বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গত দশ মাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড


গত মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বহুদলীয় রাজনীতি বলতে যা বুঝায় তা নেই। তারপরও চলমান স্থানীয় সরকারের পৌরসভাগুলির নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচনের সুবাদে কতকগুলি দল নির্বাচনে সীমিত আকারে কিছু রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। মূলত আওয়ামী লীগ বা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট অন্য কোন সংগঠন ছাড়া কারোর পক্ষে স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ অত্যন্ত কম। অন্য কোন দলের রাজনৈতিক সহিংসতা, মারামারি ও হানাহানি প্রায় নেই। কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঝে সন্ত্রাসের কোন কমতি দেখা যায়নি। বর্তমান বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার নব্বই ভাগ এই আওয়ামী মহল একক কৃতিত্বের দাবিদার, তাতে কোন সন্দেহ  নেই এবং তাদের সমকক্ষ কেউ আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য নেই। গত মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দশ মাসে কেবলমাত্র রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় নিহত নিরানব্বই জন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের হাতে ঊননব্বই জন, বিএনপির হাতে তিন, এমএনপি হাতে এক, সন্তু লারমার জেএসএস-এর হাতে চার এবং জামায়াতের হাতে দু’জন নিহত বলে অভিযোগ।
আওয়ামী লীগের হাতে নিহত চল্লিশ জন : ১১ মার্চ চাঁদপুর জেলার কচুয়ায় সকাল ১১ টায় স্থানীয় চরকাঠি গ্রামে শ্বশুরবাড়ি থেকে যুবদল নেতা মুক্ত শেখকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় এবং মারধর করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ মার্চ মুক্তা শেখ মারা যায়। ১৮ মার্চ পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে চাঁদা ও জুয়ার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতার গুলীতে ছাত্রলীগ নেতা বাঁধন খন্দকার মারা যায়। ১৩ মার্চ লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে জেরে যুবলীগ নেতা মনু মিয়া মারা যায়, ২৯ মার্চ যশোরের মনিরামপুরে আওয়ামী লীগের দলীয় দু’গ্রুপের হামলায় মনোয়ার হোসেন নামে একজন কর্মী নিহত হয়েছে, ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে ঢাকার নিউ ইস্কাটনে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ও মহিলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদিকা পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনির হঠাৎ এলোপাতাড়ি পিস্তলের গুলীতে আহত হয় রিক্সা চালক আব্দুল হাকিম ও সিএনজি অটোরিক্সা চালক ইয়াকুব আলী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা যথাক্রমে ১৫ ও ২৩ এপ্রিল মারা যায়। এই ঘটনায় তার গাড়ির ড্রাইভার ইমরান ফকির আদালতে এমপির ছেলের দায় স্বীকার করেছে। ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মধ্যে তেল সরবরাহকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে যুবদল নেতা নাজিম উদ্দিন ভূঁইয়াসহ আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৯ এপ্রিল মারা যায়। ১০ মে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে সজীব সিকদার নামে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হয়েছে। ১৪ মে কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল গ্রুপ ও ছাত্রলীগ নেতা সরোয়ার গ্রুপের মধ্যে রাত দশটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সংঘর্ষে গোলাগুলী চলে এবং সংঘর্ষ চলাকালে গাড়ি চাপায় মাসুম সরকার নামে একজন ছাত্রলীগ কর্মী মারা যায়। ২৩ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে আওয়ামী লীগ নেতা ইদ্রিস খানের লাঠির আঘাতে দোকানি আব্দুল জলিল নিহত হয়েছে। ১ জুন ফেনীর সোনাগাজীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র আওয়ামী লীগে এমপির ইন্ধনে নিহত হয়েছে যুবলীগ নেতা আজিজুল হক। এ ঘটনায় এমপির ভাই ও ভাতিজাসহ তেত্রিশ জনের নামসহ এবং আরো দশ-বারজনকে আসামী করে মামলা হয়েছে। ২ জুন মাদারীপুরের শিবচরে আওয়ামী লীগে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরশেদ মাতুব্বর (যুবলীগ) ও শাহাজান ঘরামী (দোকানী) নামে দু’জন নিহত হয়েছে। ৮ জুন বগুড়ার ধুনটে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে খুন হয় ডাবলু মিয়া নামে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী। ২২ জুন নওগাঁর পত্নীতলায় জমি-জমার বিরোধকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা চান মোহাম্মদ এবং আব্দুল মতিন গংদের হামলায় উপজাতি শিশু মিথুন ও হাফিজুল ইসলাম নামে দু’জন নিহত। ৬ জুলাই চট্রগ্রামের সীতাকুন্ডে উত্তর বাঁশবাড়িয়া এলাকায় রাত আটটায় আওয়ামী লীগ নেতা ও নাজিম বাহিনীর প্রধান নাজিম উদ্দিন ডাকাতির চেষ্টাকালে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আহত হয়। নাজিমের অন্যান্য সঙ্গীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঘটনায় এস.আই দুলাল, জামান, কনেষ্টবল জাহেদ, কামরুল, শাহাদাতসহ পাঁচ পুলিশ ও এক আনসারসহ ছয়জন আহত হয়েছে। পরে চিকিৎসাধী অবস্থায় ৭ জুলাই ভোর রাত দু’টায় নাজিম উদ্দিন হাসপাতালে মারা যায়। ১০ জুলাই কুমিল্লার লাঙ্গলকোটে ইফতার মাহফিলে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আব্দুর রহীম নামে একজন আওয়ামী লীগ নেতা আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ জুলাই রাতে চট্টগ্রামে একটি ক্লিনিকে মারা যায়। ১৩ জুলাই বগুড়ার গাবতলীতে বাবনভিটা রাস্তায় আওয়ামী লীগের নশিপুর ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব ও তার লোকজন ব্যবসায়ী মোজাম প্রামানিককে ব্যারিকেড দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান। এ ঘটনার মামলায় বিপ্লবসহ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিপ্লব পুলিশের কাছে খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। ২৩ জুলাই মাগুরা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উত্তর রূপদহ সুন্দরপুর গ্রামে আওয়ামী লীগের সহিংশতায় উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা রুস্তম আলী ও পরাজিত আওয়ামী প্রার্থী আবু নাসির বাবলু গ্রুপের সংঘর্ষে নান্নু মোল্লা নামে একজন নিহত হয়। ১০ আগস্ট ঢাকার কাফরুলে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ কাফরুল থানা সাধারণ সম্পাদক রুবেল মিয়াকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। প্রথমে তাকে কাজীপাড়া এক্সিম ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত অনুমান এগারটার সময় রুবেল মারা যায়। ১৩ আগস্ট ঢাকার বাড্ডা আদর্শ লিংক রোডে আল সামী হামপাতাল সংলগ্ন পানির পাম্পের পাশের খোলা মাঠে শোক দিবস পালন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক আলোচনা কালে হঠাৎ প্রতিপক্ষ গ্রুপের এলোপাতাড়ি গুলীতে আওয়ামী লীগ নেতা সামসুর রহমান মোল্লা, ফিরোজ আহমেদ মানিক, বাড্ড থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান সোয়েল ওরফে গামা এবং বাড্ডা ইউনিয়ন যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম গুলীবিদ্ধ হয়। তার মধ্যে সামসুর রহমান মোল্লা ও ফিরোজ আহমেদ মানিক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐ দিনই গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যায়, ১৪ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থা মাহাবুবুর রহমান সোয়েল ওরফে গামা মারা যায় এবং পরে ২৩ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় আব্দুস সালাম মারা যায়। মূলত ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সাবেক ছাত্রলীগ গুলশান থানা সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ বাড্ডা থানা শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ফারুক হোসেন মিলন এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের পৌর সভার বাতেন মার্কেট এলাকায় গরুর হাটে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র আওয়ামী লীগ ক্যাডার শিশু ও জাফর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর আলম ও হুমায়ুন কবীর নামে দু’জন গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যায় এবং তিন জন গুলীবিদ্ধসহ অনেকে আহত হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের শালথায় মোবাইলের মেমোরী কার্ড কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আহত প্রায় পঞ্চাশজন এবং পবে ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবুল হোসেন নামে একজন মারা যায়। ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলো- ফরিদ শেখ, মঙ্গল মোল্লা, রাশেদ, ইসাহাক, অহিদ খান, আর্শেদ, রাকিবুল, নবীন শেখ, বাবুল মাতুব্বর, অপু শেখ, সালাম মাতুব্বর ও বতু শেখ। ভ্রাম্যমাণ আদালত গ্রেফতার বার জনের ছয় জনকে দুই মাস করে বিনাশ্রম কারাদ- দেয়। ৩০ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের ধাইনগর ইউনিয়নে নাক্কাটিতলা গ্রামে ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগের ধাইনগর ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কার ও আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলামের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে হয়। ঐ সংঘর্ষের জেরে ১ অক্টোবর আবারও দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে মধ্যে পড়ে বিএনপির নজরুল ইসলাম নামে একজন নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছে। নিহত নজরুল ধাইনগর ইউনিয়ন বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে আহত পনের জন। ৭ অক্টোবর খুলনা আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোল্লা জালাল উদ্দিনের পুলিশ লাইনের পাশে মুন্সীপাড়ার বাসায় ভ্রাতুষ্পুত্র মাওলানা হেদায়েত হোসেন আওয়ামী লীগ নেতা জালাল মোল্লার নিজ পুত্রবধূ রাব্বি সুলতানা লিপিকে শর্টগান দিয়ে গুলী করে হত্যা করে। শর্টগানটি মোল্লা জালাল উদ্দিনের লাইসেন্সকৃত। ২২ অক্টোবর নাটোরের সিংড়ায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আব্দুল হান্নান নামে একজন নিহত, আহত পনের এবং গ্রেফতার ষোলজন। এ সময় ৩৫টি বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১৯ তারিখ আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের একবার সংঘর্ষ হয়েছে। ২৯ অক্টোবর ফেনীতে লক্ষ্মীপূজায় নামাজের সময় আতশবাজি ফুটানোর অযুহাতে পূজায় হামলা করে ছয় মাসের গর্ভবতী তুলসী রানী দাস নামের এক হিন্দু মহিলার গর্ভপাত ঘটায়েছে এবং বাকী আলো রানী দাস, শোভা রানী দাস, শুকদেব দাস, পরিমল দাস ও বিকাশসহ আরো পাঁচজনকে আহত করেছে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এ সময় একটি মৃত সন্তান প্রসব করে টুনি। সন্ত্রাসীরা দোকন লুটপাট, ভাংচুর ও মারপিট করে হিন্দুদের। ৬ নবেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তিনজন আহত হয়। গুরুতর আহত জাসদ কর্মী বাবলু চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১২ নবেম্বর রাত দু’টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। ৮ নবেম্বর কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে মাদরাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র মাকসুদুর রহমানকে স্বর্ণ চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৩০ অক্টোবর মাকসুদুর রহমানকে পিটিয়ে হত্যা করার দায়ে আওয়ামী লীগের সরসপুর ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি নূরুল আমীন, তার ছেলে রুবেল হোসেন ও মাসুদ, স্ত্রী রোজিনা আক্তার, মেয়ে স্বপ্না আক্তার, ভাগিনা ওমর ফারুক ও মিলনসহ দশ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে মৃতের মা জাহানারা বেগম। ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে সোনারগাঁওয়ে শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চরপাগলা-চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় বালু মহলের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে দু’পক্ষের সংঘর্ষে জামাল হোসেন নামে একজন নিহত ও অপর বিশজন আহত হয়েছে। ২২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় পৌর নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বাদশা মিয়ার নির্বাচনী প্রচারণা শেষে বাড়ি ফেরার পথে ৪নং ওয়ার্ডে আদর্শ গ্রাম এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকজনের ধারালো অস্ত্রের হামলায় বিএনপি কর্মী নজরুল ইসলাম নিহত হয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। ২৪ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া সদর থানায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম নামে একজন নিহত হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পৌর নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মোজাম্মেল বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী আব্দুল হালিমের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলীতে ভোটের লাইনে দাড়িয়ে থাকা বিএনপি কর্মী নূরুল আমীন গুলীবিদ্ধ হলে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে এবং রবগুনা পৌর নির্বাচনে আওয়মী লীগ ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৩১ ডিসেম্বর বরগুনা সদর হাসপাতালে নূরুল ইসলাম মারা যায়।

যুবলীগের হাতে নিহত সাতাশ জন : ৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার যুবলীগের ভাঙ্গাখা ইউনিয়নের যুগ্ম-আহবায়ক আরিফুর রহমান ফরহাদকে দলীয় কোন্দলের ফলে তাকে হত্যা করে মৃত অবস্থায় স্থানীয় মিরিকপুর বাজারে একটি স’মিলের ভিতর থেকে ভোরে তার গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। ৫ মার্চ রাতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নাটোর সদরে ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা সিরাজ সিকদার খুন হয়েছে। টাকা ভাগাভাগী নিয়ে শহরের ঝাউতলা মোড়ে যুবলীগের দলীয় কোন্দলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে ও ৫ মার্চ সন্ধায় বগুড়া শহরের সাবগ্রামে অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগের দলীয় কোন্দলে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে সাবগ্রাম বন্দর কমিটির সভাপতি মানিক খুন হয়েছে। ২৪ মার্চ ফেনী শহরে যুবদলের নেতা দেলোয়ার হোসেনকে যুবলীগ কর্মীরা আহত করে এবং শহরের কসমোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ মার্চ মারা যান তিনি। ৪ এপ্রিল ফেনী সদরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দলে যুবলীগের কর্মী সাইফুল ইসলাম নিহত হয়েছে। ৮ এপ্রিল ঢাকার খিলগাঁওয়ে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয় মোঃ আরিফ নামে এক যুবলীগ কর্মী। মৃত্যুর আগে আরিফ সাংবাদিকদের জানায় স্থানীয় শুভ, মিঠু, ইমরান ও কালা তার উপর হামলা করেছে। আরিফের বক্তব্য অনুসারে দলীয় কোন্দলে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এরপর আরিফ আর কথা বলতে পারেনি। ২৪ এপ্রিল বাগেরহাট মডেল থানা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগ দু’গ্রুপের সংঘর্ষে রাজা শেখকে কুপিয়ে জখম করে এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজে রাজা শেখ মারা যায়। ৭ মে চট্রগ্রামের মুরাদপুরে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকে ডাকাতিতে অংশ নেয় যুবলীগের পাঁচ নেতা আরিফ, মাহবুব, সাগর, পিয়াস ও মাসুদ। ঘটনার সময় তারা ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী ইব্রাহিতকে খুন করে। ২০ মে নোয়াখালী পৌর যুবলীগের নেতা আলী আকবরের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে এলাকায় কয়েকদিন আগ থেকে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। ২১ মে কুমিল্লার তিতাসে হারাইকান্দি গ্রামে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে শাহ আলম নামে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী নিহত হয়েছে। ১৮ জুন ফেনী সদরের বালিগাঁওয়ে যুবলীগের দ্বন্দ্বে গোলাম মওলা মিস্টার, আজিমসহ আরো ছয়-সাত জনের হামলায় গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে যুবলীগ নেতা রসুল আমিন মানিক। ১৯ জুন খুলনায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে যুবলীগ কর্মী ইমরান সজিব আকনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে যুবলীগ খুলনা মহানগর কমিটির সদস্য এস.এম হাফিজুর রহমান হাফিজের লোকজন। নিহতের বাবা ২১ জুন খুলনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন- তার ছেলে মরে যাওয়ার আগে বলে গেছে, মাহবুব ও চঞ্চল তাকে চেপে ধরে এবং ভাগ্নে সুমন তার মাথার পিছনে কোপ মারে ও হাত কেটে নেয়। সিরাজসহ আরো অন্যান্যরা তার শরীরে কোপায়। তিনি আরো অভিযোগ করেন নিহতের হাতটি কেটে নিয়ে এমন নৃশংসতা দেখায় যে তা দিয়ে ক্রিকেট খেলার মত ক্যাচ ধরার খেলা করে। ২৭ জুন লালমনিরহাটের সদর থানার মহেন্দ্রনগর বাজারের খান মার্কেটের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগের দু’গ্রুপের দ্বন্দ্বে যুবলীগ নেতা ফখরুল ইসলাম বুলেট নিহত হয়েছে। ৮ জুলাই সিলেটের জালালাবাদ থানার কুমারগাঁও এলাকায় চোর সন্দেহে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে আহত করে পরে হাসপাতালে নিলে ডাক্তারা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা আলী হায়দার ওরফে হায়দার আলী, তার ভাই শামীম, কামরুল ও বাদলসহ আরো অনেকে। পুলিশের এস.আই আমিনুল ইসলাম যুবলীগ নেতা হায়দার আলীর মাধ্যমে বারো লক্ষ টাকায় চুক্তি করে নগদ ছয় লক্ষ টাকা দিয়ে মূল আসামী বাদ দিয়ে এজাহার দায়ের করে এবং মৃতকে বেওয়ারিশ দেখিয়ে মামলা রেকর্ড করে। ১২ জুলাই নাটোরের সিংড়ায় ননী গোপাল কুন্ডু ও তার স্ত্রী চিত্রা রানী কুন্ডুকে শ্বাস রোধ হত্যা করা হয়। হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা এমদাদুল হক কালু, মকবুল হোসেন, মমতাজ আলী, আব্দুল হক ও শামসুল হককে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ২১ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলা বাজারের ব্যবসায়ী ও ইউনিয়ান যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক আব্দুল মোতালেব মোল্লার বাড়িতে বসে সাতজন মিলে মদের আসর বসায় এবং দেশীয় মদ পান করে। অতিরিক্ত মদ পান করার পর সাতজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থদের ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। পরের দিন ২২ জুলাই আব্দুল মোতালের মোল্লা ও চৌকিদার শুকলাল চন্দ্র রবিদাস মারা যায়। ২৫ জুলাই মাগুরায় যুবলীগের গুলীবিদ্ধ নেতা আব্দুল মমিন ভূঁইয়া মিরাজ রাত ১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাগুরা সদর হাসপাতালে মারা যায়। উল্লেখ্য আব্দুল মমিন ভূঁইয়া মিরাজ গত ২৩ জুলাই যুবলীগের এক সংঘর্ষে গুলীবিদ্ধ হয়। ১৫ আগস্ট কুষ্টিয়াতে আওয়ামী লীগের শোক র‌্যালিতে তাদের অঙ্গ সংগঠনের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী সবুজ হোসেন নিহত হয়। ১৯ আগস্ট ঢাকার ওয়ারীতে যুবলীগের দলীয় কোন্দলে যুবলীগ নেতা আব্দুল মান্নান খুন হয়েছে। তিনি এলাকায় মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যকালাপের বিরেধিতা করতেন বলে সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছে। স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে আব্দুল মান্নান এলাকায় মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যকালাপের প্রতিবাদ করতেন বলে এলাকার কিছু দলীয় লোকের সাথে তার দ্বন্দ্ব ছিল, ৫ সেপ্টেম্বর ছিনাইদাহের শৈলকুপায় যুবলীগের হাতে নিহত হয় যুবদলের আবু জাফর। ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর এতিম ছাত্রী পনের বছরের সুমাইয়া আক্তার নাদিয়াকে যুবলীগের মোশাররফ হোসেন লিটন, ফকিরা, সুমন ও স্বপন সকাল ন’টা থেকে সাড়ে এগারটা পর্যন্ত পালাক্রমে ধর্ষণ করে গলাটিপে হত্যা করে। পুলিশের হাতে চার ধর্ষকের মোশাররফসহ তিনজনই ধরা পড়ে ১৬৪ ধারা মতে জবানবন্দী প্রদান করে ঘটনার সব তথ্য প্রকাশ করে। একই দিন নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মধ্যম হাজীপুর গ্রামে যুবলীগের স¤্রাট বাহিনীর গুলীতে জসিম উদ্দিন রুবেল ও স্বাধীন গুলীবিদ্ধ হয়। পরে জসিমকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তারা তাকে মৃত ঘোষণা করে। ২৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চাটখিলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুবলীগের হাতে অপর যুবলীগ কর্মী আক্তার হোসেন স্বপন নিহত হয়েছে। আগের দিন তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি হলে পরের দিন যুবলীগ কর্মী রবিন হোসেন রবিন, তার ছোট ভাই জাকির হোসেন রাব্বি, তাদের মামা তারেক ও প্রতিবেশী রিশনসহ আরো কয়েকজন ঘুমন্ত স্বপনের উপর হামলা করে। ১৬ নবেম্বর চুয়াডাঙ্গা সদরে যুবলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জিপু গ্রুপ ও নাঈম গ্রুপের সংঘর্ষে নাঈম গ্রুপের আজিজুল হক নামে একজন যুবলীগ নেতা নিহত এবং জিপু গ্রুপের বুদো আহত হয়। কমিটি গঠন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে কমিটি গঠন হলে বিরোধ আরো চরমে ওঠে। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা ওবায়দুর রহমান জিপু চৌধূরীসহ ত্রিশজনের নাম উল্লেখ করে নিহতের স্ত্রী ডলি খাতুন হত্যা মামলা দায়ের করেছে এবং মামলায় বাকী ৮-১০ জনের নাম অজ্ঞাত উল্লেখ করা হয়েছে এবং ২২ ডিসেম্বর ঢাকার আশুলিয়ায় যুবলীগের সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছে ভ্যান চালক মঈন উদ্দিন এবং আহত হয়েছে প্রতিবেশী মোর্শেদ। মঙ্গলবার সন্ধায় সুদের টাকা লেন-দেন নিয়ে যুবলীগ নেতা হাসান মন্ডল এক শালিস বৈঠকে ডাকেন মন্ডল মার্কেটে। তারা বৈঠকে যাওয়া মাত্র যুবলীগ সদস্য মেহেদী, মামুন, মান্নান, তুষার, পারভেজ, মানিক ও সুমন তাদের লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। এ সময় তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয়রা তাদের পলাশবাড়ী হাবিব ক্লিনিকে নিয়ে যায়। মঈনের অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তাররা তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে যাওয়ার পথে মঈন মারা যায়।
মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান 

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পিয়ন প্রহরীর নির্বাচন!


ফাজলামিরও বোধকরি একটা সীমা থাকে। কিন্তু কাজী রকিব উদ্দিনের নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশন এখন বাংলাদেশে বহাল আছে, তাদের ফাজলামির কোনো সীমা আছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের প্রায় ৯ কোটি ভোটার ও ১৬ কোটি লোকের সঙ্গে তারা ধারাবাহিকভাবে এক ধরনের ইয়ার্কি করে যাচ্ছে। গত বছর ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে এই কমিশন যতগুলো নির্বচন বা উপনির্বাচন করেছে, তার সবই ছিল ইয়ার্কিতে ভরা। সরকার ও সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো বাদে ভোটার কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের যে তাচ্ছিল্য, তা ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। এরা নির্বাচন কমিশনকে যেমন একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, তেমনি পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছে।
এই লেখা যখন পাঠকের কাছে পৌঁছবে, যখন তারা এ লেখা পড়ার সুযোগ পাবেন, ততক্ষণে রকিব কমিশনের নির্বাচনী কৌতুক শুরু হয়ে গেছে। কিংবা সরকারের প্রধান অংশীদার ও তাদের সাবেক প্রভু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নির্বাচনে ভোট দেয়া শেষ হয়ে গেছে। এই কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেভাবেই সকাল ১১টার মধ্যে এর আগের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখনও এই হাস্যকর ব্যক্তিরা জনগণের ভোটাধিকারে সংরক্ষণ করতে কোনো রকম চেষ্টাই করেননি। তাদের তত্ত্বাবধানে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়। অন্যান্য প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এই কমিশনের পোলিং অফিসাররা দুই হাতে সরকারি প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরেছেন। সেখানে পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিকদের ঢুকতে দেননি নির্বাচনের দায়িত্ব পালনরত সরকার-সমর্থক পুলিশ কর্মকর্তারা। অনেক জায়গায় তাদের নাজেহাল করেছেন। আর এই অথর্ব নির্বাচন কমিশন তাতেই বাহবা বাহবা বেশ বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে।
তখনও নির্বাচনের আগে এদের প্রভু ছাড়া সব প্রতিদ্বন্দী দল ও প্রার্থী দাবি করছিল, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হোক। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সে দাবি আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি সাধারণত করা হয় এই বিশ্বাস থেকে যে, সেনাবাহিনী পাহারায় থাকলে জালিয়াত, কেন্দ্র দখলকারী, হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসীরা দূরে থাকবে এবং জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারুক- এটাই চায় না সরকার। আর সে কারণে চায় না নির্বাচন কমিশন। এদের দায়িত্ব নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন করা। সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে যদি মানুষ নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, তাতে নির্বাচন কমিশনের অসুবিধা কোথায়, বোঝা মুশকিল। সরকারের অসুবিধা বোঝা যায়। মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে এই জনধিকৃত সরকার যে অনন্তকালের জন্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, সে কথা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার করে না। তাছাড়া গত সাত বছরে এ সরকার জনগণের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে তারা এর দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে দেবেন। তবে একথাও সত্য যে, এই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা যেমন জনগণের রুদ্ররোষে পড়বে, তেমনি সে রোষ থেকে বাদ পড়বেন না নির্বাচন কমিশনের এই নিম্ন শ্রেণীর সেবাদাসরাও। পবিত্র দায়িত্ব পালনে চরম পক্ষপাতিত্বের কারণে এদেরও পিঠ বাঁচানো দায় হয়ে পড়বে। তবে সবার ওপরে এই আত্মমর্যাদাহীন কর্মচারীদের চাই তাদের চাকরির নিশ্চয়তা। সে নিশ্চয়তা তো সংবিধানই তাদের দিয়েছে। সরকারের এমন সেবাদাস হওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ কর্মজীবনে সরকারের নির্দেশ মানতে মানতে এদের মধ্যে যে দাস মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে তারা বের হতে পারছেন না।
এই কমিশন গঠনের পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে তারা এমন ইয়ার্কি-ফাজলামি শুরু করেছে, মনে হতে শুরু করে এরা নির্দিষ্ট মিশন নিয়ে এই ‘চাকরি’ গ্রহণ করেছে। আর তা হলো নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি করা, যাতে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ না করেন। রকিব কমিশন তার সে মিশন প্রায় সফল করে এনেছে। এদেশে যখনই কোনো নির্বাচন আসে, তখনই সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কৌতূহলের সৃষ্টি হতে থাকে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, তা নিয়ে ততই জমজমাট হয়ে ওঠে আলোচনা। রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের অধিকাংশেরই শিকড় প্রোথিত আছে গ্রামে-মফস্বলে। ফলে অলিতে-গলিতে, চায়ের দোকানে, বাসে, ট্রেনস্টেশনে চলতে থাকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা; চলে নানা বিশ্লেষণ। কিন্তু এবার রাজধানীতে সেই নির্বাচনী উত্তাপ তেমন একটা লক্ষণীয় নয়।
গত সোমবার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা দেদার আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং এসব বিষয়ে নানা বক্তব্য দিয়ে কমিশনাররা হাসিরপাত্রে পরিণত হয়েছেন। তারা বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি দলের ২৩ জন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠল। নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় নানা বক্তব্য দিয়ে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এ সংশয় নিরসনে কমিশন কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনিয়মকারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে জেলে ঢোকান। অভিযোগ উঠেছে এমন দু-একজনের প্রার্থিতা বাতিল করুন। অনিয়ম ও অভিযোগ উঠলে নির্বাচন বন্ধ করুন। সুজনের সভাপতি হাফিজউদ্দিন আহমদ খানও এই ইসির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আগেও ইসির বিতর্কিত ভূমিকা দেখা গেছে।
সুজনের এই বক্তব্য ইতিমধ্যেই অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে ইসি কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। আর একে হাস্যকর করতে তারা যা করেছে, তা ছিল একেবারে অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। কমিশন টাঙ্গাইলের সখিপুর পৌরসভা নির্বাচনে ৯টি ভোটকেন্দ্রের পাঁচটিতে একজন করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাদের চারজন নৈশপ্রহরী ও একজন পিয়ন। উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭০০-এর বেশি ও ৫০টি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫০০-এর বেশি শিক্ষক থাকলেও তাদের নিয়োগ না দিয়ে ঐ পিয়ন ও নৈশপ্রহরীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত পোলিং কর্মকর্তা ও শিক্ষক নাম না প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে পিয়নদের সমান গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অপমান করা হয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘পাঁচজন নয়, এর চেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থেকে তা করা হয়নি।’ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংসদ নির্বাচনের পরিপত্রে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া যাবে না বলে উল্লেখ থাকলেও পৌর নির্বাচনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে যেহেতু সরকারি শিক্ষকের কোনো অভাব নেই, তাই পিয়নদের নিয়োগ না দেয়াই সমীচীন।
এ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। সেদিনও সিইসিকে দেখলাম নানা ধরনের ফটর ফটর করতে। কিন্তু এই অনিয়ম নিয়ে তিনি একটি কথাও বললেন না। ধারণা করা যায়, এভাবে শত শত পিয়ন-দারোয়ান-সুইপারকে নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে এই ইসি নিয়োগ দিয়েছে। শুধু কী তাই? গণধিকৃত রকিব কমিশন সীতাকু- পৌরসভা নির্বাচনে বারবকু-ের এক যুবলীগ সভাপতিকেও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এভাবে সরকারি দলকে জেতাতে কত-শত অনিয়মের আশ্রয় এই কমিশন নিয়েছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। শুধু একটা কথাই নিশ্চিত করে বলা যায়, নির্বাচন নিরপেক্ষ বা সুষ্ঠু হওয়ার কোনো আশা নেই। তাছাড়া প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, বাড়িঘরে আগুন, মধ্যরাতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে চড়াও, কাফনের কাপড় পাঠিয়ে ভোট থেকে বিরত থাকার আহ্বান একবারে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সং-এর মতো বসে বসে তামাশা দেখছে কমিশন।
আর মিডিয়া, সাবধান! মিডিয়া কর্মীদের নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে দূরে রাখার নানা পরিকল্পনা করেছে ইসি। সিইসি রকিব সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, তারা যেন ক্যামেরা বুথের দিকে না ধরেন। তাদের কেন্দ্রে ঢুকতে হবে কেন্দ্র কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে। পুলিশ তাতেও নারাজ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও আরোপ করা হয়েছে নানা ধরনের বাধানিষেধ। এর বোধকরি দরকার ছিল না। কারণ এখন যেসব টিভি চালু আছে, তার সবই সরকার ও সরকার দলের নিয়ন্ত্রণে। ফলে শুধু বলে দিলেই যথেষ্ট, তারা কোনো কেন্দ্রের ধারে-কাছেও ভিড়বে না। যেমন গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করেন। সাধারণত টিভি চ্যানেলগুলো তার বক্তব্য সরাসরি প্রচার করে। চ্যানেলগুলো সেভাবে তৈরিও ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অদৃশ্য কলকাঠির নির্দেশে তারা বেগম জিয়ার ভাষণ সরাসরি প্রচার করতে পারেনি। ফলে আমরা শুধু এটুকুই বোধকরি, প্রার্থনা করতে পারি, ইসিসহ সব পিয়ন-দারোয়ান দ্বারা পরিচালিত এই নির্বাচন ধারা চিরজীবী হোক।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এখন দোষারোপের সময় নয়


‘এম কে-১১ বাংলাদেশে এলো কিভাবে?’ এমন শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে মানবজমিনে। ২৮ ডিসেম্বর মুদ্রিত ওই খবরে বলা হয়, চট্টগ্রামে ‘জঙ্গি’ আস্তানা থেকে স্নাইপার রাইফেল উদ্ধারের ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, অত্যাধুনিক এ অস্ত্র বাংলাদেশে কোথা থেকে কীভাবে এলো এটিও প্রশ্নের বিষয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, সমাজের মধ্যে বিভাজন-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মসজিদে হামলা করা হচ্ছে। যারাই করুক জেনেশুনে পরিকল্পনা করে করছে। কাদিয়ানী মসজিদে হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে যে ধরনের হামলা হয় সে ধরনের হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, সৌদী সামরিক জোটে বাংলাদেশ যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনলো কি না সেটিও দেখার বিষয়। চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানা থেকে এমকে-১১ রাইফেল উদ্ধার হয়েছে। এ রাইফেল তো সর্বাধুনিক অস্ত্র। এ অস্ত্র জঙ্গিদের কাছে কীভাবে এলো? মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এ অস্ত্র তো খোলাবাজারে কেউ কিনতে পারবে না। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এদিকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনীরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা হলো। এর দায় আইএস স্বীকার করেছে। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ধরনের দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ হলো। এর আগে এত অত্যাধুনিক অস্ত্র বাংলাদেশের জঙ্গিদের হাতে দেখা যায়নি। এটি ভয়াবহ উদ্বেগের বিষয়।
চট্টগ্রামের জঙ্গি আস্তানা থেকে এমকে-১১ রাইফেল উদ্ধারের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাঁরা তাঁদের উদ্বেগের কথা স্পষ্টভাবেই বলছেন। তারা বলছেন, এই ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র ইরাকে ব্যবহার করা হয়। খোলাবাজার থেকে এই অস্ত্র কেনা যায় না। আর কাদিয়ানী মসজিদে আত্মঘাতী হামলার ধরনকে তারা মধ্যপ্রাচ্যে হামলার ধরনের সাথে মিলিয়ে দেখছেন। সব মিলিয়ে এখন তাদের প্রশ্ন, বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো কি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে?
আমরা মনে করি, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা উচিত সরকারের। বর্তমান বিশ্ববাতাবরণে বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসীহামলা হলে কীভাবে মোকাবিলা করবে সরকার? এ জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সরকারের প্রস্তুতিতে তেমন সন্তুষ্ট নন। তারা বলছেন, জঙ্গি আস্তানাগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব যাদের তারা কতটা পারদর্শী? গোয়েন্দাদের দুর্বলতা আছে। তাদের যে মুখ্য কাজ, তারা সেটা বাদ দিয়ে অন্য কাজ করছে। বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, যারা সরকারের সঙ্গে সুর মেলায় তাদের কথা শুনলে হবে না। এ নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক সংলাপের প্রয়োজন। আমরা মনে করি, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে। জঙ্গি হামলার বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নেয়া সঙ্গত হবে না। আর কোথাও হামলা হলে তার সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। এর পরিবর্তে যদি ব্লেমগেমের মন্দ উদাহরণ চলতে থাকে, তাহলে আমাদের সঙ্কট আরো বাড়তে পারে। ভাবতে অবাক লাগে, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জাতীয় স্বার্থে সঙ্কট সমাধানের প্রকৃত পথে চলার পরিবর্তে রাজনীতিবিদরা দোষারোপের রাজনীতি করেন কোন কাণ্ডজ্ঞানে।

শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পৌর নির্বাচন স্বাধীন যথেচ্ছায়ী দলের সাথে ভয়-ভীতি হামলা-মামলায় পিষ্ট দলের লড়াই


নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে পৌরসভার রয়েছে ১০০ বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্য। লর্ড রিপনের শাসনামলে ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল মিউনিসিপাল অ্যাক্ট পাস হয়। গঠিত পৌরসভায় কমিশনারদের দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন। কমিশনাররা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান এবং একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। সময়ের বিবর্তনে পৌরসভার কাঠামো ও নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদবিতে পরিবর্তন এলেও এতদিন তাদের নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
স্থানীয় সরকার বিষয়ে এক সংজ্ঞায় বলা আছে-‘স্থানীয় সরকার সেইসব কার্যাবলী সম্পাদন করে যেগুলো বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ এবং এলাকাটি সমগ্র দেশের তুলনায় ক্ষুদ্র।’ অন্যভাবে বলা যায়, স্থানীয় কাজের জন্যই ‘স্থানীয় সরকার’ থাকে।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার পরিবর্তিত হয়েছে সরকারের একক ইচ্ছায়। এ আইন নিয়ে সংসদে বিশদ আলোচনা যেমন হয়নি, তেমনি সংসদের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও হয়নি। এমনকি স্থানীয় সরকার নিয়ে যাঁরা বহু বছর ধরে অধ্যাপনা এবং গবেষণা করছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হয় নি। তার উদাহরণ মত পরিবর্তন করে শুধু মেয়র পদকে দলীয়করণ করা। শুধু মেয়র পদ হবে দলের, বাদবাকি নির্দলীয়।
দেশে সরকারবিরোধী অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারের সিদ্ধান্তকে দুরভিসন্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচন রাষ্ট্র ও সমাজে বিভাজন তৈরি করবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুই জোটের বাইরে থাকা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এতে করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরও সংকুচিত ও দুর্বল হবে। সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী বিশিষ্টজনদের মতে নির্দলীয় নির্বাচনে প্রার্থী, দল-মত নির্বিশেষে ভোট পাওয়ার আশায় নিজেকে সৎ, সভ্য ও সজ্জন হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকত। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে তা তিরোহিত হবে। রাজনীতির বাইরেও সৎ ও যোগ্য লোক সমাজে আছে। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে এসব সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি তৃণমূল পর্যায়ে সমাজকে নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ পাবেন না। সমাজের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া, দলীয়ভাবে নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্য হবে।
এই আইন ও ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বাদ দিলেও বড় প্রশ্ন হয়েছে, পৌরসভা নামের পরিষদটি কীভাবে পরিচালিত হবে। এখানে যেসব কাউন্সিলর মেয়রের দলের বাইরের হবেন, তাঁদের অবস্থান কী হবে? এ প্রশ্ন আমাদের মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশের জন্য প্রযোজ্য। এখানে স্থানীয় সরকার পরিষদ চলে মেয়রের কৃপায়, সংসদীয় পদ্ধতিতে নয়। আরও বড় ধরনের কারিগরি প্রশ্ন হচ্ছে, দলীয় মেয়রের পরিবর্তে প্যানেল মেয়র কে হবেন? কারণ, দৃশ্যত মেয়রকে দলীয় হতেই হবে। যেভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কলমের এক খোঁচায় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি বিভিন্ন অভিযোগে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত এবং দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়ার আগেই বরখাস্ত হচ্ছেন, তাতে প্যানেল মেয়রের ভূমিকা অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে নির্দলীয় একজন কাউন্সিলর, তিনি যে দলের সমর্থক হোন না কেন, তাঁর আইনি অবস্থান কী হবে? নাকি মেয়রের জায়গায় পুনঃনির্বাচন পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগ হবে, তা অন্তত তথ্যমতে পরিষ্কার নয়।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। পৌরসভার মেয়র নির্বাচন সংসদ সদস্য নির্বাচনের আদলে হলেও নির্বাচনের পরে দলত্যাগের মতো ঘটনা ঘটলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তার কোনো বিধান নেই। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই দুটি বিষয় বিশ্লেষণ করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতীয়মান হয়, তা হলো নির্বাচনের পর মেয়র কেনাবেচা অথবা দলত্যাগ করাতে বেগ পেতে হবে না। এমনকি প্যানেল মেয়রের ক্ষেত্রেও তেমন হতে পারে।
শুধু আইনই নয়, নির্বাচনী বিধিমালাতে রয়েছে কমপক্ষে পাঁচটি দৃশ্যমান জটিলতা। প্রথমটি হলো বিধি ১২-এর উপবিধি (৩) দফা (গ) এর নতুন সংযোজন (BBB)। সেখানে মনোনয়নে দলের একজন প্রার্থীর বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে, যেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর মনোনয়নের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা ও গবেষণা করে করা হয়েছিল, যাতে কোনো দল নির্বাচন থেকে বাদ না পড়ে। পৌরসভার এ বিধিতে কোনো দলের একক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হলে তার পরিবর্তে আর কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন সম্ভব নয়। যেকোনো কারণে প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। শুধু হলফনামার বিবরণ বিশ্লেষণেই বহু প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। এ ধরনের বিধি অত্যন্ত মারাত্মক এবং অগণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত। অপর বিধিটি হলো, স্থানীয় পর্যায়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে ১০০ জনের স্বাক্ষর গ্রহণ। মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা খুব বড় এলাকা ও নি¤েœ লক্ষাধিক ভোটারের আবাস। অপরদিকে বেশির ভাগই গ্রাম্য পৌরসভা, যার ভোটার সংখ্যাও ১০ হাজারের নিচে, সে ক্ষেত্রে গ্রামেগঞ্জে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১০০ জন ভোটার কাউকে সমর্থন করে চিহ্নিত হতে চাইবেন কি না, তা অনুধাবন করা প্রয়োজন ছি।
বিধি অনুযায়ী প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্যদের প্রচার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা অতীতে হয়নি। কারণ, সব সংসদ সদস্যই সংবিধানের আওতায় লাভজনক পদাধিকারকারী নন। এই নির্বাচনের এই বিধি নির্বাচন কমিশন প্রয়োগ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিধি ২০ও একধরনের সমস্যার সমাধান করবে। কারণ, এর আগে স্থানীয় নির্বাচনে কোনো বৈধ প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে সম্পূর্ণ বা কোনো অংশের নির্বাচন প্রক্রিয়া বাতিল হতো না। এ ধারা সংযোজন দুইধারি তলোয়ারের মতো কাজ করবে। আল্লাহ না করুন, মেয়র পদ বাদ দিলেও কোনো ওয়ার্ডের একজন প্রার্থীর যেকোনো কারণে মৃত্যু ঘটলে হয়তো ওই ওয়ার্ডের কারণে মেয়র নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানের আংশিক দলীয় নির্বাচনে কী ধরনের জটিলতা ঘটতে পারে, তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এই নির্বাচন গ্রামাঞ্চলের নির্বাচন, আরবান নির্বাচন নয়। তা ছাড়া, আচরণবিধির বহু বিধিই প্রয়োগ করা কতখানি সম্ভব হবে, তা নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্যের প্রমাণ অবশ্য দেবে। (সূত্রঃ নির্বাচনী শাসন বা পরিচালনা ব্যবস্থা, এম সাখাওয়াত হোসেন, দৈনিক প্রথম আলো ৯ ডিসেম্বর ২০১৫)
বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল পৌরসভার ভোট পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি দাবি করেছিল, সংসদ সদস্যরা যেন ভোটের প্রচারে নামার সুযোগ পান। কিন্তু  কোনো আবদারেই শেষ পর্যন্ত সাড়া দেয়নি নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে ৩০ নভেম্বর কমিশনারদের বৈঠকে আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে পৌরসভায় ভোট ৩০ ডিসেম্বর থেকে না পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ত্যাগ করার সময় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পৌরসভা নির্বাচন একদিনও পেছানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, দলগুলো পেছানোর দাবি করায় আমরা আলোচনায় বসেছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম একদিনও যদি পেছানো যায়, কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই। আর সংসদ সদস্যরাও (এমপি) নির্বাচনে প্রচারণায় যেতে পারবেন না।
কাজী রকিবউদ্দীন বলেন, ২০ ডিসেম্বরও যদি ভোটের সময় রেখে তফসিল করা যেত, পেছানোর সুযোগ থাকত। কিন্তু শেষ সময়ে এসে তফসিল ঘোষণা করতে গিয়ে ৩০ ডিসেম্বরে ভোটের তারিখ রাখা হয়েছে। এতে পর্যাপ্ত সময় রাখা হয়েছে। এরপরও একদিন পেছানো যায় কি না যাচাই করে দেখেছি, কিন্তু সে সুযোগ নেই আমাদের।
তিনি বলেন, যেহেতু আইন সংশোধনের গেজেট আমরা দেরিতে পেয়েছি তাই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা এবং বিধিমালা আমাদের দ্রুততার সঙ্গে করতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় ছিল না। অন্যদিকে, মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণার সুযোগ না দেয়ার যে বিধান সেটিও পরিবর্তন করা এ পর্যায়ে ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন সিইসি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে? অন্য নির্বাচনগুলোতে এ বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বর্তমান সংশোধিত আচরণবিধিতে দলীয় প্রধানের প্রচারণায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী দলীয় প্রধান হেলিকপ্টারে প্রচারণায় যেতে পারবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। তবে সরকারি সুবিধাভোগী হিসেবে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্বাচনী প্রচরণায় যেতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন-প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা, মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়রের কথা বলা রয়েছে।
এক দলের শীর্ষ নেতা প্রচারণায় যেতে পারবেন, অন্য দলের নেতারা যেতে পারবেন না, এমন ভুল কেমন করে হল-জানতে চাইলে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, এটি তো ভুল নয়। এটি একটা বিষয় পরিমাপ করা। আর এটিই তো শেষ নির্বাচন নয়। আমরা অভিজ্ঞতা নেব। যদি দেখি কোনোটা সঠিক হচ্ছে না, তবে অন্য নির্বাচন রয়েছে। তখন এগুলো ঠিক করে নেব। (সূত্রঃ দৈনিক সকালের খবর ১ ডিসেম্বর ২০১৫)
আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা আল্লাহ জানেন। তবে নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে মানুষ আওয়ামী লীগের অতীত সব অপকর্ম ভুলে যাবে।
ক্ষমতাসীনদের এমন আচরণ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, দেশের অনেক স্থানে সরকার দলীয় লোকজন অন্যদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে দেয়নি। যেখানে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সেখানে সরকার নানাভাবে জুলুম নির্যাতন এবং গ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, এই নির্বাচনে কারচুপি হবে জেনেও আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু আমরা জেনে শুনে বিষ পান করতে চাই না। বিগত ঢাকা সিটির মত আরেকটি নির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তারা সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের সহায়তায় সরকারের এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ৬ ডিসেম্বর ২০১৫)
৩ ডিসেম্বর ২০১৫ মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক স্থানেই বিএনপির প্রার্থীরা বাধার মুখে পড়েছেন। আবার মামলা ও গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে থাকায় অনেক প্রার্থীই মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। অনেকের পক্ষে দলীয় কর্মী, সমর্থক ও স্বজন মনোনয়নপত্র জমা দেন।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে জেল-জরিমানা ও প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রয়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৪ ডিসেম্বর ২০১৫)
মূলত নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে থাকেন সহকারী রিটার্নিং ও রিটার্নিং অফিসার। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ক্ষেত্রে আইনে এ দু’জন কর্মকর্তাকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। তাই নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে এ দুটি পদের গুরুত্ব অনেক। তবে নির্বাচন কমিশনের হাতে এক সময় অনেক বেশি আসনে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য সহকারী রিটার্নিং ও রিটার্নিং অফিসার দেয়ার মতো জনবল ছিল না। আর থাকলেও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিয়েই করানো হতো। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে জরুরী অবস্থাকালীন সরকারের সময় ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন এ বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে একযোগে সারা দেশে নির্বাচন পরিচালনা করার মতো নির্বাচন কমিশনের জনবল রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রিটার্নিং অফিসার পদে ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৭৬টিতে মাঠ প্রশাসন থেকে ইউএনও এবং এডিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাকি ৫৮টিতে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়েছে।
ইসির এমন ভূমিকা প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, তাদের সময়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ৫-৭ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা ছোট-বড় অনেক নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করেছেন। কিন্তু নির্বাচনে ইসির লোকবল কম নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ পৌরসভায় রিটার্নিং কর্মকর্তা করায় নির্বাচনে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অতীতের নির্বাচনে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কমিশন যাকে ভালো মনে করবে তাকে নিয়োগ দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে-কমিশন যদি মনে করে, সরকারি দলের লোকজন দিয়ে নির্বাচন ভালো হবে, তার বিচার বিশ্লেষণ জনগণ করবে। তবে সরকারি লোক নিয়োগ দেয়ার ফলে নির্বাচন খারাপ হলে এর দায়িত্ব কমিশনকেই নিতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছেন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা যেভাবে কমিশনের কথা শুনবে, সরকারি কর্মকর্তারা সেভাবে শুনবে না। এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া তিনি মনে করেন, ইসির পর্যাপ্ত জনবল থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আধিক্য বেশি হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ সন্দেহ নির্বাচন কমিশনকেই দূর করতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সঙ্গতকারণে এডিসি এবং ইউএনও দিয়ে কী হবে তা সহজে অনুমান করা যায়। তবে এ কথাও সত্য যে, নির্বাচন কমিশনের হাতে যে জনবল আছে তাদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করার মতো সক্ষমতা আছে। কারণ মধু ও মধুর মতো মিষ্টি এক জিনিস নয়। তিনি বলেন, আসলে প্রধান সমস্যা এখানে না। সমস্যা হল-নির্বাচনের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর কারণ আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। এর মধ্যেই সব প্রশ্নের উত্তর আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেঃ জেনারেল (অবঃ) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক অনেক কথা রয়েছে। এই কমিশন সরকারের একটা ক্যাডার বাহিনী। বলা যায়, তাদের একটা অঙ্গসংগঠন। তবে এই নির্বাচন কীভাবে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটা অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে। এই নির্বাচনের ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতের সংসদ নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচন। তিনি বলেন, বিএনপির অনেক প্রার্থী মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারেননি। নানা অজুহাতে রিটার্নিং অফিসাররা তাদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি। এ ছাড়া যারা নির্বাচন করবেন, তারা প্রকাশ্যে বের হতে পারছেন না। নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মীরা বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমার শিকার হচ্ছেন। এখানে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেনি নির্বাচন কমিশন। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৬ ডিসেম্বর ২০১৫)।
জিবলু রহমান 

বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্মৃতিময় রবিউল আউয়াল


রবিউল আউয়ালের এমনি এক দিনে এমন এক যুগে মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটেছিল, যখন বিশ্বের অন্য সব দেশ ও অঞ্চলের মতো সৌদি আরবও অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল বৈষম্য, হানাহানি। গোটা আরবের মানুষ ছিলেন মানবেতর অবস্থায়। নানা দেব-দেবীর পূজা করতেন তারা। সব মিলিয়েই ওই সময়কালকে বলা হয়েছে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’। অর্থাৎ অন্ধকারের যুগ। অমন এক সমাজে জন্ম নিলেও ছেলেবেলা থেকেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একজন ব্যতিক্রমী ও আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। সাদাসিধে, কিন্তু অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুহাম্মদ (সা.) কৈশোরেই পেয়েছিলেন ‘আল আমীন’ বা বিশ্বাসী হিসেবে সম্মান ও পরিচিতি। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুওত লাভ করেন। নবী (সা.)-এর উপর আল্লাহর তরফ থেকে প্রথম বাণীই ছিল : ‘ইক্বরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ ছিল প্রথম কালাম যার অর্থ, ‘পাঠ করো, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি রক্তপিন্ড থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করো, তোমার রব (প্রতিপালক) মহামহিম, মানুষকে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষ যা জানতো না।’ নবুওয়াত শুধু নয়, সর্বশেষ নবীর মর্যাদাও পেয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা.)। সত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আত্মরক্ষামূলক অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁকে। নিজের জন্মভূমি মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে মদিনায় হিজরত করেছেন তিনি। কিন্তু আল্লাহর পথ থেকে সামান্যও সরানো যায়নি তাঁকে। মদিনায় তিনি প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধানও তিনিই দিয়েছিলেন। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষকে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়। বলা হয়েছিল, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সম্পত্তিতে অধিকার দেয়াসহ নারীকেও তিনি উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে গেছেন। মেয়ে শিশুকে হত্যা এবং বিয়ে না করে নারীর দেহভোগকে নিষিদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিয়ে ও পারিবারিক উত্তরাধিকার পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ইসলামে। সব আইন ও বিধানের উৎস কুরআন এবং সুন্নাহ। আর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনকে বলা হয়েছে, আল কুরআনের প্রতিচ্ছবি। তাই তাঁর জীবন সব মানুষের জন্যে অনুসরণীয় মডেল।
ইসলাম প্রচলিত অর্থের সাধারণ কোনো ধর্ম নয়, বরং ইসলাম পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনবিধান। ব্যক্তির জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ের দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। আর ইসলাম শব্দটির অর্থই শান্তি। বিচ্ছিন্ন বা খন্ডিতভাবে না দেখে সামগ্রিক পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সব অশান্তি, সব ফ্যাসাদ থেকে মানুষকে মুক্ত করা ও সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে একমাত্র রাসূল (সা.)-এর আদর্শই পারে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রচারিত আদর্শ ইসলামই পারে শোষণ-বৈষম্যসহ সব অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে সংঘাতে বিপন্ন বিশ্বকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বর্তমান বিশ্বে একদিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানো হচ্ছে; অন্যদিকে ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ আন্দোলনের পরিবর্তে মুসলমানদেরও অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে সীমা লঙ্ঘনের পথে পা বাড়াচ্ছে। এর ফলে মুসলমানদের চিহ্নিত করা হচ্ছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হিসেবে। শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে প্রশংসিত হয়ে আসা বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানদের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর অভিযোগ উঠছে। এই অজুহাতে দুনিয়ায় ইসলামের বিরুদ্ধে যেমন অপপ্রচার চলছে, তেমনি আমাদের নানা রকমের সাজানো অভিযোগ তুলে ইসলামী আদর্শ, ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল করে দেয়ার ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি আমরা মনে করি, অশুভ উদ্দেশ্যে চালিত হওয়ার পরিবর্তে ইসলামবিরোধী সব পক্ষের উচিত পবিত্র ইসলামের নিকটবর্তী হওয়া এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করা। তাহলেই ইসলাম সম্পর্কে সব ভুল ধারণার অবসান ঘটবে। রাসূল (সা.)-এর জন্মগ্রহণের মাস উপলক্ষে আমাদের আহ্বান, আসুন, ইসলাম সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করি এবং ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং আল্লাহর রাসূল নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে আমরা ‘উসওয়াতুন হাসানা’ খুঁজি।

সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মানবাধিকার আসলে প্রচারণার বিষয় নয়


মানবাধিকার নিয়ে আলোচনার কমতি নেই বর্তমান বিশ্বে। এত আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতির পরেও বিশ্বে মানবাধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না কেন?- এমন প্রশ্নের আকার দিন দিনই বড় হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো তো মানবাধিকারের ব্যাপারে বেশ সোচ্চার। আর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি তো বিশ্ব-মিডিয়ায় বেশ ফলাও করে প্রচার হয়ে থাকে। কিন্তু খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই মানবাধিকার নিশ্চিত হয়েছে কি? যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা কর্মস্থল, স্বাস্থ্যসেবা থেকে কারাগার- সব ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত ১১ ডিসেম্বর বিশ্ব সংস্থার মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, নারীর সমতা প্রতিষ্ঠায় ওবামা প্রশাসন প্রশংসিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ‘প্রবল মেরুকরণ’-এর পরিপ্রেক্ষিতে নারী অধিকারের বিষয়টি অবজ্ঞার মধ্যেই রয়ে গেছে।
বিশ্ব সংস্থার মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। বিবৃতিটিতে বলা হয়, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অভিবাসী নারী শ্রমিক, আফ্রিকান-আমেরিকান, স্প্যানিশ ও স্থানীয় নারীরা বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। শারীরিকভাবে অচল নারীদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার সময় গ্রেফতার হওয়া নারীদের অবস্থাও করুণ। পর্যবেক্ষণে আরও উঠে এসেছে যে, কর্মস্থলে পুরুষ সহকর্মীদের চেয়ে কম বেতন পাওয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক নারীই মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও তারা বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালে প্রসবকালীন মৃত্যুর হার ১৩৬ শতাংশ বেড়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে এ ঝুঁকি ৪ গুণ বেশি। ক্লিনিকে মায়েদের হয়রানির শিকার হওয়া এবং আন্তরিক চিকিৎসাসেবা না পাওয়ারও প্রমাণ মিলেছে বিশেষজ্ঞদের পরিদর্শনের সময়। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে মার্কিন প্রশাসনের দৃঢ় অঙ্গীকার সত্ত্বেও বন্দুক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ আইন না থাকায় নারীরা প্রচণ্ড হুমকির মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারসমূহে নারী কয়েদিদের মানবাধিকার বলতে কিছুই নেই বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্বের যে ৭টি দেশ এখনও নারীর প্রতি বৈষম্যসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করেনি, যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম। এই উদাহরণ থেকে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির একটি পরিচয় পাওয়া যায়। মানবাধিকার আসলে কোনো প্রচারণার বিষয় নয়, মানবাধিকার কোনো পণ্যও নয়। মানবাধিকার আসলে একটি নৈতিক বিষয়। মানুষের মধ্যে যদি নীতিবোধ না থাকে তাহলে সে অন্যের অধিকার নিশ্চিত করবে কীভাবে? নীতিবোধের অভাবে মানবাধিকার বিষয়টি এখন প্রচারণা ও প্রহসনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আদর্শ ও নীতিবোধের অভাবে বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার বিষয়টি যত উচ্চকণ্ঠে প্রচার করা হচ্ছে, ততই যেন মানবাধিকার পদদলিত হচ্ছে। বিশ্বের দেশে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অনাকাক্সিক্ষত এই পরিস্থিতি দূর করতে হলে প্রথমেই মানবাধিকারের প্রবক্তাদের প্রহসনের কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। বিষয়টি তাদের না বোঝার কথা নয়।

রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নাটক ও বাস্তবের ক্ষমতার আবর্ত


বাস্তবের জীবনে ক্ষমতার আবর্তন এক চিরচেনা বিষয়, যা কখনো কখনো নাটকের আবহে মঞ্চায়িত হয়। যেমন, কালজয়ী নাট্যকার শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন ‘টুয়েলফ্থ নাইট’। ভারতের  ব্রাত্য বসুর পুনর্লিখন করলেন ‘মুম্বাই নাইট্স’। রঙ্গমঞ্চ কীভাবে ক্ষমতার কাঠামোয় অন্তর্ঘাত করতে পারে, চার শতাব্দীর ব্যবধানেও সেটা খেয়াল না করে উপায় নেই। রাজনৈতিক নাটকের এমন রূপান্তর বিশ্বের নানা দেশে ও নানা সময়েই সম্ভব। কারণ, নাটক যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে বলতেই হবে যে, সে জীবনের অনেকটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে রাজনীতি। কারণ, সহস্রবর্ষ পূর্বে পণ্ডিত এরিস্টোটোল স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়ে গেছেন, “মানুষ আসলে রাজনৈতিক জীব।” আর রাজনীতির ভেতরে গোত্র, গোষ্ঠী, পরিবার বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় ক্ষমতার বৃত্ত। অতীতেও যেটি ছিল সত্য, বর্তমানে সেটা হয়েছে চরম সত্য। যে কারণেই ইতিহাসে বার বার স্বৈরতান্ত্রিক হিটলার, স্ট্যালিনের মুখ নানা ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আশ্রয় করে আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে।
শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকটি সম্ভবত ১৬০১ সালে লেখা। ওই বছর বড়দিনের পর দ্বাদশ রজনীতে, অর্থাৎ এপিফ্যানি-র রাতে, যে তারিখে তিন প্রাজ্ঞ পুরুষ সদ্যোজাত ত্রাতাকে দেখতে বেথল্হোমে তীর্থ করতে আসেন, রাণি এলিজাবেথ হোয়াইটহল  প্রাসাদে অর্সিনো নামের এক ইতালীয় অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান। রাজসভার আপ্যায়নের অন্যতম অঙ্গ ছিল শেক্সপিয়ারের দল ‘লর্ড চেম্বারলেন্স’ প্রযোজিত এক নাটক। অভ্যাগতদের নামের সঙ্গে ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকের এক প্রধান চরিত্রের নামের মিল রয়েছে, সে আবার ডিউক, তার সামাজিক কদর গল্পে সব চাইতে বেশি। তা ছাড়া নাটকের নামের ব্যাখ্যা গল্পে নেই, হয়তো মঞ্চায়নের উপলক্ষের মধ্যে রয়েছে। ৬ জানুয়ারির ধার্মিক তাৎপর্য গুরুগম্ভীর, কিন্তু তার উদযাপনের ধরনটি উৎসবের, অন্তত বেশ কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর সঙ্গে রাজনীতির কিছু বিষয়ও অস্পষ্ট নয়।
সাহিত্যের ইতিহাস অনুযায়ী, আইনের পড়ুয়া জন ম্যানিংহ্যাম-এর রোজনামচা থেকে জানতে পাই যে, তাঁর আইনের বিদ্যাপীঠ মিডল টেম্পল-এ নাটকটি তিনি দেখেন ১৬০২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, নাটকটি রচনার পরের বছরই। ও-দিনও আবার গির্জার পঞ্জিকায় অনুষ্ঠান বা পরবের দিন। সে-দিন ক্যান্ডলমাস উপলক্ষে মোমবাতি জ্বালানো হয়, কারণ ওই তারিখে যিশুর জন্মের চল্লিশ দিনের মাথায় জেরুজালেমের মন্দিরে পুরোহিতদের কাছে তাঁকে হাজির করেন তাঁর মা। এই উৎসবের বাতাবরণেই নাটকের বিস্তার।
নাটকটির সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক তাই সব দিক থেকেই নিবিড়। রাজসভায় অভিনীত নাটকে রাজনীতির প্রসঙ্গও সংলাপে দুর্লভ নয়। শেক্সপিয়ার এই দু’টি মাত্রাকে আলাদা করে রাখেননি, কমেডি ও ট্র্যাজিক সম্ভাবনাও মূল নাটকে প্রায়শই একাকার। সামাজিক বিভাজন একটি ছিল গল্পে। উপরতলার প্রেম-প্রতিহিংসার বৃত্ত আভিজাত্য ও কাব্যিক সংলাপে প্রকাশ, আর নিচুতলার দুনিয়ায় সেই একই প্রসঙ্গগুলি হুল্লোড় এবং অভব্য গদ্যের আবহে ঘেরা। এতে সমাজের বিভক্ত অংশের মানুষের উৎসব, অনুষ্ঠান, আচার-আচরণ এবং রাজনৈতিক চিন্তা ও ভঙ্গির প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে। হাস্যরস, করুণরস ইত্যাদির সঙ্গে হালকাভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্ম এবং রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ। এতেই নাটকটি সাধারণ বা গতানুগতিক মাত্রার চেয়েও বেশি গভীরতা এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।
অন্যদিকে, শেক্সপিয়ারের চারশত বছর পরে রচিত ‘মুম্বাই নাইট্স’ নামের পুনর্লিখনে নাট্যকার ব্রাত্য বসু বিন্যাসটি ধরেছেন নিপুণ ভাবে। মিনার্ভা রেপর্টরি থিয়েটার প্রযোজিত নাটকটিতে রাজনীতি, প্রেম ও হিংসার বিকল্প পটভূমি হল মুম্বই চলচ্চিত্রের জগৎ এবং তার সঙ্গে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাজশ। কমিক হুল্লোড় জমিয়ে তোলার খাতিরেও শেক্সপিয়ার ইতালীয় কোম্মেদিয়া দেল্লার্তে-র খড়ের কাঠামোর উপরে লাগিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য ধারালো সংলাপ ও চরিত্রায়ণের প্রলেপ। ব্রাত্যর নাটকে জমাট মজার আশ্রয় মুম্বই ফিল্মে মনোরঞ্জনের রকমারি মশলার ঝাঁঝালো মিশেল। সামাজিক বিভাজনটি বাংলা নাটকটিতেও ঠিক দৃঢ় নয়। এই দুই মহলের মধ্যে সেতুর কাজ করেছে পারিবারিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার রফা, এবং সূত্রধর-সদৃশ একটি গাইড চরিত্র।
‘মুম্বাই নাইট্স’ বাংলা থিয়েটারে শেক্সপিয়ার-চর্চায় এক নতুন খবর। শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকে যে লৌকিক-লোকোত্তরের সন্ধি, গদ্য ও কাব্যের যে রৌদ্ররাত্রির  খেলা, তার সঙ্গে টক্কর দূরস্থান, অনুকৃতির চেষ্টাতেও প্রবৃত্ত হননি ব্রাত্য। তিনি কাজে লাগিয়েছেন ব্রেখ্ট-এর ‘মজা’। প্রমোদ-ব্যবসার সঙ্গে যখন হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের যোগ প্রায় ওতপ্রোত, তখন সেই ‘মজা’ আর স্রেফ হিন্দি ছবির গান, সম্মেলক নাচ, মঞ্চসজ্জা, কোরিয়োগ্রাফি ও কোরাস-সদৃশ ব্যান্ডের ব্যবহারের অজুহাতে সীমিত থাকে না। তামাশার ছলে সাম্প্রদায়িকতা বা যুদ্ধবাজ রাজনীতির প্রসঙ্গ তাই কোনো সময়েই আরোপিত বলে মনে হয় না।
ইংরেজি নাটকটির কথা উঠলেই ভাষ্যকাররা একটি শব্দ ব্যবহার করেন: মেলানকলি বা বিষাদ। জুডি ডেন্চ এক দশকের বেশি ফারাকে ভায়োলা-র ভূমিকায় অভিনয় করেন বিলেতে, ১৯৫৭ সালে ওল্ড ভিক প্রযোজনায়, আবার ১৯৬৯ সালে জন বার্টন-এর নির্দেশনায় রয়াল  শেক্সপিয়ার কোম্পানির হয়ে। তিনি লিখেছেন, প্রথমবার মঞ্চসজ্জা ও পোশাকের প্রধান রং ছিল হেমন্তের, বাদামি ও হালকা লাল, দ্বিতীয়বার বসন্তের সবুজ ছিল বেশি। নাটকের সময়কাল শীত হলেও প্রেমের বিচিত্র প্রমাদ হেমন্তের কুয়াশাজনিত বলে ভ্রম মনে হতে পারে, আবার বসন্তের স্বপ্ন বলেও হাজির করা যায়। প্রতীচ্যের শিল্পে প্রেমের এই মায়ার খেলা,  যার মধ্যে সমকামিতার ইঙ্গিত মিশে আছে,  প্রায়শ কৌতুক ও উল্লাসের ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছে, যেমন মোৎসার্টের ‘ফিগারোর বিবাহ’ অপেরায়।
সমাজের নানা প্রসঙ্গের এই মিশেলের তাৎপর্য মোক্ষম ধরেছেন ব্রাত্য বসু। ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ নাটকে শেক্সপিয়ারের প্রতিভায় বিষাদ ও কৌতুক, সূক্ষ্মতম কাব্য ও স্থূলতম হুল্লোড়, প্রেম ও হিংস্রতা, ক্ষমতা ও দ্বন্দ্ব সামাজিক জীবনের মৌলিক উপাদান, এদের পৃথক করলে জীবন, সমাজ ও রাজনীতি বিমূর্ত বিষয় হয়ে পড়ে। মুম্বইয়ের রাস্তায় জনস্রোত, গণেশ চতুর্থীর শোভাযাত্রা, ক্রিকেট, অপরাধ জগৎ, বিনোদন ব্যবসা এবং হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতি তেমনই এক সূত্রে গাঁথা বাংলা ভাষ্যটিতে। পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের রাজনীতির কারসাজি কী ভাবে ফাঁস করে দিতে পারে কমেডি, সেই পাঠটি ব্রাত্য বসু নিয়েছেন ইংরেজ নাট্যকারের থেকেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে দেশজ বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তুতে আত্মস্থ করার মাধ্যমে চিরায়ত নাটকের বিস্তার সমকালেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন রূপান্তর বিশ্বের নানা দেশেই সম্ভব। কারণ, গণতন্ত্রের দামামা বাজানো হলেও স্বৈরতন্ত্রের প্রচ্ছায়া একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায় নি বিশ্বের নানা দেশ ও সমাজ থেকে। এখনো ক্ষমতার নানা রঙ-তামাশা গবেষকদের মনোযোগের বিষয়।
উল্লেখ্য, শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর পরেই ১৬২৩ সালে ‘টুয়েলফ্থ নাইট অর হোয়াট ইউ উইল’ নাটক নামের হেঁয়ালি ছেড়ে ‘মালভোলিয়ো’ নামে মঞ্চস্থ হয়। মালভোলিয়ো ধনী অলিভিয়ার ঘরদোরের নিয়মরক্ষী, বেনিয়মের কড়া শত্রু। এর এক দশকের মধ্যেই ইংল্যান্ডের দোরগোড়ায় গৃহযুদ্ধ। ক্রমশ রাজতন্ত্রবিরোধীদের নেতৃত্ব চলে যায় মালভোলিয়োদের হাতে, ১৬৪২ সালে হুল্লোড়ের দুশমনরা দেশের সব থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে দেয়। পৃথিবীর নানা দেশেও কি তুলনীয় পরিস্থিতি আসন্ন কিনা, সে প্রশ্ন নাটকের পর্বে পর্বে ছড়ানো, যার প্রতিচ্ছবি রয়েছে বাস্তবের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রঙ্গমঞ্চের অন্তর্ঘাতী সম্ভাবনাটি অন্তত ভুলতে দেন না নাট্যকার-নির্দেশক। কমেডির প্রাণকেন্দ্রে হাসি ও নিষ্ঠুরতার যে সমবায়, তা অসামান্য অভিনয়ে টানটান ধরে রাখেন মালভোলিয়ো চরিত্র, যিনি ব্রিটিশ ইতিহাস ও রাজনীতিরও এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
কিছুটা মদত ও মেধাবী নির্দেশনা পেলে মঞ্চে কিন্তু বাস্তবের প্রতিফলন চমৎকারভাবে করা সম্ভব। শেক্সপিয়ার সে পথ দেখিয়ে গেছেন। ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশ সে পথ ধরে সমসাময়িক বহু ঘটনার নাটকীয় রূপান্তর সাধন করেছেন। ‘টুয়েলফ্থ নাইট’ এবং ‘মুম্বাই নাইট্স’ তার উজ্জ্বল নমুনা অনুসরণ করে অনেক দেশের বহুবর্ণা, চিত্র-বিচিত্র রাজনীতির রূপায়ণ খুবই সম্ভব। বিশেষত, হিটলার-পরবর্তী যুগে ঘাপটি-মারা বহু হিটলার যেমন রক্তপানের উন্মাতাল নেশায় বিশ্বের স্থানে স্থানে নখর বিস্তার করছে, তখন রাজনৈতিক নির্মম-বাস্তবতার অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে মানুষকে দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। ভয়ে যখন মানুষ সরাসরি সেসব কথা বলতে পারে না, তখন নাটকের আশ্রয় নেয়। এভাবেই বাস্তবে আর নাটকে জীবনের সত্য উদ্ভাসিত হয়। ক্ষমতার গোপন আবর্ত প্রকাশ্যে দেখা যায়। শেক্সপিয়ারের দেখিয়ে দেওয়া পথে সে কাজ এখনো করছেন বিশ্বের নানা দেশের নাট্যকারগণ। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেও তা চলতে থাকবে। শুধু স্থান, কাল, পাত্র বদলে যাচ্ছে মাত্র!

শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নেপাল যা করছে বাংলাদেশ সেটি পারেনি


নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি গভীর বেদনার সাথে বলেছেন যে, ভারত তাদের অর্থাৎ নেপালের সমস্ত স্বপ্ন চূরমার করে দিয়েছে। তিনি নেপালের ওপর আরোপিত ভারতের অঘোষিত অবরোধের কথা বলছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রায় ৩ মাসেরও বেশি সময় হলো, নেপালের ওপর ভারতের এই অঘোষিত অবরোধ চলছে। এতদিন ধরে নেপালে জ্বালানি সরবরাহের একমাত্র উৎস ছিল ভারত। এ ছাড়া বিদেশ থেকে যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নেপালে আসে সেগুলো ভারতের ওপর দিয়েই আসে। এখন ভারত এই জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি নেপালে সরবরাহের প্রবেশ মুখগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে নেপালে দেখা দিয়েছে হাহাকার। তারপরেও এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত নেপাল ভারতের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি। বিগত প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের পর নেপাল রাষ্ট্রটি এমনিতেই বিধ্বস্ত। তার ওপর ভারতের এই অঘোষিত অবরোধ নেপালের জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপরেও নেপালের সরকার ও জনগণের স্বাধীন চেতনার প্রতি অভিনন্দন। নতি স্বীকার করার পরিবর্তে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভারতের সব ধরনের সিনেমার প্রদর্শন নেপাল বন্ধ করে দিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমগ্র নেপালে ভারতের সব ভাষার ছবি বিশেষ করে হিন্দি ছবির রয়েছে একচেটিয়া বাজার। নেপাল প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত দেশ। ভারতও হিন্দু প্রধান দেশ। তৎসত্ত্বেও ভারতের সংবিধানে রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। কিন্তু নেপালে বিগত ৬০/৬৫ বছর ধরে রাষ্ট্র ধর্ম ছিল হিন্দু। পৃথিবীর আর কোন দেশে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে হিন্দু ধর্ম চালু নাই। এই তো সেদিন নেপালের নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয়েছে। সেই সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদস্থলে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। নেপালে ভারতীয় মুদ্রা শুধু মাত্র সহজেই বিনিময় যোগ্য নয়, বরং সমগ্র নেপালে দ্রব্য সামগ্রী কেনা বেচার জন্য নেপালী মুদ্রার পাশাপাশি ভারতীয় মুদ্রাও চালু রয়েছে। যেখানে দুই দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বন্ধন অবিচ্ছেদ্য, সেখানে নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নেপাল ভারতীয় সিনেমা বন্ধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
ভারতের অবরোধ আরোপের কঠোর সমালোচনা করে প্রতিবেশী দেশ নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি বলেছেন, ‘হিমালয়ের দেশকে উন্নতির ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার যে বাসনা ছিল সেই বাসনা (স্বপ্ন) ভেঙে খান খান করে দিয়েছে ভারতের অবরোধ।’ দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা থেকে উত্তরণে নেপালের শিক্ষাবিদদের একটি স্মারকপত্র রোববার হাতে পাওয়ার পর তিনি বলেন, নেপালকে উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার যে পরিকল্পনা ছিল সেটি মেঘে ঢেকে গেছে। সোমবার এ খবর প্রকাশ করেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। ২৫ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ওই ভূ-কম্পনে প্রায় ১০ হাজার লোক নিহত হন। নির্বাচনে জয়লাভের পর অলি বলেছিলেন, তিনি বহু জাতির একটি দেশ গড়ে তুলবেন। দৈনন্দিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূর, কাঠমান্ডুতে আধুনিক বৈদ্যুতিক যান চালু এবং স্বনির্ভর অর্থনীতির ওপর দেশকে দাঁড় করাবেন তিনি। রোববার হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘প্রধান মন্ত্রী হওয়ার আগে আমি বেশকিছু স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি কঠিন দুরবস্থার মধ্যে প্রধান মন্ত্রী হলাম। যখন ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ক্ষত দূর করার চেষ্টা করছি, তখন সীমান্তে মারাত্মক একটি ঝড় ফের আমাদের আঘাত হানল। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে সেই ক্ষত ও ভোগান্তি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’ নেপালের নতুন সংবিধানে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এমন অভিযোগে দেশটির সংখ্যালঘু মধেশী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের কারণে ভারত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। দেশটি থেকে নেপালে আসা তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ট্রাক আটকা পড়ে। এরপর ভারত নেপালে তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়।
ভারত নেপাল সাম্প্রতিক বিরোধের উৎপত্তি কোথায়, সেটি জানা দরকার। নেপালবাসীদের দুর্ভাগ্য যে, দেশটির ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এই দেশটি তিনবার ঝড় ঝাপটার শিকার হয়েছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে দেশটির ওপর দিয়ে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এই ভূমিকম্পে ১০ হাজার লোক নিহত হয়। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই দেশের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে শুরু হয় প্রচ- রাজনৈতিক গোলযোগ। এই গোলযোগে ৪০ ব্যক্তি নিহত হয়। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগে তার দক্ষিণের বিশাল প্রতিবেশী তার ওপর আরোপ করেছে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবরোধ।
এতসব ঝড় ঝাপটার পরও বিগত ৭ বছর ধরে সারা দেশে তীব্র বাদানুবাদের পর অবশেষে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ নেপালে চালু হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান। দেশটির নতুন নামকরণ হয়েছে ‘ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব নেপাল’ বা ‘ যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক নেপালী প্রজাতন্ত্র’। বলাবাহুল্য, বোধগম্য কারণেই এই সংবিধান চালুর ফলে নেপালের বর্তমান সরকারের ওপর প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়েছে তার বিশাল প্রতিবেশী ভারত। আর এই ক্ষিপ্ততার কারণেই সংবিধান চালুর মাত্র ৩ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর চতুর্দিকে স্থল পরিবেষ্টিত দেশটির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করেছে ভারত।
॥দুই॥
কেন ভারত নেপালের ওপর চটে গেছে? কারণটি হলো এই যে, নতুন সংবিধান যেহেতু ফেডারেল চরিত্রের তাই ফেডারেশনের মূলনীতি হিসেবে দেশটিকে ৭ টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে। দেশটির মধেশী, থারু এবং জনজাতি - এই তিনটি নৃতাত্বিক সম্প্রদায় এই শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা মনে করে যে, এই শাসনতন্ত্র তাদের সাম্প্রদায়িক আকৃতিকে আরও খর্ব করবে। এদের মধ্যে মধেশীদের জন্য ভারদের রয়েছে প্রবল টান। কারণ এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হলো ভারতে। ভারতের বিহার রাজ্যের টেরাই অঞ্চলে তাদের বাস। নেপালের অধিকাংশ মানুষ পার্বত্য উপজাতীয় হলেও মধেশীরা সমতল ভূমির। তাদের সংস্কৃতিও আলাদা। নেপালে ২ কোটি ৭০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মধেশীরা ৫০ শতাংশ বলে ভারতীয় পত্র পত্রিকার দাবি। বাইরে থেকে দেখলে বিষয়টিকে মনে হবে, এই বিবাদ সমতল ভূমির মানুষ এবং পাহাড়ীদের মধ্যে বিবাদ। যারা পাহাড়ী তাদের মধ্যে রয়েছে উচ্চবিত্ত হিন্দু, যারা নেপালের সমগ্র জনগোষ্ঠির ১৫ শতাংশ। এরাই রাজধানী কাঠমান্ডুতে বসে সমগ্র নেপালকে এ পর্যন্ত শাসন করে এসেছে।
নেপালের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো এই যে, তার প্রায় সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আসে ভারত সংলগ্ন নেপালগঞ্জ, বীরগঞ্জ, জানকপুর এবং বিরাট নগর সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে। নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে মধেশীরা সেই রাস্তাটি অবরোধ করে রাখে যে রাস্তা দিয়ে ভারত থেকে দ্রব্যসামগ্রী নেপালে প্রবেশ করে। যদিও ভারত অস্বীকার করেছে তবুও বাস্তব ঘটনা হলো এই যে, ভারত খুব চাতুর্যের সাথে এই অবরোধ চালু রেখেছে। তারা প্রকাশ্যে বলছে না যে, তারা নেপালের ওপর অবরোধ জারি করেছে। কিন্তু তলে তলে তারা সীমান্তে কর্মরত ভারতীয় কর্মকর্তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নেপালে পণ্যসামগ্রী পরিবহনকারী যান বাহনকে ঢুকতে না দেয়।
যখন নেপালে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া চলছিল তখন মধেশীদের দাবি দাওয়া পূরণের জন্য ভারত বারবার নেপাল সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছিল। সংবিধান জারি করার আগে ভারত নেপাল সরকারকে বার বার বলেছে যে ধীরে চলো। কারণ, সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই শাসনতন্ত্রের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা শাসনতন্ত্রের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপালোচনা শুরু করেন এবং শাসনতন্ত্র চালু করেন। পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তারা ভারতীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি এবং ভারত যে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করতে বলেছিল সেটিও তারা শোনেননি। আর এ কারণেই ভারত ক্ষুব্ধ হয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষেকগণ মনে করেন।
॥তিন॥
এখানে কয়েকটি তারিখ লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো, সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব জয় শংকর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে কাঠমান্ডু গমন করেন। তিনি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান প্রশ্নে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য নেপালের সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দকে বলেন। তিনি তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেন যে, নেপালে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে সেটি ভারতেরও কোনো কোনো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ পুলিশী জুলুম থেকে বাঁচার জন্য অনেক মধেশী ভারতের বিহার রাজ্যে স্মরণার্থী হিসাবে আসছে। আর একই সময়ে অর্থাৎ ১২ অক্টোবর বিহারের বিধানসভা গঠনের জন্য পর্যায়ক্রমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে নেপালের নেতৃবৃন্দ তাদের অবস্থানে অটল থাকেন। এ পর্যায়ে দিল্লী নেপালকে প্রস্তাবিত সংবিধানের ৭টি অনুচ্ছেদ বাতিল করার দাবি জানায়। এসব দাবির মধ্যে একটি হলো, যেসব ভারতীয় নারী নেপালীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে তাদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাকে নেপালী নাগরিকত্ব প্রদান করা। দ্বিতীয় দাবি হলো, জনসংখ্যার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি দেয়া হোক। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মধেশীরা নেপালী জন গোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী। এই দাবি মানা হলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালীরা নেপালের রাজনীতি এবং প্রশাসনে প্রাধান্য পায়। অপর একটি দাবি ছিল, জন সংখ্যার হার মোতাবেক নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হোক। এটি করলে মধেশীরা বেশি সংখ্যক নির্বাচনী এলাকা পাবে। পরবর্তী দাবি ছিল, পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হোক জনসংখ্যার ভিত্তিতে। এই দাবি যদি নেপালীরা মেনে নেয় তাহলে মধেশীরা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে। তার পরের দাবিতে বলা হয় যে, জন্মগত ভাবে যারা নেপালী নাগরিক শুধুমাত্র তারাই প্রেসিডেন্ট বা প্রধান মন্ত্রী হতে পারবেন সেই ব্যবস্থা বাতিল করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নেপালে বাস করছে এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেপালের নাগরিকত্ব লাভ করেছে তাদেরকেও প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
এগুলো ছাড়াও আরও কিছু দাবি দাওয়া ভারত নেপালকে মানতে বলেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের সবগুলো দাবিই নেপালের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের শামিল। এসব দাবি যদি নেপাল মেনে নিত তাহলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালীদের মাধ্যমে ভারত নেপাল শাসন করতো। কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এই সব দাবি মেনে নিতে পারে না। তাই নেপালও মেনে নেয়নি। এজন্যই শুরু হয়েছে ভারতের সাথে নেপালের তীব্র বিরোধ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নেপালের জনসংখ্যার চেয়ে সাড়ে ৫ গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ নেপালের মতো পারেনি। কিন্তু আয়তন এবং জনসংখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ছোট এবং দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় অন্যায় আবদার মেনে নেয়নি। এখানেই এই দুটি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে মৌলিক তফাত।

শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেশকে ১০০ বছর পিছিয়ে দেয়ার সেই খলনায়ক


ইতিহাস মাঝেমধ্যে স্মরণ করতেই হয়। কেবল ইতিহাসপ্রীতির কারণে নয়, কোনো না কোনো সময় ঘটনা বা উপলক্ষও কাজ করে আশু কারণ হিসেবে। এসব ঘটনা বা উপলক্ষের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সে রকম অনেক কারণই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সব কিছু নিয়ে আলোচনা না করাই উত্তম, নিরাপদ তো বটেই! এবারের নিবন্ধে বরং এদেশের অনেক বিশিষ্টজনের প্রিয় দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে পাওয়া এবং কিছুটা পুরনো হয়ে যাওয়া একটি  খবরের উল্লেখ করা যাক। ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকে গত ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন পর জনসমক্ষে এসে ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠীর প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদ। খবরে ভদ্রতা করে ‘বিব্রতকর’ কথাটা বলা হলেও বাস্তবে বাংলাদেশীদের ধাওয়ার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ঘটনাস্থল ছিল জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার মসজিদ। সেখানে ১৩ নভেম্বর প্রথম দফা জুমার নামাজে অংশ নিয়েছিলেন ফখরুদ্দিন আহমদ। পরে জানা গেছে, জুমার আড়ালে প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল আবদুল মুনিম চৌধুরী নামের এক বাংলাদেশীর জানাযায় অংশ নেয়া। মরহুম চৌধুরী তার বন্ধু ছিলেন। সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল মসজিদ কমিটির সম্পাদক ফখরুদ্দিন আহমদের নাম ঘোষণা করার পর। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, মরহুমের বন্ধু হিসেবে বক্তব্য রাখবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা।
আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশী মুসল্লীরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ‘শখ’ মিটে গিয়েছিল ফখরুদ্দিন আহমদের। বক্তব্য রাখার সুযোগ পাওয়া দূরের কথা, তিনি এমনকি মসজিদের ভেতরেও থাকতে পারেননি। মসজিদ কমিটি কোনোভাবে তাকে বাইরে নিয়ে অপেক্ষমাণ একটি গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল। তখনও প্রতিবাদী স্লোগান এবং তুমুল বিক্ষোভ চলছিল। বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করে বলছিলেন, এই লোকটি দেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন এবং বাংলাদেশকে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে এসেছেন। দেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার দায়েও অভিযুক্ত করেছেন বিক্ষোভকারীরা। কোনো কোনো খবরে ইঙ্গিতে গলা ধাক্কার কথাও জানানো হয়েছে। উপস্থিতজনদের কাছে জানা গেছে, শারীরিকভাবে ‘উত্তম-মধ্যম’ না খেলেও ধাওয়া তিনি ভালোই খেয়েছেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে গোপনে কেটে পড়ার পর তিনি নাকি সেদিনই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশীদের প্রকাশ্য কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন।
এই ‘মধুর’ অভিজ্ঞতা তাকে আদৌ অনুতপ্ত করবে কি না এবং নতুন করে চিন্তার খোরাক যোগাবে কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বড় কথা, তার নতুন কোনো চিন্তার খবরে আমাদের অন্তত খুশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, দেশের ক্ষতি যা করার তা তিনি সুচিন্তিতভাবেই করে গেছেন। করেছেনও একজন বন্দুকধারী জেনারেলের নেতৃত্বে। বন্দুকের জোরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে তারা দেশ ও জাতির নানামুখী ক্ষতি করে গেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সর্বনাশও করেছেন তারা। কিন্তু হাতে ‘বন্দুক’ এবং একটি রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমর্থন ছিল বলে কারো কাছে জবাবদিহিতা করতে হয়নি তাদের। রাজনৈতিক নেতাদের জেলের ভাত খাওয়ানো এবং ব্যবসায়ীদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে অর্থনীতিতে ধস নামানোর পাশাপাশি ফখরুদ্দিন আহমদরা একের পর এক এমন অনেক মৌলিক ও নীতিগত বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সেগুলো কার্যকর করেছিলেন, যেগুলো তত্ত্বাধায়ক সরকারের দায়িত্বে ও এখতিয়ারে পড়ে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে ফখরুদ্দিনদের সরকার ‘মহাবিপ্লব’ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। সব মিলিয়ে পরিষ্কার হয়েছিল, ফখরুদ্দিনরা আসলে বিশেষ কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন। দেশকে তারা প্রচলিত রাজনীতির অনেক বাইরে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিত এবং জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎখাত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাদের ছিল সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা।
সেদিকে যাওয়ার আগে অন্য কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। বন্দুকের জোরে সকল ক্ষেত্রেই ‘কৃতিত্ব’ দেখিয়ে গেছে ফখরুদ্দিনদের তত্ত্বাবধায়ক নামের অসাংবিধানিক সরকার। এই সরকারের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একথা পরিষ্কার হয়েছিল, ২০০৬ সালের অক্টোবরে সংঘটিত লগি-বৈঠার নৃশংসতা থেকে জরুরি অবস্থা জারি করা পর্যন্ত সবই করা হয়েছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে। বহুল আলোচিত ‘রোডম্যাপ’ও ছিল সেই পরিকল্পনার অংশ। এর ভিত্তিতেই ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ডিজিটাল নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতায় বসানো হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এরপর এসেছে ‘ঋণ’ পরিশোধ করার পালা। সেই কার্যক্রম চলছে এখনো। এজন্যই ফখরুদ্দিন আহমদ তার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও শ্যালক ইফতেখার আহমদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে পেরেছিলেন। অন্য উপদেষ্টারাও বহাল তবিয়তে রয়েছেন, কেউ কেউ আবার চুটিয়ে রমরমা ব্যবসাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
‘নাটের গুরু’ ও প্রধান ‘উদ্দিন’ জেনারেল মইন উ আহমেদ সম্পর্কেও কিছু বলা দরকার। মইন উ যে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, সে কথা জানতে জাতির কয়েকদিনও সময় লাগেনি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার সময় ‘লাইনচ্যুত ট্রেনকে’ লাইনে উঠিয়ে আনাসহ মিষ্টি-মধুর অনেক কথাই শুনিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে মইন উ ও তার সহচররা দেশে ব্ল্যাকমেইলিং-এর রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেননি তারা। সমৃদ্ধি অর্জনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টির ব্যাপারেই তাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। দুর্নীতি দমনের নামে ওই সরকার এমন সব শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই ঢালাও ব্যবস্থা নিয়েছিল- বছরের পর বছর ধরে যারা দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করেছেন, শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, লাখ লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছেন এবং দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছেন। এসব শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রেফতার হওয়ায় এবং অনেকে ভয়ে পালিয়ে থাকায় তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল, অর্থনীতির সকল সূচক হয়েছিল নিম্নমুখী। রাজনীতির ক্ষেত্রে মইন উ’রা রীতিমতো ‘মহাবিপ্লব’ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের অনেককেই ‘জেলের ভাত’ খাইয়েছেন তারা। মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সংস্কারের আদেশ চাপিয়েছেন। কথায় কথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ করেছেন মইন উ। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তার নিজের বিরুদ্ধেই নানা ধরনের নোংরা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। অর্ধ ডজন ভাই এবং ঘনিষ্ঠ সহচরদের জন্যও ‘ফুলে-ফেঁপে’ ওঠার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ভারতের স্বার্থে সীমান্ত খোলা রেখে বিডিআরকে দিয়ে ‘দোকানদারি’ করিয়েছেন মইন উ। তার হুকুমে হকার উচ্ছেদের নামে লাখ লাখ গরীব মানুষের পেটে লাথি মারা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন তিনি সেনাবাহিনীর। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতা কমে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে চাকরির নামে  সৈনিকদের মধ্যে তিনি অর্থ-বিত্তের লোভ ঢুকিয়েছেন, ব্ল্যাকমেইলিং-এর কাজে নিয়োজিত রেখে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। সব মিলিয়েই দেশ ও জাতিকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে গেছেন মইন উ। ক্ষমতায় সত্যিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে অনেক আগেই এই লোকটিকে কারাগারে ঢুকতে এবং বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। অন্যদিকে মইন উ’র ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রথম থেকেই ‘অন্য রকম’ মনে হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কেও জেনে গেছে সাধারণ মানুষ। সবকিছুর পেছনে রয়েছে একই ‘রোডম্যাপ’। এই ‘রোডম্যাপের’ ভিত্তিতেই লগি-বৈঠার তাণ্ডব এবং ১/১১ ঘটানো হয়েছিল। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। ক্ষমতালিপ্সা এবং ভাড়া খাটার তাগিদ ছিল বলেই মইন উ নিজেও ক্ষমতা দখল করেছিলেন।
পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, মইন উ’দের আসলে ‘নিয়ে আসা’ হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে তৈরি করা ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন মইন উ। বিএনপি-জামায়াতসহ তৎকালীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ক্ষমতায় যেতে পারবে না বলে হতাশ হয়ে পড়া আওয়ামী লীগও ‘নাচুনে বুড়ির’ মতো ‘ঢোলের বাড়িতে’ সাড়া দিয়েছিল, নেচে উঠেছিল। এরপর ছিল ‘ডিল’ হওয়ার পালা। সে ‘ডিল’ অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। বিনিময়ে আওয়ামী লীগ ‘ঋণ’ পরিশোধ করে চলেছে। সবকিছুই এত নগ্নভাবে ঘটেছে যে এসবের কোনো একটি নিয়েই গবেষণা করার প্রয়োজন পড়ে না। ৫০ বছর লাগার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। বলা দরকার, ২০১০ সালে একবার দেশে এসে মইন বলেছিলেন, তিনি নাকি ‘জেনে বুঝে’ কোনো ভুল করেননি! মইন উ আরো বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ভালো কাজ করেছে’ বলেই তিনি জানেন। ওই সরকারের মূল্যায়ন এখনই করা উচিত নয়। এজন্য নাকি ৫০ বছর লাগবে!
তখনও বলা হয়েছিল, ইতিহাস গবেষকদের ‘খেয়ে দেয়ে’ বহু কাজ থাকে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে তারা গলফের মাঠে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করেন না। তেমন বিকৃত রুচি ও ইচ্ছাও সাধারণত গবেষকদের থাকে না। সুতরাং মইন উ’র মতো একজন অবৈধ ক্ষমতাদখলকারীকে নিয়ে গবেষণার জন্য নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার চিন্তাও ইতিহাস গবেষকরা করবেন না। কারণ, তিনি তো অনেক আগেই দেশ ও জাতি বিরোধী ‘খলনায়ক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ভালো কাজ করেছে’ বলে জানেন কথাটার মধ্য দিয়ে মইন উ সেবার অন্য একটি সত্যও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। সে সত্যটি ছিল, কয়লার ময়লা আসলেও ধুলেই যায় না। বাংলাদেশ এবং এদেশের জনগণ সম্পর্কেও নিজের অজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন মইন উ। কারণ, মাত্র দু’ বছরে বহু বছর পিছিয়ে দেয়ার পর ৫০ বছরের কথা বলেও জাতিকে তিনি পিছিয়েই দিতে চেয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণ মোটেও পিছিয়ে পড়ার মতো বোকা কিংবা অলস জাতি নয়। কারণ, কলকাতাকেন্দ্রিক ‘বাঙ্গালী’ প্রেম বুঝতে জাতির ৫০ বছর লাগেনি। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর মাত্র ৩৬ বছরের মধ্যেই ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশ ভারত থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ১৯৪৭ সালে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তানে। পাকিস্তানের মোহ কাটিয়ে উঠতেও জাতির ৫০ বছর লাগেনি। ২৪ বছরের মধ্যেই তারা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মইন উ’র মতো একজন বন্দুকধারী ভাড়া খাটা জেনারেল এবং তার নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক নামধারী অবৈধ সরকার সম্পর্কে জানার জন্যও জাতিকে ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। ১/১১-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জাতি কিছুদিন পর থেকেই সবকিছু জানতে শুরু করেছিল। একই কারণে ওই সরকারের মূল্যায়ন করার জন্য জাতিকে অবশ্যই ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। কথাটার মধ্য দিয়ে মইন উ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশী জাতির মানহানি করেছিলেন। ভাড়া যারা খাটে তাদের অবস্থা অবশ্য এমনই হয়ে থাকে।
এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। মাঝেমধ্যে করা হয়েছেও। এখানে এ পর্যন্ত খুবই কম আলোচিত এবং চমকে ওঠার মতো একটি বিশেষ তথ্য সম্পর্কে জানিয়ে রাখা দরকার। তথ্যটি হলো, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ড. ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। ২০১০ সালের ৯ জানুয়ারি কথাটা প্রথম প্রকাশ্যে বলেছিলেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাই ফখরুদ্দিন আহমদের ছিল না। কারণ, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং সংবিধানে বলা আছে, কোনো বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হতে পারবেন না। অন্যদিকে সত্য গোপন করে ফখরুদ্দিন আহমদ প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তার উপদেষ্টাদের মধ্যে চারজনও সংবিধানের একই ধারা লংঘন করে পদ নিয়েছিলেন। সত্য গোপন এবং সংবিধান ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে ফখরুদ্দিন আহমদসহ তত্ত্বাধায়ক নামধারী ওই সরকারকে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। উল্লেখ্য, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকেরও আগে ফখরুদ্দিন আহমদের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ্যে এসেছিল। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি জানিয়েছিল, ফখরুদ্দিন আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী আবাসিক কার্ডধারী বা রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে তার সোস্যাল সিকিউরিটি নাম্বার- ১৪৮৫২৮৯৯২। অর্থাৎ ড. ফখরুদ্দিন আহমদ মার্কিন নাগরিকের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। তার স্ত্রী-সন্তানরাও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জানিয়েছিল, ফখরুদ্দিন আহমদ অবৈধ পথে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ডে তার দুটি বাড়ি রয়েছে। এ দুটি বাড়ির মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। সে দেশের ওয়াস্যুভিয়া ব্যাংকের দুটি অ্যাকাউন্টে তার প্রায় এক কোটি টাকা জমা রয়েছে। অন্য কয়েকটি ব্যাংকেও তার অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে বলে ধারণা করেছিল স্থায়ী কমিটি। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সময় ফখরুদ্দিন আহমদ তথ্যগুলো গোপন করেছিলেন। এসব তথ্য ও বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাকে তলব করার চিন্তা-ভাবনা করছে বলে সে সময় প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল। অন্যদিকে রহস্যজনক কিন্তু সহজবোধ্য কিছু কারণে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ফখরুদ্দিন আহমদকে কখনো তলব করেনি। তিনিও তাই পার পেয়ে গেছেন। পার পেয়েছেন জেনারেল মইন উ আহমেদসহ তথাকথিত ১/১১-এর অন্য কুশীলবরাও। এর কারণও এতদিনে সবার জানা হয়ে গেছে। বহুল আলোচিত ‘ডিল’ নাকি সেভাবেই হয়েছিল। সে ‘ডিল’-এর সুযোগ নিয়েই মাঝারি মানের সাবেক ব্যাংকার ফখরুদ্দিন আহমদ বিদেশী শক্তির মনোনীত সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে গেছেন। এদিকে আওয়ামী লীগ যেহেতু তাদের বদৌলতে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে, সেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার তাকে বা অন্য কোনো উদ্দিনকে হেনস্থা করার সাহস পায়নি।
তা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের একটি মন্তব্য স্মরণ ও উল্লেখ করা দরকার। ২০১০ সালেরই জুলাই মাসে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে তিনি বলেছিলেন, কার্ডধারী মার্কিন রেসিডেন্ট ড. ফখরুদ্দিন আহমদ নিজে শুধু নন, তাকে যারা প্রধান উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন তারাও সংবিধান লংঘন করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে তত্ত্বাবধায়ক নামধারী ওই সরকারের বৈধতা নিয়েই সে সময় প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাখ্যাকালে এসেছিল ফখরুদ্দিন সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতার দিকটিও।
এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, তথ্য গোপন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ড. ফখরুদ্দিন আহমদের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্তি যদি সংবিধানের লংঘন ও বেআইনী হয়ে থাকে তাহলে তার সরকার এবং সে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ও কর্মকা-ও বৈধ বা আইনসম্মত হতে পারে না। ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিকোণ থেকে ফখরুদ্দিন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন এবং সে নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত সরকারের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সরকারের পরবর্তী কোনো কার্যক্রমও তাই প্রশ্নাতীত হতে পারে না।
এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীকালে করার ইচ্ছা রইল। বর্তমান নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে শুধু এটুকু বলে রাখা দরকার যে, ড. ফখরুদ্দিন আহমদের ধাওয়া খাওয়ার ‘মধুর’ অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেকের জন্যই শিক্ষণীয় রয়েছে। ভবিষ্যতে আরো অনেকেই সাবেক এ প্রধান উপদেষ্টার মতো জনগণের আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে তথা ধাওয়ার মুখে পড়তে পারেন।
আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচন প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের রিপোর্ট


২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)। বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতার বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে ওই নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে উল্লেখ করে ডিএফআইডি বলেছে, নির্বাচনটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সংবিধানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিরোধী দলের বয়কট করা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই অওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে। সেজন্য প্রকৃত নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নির্বাচনটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। রিপোর্টে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী লিগ্যাল রিভিউ বা আইনগত পর্যালোচনা করার জন্য সুপারিশ করার পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনের দু’মাসের ব্যবধানে আয়োজিত উপজেলা নির্বাচনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের ভুল-ত্রুটিরও কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। কমিশনের সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছে ডিএফআইডি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, রিটার্নিং অফিসারদের ওপর কমিশনের সম্পূর্ণ বা যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকার আশংকার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে কমিশন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবকে আরো জোরদার ও নিশ্চিত করেছে। অভিযোগের সমর্থনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ফুটেজের উল্লেখ করে ডিএফআইডি বলেছে, আওয়ামী লীগ ও এর জোটের প্রার্থীদের কোনো অন্যায় ও বেআইনী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধেই কমিশন ব্যবস্থা নেয়নি। এই সুযোগে নির্বাচনী আইন লংঘন করা হয়েছে যথেচ্ছভাবে। এসবের মধ্য দিয়ে কমিশনের দুর্বলতারই শুধু প্রকাশ ঘটেনি, এমন অনুমানও শক্তিশালী হয়েছে যে, এই কমিশনকে দিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। রিপোর্টে প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকেই নতুন করে আবারও একটি সংসদ নির্বাচন অনুষষ্ঠানের জন্য পাশ্চাত্যের দেশগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়ে এসেছে। দাতা সংস্থাগুলো যে নির্বাচন কমিশনকে দেয়া সাহায্য প্রথমে অর্ধেক করার পর ২০১৫ সালের জুলাই থেকে সাহায্য সম্পূর্ণ স্থগিত করেছে সে তথ্যেরও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ডিএফআইডি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের ব্যাপক সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে, যাতে আগামী নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সরকারের প্রভাবমুক্ত হতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই ডিএফআইডি সামান্য বাড়িয়ে বলেনি। বড় কথা, ডিএফআইডির মাধ্যমে যুক্তরাজ্য আসলে প্রকৃত চিত্রই তুলে ধরেছে। কারণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের নামে যে ভোটারবিহীন ও একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং যে কোনোভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসাই যে এর উদ্দেশ্য ছিল সে ব্যাপারে জানা গেছে প্রাথমিক দিনগুলোতেই। একই কারণে একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাই নির্বাচনটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বর্তমান সরকারও তাই এখনো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। ওদিকে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেও ডিএফআইডির রিপোর্টে সঠিক তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। কারণ, প্রমাণিত সত্য হলো, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর আওয়ামী লীগ এবং তার জোটভুক্ত দলগুলো ছাড়া দেশের কোনো রাজনৈতিক দলেরই আস্থা নেই। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীসহ বিদেশী কূটনীতিকদের বক্তব্য ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও একই অনাস্থার প্রকাশ ঘটে চলেছে। দেশের ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রথম থেকেই ইসির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেছে। কমিশনকে ‘মেরুদ-হীন’ ও ‘অথর্ব’ আখ্যায়িত করে বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই বলেছেন, এই কমিশনের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই এবং কমিশন সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। শুধু বিএনপি ও জামায়াতের কথাই বা বলা কেন। বিভিন্ন সময়ে মুখ খুলেছেন এমনকি মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও। বলেছেন, নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে ইসি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে এবং জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। অতীতের বিভিন্ন উপলক্ষের মতো এই সময়ে চলমান পৌর নির্বাচনেও কথাটার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কমিশনের সাম্প্রতিক সকল কর্মকাণ্ডে ও বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে, পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ যেমন হবে না তেমনি ভবিষ্যতের সব নির্বাচনও হবে একতরফাই।
আমরা মনে করি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও অভিযোগের পাশাপাশি ডিএফআইডির রিপোর্টের মূলকথার মধ্য দিয়েও এ আশংকাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আসলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে। একই কারণে এই কমিশনের অধীনে অন্তত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। কমিশনের বরং ব্যাপক সংস্কার করা দরকার। এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে যারা সব মহলের আস্থা অর্জন করতে পারবেন। এটা কঠিন কোনো কাজও নয়। কারণ, সংবিধান কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। সে অনুযায়ী অবস্থান নিলে এবং ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করলেই কমিশন আবারও গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেতে পারে। কথাটা অনুধাবন করে যতো তাড়াতাড়ি কমিশনকে সংস্কারের ব্যবস্থা নেয়া হবে ততই দেশ ও জাতির এবং গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল বলে আমরা মনে করি। সরকারকে একই সাথে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যেও উদ্যোগী হতে হবে যার তাগিদ রয়েছে ডিএফআইডির আলোচ্য রিপোর্টে।

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এগিয়ে যাই সমৃদ্ধির পথে


প্রতিবছর স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলেই আমরা একটা হিসাব নিয়ে বসি, কী আমাদের অর্জন, কী আমরা হারালাম, কী আমরা আরও করতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমাদের ভুল হয়ে গেছে, কোন পথে এগোলে আমরা আরও দ্রুত পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, কীভাবে নির্মাণ করতে পারি আমাদের সন্তানদের জন্য অধিকতর বাসযোগ্য একটি আবাসভূমি। বলতে পারি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যারা যুদ্ধ করে স্বদেশ স্বাধীন করেছে। অন্যান্য দেশ স্বাধীন হয়েছে আলোচনার টেবিলে বসে, দেনদরবারের মাধ্যমে। সেসব ক্ষেত্রে আলোচনা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। সে আলোচনা কখনও ভেঙে গেছে, কখনও আবারও শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার একটা মীমাংসা হয়েছে। আমরাও ভোট ও আলোচনার টেবিলে বসেই এর একটা সমাধান চেয়েছিলাম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অপরিণামদর্শী বল প্রয়োগের নীতির কারণে আমরা শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে তুলে নেই। মরণপণ লড়াই করে শত্রুকে হারিয়ে দিয়ে আমরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি।
পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, সদ্য স্বাধীন সেসব দেশ দ্রুত আত্মউন্নয়নের পথে এগিয়ে গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে জাতীয় ঐক্য। যারা তা পারেনি, তারা শিগগিরই গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় বড় ফুটানির কথা কোনো কাজে আসেনি। স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্রেও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তখন সেখানে কেউ উন্নয়নের আশা করেনি। সেখানে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অগ্রগতির ধারা সূচিত হয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর থেকে। ফুলগেনসিও বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ৫ বছর ৫ মাস ৬ দিন যুদ্ধ করে ১৯৫৯ সালে কিউবা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে। বাতিস্তারও সমর্থক ছিল। ক্যাস্ট্রো ও তার সহযোগীরা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধেই। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে একযোগে দেশ গড়ার ডাক দেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এই ঐক্যই যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল ফিদেল সরকারকে।
সমাজতন্ত্রের নীতি গ্রহণ করায় ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র একযোগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে মার্কিন পক্ষে যোগ দেয় দক্ষিণ ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি পশ্চিমা দেশ। ভিয়েতনামের পক্ষ সমর্থন করে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়া। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম একটি রাষ্ট্রই ছিল। আর সেটি ছিল ফ্রান্সের দখলে। ভিয়েতনামীরা তখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। এক সময় ফ্রান্স উপলব্ধি করে যে, এ যুদ্ধে তাদের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। তখন তারা কম্যুনিস্টদের সঙ্গে একটি আপোস ফর্মুলায় আসে। আর তা হলো, ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভক্ত হবে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম থাকবে সা¤্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার হিসেবে। কৌশলগত স্বার্থে হা চি মিনের নেতৃত্বাধীন উত্তর ভিয়েতনামের কম্যুনিস্টরা তা মেনে নেয়। এক ভিয়েতনাম দুটি ভিয়েতনামে পরিণত হয়। এর পরের বছর থেকেই শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দো-চীন যুদ্ধ হিসেবেও পরিচিত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলেছে টানা বিশ বছর। ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র বাহিনীকে খেয়ে না-খেয়ে লড়াই করে হারিয়ে দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ভিয়েতনাম। বিজয়ের পর দুই ভিয়েতনাম পুনরায় এক হয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষেই তারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন ভেদ-বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে জাতি গঠন ও উন্নয়নের ধারায় সকলকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। জাতি ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মকে কাজ করতে হবে। মুছে দিতে হবে যুদ্ধকালীন ভেদরেখা। চীনের সহযোগিতায় সে পথ ধরেই অগ্রসর হতে থাকে ভিয়েতনাম। তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থনও তাদের ছিল। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ-পরবর্তী ভিয়েতনামের উন্নয়নের গতিধারা ছিল অত্যন্ত শ্লথ। কিন্তু সেখান থেকে বের হবার পথ বড় সহজ ছিল না ভিয়েতনামের জন্য। ভিয়েতনাম ঘৃণার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে শুরু করল। তারা বিশ বছর ধরে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেছিল, তাদের সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করল। স্বদেশের উন্নতির জন্য তাদের বাণিজ্য চাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে ২০ বছরে ভিয়েতনামের ১৫ লক্ষ থেকে ৩০ লোক শহীদ হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ হাজার সৈন্য তাতে নিহত হয়। অর্থাৎ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ লোক মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন ভিয়েতনামে। সে তুলনায় প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মারা গিয়েছিল মাত্র দুই হাজার। এই ক্রোধ ভিয়েতনামীদের তাড়া তো করবেই। তা সত্ত্বেও তারা অতীতের তিক্ততা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তা পরিপূর্ণ রূপ নিতেও বিশ বছর সময় লেগেছিল। পরে ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেন। এরপর দু’ দেশ উভয় দেশে দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার আগে থেকেই অবশ্য দু’দেশের মধ্যে লিয়াজোঁ অফিস ভিত্তিক সম্পর্ক ছিল।
কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপর এই সম্পর্ক এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতি পেছনে ফেলে এখন অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা দ্রুত এগিয়ে গেছে। দ’ুদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ২০০১ সালে দু’ দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছিল মাত্র দেড় শ’ কোট ডলারের। আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫০ কোটি ডলারে। আবার ৩৬ লক্ষ ভিয়েতনামী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ১৮ লক্ষেরই বাস যুক্তরাষ্ট্রে। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে লাওস ও কম্বোডিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি এ বছরই ভিয়েতনামে এক জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায় যে, শতকরা ৭৮ জন ভিয়েতনামী মনে করে, অতীতের তিক্ততা ভুলে ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দ্রুত সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এদের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিও আছেন। আছে ২২-২৪ বছরের তরুণ-তরুণীও। তাদের অনেকে আবার মার্কিনীদের বিয়ে করতেও আগ্রহী। ভিয়েতনামে ঐ ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘরও রয়েছে। শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে তা অবহিতও করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ঘৃণা শেখানো হচ্ছে না। ইতিহাসকে যেমন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে না, তেমনি ঘৃণার বদলে জাতীয় অগ্রগতিকেই মুখ্য করে তোলা হয়েছে। শিক্ষা ও সমৃদ্ধির এই সৌকর্য আমরা আয়ত্ত করতে পারিনি।
আমরা বিজয়ের সাফল্য কিংবা সমৃদ্ধির মঞ্চের বদলে ঘৃণাস্তম্ভ বানিয়েছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঔদার্য ভালবাসা সহমর্মিতার বদলে ঘৃণা করতে শিখিয়েছি। তাদের সঙ্কীর্ণতার গণ্ডীর ভেতরে আবদ্ধ করেছি। ফলে কাম্য অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারছি না। আর সে কারণে সমাজের ভেতরে তার বিষবৎ ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোনো এক শহরে দেখলাম ঘৃণাস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। যে ছোট্ট শিশু প্রতিদিন এই পথে ব্যাগ হাতে স্কুলে যায়, তার প্রশ্নের জবাব ঐ শিশুর অভিভাবকরা কী দেবেন? কোনোদিন হয়তো বলবেন, পাকিস্তানীরা এদেশে ১৯৭১ সালে মানুষ হত্যা করেছিল, আমরা তাদের ঘৃণা করি, আর তাই এ স্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। কোনোদিন হয়তো বলবেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে যারা সহযোগিতা করেছিল, আমরা তাদের ঘৃণা করি, তাই এ ঘৃণাস্তম্ভ। এইভাবে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে ঘৃণাই শিখিয়ে যাব? বাংলাদেশের এই ঘৃণাস্তম্ভের মতো কোনো স্তম্ভ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি  নেই।
এই ঘৃণার বিষময় ফলই হলো বর্তমান সময়ের অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা। ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতা লালন করেছি বলেই এই প্রজন্মে খুন-গুম-রাহাজানি, শিশু হত্যা-ধর্ষণ সমাজে এত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। আমরা সমাজপতিরা ঘৃণা শিখিয়েছি, শিখিয়েই যাচ্ছি। এর নিকট কিংবা সুদূরপ্রসারী পরিণাম কী হতে পারে, তা ভেবে দেখতে চাইনি। গোটা সমাজ এখন তার খেসারত দিচ্ছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও এই সত্য ও বাস্তব পরিণতি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। আর তাই তিনি ১৯৭৩ সালেই দেশ থেকে সম্ভাব্য বিভেদের বীজ উপড়ে ফেলার জন্য, সকলে একযোগে কাজ করে দেশ গড়ার জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছিলেন অন্য সব রাষ্ট্রনায়কের মতো। আসুন, আজকের মহান বিজয় দিবসে অন্য সব যোদ্ধা জাতির মতো আমরাও অতীতের গ্লানি মুছে ফেলে উন্নতি আর সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। সেই হোক আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিজয় দিবস : আমাদের সাফল্য ব্যর্থতা


আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১১ দিনব্যাপী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘটিত ঘোষিত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর নিকট পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বিজয় সূচিত হয় এবং আমরা একটা স্বাধীন দেশের পতাকার অধিকারী হই। তখন থেকে এই দিবসটি বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে এবং আগামীকাল এই দিবসের ৪৫তম বার্ষিকী উদযাপিত হবে। বিজয় দিবসের এই উষালগ্নে আমরা দলমত নির্বিশেষে সকল দেশবাসী, সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার এবং আহত নিহত সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই এবং নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য ব্যাপক; এই দিবস প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার স্বর্ণ দুয়ার উদঘাটিত করেছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আমরা বৃটিশ শাসকদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়েছিলাম। আশা ছিল আমরা আমাদের স্বাধীনসত্তা তথা মৌলিক অধিকার ফিরে পাবো। বাকস্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সরকার গঠন ও পরিচালনার অধিকার, ন্যায়বিচারের নীতিমালা এবং অর্থনৈতিক সুবিচারসহ আমাদের প্রাপ্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। সমাজে ব্যভিচার, দুর্নীতি ও কোনও প্রকার বৈষম্য থাকবে না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের আকিদা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবেন। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা ১৯৫০ সালে East Bengal Estate Acquisition and Tenancy Act বাস্তবায়নের মাধ্যমে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষক প্রজাদের ভূমি মালিকানা প্রদান করা হয়। বলাবাহুল্য, এর আগে তৎকালীন পূর্ব বাংলার (যা পরে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়) জমিদারদের শতকরা ৯৫ জনই ছিল অমুসলমান, হিন্দু। অঞ্চলটি ছিল কৃষিভিত্তিক, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মুসলমানদের শতকরা প্রায় ১০০ জনই ছিল তাদের প্রজা। জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে মুসলমান প্রজাদের জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় বা পাল্কি চড়ে যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। যত শিক্ষিত বা সম্ভ্রান্তই হোক না কেন জমিদারদের সামনে তারা চেয়ারে বসতে পারতেন না; মেঝেতে বসতে হতো। তাদের সঙ্গে অচ্ছুতের মতো ব্যবহার করা হতো। কুকুর-বিড়াল ঢুকলে হিন্দু বাড়ির পবিত্রতা নষ্ট হতো না, কিন্তু মুসলমান বা তাদের ছেলেমেয়ে ঘরে ঢুকলে তা অপবিত্র হয়ে যেতো। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র সাধারণ মুসলমানরা ছিল অবাঞ্ছিত। ’৪৭ সালের স্বাধীনতা তাদের এক্ষেত্রে এবং এতদাঞ্চলের শিল্পায়নসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতির দুয়ার খুলে দিয়েছিল। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষার প্রতি অবজ্ঞা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস, অত্যাচার, অবিচার, সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ি, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা এবং নির্মম হস্তে অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দমনের প্রচেষ্টা ও গণহত্যা প্রভৃতি তাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয় এবং এই অঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারত এ ক্ষেত্রে তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা ও এই ভূখণ্ড থেকে তাদের স্বার্থ আদায়ের দ্বৈত লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পরাভূত হয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় সূচিত হয়। অবশ্য অনেকে বলে থাকেন এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে অনুপস্থিত রাখা হয়। এই ইতিহাস, আমার আলোচ্য বিষয় নয়। বাস্তবতা হচ্ছে আগামীকাল বিজয় দিবস এবং এই বিজয়ের ফলে আমরা কী পেলাম কী পেলাম না আমাদের প্রত্যাশার আলোকে তার বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীন বাংলাদেশের সাফল্যগাঁথা অনেক। আমাদের খাদ্যোৎপাদন বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় আয়ু ও জীবনযাত্রার মান এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। শিশুমৃত্যু ও প্রসূতি মায়েদের অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বসন্ত, কলেরা ও ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বর এখন নাই বললেই চলে। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য অভূতপূর্ব। রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্টসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো আমাদের অবস্থাকে যথেষ্টভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। গার্মেন্টস ও নীটওভেন শিল্প বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনে আমাদের সহায়তা করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের দক্ষ, আধা-দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা প্রবাস থেকে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন। এই সাফল্য এ দেশের মানুষের সকলের, কোনও বিশেষ পক্ষ শক্তির কৃতিত্ব নয়।
আমাদের ব্যর্থতাও আছে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন আমাদের অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন সবকিছুর মূল্য বেড়েছে, কিন্তু মানুষের জীবনের মূল্য সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। হত্যা, গুম, ব্যভিচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের নিত্যব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি এলিট ফোর্সে কর্মরত সেনাবাহিনীর সিনিয়র জুনিয়র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অর্থবিত্তের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা অবৈধ অর্থ দিয়ে খুন-খারাবির কাজে লাগানোর অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবৈধ ভোগ এখন রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য;
আদর্শ এখানে গৌণ। কে কত ধর্মবিদ্বেষী হতে পারলো এবং ধার্মিক, সৎ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শবাদী দল ও নেতাকর্মীদের নিধন করতে পারলো তার উপরই এখন প্রগতিশীলতা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফেরাউনী ধাঁচের স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসকরা এখন মানুষের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার চর্চা দেশ থেকে বিদায় হয়ে গেছে। বিনা নির্বাচন, নির্বাচনী প্রহসন ও বিনাভোটে সরকারি দল ও তার জোটের নেতাকর্মীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী পরিষদে গিয়ে দেশ শাসন করেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের সীমাহীন অপচয় ও আত্মসাতে লিপ্ত হন। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠানসমূহে কাজ করতে দেয়া হয় না। নানা অজুহাত তুলে তাদের জেলে পাঠিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত জননিন্দিত সরকারি দলের নেতাকর্মীদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। আবার অর্থনৈতিক সুবিচারও নির্বাসনে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য চরমে উঠেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য, সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের স্বৈরাচার ও সন্ত্রাস শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু ধ্বংসই করেনি আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও ধ্বংস করে দিচ্ছে। সরকার এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কার দিচ্ছে বলে মনে হয়।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সরকার বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করে ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বিচারের আদালত অভিযোগ অনুযায়ী হাসির আদালতে পরিণত হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সমাজে যারা সৎ, ধার্মিক, নিষ্ঠাবান ও জনদরদী হিসেবে পরিচিত এবং সর্বজন স্বীকৃত তাদের পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কৃতই শুধু নয় নিষ্ঠুরভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়াও হচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষা ও পন্থা সবকিছুই সরকার বন্ধ করে দিয়েছেন। পরাধীন আমলে জনসভা, পথসভা ও বিক্ষোভ মিছিলে কোনও বাধা ছিল না। এখন ঘরোয়া বৈঠকে বসলেও সরকার নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতন ও প্রতিপক্ষ ঠেঙ্গানোর মাত্রা স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির দাবিদার দল/দলগুলোর মধ্যে এতবেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সারা দেশটি যেন এখন তাদের জমিদারীতে পরিণত হয়েছে। বৃটিশ আমলে ২৪ পরগনার নাকিলেকবাড়িয়া পরগনার জমিদার কৃষ্ণরাও দাড়ি রাখার জন্য মুসলমানদের উপর দাড়িপ্রতি পাঁচ শিকে (১.২৫) করে জরিমানা করতেন। এখন আমাদের জমিদাররা ধর্মীয় বইপুস্তককে জেহাদী বই (সন্ত্রাসী অর্থে) আখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাম্যপ্রতিষ্ঠা, অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ, মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি লক্ষ্যে আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। কিন্তু আজকে যা ঘটছে তার সাথে এই প্রত্যাশার সামঞ্জস্য আছে কি না তা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মতামত প্রকাশ ও শিক্ষা-দীক্ষায় কম্পিউটার ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলো বিশেষ করে ভাইবার, স্কাইপি ও অনেকগুলো APP বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভয়, জামায়াত। এক জামায়াতের ভয়ে তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অনেকে বলে থাকেন জামায়াতের মতো নিষ্ঠাবান আরো দু-একটি প্রতিষ্ঠান থাকলে সম্ভবত অত্যাচারী সরকারের অনেকে হয়তো ভয়ে আত্মহত্যা করতেন।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

চ্যালেঞ্জিং পৌরসভা নির্বাচন


আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন সকলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং ঘটনা হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমত, নির্বাচনটি এই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লড়াইটিও তাই দলীয় এবং রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি-জামায়াতসহ আন্দোলনরত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। দীর্ঘদিন মাঠে-ময়দানে আন্দোলন-কর্মসূচিতে ব্যস্ত নেতাকর্মীগণ এখন নির্বাচনী তৎপরতায় ব্যস্ত। ফলে নির্বাচনী লড়াই যে জমে উঠবে এবং তীব্র হবে, তা বলাই বাহুল্য।
নির্বাচনের প্রাক্কালে দলগুলোর মধ্যে কিছু অনিয়ম দেখা যায় ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও অন্যান্য ইস্যুতে। কোথাও কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থীও দাঁড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এসব সমস্যাও মোকাবিলা করা হয়েছে। দেশের প্রায়-সর্বত্রই এখন সরকারি দল আর বিরোধী দল নির্বাচনী যুদ্ধে মুখোমুখি।
আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন একটি স্থানীয় পর্যায়ের ভোট হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বহীন নয়। বিশেষত, দলীয় প্রতীকে এবং দলের মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটিই রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করেছে। পাশাপাশি, এই নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের নিরিখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্রও পাওয়া সম্ভব হবে। জানা যাবে, দলগুলোর জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তার বিষয়টিও। 
বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির কার্যকারিতাও পরীক্ষা করা যাবে এই ভোটের সময়। কারণ, দেশের প্রায়-সকল বিরোধী দলেরই অভিন্ন দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পক্ষে। কারণ, তারা অভিযোগ করে আসছিলেন যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হয় না। এই নির্বাচনে প্রমাণ হবে যে, আসলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় কি না? দেশবাসী এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তাই এ নির্বাচনের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে আছেন।
সরকার ও বিরোধীদের জনপ্রিয়তা পরিমাপেরও একটি সুযোগ আসবে এই নির্বাচনে। যদিও পৌরসভা নির্বাচন ক্ষমতার পালাবদলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না, তথাপি সাধারণভাবে এটা জানা যাবে যে, কোন দলের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন কতটুকু। তাই সরাসরি জাতীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলে ভূমিকা না-রাখলেও এই নির্বাচন বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি পরোক্ষ প্রভাব রাখবে।
নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনে কতটুকু সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং সকলকে সমান সুযোগ, নিরাপত্তা ও সুবিধা কতটুকু ন্যায়ানুগ ও সুষ্ঠুভাবে দিতে পারে, সেটাও বোঝা যাবে। নির্বাচন কমিশন যদিও দলীয় সরকারের অধীনে থেকেও নিরপেক্ষ আচরণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে।
ইতিমধ্যে বিরোধী দলের পক্ষে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সকলের জন্য সমান সুবিধার দাবি করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মী-প্রার্থীদের হয়রানি করার অভিযোগ আসছে। প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধাও সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না বলেও বলা হচ্ছে। এসব ব্যাপারে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়ে অভিযোগের সুরাহা করা আবশ্যক।
অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে যে অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমান পৌর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। নির্বাচনের মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হতে পারবে এবং অসহিষ্ণুতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মাত্রা হ্রাস পেতে পারবে। তবে সব কিছুই হতে পারবে, সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলেই।
বাংলাদেশ আসলেই গণতন্ত্রমুখী একটি দেশ এবং বাংলাদেশী জনগণ পুরোপুরিভাবেই গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার অধিকারী। নির্বাচন বা ভোট এখানে উৎসব মুখর একটি বিষয়। মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার ও পছন্দের ভিত্তিতে ভোট ব্যবস্থাকে সকলের জন্য  অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ করা তাই অপরিহার্য। জনগণকে আস্থায় ও বিশ্বাসের মধ্যে নিতে হলে অবশ্যই তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নচেৎ জনক্ষোভ ও বিরূপতা সঞ্চারিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকেই যাবে। জনগণকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশীদার করতে হলেও তাদেরকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে। পৌরসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে এসব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সেগুলো ইতিবাচক ও আইনানুগভাবে ব্যবহার করাই সমীচিত হবে।
অতীতে নির্বাচনী ব্যবস্থার শরীরে যে নানা কালো দাগ ও কালিমা লেপ্টে গেছে, সেগুলোকে পরিশুদ্ধ করারও একটি প্রচেষ্টা নেয়ার সুযোগ এসেছে এ নির্বাচনে। ভোট ডাকাতি, সন্ত্রাস, কালো টাকা, ব্যালট পেপারবক্স ছিনতাই ইত্যাদি অতীতের কলঙ্ক বিমোচনের সুযোগও আনবে এ নির্বাচন। ক্ষমতা ও শক্তির বলে জনগণের মতামত ও ভোটাধিকারকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিতভাবে নির্বাচিত হওয়ার অপচেষ্টাও এ নির্বাচনের মাধ্যমে বানচাল করতে হবে। তাহলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দৃঢ় হবে এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
প্রসঙ্গত বলা ভালো, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এ নির্বাচনকে অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। বিভিন্ন ক্রটি-বিচ্যুতির পরেও বিএনপি সরবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বেগম জিয়া দলের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে অনেকগুলো বৈঠক করেছেন এবং নানা পর্যায়ে নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করেছেন। এতে প্রমাণ হয় যে, বিএনপি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ স্বরূপই গ্রহণ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে বিএনপি, সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থারই লাভ। আন্দোলনের উত্তপ্ত মাঠ থেকে দলটি যদি নির্বাচনী ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়, তবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নানা অনিয়ম ও শক্তি প্রদর্শনের কারণে দলটি যদি আইনানুগ অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়, তাহলের আন্দোলনের মাঠে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর সামনে। এতে পরিস্থিতি আবারো আগের মতো অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
বাংলাদেশে সুশাসন, উন্নয়ন, অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অতি জরুরি বিষয়। এই স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে দেশে কার্যকর বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সমঝোতা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। হানাহানি ও আক্রমণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জিত হয় না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা-জেল-জুলুম-ফাঁসি দিয়ে শান্তি স্থাপন আকাশ কুসুম কল্পনার বিষয়। হিংসার রাজনীতি দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও অবাস্তব প্রচেষ্টা মাত্র। অতএব যত দ্রত সুচিন্তা ও সুবিবেচনার উদ্ভব হবে, ততই সংকটের সমাধান ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদীভাবে রাজনৈতিক সংকট ও অচলাবস্থার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ থাকতে পারে না। স্থিতিশীলতাও প্রতিনিয়ত বিপণœ হতে পারে না। কোনো একদলীয় বা স্বৈরতান্ত্রিক প্রচ্ছায়াও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনই কাম্য। দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মুখচ্ছবিই প্রত্যাশিত। নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি এক্ষেত্রে সংকট উত্তরণের বিরাট বড় সহায়। অতীতে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধসের কারণেই বহু সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন তেমন সংকট আর সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সকলের সতর্কতা অতি প্রয়োজন। ব্যক্তি, দল ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে সকলের সৎ, আইনানুগ ও আন্তরিক উদ্যোগে সুষ্ঠু ও গতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথচলা মসৃণ হবে বলেই সকলে আশা করেন। সকলেই প্রত্যাশা করেন, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও সংঘাতে অবসান ঘটবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা নিয়েই সমন্বয় ও সমঝোতার ভিত্তিতে এক সাথে সুশাসনের মাধ্যমে উন্নয়নের পথে চলবে। বাংলাদেশকে নিয়ে একটি আশাবাদী ও সুদূরপ্রসারী, শান্তি ও সমৃদ্ধকামী রূপরেখার উদ্ভাসনই রাজনীতিক নেতৃত্বের কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে। যে প্রত্যাশায় ব্যক্তি ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থের বদলে দলের জাতির সামগ্রিক স্বার্থের প্রাধান্যই স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশের মানুষের এই ইতিবাচক ও জাতিস্বার্থমুখী স্বপ্নের প্রাসঙ্গিকতাও সকলের জানা। চলতি ডিসেম্বর মাসে তা আরো স্পষ্ট। জাতির বিজয়ের মাসে গণতন্ত্রের বিজয়ের প্রত্যাশাও প্রাসঙ্গিক। আসন্ন পৌরসভার নির্বাচনে গণতন্ত্রেরই বিজয় হবে, সে প্রত্যাশা তাই সকলের।

Ads