শনিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জহির রায়হানের মৃত্যু রহস্য : কতিপয় নেপথ্য ঘটনা


গত ৩০ জানুয়ারি ছিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের মৃত্যু দিবস। তার মৃত্যু রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ রেরিয়ে আসছে। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর যাওয়ার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের অন্তর্ধানকে হত্যাকান্ড হিসেবে বর্ণনা করে সেই হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব (তাদের ভাষায়) ‘রাজাকার’দের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ, মে. জে. (অব.) মঈন, মে. জে. (অব.) ইব্রাহিম প্রমুখ অফিসার বলতে চেয়েছেন যে, মিরপুরে ৩০ জানুয়ারি বিহারীদের গুলীতে তিনি নিহত হয়েছেন। কিন্তু জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্য ঘাঁটতে গিয়ে এমন কিছু ব্যক্তির এমন কতগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেল যেগুলো পড়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে জহির রায়হানের শালী অভিনেত্রী ববিতা, জহির রায়হানের ভাবী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার এবং ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির প্রমুখের কাছ থেকে। এছাড়াও এদের জবানীতে সত্যজিৎ রায় এবং শেখ মুজিবের যেসব উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেননি। তার পরেও বেশ কয়েকদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। এদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাংলাদেশে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যেই ছিলেন।
ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করলে তার মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব তৎকালীন প্রশাসনকেই গ্রহণ করতে হয় এবং (তাদের ভাষায়) রাজাকার বা দালালদের ওপর কোনভাবেই চাপানো যায় না। এই কলামে নিজস্ব মন্তব্যের পরিবর্তে ওপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের উদ্ধৃতি এবং মন্তব্য ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যখন অপপ্রচার এবং উস্কানিমূলক প্রচারণার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন তখন এসব ব্যক্তিবর্গের সেদিনের উক্তি এবং আজকের ভূমিকা মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের আলোকবর্তিকা দেখাতে সাহায্যে করবে।
॥ দুই ॥
সেই সময়কার সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সংখ্যাটি ছিল ১৯৯২ সালের ১ মে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আজকের আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ঘাদানিক সংগঠক শাহরিয়ার কবির। তাদের সংলাপের অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে সত্যজিৎ রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন...
-“জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?”
শাহরিয়ার কবির, “তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেটাই ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো করণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, যে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল।”    
১৯৯২ সালেও শাহরিয়ার কবির মনে করতেন যে, জহির রায়হানকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পরেও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে ঘাদানিক নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বলুন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানকে আটকে রাখার ক্ষামতা ছিল কাদের? বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে জহির রায়হানের হাতে এমন কিছু তথ্য এসেছিল যেটা রথী-মহারথীদের জন্য ছিল বিপজ্জনক। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের আমলে কারা ছিলেন রথী-মহারথী? যে বিপজ্জনক তথ্যের জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল সেসব তথ্য কাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল? তাদের ভাষায় ‘রাজাকার’ এবং ‘পাকিস্তানী দালালদের’ রাজনীতি তো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারা তাহলে জহির রায়হানকে সরিয়েছে? যুদ্ধাপরাধী বা দালালদের বিচার করতে গেলে এসব প্রশ্ন এসে পড়বে।
॥ তিন ॥
পান্না কায়সার সাবেক আওয়ামী এমপি। জহির রায়হানের বড় ভাই পরলোকগত শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী। বাংলা ১৩৯৯, ১০ জৈষ্ঠ্য, ইং ১৯৯২ দৈনিক ‘বাংলার বাণী’তে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত¦না’। এই নিবন্ধে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ আফিসার লেফটেন্যান্ট সেলিম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আলোচ্য নিবন্ধের এক স্থানে পান্না কায়সার বলেছেন, “৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। একথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের কথা। সেলিমও নাকি সেরকমই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দু’জনের ভাগ্যে একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দু’জনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সমস্ত কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক কষ্ট করেও কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হান নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোন কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজগুলোর কোন হদিসই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেলে হয়তো পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির অন্য কেউ কাজে লাগাতে পারতেন। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন একথা আমি আগে জানতাম না। আমি কেন, আর কেউ জানে কিনা তাও জানি না। জহির রায়হান ও সেলিমের নিখোঁজ রহস্য এখন আমার কাছে আরও রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা যেমন ৭১ সালে গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ হয়েছিল সেদিন।”
পান্না কায়সার নিজেই বলেছেন যে, খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে সেটা ভাবনারও অতীত। জহির রায়হানের সাথে লেফটেন্যান্ট সেলিমও বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ সম্পর্কিত কাগজপত্র জহির রায়হান এবং সেলিম উভয়ের কাছ থেকেই উধাও হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? ‘রাজাকার’ বা ‘পাকিস্তানপন্থীরা’ অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশপাশে ছিলেন।
॥ চার ॥
তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার এমন একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিভাবান মানুষের নিখোঁজ হওয়ার বিষয় তদন্ত না করায় এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে গেছে। অথচ বিভিন্ন মহল জহিরের হত্যাকা-ের জন্য ভারতের স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তিকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছে। এই অভিযোগকে সর্বশেষ সমর্থন করলেন জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বিশিষ্ট নায়িকা ববিতা।
ববিতা বলেছেন, “যুদ্ধের নয় মাসে অনেকের কা-কীর্তি ফাঁস করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই জহিরকে ফাঁদে ফেলে মিরপুর নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরিকল্পনামাফিক তাকে সরিয়ে দেয়া হয় পৃথিবী থেকে। বেক্সিমকো গ্রুপের রম্য পাক্ষিক পত্রিকা ‘আনন্দ ভুবন’ এর ১৬ মার্চ, ‘১৯৯৭ সংখ্যায় ‘কুলায় কালস্রোত’ বিভাগে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ শিরোনামে তিনি অতীত স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি মরহুম জহির রায়হানের স্ত্রী আরেক নায়িকা সুচন্দার ছোট বোন ববিতা।
জহির সম্পর্কে বলতে গিয়ে, ববিতা উল্লেখ করেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জহির ভাই কলকাতায় ছিলেন। ওপেনলি পার্টি করতেন না। তবে গোপনে করতেন। অনেক লোকজন আসতো তার কাছে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এলেন। তখন তাকে খুব অসহায় দেখেছি। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে পাক সেনারা মেরে ফেলেছে। ওর জন্য জহির ভাই প্রায় পাগলের মতো হয়ে পড়েছিলেন। তখন ভাইকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে যা বলতেন, তাই করতেন। একবার একজন এসে বললো, আজমীর গিয়ে বাবার কাছে দোয়া চাইলে বড়দাকে পাওয়া যাবে। জহির ভাই বৌ, ভাবীকে নিয়ে আজমীর গিয়ে পড়ে থাকলেন কয়েকদিন।
কারা যেন এসে বললো, প্লানচেট করলে বড়দার খোঁজ পাওয়া যাবে। জহির ভাই তাই করলেন। যে যা বলছে, তাই বিশ্বাস করেছেন। সেয়াস (প্রেতচক্র) করলেন। আত্মা এসে বললো বড়দা মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে আছেন খুব অসহায় অবস্থায়, তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। জহির ভাই বাসায় কাউকে কিছু না বলে মিরপুর গেলেন। যাওয়ার সময় শুধু বললেন, তোমরা সবাই আজকে নামায কালাম পড়ো। আমি তোমাদের অবাক করে দেয়ার মতো একটা কাজ করবো। এই বলে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না। তার সাথে ছিলেন একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার। সেই ব্রিগেডিয়ারের রাতে আমাদের বাসায় ডিনার করার কথা ছিল। সন্ধ্যার সময়ে ব্রিগেডিয়ার সাহেব আমাদের গেন্ডারিয়ার বাসায় ফোন করে বললেন, ডিনার খাওয়া হবে না। কেননা জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বললাম, কেন উনিতো আপনার সাথেই বেরিয়ে গেছেন। উনি বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু ওখানে গিয়ে একসময়ে উনি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, এই বলে ফোন রেখে দিলেন।
আমার মনে হয়, জহির ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ভারত থেকে ফিরে আসার পর একবার এক মিটিংয়ে উনি বলেছিলেন “যুদ্ধের নয়মাস আমি কলকাতায় ছিলাম। আমি দেখেছি সেখানে কে কি করেছে। কে দেশের জন্য করেছে, আর কে নিজের আখের গুছিয়েছে। আমার কাছে সব রেকর্ড আছে। আমি সব ফাঁস করে দেব। এটাই জহির রায়হানের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই আজমীরে যাওয়া, ওই সেয়াস করা, এগুলোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল তাকে মিরপুরে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যা করা।”
॥ পাঁচ ॥
জহির রায়হানের আকস্মিক মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে সহায়ক হতে পারে আরেকটি তথ্য। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক লেখায় তিনি বলেছেন, “চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে আমার কলকাতায় পরিচয় ঘটে। তার থাকবার কোন জায়গা ছিল না প্রথমে। আমি তাকে তিন মাসের জন্য থাকবার একটা খুব ভাল ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম কলকাতায়। দেশে ফিরবার পর তিনি মারা যান। তাকে মেরে ফেলা হয়। কেন, কি কারণে, কারা তাকে মেরে ফেলে আমি তা জানি না।”
ড. সামাদ আরো বলেছেন, ৭ ডিসেম্বর (৭১) কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি উৎসব হয়। রায়হান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমিও ছিলাম। তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন আমার দু’সারি আগে। হঠাৎ তাকে বলতে শুনি “দেশকে দু’বার স্বাধীন হতে দেখলাম। আবার একবার স্বাধীন হতে দেখবো কিনা জানি না।” কেন তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন, তা ভেবে আমার মনে পরে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। তার মৃত্যু আজো হয়ে আছে রহস্যঘেরা।
জহির রায়হানের উপরোক্ত মন্তব্যে দেখা যায়, তিনি ৪৭ সালে ইংরেজদের বিদায় এবং ভারতবর্ষ বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবর্তন, তথা পাকিস্তানের জন্মকেও স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার চেয়েও বেশি তাৎপর্যম-িত ব্যাপার হলো, রাজনৈতিকভাবে মওলানা ভাসানীর অনুসারী জহির খুব সম্ভব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভবিষ্যতে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ কবলিত হওয়া এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জনগণের বিজয় অর্জনের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর এই ইঙ্গিত উপলব্ধি করে কট্টর ভারতপন্থী মহল এবং তাদের গুরুদের গা-জ্বালা ধরে যাওয়াই স্বাভাবিক। তখনকার পরিস্থিতিতে খোদ কলকাতায় বসে প্রকাশ্যে এমন উক্তি করা তাদের কাছে ‘স্পর্ধা’ বলে মনে হতে পারে। হয়তো এই দুঃসাহসের মূল্য হিসেবেই জহিরকে জীবন দিতে হয়েছে।
আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। এ বিশ্বাস এখনো আমার আছে, বলেছেন ড. সামাদ।
॥ ছয় ॥
জহির রায়হানের মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলেছেন তার প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী। তিনি বলেন, সেদিন বাড়ি থেকে জহির কিভাবে কেমন করে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি দেখিনি। কারণ আমি তখন মোহাম্মদপুরে তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকি। পরে আমার ননদ জহিরের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়ার কাছে বিস্তারিত শুনেছি। সেদিন সকাল আটটার দিকে জহিরের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। সেদিন রফিক নামে কেউ একজন ফোন করেছিল। আমরা যে রফিককে চিনতাম তিনি ইউসিসে চাকরি করতেন। তার সঙ্গে আমারই প্রথম পরিচয় ছিল। পরে আমিই তাকে জহিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। টেলিফোনে সে জহিরকে বলেছিল, আপনার বড়দা মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। অন্য কেউ যদি সেখানে যায় তাহলে আপনার বড়দার ডেডবডি আসবে বাড়িতে।
টেলিফোন পেয়েই জহির প্যান্ট পরে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর বাড়িতে ফিরে আসেনি জহির। কোথাও ফিরে আসেনি।
একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বলেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে। (তথ্য সূত্র: শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত “একাত্তরের অবিরাম রক্তক্ষরণ”, আসলাম সানী রচিত “শত শহীদ বুদ্ধিজীবী”)।
আসিফ আরসালান 

বৃহস্পতিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ প্রসঙ্গে


সন্ত্রাস-নাশকতা ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড দমন করার জন্য যখন যেখানে যা করা দরকার তা-ই করার জন্য পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত বুধবার পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, যারা  পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষকে পোড়াবে বা আঘাত করবে তাদের বিরুদ্ধে যত কঠিন ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেটাই আপনারা নেবেন। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলবে না। প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। যা কিছুই হোক তার দায়িত্ব  নিজে নেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, সরকার প্রধান হিসেবেই তিনি এ নির্দেশ দিচ্ছেন। চলমান অবরোধ, হরতাল এবং নাশকতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আরো কিছু কথা বললেও পুলিশের উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ নিয়েই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশি আলোচনা চলছে। সচেতন সকল মহলেও ঘটেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। পুলিশের সাবেক আইজি ও সাবেক সচিবসহ বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, সংবিধান এবং প্রচলিত আইন-কানুন অনুযায়ী জনগণের জানমালের হেফাজত করাই আইন-শৃংখলা বাহিনী হিসেবে পুলিশের প্রধান দায়িত্ব। কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে তাও পুলিশের আইনে লিখিত রয়েছে। প্রশিক্ষণকালে এসব বিষয়ে শেখানো হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী সে দায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর থাকতে পুলিশকে তাগিদ বা নির্দেশ দিতে পারেন। পুলিশেরও উচিত তার আইনানুগ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়া। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় ও সুরে নির্দেশ দিয়েছেন তার ফলে আইনের বরখেলাপ হতে পারে, অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যরা এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এবং আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা চালাতে পারেন। এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিশিষ্টজনদের এমন উদ্বেগ ও আশংকার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। কারণ, বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সারা দেশে যখন অবরোধ চলছে তখন দাবি মেনে নেয়ার এবং সমঝোতার পথে পা বাড়ানোর পরিবর্তে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেফতার এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের ভয়ংকর অভিযানে নেমেছে বলে অহরহ অভিযোগ উঠছে। র‌্যাব ও বিজিবি অংশ নিলেও এসব কাজে প্রধানত পুলিশকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এমনকি গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে। পুলিশকে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। পুলিশ কখন কাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে, কখন কোথায় কোন দলের নেতা-কর্মীর লাশ পাওয়া যাবে- এ ধরনের আতংকের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে দেশবাসীকে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে পড়েছে বলেই পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ নির্দেশ নতুন করে প্রচণ্ড ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি করেছে। তিনি শুধু ব্যবস্থা নিতে বলেননি, যখন যেখানে যা করা দরকার তা-ই করার, যত কঠিনই হোক সে ব্যবস্থা তো বটেই, প্রয়োজনে ‘সর্বোচ্চ ব্যবস্থা’ নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আমরা মনে করি না যে, প্রধানমন্ত্রীর কথার অর্থ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে। বাস্তবে নির্দেশের আড়ালে তিনি যখন যেখানে যা খুশি তা-ই করার অনুমতি দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীকে। সহজ কথায় বলা যায়, পুলিশকে ‘ওপেন লাইসেন্স’ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশ এমনকি হত্যা করারও অঘোষিত অনুমতি পেয়ে গেছে। উদ্বেগের কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই প্রচণ্ড দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে একের পর এক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হত্যার মহোৎসব শুরু হয়েছে, তার ওপর ‘সর্বোচ্চ ব্যবস্থা’ নেয়ার মতো কর্মকাণ্ডের জন্য ওপেন লাইসেন্স তথা অনুমতি দেয়া হলে এবং যে কোনো কাজের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজে বহন করতে সম্মত হলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতিই ঘটতে থাকবে। আর প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং দল দুটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাই যে প্রধান শিকারে পরিণত হবেন তার প্রমাণ তো এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে অত্যন্ত বিপদজনক এবং সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী বলে মনে করি। আমাদের মতে সত্যিই নাশকতার অবসান ঘটাতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিরোধী দলের সাথে আলোচনা ও সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া। কারণ, দাবি পূরণ হয়নি বলেই অবরোধের ডাক দেয়া হয়েছে আর অবরোধের সুযোগ নিয়েই ঘাতক-সন্ত্রাসীরা নাশকতা চালাচ্ছে- যারা অন্তত বিএনপি বা জামায়াতের কেউ নাও হতে পারে। আমরা তাই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার আগেই সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাই।

বুধবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গুলী করে জনগণের আন্দোলন দমন করা যায় না


রাজনৈতিক অস্থিরতায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মরছে মানুষ, পুড়ছে যানবাহন। প্রতিদিনই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। গোটা দেশ অচল হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন ক্রমেই প্রচন্ড রূপধারণ করছে। সরকার সংলাপ-সমঝোতার পরিবর্তে কঠোরতম পন্থা অবলম্বন করেছে। গুলী এখন আন্দোলন দমনের প্রধান হাতিয়ার। বিরোধী মত বলতে কিছুই নেই। সাধারণ মানুষ পার করছে অনিশ্চিত জীবন। সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করছে। সরকার নিজেই হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও তা-ব সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত। দেশের বুদ্ধিজীবী, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ কারো অভিমতের কোনো মূল্যায়ন করছে না সরকার। জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার চলমান সংকটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ এবং তা নিরসনে সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান আমলে নিচ্ছে না বর্তমান সরকার। দেশ, দেশের অর্থনীতি, জনগণের জীবন বিপন্ন প্রায়। আর সরকার ব্যস্ত দমন-পীড়নের মাধ্যমে নিজেদের গদি রক্ষায়।
বাংলাদেশ সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এটা কোনো দল বা ব্যক্তির একার দেশ নয়। অধিকাংশ মানুষের পছন্দের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রকাশিত হয় রাজনৈতিক দলসমূহের মাধ্যমে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সাথে কমবেশি জনসম্পৃক্ততা রয়েছে। সুতরাং কোনো রাজনৈতিক দলকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। গণতন্ত্রে বহুদলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ভিন্ন মত ও দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না, গণতন্ত্র টিকে না। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক নাগরিকের সভা-সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে। এটা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র যখন এ অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে বা তা হরণ করে তখন তা হয় সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান লংঘন করে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশে ভিন্ন মত উৎখাতের যে অভিযান চলছে তা উদ্বেগজনক। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডিজিটাল কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর চড়াও হতে থাকে। সভা-সমাবেশ ও মিছিলের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা আদালতের দোহাই দিয়ে বাতিল করা হয়। অথচ আদালতের ঐ রায়েই পর পর দুটো নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল। সংকটের সূত্রপাত ওখান থেকেই। জনগণের প্রচ- আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্যে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসলে সরকার একতরফা নির্বাচনের নানান বাহানা খুঁজতে থাকে। জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিমত অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়। জনগণ সে নির্বাচন বয়কট করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভোটারবিহীন এ ধরনের নির্বাচন অতীতে কোনো স্বৈরশাসকের আমলে আর দেখা যায়নি। ১৫৪টি আসনে বিনা নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা, অবশিষ্ট আসনগুলোতে শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। নির্বাচনের এ করুণ অবস্থা দেখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতারা নিয়ম রক্ষার দশম সংসদ নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তারা আরো ঘোষণা করেছিলেন, ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সমঝোতায় আসলে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।’ তিনি আলোচনা চলতে থাকবে বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতা দখল করার পর তাদের সে বক্তব্যের সুর পাল্টে যেতে লাগলো। শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা বলতে শুরু করলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকবে।
তামাশার নির্বাচনের ১ বছর পেরিয়ে গেলো। আওয়ামী নেতৃবৃন্দ জোর গলায় বলার চেষ্টা করছেন নির্বাচনের যেহেতু অনেক সময় বাকি সুতরাং এত আগেভাগে আলোচনার দরকার নেই, সমঝোতারও প্রয়োজন নেই। শুধু তাই নয় তারা বিরোধী ২০ দলীয় জোটকে কোনো ধরনের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে দিতে রাজি নয়। ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ৫ জানুয়ারির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অবরুদ্ধ করে রাখে ২০ দলীয় জোটনেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। সরকার নিজেই সারাদেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হন। অবরোধের পাশাপাশি চলতে থাকে হরতাল। হরতাল-অবরোধে গোটা দেশ আজ অচল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতি স্থবির, জনজীবন বিপর্যস্ত। প্রতিদিনই ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। সরকার পুলিশ প্রহরায় যানবাহন চালানোর ঘোষণা দেয়। যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাও বলে। পুলিশ প্রহরায় চলন্ত যানবাহনে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার ঘটনা এবং দুষ্কৃতকারীদের ধরা না পড়া খুবই রহস্যজনক। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সরকারদলীয় ক্যাডাররা পরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালিয়ে বিরোধী দলকে দায়ী করছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরায় কিভাবে মানুষ খুন হয় তার জবাবদিহি করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের।
রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘর থেকে ধরে নিয়ে নির্দয়, নিষ্ঠুরভাবে মানুষ হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে ঘোষণা দিচ্ছেন ‘ক্রসফায়ারে নিহত’ বলে। ইতোমধ্যেই নড়াইলের নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার এডভোকেট ইমরুল কায়েসকে গুলী করে হত্যা করার পর বলা হলো ‘ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে’। খিলগাঁওয়ের ছাত্রদলের ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদককে ধরে নিয়ে গুলী করে হত্যা করার পর তাকে ‘ক্রসফায়ারে নিহত’ বলে প্রচার করা হলো। রংপুরের মিঠাপুকুরে জামায়াত নেতা আল-আমিন ও তার স্ত্রী বিউটি বেগম এবং প্রতিবেশী মৌসুমীকে ঘরে থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় নিয়ে আল-আমিনের গায়ে গুলি চালানো হয় এবং হাত ভেঙে দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত তারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের কোনো সন্ধান নেই। দেশ যেন আজ এক সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এভাবে চলতে পারে না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে হয়। কিন্তু আওয়ামী সরকার আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে দমন-পীড়ন আর গুলী করেই সংকটের সমাধান করতে চাচ্ছে। সরকারের এই মনোভাব কিছুতেই দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে না।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের গুলী করে দমন করা হবে বলে প্রথম ঘোষণা দেন জাসদের নেতা মইনউদ্দিন খান বাদল। তিনি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সরাসরি বুকে গুলী চালানোর কথা বলেছেন। ১৮ জানুয়ারি খাদ্যমন্ত্রী বিবিসি সংলাপে বলেন, ‘অস্ত্র দিয়েই বিএনপির সন্ত্রাস দমন করা হবে’। ২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার সমাজকল্যাণমন্ত্রী বললেন, ‘দৃষ্কৃতকারীদের দেখামাত্রই গুলীর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার’। সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাদের এই যদি হয় অবস্থান, তাহলে দেশের পরিণতি কত বিভীষিকাময় হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের গুলী করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। ১৫ জানুয়ারি বিজিবি মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি বোমা ফাটায়, তাহলে ৫ জন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ঐ বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালটি (হতাহত) করা তার দায়িত্ব।’ বিজিবি মহাপরিচালকের এ ঘোষণা অসাংবিধানিক, বেআইনি এবং আইনগত এখতিয়ারবহির্ভূত। যদি কেউ বোমা ফাটায় তাহলে প্রচলিত আইনে তার বিচার করার সুযোগ আছে। কিন্তু বিচারের আগে তাকে গুলী করার অধিকার বিজিবি বা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়নি। এদেশের মানুষকে হত্যা করার কোনো অধিকার বিজিবির নেই।
১৬ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক বলেন, ‘বিএনপির ভুলের খেসারত জনগণ দেবে না। ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করতে দিলে যদি হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হতো তখন টকশোওয়ালারা কি করতেন? এর দায় পড়তো সরকারের ওপর।’ পুলিশের আইজি আরো বলেন, ‘একটা দলের প্রধান তিনি যদি বেআইনি কাজ করেন তার কাছ থেকে জনগণ কি চাইবে? আপনারা ভোট প্রতিরোধ করলেন। ভোট কেন্দ্রে লোক আসতে দিলেন না। ভোটের কেন্দ্রগুলো যেখানে- সেই স্কুল, কলেজ, মাদরাসাগুলো পুড়িয়ে দিলেন, মানুষ মারলেন, জনগণকে ভোটের অধিকার দিলেন না কেন? ভুল আপনারা করেছেন জনগণ খেসারত দিবে কেন? এই দেশে আমরা তা করতে দেব না ইনশাআল্লাহ্। আমরা গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে। আমরা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে কাজ করে যাবো। কোনো অপশক্তি, কোনো সন্ত্রাসী বাংলার মাটিতে কখনো তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ সেটা আমরা নির্মূল করে ছাড়বো। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষে থেকে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও নাশকতা নির্মূলে কাজ করে যাবো। জনগণকে সাথে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হবে।’ (মানবজমিন, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫)
এই বক্তব্য পাঠ করলে সকলেরই ধারণা হবে এটা আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বক্তব্য। বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান এ ধরনের বক্তব্য রাখতে পারেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। তিনি বিরোধী রাজনীতি নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশের এই রাজনৈতিক বক্তব্য জনগণের শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবর্তে তা বিঘিœত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
র‌্যাবের ডিজি বেনজির আহমেদ বলেছেন, ‘নির্ধারিত সময়ের পরই নির্বাচন হবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এর বাইরে আমরা আর কোনো কিছুই চাই না। ২০১৩ সালের মতো একটি গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা দেশের গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে। তারা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। তারা সন্ত্রাসী। তারা গণতন্ত্রের নামে বোমাবাজি করে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এসব খুনিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। দেশবাসীকে সাথে নিয়ে এগুলোকে ২০১৩ সালে আমরা একবার রুখে দিয়েছি এবারও রুখে দেবো ইনশাআল্লাহ।’ (মানবজমিন, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫)
র‌্যাবের ডিজির বক্তব্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রতি ইঙ্গিত করে যেসব কথা বলা হয়েছে তা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্যের ভাষার মতোই। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যৌথ বাহিনীর অভিযানে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ৭১-এর শরণার্থীর মতো লোকজন পালিয়ে যাওয়ার ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি সরকারের দলীয় বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। একদিকে ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বে চলছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। অপরদিকে সরকার, সরকারদলীয় ক্যাডার ও রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ক্রমেই সংঘাত, সংঘর্ষ বিস্তৃত হচ্ছে। ছাত্রদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস প্রায়। এসব কিছুর মূলে সরকারের একগুঁয়েমি, অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক কর্মকা- এবং জোর করে ক্ষমতায় থাকার মানসিকতা। এটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য নয়। যারা জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তা-বতা সৃষ্টি করেন তাদের দ্বারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাহলে সমস্যার সমাধান কোথায়? এর উত্তর হলো যখন মানুষের বাঁচার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায় তখনই গড়ে উঠে প্রতিরোধ আন্দোলন। আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন মানুষের বাঁচার সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে জালেম সরকারের পতন ঘটায়।
বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ বাঁচার তাগিদে ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণের এই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গুলী করে দমন করা যাবে না। সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমেই এ সংকটের অবসান হতে পারে। আর এ সংলাপ-সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার প্রধান দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি আলোচনার টেবিলে সমস্যার সমাধান না করে বন্দুকের গুলী দিয়ে সমাধান করতে চান তাহলে হয়তো মানুষ খুন করা যাবে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। একটি খুনের রক্ত থেকে লক্ষ প্রতিবাদী শক্তির উদ্ভব ঘটবে। এটাই আন্দোলনের ইতিহাস। এতদিন এ আন্দোলনের পথেই আওয়ামী লীগ হেঁটে এসেছে। তারাই আজ গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে স্বৈরাচারের লেবাস ধারণ করে জনগণের বুকে গুলী চালাচ্ছে। এর চূড়ান্ত পরিণতি একদিন আওয়ামী লীগকেই ভোগ করতে হবে।
মতিউর রহমান আকন্দ 

মঙ্গলবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সত্য কি অবিরাম সমাহিত হতে থাকবে?


গত ২৪ জানুয়ারি অত্যন্ত আকস্মিকভাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো মাত্র ৪৫ বছর বয়সে বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে বারোটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় ইন্তেকাল (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন) করেছেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এক গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশী-বিদেশী চক্রান্তে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে শহীদ হন। তারপর থেকেই বেগম খালেদা জিয়া তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে আঁকড়ে জীবনযাপন করতে থাকেন। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্রের জাল পাকিয়ে তুলছিলেন জিয়াউর রহমানেরই মনোনীত পাকিস্তান-প্রত্যাগত অমুক্তিযোদ্ধা লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ ডিসেম্বর এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। তার এই সামরিক শাসন জারিতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া ছিল,‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপী (আমি অখুশি নই।)’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদিত দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকা অত্যুৎসাহে গণতন্ত্র হত্যার এই খবরের শিরোনাম করেছিল, ‘এক ফোঁটা রক্তও নয়, একটি গুলীও নয়।’ গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে সামরিক শাসন জারি হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের আনন্দের কোনো সীমা থাকলো না। কেন রইলো না? গণতন্ত্র থাক বা না থাক, বিএনপি তো গেছে। এতেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের আনন্দের সীমা ছিল না।
সেই থেকে ঘৃণার শুরু। ঘৃণা কোনো সুকুমার অনুভূতি নয়। কিন্তু ঘৃণার রাজনীতিই আওয়ামী রাজনীতি একমাত্র ভরসা। কার বিরুদ্ধে কত কুৎসা রটনা করতে পারলাম, অপরের মুখ কতটা ম্লান করে দিতে পারলাম, সম্মানিত ব্যক্তির মুখ কতটা ছোট করতে পারলাম, সেটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য। সম্মান-শ্রদ্ধা তারা অর্জন করতে চায় আইন করে। সম্মান কি আইন করে পাওয়া যায়? নাকি সম্মান পেতে হয় আচরণের মাধ্যমে? এই বোধ আওয়ামী নেতানেত্রীদের নেই। এদেশের মানুষ ষোলো কোটি। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ষাটোর্ধ্ব। যাদের বয়স ষাটের উপরে তাদের পক্ষে আওয়ামী নির্দেশ অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে দেবতা জ্ঞান করা সম্ভব নয়। আমরা সব সময় বলেছি, শেখ মুজিবুর রহমান দোষেগুণে মানুষ ছিলেন। তিনি দেবতাও ছিলেন না, ফেরেশতাও ছিলেন না। তিনি মানুষ ছিলেন। মানুষের ভুলত্রুটি থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কিংবা তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডও প্রশ্নাতীত ছিল না। তিনি যা বলেননি বা বলতে চাননি, সেটি এখনকার সরকার দেশবাসীকে বলতে বাধ্য করতে চাইছে।
অতীত ইতিহাসের দিকে গেলে অনেক তিক্ত কথা উঠে আসবে। সেদিকে আমরা একেবারে না গিয়ে পারবো না। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সা¤্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির সম্মিলিত চক্রান্তে জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ফখরুদ্দিন আহমদের মতো এক সা¤্রাজ্যবাদীর সেবাদাসের নেতৃত্বে যে সরকার এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা ছিল বাংলাদেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম সরকার। এরা ছিল আসলে এক লুটেরা দল। বিএনপির দুর্ভাগ্য এই যে, বিএনপির যারা এই অনুগ্রহ গ্রহণ করেছে তারা সবাই বিএনপির বুকে-পিঠে ছুরি মেরেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এরশাদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। সে এরশাদ জিয়াউর রহমানকে হত্যার যাবতীয় ষড়যন্ত্র করেন। এবং ক্ষমতা দখল করেন। বিশ্বাসঘাতক জেনারেল মইন উদ্দিনকে বেগম খালেদা জিয়া কয়েকজনকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করেছিলেন। আহ্! মুহাম্মদী বেগের মতো বিএনপির পৃষ্ঠদেশে এই বেঈমান আমূল ছুরি চালিয়ে দিয়েছে।
মীর জাফররূপী এই জেনারেল বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করেছে। তারেক রহমানকে কারারুদ্ধ করে তার মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে। আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করে ড্রাগ দিয়ে তার হৃদপিন্ড দুর্বল করে দিয়েছে। এইখানে হয়তো মইন-প্রেমিকরা বলতে পারেন যে, এগুলো সত্য নয়। তাহলে আমরাও প্রশ্ন করতে পারি যে, শেখ হাসিনা যখন কারারুদ্ধ ছিলেন তখন তিনি বললেন, তাকে হত্যার জন্য মইন-ফখরের সরকার আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করেছিল। উনার এক লাফাঙ্গা চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মোদাছছের হোসেন বললেন যে, আর্সেনিক বিষপ্রয়োগের ফলে শেখ হাসিনা কানে শুনতে পাচ্ছেন না। এই খবরের পাশাপাশি ঢাকার সংবাদপত্রে একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। শেখ হাসিনা দুই কানে দুই টেলিফোন নিয়ে কথা বলছেন। যদি কানেই শুনতে না পান, তাহলে দুই কানে দুই টেলিফোন নিয়ে তিনি কী করছিলেন?
অপরদিকে তারা যাকে হত্যার চেষ্টা করলো বলে তিনি অভিযোগ করলেন, আর্সেনিক প্রয়োগ করলো বলে তিনি জানালেন, কানে শুনতে পাচ্ছেন না বলে তিনি অভিযোগ করলেন, ডাক্তারদের দিয়ে বলালেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ, বিদেশের চিকিৎসা না করতে পারলে এক্কেবারে শেষ। সেভাবেই সবকিছু চলল। মইনের বর্ণচোরা সরকার পরে শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবার অনুমতি দিল। সেখানে গিয়ে তিনি রাজনীতি শুরু করলেন। পরে এইসব স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে চেপে গেলেন। এখন আর উনাদের নাম শোনা যায় না।
কিন্তু বেগম খলেদা জিয়া রয়ে গেলেন বাংলাদেশেই। ঐ সরকার তাকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দেবার হেন কোনো চেষ্টা নেই, যা করেনি। কিন্তু রাজি হননি বেগম খালেদা জিয়া। ঐ সরকারের মূল উদ্দেশ্যই যেন ছিল জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া। তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে আটক করে তার ওপর করা হয় অমানুষিক নির্যাতন । ভেঙে দেয়া হয় তার মেরুদন্ড। তিনি এখনও লন্ডনে চিকিৎসাধীন আছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কোনো রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা ছিল না। খেলাধূলা আর ছোটখাটো ব্যবসা নিয়েই ছিলেন তিনি। ঐ সামরিক সরকার তাকেও আটক করে তার ওপরও চালায় অমানুষিক নির্যাতন। তাতে তিনিও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্যারোলে মুক্তি লাভ করে তিনি চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান। সেখান  থেকে যান মালয়েশিয়ায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
দীর্ঘ সাত বছর তিনি স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ বিদেশে। এর মধ্যে মাত্র একবার বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। ঐ সময় খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। বড় ছেলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী-কন্যার সঙ্গেও এই সাত বছরে বেগম খালেদা জিয়ার দেখা হয়েছে একবারই।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুসংবাদ তার জন্য যে কতটা শোক ও বেদনার ছিল, সেটা যেকোনো সুস্থ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই উপলব্ধি করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই এ সংবাদে তার ভেঙে পড়ারই কথা। তার মধ্যেই ও বাড়ির গেইটে এক দারুণ নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি চলছে। এরসঙ্গে মাঝেমধ্যে যুক্ত হচ্ছে হরতালের কর্মসূচি। ২০ দলীয় জোট নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। হাজারে হাজারে নেতাকর্মীকে প্রতিদিন আটক করা হচ্ছে। ক্রসফায়ারের নামে প্রতিদিন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। তাদের গুম করা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার নানা কোশেশ করা হচ্ছে। তার ছেলেদের বিরুদ্ধে নাহক মামলা চালানো হচ্ছে। এখন ছোট ছোট মুখে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলা হচ্ছে।
এমন এক সময়ে গত ২৪ জানুয়ারী ছোট ছেলের মৃত্যু সংবাদে একেবারেই মুষড়ে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। শান্ত রাখতে চিকিৎসকরা তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। নাটকের শুরু এখান থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সন্ধ্যায় জানানো হয় যে, বেগম খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তার কার্যালয়ে আসতে চান শেখ হাসিনা। বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস রাত ৭টা ১০-এ প্রধানমন্ত্রীর এপিএসকে জানান, চিকিৎসকরা ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। ঘুম ভাঙলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের কথা জানানো হবে। তখনও যদি প্রধানমন্ত্রী আসতে চান, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী রাত সাড়ে আটটায় বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে এসে হাজির হন, যে কার্যালয়ে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে অত্যন্ত বেআইনীভাবে দু’ সপ্তাহ ধরে তালা মেরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী কোথায়ও গেলে সাধারণত দু’ একদিন আগে থেকে সে পুরো এলাকাটি এসএসএফের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এক ধরনের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। শেখ হাসিনা যখন বেগম খলেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান, তখন তার ভেতরে গিজগিজ করছিল শত শত নেতাকর্মীতে, যা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার অনুকূল ছিল না। সে রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে কেন তিনি গেলেন। নাকি তিনি যেতে চেয়েছিলেন ঐ গেট পর্যন্তই। এখন অভিযোগ করা হচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়ার অফিসের তালা খুলে কেউ তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন না কেন। বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এখন বাইরের তালা তারা খুলে দিলেও, ভেতরের তালা ঝুলানোই আছে। ছোট গেট দিয়ে আসা যাওয়া করছেন অফিসের কর্মীরা ও নেতানেত্রীরা। সেই পথে মাথা নিচু করে চরম অনিরাপত্তায় শেখ হাসিনার ঐ বাসভবনে যাওয়ার কথা কোনো সুস্থ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর এলো। তিনি নামলেন। মিনিট খানেক দাঁড়ালেন। তারপর আবার গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। হায় হায় রব তুললেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, দলকানা মিডিয়া এবং আরও অনেকে। অনেককেই বলতে শুনলাম, সঙ্কট সমাধানের একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করল বিএনপি। এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীর গুলশান ভ্রমণ কতটা আন্তরিক ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ঘণ্টা দুয়েক পরেই। দু’ ঘণ্টা পর যাত্রাবাড়িতে বাসে বোমা হামলার ঘটনায় সরকার শোকে মুহ্যমান খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করে মামলা দায়ের করে দিল। সমবেদনার আওয়ামী ভাষা এটাই। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো না জানানো নিয়ে যারা সমালোচনামুখর,  তারা আশা করি বুঝবেন, সরকারের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কোকোর মর্মান্তিক মৃত্যু, বোমা রাজনীতি ও আন্দোলনের যৌক্তিকতা


গত শনিবার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় ইন্তিকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিদেশের মাটিতে তার ইন্তিকালের বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজনীতিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ড নির্যাতনের যে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল বেগম জিয়া, তার দুই ছেলেসহ অন্য আত্মীয়বর্গও এর শিকার হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে জয় এবং অন্য স্বজনরাও এসব মামলার আসামী হয়েছিলেন। বেগম জিয়ার পরিবারের ক্ষেত্রে নৃশংসতা ও নির্মমতা সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল, তার দুই ছেলেকে এত নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল যে, তাদের বাঁচার সম্ভাবনাই ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসকের সুপারিশ অনুযায়ী প্যারোলে জামিন নিয়ে তাদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়। যাত্রার সময় তৎকালীন সরকারের নির্দেশে তারা মাসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঠিকমতো কথাবার্তা বলার সুযোগও পাননি। দুই ভাই এর এক ভাই যান লন্ডনে, অন্য ভাই ব্যাংককে। প্রায় ৫ বছর চিকিৎসা শেষে তারেক কিছুটা সুস্থ হয়ে চলাফেরা ও সীমিত আকারে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে সক্ষম হলেও কোকো অসুস্থই ছিলেন। তিনি ব্যাংকক থেকে বছরখানেক আগে মালয়েশিয়ায় এসে ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অব্যাহতভাবে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়া ব্যয় সাপেক্ষ বিধায় হাসপাতাল বাসা এই করেই চিকিৎসা চলছিল এবং শুক্রবার অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কেয়ারটেকার আমলে আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা ছিল এবং এর মধ্যে ৪টি মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তৎকালীন সরকার তাকে জাতীয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য এক সময়ে বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িতও করেছিলেন। তার দলের বহু নেতা আদালতে দন্ডিত হয়েছিলেন এবং এই দন্ড সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে ৩১ বছর পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। এই নেতারাই শুধু দন্ডিত হননি, তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতারাও দন্ডিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের নেতৃবৃন্দ এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন যারা দন্ডিত হয়েছিলেন অথবা মামলায় আসামী হয়ে পলাতক কিংবা জেলে ছিলেন তাদের সকলের মামলা তুলে নেন, দন্ড মওকুফ করান এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরৎ আনান। কিন্তু এই সরকার বেগম জিয়া, তার পুত্রসহ আত্মীয়-স্বজন এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দের বেলায় ভিন্ন নীতি অবলম্বন করেন। তারা তাদের মামলাসমূহ শুধু অব্যাহতই রাখেননি বরং তাদের নামে নতুন নতুন মামলাও রুজু করেন এবং বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করে দেন। এখানে এক যাত্রায় দুই ফল দেখা গেল এবং আওয়ামী লীগই সেটা করল। বেগম জিয়া ও তার দুই পুত্র এই প্রতিহিংসারই বলি।
আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু সংবাদ বেগম জিয়ার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি দুঃখিনী একজন মা, স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনহারা একজন হতভাগিনী বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি তার ভাই এবং বোনদের হারিয়েছেন। তার মাকে তিনি হারিয়ে ছিলেন মইন সরকারের হাতে গ্রেফতার অবস্থায় থাকাকালে। প্যারোলে তিনি এবং তার দুই সন্তান মায়ের লাশ দেখতে গিয়েছিলেন। তাদের এমনভাবে নেয়া হয়েছিল যে, এই বিপদের দিনে মা ছেলের চেহারা দেখতে পাননি আর ছেলেরা মায়ের চেহারা দেখতে পাননি। এই নির্মমতা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়।
কোকের মৃত্যু শোকে মুহ্যমান বেগম জিয়াকে গতকাল আরেকটি খবর শুনতে হলো, এই খবরটি হচ্ছে যাত্রাবাড়ীর কাঠের পুল নামক স্থানে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের অপরাধে বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী করে পুলিশের মামলা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কয়েক দিন আগেই এ ধরনের মামলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এর আগে বেগম জিয়া অবরোধকালে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ব্যাপারে দায়িত্ব অস্বীকার করে জাতির কাছে তিনটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। তার প্রশ্ন ছিল (১) বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে লাভ কার? (২) ধ্বংসাত্মক কাজের দোষ চাপানোর জন্য যে মিডিয়া ব্যবহৃত হবে তার উপর নিয়ন্ত্রণ কার? (৩) মানুষ খুনের ঐতিহ্য কার? এই তিনটি প্রশ্নই জাতির জন্য সংবেদনশীল এবং বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী এসব প্রশ্নের জবাবে সর্বাগ্রে আওয়ামী লীগের নামই উঠে আসে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোতেই আওয়ামী লীগের সক্রিয় ও ধ্বংসাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। পেট্রোল বোমা তৈরিকালে সম্প্রতি ছাত্রদল নেতা বলে কথিত বাপ্পী নামক যে ব্যক্তি নিহত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সে ছিল আওযামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের ডানহাত, আওয়ামী লীগ কর্মী, দৈনিক বিডি নিউজের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বাপ্পী বোমা বানানোর জন্য হাজী সেলিমের কাছ থেকে দু’লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা নিক্ষেপরত অবস্থায় এবং ভাঙচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগকালে গত তিন সপ্তাহে হাতেনাতে বহু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মী ধরা পড়েছে। মারণাস্ত্র নিয়ে তারা শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল নয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দালে নিজেরা নিজেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এতে প্রতিনিয়ত হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ২০০৬ সালের নবেম্বর মাসে লগি-বৈঠা নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করার নির্দেশ কে দিয়েছিলেন? শেরাটন হোটেলের সামনে বাসে গান পাউডার ঢেলে ১৮ জন যাত্রীকে কারা, কার নির্দেশে হত্যা করেছিল তার স্বীকারোক্তি এখনও পত্রপত্রিকাসহ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আরকাইভে পাওয়া যায়। বেগম জিয়া অথবা বিরোধী দলের অন্য কোনো নেতা কর্তৃক এ ধরনের নির্দেশ দেয়ারও কোনো নজির নেই। হুকুমের আসামী যদি কাউকে করতে হয় তাহলে অতীতে বাংলাদেশে সংঘটিত সকল ধ্বংসাত্মক কাজ (সচিবসহ কর্মচারীদের ন্যাংটা করার ঘটনাসহ) দায়িত্ব চিহ্নিত করে সবাইকে করা উচিত বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এখানে একটা বিষয় বলে রাখা দরকার, যাত্রাবাড়ীর কাঠের পুলে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ পোড়ানোর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নেই। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সকলের প্রতি আমরা সহানুভূতি জানাই। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন আছে, এই স্থানটি কোথায়? অনুসন্ধানী এক রিপোর্ট অনুযায়ী এই স্থানটি আওয়ামী লীগের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার বাড়ির অতি সন্নিকটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বদা সশস্ত্র ক্যাডারবেষ্টিত এই এমপি সাবের বাড়ির নিকটে কে কোন সাহসে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে? বিএনপি নেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া রিমান্ডে আছেন, তিনি কি সেখানে বোমা নিক্ষেপ করতে গেছেন? না বিএনপি নেত্রী? বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি। বোমা নিয়ে রাজনীতির ভবিষ্যৎ শুভ হয় না।
আমি শোকাহত বেগম জিয়াকে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর গুলশান গমন এবং তা নিয়ে যে তর্কবিতর্ক চলছে, সে সম্পর্কে কিছু বলবো না। কিন্তু তার পরের দিন বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী বানানো সঠিক হয়েছে কিনা, যারা সংলাপের সহায়ক পরিবেশের কথা বলেন, তাদের কাছে এই ছোট্ট প্রশ্নটি রাখতে চাই।
বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আরাম আয়েশ সব কিছু ত্যাগ করে স্বজনহারা অবস্থার মধ্যেও দেশের মানুষের ভোটের অধিকার, মৌলিক মানবিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যে ভূমিকা পালন করছেন, তার জন্য জাতি তার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে। আমরা দোয়া করি, আল্লাহ তাকে ধৈর্য, সহনশীলতা ও দুঃখ জয়ের শক্তি দান করুন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কিছু কিছু সদস্য এবং টক শোর অভিনেতা-অভিনেত্রী বর্তমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
২০ দলীয় জোট বর্তমানে যে আন্দোলন করছে তা হচ্ছে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের দাবি আদায় এবং বর্তমান অবৈধ সরকারের বিদায়। ২০ দলীয় জোটের বিশ্বাস, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হয়েছে তা সংবিধানবিরোধী ছিল। এতে সংবিধানের ৬৫ ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে। আবার বিদ্যমান পার্লামেন্ট না ভেঙে, আসন খালি না করে তারা নির্বাচনের প্রহসন করেছে। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারসহ অর্ধেকেরও বেশি ব্যক্তি বিনা ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শতাধিক নির্বাচন কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। ১৪৬টি কেন্দ্রে সামগ্রিকভাবে গড়ে ভোটার উপস্থিতি ছিল ১০ শতাংশেরও কম। এর পরও ব্যালট পেপার যত্রতত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং দলীয় ক্যাডাররা ব্যাপক হারে সিল মেরেছিল। আবার হাজার হাজার প্রিসাইডিং অফিসারের ভোটার টার্নআউট পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণায় তিন দিন সময় লাগানো হয়েছিল যা ছিল অস্বাভাবিক। এ ছাড়াও পূর্ববর্তী সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নতুন সংসদের ‘সদস্যদের’ শপথ পড়ানো হয়েছিল। গণতন্ত্রের ইতিহাসে দুনিয়ার কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায় না। এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে দিয়ে যে নাটক তখন মঞ্চস্থ করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক। এর সব কিছুই তারা করেছেন ক্ষমতা ও অস্ত্রের জোরে এবং এখনও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি তো আছেই। এই অবস্থায় বিরোধী দল বসে থাকতে পারে না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

রবিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

খালেদার শোক ও জাতীয় প্রতিরোধের শক্তি


বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নেত্রী, একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে শোক নতুন নয়। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করার ঘটনাও কম নয়। শোক, দুঃখ, বেদনা কখনো কখনো বিপুল শক্তিতে পরিণত হয়, এই প্রমাণ বার বার দিয়েছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ব্যক্তিগত শোকের যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে জাতীয় জীবনে শক্তি সঞ্চারিত করার উদাহরণ তিনি।
১৯৮১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ও স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিপথগামী-ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হলে কেবল জিয়া পরিবার বা বেগম খালেদা জিয়াই নন, পুরো দেশই আক্রান্ত হয় গণতন্ত্র লুণ্ঠনকারীদের দ্বারা। গণঅধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। সেই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে একাকী, বেদনার্ত, নিঃসঙ্গ বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতে রূপান্তরিত করে গণতন্ত্রের আন্দোলন সফল করেন। শোকার্ত বেগম খালেদা জিয়া অক্লান্ত লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করে বিজয়ের হাসি হাসেন।
আবার ১/১১-এর সময় কুচক্রী মহল জিয়া পরিবারকে শুধু শারীরিকভাবে আক্রমণই করেনি; সব কিছু তছনছ করে দেয়। জিয়া পরিবারের উত্তরসুরী তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে আহত ও ক্ষত-বিক্ষত করে। তাদেরকে দেশ-ছাড়া করে। কিন্তু সেই বেদনার সময়ও বেগম খালেদা জিয়া নিঃশঙ্ক চিত্তে জনতার পাশে হিমালয়ের মতো অটলভাবে উপস্থিত ছিলেন। অনেকেই তখন কুচক্রীদের দোসর ও দালাল হয়ে ক্ষমতার বাটোয়ারায় অংশ নেয়। কুচক্রীদের হালুয়া-রুটিতে উদর পূর্ণ করে। কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত-পারিবারিক ক্ষতি মেনে নিলেও জাতীয় ক্ষতি মেনে নেননি। অসৎ চক্রের সঙ্গে কোনো আপোস না করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যেতেই থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় স্বচ্ছ নির্বাচন আর জনঅংশগ্রহণমূলক ভোটের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামরত অবস্থায় দেশ অবরুদ্ধ আর তিনি নিজেও যখন সাহসিক প্রত্যয়ে আন্দোলনের নেতৃত্বরত, তখন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বিদেশের মাটিতে নিঃসঙ্গ ও চিকিৎসারত আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু বরণ করেন। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষা ও সন্ধিক্ষণের মতো এবারও তিনি ব্যক্তিগত শোকের কষ্ট চেপে রেখে জনগণের দাবি ও অধিকার রক্ষার মহান লড়াইকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের শোককে তিনি পরিণত করেছেন জাতীয় প্রতিরোধের শক্তিতে।
অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, একজন জাতীয় নেত্রীর পুত্রশোক ও ব্যক্তিগত বেদনার চরম সময়েও চালবাজির এমন নোংরা রাজনীতি করা হলো যার উল্লেখ করাও সমীচীন নয়। দেশবাসী সেইসব চিত্রাবলি উভয় পক্ষের বক্তব্য, টিভি ফুটেজ ও ঘটনা পরম্পরার মাধ্যমে অবহিত হয়েছেন। একজন জাতীয় নেত্রীর ব্যক্তিগত শোক এবং বিপদগ্রস্ত দেশবাসীর গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরে পাবার চূড়ান্ত লড়াই সফল করার আন্দোলনের চরম সময়ে এ ধরনের বিষয় আলোচনা করাও কাম্য নয়।
এ কথা সকলের জানা যে, ২০ দলীয় জোটের পক্ষে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করা বিএনপি চেয়ারপারসন ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পান সেখানে বসেই। দুপুরের পর পরিবারের সদস্যরা তাকে ছেলের মৃত্যু-সংবাদ দেন। এ খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে ছেলের শোকে মুহ্যমান খালেদা একান্তে নিজ কক্ষে অবস্থান করেন। রাতে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানান, শোকে বিহ্বল খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
মা ও বড় ভাই রাজনীতিতে থাকলেও আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন রাজনীতির আড়ালে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই বছর ৩রা সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়ি থেকে আরাফাত রহমান কোকোকে আটক করা হয়। ২০০৭ সালের ১৭ই জুলাই কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলী রহমান সিঁথি, দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান কোকো। এরপর থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। বিএনপি ও পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় অসুস্থ থাকায় তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই কোকোর বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের একটিসহ মোট পাঁচটি মামলা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর কোকোর প্যারোলের মুক্তির সময়সীমা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২০১১ সালের ৩রা জুন মুদ্রা পাচারের মামলার রায়ে কোকোকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। সেই সঙ্গে ১৯ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় জামিনে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করলেও বর্তমান সরকার জামিনের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় পলাতক হিসেবে বিবেচিত হন তিনি। পলাতক দেখিয়েই তার বিচার এবং সাজার রায় হওয়ায় আপিলের সুযোগ পাননি তিনি। এভাবেই একদা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরাফাত রহমান কোকো নীরবে, নিঃসঙ্গ ও অসুস্থ অবস্থায় স্বদেশের প্রিয় মৃত্তিকা থেকে বহুদূরের প্রবাসের বিরূপ পরিস্থিতিতে মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়েন। চিরদিনের জন্য চলে যান না ফেরার দেশে।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, দলীয় চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জন্য নয়া পল্টনের কার্যালয়ে মিলাদ পড়তে চাইলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের জন্য কার্যালয়ের নিচতলায় অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু পল্টন মডেল থানা পুলিশ বলেছে, অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। মিলাদের অনুমতি না দেয়া নিয়ে বিএনপির অভিযোগের পর এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি, একেক জন অন্যজনকে দেখিয়ে দেন। গত ৩ জানুয়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ তুলে নেয়ার পর সেখানে পুলিশ তালা লাগিয়ে দেয়। ওই রাতে বের হতে বাধা পাওয়ার পর খালেদা জিয়াও গুলশানে তার কার্যালয়ে রয়েছেন। অবরুদ্ধ অবস্থা থেকেই সারাদেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন তিনি। পরে কার্যালয় ঘিরে থাকা পুলিশ সরানো হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন এক প্রকার অবরুদ্ধই আছেন। অবশেষে বিকাল থেকে গুলশানের কার্যালয়ে পাশের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া-কালামের মাধ্যমে  আরাফাত রহমানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।
রাত সাড়ে ১১টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তিনি শোকার্ত ও অসুস্থ। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ‘ঘুম থেকে জেগে’ যখন তিনি জানলেন প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন, তখন তিনি তাঁকে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান। মারুফ কামাল খান বলেন, খালেদা জিয়া তাঁদের বলেছেন- এরপর যখনই প্রধানমন্ত্রী আসতে চাইবেন তখনই তাঁকে স্বাগত জানানো হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে খালেদা জিয়া সমবেদনা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া জীবনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক নির্যাতন, বিপদ নতুন নয়। ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা নিহত হন তাঁর স্বামী। বার বার তিনি আক্রান্ত হন গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তির দ্বারা। তাঁকে দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি বিজড়িত বাসভবন থেকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করা হয়। তাঁর পরিবার-পরিজনকে তছনছ করে দেয়া হয়। তাঁর দুইটি মাত্র পুত্রকে দেশছাড়াও করা হয়। একের পর এক মামলায় একাধিক বারের একজন সফল সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নাজেহালও করা হয়। বছরের পর বছর তাঁকে তাঁর পুত্রদ্বয় ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবু গণতন্ত্রের আপোসহীন নেত্রী, জাতীয় সাহসের প্রতীক, ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনাকে জয়-করা ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া নিজের শোকের জন্য জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনকে জলাঞ্জলী দেন নি। ব্যক্তিগত বেদনাকে বুকে চেপে তিনি জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ধৈর্য্য, ত্যাগ, সাহস ও প্রত্যয় অনেক নেতাই দেখাতে পারেন নি। বেগম খালেদা জিয়া নিজের ব্যক্তিগত শোককে বরং জাতীয় প্রতিরোধের শক্তিতে পরিণত করেছেন। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অনমনীয়তা, আপোসহীনতা ও সাহসের জন্য তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জনআন্দোলন সফলতার মোহনা স্পর্শ করবেই। ব্যক্তিগত শোকে নিঃসঙ্গ বেগম খালেদা জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা। অতীতের মতো এবারও তিনি জনতার সংগ্রামকে সকল বাধা-বিঘ্ন-বেদনা অতিক্রম করে সফল করবেন।

শনিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বেগম জিয়াকে গালাগালি করার ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের অশালীন প্রতিযোগিতা


বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দুজনেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক নেত্রী। সুতরাং তাদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রত্যেকের উচিত শিষ্টাচার রক্ষা করে কথা বলা। এই দুই নেত্রীর রাজনীতির আদর্শ এক নয়। সেটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে জন্যই তো তারা দুজনে দুই দলের নেত্রী। রাজনৈতিক আদর্শ যদি দুটি দলের এক হতো তাহলে তো তারা এক দলই করতেন। রাজনৈতিক আদর্শের মতভিন্নতা থাকলেও তারা দুজনেই দেশের শ্রেষ্ঠ দুই নেত্রী। বেগম জিয়া ৩ বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেখ হাসিনাও এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় মেয়াদ পার করছেন। এসব কারণে তারা শ্রদ্ধা এবং সন্মানিত ব্যক্তি। বাংলাদেশের আরো অনেক নেতা আছেন, তারাও অনেক উঁচু মানের এবং তারা মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। এরা হলেন, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান। এদের স্থান ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এসব নেতার মধ্যেও রাজনৈতিক মত পার্থক্য ছিল। কিন্তু এসব কালজয়ী নেতা কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি অথবা এমন কোনো কথা বলেননি যেটি চরিত্র হননের শামিল হয়। অথচ অত্যন্ত গুরুতর মৌলিক এবং পররাষ্ট্র বিষয় নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে মতবিরোধ হয়। মতবিরোধ এমন চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে যে, শেষ পরিণতিতে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয় এবং মওলানা ভাসানী একটি অংশ নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করেন। শেখ মুজিব মারা যাওয়ার পর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের প্রতি সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং অত্যন্ত সমীহ করে শেখ মুজিব সম্পর্কে কথা বলতেন। অথচ জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, গণতন্ত্র ইত্যাদি প্রতিটি ব্যাপারেই এই দুই নেতার চিন্তা ধারায় মৌলিক পার্থক্য ছিল।
দুঃখের বিষয়, নেতা-নেত্রীদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ এখন রাজনীতি থেকে বলতে গেলে উঠেই যাচ্ছে। আরো দুঃখের বিষয় হলো এই যে, পলিটিশিয়ানদের ব্যক্তিগত আক্রমণ তথা তাদের চরিত্র হননের নিন্দনীয় কাজটি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। বেগম খালেদা জিয়া ৩২ বছর হলো রাজনীতি করছেন। এই ৩২ বছরে তিনি ৩২ বার তো দূরের কথা, ৩ বারও শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেননি। অথবা তার চরিত্র হননের কোনো প্রয়াস পাননি। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় এই যে, শেখ হাসিনা অসংখ্য বার বেগম জিয়াকে ব্যক্তিগত এবং পরিবারিকভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন অশ্রদ্ধার সাথে তিনি বেগম জিয়ার এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পর্কে উক্তি করেছেন যে, তার এসব অসংলগ্ন উক্তির কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যেমন জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন তেমনি তার দলও জনপ্রিয়তা অনেক হারিয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনপূর্ব রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে শেখ হাসিনা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘এক অখ্যাত মেজর’ হিসেবে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। শুধুমাত্র এই কারণে তিনি অন্তত ৩ শতাংশ ভোট ১৯৯১ এর নির্বাচনে হারিয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল ধারণা করেন।
বহুবার শেখ হাসিনা এ কাজটি করেছেন। সর্বশেষ করেছেন গত ১২ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায়। ঐ জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভা নেত্রী শেখ হাসিনা। তার ভাষণটি বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে দৈনিক ‘জনকণ্ঠে’, ১৩ জানুয়ারি।
খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের সমালোচনা করে ঐ জনসভায় ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি অফিসে কী করেন? উনাকে তো অবরুদ্ধ করে রাখা হয়নি। উনি বাড়িতে চলে যাক। উনি নাকি সরকার উৎখাত না করে ঘরে ফিরবেন না। সন্ত্রাস ও জঙ্গি রানীর কথায় জনগণ আসবে না। শেখ হাসিনা খালেদাকে কটাক্ষ করে বলেন, ঘর থুইয়া অফিসে কেন? পুরনো অভ্যাস। ঘর ছেড়ে পালানো উনার পুরনো অভ্যাস। এ সময় খালেদা জিয়ার ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন উদাহরণ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, স্কুলে পড়া অবস্থায় উনি সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের বিহারের কাতিহারা স্টেশন থেকে জনগণ তাকে উদ্ধার করে মা-বাবার কাছে ফেরত দেন। এরপর জিয়ার সঙ্গে দিনাজপুর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়ার পরিবারসহ সকল অফিসারের পরিবারকে ফিরিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলারা ঢাকায় এসেছিলেন। খালেদা জিয়াকে আনতে গেলে উনি জানান, পরদিন যাবেন। কিন্তু পরদিনই উনি পালিয়ে গেলেন, পাকিস্তানী আর্মি অফিসার আসলাম বেগের আতিথেয়তা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেলেন। তখন আসলাম বেগ ছিলেন কর্নেল। পরবর্তীতে তিনি জেনারেল হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হন। যাওয়ার সময় জিয়াকে মেসেজ দিয়ে যান, যুদ্ধ করে কিছু হবে না। তুমি পাকিস্তানে চলে যাও, আমিও যাব। এখানেই শেষ নয়। দেশে কিছু অঘটন ঘটার আগেই উনি পালিয়ে যান, আত্মগোপনে থাকেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও হঠাৎ করেই উনি তিন দিন লাপাত্তা হয়ে গেলেন। পরে এরশাদ সাহেব পূর্বাণী হোটেলের দরজা ভেঙে তাঁকে উদ্ধার করলেন। ’৮৬ সালেও সিপাহী-জনতার বিপ্লবের কথা বলে তিন দিন আত্মগোপনে ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের দুই ঘণ্টা আগে উনি (খালেদা জিয়া) ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। বিদ্রোহ ঘটার দু’ঘণ্টা আগে উনি পালালেন কেন? আসলে উনি যখনই ষড়যন্ত্র করেন, তার আগে আত্মগোপনে চলে যান। এর ধারাবাহিকতায় এবার উনি খাট, সোফা, গদি নিয়ে উঠলেন গুলশান কার্যালয়ে। পত্রিকায় বেরিয়েছে কয়েকদফা উনি খাট পরিবর্তনও করেছেন। নিজে পালাবেন আর বলবেন অবরুদ্ধ।
দুই
ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে। সেটি হলো, Trend Setter. দেখা যায় যে দলনেত্রী ট্রেন্ড সেট করে দেন, আর তার অনুসারীরা শতকরা ১০০ ভাগ আনুগত্য সহকারে সেটি অনুসরণ করেন। বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচনা সম্পর্কেও তার অনুসারীরা সেই একই মহাজনী পথ অনুসরণ করছেন। সাম্প্রতিক অবরোধকালে শেখ হাসিনার মন্ত্রী মিনিস্টাররা যার মুখে যা আসছে তাই বলছেন। গত ২৩ জানুয়ারি ‘আমাদের সময় ডটকমে’ এ সম্পর্কে একটি তথ্যবহুল সংবাদ ছাপা হয়েছে।
ওই সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ মন্তব্য করা থেকে বাদ পড়েননি খোদ প্রধানমন্ত্রীও। খালেদা জিয়াকে ‘ডাইনি বুড়ি’, ‘কুইন অব টেরর অ্যান্ড হরর’, ‘সন্ত্রাসের রানী’, ‘গোলাপি রে গোলাপি’, ‘জামায়াতের আমীর’, ‘বোমানেত্রী’, ‘পেট্রোল বোমানেত্রী’ ও ‘পাকিস্তানীদের দোসর’ বলে মন্তব্য করেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
গত বছরের ২৩ জানুয়ারি যশোরের অভয়নগরের শংকর পাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত  সমাবেশে খালেদাকে ‘গোলাপী রানী’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গোলাপি রে গোলাপি, ট্রেন তো মিস করলি।’ তিনি বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করে ট্রেন মিস করলেন। এখন যদি আমি বলি, ‘গোলাপি রে গোলাপি ট্রেন তো মিস করলি। গোলাপি এখন আর ট্রেনে নাই।’ ওই সভায় জামায়াতের সমলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ইসলামের নামে রাজনীতি করে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে না। বিএনপির নেত্রী তাদের সমর্থন দিচ্ছেন। বিএনপির নেত্রী জামায়াতের নেত্রী হয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া এখন জামায়াতের আমীর হয়ে গেছেন।
রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসের রানী বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী নেত্রী থেকে ‘সন্ত্রাসের রানী’তে পরিণত হয়েছেন।
সুরঞ্জিত বলেন, বিএনপির দলীয় বৈশিষ্ট্য পাল্টে গেছে। খালেদা জিয়া এখন আর জাতীয়তাবাদী নেত্রী নন। তার সঙ্গে এখন আর তার নেতারা নেই। তিনি তার দলকে সন্ত্রাসী দলে পরিণত করেছেন। তিনি এখন মোল্লা ওমরের ভূমিকায়। তিনি এখন সন্ত্রাসের রানী, কুইন অব টেররিজম। ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির যৌথ সমাবেশ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পাকিস্তানীদের দোসর বেগম খালেদা বাংলাদেশের জনগণ শান্তিতে থাকুক, তা চান না। তিনি দেশকে পাকিস্তান বানাতে চান। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত মানববন্ধনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘কুইন অব টেরর অ্যান্ড হরর’ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু খালেদা রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে সারাদেশে সাধারণ মানুষের ওপর পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেন, যা সারাবিশ্বে নজিরবিহীন ঘটনা। খালেদা আজ বাংলার মানুষের কাছে ‘কুইন অব টেরর অ্যান্ড হরর’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছেন। শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রোকেয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শীতার্ত ও দুস্থ মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে মানুষ হত্যা করে খালেদা জিয়া ‘ডাইনি বুড়িতে’ পরিণত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি বলেন, মানুষ হত্যাকারী খালেদা জিয়া ‘ডাইনি বুড়িতে’ পরিণত হয়েছেন। তিনি অহেতুক হরতাল-অবরোধ ডেকেছেন। একদিকে তিনি মানুষ হত্যা করছেন, অন্যদিকে উল্লাস করছেন। এটি ‘ডাইনি বুড়ি’র কাজ বৈধ কিছুই নয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জঙ্গিরানী হিসেবে মন্তব্য করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, দেশ ও দেশের মানুষ আজ জঙ্গিরানীর কাছে জিম্মি। এ থেকে পরিত্রাণ চায় দেশবাসী।
তিন
হাতে কোনোরকম প্রমাণ না রেখে শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে তার পারিষদ দল বলে চলেছেন যে, বেগম জিয়া নাকি ‘জঙ্গিরানী’ এবং জামায়াতের আমীর হয়ে গেছেন। বিএনপি এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা ধৈর্য সহকারে অনুসরণ করছেন। অনেক মার খেয়েছে বিএনপি, কিন্তু কোনো সময় অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পাল্টা আঘাত করে দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। বাংলাদেশকে তিনি যদি পাকিস্তান বানাতে চেয়ে থাকেন তাহলে তিনি তিন তিন বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন কি তিনি এ কাজটি করার উদ্যোগ নিতে পারতেন না? তার সাথে তার দলের লোক নেই- এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই বেরুতে পারে। চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নামের একটি সিনেমা বানিয়েছেন। সেখানে গোলাপীর চরিত্র কি ছিল, সেটি মানুষ ভুলে যায়নি। এখন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়াকে যখন গোলাপী বলেন তখন তাদের রুচি কোন পর্যায়ে গেছে সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আসিফ আরসালান 

শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জাতীয়তাবাদ


বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাত এর কারণ ও স্বরূপ নিরূপণে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের আলোচনা পাঠকের ভাবনার খোরাক যোগাবে। এ আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্রে বসবাসকারী জাতি। প্রশ্ন হল  জাতি কি ? জাতি হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমষ্টি, যারা ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত সুনির্দিষ্ট আবাসভূমির বাসিন্দা। জাতি রাষ্ট্রের  অধিবাসী সেই লোকসমষ্টির সামগ্রিক বা সমষ্টিগত জীবন সুনিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ সেই জনসমষ্টি এরূপ একটি নিজস্ব সরকার দ্বারা শাসিত, যে সরকার সর্বক্ষেত্রে সত্যিকারার্থে স্বাধীন এবং কোন ক্ষেত্রেই অন্য কোন শক্তির লেজুর বা তাঁবেদার নয়। জাতীয়তা কি? জাতি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান জাতীয়তা। জাতীয়তা হচ্ছে- একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিশাল জনসমষ্টির চিন্তার, আবেগের, অনুভূতির, আশার, আকাক্সক্ষার, সংস্কৃতির, সংস্কারের, দেশাত্ববোধের, আনুগত্যের বিরাট সম্পর্ক ও অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তা। এই আত্মীয়তা যেখানে অনুপস্থিত সেখানে জাতীয়তা অবর্তমান। আবার একই রাষ্ট্রে একাধিক এথনিক গ্রুপ, কালচারাল গ্রুপ, রিলিজিয়াস গ্রুপ থাকতে পারে। কিন্তু জাতি ভাবাদর্শের মেইনস্ট্রিম থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনার একটি বহুল পরিচিত পন্থা হলো গণতন্ত্র। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র হলো কোন জাতিরাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান ভোট বা অধিকার আছে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরীর ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশ গ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসী শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে, যার অর্থ “জনগণের শাসন” শব্দটির উৎপত্তি (ডেমোস) “জনগণ” ও (ক্রাটোস) “ক্ষমতা” থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে এথেন্স ও অন্যান্য নগর রাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এই শহর-রাষ্ট্রটি ছিলো এথেন্স শহর এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে সনাতনী রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান। তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময়  অথবা প্যারিশ- এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয় যার পরে নাম হয় ডেমোক্রেশিয়া  যার অর্থ হচ্ছে জনগণের  শক্তি ।
ফ্যাসিবাদ হচ্ছে র‌্যাডিক্যাল কর্তৃত্বমূলক জাতীয়তাবাদের একটি রূপ যা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপে খ্যাতি লাভ করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ইটালিতে ফ্যাসিবাদ উৎপত্তি লাভ করে জাতীয় সিন্ডিক্যালবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। এটি বিশেষভাবে বামপন্থী রাজনীতির উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে ডানপন্থী রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করে; এবং এটি ছিল সমাজতন্ত্র, উদারতাবাদ, সাম্যবাদ, ডানপন্থী রক্ষণশীল, গণতান্ত্রিকের বিরোধী। যদিও ফ্যাসিবাদকে বাম-ডান রাজনীতিতে সাধারণভাবে দূর ডানে জায়গা দেয়া হয়, কতিপয় স্ব-ব্যাখ্যাত ফ্যাসিবাদী এবং কিছু মন্তব্যকারীরা বলেছেন যে এই বিবরণ যথার্থ নয় এটি মুলত রাষ্ট্রের সকল মানুষকে একাত্ম করে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই কাজে তারা নির্ভর করে একটি বিশেষ বাহিনী বা গোষ্ঠীর উপর যারা পূর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে ততটা প্রভাবশালী ছিল না। যাদের এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে তারাই পরবর্তীতে রাষ্ট্র নেতৃতে অগ্রণী দায়িত্ব নেয়। সেই রাষ্ট্র তখন প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা, যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে অনুমোদন দেয় এবং রাষ্ট্রের মতে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য এগুলো মৌলিক বিষয়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অনুযায়ী উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের (তারা নিজেদেরকেও এই শ্রেণীতে রাখে) উচিৎ অন্য দুর্বল বা যাদের অর্থনীতি তেমনটা মজবুত নয় এমন রাষ্ট্র বা জাতিকে দখল করে স্থানচ্যুত করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্যাসিবাদীরা অন্য সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকে এবং জাতি ও সংস্কৃতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে একাত্ম করাই অর্থাৎ শ্রেণীবিভাজন দূর করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য। অনেক বিশ্লেষকের মতে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মাঝখানে অবস্থিত বা তৃতীয় “অবস্থান’’ বলেও উল্লেখ করেছেন। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি স্বনির্ভরতার উপর গুরুত্ব দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্যাসিবাদী সরকার সামরিক বাহিনীর ওপর অতিনির্ভর ও আস্থাশীল হয়। ইতালির জাতীয় শ্রমিক আন্দোলন জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যাসিবাদ উত্থান হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কোন রাজনৈতিক দলই খোলাখুলিভাবে নিজেদের ফ্যাসিবাদী বলে দাবি করতে চায় না। এখন সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলের প্রতি ঘৃণা বা রাগ প্রকাশের জন্য এই শব্দ ব্যবহার করে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার এবং ইতালির বেনিতো মুসোলিনি উল্লেখযোগ্য।
জাতীয়তাবাদ কি? জাতীয়তাবাদ বিবেচনা করা দরকার ব্যাপক অর্থে সাংস্কৃতিক স্মারকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় হিসাবে। নিরাপত্তাহীন পৃথিবীতে এই স্মারকের একটি প্রকৃত অর্থ আছে ব্যক্তির কাছে। এদিক থেকে যদি দেখি তাহলে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন অর্থ আছে, অবশ্য এই অর্থ শেষ বিশ্লেষণে, ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। সেজন্য কোন নির্বস্তুক সংজ্ঞা নয়, কংক্রীট সংজ্ঞা কেবল ব্যবহার করা যায় সাংস্কৃতিক স্মারক এবং সাংস্কৃতিক যুক্ততার ক্ষেত্রে। কারণ উপাদানগুলো ব্যক্তির সাথে জড়িত একাত্মভাবে।
(তথ্যসূত্র বাংলাদেশ রাজনীতির ২৫ বছর, সম্পাদনায়- তারেক শামসুর রহমান)। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধানতঃ দুটি ধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারা। তত্ত্বগতভাবে এধরনের জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর নানা স্থানের বাংলাভাষীদের ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বললেও কার্যত এটি আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বাঙালীদের ওপরই জোর দেয়। এ কারণে এ জাতীয়তাবাদ কার্যত ভূখন্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তা হয়ে পড়ে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সেই ভূখন্ডের অন্যান্য ক্ষুদ্র ভাষাভাষীরা এ জাতীয়তাবাদের স্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের অপর ধারাটি হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন ভূখন্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা।
বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি নানা ধর্মের লোক বাস করেন। বসবাস করেন বাংলাত, চাকমা, মারমা, উর্দুসহ অনেকগুলো ভাষা ও নানা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। এরা সবাই অর্থাৎ বাংলাদেশ ভূখন্ডে যারা বাস করেন তারা সবাই মিলে আমরা বাংলাদেশী। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল বক্তব্য ও মূল সুর। এই বাংলাদেশীদের জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা ও উন্নয়নই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলবাণী ও মর্মকথা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এতদঞ্চলের ইতিহাসেরই বাস্তব ফলশ্রুতি। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (২৯/০১/১৯৩৬- ৩০/০৫/১৯৮১) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন উর্ধ্বে তুলে ধরে জিয়াউর রহমান আমাদেরকে সঠিক জাতীয় পরিচয়ের সন্ধান দিতে সক্ষম হন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি বিকাশ ও গুরুত্ব সম্পর্কে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শ’শ’ বছর ধরে এদেশের আপামর জনগণের অন্তরে চির জাগরূক রয়েছে। যুগ-যুগান্তরের দেশপ্রেমিক হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সব উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এই দর্শনে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপযোগী বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংবদ্ধ করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতি, সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
বাক স্বাধীনতা হরণ। গণ মাধ্যমের কন্ঠরোধ ফ্যাসিবাদের অস্ত্র। ফ্যাসিবাদের পরিণাম রক্তপাত। হিটলার তার প্রমাণ। পক্ষান্তরে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা গণতন্ত্রের অলঙ্কার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দফতরের ভেতরে মারণাস্ত্র দিয়ে আঘাত অমার্জনীয়।
আখতার মাহমুদ 

বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

লাখ টাকার পুরস্কার প্রসঙ্গে


আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের এক সভা শেষে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, বোমাবাজ-সন্ত্রাসীদের যারা ধরিয়ে দেবে তাদের এক লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। এই পুরস্কার পাওয়া যাবে এক-একজনের জন্য। অর্থাৎ যে যতজনকে ধরে দেবে তাকে ততো লাখ টাকা দেবে সরকার। মন্ত্রী আমুর মাধ্যমে ঘোষিত সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিশিষ্টজনেরাও বলেছেন, কেউ সন্ত্রাসী বা বোমাবাজ কি না তা তার গায়ে লেখা থাকে না। তাছাড়া প্রাণবিনাশী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করার জন্য দেশে র‌্যাব ও পুলিশসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা যদি ঢালাওভাবে সাধারণ নাগরিকদের দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে যদি লাখ টাকা পুরস্কারের প্রলোভন দেখানো হয় তাহলে সমাজে এক মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে যাবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তো থাকবেই, একযোগে শুরু হবে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কার্যক্রমও। বিশিষ্টজনেরা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের চলমান মানসিকতার দিকে ইঙ্গিত করে আশংকা প্রকাশ করেছেন, এই সুযোগে তারা প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদেরই শুধু আটক করবে না, যাকে-তাকে ধরার এবং ধরিয়ে দেয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের মধ্যেও চাঁদাবাজির মহোৎসবে নেমে পড়বে। ফলে সব মিলিয়েই সমাজে সংঘাত ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়তে পারে। 
আমরাও সম্ভাবনার চাইতে আশংকার দিকটিকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এর কারণ, পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন থেকে শুরু করে আরো অনেকভাবেই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে দেখেছে সরকার কিন্তু সুফল অর্জন করা যায়নি। জনগণের সচেতন অংশ এসব পন্থা বা কৌশলের পেছনে নিতান্ত উস্কানি ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পায়নি। এজন্যই লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত ও ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যে কেউ ভাবতে পারেন, সারা দেশে পুরো প্রশাসন তথা র‌্যাব-পুলিশ ও বিজিবির পাশাপাশি দলীয় বাহিনীকে মাঠে নামিয়েও নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। মূল দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার কাজে অনেক বেশি সময় দিতে হচ্ছে বলে আইন-শৃংখলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ক্লান্ত বা অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছে কি নাÑ এ ধরনের কোনো জল্পনা-কল্পনায় না গিয়েও বলা যায়, জনগণ সরকারের আহ্বানে খুব একটা সাড়া দেয়নি। জনগণ বরং ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচিই পালন করে চলেছে। হরতালও পালন করছে তারা। পেট্রোল বোমা ও গান পাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা কারা করছে এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন রয়েছে। কারণ, অতীতের মতো সাম্প্রতিক সময়েও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তাদের সামনেই ঘটানো হচ্ছে। সবই দেখতে ও জানতে পারছে তারা। সুতরাং সরকার চাইলেই সম্পদ ও প্রাণবিনাশী কর্মকাণ্ডের সব দায় বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের উপর চাপানো যাবে না। একই কারণে জনগণকেও বেগম খালেদা জিয়ার বা তার নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো সম্ভব হওয়ার কথা নয়। আমরা তাই এ ধরনের বিপদজনক ও সংঘাতমুখী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানাই। আমাদের মতে লাখ লাখ টাকার প্রলোভন দেখানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত প্রত্যেকটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করা এবং সংকট উত্তরণের সহজ ও গণতন্ত্রসম্মত পথে পা বাড়ানো। সেটা সম্ভব হতে পারে ক্ষমতাসীনরা যদি হত্যা-গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতনের কর্মকাণ্ড ছেড়ে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেন এবং বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থাপিত সাত দফা দাবি অথবা সর্বস্বীকৃত কোন পদ্ধতির ভিত্তিতে নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতায় আসেন। এর মাধ্যমেই শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যাবে বলে আমরা মনে করি।

মঙ্গলবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিজিবি-পুলিশ-র‌্যাব ভরসা


কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার দুটি চরণ এ রকম : ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়, নিমিষে যোজন ফরসা/জয় শ্রীচরণ ভরসা।’ বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের জনবিচ্ছিন্নতায় তাদের অবস্থাও প্রায় এমনই দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাধারণত ভরসা থাকে বা ভরসা করতে হয় জনগণের ওপর। এই জনগণের ওপর যখন ভরসা করা যায় না, জনগণ যখন সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সেই সরকার সর্বশক্তি দিয়ে ঐ জনগণকেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এবং তারা জানে জনগণের শক্তি দুর্বার। আবার এই প্রক্রিয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে এবং দলীয় মাস্তানদের ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সেও জনগণকে দমন করার জন্যই, যেন তারা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে।
বর্তমান সরকারও তেমনি এক উৎপীড়নের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে গেছে। আর সে কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই এই সরকার জননিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। লক্ষ্য, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। এই সঙ্গে সরকার-বিরোধী সকল কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া, যাতে ভবিষ্যতেও কেউ কোনোদিন এই সরকারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও না করতে পারে। আমরা প্রথম থেকেই এর বিপজ্জনক দিক নিয়ে আলোচনা করে এসেছি। আমরা বলেছি, গণনির্যাতনের জন্য এসব বাহিনী ব্যবহার করা হলে তারা একসময় নিজেরাই অপরাধ সংঘটন করতে শুরু করবে। যেহেতু সরকার তাদের ব্যবহার করছে, সে কারণে এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে এরা জনরোষের মুখেও পড়তে পারে।
আমাদের অনুমান এতদিনে সত্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। সরকার এই বাহিনীগুলোকে এতটাই দলীয়করণ ও অপব্যবহার করেছে যে, এখন তারা যেন নিজেরাই নিজেদের সরকার তথা দন্ডমুন্ডের কর্তা ভাবতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ প্রধান জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধংদেহী ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, প্রজাতন্ত্রে কর্মকর্তা হিসেবে তা তাদের এখতিয়ারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। একটি অংশগ্রহণমূলক নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচির পর এখন লাগাতার অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে।
এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে সরকারের স্বৈরাচারী ও অদূরদর্শী মানসিকতার কারণে। তার আগে থেকেই সরকারের মন্ত্রী, নেতা, পাতি নেতারা বিরোধীদলগুলোকে এমনভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল যে, দেশে বোধ করি বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা এই বলে হুঙ্কার দিচ্ছিল যে, বিরোধী দল যদি আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়, তবে তাদের মাঠে নামতে দেয়া হবে না। কেউ কেউ বলছিল, সরকার এমন ব্যবস্থা নেবে যে, তারা মাটির নিচে লুকিয়েও পার পাবে না। কেউ আবার বলছিলেন যে, বিরোধী দলের আন্দোলনের কোনো মুরোদই নেই। কেউ বলছিলেন, বিরোধী দল যদি আন্দোলন শুরু করে, তাহলে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ‘নেড়ি-কুত্তা’র মতো রাস্তায় পেটানো হবে। এমনও বলতে শুনেছি যে, খালেদা জিয়াকে কেনো যুদ্ধে নামতে হলো? জেনারেল কখন নিজে যুদ্ধে নামে? তখনই নামে যখন তার সৈন্য-সামন্ত সবই যুদ্ধে মারা যায়। খালেদা জিয়ার সব সৈন্য মরে গেছে। এ কথা ঠিক যে, অত্যন্ত নিম্নমানের পদ্ধতিতে বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে কারাগারে আটক করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে হুলিয়া। শুধু শীর্ষস্থানীয় নেতাই বা বলি কেন, মধ্যস্তরের সকল নেতাও কারারুদ্ধ কিংবা হুলিয়া নিয়ে পলাতক।
এরকম একটা পরিস্থিতিতেই এসেছিল ৫ জানুয়ারি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি প্রহসনের নির্বাচন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। কারণ সকল বিরোধী দল সে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাদের দাবি ছিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে একটি নিদর্লীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সারা বিশ্বই উপলব্ধি করছিল যে, সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে। তারা এ ধরনের একটি নির্বাচন না করারও অনুরোধ জানিয়েছিল। উভয়পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা আনার জন্য জাতিসংঘ দূত পাঠিয়েছিল। সে আলোচনা ব্যর্থ হয়। সরকার একতরফা নির্বাচন করে। এবং জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে কিছু লোকের নাম ঘোষণা করে তাদের সংসদ সদস্য বলে অভিহিত করে।
তারই বর্ষপূর্তি ছিল ৫ জানুয়ারি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে অভিহিত করে সারাদেশে কালো পতাকা দিবস ও ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল। একইভাবে আওয়ামী লীগও দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর বিএনপি নয়া পল্টনে সমাবেশ করার পরিকল্পনা করে। ৩ তারিখ বিকেলে পুলিশ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর সরকার ঢাকামুখী সকল যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সারাদেশে অবরোধ অবস্থা জারি করে। কারণ সরকার নিশ্চিত ছিল যে, তারা সোহরাওয়ার্দীতে জনসভা ডাকলেও সেখানে তেমন কোনো লোকসমাগম হবে না। তাদের কাছে অজানা নেই যে, সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়নে অতিষ্ঠ সারাদেশের মানুষ তাদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। আর এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সাধারণ মানুষ লাখে লাখে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের জনসভায় যোগ দেবে। আর তাই সরকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হলো না, ৩ তারিখ রাত থেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলল। তালা লাগিয়ে দেয়া হলো বিএনপি অফিসে।
৫ তারিখে বেগম খালেদা জিয়া যখন তার পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী নয়া পল্টনের দিকে রওনা হতে গেলেন, তার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আগে থেকেই তার দফতরের বাইরে ইট-বালুর ট্রাক, পুলিশে ট্রাক, জলকামান, প্রিজনভ্যান আর শত শত পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে ফেলা হয়। কেড়ে নেয়া হয় ২০ দলীয় জোট নেত্রীর অবাধে চলাফেরার সকল অধিকার। তাকে তো বের হতে দেয়া হলোই না, উপরন্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষাক্ত পিপার স্প্রে ছিটানো হলো বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির অন্যান্য নেতাকর্মীর ওপর। ফলে তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এটা যেন ছিল অনেকটাই বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র।
নয়া পল্টনে যেতে ব্যর্থ হয়ে বেগম খালেদা জিয়া পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিলো। সে অবরোধ এখন চলছে। সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রাজধানী। প্রতিদিন শত শত বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। যথেচ্ছ গুলী চালানো হচ্ছে। অবরোধ থামানো যাচ্ছে না। অথচ সরকার ভেবেছিল দুই চার দিনের মধ্যেই তারা ডা-া মেরে ষোল কোটি মানুষকে ঠান্ডা করে দেবে। তারপর যা ঘটল তা অভাবনীয়। মনে হলো, বিজিবি-র‌্যাব-পুলিশ যেন রাষ্ট্র ক্ষমতাই দখল করে বসেছে। গত ১৫ জানুয়ারি বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ পিলখানায় সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘বিজিবি মানুষ হত্যা করতে চায় না। সে ধরনের নির্দেশও বিজিবির ওপর নেই। তবে মানুষ হত্যা করতে দেখলে এবং নিজে আক্রান্ত হলে জীবন বাঁচানোর জন্য যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করবে।’ তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি পেট্রোল বোমা ফাটায়। তাহলে পাঁচজন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ঐ বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালিটি করা তার দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে কোনো বোমাবাজকে গুলী করতে বিজিবি কুণ্ঠিত হবে না।’ তিনি বলেন, সীমান্ত রক্ষা আমাদের প্রাইম কাজ। কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষা করা, সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়া, এসব আমাদের সেকেন্ডারি কাজ। সুতরাং এ কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে বিজিবি মহাপরিচালকের কথা থেকে স্পষ্ট হলো যে, সেকেন্ডারি কাজ নিয়েই বিজিবির আগ্রহ অনেক বেশি।
এরপর গত ১৬ জানুয়ারি র‌্যাবের মহাপরিচালক একেবারে ইনু-কামরুলের মতো বক্তৃতা দিয়ে বসলেন যে, ‘নির্ধারিত সময়ের পরেই নির্বাচন হবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এর বাইরে আমরা কোনো কিছুই চাই না।’ বিএনপি জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে র‌্যাব ডিজি বললেন, ‘গত দুই সপ্তাহে মিঠাপুকুরের পাঁচজনসহ সারাদেশে ২৪ জনকে খুন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের মতো একটি গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা দেশের গণতন্ত্র-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে। তারা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ খুনিদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’
একইদিন পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বলেছেন, ‘বিএনপির ভুলের খেসারত জনগণ দেবে না। যারা টকশো করেন, তারা বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ তারা কি বলছেন, তারা নিজেরাই জানেন না। ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করতে দিলে যদি হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হতো, তখন টকশো-ওয়ালারা কী করতেন? এর দায় পড়তো সরকারের ওপর। ...। একটা দলের প্রধান যদি বেআইনি কাজ করেন, তার কাছ থেকে জনগণ কী চাইবে? আপনার ভোট প্রতিরোধ করলেন। ভোট কেন্দ্রে লোক আসতে দিলেন না। ভোটের কেন্দ্রগুলো যেখানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ছিল সেগুলো পুড়িয়ে দিলেন। মানুষ মারলেন। প্রিজাইডিং অফিসার, জনগণকে ভোটের অধিকার দিলেন না। কেন? ভুল আপনারা করছেন। জনগণ খেসারত দেবে? তা এই দেশে আমরা করতে দেবো না ইনশাআল্লাহ। আমরা গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে, আমরা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে কাজ করে যাবো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। কোনো অপশক্তি কোনো সন্ত্রাসী বাংলার মাটিতে কখনও তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ, সেটা আমরা নির্মূল করে ছাড়বো।’
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নাশকতা নির্মূলে কাজ করে যাবো। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হবে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিগুলোর দুর্লবতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবরোধ আর হরতাল সংবিধান পরিপন্থী। হরতাল আর অবরোধের নামের যারা দেশের সম্পদ নষ্ট করছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। শুধু মিথ্যাচার করছে। এই অপশক্তিকে নির্মূল করতে হলে পুলিশের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এই পুলিশ প্রধান আরও বলেন, ‘সংবিধানের কোথাও লেখা নেই গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে, হরতাল ও অবরোধ দিয়ে মানুষ মারা ও জনগণের সম্পদ নষ্ট করতে হবে। হরতাল অবরোধের মতো সংবিধান পরিপন্থী কাজ করে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সংবিধানে রয়েছে, প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমাবেশ করার অনুমতি।’
এই তিন বাহিনীর প্রধানকে সাবাসি দিতে হয়। একেবারে যেন বাকশাল কায়েম হয়ে গেছে। বাকশালের সরকারি কর্মকর্তাদের যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। রাজনৈতিক কর্মী হলে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে আর বাধা কি? আর এই ঘটনার পর এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিন ব্যক্তি। তারাই এখন প্রকাশ্যে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে গুলী চালানো হুকুম ও ভয়ভীতি দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব বাহিনী প্রধানের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার অর্থ সত্যিই বিপজ্জনক। অর্থাৎ সরকার রাষ্ট্রের ওপর নিজের সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। অতএব তাদের জন্য, ‘জয় বিজিবি-পুলিশ-র‌্যাব ভরসা।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আসুন দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করি


দেশে স্বৈরতন্ত্রের অবসান, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের কারামুক্তি ও তাদের ওপর জেল-জুুলুম এবং নির্যাতন বন্ধকরণ, মৌলিক মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের আহ্বানে সারাদেশে গত ১৬ দিন ধরে অবরোধ চলছে। অবরোধের পাশাপাশি পালাক্রমে বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় হরতালও পালিত হচ্ছে। ফলে সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। সরকার পুলিশী নিরাপত্তা দিয়ে আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাক চলাচলের মাত্রা বৃদ্ধির চেষ্টা করলেও পরিবহন চালক ও মালিকরা এতে নিরাপত্তাবোধ করছেন না এবং রাষ্ট্রীয় সকল শক্তি ব্যবহৃত হবার পরও আঞ্চলিক ও আন্তঃজেলা মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের মাত্রা বাড়ছে না। দৈনিক প্রথম আলো ১৮ জানুয়ারি দেশের কর্মমুখর ১২টি জেলার ওপর নিবিড় তদন্ত করে রিপোর্ট করেছে যে, এইসব জেলায় সড়ক মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের হার শতকরা ৩৮ ভাগে নেমে এসেছে। পত্রিকাটির এই রিপোর্টটিতে দেশের দৈনন্দিন অবস্থার প্রতিফলন হয়নি বলে আমার ধারণা। ১৭-১৮ তারিখ তাবলিগ জামায়াতের আখেরী মুনাজাতের কারণে দেশে অবরোধ অবস্থা কিছুটা শিথিল ছিল। অন্যান্য দিনের অবস্থা ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে সীমিত বলে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে। এই অবরোধ-হরতালের পাশপাশি বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও ভাঙচুরের বহু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে এর জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা হচ্ছে। আবার বিরোধী দলগুলোর তরফ থেকে সরকারি দল ও গোয়েন্দা সংস্থার কিছু সংখ্যক সদস্যকে দোষারোপ করে বলা হচ্ছে যে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি এবং তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তারাই এই কাজগুলো করে তার দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগের অতীত চরিত্রকে এখানে তুলে ধরছেন এবং বলছেন যে, হরতাল-অবরোধে ধ্বংসাত্মক কাজে তারা নিজেরাই সিদ্ধহস্ত এবং তাদের যুক্তির সমর্থনে তারা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল এবং ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্র্যন্ত পালিত যথাক্রমে ১৭৩ ও ১৩০ দিনের হরতাল-অবরোধের প্রাক্কালে সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তারা যাত্রাবাড়ী ও শেরাটন হোটেলের সামনে যাত্রীবাহী বাসে গান পাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এবং প্রকাশ্যে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন। অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞ তো ছিলই। আমি মনে করি যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মাধ্যমে অপরাধমূলক কাজ অব্যাহত থাকতে পারে না। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে রাজনীতিতে শিষ্টাচারের প্রতিষ্ঠা এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সৌজন্য ও সহনশীল সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে এখন তাদের আচার-আচরণ সকল শিষ্টাচার, সহনশীলতা, সভ্যতা ভব্যতার নীতি বৈশিষ্ট্যকে পদাঘাত করছে বলে মনে হয়। দেশে এখন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত কোনও সরকার নেই। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে ২০০৮ সালের নির্বাচিত পার্লামেন্টকে বহাল রেখে নানা ছলছুতায় বিরোধী জোটকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে এবং জনগণের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে যে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাকে বাতিল করে আওয়ামী লীগ তার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে ক্ষমতা দখল করে। তারা জনগণকে ভোট দিতে দেয়নি। ২০ দলীয় জোট এখন মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই আন্দোলন করছে।
এই আন্দোলনের পূর্বে তারা সরকারের কাছে তাদের দাবি দাওয়াও পেশ করেছে এবং একটি জনসভার অনুমতি চেয়েছে। সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়নি। সম্মেলনের অনুমতিও দেয়নি। বরং বিএনপি-জামায়াত ও তাদের নেতৃত্বাধীন দলগুলোর নেতা-কর্মীদের জঙ্গি দেশদ্রোহী এবং স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে শুধু রাজনীতি নয় তাদের দেশ থেকে নির্মূলেরও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। সারা দুনিয়া বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে একটি কার্যকর সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে সরকার তাদের জুলুম নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাদেশে বেপরোয়া গ্রেফতার চলছে। দলীয় ক্যাডার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিতভাবে এতে অংশ নিচ্ছে। ফলে সারাদেশ হানাহানি, মারামারির বিশাল প্লাটফরমে পরিণত হয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল টিক্কাখান ১৯৭১ সালে যেমনি অস্ত্রবলে এ দেশে মানুষ নয়, মাটি চেয়েছিলেন তেমনি আওয়ামী লীগও দেশকে বিভক্ত করে তাদের সাথে দ্বিমত পোষণকারী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সকল মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে মাটি পাবার প্রত্যাশা করছেন বলে মনে হয়।
বিরোধী দলকে দমনের জন্য সরকার পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী দিয়ে অপারেশন শুরু করেছেন। এই অপারেশনের রাহবার হিসাবে ১৪ দলের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। তারা অনেক স্থানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের সনাক্ত করছেন এবং যৌথবাহিনী তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের এক অপারেশনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রসূলপুর গ্রামের ৩০টি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বাড়িগুলোর হাজার হাজার বাসিন্দা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়ে এখন আশ্রয়হীন অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে। কেউ তাদের সাহায্যও করতে যেতে পারছে না। পত্র-পত্রিকায় বাড়িঘর ছেড়ে পলায়নপর শিশু-নারী ও পুরুষদের চিত্র প্রায় দিনই প্রকাশিত হচ্ছে। বহু জেলা থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, ‘আসামী’ ধরতে অপারেশনে গিয়ে আসামী না পেয়ে অথবা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার সময় যৌথবাহিনীর সহযোগী সরকার দলীয় ক্যাডাররা বাড়ির রান্নার চুলা ভেঙে দিচ্ছে, খাবার সামগ্রী ফেলে দিচ্ছে এবং লেপ-তোষক, কাঁথা-বালিশ প্রভৃতি পুকুরে ফেলে দিচ্ছে। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের বই-পুস্তকও তারা নষ্ট করে দিচ্ছে। তাদের এই নির্মমতা ফেরাউনী অত্যাচারকেও হার মানায়। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের মানুষ, সে যে দলেরই হোক না কেন, মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে এতো নিচে নেমে গেছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার এখন বিরোধীদল নিধনে ব্যস্ত। আবার চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগ স্বয়ং মারণাস্ত্র নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর হামলা করছে। পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো তার সচিত্র ছবি প্রকাশ করছে। কিন্তু সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ হোস্টেলগুলোতে ছাত্রলীগ অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে; পুলিশ তা উদ্ঘাটন করছে। কিন্তু কোনও বিচার নেই। একইভাবে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যা, নারায়ণগঞ্জের এইট মার্ডার, ফেনীর একরাম হত্যা, নাটোরের সানাউল্লাহ হত্যা প্রভৃতিরও বিচার হীমাগারে চলে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
জনগণের জানমাল, ইজ্জত রক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তাদের নিরপেক্ষতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত। কিন্তু সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানদের প্রদত্ত এ সংক্রান্ত বিবৃতি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। বিজিবি সদস্যদের প্রধান কাজ হচ্ছে সীমান্ত পাহারা দেয়া। সীমান্তে আমাদের নাগরিকরা প্রতিনিয়ত নিহত হচ্ছেন। বিজিবি তাদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পক্ষান্তরে বিজিবি প্রধান যখন বলেন যে, তার বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আন্দোলনরত বিরোধীদলীয় কর্মীদের উপর গুলীবর্ষণ করবেন তখন মাথায় হাত দেয়া ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। নবনিযুক্ত আইজিপি’র বেগম খালেদা জিয়ার সমাবেশ অনুষ্ঠানের দাবিকে আইনের অবমাননা এবং টকশোতে অংশগ্রহণকারী ও সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মন্তব্যকারী সুধীদের দেশপ্রেমে কটাক্ষ অবাক করে দেয়ার মতো বিষয়। র‌্যাব প্রধানের মন্তব্যকেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অহমিকাপূর্ণ, দলীয় পক্ষপাতপুষ্ট এবং দায়িত্বহীন রাজনৈতিক বক্তব্য বলে মনে করেন যা তাদের জন্য শোভনীয় নয়।
আমি একান্তভাবে বিশ্বাস করি, অনেক কষ্টে আমরা দেশটি অর্জন করেছি। ষোল কোটি মানুষের কল্যাণ আমাদের কাম্য। আসুন, এক্সটিমিজম ও হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে দেশটাকে আমরা রক্ষা করি। এর জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। আমাদের প্রধান সমস্যা নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় ঐকমত্য এবং তার মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। নিজেকে আমরা একমাত্র দেশপ্রেমিক ও অন্যদের দেশের শত্রু গণ্য করতে পারি না। আমাদের সকলের খাজনায় দেশ চলে। এই দেশ ধ্বংস হলে আমরাও নিরাপদ থাকতে পারবো না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

রবিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কার্যকর সংলাপের বিকল্প নেই


গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় বিষয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই বিষয়গুলোকে অবজ্ঞা করায় এই জনপদের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে এবং অবশেষে লিপ্ত হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে। ইতিহাসের এই সত্য বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের গুরুত্বের সাথে স্মরণে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দৃশ্য এবং রাজনীতিবিদদের আচরণ দেখে মনে হয় না তারা জনগণের চিন্তাচেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। ভাবতে অবাক লাগে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে কী করে লাগাতার অবরোধ ও হরতালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়! গণতান্ত্রিক সমাজে মতপার্থক্য, বহুমত ও বহুদলের অস্তিত্ব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অপরের মতকে সম্মান প্রদর্শন তথা সহিষ্ণুতা-গুণকে ধারণ করে মত ও পথের পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়েই গণতান্ত্রিক সমাজ প্রগতির পথে এগিয়ে যায়। গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতালিপ্সা কখনো রাজনীতিবিদদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। বরং নিজেদের আদর্শ ও কর্মসূচির আলোকে সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তারা ক্ষমতায় যেতে চাইবেন এবং সেই লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে কর্মতৎপরতার মাধ্যমে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে না এমন রাজনীতিতে সরকারের পক্ষ থেকে যেমন দমন-পীড়ন এবং শঠতা ও চাতুর্যের জন্য লাগাতার অবরোধ ও হরতাল পালনের অধিকার নেই বিরোধী দলের। কিন্তু দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হয়, রাজনীতির কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক চিত্র আজ দেশে বর্তমান নেই। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ এবং বিঘোষিত লক্ষ্যের কথা যেন ভুলে গেছি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানির বিবৃতির পর আমরা কী করে এ কথা মেনে নেব যে, আমাদের রাজনীতিবিদরা সঠিক পথে আছেন এবং নিজেদের আত্মসম্মানের ব্যাপারে তারা সচেতন? গত ১৬ জানুয়ারি রাভিনা যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের বিবদমান দুই পক্ষের প্রতি এক হুঁশিয়ারি বার্তা। বিবৃতিতে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, গভীরতর রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে হত্যাকা-ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এর দায় তাদের নেতারা এড়াতে পারবেন না। ওই বিবৃতিতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দেয়া নাভিপিল্লাইয়ের বিবৃতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকায় জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নাভিপিল্লাইয়ের দফতরের একজন মুখপাত্র তখন চলমান সহিংসতার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারের সম্মুখীন করার দিকে ইঙ্গিত করার কারণ ও প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছিলেন। ওই মুখপাত্র বলেছিলেন, সংলাপের মাধ্যমে সুরাহা না হলে এই সহিংসতা আরও নিকৃষ্ট রূপ নিতে পারে। আর ফৌজদারি অপরাধের দায় থেকে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান, সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কেউই শুধু পদমর্যাদার কারণে রেহাই পেতে পারেন না। উল্লেখ্য যে, এবার ১৬ জানুয়ারির বিবৃতিতে উল্লেখ করা ‘ডেসট্রাকটিভ ব্রিঙ্ক ম্যানশিপ’ কথাটি ২০১৩ সালে পিল্লাইয়ের বিবৃতিতেও বলা হয়েছিল। যার অর্থ হলো, ‘কোনো বিপদজনক নীতি অনুসরণ করার ফলে যুদ্ধ বা ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছানো।’ ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন হাইকমিশনার নাভিপিল্লাই দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে তাদের মতপার্থক্য দূর করে অবিলম্বে ধ্বংসাত্মক নীতি পরিহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর তাতে হেগের আদালতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল। পিল্লাই আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশ রোম সংবিধির দস্তখতকারী দেশগুলোর অন্যতম। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাতিসংঘের নতুন বিবৃতিতে এক বছর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। চলমান সংঘাতকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি। জেনেভায় এক সংবাদ-বিবৃতিতে চলমান রাজনৈতিক সংঘাতে যেসব হত্যাকা- হয়েছে তার সবগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে। এসব হত্যাকা- সরকার বা সরকারের বাইরে যাদের দ্বারাই হোক না কেন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে সেগুলোর নিরপেক্ষ এবং কার্যকর তদন্তের উদ্যোগ নেবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নেয়া পদক্ষেপগুলো যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গ-ির মধ্যে থাকে সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে কেনিয়ায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় এক হাজারের বেশি নাগরিকের মৃত্যুর দায়ে কেনীয় প্রেসিডেন্ট ও ডেপুটি প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন। বর্তমানে বিশ্বের আটটি দেশে আইসিসি মামলা তদন্ত করছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানির বিবৃতিতে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতিবিদদের জন্য মোটেও সম্মানজনক নয়। আমাদের রাজনীতিবিদরা কেন আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হবেন? তারা চাইলে বরং সংলাপের মাধ্যমে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে পুরস্কৃত হতে পারেন। তেমন সামর্থ্য তাদের আছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। ৫ জানুয়ারি কি ধরনের নির্বাচন হয়েছে এবং বর্তমানে দেশ কিভাবে চলছে, তা তো সবার জানা। তাই এ নিয়ে অযথা বিতর্ক না বাড়িয়ে বরং গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণই এখন সময়ের দাবি। এমন লক্ষ্যে এগুতে চাইলে একটি কার্যকর সংলাপের কোনো বিকল্প আছে কী?

শনিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তারা কি রাজনৈতিক নেতার মত কথা বলতে পারেন?


অবরোধ চলছে আজ ১৪ দিন হলো। এর মধ্যে গত ১৫ এবং ১৬ জানুয়ারি দুইটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ১৫ তারিখে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলন করে এমনসব কথা বলেছেন যেগুলোকে বোমা ফাটানোর শামিল বলে গণ্য করা যায়। পরদিন অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে পুলিশের মহাপরিচালক শহিদুল হক এবং র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এমনসব উক্তি করেছেন যেগুলো পলিটিক্যাল লিডারের মতো। তাদের এসব কথা বার্তায় জনগণ হতভম্ব হয়েছেন। জনগণ জানেন যে, পুলিশ, র‌্যাব বা বিজিবি সাধারণত কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন ধরেন। কিন্তু তাই বলে তারা যে একটি দলের নেতা ও ক্যাডারের মতো বক্তৃতা করলেন সেটা ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়। সেভাবে বক্তৃতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন এমন কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রী সান্ত্রী, পুলিশ ও র‌্যাব প্রধানরা যা বলছেন বাস্তবের সাথে তার কোনো মিল নেই। দুইজন মন্ত্রী বলেছেন, ৭ দিনের মধ্যেই নাকি আন্দোলন ঠা-া হয়ে যাবে। কোন সংবাদের ভিত্তিতে এবং কোন হিসাব নিকাশের ভিত্তিতে তারা এসব বলেছেন সেটা আমরা জানি না। কিন্তু গত শনিবার একাধিক পত্রিকা পড়ার পর সেসব পত্রিকার যেসব শিরোনামকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেগুলো নিম্নে তুলে ধরলাম।
০১. রাজধানীতে ৫টি গাড়িতে আগুন।
০২. তেজগাঁওয়ে সাত রাস্তার মোড়ে বাসে আগুন।
০৩. নেত্রকোনায় ট্রাকে আগুন : চালক দগ্ধ।
০৪. ধানমন্ডিতে আওয়ামী সাংস্কৃতিক জোটের অফিসে আগুন।
০৫. রাজধানীর বিজয় নগরে অটো রিক্সায় আগুন।
০৬. বঙ্গভবনের পাশে লেগুনায় আগুন।
০৭. ধানমন্ডিতে বাসে আগুন।
০৮. টিএসসিতে বাসে আগুন।
০৯. রাজধানীর মিরপুরে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ।
১০. পান্থপথে ককটেল ফাটার শব্দে জনমতে আতঙ্ক।
১১. রাতে লক্ষ্মীপুরে ১০ গাড়ি ভাংচুর: অটোরিকশায় আগুন: আহত-৫।
১২. অবরোধে ভাংচুর আগুন: রাতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ।
১৩. নোয়াখালিতে ৩ অটোরিক্সায় আগুন।
১৪. মাধবদীতে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে ঝলসে গেছে যাত্রীবাহী বাস।
১৫. বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাস ভবনে ককটেল বিস্ফোরণ।
১৬. বিজিবির প্রহরায় গাড়ি চলাচল।
১৭. কুষ্টিয়ায় পত্রিকা অফিসের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ।
১৮. রাজধানীতে দুটি বাসে আগুন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী দগ্ধ।
এগুলো ছাড়া চিত্রের অন্যদিকও রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং প্রাক্তন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলী করা হয়েছিল। আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে গেছেন। একাধিক গুলী তার কোমর ও উরু ভেদ করে বেরিয়ে যায়। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ড. মইন খানের বাস ভবনে কে বা কারা গুলী করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবি সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার বাস ভবনে একাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশারফ হোসেনের বাস ভবনে ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়েছে। বেগম জিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক সচিব সাবি উদ্দিনের গাড়ি জালিয়ে দেয়া হয়েছে।
এসব কারা ঘটাচ্ছে সেগুলো আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা ঢালাওভাবে সব ধরনের অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ, গাড়ি ঘোড়া ভাংচুর এবং গুলীবর্ষণের ঘটনার জন্য বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। এ ব্যাপারে  অত্যন্ত নিরপেক্ষ বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। গত শুক্রবার রাত ১০টার ‘সময়’ টেলিভিশনের ‘সম্পাদকীয়’ টকশোতে তিনি দ্বায়িত্বপূর্ণ উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রতিটি হামলার ঘটনাই নিন্দাজনক। কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই যে, কারা এসব ঘটাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার জন্যই সরকার বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে। কিন্তু একটি ঘটনারও তদন্ত করেনি।
দুই
এ ব্যাপারে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ এবং দৈনিক ‘যুগান্তরের’ দুটি সংবাদ প্রনিধানযোগ্য। গত ১৫ জানুয়ারি দৈনিক ‘প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় প্রধান সংবাদে লেখা হয়েছে, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের গাড়ি, কার্যালয় ও বাড়িঘরে হামলাকারীদের পরিচয় নিয়ে পুলিশের ভেতরেই নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ। পুলিশ মনে করছে, হামলাকারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়। ঘটনাস্থলে আলামত সংগ্রহ করতে আসা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এটা ছিল অত্যন্ত দক্ষ হাতের নির্ভুল আঘাত। কারা করেছে তা জানি না। তবে যারা করেছে তারা সব বুঝে শুনেই করেছে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহা পরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যখন কোনো সংকট শুরু হয়, তখন সুযোগ সন্ধানী মহল নানা ধরনের অঘটন ঘটায়। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের উচিত, এদের শক্ত হাতে দমন করা। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
গুলশান থানা পুলিশ জানায়, রিয়াজ রহমানের ঘটনা তদন্তে নেমে গতকাল পুলিশ বেশকিছু তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া একটি গুলীর খোসা ও ব্যবহৃত বুলেটের অংশ। গতকাল আলামত সংগ্রহে আসা সিআইডি কর্মকর্তারা এসব পরীক্ষা করেন। ঘটনাস্থলের পাশের একটি ভবনের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও চিত্রও পুলিশ হাতে পেয়েছে। ওই ভিডিও চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘটনার পর চারটি মোটর সাইকেলে করে লোকজন চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি মোটর সাইকেলে একটি কম বয়সী ছেলে আছে। তবে ছবিতে এদের চেহারা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। রিয়াজ রহমানের গাড়ি চালককে পুলিশ এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি। উদ্ধার করা গাড়িটি পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। সিআইডির কর্মকর্তারা গতকাল গাড়ি থেকে বিভিন্ন ছাপ সংগ্রহ করেন।
হাসপাতালের ব্রিফিংয়ের আগে বিএনপির চেয়ার পারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির পররাষ্ট্র-সংক্রান্ত বিষয়গুলো যাঁরাই দেখছেন, বেছে বেছে তাঁদের ওপরই হামলা চালানো হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। যারা এ ঘটনা ঘটাচ্ছে, সরকারের উচিত তাদের খুঁজে বের করা। এর আগে বিএনপি চেয়ার পারসনের আরেক উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলছেন, সরকারের মদদপুষ্টরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ১০ জানুয়ারি রাত নয়টার দিকে গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কে বিএনপি চেয়ার পারসনের উপদেষ্টা সাবিহউদ্দীন আহমেদের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এর এক ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে আরেক উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর গুলশান অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলী ছুঁড়ে মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক। পরদিন রাত ১০টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান ও খন্দকার মোশাররফ হোসেনের গুলশান-২ নম্বরের বাসার সামনে ফাঁকা গুলী ছোঁড়ে দুর্বৃত্তরা। একইদিন বেলা তিনটার দিকে আরেক উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেনের রামপুরার মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার চেম্বারের সামনে চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। ওইদিন রাত ১১টার দিকে ধানমন্ডিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে ফাঁকা গুলী ছোড়া হয়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এরা কারা? এরা কী ভাড়াটে সন্ত্রাসী? না অন্য কেউ? জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ‘প্রথম আলোকে’ বলেন, হামলাকারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন তাঁরা। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। দুটি ঘটনায় হামলাকারীদের ছবি সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। এসব ভিডিও এখনো পুলিশের হাতে আসেনি। ছবি পেলে সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।
তিন
গত ১৬ জানুয়ারি দৈনিক ‘যুগান্তর’ প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বিশ্লেষণধর্মী খবর ছেপেছে। খবরটির শিরোনাম, ‘অপরাধী কারা’? খবরে বলা হয়েছে, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্পর্শ কাতর ও জনবহুল স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ককটেল বিস্ফোরণ, গুলী ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনার পরপরই নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা গুলী ছুঁড়ছে, তারা খুবই দক্ষ এবং তাদের নিশানাও নির্ভুল। এমনকি তারা অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করছে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনাও। সবকিছুই ঘটছে সুপরিকল্পিতভাবে। টার্গেট করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে তারা। কিন্তু অপরাধী কারা, তা এখনও চিহ্নিত হয়নি। নিরাপত্তার ভারি চাদরে ঢাকা বেশ কয়েকটি স্থানে নাশকতা হওয়ায় কর্তব্যরত আইন শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা, বিচারক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির গাড়ি, কার্যালয় ও বাড়ি-ঘরে হামলাকারীদের পরিচয় নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। হামলাকারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি কর্মী নাও হতে পারে বলে ধারণা তাদের। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অবরোধ ও হরতালসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে চলেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অন্যদিকে সরকারের পুরো মেয়াদ স¤পন্ন করতে বদ্ধপরিকর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের এমন অনড় অবস্থানকে পুঁজি হিসেবে বার বার ব্যবহার করেছে স্বার্থান্বেষী মহল। এর খেসারত দিতে হয়েছে দুই দলকেই। তাদের ধারণা, এ মুহূর্তে আবারও তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে ওই মহলটি। চলমান অবরোধে আইনমন্ত্রীর বাড়িতে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমাবেশে, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও হাইকোর্ট চত্বরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের ওপর বিক্ষিপ্ত হামলার ঘটনায় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতংক ও উদ্বেগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কূটনীতিক পাড়ায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কারও পক্ষে সহজেই পার পাওয়ার কথা নয়। কানাডিয়ান ও সৌদি দূতাবাসের সামনে কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো আছে। গুলশানসহ রাজধানীর যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ স্থানেই এই ক্যামেরা দিয়ে বেষ্টনী। ককটেল নিক্ষেপের সময়ও নিক্ষেপকারীদের দেখে ফেলা সম্ভব। পুলিশের এ সক্ষমতা আছে। কিন্তু নিক্ষেপকারীরা ধরা পড়ছে না। আবার যেখানে টহল জোরদার আছে তার আশপাশেই নিক্ষেপ করা হচ্ছে ককটেল।
চার
প্রথমে শুরু করেছেন জাসদের সংসদ সদস্য মইনুদ্দিন খান বাদল। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য কিন্তু বাদল সাহেবকে কোনো ইলেকশন করতে হয়নি। কারো ভোটও দিতে হয়নি। মুফতে তিনি এমপি হয়ে গেছেন। সেদিন তিনি বললেন, যারা অবরোধের আন্দোলন করছেন প্রথমে তাদের পায়ে গুলী করতে হবে। তাতে যদি কোনো কাজ না হয় তাহলে বুকে গুলী করতে হবে। এরপর দৃশ্যপটে এলেন বিজিবি বা বর্ডার গার্ডের মহা পরিচালক মেজর জেনারেল আজীজ আহমেদ। গত ১৫ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কারো হাতে পেট্রোল বোমা দেখলে বিজিবি সদস্যরা অবশ্যই অস্ত্র তুলে নেবে। কারণ একজনের পেট্রোল বোমায় হয়তো পাঁচজনের জীবন চলে যাবে। তাই তাকে দমন করাটাই শ্রেয়। এরপর আবার বলেন, “একজন ব্যক্তি যদি বোমা ফাটায় তাহলে ৫ জন লোক নিহত হতে পারে। এই দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ওই বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালটি করা তার দায়িত্ব’।
র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ বলেন, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের পরেই অনুষ্ঠিত হবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এর বাইরে কোনো কিছু নয়।
পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, অবরোধ আর হরতাল সংবিধান পরিপন্থী। হরতাল আর অবরোধের নামে যারা দেশের সম্পদ নষ্ট করছে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিগুলোর দুর্বলতার কারণে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি মানুষ হত্যা করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানবতা বিরোধী, সন্ত্রাসী, দেশ ও জনগণের শত্রুদের রুখতে হবে। গতকাল শুক্রবার রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সন্ত্রাস ও নাশকতারোধে সুধীজনের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক মত বিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইজিপি এসব কথা বলেন। এই সভায় র‌্যাবের মহা পরিচালক বেনজীর আহমেদ সন্ত্রাসীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এবার সন্ত্রাস করতে হলে জীবন হাতে নিয়ে এসো। জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল ও অবরোধকারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে হরতাল এবং অবরোধ দিয়ে মানুষ মারা ও জনগণের স¤পদ নষ্ট করতে হবে।
এ সব উক্তির ওপর মন্তব্য করার প্রয়োজন পড়ে না। এরা সরকারি অফিসার। তারা আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীর মতো কথা বলতে পারেন কি না, সেটা বিবেচনা করবেন জনগণ।
আসিফ আরসালান 

Ads