রবিবার, ৩১ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সাগরে ভাসমান মানবতা


বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্রে ভাসছে শত-সহস্র বিপন্ন মানুষ।  জীবন বাঁচাতে লড়ছে তারা প্রবল ও কষ্টকর জীবন সংগ্রামে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এবং বিশ্ব নেতৃত্বের সামনে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে এসেছে। সমুদ্রে মৃত্যুর খবরের পাশাপাশি এসেছে বিশ্বের নানা দেশের গণকবর আর কারাগারে বাংলাদেশের মানুষের করুণ চিত্র। আমরা বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থ সানন্দে গ্রহণ করি বটে। কিন্তু তাদের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে পারি না। এটা এক চরম ব্যর্থতা।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট, বাংলাদেশের ঠিকানা ইত্যাদি বিশ্বের নানা দেশে কেমন অমর্যাদার শিকার হচ্ছেন, সেটা ভুক্তভোগী মাত্রেই অবগত রয়েছেন। অবক্ষয় ও মর্যাদাহীনতা এখন দেশ ছাড়িয়ে বাইরেও প্রকট হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রবেশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। কমছে শ্রমবাজারের পরিধিও। যারা বিদেশে এখনো নানা রকমের কষ্ট সহ্য করে টিকে আছেন, তাদেরকে পোহাতে হচ্ছে বিরূপ সমস্যা। অমানবিক নানা শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে আমাদের শ্রমশক্তিকে।
বাংলাদেশ বিগত আশি দশকে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্রমশক্তি রফতানিকারী দেশ। বাংলাদেশের বিশাল শ্রম বাজার ছড়িয়ে ছিল মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায়। সেটা বাড়ার বদলে কমেছে। শ্রমিকদের জীবন ও নিরাপত্তার উন্নয়নের বদলে অবনতি হয়েছে।
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে মানব পাচারের চাঞ্চল্যকর ও মর্মান্তিক নানা খবর মিডিয়ায় আসছে। দেশের নানা স্থান থেকে লোকজনকে লোভ-লালসা দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে টেকনাফ-কক্সবাজারের ঘাঁটি থেকে। সাগরে সেসব মানুষের মৃত্যুদৃশ্য আর বেঁচে থাকার আকুতি প্রকাশ না পেলে, কেউ জানতেই পারতো না দেশে গোপনে চলছে এক ধরনের দাস ব্যবসা। সরকার বা প্রশাসনের চোখের সামনে কিভাবে এসব ঘটতে পারে? কিভাবে নানা গডফাদার মানব পাচারের শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ কাজ-কারবার? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের মানুষ কেন জীবন বাজি রেখে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে চাচ্ছেন? এতো উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধার কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলোকে গ্রাহ্য না করে মানুষ চলে যাচ্ছে কেন? সুশাসন, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা থাকলে তো মানুষের দেশ ছাড়ার কথা নয়? কেন মানুষ এতো বিপদ মাথায় নিয়েও দেশ ত্যাগ করছে, সেটা কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখতে পারেন। সাধারণ মানুষকেও ভাবতে হবে, কেন নাগরিকরা মৃত্যুভয় আছে জেনেও দেশ ছাড়ছে? এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত বাস্তবতা।
ইতিহাসে দেখা গেছে, মানুষ নানা কারণে দেশ ত্যাগ করেন, অভিবাসী হন। এর মধ্যে প্রধান হলো আর্থিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা। ধর্মীয় কারণেও মানুষ দেশ ছাড়ে। উপমহাদেশে অতীতে ধর্মগত কারণেও মানুষ ভারত বা পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আজকের বাস্তবতা অন্য রকম। আজকের এই আধুনিক যুগে মানুষ কেন আদিম পন্থায় এবং অবৈধ ও অনিরাপদ পথে দেশ ছাড়ছেন? এর পেছনে পার্শ্ববর্তী দেশের জাতিগত নিপীড়ন যেমন আছে, তেমনি রয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ সহিংসতার কঠোরতা। আমরা এখন ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের রক্তলোলুপতা এবং মিয়ানমানের বৌদ্ধ মৌলবাদীদের পাশবিকতা দেখছি। এবং মজার ব্যাপার হলো এটাই যে, হিন্দু বা বৌদ্ধ মৌলবাদীরা মুসলমান নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সবাইকে কচু-কাটা করলেও বিশ্ব বিবেকের কিছুই হয় না। দক্ষিণ এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে মুসলমান সম্প্রদায় ধর্মীয়-রাজনৈতিক-জাতিগত নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে অকাতরে মৃত্যুবরণ করলেও কারোই কিছু যায়, আসে না। বরং সব দোষ হচ্ছে উল্টো মুসলমানদের। মুসলমানদের মধ্যে মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদ খোঁজা হচ্ছে। একতরফাভাবে সব দোষ দেয়া হচ্ছে মুসলমানকেই। এ এক আশ্চর্য প্রহসন। উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর আধুনিক কোসেস।
বিদ্যমান পরিস্থিতি ও আক্রমণাত্মক অবস্থায় বিশ্বের দেশে দেশে মুসলমানদের সচেতন, সতর্ক ও আত্মঅধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এতো আক্রমণ, হামলা, মৃত্যুর পরেও যদি মুসলমানদের চোখ উন্মোচিত না-হয়, বিবেক জাগ্রত না-হয়, তবে আক্রান্ত মুসলমানদের বাঁচাবে কে? নিজে যদি শিক্ষা, দীক্ষা, আদর্শ, নীতি, নৈতিকতা, প্রযুক্তি এবং সামগ্রিক সচেতনায় ঋদ্ধ  হতে না পারি, তবে কাকে দোষ দেবো? নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হবো না, প্রকৃত শত্রু শনাক্ত করতে পারবো না, মিত্রকে শত্রু জ্ঞান করবো, তাহলে তো বিপদ হবেই? শত্রু ষড়যন্ত্র করবেই, এটা জানা কথা। শত্রুর ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমরা কি করবো? সেটাও তো ঠিক করতে হবে।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলিম জাতিগোষ্ঠী বর্তমানে নানা দিক থেকে চরম বিপদের মধ্যে নিপতিত হয়ে আছে। দেশে দেশে ছদ্মবেশীরা চক্রান্তের জাল বিস্তার করছে। ক্রমেই সে জালে ধরা পড়ছে বহু মানুষ। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক বিপদ একই সঙ্গে ধেয়ে আসছে। শুধু বিদেশগামী বা সমুদ্রের মানুষ নয়; ডাঙ্গায় যারা আছেন, তাদের নিরাপত্তাও সীমিত হয়ে আসছে। জাতীয়-আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র একেবারেই সামনে চলে এসেছে। এখনো সতর্ক না হলে আর কবে বিপদ উত্তরণ করা হবে?
বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করেন যে দেশে ও বিদেশে তারা যেন নিরাপদ থাকেন। সম্মানজনক জীবনের অধিকারী হতে পারেন। কোথাও যেন তারা অমানবিক আচরণ ও নির্যাতনের শিকার না হন। কোথাও যেন তারা অবহেলার সম্মুখীন না হন। এটা তাদের মানবিক অধিকার। এটা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। এই অধিকার দেশে ও বিদেশে নিশ্চিত করতে হবে। নেতৃবৃন্দকে এজন্য কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের কৃতিত্ব দেখাতে হবে। রাজনৈতিক কৃতিত্ব কেবল পোস্টার, ব্যানার আর বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।
বাংলাদেশের মানব পাচারসহ নানাবিধ জাতীয় দুর্যোগে সর্বদলীয় সংলাপ ও আলোচনাও হতে পারে। কিন্তু অতি বেদনার বিষয় এটাই যে, দলগুলো পরস্পর এক টেবিলে বসতে পারছে না। হিংসা, বিদ্বেষ, পরস্পরের ক্ষতির চিন্তায় সকলেই যেন মশগুল। সরকার আর বিরোধী পক্ষ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, এদের মুখ দেখাদেখি নেই। এক পক্ষ আরেক পক্ষের প্রতি চরম বিরূপ। এই বিরূপতা মঙ্গলজনক নয়। বরং এই অনৈক্য নানা রকমের ক্ষতির কারণ হবে। সামনের দিনগুলোতে যদি দেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য হ্রাস করা সম্ভব না হয়, তবে আমাদের শক্তিই দুর্বল হবে। রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদেরকে বিপদ উত্তরণে সাহায্য করবে। অতএব জাতির জন্য দরকার, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐক্য ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সরকারকে এজন্য এগিয়ে এসে নানা জাতীয় দুর্যোগ ও বিপদের মধ্যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে এবং বিভেদের অবসান ঘটাতে হবে। তাহলেই সকল  জন ও মানবিক সমস্যার সম্মানজনক সমাধান বের হয়ে আসবে।

শনিবার, ৩০ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মোদির সফর : তিস্তার পানি পাচ্ছে না ঢাকা


কলকাতার শতবর্ষের বাংলা প্রাচীন দৈনিক ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’ লিখেছে যে আগামী ৬ ও ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি ‘বাংলাদেশ বিজয়’ করতে যাচ্ছেন। দুই দিনের ঢাকা সফরে তিনি অর্থাৎ ভারত বাংলাদেশ জয় করবে। এই দিকে বাংলাদেশ সরকার তথা আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা দাবি করেছেন যে তাদের নেতা শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই ‘ভারত জয়’ করেছেন। ভারতের রাজ্য সভায় এবং লোকসভায় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুমোদিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার ভারত বিজয় কমপ্লিট হয়েছে। ঢাকা সফরকালে নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা চুক্তিটির নীচে তাদের স্বাক্ষর প্রদান করলে শেখ হাসিনার ভারত বিজয় ফাইনাল হয়ে যাবে। এখন পাবলিক ভারত এবং বাংলাদেশের দাবি শুনে ধোঁয়াশার মধ্যে পড়েছেন। কে কাকে জয় করলো? ভারত বাংলাদেশ জয় করলো? নাকি বাংলাদেশ ভারত জয় করল? একসঙ্গে দুটি দেশই তো দুটি দেশ জয় করতে পারে না। একজন জয়ী হয়। দুইজন তো এক সাথে জয়ী হয় না। তবে আমেরিকানরা মাঝে মাঝে ইংরেজি ভাষায় নতুন নতুন শব্দ উদ্ভাবন করে। তেমনি একটি শব্দ হল Win win situation, অর্থাৎ কেউ হারেনি, সকলেই জিতেছে। আসুন, আমরাও দেখি, এবার কে হারলো আর কে জিতলো।
বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে যে, স্থল সীমান্ত চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের জয় হয়েছে। তবে যারা শিক্ষিত লোক এবং যারা অতীতের খবরাখবর রাখেন, তাদের মতে এখানে বাংলাদেশের বিশেষ কোনো সাফল্য বা অর্জন নাই। স্থল সীমান্ত চুক্তি বা ছিটমহল বিনিময় চুক্তি তো স্বাক্ষরিত হয়েছে সেই ৪০ বছর আগে, ১৯৭৪ সালে। তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ৪০ বছর আগেই ভারতকে তার পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে, অর্থাৎ বেড়ুবাড়ী হস্তান্তর করা হয়েছে। বিনিময়ে দহগ্রাম এবং আঙ্গরপোতা বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়ার কথা। এই দুটি ছিাটমহলের মধ্যে যাতায়াতের জন্য রয়েছে যে তিন বিঘা করিডোর সেটি বাংলাদেশকে ভারতের স্থায়ীভাবে ইজারা দেয়ার কথা। ৪০ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশকে ঘুরিয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে ছিটমহলও দেয়নি বা করিডোরও ইজারা দেয়নি। অবশেষে ৪০ বছর পর বাংলাদেশ তার পাওনা পেয়েছে। এখানে বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগ সরকারের বিজয় হল কোত্থেকে? তাছাড়া এখানে বিজয়ের প্রশ্নই বা আসে কোত্থেকে? বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে আসুন, ৪০ বছর পেছনে ফিরে যাই।
॥ দুই ॥
৬২ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশের নিকট থেকে যে দু’টি বস্তু পাচ্ছিল না, যে দুটির বস্তুর সাথে বাংলাদেশের শুধু মাত্র অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব জড়িত, সেই বিষয়টি মাত্র এক লহমায়, কলমের এক খোঁচায়, ভারতকে দিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই দুটি বিষয় হলো (১) বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দর অর্থাৎ চট্টগ্রাম এবং খুলনার মংলা ভারতকে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া (২) ভারতকে তাদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত এবং বহু প্রতীক্ষিত করিডোর প্রদান। এতো বড় দুটি জিনিস ভারতকে শেখ হাসিনা দিয়ে দিলেন। অথচ বিনিময়ে তিনি কিছুই পেলেন না। স্বাধীনতার কিছু দিন পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান একটি কবিতার দুই লাইন প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। ওই লাইন দুটি হলো-
রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি
দেবার কিছু নাই
আছে শুধু ভালবাসা
দিলাম আমি তাই
কিন্তু শেখ হাসিনা যা করলেন সেটি তার পিতার এই উক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার যা কিছু দেবার আছে তার সবকিছু তিনি ভারতকে উজাড় করে দিয়েছেন। বিনিময়ে ভারত তাকে কিছুই দেয়নি। ভারতের অন্তরে যাই থাকুক না কেন, মুখে দিয়েছে, তার পিতার ভাষায়- শুধু ভালবাসার কথামালা। বাংলাদেশ সবকিছু দিয়ে রিক্ত নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সবকিছু পেয়ে ভারত সমৃদ্ধ হয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশকে দিয়েছে শুধু কথার ফুলঝুরি।
 বাংলাদেশের মাত্র দুটি সমুদ্র বন্দর। আওয়ামী সরকার এই দুটি সমুদ্র বন্দরই ভারতকে দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে তারা ভারতের নিকট থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল এবং তিনবিঘা করিডোর আনতে পারেনি। অথচ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। এই হস্তান্তরের বিরুদ্ধে সেই সময় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন জনাব আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি বলে ১২ নম্বর দক্ষিণ দগগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল দুটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিনিময়ে ভারতের দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল দুটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা যাওয়ার রাস্তা হলো তিনবিঘা করিডোর। এটিও ভারতের দখলে। মুজিব ইন্দিরা চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু তিনবিঘা করিডোর দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার প্রবেশ পথ, তাই এই করিডোরটি বাংলাদেশের কাছে স্থায়ীভাবে ইজারা দেয়া হবে। এই চুক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে কাজী মোখলেছুর রহমান নামক একজন আইনজীবী উচ্চ আদালতে মামলা করেন। তখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। জনাব মোখলেছুর রহমানের মামলার মূল বিষয় ছিল এই যে, ভারত বিভাগের সময় দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়ন বাংলাদেশের ভাগে পড়েছে। সংবিধান সংশোধন ছাড়া দেশের ভূখর্ড অন্য দেশের কাছে হস্তান্তরের কোন অধিকার সরকারের নাই। সুপ্রিম কোর্ট এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, একটি দেশের ভূখ-ের একটি অংশ অন্য দেশের কাছে হস্তান্তর করতে হলে পার্লামেন্টের অনুমোদন এবং সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। যেহেতু এখনও এটি হস্তান্তরিত হয়নি তাই বিষয়টি অপরিপক্ক। এই যুক্তিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এরপর ২৮ নবেম্বর সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার মুজিব ইন্দিরা চুক্তি র‌্যাটিফাই করে এবং বেরুবাড়ি ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। অন্য দিকে ভারতের উচ্চ আদালতেও একই বিষয় নিয়ে মামলা হয়। ওই মামলায় ভারতীয় উচ্চ আদালত রায় দেয় যে দেশের ভূখ- অন্য দেশের কাছে হস্তান্তর করার অধিকার ভারত সরকারের নাই। তাই দগগ্রাম ও আঙ্গরপোতা বাংলাদেশকে দেয়া যাবে না। ফলে বেরুবাড়ি ভারত পেয়ে যায়, কিন্তু দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা বাংলাদেশ পায় না। শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংহের যৌথ ইস্তেহারের পর এগুলো বাংলাদেশকে ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু সেটারও কোন সুরাহা হয়নি। মাঝখানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতকে দেয়া হলো।
॥ তিন ॥
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার এক্সক্লুসিভ খবরে প্রকাশ, পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ঢাকা আসছেন ঠিকই, কিন্তু তিস্তার ওপর এবার কোনো চুক্তি সই হবে না। আগামী বছর কলকাতা বিধান সভার ইলেকশন। ঐ ইলেকশনকে সামনে রেখে মমতা এবার ঢাকায় তিস্তা চুক্তি সই করছেন না। তাহলে নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর থেকে বাংলাদেশ এবার কি পাচ্ছে? পর্যবেক্ষকগণের মতে কিছুই পাচ্ছে না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে ৫৪টি নদী রয়েছে যেগুলোকে বলা হয় অভিন্ন নদী। অর্থাৎ এগুলো ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে নেমে এসেছে। এ কারণে বাংলাদেশ হলো ভাটির দেশ। ভারত বিগত ৪০ বছর ধরে ওয়াদা করে আসছে যে এই ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বাংলাদেশের সাথে আলোচনাক্রমে এবং বাংলাদেশের সম্মতিক্রমে ন্যায্যভাবে বণ্টন করা হবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছে।
এর আগে শহীদ জিয়ার আমলে পানি বণ্টন নিয়ে প্রথম চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। শহীদ জিয়ার চুক্তির তুলনায় শেখ হাসিনার চুক্তিটি অত্যন্ত দুর্বল এবং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশকে কম পানি বরাদ্দ করা হয়। প্রথম চুক্তিতে তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু তুলনামূলক কম পানিও ভারত বাংলাদেশকে দিচ্ছে না। এখন অবশিষ্ট ৫৩টি নদীর চুক্তি কবে হবে? এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে অত্যন্ত কঠিন সমস্যা হলো তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যা। শেখ হাসিনা বিগত দিল্লী সফর করে যখন ৫০টি দফা ভারতকে দিয়ে আসেন তখন বাংলাদেশের মানুষ জানতে চেয়েছিলেন যে, তিস্তার পানি বণ্টনের কি হলো? সেই দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মণি বলেছিলেন যে, বাংলা ভারত যৌথ নদী কমিশনের পরবর্তী বৈঠকেই অর্থাৎ মার্চ মাসের বৈঠকেই তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কে একটি অস্থায়ী চুক্তি হবে। মার্চ মাসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তিস্তার পানি চুক্তি আর হয়নি।
এর পর ঢাকায় এলেন প্রণব বাবু। তিনি এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না। কিন্তু পরের দিন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মণি বলেন যে, আগামী বছর নাকি এটি হবে। জনগণের প্রশ্ন : তাহলে এতো তাড়াহুড়ো করে করিডোর দিলেন কেন? কেন এতো সাত তাড়াতাড়িতে বন্দর দুটি দেয়া হলো? কেন আশুগঞ্জকে এমন ক্ষিপ্রতার সাথে ‘পোর্ট অব কল’ হিসেবে ঘোষণা করা হলো?
॥ চার ॥
বাংলাদেশের নিকট থেকে ভারত চায় দুটি জিনিস। একটি হলো বহুমুখী করিডোর। অপরটি হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধাদেরকে ভারতীয় বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা। নর্থ ইস্টের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ইতোমধ্যেই হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের সাতটি রাজ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা অমূল্য ভূমিকা রেখেছেন। বাকি রইলো বহুমুখী করিডোর প্রদান।
বর্তমান প্রজন্ম তো দূরের কথা, তার আগের প্রজন্মও হয়তো ভারত বিভাগের অব্যবহিত পরের দিনগুলোর কথা ভুলে গেছেন। আজ যেটি বাংলাদেশ, সেটি স্বাধীনতার পূর্বে পরিচিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। আজ সেটার নাম পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু মানচিত্র বা ভূমির পরিবর্তন হয়নি। ভারত ভাগ হওয়ার পর আজকের বাংলাদেশ এবং সেদিনের পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের কোনো সমুদ্র বন্দর ছিল না। অথচ সমুদ্র বন্দর ছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য চলবে কিভাবে? কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার একমাত্র সমুদ্র বন্দর। পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, যত দ্রুত সম্ভব চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলা হবে। কিন্তু সে জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। পাকিস্তান সরকার তাই সেদিন ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিল, ‘অন্তত ৬ মাসের জন্য পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশকে কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হোক।’ ভারতে তখন ক্ষমতার দন্ড ছিল পন্ডিত নেহরু এবং সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের হাতে। নেহরু এবং প্যাটেল সেদিন সাফ জবাব দিয়েছিলেন, ‘৬ মাস তো দূরের কথা ৬ ঘণ্টার জন্যও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।’ যারা সেদিন ৬ ঘণ্টার জন্যও কলকাতা বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি তারা আজ স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে চায় কোন মুখে? আর বাংলাদেশ সরকারই বা সেই অনুরোধ বিবেচনায় আনবে কেন?
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানে বেসামরিক বিমান সার্ভিস চালু হয়নি। তৎকালীন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫০০ মাইল। বিমান ছাড়া দুই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা অসম্ভব ব্যাপার। যতদিন বিমান সার্ভিস গড়ে না উঠছে ততোদিন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভারতের কাছে স্থলপথে ভারতীয় ভূখন্ডের ওপর দিয়ে আকাশ পথে ট্রানজিট সুবিধা চেয়েছিল পাকিস্তান। ভারত ট্রানজিট সুবিধার অনুরোধপত্র পাঠ নাকচ করে দেয়। আজ সেই ভারতকে এখন একই সুবিধা দিচ্ছে আওয়ামী সরকার। সেদিন ভারত বলেছিল যে, ট্রানজিট দিলে নাকি ভারতের নিরাপত্তা সমস্যা হবে। অথচ সেদিন পাকিস্তানের ছিল না কোনো সামরিক বাহিনী, ছিল না কোনো শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী, ছিল না কোনো শক্তিশালী কাউন্টার টেরোজিম সংস্থা। আজ ভারতের সেনাবাহিনী পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম। পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তৃত রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর নেটওয়ার্ক। সামরিক দিক দিয়ে এমন শক্তিশালী ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিলে দুর্বল বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি হবে ভয়াবহ নিরাপত্তা সমস্যা। সুতরাং ট্রানজিট শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়। এটি মূলত কৌশলগত নিরাপত্তা সমস্যা।
তাই পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে, ট্রানজিট বা করিডোর দেয়ার আগে বাংলাদেশকে বিষয়টি নিয়ে হাজার বার ভাবতে হবে।
আসিফ আরসালান 

শুক্রবার, ২৯ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন


বিখ্যাত মানুষদের বিপদের শেষ নেই। মরে গেলেও বেঁচে যেতে পারেন না তারা। মৃত্যুর পর বরং তাদের নিয়ে গবেষণা ও মূল্যায়নের নামে ঘাঁটাঘাঁটি অনেক বেশি হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমও তেমন একজন বিখ্যাত মানুষ। বিএনপি যেহেতু এখনো এত দমন-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পরও দেশের প্রধান ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানে রয়েছে সেহেতু জিয়াউর রহমানকে ধরেও টানাটানি চলছে বিরামহীনভাবে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার নিন্দা-সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন এমন অনেকেও, যারা সরাসরি রাজনীতি করেন না। এদেরই কেউ কেউ বলেছেন, জিয়া নাকি একজন ‘খলনায়ক’! কোন উপলক্ষে এবং কারা বলেছেন- সে প্রসঙ্গে অবশ্য যাওয়ার পরিবর্তে এবারের নিবন্ধে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা হবে। বলা দরকার, আজ ৩০ মে তার মৃত্যুবার্ষিকী বলেই তাকে বিষয়বস্তু বানানো হচ্ছে। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছিলেন। এ উপলক্ষে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার মূল্যায়ন করা যেতেই পারে।
ঘটনাক্রমে রাজনীতি করেছেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বলেই জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা রয়েছে। যেমন কিছু বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলস্তম্ভ  ভঙ্গ করেন এবং এরশাদ সে ভাঙা স্তম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করে গেছেন। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, ওই বিশেষজনেরাই আবার বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সে বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া তাই বলে ওই বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না। প্রসঙ্গক্রমে ওই দিনগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ৭ নভেম্বরের এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মিলিত প্রতিরোধ ও পদক্ষেপের ফলে। এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরও নিজেদের তাগিদেই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে পা বাড়িয়েছিলেন বলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে দেশ বিশেষের পদানত করে ফেলা সম্ভব হয়নি।
সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবেরই সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নভেম্বর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার বিশেষ দেশপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থকÑ এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
বস্তুত ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেছে, বাংলাদেশকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। এর ফলে কেউ কারো নির্দেশ মানছিল না। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। সকল বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান। তার সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে এমনভাবেই অফিসার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, যার পরিণতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো এবং এই বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া দেশ বিশেষের জন্য কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ংকর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রÑ যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জাসদ এবং আরো দু-একটি রাজনৈতিক দল। এতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জাতির ভাগ্য ভালো, সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসারদের সমন্বয়ে সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। তার নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা থাকায় জেনারেল জিয়া সম্পর্কে সশস্ত্র বাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়নি। জিয়া নিজেও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। কেন অফিসারদের হত্যা করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছেÑ সেকথা তাদের বুঝিয়ে বলতে হয়নি। মূলত এসব কারণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সকল ক্যান্টনমেন্টে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাকশালের গঠনতন্ত্রে সকল ক্ষমতা এই চেয়ারম্যানের হাতে দেয়া হয়েছিল। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের অসামরিক স্বৈরশাসন। শেখ মুজিবের তো প্রশ্নই ওঠে না, বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধেও তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে ৩৭ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি আসলে বন্দী হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশ ও দেশের মানুষকে ওই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এই পথ ধরেই বাতিল হয়ে যওয়া দলগুলো আবারও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরে আসার এবং তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিব ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মাত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার সুযোগ দেয়াও ছিল জিয়াউর রহমানের এক অনন্য অবদান। শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরে আসতে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। (স্মরণ করা দরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো মহল পানি ঘোলা করার চেষ্টা কম করেননি। কিন্তু  প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। জিয়ার এই ঘোষণার পরই ১৯৮১ সালের ১৭ মে নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।) জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়ার উদার ও সঠিক নীতির সূত্র ধরে। শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এখনো প্রথম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলেই সংবিধানের শুরুতে জিয়াউর রহমানের ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেছেন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সকল কাজের ক্ষেত্রে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাধ্যতামূলক করাও ছিল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই এসব পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কুটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশবাসীকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। এই কুটিল রাজনীতি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে এরশাদ ছিলেন সকল ব্যাখ্যাতেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। দূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এমনভাবে জিয়ার পদাংক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। জিয়াকে ‘খলনায়ক’ বানাতে গিয়ে বিশেষজনেরাও এরশাদের সে কৌশলের জালেই আটকে গেছেন। এজন্যই তারা এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা পড়ে যে কারো মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যায় দেখা যাবে, জিয়ার সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলে না। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে স্মরণ করা দরকার, সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ঘোষিত একটি রায়ে (যা পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর) দু’জন মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারপতিদের মন্তব্য ছিল, এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমা করা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সর্বোচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও অভিমত নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা কিন্তু খুবই নৈরাশ্যজনক। কারণ, এরশাদের বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সময়ে তো বটেই, মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেও এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর বিচারপতিরা যাকে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এরশাদের সে অবৈধ অভ্যুত্থানকেও আওয়ামী লীগই প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিএনপির বিদায়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে শেখ সেলিমের মালিকানাধীন দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়াসহ নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। এরশাদ এমনকি নিশ্চিত পতনের মুখে এসেও টিকে গেছেন কয়েকবার। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও এরশাদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটেনি। এরশাদকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার। তার কোনো মামলারই সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। সেই থেকে শেখ হাসিনা এবং এরশাদ একযোগে কাজ করে এসেছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এরশাদের দলের একাধিকজন এখনো শেখ হাসিনার মন্ত্রী। এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের অন্তত তুলনা চলে না। জিয়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার এবং অমন একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রপতিকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে বরং সমগ্র প্রেক্ষাপট মনে রাখা দরকার। নাহলে ব্যক্তি জিয়ার প্রতি তো বটেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিও চরম অন্যায় করা হবে।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

চাকরিতে ৫ লাখ অবৈধ বিদেশী?


হাজার হাজার বাংলাদেশী যখন জীবিকার অন্বেষণে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, বিদেশের মাটিতে যখন শত শত জনের মৃত্যু ঘটছে তখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের অভ্যন্তরে চাকরিসহ আয়-রোজগারের অবস্থা সম্পর্কে নতুন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সময়ে সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কম করে হলেও পাঁচ লাখ বিদেশী চাকরি করছে। গার্মেন্ট থেকে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং মোবাইল ফোন কোম্পানি পর্যন্ত নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে তারা। উচ্চ পদে শুধু নয়, অনেককে এমনকি নীতিনির্ধারকের অবস্থানেও দেখা যাচ্ছে। বড়কথা, বছরের পর বছর ধরে চাকরি করছে তারা অবৈধভাবে। অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসায় দু’মাসের জন্য এসে চাকরিতে ঢুকে পড়েছে, অনেকে আবার ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে এলেও সে পারমিট আর নবায়ন করেনি। সবকিছুর পেছনে রয়েছে সরকারি সংস্থাগুলোর গাফিলতি। অবৈধ বিদেশীদের সংখ্যা এবং তারা কোথায় কোন ধরনের চাকরি করছে এসব বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান নেই। থাকলেও তা প্রকাশ করা হয় না। এ অবস্থারও সুযোগ নিয়ে থাকে বিদেশীরা। তারা আরো বেশি সংখ্যায় চাকরি নিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। এর ফলে একদিকে শিক্ষিত তরুণ-যুবকরা চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের নিরাপত্তার জন্য সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক হুমকির। উল্লেখ্য, স্বল্পসংখ্যক ছাড়া অবৈধ বিদেশীদের প্রায় সবাই ভারতীয় নাগরিক।
দেশের ভেতরে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-যুবক যেখানে চাকরি পাওয়ার জন্য হা-পিত্যেশ করছে, বেকারের সংখ্যাও যেখানে হু হু করে বেড়ে চলেছে সেখানে পাঁচ লাখের বেশি বিদেশীর অবৈধভাবে চাকরিতে নিয়োজিত থাকার তথ্য শুধু আশঙ্কাজনক নয়, যথেষ্ট আপত্তিকরও। একে বেকারের দেশে নির্মম নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সরকারের গাফিলতিই এমন অবস্থার প্রধান কারণ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্থল সীমান্ত পথে পাসপোর্ট ছাড়া যে হাজার হাজার ভারতীয় আসছে তাদের তো খবরই নেই, পুলিশ এমনকি সেই সব ভারতীয় সম্পর্কেও কোনো খোঁজ-খবর করে না, যারা পাসপোর্ট নিয়ে আসে। অর্থাৎ বিদেশীদের ব্যাপারে সরকারের কোনো রকম মনিটরিং নেই বললেই চলে। অথচ বিদেশীরা কোথায় কি করছে বা কোন ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে এসব বিষয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে খোঁজ-খবর রাখা সরকারের কর্তব্য। ভিসার মেয়াদশেষে বিদেশীরা ফিরে যাচ্ছে কি না তা মনিটর করার পাশাপাশি ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর কেউ থেকে গেলে তাকে বহিস্কার বা গ্রেফতার করাসহ আইনত ব্যবস্থা নেয়াও সরকারের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অন্যদিকে সরকার সে কর্তব্য পালনের ধারে-কাছেও যাচ্ছে না। আরো অনেকভাবেও অবৈধ বিদেশীদের জন্য দরোজা খুলে দেয়া হচ্ছে। বায়িং হাউস ও মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিনিয়োগের আড়ালে বিশেষ করে ভারতীয়রা তাদের দেশ থেকে বেশি বেতনে লোকজন নিয়ে আসছে। তারা বেতনের টাকাও হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠাচ্ছে। ফলে একদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশীরা চাকরি পাচ্ছে না, অন্যদিকে হুন্ডির কারণে ভারতীয়দের বিনিয়োগে দেশও উপকৃত হচ্ছে না। এভাবে বিশেষ করে গার্মেন্ট ও মোবাইল ফোনের মতো খাতগুলো বরং ভারতীয়দের দখলে চলে যাচ্ছে। বিদেশীদের ব্যাপারে মনিটরিং না থাকায় দেশের নিরাপত্তার দিকটিও উপেক্ষিত হচ্ছে। তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। 
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যাতে বিদেশীদের পক্ষে অবৈধভাবে চাকরি ও বসবাস করা সম্ভব না হয়। এজন্য মনিটরিং-এর ব্যবস্থা নিশ্চিত ও জোরদার করতে হবে। কতজন বিদেশী আসছে, তারা ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরে অন্য কোনো কাজ- বিশেষ করে চাকরি করছে কি না এসব বিষয়ে মনিটরিং থাকতে হবে। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসছে তাদের কাউকে কোনো চাকরিতে ঢুকতে দেয়া যাবে না বরং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বহিষ্কার বা গ্রেফতার করতে হবে। বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার সময়ও শর্ত রাখা দরকার যাতে স্থাপিত শিল্প বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রধানত বাংলাদেশীরাই পেতে পারে। অবৈধ জেনেও যেসব কোম্পানি বিদেশীদের চাকরিতে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধেও লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা মনে করি, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার যে অঙ্গিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন তা পূরণের কিছুটা কাছাকাছি যেতে হলেও অবৈধ বিদেশীদের বিদায় করা দরকার। এই সহজ সত্যটুকুও বুঝতে হবে যে, দেশে চাকরি পায় না বলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশীরা সমুদ্র পাড়ি দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সে কারণেই বিদেশে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এমন মেরুদন্ড ও মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না


‘এই মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না’- বক্তব্যটি কোনো রাজনীতিবিদের নয়। বক্তব্যটি রেখেছেন দেশের বইপড়া আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত করে দিয়েছে, আজকে সবকিছু দ্বিখন্ডিত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গত ২৪ মে রোববার বাংলা উৎসব ও বইমেলার শেষ দিনে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। বরাবরই সবরকম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থাকা এই বিশিষ্টজন তার বক্তৃতায় আরও বলেন, স্বাধীনতার পর গত সাড়ে চার দশকে যেভাবে দেশ এগিয়ে যাবে বলে আমরা আশা করেছিলাম বস্তুত দেশ  সেভাবে আগায়নি। যে ব্যর্থতার জন্য দেশ এগুতে পারছে না, সেটা হলো রাজনৈতিক ব্যর্থতা। আর পরের সমস্যাটা হলো সংবিধান। যে সংবিধানের শিকার হয়ে রাজনীতি বিপাকে পড়েছে। এর থেকে রাজনীতি বের হতে পারছে না।
বস্তুনিষ্ঠতার গুণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। এ কারণেই নিউইয়র্কে বাংলা উৎসবে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা দেশের সচেতন মহল গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। তিনি যে বলেছেন, ‘এই মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না’- তা যে কতখানি বাস্তব তা সেদিনের বাংলা উৎসব মঞ্চেও উপলব্ধি করা গেছে। তিনি যখন বক্তব্য পেশ করছিলেন, তখন চিরকুট দিয়ে বার বার তাকে বক্তব্য শেষ করতে বলা হয়। এমনকি এক পর্যায়ে কয়েক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে হইচই করে তার বক্তব্য থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। এরপর তিনি দ্রুত তার কথা শেষ করতে বাধ্য হন। আমাদের রাজনীতি যে কতটা অসহিষ্ণু ও অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল নিউইয়র্কের বাংলা-উৎসব মঞ্চেও। নইলে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থাকা এমন এক বিশিষ্টজনের বক্তব্যে বাধা প্রদান করা হবে কেন? আমরা তো একথা জানি যে, জনমনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই উদ্যোক্তারা সুদূর নিউইয়র্কে তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেছেন।  তার বক্তব্যের গুরুত্ব আছে, এ কথা তো উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই জানতেন। কিন্তু তিনি যে দলকানা নন কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থাকেন, সে কথাটি কি তারা জানতেন না? সব জেনেশুনেই যদি তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে, তাহলে মঞ্চে বারবার চিরকুট দিয়ে তার বক্তব্যে বাধা প্রদান করা হলো কেন? উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ কি এমনটি ভেবেছিলেন যে, বর্তমান সময়ে অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো তিনিও বিশেষ ঘরানার গুণগান গেয়ে যাবেন? কিন্তু আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাননি, এ কারণেই হয়তো সেদিন বক্তব্য প্রদানকালে তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আসলে বড় বড় অট্টালিকা, উড়াল-সেতু কিংবা লাইট পোস্টের আলোর ঝলকানি কোনো জাতির প্রকৃত উন্নয়নের মানদ- হতে পারে না। জাতিকে প্রকৃত উন্নয়ন ও স্বাধীনতার সুফল দিতে হলে প্রয়োজন যে নৈতিক মেরুদ-, বর্তমান সময়ে তার অভাব খুবই প্রকট। লোভ-লালসাক্লিষ্ট মানসিকতা ও জীর্ণশীর্ণ মেরুদন্ড নিয়ে জাতিকে পথ দেখানো যায় না, গণতান্ত্রিক উন্নয়নও সম্ভব হয় না। তাই বলতে হয়, নিউইয়র্কের বাংলা উৎসব মঞ্চে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে সেদিন যে আচরণ করা হয়েছে, তা শুধু আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য নয়, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যও বটে। এমন দৈন্য নিয়ে আমরা যত উৎসবের আয়োজন করি না কেন, যত মঞ্চ সাজাই না কেন- তা কখনও বাতিঘরের ভূমিকা পালনে সমর্থ হবে না। আমাদের এইসব কথার অর্থ আবার এই নয় যে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা অন্য কারো সবকথা আমাদের মেনে নিতে হবে, কিংবা কারো কথার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করা যাবে না। জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে যে কোনো মানুষই কারো বক্তব্যের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। তবে সেই দ্বিমত প্রকাশের পদ্ধতি হতে হবে গণতান্ত্রিক। জোরজবরদস্তি, চাতুর্য কিংবা শক্তি প্রদর্শন কোনো সভ্য মানুষ কিংবা সভ্য-সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে না।
দেশের মন্দ রাজনীতির প্রভাব আমরা নিউইয়র্কেও লক্ষ্য করলাম। নীতিনিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আমাদের রাজনীতি এখন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারছে না। নানা অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি, আত্মসাৎ আর স্বজনপ্রীতির কারণে ডুবছে দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বিমান, বিটিসিএল, বস্ত্র ও পাটখাত, ডাক বিভাগ, বিদ্যুৎখাত, বিটিভি ও ওয়াসাসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই সমানে চলছে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অনৈতিকতার দৌরাত্ম্য। এমনকি ছাত্ররাও তা থেকে মুক্ত নয়।
‘ওরা বাস্টার্ড’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে মানব জমিন পত্রিকায়। ২৩ মে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ক্ষোভ দেখালেন অর্থমন্ত্রী। বললেন, ‘ওরা বাস্টার্ড, ওদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছি। কোনোভাবেই ছাড় নয়।’ এর আগে ছাত্রলীগের একাধিক বিতর্কিত ঘটনায় নিজ নির্বাচনী এলাকা সিলেটেও বিব্রত হন অর্থমন্ত্রী। এমন কি মন্ত্রীর সমাবেশস্থলেও ভাংচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনার পর নতুন দু’টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফের বেসামাল হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের সখ্যভাবের কারণে নগর জুড়ে নানা বিতর্কিত কাজ করেই চলেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। ওই ছাত্রলীগের হাত থেকে রেহাই পেলেন না ছাত্রলীগের এককালের নেতা ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্তও।
সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে খুবই ক্ষুব্ধ তা তার ভাষা ব্যবহার থেকেও উপলব্ধি করা যায়। দেশের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী সন্ত্রাসের  বিরুদ্ধে কথা বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস তো শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের খবর পাওয়া যায়। একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের অনাকাক্সিক্ষত এমন চিত্রে দেশের যে কোনো সচেতন নাগরিকেরই ব্যথিত হওয়ার কথা। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগ কিংবা কোনো দলকে ছোট করার লক্ষ্যে এ জাতীয় খবর তুলে ধরার মধ্যে তেমন কোনো কল্যাণ নেই। শুধু ছাত্রলীগ কেন, বিভিন্ন সময় আমরা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকতে দেখেছি। শুধু আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই যে এখন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কমীরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেযুক্ত হচ্ছে তা নয়; টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। যে সমস্ত কর্মকান্ড ছাত্রদের সাথে যায় না সেই সব কর্মকান্ডে ছাত্রনেতারা কীভাবে জড়িয়ে পড়ছে জাতীয় স্বার্থেই তা গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং ব্লেম গেম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমরা জানি, জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ছাত্র-রাজনীতিতেও পড়ে থাকে। একসময় তো মেধাবী এবং যোগ্য ছাত্ররাই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকতো। তারা লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতো, এমন কি জাতীয় প্রয়োজনে রাজনীতিতেও অবদান রাখতো। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তখন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের যেনতেনভাবে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত ছিলেন। তারা ছাত্রদের স্বার্থ যেমন দেখতেন, তেমনি দেখতেন জাতীয় স্বার্থও। ক্ষমতাকেন্দ্রিক বর্তমান রাজনীতিতে সেই সুবাতাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শ-নিষ্ঠা এখন গৌণ হয়ে পড়ায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মন্দ প্রভাবে ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা এখন নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে পদ-পদবী ও অর্থলিপ্সায় মত্ত হয়ে উঠেছে। ফলে তারা কাউকে মারতে, অপমান করতে কিংবা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না। দেশের জনগণ তো দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি চায় না, তারা চায় নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত, গণতান্ত্রিক রাজনীতি। কিন্তু তেমন আকাক্সক্ষা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো যে ছাত্র সমাজ, তাদের চিত্রই বা কেমন? কালান্তরের এই সময়টায় আমাদের রাজনীতিবিদরা কি তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন না? দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন আসলে প্রথমেই তাকাতে হয় নিজের দিকে। আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজের দিকে তাকিয়ে আত্মসমালোচনার দায়িত্ব পালন করে যদি রাজনীতির গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে এগিয়ে আসেন, তাহলে তাদের আর কোনো সন্ত্রাসী বা তাবেদার বাহিনী পুষতে হবে না। তখন ছাত্র রাজনীতিও রাহুমুক্ত হয়ে আপন মহিমায় ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা সময়ের দাবি পূরণে এগিয়ে আসেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে সময়ের দাবি পূরণে যদি তাঁরা ব্যর্থ হন, তাহলে আমাদের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় বলতে হবে, ‘এই মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না’। জানি না মূল্যবোধের এই সংকট থেকে জাতি কখন মুক্তি পাবে।

মঙ্গলবার, ২৬ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মোদির ঢাকা সফর ও সালাহ উদ্দিন কাহিনী


আগামী ০৬ জুন ৩৬ ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তার এই সফর নিয়ে শাসক মহলে উত্তেজনার শেষ নেই। ভারতের কংগ্রেস ও ইন্দিরা পরিবারের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার মোদিকে তুষ্ট করার জন্য যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছে। এমনকি নিরামিষভোজী নরেন্দ্র মোদির জন্য পানিশূন্য পদ্মার ইলিশ রান্নার ব্যবস্থাও করেছে সরকার। আমার জানা নেই যে, নিরামিষভোজীরা ইলিশ মাছ বা অন্য কোনো মাছ খান কিনা। তবে সরকার আয়োজন রেখেছে। সেটা অবশ্য ভালো কথা।
 আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রাখার জন্য কংগ্রেস সরকার করেনি হেন কোনো অপকর্ম নেই। আর এতে তাদের কোনো রাখঢাক ছিলো না। যে কোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে এবং শেখ  হাসিনার যে কোনো বিপদে তাকে প্রয়োজনে জঙ্গি বিমান পাঠিয়ে উদ্ধার করে আনা হবে, এই ছিলো কংগ্রেস সরকারের ঘোষণা। এই ঘোষণাকালে তারা বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে ফিরে তাকায়নি। তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়, বন্ধুত্ব চেয়েছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণ কংগ্রেস সরকারকে তাদের বন্ধু বলে কখনও ভাবতে পারেনি।
উপরন্তু কংগ্রেস তাদের বড় ভাইসুলভ মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে কখনও মনোযোগ দেয়নি। ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে গঙ্গাসহ ৫৪ টি নদীর পানি। অথচ ভাটির দেশ হিসাবে এসব নদীর বেশির ভাগ পানির হিস্যা বাংলাদেশের পাবার কথা। ভারত নানা ধরনের অজুহাত তুলে সে  দেশে আমাদের পণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত করে বাড়িয়েছে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা। সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের হত্যা করে সীমান্তকে করে তুলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্তে। শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি দিয়ে সম্পাদন করে নিয়েছে বহু সংখ্যক গোপন চুক্তি, যা বাংলাদেশের স্বার্থের সম্পূর্ণ প্রতিকূল। এমনি আরও সব কর্মকা-ের ফলে বাংলাদেশী মানুষের কাছে ভারত এক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। যা শুধু ঘৃণাই বাড়িয়েছে, ভালোবাসার বিস্তার ঘটাতে পারেনি।
কংগ্রেস সরকার সর্বশেষ ২০১৪ সালে যে ন্যক্কারজনক কা- করেছিল, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। গত বছরের ৫ জানুয়ারি জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা যে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করেছিলেন সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল পচে যাওয়া বামপন্থী ইনু-মেনন ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল। এমনকি ১৯৮২ সাল থেকে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও ঐ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সকল রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে সে নির্বাচন কোনোভাবেই বৈধতা পাবে না Ñ এই আশঙ্কা থেকে ভারতের কংগ্রেস সরকার একেবারে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো শেখ হাসিনার নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ‘গুরু দায়িত্ব’ নিজের কাঁধেই তুলে নেয়। শেখ হাসিনার চৌদ্দ দলের মিত্রদের মধ্যে পতিত স্বৈরাচার হলেও এরশাদেরই খানিকটা উত্তরবঙ্গভিত্তিক জনসমর্থন ছিল। সুতরাং এরশাদকে যদি অনন্ত নির্বাচনে আনা যায় তাহলেও শেখ হাসিনার খানিকটা মুখ রক্ষা হয়। কিন্তু ঐ নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজে এরশাদকে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছিলেন না। তার তাই কংগ্রেস সরকার ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন এরশাদকে ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করানোর জন্য। সুজাতা সিংও যখন এরশাদকে ঐ পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন তিনি এরশাদকে এমন কথাও বলেছিলেন যে, এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নিলে মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিবে। এরশাদ তাতেও রাজি হননি। জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতায় আসে সে দায়িত্ব সরকারের, এরশাদের নয়। আর এরশাদ মিডিয়ায় এ কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন।
ফলে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় ভারতের কংগ্রেস সরকার। ঐ ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। তারপর সম্ভবত ভারতের পরামর্শেই রওশন এরশাদকে দিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে এক ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি করা হয়। এরশাদকে অসুস্থ বলে জোর করে সিএমএইচ-এ বন্দী রাখা হয়। যে কথা এরশাদ বার বার হাসপাতাল থেকে তার প্রতিনিধির মাধ্যমে বলেই গেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এরশাদের লোকেরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিল। এরশাদ সিএমএইচ-এ বন্দী অবস্থায় নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে বিধি মোতাবেক জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দেন। অনেকেই তা প্রত্যাহার করে নেন। কেউ কেউ চুপচাপ থাকেন। রওশন ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টি তার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এতে এরশাদ জাতীয় পার্টিতে একেবারেই শূন্য হয়ে যান। এরপর নির্বাচন কমিশন এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ ৩০০ আসনের ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য ঘোষণা করে দেয়। সেই হলো বাংলাদেশের সংসদ।
এমনই এক পরিস্থিতিতে গত বছর এপ্রিল মাসে ভারতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে যে, ঐ নির্বাচনে কংগ্রেসকে জেতানোর জন্য শেখ হাসিনা অবদান রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপশাসন, দুঃশাসনের কারণে কংগ্রেসের প্রতি সম্পূর্ণ বিরূপ হয়ে পড়েছিল ভারতীয় জনগণ। আর তারই পরিণতি হলো কংগ্রেসের ১০০ বছরের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটে। বিরোধী দল হওয়ার মতো মাত্র ৫৪ টি আসনে জয়লাভ করতেও ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। ৪৩টি আসনে তারা জয়ী হয়। শেখ হাসিনার জন্য এটা ছিল একটা বড় ধরনের ধাক্কা। তিনি কল্পনাও করেননি যে, কংগ্রেস এই রকম শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে। নরেন্দ্র মোদির অভিষেক অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত সকল দেশ যোগদান করলেও যোগ দিতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম।
বিগত এক বছরে নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশে ৫৪ দিন সফরে ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সফরে আসছেন ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর। এ কথা প্রচার করা হয়েছিল যে, মোদি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কিছু একটা হাতে নিয়ে আসতে চান। সেই কিছু একটা হলো, ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় স্থল সীমানা চুক্তি অনুমোদন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে জাতীয় সংসদে সে চুক্তি অনুমোদন করিয়ে ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু গত ৪১ বছরে ভারতের কোনো সরকার তাদের সংসদে ঐ চুক্তি পাস করাতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে রাজ্যসভা ও লোকসভায় চুক্তিটি পাস করিয়ে ছিটমহলবাসীদের জন্য এক সুসংবাদের সৃষ্টি করেছেন। এরা শুধু বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী নয়, ভারতের ছিটমহলবাসীরও এর অন্তর্ভুক্ত। এই চুক্তির ফলে উভয় দেশের ছিটমহলবাসী উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ একা কোনো সুবিধা পায়নি। তা সত্ত্বেও এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে, এই চুক্তির অনুমোদন উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে।
কিন্তু এর চাইতেও যেটি বড় সমস্যা তা হলো তিস্তার পানি বণ্টন। ভারত তিস্তার পানি বণ্টনে এখন পর্যন্ত গড়িমসিই করে আসছে। ফলে বাংলাদেশের এক বিশাল এলাকা চাষাবাদ, জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। তিস্তা যেন শুধুই এক ধূ ধূ বালুচর। কংগ্রেস সরকার বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী সরকারের আপত্তির কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। মমতা ঢাকায় এসে বলে গেছেন, এই পানি বণ্টনের ব্যাপারে তার উপর আস্থা রাখি। আস্থা রেখেছি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কেবল আশার বাণীই শুনিয়ে যাবেন। আমরা পানি কবে পাবো সেটি নিশ্চিত নয়।
এদিকে মেঘালয়ের একটি আদালত বাংলাদেশে কয়লা রফতানি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে জ্বালানি ক্ষেত্রে এক নতুন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর পদ্মাসেতু নির্মাণে ভারত থেকে পাথর ও নুড়ি-পাথর আমদানির যে কথা হয়েছিল ভারত সরকার তা সাময়িকভাবে স্থগিত করে রেখেছে। প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ চীনকে দেয়ার ঢাকার সিদ্ধান্তের পর পরই মেঘালয় সরকার বাংলাদেশে পাথর ও নুড়ি পাথর রফতানি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু অনেক কাল ধরেই এই রফতানি চালু ছিল। এর কোনোটাই বন্ধুত্বের স্মারক নয়।
সালাহ উদ্দিন কাহিনী
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ উত্তরার একটি বাসা থেকে অপহৃত হন গত ১০ মার্চ রাতে। সালাহউদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর ছিল। তারপর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ঐ বাসার সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে কয়েকজন যুবক তার চোখ ও মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেয়। ‘প্রায় ঘণ্টা দুই মতো গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে একটি ঘরে। ঘরের একটি রুমে আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত-পা ও চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। রুমটিতে প্রবেশের একটি মাত্র দরজা ছিল। সঙ্গে এটাচ বাথরুম। রুমের ভিতর আসবাবপত্র বলতে একটি খাট, মাথার ওপরে ছিল বৈদ্যুতিক পাখা। ঐ রুমে আমাকে রেখে যুবকরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। ঐ বাসায় আমাকে ৬১ দিন আটক রাখা হয়। আমাকে নিয়মিত খাবার ও ওষুধ দিয়ে যাওয়া হতো। যারা খাবার ও ওষুধ নিয়ে আসতো, তাদের কেউই আমার সঙ্গে কথা বলতো না। আমিও ভয়ে তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতাম না।’
উত্তরার বাসা থেকে অপহরণের সময় তার চোখ, কান ও হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। আর ঐ ঘরটিতে বন্দী করার পর তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়। ঐ বাড়ির অবস্থান সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা গত ২৫ মে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘যে ঘরে আমাকে বন্দী রাখা হয়েছিল, ঐ ঘরে আবারও আমার হাত, পা, চোখ ও কান বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। তখন আমার মনে হয়েছে খুন করার জন্য হয়তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে নিয়ে চার ঘণ্টা না দশ বারো ঘণ্টা ড্রাইভ করা হয়েছে তা ঠিক অনুমান করতে পারিনি। তবে রাস্তায় একবার গাড়ি বদল করা হয়। রাতের আঁধারে আমাকে একটি খোলা জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়। খুলে দেয়া হয় হাত ও পায়ের বাঁধন। ভয়ে আমার বুক কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাকে শ্যুট করা হবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনি। এরপরও আতঙ্ক কাটছিল না। নিজের ভিতর শক্তি সঞ্চয় করে চোখের বাঁধন খুলি। চারদিকে অন্ধকার দেখতে পাই। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পথচারীকে দেখতে পেয়ে তাদের জিজ্ঞেস করি আমার অবস্থান সম্পর্কে। তারা জানায় আমি ভারতের শিলং-এ অবস্থান করছি। আমি তাদের অনুরোধ করি পুলিশে খবর দিতে। এরপর পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়।’
তিনি পুলিশকে বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তারা তার কথা বিশ্বাস না করে স্থানীয় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ বাংলাদেশে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর সালাহউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন। এবং তাকে শিলং হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সে হাসপাতাল থেকে হৃদরোগ, মূত্রথলির সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতার জন্য তাকে শিলং-এর ইন্দিরা গান্ধী বিশেষায়িত হাসপাতালে এখন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো যা লেখে, তাতে কখনও কখনও মনে হয় সালাহউদ্দিন অসুস্থতার ভান করে আছেন। কিন্তু পুলিশ ও বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসকরা মনে করছেন তার হাসপাতালে চিকিৎসা আরও কিছুদিন করতে হবে।
এটি সালাহউদ্দিনের অপহরণের বাইরের দিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা এই যে, সালাহউদ্দিনের এই অপহরণের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। এবং আমরা দেখেছি ভারতের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে বাসা বাড়ি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সকল জায়গা থেকে নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশী মানুষের ধারণা সালাহউদ্দিন অপহরণের পেছনে ঐ গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। হয় তারা নিজেরাই এ কাজ করেছে অথবা এই অপকর্মকারীদের তারা ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছে। কেননা বাংলাদেশ সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে যে, বাংলাদেশী কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেনি। বাংলাদেশ সরকারও জানতে চায় গত ১১ মে সালাহউদ্দিন কীভাবে মেঘালয়ের শিলংয়ে পৌঁছলেন। আর এর ফলে বাংলাদেশীদের মনে জন্ম নিয়েছে বহুবিধ প্রশ্নের। বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায় সালাহউদ্দিন আহমেদ স্বেচ্ছায় অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন নাকি কেউ তাকে অপহরণ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় শিলং নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। যদি তিনি স্বেচ্ছায় কোথায়ও আত্মগোপন করতেই চান তাহলে  ভারতে যাওয়ার ঝুঁকি তিনি কেন নিবেন? ভারতে তাকে নিয়ে যাওয়া হোক বা তিনি যদি স্বেচ্ছায়ও গিয়ে থাকেন তাহলে ঢাকায় কারা তাকে অপহরণ করলো, এবং ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে গেল সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। কিংবা স্বেচ্ছায় তিনি গেলে ভারতের কোন গোয়েন্দা সংস্থা তাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শিলং যেতে সাহায্য করলো? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের সচেতন মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। উপরন্তু শিলং-এর পুলিশ প্রধান বলেছেন, সালাহউদ্দিন এমন মাপের কোনো লোক নন যে, তিনি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া শিলং এসে পৌঁছবেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, কোনো না কোনো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে শিলং এনে ফেলে গেছে।
সালাহউদ্দিন শিলং পুলিশকে জানিয়েছেন যে, ঢাকা উত্তরা থেকে তাকে গ্রেফতারের পর দু’ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞাত কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ৬১ দিন পরে প্রায় ১০/১২ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ও একবার গাড়ি বদল করে হাত পায়ের বাঁধন খুলে তাকে শিলং ছেড়ে দেয়া হয়। এখন শিলং পুলিশ তার বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনতে যাচ্ছে। আর তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে।
এদিকে সাপ্তাহিক হলিডে তাদের নিজস্ব তদন্ত থেকে জানতে পেরেছে যে, ভারতভিত্তিক কোনো একটি গোয়েন্দা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেছিল। তাদের ধারণা ছিল গোপন স্থান থেকে বিএনপির অবরোধ ও হরতাল আন্দোলনের মধ্যে সালাহউদ্দিনের ধারাবাহিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি হাসিনা সরকারকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছিল। ভারতের যে গোয়েন্দা সংস্থাটি এই কাজ করেছিল, তারা র’ বা রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং নয়। ঐ সংস্থা প্রধানত আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল এবং আরও অনেক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থানে কাজ করে। এই কাউন্টার গোয়েন্দা সংস্থা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে সকলভাবে সতর্ক করেছিল।
এ সমস্ত কারণেই মনে করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাংঘর্ষিক অবস্থানের জন্যই সালাহউদ্দিন অপহৃত হয়ে থাকতে পারে। মোদি সরকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পর্কে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই নিরীখে বাংলাদেশে আসার আগে সালাহউদ্দিনের অপহরণ ও শিলং-এ তাকে উদ্ধার বিষয়ে অবশ্যই স্বচ্ছতারই আশ্রয় নিবেন তিনি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৫ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ছাত্র রাজনীতিতে


‘ওরা বাস্টার্ড’- শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে মানবজমিন পত্রিকায়। ২৩ মে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ দেখালেন অর্থমন্ত্রী। বললেন, ‘ওরা বাস্টার্ড, ওদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছি। কোনোভাবেই ছাড় নয়।’ এর আগে ছাত্রলীগের একাধিক বিতর্কিত ঘটনায় নিজ নির্বাচনী এলাকা সিলেটেও বিব্রত হন অর্থমন্ত্রী। এমনকি মন্ত্রীর সমাবেশ স্থলেও ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনার পর নতুন দু’টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফের বেসামাল হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের সখ্যভাবের কারণে নগরজুড়ে নানা বিতর্কিত কাজ করেই চলেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। ওই ছাত্রলীগের হাত থেকে রেহাই পেলেন না ছাত্রলীগের এককালের নেতা ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্তও।
সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যে খুবই ক্ষুব্ধ তা তার ভাষা ব্যবহার থেকেও উপলব্ধি করা যায়। দেশের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসতো শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়। একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের অনাকাক্সিক্ষত এমন চিত্রে দেশের যে কোনো সচেতন নাগরিকেরই ব্যথিত হওয়ার কথা। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগ কিংবা কোনো দলকে ছোট করার লক্ষ্যে এ জাতীয় খবর তুলে ধরার মধ্যে তেমন কোনো কল্যাণ নেই। শুধু ছাত্রলীগ কেন, বিভিন্ন সময় আমরা অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকতে দেখেছি। শুধু আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই যে এখন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে তা নয়, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। যে সমস্ত কর্মকা- ছাত্রদের সাথে যায় না, সেই সব কর্মকাণ্ডে ছাত্রনেতারা কীভাবে জড়িয়ে পড়ছে জাতীয় স্বার্থেই তা গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং ব্লেমগেম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমরা জানি, জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ছাত্র রাজনীতিতেও পড়ে থাকে। এক সময় তো মেধাবী এবং যোগ্য ছাত্ররাই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকতো। তারা লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতো, এমন কি জাতীয় প্রয়োজনে রাজনীতিতেও অবদান রাখতো। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তখন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের যেনতেনভাবে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত ছিলেন। তারা ছাত্রদের স্বার্থ যেমন দেখতেন, তেমনি দেখতেন জাতীয় স্বার্থও। ক্ষমতাকেন্দ্রিক বর্তমান রাজনীতিতে সেই সুবাতাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শ, নিষ্ঠা এখন গৌণ হয়ে পড়ায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মন্দ প্রভাবে ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা এখন নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে পদ-পদবী ও অর্থলিপ্সায় মত্ত হয়ে উঠেছে। ফলে তারা কাউকে মারতে, অপমান করতে কিংবা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না। দেশের জনগণ তো দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি চায় না, তারা চায় নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত, গণতান্ত্রিক রাজনীতি। কিন্তু তেমন আকাক্সক্ষা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো যে ছাত্রসমাজ, তাদের চিত্রটাই বা কেমন? কালান্তরের এই সময়টায় আমাদের রাজনীতিবিদরা কি তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন না? দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন আসলে প্রথমেই তাকাতে হয় নিজের দিকে। আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজের দিকে তাকিয়ে আত্মসমালোচনার দায়িত্ব পালন করে যদি রাজনীতির গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে এগিয়ে আসেন, তাহলে তাদের আর কোনো সন্ত্রাসী বা তাঁবেদার বাহিনী পুষতে হবে না। তখন ছাত্র রাজনীতিও রাহুমুক্ত হয়ে আপন মহিমায় ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা সময়ের দাবি পূরণে এগিয়ে আসেন কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এই সন্ত্রাসকে রুখতে হবে


দুর্বৃত্তদের সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কথা আমরা দীর্ঘকাল ধরেই শুনে আসছি। এখন শোনা যাচ্ছে যৌন-সন্ত্রাসের কথা। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে এখন বেশ লেখালেখি হচ্ছে। সারাদেশে এখন নারী-নির্যাতনের পাশাপাশি যৌননির্যাতনের মাত্রাও বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না বয়স্ক নারী থেকে শুরু করে কোমলমতি শিশু-কিশোরী কেউই। ধর্ষকরা কৌশল বদলে এখন যৌন সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এসব অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় ক্রমেই তাদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে খোদ রাজধানীর রাস্তা থেকে আদিবাসী এক তরুণীকে তুলে নিয়ে চলন্ত মাইক্রোবাসে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর ১০ দিন আগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও-এ চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন এক গার্মেন্টস কর্মী। ধর্ষণের এমন ঘৃণ্য ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন নারী সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা।
মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী চলতি বছরে প্রথম ৪ মাসে সারাদেশে ১৫৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬১ নারী ও ৯৩ জন শিশু। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৬ জন। তারমধ্যে আবার ৩৯ জনই শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ জনকে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ২ নারী ও শিশু। এদিকে পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই ৩ মাসে সারাদেশে ৭০৯টি ধর্ষণের মামলা হয়। এর এক বছর পরের চিত্রে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ৩ মাসে ৭৯৭টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ, অর্থাৎ ধর্ষণের হার বেড়েই চলেছে। তবে নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র এরচেয়ে অনেক বেশি বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। লোকলজ্জা ও হুমকি-ধমকির কারণে অনেকেই ধর্ষণের কথা প্রকাশ করতে চান না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা না থাকা এবং জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব ধর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধির বড় কারণ। ধর্ষণ মামলা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা ও ভিকটিম সুরক্ষার নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কথাও তিনি জানান। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন, আমাদের ভাল ভাল আইন আছে কিন্তু তার বিধি নাই। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব ধরনের ভিডিও চিত্র বিনাবাধায় দেখতে পাচ্ছে সব স্তরের লোকজন। অনেক ধরনের ভিডিও চিত্র বিকৃত যৌনাচারে উৎসাহ যোগায় মানুষকে। পুলিশ অনেক দেরী করে মামলা করে যাতে আসামীরা পার পেয়ে যায়। নীতিনৈতিকতাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলার পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে জোর দেন সালমা আলী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের চিকিৎসকরা বলেছেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশির ভাগ মামলা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না। এতে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ হারান। যদি ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর পরিবার দরিদ্র হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত তারা মামলায় আপোষ করেন। অনেক ক্ষেত্রে আসামী পক্ষের চাপেও তারা আপোষ করতে বাধ্য হন। এছাড়া লোকলজ্জার ভয়েও অনেকে মামলায় যেতে চান না। ফলে ধর্ষণের সাথে জড়িতরা পার পেয়ে যায়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে আরও বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষপাতমূলক তদন্ত এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের চাপের কারণেও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা রক্ষা পেয়ে যায়। আমাদের সমাজকে মানুষের বসবাসযোগ্য রাখতে হলে এসব বিষয়ে সঙ্গত সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। মানুষতো জানমাল ইজ্জতের নিরাপত্তা ও শান্তিময় জীবন-যাপনের জন্য সরকার নির্বাচন করে থাকে। সরকার আইনের শাসন তথা সুশাসনের মাধ্যমে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারে। জন-আকাক্সক্ষা পূরণ শুধু অঙ্গীকারের বিষয় নয়, সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের বিষয়ও বটে। যৌন-সন্ত্রাস রোধে দেশের নাগরিক সমাজ, অভিভাবক, মিডিয়া, সংস্কৃতিসেবী এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদেরও দায় দায়িত্ব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে আসলে এই অনাচার থেকে আমাদের সমাজ মুক্তি পেতে পারে।

শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সরকার গরিবের বন্ধু নয় বরং যেন গরিব মারার সরকার


সরকার মুখে বলে তারা  গরিব মানুষের সরকার । কিন্তু কার্যকলাপের দ্বারা তারা প্রমাণ করেছে যে তারা গরিব মারার সরকার। বড় লোকরা আজ যা দাবি করে কাল তারা সেই মোতাবেক কাজ করে। এইগুলো কোন কথার  কথা নয় । চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের বড় লোকরা অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই দাবি করল যে ব্যাংকের লেন্ডিং রেট কমাতে হবে। অর্থাৎ তারা ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয় সেই ঋণের সুদের হার  কমাতে হবে। এই সুদের হার  কমাতে হলে সরকার ও ব্যাংকের কাছে সাধারণ মানুষের যে আমানত থাকে সেই আমানতের সুদের হার কমাতে হবে। ব্যবসায়ীদের এই দাবির এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার বিভিন্ন প্রকার আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়। 
এভাবে আবার সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর হামলা করা হয়েছে। দেখা যায়, স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআর) এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রায়শই হামলা হয়। এতে সরকারের যে কি লাভ হয় সেটা বোধগম্য হয় না। যে দেশে ব্যাংকের অলস তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে সঞ্চয়পত্র বা এফডিআরের ২ শতাংশ সুদ কমিয়ে বিনিয়োগের কি এমন বেগবান স্রোত সৃষ্টি হয়? বরং ক্ষুদ্র সঞ্চয় উৎসাহিত করার পেছনে গরিব ও মধ্যবিত্তকে সাহায্য করার সরকারের যে বিঘোষিত লক্ষ্য সেটাকেই বার বার বানচাল করা হচ্ছে।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের এক ঘোষণা থেকে জানা যায় যে, সরকার ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩.২৬ শতাংশ থেকে প্রায় ২ শতাংশ কমিয়ে ১১.১৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে এ সম্পর্কে সরকারিভাবে এখনও কোনো গেজেট নোটিফিকেশন বা প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেন, সুদের হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এটা চলতে থাকলে এ খাতে বিনিয়োগ আরো বেড়ে যাবে। সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝাও বেড়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রী বলেন, সে কারণেই আমরা এটাকে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আগে আমরা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়িয়েছিলাম। সেটা আর রাখা সম্ভব হলো না।
৫ বছর  মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদ বা মুনাফা ছিল ১৩.৪৫%। পেনশনার সঞ্চপত্রে ১৩.১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩.১৯ শতাংশ। ৩ বছর মেয়াদী তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ১২.৫৯ শতাংশ সুদ দেয়া হতো। আর তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ছিল ১৩.২৪%।
চলতি অর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। আটমাসে এর নিট বিক্রি দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে বিক্রির শীর্ষে ছিল তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ৫ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। পোস্ট অফিসের মেয়াদী সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা এবং ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ২৫৯ কোটি টাকা।
যেহেতু এখন পর্যন্ত গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হয়নি তাই সরকারি সিদ্ধান্তের বিস্তারিত জানা যায়নি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে আরো কিছু অস্পষ্টতা আছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ছয় প্রকার সঞ্চয়পত্র আছে। কোনগুলোর সুদ হ্রাস করা হলো আর কোনগুলোর করা হলো না সেটি পরিষ্কার নয়। সংবাদে বলা হয়েছে যে ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো (অর্থমন্ত্রীর ভাষায় রিভিউ) হয়েছে। এ ছাড়া ২ বৎসর এবং ১ বৎসর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র রয়েছে। সেগুলোর সুদের হার কমলো কি না বলা হয়নি।
মৎস্য চাষ, মুরগির খামার, বীজ উৎপাদন, গরুর খামার, মাশরুম চাষ প্রভৃতির আয় থেকে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। তবে এই আয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আয়করের ডেপুটি কমিশনারের নিকট থেকে প্রত্যয়নপত্র আনতে হবে। এটি চালু হয়েছে ১৯৯৭ সালে। ২০০৯ সালে যে পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় সেটির ৫ বছর মেয়াদী সুদ ছিল ১৩.৪৫ শতাংশ। এটির সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৪৫ লাখ। ৩ মাস পরপর মুনাফা তোলা যাবে যেমন ৩ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় ১৯৯৮ সালে। এর সর্বোচ্চ সুদ হলো ১২.৫৯ শতাংশ। ৫ বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদ ১২.২০ শতাংশ। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য চালু হয় পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এটি কেনার শর্ত হল (১) ক্রেতাকে সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী হতে হবে (২) তার চাকরি জীবন অন্তত ২০ বছরের হতে হবে। (৩) যেকোনো অবসরভোগী যিনি ৫৫ বছরে পৌঁছেছেন (৪) এই ক্যাটাগরিতে পেনশনারের মৃত্যু হলে তার স্বামী-স্ত্রী/সন্তান-সন্ততিরা কিনতে পারবেন। এক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমারেখা  নেই। ৫ বছর মেয়াদী মুনাফা ১৩.১৯%।
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিগত ১৭ বছর ধরে সঞ্চয় পত্রের কার্যক্রম চলে আসছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ নির্বিশেষে প্রতিটি সরকারই বলে এসেছে যে নি¤œবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের রিলিফ দেয়ার জন্যই এই স্কিমটি চালু করা হয়েছে এবং আজও চলছে। দেশের গরিব এবং মধ্যবিত্তের জন্য সরকারকে যদি দুই-চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হয় তাহলে সেটা কি বিরাট বোঝা হতে পারে? বিশেষ করে আগামী জুলাই থেকে যে দেশের বাজেট ৩ লাখ কোটি টাকা হতে যাচ্ছে? যেখানে এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে?
অর্থমন্ত্রী বলছেন, ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সভায় অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। ওরা বলেছিলেন যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে উচ্চহারে সুদ দিতে হয়। সেই সুদের হার কমানোর জন্যই সঞ্চয়পত্র শুধু না, স্থায়ী আমানতের সুদের হারও কমাতে হবে। এফডিআর বা স্থায়ী আমানতের সুদের হার তো ইতোমধ্যেই ৪ থেকে ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। অতীতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছিল। তার ফলে বেসরকারি খাতে কি বিনিয়োগ বেড়েছে? সরকার একটি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করুক যে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়াটাই সব অনিষ্টের মূল। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, সরকার এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে না। বরং ড. জায়েদ বখতসহ একাধিক অর্থনীতিবিদ বলেছেন যে, এফ ডি আরের ঋণ অসম্ভব হ্রাস এবং শেয়ার বাজার অলাভজনক হওয়ায় সঞ্চয় পত্রের পালে হাওয়া লেগেছে। এটিই যদি কারণ হয়ে থকে তাহলে তার জন্য দায়ী হলো সরকারের ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাদের অর্থনৈতিক ভাষ্যে এবং কলামে মন্তব্য করেছে যে হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার দুই শতাংশ কমানোর ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন অবসর জীবন-যাপন করা হাজার হাজার মানুষ । সঞ্চয়ের লভ্যাংশে সংসার পরিচালনাকারী  ছাড়াও মধ্যবিত্ত  শ্রেণীর একটি বড় অংশ বিপাকে পড়ে যাবে। নির্ধারিত  আয়ের এই মানুষগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে  এমনিতেই হিমশিম  খাচ্ছে । সঞ্চয়পত্রের সুদের  ওপরই নির্ভর করছে যাদের জীবন। হঠাৎ করে সুদ কমে যাওয়ায়  তারা পড়েছেন হতাশায়। কারণ, জীবনের পড়ন্ত  বেলায় সংসার  চালানোর বিকল্প কোন  অবলম্বন নেই ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, এ সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত ও বিবেচনাপ্রসূত হয়নি। এর ফলে  সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত  হওয়ার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগেও  নিরুৎসাহিত হবেন। এমন কি এর মাধ্যমে তারা তাদের বর্তমান পুঁজিটাও হারাবে বলে মনে করেন তিনি।
এক প্রাক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মহিত সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর  ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, সুদের হার কমিয়ে দেয়া এবং  মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর ধার্য করার কথা জানান । আর এতে বিপাকে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকে আবার সঞ্চয়পত্র থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগের চিন্তা করছেন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেলে সরকারের অর্থের জোগানে ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।  এছাড়া দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ মোকাবিলায় তাদের অনেক সময় অন্যের ওপর নির্ভর করতে হতো অথবা নানাভাবে তাদের সমন্বয় করে চলতে হচ্ছিল। হঠাৎ  অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণা তাদেরকে ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত করেছে বলে জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেজ্ঞরা মনে করেন যে, এতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুদের হার কমানোর ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবে। তারা বলেন, শেয়ারবাজারের  মতো বিনিয়োগের অন্যান্য উপায়গুলোতে মানুষ আর ভরসা পাচ্ছে না। ফলে সাধারন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানা যায় এ খাতে বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগই হচ্ছেন পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী । নিরাপদ  বিনিয়োগ  হিসেবে এতদিন তারা বাজারে থাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, সরকার বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা  না করে আমলাদের  পরামর্শে  এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার ফল ভোগ করছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ। তারা বলছেন, সঞ্চয় পত্রে নিরাপদ বিনিয়োগ করে পরিবার চালানোসহ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালানো যেত। এখন সেটা অনেকটা হুমকির মুখে পড়বে।
ওপরে এতক্ষণ ধরে  যা কিছু বলা হল সেটা শুধু আমাদের কথা নয়। দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকার এবং অর্থনীতিবিদরাও একই ধরনের মতামত প্রকাশ  করেছেন।
এফবিসিসিআই এর নির্বাচনে তিনটি প্যানেলের প্রত্যেকটির ওয়াদা ছিল এই  যে নির্বাচিত হলে ব্যাংকের লেন্ডিং রেট তথা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের  সুদ তারা কমিয়ে দেবেন। গত বৃহস্পতিবার একটি প্যানেলের নেতা ঘোষণা করেছেন যে নির্বাচিত হলে তারা ব্যাংকের লেন্ডিং রেট অন্তত ৯ শতাংশ নামিয়ে আনবেন। মন্ত্রীর  এই বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে আমানতের সুদের হার ৯% এর নিচে হবে। লেন্ডিং রেটের সুদের হার এবং আমানতের সুদের হারের মধ্যে কম করে হলেও নাকি ৪ শতাংশ হতে হয় । এটিকে ব্যাংকের পরিভাষায় বলে Spread (স্প্রেড)। সেক্ষেত্রে আমানতের সুদের হারকে উর্ধ্বে ঠেললেও ৫ শতাংশের উপর যাবে না।
 সরকার কি সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে? তাহলে আর এ সরকার গরিবের বন্ধু হয় কিভাবে? আসলে এই সরকার গরিবের বন্ধু নয়, বড় লোকের বন্ধু ।
আসিফ আরসালান 

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে বাংলাদেশের সম্ভাবনা


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি এবং পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গে ঢাকা সফরে আসছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনের বেশি আশাবাদীরা মনে করছেন, এবার বাংলাদেশের ভাগ্যের চাকা সম্ভবত ঘুরতে শুরু করবে। চাকাটা ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশকে ঠিক কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে, তিস্তা চুক্তি ‘হনুজ দূর ওয়াস্ত’ই থেকে যাবে কি না এবং সম্প্রতি হঠাৎ করে ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভা ও রাজ্যসভায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন করার পেছনে বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে ‘ঘোল’ খাওয়ানোর উদ্দেশ্য রয়েছে কি না- এসব প্রশ্নও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। আলোচনা অবশ্যই অকারণে হচ্ছে না। প্রধান একটি কারণ হলো, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই দু’জন অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। তাদের সম্পর্ক একেবারে সাপে-নেউলের মতো। গত বছর, ২০১৪ সালে দেশটিতে যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখনও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে মিস্টার মোদিকে ‘কসাই’ বলেছিলেন, ‘তুই-তুকারি’ তো করেছিলেনই। এই পরস্পর বিরোধী ও দৃশ্যত শত্রুতাপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় রাজনীতিকদের ঐকমত্য রয়েছে বলেই দু’জনের এক সঙ্গে সফর করা সম্ভব হচ্ছে। কথা ওঠার অন্য কারণও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশকে ‘এক হাত’ নেয়ার ব্যাপারে তিনিও কখনো পেছনে পড়ে থাকেননি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় তার প্রধান একটি এজেন্ডাই ছিল ভারত থেকে কথিত বাংলাদেশীদের বের করে দেয়া। মিস্টার মোদী ভারতে অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচনে তার দল যদি জিততে পারে এবং তিনি নিজে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন তাহলে ক্ষমতায় গিয়েই ঘাড়ে ধরে বের করে দেবেন বাংলাদেশীদের! তখনও কথার পিঠে তেড়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সে অবস্থান কথিত বাংলাদেশীদের পক্ষে গিয়েছিল। এর পেছনেও মমতার ‘পলিট্রিক্স’ই ছিল, যে প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে বলা হবে। এদিকে মিস্টার মোদির জবাবে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিকরা বলেছিলেন, ভারত এমন কোনো আহামরি দেশ নয় যে, সেখানে যাওয়ার এবং গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করার জন্য বাংলাদেশীরা দিওয়ানা হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ থেকে একেবারেই যে যায় না বা সময়ে সময়ে যায়নি তা অবশ্য সত্য নয়। কিন্তু ঠিক কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকজন তারা এবং তাদের সংখ্যাই বা কত সে সব বিষয়ে নরেন্দ্রনাথ মোদিরও জানা থাকার কথা। না জেনে থাকলে তিনি পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। কারণ, বিজেপি ও কংগ্রেসের পাশাপাশি কমিউনিস্টদের হারিয়ে দেয়ার জন্য শ্রীমতি মমতা নাকি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘রিফিউজি’ ভোটারদের ওপরই প্রধানত নির্ভর করেছেন। ওদিকে কমরেড বুদ্ধদেব তো বহু বছর আগেই শুনিয়ে রেখেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে নাকি ‘স্রোতের মতো’ মানুষ গিয়ে হাজির হয়েছিল পশ্চিম বঙ্গে। যেন গিয়েছিল লাখে লাখেÑ হয়তো কোটিরও বেশি! কিন্তু কমরেড বুদ্ধদেবই আবার জানিয়েছিলেন, ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে নাকি লাখ চার-পাঁচেক বাংলাদেশী পশ্চিম বঙ্গে গিয়ে উঠেছিল!
নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে যেহেতু বলেছিলেনই সেহেতু অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের দায়িত্বটুকুও মিস্টার মোদির ওপরই বর্তেছিল। সেটা কিন্তু তিনি করেননি। মানে, করার সৎসাহস পাননি। কারণ, করতে গেলে নরেন্দ্রনাথ মোদিকে অন্য একটি সত্যও স্বীকার ও গলাধঃকরণ করতে হতো। সে সত্য হলো, তিনি শুধু ভারতে কথিত বাংলাদেশীদের দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতেই দিতে চাননি যে, বাংলাদেশীদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে রয়েছে। বড় কথা, এই ভারতীয়রা শুধু অবৈধভাবে বসবাসই করছে না, অবৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকরি-বাকরিও করছে। কিছুদিন আগেও এক টিভি টকশোতে জানানো হয়েছে, অবৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকরিতে নিয়োজিত ভারতীয়দের সংখ্যা কম করে হলেও লাখ পাঁচেক। হুন্ডিসহ অবৈধ পথে এদের পাঠানো অর্থের পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। রফতানি ও রেমিট্যান্সসহ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে এরাই রয়েছে পঞ্চম স্থানে! এর পরিমাণ সম্পর্কে কল্পনা করতে গেলেও চমকে উঠতে হয়। মিস্টার মোদি কিন্তু এত বড় একটি বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। কেন করেননি তার কারণ অবশ্য এতদিনে বোঝা যাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি কিন্তু এখন আর কথিত বাংলাদেশীদের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার কথা বলেন না।  কারণ, তেমন অবস্থায় বাংলাদেশ থেকেও যদি ভারতীয়দের ঘাড়ে ধাক্কা খেয়েই বেরিয়ে যেতে হয় তাহলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পঞ্চম খাতটি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। সে ধাক্কার ঠ্যালা সামাল দেয়া অন্তত মিস্টার মোদির পক্ষে সম্ভব হবে না।
পাশাপাশি রয়েছে মমতা ফ্যাক্টরও। কারণ, ২০১১ সালে পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট ও বামফ্রন্টের ভরাডুবি এবং মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট বিজয়ের একটি বড় কারণ হিসেবে বহুদিন পর দৃশ্যপটে এসেছিলেন নির্যাতিত ও বঞ্চিত মুসলমানরা। শতকরা হিসাবে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট থাকলেও পশ্চিম বঙ্গে তারা ‘সংখ্যালঘু’। গত বছর অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনেও মুসলমানরাই নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছেন। সে কারণে মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অতি হাস্যকর প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। মুসলমানদের উন্নতি-সমৃদ্ধির নানা ধরনের অঙ্গীকারের ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা। প্রতিটি দলই কয়েকজন করে মুসলমান প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন হাতে মুসলমানদের দোয়া চেয়ে বেড়িয়েছেন। তৃণমূলের নারী কর্মীরা গায়ে বোরখা চাপিয়েছিলেন, আর পুরুষরা মাথায় টুপি পরেছিলেন। মুসলমানদের নিয়ে বামফ্রন্টকেও ঠ্যালা-ধাক্কা কম দেননি মমতা। এই সত্য তিনি ফাঁস করেছিলেন যে, দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এক শতাংশ মুসলমানও শিক্ষা-চাকরি ও ব্যবসা পাননি। অর্থাৎ কমিউনিস্টরা নামেই ধর্মনিরপেক্ষ, বাস্তবে তারাও মিস্টার মোদিদের মতোই মনে-প্রাণে কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন!
এবার সংক্ষেপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলা যাক। ভারতের সবচেয়ে অবহেলিত রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। আওয়ামী এবং ভারতপন্থী শিবিরের পক্ষ থেকে এই দিদিমনিকে নিয়ে মাতামাতি এবং ‘এপার বাংলা-ওপার বাংলা’ বলে চামচামো যথেষ্টই করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে অন্য ভারতীয়দের নীতি-কৌশল ও অবস্থানকেই এগিয়ে নিয়েছেন। কিছু কিছু ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিরোধী কট্টর ভূমিকা পালনেরও অভিযোগ রয়েছে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখ করা যায়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এই বলে জোর প্রচারণা চালানো হয়েছিল যে, এবার তিস্তা চুক্তি ‘হবেই’! দৃশ্যত আয়োজনও ঠিকঠাক মতোই চলছিল। কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন মমতা একাই। তিনি শুধু খসড়া চুক্তিরই বিরোধিতা করেননি, একই সঙ্গে একেবারে শেষ মুহূর্তে ঢাকায় আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছিলেন। কারণ জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে পানি দেয়ার পরিমাণ নিয়ে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন মনমোহন সিং। কথা নাকি ছিল বাংলাদেশকে ২৫ হাজার কিউসেক দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তির খসড়ায় ৩৩ হাজার কিউসেক দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এতেই বেঁকে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি থেকে তখনকার ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত সবাই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মমতাকে রাজি করাতে পারেননি। কারণ, তিস্তা মমতার কাছে তাদের উত্তর বঙ্গের কৃষির জন্য ছিল ‘লাইফ লাইন’। যুক্তিও চমৎকারই দেখিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বাংলাদেশ তাদের শুধু প্রতিবেশী নয়, আত্মীয়ও। কিন্তু নিজে খাওয়ার পর অতিরিক্ত থাকলেই তো প্রতিবেশীর কথা মনে পড়বে! তার রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় ছয়টি জেলার চাষীদের নাকি প্রচুর পানির দরকার। অন্যদিকে তিস্তায় যে পরিমাণ পানি আছে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি আপাতত সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের ব্যাপারেও নেতিবাচক কথাই জানিয়ে রেখেছিলেন মমতা। বলেছিলেন, শুষ্ক মওসুমে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে তিস্তায় একেবারেই পানি থাকে না। তার সরকার দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় আরো দুই লাখ হেক্টর জমিতে সেচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানির একটা বড় অংশ নিতে হবে তিস্তা থেকে। সে কারণেও তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিম বঙ্গের পক্ষে রাজি হওয়া সম্ভব নয়। এভাবে নানা কথার মারপ্যাঁচে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের কোনো কোনো নেতা-নেত্রীর সঙ্গে তার পার্থক্য রয়েছে। তিনি আগে নিজেদেরটা দেখেন, কোনো দেশের দালালি করেন না। এজন্যই ‘দুই বাংলা যেন এক হয়ে গেছে’ মনে করলেও জামদানি শাড়ি ও ইলিশ মাছের প্রলোভন তাকে নাড়া দেয়নি, তার রাজ্যের স্বার্থের প্রশ্নে এক ইঞ্চিও ছাড় দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেবার প্রসঙ্গক্রমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আবারও ভারতীয়দের বাংলাদেশ নীতি প্রধান্যে এসেছিল। কারণ, তিস্তা বেশি আলোচিত হলেও ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে। বাংলাদেশের ওপারে তিস্তার ৪৫ কিলোমিটার উজানে ভারত এমন এক গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে যার ফলে কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ খুব একটা পানি পেতে পারতো না। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের পানি ভাগাভাগি নিয়েই এত কিছু ঘটেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাড় না বাঁকালেও এবং সত্যি সত্যি কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ লাভবান হতে পারতো না। এর কারণ শুধু মোট পানির পরিমাণ নয়, ভারতীয়দের চাণক্য কৌশলও। এই কৌশলের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থে যা কিছু করছে ও করেছে সেগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের এক ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। কারণ, চাণক্য কৌশল নিয়ে অগ্রসরমান ভারতীয়রা এখনো ‘অতুলনীয়’।
একটি উদাহরণ হিসেবে ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’র উল্লেখ করতেই হবেÑ যে চুক্তিটি এতদিনে, দীর্ঘ ৪০ বছর পর ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় অনুমোদন পেয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো আদায় এবং সীমান্ত চিহ্নিত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। বড় কথা, ওই চুক্তি অনুযায়ী ভারত একই সঙ্গে পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি। এই সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য মরণ বাঁধ হিসেবে চিহ্নিত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে ভারত নিয়েছিল চাতুরিপূর্ণ কৌশল। মুজিব-ইন্দিরা যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মওসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসতে পারে সেজন্য ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে। যুক্ত ইশতেহারের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কথা ছিল, ৪১ দিনের নির্ধারিত সময়ে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি ফিডার ক্যানেল দিয়ে হুগলী নদীতে নিয়ে যাবে। কিন্তু ৪১ দিনের সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মওসুমে একতরফাভাবে গঙ্গার পানি নিয়ে যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফিডার ক্যানেল চালু করার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় পানি প্রবাহ যেখানে ছিল ৬৫ হাজার কিউসেক সেখানে ১৯৭৬ সালে এর পরিমাণ নেমে এসেছিল মাত্র ২৩ হাজার ২০০ কিউসেকে। এর প্রধান কারণ ছিল ফিডার ক্যানেল দিয়ে পূর্ণ ক্ষমতা অনুযায়ী ভারতের পানি প্রত্যাহার করে নেয়া। পরবর্তীকালেও ভারতীয়দের নীতি ও কার্যক্রমে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আগত আরেক আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ভারত যথারীতি চুক্তি লংঘন করায় ১৯৯৭ সালের মার্চেই সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ড স্থাপিত হয়েছিল- ২৭ মার্চ বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি আগেই উজানে উঠিয়ে নিয়েছিল।
এখানে ইতিহাসের উল্লেখ করার কারণ, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন তখন তাকে নিয়ে সীমা ছাড়ানো মাতামাতি করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মমতা কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস দেননি। ‘মনে হচ্ছে, নিজের দেশে এসেছি’ বলার পাশাপাশি তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে বলেছেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’! ভাবখানা এমন ছিল যেন মমতা চাইলেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে! আসলেও কি তা-ই? বাস্তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের প্রায় ৩০টির মধ্যে একটি মাত্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ভারত যেহেতু একটি যুক্তরাষ্ট্র সেহেতু তিস্তা চুক্তির মতো যে কোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর সম্মতি ও অনুমোদন দরকার পড়ে। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গে ক্ষমতাসীন মমতার তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকে চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছে। তাছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইলেই চলবে না, এ ধরনের বিষয়ে বিরোধী দলেরও সমর্থন থাকতে হবে। মূলত সে কারণে ২০১১ সালে ‘হবেই’ অবস্থায় এসে যাওয়া সত্ত্বেও মমতার বিরোধিতায় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। এই একটি বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস এবং নরেন্দ্রনাথ মোদির বিজেপি সরকারের মধ্যে কোনো মতানৈক্য দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্ভাব্য ঢাকা সফর নিয়ে উদ্বেগের কারণটিও এখানেই। সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর পরিবর্তে এখানে স্মরণ করা দরকার, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় মিস্টার মোদি বাংলাদেশ বিরোধিতাকে পুঁজি বানিয়েছিলেন, বাংলাদেশীদের ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। অন্যদিকে ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’Ñ এই বাগাড়ম্বরের বাইরে আশাবাদী হওয়ার মতো একটি শব্দও উচ্চারণ করে যাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তা-ই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্রনাথ মোদিকে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলিম হত্যার দায়ে ‘কসাই’ পর্যন্ত বলেছিলেন। সে দু’জনই এবার এক সঙ্গে ঢাকায় আসার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং দেশপ্রেমিকরা ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’ বললে তাদের দোষ দেয়া যাবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরকালেও তিস্তা চুক্তি ‘হনুজ দূর ওয়াস্ত’ই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে ‘ঘোল’ খাওয়ানোর সম্ভাবনাকেও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
শেষ করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দু’-একটি কথা বলা দরকার। যেমন বিএনপি ও চারদলীয় সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অতীতের অনেক সরকারই নাকি ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার এবং অন্য নানাভাবে ভারতবিরোধিতা করে দেখেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি বরং ভারতের সঙ্গে তিক্ততা বেড়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের কেউ কেউ নাকি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও গোপনে গিয়ে ভারতীয়দের পা ধরে থাকে! অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলটি কখনোই তথাকথিত ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ করেনি। বিএনপি বরং সব সময় জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা পালন করেছে। একে ‘ভারতবিরোধী’ না বলে ‘দেশপন্থী নীতি’ বলাই যথার্থ। উদাহরণ দিতে গিয়ে বিএনপির মুখপাত্র বলেছেন, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করা হলে এবং ফেলানীর মতো কিশোরীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হলে বিএনপি অবশ্যই তার প্রতিবাদ জানাবে। জানিয়েছেও। এমন অবস্থান কোনোভাবেই ভারতবিরোধী হতে পারে না। বরং এটাই একটি দেশপ্রেমিক দলের প্রধান দায়িত্ব। একে যারা ভারতবিরোধী নীতি বলতে চান এবং এর ভিত্তিতে বিএনপিকে যারা ভারত বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করেন তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই প্রশ্ন ওঠানো দরকার। ওই মুখপাত্র একই সাথে পরিস্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, জাতীয স্বার্থ পরিত্যাগ করে বিএনপি ভারত বা অন্য কোনো দেশকেই কখনো ছাড় দেবে না। অতীতেও ছাড় দেয়নি। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রতিটি বৈঠকে এ কথাটাই জানিয়ে এসেছেন। তিনি আরো বলেছেন, গভীর সম্পর্ক গড়তে হবে দু’ দেশের জনগণের মধ্যে। বেগম জিয়ার সফরের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তখন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়েছিল, অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন, তিস্তা চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য বৈষম্য, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ এবং ট্রানজিট তথা কানেক্টিভিটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি এতদিন যেসব দাবি জানিয়ে এসেছে সেগুলো সম্পর্কে মুখোমুখি বলার উদ্দেশ্যেই বেগম জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ ভারতের নেতাদের কাছে এসব বিষয়ে বিএনপির দাবি ও অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছিলেন তিনি। জবাবে ভারতীয়রাও বেগম জিয়াকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তারাও বলেছিলেন, ভারত শুধু বাংলাদেশের সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় না, অন্য সব দলের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক, সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে চায়। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি তার পূর্বসুরীর আশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করেন কি না। উল্লেখ্য, বিএনপি এরই মধ্যে তেমন আশাই প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের সব দলও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই চায়।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংলাপকে ভয় করছে সরকার


উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করার জন্য সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসায় বিশ্ব পঞ্চমুখ-এ মর্মে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পাচ্ছেন, দেশে কোন সংকট নাই, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক, খালেদা জিয়া খুনি, তাকে গ্রেফতার করতে হবে, বিএনপি-জামাত দেশে জঙ্গি হামলা চালাচ্ছে প্রভৃতি ডামাঢোল যখন সরকারের লোকরা বাজাচ্ছে, তখন বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় দেখা যায় এর ভিন্ন চিত্র। দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত অর্থে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। ঢাকা ও গোটা বাংলাদেশের চিত্র এক নহে। ঢাকাতেও ৩৫% মানুষ বস্তিতে বা ফুটপাতে বসবাস করে। পত্রিকা বা বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেলের নিত্যদিনের যা ঘটনা তা দেখে সরকারের ডামাঢোল প্রতিবাদের সব রাস্তা সরকার দিন দিন গলা চেপে ধরেছে। প্রতিবাদের অর্থই গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামী হয়ে রিমান্ডে যাওয়া। প্রতিদিন খুন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটক করে অস্বীকার বা ক্রসফায়ার, দখলবাজি ও টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ বনাম যুবলীগ খুনাখুনি, এখানে যেখানে লাশ আর লাশ, আসামী ধরতে গিয়ে পুলিশ কর্তৃক নারী নির্যাতনের অভিযোগ, পুলিশী নির্যাতন থেকে সাংবাদিকও বাদ পড়ছে না। পুলিশ হেফাজতে রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু, প্রতিদিনই জেলায় জেলায় রাজনৈতিক কর্মী গণগ্রেফতার, প্রতিনিয়তই বর্ডার এলাকায় বাংলাদেশীর লাশ, ফেলানীর বিচার ধুকে ধুকে কাঁদছে, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ কর্তন প্রভৃতি কোথাও ঘটনা আবার কোথায় নাটক, গণমানুষের অস্বস্তিরতার দিন আর কাটছে না।
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার জন্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে মর্মে দেশবাসী যা আশা করে ছিল; ফল হয়েছে তার উল্টো। ইলিয়াস আলীসহ বিরোধীদলীয় অনেক নেতা-কর্মী খুন ও গুম হওয়ার পর একটি বৃহৎ দলের মুখপাত্র ও সাবেক মন্ত্রীকে জোরপূর্বক ধরে নেয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বীকার-দেশবাসীকে আরো বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ- রেহমান সোবহান বলেছেন যে “দেশের আমলাতন্ত্র দলীয়করণের মাধ্যমে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে- যে কোনভাবেই সে ক্ষতি পোশানো কঠিন হয়ে যাবে”।
লাঙ্গলবন্দ ট্যাজেডি, বিল্ডিং ধস, অভিনব পদ্ধতিতে ক্রাইম বৃদ্ধি, অহরহ সড়ক, লঞ্চ দুর্ঘটনা, এরশাদের ভাষায় ঘরে থাকলে খুন, বাহিরে গেলে গুম প্রভৃতি পরিস্থিতিতে আকাশ যখন ভারী হয়ে উঠে তখনো সরকারের মুখে রসালো রসিকতা আরও বৃদ্ধি পায়। জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পালিত সরকারের অধিদপ্তর, ডিপার্টমেন্ট, এজেন্সি, বিভিন্ন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ ওয়াসা পাইপে পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদের উদ্ধার কাজ সরকারিভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করার পর আনাড়ি যুবকরা (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নহে) দেশীয় প্রযুক্তিতে শিশু জিহাদের লাশ উদ্ধার করার পরও নিজ যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সরকারের কোন বোধোদয় হয় নাই। ফলে সকল লঞ্চ ডুবি, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসে উদ্ধার কাজ সম্পর্কে জনগণের আস্থাহীনতা আরো প্রকট থাকার ধারণ করেছে। এমনিতেই রানা প্লাজার রোকশানা উদ্ধার কাজকে মানুষ নাটক বলে মনে করে। তার পর চলছে মড়ার উপর খাড়ার ঘা। প্রতিদিনই চলছে গণমামলা, গণগ্রেফতার, গণরিমান্ড, গণস্বীকারোক্তিসহ আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের দিয়ে জনগণকে ধমকানো; ফলশ্রুতিতে দেশে মানুষের মধ্যে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো তখন সংলাপের প্রস্তাবকারী সুশীল সমাজকে ধমক দিলেন- স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বললেন- সুশীলদের ১৮ জনের মধ্যে ১১ জনই আমার নিকট বিভিন্ন তদবিরে এসেছিলেন। সুশীল সমাজ রাষ্ট্রপতির মধ্যস্থতায় একটি সংলাপ চেয়েছিলেন। সংবিধানে যাহাই থাকুক না কেন ড. আকবর আলি খানের ভাষায়- “রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একজন সেকশন অফিসারের চেয়েও কম। কেননা, এই কর্মকর্তারা সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করতে পাবেন; কিন্তু রাষ্ট্রপতির সে সুযোগ নাই”। যা হউক মান্না-খোকার টেলিফোনিক আলাপের পর রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার ভয়ে ভীত সুশীল সমাজ এমন নিথর ও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে- তাদের মোবাইল নাকি এখন বন্ধ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির নিজ উদ্যোগে কোন উদ্যোগ আশা করা যায় না। কারণ যে অনির্বাচিত সংসদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সে সংসদকে সকল সমস্যার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করার জন্য তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোন উদ্যোগ নিতে পারবেন কি? জাতীয় স্বার্থে তিনি এতোটুকু রিস্ক নেয়ার পূর্বে তিনি নিশ্চয় তার অবস্থানের কথা গভীরভাবে চিন্তা করবেন।
ইতঃপূর্বে সংলাপের কথা বলায় বঙ্গবন্ধুর এককালীন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ড. কামাল অবশ্য এ মর্মে “ইটাকা জবাব পাত্থরে দিয়েছেন;” তার পর থেকে তাকে গ্রেফতারের দাবি এখন চুপ। প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় বঙ্গবন্ধুকে যিনি পিতা হিসাবে জানেন সেই বঙ্গবীর আ. কাদের সিদ্দিকীকে পূর্বেই নব্যরাজাকার টাইটেল দেয়া হয়েছে, সংলাপের দাবিতে প্রায় ৬০ দিন তিনি রাস্তায় অবস্থান করেছেন। বামপন্থী জোট, ২০ দল বহির্ভূত ইসলামী বিভিন্ন দল, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন জোট, সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীসহ সকলেই সংকট নিরসনে সংলাপ দাবি করেছেন।
সংলাপের মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ১৫টি ইউরোপীয়নে রাষ্ট্রদূতের যৌথ স্বাক্ষরে চিঠি দিলেও সরকার এর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নাই বরং জাতি সংঘের মানবাধিকার তদন্ত কমিশনের সাথে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অপব্যাখ্যা দেয়ায় কমিশন দুঃখ প্রকাশ করেছে যা জাতির জন্য লজ্জাজনক। উক্ত চিঠির কথাও সরকার গোপন রেখেছে দীর্ঘ দিন।
সংলাপের জন্য জাতিসংঘ বার বার তাগিদ দিয়ে সংকট নিরসনের কথা বলার সাথে এও বলেছে যে- সংসদের বাহিরে বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসতে হবে। কারণ বিশ্ব জানে যে, সংসদের ভিতরের বিরোধী দল গৃহপালিত ও সরকারের দোসর মাত্র। গণতন্ত্র নিধনে সরকারের অসংবিধানিক কর্মের সমর্থন আদায়ের জন্য গৃহপালিত বিরোধী দলটি হোটেল রেডিসনে রাষ্ট্রদূতদের সাথে একটি নৈশ ভোজে মিলিত হয়েছে। সরকার ৩টি বিষয় খুব ভালো করে প্রচার করছে। (১) স্বাধীনতার চেতনা, (২) বার্ন ইউনিট ও (৩) সংবিধান রক্ষা। প্রধান রাজনীতিবিদ ও মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদ সরকার ভূষিত “স্বাধীনতা পদক” গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, এতেই প্রতীয়মান হয় যে- স্বাধীনতার মূল চেতনা অর্থাৎ গণতন্ত্র রক্ষার প্রতি প্রধানমন্ত্রী কতটুকু যত্নবান? বার্ন ইউনিটের জন্য আমি/আমরা/জাতি/বিশ্ব মর্মাহত, দুঃখিত এবং যেভাবেই হউক এর অবসান অবশ্যই হওয়া উচিত; নতুবা দেশের কোন নাগরিকেরই জীবন নিরাপদ নহে। সকল কিছুর উর্ধ্বে ওঠে এ মর্মে সোচ্চার হওয়া দরকার। কিন্তু কেন এই অভিশপ্ত বার্ন ইউনিট? ড. কামাল হোসেনের ভাষায়- “৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের জন্যই দেশে এই অস্বাভাবিক অবস্থা”। গণতন্ত্রই স্বাধীনতার মূল চেতনা। সে চেতনাকে বুটের তলায় পিষে চেতনার শ্লোগান দেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র শাক দিয়ে মাছ ঢাকার জন্য।
সংবিধান রক্ষার জন্য সরকার এখন মরিয়া হয়ে ওঠেছে। দেশী-বিদেশী সকলের কাছে “সংবিধান মত দেশ চলছে ও চলবে বলে সাফাই গাওয়া হচ্ছে।” জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ- “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার (অর্থাৎ মহিলা আসন) কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্য দিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অবিহিত হইবেন।” যেখানে ১৫৩ জন বিনা ভোটে ও বাকি একতরফা ভোটে তথাকথিত নির্বাচনী মহড়া হয়েছে তাকে কি সংবিধানের ভাষায় “প্রত্যক্ষ নির্বাচন” বলা যাবে? তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন নিয়ম রক্ষার জন্য নির্বাচন। এখন তিনি বেমালুম সে ওয়াদা ভুলে গিয়ে এখন (১) স্বাধীনতার চেতনা, (২) বার্ন ইউনিট ও (৩) সংবিধান রক্ষার ডামাঢোল বাজাচ্ছেন যা কারো নিকট গ্রহণযোগ্য নহে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গন ও বিবেকবান মানুষ তা মেনে নিচ্ছে না; এক ভারত ছাড়া। কারণ বাংলাদেশের সাথে ভারতের অনেক স্বার্থ জড়িত। সবে মাত্র বিনা শুল্কে সড়ক পথে ত্রিপুরা যাওয়ার জন্য ভারতীয় চালের জাহাজ আশুগঞ্জে পৌঁছেছে। এরশাদ তখনই বলেছিলেন যে- ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং একতরফা নির্বাচনে যেতে তাকে চাপ প্রয়োগ করেছেন।
পাকিস্তানের অনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক সম্পর্কে (যিনি ১৭ আগস্ট ১৯৮৮ প্লেন ক্রাসে মৃত্যুবরণ করেন) একটি গল্প চালু ছিল যা নিম্নরূপ :-
[ জিয়াউল হক যখন চুল ছাটতেন তখন নাপিত বার বার তাকে জিজ্ঞাসা করতো- “স্যার, পাকিস্তানের নির্বাচন কবে দিবেন?” একথা শুনলেই তিনি রাগে টগবগিয়ে কিছু না বলে চোখ রাঙ্গিয়ে নাপিতের দিকে তাকাতেন। বার বার প্রশ্নের পর একদিন জিয়াউল হক নাপিতকে জিজ্ঞাসা করলেন- পাকিস্তানের নির্বাচন দিলে তোর লাভ কি? প্রতি উত্তরে নাপিত বললো- স্যার, নির্বাচনের কথা বললে আপনার চুল সব খাড়া (সোজা) হয়ে যায়, তখন আমার চুল ছাটতে সুবিধা হয়]
সরকার সব শুনতে রাজি একমাত্র সংলাপ ছাড়া। সংলাপের কথা শুনলেই সরকারের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়, যাদের মাথায় চুল নাই তাদেরও। কারণ সংলাপে বসলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। তাই সরকারের মন্ত্রীরা সংলাপ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করে রসিকতা করছেন। কেহ বলেন খালেদার সাথে সংলাপ হবে কারাগারে। কেহ বলেন জামাত ছাড়া আসতে হবে। আবার বলেন- সংবিধান মেনে আসতে হবে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে আলোচনা হবে না- শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এরা সন্ত্রাসী বিধায় বিএনপি-জামাতের সাথে সংলাপ হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রচ- রোদে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেন। সরকারের হয়েছে এখন সে অবস্থা। তাই সকলের দাবি উপেক্ষা করে সংলাপের বিষয়ে তাদের কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই; বরং খালেদা জিয়া সংকট নিরসন ও সংলাপের বিষয় বস্তু সম্পর্কে তার কার্যালয়ে ১৩/৩/২০১৫ তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন যা কোন প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সরকার তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করেছে। বরং “সংলাপ নয়, শক্তিতেই সমাধান খুঁজছে সরকার” মর্মে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা মতামত ব্যক্ত করেছে। ১৯৯৬ সনে মতিউর রহমান নিজামীকে সাথে নিয়েই শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তখন জামাতের গায়ে গন্ধ ছিল না? সন্তু লারমা হাজার হাজার বাঙ্গালী খুন ও সম্পদ লুট করেছেন। সেই সন্তু লারমার সাথে কি শেখ হাসিনা শান্তি চুক্তি করেন নাই? এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে প্রশ্ন তুলছেন তিনি কি ১৯৯৬ সানের ১২ই জুন তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে নির্বাচিত হন নাই? জামাত, ইনু, মেননকে সাথে নিয়ে তিনি কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল-অবরোধ করেন নাই? তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের জুজুর ভয় দেখান। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা পরিষদের অধীনে নির্বাচন করে তিনি কি নির্বাচিত হন নাই? তখন এই প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন- “এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল এবং তাদের সকল কাজের  বৈধতা আমি দিবো” এবং তিনি তা দিয়েছেন।
পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সার্বিক সংকট মোচনের জন্য জাতির স্বার্থের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার স্বার্থটি তিনি বড় করে দেখছেন। কারণ সংলাপ হলে কার লাভ কার ক্ষতি- এ বিষয়টি তিনি ভালোই বুঝেন। সংলাপের প্রথমই আসবে, কেন বা কার স্বার্থে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি সংবিধানে সংশোধন করা হলো? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের নির্বাচন কি প্রত্যক্ষ ভোটে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য কোন নির্বাচন ছিল? তৃতীয় প্রশ্ন, দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সব মামলা থেকে অব্যাহতি; পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সংক্রান্ত সব মামলা সচল রয়েছে কোন যুক্তিতে? পর্যালোচনায় উত্তর নেগেটিভ আসবে জেনেই সরকার সংলাপে বসতে চায় না। সংলাপে না বসাটাই প্রধানমন্ত্রী নিজকে লাভবান মনে করছেন। তাই পরিস্থিতি ভিন্ন পথে নেয়ার জন্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে বিরোধী দলকে সরকার দমন করার দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন যে- এ কারণেই পুলিশকে সম্প্রতি ১২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সংলাপে না বসলে কি হতে পারে? বিএনপি-জামাতকে সরকার জঙ্গিবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। যদিও ২০ দল বার বারই দৃঢ়তার সাথে বলছে যে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী যা করতে সরকার বন্দুকের নলে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারও জানে ২০ দল গণতান্ত্রিক দল এবং বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী যার প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপি একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না বিধায় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য সংবিধান সংশোধন জিয়ার উদ্যোগেই হয়েছিল। কিন্তু সরকার সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসবাদ বলে সন্ত্রাসবাদের শুড়শুড়ি ও উস্কানি দিচ্ছে মাত্র। এখানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন- “আমেরিকা জামায়াতকে অর্থায়ন বন্ধ করলে জঙ্গিবাদ বন্ধ হবে।” জামায়াত সম্পর্কে বামদের এলার্জি অনেক আগে থেকেই। গোটা বিশ্ব মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে সে সুবিধাটাই সরকার পেয়ে যাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলার পেছনে বড় বড় শক্তির গোয়েন্দাদের ইন্ধন রয়েছে। বিশ্ব রাজনীতি এখন গোয়েন্দাদের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন সংলাপের মাধ্যমে সংকটের মীমাংসা না হলে চরমপন্থী উত্থান ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে ২৩/২/২০১৫ তারিখে বিবৃতি দিয়েছে যা পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিশ্লেষকদের মতে স্বৈরতন্ত্রের কারণে জঙ্গিবাদের যেন উত্থান না হয়- এটাই দৃঢ়ভাবে কামনা করি। কারণ জঙ্গিবাদ আন্তর্জাতিক অর্থায়নে নীল নকশার ষড়যন্ত্রের একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এতে কল্যাণ বয়ে আনবে না বরং দেশ থেকে শান্তি চলে যাবে।
পর্যালোচনায় এটাই পরিষ্কার যে- সংলাপ না হলে আপাতত দৃষ্টিতে অনির্বাচিত সরকার সময়িক লাভবান হবে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র তথা জনগণ। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার উত্তম পন্থা হিসেবে বিবেচিত। সে কারণেই এ সরকার সংকট নিরসন ব্যতীত চলতে পারবে না। তাদের সাময়িক লাভ কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অন্ধকার। সংলাপ না করে আমলাদের ওপর প্রধানমন্ত্রীর নির্ভর করাটা কতটুকু নির্ভরযোগ্য হবে তা সময়ই বলে দিবে। জাতি সে সময়ের অপেক্ষায়।
এখন জাতির বিবেকের নিকট প্রশ্ন- দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী কি সঠিক পথে এগুচ্ছেন?
অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার 

বুধবার, ২০ মে, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এটা গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায়ও পড়ে না


সরকার দেশের সবগুলো সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃত্ব দখলে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা একদিকে ২০ দলীয় জোটের নির্বাচিত মেয়রদের সাজানো মামলায় ফাঁসাচ্ছেন, অন্যদিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি পুলিশকে দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে দাখিল করাচ্ছেন চার্জশিট। একযোগে চলছে স্থানীয় সরকার আইনের অপব্যবহার করে মেয়রদের সাময়িক বরখাস্ত ও অপসারণ করার কার্যক্রম। সিরিয়াল বা ক্রমিক না মেনে প্রতিটি স্থানে প্যানেল মেয়র হিসেবে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের। গত সোমবার দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান মনি এবং গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে ঢোকানোর এবং সাময়িক বরখাস্ত করার কাজ শেষ হয়েছে। কুমিল্লা ও বরিশালের মেয়রদের বিরুদ্ধেও জোর তৎপরতা চলছে। উল্লেখ্য, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে আটটির মধ্যে রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ ছাড়া সব কর্পোরেশনের মেয়র পদেই বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। ২৩৩টি কাউন্সিলর পদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা ১২৬ আসনে জিতেছিলেন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮০ জন কাউন্সিলর। ক্ষমতায় আসতে পারলেও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রায় সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ পরাজয় বরণ করেছে। ২০১০ সালের জুন মাসে প্রথম অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে জিতেছিল বিএনপি। মেয়র হয়েছিলেন মঞ্জুরুল আলম। তাকেও শেষদিনগুলোতে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে, তিনি এমনকি কর্পোরেশন অফিসেও যেতে পারেননি। চট্টগ্রামের পর পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছিলেন বিরাট ব্যবধানে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের জুন ও  জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ছিল শোচনীয়। সব মিলিয়ে দেশের আটটি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে দুটি ছাড়া সবগুলোতেই মেয়রের আসনে জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। ব্যতিক্রম ছিল রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ। রংপুরে জাতীয় পার্টি জিতেছিল, অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে জিতেছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভি। সেখানে বিএনপি প্রার্থী দেয়নি। অর্থাৎ দলগতভাবে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছিল। এভাবে প্রতিটি নির্বাচনেই ২০ দলীয় জোট বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল। মূলত তখন থেকেই ফন্দি এঁটে এসেছেন ক্ষমতাসীনরা, যার বাস্তবায়ন ঘটানো হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। পাঁচ সিটির মেয়ররা শুধু নন, একই অবস্থায় পড়েছেন কাউন্সিলরসহ বিভিন্ন পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও- যারা ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। প্রত্যেককেই কয়েক মাস ধরে পুলিশের ধাওয়ার মুখে রাখা হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে ডজনের বেশি নাশকতা ও খুনের মামলা দিয়েছে পুলিশ। অনেকে এরই মধ্যে কারাগারেও স্থান পেয়েছেন। এর ফলে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
আমরা সব সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃত্ব দখলের লক্ষ্যে সরকারের কৌশল ও স্থানীয় সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই। ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দখল নেয়া। ভোট জালিয়াতি ও সন্ত্রাসের পথে সে দখল তারা নিয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা চাচ্ছেন সকল সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিজেদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। জনসেবা ও উন্নয়ন ধরনের বাগাড়ম্বর করা হলেও অন্তরালের উদ্দেশ্য আসলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দলীয় লোকজনের পকেট এবং দলের তহবিল স্ফীত করা। এজন্যই নির্বাচনে আবারও কুপোকাত হওয়ার পরিণতি এড়ানোর কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। সর্বাত্মক দমন-নির্যাতন চালানোর এবং মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাজানো মামলায় ফাঁসানোর মধ্য দিয়ে এমন এক ত্রাসের রাজত্ব তারা কায়েম করেছেন যাতে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের কেউ এমনকি প্রার্থী হওয়ারও সাহস না পান। যাতে ফাঁকা মাঠ পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেই দখল ও তছনছ করতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। আমরা এই গণবিরোধী নীতি-উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই এবং মনে করি, গণতন্ত্রের ব্যাপারে আদৌ সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত ২০ দলীয় জোটকে ধাওয়ার মুখে রাখার পরিবর্তে অবিলম্বে দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও মামলার অভিযান বন্ধ করা। সরকারকে একই সাথে মেয়র ও কাউন্সিলরসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যেককে যার যার পদে পুনর্বহাল করতে হবে। আমলা এবং দলীয় লোকজনকে মেয়র বা প্রশাসকের পদে বসানোর চিন্তা বাদ দিয়ে সুযোগ দিতে হবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে।

Ads