রবিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণ ও মৌলিক মানবাধিকার প্রসঙ্গ


পৃথিবীতে নানা ধরনের ‘স্মরণ’ অনুষ্ঠান হয়। মৃত আত্মীয়, জাতীয় বীর, যুদ্ধের শহিদ ইত্যাদি খ্যাতনামাদের স্মরণে অনুষ্ঠান বা দিবস পালনের রেওয়াজ নতুন নয়। বাংলাদেশে এখন যুক্ত হয়েছে নতুন এক স্মরণ-সংস্কৃতি। এর নাম ‘গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণ’। সন্দেহ নেই, গুমের কারণে স্মরণযোগ্য ব্যক্তির গুরুত্ব ও সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে মানুষ অনুষ্ঠান পর্যন্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা আর আইন-শৃঙ্খলা কাঠামোতে বিষয়টি একটি অভিনব, উল্লেখযোগ্য অথচ বেদনা-বিধুর সংযোজন। অনুষ্ঠানে যে বক্তব্যটিই শিরোনামে এসেছে মিডিয়ার এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো: ‘রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এভাবে গুম হয় না’।
বাংলাদেশে ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও গুম নিয়ে এতো আলোচনা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে কি না, জানা নেই। এটাও কারো জানা নেই যে, অসংখ্য মানুষ, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা জায়গায় বহাল তবিয়তে ছিলেন, তারা অকস্মাৎ গুম বা নিখোঁজ হয়ে গেছেন, এমন ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটছে কি না? পরিবার-পরিজনকে অকূলে ভাসিয়ে তারা কোথায় চলে গেছেন? প্রশাসন কিছুই বলতে পারছে না। যারা নাগরিক সমাজের দায়িত্বে নিয়োজিত, তারাও মুখ বন্ধ করে আছে। এজন্যই সম্ভবত গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এভাবে গুম হয় না’। 
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত্র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, দেশে এভাবে গুম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হয় না। তারা (সরকার) হচ্ছে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন। এ পর্যন্ত যতগুলো গুম হয়েছে তার বিচার করতেই হবে। গত শনিবার রাজধানীর জাতীয়  প্রেসক্লাবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে পালিত আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, দলমত নির্বিশেষে মৌলিক অধিকারের প্রয়োজনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জান-মালের নিরাপত্তার প্রশ্নে  কোন আপস নাই। তিনি বলেন, তদন্ত হয় না, বিচার হয় না, এই  রোগ আমাদের  পেয়ে বসেছে। শাসন ব্যাবস্থা বিচার ব্যাবস্থার উপর এই  রোগ আছে। গুম খুনের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, স্থানীয় এমপির মাধ্যমে মন্ত্রী এবং সরকারের কাছে লিখিত জবাবদিহিতা চাইতে হবে। আমাদের সবাইকে গুমের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এটা বিএনপি আওয়ামী লীগ এর বিষয় নয়। আমরা জাতি হিসেবে অসহায় না। আজকের সম্মেলনের মাধ্যমে সবার ভয়  ভেঙ্গেছে। মনে রাখতে হবে জনগণই ক্ষমতার উৎস, সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দ। ১০টায় জাতীয়  প্রেসক্লাবের সম্মেলন কক্ষে সারা  দেশ  থেকে আসা শতাধিক ভুক্তভোগী পারিবারের স্বজনদের উপস্থিতিতে সম্মেলন শুরু হয়। প্রথম অধিবেশনে ২০-২৫ জন ভুক্তভোগী স্বজন বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ক্ষতিগ্রস্ত স্বজনরা বলেন,  দেশে গুম, খুনের মতো  কোনো ঘটনা আর  কেউ  দেখতে চায় না। এমন নির্মম পরিণতি আর  কেউ চায় না। স্বজনদের  বেশিরভাগই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের গুম হওয়া স্বজনদের সন্ধান এবং বিচার দাবি করেন। বক্তব্যে স্বজনরা গুম, অপহরণের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাবকে দায়ী করে এর প্রতিকারের দাবি জানান।প্রত্যেক স্বজন ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায়  ভেঙে পড়েন। তখন  গোটা সম্মেলন কক্ষেই নেমে আসে স্বজন হারানোর হাহাকার।  সেই হাহাকার ছুঁয়ে যায় সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের। সম্মেলনে লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের হিরুর মেয়ে মাসরুফা ইসলাম বলেন, গত ২৭ নভেম্বর ২০১৩ সালে আমার বাবা গুম হন। গত ৯ মাসেও আমরা তাকে ফিরে পাইনি। সম্মেলনে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার বলেন, “গুম হয়ে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ দেশে বিরাজ করছে বলেই এমনটা হচ্ছে। আমরা  কেউই এ রকম সমাজ বা রাষ্ট্রে বাস করতে চাই না। আমারা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের এাঁ মৌলিক অধিকার।” কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দেস ২০১২ সালে সাভারের নবীনগর  থেকে তার আরেক সহপাঠীর সাথে গুম হন। তার বাবা মওলানা আবদুল হালিম সেমিনারে বলেন, দুই বছর পার হয়ে গেলেও আমরা তার কোনো খোঁজ পাইনি। দেশে সাধারণ মানুষও গুম হয় এটাই তার প্রমাণ।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ভাবতেই হয়, ‘গুম’ বলতে কি বোঝায়? নিখোঁজ হওয়া? ধরে নিয়ে যাওয়া? তার নয়। কারণ, নিখোঁজ হলে এক সময় খোঁজ পাওয়া যায়। জীবিত বা মৃত হলেও উদ্ধার হয়। ধরে নিলে বা গ্রেফতার করা হলেও একটি রেকর্ড থাকে। মামলা-মোকাদ্দমা হয়। এক সময় শাস্তি শেষে ছাড়া পাওয়ারও ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু গুম? এর তো কোনো রেকর্ড থাকে না। গুম হওয়া ব্যক্তির কোনো রেকর্ডও থাকে না। পরিবার-পরিজন জানে না, লোকটি আছে, নাকি নেই। এমন অবস্থা বড়ই মর্মান্তিক। করুণ। বাংলাদেশে ব্যাপক হারে এমনটিই হচ্ছে। অনুষ্ঠান করে গুম-হওয়া লোকদের স্মরণও করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরম নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি এমন খবরের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে। মানবাধিকারের বিরাট লঙ্ঘনের চিত্রও এসব গুমের ঘটনায় লুকিয়ে রয়েছে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দেশে তো বটেই, বিদেশেও উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হয়েছে।
সচেতন মানুষ মাত্রেই এ প্রসঙ্গে জানেন যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে  গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া আইনশৃৃংখলা বাহিনীর খেয়ালখুশিমতো  গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও কর্মক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে রাজনেতিক সহিংসতা, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি, নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা, পরোক্ষ হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় ওঠে এসেছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ‘ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার’ শিরোনামে প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বিগত ২০১৩ সালে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন  কেরি ওয়াশিংটনে তার দফতরে বার্ষিক এ প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন। ৪২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেয়ালখুশিমতো  গ্রেফতার, মতামত প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের দুর্বল অবস্থা ও শ্রম অধিকার। এতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটছে। তবে এতে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়া এবং তদন্তের অঙ্গীকার করা হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়  থেকে। এরপরও বিচার বহির্ভূত হত্যা থেমে নেই। বলা হয়, এমন ঘটনায় সব মিলিয়ে কতজন প্রাণ হারিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তারও পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে না। আবার এসব ঘটনার তদন্তে সমন্বিত ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে  ফৌজদারি শাস্তি  দেয়া হয়েছে কিনা, এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। সরকার র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তদন্তে অভ্যন্তরীণ সেল গঠন করলেও গত বছর এ বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন হত্যার অভিযোগে  কোনো বিচার হয়েছে কিনা, তাও জানা যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ  কেন্দ্রকে (আসক) উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম নয় মাসে র‌্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের হাতে ১৪৬ জন নিহত হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানুষের প্রাণহানির ঘটনাকে কখনও ‘ক্রসফায়ার’, কখনও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা ‘মুখোমুখি সংঘর্ষ’ হিসেবে তুলে ধরেছে প্রশাসন। ২০১২ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন প্রায় ৭০ জন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারকে উদ্ধৃত করে মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৪ জন গুম হয়েছেন। ২০১২ সালে ওই সংখ্যা ছিল ২৪ জন। অন্যদিকে, আসকের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালে গুম হয়েছেন ৩৩ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৮৯ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৪৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ  কোন্দলে সহিংসতা হয়েছে ১৩৫ বার। এতে নিহত হয়েছেন ১৫ জন। বিএনপিতে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৭৫ ও ৬।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে হরতাল চলাকালে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলী ছোঁড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর। এতে নিহত হন ৫ জন। তবে নিহতরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তারা হরতালেও অংশ নেননি। নিহতরা হলেন কৃষক আলমগীর হোসেন, ব্যবসায়ী নাসির আহমেদ, নাজিমুদ্দিন মোল্লা ও শাহ আলম। ২৫ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ন্যাশনাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ আলী মোহাব্বতকে অপহরণ করে র‌্যাব। তার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন তারপর থেকে তিনি কোথায় আছেন তারা তা জানেন না। বছর শেষ হয়ে গেলেও তার কোনো হদিস  মেলেনি। ১৫  মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি ‘দ্য নিউ এজ’ পত্রিকাকে বলেন, ২০১২ সালে আদালত  থেকে তাকে সাদা  পোশাকের পুলিশ অপহরণ করে। এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। এতে  কোনো তদন্তও হয়নি। উল্টো প্রসিকিউশন তাকে অপহরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সুখরঞ্জন দাবি করেছেন, তাকে সীমান্ত  পেরিয়ে অবৈধ উপায়ে ভারতে পাঠিয়ে  দেয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ রাখা হয় নিরাপত্তা হেফাজতে। বছর শেষেও তিনি কলকাতার জেলে বন্দী ছিলেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে হত্যা করা হয় বিশ্বজিৎ দাসকে। এ ঘটনায় জড়িত ৮ জনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট মৃত্যুদ-ের শাস্তি  ঘোষণা করেন। ১৩ জনকে  দেন যাবজ্জীবন কারাদ-। বছরজুড়েই অব্যাহত ছিল গুম ও অপহরণ। এজন্য দায়  দেয়া হয় নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থাগুলোকে। যার মধ্যে রয়েছে র‌্যাব ও সিআইডি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জেলখানার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, জেলখানাগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। এতে আসামীতে ঠাসাঠাসি। পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।
প্রতিবেদনে মিডিয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, মুক্ত মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখাতে মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হয়েছে সরকার। হয়রানি ও হুমকির আতংকে কিছু সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ করেন। সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করেছে পুলিশ। অধিকারের উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, ২০১৩ সালে কোনো সাংবাদিক নিহত না হলেও জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৪৪ সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে না হয় তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন দুই সাংবাদিক। আর হামলা হয়েছে, ৩৯ জনের ওপর। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন করা হয় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে। এ ঘটনায় ২০১৩ সালেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এছাড়া সরকারবিরোধী-সমর্থিত কিছু মিডিয়া বিভিন্ন অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয়।
৫ ও ৬ মে সরকার হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি প- করে দিতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদেও মোতায়েন করে। সরকার দাবি করে, পুলিশ ও ইসলামী দলটির মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আল জারিরা রিপোর্টে বলা হয়, নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন। জুনে অধিকার জানায়, দু’দিনের ওই সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬১ জন।
২০১৩ সালের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেছে মানবাধিকার গ্রুপগুলো, মিডিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য কিছু সংস্থা। যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছেন তারা দায় মুক্তির সুযোগ পেয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার সরকারি প্রতিষ্ঠান হল দুদক। ২০১০ সালের বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকার দুদকের কাজকে খর্ব কওে দেখে এবং তারা দুর্নীতির বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের চেয়ে কম দুর্নীতির মামলা করেছে। পাশাপাশি সরকারি কমিশন হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করার জন্য দুদককে সুপারিশ করেছে। সরকার ৩১ জানুয়ারি পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংকের বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সমালোচনার পর সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রতিবেদনে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭২৯টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ওঠে আসে শ্রমিক অধিকার প্রসঙ্গও। বলা হয়, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়া হলেও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। মার্কিন প্রতিবেদনে সাভারের রানা প্লাজা ধসের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, ওই দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৩ জন শ্রমিক নিহত ও ২ হাজার ৫০০ শ্রমিক আহত হয়েছেন।
তথ্য-পরিসংখ্যান আরো বিস্তারিতভাবে দিলে এ লেখার কলেবর বিরাট আকার ধারণ করবে। উপরে উদ্ধৃত দেশী-বিদেশী স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবরণে বাংলাদেশের মানবাধিকার তথা গুম-হত্যা-নির্যাতনের ভয়াবহতা আঁচ করা সম্ভব। এ সমস্যা দূরীকরণের বদলে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যে কারণে গত শনিবার প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত গুমের স্মরণে সভা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগের আঙুল নির্দেশ করা হয়েছে। গুম ও নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোও জানে, কারা এসব ঘটাচ্ছে। সাধারণ জনগণের চোখও খুলে গেছে। তারপরও উচ্চ পর্যায় থেকে গুম-খুনের মতো মৌলিক অপরাধ আর মানবতার প্রতি জঘন্য আচরণ বন্ধ করা হচ্ছে না। এমন কি, অপরাধ স্বীকার বা দোষীদের  চিহ্নিত করারও কোনো খবর জানা যায় নি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে মানবাধিকার বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক আইনগত অধিকার এবং নিরাপত্তার বিষয়টিও ভূলুণ্ঠিত হবে। সভ্য সমাজে এমনটি কখনোই কাম্য হতে পারে না। 
কনক জ্যোতি 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী... রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও শূন্যতা

রাজনীতিশব্দটি বিশ্বজনসমাজে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলেই দেশে দেশে রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ দেখা যায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানবসত্তার অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে রাজনীতি। প্রাচীন গ্রিসে জ্ঞানীদের শিকবলে যাকে মান্য করা হতো, সেই অ্যারিস্টটলের বহু উদ্ধৃত মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য ÔMan is by nature a political animal.Õ রাজনৈতিক জীব হিসেবে মানুষের আচরণ ইতর প্রাণীর চেয়ে উত্তম। কারণ মানুষ প্রাণিজগতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। তারা নিজেদের মাঝে ভিন্ন ধরনের মতামত, পৃথক চাহিদা ও পরস্পরবিরোধী স্বার্থকে উপস্থাপন করতে পারে।
আসলে রাজনীতি কী সেই প্রশ্নটির উত্তর সবাই নিশ্চিতভাবে পেয়ে গেছেন, তা বলা যাবে না। হয়তো একটা সর্বজনগ্রাহ্য রূপরেখা পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং রাজনীতিনামে পরিভাষাটিকে ঘিরে এখনো নানা বিতর্ক ও মতানৈক্য বিদ্যমান রয়েছে। রাজনীতির বিষয়বস্তু নিয়ে নানাজন নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে প্রাচীনকালের রাজনীতির আলোচনা শুরু হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা সম্পর্কিত চর্চা থেকে। এখন সরকার, সরকারের প, বিরোধী প, ক্যাবিনেট, পার্লামেন্ট, আমলাতন্ত্র, কর্মচারী, ক্যান্টনমেন্ট, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, নির্বাচন, অর্থনীতি, জনগণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক, শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী, সুশীলসমাজ ইত্যাদির সমন্বয়ে রাজনীতির পরিসীমা নির্ণীত হয়।
রাজনীতি পরিসীমার অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলো সময়ের ব্যবধানে নিরন্তর নানা অভিঘাতে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। যেহেতু রাজনীতি সামাজিক কার্যকলাপ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই সমাজভুক্ত পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্ঘাত থেকে রাজনীতির আবির্ভাব হয় বলে অনেক পণ্ডিত সমাজবিজ্ঞানের বিচারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিশ্লেষণ করে থাকেন।
তবে রাজনীতিচর্চা তার ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় আদিম বন্য বর্বর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভবকালে রাজন্যবর্গ, অভিজাততন্ত্র, জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং উদার ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রকে ঘিরে রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনের স্বরূপ নানা যুগে নানা দেশে পৃথিবীর মানুষ নানাভাবে অবলোকন করেছে। রাজনীতিশাস্ত্রের চর্চা, সরকার, সেনাবাহিনী ও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে আটকে না থেকে আধুনিক যুগে বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করেছে। সেই থেকে রাষ্ট্রের সংগঠিত নাগরিকেরা রাষ্ট্র ও সমাজের নানা প্রয়োজন যেমন সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, ক্রীড়া ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছেন এবং এর ফলে নানা পরস্পরবিরোধী মতবাদের উদ্ভব ঘটিয়ে সঙ্ঘ গড়ে তুলেছেন। মানবসমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র, সরকার, জনসমাজ ও জনজীবনের নানামুখী বিষয় নিয়ে চিন্তাশীল মানুষের যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে যে মতবাদ গড়ে ওঠে, তাতে আবর্তিত হয়েই ক্রমান্বয়ে জনসমাজে রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ঘটে। রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ ইত্যাদি নিয়ে মানুষের ভাবনাকে আমরা রাজনৈতিক ভাবনা বলে অভিহিত করতে পারি, যা রাজনৈতিক মতবাদে পরিণতি লাভ করে। এভাবেই রাজনৈতিক চিন্তা অগ্রগতির ক্রমধারায় নাগরিকদের সামষ্টিক চেতনায় আধুনিক স্তর লাভ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে রাজার মতাকে কেন্দ্র করে পার্লামেন্টে টোরি ও হুইগরা তুমুল ঝগড়ার সূত্রপাত করেন। ইংল্যান্ডে রাজার উত্তরাধিকার ও স্বর্গীয় চরম মতার অধিকার নিয়ে বিতর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়। বহু বাদানুবাদের পর টোরিরা হুইগদের অনুকরণে রাজার স্বর্গীয় মতার কিছুটা কর্তন করতে রাজি হন এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের মতবাদ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও সরকারের স্বরূপ নিয়ে পার্লামেন্টে ও বাইরে ইংল্যান্ডে চিন্তাশীল মানুষের যুক্তিতর্ক রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে রণশীল ও উদার মতবাদে মূর্ত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুক্তরাষ্ট্রেও ফেডারেল সরকার ও স্থানীয় সরকার বিতর্কে দুজন প্রেসিডেন্ট জড়িয়ে পড়েন। বিতর্কের পরিণতি লাভ করে ভোটাভুটিতে এবং এতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জয় লাভ করে। এরপর সেখানে ফেডারালিস্ট ও অ্যান্টি-ফেডারালিস্ট এ দুটি মতবাদের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলো উৎপত্তি লাভ করেছে।
ওপরের উদাহরণগুলো চিরায়ত গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের বিবর্তনপ্রক্রিয়া। উদারবাদী বহুমাত্রিক চেতনা আধুনিক মননেরই আবিষ্কার, তবে দেশে দেশে প্রাচীনকাল থেকেই এটি ভিন্নমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্ঘাত, আবার নিজেদের কল্যাণচিন্তার বৈচিত্র্যের কারণেই বহুত্ববাদী চিন্তা সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চর্চা করে এসেছিল। মানবসমাজে বহু মত ও পথের অস্তিত্বের কারণে রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। অবশ্য যুগে যুগে নিষ্ঠুর শাসকেরা মানুষের বহুত্ববাদী চিন্তাকে নির্মূল করে দুঃশাসন চালু রেখেছিল। অনেক দেশে বিংশ শতাব্দীতে এবং এখনো দুঃশাসনের দৃষ্টান্ত রয়েছে, টিকে আছে একদলীয় একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। একদলীয় রাষ্ট্রে দলের কাছে শর্তহীন আনুগত্যই জনগণের জন্য নির্ধারিত।
আধুনিককালে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলোর সমান্তরালে একক রাজনৈতিক দলের one party state গুলো সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে। তথ্যের মুক্ত প্রবাহ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন একটি প্রাণশক্তি, যার কারণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী জাতীয় কোনো ইস্যুতে তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করে ইস্যুটির সঠিক বিচার করতে পারে; কিন্তু একদলীয় রাষ্ট্রে one point of view বা একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের মধ্যে উপস্থাপিত করা হয়, যা সত্যও হতে পারে, আবার নাও পারে; কিন্তু সেটিকে নিয়ে জনগণকে তর্ক-বিতর্ক করার অনুমোদন দেয়া হয় না। মানবপ্রকৃতি শরীর ও মনকে যেকোনো ধরনের খোঁয়াড় বা বন্দিশালায় রাখার বিরোধী। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় ইস্যু নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলে মতামতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তর্কিত বিষয়টির সূক্ষ্ম বিচার নিশ্চিত করা যায় এবং একটি ইতিবাচক পরিণতিতে উপনীত হওয়া যায়। একদলীয় অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় যেকোনো ইস্যুতে প-েবিপে বিতর্কের অনুপস্থিতিতে নিরপে বিচারের কোনো সুযোগ থাকে না। সেখানে ইস্যুটির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণই বড় কথা। কারণ, সেখানে বিরোধী মতামতের কোনো সুযোগ থাকে না। ইস্যুটির যৌক্তিক পরিণতির জন্য পরস্পরবিরোধী বিতর্কের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছ বিচারের প্রক্রিয়ায় যে নৈতিক মান ফুটে ওঠে, তা স্বীকার করা হয় না। একদলীয় রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি জনপ্রিয় হলেও ধীরে ধীরে অলৌকিক মতার দেউলে অধিষ্ঠান করতে থাকেন স্বার্থপর পূজারিদের অর্চনায়। কারণ, তখন তার টিকে থাকার জন্য জনগণের মতামতের প্রয়োজন হয় না। এ অবস্থায় পূজারিদের সাড়ম্বর উপস্থিতি সর্বত্র দেখা যায়।
এ ধরনের রাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক শূন্যতার দিকে এগিয়ে যায়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলনের অভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, শূন্যতা গভীর থেকে গভীরতর হয়। ইউরোপে একটি প্রবাদ আছে Nature abhor vaccum. অর্থাৎ প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে।তাই এ রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কালবৈশাখীর হুঙ্কার শোনা যাবেই, শূন্যতাকে পূরণ করতে ধেয়ে আসা ঝড়ো হাওয়া সব কিছু ওলটপালট করে দেবেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কিছুটা অরাজকতা থাকবেই, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করলে রাষ্ট্র নিজেই তীব্র প্রতিশোধ হানে।
রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি দুর্বল হয় জনগণের কণ্ঠরোধে, বিবেক, চিন্তা ও উপাসনার অধিকার সঙ্কুচিত করে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার মধ্য দিয়ে। ১৯৭২-৭৫ সাল ছিল রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিস্তেজ করার এক ধারাবাহিক কর্মসূচি। দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাকশাল কায়েম করে চৈতন্যহীন অন্ধশক্তি হুড়মুড় করে ভেঙে ফেলে নির্মাণাধীন গণতন্ত্রের কাঠামো। শুরু হলো রাষ্ট্রকে দুর্বল করার পালা, ছড়িয়ে পড়ল রাজনৈতিক শূন্যতা। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার পর সেই শূন্যতা অনেকখানি পূরণ হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। কারণ, দলটি বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে সবল করে তুলতে সম হয়েছিল।
রিজভী আহমেদ : বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিচারপতির অপসারণ : খায়রুল হক সাহেব সেদিন কি বলেছিলেন আর আজ কি বলছেন



বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির মর্যাদায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন এবং এখনও সেই পদে বহাল আছেন। আইন কমিশনের চেয়াম্যান হিসাবে তিনি সরকারের কাছে সুপারিশ করেছেন যে, জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে অর্থাৎ জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্টের কাছে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন ও অপসারণের ক্ষমতা ফেরত দেওয়া হউক। এই উদ্দেশ্যে দেশের প্রথম সংবিধান অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হউক। এই সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেছেন এবং মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেটি অনুমোদন করেছেন। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এই সুপারিশ বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সেই অধিবেশনেই এটি পাস হয়ে আইনে রূপান্তরিত হবে এবং সংবিধানের সংশোধনী হিসাবে আইনে পরিণত হবে বলে সরকারি মহল আশা করছেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
“(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সদস্যের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।

 এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীনের প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।

সরকারি মহল থেকে বলা হয় যে, মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের নিকট থেকে কেড়ে নেন এবং সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নিকট অর্পণ করেন। এটি সত্য নয়। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের যে চতুর্থ সংশোধনী পাস হয় এবং বাকশাল গঠিত হয় সেই সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সংসদের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে প্রেসিডেন্টের হাতে অর্পণ করা হয়। এ সম্পর্কে ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনীতে বলা হয়,

“ (ক) (২) দফার পরিবর্তে নি¤œরূপ (২) দফা প্রতিস্থাপিত হইবে :

(২) অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা কোন বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবেঃ

তবে শর্ত থাকে  যে, কোন বিচারককে তাঁহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত  তাঁহাকে অপসারিত করা যাইবে না ”

১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণা পত্রে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যাস্ত করা হয়।ঐ ঘোষণা পত্রে বলা হয় যে এই কাউন্সিলের প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং দুইজন সদস্য হবেন সেই দুইজন বিচারপতি যারা জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে সিনিয়র মোস্ট। এই কাউন্সিলের সুপারিশ মোতাবেক প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ করা হয়।

২০০৫ সালে বিচারপতি খায়রুল হক এবং বিচারপতি ফজলে কবীর পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। একই সাথে তিনি খন্দকার মোশতাক, প্রেসিডেন্ট সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। পঞ্চম সংশোধনী মামলা বাতিলের রায়ে এ বি এম খায়রুল হক সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পক্ষে বলেছেন। সেদিন তিনি কেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করেননি ? আজ তিনি কেন তার সে মতামতের সম্পূর্ণ উল্টা মতামত দিচ্ছেন? পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়টি বহাল রাখেন। কিন্তু সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অনুচ্ছেদটি বাতিল করেননি। সেটিকে তারা বহাল রাখেন।

 জনাব খায়রুল হক অপর একটি রায়ে ঘোষণা করেন যে, মরহুম জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন। তিনি আরেকটি রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেন, ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার ফলে গত ৫ জানুয়ারীর তীব্র বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করে দেন জনাব খায়রুল হক। এই রায়েও তিনি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করেননি।

দুই

সংবিধানের সংশোধনীর জন্য আওয়ামী লীগ খুব ঘটা করে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করে। পঞ্চম সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানের সবচেয়ে বড় সংশোধনী। এটিকে একটি ছোটখাট সংবিধান বলা যেতে পারে। এত বিশাল একটি সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও  সেখানেও  সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখা হয়।

এভাবেই চলছিল। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পর এমন কি ঘটল যে খায়রুল হক সাহেবকে ৯৬ অনুচ্ছেদ ফেরত আনার জন্য সুপারিশ করতে হল ? আর সরকারই বা সাথে সাথে সেই সুপারিশ লুফে নিল কেন?

জনাব খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির মর্যাদায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন? এ সম্পর্কে বর্তমান সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে,

 [৯৯। (১) কোন ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী- অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন ব্যতীত) বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।

উপরোক্ত অনুচ্ছেদ মোতাবেক  তার বর্তমান পদ কি ‘বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয়’ সেটি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন, তার এই পদটি প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদ কি না ।

 জনাব খায়রুল হক যদি ১৯৭২ সালের ৯৬ অনুচ্ছেদে ফেরত যাওয়ার সুপারিশ করেন তাহলে তিনি ’৭২-এর সংবিধানের ৯৯ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার পক্ষে সুপারিশ করছেন না কেন ?

১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকিবে।”

’৭২ সালের সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“৯৯। কোন ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানবলী অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্বপালন ব্যতীত) বিচারকরূপে দায়িত্বপালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।”

সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের (২) উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরিতা কালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।”

 যে সংসদে ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫৩ জনের নির্বাচনে জনগণকে  ভোট দিতে হয় না এবং অবশিষ্ট ১৪৭ জনের নির্বাচনে ২০ শতাংশও ভোট পড়েনা সেই সংসদের নিকট বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা কতখানি জনগণের ক্ষমতা বলে পরিগণিত হতে পারে সেটি খায়রুল হক সাহেবসহ বিবেকবান মানুষ বিচার করবেন। 

তিন

সরকার যদি জনগণের ক্ষমতায়ন তথা পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার নীতিতে এত বিশ্বাসী হয় তাহলে তারা সংবিধান সংশোধন  করার উদ্দেশ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ গ্রহণ করেনি কেন? ২০১১ সালের মার্চ মাসে কমিটি সুপারিশ করেছিল যে, সাংবিধানিক পদসমূহে যে নিয়োগ  দেওয়া হবে সেই নিয়োগ সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এই জন্য অভিজ্ঞ ও সিনিয়র সংসদ সদস্যগণকে নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হবে। তারা নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শুনানি গ্রহণ করবেন। শুনানিতে ঐ কমিটি সন্তুষ্ট হলে তারা সেই নিয়োগ অনুমোদন করবেন এবং অনুমোদনের পর নিয়োগপ্রাপ্তরা শপথ গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু এই সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিশেষ সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী, যিনি তখন ঐ সংসদের সরকারি দলের উপনেতা ছিলেন। এই কমিটির কো চেয়ারম্যান ছিলেন বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের লোক। তারপরেও তারা সেই সুপারিশ গ্রহণ করেনি। কারণ সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সোজা কথায় প্রধানমন্ত্রী, চেয়েছিলেন যে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতিবৃন্দ,  প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার,  দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, এ্যাটর্নী জেনারেল,  কম্পট্রোলার জেনারেল, অডিটর জেনারেল প্রভৃতি পদে নিয়োগ দানের ক্ষমতা তার হাতে তথা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকুক।

বিশেষ সংসদীয় কমিটি ৩০ মে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করে। প্রস্তাবে বলা হয় যে, সংসদীয় কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যাদের  ডাকা হবে তারা সবাই হাজির হতে বাধ্য থাকবেন এবং যে সমস্ত দলিল তলব করা হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সে সব দলিল দাখিল করতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু কয়েকজন মন্ত্রী এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তারা বলেন যে, এটি যদি আইন হয় তাহলে তাদের জন্য কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রধান মন্ত্রী ঐ মন্ত্রীদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ফলে প্রস্তাবটি মাঠে মারা যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, বিশেষ সংসদীয় কমিটি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেন। বলা হয় যে এই ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের পায়ে পরাধীনতার শিকল পরিয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ভয়ে সদস্যরা স্বাধীনভাবে সংসদে কথা বলতে পারেন না। কারণ স্বাধীনভাবে কথা বললে যদি সেটি বড় বড় নেতার চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যায় তাহলে তাদেরকে সংসদ পদ হারাতে হবে। ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল কয়েকজন প্রখ্যাত আইনবিদ কমিটির বৈঠকে যোগদান করেন। তারা এবং অন্যরা বলেন যে ৩টি বিষয়ে সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। এ গুলো হল, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা, সরকারের বাজেট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। অবশিষ্ট বিষয়ে তারা স্বাধীনভাবে  ভোট দিতে পারবেন। এই প্রস্তাবটিও এই সরকার গ্রহণ করেনি।

 জনগণের ক্ষমতায়ন তথা পার্লামেন্টকে অধিক ক্ষমতা দেওয়াই যদি প্রস্তাবিত ষোড়শ সংশোধনীর উদ্দেশ্য হয় তাহলে ওপরে যে সব প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করা হল  সেগুলো বর্তমান সরকার গ্রহণ করেনি কেন? অথচ প্রস্তাবগুলী দিয়েছিল এই সরকারেরই একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সদস্যবৃন্দ। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, জনগণের ক্ষমতায়ন বা পার্লামেন্টের ক্ষমতায়ন নয়, সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই এই সরকারের আসল মতলব।
আসিফ আরসালান
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অবাধে হত্যার উৎসব

কখনো কখনো চমকে চমকে উঠতে হয়। সন্ত্রাসী, প্রতিপক্ষ কিংবা রাজনৈতিক জিঘাংসার শিকার হয়ে প্রতিদিনই দেশের কোথাও-না-কোথাও অপঘাত মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ নাগরিকেরা। এভাবে হিসাব মিলালে দেখা যায়, ডজন ডজন পরিবারে প্রতিদিনই কান্নার রোল উঠছে। এর ওপর আছে গুম। একটি জলজ্যান্ত মানুষ সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়েছিলেন হয়তো কোনো কাজে, নয়তো চা খেতে; কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। অদৃশ্য ঘাতকেরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। কোনো দূর বিজন প্রান্তে কোনো নদী-নালা, ডোবা-খাল, ধানক্ষেত, ডাস্টবিনের ম্যানহোলে এরা হারিয়ে যান। পরিবারের সদস্যরা বুক ফাটা কান্নায় হৃদয়ের ভার যে কিছুটা লাঘব করবেন তারও কোনো উপায় থাকে না। হয়তো ভাবেন, এই বুঝি হারিয়ে যাওয়া স্বজন ঘরে ফিরে এলো। হয়তো সে আসবেই। আজ হোক কাল হোক। পরিবারজুড়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক। কেবল চাপা দীর্ঘশ্বাস আর ভয়। সংসারজুড়ে শীতের ঘন কুয়াশার মতো আবৃত হয়ে থাকে। 
ভিন্ন দিকও আছে। হয়তো ঘর থেকে কোনো কাজে বের হলো জায়া, জননী, ভগ্নী। হয়তো যাবেন এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি। কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায়। সেও যে জীবিত ইজ্জত নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সর্বত্র ওঁৎ পেতে আছে সরকারদলীয় খুনি, মাস্তানেরা। এরা পথ আটকে যে কোনো নারী বা শিশুকে প্রায় প্রকাশ্যেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শ্লীলতাহানি করছে। কখনো তারা দাঁড়াচ্ছে মুখোমুখি। প্রতিবাদ প্রতিরোধের মোকাবেলার আশঙ্কা থাকলে শ্বাসরোধ করে কিংবা গলা কেটে ওই নারী বা কন্যাশিশুকে হত্যা করছে। আবার একই কায়দার ঝোপঝাড়, ডোবা নালা, বনবাদাড়ে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। কখনো লাশ কুটি কুটি করে কেটে বস্তায় ভরে এখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে। মুখের চেহারা এমনভাবে বিকৃত করছে যে, যাতে মুখ দেখে চেনাই না যায়। কে ছিল এই নারী বা কন্যাশিশু। 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। কখনো কখনো আমরা দেখি লাশ কিংবা লাশের টুকরো দিনের পর দিন ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে। এ থানা বলে ওটা আমাদের এলাকা নয়, ও থানা বলে এটা আমাদের এলাকা নয়। তা হলে লাশের কী হবে? শিয়ালে-কুকুরে-কাকে-ঈগলে মানুষের লাশ খুবলে খুবলে খায়। যাদের চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে, তারা কার্যত কিছুই করতে পারেন না। কেননা এই লাশ শনাক্ত করা, মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করার দায়-দায়িত্ব দারোগাবাবুর। কেউ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে এ লাশ দাফন করতে চান, তাহলে থানা পুলিশ তাকে নিয়েই টানা-হেঁচড়া শুরু করবে। থানায় যাও, আদালতে যাও, সাক্ষ্য দাওÑ এই টানা-হেঁচড়ার ভেতরে কে যাবে! ফলে হৃদয়বান-বিবেকবান মানুষ দাফনের মতো ফরজ কাজটিও করতে পারে না। তাদেরও দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়। 
রাষ্ট্রে শাসনক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন যে প্রশাসন তাদের মুখের ভাষা, শরীরের ভাষা অত্যাচারী জমিদারের পাইক-পেয়াদাদের মতো। আর দেশের নাগরিকেরা যেন তাদের বশংবদ প্রজামাত্র। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় জনগণই দেশের মালিক। আর ওই সব প্রশাসনিক কর্মকর্তা তাদের খেদমতগার; কিন্তু সাড়ে পাঁচ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনে এখন জনগণ সত্যি এক নিপীড়ক জমিদারতন্ত্রের শিকার। এই পীড়ন অ্যালেক্স হ্যালির দি রুটস্উপন্যাসের মতো। এ দেশের নাগরিকদের সব সম্পদ জায়া-জননী-ভগ্নি সব কিছুই যেন আওয়ামী শাসক, সন্ত্রাসী ও প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নিবেদিত। এমন বিধানই করেছে সরকার।   
এই যে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে, সেগুলো নিয়ে এক ধরনের ঠাট্টামশকারা করতে শুরু করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যা, ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম হত্যা, তার আগে নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যাÑ এসব ঘটনার পরপরই সরকারের শীর্ষপর্যায়ের লোকেরা একবাক্যে রায় দিয়ে দেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিএনপি-জামায়াত জড়িত। কিন্তু সত্য তো সব সময় ধামাচাপা দেয়া যায় না। দেখা গেল নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যায় জড়িত আছে সরকারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং র‌্যারেব দায়িত্বশীল সদস্যরা। হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি কমিশনার নূর হোসেনের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ। র‌্যাবের যে কর্মকর্তা প্রধান অপারেটর, সেই লে. ক. তারেক সাইদ সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর জামাতা। এই মন্ত্রীর ছেলের নামও এখানে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আরো যারা দৃশ্যপটে আবির্ভূত, তারাও র‌্যাবেরই সদস্য। যারা খুন হয়েছেন আর যারা খুন করিয়েছেন উভয়ই আওয়ামী লীগের সদস্য সমর্থক। অভিযোগে প্রকাশ, তাদের পেছনে আছেন নারায়ণগঞ্জের গডফাদার বলে খ্যাত শামীম ওসমান। তিনি নূর হোসেনকে ভারতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। তাকে বিচারের আওতায় না এনে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, শামীম ওসমান পরিবারের যেকোনো বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে থাকবেন। আশকারা আর কাকে বলে! 
এদিকে আবার নারায়ণগঞ্জের সাত খুন থেকে শুরু করে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের খবর খুব স্বাভাবিকভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। গণমাধ্যমে এসব কথা প্রচার হওয়ায় সরকার মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে। সরকারের এক মন্ত্রী এমন তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন যে, নারায়ণগঞ্জের সাতটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিডিয়াগুলো যা করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা নাকি কোথাও হয়নি। সুতরাং সাংবাদিকদের এমন কষে গালি দিলেন যে, যা কেবল বিশেষ শ্রেণীর মুখেই মানায়, সবার মুখে নয়। এরপর তিনি জানান দিলেন, এমন সম্প্রচার আইন করা হবে যে, সাংবাদিকেরা যাতে টুঁ শব্দটি করতে না পারেন। তারপর সত্যি সত্যি সে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়ে গেল। 
কিন্তু এরকম আইনের হঠাৎ কেন প্রয়োজন পড়ল? বিরোধী মতের যা কিছু সংবাদপত্র বা ইলেকট্রকিন মিডিয়া ছিল, তা সবই তো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসএসবি বন্ধ, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ, দিগন্ত টিভি বন্ধ, ইসলামিক টিভি বন্ধ, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ, সম্পাদক কারাগারে, দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক কিছু দিন কারাভোগ করে এসেছেন। দৈনিক ইনকিলাবও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গণহারে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছিল। এখন আবার ঠুনকো অজুহাতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে এর বার্তা সম্পাদককে রিমান্ড শেষে কারাগারে রাখা হয়েছে। 
আর যারা এখন বাজারে সচল তাদের প্রায় সবই সরকারের তাঁবেদার ও স্তাবক। সরকারের খাস লোক। তারপরও কেন এমন আইন করা হচ্ছে। তার কারণ, জনভিত্তিহীন সরকার আসলে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না। সরকারও তার আপনজনকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কখন কোন ফাঁক দিয়ে কোন অপকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়ে? সব সময় সেই ভয় আর আতঙ্কে সরকার থরহরিকম্প। 
 সেই কারণেই সম্প্রচার নীতিমালায় সরকার এমন বিধান রেখেছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয় এমন কিছু প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ পুলিশের চাঁদাবাজি, গ্রেফতার বাণিজ্য, চাঁদার দাবিতে খুনÑ কোনো কিছুই প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। 
আর ছাত্রলীগ তো খুনি-টেন্ডারবাজ-দখলবাজ বাহিনী হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে। হেন অপরাধ নেই যা তারা করে না। নারী নির্যাতনও তাদের জন্য ডালভাত, সম্ভবত অধিকারও। ফলে সমাজে অপরাধ, হত্যা, গুম, নারী নির্যাতন এখন ডালভাতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় ইসলামিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে খুুন করে কিছু যুবক। হাত-পা বেঁধে, গলা কেটে পূর্ব রাজাবাজারের বাসার ডাইনিং রুমে হত্যা করে নির্বিঘেœ চলে যায়। তিনি সুন্নিভিত্তিক সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ইসলামিক ফ্রন্টের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। এ ঘটনার পরপরই সরকারি মহল থেকে রটানোর চেষ্টা হলো যে, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের লোকেরা তাকে হত্যা করেছে। এমনিতেই প্রতিদিন শত শত বিএনপি ও জামায়াতের লোকদের গ্রেফাতার করা হচ্ছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ সংখ্যা হয়তো আরো বাড়বে। 
মাওলানা ফারুকীর রক্তের দাগ শুকাবার আগেই ৩৬ ঘণ্টার মাথায় মগবাজারের এক বাসায় ঢুকে দুর্বৃত্তরা একই পরিবারের তিনজনকে হত্যা ও একজনকে গুরুতর জখম করেছে। টেলিভিশনে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত তৃপ্তির হাসি দিয়ে কাদের সাথে যেন কথা বলছেন। মতিয়া চৌধুরী খিচ্চে বিএনপিকে গাল দিচ্ছেন আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কামাল মগবাজারে খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। 
এভাবেই এসব লোমহর্ষক ঘটনার ইতি ঘটে। ইতি ঘটে যায়; কিন্তু মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামে না। ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। 
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাণিজ্য ঘাটতি এবং ভারতীয়দের উপদেশ


২০০৬ সালের মার্চে চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর এটাই ছিল তার একমাত্র ভারত সফর। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শুধু নয়, দিল্লি গিয়েছিলেন তিনি সার্কের চেয়ারপারসন হিসেবে। সাংবাদিক হিসেবে আমারও সুযোগ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। সে হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয়দের কাছে গুরুত্ব যথেষ্টই পেয়েছিলাম। থেকেছি দিল্লির একমাত্র সেভেন স্টার বা সাততারকা হোটেল মৌর্য শেরাটনে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী অবস্থান করেছেন (উল্লেখ্য, এর মাত্র কিছুদিন আগে ভারত সফরে আগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ হোটেলের যে সুইটে ছিলেন, বেগম খালেদা জিয়াকেও সে সুইটেই থাকতে দেয়া হয়েছিল)। ওই তিনদিনে বহুকিছু দেখেছিলাম খুব কাছে থেকে। সফরের তৃতীয়দিনে অন্য একটি পাঁচতারকা হোটেল অশোকায় বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন প্রধান অতিথি। ওই সম্মেলনে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যখন বাংলাদেশে আরো বেশি রফতানি ও বিনিয়োগ করার সুযোগ-সুবিধার দাবি ওঠাচ্ছিলেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা তখন বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রথমে বাংলাদেশের জন্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গটি নিয়ে সম্মেলনে গুঞ্জন তো উঠেছিলই, কিছুটা উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী কমলনাথ। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ছয়ফুর রহমানকে নিজের ‘বিশিষ্ট বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, তার এই ‘বন্ধু’ নাকি কখনো তাকে জ্ানাননি যে, বাংলাদেশ এত বিপুল ঘাটতির মধ্যে রয়েছে! মন্ত্রী কমলনাথের ভাবখানা এমন ছিল যেন ছয়ফুর রহমান জানালেই তিনি বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার ব্যবস্থা নিতেন! বলাবাহুল্য, কমলনাথের ওই হাস্যকর বক্তব্য মাঠে মারা গিয়েছিল। তার কথা এমনকি ভারতীয় সাংবাদিকরাও বিশ্বাস করেননি।
প্রায় সাড়ে আট বছর আগের ঘটনাটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার বিশেষ কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হলো, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারত সব সময়ই অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। এমনকি বাংলাদেশের চাইতেও। কিন্তু পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এই দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সকল বিষয়ে বাংলাদেশ কেবল পিছিয়েই পড়েছে। অতীতের মতো বিগত পাঁচ বছর আট মাসে ভারত শুধু নিয়েছেই। এখনো সে নেয়ার ও নিজের ইচ্ছাপূরণ করার ব্যাপারেই ব্যস্ত রয়েছে দেশটি। শেখ হাসিনার সরকারও বাণিজ্যসহ প্রতিটি বিষয়ে কেবল উজাড় করেই দিয়ে চলেছে। সরকার একই সঙ্গে বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রেও পরিণত করে ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা কাঠামোগত চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াই যথেষ্ট হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ‘ঐতিহাসিক’ সে সফরের সময় স্বাক্ষরিত এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। কোনো মেয়াদের উল্লেখ না থাকায় বাংলাদেশ কখনো এই চুক্তি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ পাবে না।  চুক্তিটির মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির শেকলে বেঁধে ফেলেছে ভারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়েও বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভ’মিকা পালন করতে হবে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে এমনকি সামরিকভাবেও জড়িয়ে পড়তে হতে পাবে।
বর্তমান পর্যায়ে কথা উঠেছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অতি সাম্প্রতিক সফর এবং সফরকালীন কিছু বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। যথেষ্ট আটঘাঁট বেঁধেই এসেছিলেন তারা। প্রতিনিধি দলে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল মোদী সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জেনারেল (অব) ভি কে সিং-এর অন্তর্ভুক্তি। কারণ মিস্টার ভি কে সিং মাত্র বছর দুই আগে ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন। অবসর নেয়ার পরপর বিজেপিতে যোগ দেয়ায় এবং তারপর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় এই অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারতের সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে আসলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তৎপর রয়েছে। এটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ, যা নিয়ে পরবর্তীকালে আলোচনা করা যাবে। এখানে জানানো দরকার, গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে দু’ দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও আইবিসিসিআই আয়োজিত বাণিজ্য উন্নয়ন সম্মেলনেও ভারতীয়রা যথারীতি আশ্বাসের আড়ালে নিজেদের দিকটিকেই প্রাধান্যে এনেছেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য জেনারেল (অব) ভি কে সিং-এর কিছু কথার উদ্ধৃতি দেয়া যায়। বাণিজ্যসহ দু’ দেশের অর্থনৈতিক সুসম্পর্কের ব্যাপারে উপদেশ খয়রাত করলেও তিনি কিন্তু বাংলাদেশের ঘাটতির বিষযটিকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে গেছেন। তিনি বরং নজর ফেলেছেন বাংলাদেশের গার্মেন্টের দিকে। বলেছেন, এই খাতটিতে ভারত ও বাংলাদেশের উচিত যৌথভাবে বিনিয়োগ করা। সাবেক এ সেনাপ্রধানের উদ্দেশ্যের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো অস্পষ্টতা নেই। বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক গার্মেন্ট বাজারে প্রায় শীর্ষ অবস্থানে চলে গেছে ভারতের সেহেতু ‘ভাগ’ বসানো দরকার! ডভ কে সিং অবশ্য বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের জন্যও নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন, তারা যেন মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ করেন! হাইকমিশনার পংকজ শরণসহ অন্য ভারতীয়দের বক্তব্যেও লক্ষ্যণীয় ছিল ভারতের স্বার্থ। তারা মেঘালয় থেকে নগদ মূল্যেও বিনিময়ে বিদ্যুৎ আমদানি করার পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু বলেননি, মূল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ কিভাবে ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে।
বলা দরকার, এবারই প্রথম নয়। এর আগেও সময়ে সময়ে আশ্বাস কম দেননি ভারতীয় নেতারা কিন্তু প্রতি বছর ঘাটতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বৃহৎ এ প্রতিবেশি দেশটি থেকে আমদানি লাফিয়ে বাড়লেও নানা ধরনের শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাড়তে পারছে না। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে ভারতীয়দের বছর দুই আগের একটি সফরের কথা স্মরণ করা যায়। সেবার ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং রাজ্য সভার সদস্য মণি শংকর আয়ার। বাংলাদেশের  ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে একজন দার্শনিকের স্টাইলে মিস্টার আয়ার বলেছিলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘অর্থনৈতিক সীমারেখা’ রাখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি দাবি করেছেন, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা নাকি ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন বড় কোনো বাধা বা বিষয় নয়! মিস্টার আয়ারের মতে, প্রধান বাধা নাকি ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের ‘মাইন্ডসেট’! এই ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তন করার জন্য নসিহত করেছিলেন তিনি। মণি শংকর আয়ার তাই বলে মূল ভারতে বাণিজ্য বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দেননি, যেমনটি এবার দেননি জেনারেল (অব.) ভি কে সিং। মিস্টার আয়ারও ভি কে সিং-এর মতোই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিনিয়োগ করতে বলেছিলেন। সেখানে নাকি বাংলাদেশের জন্য ‘প্রচুর সম্ভাবনা’ রয়েছে! শুধু তা-ই নয়, দেশে ফেরার আগেও চমক লাগিয়ে গিয়েছিলেন মণি শংকর আয়ার। বলেছিলেন, নিজেদের স্বার্থেই চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন করতে চায় ভারত। কারণ, বাংলাদেশ নাকি বন্দরের যে ক্ষমতা তার ২৫ শতাংশও ব্যবহার করতে পারছে না। জেনারেল (অব.) ভি কে সিংও কিন্তু ‘স্থলপথ ও নৌপথসহ ‘সব ধরনের’ যোগাযোগ ব্যবস্থা ‘সহজ’ করার নসিহত করে গেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মাথা বাংলাদেশের হলেও ব্যথায় মরে যাচ্ছেন মণি শংকর আয়ার থেকে ভি কে সিং পর্যন্ত ভারতীয়দের সকলেই!
অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কিন্তু তাদের দাবি ও বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলেছেন, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা ছাড়াও কাস্টমস ও ব্যাংকিং সমস্যা এবং মান পরীক্ষার নামে সীমান্তে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে পণ্য আটকে রাখার ভোগান্তিসহ ভারতীয় আইনের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণেই ভারতে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ছে না। দু’ দেশের বাণিজ্য ঘাটতিও দূর হচ্ছে না। মাঝখান দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তারা তাই ভারতে রফতানির ব্যাপারে অগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর ফলেও বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এদিকে দেশপ্রেমিকরা বলেছেন, বাংলাদেশ বন্দরের ক্ষমতার কত শতাংশ ব্যবহার করা হবে সেটা বাংলাদেশের নিজের ব্যাপার। তাছাড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বলেও একটা কথা আছে। ভারত একবার বন্দর ব্যবহার শুরু করলে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের প্রয়োজন দেখা দিলে তখন কিছুই করার থাকবে না বাংলাদেশের। কারণ, ভারত তো অবশ্যই ছাড় দেবে না।
এভাবে যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে  ভারতের নীতি, আশ্বাস ও কার্যক্রম আসলে প্রতারণাপূর্ণ। কারণ, প্রকাশ্যে আমদানি বাড়ানোর এবং ঘাটতি কমিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও ভারত সুকৌশলে এমন কিছু শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার সৃষ্টি করে চলেছে যার ফলে রফতানির সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ভারত থেকে নানা ধরনের অসংখ্য পণ্য আসছে বাংলাদেশে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো জানিয়েছে, ভারত থেকে যেখানে ২০৮৬ ধরনের পণ্য আসছে বাংলাদেশ সেখানে মাত্র ১৬৮ ধরনের বেশি পণ্য রফতানি করতে পারছে না। নিজেদের শিল্প সংরক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশের ৭৫০ ধরনের পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। ভারত সেই সাথে এমন ৪৫০টি পণ্যের জন্য ‘ছাড়’ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যেগুলোর ৯৮ শতাংশই বাংলাদেশ উৎপাদন করে না। বৈধ বাণিজ্যের পাশাপাশি চোরাচালানের পথেও বিপুল পরিমাণ পণ্য ঢুকে পড়ায় ঘাটতি শুধু বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ এক পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, ভারতের সঙ্গে শুধু বৈধ বাণিজ্যেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এভাবে বাংলাদেশকে বিপুল ঘাটতির মধ্যে থাকতে হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকেই। প্রসঙ্গক্রমে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ঢাকা সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৯৯ সালে ঢাকা-কোলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকায় এসে তিনি ২৫ ক্যাটাগরির বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ঘোষণার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফরকালেও ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার কথা শোনানো হয়েছিল। কিন্তু তারও বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের শত শত কোটি টাকার তৈরি পোশাকের বিল আটকে রেখেছে ভারতীয়রা।
এভাবেই দেশের সার্বভৌমত্বসহ বিভিন্ন প্রশ্নে দেশপ্রেমিক অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়িয়ে দেয়ার নামে দেশকে উল্টো ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ও পানি আগ্রাসন বন্ধ করার মতো বিভিন্ন প্রশ্নে দর কষাকষির যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার কিন্তু এসব বিষয়ে উল্লেখ করারও কোনো চেষ্টা করেনি, এখনো করছে না। সরকার ব্যস্ত রয়েছে একটি মাত্র কাজে- সেটা ভারতের ইচ্ছা পূরণ। এটাও আবার এমনভাবেই করা হচ্ছে যেন সবই আগে থেকে সরকারের এজেন্ডায় ছিল! বলার অপেক্ষা রাখে না, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের আড়াল নিয়ে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল মইন উ’দের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় এসেছে বলেই আওয়ামী লীগ সরকার সর্বান্তকরণে ভারতের স্বার্থে পদক্ষেপ নিতে উঠে-পড়ে লেগে আছে। আপত্তি উঠতো না যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়দের নীতি-কৌশল ও মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবার কোনো সম্ভাবনা দেখা যেতো। কিন্তু তেমন কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। ভারতের মতো সম্প্রসারণবাদী দেশের দিক থেকে এমনটাই অবশ্য স্বাভাবিক। অন্যদিকে আফসোসের বিষয় হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলই যেখানে বাংলাদেশকে শোষণ করার ও ইচ্ছাধীন রাখার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকে, আওয়ামী লীগ সরকার সেখানে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপস তো করছেই, লজ্জার মাথা খেয়ে নিজেদের মাথাও নত করে বসেছে। এজন্যই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে কি না, নাকি বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে নালিশ করা এবং প্রতিবিধানের উদ্যোগ নেয়া সে কথা ভাবতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। নাহলে জাতীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে এবং প্রতিটি পণ্যের জন্যই বাংলাদেশকে ভারতের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে- যা কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য কাম্য হতে পারে না। 
আহমদ আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মাওলানা ফারুকীর হত্যাকাণ্ড


আরো একটি হত্যাকাণ্ড দেশবাসীকে প্রচণ্ডভাবে ভীত ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। নারায়ণগঞ্জের পর এবারের ঘটনাস্থল রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার। আর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন টেলিভিশনের বিশিষ্ট উপস্থাপক মাওলানা শেখ নূরুল ইসলাম ফারুকী। পুলিশ এবং স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত বুধবার রাত আটটার দিকে প্রথমে দু’জন অচেনা যুবক এসে মাওলানা ফারুকীর সঙ্গে হজে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। পরে মোবাইলে তারা সঙ্গীদের খবর দেয়। এই খবর পেয়ে সাত-আটজন লোক ঢুকে পড়ে। এসেই তারা মাওলানা ফারুকীর কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। মাওলানা ফারুকী রাজি না হলে দুর্বৃত্তরা তার স্ত্রী-সন্তান ও শাশুড়িসহ সকলকে বেঁধে ফেলে ও তাদের মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়। ফলে কেউই কোনো সাড়া-শব্দ করতে পারেনি। এরপর দুর্বৃত্তরা মাওলানা ফারুকীকে পাশের একটি কক্ষে নিয়ে হাত-পা বেঁধে তার গলা কেটে ফেলে। মুহূর্তেই মৃত্যু ঘটে মাওলানা ফারুকীর। এরপর নগদ কিছু অর্থ লুট করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। টেলিভিশন অনুষ্ঠান এবং হজ্ব ও ওমরাসহ ব্যবসার পাশাপাশি আহলে সুন্নাত আল জামায়াত ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে মাওলানা ফারুকীর বাসায় সব সময় অনেক লোকজনের যাতায়াত ছিল। সেজন্যই আশপাশের কারো মনে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়নি। দুর্বৃত্তরাও তাই কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। হত্যাকা-ের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং র‌্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে খুনীদের গ্রেফতার করার আশ্বাস দিয়েছেন। ওদিকে আহলে সুন্নাত আল জামায়াতসহ বিভিন্ন সংগঠন হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে তারা মিছিল সমাবেশ করেছেন। রোববার হরতালও ডেকেছে এই সংগঠনগুলো।
আমরা এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং খুনীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি। আমরা মনে করি, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আসলেও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যখন এমনকি বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি কোনো মানুষের জীবনই আর নিরাপদ নয়। উল্লেখ্য, মাওলানা ফারুকী চ্যানেল আই এবং মাইটিভির ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। বিশেষ করে পবিত্র রমযান মাসে তার উপস্থাপিত কাফেলা নামের অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এ অনুষ্ঠানে তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখানোসহ ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরতেন। সে কারণে দর্শকরা যেমন বহুকিছু জানতে ও দেখতে পারতেন, ব্যক্তিগতভাবে মাওলানা ফারুকীও তেমনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ফলে তার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমরা মনে করি, কেবলই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে শোরগোল করার এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত মাওলানা ফারুকীর খুনীদের খুঁজে বের করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো এবং তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। সরকারকে একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সত্যিকারের উন্নতি ঘটানোর জন্যও সচেষ্ট হতে হবে, যাতে আর কাউকে মাওলানা ফারুকীর মতো নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার না হতে হয়। আমরা মাওলানা ফারুকীর স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ


গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের অভিভাবক নয়। রাষ্ট্রের অবিভাবক হচ্ছে সংবিধান। আর সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে উচ্চ আদালত। বিচার বিভাগ জনগণের রক্ষাকবচ। বিচার বিভাগ যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা পাবে না। সকল প্রকার চাপের ঊর্ধ্বে থেকে বিবেকের কাছে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে স্বীয় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার বিভাগ দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর অবদান রাখে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। বিচার বিভাগের উপর কোন ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশসমূহ বিচার বিভাগকে সকল রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রেখেছে। বিচার বিভাগ যদি স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে না পারে, সেদেশে ধ্বংস ও নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করা যায় না। সরকার বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে চক্রান্ত করছে তা দেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্র।
বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা উল্লেখ আছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অংগসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সে মতে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ৭ বছরেও দেশে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক কোন সচিবালায় গড়ে ওঠেনি। দেশের প্রধান বিচারপতিসহ এ অঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় বলে আসছেন, পৃথক সচিবালায় ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্ভব নয়।
আমাদের সংবিধানের চতুর্থ অংশে বিচার বিভাগের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর হলো দেশের সুপ্রীম কোর্ট যা অ্যাপিলেট ডিভিশন ও হাইকোর্ট ডিভিশন নিয়ে গঠিত। প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দান করিবেন।’
এখন সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশোধনীর খসড়া ইতিমধ্যেই মন্ত্রীসভায় অনুমোদন হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের অধিবেশনে এ খসড়া উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এটি সংসদে পাস হলে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা পাবে সংসদ।
আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হতে পদত্যাগ করেন অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শুন্য হইবে। তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সদস্যই দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নিতে পারেন না। আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে জন্য বিচারকের নিয়োগ এবং অপসারণ নির্বাহী প্রধানের অভিপ্রায়ের উপর নির্ভরশীল।
 দেশের নিম্ন আদালতগুলো উচ্চ আদালতের অধীনে করে দেয়া হলেও সেখানে নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরের মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতির অধীন। আবার রাষ্ট্রপতি এসব দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণ করেন।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিষ্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন।’
১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রন (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’
রাষ্ট্রপতিকে এসব কাজ করতে হয় নির্বাহী বিভাগের পরামর্শক্রমে। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতিত সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে হয় রাষ্ট্রপতিকে। তাই মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদিত সংশোধনী পাস হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না।
নিম্ন আদালত সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীগণ বহু পূর্বেই মন্তব্য করেছেন, ‘নিম্ন আদালত সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’ এখন নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের গোটা বিচার বিভাগের উপর সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে।
॥ দুই ॥
দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অনেক রক্ত, অমূল্য জীবন ও সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষন, বঞ্চনা ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের। যেখানে জনগণ ন্যায়বিচার পাবে, মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে। জীবনের নিরাপত্তা পাবে। ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব জাতিকে গ্রাস করবে না।
বাংলাদেশের যতটুকু অর্জন তা জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব হয়েছে। জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলেই ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন এবং ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সফলতা অর্জন করেছিল। আবার ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও জনতার স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিল এবং গণতন্ত্রের পুন:যাত্রা শুরু হয়েছিল। গণতন্ত্রের সেই অগ্রযাত্রা আজ স্তব্ধ হতে চলেছে। গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকার একে একে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেশে গণতন্ত্রই যদি না থাকে তবে মানুষের কোন অধিকার আর থাকবে না।
ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী বর্তমান সরকার একের পর এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার পর আদালত ও মিডিয়ার উপর নজর দিয়েছে। ইতিমধ্যেই সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে মিডিয়ার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশের সংবাদপত্র কর্মী, কলামিষ্ট, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিডিয়ার উপর সরকারের ঘোষিত নীতিমালার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কারো কথায় তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটিয়েছে এমন নজির খুব একটা নজরে পড়ে না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে এমনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নীতিমালা ঘোষণার পরই সরকার গত ১৮ আগস্ট মন্ত্রীসভার বৈঠকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পার্লামেন্টের অনুমোদনের পরেই তা বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত হবে।
বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এটি তার আরেকটি পদক্ষেপ। গণতান্ত্রিক শাসনের শর্তগুলো ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দেশের বুদ্ধিজীবী, কলামিষ্ট, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের পাশাপাশি দেশের বাইরে থেকে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বন্ধুসুলভ (Friendly criticism) সমালোচনাকে সরকারে ভালো চোখে দেখছে না। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের মতামত উপেক্ষা করে চলছে সরকার। সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতা থেকে প্রকাশ হয়ে পড়েছে কোন ধরনের সমালোচনা সরকার গ্রহণ করবে না। করতে রাজী নয়। সরকার নিজেদের ভুলত্রুটি প্রকাশ হওয়ার ছিদ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকারের এ প্রবণতাকে অনেকে অসামরিক স্বৈরাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন শাসকগোষ্ঠী সর্বদাই জনগণের মুখের ভাষা, মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্রমাগতভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তাই বিভিন্ন ধরনের কালো আইন প্রণয়ন করে ক্ষমতা আকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা করতে খুব বেশী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের প্রয়োজন হয় না। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ থেকে ১৯৪৭ সালে মাউন্ট ব্যাটেনের সময় পর্যন্ত ২৪০ বছরে এদেশে যত আইন কানুন ও নীতিমালা রচিত হয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ বছরেই তার চেয়ে অনেক বেশী আইন কানুন ও প্রবিধান এবং নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষানীতি, নারীনীতি, স্বাস্থ্যনীতিসহ অসংখ্য নীতি প্রণয়ন করেছে সরকার। কিন্তু এসব নীতি দ্বারা জনগণের কল্যাণ বলতে কিছু হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রকৃতপক্ষে কোন একটি নীতিমালা দ্বারা মানুষের কল্যাণ হয়নি। শুধু যে কল্যাণ হয়নি তা নয়, নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যার কুফল ভোগ করছে সমগ্র জাতি।
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। যেকোন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সাফল্যমন্ডিত করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোন বিকল্প নেই। কথিত আছে, ‘Judiciary is the third pillar rather backbone in any strong democratic state system and only protection to all segments of society’ অর্থাৎ বিচার বিভাগ তৃতীয় স্তম্ভ, তথা যেকোন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মেরুদন্ড এবং কেবল মেরুদন্ডই পারে সমাজের সব অংশকে রক্ষা করতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধখ্যাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল বলেন, ‘If our judiciary  is dispensing the justice than we lost nothing’ -যদি আমাদের বিচার বিভাগ ন্যয়বিচার দিয়ে জনগণকে সেবা দেয় তাহলে আমাদের হারানোর কিছুই নেই।
‘A state of injustice can not run’ -ন্যায়বিচারহীন কোন রাষ্ট্র চলতে পারে না। ন্যয়বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ন্যয়বিচার নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। এই কারণে দেখা যায়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে তারা ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দান করে। বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে এর ব্যতিক্রম ছিল না।
কিন্তু আওয়ামী লীগ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের উপর স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেয়ার অব্যাহত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একে একে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সকল চরিত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের আপাতত শেষ আক্রমণের শিকার বিচার বিভাগ।
শাসকদলের পক্ষ থেকে তাদের এসব গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের স্বপক্ষে কুযুক্তি প্রদর্শনের ব্যাপারে কোন কমতি নেই। তাদের বক্তব্য হলো বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য এ আইনের প্রয়োজন আছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্যই বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া উচিৎ। সংসদের হাতে এই ক্ষমতা দিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে না। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় জনগণের যে সুফল লাভ সেটাই এই সংশোধনের মারফত আরো পাকাপোক্ত হবে।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক বলেছেন, ‘আদালতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিৎ। আর সংসদের হাতে এ ক্ষমতা থাকা গণতান্ত্রিক।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে কোন ভয়ের কারণ নেই। ১৯৫০ সাল থেকে এটা ভারতে রয়েছে। এটা একটি গণতান্ত্রিক বিষয়।’ আওয়ামী লীগের অন্যান্য মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাগণও একই ভাষায় কথা বলছেন। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে সবখানেই চালু আছে অভিশংসন আইন। তবে প্রয়োগ খুবই কম। ভারতে স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই অভিশংসন আইন চালু আছে, কিন্তু প্রথম প্রয়োগ হয়েছে ২০০৯ সালে, অর্থাৎ দীর্ঘ ৬২ বছর পর। আর শিকার হয়েছিলেন কলকাতার বিচারক সৌমিত্র সেন। এর আগে পাঞ্জাব ও হারিয়ানার বিচারপতি ভি রামস্বামীর বিরুদ্ধেও অভিশংসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এসব ঘটনা বিশ্লেষন করলে দেখা যায় কোথাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। সবই নৈতিক।
শাসক দলের উদ্যোগে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের লক্ষ্যে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা চাপিয়ে দেয়া, এ দুয়েরই একটাই লক্ষ্য দেশে গণতন্ত্র হত্যা করা। দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথ রূদ্ধ করে দেয়া। আর দেশে যখন গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয় তখন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। আর নৈরাজ্যের পথ ধরেই অসাংবিধানিক ও অবাঞ্ছিত কর্মকা- জাতিকে গ্রাস করে। ওয়ান ইলেভেনের তিক্ত অভিজ্ঞতা দেশের জনগণ নিদারুণভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল দেশের জন্য সুফল বয়ে আনেনি।
বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করার একটি অশুভ প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রীম কোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি আরো বলেন, এই প্রস্তাব পাস করা হলে সংবিধানের অনেক জায়গায়ই পরিবর্তন করতে হবে। অন্যান্য সাংবিধানিক পদের ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য হয়ে যাবে।
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের পার্লামেন্টে আছে বলে শাসক দলের পক্ষ থেকে যে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে তা যুক্তি নয়, কুযুক্তি এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এসব কুযুক্তি এ কারণে যে, ঐসব দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। ঐসব দেশে কোনদিন গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়নি। অথবা অর্ধেকেরও বেশী আসনে বিনা নির্বাচনে প্রার্থী বিজয়ী এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কোন সরকার নিজেদের বৈধ সরকার বলে তৃপ্তিবোধ করেনি। অন্যান্য দেশে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা আমাদের দেশে এখনো গড়ে উঠেনি। গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর স্বার্থেই এ অশুভ সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। অন্যান্য দেশের শাসক দলের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক চেতনা, পরমত সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধকে অনুসরণ না করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ন্যস্ত করার উদাহরণ টেনে আনা কিছুতেই যুক্তিসংগত হতে পারে না। বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ যাদের কোন নৈতিক ভিত্তি নেই, তারাই যদি বিচারকদের স্বাধীনতার কথা ভাবে তাহলে বুঝতে হবে তার পেছনে লুকিয়ে আছে কোন অসৎ উদ্দেশ্য।
দেশে সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্বেষপূর্ণ, পারস্পরিক ও ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে সংসদের উপর বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা দেয়া হলে দেশে আরেকটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
মতিউর রহমান আকন্দ 

Ads