মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আমদানি খাদ্য নিয়ে বিতর্ক


সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবির পাশাপাশি চাল রফতানির খবর প্রচার করা হলেও বাস্তবে পরিস্থিতির উল্টো অবনতি ঘটে চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষাসহ বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই দেশে ২৮ দশমিক ৪৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে, যার মধ্যে চালের পরিমাণ পাঁচ লাখ টন। এ সময় বেসরকারি পর্যায়ে আট দশমিক ৬৯ লাখ টন চাল এবং ১৯ দশমিক শূন্য দুই টন গম আমদানি করা হয়েছে। অর্থবছরের বাকি চার মাসে আরো ১৪ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হতে পারে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিগত অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩১ দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিক টন, চলতি অর্থবছরে সেখানে আমদানির পরিমাণ বেড়ে হতে পারে ৪২ লাখ মেট্রিক টন। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো, এমন অবস্থার মধ্যেও সরকার নিজের সাফল্য ও কৃতিত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যে ২৫ হাজার টন চাল রফতানি করেছে। ফলে সঙ্গত কারণেই খাদ্য উৎপাদনের প্রকৃত হালচাল নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, সত্যিই খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়ে থাকলে এত বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করার প্রয়োজন পড়তে পারে না। পর্যালোচনায় প্রাধান্যে এসেছে কৃষকদের বঞ্চনা সম্পর্কিত তথ্য। কৃষক বোরো ধানের যথেষ্ট উৎপাদনই করেছিল। কিন্তু সরকার কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। প্রতি মণ ধানের জন্য কৃষককে যেখানে অন্তত ৮০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে সরকার সেখানে মাত্র ৮০ টাকা বেশি অর্থাৎ ৮৮০ টাকা দাম নির্ধারণ করেছিল। সেই দামও পায়নি কৃষক। সরকার নানা অজুহাতে সময় নষ্ট করায় কৃষককে খোলা বাজারে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। আর সে পর্যায়েই মাঠে নেমেছিল ফড়িয়া থেকে মহাজন পর্যন্ত বিশেষ গোষ্ঠী, যাদের পেছনে সরকারের প্রকাশ্য সমর্থন ও প্রশ্রয় রয়েছে। তারা রাজনীতি তো করেই, অনেকে আবার আওয়ামী লীগেরও নেতা-কর্মী। এই গোষ্ঠীর লোকজন সরকার-নির্ধারিত ৮৮০ টাকার স্থলে প্রতি মণের দাম দিয়েছে বড়জোর ৫০০ টাকা। কোনো কোনো এলাকায় ৪০০ টাকাও পায়নি কৃষক, অথচ ধান কাটার জন্য দিনমজুরকেই দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। ফলে সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক। এমন অবস্থায় বাধ্য হয়ে তারা চোরাচালানীদের কাছে ধান বিক্রি করেছে। ধানও রাতারাতি চলে গেছে ভারতে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বাস্তবে এটাই ছিল গোপন পরিকল্পনা। একই গোষ্ঠী একদিকে ধান-চাল পাচার করেছে অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে আমদানি করার অনুমতিও আদায় করেছে। মূলত সে কারণেই খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ টন বেড়ে গেছে। তুলনামূলক পরিসংখ্যান হলো, উৎপাদিত ধান-চালের মাত্র ৩৬ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়েছে। বাকি ৬৪ শতাংশই হয় চোরাচালানের পথে ভারতে পাচার হয়েছে নয়তো রয়েছে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর দখলে। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবে, ইতিমধ্যে করতে শুরুও করে দিয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সবকিছুর পেছনে খাদ্যশস্য নিয়ে সরকারের অশুভ রাজনীতিই প্রধান কারণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। নিজের কৃতিত্ব ও সাফল্য সম্পর্কে জাহির করার জন্য যা আদৌ সত্য নয় তাকেই সরকার জোর করে সত্য বানাতে চেয়েছে। এতেও আপত্তি উঠতো না, সরকারের পক্ষ থেকে যদি কৃষকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হতো। অন্যদিকে মুখে লম্বা অনেক আশ্বাস দিলেও সরকার এ বছরও বোরো মওসুমে কোনো সাহায্য করেনি তাদের। শুধু ধান কেনার সময় ঠকেনি কৃষক, তারও আগে তাকে খোলা বাজার থেকে অনেক বেশি দামে ভারতীয় সার ও বীজ কিনতে হয়েছিল। সেই সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকায় পানির মেশিন চালানোর জন্য কৃষককে ডিজেল কিনতে হয়েছে। সেখানেও সরকারের প্রশ্রয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বিক্রেতারা। এসবের পাশাপাশি প্রয়োজনের সময়ে ব্যাংক ঋণও পায়নি কৃষকরা। তাদের তাই আবারও গ্রামীণ সুদখোর মহাজন এবং এনজিওদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সবশেষে ছিল ধান বিক্রির সময় বঞ্চনা ও বিপদের পালা। অথচ তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে এবং আমরাও মনে করি, ধান-চাল নিয়ে অশুভ রাজনীতি করার পরিবর্তে সরকার যদি কৃষকদের জন্য কিছুটা লাভজনক মূল্য পাওয়ারও ব্যবস্থা করতো তাহলে একদিকে চোরাচালান প্রতিহত করা সম্ভব হত, অন্যদিকে খাদ্যশস্যও আমদানি করার প্রয়োজন পড়তো না। কিন্তু দলীয় লোকজনের পকেট ফুলিয়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল বলেই সরকার বাঁকা পথে পা বাড়িয়েছে। আমরা এই নীতি-কৌশল ও উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাই। সরকারের উচিত সস্তা রাজনীতির পথ ছেড়ে কৃষকদের কল্যাণে ভূমিকা রাখা এবং জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো।

সোমবার, ২৯ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট ও মানবাধিকারের টুকিটাকি


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস্ এন্ড লেবার সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত রিপোর্টে ২০১৪ সালে এই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটি নিটোল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুম, নারী নির্যাতন, বাক-স্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের একাংশের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়া, সরকারি খাতের ব্যাপক দুর্নীতি, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতিকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, এই বিভাগের সামর্থ্যরে ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং বিচারের আগে দীর্ঘমেয়াদী ডিটেনশানের সমালোচনা করে বলা হয় যে, এর ফলে বিচার প্রার্থীরা অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং সরকার বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন। এতে বলা হয় যে, আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা সরকারি কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বুদ্ধ করছে এবং অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার ও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা সংক্রান্ত কোনও পরিসংখ্যান প্রকাশ অথবা এ ব্যাপারে কোনও তদন্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় রিপোর্টে সরকারের সমালোচনা করা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভাষায় “The Government took limited measures to investigate and Prosecute cases of security force abuse and killing.” রিপোর্টে মানবধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থাকে অত্যন্ত ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন রাজনীতি নেই। স্বৈরাচারী পন্থায় আওয়ামী লীগ এখন তার অনুগত এবং জনধিকৃত কিছু দল ও রাজনৈতিক এতিমদের সাথে নিয়ে দেশ শাসন করছেন। বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত এমপি’ ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়ী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত পার্লামেন্টে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে অস্ত্রবলে এখন তারা দেশ চালাচ্ছেন এবং কেউ কেউ মনে করেন যে, দেশটি এখন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ব্যভিচারের আঁস্তাকুড়ে পরিণত হয়েছে। আইনের শাসন এখন আর নেই। ফলে ক্ষমতাসীনরা যে যেখানে পারছেন সেখানেই আখের গুছাচ্ছেন।
এদিকে নিরাপত্তা বাহিনী পর্যায়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অংশে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার প্রবণতাও মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে হয়। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী গত তিন মাসে বিভিন্ন স্থানে ২৮ ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এদের কেউ ছিনতাইকালে, কেউ চুরি আবার কেউ বিনা কারণে এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়।
॥ দুই ॥
আমাদের দেশের সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। নিখুঁত ন্যায়বিচার পাওয়া আমার আপনার সকলের অন্যতম মানবিক অধিকার। স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান এবং আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যম ছাড়া কারুর নাগরিক অধিকার হরণ করা যায় না। এটা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনে রয়েছে। কিন্তু দেশের সব মানুষ তো আর সংবিধান পড়েননি, গণপিটুনি বা গুলী করে মানুষ হত্যা অথবা তাকে পঙ্গু করে দেয়ার পরিণাম ও তাৎপর্য তাদের সকলেরই জানা থাকার কথা নয়। আইনগত দিক থেকে সরকারি অবস্থান ব্যাখ্যা করা হলে এ ব্যাপারে মানুষের মটিভেশনের কাজ সম্পন্ন হতো এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কম হতো বলেই মনে হয়। অবশ্য সরকারি অবস্থান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এখানে কিছু সমস্যাও রয়েছে বলে অভিজ্ঞজনদের ধারণা। তাদের মতে আজকে যে বা যে সব দল ক্ষমতাসীন রয়েছেন তারাই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পুরানা পল্টনে প্রকাশ্য দিবালোকে সাপের মত পিটিয়ে মানুষ হত্যা করেছিলেন। আবার এরাই ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহকে একই কায়দায় হত্যা করেছিলেন। এ দু’টি হত্যাকা-ের বিচার এখনো পর্যন্ত হয়নি। এই অবস্থায় গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যার যে সব ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে তার প্রতিকার ও বিচারের ব্যাপারে মানুষ অনেকটা হতাশ।
দেশের প্রত্যেকটি জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়নেও বিচারালয় রয়েছে। থানায় পুলিশ আছে, ইউনিয়নে চৌকিদার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মী আছে, আদালতে বিচারক আছেন, সরকারি-বেসরকারি উকিল আছেন। আইনকে সমুন্নত রাখা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ও মানুষের মানবিক অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চত করা এদের কাজ। সাংবিধানিক পদ্ধতির বাইরে এবং তার মূল স্পিরিটের সাথে সংগতিহীন বিচারের যে কোন ব্যবস্থাই বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গুম করে হত্যা, মাতাল হয়ে পিস্তল দিয়ে গুলী করে পাখির মতো মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে অথবা লুটপাটের উদ্দেশ্যে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মারধোর- এর প্রত্যেকটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে দেশে এই অপরাধের বিচার হয় না সে দেশে আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন হত্যা, গুম ও গণপিটুনীর অংশ হয়ে যায় তখন তো কথাই নেই।
প্রতিবাদী হওয়া মানুষের একটি সামাজিক প্রবণতা। এই প্রবণতার পেছনে  কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। এক, পুলিশ ও আইন-আদালতের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে সে সম্পর্কে এক শ্রেণির মানুষের অনীহা ও অনাস্থার মনোভাব। সুবিচার বা ন্যায়বিচার পাবার ক্ষেত্রে মানুষের যখন সংশয় দেখা দেয় তখনি তারা আইনকে হাতে তুলে নেয়। চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে এবং হাতেনাতে অপরাধীদের পাকড়াও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার পরও যখন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় কিংবা নির্দিষ্ট মেয়াদে শাস্তি ভোগ করে পুনরায় একই অপরাধে লিপ্ত হয়, তখনি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা থেকে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে নিজেদের মর্জিমত বিচার-আচারে লিপ্ত হয়। এই কথা কে না জানে যে, আমাদের দেশের জেলখানাগুলো অপরাধ বিদ্যার এক একটি উচ্চতর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে। অপরাধীদের সংশোধন, অপরাধের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পেশাগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ জেলাখানায় অপরাধীরা খুব একটা পায় না। এখানে তারা পরস্পর পরস্পরের সংস্পর্শে এসে অপরাধের কলাকৌশল সম্পর্কে পারস্পরিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। চুরির অপরাধে যে জেলে যায় সে বড় ডাকাতের জ্ঞান ও ডিগ্রি নিয়ে জেল থেকে বের হয়। এর ফল স্বাভাবিক। মানুষ পাপের পরিবর্তে পাপীকে ঘৃণা করতে শেখে এবং অপরাধের মাত্রা নির্বিশেষে পকেটমার, চোর, ডাকাত, হাইজাকার যাকেই যেখানে ধরতে পারে তাকেই পিটিয়ে হত্যা করে।
দ্বিতীয়ত পিটিয়ে মানুষ মারার আরেকটি কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুস্পষ্ট। এটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ। কিছুসংখ্যক কায়েমী স্বার্থবাদী মাতব্বর, রাজনৈতিক নেতা ও দল এই কাজের উদ্যোক্তা। তারা নিজেদের লোক লেলিয়ে দিয়ে কাল্পনিক অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিদের মারধোর ও হত্যা করে এবং বিরোধী শিবিরের লোকজনদের আসামী করে থানায় মামলাও করে। বহু নিরপরাধ লোক এই চক্রের হাতে নির্যাতিত হয়। বিভিন্ন জেলায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার এর অন্তর্ভুক্ত। এই অত্যাচার এখন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; ইসলামী ছাত্রীসংস্থা ও ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত পুরুষ ও নারী কর্মীদের বেলায়ও সাংঘাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। বিচারলয়ে গিয়ে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক মামলায় নিরীহ রাজনৈতিক কর্মীদের বিচারের কাজেই বিচারকদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে হয়। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ ও অন্যান্য ফৌজদারী অপরাধের জন্য চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার করার তারা সময়ই পান না। ফলে দেশে অপরাধপ্রবণতা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আমাদের দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান। কিন্তু আমরা আমাদের সমাজে এখন তা দেখতে পাই না। ক্ষমতাসীন দল বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা যত বড় অপরাধই করুক তাদের জন্য সাত খুন মাফ। সামাজিক জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামাজিক সংহতির সমস্ত গ্রন্থিগুলো খুলে পড়ছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে পড়ছে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো আগেই মেরুদ- হারিয়েছে। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এখন ব্যভিচারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সমাজের নৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিচ্ছে। তাদের অপরাধের কোনও বিচার হয় না। সমাজে যারা সুকৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, চরিত্রবান মানুষ তৈরিতে বদ্ধপরিকর তারা এখন সরকারের শত্রু। এ প্রবণতার অবসান হওয়া প্রয়োজন এবং এ জন্য প্রত্যেকটি মানুষের সচেতন ও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তা না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এবং আমরা কেউই তা থেকে রেহাই পাবো না।

রবিবার, ২৮ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পলাশীর কথিত যুদ্ধ ও কাশিমবাজার কুঠির ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে রবার্ট ক্লাইভ ও শেঠগণ


কলকাতায় কাশিমবাজার কুঠিস্থ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ফলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস আবারো প্রাসঙ্গিকতা পাচ্ছে। কারণ  বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনতা পাওয়ার কথা যত লেখা আছে; স্বাধীনতা হারানো কথা লেখা আছে ততই। বিশেষত সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হারানোর প্রত্যক্ষ ধারা যদিও এখন আর নেই; তথাপি বিশ্বের দেশে দেশে প্রচ্ছন্নভাবে ক্ষমতা হারানোর ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের পাতায়, আমাদের কাছে এবং দূরে এমন উদাহরণেই কমতি নেই। তাই পলাশীর ঘটনা এখনো প্রাসঙ্গিক।    
ইতিহাস জানাচ্ছে যে, উপমহাদেশের আদি ঔপনিবেশিক শক্তি ওলন্দাজরা সযতনে কলকাতাকে এড়িয়ে কুঠি ফেঁদেছিল কিঞ্চিত দূরে, হুগলীর চুঁচুড়ায়। ওলন্দাজদের কেউ কেউ নাকি কলকাতাকে ডাকত ‘গলগথা’ নামে, যার মানে মড়ার খুলি, বা খুলিভর্তি জায়গা। মনে রাখতে হবে, যীশুকে যেখানে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই পাহাড়ের নামও ছিল গলগথা। সেই প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকেই, মহা ষড়যন্ত্র ও দুর্দশার জায়গা বোঝাতে এই কথাটা ব্যবহার হয়। শুধু ওলন্দাজদের দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই।  কারণ, প্রাচীন আমল থেকেই এ অঞ্চল সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায় যে: ‘বঙ্গদেশ মুঘল ও অন্যান্য বৈদেশিকগণের স্বাস্থ্যের প্রতিকূলরূপে বিবেচিত হইত; সেই জন্য যে সকল কর্মচারী রাজার বিরাগভাজন হইত, তাহারাই বঙ্গদেশে প্রেরিত হইত। সুতরাং এই ঊর্বর ভূখ-ে চিরবসন্ত বিরাজমান থাকিলেও, ইহা অন্ধকারময় কারাগার, প্রেতভূমি, ব্যাধিনিকেতন ও যমালয় স্বরূপে পরিগণিত হইত।’ এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিক থেকেও এ অঞ্চলের বিবরণ ঐতিহাসিকগণ দিয়েছেন।
এহেন কলকাতায় দুর্ধর্ষ ইংরেজরা এসে ঘাঁটি বানালেন। যদিও তারা জানতেন, ইংরেজদের মধ্যে প্রচলিত ‘টু মনসুন্স’ কথাটা। এর মানে, নতুন সাহেব-মেম জাহাজ থেকে নেমে চন্দ্রপাল (চাঁদপাল) ঘাটে পা রাখার পরে তাঁদের আয়ুর সীমাকাল মাত্র দুটি বর্ষা। এর মধ্যেই কবরের মাটি নিত অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ। সাত সাগর পাড়ি দিয়ে ছেলেছোকরারা আসত চটজলদি টাকা কামানোর ধান্দায়; যুবতী মেয়েরা আসত বড়লোক স্বামীর খোঁজে। তারা অনেকেই গিয়ে মিলত গোরস্থানে।
শুধু সাহেবরা নয়, যে সব পশ্চিমি সেপাই কোম্পানির বাহিনীতে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসত, আক্ষেপ করত তারা এই বলে: ‘দাদ হোয়, খাজ হোয়,/আর হয় হৌহা/ কলকাত্তা নাই যাও/ খাও মৌহা।” তা সত্ত্বেও, তখন এ ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর, কালক্রমে রাজধানী। ফলে, মৌহা না খেয়ে তারা বরং কলকাতাতেই আসত। বিরাম ছিল না লোক আসার। বিরাম ছিল না রোগের, মত্যুরও। আর বিরাম ছিল না তার প্রতি উদাসীন থেকে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার।
এমনই এক শহর প্রতিষ্ঠা করেন জোব চার্ণক্য। আর একে শক্তি ও ভিত্তি দেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভের বয়স তখন মাত্র পঁচিশ। এই যুবক মাত্র আঠারো বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য রাইটারশিপ বা কেরানিগিরি চাকরি নিয়ে ভারতের পথে জাহাজে উঠেন। সে সময় তার সামনে ছিল মাত্র দু’টি উপায়: ভারতে গিয়ে ধনবান হওয়া অথবা জ্বরে মরে মারা যাওয়া। তিনি প্রথম উপায়টিই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অনুসরণ করেন এবং নিজের ব্যক্তিগত ও জাতিগত সাফল্যের স্মারকে পরিণত হয়ে ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে নিজের স্থায়ী  ছাপ অঙ্কন করেন। লর্ড মেকলের ভাষায়- ‘এদেশ (ইংল্যান্ড) অনেক বীর ও রাষ্ট্রনায়কের জন্ম দিয়ে থাকলেও তার (ক্লাইভ) চেয়ে বড় যোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনায়কের জন্ম দেয়নি।’
কিন্তু ক্লাইভ কতটুকু যোদ্ধা আর কতটুকু ষড়যন্ত্রী ছিলেন, ইতিহাস সেটাও জানাচ্ছে। এই জুন মাসে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ কিংবা ষড়যন্ত্রের ঘটনাপ্রবাহে সেসব পুনরায় বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের মতোই স্বাধীনতা হারানোর কথাও ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাই স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস জানা যেমন জরুরি; স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস জানাও তেমনি জরুরি। 
বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে পরবর্তী-তাৎপর্য ও গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেছেন। তাঁর এ মতের সঙ্গে কারো দ্বিমত পোষণের অবকাশ খুব কম। তবে বিশ্বখ্যাত এ যুদ্ধটি রণাঙ্গনে দেখি এক ভিন্নরূপ। ২৩ জুন ১৭৫৭। সুবা বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশী নামক গ্রামের প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল ক্লাইভের সেনাবাহিনী ও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থানে। সকাল নয়টায় যুদ্ধ শুরু, বিকেল চারটার মধ্যেই যুদ্ধ শেষ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধ-নাটকে বা ষড়যন্ত্রেই সব শেষ হয়ে গেল। বাংলার স্বাধীনতা গেল। 
এখন ইতিহাসবিদরা বলছেন, পলাশীতে যুদ্ধ হয়নি বললেই চলে। যা হয়েছে, তার নাম ষড়যন্ত্র। এহেন যুদ্ধ-নাটকের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল প্রবল পরাক্রমশালী ‘ষড়যন্ত্র-কার্যক্রম’ সিরাজের স্থলে ক্লাইভকেই কেবল ক্ষমতায় আনেনি, পলাশীর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা থেকে শুরু করে ক্রমেই সমগ্র ভারতে এবং আরো পরে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থাপন করে রাজনৈতিক-সামরিক শক্তিতে ভরপুর ‘বাণিজ্যিক বলয়’-যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে এবং পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায়। এবং পলাশীর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ‘ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রিটেনের আদলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে।’
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলাভাষী অন্যান্য অঞ্চলেও কিছু সাম্প্রদায়িক ও উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাসকার  ব্যতিত সকল সৎ, যোগ্য এবং প্রজ্ঞাবান ঐতিহাসিক একবাক্যে বলেছেন যে, ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকল ষড়যন্ত্র আর বিদ্বেষের জাল জগৎশেঠের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছিল। রবার্ট ক্লাইভ স্বয়ং লিখেছেন, ‘কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি চক্রান্তের পেছনে থাকলেও আসল নেতৃত্ব দিয়েছিল জগৎশেঠ নিজে।’  মঁশিয়ে জা-ল প্রমুখ সমকালীন-নিরপেক্ষ  ইতিহাসকার লিখেছেন, অনেকদিন ধরে বাংলায় যে সব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিল জগৎশেঠ। ... ইংরেজরা যা করছে (পলাশীর কথিত যুদ্ধবিজয় এবং বাংলা-ভারতে উপনিবেশ স্থাপন) তা জগৎশেঠের সমর্থন ছাড়া কখনো করতে পারত না।’
কে বা কারা এই জগৎশেঠ, সেটা জানা দরকার। শেঠরা বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশের লোক নয়। তারা উত্তর ভারতের যোধপুরের নাগোর  এলাকার মানুষ। জৈন ধর্মের অনুসারী, হীরানন্দ তাদের পূর্ব-পুরুষ। প্রথমে তারা ভাগ্যান্বেষণে বিহারের পাটনায় আসে। হীরানন্দের পুত্র মানিক চাঁদ ঢাকায় তার গদি স্থাপন করে। এ  পর্যায়ে তৎকালীন শাসক মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়। মুর্শিদকুলী খানের অনুগমন করে তারা নতুন শহর মুর্শিদাবাদে এসে জেঁকে বসে। বাদশাহ্ ফররুখ শিয়ারের কাছ থেকে তারা শেঠ উপাধি লাভ করে মুর্শিদকুলী খানেরই বদৌলতে। ইতিমধ্যে সারা ভারতের প্রধান প্রধান নগরীতে শেঠদের গদি স্থাপিত হয় এবং চলতে থাকে অর্থলগ্নী ও সুদের ব্যবসা। বলা বাহুল্য, সে যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রচলিত না থাকায় জগৎশেঠরা অলিখিত ব্যাংকার হিসাবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চালাতে সচেষ্ট হয়। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যু হলে ভাগিনা ফতেচাঁদ প্রথম ‘জগৎশেঠ’ উপাধি  প্রাপ্ত হয় এবং তার মৃত্যু হলে তদীয় পৌত্র মাহতাব চাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পায়। অপর শেঠ স্বরূপচাঁদ লাভ করে মহারাজ খেতাব।  শেঠদের গদিতে তৎকালীন সময়ের বাজার মূূল্যে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হত। এহেন জগৎশেঠরা পলাশী বিপর্যয়ের নেপথ্য কারিগর-ষড়যন্ত্রের হোতা।
মূলত নবাব সুজাউদ্দিনের সময় থেকেই এরা নানা অপকর্মে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দী তাদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন বটে, কিন্তু শেঠরা ঘাপটি মেরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলাতে থাকে এবং রাষ্ট্রের সংহতির শিকড় কাটতে থাকে। শেঠরা নবাব পরিবারের মধ্যে অর্থ, ঘুষ ও কুমন্ত্রণা দিয়ে নানা উপদল তৈরি করে এবং একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। যে বিভক্তির কারণে তারা ইংরেজদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। বিশেষ করে তরুণ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে এরা প্রথম থেকেই ছিল খাপ্পা। যে কারণে তারা সিরাজের জন্য দিল্লী থেকে সনদ আনানোর ব্যাপারে চরম উদাসীনতা ও গড়িমসি প্রদর্শন করে। এরা প্রথমে শওকতজঙ্গ, পরে ইয়ার লতিফ ও সর্বশেষ মীর জাফরকে বাংলার নবাব বানানোর প্রজেক্ট গ্রহণ করে। কারণ নবাব সিরাজ ছিলেন লুটেরা-শোষক শেঠদের সীমাহীন নির্যাতন, কায়েমী স্বার্থ ও নীচুতার প্রতিবন্ধক। ফলে তারা নবাব পদে সিরাজকে সহ্য করতে পারেনি এবং নিজেদের বশংবদ একজনকে নবাব বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়। এরাই পুরো ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে এবং ইংরেজ ও প্রাসাদের ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দূতিয়ালী ও সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ ও স্থানীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে সম্পাদিত হয় বাংলার স্বাধীনতা-বিনাশী গোপন চুক্তি। আর এভাবেই পদদলিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
বাংলার স্বাধীনতা হারানোর নেপথ্যে কলকাতাস্থ ভয়ঙ্কর-ষড়যন্ত্র এবং ক্লাইভ ও শেঠদের ভূমিকা এতোই উজ্জ্বল যে, কিছুতেই সেটা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তদুপরি প্রায়-তিন শত বছর হয়ে গেলেও ক্লাইভ বা শেঠদের বংশ লোপ পায়নি। তারা এখনো আছে।

শনিবার, ২৭ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বদেশকে যারা ভারত বানিয়েছিল

গত ৬-৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির বাংলাদেশ সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে ২০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার একটি চুক্তিও বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল নয়। আর এই চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, ‘আমাদের যে পার্শ্ববর্তী দেশ, আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো, তাদের সঙ্গে গত ৪০ বছরে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে একটা সীমানা রেখা ছিল, আমি মনে করি ধীরে ধীরে সেটাও আজকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আমরা এখন সবাই এক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছি’ (এনটিভি, অনলাইন/মানবজমিন অনলাইন, ০৭.০৬.১৫)। তার অর্থ, ভারত ও বাংলাদেশ ক্রমেই এক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতরে যারা রাস্তাঘাটে বাংলাদেশবিরোধীদের খুঁজে খুঁজে পেরেশান হচ্ছেন, তারা, আশা করি, উপলব্ধি করতে পারছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বা বাংলাদেশবিরোধী কাদের বলে।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মন্ত্রী কিভাবে এখনো মন্ত্রিপরিষদে থাকতে পারে, সেটা দেশবাসীর একটা বড় প্রশ্ন। কই স্বাধীনতাবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী বলে যারা অবিরাম মুখে ফেনা তুলছেন, তারা এখন কোথায়? আমাদের এখনই চিহ্নিত করে রাখার দরকার আছে, কারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ভারতের সাথে এক রাষ্ট্র করতে চাইছে।
আমাদের মধ্যে একটা গৎবাঁধা বুলি আছে : তা হলো একশ্রেণীর নাগরিকের উদ্দেশে আমরা বলতে পছন্দ করি যে, ওরা দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়। এর মানে বোঝা দুঃসাধ্য। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর দুটো মাত্র পথ খোলা আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা একেবারে মাটির গভীর থেকে খুঁড়ে লাখ লাখ আলাদিনের দৈত্যের মাথায় তুলে নিয়ে যেতে হবে পাকিস্তান সীমান্তে। এর জন্য উপযুক্ত স্থান হবে সিন্ধু প্রদেশের সীমান্তবর্তী করাচির পাশে সমুদ্রের ভেতরে। এলাকাটা এই কারণে বেছে নিতে হবে যে, পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকার সীমান্ত বরাবর রয়েছে আর কোনো দেশ। স্বাভাবিকভাবেই তারা সেখানে বাংলাদেশকে বসিয়ে দেয়ার জন্য ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা ছেড়ে দেবে না। এতএব বাংলাদেশের অবস্থান হবে সমুদ্র থেকে গভীরতম সমুদ্রে।
আরো একটা পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আর তা হলো, আদর্শিকভাবে। বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এই প্রক্রিয়াটা বেশ কঠিন ও জটিল। কারণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেই বাংলাদেশের পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সংবিধানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কথাটা লিখে দিলেই বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের জীবনধারা বদলে যাবে না। আর পাকিস্তান হয়ে যাওয়াটা তো বহুদূর। কারণ ইরানও ইসলামী প্রজাতন্ত্র, পাকিস্তানও ইসলামী প্রজাতন্ত্র। তাই বলে এই দুই রাষ্ট্র কোনো দিন এক রাষ্ট্র হয়ে যাবে, বর্তমানকালে কোনো পাগলেও বোধকরি এ চিন্তা করতে পারবে না। বাংলাদেশের পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার এই দু’টি পথ ছাড়া ভিন্ন কোনো পদ্ধতি জানা নেই।
তা হলে উপায়? সে উপায় বাতলাতে পারেন এই প্রচারবাজরাই। কোনো উন্মাদও, ধারণা করি বলবে না যে, বাংলাদেশকে মাটি খুঁড়ে গাছের চারার মতো তুলে নিয়ে অন্য কোথায়ও বসিয়ে দেয়া সম্ভব। আর নাম পরিবর্তন করলেই একটি দেশ আরেকটি দেশে পরিণত হয়ে যায় না। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। এ সব কথা বাতকে বাত বা স্লোগান মাত্র। বাস্তবে এসব কথার দুই পয়সাও দাম নেই। আমাদের মধ্যে একশ্রেণীর ইতিহাসজ্ঞানহীন লোক আছেন, যারা এসব কথা গালি হিসেবে ব্যবহার করেন।
কিন্তু দেশে এখনো এমন গালি কেন প্রচলিত হয়নি যে, ওরা বাংলাদেশকে ভারত বানাতে চায়? অথচ বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যে মাত্রায় কঠিন, তার চেয়ে অনেক সহজ ভারত বানানো। কারণ বাংলাদেশকে ভারত বানানোর জন্য দেশটাকে মাটি খুঁড়ে অন্য কোথায়ও তুলে নিয়ে যেতে হবে না। বাংলাদেশ আছে ভারতীয় সীমান্ত বরাবর। শুধু তাই নয়, এ দেশের তিন দিকই ভারত দ্বারা বেষ্টিত। উপরন্তু বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রও ঘোষণা করতে হবে না। ভারত হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি শাসিত রাষ্ট্র হলেও তারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ। আর বাংলাদেশ যত বড় স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিতই হোক না কেন, তারাও ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে এই মাসতুতো ভাইদের একত্রে মিলে যাওয়ার পথে কোনো বাধা নেই। আর সে কারণেই এ দেশের কোনো মন্ত্রী বলতে পারেন যে, ভারত- বাংলাদেশ ক্রমেই একরাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।
ভারতীয় দালালদের কারসাজিতে এর আগে অন্তত দু’টি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। সে দু’টি রাষ্ট্র হলো মনিপুর ও সিকিম। মাত্র ২২ হাজার ৩২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মনিপুর ভারতের মিজোরাম সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। লোকসংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ মণিপুরে ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন মিতেই গোষ্ঠীর রাজা নন্দা লাইরেন পাখাম্বা। তিনি ছয়টি গোষ্ঠীকে একীভূত করে তার রাজকাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণুবাদ, যা হিন্দুত্ববাদেরই অংশ। মিতেইদের সঙ্গে ওই উপত্যকায় শান্তিতে বসবাস করে মিজোরাও। ১৭২০ সাল থেকে মনিপুরে স্থায়ী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশরা এই রাজ্য অধিগ্রহণ করে। মনিপুর ছিল ব্রিটেনের ভারতভুক্তির শেষ রাজ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ও তার মিত্ররা মনিপুর আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তারা রাজধানী ইমফল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী ওই এলাকায় আসার আগেই মণিপুরীরাই জাপানি বাহিনীকে যুদ্ধ করে হটিয়ে দেয়। এখান থেকেই উপমহাদেশে যুদ্ধে নতুন ধারার সূচনা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালেই মনিপুর ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ওই বছরই মনিপুর তার সংবিধান রচনা করে। তাতে মহারাজা হন রাষ্ট্রের সম্মানসূচক প্রধান নির্বাহী। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। একটি সংবিধান প্রণীত হয়। তাদের জাতীয় পতাকাও ছিল। সে সংসদে সংখ্যালঘিষ্ট হয়েও মণিপুরের কংগ্রেস নেতা রাজার ভাই প্রিয়ব্রত সিং ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রিয়ব্রত রাজা হতে চেয়েছিলেন। ভারত তাকে সে আশাও দিয়েছিল। কিন্তু মণিপুরের ভারতভুক্তির পর ভারত সরকার তাকে আর বিশ্বাস করেনি। আর তিনিই ছিলেন মূল বিশ্বাসঘাতক। মনিপুরীরা ঘৃণাভরে তার নাম উচ্চারণ করে। আর লাখো মানুষের ঘৃণা নিয়েই গৃহবন্দী অবস্থায় বহু বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী থাকার পর ২০০৫ সালের ২৯ অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে তিনি রাজাদের একটি প্রাসাদে বন্দী অবস্থায় মারা যান। 
কিন্তু ভারত মনিপুর রাজ্যটি দখল করে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে ১৯৪৭ সাল থেকেই। ১৯৪৯ সালে ভারত মনিপুরের মহারাজা বুদ্ধচন্দ্রকে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে ডেকে পাঠায় এবং অস্ত্রের মুখে ২১ সেপ্টেম্বর তাকে দিয়ে মনিপুরের ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। যদিও ওই চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো সাংবিধানিক অধিকার রাজার ছিল না এবং ওই চুক্তি স্বাক্ষরের তিনি শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করতে থাকেন। তখন তাকে বলা হয় যে, তিনি যদি ভারতভুক্তির স্বাক্ষর না করেন, তবে ভারত রাজপরিবারের অন্য কাউকে রাজা করবেন, যিনি এই চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি আছেন। এটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। রাজপরিবারে বিশ্বাসঘাতক ছিল, কিন্তু নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়ার মতো কেউ ছিল না। শেষে বিপুল সেনা দিয়ে প্রাসাদ ঘিরে ফেলে রাজা বোধচন্দ্রকে দিয়ে ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই নেয়া হয়। এরপর মনিপুরের জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে ১৯৪৯ সালেরই অক্টোবরে সামরিক অভিযান চালিয়ে মণিপুরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ভারত। ১৯৭২ সালে মনিপুর পুরোপুরিভাবে একটি ভারতীয় রাজ্যে পরিণত হয়। আর রাজা শিলংয়ের প্রাসাদে বন্দী থেকে ১৯৫৫ সালে মারা যান।
কিন্তু ভারতের তরফ থেকে এ উদ্যোগ আসার পর গোটা মনিপুরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা গভর্নর জেনারেলের কাছেও প্রতিবাদলিপি পাঠায়। স্পিকারসহ জাতীয় সংসদের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য এর তীব্র বিরোধিতা করে। তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রিয়ব্রত (মণিপুরের ভাষায় তার নামের উচ্চারণ প্রিয়ব্রাত্তা) মনিপুরে সব বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন। কিন্তু তাকেও বিশ্বাস করেনি ভারত। ফলে তাকেও একটি প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়।
আর ভারতভুক্তির পর থেকেই মনিপুরিরা তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে। সে যুদ্ধ চলছেই। এমনকি মনিপুরের স্বাধীনতাকামীরা মোদির বাংলাদেশ সফরের পাক্কালে গেরিলা হামলা চালিয়ে ২০ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে।
আর সিকিমের বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। মণিপুর, নেপাল, সিকিম আর ভুটান দখলের স্বপ্ন ছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর। শ্রীলঙ্কার দিকেও তার চোখ ছিল। তবে তিনি শুধু মণিপুর দখল করে যেতে পেরেছিলেন। সিকিম দখল করেছেন তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী। ভুটান জাতিসঙ্ঘের সদস্য হয়ে যাওয়ায় দখলে অসুবিধা হয়ে যায়। তবে দেশটি সম্পূর্ণরূপে ভারতের কব্জায়ই আছে। 
লেন্দুপ দর্জি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে। ছিলেন সিকিমে। তিনি সিকিম স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে তার লক্ষ্য ছিল, সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা। সে লক্ষ্যেই তিনি রাজা চোগিয়ালের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে এই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে চোগিয়াল দক্ষতার সঙ্গেই তা মোকাবিলা করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় র-এর প্ররোচনা ও ধারাবাহিক আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৭৩ সালে দর্জি যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা আর মোকাবিলা করতে পারেননি চোগিয়াল। চোগিয়াল ধরে নিয়েছিলেন, তিনি গান্ধীর অনুসারী ও ভারত-অনুরক্ত। ফলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মতো কোনো কাজ ভারত করবে না। কিন্তু তবু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিকিমের পতন ঘটে এবং সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
ভারতের চাপে রাজা চোগিয়াল সরকার, সিকিম কংগ্রেস ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি বলে সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালে সিকিমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টিতেই জয়লাভ করে সিকিম কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী হন দেশদ্রোহী দর্জি আর তিনি নেপালের খ্যাতিমান পত্রিকা কান্তিপুরের সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, ওই নির্বাচনে বা আন্দোলনে যত না সিকিমিজ অংশ নিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় অংশ নিয়েছিল ভারতীয় সৈন্যরা। সংসদে দর্জি ভারতের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব তেলেন এবং তা বিনা বাধায় পাস হয়ে যায়। আর সে পথ ধরেই ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ সিকিম ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। তার চার দিন পরে তথাকথিত এক গণভোটে সিকিমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। তাতেও বেশির ভাগ ভোট দিয়েছিল সাদা পোশাকে ভারতীয় সৈন্যরা। পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে তাই রাষ্ট্রদোহী ব্যক্তির নাম আর মীরজাফর নেই, লেন্দুপ দর্জি হয়ে গেছে।
১৯৭৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে লেন্দুপ দর্জি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ক্ষমতায় ছিলেন পাঁচ বছর। সিকিমে ১৯৭৯ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে দর্জির কংগ্রেস একটি আসনও লাভ করতে পারে না। ফলে এই রাষ্ট্রদ্রোহী দর্জিকে ক্ষমতা শুধু নয়, সিকিম ছেড়েই চলে যেতে হয়। ভারত সরকার তাকে পশ্চিমবঙ্গের কালিমপংয়ে কার্যত বন্দী করে রাখে এবং তাকে বাকি জীবন তার জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে নিঃসঙ্গ কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময় ভারতীয় আইবির লোকেরা সপ্তাহে দুদিন এসে তাকে গাট্টি গাট্টি টাকা দিয়ে যেত। ওই সাংবাদিক সুধীর শর্মার সঙ্গে দু’দফা সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দুঃখ ও আফসোস করেছেন। বলেছেন, এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শুধু কি তিনি একাই দায়ী?
সুধীর শর্মাকে তিনি জানান, ‘র’সহ যে ভারতীয় গোয়েন্দারা তার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেছে, তাদের সঙ্গে দিনাতিপাতের টাকা পয়সার জন্য কথা বলতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় কখনো কখনো মাসের পর মাস। নিজের সার্বভৌম দেশকে অন্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার ঘৃণা তার প্রতি এতটাই তীব্র ছিল যে, তার আত্মীয়স্বজনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন না। সিকিমবাসীর এই পর্বতপ্রমাণ ঘৃণা নিয়ে ১০৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই কাজী লেন্দুপ দর্জি মারা যান। ইতিহাস সাক্ষী, এ পর্যন্ত কোনো দেশদ্রোহীরই বেদনাবিহীন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভারত ও প্রণব মুখার্জি প্রসঙ্গে আরো একবার


গত সপ্তাহের নিবন্ধে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে অংশ না নেয়ার কারণ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য উল্লেখ করেছিলাম। এবারের নিবন্ধে খালেদা জিয়ার সে বক্তব্যের ভিত্তিতে কিছু বিশেষ তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। মিস্টার মোদি ঘুরে যাওয়ার পরপর ভারতের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, নিজের প্রাণনাশের আশংকা ছিল বলেই ২০১৩ সালের মার্চে তিনি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসেননি। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, সেদিন জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ছিল। হরতালের মধ্যে গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে আসার বা যাওয়ার পথে তার ওপর হামলা চালানো হতো এবং হামলা ও হত্যার দায় চাপানো হতো জামায়াতের ওপর। এটাই ছিল সরকারের পরিকল্পনা- ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলেন বলেই খালেদা জিয়া বৈঠক বাতিল করেছিলেন। এটাই ছিল প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার ‘প্রকৃত’ কারণ।
খালেদা জিয়ার কথার মধ্যে সত্যতা আছে কি না তা নিয়ে সরকারের উচিত ব্যাখ্যা দেয়া। আমরা শুধু অন্য কিছু কথা স্মরণ করতে পারি। কথাগুলো সে সময় ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত। তারা এমন এক প্রচারণা চালিয়েছিলেন যেন ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে খালেদা জিয়া বিরাট কোনো ‘অপরাধ’ করে ফেলেছিলেন! সে প্রচারণা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। এখনো তারা বিএনপির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিম তো মাত্র ক’দিন আগে সংসদে দাঁড়িয়েও মিথ্যাচার করেছেন। অন্যদিকে সত্য কিন্তু তেমন ছিল না- ক্ষমতাসীনরা যেমনটি বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং এখনো বোঝাতে চাচ্ছেন। কারণ, এই সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত তারিখ ছিল ২০১৩ সালের ৪ মার্চ। সেদিন এবং তার আগেরদিন আগেই হরতাল ডেকেছিল ১৮ দলীয় জোটের দ্বিতীয় প্রধান দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জোটের প্রধান নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে হরতাল ভঙ্গ করা এবং গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া গণহত্যাসহ সরকারের ফ্যাসিস্ট কর্মকা-ের কারণে তার জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নও ছিল, যে কথাটা এতদিন পর তিনি প্রকাশ করেছেন। এজন্যই খালেদা জিয়া অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এতেই নাকি সরকারের ‘মহাভারত’ অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল! ওদিকে ভারতীয়রাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সুদূরপ্রসারী বার্তা’ দিয়েছেন! রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার আরো জানিয়েছিল, খালেদা জিয়া আসবেন না- এ খবরটি জানার পর প্রণব মুখার্জির মুখের হাসি নাকি কিছুক্ষণের জন্য ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল!
ক্ষমতাসীনরা ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করার বিষয়টিকে নিয়ে এভাবে রাজনীতি করলেও দেশপ্রেমিকরা কিন্তু তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট নেত্রীর সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তারা বলেছিলেন, সরকার আসলে প্রণব মুখার্জিকেও নিজেদের দাবার ঘুঁটিই বানিয়ে ছেড়েছেন। না হলে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতিকে সম্মান দেখানোর সত্যিই সদিচ্ছা থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত-শিবিরের গণতন্ত্রসম্মত প্রতিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এতটা ভয়ংকরভাবে মারমুখী হয়ে উঠতো না। তার সফরের ডাশ প্রাক্কালে ডজনে-ডজনে লাশও ফেলতো না। ক্ষমতাসীনরা ঠিকই জানতেন, আন্দোলনকারীদের লাশের ওপর দিয়ে খালেদা জিয়া অন্তত প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন না। তেমন অবস্থায় তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে এবং নতুন পর্যায়ে ভারতের সমর্থন আদায় করতে পারবেন। মূলত অমন এক কূটিল কৌশল নিয়েই এগিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। অন্য একটি কথাও ব্যাপকভাবেই আলোচিত হয়েছিল। সেটা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি প্রণব মুখার্জির সমর্থন সংক্রান্ত। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যখন সেনা অফিসারদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন এই প্রণব মুখার্জি নাকি ঢাকা থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘অনুরোধ’ তথা ‘এসওএস’ বার্তা পেয়েছিলেন। এই বার্তার ভিত্তিতেই তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। কলকাতা ও আসামের গৌহাটি বিমান বন্দরে যুদ্ধ বিমানগুলোকেও রেখেছিলেন ‘প্রস্তুত’ অবস্থায়। পিলখানায় হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য পাল্টা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এটা ছিল পরিষ্কার হুমকি, যার ওপর ভর করে বিপদ পাড়ি দিয়েছিল সরকার। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন উপলক্ষে প্রণব মুখার্জি আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন। তার কিছু কার্যক্রম নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুধু নয়, ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে। সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পর এবং পিলখানা হত্যাকান্ডের ঠিক প্রাক্কালে একই প্রণব মুখার্জি ১০ ঘণ্টার এক রহস্যময় ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন (৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)। তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই সফর সম্পর্কে তখন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, সেবার ঢাকায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলের নেত্রী এবং তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। হতে পারে, খালেদা জিয়া তার ‘বন্ধু’ ছিলেন না, কিন্তু গণতন্ত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করাটা প্রণব মুখার্জির কর্তব্য ছিল। তা না করায় মইন উ’র সঙ্গে একান্ত বৈঠক নিয়ে সে সময় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। কারণ, ততদিনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল এবং মইন উ রাষ্ট্রীয় কোনো বিশেষ অবস্থানে ছিলেন না। বলা হয়েছে, এর পর পর সংঘটিত পিলখানা হত্যাকান্ডকে বিবেচনায় নেয়া হলে এবং তারও আগে লগি- বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে তথাকথিত ১/১১ ও রোডম্যাপ এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার কথা স্মরণ করা হলে প্রণব মুখার্জির উদ্দেশ্য সম্পর্কে নাকি ধারণা পাওয়া যেতে পারে! বড়কথা, দু’ দেশের সরকার চেষ্টা চালালেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার বিষয়ে কিন্তু মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছিল, সেটা যদি ‘অশোভন’ ও ‘কূটনৈতিক সৌজন্যের লংঘন’ না হয়ে থাকে তাহলে হরতালের যুক্তিসঙ্গত কারণে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন এত পাড়া মাতানো হয়েছিল?
প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে অন্য একটি কারণের মধ্যে। ক্ষমতাসীনরা আসলে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন খালেদা জিয়ার দুটি বিবৃতির জন্য। প্রথম বিবৃতিটি তিনি দিয়েছিলেন ২ মাচ (২০১৩)। এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, নিরস্ত্র জনগণের ওপর সরকার শুধু গুলী চালাচ্ছে না, গণহত্যার ভয়ংকর অভিযানও চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভিনদেশী কোনো হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দেশের ওই সময়ের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ সংকট হিসেবে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সরকার গোটা জাতিকে বিভক্ত করে এক ভয়ংকর সংঘাত ও সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সরকারের মদতে একটি কুচক্রী মহল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে পবিত্র ইসলাম এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে নোংরা কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে। তারা সরকারবিরোধী সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধরে ধরে ‘জবাই’ করতে চাচ্ছে। শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম ও গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি ইঙ্গিত করে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সরকার একটি গোষ্ঠীকে উস্কানিমূলক ও বেআইনী কর্মকা- সংঘটনে প্রতিনিয়ত আস্কারা ও সমর্থন দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে এই গোষ্ঠীর লোকজন জাতীয় জীবনে বিভেদ-বিভাজনকে উস্কে দিচ্ছে। হত্যাকান্ডে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। শাহবাগীরা অভিযুক্ত প্রত্যেককে ফাঁসি দেয়ার যে অন্যায় দাবি জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী তার পক্ষ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের প্রতি দাবিটি বিবেচনায় রেখে রায় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন ঘটনা নজীরবিহীন। এমন পরিস্থিতিতে কোনো বিচারকের পক্ষেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা কিংবা রায় দেয়া সম্ভব নয়। তাই এ ট্রাইব্যুনালের যে কোনো রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গক্রমে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারেও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার আমরাও চাই। তবে সে বিচার হতে হবে স্বচ্ছ এবং দেশী ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে। আমরা বিচারের নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের পক্ষপাতী নই। অন্যদিকে চলমান বিচার প্রক্রিয়া, ট্রাইব্যুনাল ও আইন নিয়ে শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ব্যাপক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। সে কারণে আমরা বার বার সরকারকে সতর্ক করেছি। এ বিচারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য গঠন খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সরকার আমাদের কথায় কান দেয়নি।
৪ মার্চের দ্বিতীয় বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার হীনউদ্দেশ্যে সরকার পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়ে দেশে বিরাজিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি এই আত্মঘাতী ষড়যন্ত্র থেকে বিরত হওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সজাগ থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিচার প্রক্রিয়ার ওপর বিক্ষোভের চাপ প্রয়োগকে সমর্থন জানিয়ে, জাতিকে বিভক্ত করে ও সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়ে এবং নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়ে সরকার ক্ষমতায় থাকার সব নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশ আরো ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। সে কারণে অনতিবিলম্বে ‘রক্তপিপাসু খুনি’ সরকারের পদত্যাগ দাবি করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া হলে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। সরকারের জন্য এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। সবশেষে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আসুন সবাই মিলে দেশ বাঁচাই, মানুষ বাঁচাই। আসুন মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ ফসল গণতন্ত্রকে রক্ষা করি। জনগণের জানমালের হেফাজত করি এবং জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করি।
এসব লক্ষ্য অর্জন করার উদ্দেশ্যেই বেগম খালেদা জিয়া ২০১৩ সালের ৫ মার্চ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিলেন। তার ডাকে সাড়াও পড়েছিল জনগণের মধ্যে। হরতাল পালিত হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। এর কারণ, কোনো একটি প্রশ্নেই তিনি সামান্য বাড়িয়ে বলেননি বরং বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেছিলেন কঠিন সত্য। বস্তুত ইসলাম বিরোধী প্রচন্ড উস্কানি থেকে নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র পর্যন্ত প্রসঙ্গগুলোর পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সরকারের মদতে শাহবাগের কথিত তরুণ প্রজন্ম শুধু বিচার প্রক্রিয়াকেই চ্যালেঞ্জ করেনি, ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগানের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতার ওপরও হস্তক্ষেপ করেছিল। বন্দী সব নেতাকে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে তারা গায়ের জোরে রায় আদায় করার চেষ্টা চালিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়াও তাই না বলে পারেননি যে, ন্যায়বিচারের সর্বশেষ আশাটুকুও তিরোহিত হয়ে গেছে। একই কারণে এ ট্রাইব্যুনালের যে কোনো রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। ইসলামবিরোধী ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রচারণা ও কর্মকান্ড সম্পর্কেও যথার্থই বলেছিলেন তিনি। ইসলাম ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো বিরোধ না থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার শুধু উস্কানি দিয়ে বেড়ায়নি, ইসলাম এবং স্বাধীনতাকেও মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে নোংরা কুৎসা রটিয়ে বেড়ানোর সাহস পেয়েছে। হীন ও ভয়ংকর এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। কিন্তু দেশের ৯০ ভাগ অধিবাসী মুসলমানদের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান দেখানোর পরিবর্তে সরকার পুলিশকে লেলিয়ে দিয়েছিল। প্রণব মুখার্জির সফরের প্রাক্কালে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ঘটনাপ্রবাহের প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ১১ দিনে পুলিশ ১৭ জনের লাশ ফেলেছিল। এরপর এসেছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা-উত্তর পরিস্থিতি। ২৮ ফেব্রুয়ারির একদিনেই সরকার পুলিশকে দিয়ে ৬০ জনের বেশি মানুষের লাশ ফেলেছিল। সব মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। পৈশাচিক এ হত্যাকা-কেই বেগম খালেদা জিয়া ‘গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তার এ মন্তব্য যথার্থ হলেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। বলে বেড়িয়েছিলেন, জামায়াতের ডাকা ৩ ও ৪ মার্চের হরতালের পরদিন হরতালের ডাক দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি নাকি জামায়াতের ‘লেজুড়বৃত্তি’ শুরু করেছে! এ ব্যাপারে এককালের ঘোর আওয়ামী লীগ বিরোধী বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের বক্তব্য উল্লেখ করতেই হবে। তিনি বলেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া নাকি জামায়াতের ‘ভারপ্রাপ্ত আমীর’ হয়েছেন! বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা, সম্ভব হলে দল দুটির ঐক্যে ভাঙন ধরানো। এই চেষ্টা তারা বহুদিন ধরেই চালাচ্ছিলেন। বিএনপির জন্য মায়াকান্নাও তারা কম কাঁদেননি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।
এ ধরনের কোনো চেষ্টাতেই যে কাজের কাজ কিছু হবে না সে কথা স্বয়ং খালেদা জিয়াই পরিষ্কার করেছিলেন। ২০১৩ সালের ২ মার্চই প্রথম নয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে শুরু থেকেই তিনি একই অবস্থান বজায় রেখেছেন। যেমন জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের পরপর, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের কথা বলে জাতিকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিল মুজিব সরকার। চার দশক পর আরেক আওয়ামী লীগ সরকার বিচারের নামে জাতিকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে সরকারের এই নীতিকে খালেদা জিয়া ‘দু-মুখো নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, বিচারের নামে সরকারের পদক্ষেপটি জাতিকে শুধু বিভক্তই করবে না, দেশে রাজনৈতিক সংঘাতেরও উস্কানি দেবে। প্রায় আড়াই বছর পরও খালেদা জিয়া সে একই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। বাস্তবেও দেখা গেছে, সরকার দেশকে বিভক্ত করে ফেলেছে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে এবং দেশের নিরাপত্তা যাতে বিপন্ন না হয় সে জন্যই খালেদা জিয়া দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জনগণ যে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসবে তার লক্ষণ ও সূচনা দেখা গিয়েছিল ৫ মার্চের হরতালে। এজন্যই প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের চাল ও কৌশল তখন কোনো কাজে আসেনি। এখনো আসবে বলে মনে হয় না। কারণ, এতদিন পর খালেদা জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক বাতিল করার প্রকৃত কারণ ফাঁস করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ তো বটেই, ভারতীয়রাও তার কথাই বিশ্বাস করবে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জির তো আরো নির্দিষ্টভাবেই জানার কথা!
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মানবপাচারের মহামারি বেড়েই চলছে দায় কার!


এই লেখাটি শুরু করেছি মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত রচনা কবর নাটকের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে। নাটকটির পটভূমি ছিল মহান ভাষা আন্দোলনের। লেখক কারাবন্দী অবস্থায় এই নাটকটি লেখেছিলেন। আমরা যারা একটু আধটুকু পড়ালেখা করেছি তারা সবাই কম বেশি কবর নাটকের মর্মার্থ বুঝতে পেরেছি। ইতিহাসের পাঠে কবরের কথা শুনেছি কিন্তু গণকবরের কথা শুনেনি। গত কয়েকদিন ধরে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো বেশ ফলাও করে প্রচার করেছে গণকবর সম্পর্কিত প্রতিবেদন। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এমনিতে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তারপরে আবার গণকবরের সংবাদ দেশবাসীর মনে আরও ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
আমি যে সময়ে এই লেখাটি লেখছি সে সময়েও সংবাদের শিরোনামে মানবপাচারের ভয়াবহতার নির্মম কাহিনীর সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। আর এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখনও হয়তো বা নিহত বা আহতদের সংবাদের কথা শুনতে হবে। এই মানবপাচার হঠাৎ করে কেন বেড়ে গেল সেই প্রশ্ন কেউ করেনি বা করার সাহসটুকু পাচ্ছে না। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একশ্রেণীর দলকানা সুশীলরা যতই উন্নয়নের কথা বলে জনগণকে বোকা বানাতে চাচ্ছে ততই কেন জানি দেশের আসল চিত্র জাতির সামনে ফুটে ওঠছে। বাসন্তীর কথা কেউ মনে রাখেনি। বাসন্তী তার লজ্জাকে ঢাকতে শরীরে মাছ ধরার জাল পরেছিল। আজ হয়তো বা বাসন্তীর মতো কেউ জাল পড়ছে না। কিন্তু জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে বাসন্তীর ভাই ব্রাদার।
মানবপাচার যে এক মানবিক বিপর্যয়ের নাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যার অন্যতম শিকার বাংলাদেশের মানুষ। মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে দেশের শত শত মানুষ ভিটেবাড়ি বিক্রি করে পাড়ি দিচ্ছে অজানা গন্তব্যে। মালয়েশিয়ায় চাকরির আশায় অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলার ডুবিতে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তার হিসেব নেই। পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে জীবন দান কিংবা ক্রীতদাসের জীবনবরণ করার ঘটনাও কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সাগরপথে মানবপাচারের ঘটনা বেড়েই চলছে। জীবনের তাগিদে মানুষ ছুটে চলে গ্রাম থেকে শহরে কিংবা দেশ থেকে দেশান্তরে। অভাবের তাড়নায় ভালোবাসাও জানালা দিয়ে চলে যায় দূর আকাশে। তখন প্রিয়ার মিষ্টি হাসি আর রঙিন স্বপ্নের কথা শুধু মাত্র রুপকথার গল্পের মতো আকাশে ভাসতে থাকে। এই সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে ঘরে ঘরে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ডিপ ফ্রিজের ভিতরে রয়েই গেল। ক্রসফায়ার মামলা কিংবা গ্রেফতার কোন কিছুই মানবপাচারের টুঁটি চেপে ধরতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি। সরকারের অন্যায়মূলক কোন কথার প্রতিবাদ করলে বা লিখলে সরকারদলীয় লোকজন তেড়ে আসেন। আবার সরকারের জয়গান গাইলে অন্যায় করেও পার পাওয়া যায়। নিকট অতীতে সরকারের সোনার ছেলেরা নিজেরা নিজেদের রক্ত ঝরাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের আজ্ঞাবহ সুশীলরা কোন কথা বলতে অক্ষম।
  ছোটবেলায় পড়েছিলাম অন্যায় যে করে আর যে সহে তারা সমান অপরাধী। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সুজলা সুফলার এই দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে হন্যে হয়ে অবৈধ উপায়ে যখন ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার কৌশল গ্রহণ করে তখন আর আইনের শাসন বা সুশাসন সমাজ বা দেশে থাকে না। আমার কথার সাথে কেউ কেউ হয়ত বা দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। আর করাটাই স্বাভাবিক। নবাব সিরাজউদদৌল্লার পতন ত্বরান্বিত করার পিছনে যতখানি না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল নবাবের কাছের প্রিয় সহচররা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সারা বিশ্ব যেখানে বলেছেন এটি একটি প্রহসনের নির্বাচন সেখানে গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারা বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সরকার জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি সেই সরকার কি করে মানবপাচার বন্ধ করবে এটাই প্রশ্ন? যে শ্রমিকের কর্মস্থল চামড়ার কারখানায়, চামড়ার গন্ধ সে টের পায় না। অথচ অন্যরা বহুদূর থেকে সে গন্ধ টের পায়। তেমনি অবস্থা বাংলাদেশের জনগণের। দেশ যে ডুবছে- সেটি তারা বুঝতেই পারছে না। আগুনের জ্বলন্ত শিখা দেখার পরও সেখানে যে আগুন জ্বলছে সেটি বুঝতে কি পণ্ডিত হওয়া লাগে? চোখ-কান থাকলেই সেটি বোঝা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের চোখ-কান আছে বলেই কি মানবপাচারের মহামারি বন্ধ করতে পারছে না।
রাষ্ট্রে যখন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য দিতে পারে না, কলকারখানার শ্রমিকদের শ্রমের প্রকৃত মজুরি ও নিরাপত্তার কর্ম পরিবেশ দিতে পারে না, শিক্ষিত যুবকদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না তখনই কেবল জীবিকার খোঁজে অবৈধ পথে পাড়ি জমায় মানুষ। লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় খুঁজছে কেন তা রাষ্ট্রের উচিত সবার আগে খতিয়ে দেখার। এ কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হওয়ায় তরুণরা অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইসিআরের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিন বছরে পাচার হওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) আরেক হিসেবে জানা যায়। ২০১৪ সালে পাচারের সময় ৫৪০ জন বাংলাদেশী গভীর সমুদ্রে মারা গেছেন, নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। ৮ মে ব্যাংক পোস্টেও এক প্রতিবেদনে বলা হয়, থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশে জঙ্গলের ঘাঁটি থেকে ১১৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯১ জন বাংলাদেশী। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১০ মে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে ৪টি ট্রলার থেকে ৪৬৯ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশী এবং মালাক্কা প্রণালীতে সমুদ্রে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় আছে ৭-৮ হাজার অভিবাসী। এর পরদিন উদ্ধারকৃত ১ হাজার ১৮ জনের মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশী ও ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে ১০১ জন নারী ও ৫২টি শিশু। এ যাবত থাইল্যান্ডে মোট ৩৩টি গণকবর থেকে ৩৩ জন অভিবাসীর দেহাবশেষ ও কংকাল উদ্ধার করা হয়েছে। আর এ মানবপাচারে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এ চার দেশের ২৪১ জন দালাল জড়িত  (দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ মে ২০১৫)। বিদেশের মাটিতে এভাবে আর কত মায়ের বুক খালি হয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হবে? গত ৬ বছরে ৫৬টি দেশ থেকে ১৪ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে। তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে (প্রথম আলো ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। যাদের ঘাম আর রক্তে উপার্জিত রেমিটেন্সে দেশীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, সেই অর্থনীতির সোনার ডিম দেয়া প্রবাসীরা যখন দেশে আসে লাশ হয়ে, তখন প্রতিকার ও প্রতিরোধহীন নির্বিকার অকৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে ধিক্কার জানায় বিমানবন্দরের কফিনের সারিগুলো। আমরা বিদেশের মাটিতে আর কোনো বাংলাদেশীর দাসত্বের বন্দীজীবন আর অনাহারে মৃত্যু দেখতে চাই না। সাগরের নৌকায় ভাসমান মানবেতর জীবন, বিমানবন্দরে কফিনের মিছিল, কবর থেকে উঠিয়ে আনা কংকাল কিংবা সাগরের পানিতে ফেলে দেয়া মানুষের লাশ দেশের মানুষ আর দেখতে চায় না।
মো: তোফাজ্জল বিন আমীন 

বুধবার, ২৪ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সরকারের দ্বিমুখী নীতি


বিভিন্ন এলাকার মেয়র এবং নির্বাচিত অন্য জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত, অপসারণ ও গ্রেফতার করার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মতো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সরকার দুই রকম নীতি-কৌশল অবলম্বন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিছু উদাহরণ উল্লেখ করে বুধবার একটি দৈনিক পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ব্যাপারেও সরকার নগ্নভাবেই পক্ষপাতিত্ব করছে। যেমন এই সময়ে গম কেলেংকারীর সঙ্গে জড়িত একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সহসা হবে বলেও মনে হচ্ছে না। আরেকজন মন্ত্রী দুদকের দায়ের করা মামলায় দন্ডিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে রেহাই দেয়া হয়েছে, এখনো তার মন্ত্রিত্ব যায়নি। একই ধরনের খবর জানা যাচ্ছে আরো অনেকের সম্পর্কেও। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তথা বিরোধী দলের কেউ হলে তাদের সামান্য ছাড় দেয়া হচ্ছে না। দেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশনের কর্তৃত্ব দখলে নেয়ার গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার একদিকে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচিত মেয়র ও অন্য প্রতিনিধিদের সাজানো মামলায় ফাঁসাচ্ছে, অন্যদিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি পুলিশকে দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে দাখিল করাচ্ছে চার্জশিট। একযোগে চলছে স্থানীয় সরকার আইনের অপব্যবহার করে মেয়রদের সাময়িক বরখাস্ত ও অপসারণ করার কার্যক্রম। রাজশাহী, সিলেট, খুলনা এবং গাজীপুরের পাশাপাশি কুমিল্লা ও বরিশালসহ অন্য সব এলাকার মেয়রদের বিরুদ্ধেও তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে ঢোকানোর এবং সাময়িক বরখাস্ত করার কাজ শেষ হওয়ার পথে। স্মরণ করা দরকার, ২০১৩ সালের জুন-জুলাই মাসে কুমিল্লা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর থেকেই ফন্দি এঁটে এসেছেন ক্ষমতাসীনরা, যার বাস্তবায়ন ঘটানো হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। সরকারের এই দ্বিমুখী নীতির ফল যে শুভ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই সে সম্পর্কেও এরই মধ্যে জানা যাচ্ছে নানাভাবে। যেমন গতকাল বুধবারই একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিধিরা না থাকায় ঢাকা জেলা পরিষদে আমলাদের দৌরাত্ম্য চরমে পৌঁছেছে। সেখানে একজন নারী প্রশাসক এবং হিন্দু প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার যৌথ শাসন চলছে। তারা যে গ্রামে শত বছরেও কোনো হিন্দুর বসবাস ছিল না তেমন একটি গ্রামেও হিন্দুদের মন্দির সংস্কারের নামে লাখ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন। এটা একটি ঘটনা মাত্র। এ রকম এবং এর চাইতেও অনেক বড় বড় অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে দেশজুড়ে। প্রতিটি সঙ্গেই জড়িত রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন। আর সব লেনদেনের পেছনে যে কেবল ক্ষমতাসীনরাই থাকতে পারেন এবং রয়েছেনও- সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। বড় কথা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং জেলা-উপজেলা থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিরাজ করছে একই অবস্থা। চলছেও একই ধরনের কর্মকান্ড। কিন্তু দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পার পেয়ে যাচ্ছেন সকলে। হাতেনাতে ধরা পড়লেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কারণ সকলে ক্ষমতাসীন দলের লোক, অনেকে নিজেরাই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাধর এমপি।
আমরা মনে করি, এভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেই শুধু অচল করা হচ্ছে না, দেশের উন্নয়ন কর্মকা-কেও করা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। তাই বলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু কোনো রাখঢাক করা হচ্ছে না। ভোট জালিয়াতি ও সন্ত্রাসের পথে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দখল নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিজেদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন তারা। জনসেবা ও উন্নয়ন নয়, অন্তরালের উদ্দেশ্য আসলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং নিজেদের ও দলীয় লোকজনের পকেট স্ফীত করা। জাতীয় নির্বাচনও রয়েছে তাদের পরিকল্পনায়। এজন্যই সর্বাত্মক দমন-নির্যাতন চালানোর এবং মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাজানো মামলায় ফাঁসানোর মধ্য দিয়ে এমন এক ত্রাসের রাজত্ব তারা কায়েম করেছেন যাতে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কেউ এমনকি প্রার্থী হওয়ারও সাহস না পান। যাতে ফাঁকা মাঠ পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ। এজন্যই দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দখল ও তছনছ করতে চাচ্ছে সরকার। এমন নীতি- কৌশল ও কর্মকান্ড অবশ্যই গণবিরোধী এবং অগ্রহণযোগ্য। আমরা মনে করি, গণতন্ত্র এবং জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়নের ব্যাপারে আদৌ সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত অবিলম্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার ও মামলার অভিযান বন্ধ করা। সরকারকে একই সাথে মেয়র ও কাউন্সিলরসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সকলকে যার যার পদে পুনর্বহাল করতে হবে। বড়কথা, আইন প্রয়োগ এবং কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে দুই রকমের নীতি অবলম্বন করা চলবে না। অপরাধী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি হলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

সোমবার, ২২ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কথা ও কাজে মিল থাকা প্রয়োজন


আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তো প্রায়ই বলে থাকেন যে, ব্যক্তির চাইতে দল বড়, আর দলের চাইতে দেশ বড়। এমন কথা বলে তারা বোঝাতে চান যে, ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে নয়, তারা মূলত কাজ করেন দেশ তথা জনগণের স্বার্থে। কী চমৎকার কথা! এমন কথা শুনলে শ্রোতা ভাবতে পারেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কতই না নিষ্ঠাবান এবং দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। আসলে কি তাই? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাস্তব চিত্র আসলে উল্টো। বহু রাজনীতিবিদের আচার-আচরণ দেখে জনমনে এখন এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে- মুখে যত কথাই বলুক না কেন, রাজনীতিবিদদের কাছে দেশের চাইতে দলের স্বার্থ বড়, আর দলের চাইতেও বড় ব্যক্তি স্বার্থ।
পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টালেই উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বহু উদাহরণ  লক্ষ্য করা যাবে। প্রথম আলো পত্রিকার ২১ জুন সংখ্যায় প্রথম পাতায় মুদ্রিত একটি খবরের শিরোনাম ‘প্রয়োজন নেই তবু দলের স্বার্থে বাড়তি গম কেনা’। খবরটিতে বলা হয় : প্রয়োজন নেই কিন্তু মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের স্বার্থে সরকার আরও এক লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাও আবার বাজারদরের চেয়ে কেজিতে ১০ টাকা বেশিতে। ফলে সরকারের ক্ষতি হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য যে, মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের চাহিদাপত্র দেওয়ার পর সরকার অতিরিক্ত গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। বাজারে প্রতিকেজি গমের দাম ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। আর সরকার কিনছে ২৮ টাকা দরে। প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা মুনাফার কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সরকারি গুদামে গম সরবরাহে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব হোসেন বলেন, বাজার দরের সঙ্গে গমের সংগ্রহ মূল্যের পার্থক্য ১০ টাকা। এটা অস্বাভাবিক। সাধারণত এই পার্থক্য হয় দুই থেকে তিন টাকা। অতিরিক্ত মুনাফার কারণেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত হয়ে পড়বে,  এটাই স্বাভাবিক। সরকারি গুদামে গম সংগ্রহ বাড়াতে সরকারদলীয় ৮০ জন নেতা খাদ্যমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র বা ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬ জন মন্ত্রী, ৬০ জন এমপি এবং অন্যরা সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমপির মনোনীত ব্যক্তিরা গম সরবরাহ করছেন বলে জানা গেছে। বেশ কয়েকটি এলাকায় এমপিরা নিজেই গম সরবরাহ করেছেন।
প্রয়োজন ছাড়া গম কিনে যেভাবে রাষ্ট্রের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি করা হলো তা একটি মন্দ উদাহরণ হয়ে রইবে। এতে হয়তো দল ও দলের কিছু লোক উপকৃত হবে, কিন্তু ক্ষতির বোঝা বইতে হবে দেশ ও জনগণকে। আর এ জাতীয় অনৈতিক কর্মকা-ের ফল আখেরে দলের জন্য কি কোনো উপকার বয়ে আনবে? গম ক্রয় তথা সংগ্রহ কর্মসূচিকে ঘিরে গত কিছুদিনে দেশে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। সহজ প্রাপ্তির লোভের অনেক জায়গায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিবাদ, মারামারি, এমনকি গোলাগুলীর ঘটনাও ঘটেছে। এতে দলের ঐক্য ও শৃঙ্খলার ক্ষতি হয়েছে। নিজেদের মধ্যে সংহতির বদলে শত্রুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব ঘটনা জনমনে সরকার ও সরকারি দলের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণার মাত্রা বাড়িয়েছে। তাই নিজেদের স্বার্থেই এইসব বিষয়ে সরকারের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন।

শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মোদির ঢাকা সফরের বিশেষ কিছু দিক


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর এবং তার ফলাফল তথা বাংলাদেশের লাভ ও প্রাপ্তি নিয়ে এখনো সব মহলে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এটাই স্বাভাবিক। আমরাও এতে অংশ নেবো। কিন্তু তারও আগে বেগম খালেদা জিয়ার সম্প্রতি ফাঁস করে দেয়া একটি তথ্য সম্পর্কে জানানো দরকার। ভারতের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, মূলত নিজের প্রাণনাশের আশংকা ছিল বলেই ২০১৩ সালের মার্চে তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে অংশ নেননি। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, সেদিন জামায়াতে ইসলামীর ডাকে হরতাল পালিত হচ্ছিল। হরতালের মধ্যে গাড়িতে চড়ে সোনারগাঁও হোটেলে আসার বা যাওয়ার পথে তার ওপর হামলা চালানো হতো এবং হামলা ও হত্যার দায় চাপানো হতো জামায়াতের ওপর। এটাই ছিল সরকারের পরিকল্পনাÑ ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র। কিন্তু বিষয়টি আগেই জেনে গিয়েছিলেন বলেই খালেদা জিয়া বৈঠক বাতিল করেছিলেন। সানডে গার্ডিয়ানের সাংবাদিককে খালেদা বলেছেন, এতদিন পর এসে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার ‘প্রকৃত’ কারণ আপনাকে জানালাম।
স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ২০১৩ সালের ৪ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও আরো অনেকের সঙ্গেই দেখা ও কথা হয়েছিল তার। নড়াইলে শ্বশুরবাড়িতে গেছেন তিনি, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের দীঘিতে নৌকায় বসে রবীন্দ্র সঙ্গীত উপভোগ করেছেন। খাওয়া-দাওয়াও যথেষ্টই করেছিলেন। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রণব মুখার্জি নাকি খুশি হতে পারেননি বরং ফিরতি পথে বিমানে তাকে যথেষ্ট ‘ক্ষুব্ধ’ দেখেছিলেন ভারতের সাংবাদিকরা। কথাটা ভারতীয় পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশেও প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ক্ষুব্ধ’ হওয়ার কারণ ছিল একটাইÑ বেগম খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি এবং পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করেছিলেন। প্রণব মুখার্জির প্রতিক্রিয়া জানারও আগে এ ব্যাপারে জানান দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা। তারা এমন এক প্রচারণা চালিয়েছিলেন যেন ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে খালেদা জিয়া বিরাট কোনো ‘অপরাধ’ করে ফেলেছিলেন! ভারতীয়রাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছিলেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছিল, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে ‘সুদূরপ্রসারী বার্তা’ দিয়েছেন! রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার আরও জানিয়েছিল, খালেদা জিয়া আসবেন না- এ খবরটি জানার পর প্রণব মুখার্জির মুখের হাসি নাকি কিছুক্ষণের জন্য ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল!
সন্দেহ নেই, কথাগুলো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদির ঢাকা সফরের আগে-পরে প্রচারণার প্রাধান্যে আনা হয়েছিল। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার পরিবর্তে অন্য কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। গত ৬ জুন মাত্র ৩৬ ঘণ্টার সফরে এসে পুরো বাংলাদেশকেই নৃত্যে মাতিয়ে গেছেন মোদি। এর পেছনে অবদান বেশি ছিল অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের, সেই সাথে অবশ্যই মিডিয়ারও। মনে হচ্ছিল যেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, ভারতপন্থী রাজনীতিক এবং সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিক থেকে শুরু করে সাংবাদিক নামধারী পর্যন্ত সকলেরই একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছিল মোদি বন্দনা! শুধু তা-ই নয়, বেশ কয়েকদিন আগে থেকে এমন এক প্রচারণাকে সর্বাত্মক করা হয়েছিল যেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘চাহিবা মাত্র’ সবকিছু দিয়ে একেবারে ধন্য করে দেবেন বাংলাদেশকে! তিস্তা চুক্তি তো হবেই, আরো অনেক ‘চমক’ও দেখাবেন ভারতের এই নাটকীয় চরিত্রের প্রধানমন্ত্রী! অন্যদিকে মিস্টার মোদিও তার পূর্বসুরীদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন। কেবলই নিয়ে গেছেন তিনি, প্রকৃতপক্ষে কিছুই দেননি বাংলাদেশকে। ফলে বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি ‘হনুজ দূর ওয়াস্ত’ই রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে যথারীতি আবারও খেল দেখিয়ে গেছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ঢাকায় এসেছেন এবং ছোট্ট খুকুমনির মতো আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে আদর নিয়েছেন। কিন্তু তিস্তার প্রশ্নে ‘এক চুল’ পরিমাণও সরে যাননি। তিনি বরং বুঝিয়ে গেছেন, জাতীয় স্বার্থে ভারতীয়রা সবাই সমান!
মমতার এই খেল বা ‘পলিট্রিক্স’ নিয়ে আগেও লিখেছি বলে আজকের নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্যের দিকে পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। বাংলাদেশে আসার প্রাক্কালে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পাওয়া এই মন্তব্যে মিস্টার মোদি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমান্ত চুক্তির নিষ্পত্তি যে আসলে কত বড় অর্জন তা নাকি ভারতের গণমাধ্যমগুলো অনুধাবন করতে পারেনি। এটা বিশ্বের অন্য কোথাও হলে একে ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর পতনের সঙ্গে তুলনা করা হতো, ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর মতো বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। প্রধানমন্ত্রী মোদির এই মন্তব্য কিন্তু নিতান্ত কথার কথা নয়, এর অন্তরালে রয়েছে গুরুতর উদ্দেশ্য। দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমান্ত চুক্তি বলতে তিনি ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষরিত ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’র কথা উল্লেখ করেছেন, যে চুক্তিটি দীর্ঘ ৪১ বছর পর অতি সম্প্রতি ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় অনুমোদন পেয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল মুজিব সরকার। এজন্য সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী পাস করতে হয়েছিল। কিন্তু ভারতকে বেরুবাড়ি তুলে দিলেও বিনিময়ে তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো আদায় এবং সীমান্ত চিহ্নিত করতে পারেনি সেকালের আওয়ামী লীগ সরকার। শুধু তা-ই নয়, ওই চুক্তি অনুযায়ী ভারত একই সঙ্গে পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি।
প্রশ্ন উঠেছে, ৪১ বছর আগে তারই পূর্বসূরী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে চুক্তিটি স্বাক্ষর করে গেছেন এবং যে চুক্তির বাস্তবায়ন করা ভারতের সকল সরকারের কর্তব্য ছিল, এতদিন পর সে চুক্তির অনুমোদনকে মিস্টার মোদি কেন ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর পতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন? এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে প্রসঙ্গক্রমে ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। সংক্ষেপে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) হিটলার ও মুসোলিনির পরাজয়ের পর প্রধান দুই বিজয়ী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া পুরো ইউরোপকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। এ সময়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল জার্মানীকে বিভক্ত বা দ্বিখ-িত করা। এডলফ হিটলারের জার্মানীকে দুটি দেশ বানিয়ে পূর্ব জার্মানীর দখল নিয়েছিল রাশিয়া। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানী গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর মাঝখানে নির্মিত হয়েছিল ‘বার্লিন প্রাচীর’। এই প্রাচীর দেশ দুটিকে বিভক্ত করেছিল। অর্থাৎ ‘বার্লিন প্রাচীর’ পরিণত হয়েছিল বিভক্তির প্রতীক হিসেবে। নামে দেশ দুটি অবশ্য স্বাধীনই ছিল। পূর্ব জার্মানীর রাজধানী ছিল বার্লিন, বনকে করা হয়েছিল পশ্চিম জার্মানীর রাজধানী। দুই জার্মানী ছাড়াও পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া প্রভৃতি দেশের ওপর রাশিয়ার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব দেশে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র চাপিয়েছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালীসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ। সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বের নতুন নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকায় পশ্চিম জার্মানী ক্রমাগত উন্নতি করেছিল এবং ধনী দেশের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে কমিউনিস্ট রাশিয়ার অধীনস্থ হয়ে পড়ায় পূর্ব জার্মানীর অবস্থা দ্রুত শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। মানুষ এমনকি দু’ বেলা ঠিকমতো খাবারও পেতো না। সে কারণেই পশ্চিম জার্মানীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল পূর্ব জার্মানীতে। সেদেশের আন্দোলনকারীরা মাঝেমধ্যেই ‘বার্লিন প্রাচীর’ ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। এই আন্দোলন জোরদার হয়েছিল ১৯৮০-র দশকে, যখন তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে রাশিয়ার কোমর ভেঙে গিয়েছিল। এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই ১৯৮৯ সালে পূর্ব জার্মানীর জনগণ ‘বার্লিন প্রাচীর’ ভেঙে ফেলেছিল। তারা শুধু প্রাচীরই ভাঙেনি, দলে দলে গিয়ে পশ্চিম জার্মানীতে বসবাসরত স্বজনদের সঙ্গেও মিলিত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো সক্রিয় সমর্থন দেয়ায় এবং রাশিয়া তখন নিজেকে বাঁচাতে বেশি ব্যস্ত থাকায় দুই জার্মানীর পুনর্মিলনকে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিম শব্দ দুটি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল এবং জার্মানী আবারও এক দেশে পরিণত হয়েছিল। সেই থেকে বার্লিন জার্মানীর রাজধানী হিসেবে টিকে আছে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও দেশটির রাজধানী।
ইতিহাসের এই অংশটুকুর পর্যালোচনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্যের বিশেষ ব্যাখ্যাই তুলে ধরবে। সে ব্যাখ্যা হলো, ১৯৪৭ সালে আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। মিস্টার মোদি সম্ভবত ইতিহাসের এই অংশটুকুই স্মরণ করেছেন এবং বাংলাদেশকে পূর্ব জার্মানীর পথ অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু মিস্টার মোদির ব্যাখ্যাকে অসম্পূর্ণ এবং ভুল হিসেবেই চিহ্নিত করবে। কারণ, একথা সত্য, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের বঙ্গ নামক কোলকাতাকেন্দ্রিক প্রদেশের অংশ ছিল। পরিচিতি ছিল পূর্ব বঙ্গ নামে। কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে মুসলিম প্রধান এ অঞ্চলের সঙ্গে মূল ভারতের দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে। দু’-চারজন ছাড়া জমিদারদের প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। মুসলমান কৃষকদের ওপর হিন্দু জমিদাররা যথেচ্ছ শোষণ-নির্যাতন চালাতো। মুসলমানরা এমনকি জমিদার বাড়ির আশপাশ দিয়ে জুতো পরে বা ছাতা মাথায় দিয়েও যাতায়াত করতে পারতেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি ছিল হিন্দুদের দখলে। শিক্ষাতেও হিন্দুরাই একচেটিয়াভাবে এগিয়ে ছিল। সব মিলিয়েই মুসলমানরা ছিলেন নির্যাতিত, উপেক্ষিত ও পশ্চাদপদ অবস্থায়।
হিন্দুদের প্রাধান্য বহাল রেখে মুসলমানদের পক্ষে যেহেতু উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন করা একেবারেই সম্ভব ছিল না, সেহেতু মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গ ও প্রতিবেশী রাজ্য আসামকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশ গঠনের দাবিতে মুসলমানরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ গঠন করে। ঢাকাকে এর রাজধানী করা হয়। এটাই ইতিহাসে ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামে পরিচিতি। এর ফলে ঢাকাসহ বর্তমান বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু মুসলমানদের এই উন্নতি ও সম্ভাবনার বিরুদ্ধে হিন্দুরা পাল্টা তৎপরতা শুরু করে। কারণ, হিন্দুদের দৃষ্টিতে এটা ছিল তাদের ‘বঙ্গমাতা’কে দ্বিখন্ডিত করার পদক্ষেপ। কোলকাতায় বসবাস করে পূর্ব বঙ্গের ওপর যারা শোষণ-নির্যাতন চালাতো এবং এখানকার অর্থবিত্ত লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসে যারা নাচ-গান ও আনন্দ-ফ’র্তি করতো, সেই হিন্দু জমিদারদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে ও উস্কানিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড দুর্বার হয়ে ওঠে। হিন্দুরা একে সন্ত্রাসবাদী ‘আন্দোলন’ নাম দেয়। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে ভীত হওয়ার অভিনয় করে মুসলিম বিরোধী ব্রিটিশ সরকারও হিন্দুদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়, ঢাকাসহ পূর্ব বঙ্গ আবারো কোলকাতার এবং হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। হিন্দুদের মধ্যে যে ‘বঙ্গমাতা’র জন্য প্রীতির লেশমাত্র ছিল না এবং মুসলিম বিদ্বেষই যে বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি বিশেষ ঘটনায়। সন্ত্রাসের অভিযোগে শত বছরের রাজধানী কোলকাতাকে পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ সরকার এ সময় দিল্লিকে ভারতের রাজধানী বানিয়েছিল। কিন্তু হিন্দুরা কোনো প্রতিবাদই করেনি। অন্যদিকে মুসলমানদের হিন্দু ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে। পর্যায়ক্রমে সেটাই মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছিল সে আন্দোলনেরই সফল পরিণতি।
এভাবে ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যাখ্যা ও হিসাবে মারাত্মক ভুল রয়েছে। বাংলাদেশকে কোনোদিক থেকেই পূর্ব জার্মানীর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কারণ, পূর্ব জার্মানীর ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ চাপিয়ে দেয়া। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ সব দিক থেকে নিজের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী এগিয়েছিল। অন্যের পদানত থাকতে রাজি নয় বলেই ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বানিয়েছে। সুতরাং কেউ যদি মনে করে থাকেন, বাংলাদেশ পূর্ব জার্মানীর পথ ধরবে এবং পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতের সঙ্গে আবারও মিলিত হবে তাহলে সেটা হবে গর্দভের স্বর্গযাত্রার মতো ফালতু কল্পনাবিলাস। সে বিলাস যে কেউ করতেই পারেন। কিন্তু যুগে যুগে প্রমাণিত সত্য হলো, বাংলাদেশ কারো অধীনস্থ থাকে না। তেমন যে কোনো প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়ার যোগ্যতা, সাহস ও ক্ষমতাও বাংলাদেশীদের রয়েছে। এখানে অন্য কিছু কথাও বলা দরকার। মিস্টার মোদি শুধু ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর কথাই বলেছেন। অন্যদিকে প্রকৃত ইতিহাস হলো, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এশিয়া ও ইউরোপে আরো অনেক পরিবর্তনও ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে রাশিয়া নিজেকে সোভিয়েট ইউনিয়ন নামের বিশাল এক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। আশপাশের বহু স্বাধীন দেশকে রাশিয়া দখল করে নিয়েছিল। জার্মানীতে যখন ‘বার্লিন প্রাচীর’ ভেঙে ফেলার আন্দোলন তুঙ্গে ঠিক একই সময় ওই দেশগুলোও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। মিখাইল গরবাচভের নেতৃত্বাধীন রাশিয়ার সরকারকে একের পর এক শুধু পরাজয়ই স্বীকার করতে হয়েছিল। এর ফলে ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, অ্যাস্টোনিয়া, আজারবাইজান ও লাটভিয়াসহ ডজনের বেশি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল। রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এসব তথ্য বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবনায় থাকা দরকার ছিল। কারণ, আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডসহ ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের রাজ্যগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে। কে জানে, এসব রাজ্যও কখনো ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানের মতো ভারতের ‘ইউনিয়ন’ থেকে বেরিয়ে আসবে কি না এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে কি না। অমন কোনো সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করার পরিবর্তে এখানে শুধু এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট যে, ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর উদাহরণ দিতে গিয়ে মিস্টার মোদি সম্ভাবনার একটি দিককেই প্রাধান্যে এনেছেন। বাস্তবে সম্ভাবনা কিন্তু অন্যরকমও রয়েছে!
এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের দু-একটি প্রসঙ্গ। খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এত আলোড়ন সৃষ্টিকারী সফরেও মিস্টার মোদি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একাই এসেছিলেন। ৮১ জন সফরসঙ্গীর মধ্যে একজনও মন্ত্রী বা রাজনীতিক ছিলেন না। ছিলেন শুধু আমলা এবং ব্যবসায়ীরা। অনেক শিল্পী-সাংবাদিকও ছিলেন কিন্তু আগে থেকে ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে আসেননি আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীরা। এসেছিলেন শুধু পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাও মোদির সঙ্গে নয়। একদিন আগে এসেছিলেন তিনি। মমতা থেকেছেনও আলাদা হোটেলে। এর মধ্য দিয়ে একটি কথাই মমতা পরিষ্কার করেছিলেন। সে কথাটা ছিল, আর যা-ই হোক, তিস্তা চুক্তি অন্তত স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। বাস্তবেও হয়নি। স্মরণ করা দরকার, একই মমতার কারণে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরেও একেবারে ‘হবেই’ পর্যায়ে এসে যাওয়ার পরও তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। সেবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর সঙ্গে ঢাকায় আসতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন মমতা। মাঝখানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে এসে তার ওপর ‘আস্থা’ রাখার আহ্বান জানিয়ে গেছেন মমতা। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়েছিল, ঢাকা থেকে ‘হাসিনাদি’র ফোন পেয়ে শ্রীমতি মমতা নাকি এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, তার মনে হচ্ছিল, ‘দুই বাংলা যেন এক হয়ে গেছে’! তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ‘ওপার বাংলা’ পশ্চিম বঙ্গের মতো ভারতের একটি রাজ্য মাত্র নয় বরং সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র! বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। এখানে সংক্ষেপে বলা দরকার, মোদির এই সফরকালেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ভারতীয়দের বাংলাদেশ নীতিই প্রাধান্যে এসেছে। কারণ, তিস্তা বেশি আলোচিত হলেও ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে টেলিভিশন ও সিনেমাসহ সকল ব্যাপারেই বাংলাদেশ ভারতীয়দের চাণক্য কৌশলের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। এই কৌশলের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থে যা কিছু করছে ও করেছে সেগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। কথা আরো আছে। একদিকে মিস্টার মোদি শুনিয়েছেন ‘বার্লিন প্রচীর-এর কথা, অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে দুই বাংলা যেন ‘এক’ হয়ে গেছে! পাঠকরা চিন্তা করে দেখতে পারেন।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

খোশ আমদেদ মাহে রমযান


বছর ঘুরে আবারও এসেছে আল্লাহ তা’লার রহমত এবং গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার পবিত্র মাস রমযান। সুরা আল বাক্বারাহ্র ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম (অর্থাৎ রোজা) ফরজ করা হয়েছে যেমনভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’  রোজা সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বর্ণনার দরকার পড়ে না। সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব তথা সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকাটা অবশ্যই সহজ কাজ নয়। কোনো মানুষ দেখবে না জেনেও মুসলমানরা লুকিয়ে কিছু খান না। পানও করেন না। কারণ, তারা জানেন, মহান আল্লাহ সবই দেখছেন। আর  রোজা যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সেহেতু কষ্ট যতোই হোক, মুসলমানরা  রোজা ভাঙেন না। এর মধ্য দিয়ে একদিকে তারা অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জীবন যন্ত্রণা অনুভব করতে শেখেন, অন্যদিকে ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়ার পাশাপাশি অন্যদের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষাও লাভ করেন। আল্লাহ তাঁর এই বান্দাদের জন্য রহমতের দরোজা  খুলে দেন এই মাসে। একমাস ধরে  রোজা রাখার তথা সংযম পালনের পেছনেও মুসলমানদের জন্য রয়েছে নানামুখী কল্যাণ। এ মাসে পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি চিন্তা ও কার্যক্রমের সকল ক্ষেত্রেও নিজেদের পরিশীলিত রাখেন মুসলমানরা। তারা কোনো অন্যায় কাজে অংশ নেন না, কারো সঙ্গে বিবাদে জড়ান না। অন্যের ক্ষতির চিন্তাও এড়িয়ে চলেন। সব মিলিয়েই রমযানের দিনগুলোতে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধির এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন। আল্লাহ তা’লাও বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ দেখান এবং তাদের মাফ করে দেন। ভালো কাজ না করার কারণে যারা দরিদ্র ও হীন অবস্থায় থাকে তারাও এ মাসের মাহাত্ম্যে এবং তওবা-এস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানিত ও মর্যাদাবান হয়ে উঠতে পারে।
রমযান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার দ্বিতীয় কারণ পবিত্র লাইলাতুল কদর। ২৬ রমযানের দিন শেষে, অর্থাৎ ২৭ তারিখে, অনেকের মতে রমযান মাসের শেষ ১০ দিনের যে কোনো বেজোড় তারিখের রাতে হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর পবিত্র কুরআন নাযিল শুরু হয়েছিল। আল-কুরআন এমন একটি মহাগ্রন্থ, যার মধ্যে আল্লাহর নাযিল করা পূর্ববর্তী সকল গ্রন্থের সারবস্তু এবং ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌল নির্দেশনা একত্রিত করা হয়েছে। পবিত্র এ গ্রন্থটিকে আল্লাহ মানুষের জন্য জীবনবিধান হিসেবে পাঠিয়েছেন। মক্কার নিকটবর্তী হেরা পর্বতে শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। স্বয়ং আল্লাহ তা’লা বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ এই রাতে বেশি বেশি ইবাদতের তাগিদ দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি নিজেও কদরের সারারাত আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন। শুধু এই একটি রাত্রি নয়, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ ১০দিনই ইতিকাফ করতেন, যার অর্থ পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে কেবলই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের ইবাদতে মগ্ন থাকা এবং আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমতের জন্য মোনাজাত করা। গুনাহর জন্য মাফ চাওয়া। এজন্যই কদরের রাতকে যারা পাবেন তারা খুবই সৌভাগ্যবান এবং তাদের উচিত আল্লাহর কাছে সর্বান্তকরণে নিজেদের সমর্পণ করা, তাঁর কাছে পানাহ চাওয়া। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা এবং শারীরিক সুস্থতা ও সহজ-সরল জীবনযাপনের তওফিক দেয়ার জন্য আল্লাহ তা’লার কাছে বিশেষভাবে মোনাজাত করা। গুনাহ থেকেও মাফ ও মুক্তি চাইতে হবে। কারণ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ জীবনে মানুষ প্রতিদিনই অনেক গুনাহ বা অপরাধ করে। অন্যদিকে আল্লাহ গুনাহগার বান্দাদের মাফ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যভিচারী, মুশরিক ও নাস্তিক-মুরতাদ ছাড়া অন্য বান্দাদের সব নেক তথা ভালো আশা-আকাঙ্ক্ষা পুরনের মওসুম রমযান মাস। এমন একটি সুযোগকে অবশ্যই হাতছাড়া করা যায় না। প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত নিজেদের পাশাপাশি জনগণের কল্যাণ এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে দোয়া করা। আমরা মনে করি, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রমযান পালনের পাশাপাশি সামগ্রিক বাস্তবতার আলোকেও চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। কারণ, সরকারের ব্যর্থতা এবং চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে টাউট ব্যবসায়ীরা রমযান মাসে পণ্যের দাম বাড়ায় যথেচ্ছভাবে। নাভিশ্বাস ওঠে পানি ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। এজন্যই আমাদের উচিত সকল ব্যর্থতা এবং বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

বুধবার, ১৭ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

হতাশার মাত্রা বৃদ্ধি তো কোনো সরকারের কাজ হতে পারে না


এটা কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি? অথচ এখন বলা হচ্ছে, টেন্ডারবাজি নাকি রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। আরও মারাত্মক কথা হলো, ক্ষমতার সাথে সংযোগ রেখে অর্থ-সম্পত্তির মালিক হতে হবে- এমন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এখন রাজনীতিতে আসছেন লোকজন। তাহলে ‘আমরা দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করি’- এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়? এ প্রসঙ্গে ‘টেন্ডার সিন্ডিকেটে জিম্মি উন্নয়ন’ শিরোনামে পত্রিকান্তেরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৬ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয় : টেন্ডারবাজি রোধে সরকার ই-টেন্ডারের ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং সারা দেশের টেন্ডার এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সরকারি দলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হানাহানি। এমনকি টেন্ডার বাণিজ্য ঘিরে মূল দলের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিরোধও ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। বেশির ভাগ জেলায় সরকারি দলের এমপিরা নিজেরাই মূল সিন্ডিকেটের গডফাদারের ভূমিকা পালন করছেন। ফলে সিন্ডিকেটের লোকজনও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। এতে ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রম। টেন্ডার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড।
তারপরও সরকার সংস্থার অসহায় প্রকৌশলীরা চাপের মুখে সব মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন। অনেক সময় নিজেরাও সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছেন। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘টেন্ডারবাজি এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ-সুবিধা এবং ক্ষমতার যোগসাজশে অর্থ-সম্পত্তির মালিক হতে হবে- এমন প্রবণতা থেকেই রাজনীতিতে আসছেন সবাই। এমন কি এই রীতিকে আজকাল নেতারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগেও একজন এমপি বলেছেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে তো সম্পদ বাড়বেই।’ উল্লেখ্য যে, রাজধানীতে একাধিক গোযেন্দা সংস্থার খাতায় পেশাদার টেন্ডারবাজ হিসেবে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির নাম আছে। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা। পেশা ঠিকাদারি না হলেও সরকারি ভবনগুলোতে তাদের পরিচিতি টেন্ডারবাজ হিসেবে। তাদের সবার নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই, তবুও তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারের উন্নয়ন কাজের দরপত্র। দরপত্র জমা দিয়েই তারা হাতিয়ে নেন কাজের ১০ শতাংশ অর্থ। নিয়মিত তাদের দেখা মেলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে। এগুলো যেন তাদের নিজের অফিস। আসলে তারা টেন্ডারবাজ। তাদের মধ্যে যাদের ঠিকাদারি লাইসেন্স আছে, তারা কখনও নিজেরা কাজ করেননি। দরপত্র কিনে ‘নিকো’ অর্থাৎ কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য মধ্যস্থতা করাই তাদের মূল পেশা। রাজধানীতে কমপক্ষে ১০টি সরকারি ভবন ও অধিদফতরে দেখা মিলবে তাদের। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সরকারি অফিসে ই-টেন্ডার চালুর উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯৮ সালে। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে সরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ই-টেন্ডার কার্যকর করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় ২০১১ সালে। সরকার অন-লাইনে টেন্ডার জমা দিতে সবার জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল (www.eprocure.gov.bd) চালু করে যা ই-গবর্নমেন্ট বা সংক্ষেপে ই-জিপি নামেও পরিচিত। বিভিন্ন সরকারি দফতর ও সংস্থার নিজস্ব ওয়েব সাইটের পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত এই ওয়েব সাইটেও টেন্ডার প্রকাশ ও জমাদানের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই মানা হচ্ছে না। শতকরা ৮০ শতাংশ টেন্ডারই ই-টেন্ডারের বাইরে হচ্ছে বলে পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এমন চিত্রে সহজেই উপলব্ধি করা যায় কেন দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাচ্ছে না। আর এসব কারণেই দেশ ও জনগণের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সরকারি দলের সিন্ডিকেটের কারণে দেশের উন্নয়নসহ অনেক কল্যাণমূলক কাজই এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত ১৭ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত এক প্রতিদেনে বলা হয়, মেহেরপুর জেলায় সরকারের সংগ্রহ অভিযান চললেও কৃষক তাদের উৎপাদিত গম গুদামে দিতে পারেনি। তবে গুদামে গম গেছে তাদের নামেই। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের একাংশ দাবি করেছে, কৃষকদের বদলে দলের কয়েকজন নেতা গম সরবরাহ করে ৮ কোটি টাকার মতো আয় করেছেন। এ নিয়ে নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলীর ঘটনাও ঘটেছে।
টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা) জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এসব কর্মসূচি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। গত ১৪ জুন ‘কাবিখা লুটেখা’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনে। রিপোর্টে বলা হয়, টিআর ও কাবিখার নামে বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরই কোনো কাজ হয় না। অনেক সময় শত ভাগই গায়ের জোরে করে দেয়া হয়। টিআর এবং কাবিখার বরাদ্দে উন্নয়নের নামে উপজেলায় গড়ে উঠেছে ‘লুটেখা’ সিন্ডিকেট। নানা কৌশলে প্রশাসনের যোগসাজশেই এই লুটপাট এবং দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয়। অনেক সময় দেখা যায়, এমপিরা নিজেরাই এর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। আবার কোনো কোনো এলাকায় এমপি না জড়ালেও স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও সরকারি দল সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা ভাগাভাগি করে নেন পুরো প্রকল্পের টাকা। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের তুষ্ট রাখতে প্রতিবছরই এই টিআর ও কাবিখা বরাদ্দ দেয়া হয়। অথচ এসব বরাদ্দের বিপরীতে আদৌ কোনো কাজ হলো কিনা তার কোনো রকম তদারকি হয় না। সুশাসনের অভাবে টিআর ও কাবিখা কর্মসূচি এখন দুর্নীতির বড় প্রশ্রয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে ৩০০ এমপি ও সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন এমপির নামে টিআর ও কাবিখার বিপরীতে বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। প্রতিজন এমপির বিপরীতে টিআর প্রকল্পের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন ও কাবিখা প্রকল্পের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন করে গম ও চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। টিআর ও কাবিখা মিলিয়ে মোট বরাদ্দের পরিমাণ জনপ্রতি ৬০০ মেট্রিক টন। জানা গেছে, এই বরাদ্দ প্রকল্পের বিপরীতে দেয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রকল্প না পেয়েই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার ভর্তুকি মূল্যে যে চাল ও গম ক্রয় করে, সেই চাল-গমই আরো কমমূল্যে টিআর ও কাবিখার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু কেনার মূল্য থেকে কমে বরাদ্দ দেয়া হলেও বাস্তবে সিন্ডিকেট চক্রের কারণে সেই চাল ও গম বিক্রি হয় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও অনেক কম দামে। সূত্র জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় চলতি বছর টিআর ও কাবিখার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া প্রতি টন চালের মূল্য ধরে দিয়েছিল ২২ হাজার ৫০০ টাকা করে। একইভাবে প্রতিটন গমের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৯ হাজার ৫০০ টাকা করে। কিন্তু টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া প্রতি টন চাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে ১৪ হাজার টাকা ও গম বিক্রি করা হয়েছে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা দরে। অথচ বর্তমানে চালের বাজার দর হচ্ছে প্রতি টন প্রায় ২৫ হাজার টাকা করে। আর গমের বর্তমান বাজার দর হচ্ছে প্রতি টন প্রায় ২০ হাজার টাকা। মাঠ পর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত চাল ও গম উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।
টিআর ও কাবিখার এসব দুর্নীতি প্রসঙ্গে টিআইবি’র ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনপ্রতিনিধিদের হাতে এ বরাদ্দ দেয়ায় অর্থের অপচয় থেকে শুরু করে দুর্নীতির সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিত। আমি নীতিগতভাবে এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি না। জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব এটি হওয়ার কথা নয়। স্থানীয় সরকারের হাতে, প্রকল্প বাস্তবায়নে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতে এ দায়িত্ব দেয়া উচিত। এমপিদের হাতে বরাদ্দ দিলে দলীয়করণের সৃষ্টি হয়। এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এসব বরাদ্দ এমপিদের হাতে দেয়াই অন্যায়। এটি সংসদ সদস্যদের কাজ নয়। তাদের কাজ হলো সংসদে আইন প্রণয়ন করা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার বাস্তবায়ন দেখাতে গেলে লুটপাট তো হবেই। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার চেয়ারম্যান শাহজাহান মজুমদার বলেন, টিআর, কাবিখার টাকা কোনো কাজেই আসে না। এসব বরাদ্দ এমপি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের হরিলুট ও ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যে শেষ হয়। আমরা মনে করি, যে জনগণের জন্য বরাদ্দ তারাই যদি না পায় তাহলে এসব প্রকল্পে অর্থ খরচ করে লাভ কি? দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি তো কোনো প্রকল্পের লক্ষ্য হতে পারে না। টিআর ও কাবিখা তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যখন তার সুফল জনগণ পাবে। এই ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় আছে। সরকার কর্তব্যকর্মে এগিয়ে আসে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে সরকারি দলের সিন্ডিকেটের কারণে যেভাবে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং টেস্ট রিলিফ ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অর্থ যেভাবে লুটপাট হচ্ছে, তাতে সুশাসনের সংকট স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রশ্রয়ের নীতি পরিহার করে সরকার যদি অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে দেশে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি আরো এগিয়ে যাবে। এমন বাস্তবতায় শুধু যে সুশাসন ও গণতন্ত্রই পিছিয়ে পড়বে তা নয়, জনমনেও বাড়বে হতাশার মাত্রা। হতাশার মাত্রা বৃদ্ধি কি কোনো সরকারের কাজ হতে পারে?

মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলো সার্বভৌমত্বই


ভারতের চরম হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বিশ্বনেতৃত্ব গ্রহণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপকে তার বলয়ভুক্ত করার জন্য মরিয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। নেপাল ও মালদ্বীপে তার সামান্য ভুল হলেও সে ভুল তিনি করেননি বাংলাদেশ ও ভুটানের ক্ষেত্রে। নেপালের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে সাহায্য করার নামে হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনী। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভারতীয় হেলিকপ্টার বিতর্কিত চীন-সংলগ্ন অরুণাচল প্রদেশে চীনা সীমান্ত অতিক্রম করে ঐ এলাকার ছবি তুলছিল। চীন অরুণাচলকে ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই তাদের এলাকা বলে দাবি করে আসছে। এমনকি নরেন্দ্র মোদির চীন সফরের সময় ঐ এলাকার যে মানচিত্র চীনে প্রকাশ করা হয়, তাতেও এই অঞ্চলকে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো হয় আর মোদিকে তা হজমও করতে হয়।
তথাকথিত ত্রাণ কাজে নিয়োজিত ভারতীয় হেলিকপ্টার চীন সীমান্ত অতিক্রম করলে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নেয়। কড়া প্রতিবাদ আসে চীনের তরফ থেকে। নেপাল সরকার খুব দ্রুতই ত্রাণ কাজে নিয়োজিত ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নেপাল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ভারতও ত্রাণ কাজ থেকে সামরিক বাহিনী গুটিয়ে নেয়। ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে দাহ করা হয় নরেন্দ্র মোদির কুশপুতুল। মালদ্বীপের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতপন্থী বলে নিন্দিত মোহাম্মদ নাশিদ শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। কিন্তু তাকে জেতাতে কসরত কম করেনি ভারত। এখন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মোহাম্মদ নাশিদের বিচার চলছে। সেই অভিমানে নরেন্দ্র মোদি তার মালদ্বীপ সফর বাতিল করে দিয়েছেন।
ভুটানের পরিস্থিতি বেশ ভালো। কারণ ভুটান পুরোপুরি একটি ভারতনির্ভর দেশ। এর রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতি সবই ভারত নিয়ন্ত্রিত। তারা একটি দিয়াশলাইয়ের কারখানা দেয়ারও অধিকার রাখে না। ভারত তা সরবরাহ করে। নিজেদের নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ। এসব লেখাপড়ার জন্য তাদের যেতে হয় ভারতে। এখন পর্যটন শিল্প থেকে যেটুকু আয় হচ্ছে তারও সিংহভাগ চলে যাচ্ছে ভারতে, অধিকতর আমদানির কারণে। সেদিক থেকে মোদি সরকার ভালো আছেন শ্রীলঙ্কা নিয়ে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতপন্থী মাইথ্রিপালা সিরিসেনা নির্বাচিত হয়েছেন। তার এ বিজয় ছিল অকল্পনীয়। হেরে গেছেন চীনপন্থী বলে পরিচিত মাহিন্দ্র রাজা পাকশে।
এই প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই মোদি ঢাকা সফরে এসেছিলেন। ঢাকায় তিনি যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তার সবই হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশের ওপর ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খবরদারি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। একই সঙ্গে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো যে, মোদি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে অবাধে প্রবেশের সুযোগ আদায় করে নিয়ে গেছেন। আর তার সবই করেছেন বাধা-বিঘœহীনভাবে। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশকে দিয়ে যাননি কিছুই। বরং তিনি নানা বাকোয়াজিতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন।
বার্লিন ওয়াল ধ্বংস, পাশাপাশির বদলে এখন থেকে একসঙ্গে চলা এসব বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ না করেই, ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির পরিণতি কী হতে পারে সে চিন্তা না করেই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা মোদি চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রিসভায় কানেকটিভিটির নামে ভারতকে করিডোর দেয়ার ব্যবস্থা অনুমোদন করে দেয়। ঐ চুক্তিতে অবশ্য বলা হয় যে, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ব্যক্তিগত, যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। আর এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর হবে, এতেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে সরকার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা নৌবন্দর ব্যবহার করতে দিল এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরা রুটে বাস চলাচলের অনুমতি দিল এবং বাস চলাচল শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু মীমাংসা হয়নি কোনো প্রশ্নেরই। যদি বিষয়টা সমানে সমানে হতো তাহলে বাংলাদেশ থেকে একদল পর্যটক বাসে করে যেতে পারতো নেপাল কিংবা ভুটানে। সে ব্যবস্থা তো হয়ইনি, বরং এখন বলা হচ্ছে, ভুটানে যাবার রাস্তাই তৈরি হয়নি। সে কথার বিশ্বাসযোগ্যতাও অতি সামান্য। কারণ, ভারতের সঙ্গে ভুটানের নিয়মিত সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। আর ভুটানে প্রধান রফতানিকারী দেশ ভারতই। তাহলে আমরা কেন যেতে পারলাম না ভুটানে বা নেপালে।
এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের যানবাহন ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল-ভুটানে যেতে পারবে কিনা, তার কোনো ফয়সালা হয়নি। অথচ, ভারতের যানবাহন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নির্বিঘ্নে যাচ্ছে আগরতলা বা ত্রিপুরায়। তাছাড়া এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তিই হয়নি। সেদিক থেকে চার দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ চুক্তি একটি ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই না। এর এতসব চুক্তির মধ্যে কোথায়ও নেই যে বাংলাদেশের কোনো যানবাহন পণ্য নিয়ে ভারত বা নেপাল-ভুটানে যেতে পারবে কিনা। তাহলে এর সরল অর্থ দাঁড়ালো, ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তার সকল পণ্য ও সেবা নির্বিঘ্নে নিয়ে যাবে তার সাত রাজ্যে। আগে যা নিতে দু’হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো, এখন বিনা শুল্কে বিনা মাশুলে মাত্র ৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েই তা নিয়ে যেতে পারবে তার সাত রাজ্যে। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ যা দাঁড়ালো, তাহলো যেটুকু পণ্য বাংলাদেশ ঐ সাত রাজ্যে রফতানি করতো, সে পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। তথাকথিত কানেকটিভিটির লাভের গুড় এভাবেই ভারতই খেয়ে ফেলার আয়োজন সম্পন্ন করে নিলো। অথচ আমাদের ব্যবসায়ীরা অনেকদিনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সাত রাজ্যে কয়েক কোটি ডলারের বাজার তৈরি করেছিল।
এদিকে ভারতকে এই সুবিধা দেয়ার ফলে আরও যে বিপদ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তাহলো, এই সুযোগে ভারতীয় পণ্যে সয়লাব হয়ে যাবে বাংলাদেশের বাজার। বিপন্ন হয়ে পড়বে আমাদের দেশের শিল্প-কারখানাগুলো। ভেঙে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা যায় যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বাণিজ্য ভারসাম্যের দিক থেকে এগিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারত বাংলাদেশে বছরে রফতানি করে ছয়শ’ কোটি ডলারের পণ্য। আর ভারতে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির পরিমাণ মাত্র ছয় কোটি ডলার। এটাও অবিরাম খাবিখায় ভারতের নানা ধরনের অশুল্ক বাধার জন্য।
এছাড়া ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তার উত্তর-পুর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে সেখানকার স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য পাঠাচ্ছে সমরাস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম। সেই সঙ্গে যাচ্ছে ও যাবে পর্যটকের বা যাত্রীর ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্য। তাতে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের টার্গেটে পরিণত হবে বাংলাদেশ। গেরিলা যুদ্ধের নিয়মানুসারে তারা এসব সামরিক সাজসরঞ্জাম ও সৈন্য ঠেকাতে প্রবেশ করবে বাংলাদেশের ভেতরে। তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হবে বাংলাদেশের ভেতরেই। আর এতে অকারণেই বাংলাদেশ ভারতের এক সম্প্রসারিত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে।
তারপরও সম্ভবত মোদি সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার। আর করিডোর-ট্রানজিট আমাদের সদিচ্ছা। বাংলাদেশের মানুষকে অধিকারবঞ্চিত করে রেখে ফাঁকা বুলি দিয়ে তাদের বেশিদিন ধোঁকা দিয়ে রাখা যাবে না। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এদেশের মানুষ একসময় প্রতিরোধ গড়ে তুলবেই। ভারত সরকার যত তাড়াতাড়ি সেটা উপলব্ধি করে, ততই মঙ্গল।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ১৫ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সভ্যতার প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ


পৃথিবীটা এখন ঠিকভাবে চলছে না। এর কারণ প্রহসনের রাজনীতি। নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে রাজনীতি এখন যেন চাতুর্য ও প্রোপাগান্ডার বিষয় হয়ে উঠেছে। দেশে-বিদেশে ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এখন একই বাতাবরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনীতির এমন বাতারণে এখন সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব। লাখো মুসলিম এখন জুলুম-নির্যাতনের শিকার। কোটি কোটি মুসলিম শান্তিময় জীবন-যাপনের মাধ্যমে শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এমন বাতাবরণের মধ্যে কখনও কখনও মুসলিম নামধারী কিছু মানুষকে নিষ্ঠুর ও সন্ত্রাসী কিছু কার্যক্রম চালাতে দেখা যাচ্ছে। ঘৃণ্য এসব কার্যক্রমের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে বেরিয়ে আসছে রহস্যজনক বিষয়-আশয়। এসব কর্মকা-কে উপলক্ষ করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও মিডিয়া ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- উদ্দেশ্যমূলক এসব প্রচারণার ব্যাপারে বর্তমান সভ্যতা সঙ্গত ভূমিকা পালন করছে না। এমন অবস্থায় বঞ্চনা ও অপপ্রচারের শিকার মুসলিম বিশ্বের জনগণের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। সচেতন ও প্রাজ্ঞ মুসলমানরা অবশ্য অনাকাক্সিক্ষত এই হতাশা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক জবাব দেয়ারও চেষ্টা করছেন।
বর্তমান সময়ে আইএস ও বোকো হারামের মতো সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে মুসলিমবিরোধী যে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, তা আর ধোপে টিকছে না। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও এখন স্বীকার করছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তৎপর আইএস আমেরিকা থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। তিনি মার্কিন ফক্স নিউজকে গত বুধবার বলেছেন, আইএসকে অস্ত্র দেয়ার বিষয়ে আমেরিকাই দায়ী। ১৫ জুন দৈনিক সংগ্রামে মুদ্রিত খবরে আরও বলা হয়, গত মার্চ মাসে ইরাকের বাদর সংস্থার প্রধান কাশিম আল-আরাজী জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তার কাছে প্রমাণ রয়েছে যে, আমেরিকা ইচ্ছাকৃতভাবে উগ্রবাদীদের অস্ত্র দিচ্ছে। এছাড়াও ইরাকের গণমাধ্যম ও অন্য কয়েকটি সূত্র অন্তত দু’বার বলেছে, মার্কিন সামরিক বিমান থেকে আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অস্ত্র ফেলা হয়েছে। এছাড়া ইরাকের গোয়েন্দা সংস্থা গত ডিসেম্বর মাসে বলেছিল, মার্কিন সামরিক বিমান থেকে আইএস-এর জন্য কয়েকটি প্রাণ-কার্গো ফেলা হয়েছিল। যাতে করে তারা ইরাকের সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অবরোধ ভাঙতে সক্ষম হয়। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার বলেন, এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, আমেরিকা এসব অস্ত্র শুধু তাদের কাছেই পাঠাচ্ছে, যারা পেন্টাগনকে সহায়তা করছে। আর এর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, আইএসকে অস্ত্র দেয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকা একটা ভূমিকা পালন করছে। গত বছরের জুন মাসে অ্যারোন ক্লেইন নামে এক সাংবাদিক ওয়ার্ল্ড নেট ডেইলিতে রিপোর্ট করেছিলেন যে, ২০১২ সালে জর্ডানের একটি গোপন ঘাঁটিতে মার্কিন প্রশিক্ষকদের কাছে আইএস সন্ত্রাসীরা প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
এমন ফিরিস্তি আরো বাড়ানো যেতে পারে। তবে মূল কথা হলো, ইসলাম কখনও মুসলমানদের সন্ত্রাসী হতে বলে না কিংবা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে বলে না। এখন মুসলিম নামধারীদের হাতে যে সব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে, তা যে শক্তিমান মহলের পরিকল্পনায় ও কারসাজিতে ঘটছে তা অনেকটাই স্পষ্ট। প্রোপাগান্ডায় জর্জরিত মুসলমানদের এখন আবেগের পরিবর্তে তথ্যভিত্তিক জবাব দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে যে, ইসলামে জিহাদ ও সন্ত্রাস এক কথা নয়। ব্যক্তিগত আবেগ বা ক্ষোভ দিয়ে জিহাদ করা যায় না। জিহাদ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যে কোনো শুভ ও ন্যায়সঙ্গত প্রচেষ্টা। জিহাদ নিজের প্রবৃত্তি বা রিপুর বিরুদ্ধে হতে পারে। জিহাদ হতে পারে সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে, জিহাদ হতে পারে পরিবেশ প্রতিবেশে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াসে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও প্রয়োজন হতে পারে জিহাদের। তবে কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ ইচ্ছে করলেই জিহাদ ঘোষণা করতে পারে না। বৃহত্তর জিহাদ ঘোষণা করতে গেলে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রের। ব্যক্তিগত, ক্ষুদ্র বা বৃহত্তর জিহাদ বা প্রচেষ্টার উত্তম উদাহরণ পাওয়া যায় শেষ নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর উজ্জ্বল জীবনে। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং সঙ্গত আচরণের মাধ্যমে জবাব দিতে হবে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার।

শনিবার, ১৩ জুন, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অবাঞ্ছিত প্রবণতা


‘জমি রাষ্ট্রের, অফিস আওয়ামী লীগের’। এটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুদ্রিত একটি খবরের শিরোনাম। গতকাল ১৩ জুন মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার জমি দখল করে নিজেদের কার্যালয় নির্মাণ করছে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। জানা গেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এমপি ও নেতারাই এ দখলদারিত্বে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এসব অফিসের সাইনবোর্ডও বদলে গেছে। সব মিলিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো। সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। এখনও অব্যাহত  রয়েছে সরকারি দলের অফিস তৈরির হিড়িক। আর বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে নামসর্বস্ব সংগঠনের তৎপরতা। ২০০৯ সালের আগে যেখানে অন্য কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল সেগুলো এখন হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রের জমি দখল করে রাজনৈতিক অফিস তৈরি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও প্রভাবশালীরা এটি করে যাচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের জমি দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দুই সিটিতে যারা মেয়র নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, তাদের উচিত এখন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। উল্লেখ্য যে, ঢাকার কূটনৈতিক জোনও রেহাই পায়নি এ ধরনের দখলদারিত্ব থেকে। দূতাবাসের আশপাশের ফুটপাত দখল করে চলছে অফিস বানানোর তৎপরতা। রাজধানীর বারিধারায় মার্কিন দূতাবাসের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে যুবলীগের অফিস। এ অফিসের কারণে দূতাবাসও অনেকটা অস্বস্তিতে রয়েছে। অভিজাত এলাকা গুলশান-২ নম্বর মোড়ে ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ অফিস। পাশাপাশি রয়েছে জাতীয় পার্টির অফিসও। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রভাবশালী নেতাদের মদদে গত কয়েক বছর ধরে ফুটপাতসহ সরকারি জায়গা দখল করেছে বিভিন্ন সংগঠন। গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক দলীয় কার্যালয়।
ফুটপাতসহ সরকারি জায়গা দখল করে সরকারি ঘরানার লোকজন যে অন্যায় কর্ম করেছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। উপরন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নামে এসব কার্যালয়ের আশপাশের এলাকায়  চাঁদাবাজিসহ রাতে নানা অপকর্ম চলার অভিযোগ রয়েছে। সরকারের জন্য এবং দেশের রাজনীতির জন্য এগুলো মন্দ উদাহরণ। দেশে সরকার আছে, আইন-আদালত আছে, পুলিশ-প্রশাসন আছে তারপরেও ফুটপাত ও জমি দখল করে এমন তৎপরতা চলে কী করে? সকারি দলের সাথে সম্পর্ক থাকলে তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে চলে যায়? আমরা মনে করি এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দলের করণীয় আছে। সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে দখলের অন্যায় কর্মকে প্রতিহত করতে পারে। আর সরকারি দল দলের গঠনতন্ত্র ও ঐতিহ্যের আলোকে দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলায় আনতে পারে এবং দেশ ও জনগণের সেবায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আসলে কোনো দল বক্তৃতা-বিবৃতিতে যে চমৎকার কথাগুলো বলেন, তার অনুশীলন কিন্তু শুরু করতে হয় তৃণমূল পর্যায় থেকেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে গঠনতন্ত্র ও ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে দল ভারী করাই যেন রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে নীতিহীন ও সুবিধাবাদী লোকজন এখন সহজেই রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। এটা আমাদের রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহল উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

Ads