলেও পরিস্থিতির অবনতিই শুধু ঘটছে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাবকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে। কারণ, মূল কথায় এবারও তিনি সমঝোতামুখী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্যই দেশপ্রেমিকরা আশা করছেন, খালেদা জিয়ার এই গণতন্ত্রসম্মত প্রস্তাবটির যথোচিত মূল্যায়ন করা হবে এবং নাকচ করার পরিবর্তে এর ভিত্তিতেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা পদক্ষেপ নেবেন। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোর পাশাপাশি রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তা সত্ত্বেও সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভূত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়বে- যে ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের আশা-আকাংক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া। সে প্রমাণ দিতে হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ ও ব্যবহার করা। বলা দরকার, সেটা না করে গণতন্ত্রের কফিনে আরো একবার আওয়ামী পেরেক ঠুকে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে জনগণ তো বটেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তা প্রত্যাখ্যান করবে- যার  পরিণতি সরকারের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মধ্যম আয়ের দেশ বনাম সাতাশটি লাশ


পহেলা জুলাই বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে এ ধাপে উন্নীত হতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময়। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশে ও বাংলাদেশীদের জন্য অনবদ্য অর্জন এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নতির পরিচায়ক। মূলত মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোর এই অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। জাতীয়ভাবে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১০৪৬ ডলার অতিক্রম করলেই সে দেশ নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। যদিও বাংলাদেশ ২০১২-১৩ অর্থবছরেই ঐ সীমা অতিক্রম করে এবং তখন মাথাপিছু আয় ১০৫৪ ডলারে পৌঁছে। বিশ্বব্যাংক তখন সে খবর না দিয়ে আমাদেরকে এ সুখবর দিলো দুই বছর পর। অবশ্য এটাই নিয়ম। নিয়মানুযায়ী উন্নতির ধারা তিন বছর স্থায়ী থাকতে হবে। আমরা তাতেও সমর্থ হয়েছি এবং এলডিসি তথা স্বল্পোন্নত দেশ কিংবা গরীব দেশের অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। বিশ্বব্যাংক মোট চারটি স্তরে দেশগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করে থাকে। সে নিয়ামানুযায়ী জাতীয় মাথাপিছু আয় ১০৪৫ পর্যন্ত থাকলে নিম্ন আয়ের দেশ, ১০৪৬-৪১২৫ ডলার জাতীয় মাথাপিছু আয় পর্যন্ত নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, ৪১২৬-১২৭৩৬ ডলার জাতীয় মাথাপিছু আয় পর্যন্ত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং জাতীয় মাথাপিছু আয় ১২৭৩৬ ডলারের বেশি হলে উচ্চ আয়ের দেশ বলা হয়। আমাদের দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের সীমারেখায় অবস্থান করলেও আমাদের উন্নয়নের গতি অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিক বেগবান। সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আমাদের দেশের জাতীয় মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলারে পৌঁছেছে। সুতরাং নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের সীমা অতিক্রম করে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের সীমায় পদার্পণ করতে আমাদেরকে বর্তমান জাতীয় মাথাপিছু আয়কে বর্তমানের চেয়ে আরও ৩.১৪ গুণ বাড়াতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে নিম্ন আয়ের দেশ ৩১টি, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ৫১টি, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ৫৩টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছরের মাথায় আমরা যে সীমা অতিক্রম করেছি তার পরবর্তী সীমায় প্রবেশ করা মাত্র ৪-৫ বছরের সম্ভব নয় কেননা এখানে কোন শর্টকাট রাস্তা নাই। বরং ধারাবাহিক অর্জনকে ধরে রেখে আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকাভুক্ত হতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদেরকে রফতানি বাণিজ্য বাড়াতে হবে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং রেমিটেন্স বাড়াতে হবে। নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের জন্য যেমন গৌরবের তেমনি বাংলাদেশী হিসেবে এদেশের সকল নাগরিকের জন্যও মর্যাদার বটে। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় সেখানে শঙ্কাও তৈরি হয়। বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেই এদেশের অর্থনীতির জন্য প্রতিটি দিন চ্যালেঞ্জের। এখন আমাদের অপেক্ষা শুধু উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ায়। তবে এ অবস্থান আমাদেরকেই তৈরি করে নিতে হবে।
এই অর্জনে দেশের ১৬ কোটি মানুষের অবদান রয়েছে। আমাদের কাক্সিক্ষত অর্জিত এ সুনামকে স্থায়ী করে সামনে ধারাবাহিক করার এখন উপযুক্ত সময়। এজন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে দেশকে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে সমানভাবে আন্তরিক হতে হবে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থ ও সুনামকে স্থান দিতে হবে। দলীয় কিংবা রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে যেন কোন অপশক্তি জাতীয় অর্জনের গতিপথে বাধার সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নাই। কাজেই রাজনৈতিক সংঘাত ভুলে সবাইকে দেশপ্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ছাড়া জাতীয় উন্নতির আশা করা প্রায় অসম্ভব। কাজেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সবার সমান অধিকার ও চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। ক্ষমতার বৈষম্য, আয় বৈষম্য, ধন বৈষম্য কিংবা সুযোগের বৈষম্য রেখে টেকসই উন্নয়ন অর্জিত হবে না। বিশ্বব্যাংক রিপোর্টে যদিও আমরা নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক কিন্তু জাতিসংঘ থেকে এ স্বীকৃতি পেতে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতিতে নয় বরং সামাজিকভাবে অগ্রগতি দেখাতে হবে। টাকা বা ডলারের হিসেবেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হবে না বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রেও অগ্রগতি দেখাতে হবে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস করতে হবে এবং সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি ছাড়া জাতীয় আয় বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। কৃষিক্ষেত্র অগ্রগতির জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি চাষের মাধ্যমে উৎপাদকের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং এ জন্য প্রয়োজন কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ ও প্রসার। অথচ গত সাত বছর ধরে কৃষি ক্ষেত্রে বাজেটের বরাদ্দ অংক ক্রমাগত সংকোচন হচ্ছে। যে জন্য কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে গেছে। পোশাক শিল্পকে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ ব্লাড তথা চালিকা শক্তি বলা হয়। অথচ বিভিন্ন সময়ে কাজের পরিবেশের নিম্ন মান, অপর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় শ্রমিক অসন্তোষ কিংবা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে পোশাক শিল্প অস্থির হয়ে ওঠে। পোশাক শিল্পকে রাষ্ট্রের উন্নতির স্বার্থে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর কোন বিকল্প নাই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য রফতানির ক্ষেত্রে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে এবং রফতানিযোগ্য মান ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। চামড়া, চা, মৎস্য, ওষুধ, টিনজাত দ্রব্য, সিমেন্ট, গরুর গোশত ও দুধ, মুরগির গোশত, চাল এবং শাক-সবজি রফতানির ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার জন্য দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করতে হবে এবং তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ব্যতীত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে দেশের প্রায় ৮০ লাখ দক্ষ, অর্ধদক্ষ কিংবা অদক্ষ শ্রমিক বৈধভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এছাড়াও অবৈধভাবে আরও প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। দেশের অর্থনীতিতে তাদের পাঠানো রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১৪ সালে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ্যাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী মোট ৫৮৩ কোটি বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স সংঘটিত হয়। এই রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেক আবার বিশ্বের ১০টি দেশ সংগ্রহ করে। সেই দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। কিন্তু বিদেশী রেমিটেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে অথচ আমরা যে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারছি। যে সকল বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে শ্রম বিক্রি করে তাদের অধিকাংশ অদক্ষ কিংবা অর্ধদক্ষ। যে কারণে শ্রমের মজুরি হিসেবে এদেশীয় শ্রমিকরা অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের চেয়ে অনেক কম অর্থ মজুরি পাচ্ছে। আমরা যদি আমাদের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে বিদেশ পাঠাতে পারি তবে রেমিটেন্সের অংক অনেক গুণ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য বিশ্বের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার বন্ধ। সরকার যদি আলোচনার মাধ্যমে বন্ধ শ্রমবাজার পুনরায় বাংলাদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করতে পারে তবে বিদেশ থেকে আগত রেমিটেন্সের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। শ্রমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হুন্ডি বা অবৈধ পন্থায় দেশে টাকা পাঠানোর কারণে রাজস্ব আয় থেকে রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর কারণে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই এ ব্যাপারে প্রবাসী শ্রমিকদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। সম্প্রতি এক রিপোর্টে দেখা গেছে, সুইস ব্যাংকসহ টাকা জমানোসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারে বাংলাদেশীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এক্ষেত্রে প্রধানত দু’টো কারণ হতে পারে। প্রথমত: বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগে তারা ভরসা পাচ্ছে না। কেননা চলতি বছরের জানুয়ারির ৫ তারিখ থেকে তিন মাসের অধিকাকাল সময় রাজনৈতিকভাবে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কেটেছে তা ভয়াবহ এবং সে ধারা থেকে দেশবাসী এখনো পূর্ণ বের হতে পারেনি। সুতরাং ব্যবসা মনস্ক ধনাঢ্যরা পুঁজি হারানোর ভয়ে কিংবা দেশের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কাবোধ করে বিনিয়োগের আগ্রহ না দেখিয়ে বিদেশী টাকা সঞ্চয় করছে। দ্বিতীয়তঃ কালো টাকা অর্র্থ্যাৎ অসৎ পথে অর্জিত টাকা খুব দ্রুত দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অতীতের ক্ষমতাশীলদের যেমন এ প্রবণতা ছিল বর্তমান ক্ষমতাশালীদের অনেকেই এ প্রবণতা থেকে বের হতে পারেনি। সুতরাং দেশের উল্লেখযোগ্য অংকের টাকা দেশেরে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সহায়ক না হয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এদেশের কৃষকের সন্তানরা যখন বিদেশে শ্রম বিক্রি করে ঘাম ঝরিয়ে হাজার টাকা দেশের উন্নয়নের জন্য দেশে পাঠাচ্ছে ঠিক তখনই এদেশের ধনাঢ্যদের একাংশ এদেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে অর্জিত টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। সুতরাং দেশপ্রেমিকতার মানসিকতায় ধনাঢ্যদের চেয়ে কৃষক এবং কৃষকের সন্তান অনেক এগিয়ে। পোশাক শিল্পে আমাদের দেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বিশ্বের অনেক দেশকে টপকে পোশাক রফতানিতে আমরা কখনে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়। অথচ সম্প্রতি ঈদের পোশাক বাজার ভারতীয় পোশাক দখল করে নিয়েছে। মাত্র কয়েকদিনের ঈদ বাজারকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পোশাক আমাদের দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা আয় করে নিয়ে যাবে। অথচ একটু আন্তরিক হলে দেশের টাকা দেশেই রাখতে পারতাম।
গত ১০ জুলাই ময়মনসিংহে যাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শামীমের বাসার সামনে শিশু ও মহিলাসহ ২৭ জন পদদলিত হয়ে মারা গেছে এবং আহত হয়েছে আরও অনেক। এমন দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য এই প্রথম। ব্যবসায়ী শামীম গত কয়েক বছর ধরেই যাকাতের কাপড় দিয়ে আসছেন। তবে অতীতে কখনোই এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটেনি। অতীতের ধারাবাহিকতায় এ বছরও ৬৪০ জন মহিলাকে যাকাতের কাপড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত দিনে যাকাতের কাপড় প্রাপ্তির জন্য অমনোনীতদের উপস্থিতির কারণে সৃষ্টি চাপে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় এমন একটি দুর্ঘটনা দেশের উন্নতির প্রতিবন্ধকতার সংবাদ নয় তবে দেশে যে ধন বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তা স্পষ্ট হয়েছে। দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে যাকাতের সম্পদ বণ্টনে যেমন ত্রুটি রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রীয় যাকাত খাতে যাকাত জমা প্রদানের ব্যাপারেও অনেকে আস্থা রাখে না। মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে তার সঠিক অগ্রগতি ও অর্জন বহাল রাখতে হলে পুঁজি ব্যবস্থার সুষম বণ্টন করে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে। আয় ও ধন বৈষম্যের অসম দূরত্ব দূর করা সম্ভব না হলে জাতীয় মাথাপিছু আয়ে বৃদ্ধি কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে এবং বিশৃঙ্খলাও বৃদ্ধি পাবে। অথচ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং উচ্চ আয়ের দেশের সিঁড়ি মাড়াতে হবে।
মানবপাচার বাংলাদেশের জন্য চরম অভিশাপ হিসেবে রূপ নিয়েছে। মানবতা ভাসছে অথৈ সমুদ্রে। জীবন সঙ্কুল জেনেও মানুষ ট্রলারে পাড়ি দিচ্ছে দূর দেশে। যাত্রা পথেই মারা যাচ্ছে খাদ্যের অভাবে। যারা কোনভাবে জীবনে বেঁচে কূল পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে তাদের অধিকাংশের ঠাঁই হচ্ছে গহীন জঙ্গলের গণকবরে। তবুও মানুষ ছুটেই চলেছে। তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা এবং সরকারের কঠোরতায় মানব পাচার বন্ধ হয়েছে। তবে ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে যারা যাত্রা করেছিল তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের জীবন এখনও শঙ্কার মধ্যে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে তাল মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী অনিশ্চিত সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য ছুটেছিল। কিন্তু এ সকল মানুষ জমি বিক্রি করে কিংবা লোন করে টাকা দিয়ে মৃত্যু কিনেছিল কেন? মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হয়ত মিয়ানমার সরকার ও স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশীরা কোন ভয়ে দেশ ছাড়ছিল? নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়া দেশের এ কোন চিত্র? সুতরাং সকল বিষয়গুলোকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন দেশের উন্নতির জন্য এ বিষয়গুলো অবশ্যই প্রতিবন্ধক এবং দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার সহায়ক। কাজেই দেশের নীতি নির্ধারকদের সকল সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করে এর স্থায়ী সামাধান করতে হবে। এজন্য সবার সহযোগিতা একান্তই কাম্য। দল কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হবে। ক্ষমতার মসনদ পাকাপাকি করার লড়াইয়ে দেশ যেন বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে সেজন্য সব মহলকে আন্তরিকতা দেখাতে হবে। সবার আগে যদি দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া সম্ভব হয় তবেই কেবল কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছ আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে স্থায়ী আসনে রূপদান করা সম্ভব।
রাজু আহমেদ 

বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব ।


বিএনপির চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারকে হতে হবে নিরপেক্ষ। গত ২৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানে কথাটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন, ওই সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়কই হবে তা নয়। নাম যা-ই হোক না কেন, আমরা এমন একটি সরকার চাই, যে সরকার জাতিকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে। সরকারের নামের ব্যাপারে আপত্তি নেই জানিয়ে বেগম জিয়া বলেছেন, তবে আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। এজন্যই আমরা নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়েছি। সরকারের উদ্দেশে তিনি হুশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, র‌্যাব-পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে না। তেমন চেষ্টা করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আমরা তা চাই না। তাই সরকারকে বলবো, শুভবুদ্ধির পরিচয় দেয়ার জন্য এখনো সময় আছে। নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, ২০০৮ সালে মইন-ফখরুদ্দিনদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিল বলেই আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনকে ভয় পায় এবং সে কারণেই দলটি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে।  
জাতীয় জীবনের অন্য কিছু প্রসঙ্গেও বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া, কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তার নির্বাচনকালীন সরকার সংক্রান্ত প্রস্তাব ও বক্তব্য। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, বেগম জিয়ার বক্তব্যের সবটুকু না শুনেই কিংবা অর্থ না বুঝেই ক্ষমতাসীনরা তার দাবি ও প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। ১৪ দলীয় আওয়ামী জোট তো বটেই, সরকার সমর্থক নাম সর্বস্ব ১০টি দলের জোটও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এর মধ্যে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ‘পরাজয়’ও আবিষ্কার করে বসেছে! এক ধাপ এগিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, সরকার পতনের আন্দোলনে লজ্জাকর ব্যর্থতার পর এতদিনে খালেদা জিয়া নাকি ‘পথে’ এসেছেন! আর পথে যখন এসেছেনই তখন তার উচিত হবে নির্বাচনের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কারণ জানাতে গিয়ে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা আরো বলেছেন, দেশে কোনো আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। আমরা কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়াকে সমর্থনযোগ্য এবং গণতন্ত্রের জন্য শুভ মনে করি না। আমাদের মতে, প্রাধান্যে আনা উচিত বরং বেগম জিয়ার উদ্দেশ্যের দিকটিকে। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, তিনি আসলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করারই দাবি জানিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, নির্বাচনকালীন সরকারের নাম প্রসঙ্গে তিনি যথেষ্ট ছাড় দিয়েছেন। বলেছেন, নাম যা-ই হোক না কেন, ওই সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে। উল্লেখ্য, এবারই প্রথম নয়, এরও আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরেও তিনি সরকারের নামের আগে তত্ত্বাবধায়ক না রাখার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছিলেন। সেবার উপস্থাপিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখায় বেগম জিয়া বলেছিলেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার মধ্য থেকে সরকারি দল পাঁচজনের এবং বিরোধী দল পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে। আর প্রধান উপদেষ্টা করা হবে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে। শুধু রূপরেখা পেশ করেই থেমে যাননি বেগম খালেদা জিয়া। সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে পরদিনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সংসদেও তার সে রূপরেখা পেশ করা হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বেগম জিয়া সেবার বলেছিলেন, দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রথমে দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এগিয়েছিলেন নিজেদের ছক অনুযায়ী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারা এমন একটি নির্বাচন করেছেন যা পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারও আগে জনগণের পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই ‘সর্বদলীয়’ নামের এক বিচিত্র সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু এত কিছুতেও কোনো লাভ হয়নি, দেশের রাজনৈতিক সংকট ক্রমাগত বরং আরো ভয়ংকর হয়েছে।
এমন এক অবস্থার মধ্যে ছাড় দিয়েছেন বলেই আমরা বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাবকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় মনে করি। কারণ, মূলকথায় এবারও তিনি সমঝোতামুখী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আমরা আশা করতে চাই, বেগম জিয়ার এই গণতন্ত্রসম্মত প্রস্তাবটির যথোচিত মূল্যায়ন করা হবে এবং না বুঝে-শুনে নাকচ করার পরিবর্তে এর ভিত্তিতেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা পদক্ষেপ নেবেন। বেগম খালেদা জিয়ার মতো আমরাও মনে করি, শুভবুদ্ধির পরিচয় দেয়ার জন্য এখনো সময় আছে।

মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিশ্বাস ভেঙে গেছে


অবিরাম বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে সরকারের ও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন-পুলিশের বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো কথাই আর আজকাল বিশ্বাস হতে চায় না। সরকার যা কিছু কথা বলে, প্রায় সকল ক্ষেত্রে তা খণ্ডিত, একপেশে এবং অগ্রহণযোগ্য। যেমন গত ৫ জানুয়ারির পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের সময় থেকে দেশে দু’ ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এক হলো পেট্রোল বোমায় মানুষের প্রাণ গেছে, অনেকে পুড়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও বর্বর ঘটনা, এ বিষযে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে, এসব পেট্রোল বোমা হামলায় বিরোধী দলের কাউকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি। যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই সরকারদলীয় সদস্য। এদের কাউকেই আবার শাস্তির আওতায় পর্যন্ত আনা হয়নি।
আবার লক্ষ্য করা গেছে যে, ১৮ দলের অবরোধের সময় সামনে পেছনে পুলিশ-বিজিবির পাহারা দিয়ে কিছু পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও ঐ ট্রাক বহরের মাঝখানের কোনো ট্রাকে পেট্রোল বোমা মেরে যারা পালিয়ে গেছে তাদের কাউকে পুলিশ বা বিজিবি গ্রেফতার করতে পারেনি। এটা কীভাবে সম্ভব? সে প্রশ্নের কোনো জবাব সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু  তারা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ঐ বোমা হামলার অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
এর বিপরীতে আছে বাড়ি থেকে, রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুলী করে হত্যা বা পঙ্গু বানিয়ে ফেলা এবং তাদের আটক নিয়ে গ্রেফতার বাণিজ্য। সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত শত অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে মুশকিল হলো এই যে, শত শত লোকের সামনে থেকে আটক করে নিলেও পুলিশ কিছুক্ষণ পরেই তাদের গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে বসেছে। সেখানে এক অসহায় অবস্থায় পড়ে সংশ্লিষ্টের পরিবার। তারা একবার থানায় যায়, একবার র‌্যাব দফতরে যায়। কোথায়ও তাদের স্বজনদের কোনো হদিস পায় না। কখনও বা কোনো পরিবার লাশ পায়, কখনও অনিঃশেষ দীর্ঘশ্বাসই হয় সম্বল, লাশও মেলে না।
এখন এক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিবি পুলিশ বা গোয়েন্দা পুলিশ। এই বাহিনীর গাড়ি আছে, তাতে বড় করে ‘ডিবি’ লেখা আছে,  দের হোলস্টারে গোঁজা আছে পিস্তল, কোমরে ঝোলানো আছে হ্যান্ডকাফ। চুল থাকে ছোট করে ছাঁটা। এরা ডিবি পুলিশ। কিন্তু এদের কাছে যা নেই, তা হলো আদালত থেকে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা। পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা সাধারণ নাগরিকরা জানতাম, আদালতের পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। এখন আর সে বিধান নেই। র‌্যাব-পুলিশের পরিচয়ে যে কেউ যে কোনো সময় যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। আগের দিনে জানতাম, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে কোনো কর্তৃপক্ষই হোক না কেন, তারা কাউকে রাতের বেলা গ্রেফতার করতে পারবে না। এখন সে বিধানও রদ করা হয়েছে। ফলে পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার বাণিজ্যের লক্ষ্যে একবারে গাড়ি পুলিশ বন্দুক নিয়ে কোনো গ্রামে হানা দিয়ে ডজন ডজন লোককে গ্রেফতার করে আনে। তারপর মুক্তিপণের জন্য চলে নানা দেনদরবার। এভাবে সর্বসান্ত¡ হয়ে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার পরিবার। সরকারের ন্যায়বিচারের ললিত বাণী কেবল বিদ্রুপই করছে সাধারণ মানুষকে।
এক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই ছিল মানুষের বিপদে-আপদের আশ্রয়স্থল। এখন সাধারণ মানুষের কাছে তারা ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সরকার র‌্যাব-পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন করে তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে চাইছে। সরকারের দ্বারা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হওয়ার ফলে তারা জেনে গেছে যে জবাবদিহিতা চাওয়ার মুরোদ আর এ সরকারের নেই। সে কারণে তারা নিজেরা নিজেদের আখের গোছানোর কাজে একেবারে কাছা দিয়ে নেমে পড়েছে। একের পর এক অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। মাত্র কয়েকটি ঘটনা আলোচনা করে আমরা পরিস্থিতির সামান্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। আলোচনা শুরু করা যায় নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের ঘটনা নিয়ে। গত বছর ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কমিশনার নূর হোসেনের কাছ থেকে বিপুল আর্থিক সুবিধা নিয়ে র‌্যাবের সিইও  ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা  লে. কর্নেল তারেক সাইদের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য ও বেসরকারি ব্যক্তি সাতজনকে হত্যা করে তাদের পানিতে ফেলে দেয়। জনাব মায়া ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত। দুদকের আইনজীবী বলেছেন, তার মন্ত্রিত্ব ও এমপি পদ উভয়ই খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি আছেন বহাল তবিয়তেই। যেখানে সন্দেহজনক মামলায় রাজনৈতিক বন্দীদের ডান্ডাবেরি পরিয়ে আদালতে আনা হয়, সেখানে দেখলাম মায়ার জামাতাকে একবারে জামাই আদরে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে কোনোরকম হ্যান্ডকাফ ছাড়াই আদালতে আনা হলো।
এক্ষেত্রেও ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। এই মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন আওয়ামী লীগের এক বহুল নিন্দিত এমপির সহায়তায় ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। তার বিস্তারিত অডিও রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঐ এমপিকে কেউ জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি। এ এক দারুণ খেলা। নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী বর্তমানে নিজেও নির্বাচিত কমিশনার সেলিনা ইসলাম এই মামলার চার্জশীটে নারাজি দিয়েছেন। তা নিয়েও নানা ঘটনার জন্ম হচ্ছে। এদিকে যেহেতু মূল আসামী অনুপস্থিত, তাই মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। নূর হোসেন কলকাতার কারাগারে আটক আছেন। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ, অবৈধ বৈদেশিক মুদ্রা রাখা ও নাম গোপন করে বাড়িভাড়া গ্রহণের দায়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ভারতে। কোনো চার্জশীট হয়নি। গত সপ্তাহে কলকাতার একটি আদালত নূর হোসেনের সহযোগীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সে পরোয়ানা কবে কার্যকর হবে, কেউ জানে না। সে সময় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেছিলেন, নূর হোসেনকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরিয়ে আনা  সম্ভব। কিন্তু গত ১৫ মাসেও তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আর বাংলাদেশে এখনও তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো চার্জশীট দাখিল করা হয়নি।
নূর হোসেন ভারতে আটক হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, শিগগিরই নূর হেসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তারপর আমরা অনেক নাটক দেখেছি। সরকার লোক দেখাতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছিল ও রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। এরপর ১৫ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার।
এর সবকিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। নূর হোসেনের সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হতে পারে এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের কোন কোন রাজনীতিক জড়িত আছেন। ভারতের সঙ্গে তো বাংলাদেশের বন্দীবিনিময় চুক্তি আছে। তাহলে নূর হোসেনকে কেন ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না- সে প্রশ্ন এখন সবার মনে। কেননা, ঐ চুক্তির অধীনে সরকার তো উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। তাহলে নূর  হোসেনকে কেন ফিরিয়ে আনা যাবে না? সে ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার সাত খুনের বিচার করতে সত্যি সত্যি নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে চায় কিনা।
প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে গত ৮ জুলাই সিলেটে। ঐ দিন ভোরে সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা মিলে ১৩ বছরের শিশু সবজিবিক্রেতা রাজনকে ভ্যানচোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তার প্রায় ২৯ মিনিটের ভিডিও করেছে ঘাতকরা। সে ভিডিও তারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েও দেয়। শিশুটি মারা গেলে তার তার লাশ গুম করার সময় স্থানীয় অধিবাসীরা খুনীদের আটক করে। এনিয়ে মামলা করতে গেলে রাজনের পিতাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দেয় পুলিশ। পরে তারা ঘাতকদের সঙ্গে বৈঠক করে খুনী কামরুলকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরব চলে যেতে সহযোগিতা করে। এখানে পুলিশ সরাসরি খুন করেনি বটে, তবে টাকার বিনিময়ে খুনীদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। আর নিজেদের দেয়া মামলায় শিশুটিকে বলেছে ‘অজ্ঞাত পুরুষ’। অর্থমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রী সেখানে গেছেন। রাজনের পিতাকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। মামলার দ্রুত বিচারের আশ্বাসও দিয়েছেন। আর তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, রাজনের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের কোনো বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। ফলে কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ সৌদি আরবে রয়েছে তাদের নিজস্ব আইন-কানুন। সেখানে কামরুল কোনো অপরাধও করেনি। সে ক্ষেত্রে কামরুলকে ফিরিয়ে আনতে কাঠখড় পোড়াতে হবে অনেক বেশি। তাছাড়া সরকারের অদূরদর্শী কূটনীতির কারণে বর্তমানে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ শীতল। ফলে কামরুলেরও নূর হেসেন কেস হবার আশঙ্কাই বেশি।
আরও একটি কথা এখানে আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটা হলো, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ও বহু মন্ত্রীর জেলা সিলেটের রাজন হত্যা নিয়ে সমাজে সত্যি তোলপাড় উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দোষীদের শাস্তি সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। তারপরও শোরগোল আছে। কিন্তু এমপি পুত্র রনির গুলীতে যে দুজন নিরীহ শ্রমজীবী মানুষের প্রাণ গেল, তাদের খোঁজ নিতে যাননি কোনো মন্ত্রী বা সরকারের কোনো প্রতিনিধি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তারা। এমন কি ঈদের দিনেও তাদের বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। কেউ খবর রাখেনি।
পাদটীকা :
নোয়াখালির কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে যে কিশোর মিলনকে জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল এবং জনতা তাকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল, গত ২৭ জুলাই তার চার বছর পূর্ণ হয়েছে। যেসব পুলিশ সদস্য কিশোর মিলনকে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল, ঘটনার বছর না পেরুতেই সেই পুলিশ সদস্যদের সাময়িক শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনার চার বছরের মাথায় এসে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ কিশোর মিলন হত্যা মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। এর ফলে অভিযুক্ত চার পুলিশ সদস্যসহ মামলার সব আসামীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখন কিশোর মিলনের মা কোহিনুর বেগম ছেলে হত্যার বিচার আল্লাহর আদালতে ছেড়ে দিয়েছেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আগে জানতে হবে সত্যটা

বাজারে গোলআলু দেখে সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘এগুলো কি মুরগির ডিম নাকি ফজলি আম?’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শিশু ছেলেটা হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ব্যাটা তিনটার একটাও চেনে না।’ সবার হাসি থেমে গেল। তাই তো, তিনটা বস্তুর একটাও তো লোকটা চেনে না! এমন ঘটনা বাজারে অবশ্য সচরাচর ঘটে না; কিন্তু ইদানীং ‘মুক্তচিন্তা’র অমুক্ত বাজারে প্রায়ই ঘটে থাকে। বাজারটির নাম মুক্তচিন্তা, কিন্তু স্বভাবে অমুক্ত, শুধু ধর্মের কুৎসার কাঁটাতারেই সে ঘেরা। 
তসলিমা নাসরীন তার নারীর কোন দেশ নাই বইটির এক জায়গায় আমাদের খবর দিয়েছেন যে, ইসলামি শরিয়া মতে ধর্ষিতা নারীটি নাকি ধর্ষকের স্ত্রী হয়ে যায়, যাতে ধর্ষকের ... পূজাটা ভালো করে হয়। কোথায় যেন একটি ছোট ছেলে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। ছেলেটি জানে যে, ইসলামি শরিয়ায় এমন বিধান নেই, ওখানে বরং ধর্ষকের শাস্তি অপমানজনক মৃত্যুদণ্ড। বোঝাই যাচ্ছে যে, ওই শিশু ছেলেটার সমান জ্ঞানও তসলিমার নেই। আপামণির জ্ঞানের চাবুক খেয়ে অবশ্য আমাদের মিডিয়াজগৎ বেহুঁশ। কোনো কোনো পত্রিকা তার আর্টিকেল ছাপতে পারলে জাতে উঠে যেতে পারবে বলে এখনো মনে করছে। 
কয়েক দিন আগে প্রচণ্ড কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আবার আল্লাহ্র ৯৯ শেফাতি নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে মুশরিকদের দেবদেবীর নামকে আশ্রয় করেছেন। আবার সেই হাততালি, আবার সেই হাসি। ছেলেটিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে বুঝে ফেলেছে যে, চৌধুরী সাহেব মাশরেক হতে মাগরেব পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভূ-পৃষ্ঠের কোনো অঞ্চলের দেবদেবী সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। ইসলামের কোনো ব্যাপারে যে সাহেব ধারণা রাখেন না সেটা, তার কাছে আরো বেশি পরিষ্কার। পৃথিবীর কোনো এলাকার কোনো দেবদেবীর নামের সাথেই আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো সাজুয্য আসলে নেই, ছিল না কখনো। যদি থাকেও তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে, আসলে কে কারটা অ্যাডপ্ট করেছে? ইসলাম ওদেরটা অ্যাডপ্ট করেছে নাকি ওরা ইসলামেরটা। অথবা কোনো পক্ষে অ্যাডপ্ট করার কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল কি না! ইসলামের ইতিহাস যার জানা আছে তিনিই জানেন যে, সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম ইসলাম, যা হজরত আদম আ:-এরও ধর্ম। 
অন্যান্য ধর্ম ইসলামের পরে সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই অ্যাডপশনতত্ত্ব ইসলামের বেলায় চলবে না। যারা হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর আবির্ভাবের পরে ইসলামের শুরু হয়েছে বলে মনে করেন, তাদের জানা থাকা উচিত যে, হজরত মুহাম্মাদ সা: ইসলামের শেষ নবী এবং আল-কুরআন ইসলামের শেষ গ্রন্থ। অর্থাৎ শেষটাই প্রথম নয়। ইসলামের কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, যুদ্ধ, হারাম, হালাল ইত্যাদি আগে থেকেই ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামান্য যোগ-বিয়োগ হয়েছে মাত্র, বিশেষ কোনো পরিবর্তন তাতে আসেনি। পরিবর্তনবাদীরা বারবার পরিবর্তন করে নিত্যনতুন ধর্মের আবিষ্কার করার কারণে পৃথিবীতে প্রায় হাজার তিনেক সম্প্রদায় ছিল বা আছে। এই দুনিয়ায় এমন কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী নেই যাদের মাঝে আল্লাহ্ পাক কখনো কোনো নবী-রাসূল বা পথপ্রদর্শক পাঠাননি। অনেক সম্প্রদায়ই তাদের নবী-রাসূল বা বুজুর্গ ব্যক্তিদের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে তাদের তিরোধানের বা মৃত্যুর পর মূর্তি গড়ে পূজায় লিপ্ত হয়েছে। ওইসব সম্প্রদায়ের কাছে তারা আর নবী-রাসূল থাকেননি, হয়ে গেছেন দেবতা। পৃথিবীতে প্রথম পূজা হয়েছে মেহলাইলের, যিনি ছিলেন হজরত আদম আ:-এর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ, একজন বুজুর্গ ইসলাম প্রচারক। দ্বিতীয় পূজা হয়েছে হজরত ইদ্রিস আ:-এর, যিনি এখনো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পূজিত হচ্ছেন, স্বর্গের দেবরাজ বিবেচনায়। মূর্তি সংহারী হজরত ইবরাহিম আ:-এরও মূর্তি বসিয়েছিল মুশরিকরা, খোদ কাবা শরিফে। মূর্তিপূজকরা চিরকালই এমনি লোমহর্ষক কাণ্ডকীর্তি ঘটিয়েছে, ধর্মের দোহাই দিয়েই। ওই সব কুপরিবর্তনের কারণেই ইসলামকে বারবার ফিরে আসতে হয়েছে, নতুন রূপে নয়, একই রূপে, অতি পুরাতন রূপে। আল্লাহ্ পাক বারবার পরিবর্তিত গ্রন্থগুলো বাতিল করেছেন, ওগুলোর ভাষাও বিলুপ্ত করেছেন, নতুন ভাষায় নতুন গ্রন্থ নাজিল করে ইসলামকে বারবার পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এটাই ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস। 
মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, দুনিয়ার অনেক জাতি আবার তাদের রাজা-রানীকে দেবদেবী হিসেবে পূজা করেছে, আজো করে। এসব রাজা-রানী নিজেদের কখনো সূর্যের পুত্র-কন্যা, কখনো চন্দ্রের পুত্র-কন্যা, কখনো পাহাড়-পর্বত বা নদ-নদীর সন্তান বলে দাবি করেছে এবং মানুষের পূজা আদায় করেছে, ভোগ-সম্ভোগ হাসিল করেছে। নিজেদের অমর-অজ্বর দাবি করে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, অস্থি-পঞ্জর ধুলায় মিশে গেছে, কিন্তু অতিভক্ত পূজারির কাছে তারা আজো দেবতাই রয়ে গেছেন। এশিয়া, ইউরোপ বা আফ্রিকার কোনো দেশই এই জুলুমবাজির ঊর্ধ্বে ছিল না। অনেক দেশেই রাজা-রানীকে পূজা না করার অপরাধে মুসলমানদের প্রাণদণ্ড হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, পুত্রসন্তান হত্যা করে নারীদের জীবিত রেখে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছে। এসব সম্প্রদায়ের নাম ধরে ধরে দেবদেবীর উল্লেখ করা যেত যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না থাকত। ভালো করে চোখ খুলে দেখলেই পরিষ্কার হবে যে, ওইসব দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো মিল নেই। গ্রিক মিথোলজি, ভারত-পুরাণ, মিসরীয় পুরাণ, মেসোপটেমীয় পুরাণ, নর্স-মিথোলজি, রোমান মিথোলজি বা সিরীয় মিথোলজি ঘেঁটে কথিত কোনো দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র ৯৯ নামের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। চৌধুরী সাহেব কি অ্যাডপশনতত্ত্ব আবিষ্কারের আগে এসব মিথলোজির ওপর একটু-আধটু পড়াশোনা করে নিলে ভালো হতো না? একটি নদী, একটি পাহাড় অথবা একটি বড় গাছের পূজায় যারা লিপ্ত হতে পারে, আল্লাহ্র নামের সাথে তাদের পরিচয় হবে কিভাবে? সাপ, বিড়াল, গরু, শূকর, শকুন, কুমির, কুর্ম্ম, লিঙ্গ, যোনিÑ মুশরিকদের এসব আরাধ্য দেবতার সাথে আল্লাহ্র নামের সম্পর্ক কী? এমন সব জাতির কাছ থেকে ইসলামের ধার নেয়ার মতো কী থাকতে পারে?
সুমেরীয় মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’, রোমান মহাকাব্য ‘ঈনিড’, ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’ এবং বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলো মানুষের পৃথিবী থেকে কোনোক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেলে শতকরা ৯৯ ভাগ দেবদেবীর নাম-নিশানা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কাব্য-মহাকাব্যের মাঝেই ওদের সৃষ্টি, ওখানেই ওদের বিলয়। আল্লাহ্র নামের সাথে ওদের নাম মিলবে কী করে ? আল্লাহ্ কি এতই অক্ষম যে, নিজের নামের পবিত্রতা কবিদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেবেন? আল্লাহ্ মানুষের মনের নিয়ন্তা। দেবদেবী সৃষ্টির সময় আল্লাহ্র নাম ব্যবহার করার মানসিকতা কবিদের কোনোকালেই হয়নি। ‘গিলগামেশে’র রচয়িতার মতো দু’একজন কবি চেষ্টা অবশ্য করেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি, আল্লাহ্র কোনো নামই তাদের হাতে ঠিকমতো আসেনি। এলাই, এলি, এনলিলÑ এ জাতীয় নামাদি গিলগামেশে ব্যবহৃত হয়েছে, ওসব দিয়ে ইউরোপের মহাপণ্ডিতদের কেউ কেউ ‘আল্লাহ্’ শব্দটি নির্দেশ করার খামাখা চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু সঠিক নামটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে মুশরিক কবিরা কখনো পারেননি। দেবদেবীর নামের সাথে আল্লাহ্র নাম মিলবে কিভাবে? পৃথিবীর বেশির ভাগ পূজারির আরাধ্য দেবী; দেবতা নয়, দেবী। সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্র নামের সাথে তাদের নামের মিল আসবে কোত্থেকে, তার সব নামই তো পুরুষবাচক? আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করলেও ফেরেশতাদের আল্লাহ্র কন্যাজ্ঞানে তাদের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। সেখানেও আল্লাহ্র শিফাতি নামে কোনো সংযোগ ঘটেনি। একটা বিষয় ভুললে চলবে না, পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি কখনো ছিল না, এখনো নেই, যারা আল্লাহ্কে দেবতার সাথে একাকার করে ফেলেছে। সব জাতিই আল্লাহ্র একত্বে স্বীকার করে, সাথে কিছু সুযোগ-সুবিধা হাসিলের আশায় কিছু দেবদেবীর পূজা করে। দেবদেবী যার যার নিজস্ব, কিন্তু স্রষ্টা সবার এক ও অদ্বিতীয়। এমনকি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পূজারিরাও স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে ‘একমে বা দ্বিতীয়ম’ হিসেবে, ওখানেও স্রষ্টাকে তারা বিভিন্ন নামে ডাকে, কিন্তু স্রষ্টার কোনো নামের অনুকূলে তারা কোনো দেবমূর্তি বানিয়েছে এমন নজির আছে বলে মনে হয় না। স্বয়ং স্রষ্টাকে কেউ কখনো দেবতার পর্যায়ে নামিয়ে আনেনি; না, বিশ্বের কোনো জাতিই এ অপকর্মটি করেনি। কারণ বিশ্বের সবাই স্রষ্টাকে নিরাকার, নিরঞ্জন এবং সর্বত্র বিরাজমান বলে জানে ও মানে। কী করে স্রষ্টার নামের সাথে দেবতার নাম মিলবে? যেকোনো জাতির পুরাণাদি ঘাঁটলেই পরিষ্কার হবে যে, দেবতারা কেউ নিরাকার নয়, নিরঞ্জনও নয়, সর্বত্র বিরাজমানও নয় এবং কোনো দেবতাকেই কোনো জাতি স্রষ্টার সমান মর্যাদা দেয়নি। প্রত্যেক দেবতার জন্য তারা একটা নির্দিষ্ট বিষয় ঠিক করে দিয়েছে, স্রষ্টার মতো সব বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব তারা কাউকেই দেয়নি। মুসলমানরা এই স্রষ্টারই ইবাদত করে, কোনো দেবদেবীর ইবাদত তারা করে না, দেবদেবী আছে বলে স্বীকারও করে না, যদিও জিন ও ফেরেশেতায় তারা বিশ্বাসী। স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলার বা লেখার আগে এসব তথ্য জেনে নেয়া ভালো ছিল। ধর্ম সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখার ইচ্ছা থাকলে আগে ধর্মকে জানতে হবে।
‘আমি তো মুক্তচিন্তা করছি’Ñ এই অথর্ব অজুহাতে মিথ্যাচারের অধিকার কারো জন্মায় না। মুক্তচিন্তার অর্থ সত্যের অনুসন্ধান, মিথ্যাচার নয়। টি পি হিউয়েজের মতো কোনো কোনো ইংরেজ লেখক ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে অনেক আজগুবি কথা লিখেছেন, যার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসনমুক্ত দেশের নাগরিকেরা যদি এখনো নিজেদের মগজগুলোকে ইংরেজি ভাষাভাষী লেখকদের কলোনির মতো ব্যবহার করেন, তাহলে তা অবশ্যই দুঃখজনক। ওরা যা বলে তার সব সত্য নয়, সব অকাট্য বলে মেনে নেয়ারও কোনো কারণ নেই। উপায়ও নেই; কারণ সত্য তো সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে হাসছে, আমাদের লেখকদের বোকামিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চৌধুরী সাহেবরা কি এসব দেখেন? মনে হয় না। 
মোহাম্মদ মফিদুল ইসলাম

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সময়ের আহ্বান


মাগুরা শহরে দোয়ারপাড় এলাকায় গত বৃহস্পতিবার যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুলীবিদ্ধ আবদুল মোমিন (৬২) শনিবার মধ্যরাতে মাগুরার সদর হাসপাতালে মারা গেছেন। ডা. শফিউর রহমান জানান, শুক্রবার রাতে আবদুল মোমিনের অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে রাত ২টার পর তার মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য যে, বৃহস্পতিবার বিকালে শহরের দোয়ারপাড়ের যুবলীগ কর্মী আজিবর ও মোহাম্মদ আলী গ্রুপের সঙ্গে অপর যুবলীগ কর্মী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ভূঁইয়ার গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এ সময় প্রতিপক্ষ গ্রুপ গুলী ছুঁড়লে কামরুলের বড় ভাই বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম, চাচা আবদুল মোমিন ভূঁইয়া ও প্রতিবেশী মিরাজ হোসেন গুলীবিদ্ধ হন। আহতদের মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে শুক্রবার রাতে আবদুল মোমিনের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে নাজমা বেগমকে ঐ রাতেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। মায়ের পাশাপাশি নবজাতকেরও ঘাড় ও চোখে গুলী লেগেছে। শিশুটির বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। এ ঘটনার প্রতিবাদে এলাকাবাসী শনিবার দুপুরে শহরে মিছিল শেষে চৌরঙ্গি মোড়ে মানববন্ধন করে।
সাম্প্রতিক সময়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসমূলক ঘটনা জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ছাত্রলীগের সদস্যরাই তো একসময় যুবলীগ করে এবং অবশেষে যুবলীগের সদস্যরাই যোগ দেয় আওয়ামী লীগে। এই যে চেইন তা একটি সংগঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের মত একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলের নেতা-নেত্রীরা বেশ ভালই বোঝেন। তাই ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের সদস্যরা যখন সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে তখন তারা শুধু বিব্রতই হন না, শঙ্কিতও হয়ে পড়েন। এ কারণে মাঝে মাঝে ছাত্রলীগ ও যুবলীগে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে থাকে। সাম্প্রতিককালে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র বিরোধী ও সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংগঠনটির সাথে সম্পর্ক ছিন্নও করেছিলেন। এভাবে নানা হুমকি ও চাপের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, ছাত্রলীগ কি ঐতিহ্যের ধারায় ফিরে এসে শৃঙ্খলায় সমুন্নত হতে পেরেছে? প্রশ্নটির বাস্তবতা এখনও বিদ্যমান রয়েছে।
আমরা মনে করি, ছাত্রলীগসহ দেশের সব ছাত্র সংগঠনই আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ছাত্র সংগঠনগুলো নিজ নিজ গঠনতন্ত্র মেনে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হলে তা শুধু ছাত্র সমাজের জন্যই নয়, দেশের জন্যও কল্যাণকর হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দেশের ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যেন ঐতিহ্যের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধিতেও আছে। এ কারণেই হয়তো ২৫ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি যেন কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়। তিনি আরো বলেন, ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালীর প্রতিটি অর্জনের সঙ্গে জড়িত। আমি এটুকুই চাইবো, ছাত্রলীগ যেন সব সময় একটা আদর্শ নিয়ে চলে। কারণ, আদর্শহীন সংগঠন ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না। আমাদের বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। কারণ এখন আদর্শনিষ্ঠ সংগঠন ও আদর্শবান নেতা-নেত্রীর সংকট খুবই প্রকট। এর অভাবে আমাদের সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানাবিধ সংকট চলছে। কথা ও কাজে মিল না থাকার কারণে জনমনেও হতাশার মাত্রা বাড়ছে। তাই আমরা মনে করি, শুধু ছাত্র সংগঠনই নয়, রাজনৈতিক সংগঠনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও যদি আদর্শনিষ্ঠ হয়ে যৌক্তিক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে তাহলে জনমনে আবার নতুন করে আশার সঞ্চার হতে পারে।

শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দখল ও ক্ষমতার রাজনীতি

মতাসীনদের পছন্দ জনগণের টাকা, জনগণের দুর্ভোগ এবং সরকারি জমি। যে কারণে নিজেদের মতো করে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে, চালিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং সরকারি জমি দখল করে দলের অফিস গড়ার কার্যক্রম। ‘সরকারি দল’ বলতে এখন বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, তরিকত ফেডারেশনসহ ৯টি দলকে। আমাদের রাজধানীর শত শত একর জমি এ দলগুলোর দখলে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম ভাঙিয়ে একের পর দখলবাণিজ্যে নীলক্ষেতের বাণিজ্য বিতান মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, গাউছুল আজম মার্কেট, নীলক্ষেত স্কয়ার মার্কেটসহ প্রায় ২০টি মার্কেট দখলে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও জোট, এমনকি সাথে অন্যান্য দলের কিছু লোক। পাশাপাশি সেগুনবাগিচায় ১৪ দলের বাম সংগঠনের কার্যালয় নির্মাণের জন্য জমি দখল করা হয়েছে পার্টির নেতৃবৃন্দের তত্ত্ব¡াবধানে। রাজধানীর লালবাগের জগন্নাথ সাহা রোডের পুষ্প সাহার তারাবটি পুকুর ভরাট করে গড়ে উঠেছে শ্রমিক লীগের কার্যালয় ও মার্কেট। মহাখালী রেলগেট ঘেঁষে বিপজ্জনক স্থানে গড়ে উঠেছে ২০টি দোকান। এগুলোর ঠিক ওপরেই ফাইওভার। রেলগেট পার হয়ে উত্তর দিকে মোড় নিলেই চোখে পড়বে দু’টি সংগঠনের অফিস। এর একটির সাইনবোর্ডে লেখাÑ ‘২০ নং ওয়ার্ড ও বনানী থানা যুবলীগ’, অন্যটিতে লেখা আছে ‘ঢাকা বিভাগ শ্রমিক লীগ, বনানী থানা’। যুবলীগের সাইনবোর্ডের ওপরের এক দিকে ছবিতে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী, আরেক দিকে যুবলীগ উত্তরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ছবি। অফিস দু’টি ঘেঁষেই দোকানগুলোর অবস্থান। সব স্থাপনাই রেলের জমির ওপর অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। দোকানগুলো বসিয়েছেন অফিস দু’টির নিয়ন্ত্রণকারীরা। অফেরতযোগ্য অগ্রিম টাকাসহ দৈনিক ভাড়া দিতে হয় দোকানদারদের।
এমন অবস্থা শুধু মহাখালীতে নয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই সরকারি জমি দখল করে মতাসীন দলের অফিস নির্মাণ করা যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হয়েছে এ তাণ্ডব। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের মানুষ বারবার দেখেছে, রাজনৈতিক সরকার মতায় আসার সাথে সাথেই মতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনের কার্যালয় অথবা নেতা-নেত্রীর নামে সরকারি জমিতে সাইনবোর্ড টানানোর হিড়িক পড়ে। মতার পালাবদলে পাল্টে যায় সাইনবোর্ডের শিরোনামও। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
ছাত্ররাজনীতি যারা করছেন, তাদের অনেকে ছাত্রজীবনেই হয়ে যাচ্ছেন লাখ লাখ টাকার মালিক। এর পেছনেও রয়েছে দখলের রাজনীতি। পিছিয়ে নেই ছাত্রমৈত্রীর একাধিক সাবেক সভাপতি। আমাদেরকে বারবার রাজনীতির মাঠে থেকে বুর্জোয়ার বিপরীতে থাকার জন্য মন্ত্র শেখালেও জাসদ ছাত্রলীগের নিউমার্কেটের কার্যালয়টি কিন্তু তাদের নেতা দখলবাণিজ্য করেই জুুটিয়ে দিয়েছেন। এভাবে জনগণের সম্মতি না থাকলেও দেশকে কোনো দখলবাজ সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তারা এখন নিরুপায়।
রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতার রাজনৈতিক চর্চা শুরু না করলে সোচ্চার হবে বাংলাদেশের সচেতন নতুন প্রজন্ম। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা যে কত বেশি; তার প্রমাণ দিতে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বায়ান্ন ও একাত্তরকে এবং প্রতিটি আন্দোলনকে। আন্দোলনের হাত ধরে রাজনীতিতে তরুণেরা বারবার ফিরে এসেছে স্বকীয়তা নিয়ে। ফিরে আসার যদি প্রয়োজন হয় আবারো; তাহলে এবার হবে বাংলাদেশকে লোভী-দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী-খুনি-চাঁদাবাজদের কবল থেকে মুক্তির জন্য নিবেদিত... 
মোমিন মেহেদী

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গ্রিক বাহাদুরের ঠাটা ঢেঁকি


গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসের কথা শুনে, হুমকি-ধামকি দেখে মনে হচ্ছিল যে, তার কাছে বুঝি বিরাট কোনো জাদুর কাঠি আছে, যা দিয়ে তিনি গোটা ইউরোপকে একেবারে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিতে পারেন। বলতে পারেন যে, তোমাদের আমরা থোড়াই পরোয়া করি। আমরা আমাদের মতো করে নিজেরাই চলতে পারি। তোমাদের ঋণ-ফিনের আমরা তোয়াক্কা করি না। যেমন ক’দিন আগে আমাদের আত্মমর্যাদাবতী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর গলায় বলেছেন যে, আমরা ভিক্ষা নেই না, ঋণ নেই এবং নিয়মিত পরিশোধ করি। অতএব কারও ডিকটেশন শুনতে চাই না। একেবারে খাঁটি কথা। কিন্তু খাঁটি কথার সব সময় ভাত মেলে না। ঋণের জন্য ঋণদাতাদের হাতেপায়ে ধরতে হয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে।
গ্রিসের কট্টর বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী সেদেশের নাগরিকদের মধ্যে এক ঘোর তৈরি করে এ বছরের জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগষ্ঠিতা তিনি পাননি। তাই সরকার গঠনের জন্য তাকে কোয়ালিশন করতে হয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে। অর্থাৎ চরম এক গোঁজামিলের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু করেন সিপ্রাস। কিন্তু তার আগেই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গ্রিসের অর্থনীতিতে অধিকতর ধস নামতে শুরু করেছিল। সরকারগুলো ক্ষমতায় আসীন থাকার জন্য গ্রিকদের সেটা বুঝতে দিতে চাননি। আর পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কেবলই ইউরোপীয় কমিশন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (তিন মিলে ট্রয়কা) থেকে অবিরাম ঋণ নিয়ে গেছে। ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেনি। ফলে এখন দেউলিয়া হবার মুখে পড়েছে গ্রিস। পুরানা ঋণের কিস্তি শোধ করা তো দূরের কথা, এখন গ্রিক সরকার ঐ ট্রয়কার কাছে নতুন করে আরও ঋণ চাইছে।
পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আপনার কোনো বন্ধুর কাছ থেকে গত বছর ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, ফেরত দেননি। আপনি তার আগের বছরও একই বন্ধুর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, ফেরত দেননি। এ বছর আরও ৫০ হাজার টাকা ঋণ চাইছেন। কেউ কি এ ধরনের ঋণ কখনও কাউকে দেয়? অতএব পেলেন না। এতে রাগে ক্ষোভে আপনি ফেটে পড়লেন। অথচ পুরো ইউরোপকে এক ধরনের ব্ল্যাক মেইল করে গ্রিক সরকার সে ঋণই আদায় করে নিতে চাইছে। কিন্তু তৃতীয় বছরে এসে একবারে বেঁকে বসেছে এ ট্রয়কা। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিকরা গ্রিসবাসী তথা পৃথিবীর মানুষদের নিষেধ করে গিয়েছিলেন, গ্রিকরা সে নিষেধ অমান্য করে ধার করে ঘি খেতে শুরু করেছেন প্রায় এক যুগ বা তারও আগে থেকে। এখন তাদের বিপদ ভারী হলো।
এখন গ্রিস দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। একসময় ইউরোপীয় দেশ হিসেবে গ্রিস ট্রয়কার যে সমর্থন পেয়েছিল, এখন তা প্রায় বাস্পীভূত হয়ে যেতে বসেছে। কীভাবে পরিশোধ করা হবে-সেটা চিন্তা না করেই তারা ভেবেছিল, ঋণ শোধের ক্ষেত্রে তারা ইইউ-এর শর্ত কিছুতেই মানবে না। এদিকে গ্রিস আবার ইউরোপীয় অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থার অংশীদার। ফলে সে দেশে স্থানীয় মুদ্রার চেয়ে ইউরোর কদর বেশি। গোটা অর্থব্যবস্থা এখন ইউরো-নির্ভর। ব্যাংকগুলো চলে ইউরোতে। কিন্তু আইএমএফের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রিসকে নতুন করে ঋণ দিতে অস্বীকার করে। এতে সঙ্কট এমন দাঁড়ায় যে, গ্রিসের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাই ধসে পড়ে। ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। এসময় শুধু খোলা ছিল ব্যাংকের এটিএম বুথগুলো। আর সেসব বুথ থেকে কোনো গ্রাহক সর্বোচ্চ ৬০ ইউরোর বেশি তুলতে পারছিলেন না। সে এক ভয়াবহ দুঃসময়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে পণ্য সরবরাহ সীমিত হয়ে আসছিল। মানুষের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুতের প্রবণতা। দাম বাড়ছিল ভোগ্যপণ্যের।
গ্রিসকে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐ ট্রয়কা তিন দফা সুপারিশ করেছিল। তার মধ্যে ছিল পেনশন কমানো, সোশাল সিকিউরিটি সহায়তা ও বেকারভাতা হ্রাস আর কিছু কৃচ্ছ্রতার পথ বেছে নেওয়া। তাদের যুক্তি ছিল যে, এসব প্রস্তাব মেনে এর আগে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ একই ধরনের সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আলেক্সিস সিপ্রাস এসব সংস্কার কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ইইউ’র প্রস্তাব গণভোটে দেন। এটা ছিল সিপ্রাসের সস্তা স্টান্টবাজি। তিনি বলতে চাইলেন যে, গ্রিসবাসী কোনো চাপিয়ে দেওয়া শর্তটর্ত মানতে প্রস্তুত নয়। তা হলে এতোদিন যে ধার করে ঘি খেলেন, সে ঘিয়ের পয়সা শোধ হবে কীভাবে? কিন্তু সিপ্রাস দারুণ এক জিগির তুলে দিয়ে আইএমএফের শর্তের বিরুদ্ধে জনগণের ভোট আদায় করে নিলেন। প্রায় ৫০ শতাংশ লোক ঐ গণভোটে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ আইএমএফের সংস্কার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
তবে কি তারা ধার করা অর্থ ফেরত দিতে চান না? জনগণ সেভাবে ভাববার অবকাশই পাননি। সরকার টাকা ধার করেছে কিনা, সাধারণ মানুষ তার কি জানে। কিন্তু তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়তে রাজি না। এই ধার যে সরকার নিজের জন্য করেননি, তাও জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে সিপ্রাসের সরকার। আর এই উদ্যোগে সিপ্রাসের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক ছিলেন তার অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, গণভোটে জয়লাভের পর ঐ অর্থমন্ত্রী নিজে অতি দ্রুত পদত্যাগ করে দৃশ্যপট থেকে সরে যান। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস হয়তো ভেবেছিলেন যে, ইউরোপীয় নানা ইকুয়েশনে শেষ পর্যন্ত ঋণ শোধ না করলেও, ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও ইইউ তাদের আবারও ঋণ দেবে। কিন্তু বেঁকে বসেছিল জার্মানী আর ফ্রান্স। তারা বলল, এই ঋণে কোনো ছাড় নয়। কারণ যে অর্থ তারা ঋণ হিসেবে দেবেন, তা তাদের জনগণের ঘামঝরানো ট্যাক্সের পয়সা। এটা তারা পানিতে ঢালতে পারেন না। অতএব কিস্তি পরিশোধ না করলে আর কোনো নতুন ঋণ নয়।
আইএমএফকে ‘না’ বলে গ্রিকবাসীর সে কি উল্লাস! কিন্তু তারা হয়তো ভাবেনইনি যে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের এই উল্লাসের অবসান ঘটবে। কারণ গত ২০ জুনের মধ্যেই তাদের ইইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হতো ৭০০ কোটি ইউরো। আর আগস্টের মাঝামাঝি তাদের সর্বমোট পরিশোধ করতে হবে ১২ শ’ কোটি ইউরো। এ ছাড়াও ইউরো জোনের দেশসমূহ ও আইএমএফকে তাদের অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে ২৪ হাজার কোটি করে ইউরো। ফলে গ্রিসের জন্য এখন ত্রাহি অবস্থা। এদিকে আবার চলমান পরিস্থিতিতে গ্রিসের বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশেরও ওপরে। এই বেকারদেরও আবার দিতে হচ্ছে বেকার ভাতা।
ফলে ঋণভারে জর্জরিত গ্রিস। তারা জানে না কীভাবে এই ঋণ শোধ করা হবে। আবার তারা ঋণদাতাদের পরামর্শ শুনতেও নারাজ। এ রকম একটি দেশকে কে ফের ঋণ দিতে যাবে? সঙ্কট হয়েছে সেখানেই। তাছাড়া গ্রিসে রয়েছে সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি, ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় গ্রিকদের উৎপাদনশীলতাও অনেক কম। স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি লাগামছাড়া। প্রতিযোগিতমূলক অর্থনৈতিক সংস্কারে তাদের আছে ব্যাপক অনীহা। তাছাড়া তারা আয় বুঝে ব্যয় করতেও জানে না, যা যেকোনো ভদ্র দেশ করে থাকে। গ্রিসের কর্মক্ষম লোকেরা কাজ করে খাওয়ার চেয়ে বেকারভাতা খাওয়াই অনেক বেশি পছন্দ করে। আর সরকারের মনোভাবও যেন অনেকটা সেরকমই। ঋণ নেব বেকার ভাতার মতো, যা কোনোদিন শোধ করতে হবে না। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে, তেমন ঋণ দেওয়ার দেশ বা প্রতিষ্ঠান দুনিয়ার কোথায়ও নেই।
তবে অলস হলেও গ্রিকদের গণতন্ত্রপ্রীতি দারুণ। তারা ইইউ’র নির্দেশকে ‘মানি না’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হোক, গ্রিসের দার্শনিকরাই তো পৃথিবীকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছে ও সভ্যতা শিখিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের ব্যাপক চর্চা প্রীতির প্রতি সমর্থন তাদের ঋণ থেকে মুক্তি দিতে মোটেও সহায়ক হতে পারেনি। এদিকে গত ১৩ জুলাই ইউরো জোন নেতারা এক বৈঠকে বসে গ্রিসকে চূড়ান্তভাবে হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, পরবর্তী যে কোনো আলোচনায় বসার আগে এবং ইউরো মুদ্রাভুক্ত থাকতে হলে গ্রিসকে সুনির্দিষ্টভাবে কতকগুলো পদক্ষেপ নিতেই হবে।
এরপর প্রায় ১৭ ঘণ্টা আলোচনার পর গ্রিসের বাকোয়াজ প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন শর্তে একেবারে নাকে খত দিয়ে আরও তেতো ওষুধ খেতে বাধ্য হয়েছেন। এ যাত্রা রয়ে গেছেন ইইউতে ও ইউরো জোনে। পেনশন কমবে, বেকারভাতা কমবে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, দুর্নীতিবাজদের তোয়াজ করা বন্ধ করতে হবে, কর আয় বাড়াতে হবে। স্বজনপ্রীতি চলবে না। এসব পাপ এখন গ্রিক সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়ে গেছে। দেখা যাক, সিপ্রাসের পরবর্তী নাটক কী হয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ঈদের তাৎপর্য

ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে ঘরে ফেরা। আনন্দের দাওয়াত নিয়ে প্রতি বছর ফিরে আসে ঈদ। ফিরিয়ে নিতে আসে আমাদের আনন্দের ভেতর দিয়ে এর উৎসের দিকে। মহান স্রষ্টা নিত্য, তিনি পরম; তিনি বিনে আনন্দ নেই। সব প্রশংসা তাঁরই।
আমরা আনন্দ চাই। নির্মল আনন্দের সম্মিলন চাই। এ চাওয়া থেকেই ঈদ। সম্প্রীতি ও আনন্দের উপল ঈদ। দু’টি ঈদ আসে বছরে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। দিনণ তার বাঁধা, পয়লা শাওয়াল ও দশম জিলহজ। আনন্দের জন্য দিন তো বেঁধে দেয়া হলো কিন্তু আনন্দকে বাঁধবে কে? কেউ না। আনন্দ কি রুটিন মানে? না। বিনা কারণে আমরা কেউ আনন্দিত হই না। হই তখন, যখন আনন্দের কিছু সত্যিই ঘটে। পরীায়-খেলায়-নির্বাচনে জিতলে আনন্দিত হই, হঠাৎ পুরস্কার বা তেমন কিছু পেয়ে গেলে আনন্দিত হই, বড় কাজ সুন্দর করে শেষ করতে পারলে আনন্দিত হই। এসব আনন্দের ঘটনা আগে থেকে বাঁধা থাকে না, সময়ও নির্দিষ্ট থাকে না। আনন্দ অনির্দিষ্ট। কিন্তু ঈদের দিন নির্দিষ্ট। তাহলে কিভাবে মিলন ঘটবে এ দুয়ের? কী করে আনন্দময় হবে ঈদ, যদি আনন্দের কিছু না ঘটে? না ঘটলে কি ঘটাতে হবে? কিন্তু আনন্দের সাথে তো জবরদস্তি চলে না। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটে, তাকে ঘটানো যায় না। অনেকে বলেন, যা ঘটানো হয় তা ভোগের, আনন্দের নয়। নতুন জামায় শরীর সাজানো যায়, মন নয়। সুন্দর টুপি পরে মাথার শোভা বাড়ানো যায়, চিন্তার যন্ত্রণা তাড়ানো যায় না। 
আনন্দের কিছু না ঘটলে কী করে আনন্দময় হবে ঈদ? যৌক্তিক প্রশ্ন, কিন্তু অগভীর। প্রশ্নটি মনে যখন সৃষ্টি হয়েছে, তখন ইসলামের জীবনদর্শন মনে ছিল বলে মনে হয় না। আসুন তাহলে, আমরা একটু গভীরে গিয়ে দেখি, আনন্দ কোথায় আছে। মানুষ সাধারণত কিসে আনন্দ পায়, আমরা ওপরে তা বলেছি। আরো কারণ আছে আনন্দের। আমরা এর তালিকা টানব না; সব কারণ বলব সংেেপ, দুই শব্দে : সাফল্য ও প্রাপ্তি। আনন্দের সব কারণই এ দুই শব্দের ভেতরে আছে। এটুকু মনে রেখে এবার সেই জরুরি প্রশ্ন, যার মধ্যে সুপ্ত আছে আমাদের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর। তা হলো, ইসলামি জীবনদর্শনের আলোকে মানবজীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ও প্রাপ্তি কী? এর একমাত্র ও সন্দেহশূন্য উত্তর : সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো পার্থিব জীবনের পরীায় উত্তীর্ণ হওয়া আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি। এর উত্তরণ ও অর্জনের ভিত্তি হিসেবে রয়েছে পাঁচটি মূল ইবাদত ঈমান, সালাত বা নামাজ, জাকাত, রোজা বা সাওম ও হজ। প্রথম তিনটি দীর্ঘব্যাপ্ত, শেষ দু’টি মওসুমি। অর্থাৎ বছরে একবার পালনীয়, নির্দিষ্ট কিছু দিন। ইসলাম আনন্দের দুই ঈদকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এ দুই নির্দিষ্ট সময়ের ইবাদতের সাথে। রোজা শেষে ঈদুল ফিতর, হজের পরে ঈদুল আজহা। রোজা শেখায় নিভৃত আত্মসংযম; হজ দেখায় আল্লাহর পথে ত্যাগ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের নমুনা। রোজায় টানা এক মাস কঠিন আত্মসংযমের পরীা, হজে প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কাবাঘরে গিয়ে ‘হে আল্লাহ, আমি হাজির’ বলে আত্মনিবেদন এবং কোরবানি সম্পাদনের পরীা। দুই ঈদ হলো এ দুই ইবাদতের পরীায় উত্তীর্ণ হওয়ার পবিত্র আনন্দোৎসব। সন্দেহ নেই, যারা বলে ‘নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ, সবই মহাজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই, তাদের কাছে তাদের প্রভুর হুকুম পালনে সফল হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দের ঘটনা আর কিছুই হতে পারে না। তাই বাহ্যিকভাবে সবার জন্য হলেও ঈদের আসল আনন্দ সবাইকে স্পর্শ না-ও করতে পারে। ঈদুল ফিতরের আনন্দ তাদের জন্য, যারা শরীর ও মন দিয়ে রোজা রেখে রোজার পবিত্রতা, ত্যাগ, ধৈর্য ও সংযমের শিায় জীবনযাপনের অঙ্গীকার করেছে। আর ঈদুল আজহার আনন্দ-আয়োজন মূলত আল্লাহর ঘরের মুসাফির এবং আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানিতে অংশগ্রহণকারীদের সম্মানে। রোজাদার ও হজ-কোরবানি পালনকারীদের জন্য আল্লাহ তায়ালা বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, ঈদ হলো সেই পুরস্কার মঞ্জুরির দিন। এ জন্যই ঈদের দিনকে বলা হয়েছে ‘ইয়াওম আল-জায়িজাহ’, পুরস্কার দিবস। পরীায় যারা অংশ নিয়েছে, পুরস্কার তাদের জন্যই। সমর্পণের নিষ্ঠা ও সংযমের কষ্ট যারা স্বীকার করেছে, তাদের জন্যই ঈদের সত্যিকারের আনন্দ।

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ঈদের শাশ্বত বার্তা


ঈদ মোবারক। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সবাইকে জানাই ঈদ-শুভেচ্ছা। ঈদ মুসলিম জীবনে শুধু আনন্দ-বিনোদনের বিষয় নয়, ঈদের সাথে জড়িয়ে আছে পবিত্র চেতনা ও দায়িত্ববোধ। ঈদ তো আসলে তাদের জন্যই, যারা পবিত্র কুরআনের বার্তা উপলব্ধি করে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ মোতাবেক মাহে রমযানে সিয়াম পালনে সফল হয়েছে। সিয়াম শুধু উপবাসের নাম নয়, সিয়ামের লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন। শুধু ‘খোদাভীতি’ শব্দ দিয়ে তাকওয়ার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা যায় না। তাকওয়ার ব্যঞ্জনা আরো গভীর ও ব্যাপক। আমরা বর্তমানে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক পরিম-লে যেসব সমস্যা ও সংকট লক্ষ্য করছি, তার সমাধানও কিন্তু তাকওয়ার মধ্যে নিহিত। কেউ কেউ ভাবতে পারেন হয়তো বেশি বলা হয়ে গেল। কিন্তু মহান স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার চেতনায় যারা ঘর-সংসার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তাদের উজ্জ্বল উদাহরণগুলো পর্যালোচনা করলে হয়তো আমরা বাস্তব এর ভিত্তি খুঁজে পাবো। হযরত ওমর (রা.) কোন চেতনায় বলেছিলেন, ‘আমার বোঝা আমিই বহিব সোজা’। কোন চেতনায় রাষ্ট্রের শাসক হওয়ার পরেও নিজেই খাদ্যশস্যের বোঝা বহন করে নিরন্ন দরিদ্র নাগরিকের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন? সেটা কি তাকওয়ার চেতনা নয়? এই চেতনা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বয়ং আল্লাহ সিয়ামের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- আশা করা যায় এর মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া অর্জনে সক্ষম হবে।
দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর যখন উদার আকাশে শাওয়ালের চাঁদ ওঠে তখন মুসলিম সমাজে আনন্দের ধারা বয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। কিন্তু ঈদের পরে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক পরিম-লে যখন অনাকাক্সিক্ষত এবং অনৈতিক ঘটনা লক্ষ্য করা যায় তখন প্রশ্ন জাগে, আমরা সিয়াম ও ঈদের বার্তা গ্রহণে কতটা সক্ষম হয়েছি? পবিত্র রমযান মাসে আমরা যাকাত ও ফেতরা প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের প্রতি কর্তব্য পালনের যে শিক্ষা পাই, তা সারা বছর অব্যাহত থাকে না কেন? রমযানের রোজা তো আমাদের সংযম, জবাবদিহিতা ও মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটিয়ে দরদী-সমাজ গঠনের চেতনা জাগ্রত করে। সেই চেতনা রমযান ও ঈদের পরে অব্যাহত রাখতে আমরা সমর্থ হচ্ছি না কেন? এমন আত্মসমালোচনা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।
সিয়াম ও কিয়ামের মাস রমযান আমরা অতিক্রম করেছি। সিয়াম ও কিয়াম আমাদের চিন্তা-চেতনা ও জীবন-যাপনে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, তা আজ আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস যাদের কপালে জুটেছে; যারা এ মাসে স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ পালনে সক্ষম হয়েছে, শাওয়ালের ঈদের চাঁদ তো তাদের জন্য আনন্দের বার্তাই বহন করে এনেছে। কিন্তু আনন্দের এই বার্তার মধ্যে উন্নত ও পবিত্র জীবন-যাপনের লক্ষ্যে যে দায়-দায়িত্ব বহনের নির্দেশনা রয়েছে তাও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপলব্ধি, অন্বেষা ও কর্মতৎপরতার ঘাটতি থাকলে আমাদের ঈদ নিছক আনন্দ-উৎসবের স্থূল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হতে পারে। যারা সিয়াম সাধনা করেছেন, রাতের দীর্ঘ কিয়ামে স্রষ্টার বাণীকে স্মরণ করেছেন, সিজদায় অবনত হওয়ার মাধ্যমে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তাদের ঈদ তো শুধু আনন্দ-উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আমরা যদি আসলেই সিয়াম ও ঈদের বার্তাকে ধারণ করার মতো যোগ্যতা অর্জন করে থাকি, তাহলে ঈদ-পরবর্তী জীবনে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও তার ইতিবাচক প্রভাব আশা করতে পারি। মহান আল্লাহর কাছে এটাই আমাদের প্রার্থনা।

বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অনুরাগ-বিরাগের গণতন্ত্র আর নয়


ঘটনার প্রবহমানতা আমাদের তথ্য দেয়, উপলব্ধি দেয়। ঘটনার ব্যাপারে মানুষের কৌতুহল থাকে, থাকে অনুসন্ধানও। ভাল ঘটনা আমাদের সুন্দর উপলব্ধি দেয়। এমন উপলব্ধি আমাদের জীবনে যেন অক্সিজেন জোগায়। আর মন্দ ঘটনা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মত। যা আমাদের জীবনকে দুঃখময় করে। বর্তমান সময়ে অক্সিজেনের বিপরীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রতাপ চলছে। তাই তো কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘কার্বনে ভরে গেছে আমাদের আকাশ’। শুধু কি, আকাশ, আমাদের সমাজেও যেন চলছে কার্বনের দৌরাত্ম্য। খবর কাগজের পাতা উল্টালে, ঘটনা বিশ্লেষণ করলে তেমন চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৩ বছরের শিশু রাজনের কি অপরাধ ছিল? অথচ তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতবাক দেশের মানুষ। এরই মধ্যে নির্যাতনের ভিডিও চিত্রটি সরিয়ে নিয়েছে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ। অনেকেরই অভিযোগ সামিউল আলম রাজন দরিদ্র হওয়ায় পুলিশ ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেয়নি। রাজন হত্যার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম তার ফেসবুক পেজে পোস্টার হাতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পোস্টারে লেখা আছে, ‘শিশু নির্যাতনকে না বলুন’। সামিউলকে মেরে লাশ গুম করার সময় স্থানীয় লোকজন একজনকে ধরে ফেলে। অন্যরা পালিয়ে যায়। প্রধান আসামী কামরুল ইসলাম সৌদি আরবে পালিয়ে গেলেও গত ১৩ জুলাই সোমবার সে জেদ্দায় ধরা পড়েছে। লাশের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে সামিউলের শরীরে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। টানা নির্যাতনের ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, শিশু সামিউলকে চোর অপবাদ দিয়ে ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে একটি খুঁটিতে বেঁধে ৫-৬ জন ব্যক্তি নির্যাতন চালায়। বাঁচার জন্য তার কোনো আকুতিই তাদের মন গলাতে পারেনি। এক পর্যায়ে সামিউল তাদের কাছে একটু পানি খেতে চাইলে তারা পানি না দিয়ে শরীরের ঘাম খেতে বলে। মিডিয়া মর্মান্তিক এ ঘটনায় সরব ভূমিকা পালন করায় আসামীরা গ্রেফতার হচ্ছে। হয়তো বিচারও হবে। কিন্তু সামিউলকে কি আর ফিরে পাওয়া যাবে?
আমাদের সমাজে কেন এমন নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে? সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের বিশ্লেষনে বলছেন, সামাজিক আচার-আচরণের বিরূপ পরিবর্তন, প্রথা নষ্ট হওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরার কারণে এ ধরনের বিবেকবর্জিত নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে। অনেকে বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসন না থাকায় মানুষ বর্বর হয়ে উঠছে। ঘটনা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এক ধরনের অরাজকতা চলছে, পারিবারিক শিক্ষা, প্রথাগুলো সেভাবে মানা হচ্ছে না। রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছে। মানুষের মধ্যে বিবেকহীনতা কাজ করছে। এ থেকে বের হয়ে আসা খুব একটা সহজ নয়। তবে সবক্ষেত্রে সুষ্ঠু চর্চা করা গেলে পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, এ ঘটনাকে কোনোভাবেই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা যাবে না।
দুঃখজনক কোনো ঘটনা ঘটে গেলে তখন আমরা বলি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনের শাসন না থাকার কারণেই এইসব হচ্ছে। প্রসঙ্গত তখন সুশাসনের গুরুত্ব সম্পর্কেও বক্তব্য রাখা হয়। এইসব বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যথেষ্ট ধারণা আছে বলেই আমরা মনে করি। কিন্তু বাস্তবে কাক্সিক্ষত প্রতিফলন ঘটে না কেন? রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং প্রশাসনিক তৎপরতায় তো নির্দিষ্ট বিধি বিধান ও নৈতিক মানদ- সমুন্নত রাখতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এমন উদাহরণ কমই লক্ষ্য করা যায়। বরং অনুরাগ ও বিরাগের সংস্কৃতিই যেন আমাদের রাষ্ট্রে এবং সমাজে প্রবল হয়ে উঠেছে। ফলে আইন-কানুন, নীতিনৈতিকতা, ন্যায় ও মানবিকতার বদলে এখন দলবাজি, স্বজনপ্রীতি, পদপদবী ও ক্ষমতালিপ্সাই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার অভিপ্রায়ই যেন এখন গণতন্ত্রের মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের অপচর্চার কারণে এখন ভোটের রাজনীতিই যেন গণতন্ত্রের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে এখন অনেকেই বলছেন, গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। বর্তমানে দেশে সরকার ও বিরোধী দলের যে অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা গণতন্ত্র কিংবা জনগণের জন্য মোটেও সুখকর বিষয় নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলেও জনগণের ওপর তেমন নির্ভরশীল নয়। সরকার যেন সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পুলিশ র‌্যাবের উপর নির্ভরশীল হয়ে দেশ শাসন করতে চাইছে। সরকারের জুলুম-নিপীড়ন এখন এতটাই প্রচন্ড হয়ে উঠেছে যে, বিরোধী দল তাদের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক তৎপরতাও চালাতে পারছে না। এমন অবস্থায় বিরোধী দলকে কখনও কখনও ভুল তৎপরতা চালাতেও দেখা যাচ্ছে। ফলে জনগণ এক দমবন্ধ অবস্থায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। কাক্সিক্ষত অক্সিজেনের অভাবে আমাদের পরিবেশ, রাজনীতি সবই মানবস্বাস্থ্য ও মানবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক হয়ে উঠছে। এমন অবস্থার পরিবর্তন জনগণের কাম্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই পরিবর্তন কীভাবে আসবে, কারা আনবে?
সরকারের অনেক তৎপরতাই এখন জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। ফৌজদারি অপরাধ করলেও সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করা যাবে না। তবে মামলা ও তদন্ত হতে পারে। এমন বিধান রেখে গত ১৩ জুলাই সোমবার সরকারি কর্মচারী-আইন ২০১৫-এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এখন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়ার পর এটি জাতীয় সংসদে উঠবে। এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে সরকারি কর্মচারীরা বিশেষ সুরক্ষা পাবেন। এছাড়া আইনের চোখে সবাই সমান, এই ধারণাও ব্যত্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। আবার কারো কারো মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতাও বাড়তে পারে। ৩ বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনা-সমালোচনা ও পর্যালোচনার পর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করেই আইনের খসড়াটি অনুমোদন করা হলো। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, কাউকে গ্রেফতার করা হবে কি হবে না, তা অপরাধের ওপর নির্ভর করবে। এটি যদি ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে তাহলে তাকে মধ্যযুগীয় বা সামন্তবাদী আইন বলতে হবে। তিনি আরো বলেন, আগে রাজা-বাদশাহরা অপরাধ করলে এর জবাবদিহিতা ছিল না। এর বিপরীতে আসে গণতন্ত্র, যার মূল কথা আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু যে আইন হচ্ছে, তা সবার থেকে আলাদা, যারা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। শাহদীন মালিকের বক্তব্যে ভেবে দেখার মত বিষয় রয়েছে। আমাদের সরকারি ঘরানা ও বিরোধী ঘরানা নির্বিশেষে সবাই তো বলে থাকেন দেশের মালিক
জনগণ। কিন্তু বর্তমানে দেশে যে শাসন-প্রশাসন চলছে, তাতে কি একথা মনে করার অবকাশ আছে যে, দেশের মালিক জনগণ? জনগণ প্রতিদিনই অপমানিত হচ্ছে, ক্ষুদ্র হচ্ছে। যে আইন করা হচ্ছে তাতেও জনগণ নিজেদের হেয় মনে করছে। এভাবে দেশে ঐক্য-সংহতি ও শান্তি-শৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে না। দেশের কাক্সিক্ষত অগ্রগতির জন্য এখন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক চেতনায় প্রকৃত সুশাসন। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে অনুরাগ-বিরাগের চেতনা পরিহার করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে সরকারকে। এর কোনো বিকল্প আছে কী?

মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

‘সাত খুন মাফ’


গত সোমবার অনির্বাচিত সরকার বাহাদুর তার মন্ত্রিসভায় এক আজব আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। আমরা সাধারণত লক্ষ্য করে আসছি যে, প্রধানমন্ত্রীর সভানেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে যা অনুমোদিত হয়, তা জাতীয় সংসদে একেবারে রা রা করে অনুমোদন হয়ে যায়। এই অনির্বাচিত সংসদের দু’ একজন স্বতন্ত্র সদস্য রয়েছেন, যারা কিছু বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় যে, সরকার দলের সদস্যদের টেবিল চাপড়ানো আর ফাইলের বাড়িতে সে কণ্ঠস্বর দ্রুতই হারিয়ে যায়। তারপর হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়। ফলে ধারণা করা যায়, খুব দ্রুত সংসদে ওঠানো মাত্রই এ খসড়া আইনে পরিণত হয়ে যাবে।
এই আইনের নাম ‘সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৫’। এই আইন পাস হলে দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক সমানাধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হবে। নাগরিক হিসেবে সরকারি কর্মচারীরা যেসব সুবিধা পাবেন, যে দায়মুক্তি পাবেন, সাধারণ নাগরিকরা তার ছিটেফোঁটাও পাবেন না। প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি মামলার অভিযোগপত্র আদালতের অনুমোদনের পূর্বে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিতে হবে।’ এই সুবিধার আইন অন্য কোনো পেশার লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এমনকি মন্ত্রী-এমপিদেরকেও কোনো ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করতে হলে কারও অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সে অনুমোদন লাগবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত এই আইনকে সংবিধানের ৭, ২৬ ও ২৭ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, আইনটি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে মনে হতে পারে, ‘আইন সকলের জন্য সমান নয়।’ আইন সরকারি কর্মচারীদের জন্য এক রকম আর রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের জন্য অন্য রকম কাম্য হতে পারে না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনটি রাষ্ট্র বনাম এইচআরপিবি (হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ) মামলার রায়ের চেতনারও পরিপন্থী। ইতঃপূর্বে এ ধরনের একটি বিশেষ সুবিধা আইন হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছিলেন।
প্রস্তাবিত আইনটি সংবিধানের সমতার নীতির লঙ্ঘন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রসঙ্গত সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।’ কিন্তু এই আইন সাংবিধানিক বৈষম্য তৈরি করবে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ফৌজদারি মামলায় সংসদ সদস্যদের গ্রেফতারে আইনী কোনো বাধা নেই। সংসদ সদস্যদের গ্রেফতারের পর স্পিকারকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত জাতীয় কার্যপ্রণালী বিধির ১৭২ বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোনো সদস্য ফৌজদারি অভিযোগে বা অপরাধে গ্রেফতার হইলে কিংবা কোনো আদালত কর্তৃক কারাদ-ে দ-িত হইলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হইলে ক্ষেত্রমত গ্রেফতারি বা দ-দানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ  বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় তফসিলে প্রদত্ত যথাযথ ফরমে অনুরূপ দ-াজ্ঞা বা আটকের কারণ বর্ণনাপূর্বক অবিলম্বে অনুরূপ ঘটনা স্পিকারকে জানাইবেন।’ তবে সংসদ সদস্যদের সংসদের সীমানার ভেতরে গ্রেফতার  করতে হলে স্পিকারের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমন কি অতিমানব হলেন যে, কিংবা তাদের এমন অতিমানব হিসেবে তৈরি করার কেন প্রয়োজন হয়ে পড়লো যে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া তাদের কোনো অপরাধে গ্রেফতারই করা যাবে না। সম্ভবত খুন করলেও না।
সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী লঙ্ঘন করে রাষ্ট্র কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না।’ ২৬/২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
এর আগে ২০১৩ সালে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দিতে আর একটি আইন সংসদে পাস হয়েছিল। দুর্নীতি দমন কমিশনের সংশোধনী আইনের ৩২(ক) ধারা অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়, ‘জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে।’ ঐ ধারায় বলা হয়েছে, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না। কোন্ আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে। এর ফলে কমিশন সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আমলে নিতে পারছিল না।
সংসদে পাস করা এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রীট আবেদন দায়ের করা হয়েছিল। রাষ্ট্র বনাম এইচআরপিবি মামলার রায়ে হাইকোর্ট ঐ আইনকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছিলেন। ঐ রায়ে বলা হয়, দেখা গেল, কোনো একটি দুর্নীতির ঘটনায় সরকার প্রধান বা মন্ত্রীদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারী জড়িত। ঐ অবস্থায় সরকার প্রধান কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। কিন্তু সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে অনুমতি লাগবে। এই পরিস্থিতির সমন্বয় কীভাবে করা হবে, তার কোনো দিক নির্দেশনা সংশোধিত দুদক আইনে নেই। ফলে আইনে এই  পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অযৌক্তিক। রায়ে বলা হয়, কার্যত এটা কোনো আইনই নয়। সংশোধিত এ আইন দেশের সাধারণ মানুষ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচ হবে, যা অসাংবিধানিক। এমন আইন দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক ছাড়া আর কিছুই নয়। রায়ে বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী একটি বিশেষ শ্রেণীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। রায়ে সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়, সংশোধিত দুদক আইনের ৩২(ক) অবৈধ ও বাতিলযোগ্য।
মন্ত্রিসভায় সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৫-এর অনুমোদনে খানিকটা চমকেই উঠেছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণেরর অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ তাছাড়া সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংশোধিত দুদক আইন অবৈধ ও বাতিলযোগ্য। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অযৌক্তিক আইন প্রকৃতপক্ষে কোনো আইন হতে পারে না। কারণ আইনের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান অধিকার পাবে। অথচ সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেয়া সমতার নীতির লঙ্ঘন। তাদের মতে মন্ত্রিসভায় সোমবার পাসকৃত আইনটি হাইকোর্টের উক্ত রায়ের চেতনার পরিপন্থী।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসনের মূল কথাই হলো, আইনের চোখে সবাই সমান। সামন্ত শাসনামলে একসময় দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ছিল এক আইন, আর রাজা-বাদশাহর পরিবারের জন্য ছিল আর এক আইন। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে ফৌজদারি অপরাধে আইনের চোখে যাতে সকলে সমান হয়, সেজন্যই ফৌজদারি কার্যবিধি করা হয়েছে। কাউকে আটক করা যাবে, আর কাউকে আটক করা যাবে না, এটা আইনের মূলনীতির পরিপন্থী।
এর আগে পুলিশসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ সুবিধা দেয়ায় এখন সে বাহিনী নানা অসামাজিক অনৈতিক অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার জনগণ নয়, পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনকে সমান্তরাল বিচারিক ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য। তাদের জন্য পে- স্কেল ঘোষণাও এই অভিপ্রায়েরই অংশ। তার ফলে পুলিশ ও র‌্যাব, পুলিশ ও প্রশাসন নানা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে না। জনগণের সন্তুষ্টি বা জনকল্যাণ আর সরকারের লক্ষ্য নেই। এই আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো, সরকার পুলিশ ও প্রশাসনকে তুষ্ট করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাইছে। জনগণ তফাৎ যাও। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এপথে শাসন ক্ষমতা খুব একটা দীর্ঘায়িত করা যায় না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পুলিশের এমন কাণ্ড বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়


‘রক্ষকই ভক্ষক’ প্রবাদের সাথে আমরা পরিচিত। তাই বলে পুলিশ ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে- এমন চিত্র দেশের জনগণ দেখতে চায় না। কারণ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনই তো পুলিশের কর্তব্য। তবে দুঃখের বিষয় হলো, দেশের মানুষ না চাইলেও ভক্ষকের ভূমিকায় পুলিশের তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৩ জুলাই তারিখে আমাদের সময় পত্রিকার একটি শিরোনাম ‘বাস থামিয়ে ১৯ লাখ টাকা ডাকাতি করলো পুলিশ।’ খবরটিতে বলা হয়: রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিআরটিসির বাস থামিয়ে পুলিশের এক এসআইয়ের নেতৃত্বে এক ব্যবসায়ীর ১৯ লাখ টাকা লুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ওই এসআইয়ের নাম রফিকুল ইসলাম। তিনি মিরপুরের কাফরুল থানায় কর্তব্যরত ছিলেন। অন্য এলাকায় গিয়ে টাকা লুটের ঘটনায় শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (পূর্ব) একটি দল এসআই রফিকুল ইসলাম ও লুটে সহায়তাকারী মাইক্রোবাস চালক লুৎফরকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারায়ণগঞ্জের ঝুট ব্যবসায়ী মোঃ নাজমুল যাত্রাবাড়ী থানায় ডাকাতির মামলা করেছেন। গত রোববার গ্রেফতারকৃত এসআই রফিকুল ও মাইক্রোবাস চালককে আদালত হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে আনা হয়।
উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে অপহরণ, লুট, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অপরাধের ঘটনা পুলিশ বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে। কিছু অভিযানে পুলিশ পরিচয়ে অপরাধচক্র ধরা পড়লেও তারা ভুয়া পুলিশ সদস্য বলে সনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এবার আসল পুলিশ ধরা পড়েছে। এতে পুলিশ বিভাগের ভাবমর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এসআই রফিকের এই অপকর্মের ফলে ভুয়া পুলিশ পরিচয়ে অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করা অপরাধী চক্রের জন্য সহজ হয়ে উঠবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
বাস ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে একশ্রেণীর পুলিশ। আশঙ্কার বিষয় হলো, অপরাধের সাথে পুলিশের যুক্ত হওয়ার মাত্রা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জ জেলার ২২ জন পুলিশ ও তাদের ৮ জন সোর্স মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। এরাসহ ২১ জন মাদক ব্যবসায়ীর একটি সিন্ডিকেট মিলেমিশে মাদকের ব্যবসা করছে।  আর ২১ মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে সরকারি দলের লোকজন থাকায় মাদক ব্যবসা রোধ করা যাচ্ছে না। মাদক ব্যবসায় পুলিশ জড়িত হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে অপরাধীদের দমন করবে কে? আমরা জানি, পুলিশ বিভাগে কর্মকা- পরিচালনার জন্য আইন-কানুন ও বিধি বিধান রয়েছে। পুলিশ সদস্যদের বিধি বিধান মেনেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোনটা করণীয়, কোনটা বর্জনীয় সেই ধারণাও পুলিশকে দেয়া হয়। আর পুলিশ সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণ একাডেমিও রয়েছে। এত কিছুর পরও পুলিশ সদস্যরা কেন অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে? পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন : পুলিশের রিক্রুটমেন্টে কি ত্রুটি আছে, প্রশিক্ষণে কি ত্রুটি আছে, পুলিশ প্রশাসন কি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে? আর অনেকেই তো বলছেন, দলীয়করণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। বিষয়গুলো সরকারের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নইলে দেশের ও জনগণের ক্ষতির মত্রা আরও বেড়ে যাবে।

রবিবার, ১২ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোর সম্ভাব্য কার্যকারণ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

এক তরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের অন্যতম মন্ত্রী ও শাসক আওয়ামী লীগ দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে আকস্মিকভাবে সরিয়ে দেয়ার ঘটনায় মিডিয়া এবং রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন হয়েছে। তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হলো এমনই এক সময়, যখন তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ সফরে ছিলেন। এমনিতেই তিনি এলাকায় খুব একটা যাওয়া-আসা করেন না। আর অবশেষে যেদিন এলেন, সেদিনই মন্ত্রণালয় হারালেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এটা অজানা থাকার কথা নয় যে, তিনি এলাকায় আছেন। এমন অবস্থায় তাঁকে মন্ত্রণালয়হীন করে নির্বাচনী এলাকার জনগণকে কি বার্তা দেয়া হয়েছে? সেটাও দলের উচ্চ মহলের অজানা থাকার কথা নয়; বরং ঘটনাটি সব কিছু জেনে-শুনেই করা হয়েছে। এলাকা ও মন্ত্রণালয়ে অতি অল্প সময় ব্যয় করার ব্যাপারেও দলের অনেকে নানা কথা বলেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সভায়ও তাঁর অনুপস্থিতি থাকার কথা নানা মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে। যুগান্তর পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে, ‘সব অপকর্মের হোতা এপিএস সেলিম খান’। অনেকে আবার সোহেল তাজের প্রসঙ্গ টেনে মুজিব-তাজউদ্দিন দ্বন্দ্বের নিরিখে সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোর বিষয় নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। মন্ত্রণালয় হারানোর বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হাজির করেছেন কেউ কেউ। মিডিয়ায় অনেকে এমনও বলেছেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস না করায় তাঁকে পদ হারাতে হয়েছে।’ সৈয়দ আশরাফ নিজে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলে বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ২৪-এ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমার রক্ত বেঈমানী করে না।’ তবে তাঁর এই বক্তব্যেই প্রসঙ্গের শেষ হয়নি; তাঁর মন্ত্রণালয় হারানোর নেপথ্যে কার্যকর সকল কথা ও কারণ জনগণ পুরোপুরি জানতে পারে নি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এমন একটি রাজনৈতিক ঘটনার পরম্পরায় বরং ‘অপকর্ম’, ‘দুর্নীতি’ ও ‘বেঈমানী’ শব্দ তিনটি ঘটনার প্রসঙ্গে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার ও প্রাধান্য পেয়েছে। উল্লেখ্য, সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বর্তেছে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের উপর। তিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও সামলাবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় এবং ফরিদপুরের লোক। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্র বৃহত্তর ফরিদপুর/গোপালগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ/কিশোরগঞ্জের মধ্যে আবর্তিত রয়েছে। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোজনিত ক্ষমতার রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির মেরুকরণেও নানামুখী প্রভাব পড়বে।
ঘটনার অন্য আরেকটি মাত্রাও বিবেচনা যোগ্য। যেমন, সাধারণত কোনো এলাকায় কোনো নেতা মন্ত্রীত্ব পেলে বা হারালে এলাকার জনগণ উল্লাস বা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আনন্দ মিছিল বা প্রতিবাদ মিছিল হয়। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোয় দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য কোনো ক্ষোভ বা প্রতিবাদের খবর প্রকাশিত হয় নি, যদিও তিনি নিজে সে সময় এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘গুজবে কান না দেওয়াই ভাল।’ কিন্তু পরে যখন গুজব সত্যে পরিণত হলো, তখনো স্থানীয় পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয় নি। ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় পর্যায়ের নানা নেতা ও কর্মী নিজস্ব মত দিয়েছেন। চাপা গুঞ্জন করেছেন। তবে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি বক্তব্য আমাদের নজরে এসেছে। সৈয়দ আশরাফের মন্ত্রণালয় হারানোর দিনই করিমগঞ্জে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু পরিষদের এক অনুষ্ঠানে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট শাহ আজিজুল হক প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘যে কোন পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর আস্থা রাখার ও তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার’ আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, ‘দলকে শক্তিশালী করুন, সম্মেলন করে কাউন্সিলরগণের মতামতের ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও যুগের উপযোগী নেতৃত্ব নির্বাচিত করুন। জনগণ যাকে চায়, তাদেরকে আওয়ামী রাজনীতিতে এগিয়ে আনুন।’ উল্লেখ্য, দলের সাধারণ সম্পাদকের নিজের জেলায় বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় নি। হাল নাগাদ কমিটিও করা সম্ভব হয় নি। অনেক ভারপ্রাপ্ত দিয়ে দলের কাজ চালানো হচ্ছে। এবং দলে সর্বজনগ্রাহ্য, নতুন, তরুণ, উদীয়মান, বিজ্ঞানমনস্ক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো যায় নি। 
সরকার বা প্রশাসনে মন্ত্রী বা আমলার পদ বদল, হারানো বা প্রাপ্তি অতি সাধারণ ঘটনা। কেবিনেট সিস্টেমের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় কেউ মন্ত্রী থাকেন বা বিদায় নেন। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সরকারের প্রধান যাকে দিয়ে কাজ হবে মনে করবেন, তাকেই রাখতে পারেন। যাকে দিয়ে কাজ হবে না মনে করেন, তাকে সরাতে পারেন। কারণ চূড়ান্তভাবে সফলতা বা ব্যর্থতার দায়-ভার বহন করতে হয় সরকারের প্রধান ব্যক্তি তথা প্রধানমন্ত্রীকে। অতএব, সৈয়দ আশরাফকে রাখা না রাখা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অতীতেও মন্ত্রীত্ব পাওয়া বা হারানো বহু ঘটনা হয়েছে। কিন্তু সেসব নিয়ে এতো নাটকীয়তা, ফিসফিসানি, রহস্যময়তা বা পানি ঘোলা হয় নি, যতটা হয়েছে বা হচ্ছে সৈয়দ আশরাফের ক্ষেত্রে। মনে হচ্ছে, দলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর পক্ষ ও বিপক্ষে দুটি ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো একত্রে করা হলে, সাধারণ পাঠকের পক্ষে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, ঘটনার পেছনে অনেক অব্যক্ত কথা আছে। মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ে যে কোনো পাঠকের মনে হতেই পারে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’
বস্তুত সৈয়দ আশরাফ এমনই এক সময় মন্ত্রণালয় হারালেন যখন দৃশ্যত দেশে বিরোধী দলীয় কোনো আন্দোলন বা চাপই নেই। সরকার একদলীয়ভাবে বিনা প্রতিবাদ ও বাধায় সব কিছু করতে পারছে। ফলে সৈয়দ আশরাফ সংক্রান্ত বিষয়াবলি যে বাইরের নয়, দলের ভেতরের নিজস্ব সঙ্কট, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, সরকার যতই বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণ করুক বা প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা রাখুক, নিজের ভেতরের সঙ্কট দূর করতে পারে নি। আর আওয়ামী লীগের মতো বড় ও শক্তিশালী দলের জন্য বাইরের সঙ্কটের চেয়ে ভেতরের সঙ্কট অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ভয়াবহ বলে ইতিহাস জানাচ্ছে। (এ প্রসঙ্গে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ শীর্ষক প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি স্মর্তব্য।) কেননা, যতবারই আওয়ামী লীগের পতন বা বিপর্যয় হয়েছে, ততবারই সেটা হয়েছে ভেতরের সঙ্কট, ষড়যন্ত্র ও সমস্যার কারণে। অতএব এসব সঙ্কট আওয়ামী লীগেরই বিপদ ডেকে আনবে ভেতর থেকে। আর আওয়ামী লীগকেই সে সবের সমাধান বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা যেভাবে অবাধে বিরোধী দল, বিএনপি, জামায়াতকে নসিয়ত করেন, সেটা মনে হয় এখন বন্ধ হবে। অপরের সঙ্কট মোচনে উমেদারী না করে এখন তাদেরকে নিজস্ব সঙ্কট-সমস্যার তালাশ করতে হবে এবং সেটা সমাধানের পথ বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভবত ‘নিজের চরকায় তেল’ দেয়ার সময় এসেছে। 
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, বর্তমান আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আছে একটি অতি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন নামের প্রহসনের মাধ্যমে। দেশে-বিদেশে এখনো এ ব্যাপারে কথা আছে; আপত্তি আছে। দেশে ও বিদেশে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য আওয়ামী লীগের সামনে আগে বা পরে একটি অবাধ নির্বাচনের বিকল্প নেই। সেটা করতে হলে দলকে ভেতর ও বাইরে থেকে সঙ্কট মুক্ত করতে হবে। যোগ্য নেতাদের সামনে আনতে হবে। কাউন্সিল করতে হবে। গণতান্ত্রিক গতিশীলতা বাড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, ক্ষমতায় বসে দলের এসব কাজ সম্পন্ন করা হয় নি। খোদ সাধারণ সম্পাদকের জেলাতেই কাউন্সিল হতে পারে নি বছরের পর বছর। এর ফলে মাঠে-ময়দানে তৎপর নতুন, উদীয়মান নেতারা কোনো জায়গা পাচ্ছেন না। এতে সাংগঠনিক গতিশীলতার বদলে এসেছে হতাশা ও কোন্দল। এসব বিষয়ে ভালো-মন্দের কিছু দায়-দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের উপরও বর্তায়। এখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না থাকায় তাঁকে হয়ত পূর্ণরূপে সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হবে। তাহলে বুঝতে হবে, দলের সাংগঠনিক দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনেই তাঁকে মন্ত্রণালয় থেকে সরানো হয়েছে। কিন্তু যদি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা পূর্বের মতোই স্থবির থাকে, তাহলে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ঘটবে। বুঝতে হবে বিষয়টির শিকড় অনেক গভীরে। হয়ত সেটা বিস্তারিতভাবে জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করারও দরকার হবে। তবে সামগ্রিক বিশ্লেষণে সৈয়দ আশরাফকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরের একটি সুপ্ত সঙ্কট প্রকাশ্যে এসেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর বহুমাত্রিক প্রভাব দলের ভেতরে ও বাইরে যেমন পড়বে, তেমনি জাতীয় ও স্থানীয় স্তরের রাজনীতিতেও পড়বে। আওয়ামী লীগ এখন এই বিষয়টিকে ঘরে-বাইরে কিভাবে সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।
মিয়া লুৎফে আলি মহব্বত

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নাস্তিক ও মুরতাদদের প্রতি অব্যাহত প্রশ্রয় সর্বশেষ নজির গাফ্ফার চৌধুরী


এই তো ক’দিন আগেও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে কটাক্ষ করায় এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে এখন জেলের ঘানি টানছে। এরও আগে শেখ মুজিব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করায় একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারাও জেলের ঘানি টানছে। শেখ হাসিনা এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে বিরূপ মন্তব্য করা আইনের চোখে কতখানি অপরাধ সেটি আইন বেত্তা এবং বিচারকরা মন্তব্য করবেন। এ ব্যাপারে আমরা কোনো মন্তব্য করছি না। আইন মোতাবেক যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বলার কিছু নাই। কিন্তু যদি তাদের গ্রেফতার এবং শাস্তি আইন মোতাবেক না হয়ে থাকে তাহলে আইনে যা আছে তাই করা হোক।
কিন্তু আমাদের কথা অন্যত্র। আমাদের কথা হলো, যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলা অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে রাসূল (সা) এর বিরুদ্ধে কথা বলা, তাকে অসম্মান এবং অপমান করা কি অপরাধ নয়? যদি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কথা বলা অপরাধ হয় তাহলে স্বয়ং রাব্বুল আল আমিন মহান আল্লাহ্ সুবহানা তা’য়ালার বিরুদ্ধে কথা বলা কি চরম ধৃষ্টতা এবং বেয়াদবি নয়? যদি শেখ হাসিনা এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কথা বলা অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে পবিত্র কোরআনের আয়াতকে অস্বীকার করা কি সর্বোচ্চ অপরাধ নয়? শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বললে যদি দণ্ড হয় তাহলে রাসূল (সা) এবং আমাদের প্রতিপালক রবের বিরুদ্ধে কথা বললে কি সর্বোচ্চ দণ্ড হওয়া উচিত নয়?
দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে আজ এমন এক সময় চলছে যখন আল্লাহ্ এবং রাসূল (সা)কে অসম্মান করলে পার পাওয়া যায়। কিন্তু হাসিনা এবং মুজিবরে বিরুদ্ধে কথা বললে পার পাওয়া যায় না।
আমরা আন্দাজে এসব কথা বলছি না। লতিফ সিদ্দিকী এবং গাফ্ফার চৌধুরী সম্পর্কে সরকারের অপত্য স্নেহ দেখে এসব কথা বলতেই হচ্ছে। আজ ৯ দিন হয়ে গেল, গাফ্ফার চৌধুরীকে তার খোদাদ্রোহী বক্তব্যের জন্য গ্রেফতার তো দূরের কথা, তাকে জামাই আদরে নিউ ইয়র্ক সরকারি মেহমানদারিতে রাখা হয়েছে। আজ থেকে ৮ মাস আগে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ খারিজ হওয়ার কথা। কিন্তু সরকার সেটি ৮ মাস ধরে ঝুলিয়ে রাখল। ৮ মাস পরে যদিও বা তাকে বহিষ্কার করার কাগজ জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এখনও সে কাগজের ওপর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। স্পীকার সম্ভবত সেই প্রস্তাবটি নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। নির্বাচন কমিশন অতঃপর এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। নির্বাচন কমিশন যদি আরও ২ মাস সময় লাগায় তাহলে সব কিছু মিলিয়ে প্রায় ১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবে। দু’জন লোক কোনরূপ রাখঢাক না করে আল্লাহ্ ও রাসূল (সা) এর বিরুদ্ধে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করল, তারপরেও যদি তাদের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস ব্যবস্থা নিতে সরকার এত গড়িমসি করে তাহলে সেই সরকারকে নাস্তিক ও মুরতাদদের সহযোগী বলাটা কি অন্যায় হবে?
॥দুই॥
গাফ্ফার বলেছে যে, আল্লাহর যে ৯৯টি নাম রয়েছে সেগুলো নাকি কাফেরদের দেব-দেবীদের নাম। কিন্তু আল্লাহর গুণবাচক কোনো নামে দেবতাদের নাম ছিল না বলে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় ফতোয়া বোর্ড। গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের মুফতিগণ বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কোন গুণবাচক নাম তৎকালীন সমাজে দেবতাদের নামে আদৌ ছিল না।’ ইহা মূলত মুরতাদ গাফফার চৌধুরী গংদের উদ্ভট বিকৃত মস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এ সমস্ত মুরতাদদের দৌরাত্ম্য থামাতে আমরা সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
তারা বলেন, বিতর্কিত লেখক কুলাঙ্গার আঃ গফফার চৌধুরী আল্লাহর গুণবাচক নাম নিয়ে কা-জ্ঞানহীন মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কলিজায় আগুন ধরিয়েছে। সরকার যদি এখনই উক্ত মুরতাদ গংদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তাদেরকে ইসলামবিরোধী কর্মকা- থেকে থামিয়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে ইসলামবিরোধীদের দোসর হিসেবে সরকারকে চরম মূল্য দিতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- ফতোয়া বোর্ডের উপদেষ্টা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, ফতোয়া বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর ড. মুফতি ইয়াহইয়ার রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মুফতি ড. খলিলুর রহমান মাদানীসহ ৬৪ জন মুফতি এবং আলেমে দ্বীন।
গাফ্ফার জানে না যে, আল্লাহ্্ জাল্লাহ শানুহুর ৯৯ নামের কিছু নাম এসেছে আল্লাহ্্র নিজের পছন্দে যা কোরআনুল করিমে আল্লাহ্্ নিজেকে নিজে অভিহিত করেছেন, কিছু এসেছে জিব্রাইল ফেরেশতার পরমর্শে। ৯৯ নামের হাদিসটি আবু হোরায়রা (রা) বর্ণিত, এর সনদ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কাবা শরীফে ৩০০ এর ওপরে যে মূর্তিগুলো ছিলো তাদের নামের সাথে আল্লাহর ৯৯ নামের কোনো মিল নেই। এ সব মূর্তির নাম হলো, লাত, উজ্জা, মানাত, অবগাল, দুল খালসা, হুবাল, মালাকবেল, নেব, নের্গাল, সিন সুয়া, নুহা, সুয়া, রুভা ইত্যাদি। এখানে ৯৯টি পবিত্র নামের কোনো সম্পর্ক নাই।
গাফ্ফার চৌধুরী বলে, ‘রসূল মানে দূত, অ্যাম্বাসেডর। গাফ্ফার কি জানে যে, রাসূল সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যার ওপরে জিব্রাইলের মাধ্যমে রেসালত বা আসমানী গ্রন্থ নাজেল হয়। রাসূল মাত্র চারজন, দাউদ, মুসা, ইসা (আ) এবং মুহাম্মদ (সা)। আর যারা শুধু আল্লাহর তরফ থেকে মানুষকে তার প্রতি আহ্বান জানান তারা হলেন নবী। তাদের ওপর কোনো আসমানী কিতাব নাজিল হয়নি। যেমন নূহ নবী, সালেহ নবী। তাই সব রাসূলই নবী, কিন্তু সব নবী রাসূল নন। গাফ্ফারের মাথায় এটি ঢুকেছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের ঐ সেকুলার এবং বাম গোষ্ঠী গাফ্ফারকে সব সময় মহাপন্ডিত হিসেবে হাইলাইট করেছে। যদি সে পন্ডিত হয়ে থাকে তাহলে নিউ ইয়র্ক সেদিন তার ধর্মদ্রোহী ও খোদাদ্রোহী বক্তব্য শুনে বলতেই হয় যে, সে জ্ঞান পাপী। ঠান্ডা মাথায় জেনে বুঝে যে কোরআনের আয়াতকে অস্বীকার করে সে আর মুসলমান থাকতে পারে না। গাফ্ফার ইসলাম এবং মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে গেছে।
গত ৭ জুলাই মঙ্গলবার নিউ ইয়র্ক অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেখানকার ইমাম, আলেম ও ওলামারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, গাফ্ফার চৌধুরী পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে। আল্লাহ্ ও রাসূলকে নিয়ে কটূক্তির পর সে আর ইসলামে থাকতে পারে না। ইতোমধ্যেই সে মুরতাদ এবং খারেজী হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে তাকে তওবা করতে হবে। একমাত্র তখনই সে ইসলামে ফিরে আসতে পারবে। নিউ ইয়র্কের কুইনসের বৃহৎ মসজিদ জ্যামেইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম মাওলানা আবু জাফর বেগ বলেন, “জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন কোনো দল বা মতের নয়, এটা বাংলাদেশের। স্থায়ী মিশনের রাষ্ট্রদূত কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে ডেকে এনে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারেন না। তাকেও গাফ্ফার চৌধুরীর ইসলাম অবমাননার দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য স্থায়ী মিশন থেকে তাকে অপসারণ করতে হবে।” জ্যামেইকা মসজিদের মাওলানা ফায়েক উদ্দিন বলেন, “অ্যাম্ব্যাসেডর শব্দের আরবী অর্থ হচ্ছে ‘সাফিউন’। অ্যাম্ব্যাসেডর শব্দের আরবী কখনো রাসূল হিসেবে ব্যবহার হয় না। মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে মোহাম্মদ (সা)কে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার পর রাসূল শব্দের শাব্দিক অর্থ থাকে না।
এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা ফায়েক উদ্দিন বলেন, গাফ্ফারের পুরো বক্তব্য কয়েকবার শুনেছি। তার কথা শুনে মনে হয়েছে আরবীতে তার ন্যূনতম জ্ঞান নেই। তিনি ‘আবু বকর’ নামের অর্থ বলেছেন ‘বকরির বাবা’। মূলত আবু বকর নামের অর্থ হচ্ছে ইসলামের প্রথম ‘সুশোভিত ফুল’।
আস্সাফা মসজিদের ইমাম মাওলানা রফিক উদ্দিন রেফায়ী বলেন, গাফ্ফারের কথায় মনে হয় আল্লাহর আগে দেবদেবী ছিলেন, তারপর আল্লাহ্ এসেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নামের মধ্যে কোনো দেবদেবীর নাম দেখাতে পারবেন না। আল্লাহর গুণবাচক নাম কোথাও থেকে ধার করার প্রয়োজন নাই। মহান আল্লাহ্ তায়াল সব বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জ্যামাইকা মসজিদের সভাপতি ড. ওয়াহিদুর রহমান বলেন, এখানে আলোচনা সভার নামে বিতর্কিত নাস্তিক লোকদের দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে বাংলাদেশ মিশন। এ জন্য মিশনকেও ক্ষমা চাইতে হবে।
॥তিন॥
আসলে এই সরকার ধীরে ধীরে ঠান্ডা মাথায় আল্লাহ্ রাসূল তথা ইসলামবিরোধী প্রচারণায় মদদ দিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা একের পর এক সমাজের কিছু প্রতিষ্ঠিত কিন্তু চিহ্নিত ধর্মবিদ্বেষী ব্যক্তিকে এই জঘন্য উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মাঠে নামাচ্ছে।
তার পাশাপশি ব্লগার নাস্তিকদের প্রতি সরকারের মায়া মহব্বত এবং ভালবাসা উতলে উঠছে। নাস্তিক ব্লগার রাজিব নিহত হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানানোর জন্য তার বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন। আরেক স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে বিদেশে অর্থাৎ জার্মানিতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী আর গাফ্ফার চৌধুরীর কথা তো এতক্ষণ বললাম। উভয়কেই জামাই আদরে রাখা হয়েছে। গাফ্ফার চৌধুরীকে সরকারি টাকায় লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে রাখা হয়েছে। তার এই আল্লাহ্ রাসূল বিরোধী বক্তব্যের কারণে মুসলমানরা যদি ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, যদি সেই জনরোষের বিষ্ফোরন ঘটে, তাহলে সেই জনরোষ থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই দিকে লতিফ সিদ্দিকীকে নামকা ওয়াস্তে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেটি কেমন কারাগার? মাত্র ২০/২১ দিন জেল খানায় থাকার পর তারই আবেদন মোতাবেক তাকে পিজি হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে রাখা হয় এবং বন্দি হিসেবে দেখানো হয়। এই ভিআইপি কেবিনে তিনি ছিলেন ৬ মাস। এই ৬ মাসে তার বিল উঠেছিল ৮ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। তাহলে পাঠক ভাইয়েরা ভেবে দেখুন, একজন স্বঘোষিত নাস্তিক মুরতাদকে বন্দি অবসস্থাতেও সরকার কেমন রাজার হালে রেখেছিল। ৬ মাস পর তাকে সবগুলো মামলায় জামিন দেওয়া হয়। যেখানে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল এবং নাগরিক ঐক্য নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না জামিন পাননা সেখানে লতিফ সিদ্দিকী কেমন অবলীলাক্রমে জামিন পেয়ে যায়। যেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের জামিন হওয়ার পরেও আদালতের সেই জামিনের আদেশ জেলখানায় পৌঁছতে ২ দিন লেগে যায় সেখানে মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীর জামিন তার হাসপাতাল অবধি পৌঁছে যায়। আর সেই জামিন পাওয়ার পর কেমন করে তৎক্ষনাৎ আগে থেকে রেডি করা গাড়িতে করে তিনি বাসায় চলে যান।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি হল : “You can fool some people for sometimes, but you can’t fool all people for all times.” বাংলা অনুবাদ, “তুমি কিছু সময়ের জন্য কিছু লোককে বোকা বানাতে পার। কিন্তু সব লোককে সব সময়ের জন্য বোকা বানাতে পার না।”

Ads