বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অনুরাগ-বিরাগ মানে না ন্যায়দন্ড


গুম-অপহরণের শিকার হওয়ার জন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে মানবিক প্রয়োজন মিটাবার আকাক্সক্ষায়। সমাজবদ্ধ মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে সুশাসন, নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে। নাগরিকদের এইসব লক্ষ্য পূরণ না হলে রাষ্ট্র তার গুরুত্ব হারায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৪৩ বছরে দেশের জনগণ গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা অনেক শুনেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বাদ তারা আস্বাদন করতে পারেননি। দেশে সুশাসন থাকলে একের পর এক গুম বা অপহরণের ঘটনা ঘটে কেমন করে? এর জবাব তো সরকারের দেয়ার কথা। কিন্তু সঙ্গত কোনো জবাব জনগণ এখনও পায়নি।
পত্র-পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই এখন অপহরণের নানা খবর পাওয়া যায়। অপহরণের সাথে এখন যেন জড়িয়ে গেছে সাদা পোশাক ও সাদা মাইক্রোবাস। সাদা পোশাকধারীরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে একের পর এক অপহরণ করে যাচ্ছে। অপহৃত ব্যক্তিদের কারো কারো লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কারো কারো পাওয়া যায় না কোনো খোঁজ। গত মঙ্গলবার পত্রিকান্তরে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৩ ঘণ্টায় এক ডজন মানুষকে অপহরণ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনায়ই সাদা পোশাকধারীরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছেন। এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। কারো সাথে কথা বললে বলা হয়, এ সবের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত নয়, হয়তো সংঘবদ্ধ অপরাধীরা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে এই অপকর্ম করছে। তাহলে কারা করছে তাও উদঘাটনে ব্যর্থ পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এমন কি বহুল আলোচিত আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের সাথে কারা জড়িত তাও দুই সপ্তাহে উদঘাটন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। সাদা পোশাকের ব্যাপারে বর্তমানে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার জন্য অনেকেই বলছেন, কাউকে গ্রেফতার বা পাকড়াও করতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট পোশাক পরেই তা করা উচিত। তাহলে একদিকে বিভ্রান্তি যেমন দূর হবে, তেমনি সুযোগ সন্ধানীরাও নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দেয়ার সুযোগ হারাবে।
এখন প্রায় প্রতিদিনই অপহরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত রোববার বেলা আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার চার সঙ্গী। নজরুলের ব্যবহৃত গাড়িটি গাজীপুরের শালবন থেকে উদ্ধার হলেও তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রায় একই সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হয়েছেন এডভোকেট চন্দন ও তার ড্রাইভার। তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। অপহরণের এইসব ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জবাসী আগুন জ্বালিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে। অপহৃতদের জীবিত ফেরত পেতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তাদের স্বজনরা। গত সোমবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তারা এ আকুতি জানান। এদিকে নিখোঁজ ৭ জনকে জীবিত উদ্ধারে পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক। দৈনিক আমাদের সময়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নজরুলসহ ৫ জন অপহরণের ঘটনায় অভিযুক্ত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গত সোমবার ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন অপহৃত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। এদিকে সোমবার রাত পৌনে এগারটায় নিখোঁজ আইনজীবী চন্দনকুমারের গাড়িটি রাজধানীর গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার নিশ্চিত করেন। গুম বা অপহরণের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। প্রথম দিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম হতে দেখা গেছে, মাঝে মাঝে ব্যবসায়ীরাও গুম হয়েছেন। এখন সরকারি দলের লোকজনকেও গুম হতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, মুক্তিপণ, দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির কোন্দলসহ নানা ক্ষেত্রে এখন অপহরণের ঘটনা  লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অপহরণের মত ঘটনার নায়কদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ায় অপরাধীরা এখন বেশ বেপরোয়া। ফলে এখন সরকারি ঘরানার কাউকে কাউকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত বলেছেন, সম্প্রতি যেভাবে গুম ও অপহরণ হচ্ছে তা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। তাই সরকারের সামনে এখন দু’টি চ্যালেঞ্জ। একটি হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তিনি আরো বলেন অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পেছনে কারা রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর সারাদেশে আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এদিকে গত সোমবার এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে সুপ্রীমকোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, দেশে আইনবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ বেড়েই চলেছে। অথচ সরকার এ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। সরকারের র‌্যাব, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা এই হত্যা, গুম ও অপহরণ করছে।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে অপহরণ ও গুমের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানও। গত সোমবার দৈনিক আমাদের সময়ের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, কোনো নাগরিক যদি নিখোঁজ, অপহৃত কিংবা গুম হয়ে যান, তা তিনি যে-ই হন না কেন, তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চোখ যদি না খোলে, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে যদি এটার প্রতিফলন না ঘটে তাহলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব। প্রয়োজনে আদালতে যাব। ড. মিজান আরো বলেন, অপহরণের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতারের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এ বাহিনী সে ধরনের চৌকসও। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হলে যেকোনো মানুষ বলবে, রাষ্ট্রের হয়তো কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয় এখন জাতির জন্য প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে দেশের মানুষ নানা সমস্যায় জর্জড়িত। দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও মানুষ জীবনের নিরাপত্তা চায়, একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। কিন্তু অপহরণ ও গুমের আতঙ্ক মানুষের সে শান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। সরকার যদি গুম ও অপহরণের মত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের গ্যারান্টি দিতে না পারে, তাহলে সেই সরকার দিয়ে জনগণ কি করবে? অপহরণ ও গুমের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের প্রতি জনগণের অভিযোগের মাত্রা বাড়ছে। বিষয়টি যে সরকার বোঝে না তা নয়। তারপরেও গুম ও অপহরণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকার কেন কার্যকর ভূমিকা পালনে সমর্থ হচ্ছে না, তা এক রহস্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রহস্যের সমাধান সরকারই করতে পারে। সরকার শপথ অনুযায়ী অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে যদি ন্যায়দ- প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঙ্গত ভূমিকা পালন না করে পারে কি? আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে, সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে যখন দলীয় সংকীর্ণতা কিংবা দলবাজি প্রশ্রয় পায়, তখন সুযোগ সন্ধানীদের মধ্যে অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে বেপরোয়া মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে শিথিলতা প্রদর্শন করে। অনেক ক্ষেত্রে হাওয়া যেদিকে সেদিকে চলার চেষ্টা করে। বর্তমানে আমরা অপহরণ ও গুমের যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি, তার মূলে রয়েছে ন্যায়দ- প্রতিষ্ঠার বিপরীত পরিবেশ। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। সরকার যদি পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে ক্ষমতার রাজনীতিকে অবজ্ঞা করে জনগণের জানমাল ও ইজ্জ্বতের নিরাপত্তা বিধানের কাজকেই এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা। সরকার গণ-আকাক্সক্ষার অনুকূলে পথ চলে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ চেষ্টাই মে দিবসের শিক্ষা


আজ অধিকার আদায়ের জন্য মার্কিন শ্রমিকদের জীবনদানের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক মে দিবস। ১৮৮৬ সালের এই দিনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ও ইলিনয়সহ বিভিন্ন নগরীতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছিলেন। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সেদিনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল পর্যায়ক্রমে। যুক্তরাষ্ট্রেরও আগে অস্ট্রেলিয়ার শ্রমিকরা কাজের সময়সহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেছেন। এর কারণ ছিল মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও শোষণ। সেকালের শ্রমিকদের কাজের যেমন নির্দিষ্ট সময় ছিল না, তেমনি ছিল না বেতন-ভাতারও কোনো পরিমাণ। মালিকরা যাকে যতক্ষণ ইচ্ছা খাটিয়ে নিতেন, পারিশ্রমিকও দিতেন ইচ্ছামতো। সাপ্তাহিক বা মাসিক ছুটিরও তখন কোনো আইন বা নিয়ম ছিল না। শ্রমিকরা এমনকি কঠিন অসুস্থতার সময়ও ছুটি পেতেন না। তাদের বরং চাকরি চলে যেত। প্রতিবাদ করতে গেলেও নির্যাতনের শিকার হতে হতো। সবমিলিয়েই শ্রমিকরা ছিলেন ভীষণভাবে নির্যাতিত ও বঞ্চিত। অন্যদিকে ওই যুগে দ্রুত ঘটছিল শিল্পের বিকাশ। এর ফলে শ্রমিকদের চাহিদা যেমন বাড়ছিল, তেমনি বাড়ছিল শ্রমিকদের সংখ্যাও। ফলে আন্দোলন গড়ে তোলাও সহজ হয়ে উঠছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো।
১৮৮৬ সালের পহেলা মে শিকাগো নগরীর ‘হে মার্কেটে’ এক সমাবেশ আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সে সমাবেশে পুলিশ গুলীবর্ষণ করে। গুলীতে নিহত হয়েছিলেন চারজন শ্রমিক। প্রতিবাদে পরদিন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে সমাবেশেও বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ গুলী চালিয়েছিল। এতে নিহত হয়েছিলেন ১২ জনের বেশি শ্রমিক। দাবি পূরণের পরিবর্তে মার্কিন সরকার উল্টো বিচারের প্রহসন করেছে এবং চারজন বিক্ষোভকারীকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও বৃটেনের পাশাপাশি বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। সব দেশেই ৮ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ ও সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। সব দেশের সরকারই প্রথমে আন্দোলন প্রতিহত ও নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ও বলিষ্ঠ আন্দোলনের মুখে সব সরকারকেই পিছু হটতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র মধ্যস্থতায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময়, একদিন সাপ্তাহিক ছুটি এবং চিকিৎসা সুবিধার মতো দাবিগুলো স্বীকৃত হয়েছিল। এসবের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে শ্রমিক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা ক্রমাগত বেড়েছে। প্রতিবছর পহেলা মে’কে তাই বিশ্বের সব দেশে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মে দিবস শুধু সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের জন্য মহিমান্বিত দিন নয়, দিনটির মধ্যে শিক্ষারও নানাদিক রয়েছে। মালিকপক্ষের জন্য শিক্ষার মূলকথা হলো, নিজেদের পুঁজি ও শিল্পের নিরাপত্তা বিধান ও বিকাশ ঘটানোর স্বার্থেই শ্রমিকদের চাহিদা পূরণ করা দরকার। কারণ শ্রমিকরা অসন্তুষ্ট কিংবা রোগাক্রান্ত থাকলে তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ শক্তি খাটিয়ে ও মেধার ব্যবহার করে সেবা দেয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে শ্রমিকদের জন্য শিক্ষার মূলকথা হলো, সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার কেবল চাইলে চলবে না, সেগুলো দেয়ার মতো ক্ষমতাও মালিকপক্ষকে অর্জন করে দিতে হবে। এ কথা বুঝতে হবে, লাভ না হলে মালিকের পক্ষে শ্রমিকদের দাবি ও চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে না। এভাবে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মিলিত চেষ্টাতেই একদিকে শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব, অন্যদিকে শ্রমিকদের দাবি ও চাহিদা পূরণ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সহজে সম্ভব হতে পারে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও মে দিবসের শিক্ষার বিশেষ দিকগুলোকে বিবেচনায় রাখা দরকার। যেমন বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে গার্মেন্ট শিল্পের প্রায় নিয়মিত ধ্বংসাত্মক কর্মকা-কে সমর্থনযোগ্য বলা যায় না। রফতানি আয়ের প্রধান মাধ্যম এ খাতটির ব্যাপারে উভয়পক্ষকেই যথেষ্ট সংযম দেখাতে হবে। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যসব শিল্পের ব্যাপারেও একই পরামর্শ প্রযোজ্য। আমরা আশা করতে চাইÑএবারের মে দিবসে শ্রমিকরা শুধু নন, মালিকরাও নতুন করে শিক্ষা নেবেন এবং উভয়পক্ষ মিলিতভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে জোরদার করবেন।

মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব


মানুষের জীবনের যেন কোনো মূল্য নেই। তুচ্ছ ঘটনায়ও এখন মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। প্রতিপক্ষ হলে তো কথাই নেই, সামান্য স্বার্থের কারণে নিজ দলের লোকদেরও হত্যা করতে এখন হাত কাঁপে না রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে গত ২৬ এপ্রিল। বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালি ইউনিয়নের বারপোতা গ্রামে গত শনিবার সকালে স্থানীয় প্রভাবশালী  দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহত হয়েছে দুই যুবক। নিহতরা হলেন, বেনাপোল পৌর মেয়র গ্রুপের সমর্থক যুবলীগ কর্মী ইমান (৩৫) ও আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শেখ আফিলউদ্দিন গ্রুপের সমর্থক লালন (২৪)।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পুটখালি সীমান্তের চোরাচালানি ঘাটের দখল নিয়ে ক্ষমতাসীন দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে এসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বেনাপোলের পল্লী এলাকায় চোরাচালানের পথ ‘ঘাট’ নামে পরিচিত। পুটখালি ঘাট এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় বদিয়ার রহমান গ্রুপ ও আলাউদ্দিন গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে বদিয়ার গ্রুপ মেয়র লিটনের সমর্থক ও আলাউদ্দিন গ্রুপ এমপি আফিল উদ্দিনের সমর্থক। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, একই দলের সমর্থক হওয়ার পরও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াতে কিংবা পরস্পরকে হত্যা করতে কারো বিবেকে বাধলো না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী নিয়ে এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত? ন্যায়-অন্যায় নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। এখানে দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটলো চোরাচালানের ঘাট দখলের মত একটি নিকৃষ্ট বিষয় নিয়ে। ভাবতে অবাক লাগে, এমন নিকৃষ্ট দ্বন্দ্বের সাথে জড়িয়ে আছেন এলাকার মেয়র ও এমপি। এলাকার মেয়র ও এমপি কেন নির্বাচিত হয় ? তারা তো জনগণের কল্যাণ, ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার পক্ষে কাজ করার কথা। চোরাচালান কিংবা চোরাচালানির ঘাট দখলের কথা বলে তো তারা জনগণের কাছে ভোট চাননি। তাহলে এখন প্রতিশ্রুতির বাইরে গিয়ে অর্থ ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির লালসায় তারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেন কোন বিবেচনায়?
আমরা জানি, চোরাচালান একটি অপরাধমূলক কাজ। আর এই অপরাধে যখন মেয়র ও এমপির মত জনপ্রতিনিধিরা জড়িয়ে পড়েন তখন তা আরো মারাত্মক রূপ ধারণ করে। যার উদাহরণ আমরা লক্ষ্য করলাম বারপোতা গ্রামে। চোরাচালান ও চোরাচালানের ঘাট দখলের দ্বন্দ্বে সেখানে প্রাণ হারালো দুই যুবক। আমরা মনে করি, এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারাই জড়িত আছেন তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। মেয়র কিংবা এমপি পদবীর কারণে কেউ আইনের বাইরে থাকতে পারেন না। বরং দায়িত্বের বিপরীতে কাজ করার জন্য কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হওয়াই তাদের জন্য স্বাভাবিক। আসলে আমাদের সমাজে রথী-মহারথীরা অন্যায় ও অপকর্মের সাথে জড়ানোর কারণেই অন্যরা অন্যায় কর্মের সাথে জড়াবার সাহস পায়। আলোচ্য ঘটনায় জড়িত সাধারণ অপরাধীদের সাথে রথী-মহারথীদেরও যদি শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় তাহলে সবার জন্য একটি উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে। এতে সমাজে অন্যায় ও অপরাধে জড়াবার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি জনপ্রতিনিধিরাও উপলব্ধি করবেন তাদের কাজ আসলে কোনগুলো। জনপ্রতিনিধিরা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করলে জনগণের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনি সমাজও প্রগতির পথে চলতে পারবে সহজেই।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

‘ওইখানে এক নদী ছিল, জানল না তো কেউ’


এক বন্ধুর আমন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজ দেখার জন্য গিয়েছিলাম, এলাকায় যা ডালিয়ারপুলনামে পরিচিত। গ্রীষ্মকাল ছিল। তবুও পানির স্রোতের কারণে নৌকা চালাতে পারছিলাম না বলে এক মাঝিকে ডেকেছিলাম।
মেঝো ভাই যখন লালমনিরহাটে ট্রান্সফার হলেন, তখন সেখানে ডালিয়ারপুলের ওপর দিয়েই যাতায়াত করতাম; কিন্তু বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতাম বলে এই বায়ান্ন গেটবিশিষ্ট পুল ও তিস্তার ঐশ্বর্যকে দেখার সুযোগ হারাতাম। একবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। পুলের ওপর থেকে দেখি, নদীর উজান-ভাটি কোনো দিকেই পানি নেই। বিশাল এলাকাজুড়ে বালু আর বালু। শুধু দুই পাশ দিয়ে সঙ্কীর্ণ নালার মতো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পুলের মাঝখানে এসে নদীর দিকে তাকাতেই মনে হলো, বিশাল বাহু কেউ যেন নদীটার ওপর শুয়ে কাঁদছেন। দুই দিকে দুই চোখের পানি কপোল বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর নাক ও কপাল সূর্যের আলোয় চিক চিক করছে। আমার পাশের সিটে এক ভদ্রলোক ঘুমিয়েছিলেন। তাকে ডেকে বললাম Ñ চাচা, নদীর এ অবস্থা হলো কী করে? তিনি নদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যারা শিবের মূর্তি বানাতে পারে, তারা রাবণকেও বানাতে পারে। এর অর্থ না বুঝে তার দিকে চেয়েছিলাম কিছুণ। এবার আপে করে বললেন, দাদারা বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে রেখেছেন।
তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের নির্মাণ ১৯৭৯ সালে এবং ক্যানেল সিস্টেমে নির্মাণকাজ ১৯৮৪-৮৫ সালে শুরু হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে, এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার এক লাখ ১১ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার ল্েয ১৯৯৮ সালের জুনে প্রথমপর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে; কিন্তু শুরুর দিকে ৭৯ হাজার হেক্টরে সেচ দেয়া গেলেও পরবর্তী সময়ে সব পরিকল্পনা বিনাশ করে দেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তিস্তায় পানির অভাবে প্রতি বছরেই সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমে আসছে। গত বছর এ প্রকল্পের আওতায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়। এ বছর সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর করা হলেও ২৫ হাজার হেক্টরেও সেচ দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টরে সেচ দিতে কমপে সাড়ে তিন হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন। এ পরিমাণ পানি কিভাবে পাওয়া সম্ভব?
কেউ কেউ শ্যালোমেশিন কিনে বোরো চাষ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলেও বিপাকে পড়েছেন সাধারণ কৃষকেরা। কারণ গরু, গয়না ইত্যাদি বিক্রি করে সেচ প্রকল্পের নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি খরচ করে সব জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেউ বলছেন, নতুন করে মেশিন কিংবা ডিজেল কেনার মতো টাকা তাদের কাছে নেই। তা ছাড়া অত টাকা খরচ করে ফসল ফলিয়ে ন্যায্যমূল্যও পান না। লাভের চেয়ে লোকসানই হয় বেশি। তাই তারা হাল ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছেন। এ দিকে ফসল পুড়ে ছারখার।
কবে থেকে এ সমস্যা হচ্ছে? লণীয়, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পানির প্রবাহ অতীতের ধারায় ছিল। এর গড় মাত্রা ৯০০০ কিউসেক (ডালিয়া পয়েন্ট)। এটি কমতে কমতে এবার এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০০ কিউসেকে। অবশ্য ১৩ এপ্রিল থেকে একটু বেড়েছিল। যখন তারাদেখলেন, তিস্তার পানি আমরা কাজে লাগাতে শিখেছি, এই পানি জমিতে সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য ক্যানেল সিস্টেমের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প গ্রহণ করেছি, ঠিক তখনই তারা কলকাঠি নাড়লেন। বাংলাদেশের পেটে লাথি মারা শুরু করলেন।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক। নদীর বুক চিরেই কৃষক ভাইয়েরা ফসল ফলান, নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল অনেক সভ্যতা। পড়শি রাষ্ট্র বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে, ফারাক্কা, গজলডোবা টিপাইমুখ দিয়ে আমাদের স্রোতস্বিনী নদীগুলোকে হত্যা করছে কিংবা করতে চায়। এর জন্য কিছুটা দায়ী আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যদি কেউ এসব বিষয়ে সোচ্চার হন, আন্দোলনে নামেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়। লংমার্চের জন্য বাস-ট্রাক দিতে মালিকপকে নিষেধ করা হয়। আবাসিক হোটেলগুলোতে তালা লাগাতে বলা হয়।
জানা যায়, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দুদেশের মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচবার চিঠি চালাচালি করেও সমাধান মেলেনি। আর এ চুক্তিতে ভারত যে সই করবে, এর নিশ্চয়তাও নেই। শৈশব থেকেই দেখে আসছি তিস্তার পানির ব্যাপারে ভারত একগুঁয়ে। সে েেত্র জনগণকে নিয়ে আন্দোলনই একমাত্র পথ। জাতীয় স্বার্থেই নদীর পানিতে আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে হবে। দেশের প্রতি যাদের সামান্য মমতা আছে তারাও এ ধরনের আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক করতে পারে না।
চার দিক থেকে গ্রাস করছে আগ্রাসী শক্তির থাবা। আমরা চাই ন্যায্য হিস্যা এবং শান্তিতে বাঁচতে, কৃষকদের বাঁচাতে। যারা আমার দেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূমির অন্যায় আবদার করছে, তাদের সাথে কিভাবে বন্ধুত্ব হবে? যারা তিস্তার ন্যায্য পাওনা না দিয়ে কৃষকের ফসল পুড়ছে, তারা কেমন বন্ধু? যারা পদ্মাকে শুষ্ক বালুতে পরিণত করেছে, টিপাইমুখ দিয়ে মেঘনাকে হত্যা করতে চাইছে, তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না। তারা আমাদের বন্ধু মনে করলে এসব আচরণ করত না। আমরা সখ্য গড়ার ল্েয শুধু দিয়েই গেলাম, কিছুই তো পেলাম না।
কেন আমরা ঢাকার বদলে দিল্লিকে কিংবা কুমিল্লার বদলে কলকাতাকে প্রণাম করতে যাবো। মায়ের বদলে কেন মাসিকে নেবো? আসুন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং দেশ ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অধিকার রা করি।



 মাসুদ আলম

সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পানি সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে


শনিবার প্রগতিশীল প্রকৌশলী ও স্থপতি ফোরামের উদ্যোগে ‘মৃতপ্রায় তিস্তা, মরুকরণের পথে বালাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা তিস্তা ও গঙ্গাসহ অভিন্ন সব নদ-নদীর পানির হিস্যার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার দাবি জানিয়েছেন। বর্তমান সময়ে বেশি আলোচিত তিস্তা নদীর করুণ চিত্র তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা  বলেছেন, তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে ভারত যথেচ্ছভাবে পানি সরিয়ে নেয়ায় নদীটির বাংলাদেশ অংশ শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়েছে। এপ্রিল-মে মাসে তিস্তায় যেখানে অন্তত ১০ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা সেখানে এখন চার-পাঁচশ কিউসেক পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে নদীই শুধু শুকিয়ে যায়নি, আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও মরুকরণ প্রক্রিয়া ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তিস্তায় পানি না থাকার কারণে বাংলাদেশের বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলোতে ভারত বাঁধের পর বাঁধ নির্মাণ করায় একদিকে মৎস্য, পশু-পাখি ও গাছপালা মরে যাচ্ছে এবং কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি বছর অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ১৩৫ বিলিয়ন টাকার। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০ ভাগ এলাকাই মরুভূমিতে পরিণত হবে। কিন্তু দেশ এত বিপুল ও প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাচ্ছে না। দেশটির প্রতারণামূলক কৌশলের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বলেছেন, তিস্তা অভিমুখে বিএনপির লং মার্চের দিনটিতে এক হাজার কিউসেকের মতো পানি ছাড়ার মধ্য দিয়ে ভারত অত্যন্ত নোংরা রাজনীতি করেছে। ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদ-নদীতে নির্মিত বাঁধগুলোর মারাত্মক কুফলের বর্ণনা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়ে গেছে, ভারত তার পানি আগ্রাসন বন্ধ করবে না বরং দিন দিন আগ্রাসনকে আরো ভয়ংকর করতে থাকবে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষয়-ক্ষতি এবং বিপদও কেবল বাড়তেই থাকবে। তাছাড়া এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতের ষড়যন্ত্রে ক্ষমতায় এসেছে বলে আওয়ামী লীগ সরকার পানি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য কোনো চেষ্টাই চালাবে না। এজন্যই উদ্যোগ নিতে হবে রাজনৈতিক দলসহ দেশপ্রেমিক সকল শক্তিকে। করণীয় সম্পর্কেও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের ওপর সরকার যাতে চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য হয় সেজন্য দেশের ভেতরে প্রচ- আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্যও বাধ্য করতে হবে।
আমরা শনিবারের সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তব্য ও দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্মতা প্রকাশ করি এবং মনে করি, বিশেষজ্ঞরা সঠিকভাবেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। তাদের পরামর্শও যথার্থ। কারণ, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উভয় দেশই ন্যায্যতা, ন্যায়পরায়ণতা ও অন্যের কোনো ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে যৌথ নদ-নদীর পানি ভাগাভাগি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের চুক্তি ও নীতি বাস্তবায়নের অবশ্যপালনীয় শর্ত হচ্ছে, কোনো পানি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে প্রকল্প সম্পর্কিত সকল তথ্য অন্য পক্ষকে জানাতে হবে। উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে, অন্য পক্ষের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ভারত গঙ্গার ক্ষেত্রে তো বটেই, অন্য সব নদ-নদীর পাশাপাশি তিস্তার ক্ষেত্রেও চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন হলো, কোনো বাঁধ নির্মাণ করার আগে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অনুমতিও নিতে হবে। এক্ষেত্রেও ভারত সুস্পষ্টভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী অবস্থানে চলে গেছে। এজন্যই সরকারকে শুধু প্রতিবাদ জানালে চলবে না, অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার জন্য। বলা দরকার, এ ধরনের ঘটনায় পৃথিবীর অনেক দেশই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে অধিকার ও ন্যায্য পাওনা আদায় করেছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মামলা করে স্পেন তার হিস্যাই শুধু আদায় করেনি, ফ্রান্সের একটি বাঁধকেও অকার্যকর করিয়ে ছেড়েছে। পাকিস্তানের উদাহরণও উল্লেখ করা দরকার। ভারত তার অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে বাগলিহার বাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তানকে চেনাব নদীর পানির হিস্যা থেকে কোনো এক চক্রে ৫৫ হাজার কিউসেক কম পানি দিয়েছিল। পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। ভারত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করায় পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার ঘোষণা দিয়েছিল। তখনই টনক নড়েছিল ভারতের। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী চেনাব নদী থেকে দুই লাখ একর ফুট পানি দেয়া হবে। এটা মাত্র কিছুদিন আগেরÑ ২০০৮ সালের অক্টোবর-নবেম্বরের ঘটনা। আমরা মনে করি, স্পেন ও পাকিস্তানের মতো কঠোর অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশও সহজেই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে সব নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারে। কোনো কোনো বাঁধকে অকার্যকরও করাতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায়ও রয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশকে পানিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা অপরাধ। কিন্তু ভারত শুধু বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্তই করছে না, বাংলাদেশকে পানি-প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রও বানাতে চাচ্ছে। আমরা অবশ্য এজন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর নির্ভর করার পক্ষপাতী নই। কারণ, এই সরকার সকল বিষয়ে জাতীয় স্বার্থকে পরিত্যাগ করে ভারতের সেবাদাসসুলভ ভূমিকা পালন করাকেই নিজের কর্তব্য বানিয়ে ফেলেছে। সে কারণেই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করতে হবে দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোকে। সে আন্দোলনও এমন প্রচ- হতে হবে সরকার যাতে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানাতে এবং দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা ও ভারতে নির্বাচন


ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ছত্রভঙ্গ থাকায় ও নির্বাচনের প্রস্তুতি সন্তোষজনক প্রতীয়মান না হওয়ায় এবারে ভারতের লোকসভা নির্বাচন সমস্যাকুল মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পরিচালনার প্রক্রিয়া বিশৃঙ্খল-বিজেপি খুব একটা ভালো অবস্থায় না থাকা সত্ত্বেও গোটা নির্বাচন পর্বের মূলমঞ্চে আসতে সচেষ্ট শুধু মাত্র নরেন্দ্র মোদির অভিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। সন্দেহ নেই যে এ সময়ে মোদিই শিল্প মালিক, তথ্যপ্রযুক্তি বা বিভিন্ন করপোরেট সংস্থার ডার্লি বা প্রিয়পাত্র। সমাজের সাম্প্রদায়িক ভাবধারার অনুসারী অনেক ক্ষেত্রে মোদির সমর্থক।
বিজেপি-রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা এবং তা তাদের হিন্দুত্ববাদ এজেন্ডার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। বিজেপি ২০০৪ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে, যদিও এর আগে ১৯৯৬ সালে ১৩ দিনের জন্য এবং এরপর ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত দলটি শেষবারের মতো ক্ষমতাসীন থাকে। যদিও অল্প অল্প করে দলটির লোকসভা নির্বাচনে ভোট কমে যাওয়া অব্যাহত থাকে। অবশ্য এখন মোদির অভিক্ষেপ একটি দলের জন্য একটি দ্ইু দিকেই ধারবিশিষ্ট অস্ত্র। মোদির প্রার্থিতা ভারতীয়দের একটি অংশকে সন্তুষ্ট করলেও আরেকটি অংশকে অসন্তুষ্ট করবে। ফলে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ঐক্যকে বিভাজিত করতে বাধ্য।
বিজেপি সামগ্রিকভাবে সঙ্ঘ পরিবারের অংশ। বিজেপি জানে, এর নির্বাচন পরিচালিত হয় যার উদ্দেশ্যেই গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে তার স্থলে একটি হিন্দু ধর্মভিত্তিক জাতি গঠন। আরআরএসের মতাদর্শে রয়েছে হিন্দুত্ববাদ, এটি একটি শব্দ যা শুধু হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুত্বকেই সামনে তুলে ধরে। কিন্তু আরএসএস প্রকৃত প্রস্তাবে হিন্দুত্ববাদ। আজকাল ভারতে অনেক সাম্প্রদায়িক ধারা প্রবহমান। এর মধ্যে শুধু দুটিরই প্রতিঘাত উপলব্ধি করা যায়। এই দুটি সাম্প্রদায়িক ধারায় রয়েছে সামাজিক রাজনৈতিক মুসলিম ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক ধারা।
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অন্তর্ভুক্ত মতাদর্শ হিন্দুত্ববাদে। আরআরএস-ই আসলে বিজেপির চালিকাশক্তি রাজনৈতিকভাবে যারা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় এবং সমগ্র সঙ্ঘ পরিবার বিশ্বাস করে যে সেটা সম্ভব হিন্দুত্ববাদ এজেন্ডার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। বিজেপি বা এনডিএ শেষবারের মতো ক্ষমতায় ছিল ১৯৯৬ সালে। নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে অভিক্ষেপকে অনেকে দুই পাশে ধারালো অস্ত্র মনে করছে।
বিজেপির সুবর্ণ সময়েও কদাচিত বিজেপিতে কোনো প্রধানমন্ত্রিত্বের ছাপযুক্ত প্রার্থী দাঁড় করানো হয়নি। বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাÑ বাজপেয়িও ভারতীয় সংবিধানের ধারামাফিক ক্ষমতারোহণ করেছেন। তবে নরেন্দ্র মোদির জন্য অসাংবিধানিক নিয়ম থাকবে কেন। মোদির সমর্থকেরা মোদিকে নিয়ে একটি মিথ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। নরেন্দ্র মোদি যে সবরমতিদের অযোধ্যা থেকে ফেরানোর পথে গোধরা নামক স্থানে কে বা কারা আরোহীদের পুড়িয়ে হত্যা করেছিল নরেন্দ্র মোদি ঠাণ্ডা মাথায় এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়ে গুজরাটের কসাই-এ পরিণত হয়েছিল। উল্লেখ্য, হিন্দুপ্রধান রাজ্য হলেও গুজরাটে একটি মুসলিম সচ্ছল ব্যবসায়ী কমিউনিটি থাকলেও মোদির চাতুর্য, অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, কট্টর হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসের কাছে ভারতের সোচ্চার সুশীলসমাজ, মিডিয়া এর সব কিছু হেরে গিয়েছিল। শোনা যায় যে নরেন্দ্র মোদি তার রাজ্য এবং মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য তাকে এক ধরনের নৈতিক সততা দিয়েছিল। গান্ধী পরিবার যখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, মোদির দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। কাশ্মিরের যুদ্ধে আমদানি করা বোফোর কামানের দুর্নীতি এখন পর্যন্ত ঢাকা যায়নি। এটি শুধু দুর্নীতির একমাত্র দিক নয়। অধুনা ভারতে ব্যাপক দুর্নীতি অরবিন্দ কেজরিওয়ালার উদ্ভব ঘটিয়েছে।
শুধু অতীতের চমকপ্রদ ইতিহাস দিয়ে রাজনীতির অনেক দুর্নামই ঢাকা যায় না। এ কথা ঠিক, এখনো গান্ধী পরিবারে চোখধাঁধানো ব্যক্তিত্ব আছে। তবু রবার্ট ভদ্রও প্রিয়াঙ্কার স্বামী দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছে। সেক্স স্টার্ভড ভারতীয়রা এখন বিদেশী পর্যটকদের জলজ্যান্ত গণধর্ষণের শিকার। শতাব্দীর ঐতিহ্যমণ্ডিত কংগ্রেস যদি মোদির মতো মারাত্মক লোকের কাছে হার স্বীকার করে। ভারতের জন্য মোদির জয় অন্তত দুটি বিষয়ে ভারতীয়রা বাধা পড়ে থাকবে। তার একটি বহিরাগতদের অর্থাৎ যারা আদি ভারতের নয় তাদের বিতাড়ন। কৌশলগত দিক থেকে তা একই ধরনের ভয়াবহ। পারমাণবিক যুদ্ধে ফার্স্ট স্ট্রাইকের অধিকার কংগ্রেস যে সম্প্রতি অনেকটি রাজ্য অ্যাসেমব্লিতে গোহারা হেরেছে তাতেই বোঝা যায় কংগ্রেসের স্থিতি এখন কোথায়।

এম. আবদুল হাফিজ


 

রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রের শ্মশানযাত্রায় ভারতীয় পৌরহিত্যের নেপথ্যে


বাংলাদেশের বর্তমান ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত এক ঢিলে কম করে হলেও হাফ ডজন পাখি শিকার করে নেয়ার চমৎকার  নৈপুণ্য দেখালো যেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ভারত গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখেই দিল না শুধু, বরং পথভ্রষ্ট করেও ছাড়ল। গণতান্ত্রিক চেতনা সমৃৃদ্ধ ভারতের এহেন স্ববিরোধী অবস্থান কেন তা এখন খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করছে গণতান্ত্রিক বিশ্বও। জনগণের বিরুদ্ধে একটি দল বা ব্যক্তির প্রতি এভাবে ঝুঁকে পড়ায় ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের বিরক্তি, আস্থাহীনতাও সন্দেহ-সংশয় বৃদ্ধিরই কারণ হবে এটা জেনেবুঝেও ভারত তেমনি একটা পথে কেন হাঁটছে এই জিজ্ঞাসা আজ অনেকের। ভারতের কংগ্রেস সরকার কি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, যে কোনো উপায়ে শেখ হাসিনাকে গদিতে রাখা না গেলে অর্জিত অসম সুবিধাগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে, ফাঁস হয়ে যাবে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিগুলো? অথচ এর আগে ২৫ বছর মেয়াদি ইন্দিরা-মুজিব অসম চুক্তি মুজিব পরবর্তী সরকারগুলোও পালন করেছে অক্ষরে অক্ষরে, বরং পালন করেনি ভারত এটাই বাস্তবতা। চুক্তিমত ৩ বিঘা করিডোর ভারত আজও দেয়নি এবং দেবে না যে তাও পরিষ্কার। চুক্তির প্রতি বৃৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দক্ষিণ তালপট্টি ইন্দিরা গান্ধী জীবিত থাকাকালেই তারা দখল করে নিল কোনো প্রকার আলোচনা বা সীমানা নির্ধারণ ছাড়াই। সমতার নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো দেখার সুযোগ ভারতীয়দের নেই বলে বাংলাদেশে তাদের চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়নি একদিনের জন্যও। তাহলে বাংলাদেশের ব্যাপারে এহেন অসম এবং গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী অবস্থান গ্রহণের কারণ কী হতে পারে আলোচ্য নিবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেদিকে আলোকপাতের প্রয়াশ পাচ্ছি।
১. আমাদের এই বন্ধু দেশটির কাছে বাংলাদেশে শক্ত মেরুদ- বিশিষ্ট কোনো সরকার নয়, বরং নতজানু আজ্ঞাবহ একটা সরকারই পছন্দ। ভারতকে  বৈধ-অবৈধ সুবিধা দেবে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের স্বার্থ ও দৃষ্টিকোণ চোখ বুজে সমর্থন করবে এমন সরকারই চায় তারা বাংলাদেশে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের নীতি সাধারণত মুসলিম স্বার্থ পরিপন্থীই হয়ে থাকে। সুতরাং মুসলিম দলন ও দমনে মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ও সমর্থন অব্যর্থ অস্ত্রের মতোই কাজ দেয় চমৎকার।
২. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ সাধারণভাবে পরিপূরক নয় বরং বিপরীতমুখী। যেমন মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি ও ফলমূল রফতানিতে বাংলাদেশ কোনো কারণে পিছিয়ে পড়লে সেই শূন্যতা সেরে দেয় ভারত। মালয়েশিয়ার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ যেমনি মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ভূ-খ- তেমনিভাবে কৃষ্টি-কালচার, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকেও বিচ্ছিন্ন এবং ভারতনির্ভর হয়ে থাকুক বাংলাদেশ, এটাই ভারতের প্রত্যাশা ও পলিসি। সংবিধান থেকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের ঘোষণাটি প্রত্যাহারের পেছনে বাংলাদেশী জনগণের সেন্টিমেন্ট নয় বরং ভারতের অভিপ্রায়ই যে কাজ করেছে তেমনটি মনে না করার কারণ নেই। তাই মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় তারা যতটা যতœবান বাংলাদেশকে বিতর্কিত ও সন্দেহভাজন রূপে উপস্থাপনপূর্বক দূরে সরিয়ে রাখতে তারা ততোধিক সক্রিয়।
৩.  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের প্রধান খাত এখন গার্মেন্ট শিল্প। প্রায় কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রফতানিমুখি গার্মেন্ট শিল্প। সঙ্গত কারণেই ক্রেতারা তখন পণ্য ক্রয়ে অন্য কোনো দেশ খোঁজে আর এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দের দেশটাই হয় ভারত। বাস্তবতা এই যে, আমরা এ পর্যন্ত যে সকল গ্রাহক হারিয়েছি তাদের প্রায় সকলই লুফে নিয়েছে ভারত।
৪. অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন কমে যাবে, আর ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকে প্রথমত ভারতের দ্বারস্থই হতে হবে। এতে করে একদিকে ভারতের দাদাগিরির সুযোগটা বাড়বে অন্যদিকে তাদের পণ্যের জন্য উন্মুক্ত বাজার সৃষ্টি হবে, আর কষ্টার্জিত  বৈদেশিক মুদ্রাগুলো জমা হয়ে যাবে ভারতের কোষাগারে।
৫. স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয় আগ্রাসন বঞ্চনা ও জুলুমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার দেখা গেছে জামায়াতকে। বেরুবাড়ী, তিনবিঘা করিডোর, দক্ষিণ তালপট্টি, লেলিয়ে দেয়া ‘শান্তি বাহিনী’, ফারাক্কা-তিস্তা, সীমান্তে হত্যা, ইয়াবা-ফেনসিডিল পাচারসহ সকল জুলুম ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই সংগঠনটিকে সদা সোচ্চার দেখা গেছে। টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে তারাই প্রথম জনসভা থেকে প্রতিবাদ জানায় ও জনগণকে সচেতন করে তোলে এমন এক সময় যখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল ‘টিপাইমুখ বাঁধ কার্যকর হলে উপকৃত হবে বাংলাদেশ’। ’৭১ এ পরাজিত শক্তির’ এই বাড়াবাড়ি ভারত আদৌ ভালো চোখে তো দেখেনি বরং তার কায়েমী স্বার্থের প্রতি এক বড় রকম হুমকি রূপেই দেখেছে। সুতরাং ‘জামায়াত নির্মূল’ ভারতের ১নং টার্গেটে ওঠে আসে এবং সেই লক্ষ্যে তারা অনেকটা সফলও বলা চলে। সমগ্র বিশ্ব যুদ্ধাপরাধ বিচারের অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাতদুষ্টতার বিষয়ে আপত্তি জানালেও ভারত এই বিচার কার্যক্রমের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাই জামায়াত নেতাদের ফাঁসি কার্যকর ও জামায়াত নির্মূলে আওয়ামী লীগকে যেভাবেই হোক ক্ষমতার রাখা ভারতের স্বার্থেই তারা জরুরি মনে করছে।
৬. আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ভারতের অবস্থান প্রকৃত অর্থে মানবিক ও  নৈতিক তাগিদজনিত যে নয় বরং কৌশলগত সেটি তাদের কথায় ও আচরণে অনেক আগেই তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে। ’৭১ ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেক শ’ ৭১ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারকে ই›্দরিা গান্ধীর মহাভুল হিসেবে মন্তব্য করার কারণ এখানেই। তাদের দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদগণ এখানে এসে বার বার ’৪৭-এর সীমানা মুছে দেয়ার আবদার জানাচ্ছেন প্রকাশ্যে আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রীদের সামনেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধনের ঘটনাও ঘটে কলকাতাতে। এসব আলামত থেকে এই সত্যই বোধ করি বেরিয়ে আসে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পাকিস্তান মেনে নিলেও আসলে মেনে নেয়নি ভারত। আর তাই এক সুদূরপ্রসারী নীল নকশার আওতায় ধীরে-সুস্থে এগুচ্ছে তারা। এলক্ষ্যে এখানে ভারতের জন্য চাই লেন্দুপ দর্জি বা শেখ আব্দুল্যার মতো কেউ। এ লক্ষ্যে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ ভারতের প্রথম পছন্দ। তাই তাদেরকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের এই অনৈতিক ও গণবিরোধী আচরণ।
নব্য স্বাধীন যে কোনো দেশের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে স্বাধীনতা উত্তর সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা বিনির্মাণে আত্মনিয়োগের প্রচেষ্টাই লক্ষণীয় হয়ে ধরা দেয়। আর এতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায় বিজয়ী পক্ষকেই। কিন্তু বাংলাদেশের এক নির্মম দুর্ভাগ্য! এখানে ’৭১ সালের প্রসঙ্গ টেনে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ শক্তি রূপে বিভাজন করা হচ্ছে ২য় এবং ৩য় প্রজন্মকেও। এই নতুন সমীকরণে যারা ভারতের অন্যায়, জুলুম-অত্যাচারকে নীরবে হজম করতে সক্ষম তারা হচ্ছে স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি, হোক না সে দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মানিলন্ডারার, শেয়ার বাজার বা ব্যাংক লুটেরা। আর বিভক্ত জাতিসত্তা ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল বলে এ কাজে ভারত একমাত্র আওয়ামী লীগকেই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে করে।
নিয়তির এই কঠিন বাস্তবতার অক্টোপাসে আমাদের জাতীয় জীবন বন্দি হয়ে পড়েছে যার থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় যেন জানা নেই কারও। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও এর ফলাফল এই সত্যই যেন প্রকাশ করে দিল যে, ভারত যা চায় তাই বাংলাদেশের নিয়তি, জনগণের ইচ্ছা এখানে কিছুই নয়। কারণ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সহায়তা মানবিক নয়, এটি একটি বিনিয়োগ। সুতরাং বিনিয়োগের বেনিফিট তাকে নিতেই হবে, ‘শক্তি থাকে ঠেকাও দেখি’ এই হলো তার শেষ কথা।
আমাদের জন্য দুঃখ ও কষ্টের বিষয় হলো ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে গণতান্ত্রিক চেতনা ও গণঅভিপ্রায়ের পক্ষে আমাদের সহযোগী ও বন্ধু হিসেবে যে ভারতকে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পাশে দেখতে পেয়েছিল, আজ ২০১৪ সালে সেই ভারতকেই তারা গণতন্ত্রের শ্মশানযাত্রায় পৌরহিত্য করতে দেখল! গণতান্ত্রিক চেতনা ও ঐতিহ্যের বিপক্ষে ভারতের এই অবন্ধুসুলভ অবস্থান আবারও প্রমাণ করল ভারতের ইচ্ছা ও প্রত্যাশার মোকাবিলায় আমাদের জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার বাঞ্ছিত প্রত্যাশাটিও এখন অদূরদর্শী চিন্তা ও মোহভঙ্গের নামান্তরই যেন। এহেন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অর্থ-তাৎপর্য নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে, যেমনটি আর একবার অনুভূত হয়েছিল ১৯৭১-এ ।
এম জি হোসেন 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দুঃসংবাদের সাথে বসবাস


মানুষ প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে কামনা করে সুসংবাদ; কিন্তু এর পরও মানুষ শুধু সুসংবাদই পায় না, তাদের দুয়ারে এসে হানা দেয় দুঃসংবাদও। শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, ব্যক্তিকে ছাপিয়ে পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনের বেলায় এ কথাটি খাটে; কিন্তু সুসংবাদের পরিমাণকে যদি দুঃসংবাদের পরিমাণটা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেই দুঃসংবাদের ভার বইতে সত্যিই আমাদের বড় কষ্ট হয়। তা সেই দুঃসংবাদ আসুক যেকোনো পর্যায়েই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ে কিংবা অন্য কোনো পর্যায়েই। আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ বুঝি আজ সুসংবাদের তুলনায় দুঃসংবাদের মুখোমুখি অনেক বেশি মাত্রায়। তাই ভালো আছিউচ্চারণ করাও যেন আমাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমাদের সারাক্ষণই যেন কোনো না কোনো দুঃসংবাদের সাথে বাস করতে হচ্ছে।
গত শুক্রবার দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে একটি দুঃসংবাদ। কী ভয়াবহ সংবাদ! গত বছর ৪ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে একই রাতে অপহরণের শিকার হন আট যুবক। সেই থেকে এরা নিখোঁজ। র‌্যাবলেখা পোশাক পরে, ‘র‌্যাব-১লেখা গাড়িতে তাদের র‌্যাবের লোকেরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে স্বজনদের অভিযোগ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস কাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ প্রশাসনের প্রতি আকুতি জানিয়ে বলেছেন ‘আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন।সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়েন এরা। কথা বলতে গিয়ে গলা আটকে আসে এদের। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। কারো অবুঝ সন্তানের কান্না থামানোই যাচ্ছিল না। এভাবেই এরা কাঁদছেন পাঁচ মাস ধরে। এদের কেউ হারিয়েছেন ছেলে, কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কেউ ভাই, কেউ বাবা। পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন কী তাদের অপরাধ? কেন তাদের অপহরণ করে গুম করা হলো? এরা কোনো অপরাধ করে থাকলে এদের বিচার হবে, শাস্তি হবে। অপহরণের শিকার হবে কেন? র‌্যাবের পরিচয়ে একই রাতে তুলে নেয়া এই আটজনের মধ্যে আছেন বিএনপির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ও তার খালাতো ভাই জাহিদুল করিম তানভির। সংবাদ সম্মেলনে এদের গুমকরার অভিযোগ করে অবিলম্বে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি তোলা হয়। ব্রিফিংয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
না, অপহরণের এই দুঃসংবাদের এখানেই শেষ নয়। গত ১৮ এপ্রিল মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮ জন অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয় ২৪ জনকে; কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো খোঁজ নেই। এরা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন তা কেউ জানে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে ছাত্রলীগের চারজন, জামায়াত-শিবিরের দুজন, বিএনপির ১১ জন, ব্যবসায়ী তিনজন, চাকরিজীবী চারজন এবং সাধারণ নাগরিক ১১ জন। এই ৩৯ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ পাওয়া যায়। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয় চারজনকে। অন্য ২৩ জনের কোনো খোঁজ নেই।
গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার চেতনা আর দেশাত্মবোধ প্রদর্শনের অন্য ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলাজাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে আমাদের ৪৩তম স্বাধীনতা দিবস পালন করলাম, তখন এর আগের দিন একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের একটি সচিত্র সংবাদ আমাদের মর্মে আঘাত হেনে প্রশ্ন জাগায় চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? ইংরেজি দৈনিক ডেইলি অবজারভারের ২৫ মার্চ ২০১৪ সংস্করণে পুওর মাদার সেলস হার নিউবর্নশীর্ষক সংবাদে জানায় চল্লিশ বছর বয়সী মিনা বেগম থাকেন একটি ভাড়া করা ঘরে। তিনি এক পুত্রসন্তান জন্ম দেন। তার দুই মাসের ঘরভাড়া দুই হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। কিছুতেই ভাড়ার টাকা শোধ করতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা মাসুদের স্ত্রী তাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেন। মিনা বেগম এর পরও ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে মিনা বেগম তার নবজাতক সন্তানকে রাশেদা বেগম নামের এক বন্ধ্যা মহিলার কাছে  বিক্রি করেছেন। যে দেশে এখনো একজন মাকে জীবিকার তাগিদে তার নবজাতককে বিক্রি করতে হয়, সে দেশে আড়াই লাখের মতো মানুষ জড়ো করে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলাগেয়ে ঘটা করে স্বাধীনতা উৎসব পালন কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন আসে বৈকি। তা ছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন দেশের মানুষ এখন সুখে আছে, এরা এখন দিনে চারবেলা ভাত খায়; তখন এ সংবাদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কতটুকু সমর্থন করে সে প্রশ্নও ওঠে। শুধু মিনা বেগমেই যদি জীবন-জীবিকার তাগিদে তার সন্তান বিক্রির ঘটনা সীমিত থাকত, তাহলে হয়তো একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে না হয় চালিয়ে দেয়া যেত; কিন্তু ঘটনাচিত্র ভিন্ন কিছু। প্রায়ই আমরা অভাবের তাড়নায় মা-বাবাকে সন্তান বিক্রির মতো নিষ্ঠুর পথ বেছে নেয়ার খবর গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি। দুধের শিশুকে ডাস্টবিনে কিংবা অন্য কোনো স্থানে ফেলে যেতে দেখি। অভাবের তাড়নায় বাবা-মা সন্তান হত্যা করে নিজেরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখি। এ ধরনের ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
লজ্জাজনক দুঃসংবাদ নিয়েই যেন বসবাসের নিয়তি আমরা বেছে নিয়েছি। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তি গেল গত ২৪ এপ্রিল। এ ট্র্যাজেডির শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটেছে এক হাজার ১৩৫ জনের। আহত হয়েছেন দুই হাজার ৪৩৮ জন। পরিচয় মেলেনি ১০৫ জনের। পঙ্গু হয়েছেন ৪০০ জন। জীবিতদের ৯০ শতাংশই ট্রমায় আক্রান্ত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ, এদের মধ্যে নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। ভয় পাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখাসহ নানা ধরনের দুঃসহ স্মৃতি এদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে; কিন্তু এই শোকগাথার এক বছর পূর্তির সময়ে আজ আমরা অনেক কথাই শুনছি, জানছি। আহত দুই হাজার ৪৩৮ জন শ্রমিক আজো ভুলতে পারছেন না তাদের সে দিনের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। তবে যাদের ভুলে যাওয়ার কথা ছিল না, তারা ঠিক ভুলে বসেছেন এসব মানুষের পুনর্বাসনের কথা, নিহত এক হাজার ১৩৫ ও নিখোঁজ ১০৫ জনের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার এক বছর পরও হতাহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে না পারা খুবই লজ্জাজনক ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের উপ-মহাপরিচালক গিলবার্ট হংবু। কতটুকু অমানবিক হলে আমরা ভুলে যেতে পারি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার এসব দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের কথা। এসব শ্রমিকের ৬৬ শতাংশ জীবনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ৬৩.৭৪ শতাংশ শ্রমিক শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। ৯ শতাংশ শ্রমিক কাজের প্রতি অনীহ হয়ে উঠেছেন। এক হাজার শ্রমিক এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। এদের কথা ভুলে যাওয়া সত্যিই লজ্জাজনক।
কিন্তু যাদের এ নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কথা, তারা কি লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো বোধজ্ঞান রাখেন? সমালোচকেরা বলেন, এরা যখন ক্ষমতায় থেকে সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেন, তখন তাদের লজ্জাজ্ঞানবোধ না থাকারই কথা। কার্যত ঘটেছে তা-ই। মিনা বেগমেরা যখন সন্তান বিক্রি করে জীবনের তাগিদ মেটান, রানা প্লাজার শিকার আহত-নিহত-পঙ্গু মানুষ ও তার স্বজনদের পুনর্বাসন কিংবা ক্ষতিপূরণ নিয়ে চার দিকে যখন কথা ওঠে, তখন এ দেশের মানুষ একই সাথে শোনে অন্য ধরনের দুঃসংবাদ। এ দুঃসংবাদ ক্ষমতাসীনদের অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ার দুঃসংবাদ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্প্রতি তথ্য দিয়েছে ২০০৮ ও ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আয়, সম্পদ, দায়দেনা, আয়করবিষয়ক তথ্য এবং পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৪৮ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। এ হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ২৪৩ শতাংশ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৬৪ শতাংশ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপদের ক্ষেত্রে ৩০৭১ শতাংশ সম্পদ বাড়ানোর এই অভাবনীয় হার দেখে বিস্মিত দেশের সর্বস্তরের মানুষ। সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সব মহলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সমালোচনার ঝড় থামানোর জন্যই হোক, কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক জানুয়ারির শেষ দিকে খবর বেরিয়েছে দশম জাতীয় সংসদের হলফনামায় দেয়া তথ্যানুযায়ী মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বাড়ানো বিষয়ে শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান করেছে দুদক। প্রাথমিক ধাপে সাতজনের সম্পদের তদন্তে নামছে দুদক। এরা হলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি এনামুল হক, ঢাকা-১৪ আসনের সাবেক এমপি আসলামুল হক, কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি এবং সাতক্ষীরা-২ আসনের সাবেক এমপি মো: আবদুল জব্বার। খবরে বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে আরো বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-এমপির অস্বাভাবিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করবে দুদক। তবে এই তদন্ত শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে, না তা একান্তই লোক দেখানো হবে সে ব্যাপারে অনেকেই সন্দিগ্ধ। বিশিষ্টজনেরা এই তদন্তের বিষয়কে দুদকের জন্য জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন, তেমনি একে দুদকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও মনে করছেন। কারণ বিগত পাঁচ বছরে সরকারদলীয় এমপিরা যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সে পাহাড় ডিঙিয়ে দুর্নীতি নামের দৈত্যের পতন ঘটানো দুদকের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেয়া হলফনামা মতে এই পাঁচ বছরে এমপিদের সম্পদ বেড়েছে ৩২৯৮৫ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ পরিমাণ সম্পদ বাড়াতে এরা এই পাঁচ বছরে হয়ে উঠেছিলেন একেকটি টাকা বানানোর মেশিন।
জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক দুঃসংবাদ নিয়ে যেন আমাদের বাস করতেই হবে, এমনটিও জনমনে বদ্ধধারণা জমতে শুরু করেছে। বছরের শুরুতেই দেশবাসী পেল ৫ জানুয়ারির একতরফা ভোটারবিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এদেরকে কেউ কেউ অটো-এমপি হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এদের মধ্যে যারা মন্ত্রী হয়েছেন তাদেরকে বলছেন অটোমন্ত্রী নামে। আর জাতীয় পার্টি ও এর নেতা জেনারেল এরশাদকে নিয়ে যে নাটক চলেছে, তা সবার জানা। এখনো যা ঘটছে, তা-ও কারো অজানা নয়। অভাবনীয়ভাবে তার দল এখন সরকারেও এবং বিরোধী দলেও। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত এ নির্বাচনকে দেশ-বিদেশের কেউ গ্রহণযোগ্য বলতে চান না। তার পরও সরকারি দলের কথিত নিয়ম রক্ষার এ নির্বাচন সূত্রে গঠিত দশম সংসদ নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের নেতারা এখন নানা কূটকৌশলে লিপ্ত আগামী পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার। এ জন্য সরকার যত কঠোর হওয়ার হবে এমন ঘোষণাও আসছে শীর্ষ পর্যায় থেকে। এ কূটকৌশলের অংশ হিসেবে দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে সরকার দ্রুত মাঠে নামল উপজেলা নির্বাচন নিয়ে। লক্ষ্য ছিল ৫ জানুয়ারির মতো বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের এ নির্বাচন বয়কটের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দল জোটের অবস্থান আরো শক্তিশালী করা। বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন তা হতে দেয়নি। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুয়েক দফায় বিএনপি-জামায়াত জানিয়ে দেয় স্থানীয় পর্যায়ে তাদের জনভিত্তি এখনো অনেক শক্ত। ভ্যাবাচেকা খাওয়া বর্তমান সরকার পরবর্তী কয়েক দফার উপজেলা নির্বাচনে চালায় বেপরোয়া ভোট ডাকাতি কেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স দখল করে ইচ্ছেমতো সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভরে দেয়। প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকারি দলের প্রার্থীর হয়ে নানাধর্মী অনিয়মে সহায়তা করা ইত্যাদি কোনোটিই বাদ যায়নি বিশেষ করে শেষের দিকের কয়েক পর্বের উপজেলা নির্বাচনে। সংবাদপত্রের পাতার পর পাতা ভর্তি হয়ে যায় উপজেলা নির্বাচনের নানা দুঃসংবাদ নিয়ে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভোট ডাকাতির ভিডিও ফুটেজ দেখে দেশবাসী হতবাক। এসব দুঃসংবাদ নিয়েই যখন দেশের মানুষ এক ধরনের চাপা ক্ষোভ নিয়ে বাস করছে, তখন হঠাৎ করেই নির্বাচন কমিশন ২০টি জেলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঘোষণা দিলোÑ উপজেলা নির্বাচনে কোনো অনিয়ম পায়নি নির্বাচন কমিশন। অথচ দেশবাসীসহ বিদেশীরাও জানে, এবারের উপজেলা নির্বাচন ছিল রীতিমতো ভোট ডাকাতির নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলো কার্যত পরিণত হয়েছিল ভূতকেন্দ্রে। ভোটের সময় এমনকি ভোটের আগের দিন রাতের অনেক ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা এবার জানা গেছে গণমাধ্যমের সুবাদে। অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ও মার্চজুড়ে কয়েক দফায় চলা উপজেলা নির্বাচন এ দুটি বিতর্কিত নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য যেমন কলঙ্কতিলক হয়ে থাকবে, তেমনি জাতির জন্য হয়ে থাকবে দুটি মহাদুঃসংবাদ। এর পরে খবর আসে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার নানামাত্রিক ঘোষণা।
জানি না, এ ধরনের দুঃসংবাদ নিয়ে জাতিকে আর কতকাল বাস করতে হবে। এরপরও দুঃসংবাদ বাংলাদেশের ওপর ক্রমেই ভারতের শকুনি থাবার সম্প্রসারণ ঘটছে। এমনই দুঃসংবাদ দেখলাম গত ২০ এপ্রিলের একটি জাতীয় দৈনিকে। খবরটিতে বলা হয়েছেÑ ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী বাংলাদেশের কাছে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করেছেন। তার দাবি মতে, খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল জমি ছেড়ে দিতে হবে ভারতকে। বিজেপির এই নেতার যুক্তি হলো, দেশভাগের পর অধুনা বাংলাদেশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান ভারতে প্রবেশ করেছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে বাংলাদেশে। অন্যথায় এসব মুসলমান সংস্থাপনের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের কাছে এর এক-তৃতীয়াংশ জমি ছেড়ে দিতে হবে। গত ১৯ এপ্রিল ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর থেকে প্রকাশিত দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ এ খবর জানায়। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্রিটেনের হাউজ অব কমন্সে ১৯৪৭ সালের জুনে ভারতের দেশভাগ নিয়ে বিতর্ক ও ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টের মৌলিক প্রসঙ্গ তুলে যে তত্ত্বের যুক্তিজাল সুব্রামনিয়াম স্বামী উত্থাপন করেন, এক কথায় এর মর্মার্থ হচ্ছে মানুষের বোঝা চাপিয়ে দিলে দিতে হবে জমিও। তার বক্তব্য হচ্ছে, ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছিল ভারত। তাই পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে যেসব মুসলমান ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। অন্যথায় তাদের সংস্থাপনের জন্য ভারতকে জমি দিতে হবে বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে। স্বামীর মতে, যেহেতু বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভারতে ঢুকে পড়েছে, অতএব বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ভারতকে ছেড়ে দেয়ার দাবি তুললেন তিনি।
সুব্রামানিয়াম স্বামীর বাংলাদেশের কাছে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের দাবি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভারত বিভাজনকে ভারতীয়দের মেনে না নেয়ার বিষয়টিকে। ভারতীয়রা এখনো মনে করে, আবার অখণ্ড এক ভারত হবে। তারই অংশ হিসেবে সুব্রামানিয়ামের এ দাবি উত্থাপন কি না বলা মুশকিল। সে জন্যই ভারত আমাদের অভিন্ন নদীগুলোতে পানির ন্যায্য হিস্যা দিচ্ছে না। ছিটমহল সমস্যার সমাধান করছে না। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ভারতের দখলে থাকা দুই হাজার বিঘা জমি বাংলাদেশকে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের সরকারের সে ভূমি উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেই।
বাংলাদেশের কোনো দল ন্যায্য হিস্যা দাবি করলে আমাদের ভারতপ্রেমী সরকার তাদের স্বাধীনতাবিরোধী ও সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করে নানা ধরনের টিপ্পনী কাটে। এক দিকে ভারত বাংলাদেশের মানুষকে ভাতে-পানিতে মারার জন্য উদ্যত, অন্য দিকে আমাদের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল-জোটের নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে দেশে এক ধরনের ফ্যাসিবাদ কায়েম করছে। এর সূত্র ধরে দেশে প্রতিদিন আসছে নানা দুঃসংবাদ। আর এসব দুঃসংবাদের মধ্যে আজ বাস করতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। জানি না, কবে হবে এসব দুঃসংবাদের অবসান। মানুষ ফেলবে স্বস্তির নিঃশ্বাস।

গোলাপ মুনীর


 

Ads