মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়


আফ্রিকার একেবারে পশ্চিমদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের গা ঘেঁষে লক্ষাধিক বর্গকিলোমিটার এলাকার দেশ লাইবেরিয়া। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার চমৎকার। জাপান কিংবা সিঙ্গাপুরের মতো এদেশে শাসকদের মাইক নিয়ে রাস্তায় ‘মানুষ বাড়াও’ ‘মানুষ বাড়াও’ বলে হল্লাচিল্লা করতে হয় না। সন্তানের জন্ম দাও, ছুটি দেবে-পয়সা দেবো-সুবিধা দেবো। জনসংখ্যার দিক থেকে বড় উর্বর দেশ লাইবেরিয়া। এখানকার শাসকরা ভুদু সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। কে কোথায় শাসক, তারা কোথায় ঘুমায়, কোন্ পথে চলে, এসবের খবর খুব কম লোকই রাখে। জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে চল্লিশ বছরে লাখ তিনেক থেকে তা ৪১ লাখে পৌঁছেছে। ব্যবসা বলতে জাহাজ। প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। কিন্তু তা ব্যবহার করার কথা কেউ খুব একটা ভাবে না। হলে হলো। না হলে নাই।
লাইবেরিয়ান সাধারণ মানুষ নানা উপজাতীয় দলে বিভক্ত। কামড়া-কামড়ি, হানাহানি তাদের জীবনের অঙ্গ। আধুনিক জীবনের চাহিদা খুব বেশি আছে বলেও মনে হয় না। লাইবেরিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থাও নেই। যেটুকু আছে তা ব্যবহার করেন শাসক শ্রেণী। এরপরেও যদি কারো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মানুষ বড় ভাল। তারা বিদ্যুতের জন্য আমাদের দেশের হাড়-হাভাতে লোকদের মতো সড়ক অবরোধ করে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয় না। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে নর্তন-কুর্দনও করে না। সেখানে নির্বাচন-টির্বাচন মাঝে-মধ্যে হয়। ওগুলোও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জোর করে ক্ষমতা দখলের জন্য মিলিটারীরও প্রয়োজন হয় না। পুলিশের সার্জেন্টও নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। সেভাবেই সেখানে ১৯৮০ সালে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন সার্জেন্ট ডো।
বর্তমান সরকারের শাসনকালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোটামুটি এমনই এক জায়গায় পৌঁছেছে। এখানে এখন আইন-শৃঙ্খলার বিভিন্ন প্রধানরাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের যা বলার কথা সেগুলো এসব বাহিনী প্রধানরা বলতে কসুর করছেন না। মনে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় চালকের ভূমিকায় এরা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সন্ত্রাসী বললেও এরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার ধার ধারছেন না। তারা একেবারেই নির্মূল করার ঘোষণা দিয়ে বসছেন এবং জানান দিচ্ছেন যে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো সাধারণ নির্বাচন হবে না। আর এ নিয়ে যদি কেউ আন্দোলন করে তবে তারা এক্কেবারে গুল্লি করে দেবে। কারণ তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে তা খেলনা না।
যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখতে যান, সেখানে থাকেন কোন কোন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান। যে ভাষায় তারা কথা বলেন, মন্ত্রীদের যদি ন্যূনতম কোনো ব্যক্তিত্ব থাকতো, তাহলে ঘটনাস্থল থেকেই তাকে তারা এই বাহিনী থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতো। কিন্তু আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। মন্ত্রীরা তাদের কথারই প্রতিধ্বনি করেন মাত্র। এদের মন্ত্রী হবার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। শিক্ষা নেই। পারিবারিক ভিত্তি ভূমি নেই। মাঠের খিস্তি-খেউরের এরাই বাদশা। এবারের অনেক অনির্বাচিত এমপি-ই পুলিশের ওসি, এএসআইকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করেন। এমন একটা সরকারের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাও বাতুলতা মাত্র।
আর তাই যা ঘটার সেটাই ঘটছে। সরকার বেজায় চালাক। সরকার অনেকক্ষেত্রে নিজেরা কোনো দায়ই নিতে চাইছে না। বরং বলছে এটা আদালতের আদেশ। ওটা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাতিজীর বাসা থেকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। তাদের সঙ্গে ছিলো র‌্যাবের গাড়িও। কিন্তু প্রথম থেকেই র‌্যাব পুলিশের লোকেরা অস্বীকার করতে শুরু করলো যে, তাদের কেউ মান্নাকে গুম বা অপহরণ করেনি। সরকারের প্রতিমন্ত্রীরাও বলতে থাকলেন যে, না না, তারা কেউ মান্নাকে তুলে নিয়ে যায়নি। এ নিয়ে দেশজুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। তবে কি মান্নার মতো এক লোক রাতারাতি হাওয়া হয়ে গেলেন। সরকার তেমনি নির্বিকারই ছিলো। কিন্তু ২১ ঘণ্টা পর র‌্যাব স্বীকার করলো যে, তারা মান্নাকে আটক করেছে, তবে ঘটনাস্থল বনানী নয়, ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের স্টার কাবাবের সামনে থেকে। এইটুকু মিথ্যা না বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো না। কিন্তু মিথ্যা না বললে যে সরকারের চলেই না। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি যে, এই ২১ ঘণ্টা মান্না কোথায় ছিলেন।
এরপর ১০ মার্চ রাত ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে উত্তরার একটি বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর দায় স্বীকার করেনি। তার আগেও ২০১২ সালে এভাবেই রাস্তা থেকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে। তারও আগে গুম হয়েছেন বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ আরও অনেকে। সরকার এসব গুমের ঘটনা কেবলই অস্বীকার করে গেছে। সালাহউদ্দিন, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ কারো সন্ধান মেলেনি। সালাহউদ্দিনের গুমের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু সরকার সেই মিথ্যার আশ্রয়েই আছে। মিথ্যা তো সরকার মান্নার ক্ষেত্রেও বলেছিলো। সেই সরকারি বাহিনীর কাছেই কীভাবে মান্নাকে পাওয়া গেল। এ থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, এ সরকার মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মিথ্যা আশ্রয়ী।
উপরন্তু জনগণের ওপর এ সরকারের বিন্দুমাত্র আস্থাও নেই। কেননা এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। এ সরকার সম্পূর্ণরূপে জবরদখলকারী একটি সরকার। এরা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে পুলিশী শক্তির জোরে। পুলিশ বাহিনীও জানে যে, তাদের শক্তি ছাড়া এই সরকারের পক্ষে সাতদিনও ক্ষমতায় আসীন থাকা সম্ভব নয়। ঠিক সে কারণেই এই বাহিনী নরহত্যার সকল দায়মুক্তি চাইতে সাহস করেছে। এবং সেজন্য আইন পরিবর্তনেরও দাবী তুলেছে। ধারণা করি, সরকার সে দাবিও শিগগির মেনে নিয়ে একচ্ছত্র পুলিশী শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে নির্বাচনী প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে সে প্রহসন দেশে-বিদেশে কেউই মেনে নেয়নি। সবাই বলেছে, সকলের অংশগ্রহণমূলক আর একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হোক। সরকার তার থোড়াই পরোয়া করেছে। যদিও ঐ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশী-বিদেশী চাপে সরকার ঘোষণা করেছে যে, শিগগিরই তারা সকলের অংশগ্রহণমূলক আর একটি নির্বাচন দিবে। কিন্তু এখন সে কথা অস্বীকার করছে সরকার। বলছে, ২০১৯ সালের আগে কোনো অবস্থাতেই আর কোনো নির্বাচন তারা করবে না।
ইতিমধ্যে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে তারা কারাগারে পুরেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজ অফিস ভবনে গত আড়াই মাস ধরে অন্তরীণ আছেন। সেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতা কারাগারে বন্দী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় সকল নেতার নামে শত শত মামলা। খালেদা জিয়ার নামেও মামলার শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর তথাকথিত ঋণখেলাপি মামলায় খালেদা জিয়া, কোকোর স্ত্রী ও তার দুই নাবালিকা কন্যার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার এমন ইতর নজির আধুনিক বিশ্বে কমই আছে।
একটি নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে গত আড়াই মাস যাবত সারাদেশে অবরোধ পালন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে সপ্তাহের পাঁচদিন হরতাল। এই আন্দোলন থেকেই জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে এখন সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ডাক দিয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনগুলোকেও সরকার ইতিমধ্যেই একেবারে প্রহসনে পরিণত করেছে। এর আগে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকার বিরোধীরা জয়লাভ করে। কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফা মোটামুটি তাতে দেখা গেছে, সরকারি দলের লোকেরা ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে। বাকি তিন দফা নির্বাচনে সরকার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সবকিছু একেবারে মেরে কেটে দখল করে নিয়েছে। এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিল তাদের অধিকাংশকে নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে। এবং কৌশলে সরকারি দলের প্যানেল মেয়রদের সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের উপর আবার অনির্বাচিত এমপিদের খবরদারি তো আছেই। এই হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিস্থিতি।
তার মধ্যে সরকার যখন এই তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত জানালো, তখন নির্বাচন কমিশন বলল, জুনের আগে এ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই পুলিশবাহিনী প্রধান যখন বললেন, না, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। আশ্চর্য ঘটনা এই যে, যে পুলিশবাহিনীর নির্বাচনকালে সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের হুকুমে চলবার কথা, সে পুলিশবাহিনীর প্রধানের হুকুমে নির্বাচন কমিশন এপ্রিলের ২৮ তারিখেই নির্বাচন ঘোষণা করে দিলো। ধিক্ নির্বাচন কমিশন। সেই সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটাও জানান দিলেন যে, কোনো রাজনৈতিক দল না এলেও নির্বাচন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। হাঃ!
যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শুধু এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়, তাহলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের ভাষায় সরকার কিছুতেই এ নির্বাচন করতে সাহস পাবে না। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সেবাহীন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে


যে কোন দেশের রাজধানীর চিত্র সে দেশের সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। মুখে যেমন মানুষের মনের ভাব ফুটে উঠে, তেমনি রাজধানীর চিত্র দেখে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেগুলোর রাজধানীর চিত্র ঢাকার চেয়ে সুশৃঙ্খল, পরিপাটি ও বাসযোগ্য। মেট্রোপলিটন সিটি বা মাদার সিটি বলতে যা বোঝায়, ঢাকায় তার সবকিছু থাকলেও, সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত নয়। একটি মেট্রোপলিটন সিটির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া।
বিশ্বের সব বড় শহর নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও শহরটিকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখা একজন মেয়র ও কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সেই বিবেচনায় এক দুর্ভাগা শহরের নাম ঢাকা। সুদীর্ঘকাল ধরে ঢাকা মেগা বা মাদার সিটি হিসেবে পরিচিতি পেলেও, তা পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি, গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগও খুব একটা দেখা যায় নি। এখনও অপরিকল্পিতভাবে এর বিস্তৃতি ঘটছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা কাঙ্খিত মানের নয়। প্রতিদিনই রাজধানীকে যানজটে স্থবির হয়ে পড়তে দেখা যায়।
ঢাকায় বসবাসকারী দুর্ভোগের শিকার বেশিরভাগ মানুষ। অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পায় না তাই কারোর কাছে অভিযোগও করেন না ভুক্তভোগীরা। কষ্ট মনে চেপে রেখেই দিনাতিপাত করছেন তারা। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, ঢাকা এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই ঢাকাকে জনগণের বসবাসের উপযোগী করতে সরকার পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছে বলে দাবি তার। তবে তার বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজে পায় না ঢাকার মানুষ। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ১৯ জুলাই ২০১৪)
ঢাকার আয়তন ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার আর এখানে বর্তমানে ১ দশমিক ৫০ কোটির অধীক লোক বসবাস করছে। প্রতি বর্গ কিলোমিটার আয়তনে প্রায় ৫০ হাজার লোক বসবাস করে। তবে আয়তন না বাড়লেও ঢাকায় বাড়ছে মানুষ। পাবলিক পরিবহন, ওভারব্রিজ, আরবান ভেজিটেশন, পার্ক এন্ড রিক্রিয়েশন সেন্টার, বসবাসের জন্য নিরাপদ বাড়ি, ফুটপাত ও পথচারীদের সুবিধা বাড়েনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ট্রাফিক জ্যামও এখন ঢাকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর এক প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর দেশের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এই বিপুল ক্ষতির বোঝা সামগ্রিক অর্থনীতিকে সুদীর্ঘকাল ধরেই বয়ে চলতে হচ্ছে। বলা যায়, যানজট অর্থনীতির ক্ষত হয়ে আছে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মানের একটি শহরে চলাচলের জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা থাকে। ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ৯ ভাগ। অর্থাৎ যানজট নিরসন, স্বচ্ছন্দ চলাফেরা এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার জন্য যে পরিমাণ রাস্তার প্রয়োজন ঢাকায় তা নেই। যেটুকু আছে, তাও বিভিন্নভাবে দখল হয়ে আছে।
নগরবিদরা মনে করছেন, বিদ্যমান রাস্তাগুলোকে যদি পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করা যায়, তাতেও যানজট অনেকাংশে নিরসন করা সম্ভব। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা প্রয়োজন। নগর বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যানজট ঢাকার প্রধান সমস্যা। অথচ একটি নগরের প্রধান দিক হলো পরিবহন ব্যবস্থা। ২০০৬ সালে একটি পরিবহন কৌশলপত্র নেয়া হয়েছিল, যেটি অনুমোদিত হয়। সেখানে মেট্রোরেল, কমিউটার ট্রেনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। যানজট নিরসনে এসব অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)
তবে যানজট নিরসনে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে রয়েছে, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তার মাঝপথে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করানো, রাস্তায় বাজার বসা, ফুটপাত দখল এবং ট্রাফিক নিয়ম না মানা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটু তৎপর ও সদিচ্ছা পোষণ করলেই এসব সমস্যার সামাধান সহজেই করা যায়।
২০০২ সালের এপ্রিলে ভোটের পর ২০০৭ সালের মে মাসে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হয়। ডিসিসি নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রায় চার বছর মেয়র হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় দুইবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনি জটিলতায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
২০১৩ সালের ১৩ মে ডিসিসির দুই ভাগে নির্বাচন নিয়ে করা রিট আবেদন খারিজ করে ভোট আয়োজনের ওপর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ তুলে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে তেজগাঁও সার্কেলভুক্ত সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের ১৩টি পাড়া-মহল্লা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করায় সীমানা পুননির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে।
‘অতিরিক্ত নাগরিক সুবিধার’ কথা বলে ২০১১ সালের নভেম্বরে ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর নামে দুই ভাগ হয় ডিসিসি। এর পরই দুই সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা প্রশাসক নিয়োগ করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ছয় মাস পর পর প্রশাসক বদল হয়। ২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রথম প্রশাসক নিয়োগ হয়। স্থানীয় সরকার আইন (সিটি করপোরেশন) একজন প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিন। হিসাব অনুযায়ী দুই অংশে ভাগ করার পর ইতিমধ্যে প্রতি সিটি করপোরেশনে কয়েকজন প্রশাসক বিদায় নিয়েছেন। আসছেন না সিটি মেয়র। আর অতিরিক্ত নাগরিক সুবিধার কিছুই এখনো দৃশ্যমান হয়নি।
২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের ইসি তফসিল ঘোষণা করলেও আইনি জটিলতায় তা স্থগিত হয়ে যায়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৪ মে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ২০১৩ সালের মে মাসে নির্বাচনের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে নতুন করে তফসিল ঘোষণার উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। তবে ওই সময় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একটি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় সীমানা জটিলতায় নির্বাচন আবারও ঝুলে যায়।
সরকার ডিসিসি নির্বাচন বন্ধের জন্য নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছিল। যাতে একটি সমস্যার সমাধান হলেও আরেকটি সমস্যা নির্বাচনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি নতুন এলাকা সংযুক্ত নিয়ে একাধিক মামলাও হওয়ার সম্ভবনা ছিল।
দুই ভাগে বিভক্ত করার কারণস্বরূপ বলা হয়েছিল, ঢাকা অনেক বড় নগরী হয়েছে, একক সিটি করপোরেশন নগরবাসীকে সেবা দিতে পারছে না, তাই দু’টি কেন্দ্র সৃষ্টি করা হোক। সেই সময় নগরবাসী তথা দেশবাসী মুচকি মুচকি হেসেছিল সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ঠুনকো যুক্তি শুনে। জনগণের মতে, আসল কারণ ছিল একক সিটি করপোরেশনের জন্য নির্বাচন হলে জনপ্রিয়তার কারণে বিএনপি কর্তৃক মনোনীত বা বিএনপিপন্থী মেয়রপ্রার্থী জিতে যাওয়ার প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা ছিল।
আওয়ামী লীগের তথা আওয়ামী লীগপন্থী মেয়রপ্রার্থীর পরাজয় ঠেকানোর জন্য দু’টি সিটি করপোরেশন সৃষ্টি করা হলো, যেন যেকোনো একটিতে যেকোনো প্রকারে আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থীকে জেতানো যায়। ভাগ করে দেয়ার পর সরকার আবিষ্কার করল, দু’টি করপোরেশন করার পরও আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা গৌণ। ঢাকায় যদি আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থীর পরাজয় হয় তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য মারাত্মক তাৎপর্যবাহী ঘটনা হতো।
তাই পরাজিত হওয়ার থেকে একদম শূন্য ফলাফল ভালো মনে করে আওয়ামী লীগ সরকার তিন চার বছর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধ করার পুরো বন্দোবস্ত করে। যেকোনো নির্বাচন বন্ধ করানোর জন্য সরকারের হাতে অনেক প্রকার অস্ত্র থাকে। তিন চার বছর আগে যদি ঢাকা মহানগরের একটি বা দু’টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো তাহলে মহানগরের অভ্যন্তরে সরকারি প্রশাসন বা সরকারি আমলাদের অপব্যবহার করতে পারত না আওয়ামী লীগ। করতে পারবে না বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেছেন, বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলনের অনুমতি নিতে হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে। যেটা সরকার এখন সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ বিরোধী শক্তির হাতে গেলে, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশের অনুমতি তারা সহজেই পাবে। সে ক্ষেত্রে বিরোধীদের আন্দোলন দমাতে সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি নিজেদের আওতায় রাখতে ঢাকা সিটির নেতৃত্ব কোনোভাবেই বিরোধী শক্তিকে দিতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ৩ মে  ২০১৪)
১৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার নিউজের শিরোনামটি ছিল- ‘কাউন্সিলরের কাজ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা’। সংবাদে বিস্তারিত লেখা আছে অনেক কিছু। প্রথম আলোর তথ্য মতে, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পরিবর্তে প্রশাসক দিয়ে কাজ পরিচালনার কারণে নাগরিকদের সুবিধা তো বাড়েইনি, উল্টো ভোগান্তি বেড়েছে। সিটি করপোরেশনে নাগরিক সেবা পেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের এখন যেতে হয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে। সেবার ধরন ও সেবা পাওয়ার সময়ের ওপর নির্ভর করে কোন নেতার কাছে যেতে হবে। কাজ বড় হলে চলে অর্থের লেনদেন।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি নেই তিন বছর। করপোরেশনের মূল, আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড কার্যালয়গুলো চালান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে কার্যালয়গুলোর প্রায় সব ধরনের কাজ। এলাকার সমস্যায় এসব নেতাই ওয়ার্ড বা আঞ্চলিক কার্যালয়ে হাজির হন।
জিবলু রহমান 

রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বাধীন দেশে বন্দী নাগরিক!!


স্বাধীনতা একটি জাতির জন্য বিরাট গৌরবের অনেক বেশি আনন্দের। স্বাধীনতা আমাদের অর্জিত সম্পদ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের গৌরবের মায়াগাথা এই লাল সবুজের পতাকা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমারা অর্জন করি মহান স্বাধীনতা। ইতিহাসের বিচারে মাত্র ৯ মাসের সংগ্রামের অর্জিত স্বাধীনতা বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল। যেখানে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা লাভ করতে সময় লাগে ২৬ বছর। ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে ৪০ বছরের ওপর আন্দোলন করে ভারত অর্জন করে স্বাধীনতা। ফরাসী শক্তির বিরুদ্ধে ৯ বছর ধরে লড়াই করে আলজেরিয়া পায় স্বাধীনতা। ইরিত্রিয়া রক্তাক্ত সংগ্রাম করে আজও ইথিওপিয়া থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারেনি। কাশ্মীরসহ ভারতের সাত রাজ্য অব্যাহত রেখেছে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাই স্বাধীনতা আমাদের জন্য গৌরব ও অহঙ্কারের।
আমরা স্বাধীন ভূ-খন্ড পেয়েছি সত্য, কিন্তু পায়নি তার আয়তন। আমরা স্বাধীন একটি রাষ্ট্র পেয়েছি বটে, কিন্তু পাইনি আমাদের সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার। আমরা পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি ফেলেও এখনও নিজ দেশেই যেন বন্দী। অথচ স্বাধীনতা শব্দটির মাঝেই লুকায়িত প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়ের চাওয়া পাওয়া আর আত্মার প্রশান্তি। সেই পাওয়া অঢেল সম্পদ আর ক্ষমতার মালিকানা নয় কিংবা অভিজাত্য আর বিলাসিতা পূর্ণ জীবন ও নয়। স্বাধীনতা মানে আমার কথা বলার অধিকার, স্বাধীনতা মানে আমার জানমাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা। স্বাধীনতা মানে আমার পরাধীনতার বেড়াজাল থেকে মুক্তি। স্বাধীনতা মানে আমার ছোট্ট একটি সংবিধান। স্বাধীনতা মানে আমার, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি। কিন্তু আজ আমাদের মানচিত্র খন্ড-বিখন্ডিত। বিডিয়ারকে হত্যা করে সীমান্ত অরক্ষিত, মানুষের সাংবিধানিক অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। প্রতিটি নাগরিক অধিকার নির্বাসিত। মানুষের জানমাল, ইজ্জত-আব্রুর নেই কোনো নিরাপত্তা। কিন্তু কেন? আমার দেশের প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধমীয় স্বাধীনতা কোনো দল বা গোষ্ঠীর করুণা কিংবা দয়া নয়। এটি সংবিধান স্বীকৃত আমাদের প্রাপ্য অধিকার। এ আধিকার হরণের সাধ্য কার!
একটি জাতির আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য ৪৪ বছর কম সময় নয়। কিন্তু যে গণতন্ত্র, মানবিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ইনসাফের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম তার সবই আজ আওয়ামী নখরে ক্ষতবিক্ষত। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এখনো আমাদের গণতন্ত্রের জন্য ভিন দেশের দিকে কেন করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়। এখনো আমাদের কানে বাজে ইজ্জত রক্ষায় জালপরা বাসন্তীদের হাহাকার!! দু’মুঠো খাবারের জন্য মা তার সন্তান বিক্রির খবর আসে এখনো পত্রিকার পাতায়। আকাশে-বাতাসে আজ লাশ আর বারুদের গন্ধ। রাস্তা-ঘাট, বনে-জঙ্গলে, ডোবা-নালায়, নদীতে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব আশরাফুল মাখলুকাতের মৃতদেহ।
রাতের অন্ধকারে বন্দুকের একটি আওয়াজ মানেই অজানা এক আতঙ্ক। না জানি ক্রসফায়ারের নামে ঝড়ে পড়লো কোনো তাজা প্রাণ? আজীবনের জন্য নিভে গেল কোনো উজ্জ্বল প্রদীপ! এটি কোনো সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। এ যেন কোনো মায়ের নাড়ি ছেঁড়া সন্তানের বুকে গুলী ঝাঁঝরা করা মৃত লাশের খবর!। কোনো স্ত্রীর বিধাবা হওয়ার এক মহাদুঃসংবাদ। এতিম সন্তানরা পৃথিবীতে বাবা বলে আর কাউকে ডাকতে না পারার পরিসমাপ্তি। এর কোনো জবার আছে কি আমাদের রাষ্ট্রের কাছে? ক্রসফায়ারের খবর শুনলেই যেন বুক কেঁপে উঠে। প্রিয়জনের সন্ধানে হাসপাতালের মর্গে কিংবা অজ্ঞাতনামা লাশের মিছিলে খোঁজাখুজি। বুলেট আর পেট্রোল বোমার আঘাতে এ জনপদে লাশের মিছিল এখন অনেক দীর্ঘ।
বাংলাদেশে এখন বেওয়ারিশ লাশের স্তূপ দিন দিন বাড়াছে। এটি মানবতার জন্য বড়ই অবমাননাকর। কিন্তু অনেকের ভাগ্যে লাশটিও জুটছে না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রশিবির নেতা অলিউল্লাহ আর মোকাদ্দাস, চৌধুরী আলম, মিঠাপুকুরের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান আবুল বাসেত, আর ইলিয়াস আলী আজ ও ফিরেনি। এ রকম হাজারো গুম-খুন, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, পঙ্গু হাতহারা-চোখ হারাদের সারি এখন অনেক দীর্ঘ। কিছুতেই যেন তা আর থামছে না। দেশীয়-আন্তজার্তিক কোনো সমালোচনাই যেন আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী তোয়াক্কাই করছে না। তাহলে এর অবসান আসলে কবে হবে? কবে বন্ধ হবে এই কান্নার আওয়াজ? কবে বন্ধ হবে হুঙ্কার আর নিষ্ঠুরতা। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে মানবতার এমন করুণ আর্তনাদ চিৎকার করে যেন স্বাধীনতাকে খুজে ফিরছে!!
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি, মানুষের জীবনহানি, সভ্রমহানি ও আইনের শাসনের বোধের উপলব্ধির অভাব দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে দিয়েছে। জনগণ এখন অগ্নিকুন্ডের কিনারে দন্ডায়মান। এক ব্যক্তির খেয়াল-খুশিই যেন ১৬ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে একচরম তামাশায় লিপ্ত। গুম হয়ে যাওয়া মানুষ নিয়ে যে দেশের প্রধানমন্ত্রী রশিকতা করেন। সেখানে মানবিকতার কত বড় বিপর্যয় তা কি বলার আপেক্ষা রাখে? আজ রশিকতা চলছে মানুষের জীবন, সভ্রম, নিরাপত্তা আর বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে। তার অধিকার, মর্যদা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। এটি কারো করুণা নয়। আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে সে প্রয়োজনবোধে জীবন দেবে, কিন্তু অন্যায়-অবিচার, জুলুম আর অবিচারের কাছে মাথা নত করবে না। যে বান্দা কপাল দিয়ে এক আল্লাহকে সিজদা করে, সেই সৈনিক এক আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত করে না।
পাহাড়সম দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, সহিংসতা, আগ্রাসন, নাশকতা ও রাজনৈতিক স্বার্থে মিথ্যা নাটক জনসমর্থনহীন এ সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার শূন্যের কোটায় সঙ্কুচিত করেছে। বিরোধীদলীয় জোটের আহ্বানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনে এদেশের ৯৫ ভাগ মানুষের সাড়া আর উপজেলা নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন সরকারকে ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুকতর জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। একের পর এক সরকারের অপকৌশল বুমেরাং হচ্ছে। নিজের অপরাধের  বোঝাই এখন আওয়ামী লীগের জন্য অসহনীয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন-নিপীড়ন, গণহত্যা, দুর্নীতি, তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর সর্বশেষ একদলীয় নির্বাচনের আয়োজনের কারণে বাংলাদেশে এখন বিশ্ব মিডিয়ার খোরাক।
বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তি ও একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করুক এটা ভারত কখনো চায়নি। যার কারণে ভারত পৃথিবীর এত বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের মূল মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে ভারতের কংগ্রেস সরকার। ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে সিলেক্টিভ এই সরকার সারা পৃথিবী থেকে এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভারতের যে কংগ্রেস প্রভুদের ইশারায় ক্ষমতায় এসেছে তারাও এখন দিল্লির মসনদ থেকে ছিটকে পড়েছে। অনেকেই মনে করছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজয় হবে কংগ্রেস থেকে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। কারণ কংগ্রেস থেকে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দুনীতি আর অপকর্মের পাল্লা অনেক ভারি।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু কখনো ছোট ও ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, ক্ষুদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং একদিন এসব ক্ষুদ্র দেশ ভারতে যোগদান করবে। ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র ৫৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় নেহরু লিখেছেন : Small nation state is doomed. It may survive as a cultural and autonomous area but not as an independent political unit. অর্থাৎ ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এটি সাংস্কৃতিক ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে টিকে থাকতে পারে তবে স্বাধীন রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে নয়। ভারত সেই থিওরি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। তার ব্যতিক্রম কিছু হলে এদেশের জনগণের চাপেই হতে পারে, অন্য কোনো কারণে নয়। সম্পতি ক্রিকেট জালিয়াতি কর বাংলাদেশ হারাতেও ভারত দ্বিধাবোধ করেনি। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার কাছে লজ্জাজনক পরাজয় বাংলার ক্রিকেট প্রেমিদের ক্ষত কিছুটা গুছেছে।
সোনার বাংলা বৃটিশদের দু'শো বছরের গোলামী শাসন, পাকিস্তানীদের শোষণ থেকে মুক্তি পেলেও তাদের দোসরদের কবল থেকে মুক্ত হয়নি এখনো। সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে ভারত হাঙরের মতো তার আসল চরিত্র নিয়ে হানা দিচ্ছে বাংলাদেশের ওপর। এর অন্যতম কারণ আওয়ামী লীগের অতিমাত্রায় ভারত প্রীতি। ভারতের প্রতি এই কৃতজ্ঞতা অবশ্য আওয়ামী লীগের ঐ নেতারাই বেশি প্রকাশ করেন, যারা যুদ্ধ না করে মুন্সিয়ানার মতো ভারত পালিয়ে লজিং ছিলেন। এজন্য অনেক আওয়ামী লীগারের-ই সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ভালো লাগেনা, এক মন্ত্রী তো সেদিন বলেই ফেললেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ চেতনায় এক ও অভিন্ন।’ এর বড় প্রমাণ মিলবে ইটালিয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির ‘ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি’ গ্রন্থে। যিনি ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিলো- আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ আপনার কাক্সিক্ষত মিত্র হবে। ইন্দিরা গান্ধী উত্তর দিলেন, ‘বাংলাদেশ ও আমাদের বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। অবশ্য একতরফা বন্ধুত্ব হবে না। প্রত্যেকেরই কিছু দেবার ও নেবার থাকে আমরা আমাদের পাওয়ার ব্যাপারে সব সময়ই সচেষ্ট।’ সম্মানিত পাঠক বৃন্দ এখান এটি খুবই পরিষ্কার যে, ভারত নিজেদেও স্বার্থেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল।
সম্প্রতি এনটিভিতে বাংলাদেশে মানবসম্পদ তথা তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনার ওপর এই তথ্যবহুল রিপোর্ট দেখানো হয়েছে, পৃথিবীর মধ্যে বড় অংশ কর্মক্ষম তরুণ এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে, তা প্রায় ১১ কোটির মতো। এই সম্ভাবনাকে আগামী ৩০/৩৫ বছরের মধ্যে কারিকরী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ ১-২শ’ বছর এগিয়ে যাবে। কিন্তু এই মানবসম্পদকে কাজে লাগাতে না পারলে বাংলাদেশের জনবিস্ফোরণ একটি বোঝায় পরিণত হবে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিকল্পনা আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশে পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তা নিয়ে কি এই তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আদৌ ভাবেন? বর্তমানে বিরোধ, বিভেদ, অপরাজনীতি, আর শাসক গোষ্ঠীর জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতার থাকার অপপ্রয়াস দেখে কি দেশের জনগণ তাই মনে করে না?
আমাদের সোনার বাংলার প্রতি বিদেশী শকুনদের এখন লোলুপতা। অপরূপ ও অবারিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশসহ বহির্বিশ্বের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। এখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ অনেকেই চায় না। এটি আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বুঝতে পারেন?। স্বনির্ভর অর্থনীতি আর আত্মনির্ভর বাংলাদেশ অনেকের কাছেই এখন চক্ষুশূল। এ দেশের গণতন্ত্রকে ভারত রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন সেই পরিকল্পনারই অংশ। দেশের অর্থনীতি এখন পঙ্গু হতে চলেছে। তার মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রই বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিচ্ছে। পোশাক শিল্পের একচেটিয়া সুবিধা এখন ভারত নিচ্ছে।
এজন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। গত ৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৪-১৫ অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি আরো বলেছে, বিনিয়োগ তো হয়নি, উল্টো বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে দেশ থেকে। টাকার অঙ্কে যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। সংবাদ সম্মেলনে আমেরিকান গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান উল্লেখ করে জানানো হয়, ২০১২ সালে দেশ থেকে ১৪০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এর আগে ভারতীয় পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স আকারেই ২০১৩ সালে ভারতে চলে গেছে ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার। সিপিডি বলেছে, বাংলাদেশের বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। কিন্তু দেশটিতে আমাদের লোক কমে যাচ্ছে। তারা লোক ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু আমাদের থেকে নিচ্ছে কম। সিপিডি বলেছে, নেপাল থেকে আগের চেয়ে বেশি লোক যাচ্ছে সৌদি আরবে। আবার ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তেমন প্রবাসী আয় অর্জিত হয় না। ভারত পঞ্চম প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকে। সিপিডির এই বক্তব্য সঠিক হলে তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের।
সিপিডি বলেছে, তাদের বক্তব্য সরকারি তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই তৈরি করা। বাংলাদেশ থেকে ৩৭০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স ভারতে চলে যাওয়া অর্থাৎ ভারত বাংলাদেশ থেকে পঞ্চম প্রবাসী আয় সংগ্রহ করছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে কোনো প্রবাসী আয় আসছে না। এটা থেকে কি বোঝা যায়? তাহলে বাংলাদেশে কতজন ভারতীয় নাগরিক চাকরি করছে? ৩৭০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স যাওয়া কি সহজ কথা? অথচ তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশে কোনো আয় আসছে না। বাংলাদেশে বিপুল শিক্ষিত বেকার রয়েছে। আমাদের দেশে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত।” সুতরা আজ আমাদের ভাবতে নিজেদের প্রয়োজনেই।
দেশ, জাতি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যাতে কেউ কোনো আওয়াজ তুলতে না পারে সেজন্য আওয়ামী লীগ জামায়াত-শিবিরকে নির্মূল করতে চায়। এভাবে একে একে সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে নির্মূল করে আওয়ামী সরকার একদলীয় বাকশাল কায়েম করে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধীমত শূন্য বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। তাইতো ১৯৪৭ সালে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস মানুষের দুর্দশার চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেন, ‘ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনো এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি, এ বিপদ অনুভব করা এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বে কখনো চিন্তা করার এতটা তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়নি-যতটা দেখা দিয়েছে আজকের এ সময়ে। আজ আওয়ামী দুঃশাসনের এই মানব রুপি অক্টোপাসের জুলুম নির্যাতনের নিষ্পেষণে ক্ষতবিক্ষত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। দেশের ১৬ কোটি মানুষ সকলেই যেন আজ স্বাধীন দেশের বন্দী নাগরিক!!
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম 

শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অথঃ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এবং পুলিশ রিমান্ড প্রসঙ্গ


বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভীতিকর দু’টি পরিভাষার নাম হলো ‘বিনা পরোয়ানায় মধ্যরাতে গ্রেফতার’ এবং ‘পুলিশ রিমান্ড’। অনেকের ক্ষেত্রে কোনরূপ পরোয়ানা ছাড়াই রাতে বাসা থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। যাদের কপাল ভালো তাদেরকে বিনা পরোয়ানায় উঠিয়ে নেয়ার কথা বিলম্বে হলেও স্বীকার করা হয়। আর যাদের কপাল খারাপ তাদেরকে উঠিয়ে নেয়া হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তাদেরকে উঠিয়ে নেয়ার কথা স্বীকারও করা হয় না। আইন সুস্পষ্ট ভাষায় বলে যে, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের কোনো প্রশ্নই উঠে না। এটি সম্পূর্ণ বেআইনী এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আর যদি পরোয়ানা বলে গ্রেফতার করা হয় তাহলে গ্রেফতার করার সময় হতে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিতে আদালতে হাজির করতে হবে। এই বিষয়গুলো যেন ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’ এর মতো। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি ও প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমেদ এবং প্রখ্যাত সাবেক ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না। জনাব মান্নাকে তার আত্মীয়ের বাসা থেকে (বনানী) গ্রেফতার করা হয় রাত সাড়ে তিনটায়। সমস্ত টেলিভিশনে এই গ্রেফতারের খবর সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু পরদিন সকালে ডিবি পুলিশ এবং র‌্যাব এই গ্রেফতারের খবর সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। কিন্তু সন্ধ্যার পর টেলিভিশনে পুনরায় খবর প্রচারিত হয় যে, মান্নাকে ‘ধানমন্ডির’ ‘স্টার কাবাব’ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ঐ রাতেই তাকে ডিবি পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। পরদিন তাকে কোর্টে প্রোডিউস করা হয় এবং ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।
কিন্তু জনাব সালাহ উদ্দিনের গ্রেফতার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো বিভাগই স্বীকার করেনি। তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদের কোনো জিডি কোনো থানা গ্রহণ করেনি। আজ ১৭ দিন হলো তিনি নিখোঁজ আছেন। তিনি কি বেঁচে আছেন কি নাই তাও কেউ জানে না। বেগম হাসিনা আহমেদ জোর দিয়ে বলছেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। ২০ দলীয় জোটপ্রধান বেগম খালেদা জিয়াও বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই যে সালাহ উদ্দিনকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে। একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ১৭ দিন হলো নিখোঁজ আছেন। অথচ সরকার সম্পূর্ণ নির্বিকার। কোথায় বাস করছি আমরা?
॥ দুই ॥
আরেকটি হলো রিমান্ড। ইংরেজি রিমান্ড শব্দটি বাংলায় নির্যাতনের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে গ্রেফতারকে রাজনৈতিক কর্মীরা তেমন একটা ভয় করতেন না। তখন বলা হতো, রাজনীতি করবো, আর গ্রেফতার হবো না, এটা কোনো কথা হয়? কিন্তু এখন গ্রেফতারের আশঙ্কা আছে, জানতে পারলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। কারণ এখন গ্রেফতার মানেই রিমান্ড। রিমান্ড মানেই নির্যাতন। এমন নির্বিচার রিমান্ড অতীতে আর দেখা যায়নি। আর সেই রিমান্ডও একটানা ২/৪ দিন নয়, একেবারে একটানা ১০/১৫ দিন। তাও আবার দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। এমন পাইকারি হারে রিমান্ডে নেয়া আইনে নেই এবং রিমান্ড মঞ্জুর হলেও নির্যাতনের কোনো অধিকার আইন পুলিশকে দেয়নি। ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে যা পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ:
What is a Police Remand? Does it mean permission to torture accused?
After arresting a person police officer cannot keep arrested person with him for more than 24 hours.
Within 24 hours police officer has to produce this man physically before a judge. the arrested man can also complain to the judge if police has beaten him.
The Judge then takes this man in his `judicial custody- judges custody and then he sends arrested man to Jail authority to keep him on judges behalf untill further order.
Here two more things can happen
(1) A lawyer can move an application that his client is innocent. He may be given bail.
(2) Here police can oppose grant of bail.
Then if the judge thinks that it is necessary to give the accused to police custody he may do it but shall give safety direction that the arrested person should not be beaten.
This is called remand.
বাংলা অনুবাদ :
পুলিশ রিমান্ড কি? এর অর্থ কি
আসামীর ওপর নির্যাতন চালানো?
কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলে পুলিশ অফিসার সেই ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার ওপর তার হেফাজতে রাখতে পারবেন না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামীকে শারীরিকভাবে বিচারকের সামনে হাজির করতে হবে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পুলিশ তাকে নির্যাতন করেছে কিনা সেটাও আসামী বিচারককে বলতে পারবেন।
তখন বিচারক তাকে পুলিশ হেফাজতের বদলে বিচারিক হেফাজতে সোপর্দ করবেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তিনি বিচারকের তত্ত্বাবধানে কারাগারে থাকবেন।
এখানে দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে।
১। আসামীর আইনজীবী এই মর্মে দরখাস্ত করতে পারেন যে, তার মক্কেল নির্দোষ। সুতরাং তাকে জামিন দেয়া হোক।
২। পুলিশ সেই জামিনের বিরোধিতা করতে পারে। যদি বিচারক মনে করেন যে, তাকে পুলিশ হেফাজতে দেয়া দরকার, তাহলে তিনি সেই মর্মে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু একই সাথে এ নির্দেশও দেবেন যে, তার আর কোনো শারীরিক নির্যাতন করা যাবে না। এটাকেই বলা হয় রিমান্ড।
কিন্তু কে কার কথা শোনে? শুধু বিদেশের উদাহরণ কেন, দেশের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টেরও একই রকম নীতি নির্ধারণী নীতিমালা আছে।
॥ তিন ॥
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড ট্রাস্টসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা রিমান্ড প্রশ্নে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। এটি করা হয় সন্দেহজনক গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করে। ২০০৩ সালের ২৭শে এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঐ দু’টি ইস্যুতে প্রচলিত আইন সংশোধনের নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশনা আপিল বিভাগ স্থগিত করেনি। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়,
১। আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
২। কাউকে গ্রেফতার দেখানোর সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
৩। গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে।
৪। গ্রেফতারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ।
৫। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে পুলিশকে।
৬। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যদি কাউকে আটক করা হয় তাহলে আটক ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
৭। আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
৮। জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।
৯। কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
১০। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে।
১১। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে, ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
১২। পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে।
১৩। পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয়, ঐ ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দিবেন।
॥ চার ॥
এই ১৩ দফাই হলো রিমান্ডের ব্যাপারে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা। এসব নির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ হয়নি, অথবা আপিল বিভাগ এসব নির্দেশনা বাতিল বা সংশোধন করেনি। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে এই ১৩ দফাই হলো আজ পর্যন্ত বহাল রিমান্ডের নির্দেশনা। চরম পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, এসব নির্দেশনা এখন কাজীর গরুতেই পরিণত হয়েছে। এগুলো এখন শুধু কেতাবেই আছে, গোয়ালে নেই। এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট এবং মানবাধিকার কর্মী ড. শাহদীন মালিকের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের সব জায়গায় নাগরিক অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, অভিযুক্তদের কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত অধিকার নেই বললেই চলে। ড. মালিক বলেন, রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের বিচারকরা হাইকোর্টের নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করছেন না।”
ড. শাহদীন মালিকের এই দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না।
আসিফ আরসালান 

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বিশ্বরাজনীতি


বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দু’ভাগে বিভক্ত বিশ্বরাজনীতিতে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যকার সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। এই পরিবর্তন ঘটেছিল ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। অন্যদিকে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল। সে সমর্থন শেষ পর্যন্ত পেয়েছিল বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম পরাশক্তি ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণচীনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। সাধারণভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও গণচীন সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনাকালে পাঁচ প্রধান রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল এ রকম : (এক) গণচীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬৫ সালে ভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর চীন-সোভিয়েত যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ফলে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; (দুই) যুদ্ধ ও সীমান্ত সমস্যার কারণে গণচীন ও পাকিস্তান ভারতকে সাধারণ শত্রু মনে করতো। ফলে গণচীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ; এবং (তিন) ১৯৫০-এর দশক থেকে পাকিস্তান বিভিন্ন সামরিক জোটে যুক্ত থাকায় এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সোভিয়েতবিরোধী নতুন শক্তি গণচীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দূতিয়ালি করায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রকাশ্য সম্পর্ক ছিল উষ্ণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল ভারত। জন্মকালীন শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তানের ভাঙন ঘটানো ছিল ভারতের প্রধান সাফল্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের দ্বারস্থ করেছিল, ভারত সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল পরিপূর্ণরূপে। তাই বলে ভারতের সব রাজনৈতিক দল প্রথম থেকে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়নি। উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও ডানপন্থী দলগুলো তো বটেই, ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল কংগ্রেসের ডানপন্থীরাও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মাধ্যমে ‘দ্বিতীয় পাকিস্তান’ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসে তৎপর বামপন্থীদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাফল্যের সঙ্গে শরণার্থী সমস্যাকে প্রাধান্যে এনে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ইন্দিরা গান্ধীর অন্য একটি কৌশল ও উদ্দেশ্যও ছিল উল্লেখযোগ্য : স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার আড়ালে নকশালসহ বিভিন্ন রাজ্যে চলমান সশস্ত্র সংগ্রামকে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নিজের এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব সংহত করেছিলেন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামকেও ইন্দিরা গান্ধী নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদকে দিয়ে তিনি এমন একটি সরকার গঠন করিয়েছিলেন, যে সরকার শুধু ভারতের মুখাপেক্ষীই থাকেনি, সকল প্রশ্নে কংগ্রেস সরকারের ইচ্ছা ও নির্দেশনাও মেনে নিয়েেেছ। বাংলাদেশের ওপর ভারতের এখনও যে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ, তার শুরু হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনাকালে। ইন্দিরা সরকারের নির্দেশ থাকায় বামপন্থীদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি, তারা এমনকি ভারতেই থাকতে পারেননি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকেও যুদ্ধ ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রহরাধীন রেখেছিল ভারত। ভারতের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার সম্মানজনক পথ খোলা থাকলেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের লজ্জাকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (যদিও কাগজেপত্রে তা ছিল ‘বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী’)। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সব দিক থেকে এভাবেই লাভবান হয়েছিল ভারত।
দ্বিতীয় লাভবান রাষ্ট্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক ও গণচীনের বন্ধুরাষ্ট্র হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নও পাকিস্তানের ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি চেয়েছে, কিন্তু প্রথমেই বাংলাদেশের পক্ষ নেয়নি। ভারতকে একটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ করার কৌশল হিসেবে দেশটি বরং ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেছিল। ১৯৬৯ সালে সংঘটিত চীন-সোভিয়েত যুদ্ধের পর থেকেই এ জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ভারত সম্মত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত জড়িয়ে পড়ার পর ওই সামরিক চুক্তিকে সমর্থনের পূর্বশর্ত বানিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতেরও তখন পাশ কাটানোর সুযোগ ছিল না। ফলে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৫ বছর মেয়াদী ভারত-সোভিয়েত ‘মৈত্রী চুক্তি’। এই চুক্তি ছিল ভারতের ওপর সোভিয়েত কূটনীতির বিরাট বিজয়। এটা স্বাক্ষর করায় ভারতের এতদিনকার স্বাধীন নীতি ও অবস্থান বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ভারত অনেকাংশে নির্ভরশীল রাষ্ট্রেও পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধই ছিল অন্তরালের প্রধান নির্ধারক। উল্লেখ্য, ‘মৈত্রী চুক্তি’র আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বলেছে, স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ভারতের পক্ষে দাঁড়ালেও ‘শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য তাগিদ দিয়েছে। ‘মৈত্রী চুক্তি’র পর বাংলাদেশের পক্ষে দেশটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল জাতিসংঘে। ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর পর ভেটো প্রয়োগ করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জন করা অনেক সহজ হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য ভূমিকা ছিল বিভিন্ন সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিনের অনুসারী পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত নীতি ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে মার্কিন সরকারেরই গোপন দলিলপত্র। দীর্ঘদিন গোপন রাখার পর ১৯৯৯ সালে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত গোপন দলিলপত্র প্রকাশ করতে শুরু করে। এরকম বিভিন্ন দলিলপত্রের প্রথম সংকলন ‘দি অ্যামেরিকান পেপারস : ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ১৯৬৫-১৯৭৩’ নামের গ্রন্থে মুদ্রিত দলিলপত্রগুলো পড়লে যে কারো মনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত নীতি ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। অনেকে এমনকি সংশয়েও আচ্ছন্ন হতে পারেন। দলিলগুলো একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে যে, স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মার্কিন সরকার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকেছে, সম্ভাব্য পরিণতির ব্যাপারেও প্রস্তুতি নিয়েছে। যেমন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করতে পারেন, সেকথা মার্কিন সরকার আগেই জেনে গিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঠানো গোপন রিপোর্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড জানিয়েছিলেন, সেদিনই তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠককালে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এবং সংবিধান প্রশ্নে মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থায় তাকে হতাশ ও উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরো লিখেছেন, ইয়াহিয়া জানিয়েছিলেন, যদি ৩ মার্চের আগে ভুট্টো-মুজিবের মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান না হয়, তাহলে  তিনি এক বা দুই সপ্তাহের জন্য কিংবা প্রয়োজন দেখা দিলে আরো বেশি সময়ের জন্য ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছেন। অচলাবস্থার অবসান না হলে কি ঘটবে বলে তিনি ভাবছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নৈরাশ্যের সুরে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলার’ শুরু হতে পারে। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাপ্রবাহের সম্ভাব্য গতিধারা এমনকি রক্তক্ষয়ের ব্যাপারেও জানতো। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরদিন, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড লিখেছিলেন, ‘আমাদের ঢাকাস্থ কনস্যুলেট জেনারেলের মূল্যায়নে পাকিস্তানের অব্যাহত ঐক্যের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি এসে গেছে।’ ৪ মার্চের চিঠিতে রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘যতো ক্ষীণভাবেই হোক, (শেখ) মুজিবুর রহমান এখনো পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ৫ মার্চের এক সংক্ষিপ্ত স্মারকে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলা হয়েছিল, বিচ্ছিন্নতা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে, তা যতই সহিংস ও নিষ্ফল হোক না কেন। আমাদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালীদের স্বাধীনতাকে দমন করার উদ্দেশ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সহিংসতা ও রক্তক্ষয় ঠেকানোর জন্য আমাদেরকে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। আমরা শত্রুতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ব্রিটেন ও জাপানসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর ইচ্ছা বিবেচনা করতে চাই। একই ধরনের বক্তব্য এসেছিল পররাষ্ট্র দফতরের একটি কন্টিনজেন্সি স্টাডিতেও। ৫ মার্চের এই রিপোর্টে অন্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। পাকিস্তান যদি বল প্রয়োগের পথে অগ্রসর হয় তাহলে ‘প্রস্তাবিত মার্কিন ব্যবস্থা’ উপশিরোনামে বলা হয়েছিল : ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের থাকা উচিত। ভারত এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে পারে। ভারতের সঙ্গে সমন্বয় রাখার দরকার নেই। যদিও আমরা স্বীকৃতি দেয়ার আগে ভারতকে সেটা জানাতে পারি।’
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও চিন্তাধারায়ও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। যেমন, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন এক রিপোর্টকে মার্কিন সরকার যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশের সমর্থনে বলিষ্ঠ বক্তব্য ছিল। ১৩ এপ্রিলের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল : ‘সংঘাত ও শত্রুতার অবসানের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত রয়েছে।’ রাষ্ট্রদূতের সুপারিশে বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে পারে, মার্কিন সমরাস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ভাগ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ জানাতে পারে এবং আশু রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারে।’ নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই রিপোর্টে ‘কয়েকটি সত্য’ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়- ‘একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে; বিশ্বের এই অঞ্চলে ভারত এখন সুস্পষ্টভাবে প্রধান, প্রকৃত এবং সম্ভাবনাময় শক্তি; সীমাবদ্ধ সম্ভাবনা এবং ব্যাপক সমস্যাসহ বাংলাদেশ সম্ভবত জন্ম নিতে যাচ্ছে।’ মার্কিন সরকারের ‘করণীয়’ হিসেবে রাষ্ট্রদূতের সুপারিশে বলা হয়েছিল, একই কারণে আমাদের উচিত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’, ‘বাইরের শক্তির জড়িত থাকা’ প্রভৃতি ধরনের বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকা; পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতনের অবৈধ নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও অকপট অবস্থান বজায় রাখা এবং সাধারণভাবে পাকিস্তান সরকারকে নীতি পরিবর্তনে প্রভাবিত করা। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে নয়াদিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূতের রিপোর্টে বলা হয়, ‘আমি আশা করি, পশ্চিম পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ না করার স্বাভাবিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার স্বার্থে যথাসময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করা হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র আরো অনেকভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল বলে বিভিন্ন মার্কিন দলিলপত্রে লক্ষ্য করা গেছে। এসবের মধ্যে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও মুক্তির ব্যাপারে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের টেলিগ্রামে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড ‘মুজিবের বিচার ও শাস্তি’ উপশিরোনামে লিখেছিলেন- ‘মে থেকে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই আমি ইয়াহিয়ার কাছে প্রশ্ন তুলেছি এবং এটা কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে একটি, যে ব্যাপারে আমরা পাকিস্তান সরকারের ওপর জনমতের চাপ ব্যবহার করেছি। ফলাফল ঠিক ততোটাই হয়েছে, যতোটা বাস্তবতার আলোকে সম্ভব ছিল। ...(শেখ) মুজিবকে একজন আইনজীবী দেয়া হয়েছে এবং আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আশ্বাস পেয়েছি যে, মুজিবকে হত্যা করা হবে না।’
ভারতের প্রতি গৃহীত তোষণমূলক নীতির দিকটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ প্রসঙ্গে জানা গেছে নয়াদিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূতের কাছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পাঠানো এক টেলিগ্রামে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নির্দেশ দিয়ে ২২ নভেম্বরের এই টেলিগ্রামে বলা হয়, ‘আপনি উল্লেখ করবেন যে, মিসেস গান্ধী শান্তির পক্ষে ইচ্ছা ব্যক্ত করায় এবং ভারত আগে যুদ্ধ শুরু করবে না বলে আশ্বাস দেয়ায় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাছাড়া আপনি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন, এখানে তার সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরিস্থিতিকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমরা নিম্নবর্ণিত সুনির্র্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলাম : ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আমরা পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করেছি এবং রাজনৈতিক সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি পন্থা নিয়ে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি।
একথা সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়নি, কিন্তু একথাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, মার্কিন দলিলপত্র অন্যরকম কিছু তথ্যকে সামনে নিয়ে এসেছে। ওপরে সংক্ষেপে উল্লেখিত চিন্তা, বক্তব্য ও সুপারিশসহ দলিলপত্রগুলো পড়ার পর মনে হতে পারে যেন পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ঠিক তেমন গভীর ও প্রশ্নাতীত ছিল না, যেমনটি এতদিন প্রচারিত হয়ে এসেছে। পাইপলাইন থেকে সমরাস্ত্র প্রত্যাহার, রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য ক্রমাগত চাপ, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার তাগিদ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বরং এমন ধারণাই শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। পাকিস্তানী স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে এ অবস্থানকেই ‘প্রতারণাপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে একে আবার সম্পূর্ণরূপে ভারতের পক্ষাবলম্বন বলারও উপায় নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ সমঝোতা এবং যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছিল, সময়ে সময়ে ভারতকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও একথাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা থেকে সযতেœ ও সুকৌশলে বিরত থেকেছে এবং ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি।
একই যুক্তরাষ্ট্র আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন যোগাড় করেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪-১১ ভোটে পাকিস্তানকে জিতিয়েছে এবং শেষ দিনগুলোতে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে চমক ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের ভাঙন ও পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশল অবলম্বনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সে সময় গণচীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গণচীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মধ্যস্থতা করায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার অভিনয় করেছিল। অভিনয় বলার কারণ, এই সমর্থন সর্বাত্মক ও আন্তরিক হলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে কার্যকরভাবে সাহায্য করতো। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শুধু কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাংলাদেশের বিরোধিতা করার জন্য এটুকুই অবশ্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু নিজের স্বার্থে সুকৌশলে পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল।
ওদিকে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল গণচীনের ভূমিকা। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি চীনের সমর্থন স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুই প্রতিবেশী ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় এবং দেশ দুটি বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোয় চীন দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। সমাজতন্ত্রসহ বিভিন্ন প্রশ্নে চীন-সোভিয়েত শত্রুতার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সে সময় চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মধ্যস্থতা করায় চীনের পক্ষে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন সম্ভব ছিল না। এটাই অবশ্য শেষ কথা নয়। কারণ, পরবর্তীকালে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, ভারত ও বাংলাদেশ বিরোধী কূটনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে গণচীন পাকিস্তানের জন্য ‘বেশি দূর অগ্রসর হতে চায়নি’ এবং উপমহাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত রাখার ব্যাপারে দেশটি বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকার করতেই হবে যে, চীনের ভূমিকা ছিল নিন্দনীয়Ñ যা সহজেই প্রশংসনীয় হতে পারতো এবং পাকিস্তানীদের গণহত্যাকে প্রতিহত করতে পারতো।  
এভাবে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির দুটির নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল ভারত, অন্যদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি বরণ করেছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রকাশ্য কূটনৈতিক সমর্থন বেশি পেলেও পাকিস্তান তার ভাঙন ও পরাজয় এড়াতে পারেনি। সবকিছুর পেছনে নির্ধারকের ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশের জনগণ। স্বাধীনতার জন্য তাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাছে পাকিস্তান ও তার সমর্থকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণই আসলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটিয়েছিল।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মহান স্বাধীনতা দিবসের আহ্বান


মহান স্বাধীনতা দিবসের এই শুভলগ্নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রিয় এই জনপদের সব মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। এই জনপদের সংগ্রামী মানুষ স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে। জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির যুদ্ধ বিজয় লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর। জাতি প্রতিবছর গভীর শ্রদ্ধার সাথে ২৬ মার্চ পালন করে মহান স্বাধীনতা দিবস। আমাদের স্বাধীনতার ৪৪ বছর পূর্ণ হবে এই মার্চে। জাতীয় ইতিহাসের পাতায় বিগত ৪৪ বছরে যুক্ত হয়েছে আনন্দ-বেদনার নানা ঘটনা। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার উল্লাস প্রকাশের পাশা-পাশি আমাদের পালন করতে হবে আত্মসমালোচনার দায়িত্বও। কারণ আত্মসমালোচনা ছাড়া কোনো জাতি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।
ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই একথা জানেন যে, এই জনপদের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা দীর্ঘদিনের একটি লালিত বিষয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার দীর্ঘ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব সলিমউল্লাহ, শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আরো অনেক মহান নেতাকে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ জিয়াউর রহমান। জাতির স্থপতি হিসেবে আজ স্বীকৃতি পেয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা জানি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতেও কঠিন বিষয় হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এক্ষেত্রে ফসল না হলে স্বাধীন রাষ্ট্র ও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে। এই বিষয়টি জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান বেশ ভাল ভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা জানতেন যে, স্বল্প সম্পদ নিয়েও ঐক্য ও সংহতির বদৌলতে জাতিকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া যায়। এমন চেতনাকে সমুন্নত রাখাই ছিল দেশের রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব।
স্বাধীনতার ৪৪ বছরে আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গিয়ে গেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তথা সহিষ্ণুতার অভাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। এই ব্যর্থতার কারণে আমরা কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, জীবনমান, সুশাসন ও নিরাপত্তালাভে সমর্থ হইনি। আরো লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পরমত সহিষ্ণুতার অভাবে বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট আজ দেশে-বিদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে আজ দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, পত্র-পত্রিকার বিশ্লেষণ এবং রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের নানা উপদেশে জর্জরিত হতে হচ্ছে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের। এমন চিত্র কোনো স্বাধীন দেশের জন্য সম্মানজনক নয়। দেশের মানুষ তো চায় সরকার ও রাজনীতিবিদদের কর্মকান্ডে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত হবে। দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার ও চায়, চায় নিরাপত্তা এবং জীবনমানের উন্নয়ন। কিন্তু জনগণের এমন আকাক্সক্ষা পূরণে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের কর্মকান্ড কতটা যৌক্তিক পথে পরিচালিত হচ্ছে? স্বাধীনতার ৪৪ বছর পূর্তির এই সময়ে তাই আত্মসমালোচনার দায়িত্ব পালনও আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজ দমন-পীড়ন, গুম, হরতাল-অবরোধ এবং হিংসা ও হানাহানির যে পরিবেশ লক্ষ্য যাচ্ছে, নির্বাচনে যেভাবে সন্ত্রাস ও ভোট জালিয়াতি হয়, ব্যাংক-বীমা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যেভাবে লুটপাট চলছে? সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে যেভাবে জাতীয় স্বাতন্ত্রবিপর্যস্ত হচ্ছে, ভোগ-বিলাস ও নৈতিক অবক্ষয়ের বাতাবরণে আমাদের মেরুদন্ড যেভাবে জীর্ণ হচ্ছে, তাতে স্বাধীনতার লক্ষ্যগুলো সন নাগরিকের আবার পুনঃপাঠ প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সচেতন না হলে আমাদের স্বাধীনতার আনন্দ-অনুষ্টান অর্থবহ হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। আত্মসমালোচনা, আত্মোপলব্ধি ও কর্তব্য নির্ধারণের দায়িত্ব পারন আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে সময়ের দাবি পূরণে আমরা এগিয়ে আসতে পারি কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সোমবার, ২৩ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মানুষ গুম করে কারা?


সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে নিখোঁজ হয়েছে বহু মানুষ। গত ৫ বছরে নিখোঁজের সংখ্যা শতাধিক। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ২ মাসে সারা দেশে ২১ জন মানুষ গুম হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৪ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে নিখোঁজ হয়েছেন ৭ জন। এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গত ২ মাসে বিরোধী জোটের ৩৬ জন নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। কয়েকজনকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। বাকি ১৮ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। এর আগে ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় বিরোধী জোটের ৬৫ জন নেতকর্মী গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। সবগুলো গুমের ঘটনার ধরন ছিল একই রকম। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে মানুষ নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। নিখোঁজ হওয়াদের উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।
মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নির্বাহী পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান মানবজমিনকে বলেন, প্রতিমাসেই মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে, আমরা এর তালিকা প্রকাশ করছি, কিন্তু এ ধরনের জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক ও অগ্রহণযোগ্য ব্যাপার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি মানুষগুলোকে তুলে না নিয়ে থাকে, তাহলে কারা তাদের নিয়ে গেছে? তা খুঁজে বের করার দায়িত্বও তো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বর্তায়। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে। আমরা এসব ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এসব মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পর সরকারের উচ্চমহল থেকে যে ধরনের কথাবার্তা বলা হচ্ছে, এতে ঘটনার নায়করা আরও উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে এ ধরনের ঘটনা না কমে ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গত ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে। তার পরিবারের দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই নিয়ে গেছে তাকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাও তাই। এখন পর্যন্ত হদিস মেলেনি তার। জনমনে প্রশ্ন, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো যায় কোথায়?
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও বলেছে, গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর প্রায় সব গুমের ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। আমরা জানি, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের উপরই বর্তায়। গুম হওয়া কোনো মানুষকে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে না নিয়ে থাকে, তাহলে কারা তুলে নিয়েছে তা খুঁজে বের করার দায়িত্বও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরই বর্তায়। সে দায়িত্ব পালিত না হলে মানুষ তো সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিযুক্ত করবে। বর্তমান সরকার বিগত বছরগুলোতে অনেক আশাব্যঞ্জক কথা বলেছেন। তারা দিন বদলের কথা বলেছেন। সুশাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দিন বদল হয়নি। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ও বন্ধ হয়নি। বরং দিন দিন এর মাত্রা বেড়েই চলেছে। ফলে আজ জনমনে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হলো, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো যায় কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিতে হবে। কারণ এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়। দেশে যদি মানুষ গুম হওয়া বন্ধ হয় এবং মানুষের লাশ রাস্তায় পড়ে না থাকে, তাহলে জনমনে আস্থার ভাব ফিরে আসতে পারে। তবে সামনের দিনগুলোতে সরকার তেমন দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় কি-না, সেটাই জনগণ আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করবে।

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আন্দোলন ও নির্বাচন


বাংলাদেশ অভূতপূর্ব আন্দোলন-সংগ্রামের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলছে। এমতাবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের মতো অরাজনৈতিক নির্বাচনের তোড়জোড় চালানো হচ্ছে। পুরো আন্দোলনই যখন রাজনৈতিক দাবিতে ঠাঁসা এবং সংগ্রামও চলছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাঠে, তখন সংলাপ নয়, সমঝোতা নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা নয়; নাযিল হলো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। বিরোধী দল বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা দাবি করেছে বা পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা কানেও তোলা হলো না। অন্য রকম আরেক ইস্যুকে সামনে আনা হলো, যার নাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। কে করবে এই নির্বাচন? বিরোধী দল তো তাদের দাবির ব্যাপারে কোনো কথা বা প্রত্যাশাই শুনতে পায় নি। তাদের কথা শোনে বা দাবি মেনে তাদেরকে নির্বাচনে আনার পরিবেশও তো সৃষ্টি করা হয় নি। তাহলে একদলীয় বিগত নির্বাচনের পরিণতিই কি অপেক্ষা করছে এহেন নির্বাচনের ভাগ্যে? এমনই শত প্রশ্নের মধ্যে চলছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এবং সুদীর্ঘতম বিরোধী আন্দোলন আর নির্বাচনের ভেল্কিবাজি।
স্মরণ করলে দেখা যায়, ২০ দলীয় জোটের ডাকে গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচি পালন করতে না দেয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার একদিন আগে থেকেই সারা দেশেই সড়ক ও নৌপথে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সভা সমাবেশ বন্ধ করে। বেগম জিয়াকে তার ২ দিন আগে থেকেই তার গুলশানস্থ অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখে। আজ অবরোধের ৭৭তম দিন। সরকার এই গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে হত্যা গুম হামলা মামলা আর গণগ্রেফতার করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চালায়। প্রতিদিনই সারা দেশে শ’শ’ নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করছে। হাজার হাজার নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। এতে করে নেতাকর্মীরা দৃশ্যত রাজপথে নেমে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। তারপরেও জনগণ এই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্বঃতস্ফূর্তভাবে অবরোধ পালন করছে। সরকার মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে বাস লঞ্চ চালানোর চেষ্টা করেও কোনো ফল পায়নি। পরিবহন মালিকরা চালাতে বাধ্য হলেও কোনো লাভ নেই। কেননা মূলত তারা যাত্রী সংকটের কারণেই বাস চালাতে পারছে না। খালি বাস চালাতে গিয়ে অনেক সময় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তারপরেও তারা অনেক সময় ঢাকা থেকে খালি বাস চালাচ্ছেন। টানা অবরোধের মধ্যেও রাজধানী ঢাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও এখানে বসবাসরত নাগরিকদের মধ্যে আতংক এখনও কাটেনি। দৃশ্যত অবরোধের কার্যক্রম না থাকলেও মানুষের মধ্যে আতংক কাটছে না। আর এ কারণেই এখানের মানুষ অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছে না। এতো দীর্ঘ সরকার পতনের আন্দোলন আগে কখনও এ দেশে হয়নি। এতো দিন ধরে আন্দোলন চলাও এক সাফল্য। ফলে আন্দোলন হচ্ছে না বলে সরকার মহলের ফাঁকা আওয়াজ অর্থহীন। আন্দোলন না হলে ‘হচ্ছে না’ বলা হচ্ছে কেন? জোরপূর্বক গাড়ি চালানো ও বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে কেন? অতএব কি হচ্ছে আর কি হচ্ছে না, সেটা দেশ ও বিদেশের সকলেই সচক্ষে দেখছেন।
সন্দেহ নেই, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মহাদুর্যোগের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ক্ষমতালিপ্সার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংঘাত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে রাজনৈতিক সংকট ও রক্তপাত। জাতির মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ আর বিভক্তি স্পষ্ট। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে আধুনিক যুগে একটি দেশের জন্য সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই সংসদীয় গণতন্ত্র আজ দিকভ্রান্ত। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিবর্জিত হয় তখন সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। সুতরাং বলা যায় সংসদীয় গণতন্ত্র ভয়াবহ এক দুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যে দুর্যোগের হাত ধরে আর্থ-সামাজিক নানা অঙ্গনেও আসছে বহুবিধ সমস্যা। বিগত কয়েক মাসের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশের চলমান অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা এখন বহুমুখী সংকটে রূপ পরিগ্রহ করেছে। এক সংকট থেকে আরেক সংকটে পড়েছি আমরা। রাজনৈতিক সংকট দিয়ে শুরু হলেও এ সংকট এখন সর্বগ্রাসী হয়েছে। এই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে মূলত দায়ী কারা, সেটা সবাই জানেন। ক্ষমতালিপ্সা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতার কারণে সঙ্কটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক হানাহানি যেন থামবেই না। রাজনীতির কারণে অর্থনীতিতে ধস নেমে এসেছে, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। চলমান বিভেদ ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। এর সর্বগ্রাসী প্রভাব সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লুটার চেষ্টা চালাচ্ছে। মনে রাখা ভালো, ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অসহনশীল জাতি। এই জাতির ইতিহাসে নিজেরা বেশিরভাগ সময়ই শাসিত হয়েছে। যদিও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমরা মুক্ত তারপরও শোষণ বঞ্চনার সেই হীনম্মন্যতা এখনো আমাদের মননে বিরাজ করছে। ভিন্ন মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রবণতা অর্জন করার যে মানসিকতা তা এখনো সৃষ্টি হয়নি। আর ক্ষমতার সব কাঠামোতে কিছু রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভিন্নমত সহজে সংঘাতের দিকে চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক সময়ে এসেও  ভিন্নমতের প্রতি যদি আমরা শ্রদ্ধাশীল না হই, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে লালন না করি, তাহলে দুঃসহ পরিণতি অপেক্ষমাণ। এরই মাঝে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, চলমান অস্থিতিশীলতার পরিণতি ভয়াবহ হচ্ছে। সবাই জিরো টলারেন্সে। একইসঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত নিরসনের কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। ভায়োলেন্স আরও বেশি ভায়োলেন্স জন্ম দেয়। এরপর সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য। সহিংসতা, নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক মন্দা একটি দেশকে ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। এই সংকটের মাধ্যমে আবার গণতন্ত্র বিপদে নিপতিত হয়। স্বৈরশাসন জেঁকে বসে। স্থায়ী সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নষ্ট হলে দেশে অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলবে। তাই চলমান অস্থিতিশীলতা বন্ধে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহাল রাখার বিকল্প যেমন নেই; তেমনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সঙ্কট মোচনেরও কোনো বিকল্প নেই। সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসে উপর্যুক্ত করণীয় ঠিক করতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলগুলোকে সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে। জনমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতি সরকারকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়নসহ হত্যা-গুম-খুন বন্ধ করে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এই মুহূর্তে প্রধান ও মৌলিক কর্তব্য।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার মাস মার্চে আমরা স্মরণ করতে পারি, বাংলাদেশ যে উদ্দেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছিল সে আশা-আকাক্সক্ষা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। যেখানে স্বৈরশাসন থাকবে না, থাকবে না নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনা কিংবা হানাহানি। আজ ৪৪ বছরে যদি আমরা হিসাব-নিকাশে বসি তাহলে দেখতে পাব অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে। ঐক্যের যে লৌহকঠিন শক্তি জাতি অর্জন করেছিল, সেটাও ¤্রয়িমাণ। তবুও আশাবাদী মানুষ আশা করেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে। সেই দিনটি আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরেই বাস্তবের মাটিতে নেমে আসবে। কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুর মাধ্যমে সঠিক অর্জন সম্ভব হবে কি? এই যেমন আন্দোলনের তোপের মুখে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন দেওয়ার পর পরেই নানা পক্ষ থেকে বিরূপ ও বিশাল প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে। সুজন বলেছে, বর্তমানে সারা দেশে পেট্রোল বোমা হামলা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নানা ধরনের সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী মামলার কারণে কারারুদ্ধ বা পলাতক রয়েছেন। তাই অনেকেই মনে করেন আরো কিছু দিন অপেক্ষা করলে চলমান অস্থিরতা অনেকটা প্রশমিত হতো। অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ বিরাজ করত। কিন্তু কমিশন সেটা না করে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে যারা কারাগারে রয়েছেন, তাদের জামিনে মুক্তি দিয়ে এবং যারা পলাতক রয়েছেন তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থেকে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করবে বলেও সুজন আশা প্রকাশ করে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেছেন, “আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ‘ললিপপ’ খাওয়ানোর মতো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করলেও জনগণের ভোটে সরকারি দলের প্রার্থীর জেতার কোন সম্ভাবনা নেই্ ।’ তিনি আরো বলেন,‘ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করলে সরকার নির্বাচন স্থগিত করার পথ খুঁজবে।’ শনিবার বিকেলে অবস্থান কর্মসূচির ৫৩তম দিনে মতিঝিলের দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গনের বঙ্গবীরকেও এখন আন্দোলন করতে হচ্ছে। বঙ্গবীর বলেন, “গণতন্ত্রের মা-খালা-ফুপুরা গত ২৫ বছরে কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দিয়ে ছাত্ররাজনীতি টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের হাতে তুলে দিয়ে জাতীয় নেতা সৃষ্টি হওয়ার পথকে রুদ্ধ করেছে। সেজন্যেই আগে নেতার ইচ্ছায় গু-ারা চলতে বাধ্য হতো আর এখন গুন্ডাদের ইশারায় নেতারা চলে।” অতএব আন্দোলনের বিষয়ে কোনো সাড়া না দিয়ে, আন্দোলনকারী নেতাদের জেলে রেখে এবং কর্মীদের অকাতরে হত্যা-নির্যাতন করে যে বিভীষিকাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রশাসনসহ সর্বত্র দলীয় আধিপত্য বিস্তার করে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করা হয়েছে, তেমন বিরূপতার মধ্যে  বিরোধী দল নির্বাচন সম্পর্কে গভীরভাবে না ভেবে পা বাড়াতে পারে কি? যাকে মানা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে অবৈধ, তার অধীনে নির্বাচন কবে বৈধতা দেবে? এসব প্রশ্নও ভাবতে হবে। সরকার যদি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতেও আলোচনার আহ্বান করতেন, তবে কিছু কথা বলা যেতো, কিছু দাবি আদায় করা সম্ভব হতো। সব কিছুই যদি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় হয় তখন নির্বাচনের ফলাফলও যে চাপিয়ে দেওয়া হবে না, তার গ্যারান্টি কি? অতএব নির্বাচন বা যে কোনো বিষয়েই বিরোধীদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে হবে সর্বাগ্রে। আর সেটা সরকারকেই করতে হবে। মনে হচ্ছে আন্দোলনের তোড়ে সরকার কিঞ্চিৎ দিশেহারা। নইলে হঠাৎ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সামনে এনে হাজির করানো হলো কেন? আন্দোলনের পটভূমিতে অবশ্যই নির্বাচন হবে। কিন্তু সেটা জনইচ্ছায় ও জনঅংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ হতে হবে। তেমন পরিস্থিতি কি আসলেই হয়েছে?

শনিবার, ২১ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কুইট সাহারা সেভ ক্রিকেট


ক্রিকেট নিয়ে গত বছর জাতীয় নিশান পত্রিকায় ‘ক্রিকেটে ষড়যন্ত্রের জাল’ শিরোনামে লিড নিউজ করেছি আমি। সেদিন যত ক্ষুব্ধ ছিলাম আজ তা এমন রূপ ধারণ করেছে অঙ্গিকার করেছি ক্রিকেট দেখবো না এমনকি শুভ কামনাও থাকবে না। ক্রিকেটে হেরেছি এর নেপথ্যে একটি বিস্ময়কর কারণ আমি শেষে বলছি। ছোটকালে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি। মনে আছে, টুর্নামেন্টের ফাইনাল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও হয়েছে। পুলিশ এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ আলোড়ন তোলা খবর হচ্ছে মরহুম গোলাম সরোয়ার স্মৃতি ফুলবল টুর্নামেন্ট। কি এক পাগল করা উন্মাদনা। জাতীয় আদলে টিমগুলোর আলাদা পতাকা, ঢাকা থেকে খেলোয়াড় নিয়ে আসা, দুপুরের পর থেকেই বাসের ছাদে করে দূর থেকে দর্শকদের ঢল নামা আরো কত কি। আমাদের জয়াগ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হাজারো দর্শকের গগনবিদারী উচ্ছ্বাসের সেই খেলাটি মনে ঝড় তোলে এখনো। এখনো মাঝে মাঝে খেলা দেখি। গত বছর রাতের বেলায় নিজ এলাকায় ক্রিকেট ফাইনাল খেলায় দাওয়াত পেয়ে সেখানে গিয়েছি। কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জে একটি খেলায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছি। তবে টিভি স্ক্রিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা দেখার বিরোধী আমি। স্কুল ফেলে ছাত্র, শিশু ফেলে তার মা, কাজ ফেলে শ্রমিক ক্রিকেটে ডুব মেরে ক্ষতি করে নিজের এবং দেশের। প্রস্তাব রাখি, শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ওয়ানডে ম্যাচ ব্যতীত সব খেলা সম্প্রচার বন্ধ রাখা হোক টিভিতে। এরই মাঝে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ সম্পন্ন হয়ে গেলো। এদেশের তরুণরা ভিন্ন এক উৎসব করেছে। ক্ষোভের উৎসব।
পরাজিতের জন্য উৎসব। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সেটাই দেখা গেল। মাঠে খেলা দেখা ভারতের দর্শকরা উৎসব করেছেন নিজ দেশ বিজয়ী হওয়ায়। আর বাংলাদেশের দর্শকরা উৎসব করেছেন ভারত জয়ী হওয়ায়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের তরুণরা ভারতের বিজয়ে রাতেই ক্ষোভের মিছিল বের করে। ক্ষোভে বন্ধুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুদেশ ভারতের প্রতি এদেশের মানুষের যে এত ক্ষোভ, ঘৃণা বিশ্বকাপে ভারত জয়ী হওয়ার পর আনন্দ উৎসবেই প্রমাণ হয়। প্রান্তিক গ্রামেও মানুষকে ক্ষোভের আনন্দ করতে দেখা গেছে। খেলায় একের পর এক বিতর্কিত অ্যাম্পায়রিংয়ে গোল্ড, ডেভিস আর আলিমদারকে নিয়ে চলছে বিষোদগার। প্রামাণ্য ও ব্যঙ্গ চিত্র, হ্যাসট্যাগ দিয়ে অনলাইনে প্রতিবাদের মিছিলে শামিল হচ্ছেন নেটিজেনরা। খোলা হয়েছে একাধিক ফেসবুক ও টুইট পেজ। এর পাশাপাশি দারুণ সব ব্যঙ্গ চিত্র আর তীর্যক মন্তব্য নিয়ে ‘ক্রিকেট রঙ্গ’ প্রকাশ করেছে বাংলাভাষীদের কমিউনিটি ব্লগ ‘বেশ তো’। এই পোর্টালটির ‘আম্পায়ার না ভ্যাম্পায়ার’ এখন ঘুরেছে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। একইসঙ্গে ইমোটিন সহযোগে তীর্যক মন্তব্য ‘বাংলাদেশের জন্য Target 303 (তিন সতীন...!!!)। তিন সতীন কে কে দেখে নিন- ১. ইন্ডিয়া, ২. আম্পায়ার, ৩. আইসিসি, তীর্যক মন্তব্যটিও বেশ সাড়া ফেলেছে। সব ছাপিয়ে আইসিসির পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘ইন্ডিয়া ছিঃ ছিঃ’ এখন হটকেক ডায়ালগে পরিণত হয়েছে বিভিন্ন সমাজিক মাধ্যমে। আর সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তো রীতিমতো সয়লাব হয়েছে আইসিসি, অ্যাম্পায়র ইস্যুতে। সেখানে ফাঁস হয়ে গেছে ভারতকে জেতাতে আইসিসির ছক! অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ২৩ তারিখের খেলা পরিবর্তন করে ১৯ তারিখ নিয়ে আসা ও সঙ্গে ভেন্যু পরিবর্তন, ইংল্যান্ড এবং পাকিস্তানের আম্পায়ার দিয়ে দেয়া, মিডিয়া দিয়ে চাপ সামলানো ইত্যাদি প্রসঙ্গ। কেউ আবার খেলাজুড়ে শর্মার লাইফ পাওয়া এবং মাহমুদুল্লাহর ক্যাচটির রি-প্লে ভালোভাবে না দেখানো এবং এ বিষয়ে ধারাভাষ্যকারদের নীরবতা এবং সর্বোপরি খেলা চলাকালে স্কোর বোর্ডে “জিতেগারে জিতেগা ইন্ডিয়া জিতেগা” বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রতিবাদ জানাতে এখানে ‘ক্রিকেট বাঁচাও, ভারতের নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’ ও ‘আজ বাংলাদেশকে হারানো হয়নি হারানো হয়েছে ক্রিকেটকে’-এর মতো নানা পেজ খোলা হয়েছে। নানামুখী স্ট্যাটাসের পাশাপাশি সয়লাব হয়েছে কোলাজ কার্টুনে। এর মধ্যে মেসি’র ছবি দিয়ে ‘ভাগ্যিস ইন্ডিয়া ফুটবল খেলে না, চিটিং কইরাই ট্রফি নিয়া লইতো’, ‘আইসিসি মানে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল’ ইত্যাদি নানা মন্তব্যে সয়লাব ফেসবুক পেজ। স্ট্যাটাসে #IndiaBoughtICC #SaveCricketFromICCGes #ShameIndia ইত্যাদি হ্যাস ট্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। 
এমনই একটি পেজ থেকে ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে নির্লজ্জ একপাক্ষিক আম্পায়ারিংয়ের মাধ্যমে হারতে বাধ্য করার প্রতিবাদে ২০ মার্চ, শুক্রবার টিএসসিতে বিকাল ৩টা সাধারণ নাগরিকদের ‘মানববন্ধন’র ডাক দেয়া হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট ফ্যান ইউনিটি (বিসিএফই) নামে একটি গ্রুপও তাদের ফেসবুক ইভেন্ট পেজে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদে আম্পায়ারদের কুশপুত্তলিকা দাহ করার ঘোষণা দিয়েছে। মাইক্রো ব্লগ টুইটারে @ICCShame#, @ICC=Indian Cricket Council!# ইত্যাদি টুইটে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। এক পাকিস্তানের সোয়েব আক্তার টুইটবার্তায় লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের আলিমদার ভারতকে ‘মওকা’ দিলেন।”
গুগল প্লাসে @#rip_icc‬ #shamefulcricket #iccwc2015 ইত্যাদি হ্যাস ট্যাগের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। এখানে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ক্রিকেট এখন কমার্শিয়াল গেম। আর সেখানে টাকা সবচেয়ে বেশি লগ্নি করে ভারত। সুতরাং ভারতকে জেতানোর জন্য আইসিসির এই ছক আম্পায়ারদের কল্যাণে নগ্নতা পেয়েছে’। এছাড়াও তালহা বিন নজরুল লিখেছেন, ‘বাণিজ্যের কাছে হেরে গেল বাংলাদেশ’। আমিও কথাটি আগেই বলেছি। ক্রিকেট এখন আর নিছক কোন খেলা নয়। ক্রিকেটও আজ পণ্য। অর্থ আয়ের মেশিন। মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে ক্রিকেটের সব আজ বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। সোয়াশ’ কোটি লোকের দেশ ভারত বিশ্বের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের উত্তম বাজার। আর এ সুযোগটা তারা নিচ্ছে ভালোভাবেই। ক্রিকেটকে এখন তিন মোড়লের সংগঠনে দাঁড় করানো হয়েছে। আইসিসির বর্তমান সভাপতি বাংলাদেশের আ হ ম মুস্তফা কামাল হলেও ক্ষমতাধর চেয়ারম্যান ভারতের শিল্পপতি এন শ্রী নিবাসন। দেশে তিনি ম্যাচ গড়াপেটার আসামী। আইপিএল-এ ইন্ডিয়ান সিমেন্টের এই কর্ণধারের দল চেন্নাই সুপার কিংস। আর এই দলের অধিনায়কও মহেন্দ্র সিং ধোনি। শ্রী নিবাসনের জামাতা মিয়াপ্পান এই দলের সার্বিক ব্যবস্থাপনায়। বিশ্বজুড়ে বিশ্বকাপের সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে যে স্টার স্পোর্টসে তারাই ভারতীয় দলের পৃষ্ঠপোষক। ধারা বিবরণীতেও ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটারদের আধিপত্য। ভারত যদি বিদায় হয়ে যায় তবে কি ক্ষতি হয় তা আইসিসি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ২০০৭-এ। ৫০ শতাংশের কম আয় হয় তাদের। সেবার বাংলাদেশের কাছেই হেরে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয় ২০০৩-এর রানার্স আপ ভারত। ২০১১ এর চ্যাম্পিয়ন বিদায় নিলে ক্ষতির পরিমাণটা সব অনুমান ছাড়িয়ে যেত। অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসাতেও নামতো ধস। সেখানে দর্শকই নেমে আসবে অর্ধেকে যদি ভারত না থাকে। এ বাস্তবতা উপেক্ষার কি উপায়? কর্তাদের মর্জির বলি আম্পায়াররা হতেই পারে। আমাদের ক্রিকেট দল। পরম মমতায় ডাকি টাইগার দল। ডাকি লাল সবুজের দল।
ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। ৯০ সালের শেষের দিকে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে প্রতিপক্ষ বিজয়ী হওয়ায় ভারতীয় দর্শকরা মাঠে জুতা-পানির বোতল ছুড়ে সেই ভদ্রতা ভেঙেছে। এবার ক্রিকেটে অন্য দেশের পতাকা নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। তবে টি-২০ ফাইনালে দেখা গেছে ভারতের সমর্থকরা শত শত ভারতীয় পতাকা নিয়ে মিরপুর মাঠে উপস্থিত। এফডিসির পরিচালক পিযূষ বন্দ্যোপধ্যায়ের স্ত্রী আমাদের জাতীয় পতাকা কুকুরে মুড়িয়ে এনেছে আর ভারতীয় পতাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছে। সরকার না দেখার ভান করে আছে। যারা ভারতীয় পতাকা হাতে খেলা দেখেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। শুধু কি পাকিস্তান দলের সমর্থকদের ঠেকানোর জন্যই খেলার মাঠে বিদেশী পতাকা বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে? নয়তো কিসের এই আইন। স্টেডিয়ামে দেখা যায়, ভারতের খেলোয়াড়দের নিরুৎসাহী করতে বাংলাদেশী তরুণরা ‘ভুয়া ভুয়া’ ধ্বনি দিয়েছে। দেখা যায়, ভারত পরাজিত হচ্ছে বুঝতে পেরে বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে উদ্দীপনা বেড়ে যায়। লংকানদের উৎসাহ দিতেও দেখা গেল তরুণ দর্শকদের। মহেন্দ্র সিং ধোনিদের পরাজয়ে যেন ভারতবিদ্বেষী বাংলাদেশের তরুণদের দারুণ উজ্জীবিত করে। দুঃখ হয় বিসিবিকে নিয়ে। বাংলাদেশে কি স্পন্সর করার মতো কোন কোম্পানি নেই। তবে কেন ক্রিকেটে সাহারা? শ্রমিকের টাকা আত্মসাৎ করার দায়ে যে সাহারা অভিযুক্ত। যে সাহারার মালিক সুব্রত জেলে আছেন, মানুষ মুখে কালি মেরে চরম শিক্ষা দিয়েছে, সেই সাহারা কোম্পানি আমাদের অহংকার জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সিতে থাকবে তা লজ্জার-অপমানের। জাতীয় ক্রিকেট দল বিশ্ব কাঁপাবে যখন তখন তার গায়ে থাকবে ভিনদেশী সাহারা। আমাদের তারুণ্য যখন ক্রিকেট নিয়ে গর্বে লাল সবুজের জার্সিতে রাস্তায় নেমে আসবে তখন তার গায়ে লেখা থাকবে ভারতীয় কলংক সাহারা! শুধু তাই নয়, গভীর দৃষ্টিতে তাকালেও সাহারা ক্রিকেটের জন্য অশুভ শক্তি। আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করার নীল নকশা এঁটেছে ভারত। আমাদের কোন টিভি চ্যানেল তাদের দেশে চলে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, এই ক্ষোভের কারণ বাংলাদেশের প্রতি ভারতের স্বার্থকেন্দ্রিক আচরণ। ভারত দীর্ঘ ৪৩ বছরেও বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা দেয়নি। ৫৪ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখে বাঁধ, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ কমিশন, গজলডোবা বাঁধ, ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার পথে। ভারত ট্রানজিট ও বিদ্যুৎ ট্রানজিট নিচ্ছে। পরিবেশের কথা বিবেচনা করে কলকাতার পাশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করে বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ভারতের কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকার পরও তিস্তা পানি চুক্তি, সীমান্তে হত্যাকা- বন্ধ, ছিটমহল বিনিময়সহ বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুই হয়নি। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে বেরুবাড়ী ভারতের হাতে তুলে দেয়া হলেও দীর্ঘদিনেও তিন বিঘা বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি। বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের পক্ষে দেশটির অবস্থান নেয়া তরুণরা মেনে নেয়নি। কিশোরী ফেলানীর লাশ আজও বাংলাদেশীদের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। এই যখন লিখছি তখন গণমাধ্যমে খবর এলো, আজ (৮ এপ্রিল ২০১৪) তিন বাংলাদেশী নাগরিককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে ভারতীয় নাগরিকরা। এ মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই শহরের গৌরনগর মজুমদারবাড়ী এলাকায়। নিহত তিন বাংলাদেশী সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, এক. তারা গরুর ব্যবসা করতেন। সম্ভবত গরু কিনতে তারা সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলেন। দুই. তারা সেখানে কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন। বলা হয়েছে, তারা রোববার ভোরে ওই এলাকায় যান। স্থানীয় লোকেরা তাদের গরুচোর বলে সন্দেহ করে ধাওয়া করে। তারা একটি গাছে আশ্রয় নেন। ভারতীয় নাগরিকরা গাছে উঠে তাদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে। তাদের সঙ্গে যাওয়া আরও দু’জন দেশে ফিরে এ ঘটনা তাদের পরিবারকে জানান। নিহত তিনজনের লাশ ভারতীয় পুলিশের হেফাজতে আছে। সেই ভারতের বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সাহারার কাছে ক্রিকেটকে বন্দী করা হলো। ক্রিকেট ভারতীয় বাজিকরদের কাহিনী আমাদের জানা। আশরাফুলকে নিয়ে কি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেল। বাজিকরসমৃদ্ধ ভারতীয় সাহারা আমাদের ক্রিকেটে কোন কালো ছায়া মেখে দেয় তা কি কেউ ভেবেছে। গভীর এক পরিকল্পনা থেকেই এই কাজটি করা হয়েছে। জাতীয় সংগীত গাইতে যদি ১০০ কোটি টাকা বিত্তবানদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। ক্রিকেটের জন্যও যাবে। সাথে আছে ক্রিকেটপ্রেমী বিশাল তরুণ বাহিনী। আমরা পারবো। তার আগে তরুণ-যুবক সর্বস্তরের জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাস্তায় নামতে হবে। প্রয়োজনে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আদলে ‘কুইট সাহারা’ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আসুন বাধ্য করি সাহারাকে বিতাড়িত করতে। আসুন তাদের প্রতিরোধ করে প্রাণের ক্রিকেট মুক্ত করি।
আনোয়ার বারী পিন্টু 

শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সমঝোতার সেই শেষ চেষ্টা


বিশ্বের অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও রাতারাতি স্বাধীনতা অর্জন করেনি। এর পেছনে রয়েছে শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস। সুদূর অতীতের সে ইতিহাস নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের আশু কারণ সম্পর্কে জানানো দরকার। এই কারণ তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর। ওই নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জিতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে ‘পশ্চিম পাকিস্তানে’ জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপ্লস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছিল ৮৮টি আসন। এই ভুট্টো ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নির্বাচনের পর দুই প্রদেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার উদ্ভট দাবির পাশাপাশি ঢাকায় আসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সঙ্কটের সৃষ্টি করেছিলেন ভুট্টো। তার এ সিদ্ধান্ত ও অস্বীকৃতিকে অজুহাত বানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন ১ মার্চ। প্রতিবাদে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ প্রচন্ড বিক্ষোভ শুরু হয়, দাবি ওঠে স্বাধীনতার। শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা প্রদেশে হরতালের ডাক দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলেও জানিয়েছিলেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীও উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। জনসভার ঠিক আগের দিন ‘খুনী জেনারেল’ নামে কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ গভর্নর পদে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল। ৬ মার্চই ‘জাতির উদ্দেশে’ প্রচারিত ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। গভর্নর পদে টিক্কা খানের নিযুক্তি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতামুখী আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠেছিল। প্রধান নেতা শেখ মুজিবের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার আকাক্সক্ষা নিয়ে ৭ মার্চের জনসভায় লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিল। শেখ মুজিব তার ভাষণে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন, ভুট্টোর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং সবশেষে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অসাধারণ বক্তা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তার অনেক ভাষণই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। ৭ মার্চের অত্যন্ত জ্বালাময়ী ও আবেগপূর্ণ ভাষণটি স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত ছাত্র-জনতাকে প্রবলভাবেই আন্দোলিত করেছিল। ভাষণটি আজও পর্যন্ত শোনার দিক থেকে শেখ মুজিবের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মাত্র ৯১ বাক্যের ভাষণটির অধিকাংশ ব্যয়িত হয়েছিল ইতিহাসের পর্যালোচনায় এবং ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সমালোচনায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করার সময় শেখ মুজিব অবশ্য যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন- ‘হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হলো’, ‘দোষ দেয়া হলো’ ধরনের পরোক্ষ অভিযোগ জানানোর বাইরে তেমন কিছু বলেননি তিনি। ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান’, ‘আপনি আসুন, আপনি দেখুন’ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব বরং ইয়াহিয়ার প্রতি ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন ১৫ মার্চ, মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক শুরু হয়েছিল ১৬ মার্চ থেকে। এটা সম্ভব হওয়ার কারণ, ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদকে বাতিল ঘোষণা করেননি বরং বলেছিলেন, অধিবেশনে তিনি বসবেন যদি প্রেসিডেন্ট চারটি দাবি মেনে নেনÑ (১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে; (২) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; (৩) সংঘটিত সব হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার করতে হবে এবং (৪) জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
ভাষণের মাঝামাঝি উপস্থাপিত এই চারটি দাবির ভিত্তিতেই পরবর্তী দিনগুলোতে শেখ মুজিব পা বাড়িয়েছিলেন। এখানে একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ইয়াহিয়ার মন্ত্রী ড. জিডব্লিউ চৌধুরী ছিলেন শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান ব্যক্তি। ৭ মার্চ সকালের একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. জিডব্লিউ চৌধুরী লিখেছেন, সঙ্কটের ওই পর্যায়েও শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে নিয়মিত টেলিফোনে কথাবার্তা চলছিল। জনসভায় যাওয়ার প্রাক্কালে দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয় এবং ইয়াহিয়ার নির্দেশে এ সময় ড. চৌধুরী তার সামনে উপস্থিত থাকেন। তিনি লিখেছেন, ‘দু’জনের মনোভাবই তখনও পর্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল, দু’জনই তখন পর্যন্ত সমঝোতায় আসার জন্য আগ্রহী ছিলেন। মুজিব ঢাকায় আসার এবং নিজ চোখে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি দেখার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান। অন্যদিকে মুজিবকে এমন কোনো বক্তব্য দেয়া থেকে ইয়াহিয়া বিরত থাকতে বলেন, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ থাকবে না।’ (জিডব্লিউ চৌধুরী, ‘দ্য লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’, ১৯৭৪, পৃÑ১৫৮) ইয়াহিয়ার এই পরামর্শকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন বলেই শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষণে একপাক্ষিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরিবর্তে চার দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন।
অন্য একটি কম আলোচিত ঘটনাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ড. কামাল হোসেনের বিবরণী থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনার এবং একজন ব্রিগেডিয়ারের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার বার্তা পাওয়ার পর ৬ মার্চ রাতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ছয়জন নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সে বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, আন্দোলনের গতিবেগ ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বক্তব্য দিলেও ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকবেন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার ও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাবেন। বৈঠকের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব ড. কামাল হোসেনকে এমন একটি বিবৃতি তৈরি বলেছিলেন, যাতে আইনগতভাবে নিরাপদ অবস্থান বজায় রাখা যায়। ঠিক হয়েছিল, বিবৃতিটি তাজউদ্দিন আহমদের দায়িত্বে থাকবে। জনসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর প্রয়োজনে কিছু কথা যোগ-বিয়োগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ ৭ মার্চ রাতে সেটা দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছে দেবেন। পৌঁছে দিয়েছিলেনও তাজউদ্দিন। শেখ মুজিবের এই বিবৃতিটি ৮ মার্চের সংবাদপত্রগুলোতে কম গুরুত্বের সঙ্গে ভেতরের পৃষ্ঠায় প্রকশিত হয়েছিল। অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল ভাষণের কথাগুলো- বিশেষ করে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’সহ শেষ বাক্য দুটি। (পূর্ণ বিবৃতির জন্য দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭১)
এভাবে গোপনীয়তার সঙ্গে বিবৃতি প্রকাশ করার পেছনে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে আইনগত দিক থেকে নিজের নিরাপত্তা ও অবস্থান বিপদমুক্ত রাখা এবং অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার পথ খুলে দেয়া। বিবৃতিটির ভাষা ছিল অত্যন্ত মার্জিত ও সংযত। রেসকোর্সের ভাষণের মতো বিবৃতিতেও নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিব কয়েকটি দাবি ও পূর্বশর্ত তুলে ধরেছিলেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বিবৃতির সর্বশেষ অংশটুকু। ‘স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তির সংগ্রাম’ ধরনের কোনো শব্দের উল্লেখ না করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হলো অবিলম্বে সামরিক আইন বিলোপ ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর। এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ ১৬ মার্চ থেকে ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট হাউজে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত কোনো বৈঠকেও শেখ মুজিব তার চার দফা দাবিরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। বিশেষ করে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, এ দুটির কম কোনো কিছুই পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট হবে না। জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং জটিলতা দেখা দেবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিব দু’পক্ষের আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানও সম্মত হয়েছিলেন। ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। সে বৈঠকেও আইনগত শূন্যতা ও জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে যুক্তি উপস্থিত করা হয়েছিল। পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করবেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠক শেষে শেখ মুজিব নতুন এক প্রস্তাবে বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে দুই অঞ্চলের জন্য দুটি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। দু’পক্ষের উপদেষ্টাদের বৈঠকে তথ্যটি জানিয়ে জেনারেল পীরজাদা আরো বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছেন- যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবকে গতকাল প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আসার পর খুবই হর্ষোৎফুল দেখায়।’ শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় নিচের তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে- (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিচের দুটি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলÑ (১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে সেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউজে অপ্রত্যাশিতভাবে ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যস্থতায় শেখ মুজিবের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনার জন্য আগের দিন তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সেদিনের বৈঠকে ইয়াহিয়ার পক্ষে অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা এমএম আহমদ একের পর এক সংশোধনী এনে আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন। উপদেষ্টাদের সান্ধ্য বৈঠকও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছিল।
২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। বিচারপতি কর্নেলিয়াস বলেছিলেন, ‘কনফেডারেশন’-এর পরিবর্তে ‘ইউনিয়ন অব পাকিস্তান’ রাখা যেতে পারে। জেনারেল পীরজাদা এ প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ কোনো এক সময় ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি কবে প্রচার করা হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়ার এবং দু’জনের উপদেষ্টাদের মধ্যকার অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা যেমন টেলিফোন করেননি, তেমনি প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও- যার জন্য এত সময় নষ্ট করা হয়েছিল। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কিনা। আমি তাকে জানিয়েছি যে, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, তারা যখন গিয়েছিলেন শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন- যা দেখে তার ‘লাস্ট সাপার’-এর কথা মনে হয়েছিল। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে শেখ মুজিব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তারা অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে বা অন্য কোথাও যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাত ১০টার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। সেখান থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে। কয়েকটি পর্যায়ে রীতিমতো ‘ইন্টারভিউ’ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেপুরের বৈদ্যনাথ তলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। (দেখুন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খন্ড)
ওপরের বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার ভিত্তিতে বলা যায়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান শেষ পর্যন্তও নিয়মতান্ত্রিক পথে সঙ্কটের সমাধান করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। একপাক্ষিক স্বাধীনতা ঘোষণার দায়দায়িত্ব এড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি আলোচনার পথকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতামুখী প্রবল জনমত এবং ‘পশ্চিম পাকিস্তানী’ সেনা নায়কদের অসহযোগিতা ও শত্রুতার প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব প্রথমে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাতে দুই অঞ্চলের সদস্যদের যৌথ অধিবেশনে সংবিধান পাস করার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ জন্য স্বায়ত্তশাসনের বিধান সংযোজন করা সম্ভব হয়। শেখ মুজিবের এই অবস্থানের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে- (১) এভাবে সমঝোতার পথে স্বাধীনতামুখী আন্দোলনকে প্রশমিত করে তিনি পাকিস্তানভিত্তিক সমাধান অর্জন করতে চেয়েছিলেন; অথবা (২) আলোচনার নামে সঙ্কটকে আরো জটিল করার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। বলা দরকার, পরিস্থিতি ততদিনে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যখন এমনকি শেখ মুজিব নিজেও যদি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতেন তাহলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রতিহত করা সম্ভব হতো না।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ক্ষমতান্ধদের রোষানলে প্রিয় মাতৃভূমি


বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ উর্বর ভূমি, নদ-নদী, সাগর-পাহাড়, বন-বনানীর অপরূপ প্রাকৃতিক শৈল্পিক ছোঁয়ায় অদ্বিতীয়। ১৬ কোটির বেশি মানুষ। এই ভূখ-ের মানুষের পরিশ্রম প্রিয়তা, দুর্যোগ মোকাবিলার হিম্মত, অটুট ঐক্যই সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনন্য পাথেয়। আবহমানকাল থেকেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জনপদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নজিরবিহীন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি তুলনাহীন ভূখ-ের নাম। বাংলাদেশের তুলনা কেবল বাংলাদেশ। অযুত সম্ভবনার পরও বহুরূপী ষড়যন্ত্রের মারপ্যাচে পড়ে স্বদেশ এখন শ্মশানের পথে। সকল সম্ভাবনা তৈলাক্ত বাঁশে রূপায়িত হয়েছে। একপা এগুলো দু’পা পিছায়। সিংহভাগ মানুষের বোধ, বিবেক, বিশ্বাস ও মেজাজকে অদৃশ্য অপশক্তির অপঘাতে অবদমিত করে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষফোঁড়া প্রচলন করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে একটি পক্ষ। ব্যর্থ পুঁতিগন্ধময়  ধর্মনিরপেক্ষতাকে চাকচিক্যতা প্রদান করে সেটিকে ক্ষমতা লাভের সিঁড়ি বা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার বাহন রূপে ব্যবহার করতে চায়! ক্ষমতা দখলের নীতিই যেখানে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। জনগণের জন্য দেশের জন্য রাজনীতি নয়; বরং নিজের ও পরিবারতন্ত্র কায়েমের জন্যই যেন রাজনীতি! সুশীল সমাজ দেশের অস্বস্তিকর পরিবেশের বিরুদ্ধে হক কথা বলতে চান। কিন্তু তারা হক কথার আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন, শেষ পর্যন্ত হক কথা না বলাই থেকে যায়। হক কথা যারা বলতে চান তারা ক্ষমতান্ধদের জন্মের শত্রু। কাউকে জাগতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। যদি কেউ অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সেই অপশক্তি একসময় প্রতিবাদীকে গ্রাস করতে চায়। সময় থাকতে প্রতিবাদ করতে হয়। অধিকার আদায়ের কথা বলতে হয়। হাত-পা বাঁধা বন্দীদশা সময়ে চেষ্টা করেও কোন লাভ হবে না। তাই ছদ্মবেশীদের মুখোশ খুলে দিতে হবে জনসম্মুখে। এরা দেশ জাতি ও আগামী বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকি স্বরূপ।
ষড়যন্ত্রের কবলে বাংলাদেশ
অযুত সম্ভবনার চারণভূমি বাংলাদেশ ভারত, মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত। এ ভূখন্ডটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমা বিশ্ব চীনকে ঘায়েল করতে এ ভূখন্ডের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় বহুগুণে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে ইতোমধ্যে নতুন খৃস্টান রাষ্ট্র কায়েমের গুঞ্জন রটে গেছে! কালের পরিক্রমায় হয়তোবা তা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। পাকিস্তান ও ভিনদেশী প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য ভারত বাংলাদেশের ওপর অটুট রেখেছে ওপেন সিক্রেট আধিপত্য। বাংলাদেশ যেন ‘গরিবের সুন্দরী বউ, সবার ভাবী’ রকমের বিপদের কবলে। সেই ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল। স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৪৩ বছর পরেও শাসক মহলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ভোটের অধিকার অনিরাপদ। গণতন্ত্র, নাগরিকের মৌলিক অধিকার এখানে কেবল মাত্র সংবিধান ও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যের ফ্রেমে আবদ্ধ। তাই নেতাদের যখন যেভাবে খুশি দেশের মানুষকে নীতিকথার ফুলঝুরি শুনিয়ে, বোকা বানিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার অব্যাহত চেষ্টা করা ছিল স্পষ্ট। ক্ষমতার হোলি খেলায় মানুষ খুন, ভোট ডাকাতি, বাড়ি-ঘর লুটপাট, নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিত্য-নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ক্ষমতা পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র আমাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে কাজ করেছে বার বার। ক্ষমতান্ধরা ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করতে প্রয়োজনে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেও লেন্দুপ দর্জির মতো ভিনদেশে হাওলা করে দিতে প্রস্তুত বলে মনে হয়! তাদের অপরাজনীতি ও দুঃশাসন দেশের মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে। তেমনি একটি চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। একটি পক্ষ দেশের সিংহভাগ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে যেনতেনভাবে গলা টিপে, চেপে ধরে, খবরদারী চালিয়ে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করতে চায়। জনপ্রত্যাখ্যাত কোন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের শাসন পরিচালনার উদাহরণ বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় দ্বিতীয় কোথাও নেই। একজনের নেতৃত্বে পাঁচশ’জন ক্ষমতাভোগীর হাতে অবরুদ্ধ সারা দেশ। তাদের কৃত অপরাধ ও কুকর্ম তাদেরকে জনতার আদালতে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। তাই যতদিন সম্ভব, যেভাবে সম্ভব ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা যায় ততই লাভ! জনগণের জীবন যায়, সম্পদ যায় তাতে কি? এমন গন্তব্যহীন যাত্রার কবে শেষ হবে কে জানে? কখন ষড়যন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা মিলবে প্রিয় বাংলাদেশের।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রভাব
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ফেরিওয়ালারা কিছু সংখ্যক ধর্মগুরুদের কুৎসিত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশের ফলে গণঅসন্তোষের সুযোগে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে প্রগতি ও অগ্রগতির দূত হিসেবে চাকচিক্যতার সাথে উপস্থাপনের সম্ভবপর সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মানে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে সেই পালন করবে, ধর্ম পালনে কারো কোন জবরদস্তি নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের কোন প্রভাব থাকতে পারবে না বলে সংজ্ঞায়িত করলেও মূলত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রকৃত স্বরূপ হলো ধর্মহীনতা। ধর্মহীন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, বিবেক-বোধ সবকিছু জড়বাদের অক্টোপাসে জড়িত। জড়বাদের আড়ষ্টে আক্রান্তরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে থাকে। তারা নিজের চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করতে চায়। কিন্তু এমন শাসন পরিচালনা বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সোশ্যালিজম, কমিউনিজম ও ক্যাপিটালিজম বিশ্বব্যাপী এখন বিতর্কিত, ব্যর্থ এবং অনেকটাই অচল মতবাদ। এরা বিশ্বকে ক্ষমতার প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেরও পতনঘণ্টা বাজা এখন সময়ের ব্যাপার।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষবাষ্প এখন সংবিধানে, অবৈধ ক্ষমতাধরদের মুখে। কেউ কেউ জোর গলায় প্রচার করছে স্বাধীনতার চেতনাই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ! অথচ অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে আমরা বলতে পারি যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন করেছিলেন। দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো ধর্ম পালন করে। এরপরও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রবক্তারা গায়ের জোরে টেনে-হিঁচড়ে সবাইকে ধর্মনিরপেক্ষ বানাতে চায়। গায়ের জোরে সংবিধানে অনেক কিছুই যোগ-বিয়োগ করা যায়, কিন্তু মানুষের অভ্যাসগত প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক আচরণ বদলানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তবে কথা, কাজে, প্রচারে সমাজের নানা স্তরে ধর্মকে যেভাবে মূল সমস্যার চাবিকাঠি হিসেবে চিত্রিত করে অপপ্রচারের মিশন চলছে তা এখনি যদি লাগাম টেনে ধরা না হয় তাহলে সমাজে ধর্মহীনতার কুপ্রভাব অচিরেই প্রতিফলিত হবে। এক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্মের অনুশীলন ও অনুশাসন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত রাখতে না পারলে ভোগবাদী সমাজ রাষ্ট্রকে আরো অশান্ত করে তুলবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য উদ্যোগী হলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা-গ-গোল পাকাতে পারবে না।
ক্ষমতান্ধদের রোষানলে প্রিয় মাতৃভূমি
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মীরজাফর, রাজবল্লভ ও ঘষেটি বেগমদের প্রেতাত্মাদের বদনজর থেকে রক্ষা পায়নি। দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলা ও মীর কাশিমকে ক্ষমতার মোহে নৃশংসভাবে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। আমাদের দেশের ওপর সেই প্রেতাত্মার যে আসর পড়েছে তা এখনও ভর করেই চলছে। ১৯৭১ এ দেশের প্রারম্ভিকটা সুন্দর হলেও কয়েক বছর পরই স্বৈরশাসকের কবলে পড়ে দেশ এক গভীর সঙ্কটে পড়ে। ১৯৭৫ এ এক দুঃখজনক ঘটনার মাধ্যমে এর অবসান হওয়ার পরে স্বৈরশাসক এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনকাল, ১/১১ এর পর মঈনউদ্দীন-ফখরুদ্দীনের আড়াই বছরের তিক্ত শাসনামলের পর এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে। শাসন পরিচালনার ৫ বছরে দেশে ভিন্নমতের সকল দল, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রমের ওপর অঘোষিতভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের নামে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ সংসদীয় আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে, গৃহপালিত বিরোধী দল নিয়ে এবং ভোটারবিহীন হাস্যকর নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতার উন্মাদনায় বাংলাদেশকে আগুনে পুড়ে ছারখার করে নিঃশেষ করে ফেলাই যেন আওয়ামী জোটের বড় মিশন। তাই দেশে এখন রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে তারা দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। জনগণের রোষানলে পিষ্ট হওয়ার আতঙ্কে বিরোধীমতের সকল সভা-সমাবেশ, কর্মসূচি, এমনকি দলীয় কার্যালয়ও বন্ধ করে দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের ওপর কড়া হস্তক্ষেপ আরোপ করা হয়েছে। টিভি টকশো, পত্রিকার কলাম লিখা সব কিছুই সরকারের পক্ষে নম নম করতে দিব্যি বাধ্য করছে। দেশের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে বিরোধীদের গুলী করে হত্যা করছে এবং দেশে সংগঠিত সাংঘাতিক অপরাধ দমনের পরিবর্তে সকল বিরোধীমত দমনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। এতে দেশাভ্যন্তরে যেমন অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে তেমনি সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। জনগণের মাঝে অটুট ঐক্যের পরিবর্তে নানা ধরনের বিভক্তি বিরাজ করছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বলে ভেদাভেদ তোলা হয়! দেশের মানুষ যেন এখন স্বাধীন দেশের বন্দী নাগরিক! সর্বসাকুল্যে বলা চলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। ক্ষমতান্ধদের রোষানলে ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কবলে প্রিয় মাতৃভূমি!
প্রতিবাদীরা ক্ষমতান্ধদের শত্রু
দেশের কল্যাণকামীরা সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। সরকার অনেক সময় প্রতিবাদীদের ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করে। কিন্তু সরকার যদি প্রতিবাদ ও সমালোচনাকে সহ্য করতে পারে তাহলে প্রতিবাদ-সমালোচনা সরকারকে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যখন মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয় তখন জনগণের মধ্যে ক্ষোভে দানা বাঁধতে থাকে। কালে-ভদ্রে সে ক্ষোভ গণবিস্ফোরণে পরিণত হতে পারে। তখন সরকার এমন বিস্ফোরণ ঠেকাতে  স্বৈরাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজের সুরক্ষার জন্য বৃথা চেষ্টা করে। কারণ স্বৈরাচারী সরকারের সমাপ্তি হয় অত্যন্ত করুণ।
সুশীল সমাজরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, শিক্ষিত ও বিশেষজ্ঞ সমাজ। তারা বিশেষ করে দেশের বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও অতীতকে নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেশের কল্যাণে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-বিশ্লেষণ করেন। আইনের শাসন, মানবাধিকার ও নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার জন্য বিশেষ অবদান ছাড়াও সরকার ও বিরোধী দলকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। আবার সুশীল সমাজ যখন দেশের ও জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে কোন দলের হয়ে কাজ করতে থাকেন তখন দেশের পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে। আমরা এদের মধ্যে সুবিধাবাদী সুশীল সমাজ দেখতে পাই, যারা সত্য বলতে পারেন না। ইনিয়ে বিনিয়ে সত্যের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে নিজেকে নিরপেক্ষ দেখাবার চেষ্টা করেন। তারা ভুলে যান আসল সত্য কথা না বললে অপরাধীরা নতুন করে উৎসাহিত হয়।
জাগতে হবে জাগাতে হবে
মানুষ সৃষ্টিজগতের মাঝে এক অনন্য সৃষ্টি। আশা-নিরাশা, সাহসিকতা-ভীরুতা, উদারতা-কপটতা, দয়ার্দ্রতা-নিষ্ঠুরতা, ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়-অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা সবকিছু নিয়েই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। ব্যক্তির বোধ ও বিবেক যথার্থ কার্যকর হওয়া না হওয়ার ওপর ভিত্তি করে উপরোল্লেখিত সদাচারণ ও অসদাচরণগুলো প্রয়োগ হতে দেখা যায়। মানুষের সৎ গুণাবলী ও অসৎগুণাবলী মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে পুরস্কৃত ও তিরস্কৃত করে। মর্যাদাকে বুলন্দ অথবা অপদস্ত করে।
জাগতে ও জাগাতে হবে কথাটি মানুষ ব্যতীত অন্য কানো জীব বা জড়র জন্য প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যেহেতু ভালো-মন্দ যাচাইয়ের সক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাই মানুষকে ঘিরেই বিশ্বব্যবস্থায় স্রষ্টার যতসব আয়োজন। মানুষ তার রবের নির্দেশ পালন ছাড়া কারো নির্দেশ পালন করতে পারে না। যখন ব্যক্তি নফসের বা তাগুতের নির্দেশিত পথকে আত্মতৃপ্তির পথ হিসেবে বাছাই করে নেয় তখন জানের ভয় ও মালের প্রতি আকর্ষণ এবং জুলুমবাজি তার কাছে মামুলি ব্যাপার মাত্র। আবার কিছু নিরীহ প্রকৃতির লোক আছে। এরা আমজনতা বলে পরিচিত। এরা জুলুমবাজি ও হঠকারিতা অপছন্দ করলেও ক্ষমতাধরদের তোষামোদী করে নিজেদের বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ ধরনের পক্ষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসলে আমজনতা বা নিরপেক্ষ বলতে পৃথিবীতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাইকে তার যুতসই পক্ষ বাছাই করে নিতে হয়। পাগলও পক্ষ বাছাই করতে মোটেও ভুল করে না। যেমন-সাগর বা গভীর নদীর মধ্যভাগে কেউ বিনা তরীতে ভেসে থাকতে চাইবে না, তাকে কোন কিছু অবলম্বন করে তাতে চেপে বাঁচার প্রচেষ্টা চালাতে হয় অথবা সাগর বা নদীর কিনারায় ভিড়তে সাধ্যমাফিক চেষ্টা করতে হয়। কারণ এ দু’ভিন্ন ছাড়া কোন অবলম্বন না থাকায় পানির মধ্যভাগের ব্যক্তিকে নিশ্চিত পানিতে ডুবে মরতে হবে। আমাদের দেশেও তেমন সরকার পক্ষ বা বিপক্ষ দু’টি পক্ষ রয়েছে। যাদের পরস্পর চরম বৈরীতায় দেশ মহাসঙ্কটকাল অতিবাহিত করছে। সবাই তাদের রোষানলে পড়ে পিষ্ট হয়ে গুমরে মরছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ দু’পক্ষের বাইরে ভিন্ন কোন পক্ষের লোক খুঁজে পাওয়া বড়ই মামুলি ব্যাপার।
দেশে এখন যারা আমজনতা বলে মুখে কুলুপ দিয়ে সরকারের জুলুম-নির্যাতন থেকে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তারা মরার আগে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এদের জীবন্ত লাশ বলতে দ্বিধা নেই। এরা হককে হক বলতে পারে না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। এদের নিরবতায় ক্ষমতাধররা মনে করে আমজনতা তাদের পক্ষে। দিনে দিনে তাদের স্পর্ধা আরো বাড়ে। তাই ওরা জনগণের শাসনের পরিবর্তে শোষণ করে তৃপ্ত হয়। দেশে এখন অপরাধপ্রবণতা, জুলুমবাজি ও অবিচার স্থায়ীভাবে খুঁটি গেড়ে বসছে। তাই শুধু নিজে জাগলে হবে না, সব বিবেককে জাগাতে হবে। আমজনতাকেও সবার জায়গা থেকে না জেগে গত্যান্তর নেই। আত্মসম্মানবোধকে শাণিত করতে হবে। আজ নিজেদের অতীত ইতিহাসকে স্মরণ করা জরুরি। যাদের কাছে ফ্যাসিস্টরা পদানত হয়েছিল। কারো রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে যারা হাসিমুখে জীবন দিয়েছে আমরা সেই জাতি। তাই পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের মোহকে পরিত্যাজ্য করে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেও বিষকে ছুড়ে ফেলে চিরস্থায়ী জিন্দেগীতে কাক্সিক্ষত পুরস্কার লাভের প্রত্যাশায় সফল মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ গ্রহণ করে পৃথিবীর কল্যাণ ও আখিরাতের মুক্তি নিশ্চিত করার প্রয়াসে আমরা এগিয়ে চলি। নচেৎ একটি প্রজন্মের কাপুরুষতা, আল্লাহদ্রোহিতা ও ভীরুতার ফল স্বরূপ দীর্ঘকাল কাপুরুষতা, আল্লাহদ্রোহিতা ও ভীরুতার ঘানি টানতে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যা একটি জাতির গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটাবে।
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার 

Ads