বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নতুন বছরের আশা


গতকাল খ্রিস্টীয় সাল ২০১৪ বিদায় নিয়েছে, আজ শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০১৫। বিগত বছরটি বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কিন্তু কোনো সাফল্য কিংবা শুভ কোনো ঘটনা বা কারণের জন্য নয়। বরং এমন কিছু কারণের জন্য, যেগুলো জাতিকে শুধু বিভক্তই করেনি, অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের দিকেও ঠেলে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পুরো বছর ধরেই রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, মামলা এবং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা ছিল প্রতিদিনকার উল্লেখযোগ্য বিষয়। এসবের ফলে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। কয়েক লাখ নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলায় আসামী করেছে পুলিশ। অসংখ্যজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হয়েছে। একযোগে চলেছে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনও। এসব কাজে সরকার পুলিশ ও র‌্যাবকে ব্যবহার করেছে ভাড়াটে বাহিনীর মতো। বছরের শুরুতে ৫ জানুয়ারি এক সাজানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছে, জনগণের অধিকারকে ছিনতাই করেছে। কিন্তু সংবিধানের দোহাই দেয়া হলেও ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ উল্লেখযোগ্য কোনো দলই ওই নির্বচনে অংশ নেয়নি। ভোট দিতে যাননি এমনকি পাঁচ শতাংশ ভোটারও। সে কারণে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১৫৩ জন নির্বাচন না করেই ‘নির্বাচিত’ হয়ে গেছেন। এর ফলে ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ওদিকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনায় ও প্রচারণায় ঘাটতি না থাকলেও নির্বাচনটি দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বরং নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ফলে প্রথম থেকেই বৈধতার সংকটে পড়েছে সরকার। এই সংকট ক্রমাগত আরো মারাত্মক হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন বিষয়ে একের পর এক ছাড় দিয়েছে। জোট হরতাল ধরনের বড় কোনো কর্মসূচিতে বা আন্দোলনে না গিয়েও সরকারকে সমঝোতার জন্য সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা ২০ দলীয় জোটের দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সমঝোতায় আসার এবং সুষ্ঠু ও গণতন্ত্রসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করার পরিবর্তে সরকার তার ফ্যাসিস্ট কর্মকান্ডকেই বছরের শেষদিনগুলো পর্যন্ত জোরদার করেছে।
এভাবে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার ভিত্তিতেও বলা যায়, রাজনৈতিক তথা গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য ২০১৪ ছিল অত্যন্ত অশুভ একটি বছর। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতির প্রভাব তো ছিলই, পাশাপাশি অন্য অনেক কারণেও সরকার ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে। অর্থনীতির কোনো একটি খাতেই দেশ শুভ কিছু অর্জন করতে পারেনি। দাতারা সাহায্য বন্ধ করেছে নয়তো অনেক কমিয়ে দিয়েছে। দেশে নতুন কোনো বিদেশী বিনিয়োগ হয়নি। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশীরা বিদেশে চাকরি পায়নি বললেই চলে। একযোগে সমাজে বেড়েছে অপরাধ। ছিনতাই-ডাকাতি তো বটেই, হত্যাও ডাল-ভাতের মতো সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের প্রশ্রয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছিল যে, র‌্যাবের মতো একটি অভিজাত বাহিনীর অফিসাররাও সরাসরি রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এখন সারাবিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও কার্যক্রমের পরিণতিতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে বহুদূর। জাতি বিভক্ত হয়েছে ও পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক বিষয়ে। সরকার গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরার নীতিকে অব্যাহত রেখেছে। ফলে দৈনিক আমার দেশ যেমন প্রকাশিত হতে পারেনি তেমনি নিষিদ্ধ রয়েছে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি। ওদিকে সরকারের উদ্যোগে স্বাধীনতা খুইয়ে ফেলেছে জনগণের শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগও।
বিগত বছরের অভিজ্ঞতা অতি তিক্ত হওয়ায় কোনোদিকেই তেমন কোনো সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারেনি। একই কারণে নতুন বছর ২০১৫ সালকে নিয়ে জনগণ এখনই আশাবাদী হয়ে উঠতে পারছে না। তারা বরং আশংকা করছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক সংকট ক্রমাগত আরো মারাত্মকই হতে থাকবে। এর ফলে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রেও পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। আমরা মনে করি, এমন আশংকার অবসান ঘটানোর দায়িত্ব সরকারের। হামলা ও হত্যা, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা এবং নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালানোর ও বাড়ানোর পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান যুক্ত করা এবং অমন একটি সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নেয়া। তার আগে বর্তমান মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে, ভেঙে দিতে হবে বিদ্যমান সংসদকেও। আমরা আশা করতে চাই, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সংঘাত এড়িয়ে সমঝোতার পথেই পা বাড়াবেন ক্ষমতাসীনরা।

রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অথ ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ সমাচার


বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ ২০১৪ সাল ছেড়ে ২০১৫ সালের পথে পা বাড়িয়েছে। বছরের শেষ দিনগুলোও হরতাল-আন্দোলনে প্রকম্পিত। আজকেও শুরু হয়েছে একটি পূর্ণ হরতাল। ফলে সামনের নতুন বছরের আশা ও সম্ভাবনা যতটুকু রয়েছে, তার চেয়ে বেশিই আছে হতাশা, শঙ্কা। মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা যায় নি; গণতন্ত্রের সুফলও প্রস্ফুটিত হয়নি। নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ বলছে, ‘গণতন্ত্রের নামে চলছে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’। তারা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে গণভোটের প্রস্তাব করেছে। ‘সুজন’-এর উক্ত সভায় ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘দেশে অনুদার গণতন্ত্র বিরাজ করছে।’ শামসুল হুদা বলেছেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া হয়েছে।’ অতএব বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা কথা বের হয়ে আসতে শুরু করেছে।
এমতাবস্থায় জনগণের প্ল্যাটফরম নামে পরিচিত ২০ দলীয় জোট আসন্ন ৫ জানুয়ারির ভোট ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে উদ্যোগী হয়েছে এবং সরকার যথারীতি জনসমাবেশ করতে না দেয়ার পথে এগুচ্ছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে কিছু আলাপ-আলোচনা হোক, সেটা সরকার চায় না। তারা কলঙ্ক লুকানোর মতো বিষয়টিকে লুক্কায়িত রাখতে চায়।
কিন্তু লুকিয়ে রাখতে চাইলেই সব কিছু লুকানো বা আড়াল করা যায় না। কারো চরিত্র, তার উপাধি, কারো অর্জন, কারো বিসর্জন লুকানোর বিষয় নয়। শেরে বাংলা বলতে মানুষ তার ভালো-মন্দ সব কিছুই অনুভব করে। সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, জিয়া, খালেদা, হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কথা উঠলে মানুষ সেসব ব্যক্তি বা দলের ভালো বা মন্দ, অর্জন বা বিসর্জন, সব কিছুতেই চোখের সামনে দেখতে চায়। হয়তো ভয়ে, চাপে, আতঙ্কে সব কথা খোলামেলা বলতে পারে না। তবে সময়মতো সেগুলো বলার জন্য বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখে। একদিন ভয়ে কেউ বলতে পারেনি বলেই কোনোদিন বলতে পারবে না, এমন নয়। সময় ও সুযোগমতো আমলনামা প্রকাশ পাবেই।
২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে প্রবেশের মুখে ব্যক্তি বা দলের আমলনামাও সঙ্গে থাকবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। ইতিহাস সর্বদাই জনগণের পক্ষে থাকে। যদি কেউ জানতে চায় ২০১৪ সালের প্রত্যাশা কি ছিল? তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ইতিহাস মানবকণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলবে, ২০১৪ সালের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের প্রত্যাশা। প্রতিপক্ষ নিধন আর চরিত্র হননের রাজনীতির অবসান কামনা। ২০১৪ সালে মানুষের এসব প্রত্যাশা পূর্ণতা পায়নি। ২০১৫ সালেও বাংলাদেশের মানুষ এসব প্রত্যাশায় রাজপথ প্রকম্পিত করবে।
অথচ নতুন একটি বছরে মানুষকে সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়ে আশাবাদের প্রত্যয় জাগিয়ে দিতে পারতেন পদাধিকারী নেতৃত্ব। নতুন বছরে নতুন স্বপ্নে যদি আরো একজন মানুষকেও ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টির কবল থেকে বাঁচানো যায়, সেটাও বড় অর্জন হবে। সেটা না করে, সামনের দিকে এক কদমও অগ্রসর হওয়ার আশাবাদ না জাগিয়ে নিজস্ব ক্ষমতার বলয়কে মজবুত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাই বরং উগ্রভাবে দেখানো হচ্ছে। বিরোধী দলকে সম্মানজনক জায়গা দেয়া তো দূরের কথা, তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কটু-কাটব্য করে বিকৃত আনন্দ লাভ করা হচ্ছে। একদিকে জেল, জুলুম, ফাঁসি চলছে। অন্যদিকে সভা-সমাবেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এই অবস্থাকে নানা নামে ডাকা হচ্ছে দেশ-বিদেশ থেকে। সর্বশেষ উপাধি দিয়েছে ‘সুজন’: ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’। 
‘সুজন’ জ্ঞানী-গুণীদের সংগঠন। তারা যখন কোনো কথা বলে, তখন ধরে নিতে হয় যে, বুঝে-শুনেই বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ অ্যাখ্যা দিয়ে তারা কি জ্ঞানের পরিচয় দিলেন? নাকি মূর্খতার প্রচার করলেন? ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে কয়েকটি কারণে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ উপাধিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ: ১. যেখানে ভোট হয়নি, ভোটার আসেনি, সেখানে স্বৈরতন্ত্রের সামনে ‘নির্বাচিত’ শব্দটি কি করে ব্যবহার করা যায়? ২. স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি নিকৃষ্ট কুশাসনের কাঁধে ‘নির্বাচিত’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে সেটার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? ৩. সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো সুস্পষ্ট পরিস্থিতিতে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে লাঠি না ভেঙে সাপ মারার ধূর্ততার শামিল নয় কি? ৪. প্রায়ই একটি বিশেষ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতাকালে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিত্ব ও মেরুদন্ডহীনতার কথা বলে। ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে দুই কূল রক্ষার মানসিকতা সে সমালোচনাকে সত্য প্রমাণ করবে। ৫. সমালোচনাও করা হলো, পুরস্কারও দেয়া হলো ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করে। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। অনেকেই বলবে, স্বৈরাচার হলেও তারা তো নির্বাচিত! কিন্তু আসলে সেখানে ভোট, ভোটার আর নির্বাচনের অস্তিত্ব নিয়েই বিরোধী দলের প্রধান সমালোচনা। বৈধতার সঙ্কটটিও সেখানেই। অতএব চটকদার শোনালেও ‘সুজন’ বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে উল্লেখ করে প্রকৃত সত্যের উদ্ভাসন ঘটায়নি।
ইতিহাস থেকে আমাদের জানতে হবে যে, জনপ্রিয় বা নির্বাচিত স্বৈরাচার ছিল জার্মানীর হিটলার। কারণ, হিটলার সম্পূর্ণ অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হন। পরে অবশ্য তিনি স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হন। আমাদের জানা-শোনার মধ্যেও অনেকেই প্রথমে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরে একদলীয় বা স্বৈরাচারী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে স্বৈরাচার নির্বাচিতই হয়নি, সেটাকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলার মানে কি? ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনও গত নির্বাচনের চেয়ে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছিল। তারপরেও কেউ কখনো এরশাদকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলেনি। বলেছে স্বৈরাচারী এরশাদ। আর এখন প্রবল সমালোচনামুখর নির্বাচনের পর কাউকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’-এর সার্টিফিকেট দেয়া কি করে সম্ভব?
জানি না, আওয়ামী লীগ ‘সুজন’-এর বক্তব্যের জবাবে বা প্রতিবাদে কি বলবে। সেই বক্তব্য শুনেই অনুধাবন করা যাবে যে, ‘সুজন’-এর উপমা তারা পছন্দ করেছে কি না! বিএনপি, জামায়াত বা অপরাপর বিরোধী দল ‘সুজন’-এর বক্তব্যের সাথে একমত হবে বলে মনে হয় না। স্বৈরাচারকে কেউই ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ হিসাবে মানবে বলে মনে হয় না। তাহলে ‘সুজন’-এর বক্তব্যের তাৎপর্য ও সার্থকতা কি? তাৎপর্য বা মূলমর্ম এটাই যে, পরিস্থিতি এখন এতটাই স্পষ্ট ও বিভাজিত যে কর্তাভজা কথায় আর কাজ হবে না। শ্যাম বা কূল একটা রাখতে হবে। ‘সুজন’কে এটা বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ নতুন বছরে আরো তীব্রভাবে গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের দাবিতে সোচ্চার হবে। বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদী একদলীয় শাসন বা স্বৈরতন্ত্র কায়েম হওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এ কথাই বলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে। দেশের মানুষও সেটাই চাইছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে সংলাপ বা আলোচনায় মোটেই আগ্রহী বলে মনে হয় না। বরং হামলা-মামলা চালানো হচ্ছে। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিরোধী দলের সামনে আন্দোলন ও লড়াই ছাড়া বিকল্প কি থাকতে পারে? বিরোধী দল আর গণতন্ত্রকামী মানুষকেও তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। কার্যকর কিছু করতে হলে বাস্তবতার পথ ধরেই করতে হবে। বাস্তবতা যদি সংলাপের পথে যায়, ভালো। নইলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে কে জানে! কারণ আজও একটি হরতাল শুরু হয়েছে। লাগাতার হরতাল ও আন্দোলন-অবরোধের ডাকও দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের প্রতি বার বার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ গণআন্দোলনকে কখনোই ছোট করে দেখতে নেই। গণআন্দোলনকে ছোট করে দেখে যারা, তারা গণতন্ত্রের পক্ষের লোক নয়। বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের পক্ষ আর বিপক্ষের স্পষ্ট বিভাজন হয়ে গেছে। এটাই ২০১৪ সালের বাস্তবতা। ২০১৫ সালে গণতন্ত্র বাংলাদেশে বিজয়ী হবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করছে। বাংলাদেশ ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বা অন্য কিছুর অধীনে নয়; বাংলাদেশ প্রথমত ও শেষত থাকবে গণতন্ত্রেরই নিয়ন্ত্রণাধীন। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনগণ স্বৈরাচার বা একদলীয় শাসন কখনোই মানবে না। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পক্ষেই পথ চলবে ২০১৫ সালে। এটাই নতুন বছরের প্রত্যাশা।
কনক জ্যোতি

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্র বর্বরতা এবং আওয়ামী লীগ


গত ২৪ ডিসেম্বর পুরনো ঢাকার আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে স্থাপিত বিশেষ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে সুপরিকল্পিত সশস্ত্র হামলার কবলে পড়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই হামলা যে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরাই চালিয়েছে সে সম্পর্কে এরই মধ্যে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। হামলাকারীদের মারপিট ও কর্মকান্ডের দৃশ্যগুলো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সব সংবাদপত্রেও। বিশেষ করে পিস্তল দিয়ে গুলীবর্ষণরত সন্ত্রাসীর পরিচিতি সবিস্তারে ছাপা হয়েছে পরদিনের সংবাদপত্রগুলোতে। এই কীর্তিমানের নাম আবদুল আজিজ ফয়েজ। সে ঢাকা কলেজের একজন ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যার মামলায় দু’ নম্বর আসামী। ছাত্রলীগ তাকে কাগজে-কলমে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু অন্য অনেক উপলক্ষের মতো বকশীবাজারের হামলা ও তান্ডবের সময়ও তাকে প্রকাশ্যে তৎপর দেখা গেছে। তার আশেপাশে যারা ছিল তারাও ছাত্রলীগেরই চিহ্নিত সন্ত্রাসী। সে খবরও তাদের নাম ও পরিচিতি সহকারেই প্রকাশিত হয়েছে।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ছাত্রলীগের নেতারা তো বটেই, আওয়ামী লীগের নেতারাও ওই ফয়েজ এবং অন্য ক’জন ‘আপনজন’কে চিনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো বলেই বসেছেন, ছাত্রলীগের কোনো সোনার ছেলেই ঘটনাস্থলে ছিল না। তিনি উল্টো প্রশ্ন করেছেন, তারা ওখানে যাবেই বা কেন? ওদিকে আরেক আলোচিত মন্ত্রী কামরুল ইসলাম কিন্তু হাটেহাড়ি ভাঙার মতো বক্তব্য রেখেছেন। ২৬ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উৎসাহ যোগাতে গিয়ে বলেছেন, তারা যেন আরো জোরেশোরে এবং বলিষ্ঠতার সঙ্গে তাদের প্রতিরোধের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বিএনপি যেন মাঠেই থাকতে না পারে। অন্য কিছু তথ্যও জানানো দরকার। এরকম একটি তথ্য হলো, পুলিশ কিন্তু ছাত্রলীগের কারো গায়ে একটি টোকাও দেয়নি। লাঠিচার্জ থেকে টিয়ার শেল পর্যন্ত সব পুলিশি অ্যাকশনের শিকার হয়েছেন বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাই। মামলাও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই ঠুকেছে। একটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগের এমপি ছবি বিশ্বাসের গাড়িতে আগুন ধরানোর অভিযোগে। প্রশ্ন উঠেছে, এমপি তিনি নেত্রকোনার, কিন্তু ওই বিশেষ সময়ে ছবি বিশ্বাস কেন বকশীবাজারেই মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির হয়েছিলেন? তাহলে বেগম জিয়ার ওপর হামলা চালানোর পেছনে তারও কি সরাসরি ভ’মিকা ছিল?  
তথ্যগুলো কিন্তু অকারণে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে না। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এরই নাম আওয়ামী লীগ। বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা কাকে বলে তা জানার জন্যও ইতিহাসের দিকেই চোখ ফেরাতে হবে। সে ইতিহাসে জানা যাবে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব সম্পর্কেও। প্রথমে একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। দাবিটি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরে বাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। হক-ভাসানীর পাশাপাশি তৃতীয় প্রধান নেতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ শেরে বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছিল। ৯২-ক ধারার আড়ালে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৫৬ সালে। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের অন্য নেতারাও মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছির। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পরিপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এর প্রতিবাদে এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর জন্য বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সংঘাতের পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করতে হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মওলানা ভাসানীর তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভূমিকা পালন করেননি। শুধু তাই নয়, ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই পুরনো ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে যখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন অধিবেশন চলছিল তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী গুন্ডারা হামলা চালিয়ে অধিবেশনকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। প্রথমদিন পাল্টা প্রতিরোধে পিছিয়ে গেলেও দ্বিতীয় দফা হামলা চালানো হয়েছিল পল্টন ময়দানের সমাবেশে। সেদিনও শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই আওয়ামী গুন্ডারা মওলানা ভাসানীর এবং খান আবদুল গাফফার খানসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতাদের অনেকেরই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ইট-পাটকেলের ঢিল শুধু নয়, লাঠির আঘাতও সহ্য করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। ফলে পল্টন ময়দানের সমাবেশ অনেকাংশে ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে, গুন্ডামি করার এবং সন্ত্রাসী হামলা চালানোর শিক্ষাটাও উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এই গুন্ডামি ও বর্বরতা দিন দিন শুধু আরো মারাত্মক হয়েছে। পাকিস্তান যুগে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই বিশেষ করে পল্টন ময়দানে বাধাহীনভাবে সমাবেশ করতে পারেনি। প্রতিটি সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আওয়ামী গুন্ডারা। বাংলাদেশ হওয়ার পর দলটির বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মিছিল সমাবেশে হামলা তো চালিয়েছেই, ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেককে জখম ও খুন করেছে আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা। পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীকেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন নেতারা। ভাসানী ন্যাপ এবং জাসদের অনেক নেতাকেই আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হয়েছে। ন্যক্কারজনক সে বর্বরতাই এখনও চালাচ্ছে দলটি।
প্রসঙ্গক্রমে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশল সম্পর্কে বলা দরকার। ১৯৫০-এর দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন দলটি স্বায়ত্তশাসনের তো বটেই, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেও ভূমিকা পালন করেছে। এরপর এসেছে ১৯৬০-এর দশক। এখন গালগল্প শোনানো হলেও সত্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য কোনো আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। দলটি বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের মাধ্যমে অন্যের সাফল্যকে দখল করেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দী থাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে ছয়টি ভাগে আলাদা করে শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই খারাপ ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামী বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে বরং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেয়ার পরিবর্তে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ গিয়ে এমন এক জোট ‘ড্যাক’ বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সদস্য হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। ‘ড্যাক’-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না এবং শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হলেও তার নামের আগে-পরে ছিল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম। ‘ড্যাক’-এর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি ও কাউন্সিল মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক দলগুলো। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী ‘ড্যাক’-এর সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু বাঙালীর জন্য সংগ্রামের কৃতিত্ব দখলকারী দল ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ ‘ড্যাক’-এ গিয়েছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেন, ৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পল্টন ময়দানের সমাবেশ থেকে গিয়ে গবর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। পুলিশের গুলীতে আন্দোলনকারীদের মৃত্যু ও সরকারি দমন-নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরপর দু’দিন হরতালের ডাক দিয়েছিলেন।  তাঁর এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা, আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীরা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ভন্ডুল করেছিলেন শেখ মুজিব। যে ১১ দফার ভিত্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন সে ১১ দফাকে পরিত্যাগ করে নিজের ছয় দফাকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েও তিনি নিজের মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনাও পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। আবদুল মালেক উকিল তখন সভাপতি। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৪ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেন চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জেনারেল জিয়ার সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড় কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দন্ডাদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের সঙ্গে গুরুতর প্রতারণা করেছিল।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা- কখনো একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।
ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাতদলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে অন্যদের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরো একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নবেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটতো। জামায়াতের এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নি- তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের! এ প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরো লেখার ইচ্ছা রইল।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হলে পরিণাম ভালো হয় না

বর্তমান বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয়ে থাকে। এসব রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পদ্ধতি হলো, গণতান্ত্রিক পরিবেশে অবাধ,  সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই রাষ্ট্রগুলোয় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিজ নিজ সংবিধান ও আইন মোতাবেক নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এ নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন।  ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসনাধীন থাকাবস্থায় একটি একক রাষ্ট্র ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের আইনসভায় সাধারণ জনগণের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়ে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র জন্মলাভ করলে প্রথমোক্ত রাষ্ট্রটি জন্মের পর থেকে কেন্দ্র ও প্রদেশে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখে। কিন্তু শেষোক্ত রাষ্ট্রটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, জন্মের পর থেকে বেসামরিক ও সামরিক শাসনের অধীনে ১৯৭০ অবধি যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর মাধ্যমে গঠিত সংসদের কোনোটিই নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। অবিভক্ত পাকিস্তানে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই নির্বাচনের ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদই গঠিত হতে পারেনি।  ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় সংসদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে দলটি পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার বৈধ অধিকার লাভ করে। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কিছুতেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের ওপর ন্যস্ত করতে রাজি ছিলেন না। এ কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করে রাষ্ট্রটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের অখণ্ডতা  হয়তো ক্ষুণœ হতো না।  ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি রাষ্ট্র যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে গঠিত হলেও উভয় রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিসত্তার লোকজন বসবাস করে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু তবে সেখানে প্রধান ৩৬টি জাতিসত্তাসহ ছোট-বড় শতাধিক জাতিসত্তা রয়েছে। অবিভক্ত পাকিস্তানে পাঁচটি প্রধান জাতিসত্তাসহ আরো প্রায় ক্ষুদ্র ৩০টির মতো জাতিসত্তা ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির প্রধান ধর্ম হিন্দু ও ইসলাম হলেও বিভিন্ন জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিতে ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো জাতির ভাষা অন্য জাতির কাছে দুর্বোধ্য। অনুরূপভাবে, এক জাতির সংস্কৃতি অন্য জাতির কাছে নিজস্ব ধ্যানধারণা ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী।  জাতিগত বৈচিত্র্যে ভরপুর ভারত রাষ্ট্র হিসেবে জন্মের পর থেকে অদ্যাবধি কেন্দ্র ও রাজ্যে (প্রদেশ) সরকার পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে গণতান্ত্রিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ অনুসরণ করেছে। ফলে এ রাষ্ট্রটি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের অখণ্ডতা অক্ষুণœ রাখতে পেরেছে এবং আশা করা যায়, গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্রটি অখণ্ডতা ধরে রাখতে সক্ষম হবে।  বর্তমান পাকিস্তান চারটি প্রধান জাতিসত্তা এবং ১০-১২টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও পশ্চিম পাকিস্তান নামে একসময় পরিচিত পাকিস্তানের মূল অংশে দুইবার দীর্ঘ মেয়াদি সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটেছিল। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বারবার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে দেশটিতে এখনো গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, যে কারণে দেশটি কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জনেও সক্ষম হয়নি। পাকিস্তানে বিগত সাধারণ নির্বাচনটি তুলনামূলক বিচারে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হলেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে দেশটিকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এ পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ থেকে যদি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না আসে, তাহলে আশা করা যায় পাকিস্তান তার অখণ্ডতা ধরে রেখে ভবিষ্যতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে।  গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হওয়ার কারণে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটায় এখানকার মানুষ আশাবাদ পোষণ করেছিল যে, এ দেশে কখনো গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হবে না। কিন্তু দেশটির অভ্যুদয়ের চার বছর পার হওয়ার আগেই দেখা গেল, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা’র মানসে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নেয়া হলে হয়তো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো। একদলীয় শাসনব্যবস্থা এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের এক বছর অতিক্রান্ত না হতে এটিকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়ে একটি হৃদয়বিদারক বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসমেত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।  বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তার সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে অল্প সময়ে তার বিদায় ঘটে এবং রাজনৈতিক মঞ্চে আসেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, তিনি এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জনমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সামরিক শাসক হলেও তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকাকালে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে যে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা প্রতিযোগিতামূলক ছিল নাÑ এমন দাবি করার অবকাশ সীমিত। জিয়া যে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হলে সে গণতন্ত্র হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত। কিন্তু তার ও দেশের দুর্ভাগ্যÑ একটি দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য দ্বারা তার জীবনাবসান ঘটে।  জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদের কূটকৌশলে নতি স্বীকার করে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরশাদ প্রায় ৯ বছর শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন। তার শাসনামলে যে দু’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এর প্রথমটিতে আওয়ামী লীগের বিজয়কে নস্যাৎ করা হয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি ছিল একটি প্রহসনের নির্বাচন। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচন সম্মিলিতভাবে সব বিরোধী দল বর্জন করলে সামরিক শাসক এরশাদের শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। ’৮৬’র সংসদ নির্বাচনে কী কারণে এবং কার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল সেটি রহস্যাবৃত।  ’৯০ এর গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতন হলেও সে গণ-আন্দোলন এককভাবে এরশাদের পতন নিশ্চিত করেছে, নাকি তার ওপর থেকে সামরিক বাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহার পতনকে অবশ্যম্ভাবী করেছে, সে প্রশ্নে বিতর্ক রয়েছে। তবে এ বিতর্কের পাল্লা কোন দিকে ভারী সে বিষয়টি রাজনৈতিক বোদ্ধা অনেকের কাছে অস্পষ্ট নয়। ’৯০-এর গণ-আন্দোলনের আগে চারটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ চারটি নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনেই দলীয় সরকার সমর্থিত দল ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ লাভ করে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওই সরকারের সমর্থিত দলের বিজয় এ দেশের জনগণের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম  দেয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অর্থ ক্ষমতাসীনদের বিজয় এবং বিরোধীদের পরাজয়। এ ধারণা থেকেই এ দেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তির পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ওঠে এবং এর ফলে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এ তিনটি নির্বাচনে অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ঘটে এবং বিরোধী দল বিজয় লাভ করে।  বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অভিনব ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা এবং এ কারণে এ দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে তা বলা কঠিন। নবম সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও এ নির্বাচনে অত্যধিক ভোটার উপস্থিতি আমাদের দেশের অতীতের নির্বাচনগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এ বিষয়ে সে সময়কার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।  দশম সংসদ নির্বাচন প্রকৃত অর্থেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার এতই নগণ্য ছিল যে, এটিকে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে কোনোভাবেই নির্বাচন বলার অবকাশ নেই। তা ছাড়া এ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন, যা সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটে। সে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতায় বারবার গণতন্ত্র অবদমিত হয়েছে। আমাদের দেশে রাজনীতিতে ’৯০ সালের পরবর্তীকালে যে দু’টি দল প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এদের অভ্যন্তরে যেমন গণতন্ত্র নেই, ঠিক তেমন এ দু’টি দলের কোনোটিই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে একনিষ্ঠ হতে পারেনি। এ কারণে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বলা যায় এক ধরনের অনিশ্চিত। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ কথাটি বিশ্বাস করার মতো সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হওয়ার প্রতিবন্ধকতা যতক্ষণ পর্যন্ত অপসারিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বড় দু’টি দলের কোনোটিরই পরিণাম ভালো নয়। 
ইকতেদার আহমেদ

রবিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সালতামামি ২০১৪ : কেউ ভালো নেই!


ভালো নেই দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্ব। ২০১৪ সালকে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সালতামামির মতো করে বললে এ কথাই বলতে হয় যে, ভালো নেই। 
ফিলিস্তিনী অধ্যুষিত গাজায় ইসরাইল নতুন করে বিমান হামলা শুরু করেছে। ফিলিস্তিনী যোদ্ধা সংগঠন ‘হামাসের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে’ এ হামলা চালানো হচ্ছে। ইসরাইলে হামাসের একটি রকেট হামলার জবাব দিতেই পাল্টা-হামলা চালানো হচ্ছে বলে দাবি ইসরাইলের। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। আজ হামাসের একটি সাইট লক্ষ্য করে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে ইসরাইলী বাহিনী। গাজার খান ইউনিস এলাকার বাসিন্দারা জানান, তারা দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। এ হামলায় হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। গত আগস্ট মাসে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর এটা প্রথম হামলার ঘটনা। ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার লার্নার দাবি করেন, গতকাল ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় এশকোল এলাকায় হামাসের একটি রকেট হামলার জবাবে পাল্টা-হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ওই রকেট হামলায় কোন ইসরাইলী হতাহত হননি বা কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। গত আগস্টে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইসরাইলী আগ্রাসনে ২ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে মাত্র ৭০ ইসরাইলী বাদে বাকি সবাই ফিলিস্তিনী বেসামরিক নাগরিক এবং তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। কেন এমন শিরোনাম সে ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। দক্ষিণ এশিয়া ভালো নেই মানে এ অঞ্চলের দেশগুলো ভালো নেই। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্তে কি হচ্ছে, সেটা তো রক্তাক্ত অক্ষরেই লিপিবদ্ধ হয়েছে কয়েক দিন আগে। স্কুল পর্যন্ত নিরাপদে নেই সেখানে। জঙ্গিবাদ সেখানকার প্রধান ইস্যু। ভারতেও প্রবলভাবে সাম্প্রদায়িক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে থেমে থেমে উত্তেজনা বিরাজ করছে। নেপালে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে সঙ্কট চলছে। রোডম্যাপ ঘোষিত হলেও সময়সূচি মতো সংবিধান হচ্ছে না। কারণ চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে শীর্ষ নেতা পুষ্প কুমার ডাহাল ওরফে প্রচন্ড এবং দ্বিতীয় নেতা ড. বাবু রাম ভট্টরায়ের মধ্যে চলছে ভয়ানক দ্বন্দ্ব। দলের পলিট বুর‌্যো একাধিক বার মিলিত হয়েছে দ্বন্দ্ব নিরসনে। অন্যদিকে, মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও অন্তঃদ্বন্দ্বে জর্জরিত। নেপাল কংগ্রেসে চলছে রক্ষণশীল বনাম উদারপন্থীদের লড়াই। ফলে থেকে থেকে হিন্দু ধর্মাশ্রিত নেপালে থেমে থেমে রাজতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান উঠছে। যদি সাংবিধানিকভাবে ডান, বাম, ধর্মীয় এবং নরম ও চরমপন্থীদের মধ্যে ঐক্য সাধন করা না যায়, তবে নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ পুনরায় সংঘাত ও সঙ্কটের দিকেই চলে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে চরমভাবে বিভাজিত। মহেন্দ্র রানাপাক্সের বিরুদ্ধে সবাই একাট্টা। পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট কুমারী চন্দ্রিকা। শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির দুই নেতার দ্বন্দ্বে জন্ম নিয়েছে সম্মিলিতি বিরোধী দল। চীন আর ভারত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাক দর্শক নয়। দেশীয় আর আঞ্চলিক খেলা জমছে লঙ্কার নির্বাচনকে ঘিরে। ক্ষমতাসীন মহেন্দ্র কোনো অবস্থাতেই মসনদ ছাড়তে নারাজ। অন্যদিকে বিরোধীরাও একাট্টা। অতএব আসছে বছরের জানুয়ারির ৮ তারিখের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারত মহাসাগরের মুক্তোর টিপ নামে খ্যাত দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা নাজুক অবস্থার মুখোমুখি। সেখানে বিরাজ করছে চরম ভীতি আর সংঘাত-রক্তপাতের আশঙ্কা। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভূটানেও শরণার্থী প্রশ্নে সঙ্কট চলছে। সেখানকার নেপালি ভাষী জনগোষ্ঠীকে সিকিম আর নেপালে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। আরেক বড় শরণার্থী সমস্যা হলো তিব্বতীদের ক্ষেত্রে। পঞ্চাশের দশক থেকেই লক্ষ লক্ষ তিব্বতী দালাইলামাকে অনুসরণ করে লাসা ছেড়ে ভারত বা নেপালে বসবাস করছে। আমাদের সঙ্গে এমন অনেকেরই কথা ও পরিচয় হলো, যারা তিন পুরুষ ধরে রিফিউজি। দাদা, বাপ আর এখন নিজেও রিফিউজি ক্যাম্পে বড় হলেও তিব্বতীরা শিক্ষিত, ইংরেজি-জানা এবং আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়ছেন। অনেকেই কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছেন। তাদের একটাই বেদনা, পরিচিতির সঙ্কট আর নাগরিকত্বহীনতা। যেসব দেশে তারা থাকছে, সেখানে শরণার্থী হয়েই থাকছে। নাগরিকত্ব পাচ্ছে না। দক্ষিন এশিয়ার আরো দুটি বড় শরণার্থী গ্রুপ হলো বিহারি আর রোহিঙ্গাগণ। বিহারিরা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়েছেন। যেমন রোহিঙ্গারাও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার জন্য বিহারি ও রোহিঙ্গারা নিজেদেরকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারছে না। নিজের দেশের মতোই আশ্রয় গ্রহণকারী দেশেও তারা সম্মান অর্জন করতে পারছে না। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আপাত শান্তি ও স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে মসৃণভাবে এগুতে পারছে না। নির্বাচনী বৈধতার সঙ্কট রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান দলগুলোর মধ্যে  বিরাজ করছে তীব্র অনৈক্য ও দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন শেষে বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬ জানুয়ারি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফে যে অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছিল তার কোন হেরফের হয়নি। ফলে দেশের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক চেহারা সম্পর্কে যে মনোভাব রয়েছে, সেটার বিশেষ হেরফের হয় নি। বাংলাদেশকে গ্রহণযোগ্য, অংশমূলক, তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসার তাগিদ এখনো প্রায়ই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে উচ্চারিত হয়। অতএব দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই সমস্যার বাইরে নেই। হয়তো সমস্যার ধরন ও প্রকৃতি ভিন্ন। কিংবা সমস্যাগুলো কোথাও প্রকাশ্য বা কোথাও সুপ্ত। তথাপি একথা বলতেই হয় যে, হিমালয় থেকে সমুদ্রব্যাপী বিস্তারিত বিশাল ভূ-ভাগ আর বিপুল মানুষের বসতি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সামনে অপেক্ষা করছে অনেক অজানা বিপদ আর সমস্যা। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ আর বিপদ মোকাবিলার জন্য সাধারণ মানুষের আগে ঐক্যবদ্ধ ও  প্রস্তুত হতে হয় নেতৃবৃন্দকে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিগত ও দলীয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বৈরতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, অস্বচ্ছতা, জবাবদিহিহীনতা ইত্যাদিতে এতটাই আক্রান্ত যে, ভবিষ্যতের বিপদ দেখার চেয়ে বর্তমান লুটপাটই তাদের কাছে প্রধান বিষয়। লোভ ও লাভে অন্ধ নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ বিপদ উত্তরণে কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবে? এটাই এখন সবার প্রশ্ন।
সরকারের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় দেশের কৃষিখাত আজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, সরকার ভরা আমন মওসুমে ভারত থেকে লাখ লাখ টন শুল্কমুক্ত চাল আমদানি করছে। সরকারি দলের লোকজনের লুটপাটের জন্য এ চাল আমদানি করা হচ্ছে। অথচ দেশের কৃষকরা নিজ উদ্যোগে তাদের কষ্টার্জিত অর্থের মাধ্যমে এ বছর আমনের বাম্পার ফলন ফলিয়েছে। এ চাল কৃষকরা বিক্রি করতে না পেরে লোকসানের শিকার হচ্ছেন। আজ সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তবে দলগুলোও সমালোচনার বাইরে নেই। বাংলাদেশে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মকা- আধুনিক ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে দল দুটির রাজনৈতিক আচরণ এ পর্যন্ত অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘শাসন পরিস্থিতি, বাংলাদেশ ২০১৩: গণতন্ত্র, দল, রাজনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিকাশ কেন পিছিয়ে আছে, তা বের করাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জরিপ, সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণায় পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণগুলো করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশে একচ্ছত্র দলতন্ত্রের বিকাশ এবং এর ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে এখন ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের অবস্থা রমরমা। ব্যবসায়ীদের আনা হচ্ছে, কারণ তারা দলের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারেন।
রাজনৈতিক অগ্রগতির বাধা একচ্ছত্র দলতন্ত্র : গবেষণায় দেশের রাজনৈতিক পরস্থিতির একটি উদ্বেগজনক বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র থেকে একচ্ছত্র দলতন্ত্রের বিকাশ। রাষ্ট্রগঠন, গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ও আইনের শাসন রাজনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় এই তিন সূচকের নাজুক অবস্থা থেকেই দলতন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কার। সরকার ও বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রকট। বড় দলগুলো সফলভাবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের দখলে নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তারা ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ করিয়ে নিতে পারছে। সুশীল সমাজ, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, পুলিশ বাহিনী এবং জেলা পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়েছে দলতন্ত্রের প্রভাব।
সুশীল সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়ে পড়ায় রাজনীতিতে বহুমতের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এতে করে দলগুলোর কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাও বেড়েছে। এ পরস্থিতির প্রভাব পড়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের ওপরও। এই একচ্ছত্র দলতন্ত্রের ভয়ানক প্রভাব পড়েছে দেশের সুশীল সমাজের ওপর। একসময়ের সেই সরব সুশীল সমাজ এখন মিইয়ে গেছে। দেশের আথর্ সামাজিক উন্নয়নে যাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তারা এখন অকেজো, বিশেষ করে গত কয়েক বছরের চিত্র এটাই।
রাজনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা দলীয় কর্মকান্ড : প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং তার চর্চার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এর থেকে বোঝা যায়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি তাদের অঙ্গীকার খুবই দুর্বল। আদর্শের ক্ষেত্রে দলের ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি জোরদার করতে পারেনি। আর চর্চার ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয়টি কেন্দ্র থেকে ভালোভাবে নেয়া হয় না।
বেড়েছে হানাহানি : ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। হানাহানিতে সব সময় এগিয়ে আছে ক্ষমতাসীন দল, সেটা প্রধান দুই দলের যে যখন ক্ষমতায় থাকে। আর এ ধরনের হানাহানির বেশির ভাগ ঘটে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে। রাজনৈতিক এই সংঘাতের কারণ আদর্শগত সমন্বয়ের অভাব। এসব হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সুপারিশে বলা হয়, দলের শীর্ষ নেতাদের এমন পরিবেশ  তৈরি করতে হবে, যাতে করে দলের মধ্যকার সব মতের নেতা-কর্মীরা তাদের পাশে আসতে পারেন। মুক্তচিন্তা ও বিতর্কের সুযোগ পান। একই সঙ্গে দলের মধ্যে যারা মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো লঙ্ঘন করবেন, তাদের জবাবাদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে।
পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ : বর্তমানে রাজনীতিতে ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের অবস্থা রমরমা। দলীয় সদস্যদের পরিচয় পর্যালোচনা, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব, বাজেট বক্তৃতায় অংশগ্রহণ, সংসদীয় কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতিকের ব্যক্তিগত  বৈশিষ্ট্য এখন আর সার্বিক রাজনৈতিক বিকাশে কাজে লাগছে না। এমনিক দলের কোন নেতা সংসদে সরব হবেন, তাও ঠিক করে দিচ্ছে দলগুলো। এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে, সেসব ব্যবসায়ী ও নেতারাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন, সংসদে যাদের উপস্থিতি কম।
স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলো সেসব লোকজনকেই দলে ভেড়াচ্ছে উদ্দেশ্য সাধনে, যাদের কাজে লাগানো যাবে। পরামর্শে বলা হয়, দলীয় নেতৃত্বের জন্য রাজনীতিবিদের সার্বিক জীবনচরিত পর্যালোচনা করা জরুরি। তাহলে ‘নেতা কে হবে’ আর তাদের ‘আচরণ হবে কেমন’ এসব বিষয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করানো যাবে। আর কেবল তখনই দলীয় নেতা এবং তাদের চরিত্রের মধ্যে একটি মেলবন্ধন খুঁজে বের করা যাবে।
নারীর অংশগ্রহণ হতাশাজনক : প্রধান দুই দলে নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ খুবই হতাশাজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা শুধু ব্যবহৃত হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী হিসেবে। আর দলের নীতিনির্ধারণী শীর্ষ পর্যায়ে কর্তৃত্ব করছেন পুরুষেরা। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির কারণে যে এমনটা ঘটছে, তা নয়। বরং রাজনৈতিক দলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করছে।
অর্থায়নে স্বচ্ছতা প্রয়োজন : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলগুলো আগের চেয়ে এখন আরও বেশি হারে ব্যবসায়ীদের নিয়ে আসছে। কারণ, দলের প্রত্যাশা থাকে, ব্যবসায়ীরা দলের জন্য অর্থের সংস্থান করবেন।
প্রধান দলগুলো দাবি করে, দলের সদস্য ফি-ই জেলা পর্যায়ে অর্থসংস্থানের প্রধান পথ। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দলগুলো তাদের ব্যয় নির্বাহের জন্য মূলত বেসরকারি খাতের অনুদানের ওপরই নিভর্রশীল।
প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ : সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনার পর প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, দেশের গণতন্ত্র বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ। তা না হলে গণতান্ত্রিক অর্জন পশ্চাদমুখী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
যদি মোদ্দা কথায় ২০১৪ সালের সালতামামি করি, তাহলে বলতেই হবে, ‘ভালো নেই’।
কনক জ্যোতি

শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রসঙ্গ : পুলিশের লাঠিচার্জ


গণতান্ত্রিক দেশে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন, মিছিল, অনশন বা ঘেরাও কর্মসূচির মতো তৎপরতা কেউ চালাতেই পারেন। এসব আইনানুগভাবে নিষিদ্ধও নয়। কিন্তু আমাদের পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য অতিউৎসাহী হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ, জলকামান, টিয়ারশেল, পিপারশেল প্রভৃতি নিক্ষেপ করে মারাত্মকভাবে জখম করছে। এমনকি নারী আন্দোলনকারীদেরও রেহাই দিচ্ছে না পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য। এদের তৎপরতা দেখে মনে হয় এদেশের নাগরিকরা এখনও ঔপনিবেশিক যুগের বাসিন্দা। তাদের কোনও দাবিদাওয়া থাকতে পারে না। আন্দোলন-সংগ্রাম করবার অধিকারও তাদের যেন এখন নেই।
সম্প্রতি ডেন্টাল ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে পুলিশ। তারা তাদের চারদফা দাবিতে কর্মসূচি দিয়ে ঘেরাও করতে চেয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু পুলিশ তাদের বাধা দেয়। হ্যাঁ, পুলিশ মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিতে বাধা অবশ্যই দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে ছাত্রদের ওপর জলকামান, টিয়ারশেল নিক্ষেপের মতো নিষ্ঠুর আচরণ করতে হবে কেন? লাঠিপেটা করবার মতো নির্মমতা চালাতেই বা হবে কি জন্য? পুলিশ অথবা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যারা কাজ করছেন, তারা কি এদেশের মানুষের সন্তান না? তাদের ছেলেমেয়েরা কি ডেন্টালে কিংবা নার্সিং-এ পড়ে না। কিছুদিন আগে নার্সিংয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ওপরও চড়াও হয় পুলিশ। এমনকি একজন নার্সিং ছাত্রীর পশ্চাদদেশে বেদম প্রহার করতে থাকে জনৈক পুলিশ, যা অশ্লীলতাকেও হার মানায়। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। ঔপনিবেশিক আমলে ঠিক এভাবেই এদেশের নাগরিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হতো। মানুষের কথা বলবার কোনও অধিকার ছিল না তখন। যখন-তখন চলতো নাগরিকদের ওপর জুুলুম-নির্যাতন। সামান্য কারণে তাদের জেলে পুরে পচানোর ব্যবস্থা করা হতো। এমনকি অনেক মানুষকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যাও করেছে ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ। কালাপানিতে নির্বাসন দেয়ার কথা তো অনেকেরই জানা। অবস্থা দেখে মনে হয় এদেশের এখনকার পুলিশও সেই আমলের মতো হিংস্র ও নিষ্ঠুর। তবে পুলিশ বাহিনী কিংবা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের চাকরি করতে হবে। তারা জনগণের প্রভু নয়, সেবক। বরং জনগণের ট্যাক্সের অর্থে তাদের বেতন দেয়া হয়। সেবক হয়ে প্রভুকে বেধড়ক পেটানোর কোনও আইনানুগ নিয়ম বা প্রথা কোনও সংস্থার নেই বলে আমরা জানি। বুঝলাম, তারা সরকারি হুকুম তামিল করেছে। এটা হয়তো তাদের করতেই হবে। তাই বলে কর্মসূচি বানচাল বা আন্দোলনের কর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করবার অধিকার কারুর থাকতে পারে না। থাকা যৌক্তিকও নয়। অথচ আমাদের পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য আন্দোলন দমাতে গিয়ে নাগরিকদের ওপর অন্যায় আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আরেকটি কথা মনে রাখা দরকার। সেটি হচ্ছে সরকার স্থায়ীভাবে থাকবে না। পরিবর্তন হবে সরকারের। কিন্তু তাদের চাকরি ছেড়ে চলে যাবার নিয়ম নেই। তখন তারা কী করবেন? শুধু রাজনৈতিক নেতাদেরই গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে- এমন নয়, পুলিশ, বিজিবি, বিশেষ বাহিনী সবাইকে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে যত্নবান হতে হবে। ক্ষমতাসীনদের এর ব্যত্যয় ঘটানো ঠিক নয়।
ব্যত্যয় ঘটালে বিপর্যয় ত্বরান্বিত হয়। এমনকি পতনও। তবে বর্তমানে যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেষ্টা করছেন, তাদের কথা ভিন্ন। নির্বাচনের নামে প্রহসন করে যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সচেষ্ট, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মানুষের মর্যাদা এসব তাদের কাছে নীতিকথা মাত্র। তারা চান- ‘যেনতেন প্রকারণ’ ক্ষমতায় টিকে থাকতে। এসব নীতিনৈতিকতা নিয়ে ভাববার সময় তাদের কোথায়?

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রে রাজনীতির ভাষা


মারমুখী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে অতুলনীয় সে কথা সম্ভবত বলার অপেক্ষা রাখে না। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই যথারীতি নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। প্রতিপক্ষকে ধোয়ামোছা করার ব্যাপারে তিনি যে আসলেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রীর গত কয়েকদিনের বক্তৃতায়। যেমন গত ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে একদলীয় অনুষ্ঠানে আবারও ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে এক হাত নিয়ে ছেড়েছেন তিনি। এবারের উপলক্ষ ছিল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য। ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত বলে মন্তব্যগুলো নিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার পড়ে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ছাড় দেননি একচুল পরিমাণও। বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনার ‘কুপুত্র’কে জিভ সামাল দিয়ে কথা বলতে বলবেন। তিনি নন, ‘সে’ যেভাবে ইতিহাস বিকৃত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বাংলার মানুষ তা সহ্য করবে না। তার অর্থাৎ তারেক রহমানের হাতে নাকি আইভি রহমানসহ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নিহত ২৪ জন নেতা-কর্মীর অনেক রক্ত- কথাটা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেভাবে হচ্ছে ঠিক সেভাবেই গ্রেনেড হামলারও বিচার হবে। ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’- স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতারের এই স্লোগান স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইয়াহিয়া খান ছিল একটা জানোয়ার। তার (তারেক রহমানের) কথায়ও ইয়াহিয়ার সুর শুনতে পাচ্ছেন জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ছেলেদের কি শিক্ষা দিলেন? রাষ্ট্রের টাকায় পুত্রদের মানুষ না বানিয়ে ‘বড় চোর’ বানিয়েছেন। তার (তারেক রহমানের) নাম নিতেও নাকি প্রধানমন্ত্রীর ঘৃণা লাগে জানিয়ে তিনি বলেছেন, লেখাপড়া শিখলে সে মানুষের মতো কথা বলতো। ইতিহাস বিকৃত করতো না। সতর্কও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, জানোয়ারকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা দেশের মানুষ জানে। শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, বিএনপির নেত্রী নাকি টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না এবং এতিমদের অর্থ চুরি করেছেন বলেই কোর্টে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, এত সাধু হলে কোর্টে যেতে ভয় পান কেন? ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ওদিকে প্রধানমন্ত্রী বলতে না বলতেই পাল্লা দিয়ে ময়দানে হাজির হয়েছেন তার অধীনস্থজনেরাও। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের সকলেই বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছেন। সবার মুখেই দেখে নেয়ার হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। ধমক দিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে এবং ক্ষমা চাইতে তো বলেছেনই, সৌজন্যের সীমানা ছাড়িয়ে একজন মন্ত্রী একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, সম্মানের সঙ্গে তারা বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করতেও রাজি নন। ওই মন্ত্রী বিএনপির নেত্রীকে ‘মহিলা’ বলে সম্বোধন করেছেন। হুংকার দিয়ে তারা জানিয়ে রেখেছেন, বেগম জিয়া যেন আন্দোলনের চেষ্টা করে দেখেন। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটকে আন্দোলন করতে দেয়া দূরে থাকুক, রাজপথেও দাঁড়াতে দেবেন না তারা। রাজপথ তাদের দখলেই থাকবে। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তারা বলেছেন, কার কত শক্তি তা রাজপথেই দেখে নেয়া হবে।
অন্যদিকে যথেষ্ট কষে জবাব দিলেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু গণতন্ত্রসম্মত সৌজন্যের বাইরে যাননি। পরদিন, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০-এর ছাত্র নেতাদের কনভেনশনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনি আগে আপনার নিজের জিহ্বাকে সামলান। নিজের মুখ সংযত করুন। ভাষা সুন্দর করুন। যেখানে বসে আছেন (প্রধানমন্ত্রীর আসন) সেখানে বসে এসব কথাবার্তা শোভা পায় না। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী বা তার অধীনস্থজনেরা নন, সংযম এবং ভদ্রতার জন্য জনগণের সমর্থন পেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। চোর ও কুপুত্র ধরনের শব্দযোগে বক্তব্য রাখার কারণে প্রধানমন্ত্রী বরং নিন্দিত হয়েছেন। অন্য কিছু বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী যেখানে ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ বলে কোর্টে না যাওয়ার কারণে উপহাস করেছেন জনগণের মধ্যে সেখানে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তাড়াহুড়ো উল্টো প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কারণ, বিচারক বদল এবং সময় চেয়ে করা বেগম জিয়ার প্রতিটি আপিলই খারিজ করা হয়েছে। বিচারিক আদালতও স্থাপিত হয়েছে সিএমএম কোর্ট এলাকার বাইরে পৃথক একটি স্থানে, যেখানে বিএনপি নেত্রীর জন্য নিরাপত্তার প্রচন্ড ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া বেগম জিয়া যেদিনই হাজির হতে গেছেন সেদিনই আদালত ভবনের লিফ্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ সবাই জানে, পায়ের অসুবিধার কারণে বেগম জিয়ার পক্ষে হেঁটে চারতলায় ওঠা সম্ভব নয়। ফলে বুঝতে অসুধিা হয়নি, সরকার চায় না, তিনি হাজির হোন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে অভিযোগের জবাব দিন। এ বিষয়টিকেই প্রধানমন্ত্রী উপহাস এবং আক্রমণের অজুহাত বানিয়েছেন।
বর্তমান পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ কেন এতটা মারমুখী হয়ে উঠেছেন তার কারণ জানতে হলে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা দরকার। আসল কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে নিজেদের বৈধতার সংকট এরই মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। এজন্যই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে এবং সম্ভব হলে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ঘটিয়ে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছেন তারা। এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে বিশেষ করে মামলা দায়েরের এবং বিচার কাজ শেষ করার কার্যক্রম থেকে। সরকার মামলার পর মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রাখার এবং দন্ড দেয়ার অপকৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সরকারের আসল লক্ষ্য, যে কোনোভাবে তাদের সাজা দেয়া বা দন্ডিত করা, যাতে তারা পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হন। এই অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিগত কয়েকদিনে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে অন্তত ২৯টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। এসবের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তড়িঘড়ি এমনকি সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার অতি দ্রুত বিচার কাজ শেষ করতে চায়। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মামলার রায়ও সরকার সম্ভবত ঠিক করে রেখেছে। সে রায়ে বেগম খালেদা জিয়াকে কোনো না কোনো ধরনের দন্ড দেয়া হবে, যাতে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন। একইভাবে তার বড় ছেলে এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও সরকার অন্তত ২২টি মামলা ঠুকে রেখেছে। লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানকে মামলায় হাজির হওয়ার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করিয়েছে সরকার। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, হাজির হোন আর নাই হোন, তারেক রহমানকেও দন্ডিত করা হবে এবং তিনিও পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, বিএনপির অন্য সকল শীর্ষ নেতাকেও মামলায় জড়িয়ে ধাওয়ার মুখে রেখেছে সরকার। ৪১ জন বিশিষ্ট নেতার বিচারও শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বলা হচ্ছে, সরকারের উদ্দেশ্য এসব নেতাকে দন্ডিত করা, যাতে তাদের পক্ষে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব না হয়।
দৃশ্যত গণহারে মনে হলেও বাস্তবে বেছে বেছে এমন সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলার পর মামলা দায়ের করা হচ্ছে, যারা ভবিষ্যতের নির্বাচনে অংশ নিতে এবং বিরাট ব্যবধানে জিততে পারেন। এটা যাতে ঘটতে না পারে এবং আওয়ামী লীগের জন্য যাতে নতুন পর্যায়েও ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হয় সেজন্যই সরকার মামলা দায়ের এবং কোনোভাবে দন্ড দেয়ার পন্থাকে আশ্রয় করেছে। একযোগে চালানো হচ্ছে গ্রেফতারের অভিযানও। এসব অভিযানের শিকার হচ্ছেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা আছে। ওদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। মামলাগুলোতে আসামী করা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে। লক্ষণীয় যে, জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা কোনোরকম রাখঢাক পর্যন্ত করছেন না। ২০০৯ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর পর যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢুকিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ জামায়াতের অন্য শীর্ষ নেতারা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছেন। ১৯৭১ সালের পর জন্ম নেয়া বা কম বয়সের কারণে জামায়াতের যেসব নেতাকে যুদ্ধাপরাধী বানানো সম্ভব হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা কতটা মারমুখী ও মরীয়া তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা থেকে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত দুইশ মামলা দায়ের করেছেন ক্ষমতাসীনরা। বর্তমান সময়ে মামলা দায়েরের পাশাপাশি চার্জশিট দেয়ার এবং কোনোভাবে রায় আদায় করার ব্যাপারেই বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে নতুন পর্যায়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করতে না করতেই ক্ষমতাসীনরা পুলিশের ওপর হুকুম জারি করে বসেছেন। সে অনুযায়ী পুলিশও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছে। এভাবে সব মিলিয়েই সরকার এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। উদ্দেশ্য একটাই- বিরোধী দল যাতে আন্দোলন করতে না পারে। যাতে পরবর্তী নির্বাচন থেকে তাদের বাইরে রাখা যায়।
দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেবল নয়, বিদেশেও- এমনকি সরকারি পর্যায়েও সরকারের এই নীতি ও কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও প্রকাশিত হতে বাকি থাকছে না। ক্ষমতাসীনরা কথায় কথায় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে থাকেন তারাও সরকার সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণরূপে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এখনো কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই চাচ্ছেন না, মামলা এবং দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই প্রতিহত করা যায় না। অন্যদিকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে উচিত যেখানে আলোচনা ও সমঝোতার পথে পা বাড়ানো এবং বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া ক্ষমতাসীনরা সেখানে আরো একবার প্রধান দলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৌশল নিয়েছেন। একটি সত্য তারা বুঝতেই পারছেন না। সে সত্যটি হলো, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলোকে সাময়িককালের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া গেলেও জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ঘটবে তার ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য অশুভ হয়ে উঠতে বাধ্য। ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন যে বারবার অনুষ্ঠান করা যাবে না এবং কোনোভাবে করা গেলেও তেমন নির্বাচন যে ক্ষমতাসীনদের বৈধতা এবং অস্তিত্বকেই উল্টো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে সে কথাটাও তারা সময় থাকতে অনুধাবন করতে পারছেন না। ক্ষমতাসীনরা বরং এগিয়ে চলেছেন উল্টোপথে। তারা বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে নতুন একটি নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগোতে শুরু করেছেন। তাদের ধারণা, কোনোভাবে ৫ জানুয়ারির তুলনায় কিছুটা ভালো নির্বাচন করা গেলেই নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা কিন্তু মনেই করেন না যে, এভাবে যেনতেন ধরনের কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে একদলীয় বাকশাল শাসনের কথা। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথই ধরেছেন। ৫ জানুয়ারির মিশন ব্যর্থ হলেও নতুন পর্যায়ে আবারও কোনোভাবে একটি সংসদ নির্বাচন করতে পারলেই প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটাবেন প্রধানমন্ত্রী। এমন অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। উদ্বেগের কারণ হলো, বাকশাল অর্থ এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার অধীনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দল থাকতে পারবে না। ভিন্নমতাবলম্বী কোনো রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী মাত্র সাড়ে তিন বছরে শুধু রক্ষীবাহিনীই বিরোধী দলের ৩৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছিল। এর বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও লাল বাহিনীসহ আওয়ামী শিবিরের হাতেও অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল। এসব হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূল করা এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে সেকালের মুজিব সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতনে বিরোধী দলের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সামনে কোনো প্রতিপক্ষই তখন ছিল না। তেমন এক পরিস্থিতিতেই, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সব দল নিষিদ্ধ করে সর্বময় ক্ষমতা নিয়েছিলেন নিজের হাতে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে। সে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই তিনি একের পর এক ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন, জাতিকে নতুন চেহারার বাকশাল দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় ভিন্নমতও কিন্তু রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। কারণ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে দেশে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং শেখ হাসিনার পক্ষে পিতার মতো একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা উল্টো কুফলেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়া বলে রেখেছেন, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রী এই কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন কি না। তেমন লক্ষণ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কারণ সর্বশেষ উপলক্ষেও তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশাই করেছেন। যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন তাকে আর যা-ই হোক, অন্তত ভদ্র এবং গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না।
আহমদ আশিকুল হামিদ

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নেতাদের অনেককে নির্বাচনের বাইরে রাখার পরিকল্পনা


সরকার মামলার পর মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রাখার এবং সাজা বা দন্ড দেয়ার অপকৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে নতুন পর্যায়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সরকারের আসল লক্ষ্য যে কোনোভাবে তাদের সাজা দেয়া বা দন্ডিত করা, যাতে তারা পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হন। এই অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিগত কয়েকদিনে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশেষ করে বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে অন্তত ২৯টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। এসবের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তড়িঘড়ি এমনকি সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করেছে। বিচারক বদল এবং সময় চেয়ে করা বেগম জিয়ার প্রতিটি আপিলই খারিজ করা হয়েছে। বিচারিক আদালতও স্থাপিত হয়েছে সিএমএম কোর্ট এলাকার বাইরে পৃথক একটি স্থানে, যেখানে বিএনপি নেত্রীর জন্য নিরাপত্তার প্রচন্ড ঝুঁকি রয়েছে। সব মিলিয়েই বোঝা যাচ্ছে, সরকার অতি দ্রুত বিচার কাজ শেষ করতে চায়। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মামলার রায়ও সরকার সম্ভবত ঠিক করে রেখেছে। সে রায়ে বেগম খালেদা জিয়াকে কোনো না কোনো ধরনের দন্ড দেয়া হবে, যাতে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন। একইভাবে তার বড় ছেলে এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও সরকার অন্তত ২২টি মামলা ঠুকে রেখেছে। লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানকে মামলায় হাজির হওয়ার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করিয়েছে সরকার। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, হাজির হোন আর নাই হোন, তারেক রহমানকেও দন্ডিত করা হবে এবং তিনিও পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, বেগম জিয়ার অপর ছেলে আরাফাত রহমানকে একটি মামলায় ইতিমধ্যেই ছয় বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, তারেক রহমানের স্ত্রী ডাক্তার জোবাইদা রহমানকেও সরকার মামলায় জড়িয়েছে। অথচ তিনি কখনো দল বা রাজনীতি করেননি। বিএনপির অন্য সকল শীর্ষ নেতাকেও মামলায় জড়িয়ে ধাওয়ার মুখে রেখেছে সরকার। মওদুদ আহমেদ ও মির্জা আব্বাসসহ ৪১ জন বিশিষ্ট নেতার বিচারও শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বলা হচ্ছে, সরকারের উদ্দেশ্য এসব নেতাকে দন্ডিত করা, যাতে তাদের পক্ষে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব না হয়। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে যে দন্ডিত করা হবেই- এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কোনো সন্দেহ নেই। ওদিকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় ২৬ হাজার মামলায় পাঁচ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়েছে। জামায়াতের ঢাকা মহানগরী আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের একার বিরুদ্ধেই দেশের বিভিন্ন থানায় রয়েছে দুইশ’র বেশি মামলা। এখানেও সরকারের উদ্দেশ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। সরকার জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরকেও দন্ড দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে চায়, যাতে সম্ভাব্য নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন না হতে হয়। তাছাড়া বিরোধী দল যাতে আন্দোলন করতে না পারে। 
আমরা সাজানো মামলা ও দন্ডের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে চলমান কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এই মামলাবাজি বন্ধ করা। সরকারকে বুঝতে হবে, মিথ্যা মামলার ভিত্তিতে দন্ড বা সাজা দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলকে নির্মূল করা যায় না। দলগুলোকে সাময়িককালের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া গেলেও জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ঘটবে তার ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য অশুভ হয়ে উঠতে বাধ্য। ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন যে বারবার অনুষ্ঠান করা যাবে না এবং কোনোভাবে করা গেলেও তেমন নির্বাচন যে ক্ষমতাসীনদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে সে কথাটাও সময় থাকতে অনুধাবন করা দরকার। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এগিয়েছেন  উল্টো পথে। তারা বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে নতুন একটি নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগোতে শুরু করেছেন। তাদের ধারণা, কোনোভাবে ৫ জানুয়ারির তুলনায় কিছুটা ভালো নির্বাচন করা গেলেই নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না। অন্যদিকে আমরা কিন্তু মনেই করি না যে, এভাবে যেনতেন ধরনের কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। এজন্যই সরকারের উচিত মিথ্যা মামলায় দন্ড দেয়ার মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার চিন্তা ছেড়ে গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতার পথে পা বাড়ানো। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কেও ২০ দলীয় জোটের দাবি মেনে নিতে হবে। তাহলেই সংকট যেমন সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে, তেমনি সরকারকেও আর ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে হবে না। 

মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

চবিতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গুলীতে আরো একটি হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। গত রোববার শাহ আমানত হলের সামনে নিষ্ঠুর এই হত্যাকান্ডের শিকারও হয়েছে ছাত্রলীগেরই কর্মী এবং সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার। তার বুকে একাধিক বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। বুলেটগুলো বিদেশী নাইন এমএম পিস্তলের বলে পুলিশ জানিয়েছে। যার গুলীতে তাপস মারা গেছে। সেই ঘাতক আশরাফুজ্জামান পাশা একজন পরিচিত আওয়ামী ক্যাডার। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান শত কোটি টাকার ঠিকাদারী ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং হল দখল ও নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রলীগ আগে থেকেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে রয়েছে। দুটি প্রধান গ্রুপের একটি চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিমের কথায়, অন্য গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী। খুবই কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য হলো, বিবদমান গ্রুপ দুটির মধ্যে অতি সম্প্রতি নাকি এই মর্মে সমঝোতা হয়েছিল যে, তাদের কেউ অন্য গ্রুপের কাউকে আক্রমণ করবে না। সে সমঝোতার ভিত্তিতেই উভয় গ্রুপের নেতা-কর্মীরা সেদিন বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল। তারও আগে তারা ফুল হাতে পাশাপাশি হেঁটেছেও। কিন্তু তারপরই হঠাৎ শুরু হয়েছে সংঘর্ষ। নিজেদের মধ্যে হলেও প্রথম থেকেই গুলী ছুঁড়েছে উভয় পক্ষ। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। ওদিকে তাপস সরকারকে নাকি রীতিমতো টার্গেট করে গুলী করেছে আওয়ামী ক্যাডার পাশা। নিহত তাপস মহিউদ্দিন চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত সিএফসি গ্রুপের সদস্য ছিল। অন্যদিকে ক্যাডার পাশা শুধু ভিসি নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের সদস্য নয়, ব্যক্তিগতভাবেও ভিসির খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। ভিসির সঙ্গে ওঠানো তার ছবিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এ সংক্রান্ত সব খবরেও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে বলেই জানা গেছে। 
আমরা এ হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানাই এবং মনে করি, প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রের এমন করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রতিবাদ ও উদ্বেগের এটাই একমাত্র কারণ নয়। প্রধান কারণ হলো, সারাদেশের শিক্ষাঙ্গণগুলোতে তো বটেই বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুদিন ধরেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকা- চলছে। চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য এবং হল দখল ও সিট নিয়ে ব্যবসা থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মৗ ও ক্যাডাররা জড়িত থাকে না। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধেও ছাত্রলীগ সব সময় লেগে থাকে। সুযোগ ও উপলক্ষ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে কারণে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে মাঝে-মধ্যেই ছাত্রলীগের সংঘাত বাঁধে। প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়ী থাকে ছাত্রলীগ। কিন্তু ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকায় সব দোষ চাপানো হয় প্রতিপক্ষের ওপর। জোর প্রচারণা চালিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই প্রশ্রয় যে হিতে বিপরীত হয়ে উঠেছে এবং সন্ত্রাসীরা যে আসলেও কোনো দলের হতে পারে না- একথারই প্রমাণ মিলেছে গত রোববারের হত্যাকান্ডে। এবার ছাত্রলীগের এক ক্যাডারের গুলীতে ছাত্রলীগেরই একজন তরুণ কর্মী মারা গেছে। আমরা মনে করি, এভাবে হত্যাকা-কে প্রশ্রয় দেয়ার পরিণতি ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। কথাটা ক্ষমতাসীনদেরও না জানা থাকার কথা নয়। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও তারা দলবাজি করছেন বলেই প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে। অন্য একটি কারণও উল্লেখ করা দরকার। খুনসহ অপরাধ দমনের জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দায়িত্ব হলেও ক্ষমতাসীনরা মূলত রাজনৈতিক পরিচিতির ভিত্তিতে নিজেদের দলীয় লোকজনকে রেহাই দিয়ে এসেছেন। এখনো দিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হলে সাত খুন করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছে ঘাতক-সন্ত্রাসীরা। সেজন্যই দেশের অন্যসব এলাকার মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটছে। এতে বেশি বিপন্ন কিন্তু ক্ষমতাসীনরাই হচ্ছেন। অপরাধ তো বাড়ছেই, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিরও মারাত্মক অবনতি ঘটছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ড তারই সর্বশেষ উদাহরণ। হত্যাসহ অপরাধ কমিয়ে আনতে হলে সরকারকে অবশ্যই সংকীর্ণ দলবাজির নীতি-মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। তাহলেই বাঁচানো যাবে তাপস সরকারের মতো তরুণ ছাত্রদের। আমরা মনে করি, খুনী যেহেতু চিহ্নিত হয়েছে সেহেতু অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সরকারের কর্তব্য। একই সঙ্গে সেসব বিশিষ্টজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা নামের গ্রুপ প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ করেন।

শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অথ : আওয়ামী অফিসার সমাচার : ঐ দিকে কলকাতা বনাম দিল্লীর লড়াই


পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে সে গর্তে এক সময় নিজেকেই পড়তে হয়। আওয়ামী লীগ সম্ভবত এই অমোঘ সত্যটি ভুলে গেছে। প্রশাসনে তাদের দলীয়করণ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, এখন প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিসার আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারের মত কথা বলছেন। এরা কি ভাবছেন যে, আওয়ামী লীগ রোজ কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে? ভাবে সাবে তাই মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগও সেই রকমই ভাবছে। ৫ই জানুয়ারীর আগে তারা ফিরিস্তি দিত, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা কি কি কাজ করবে। তখনও কিন্তু ৫ই জানুয়ারী ক্ষমতা ছিনতাই করার সময় আসেনি। কিন্তু তাদের মাথার ভেতরে ঐ চিন্তাই ছিল। তাই জনসমর্থনের তোয়াক্কা না করে নেহায়েত বাহুবলে তারা ক্ষমতার সিংহাসন জবর দখল করেছে। তারা যদি জোর করেও ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয় তা হলেও তারা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার দাবী করতে পারে। এখন তারা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা তো বলছেই, উপরন্তু ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। তাই ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা কি কি করবে, সেগুলো তারা বলে বেড়াচ্ছে। অবাক হই তখনই যখন দেখি যে ইদানীং তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত কি কি করবে তার পরিকল্পনাও শোনাচ্ছে। তা হলে কি তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তাই যদি না হবে তা হলে ২০৪১ সালের কথা তারা বলে কেন? অবশ্য এ বিষয়টি আমার মাথায় আসে না যে, ২০৪১ সাল আসতে এখনও ২৭ বছর বাকি। এই ২৭ বছরে শেখ হাসিনার বয়স হবে ৯৪ বছর। তা হলে শেখ হাসিনা কি ৯৪ বছর বয়স পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন? নাকি থাকতে চান?
দৃশ্যত সেটাই মনে হয়, সেই ধরনের চিন্তা ভাবনাই শাসক দলের মাথায় ঘোরাফেরা করছে। এ ব্যাপারে আমরা কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি। এ সব ঘটনা প্রমাণ করে যে, এই সরকার প্রশাসন যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অফিসারকে দলীয় ক্যাডার বানিয়েছে। তারা এত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে তারাও রোজ কেয়ামত পর্যন্ত চাকুরি করবে। একটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ বা তাদের বশংবদ এ সব অফিসার ভেবে দেখেনি। সেটি হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এরা কোথায় যাবেন? হিন্দি ছবিতে প্রায়শই একটি কথা বলা হয়। সেটি হলো, ‘এ্যায়সা দিন নেহি রাহে গা’। আওয়ামী লীগ পড়ে গেলে এরা পালাবারও পথ পাবে না। কেন পাবেনা সেটির জন্য নীচে কয়েকটি ছোট ছোট ঘটনা উল্লেখ করছি।
গত সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘ধৈর্য ধরুন, ধৈর্য ধরুন। নির্দিষ্ট সময় পর পরই নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে জিতলে ক্ষমতায় যাবেন। জনগণ তখন আপনার কথা শুনবে। আমরাও তখন আপনার নির্দেশ মতো কাজ করব।’ তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, এই সরকার সব মানুষের সরকার নয়, তার এবং তাদের মতো কিছু মানুষের সরকার। দৈনিক প্রথম আলোর কলাম মোতাবেক এই পুলিশ অফিসারের নাম জনাব আবদুল। আবদুল সাহেবের ভাষায়, ‘আমার সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা গণতন্ত্রের শীর্ষে অবস্থান করছি। পুলিশকে ঢিল মারা, গাড়িতে আগুন দেয়া গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। পুলিশ কমিশনার জনাব আবদুল আরও বলেন, ‘অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এ সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা এসেছে। এই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। সব নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক ছিল। ভালো যত কাজ আছে সেখানেও বিতর্ক আছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নতির হাতিকে কিছু দুষ্কৃতকারী পেছনের দিক থেকে টেনে ধরতে চাচ্ছে। তারা উন্নতির এই হাতিকে আটকাতে পারবে না।’ তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘কেউ যদি পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়ে, পুলিশের লাঠি তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’ (দৈনিক প্রথম আলো-১০.১২.১৪ তারিখ)। দীর্ঘ ৪০ বছর হলো সাংবাদিকতা করছি এবং কলাম লিখছি। কিন্তু কোন পুলিশ অফিসার বা অন্য কোন অফিসারের মুখে এ রকম সরাসরি দলীয় রাজনীতির কথা শুনিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাদের কাজ হলো, দুর্নীতি দমন করা। শুধু ঘুষ খেলেই দুর্নীতি হয় না। অনিয়ম করলেও দুর্নীতি হয়। স্বজন প্রীতি করলেও দুর্নীতি হয়। তেমনি কোন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড়সড় অফিসার যদি দলবাজি করেন তা হলে তিনি শুধু দুর্নীতিই করেন না। তিনি রীতি মত সংবিধান লঙ্ঘন করেন। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন তা হলে সাধারণ মানুষ যায় কোথায়? তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। কমিশনের সদস্য জনাব শাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশনের অস্থায়ী চেয়ারম্যান। কয়েকদিন আগে  বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে দুর্নীতি হয়েছে, তা বিশ্ববাসী জানেন। ওই সময় আমরা চারবার দুর্নীতিতে চ্যা¤িপয়ন হয়েছি। আপনাদের আমলের দুর্নীতিকে আপনারা চোখে দেখেননি। আপনারা তা আলমারিতে আটকে রেখেছিলেন।’ (দৈনিক ইনকিলাব-১০.১২.১৪ ইং )।
দুই
দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন চুপ্পু টিআইবির ওপরও এক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘টিআইবি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এরা ঘরের শত্রু বিভীষণ। তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, দুদককে যে দায়মুক্তি কমিশন বলে আখ্যায়িত করেছেন তার প্রমাণ আপনাকে দিতে হবে। তিনি খালেদা জিয়াকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পরামর্শ দেন। কারণ আপনার আমলেই বিশ্বে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিপয়ন হয়েছিল।’ (দৈনিক সংগ্রাম-১০.১২.১৪ ইং)। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা শত শত হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কাজ করে। এই ধরনের কাজে সকলকে সন্তুষ্ট করা যায় না। কোন কোন কাজে তারা প্রশংসা পাবেন, আবার কোন কোন কাজে নিন্দাবাদ কুড়াতে হবে। বিচারকরা যে রায় দেন, সেই রায়ে কি সকল পক্ষই খুশি হয়? কোন কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়। তাই বলে বিচারপতি কি সংক্ষুব্ধ পার্টিকে গালাগালি করবেন? দুদকের ব্যাপারটাও তাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের কোন বক্তব্যের সাথে দুদক একমত নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই একমত না হওয়ার কারণটি তারা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সে দিকে না যেয়ে টিআইবিকে ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে গালাগালি করার অধিকার কি চুপ্পু সাহেবের আছে? কার এজেন্ডা টিআইবি বাস্তবায়িত করছে? যে ভাষায় তিনি কথা বলেছেন সেই ভাষা হলো শাসক দলের ভাষা। আওয়ামী লীগের হার্ডকোর কর্মী অথবা লিডারের ভাষায় তিনি কথা বলবেন কেন? শোনা যায় যে, ছাত্র জীবনে নাকি তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পরেও তিনি ছাত্রলীগের আচার আচরণ ও কথাবার্তা ভুলতে পারেন নি। তাই তিনি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বারের মত কথা বলছেন। চুপ্পু সাহেব হয়তো ভুলে গেছেন যে, আওয়ামী লীগ অনন্ত দিন ক্ষমতায় থাকবে না। আর তিনিও ততদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। সুতরাং ঐ চেয়ারে বসে কথাবার্তা বলার সময় অবশ্যই হুস করে কথা বলতে হবে।
তিন
আমরা সাধারণত ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোতো দূরের কথা, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কদাচিৎ আলোচনা করি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যখন তখন নাক গলাচ্ছে। এমনকি কোন দলকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়া এবং কোন দলকে ক্ষমতায় বসানোর কাজে ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয়, কোন দল ক্ষমতায় থাকলে সে দল যাতে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হয় সে ব্যাপারেও ভারত সরাসরি কাজ করে। তারা বিএনপি এবং জামায়াতকে ক্ষমতায় আসতে দেয় না এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পর আওয়ামী লীগ যাতে বাপ দাদার চৌদ্দ পুরুষ ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে সে জন্য প্রকাশ্য এবং নগ্ন ভাবে কাজ করে।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে ধিকৃত করার জন্য ভারত সেদিন সারদা ফান্ড নিয়ে অনেক খেলা খেলেছে। রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য ইমরান হোসেন, সীমান্ত দিয়ে বস্তা বস্তা টাকা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছে প্রেরণ ইত্যাদি অনেক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। অবশেষে দেখা গেছে সব কিছুই শূন্যগর্ভ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিম বঙ্গের আনন্দ বাজারীরা কাছা খুলে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে এবং জামায়াত ও বিএনপির বিরোধীতা করেছে। কিন্তু আখেরে দেখে গেলো সব প্রচারণাই মিথ্যা। জামায়াত তো দূরের কথা, সারদা ফান্ডের এক কানা কড়িও বাংলাদেশে আসেনি। ইমরান হোসেনও কলকাতায় বহাল তবিয়তেই আছেন। বরং লড়াই শুরু হয়েছে দিল্লী বনাম কলকাতার মধ্যে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, পশ্চিম বঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ জন বলে পরিচিত মদন মিত্রকে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেষ্টিগেশন (সিবিআই) গত শুক্রবার ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেছে। এর আগে তৃণমূল দলীয় দুই জন পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) কুনাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বোসকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে। উভয় এমপিকেই গ্রেফতার করা হয়েছে অর্থ কেলেঙ্কারির দায়ে। এদের গ্রেফতারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। এসব গ্রেফতারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং প্রতিহিংসামূলক বলেছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। পশ্চিম বঙ্গের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মূখার্জী সিবিআইকে বিজেপির ক্রীড়নক বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিজেপির পশ্চিম বঙ্গ শাখা বলেছে যে, সিবিআই তদন্ত যে ভাবে এগোচ্ছে সেভাবে এগোতে থাকলে দেখা যাবে যে, এই তদন্ত মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানাজীর দোর গোড়ায় পৌঁছেছে।
একজন রাগান্বিত মমতা ব্যানার্জী বলেছেন যে, এটি হলো তৃণমূলের বিরুদ্ধে দিল্লী সরকারের নোংরা রাজনীতি। যদি তাদের সাহস থাকে তা হলে তারা আমাকে গ্রেফতার করুক। আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলবো, সাহস থাকলে সর্বাগ্রে আমাকে গ্রেফতার করুন। যখন মদন মিত্রকে হাসপাতালে আনা হবে তখন আমি তাকে দেখতে যাবো। তখন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ তাদের যত পুলিশ আছে নিয়ে আসুক এবং আমাকে গ্রেফতার করুক। আমরা তাদের মুখোস ছিড়ে ফেলবো। দিল্লীর রাজ পথে তাদের সাথে সংগ্রাম করবো।
ভারতে কেন্দ্র এবং প্রদেশের লড়াই জমে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ এ লড়াইয়ের শেষ দেখার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
আসিফ আরসালান 

মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রকাশ্য খুনেরও বিচার নেই


গত ৯ ডিসেম্বর ছিল পুরনো ঢাকার দরিদ্র দর্জি যুবক বিশ্বজিৎ দাসের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। দু’বছর আগে ছাত্রলীগের ঘাতকরা তাকে চাপাতির আঘাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে সবই ঘটেছিল প্রকাশ্য দিবালোকে, ২০ দলীয় জোটের সমাবেশ উপলক্ষে সেখানে সমবেত হাজার হাজার মানুষের সামনে। তা সত্ত্বেও হত্যা প্রতিহত করার জন্য কেউ চেষ্টা করেনি। শুধু তা-ই নয়, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যে রিকশাওয়ালা মুমূর্ষু বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে আদালতে সাক্ষী দিয়েছিল সেই রিকশাওয়ালা ইমনসহ মামলার সব সাক্ষীকে এখনো পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাণভয়ে দিন কাটাচ্ছে বিশ্বজিতের স্বজনেরাও। কারণ, খুনের মামলায় আটজনের ফাঁসি, ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা হলেও এবং তাদের মধ্যে আটজনকে গ্রেফতার করা হলেও মোট ২১ আসামীর ১১ জনই পলাতক রয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বেসরকারি টিভি ও সংবাদপত্রের খবরে অবশ্য ভিন্নকথা জানা যাচ্ছে। মঙ্গলবারের দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্টেও বলা হয়েছে, পলাতক বলে কথিত খুনিদের মাঝে-মধ্যেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যায়। অতি সম্প্রতিও দেখা গেছে। যার অর্থ, তারা আদৌ পালিয়ে যায়নি বরং বুক ফুলিয়ে দাপটের সঙ্গেই চলাফেরা করছে। ফেসবুকেও তাদের সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। তারা এমনকি মামলা তুলে নেয়ার জন্যও হুমকি দিচ্ছে। তাদের হুমকিতে নিহত বিশ্বজিতের স্বজনদের পাশাপাশি সাক্ষীরাও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আসলে তারাই, খুনিরা নয়। এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। খুনি-ঘাতকেরা জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। একই কারণে পুলিশের পক্ষেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। উল্লেখ্য, হত্যাকা-ের পরপর প্রথমে প্রচার করা হয়েছিল, বিশ্বজিৎ দাসকে নাকি জামায়াত-শিবির হত্যা করেছে! নিহত যুবক হিন্দু হওয়ায় অমন প্রচারণায় কাজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তাছাড়া চাপাতি দিয়ে কোপানোর সময়ও বিশ্বজিৎকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী বলেই চিৎকার করে জানান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এর পরই বিপাকে পড়েছিল সরকার। প্রবল জনমতের চাপে মামলা করলেও এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কয়েকজনের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজা দিলেও আসল কাজের তথা সকল আসামীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আওয়ামী চরিত্রেরই প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। সে কারণেই গ্রেফতার এড়িয়ে খুনিরা উল্টো বুক ফুলিয়ে চলাচল করার এবং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে অংশ নেয়ার পাশাপাশি নিহতের স্বজন ও সাক্ষীদেরকে হুমকিও দিয়ে বেড়াচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন অবস্থা শুধু আপত্তিকর নয়, যথেষ্ট ভীতিকরও। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থক হলেই তাদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। অনেককে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ভারতে পার করে দেয়া হচ্ছে ও হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ শুধু বিশ্বজিৎ দাসের বেলায় ঘটেনি। জানা-অজানা আরো অনেক খুনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এখনো ঘটছে। আপত্তির প্রধান কারণ হলো, খুনসহ অপরাধ দমনের জন্য দরকার যেখানে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, সরকার সেখানে রাজনৈতিক পরিচিতির ভিত্তিতে বাছাই করে করে নিজেদের দলীয় লোকজনকে রেহাই দিচ্ছে। সেজন্যই সারাদেশে অপরাধও বেড়ে চলেছে। বস্তুত আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক কারণে হত্যা পরিণত হয়েছে ডাল-ভাতের মতো বিষয়ে। এই অভিযোগও অনস্বীকার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, পুলিশ ও র‌্যাবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কাজে ব্যস্ত রেখেছে সরকার। ওদিকে সরকারি দলের নেতা-কর্মী হলে তো বটেই, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও ‘সাত খুন’ করেও দিব্যি ছাড় ও মাফ পেয়ে যাচ্ছে খুনি ও ঘাতকরা। ছাড় ও মাফ পেয়ে যাওয়াদের পাশাপাশি সাহস বাড়ছে অন্যদেরও। অন্তরালে সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে বলে অপরাধ দমনের ব্যাপারে পুলিশও নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। ফলে বাড়ছে হত্যাসহ নানা অপরাধ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার একটি বড় উদাহরণ হিসেবে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। অথচ এ ধরনের হত্যাকান্ডে জড়িতদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি-যে বিষয়টিতে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছাকৃতভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর ব্যর্থতা দেখিয়ে চলেছেন। আমরা মনে করি, হত্যার মতো ভয়ংকর ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনতে হলে ক্ষমতাসীনদের যেমন সংকীর্ণ দলবাজি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকেও তেমনি বাধাহীনভাবে তাদের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। অন্যদিকে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সরকারের এমন নীতির সুযোগ নিয়েই খুনি-ঘাতকেরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে। আমরা আশা করতে চাই, জনগণের প্রতি ন্যূনতম মায়া ও ভালোবাসা থাকলে সরকার অনতিবিলম্বে বিশ্বজিৎ দাসের পলাতক হিসেবে বর্ণিত খুনি-ঘাতকদের গ্রেফতার করে আদালতের দেয়া রায় কার্যকর করার পদক্ষেপ নেবে। না হলে অপরাধই শুধু বাড়তে থাকবে না, ক্ষমতাসীনদেরও এক সময় বিপদে পড়তে হবে।

সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বাধীনতার ৪৩ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি


১৯৭১ সাল একটি ইতিহাস; একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার নাগপাশ থেকে মুক্তির তাড়নায় ছিনিয়ে আনা নির্মল সবুজ একটি ভূখণ্ড। শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের এ অর্জন। ৪৩ বছর একটি নবজন্মা দেশের জন্য খুব বেশি সময় না হলেও কম সময় নয়। এই ভূখণ্ডকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশার কমতি ছিল না; এখনো একবুক আশা বুকে চেপে বেঁচে থাকার সোনালী স্বপ্ন দেখে দেশের মানুষ। যদিও-বা এ দেশ বিশ্বদরবারে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে পৃষ্ট হয়ে চলছে। নানা ধরনের ঘৃণ্যতর চক্রান্তের পদাঘাতে দেশ আক্রান্ত হলেও জনগণের দেশের প্রতি আকুণ্ঠ ভালোবাসা ও পরিশ্রম প্রিয়তার কারণে দেশ এখনো মেরুদ-হীন হয়নি। শাসক গোষ্ঠীরা ক্ষমতাকে দেশের উন্নয়নে ব্যবহার না করে নিজেদের আখের গোছানোর সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম দিয়ে তিলে তিলে দেশকে গড়তে নিরন্তর চেষ্টা চালাছে। বিচারের নামে অবিচার, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা আমাদের অস্তিত্বকে চুরমার করে দিয়ে এক নতুন প্রেতাত্মা জাতির ঘাড়ে ভর করেছে। এরপরও আমরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি, কারণ আমাদের তরুণরা মেধাবী ও সাহসী। তাদের যদি আজ সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া যায়, তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে। মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে স্থান করে নেবে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।
আমাদের প্রত্যাশা : স্বাধীনতার মুক্তির সংগ্রামে যারা সেদিন অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের প্রত্যেকের তীব্র আকাক্সক্ষা ছিল আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম একটি বাংলাদেশ পাব। যেখানে কারো তাঁবেদারি থাকবে না। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সুদৃঢ় ঐক্যের বাংলাদেশ। থাকবে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। থাকবে অর্থনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তি। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমরাও এগিয়ে যাবে সমভাবে। সুসম্পর্ক থাকবে প্রতিবেশী দেশের সাথে, আমাদের কোনো বন্ধু অবয়বে শত্রু থাকবে না; এদেশের প্রতি থাকবে না খবরদারি; থাকবে শুধু বন্ধুত্ব ও পরস্পর সহযোগিতার সম্পর্ক।
আমাদের প্রাপ্তি : দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অনেক কিছু সাম্রাজ্যবাদীরা নিয়ে গেলেও আমরা একটি সমৃদ্ধ ভাষা পেয়েছি। যার অবস্থান পৃথিবীতে ষষ্ঠ। লাল-সবুজের এমন একটি পতাকা পেয়েছি, যে পতাকটি পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের পতাকার চেয়ে সুন্দর; যেমন সুন্দর এখানকার চোখজুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। এমন একটি ভূখণ্ড পেয়েছি, যে ভূখ-টি এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিধি জুড়ে। পূর্বদিকে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর, অন্য তিন দিকে ভারত ও মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত। জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ১৪ কোটি হাত নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে। এখানের মানুষরা অসম্ভব পরিশ্রম প্রিয়, অল্পে তুষ্ট। আমরা পেয়েছি একটি উর্বর ভূমি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এখনো নিরাপদ নয় : ৪৩ বছর পরেও আমাদের ভাবতে (!) হয় আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়। পার্শ্ব দেশের ফরমায়েশি দেশের জনগণকে বিষিয়ে তুলেছে। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি অলিখিতভাবে তাদের হাতে। প্রতিনিয়ত সীমান্তবর্তী মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বন্ধুত্বের প্রশ্নে উত্তীর্ণ নয়। আমরা যেন স্বাধীন দেশের বন্দি নাগরিক। এমন পরিস্থিতিতে বারবার প্রশ্ন জাগে আমাদের কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ফসল কি? এমন আচরণ নিশ্চয় কোনো প্রতিবেশী দেশের আচরণ হতে পারে না। আমাদের দেশ থেকে ওরা নেবে আর নেবে আমরা সব বিলিয়ে দেব- এ যেন মগের মুল্লুক, আমরা জীবিত থেকেও মৃত লাশ। আমরা এমন স্বাধীনতা চেয়েছিলাম যেখানে থাকবে না কোনো বঞ্চনা ও অধিকার আদায়ের পুন পুন আন্দোলন। আমরা চেয়েছিলাম হাত হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশ। যে দেশটি বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে; প্রমাণ করবে আমরা সার্বভৌম আমরা স্বাধীন।
গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রের কবলে বাংলাদেশ : একটি দেশকে গণতন্ত্রের ফ্রেমে বন্দি করা যায়, গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ সরকার বলা যায় কিন্তু বাস্তবতা এর পুরো উল্টো। আমাদের দেশের রাজণীতি রাজতন্ত্রের ফ্রেমে আবদ্ধ সেই সূচনালগ্ন থেকে। তীর্থের কাকের মতো দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে চেপে বসা নেতাদের পড়ন্ত বেলা কবে শেষ হবে? কবে যোগ্যতার ভিত্তিতে গণন্ত্রের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের পক্ষের ব্যক্তি সরকারে বা দলের কা-ারি হবে? যে নেতাদের দেশের মানুষ অভিশপ্ত করার পরিবর্তে ভালোবাস ও ভালো লাগার জায়গায় স্থান দেবে। শত্রু নয় বন্ধু হিসেবে সবাই সবার তরে দেশমাত্রিকার জন্য একযোগে কাজ করবে, এগিয়ে যাবে প্রিয় বাংলাদেশ। কে জানে- কখন এমন হবে? কখন আমরা বলব, এই আমাদের প্রিয় স্বপ্নের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে দেশ : রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কথা অনেক দেশের মানুষ শোনেনি। কিন্তু আমাদের দেশ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে বহু আগে। এখানকার লোকেরা খুব রাজনীতি বোঝে! রাজনৈতিক ঝড়োহাওয়া সেই অজো পাড়া-গাঁয়ের চা দোকানের চায়ের কেঁটলি-কাপে ধোঁয়া তুলে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী হাইকমিশনার ডন ডব্লিউ মজিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের ডিএনএতে ও রাজনীতি পাওয়া যাবে! কথায় প্রচলিত আছে রাজনীতিবীদরা রাজনীতি বা দেশ চালান না; সাম্রাজ্যবাদীরাই দেশ চালান। অধিকাংশ রাজনীতিবীদ সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর হয়ে কাজ করছে।
অনৈক্যের বাংলাদেশ : একটি জাতির জন্য ৪৩ বছর কম সময় নয়। আমাদের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেশ যতটা না সামনে এগুচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পিছু হটছে। দেশে মীমাংসিত ইস্যুগুলোকে নিয়ে যারা পুনরায় দেশে বিভক্তির রেখা টেনে দিচ্ছে তারা মূলত কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে দেশে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। একটি দেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন এর পক্ষ-বিপক্ষ মতের মানুষ থাকবে- এটি অতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এই অনৈক্য বিষফোঁড়ার মতো বিষবাষ্প ছড়াবে- এটি একটি দেশের জন্য অত্যন্ত অনভিপ্রেত। একটি দেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনৈক্য সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আমরা আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি। তিনি বিরোধী পক্ষের রোষানলে পড়ে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির যাঁতাকলে ২৭ বছর কারাবরণ করেছিলেন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বিরোধী শিবিরকে ক্ষমা করে দিয়ে তিনি আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ লাভ করেন। বিশ্বব্যাপী দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ আমাদের দেশে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পতিপক্ষকে ঘায়েল করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য মৌলবাদী, রাজাকার, আলবদর, মানবতাবিরোধী অপরাধী নানাভাবে বিচারের নামে অবিচার শুরু করেছে। যে বিচার ব্যবস্থার অসচ্ছতার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা কথা বলেছেন। যারাই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ করেছেন সরকার তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়েছে; আইন-আদালতের ফাঁকফোকরে অতিষ্ট হয়ে পিষ্ট হয়েছে তাদের জীবন। এমন বিভক্তি আর শত্রু ভাবাপন্নতা মনোভাব নিয়ে আইনের অপব্যবহার করা সম্ভব; কিন্তু একটি দেশকে প্রত্যাশিত মাঞ্জিলে উন্নিত করা অসম্ভব।
ধর্মীয় স্বাধীনতাকে দমন : বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। এখানকার কৃষ্টি-কালচার কখনো ধর্মের বিরোধী নয়। তারা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে মিলিয়ে জীবনাচরণ পরিচালিত করে। বিশেষ করে মুসলমানরা এক্ষেত্রে অনমনীয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কারো ফরমায়েশদারির আনুগত্য করতে গিয়ে দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে উল্লেখ করলেও মূলত এখানকার মানুষের কর্ম ও বিশ্বাস থেকে ইসলামকে বিদায় করতে পারেনি। বারবার প্রমাণিত হয়েছে, যেখানে যত বাধা এসেছে এর অগ্রযাত্রা আরো বেশি শানিত হয়েছে। এখানে যার যার ধর্ম সে ধর্মের অনুসারীরা পালন করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে গেলে এখানে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় প্রতিটি পরতে পরতে। মাঝে মধ্যে সরকারের আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয়, এখানে সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কারণ তাদের আচার-অনুষ্ঠানে সরকারি বা বেসরকারি কোনো বাধা-বিপত্তি নেই। আর দেশের প্রধান সঞ্চালকরা মুসলমান নামধারী হলেও তারা নিজ ধর্মের সাথে অমুসলিমসুলভ আচরণ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ৫ মে শাপলা চত্বরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা ঘটেছে, তা কারবালার প্রান্তর ও স্পেনের গ্রানাডা ট্র্যাজেডিকে হার মানিয়েছে বহু আগে।
দারিদ্র্যতার কবলে বাংলাদেশ : বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা হলো দারিদ্র্যতা। দারিদ্র্যতা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা ও কর্মসংস্থাপন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। না খেয়ে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে পিষ্ট হয় মানুষ; মরার খবর এখনো খবরে প্রকাশিত হয়। শাসকদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে, কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয় না অভাগা জনগোষ্ঠীর। নেতাদের চাকচিক্যতায় আর বৃত্ত-বৈভব দেখলে বহিঃবিশ্বের কেউ মনে করবে না, এখানকার মানুষ দারিদ্র্যসীমার মাঝে বাস করে। সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান অষ্টম জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘বিদেশে গিয়ে আমরা যখন দেশের নানা সমস্যার কথা বলে সাহায্য চাই, তখন আমাদের বিদেশীরা তচ্ছু-তাচ্ছিল্য করে বলে, তোমাদের দেশের লোকেরা খেতে পায় না; অথচ তোমরা পাঁজারো গাড়ি হাঁকাও! তোমাদের লজ্জা থাকা উচিত।’ আসলেই মন্তব্যটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক হলেও নিজেদের বোধদয় হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের কোনো সরকারই কর্মমুখী শিক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচনে বাস্তবমুখী টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ করতে না পারায় সমসাময়িককালে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো কোনো চমক লাগানো পরিবর্তন আনতে পারেনি। উল্লেখিত দেশগুলোর জনগণ যেখানে দেশের সম্পদ সেখানে আমাদের দেশের বহুল জনসংখ্যাকে মনে করা হয় বোঝা।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট সমগ্র জাতি : বাংলাদেশ পাকিস্তানের বৈষম্যের অক্টোপাস থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দন্ডায়মান হবে- এটিই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির চাবিকাঠি অন্যদের হাতে। মুক্ত বাণিজ্যের নামে গার্মেন্টস সেক্টরে চলছে ভয়াবহ অরাজকতা। যেখানে আমরা আমাদের দেশীয় উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন, সেখানে পার্শ্ব দেশের আমদানি করা নিম্নমানের পণ্যে বাজার সয়লাব। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সরকারিভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। কলকারখানা পাকিস্তান আমলে যা হয়েছিল, তা-ও এখন বন্ধপ্রায়। দেশের যা কিছু অগ্রগতি হয়েছে প্রাইভেট সেক্টরের কারণে। বৈদেশিক মুদ্রার আয় আমাদের রাজস্ব আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যারা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ পাড়ি জমান তারা অধিকাংশ অশিক্ষত-স্বল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ শ্রমিক। পররাষ্ট্রনীতির অদক্ষতার কারণে আমাদের দেশের বাইরের কাজের পরিধিও কমে যাচ্ছে। এর উন্নয়নে সরকারের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। 
আবদুল জব্বার 

শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

‘কাজের বেটি’ মর্জিনা এবং ‘দুই আনার মন্ত্রী’ নিশা দেশাই প্রসঙ্গ


রাজনীতিতে মতভেদ থাকবেই। দলীয় রাজনীতিতে আরও বেশি মতভেদ থাকবে। মতভেদ যদি নাই থাকবে তাহলে তো সকলে মিলে একটি দলই করতেন। তাহলে আর এতগুলো দলের প্রয়োজন হয় কেন? বিদেশী নীতিতেও মতভেদ থাকবে। সে জন্যই এক সময় দেখেছি মার্কিনপন্থী ও সোভিয়েটপন্থী। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর দেখা গেল চীনাপন্থী। মিনি পরাশক্তি হিসাবে উত্থিত হওয়ার পর এখন অনেকেই হচ্ছে ভারতপন্থী। এ ধরনের মতভেদ তো থাকবেই। কোন মতবাদটি ভাল, কোন মতবাদটি খারাপ, সেটির নিষ্পত্তি হবে যুক্তি দিয়ে, তর্ক দিয়ে। সেই পথে না গিয়ে কেউ যদি বস্তিবাসির মত দেশী বা বিদেশী পলিটিশিয়ানকে খিস্তি খেউর করেন, অশ্রাব্য গালিগালাজ করেন তাহলে তিনি নিজেকে কোন্ পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেন সেটা চিন্তা করেন না।
আমেরিকার সাথে আওয়ামী সরকারের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীর কথাবার্তা থেকে এগুলো এখন বোঝা যায়। কিছুদিন আগেও দুই দেশের কিছুটা চিড় ধরা সম্পর্কের খবর রাখতেন শুধুমাত্র সমাজের ওপর তলার মানুষ জন। কিন্তু এখন খবরের কাগজ পড়েন বা টেলিভিশনের নিউজ শোনেন, এমন মানুষও আওয়ামী মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন জানেন। এটিকেও আমরা অস্বাভাবিক বলবো না। ইন্ডিয়া এবং আওয়ামী লীগ হরিহর আত্মা। সেটিকে আমরা সমর্থন করি আর নাই করি, আওয়ামী লীগ সেই ধরনের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে, যেতেই পারে। জনগণ পছন্দ না করলে নির্বাচনের মাধ্যমে বা গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে একটি দেশের রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের বেটি’ বলা বা কোন দেশের মন্ত্রী বা সহকারী মন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলা কোন ধরনের রাজনীতি সেটি কারো বোধগম্য নয়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন যে, আমরা যতই শর্ত পূরণ করি না কেন, আমেরিকা আমাদেরকে আর জিএসপি সুবিধা দেবে না। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক, তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুই নম্বর ব্যক্তি, জেনারেল সেক্রেটারি এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হঠাৎ করে রাজনৈতিক সমালোচনায় সভ্যতা এবং ভব্যতা এ ভাবে বিসর্জন দিলেন কেন?
আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই তিন দিনে সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা তার কোন মন্ত্রীর সাথে নিশা দেশাইয়ের কোন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি বিরল ঘটনা। তিনি দেখা করেছেন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। আরও দেখা করেছেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বলে নিজেদেরকে জাহির করা জাতীয় পার্টির একাংশের নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের সাথে। সরকারের কোনো পর্যায়ের কারো সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। হতে পারে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে সরকারের কোন ফাংশনারীই তার সাথে দেখা করেনি। এই দেখা না করাটাও একান্তভাবে তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এসব ব্যাপার ভাল হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে, সেটি বুঝবে সরকার এবং বুঝবে জনগণ। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফ নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং উপহাস করবেন কেন? আশরাফুল ইসলাম বলেছেন যে, নিশা দেশাই ‘চার আনার মন্ত্রী’ও নন। তিনি ‘দুই আনার মন্ত্রী’। সেই দুই আনার মন্ত্রীর সামনে বেগম খালেদা জিয়া নাকি বসে থাকেন। উদ্দেশ্য, নিশা দেশাইরা যদি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে খালেদা জিয়াকে পাওয়ারে বসান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে ব্যঙ্গ তামাশা করেছেন। বলেছেন, একজন কাজের মেয়ে খালেদা জিয়াকে পাওয়ারে বসাতে পারবে না।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনাকে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আশরাফুল ইসলাম কেন কাজের মেয়ে বললেন সে রহস্যও বেশ চিত্তাকর্ষক। কাজের মেয়ে মর্জিনা সৈয়দ আশরাফ ও তার গিন্নিকে নাকি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আম্মা, টেলিভিশনে ওই ব্যাটারা প্রায়ই আমার নাম বলে কেন?” সৈয়দ আশরাফ, “ওরা তোর নাম বলে না। ওরা বলে মজিনা। আর তুই শুনিস মর্জিনা।” সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, “এই সব কাজের মেয়ে মর্জিনা (মজিনা) কোন দিন বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে না।”
দুই
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শুধু মাত্র আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারিই নন, তিনি একজন মন্ত্রীও বটে। তাকে তো ডিপ্লোম্যাটিক এটিকেট বা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতেই হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধারও ধারেননি। এটি কি তার অপরিপক্কতার পরিচায়ক? নাকি ক্ষমতার মদমত্ততায় দুর্বিনীত ঔদ্ধত্যের পরিচয়? কূটনীতির জগতে আপনি দৃঢ় হতে পারেন, এমনকি দৃঢ়তার সাথে আপনার বিদেশী প্রতিপক্ষকে পাল্টা জবাবও দিতে পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনার ভাষা হবে স্পষ্ট, সুর হবে নরম। আর যদি মনে করেন যে, আপনি সেই দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেন তা হলে সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। নিশা দেশাইকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। তার বয়স, তার বৈবাহিক স্ট্যাটাস এবং তার নৃতাত্ত্বিক উৎস নিয়েও কথা বলেছেন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, তিনি মন্ত্রী হোন আর না হোন, সভ্যতার সূতিকাগার ইংল্যান্ডে তিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাটকে কি এ সব ভাষায় আক্রমণ করা যায়? নিশা দেশাই বিবাহিতা কি কুমারী সেই প্রসঙ্গ সৈয়দ আশরাফ তুলবেন কেন? নিশা দেশাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিনা, তার বয়স কত, তিনি পুরুষ না রমণী, তিনি কি দুই আনা নাকি ষোল আনার মন্ত্রী, এ সব কিছুই এখানে প্রাসংগিক নয়। কঠোর বাস্তব হলো এই যে, তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন অবিবাহিতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিশা দেশাই হিসেবে নয়। তিনি এসেছিলেন মার্কিন সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করতে। ঢাকায় তিনি কি বলেছেন, কাদের সাথে তিনি দেখা করেছেন, এগুলো কোনটাই তার ব্যক্তিগত ক্যাপাসিটিতে করেননি। এগুলো সব কিছুই তিনি করেছেন প্রসিডেন্ট ওবামার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন সেটি আরও কুৎসিত। সৈয়দ আশরাফের কাজের বেটির নাম মর্জিনা। আশরাফ যখন মর্জিনাকে বলেন যে, হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে চায় মজিনা তখন মর্জিনা এতই রেগে গিয়েছিল যে সে তার নামই পাল্টে ফেলতে চেয়েছিল। কারণ তার নামের সাথে মজিনা নামের অনেক মিল রয়েছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি হলো, To hit below the belt. সৈয়দ আশরাফ ড্যান মজিনাকে ঠিক সেখানেই আঘাত করেছেন। সৈয়দ আশরাফই তো বলেছেন যে, বাংলাদেশে মজিনার চাকরি শেষ। তিনি শীঘ্রই আমেরিকা ফিরে যাচ্ছেন। এমন একটি সময়ে একজন মানুষকে এভাবে ইনসাল্ট না করলেই কি চলতো না?
তিন
আবুল হাসান মাহমুদ আলী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। তিনিই বলুন, সৈয়দ আশরাফ যেভাবে বিদেশীদেরকে নিয়ে অপমানজনক ভাষায় কথা বলছেন, সে ভাবে কি বিদেশ নীতি পরিচালনা করা হয়? আমরা আগেই বলেছি যে, দুটো স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে মত ভিন্নতা থাকতেই পারে। বিশ্বায়নের গতি যত বাড়বে আন্তঃদেশীয় নির্ভরশীলতা এবং জটিলতাও তত বাড়বে। দুটি দেশের মত ভিন্নতা যত বাড়বে, দুটি দেশকে সেই ভিন্নতার প্রণালী দিয়েই পথ মাড়াতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ হবে জটিলতার মধ্য দিয়ে দৃঢ়তার সাথে বন্ধুত্বের হাত ধরে রাখা। ভারতের মত দেশ যেমন বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য খুঁজে পেয়েছে আমরাও তেমনি পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনায় মতদ্বৈধতার মাঝে মতৈক্য খুঁজবো।
আরও অবাক ব্যাপার হলো এই যে, সৈয়দ আশরাফের এই অপমানজনক উক্তিতে দুই দেশের সম্পর্কে যে ফাটল ধরলো সে ফাটল দূর করার কোন প্রচেষ্টাই কোন মহল থেকে করা হয়নি। সরকারের কোন মহল থেকেই তার এ মন্তব্য প্রত্যাহার করা হয়নি, কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি বা দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। এমনও বলা যেতে পারতো যে, আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মুহূর্তের আবেগ বা উত্তেজনায় এ সব কথা বলে ফেলেছেন। এই মন্তব্যের পর বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সেই অপমানজনক ও ক্ষতিকর মন্তব্য সম্পর্কে সরকার একেবারেই নির্বিকার। সুতরাং ধরে নেয়া যায় যে, সরকার জেনে শুনেই সৈয়দ আশরাফের মুখ দিয়ে এ কথা বলিয়েছে।
চার
এই লেখা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি তখন অর্থাৎ শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আরও সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের জন্য আমেরিকা অনেক কিছু করেছে। কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। প্রসঙ্গত তিনি বলেন যে, ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে চেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু পারেনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন যে, আমেরিকার একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করতে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার পরিচালনা পরিষদের কোন মিটিং না করে এককভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, কোন একটি দেশ, সে যতই বড় হোক না কেন, সে বা তারা বাংলাদেশের পাশে না আসলেও বাংলাদেশ চলতে পারবে। বিশ্ব ব্যাংক ছাড়াই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ নাকচ করেছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফর সম্পর্কে অবহিত করতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স¤পর্কের বিষয়ে আলোকপাত করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ সব বক্তব্যের জবাব দিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। সেই জবাবে তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পদ্মা সেতুর সমর্থক ছিল এবং বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র মনিকা এল শাই শুক্রবার রাতে বলেন, সত্যিকার ঘটনা হল- বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কানেকটিভিটির গুরুত্ব অনুধাবন করে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের কাজ করার একটা উপায় খুঁজে পাওয়ার জোরালো প্রবক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয় সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব রকমের চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সম্পর্কে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবার জানা। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল এ নিয়ে পরিষ্কার মত প্রকাশ করেছেন। তারপর নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট তার সিনেট শুনানিতে এ ব্যাপারে বলেছেন। সর্বশেষ নিশা বিসওয়াল বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা বাংলাদেশের জনগণ নির্ধারণ করবে।
এ সব বাদানুবাদে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হচ্ছে। বাদানুবাদটি হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আমেরিকা এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আসিফ আরসালান 

Ads