বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পরিবহনে নৈরাজ্য, সামনে কঠিন সময়


যানজটে নাকাল হচ্ছে জনসাধারণ। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা আতঙ্ক নিয়েই সড়কপথে চলাচল করতে হচ্ছে মানুষকে। সরকারের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের বাধার মুখে পরীক্ষা না দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন শ্রমিকরা। ফলে চালকের অদক্ষতায় এবং ট্রাফিক আইন না জানার কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।
প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে অথবা দুটি গাড়ির সংঘর্ষে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। আহত হচ্ছেন আরও অনেকে। অনেককে পঙ্গু হয়ে কাটাতে হয় সারাজীবন। দিন দিন সড়কপথগুলো পরিণত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে এসব দুর্ঘটনার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। কোনো শাস্তি হয় না চালকের। যথাযথ বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।
প্রতি বছর বিশ্বে ১১ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হন। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনায় বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৬ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। বিগত এক শতাব্দীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ কোটি মানুষ মারা  গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বের সর্বমোট মোটরযানের সংখ্যা মাত্র ৩২ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৭৫ শতাংশ। বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ মারা যান এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। অথচ বেশিসংখ্যক মোটরযানসমৃদ্ধ দেশগুলোতে এ সংখ্যা মাত্র ১২ শতাংশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বাড়বে এবং উন্নত দেশগুলোতে ৩০ শতাংশ কমবে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৭টি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এসব দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মারা যায়। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় তা খতিয়ে দেখতে ২০০৩ সালে ট্রান্সপোর্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরি একটি গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার সম্পত্তি, চিকিৎসা ব্যয় ও আইনি ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে ২০০২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ক্রমেই বেড়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় ঠেকেছে। ঝুঁকির দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকারিভাবে বছরে প্রায় ৪ হাজার দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থাকলেও প্রকৃত সংখ্যা কমপক্ষে এর পাঁচগুণ বেশি।
রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। ফুটপাতগুলো সরু হওয়ায় এবং বিভিন্নভাবে রাস্তাঘাট দখল, যেখানে-সেখানে স্তূপিকৃত ময়লা-আবর্জনা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঢাকা নগরীর ৫১টি পয়েন্ট দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, বিজয় সরণি, শনিরআখড়া, জসীম উদ্দিন রোড ক্রসিং, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, শেরাটন হোটেল ও জিপিও মোড়।
১৯৭৪ সালে ঢাকায় লোকসংখ্যা ছিল দুই লাখ। বর্তমানে এক কোটি ৪০ লাখ থেকে দেড় কোটি মানুষ বসবাস করছে। আর প্রতিদিন ১০৩টি করে প্রাইভেট কারের অনুমোদন দিচ্ছে বিআরটিএ। এ লোকসংখ্যাও গাড়ি বাড়ার তুলনায় রাস্তা বাড়েনি। ঢাকা শহরের আয়তনের মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ রাস্তা। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যে কোন বড় শহরের মোট আয়তনের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা। এ ছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তার একটা বিশাল অংশ দখল করে থাকে হকার, অবৈধ পার্কিং ও অবৈধ স্থাপনা।
বর্ষা মওসুম শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। ভূ-গর্ভস্থ বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণের অজুহাতে খোঁড়াখুঁড়ির ফাঁদে পড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। রাস্তাঘাট দীর্ঘদিন কেটে রাখার দরুন প্রতিনিয়ত কাদা, নোংরা পানি ও ধুলার সাথে বসবাস করতে হচ্ছে।
ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে ট্রাফিক পুলিশের অধীনে দুই হাজার ২৭৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এসব সড়কে রয়েছে ৬৫০টি ক্রসিং। এর মধ্যে ৩০০টি গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ৭০টিতে সঙ্কেত বাতি রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে রেলপথের রয়েছে ৩৬টি লেভেল ক্রসিং। রাস্তায় গাড়ি রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। ঢাকার ভেতরে ১৭০টি রুটে ছয় হাজার ১০০টি বাস চলাচল করছে। বাস কোম্পানি রয়েছে ১৩৭টি। ট্রাফিক বিভাগ কর্মরত রয়েছেন তিন হাজার ৩৫৮ জন। বর্তমানে রাজধানীতে ৩৮টি ফুট ওভারব্রীজ ও তিনটি আন্ডারপাস রয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরো ১০টি ওভারব্রিজ।
দয়াগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে সুইপার কলোনী হয়ে রাজধানী মার্কেট পর্যন্ত সড়কে সুয়ারেজ লাইনে স্থাপনসহ মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। পাইপ লাইন স্থাপনার পর যেখানে বালি দেয়ার কথা ছিল ঠিকাদার সেখানে রাবিশ দিয়ে গর্ত ভরাট করেছে। সবার চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও প্রতিকারের কেউ নেই।
পুরানো ঢাকার মিরহাজারীবাগ, দীননাথ সেন রোড, তনুগঞ্জ লেন, ইসলামবাগ, চকবাজার, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, লালবাগ কেল্লার মোড়সহ রাজধানীর অধিকাংশ সড়কই ভাঙাচোরা।
ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কুড়িল ও কালাচাঁদপুরের একটি রাস্তাও ভালো নেই। বারিধারা জে-ব্লকের বেশিরভাগ রাস্তা খারাপ। বারিধারা দূতাবাস সড়কসহ কয়েকটি সড়ক কিছুদিন আগে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাইপ লাইন স্থাপন করা হলেও মেরামত করা হয়নি। এখানেও রাস্তা খুঁড়ে বালির পরিবর্তে রাবিশ দেয়া হয়েছে। গুলশান দুই নম্বর মার্কেটের ইউনাইটেড হাসপাতালের আশপাশের রাস্তা কেটে পাইপ লাইন স্থাপন করা হলেও সড়কগুলো মেরামত করা হয়নি।
 ঢাকার জনসংখ্যা, এর আয়তন, গাড়ির সংখ্যা, ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা এবং সর্বোপরি গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা বর্তমান চিত্র যে কোন বিবেচনায় হতাশাজনক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ির পেছনে বাধ্যতামূলক রিফ্লেক্টিভ স্টিকার লাগানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ বিষয়ে অবগতির জন্য রাজধানী জুড়ে মাইকিং করে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ির মালিক ও চালকদের জানানো হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় রাতে চলাচলকারী রিকশা, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির পেছনের অংশে কোনো আলো প্রতিফলক বা রিফ্লেক্টিভ স্টিকার না থাকায় পেছন থেকে আসা যানবাহন চালকের দৃষ্টি এড়িয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনা এড়াতে রিকশা, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি মালিক ও চালকদের প্রতিটি রিকশা, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির বডির পেছনে মাঝামাঝি স্থানে ৬ ইঞ্চি দের্ঘ্য ও ৩ ইঞ্চি প্রস্থের রিফ্লেক্টিভ স্টিকার লাগানোর নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৭)
দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটছে, এর ৬৪ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ মহাসড়কগুলোতে। এর কারণ মহাসড়কের জন্য কতগুলো শর্ত আছে, সেগুলো পূরণ হয়নি বলেই এত দুর্ঘটনা। মহাসড়ক তৈরি করা হচ্ছে; কিন্তু এর নকশা, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। মহাসড়কে ১০০ কিলোমিটার বেগে চলা যানবাহনের সঙ্গে চলছে ধীরগতির নসিমন, করিমন ও ভটভটি। রাস্তার দু’ধারে পথনির্দেশক বোর্ডগুলোর তুলনায় বিলবোর্ডের আধিক্য, হাটবাজার গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে, চালক বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছেনÑএমন অসংখ্য কারণ রয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয়া রোগীর ৫৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার।
এসব চলাচল অযোগ্য যানবাহন মহাসড়কে বন্ধ এবং আটক করতে প্রতি জেলায় ডিসি ও পুলিশ প্রশাসনকে উপ-আনুষ্ঠানিক পত্র দেয়া হয়েছে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি পৃথক তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ তহবিল থেকে সড়কে তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট খানা-খন্দক দূর করা হবে।
সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ স্থাপনা অপসারণে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তও এখনো কার্যকর হয়নি। দেশের মহাসড়কগুলোতে স্থাপিত গতিরোধক অনেক সময় উল্টো বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ। মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। অনেক স্থানেই রয়ে গেছে এসব গতিরোধক।
প্রশিক্ষিত চালকের অভাব, পথচারীদের অসতর্কতা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, গাড়ির বেপরোয়া গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, অতিরিক্ত গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সেতু এবং অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে।
নথিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সরকারের যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্প। যানজট-দুর্ঘটনা রোধে সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করলেও সবই রয়ে গেছে কাগজে-কলমে। প্রকল্পের গবেষণাপত্র তৈরি, বাজেট বরাদ্দ, পর্যালোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মধ্যেই কার্যক্রম রয়েছে সীমাবদ্ধ। লোক দেখানো দু-একটি কাজ হাতে নেয়া হলেও শুরুতেই সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। যানজট নিরসন ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্পের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও সাধারণ মানুষ প্রকল্পের কোনো সুফল ভোগ করেনি।
বিধিমালা-২০০১ সহ বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়ন না হওয়া, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অকার্যকর অবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সামাজিক আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় স্থল পরিবহন ও মহাসড়ক বিধিমালাসহ বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিআরটিএ’র প্রয়োজনীয় জনবল নেই। অন্যসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে। এসব কারণেও সড়ক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পর সাধারণত বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৭৯ ও ৩০৪ (খ) ধারায় অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাসের কারাদন্ড। যে কারণে দোষী চালক সহজেই পার পেয়ে যান। জামিনযোগ্য অপরাধ হওয়ায় কেউ কেউ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। আইনে সড়ক দুর্ঘটনার মামলা আপসযোগ্য হিসেবে উল্লেখ থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমেই মীমাংসা করা হয়।
সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনারোধে সরকার কিছু পদক্ষেপ নেয়। দুর্ঘটনারোধে ১ নভেম্বর ২০১১ থেকে গাড়ি চালানোর সময় চালকের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কিছু কিছু প্রাইভেট গাড়ির চালক গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট ব্যবহার করলেও বাসের চালকদের কেউ গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট ব্যবহার করেন না। মোটর সাইকেল চালকদের হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে গাড়ি চালানোর সময় চালকদের মোবাইলে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নির্দেশনা অমান্য করলে জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভা শেষে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
এ নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দিতে প্রয়োজনে আইন সংশোধনের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২২ অক্টোবর ২০১১)
শুধু রাজধানী নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিনই এখন ভয়াবহ যানজট দেখা যাচ্ছে। গন্তব্যে পৌঁছতে মহাসড়কে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। এ ছাড়া কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মহাসড়কেও তীব্র যানজট চলছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। ৬ ঘণ্টার গন্তব্যে পৌঁছতে তাদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। যাত্রীদের অভিযোগ, ঈদের আগে তারা যে যানজট প্রত্যক্ষ করেছেন, একই চিত্র তারা এখনো দেখছেন। এ জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনাই মূল কারণ বলে তারা জানান।
একদিকে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা, অন্য দিকে অসহনীয় যানজট হলেও নির্বিকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক পরিদর্শন করছেন। তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ করছেন যানজট ও খানা-খন্দে ভরা সড়কপথ।
বাস্তবে যানজট নিরসনে কোনো কুল-কুনারা করতে পারেনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যানজট কমাতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উড়াল সেতু, উড়াল সড়কসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনোটি এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। নির্ধারিত সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ, অফিস সময়সূচি পরিবর্তন, ওয়ানওয়েসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও এসব মনিটরিংয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। মন্ত্রণালয়, দফতর, পরিদপ্তর, পুলিশ, প্রশাসন সবই আছে। তাদের বেতনভাতারও কমতি নেই। প্রজেক্ট প্রোফাইল, গবেষণাপত্র, প্রদর্শনী ইত্যাদির নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় আছে। কিন্তু কোনো সুফল পাচ্ছে না মানুষ। সরকার ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবর্তে বড় অঙ্কের বৃহদায়তন প্রকল্প হাতে নিতেই বেশি ব্যস্ত।
২০০৯ সাল থেকে নতুন অফিস ও স্কুল সময়সূচি ঘোষণা করা হয়। তাতেও যানজটের কোনো প্রভাব পড়েনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যানজট নিরসনে লেন পদ্ধতি, অটো সিগন্যাল পদ্ধতি, অঞ্চলভিত্তিক বিপনিবিতান বন্ধ, সিসি ক্যামেরায় ভিডিওচিত্র দেখে গাড়ি আটক, বাধ্যতামূলক ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার এবং পুরনো গাড়ি উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে গবেষণা আর প্রকল্প স্থাপনে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও যানজট নিরসনে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহরগুলোতে ফুটপাত খালি করার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। ফুটপাত জনসাধারণের চলাচলের জন্য। এ সিদ্ধান্ত কি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সরকার? সরকার এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে পারলে কম করে হলেও ৫০ শতাংশ মানুষ দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যেত। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের কোনো ব্যয় নেই।
দুর্ঘটনা রোধে সরকারের কাছে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন। কোনোটিই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। দুর্ঘটনা রোধে আইন থাকলেও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ড্রাইভারদের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার জন্য, হয়নি। দেশে প্রচুর বেকার যুবক রয়েছে। নতুন ড্রাইভার তৈরিতে ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর ছিল। সেটাও হয়নি। মালিকেরা ব্যাংক ঋণ করে নতুন গাড়ি কেনেন। দ্রুত গাড়ির টাকা তুলতে অদক্ষ ড্রাইভারের হাতে গাড়ি তুলে দেন। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়টি স্কুলের পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্তির দাবিও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-ছিল। সেটাও সরকার করেনি।
রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দিনে বাস প্রতি ৪০ টাকা হারে টার্মিনাল ফি আদায় করে। এই টাকা তারা ইজারাদারের মাধ্যমে দৈনিক চুক্তিতে আদায় করায় ইজারাদাররা টার্মিনালের ফি আদায়ের নামে বিভিন্ন রকম সার্ভিস চার্জও যুক্ত করে কয়েকগুণ বেশি টাকা চাঁদা দেয়। বাস টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছাড়ার আগেই পরিবহন মালিকদের জিটির নামে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। সেটা সর্বনিন্ম ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা পর্যন্ত। জিটি ছাড়াও টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার সময় যানজট নিয়ন্ত্রণের লোকজনকে দিতে হয় গাড়ি প্রতি ২০ টাকা, লাইনম্যানকে ২০ টাকা, টার্মিনালের গেট পেরুলেই চাঁদার দাবিতে হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ সার্জেন্ট। তাকে দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে চলাচলকারী ঢাকা-কুমিল্লা, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা-লক্ষ্মীপুর, ঢাকা-চাঁদপুরসহ বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসগুলোকে প্রতি ট্রিপে নিয়মিত চাঁদা দিয়েই গাড়ি চালাতে হয়। একইভাবে গাবতলী থেকে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোও টার্মিনালের নিত্য চাঁদাবাজির শিকার। এ ছাড়া গুলিস্তান এবং মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে যাত্রার শুরুতে চাঁদার টাকা গুণতে হয়। অন্যদিকে ট্রাক টার্মিনালেও প্রতিটি ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয়। তবে ট্রাকের চাঁদা বেশি আদায় হয় মহাসড়ক এবং ফেরিঘাটে। সারা দেশে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থেকে মালিক সমিতি ৪০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ২০ টাকা এবং শ্রমিক ফেডারেশন ১০ টাকাসহ মোট ৭০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনৈতিক সংলাপ : অতীতের অভিজ্ঞতা



সেই পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি, দেশে যখন নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী মহল বিবদমান সব পক্ষকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংলাপে বসার অনুরোধ জানান। সরকারি দল রাজি হয়ে সংলাপে বসলেও দুই একটি ক্ষেত্র বাদে সরকারি দলের একগুঁয়েমির কারণেই সংলাপ নিষ্ফল হয়েছে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং পাকিস্তানে দ্বিতীয়বার সামরিক অভ্যুত্থান হয়। আইয়ুব খানকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর সংলাপ সরকারের সদিচ্ছার কারণে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার সফলতাআমাদের মহান স্বাধীনতা এবং পাকিস্তানের ক্ষমতা থেকে ইয়াহিয়ার করুণ বিদায়। ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সাথে বিরোধী দলের সংলাপ ব্যর্থ হয় ক্ষমতাসীন সরকারের কারণে। এরশাদ কারচুপির নির্বাচন করে ক্ষমতায় ৯০ পর্যন্ত থাকলেও রাজনৈতিক বৈধতা পাননি। ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কমনওয়েলথ মহাসচিবের মধ্যস্থতায় সংলাপ হলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কারণে ওই সংলাপ ব্যর্থ হয়। ১৯৯৪ সালের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ রাজি হয়নি, ১৮ বছর পর সেই প্রস্তাবই তারা পুনরায় দিচ্ছে। এ যেন ওপর দিকে থুথু ফেলার মতো অবস্থা। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সাথে বিরোধী দলের সংলাপও ব্যর্থ হয়। ফলে বিএনপিকে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য সংশোধনী পাস করে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। ২০০৬ সালে মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপ ব্যর্থ হয় দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ভূমিকার কারণে। আলোচক দুজনের মধ্যে একজন বহিষ্কৃত হয়েছেন এবং অপরজন মহাসচিবের পদ হারিয়ে দলে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। অতীত সংলাপগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকি সব সংলাপই ছিল নির্বাচন কিভাবে হবে, তা কেন্দ্র করে। এখন প্রথিতযশা ব্যক্তিরা দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা নিশ্চয়ই উপরিউক্ত ছয়টি সংলাপের ভাগ্য সম্পর্কে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। কিন্তু সংলাপে বসার নিষ্ফল আহ্বান জানিয়ে কী লাভ? কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া তাকে নির্বাচনে হারানোর ক্ষমতা কারো নেই। তাই সেই সাথে প্রতিবন্ধকতার মোক্ষম অস্ত্র সাবেক প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে প্রয়োগ করেছেন। ২০০৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ছয়টি বিকল্প বিধান থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এক নম্বর বিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ক্ষমতাসীন বিএনপি সরাসরি ছয় নম্বর বিকল্পে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে বসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী। পৃথিবীর কোথাও কি আছে উপরাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন? বরং রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে তিনিই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আওয়ামী লীগ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সুবিধা হয়। এক দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিতর্কিত করে ভবিষ্যতে তা বন্ধের নীল-নকশা করা গেল। অপর দিকে একটি সামরিক তত্ত্বাবধায়কসরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সাহায্যে নির্বাচনের পূর্বেইজয় লাভের ব্যবস্থা করা গেল। দলটি বিচারপতি হাসান শহীদ জিয়ার আমলে বিএনপি করতেন, এই অভিযোগে তাকে মানতে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ সংবিধানের তোয়াক্কা না করে দ্বৈত নাগরিক ফখরুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা মানল কোন নৈতিকতায়? শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের সরকারের চারজন জাঁদরেল উপদেষ্টা, যারা সবাই আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারা পদত্যাগ করার সাথে সাথে আওয়ামী নেত্রী তাদের এই সাহসীকাজের জন্য অভিনন্দন জানালেন। অথচ তারা বর্তমান সঙ্কটে একই অভিযোগ তার সরকারের বিরুদ্ধে করায় তাদের নির্বাচন করতে ব্যর্থবলে উপহাস করা হচ্ছে। সংবিধানে বিধান থাকা সত্ত্বেও যারা শুধু এর প্রয়োগ সম্পর্কে সংলাপ করে একমত হতে পারেন না, তাদেরই সুধীসমাজ সংলাপে বসে (যা সংবিধান থেকে যারা কলমের এক খোঁচায় নিশ্চিহ্ন করেছেন তাদের কাছেই) সমাধান আশা করেন কিভাবে? তারা যদি সমাধান করতেনই তাহলে তা সংবিধান হতে মুছে ফেলে এই সঙ্কটের সৃষ্টিই করতেন না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ক্ষমতার গন্ধ কেমন

রাজনীতি ঈদ ভ্যাকেশনে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব অতিক্রম করছে। এই সময়টিতে রাজপথে উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ কম। একে তো বর্ষাকাল, তার ওপর রোজা। রাজনীতির খিস্তিখেউর যা হওয়ার তা ইফতার সংস্কৃতিকে ঘিরেই হচ্ছে। ঈদ শেষে রাজনীতি যে আবার রাজপথ ধরবে তার আলামত এখন স্পষ্ট। এত দিন সরকারি দল আক্রমণ ভাগে খেলেছে। সামনের দিনগুলোতে সেই খেলা আর একতরফা থাকবে না। ইতোমধ্যে রাজনীতিতে কিছু মাত্রাগত তারতম্য ঘটে গেছে। আওয়ামী লীগ পথ আগলে থাকতে চাইলে বিরোধী দল আর ছাড় দিতে চাইবে না। এর ফলে একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এই দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের পথ ধরলে কেউ হতবাক হবে না। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাচর্চায় পরিণামদর্শী হয়নি। তারা ভুলের মাশুল বাড়িয়ে তুলতেই যেন বেশি উৎসাহী। প্রতিপক্ষ দমনের ধারাবাহিকতায় কয়েকটি দলকে ইফতার আয়োজনেও বাধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভুলের মাত্রা আরো বেশি বাড়ল। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার ভেবেছে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিলে পশ্চিমারা খুশি হবে। ভারত সাহায্য-সহযোগিতা বাড়াবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বিকশিত হবে। বাস্তবে সরকার যুদ্ধাপরাধের নামে রাজনৈতিক পেন্ডোরার বাক্স খুলে পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দিয়েছে। এখন কূটনৈতিক দেউলেপনার কারণে পররাষ্ট্রনীতি মুখথুবড়ে পড়েছে। দীপু মনির অর্ধ হাজারের বেশি হাওয়াই দৌড়ঝাঁপ কোনো সুফল বয়ে আনেনি; বরং বিদেশে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো শক্তিমান রাষ্ট্র বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে প্রভু সাজতে চাইছে। এখন গুজরাটের মুসলিম ঘাতক হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থী নরেন্দ্র মোদির কাছে ধরনা দিয়েও উপায় মিলছে না। হায়রে ক্ষমতা! বিজেপিও এখন হালাল। দেশে মৌলবাদ ঠেকানো আর ভারতে মৌলবাদ তোষণÑ এ কেমন রাজনীতি? এখন সজীব ওয়াজেদ জয়ের তথ্যতত্ত্বনিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা কোনো অসুস্থ রাজনীতির বিষয় নয়; আনকোরা রাজনীতির বিষয়। জয় রাজনৈতিকভাবে পোক্ত কেউ নন। তার বয়স, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও প্রশ্নাতীত নয়। তার ভেতর দেশজ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকটি এখনো ঠাঁই পায়নি। ফলে মন্তব্য করতে গিয়ে রাজনীতির সীমা ডিঙিয়ে ফাউল করে বসেছেন। বিরোধী দল এমন ফাউল টক হজম করতে যাবে কেন। সঙ্গত কারণেই বিরোধী দল রাজনীতির উল্টো তীরটি যথারীতি ছুড়ে দিয়েছে। এতে হয়তো সজীব তত্ত্বের বধ হয়নি। তবে আওয়ামী লীগকে রক্ষণভাগে ঠেলে দেয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই বিরোধী দলের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ছেলের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে আবার একটি ছোট ফাউল করে বসলেন। তিনি নতুন করে রহস্যময় জরিপ তত্ত্বে ঢুকে পড়লেন। বিগত দুই-আড়াই বছর ধরে প্রায় সব জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় দৈনিকগুলোর অন লাইন পাঠকজরিপ প্রকাশিত হচ্ছে। কোনো জরিপেই মহাজোট ও সরকারের পক্ষে সূচক ইতিবাচক নয়। প্রাতিষ্ঠানিক যে কটি ব্যাকরণসিদ্ধ জরিপ হয়েছে, সে গুলোতেও সরকারি দলের ও জোটের অবস্থান তলানির দিকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলও সরকারি দল ও মহাজোটের পক্ষে যায়নি। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কোন জরিপের বরাতে এই মন্তব্য করে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখলেনÑ এ প্রশ্ন ক্ষমতার মালিক জনগণের মনে জাগতেই পারে। সৈয়দ আশরাফ সেই তুলনায় সতর্ক মন্তব্য করলেন। তার পরও গন্ধতত্ত্বের জন্ম দিয়ে মানুষ হাসালেন। এসব শব্দ চয়নের রাজনৈতিক রহস্যের মাত্রাটা বুঝতে চাইলে গণতান্ত্রিক আবহাওয়ায় শব্দগুলোকে ওয়াক থু বলে ছুড়ে ফেলে দেয়া যাবে না। এর ভেতরের একটা না শোনা শব্দ শোনার চেষ্টা করা যেতে পারে। এটা শত ভাগ সত্য, হালে চুপসে যাওয়া কর্মীদের আত্মপ্রত্যয়ী করার কাজটা সহজ নয়। জয়, প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ আশরাফ দলের জনশক্তিকে চাঙ্গা করতে চান। আত্মবিশ্বাসী করতে চান। তাতে এটাও ধরে নেয়া যায়, দলের জনশক্তি আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী অবস্থায় যে নেই, তা তারাও জানেন। তাদের ভেতর একধরনের হতাশা যে ভর করেছে, তা তো লুকানো যাচ্ছে না। একটি জাতীয় দৈনিক খবর দিয়েছে, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যালয় এখন সরগরম হয়ে উঠেছে। রমরমা অবস্থা। ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছেন অনেকেই। অনেকেই ক্ষমতার স্বপ্নে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করা হয়েছে। অপর দিকে সরকারি দলের অফিসে আগের অবস্থা নেই, ফাঁকা। কোনো তদ্বিরবাজের ভিড় নেই। নেতারা অফিসে যাচ্ছেন কম, কর্মীরা ছায়া মাড়াচ্ছেন আরো কম। তার ওপর নিজেদের ভেতর খুনোখুনি লেগেই আছে। সর্বশেষ আন্তঃকোন্দলে খুন হলেন যুবলীগ নেতা মিল্কি। এখন যুবলীগ জয়কে ওবামার সাথে তুলনা করলেই কী, আর বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করলেই বা কী। তাকে রংপুর থেকে নির্বাচন করাওয়ার ঘোষণা দিলেও বাড়তি লাভ নেই। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারের একটা গুরুত্ব অবশ্যই আছে। তবে সময়বলে একটা কথা আছে। তা ছাড়া শেখ রেহানা প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে জয়ের জয়কার হওয়ার নয়। এটাও ভাবতে হবে, আজকের সময়টা সেই রক্তধারার কথা বলে কতটা বেগবান করা যাবেÑ তা কোনো ছোট প্রশ্ন নয়। মহাজোট সরকার ধনুকভাঙা পণ করে যদি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, তা রাজনীতিকে অনিবার্যভাবে সঙ্ঘাতমুখী করবেই। সেই সঙ্ঘাতের সুফল কার ঘরে উঠবে তা বলা কঠিন। তবে মহাজোট সরকার যেভাবে বাস্তবতা আড়ালে ঠেলে দুয়ে দুয়ে চারের মতো অঙ্ক মিলাতে চাচ্ছে, তা হওয়ার নয়। কারণ ভাটার সময় জোয়ারের গল্প জনমনে দাগ কাটে না। বাংলাদেশের মানুষকে অবজ্ঞা করে নরেন্দ্র মোদিদের পদধূলি নিতে দূত পাঠালে জনগণ বাহাবা দেবে কেন? অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করছেন, বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। সরকারি দল ও জোটের জনপ্রিয়তা কমেছে। এ ধরনের রাজনৈতিক মূল্যায়ন হয়তো ঠিক। কিন্তু নেগেটিভ ভোটের কথাও যদি বলা হয়, তাহলে তা কোন দিকে ঝুঁকছে তাও তো দেখার বিষয়। তা ছাড়া বিরোধী জোটের জনপ্রিয়তা বাড়েনি, ভোট বেড়েছেÑ এর অর্থ কী দাঁড়ায়, তা বুঝার মতো রাজনৈতিক জ্ঞান এ দেশের মানুষের রয়েছে। এত কিছুর পরও হাভভাব, আচার-আচরণ ও বক্তব্য-বিবৃতি প্রমাণ করছে, আওয়ামী লীগ নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভঙ্গের শেষ চেষ্টা চালাবে। তারা বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ না দেয়ার জন্য সংবিধান ও গণতন্ত্র বধ করার ঝুঁকিও নিতে চাইবে। আবার বিরোধী দলও কিছু গণভিত্তি পেয়ে যাওয়ার কারণে প্রবলভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক সমঝোতার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হলে রাজনীতি ইউটার্ন করে বাঁক ঘুরে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শক্তিমান আম্পায়ার কিংবা রেফারি ছাড়া স্থিতিশীল পরিস্থিতি আশা করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পররাষ্ট্রনীতি সাজানোর চেষ্টা করে যেসব দেশ কলকাঠি নাড়ে তারা এখন সক্রিয়। তারা সক্রিয় হলে সুফল পায় প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি, তারপর বিরোধী দল, নয়তো তৃতীয় শক্তি। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে ভালো, না থাকলে অন্য কারো হাতে যাক তাতে আপত্তি নেই, তবে কোনোভাবেই যাতে বিরোধী দলের হাতে না যায় তা নিশ্চিত করতে মরিয়া। জয়ের নিশ্চিত বিজয়ের তথ্য’, প্রধানমন্ত্রীর জরিপ’, সৈয়দ আশরাফের ক্ষমতার গন্ধ’, যুবলীগের ওবামা দর্শনকে অনেকেই সেভাবে বুঝতে চান। এখন জনগণ জানতে চাইবে ক্ষমতার গন্ধ কেমন। তথ্যের উৎস কী। জরিপটির জন্মবৃত্তান্ত ও কুষ্ঠিনামা কী! এত সব প্রশ্নের জবাব দেয়া যতটা কঠিন, জনগণের মন জয় করে আবার ক্ষমতার বৃত্তে ফিরে আসাটাও ততটা কঠিন। 


মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এত উন্নয়ন করে কী হবে? ভোট তো পাই না।’


কখনও কখনও স্তম্ভিত হয়ে যাই। কখনও কখনও আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের বক্তব্যে ঠিক দিশা করে উঠতে পারি না যে এরা  প্রকৃতিস্থ আছেন কি নেই। কিংবা গণতন্ত্রের ন্যূনতম বিষয়াদি সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা আছে কি নেই। এর আগে শ্রদ্ধেয় গবেষক রাজনীতিক শিক্ষাবিদ বদরুদ্দীন উমর এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, দেশে এখন উন্মাদের শাসন চলছে। বদরুদ্দীন ওমর কখনোই বাত কি বাত কিংবা মুখ ফসকানো কথা বলেন না। তিনি যা বলেন চিন্তা করে, হিসেব করেই বলেন। তখনো মনে হয়েছিলো শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমরই সত্য। উন্মাদের শাসনই চলছে। এখন বোধ করি, সে উন্মাদনা আরো বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ কথা আকস্মিকভাবে মনে হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা এবং সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কিছু বক্তব্য আমাদের তেমনি মনোভাব পোষণে বাধ্য করছে। তার ভেতরে কোনো স্বাভাবিকতা, গণতন্ত্রপ্রিয়তা, সহনশীলতাÑ কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগের ঘটনা আরো চমকপ্রদই ছিলো। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আপনারা কি হাতে চুড়ি পরে থাকেন? একটি লাশ ফেললে ১০ টি লাশ ফেলে দেবেন। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই হোক আর প্রতিপক্ষের সাথে বিবাদেই হোক, আওয়ামী লীগের যদি একজন কর্মীও নিহত হয়, তাহলে তারা যেন প্রতিপক্ষের ১০ জনকে খুন করে। এ কথাটিও স্বাভাবিক ছিল না। কথাটি সুস্থ মস্তিস্ক-প্রসূত হতে পারে না। সত্যি যদি এরকম ঘটত, তাহলে বাংলাদেশ খুনের উৎসবে ইতিমধ্যে জনশূন্য হয়ে পড়ত। এদেশের উর্বর মাটি সে লাশের ভার বইতে পারত কিনা সন্দেহ।
সে তো আগের আমলের ঘটনা। আমরা আশা করেছিলাম, রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী আরও পরিপক্বতা অর্জন করেছেন। এ কথা সত্য যে, যদি তাকে আঁতাতের মাধ্যমে নির্বাচন করতে না হতো, প্রকৃতপক্ষেই জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হতো, তাহলে হয়তো আমরা সেই পরিপক্বতার দৃষ্টান্ত পেতাম। কিন্তু আঁতাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার ফলে সে পরিপক্বতা অর্জন তার জন্য প্রয়োজনীয় হয়নি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হলে জনগণের কাছে যেতে হয়। তাদের মন মানসিকতা বুঝতে হয়। তাদের চাহিদা, দাবি-দাওয়া, আকাক্সক্ষার সঙ্গে একাত্ম হতে হয়। শেখ হাসিনার সরকারকে তার কোনো কিছুই করতে হয়নি। ফলে তিনি  চরম উচ্ছৃংখল আচরণ করতে শুরু করেন। তার দলের লোকেরা যখন লাশ ফেলতে শুরু করল, তখন তিনি ঐ লাশ ফেলার পক্ষে হাজার রকম যুক্তি উপস্থাপন করতে শুরু করলেন। কখনও তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যে ব্যক্তি খুন করেছে তার পিতাকে রাজাকাররা খুন করেছে। অতএব এখন যে কোনো লোককে খুন করার অধিকার তার আছে। এটিকেও বোধ করি পাগলের প্রলাপ বলে অভিহিত করা যায়। 
এটি ঘটেছিল নাটোরের বড়াই গ্রামের পৌরসভা মেয়র হত্যার সময়। যার বাবাকে কথিত রাজাকাররা খুন করেছিলো। তার বয়স তখন মাত্র কয়েক বছর হওয়ার কথা। আর নিহত পৌরসভা মেয়র মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণই করেননি। তারপরেও প্রধানমন্ত্রী নিজে কোনো ব্যক্তির হাতে হত্যার অধিকার তুলে দিয়ে গৌরব বোধ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র তো ব্যক্তিকে হত্যার অধিকার দেয় না। যদি কারো স্বজন খুন হন, তবে তিনি আদালতে সে খুনের বিচার চাইবেন। আদালত তার বিচার করবেন। তিনি যদি সরাসরি খুনী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের দেশের আইনে আদালত তাকে মৃত্যুদ- দিতে পারে। সেভাবেই খুনের বদলা হয়। কিন্তু লাশ ফেলে দেয়া কিছুতেই আইনের শাসন নয়। যেখানে খোদ প্রধানমন্ত্রী আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, সেখানে অন্য নাগরিকের কাছ থেকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা আশা করা যায় না। এতে সমাজে ব্যাপক অরাজকতার সৃষ্টি হয়। গত সাড়ে চার বছরে সরকার তেমন এক ভয়াবহ অরাজকতাই সৃষ্টি করেছেন।
সে অবস্থা বাড়তে বাড়তে এখন এক উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে। যেন উন্মাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আফগানিস্তানে বাদশা আমানুল্লাহর পতনের পর এক ডাকাত দল রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলো। সে ডাকাত দলের সর্দারের নাম ছিলো বাচ্চায়ে শকাব। সে ক্ষমতা গ্রহণ করে খুন-খারাবি, লুণ্ঠন, খেয়ালখুশি মতো আইন জারি করে মাস খানেকের মধ্যে পুরো সমাজ একেবারে তচনছ করে দিয়েছিলো। এখন দেশে যেন সেই বাচ্চায়ে শকাবের শাসন চলছে। সরকার ভাবতে শুরু করেছে যে, এই রাষ্ট্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূমি, এইসবটুকুই তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। আর জনগণ যেন তাদের দাসানুদাস প্রজা। সম্রাটের কথার বাইরে যদি প্রজা যায়, তাহলে তার কপালে দুঃখ আছে। সেই অবর্ণনীয় দুঃখের ভার এখন আমরা প্রতিটি নাগরিক বয়ে বেড়াচ্ছি। সে ভার ক্রমশই দুঃসহ হয়ে ওঠছে। ১৬ কোটি মানুষ যদি এই দুঃসহ বোঝার ভার সরকারের মাথার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেন, তবে যে এই সরকার ধূলোয় মিশে যাবে, সে কা-জ্ঞান সরকারের লুপ্ত হয়েছে।
অতিসম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি উদাহরণ দিলে এর একটি খ- চিত্র পাওয়া যেতে পারে। তা হলো, (১) মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত দৃষ্টিকটু মনোভঙ্গি। কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজ দলের লোকদের সরকারি চাকরিতে ঢোকানোর যে মহাপরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছে, তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রতিবাদে নেমেছিলো মেধাবী ছাত্ররা। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)-এর চাকরি ক্ষেত্রে দেখা গেলো যে, পরীক্ষায় ৮০ নম্বর পেয়েও কেউ কেউ পাস করতে পারেনি। আবার ৫০ নম্বর পাওয়া অনেককেই পাস করিয়ে দেয়া হয়েছে। আর কোটা ব্যবস্থা খেয়ে ফেলছে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ চাকরি। এরই প্রতিবাদে একদিন রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত শাহবাগ চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলো মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তারা কোটা ব্যবস্থার বাতিলের দাবি জানাচ্ছিলো। সরকার প্রজন্ম চত্বর নামে শাহবাগে এক বান্দরের খেলার আয়োজন করেছিলো। প্রায় মাস দেড়েক ধরে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ও মদদে সে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হয়। সন্দেহ নেই, এই দীর্ঘ সময় ধরে শাহবাগ এলাকায় অবস্থিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালসহ পুরো ঢাকা শহরে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। সরকার খাদ্য দিয়ে, পানি দিয়ে, সিসি ক্যামেরা বসিয়ে, ভ্রাম্যমান টয়লেট বসিয়ে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলো। কিছু অপগত লোক সেখানে গান-বাজনা, ঢোল-ডাগড়া বাজিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে নেমেছিলো। করতালি দিতে গিয়ে হাজির হয়েছিলো সরকার দলীয় লোকেরা। ভারত থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিলো আরও কিছু খোল-করতাল বাঁদর। খোদ ভারত সরকারের প্রতিনিধি বলেছিলেন, প্রজন্ম চত্বরের এই সং-যাত্রার প্রতি তাদের সমর্থন রয়েছে। এটি বেশ ভালো কথা। কারণটা কি? কারণটা নাকি তারুণ্যের উত্থান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার মন পড়ে থাকে শাহবাগে। আর কী দারুণ ব্যবস্থা! শাহবাগীরা অল্প সময়ের মধ্যেই সরকারের উপর সরকার হয়ে উঠলো।
তারা বলল, ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বালাও। মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হলো। তারা বলল, স্কুল-কলেজে জাতীয় পতাকা তোলো। জাতীয় পতাকা উঠে গেলো। তারা বললো, সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা তোলো। সরকার জাতীয় পতাকা তুলে দিলো। নাটক এই পর্যন্ত হলে বোধ করি এ বিষয়ে আর কোনো কথা থাকতো না। কিন্তু এক সময় দেখা গেলো এই শাহবাগীরা মুক্তিযুদ্ধের নামে ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্লগে উচ্চারণ-অযোগ্য কটূক্তি করতে শুরু করে দিল। আর এর ভেতর দিয়েই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটলো। সঙ্গতভাবেই বলা যায়, যদি শাহবাগীদের এই উত্থান না ঘটানো হতো তাহলে হয়তো এমন তীব্র আকারে হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটতো না। খানিকটা প্রসঙ্গান্তরে এসে গেছি।
আমরা আলোচনা করছিলাম মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে। তারা শাহবাগে একদিন বিক্ষোভ করেছিলেন মেধার স্বীকৃতির দাবিতে। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির চোখে তা ছিল যার পর নাই ঔদ্ধত্য। মেধা আছে, অথচ রাষ্ট্রশক্তির অনুগত নয়, এমন মেধার চাইতে রাষ্ট্রশক্তির অনুগত মেধাহীন অস্ত্রবাজরাই সরকারের কাছে অধিক প্রিয় হয়ে ওঠে। আর তাই, দ্বিতীয় দিন তাদের শাহবাগে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। পুলিশ আর ছাত্রলীগ মিলে ধুম পিটিয়ে তাদের এলাকা ছাড়া করে দিয়েছিল। এতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
আমরা ভেবেছিলাম, সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেধাবীদের জন্য একটি সম্মানজনক সুরাহার কথা বলবেন। কিন্তু বেলারুশে ভাগ্নির বিয়ে থেকে ফিরে তিনি এমন কথা বলে বসলেন যাতে চমকে উঠতে হলো। বিসিএস পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীদের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর করে, স্থাপনা ধ্বংস করে, তারা কীসের মেধাবী? মেধাবীরা এ ধরনের কাজ করতে পারে না। যারা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত, তাদের পিএসসির অধীনে কোনো চাকরি হবে না। যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করেছে, তা-ব চালিয়েছে, তাদের ছবি সংরক্ষণ করে পিএসসিতে পাঠানো হয়েছে। ছবি দেখে ভাইভা নেয়া হবে। তাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকরি হবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে খাটো করে দেখতে চায়, গাড়ি ভাঙচুর করে, তাদের চাকরি হওয়ার অধিকার নেই।
তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলন করা হচ্ছে। মেয়েদের কোটা দেয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কিসের আন্দোলন? মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাটো করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা যদি ঝুঁকি নিয়ে দেশ স্বাধীন না করতো, তাহলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনই হতো না। তাদের অবদানকে খাটো করার জন্য কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? মেধাবী ছাত্ররা গাড়ি পোড়ায় না। উচ্ছৃংখল হতে পারে না। এরা কি চাকরি পাওয়ার যোগ্য? তাদেরকে যারা উস্কানি দিচ্ছে, তারা কি আগামীতে রাজাকার, আল বদর কোটা দিয়ে দেশ চালাবে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা এদের উস্কানি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আন্দোলন করে অন্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। যারা গাড়ি ভাঙচুর করে, স্থাপত্য ভাঙচুর করে, তারা কতটুকু মেধাবী? তাদের মেধা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এ কথার মধ্যে যতটুকু আবেগ আছে তার সামান্যও যুক্তি নেই। এবং তা প্রকৃতস্থ কথাও নয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, জাতির উন্নতি চাইলে মেধার মূল্য দিতেই হবে। মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে। তাদের আর কোটার প্রয়োজন নেই। তারা পুরুষকে ডিঙিয়ে প্রতিযোগিতায়ই অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বেলায় যা সত্য ছিল, তা তাদের ছেলে মেয়ে, নাতি-নাতনীদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে না। আর বহু মুক্তিযোদ্ধা নিতান্তই দিন-মজুর ছিলেন। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। তারা কোটার খবর রাখেন না। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াইয়ের ডাকে তারা শরীক হয়েছিলেন, দায়িত্ব হিসেবে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তাদের কর্তব্য সাধিত হয়েছে। তারা আবার স্ব স্ব পেশায় ফিরে গেছেন। কোনোদিন কোটার খবর নেননি। পাকিস্তানীদের হেফাজতে থেকে শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার বড় বেশি খবর নিচ্ছেন।
এরপর ২৪ জুলাই কালের কণ্ঠ খবর দিয়েছে যে, “তিন সিটি উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত/ প্রধানমন্ত্রী বললেন, অনুমোদন দিলে নির্বাচিতরা বসে বসে খাবেন।” ঐ খবরে বলা হয়েছে, বরিশাল, সিলেট ও খুলনার উন্নয়নে নেয়া দু’টি প্রকল্প অনুমোদন করেনি জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী ২৮২ কোটি টাকা খরচে বরিশাল ও সিলেট মহানগরীর রাস্তাঘাট উন্নয়ন, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন এবং ৮১ কোটি টাকার খুলনা রেল স্টেশন ও ইয়ার্ডের রিমডেলিং এবং বেনাপোল রেল স্টেশন উন্নয়ন বরাদ্দ স্থগিত করে দেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এত উন্নয়ন করে কী হবে? ভোট তো পাই না। আমরা ক্ষমতায় এসে দেশের এত কাজ করি, অথচ জনগণ আমাদের উন্নয়ন দেখে না। আর ভোটই যদি না পাই, তাহলে কার জন্য উন্নয়ন করবো?” তিনি বলেন, এ দুটো প্রকল্প অনুমোদন দিলে, যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, তারা এই ঘরে বসে বসে খাবেন। এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী আরও নানা ধরনের অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলেন। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, এই তিনটি সিটি করপোরেশনসহ মোট পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত জোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। জনগণ কেন শেখ হাসিনার দলকে ভোট দিল না, তার মাশুল হিসেবে তাদের করপোরেশনে উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেয়া হলো। এ উন্নয়ন কাজ যদি হতো, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দলের লোকদের যারা ভোট দিয়েছিল, সেই বিপুল সংখ্যক লোকও উপকৃত হতো। তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী কী বাণী পৌঁছাবেন, বলা দুষ্কর।
আপাতত সর্বশেষ আরও একটি অপ্রকৃতস্থ সমালোচনা আমরা করতে চলেছি। আর তা হলো, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলোতে সরাসরি মেয়র পদে নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগ একেবারেই জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, অতএব চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে যে, সরাসরি জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচন আর নয়। ষাটের দশকের জেনারেল আইয়ূব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের ধারায় দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সে ধারা হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রথমে কাউন্সিলর নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ কমিশনার। এই কমিশনাররা ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচন করবে। সেক্ষেত্রে কেউ যদি এমন কি কোটি টাকার ঘুষ দিয়েও একজন কমিশনারকে কিনে নিতে পারেন, তাহলে জয় তার সুনিশ্চিত। জনগণ বড় বাজে ব্যাপার। শত উন্নয়ন করলেও ভোট দিতে চায় না। ধিক্ এই জনগণকে।
এর সকল কিছু উন্মাদ কর্মকা- বলে প্রতিভাত হচ্ছে। সরকার সম্ভবত নিজেও জানে না, তারা কোথায় যেতে চায়, কী পেতে চায়, কী করতে চায়। ক্ষমতা যে পেতে চায় তা বুঝি। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতা পেতে চাই। জনগণ-ফনগণ বুঝি না। তাই কি কখনও হয়? অতীতেও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। জনগণ যাতে ভোট দেয়, সরকারকে সেই মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতি

নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন গণতন্ত্রেরই নিয়ামক। নির্বাচন নির্ধারণ করে কোনো দল বা গোষ্ঠী তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে। মানবজাতির পার্লামেন্ট গণতন্ত্রকে একটি জাতির অবাধ মত প্রকাশের বাহন মনে করে। গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন সম্মতির নির্ধারক মনে করে (জাতিসঙ্ঘ : ২০০৫ : ১) এই উপমহাদেশ শাসনপদ্ধতি হিসেবে স্বভাবতই গণতন্ত্রকে ধারণ করে এবং বিশেষত ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদীয় গণতন্ত্রকে লালন করে। কিন্তু শাসনপদ্ধতি হিসেবে দৃশ্যত গণতন্ত্র অনুসৃত হলেও জীবনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র আজ উপমহাদেশের মাটিতে সুপ্রোথিত নয়। যেহেতু রাজনীতিই গণতন্ত্রের উপজীব্য অথবা গণতন্ত্রই রাজনীতির বৈধ বাহন, তাই রাজনীতি-কেন্দ্রিকতাই এ উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যবিধাতা। গোটা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি নির্ভর করছে এ উপমহাদেশের সতর্ক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার উত্তরণ এবং উন্নয়ন নির্ভর করে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর। উপমহাদেশে ক্রান্তিকাল পালাবদলের হাওয়া বইছে সর্বত্র। পাকিস্তানে তাদের নিজস্ব ধরনের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ ক্ষমতায় এসেছে। সেকুলার পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। কারণ, পাকিস্তানে বেসামাল রাজনীতি সামাল দিতে পিপিপি ব্যর্থ হয়েছে। ভারতে সেকুলার কংগ্রেস জোট সরকারের অবস্থা দোদুল্যমান। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের মতো দুর্নীতির রাহুগ্রাস কংগ্রেসকে পেয়ে বসেছে। সেখানে আগামী বছর (২০১৪ সালে) নির্বাচন হওয়ার কথা। নরেন্দ্র মোদির মতো কট্টর মৌলবাদী ক্ষমতার মসনদে বসার খোয়াব দেখছে। শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক সরকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বৈদেশিক অভিযোগ অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। নেপাল অস্থিরতা অতিক্রম করে নির্বাচনমুখী হয়েছে। সেখানেও আগামী বছর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। হিমালয় রাষ্ট্র ভুটানে নির্বাচন হয়েছে সম্প্রতি (১৪ জুলাই, ২০১৩)। সেখানে দ্বিতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)। মালদ্বীপ নির্বাচনমুখী। অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। আগামী অক্টোবর থেকে জানুয়ারির মধ্যে একটি সাধারণ নির্বাচনের তোড়জোড় লক্ষ করা যাচ্ছে। উপমহাদেশের সব রাষ্ট্রবলয়ে পরিবর্তন তথা ক্ষমতাসীনদের পরাজয় এবং বিরোধী দলের ক্ষমতারোহণ বাংলাদেশকেও সেভাবে প্রভাবিত করছে। লক্ষণীয়, বেশির ভাগ দেশে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতি ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের উত্তরাধিকার মোটামুটি সব দেশে বর্তমান থাকলেও ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশির ভাগ দেশে বেগবান হয়নি। পাকিস্তানে কর্তৃত্ববাদী এবং সামরিক সরকারের সমাহার লক্ষ করা গেছে এর অস্তিত্বকালের বেশির ভাগ সময়ে। শ্রীলঙ্কা একটি ভারসাম্যপূর্ণ শাসন কাঠামো নিয়ে ভালোই এগিয়েছে। নেপাল রাজা বীরেন্দ্রের অধীনে স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিল। মাওবাদী বিপ্লব আর ভারতবাদী কংগ্রেসের দোটানায় দেশটি জর্জরিত। মালদ্বীপ প্রথম থেকেই রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা অনুসরণ করছিল। ভুটানে রাজতন্ত্র এখনো বিরাজমান। ভারত ছাড়া নির্বাচনী রাজনীতি আক্রান্ত উপমহাদেশের সব দেশ। ভারতের কণ্টকাকীর্ণ প্রাথমিক বছরগুলো আলোকিত রাজনীতিবিদ এবং নিয়মতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত হয়েছে বলে নির্বাচনকালীন আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ গণতন্ত্রায়নে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও নির্বাচনপদ্ধতি প্রাতিষ্ঠনিকতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট উপমহাদেশের সব দেশে সবকালে কিছু না কিছু ছিল। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিরোধী আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। সব সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে একটি নতুন সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি সরকার ‘নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠিত করে। সেই থেকে সব জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতদসত্ত্বে¡ও পরাজিত দলটি সূক্ষ্ম অথবা স্থূল কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উত্তরাধিকার প্রশ্নে প্রধান দু’দলে আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট সৃষ্টি হয়। রাজপথে দু’দলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর প্রকারান্তরে সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। অবৈধ সরকার দু’বছর ক্ষমতাসীন থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত সমর্থন এবং ভারতের বস্তা বস্তা টাকার বিনিময়ে (দ্য ইকোনমিস্ট, জানুয়ারি ২০১০) আওয়ামী লীগ দেশের ক্ষমতা করায়ত্ত করে। ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত দুঃশাসনে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হিমাঙ্কে নেমে আসে। (বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন দৈনিকের জনমত জরিপে তা প্রতিফলিত সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উদাহরণ)। আওয়ামী লীগ অব্যাহত জনপ্রিয়তা কমে যাওয়াকে ইতিবাচক পথে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা না করে অকল্পনীয় দমনপীড়নের আশ্রয় নেয়। দৃশ্যমান জনরোষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব নয় ভেবে আওয়ামী লীগ তাদেরই সৃষ্ট নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। কোর্টের একটি রায়ের দোহাই দিয়ে ‘অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক’Ñ এ ধুয়া তুলে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। পরপর আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনেরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে তা প্রত্যাখ্যান করে। সৃষ্টি হয় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলম্বিত রাজনৈতিক সাংবিধানিক সঙ্কট। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট বর্তমানে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অব্যাহত আন্দোলন গড়ে তুলছে। সিটি করপোরেশনের প্রাথমিকভাবে চারটি এবং অবধারিত ভাগ্য নিয়ন্ত্রক অপর নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হলে প্রতিকূল আবহাওয়া অনুকূলে প্রবাহিত হয়। গোটা রাজনৈতিক সমীকরণের এ নতুন মেরুকরণ প্রত্যাশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি ইতোমধ্যে নির্মাণ করেছে। নির্বাচনী সমস্যা নির্বাচন প্রক্রিয়ার দীর্ঘ জটিল এবং বাস্তব সমস্যাগুলোকে আমরা দু’ভাবে ভাগে করতে পারি। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা : আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে উদ্ভূত পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট। প্রক্রিয়াগত সমস্যা : ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা, ফলাফল প্রকাশ ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যা। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তত্ত্ব। সনাতনী সংসদীয় পদ্ধতি অনুযায়ী মেয়াদ শেষে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের নির্বাচনী ইতিহাস বলে নির্বাচন কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হয় না। সমাজতান্ত্রিক প্রথা পদ্ধতিতে দলীয় কাঠামো বা নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার অবকাশ নেই। কর্তৃত্ববাদী অর্থাৎ স্বৈরাচার, রাজা-বাদশাহ, আমির ওমরারা যেভাবে নির্দেশ করেন, সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আবার আধা কর্তৃত্ববাদী আধা গণতন্ত্রবাদী নির্বাচনে দৃশ্যমান গণতন্ত্রের লেবাস বহাল রেখে মিশ্রণের মিথষ্ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এভাবেই একদা গণতন্ত্রের জন্য নানা উপাদেয় বিশ্লেষণ যোগ করা হয়েছে। যেমনÑ আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রীদের শোষিতের গণতন্ত্র, জামাল নাসেরের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র এবং সুকর্নোর নির্দেশিত গণতন্ত্র। আমাদের দেশের প্রবর্তিত বাকশালকেও শোষিতের গণতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়েছিল। এসব ব্যবস্থা বাতিকগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ব্যবস্থা মাত্র। যা ‘গণতন্ত্র’ নামক জনপ্রিয় শব্দ দিয়ে স্বৈরাচারকে জায়েজ করার শামিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করে নিচে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করা যায় : বিশুদ্ধ ভোটার তালিকা প্রকাশ, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছ নিবন্ধন, নির্বাচনী এলাকার যৌক্তিক সীমানা নির্ধারণ, দুর্নীতিবিহীন মনোনয়ন, নির্বাচনী ব্যয়ে স্বচ্ছতা, নির্বাচনী প্রচারণায় নীতিমালা মেনে চলা, ভোট গণনায় স্বচ্ছতা, ফলাফল নিশ্চিত করা, ফলাফল প্রকাশ বা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং সার্বিক সততার সাথে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাকউনালের মতে, একটি নির্বাচন তিনটি মৌলিক কার্যক্রম বিবেচনা করে। প্রথমত, একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাধীনে ক্ষমতার পালাবদল সম্পন্ন করে। মোদ্দাকথা সরকারই এ দায়িত্ব পালন করে। দ্বিতীয়ত, প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। শাসক ও শাসিতের সংযোগ সাধন করে। শাসিতের পক্ষ থেকে শাসকের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে। মূলত নির্বাচন কমিশন সরকারের পক্ষ থেকে কাজটি সম্পন্ন করে। এবং তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করে। অন্যভাবে বলা যায় রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ সাধন করে। রাজনৈতিক দল নির্বাচন অথবা অন্য সময়ে তার আদর্শ, দীক্ষা ও কর্মসূচি অনুযায়ী জনসাধারণকে সংগঠিত ও প্রভাবিত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস সব ক্ষমতাসীন মহলের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অদম্য মানসিকতা, বাংলাদেশ সমাজব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থাÑ সব বিষয় বিবেচনা করে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করে ইতঃপূর্বে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। (দৈনিক প্রথম আলো, প্রকাশিত জরিপ, ১১ মে ২০১৩)। অথচ নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে ক্ষমতাসীন সরকার ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন না দেয়ার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর কারুকার্যেও ক্ষমতা অব্যাহত থাকার কলাকৌশল আছে বলে আইনবিদেরা সতর্ক করছেন। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। উত্তরণের উপায় উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুগ পথে পরিচালিত করার জন্য দুই ধরনের পদক্ষেপের চিন্তা করা যায়। একটি আপাত সমাধান আর একটি স্থায়ী সমাধান। যেকোনো সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ হলো পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা। প্রধানমন্ত্রী দেশের শীর্ষ এবং প্রধান নাগরিকদের দেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার সঙ্কট সমাধানে নানা ফর্মুলা নাকচ করেছেন। অপর দিকে বিরোধীদলীয় নেতা কয়েকটি পর্যায়ে কাক্সিত ছাড় দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক বনাম অন্তর্বর্তীকালীন বিতর্কে বিরোধী পক্ষ নমনীয়। অপর দিকে পার্লামেন্টের কাঠামোর মধ্যে অথবা বাইরে কোনোটিতেই খালেদা জিয়া না বলেননি। কয়েক দিন আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ সেমিনারে সরকার পক্ষ অনমনীয়তা প্রদর্শন করে। দেশী-বিদেশী প্রেসারে আক্রান্ত আওয়ামী লীগ সংলাপে এক সময় রাজি হয়েছিল। শোনা যাচ্ছে, এটা ছিল তাদের উত্তরণ কৌশল। এখন সিটি করপোরেশনে ভরাডুবির পর একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তাদের কী সংলাপ বা একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নিয়ে যায় কি নাÑ রাজনৈতিক সচেতন মহল তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইতঃপূর্বে হার্ডলাইন অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সবার ধারণা। সুতরাং একটি সমঝোতা নাগরিক সাধারণের মধ্যে স্বস্তি এনে দেবে। এ প্রত্যাশিত সংলাপে সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে রাষ্ট্্রপ্রধান উদ্যোগ নিতে পারেন। রাষ্ট্্রপতির পদটিকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা হয়। সবশেষ উপায় হচ্ছে গণভোটে যাওয়া। ইতঃপূর্বে রাজনৈতিক মহলে গণভোটের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। সাংবিধানিক বিতর্কে গণভোটই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেন না, ক্ষমতাসীনেরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক দাবি মেনে নেবে। তাহলে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে বিরোধী দল উদ্দিষ্ট গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন। স্থায়ী সমাধান স্থায়ী সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়Ñ ০১. রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তি নির্মাণ করা, ০২. বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়ী সাংবিধানিক কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, ০৩. নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর কমিশন হিসেবে ক্ষমতায়ন, ০৪. ইলেকশন কমিশনে শুধু আমলাদের প্রাধান্য না ঘটিয়ে বিশেষজ্ঞদেরও অগ্রাধিকার দেয়া, ০৫. নির্বাচন কমিশন সার্ভিস নামে আরেকটি সার্ভিসের উদ্বোধন। কমিশন সচিব বাইরে থেকে না নিয়ে একটি স্থায়ী বিশেষজ্ঞ বলয় তৈরি করা, ০৬. নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ০৭. নির্বাচন কমিশনের কাঠামো পুনর্গঠন করা, ০৮. নির্বাচন ব্যবস্থা অঞ্চলভিত্তিক না হয়ে রাজনৈতিক দলের ভোটানুপাতে অর্থাৎ সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা নেয়া, এবং ০৯. সমঝোতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ও লালন। গণতন্ত্র বনাম নির্বাচনতন্ত্র আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে গণতান্ত্রিক প্রথাপদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আসছে। পাশ্চাত্যের অনুসৃত গণতন্ত্র যে সর্বাংশেই আমাদের জন্য যুতসই এমনটি নয়। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা এশিয়া গণতন্ত্র বা প্রাচ্য গণতন্ত্রের কথা বলে আসছেন। সাম্প্রতিককালে গবেষণা সমীক্ষা শেষে একদল পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস এবং বাস্তব অবস্থা নির্ণয় করে একে গণতন্ত্র না বলে নির্বাচনতন্ত্র বলতে চাচ্ছেন। এর কারণ হলো, শুধু সরকার পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে এসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে। গণতান্ত্রিক প্রথাপদ্ধতি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং মৌলিক জীবনবোধ হিসেবে গণতন্ত্র এসব দেশে অনুসৃত হচ্ছে না। জয়ী পক্ষ দেশ শাসনে রাজতন্ত্রের মতোই আচরণ করছে। উপসংহার : নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের বিকাশ, লালন ও প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচনী সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ সময়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সুনির্বাচন নিশ্চিত করার প্রকৃষ্ট পন্থা। অবিলম্বে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ সচল, সবার মতের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য পদক্ষেপ অর্থাৎ সমঝোতার আয়োজন, সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেয়া জাতির প্রয়োজনেই জরুরি। সব রাজনৈতিক পক্ষের উচিত গণতন্ত্রের স্বার্থে, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে, জাতির স্থিতিশীল শান্তির স্বার্থে নির্বাচনকে সঙ্কট মোচনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রমজান মাসে সেই আবেগের দিনে


রমজান মাস। ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালকে ঘিরে রেখেছিল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী। ওই দিন তারেক রহমান জামিনে মুক্ত হওয়ার পর হাসপাতালের বারান্দার পাশে ছোট একটি ক থেকে উঁচু জানালা দিয়ে হাতের ইশারায় জানিয়ে দেন আমি জামিনে মুক্ত, এরপর ৫৪৬ দিন প্রতীা শেষে সোমবার ১১ সেপ্টেম্বর ১০ রমজান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য সেই দিন লন্ডন চলে যান। এখন সবার প্রত্যাশা তারেক রহমান দ্রুত সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে সম্ভাবনাময় দেশকে আগামী দিনে অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উজ্জ্বল করে তুলবেন। তিনি শহীদ জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরি। তারেক রহমান সম্ভাবনাময় এক তরুণ নেতা হিসেবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব দায়িত্ব নেয়ার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী দল গোছানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তার সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির সফলতায় সমাজের সর্বস্তরে তিনি গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এক দিকে সরকারের রাষ্ট্রীয় সব সফল কর্মসূচি, অন্য দিকে তারেক রহমানের দলীয় সফল কর্মসূচি এটিই হয় তার প্রতিপরে ঈর্ষার কারণ। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তে ঈর্ষাকাতর হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এসব ষড়যন্ত্র ব্যাপকভাবে দেশ-বিদেশে প্রচার প্রপাগান্ডার সহযোগী হয়ে আবির্ভূত হয়। একই ধারার কিছু বুদ্ধিজীবী, সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মী নানা কিসসা কাহিনীর মধ্য দিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করতে থাকে। বিশেষ করে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা, একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ছিল সুশীলসমাজ পরিচয়ধারী কিছু বুদ্ধিজীবী। এসব প্রচারণার মাধ্যমে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। এই প্রচারণার সুযোগে পশ্চিমা বিশ্ব সক্রিয় হয় ইসলামবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নে। এক দিকে মিডিয়া ও সুশীলসমাজের নামধারী দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা, অন্য দিকে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ধ্বংসাত্মক আন্দোলন। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এ রাজধানীর পল্টনসহ কয়েকটি এলাকায় আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডবলীলায় প্রায় ২১টি তাজা প্রাণ হারায়। দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এমন প্রপাগান্ডা শুরু হয়। দেশকে বাঁচানোর কথা বলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জরুরি আইন জারির মধ্য দিয়ে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুরু হয় গভীর ষড়যন্ত্র, দেশের দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ দুই নেত্রীসহ অংখ্যক রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের ভেতরের একটি অংশ গোপন অভিলাষে আরো একটি কার্যক্রম শুরু করে, যার নাম দেয়া হয় ‘সংস্কার’। সরকারের ভুলনীতির ফলে ‘সংস্কার’ কার্যক্রম দেশ ও জনগণের তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ভাঙার আয়োজন। সরকারের ছত্রছায়ায় দলের অতীতের সুবিধাভোগী অংশটি বিপ্লবী হয়ে ওঠে। জরুরি আইনের মধ্যে রাজনৈতিক দলের মূল স্রোতাধারা সরকারের আক্রমণের ল্যবস্তুতে পরিণত হয়। দলীয় প্রধানসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে, নেতাকর্মীরা দিশেহারার মধ্যেও প্রায় দুই বছর বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতি তাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রকাশ ঘটিয়েছে। এর প্রকাশ ঘটে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বেগম খালেদা জিয়া ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জামিনে মুক্তি হয়ে জনসমুদ্রে আসেন। তারেক রহমান বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশত্যাগ করেন। সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই লন্ডনে যুক্তরাজ্যে বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিল-পূর্ব এক আলোচনা সভায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নয়নের রূপরেখা উপস্থাপন করেন। যে রূপরেখায় তিনি বলেছেন, ‘অতীতমুখিতা নয়, দৃষ্টি দিতে হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দিকে।’ ঠিক একইভাবে ২১ জুলাই জাতীয় সংসদ মেম্বার হলে মহানগর বিএনপি আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন বক্তব্যে বলেছেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে নতুন ধারার, আমরা যদি নির্বাচিত হতে পারি তবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৎ ও যোগ্যদের নিয়ে দেশ পরিচালিত করব। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তব্যের পর দেশবাসীর প্রত্যাশা জাতির ঘনঘোর দুর্দিনে তারা সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন। তবেই ১৬ কোটি জনগণের সেই দিনের আবেগ-অনুভূতির শেষ পরিণতি শুভ হবে।

সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জামায়াত-আওয়ামী লীগ সমঝোতার গুজব ও বাস্তবতা


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বেশ কিছুকাল ধরে জামায়াতকে উপলক্ষ করে মজার মজার ঘটনা রটনার পর এখন নতুন আরেকটি কথাও শোনা যাচ্ছে। সরকারপন্থী একটি দৈনিক সপ্তাহ দুয়েক আগে এই মর্মে একটি খবর প্রকাশ করেছিল যে, মার্কিন দূতাবাসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। খবরটিতে বলা হয়েছিল যে, এই চেষ্টার উদ্যোক্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা গওহর রিজভী মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। এ ব্যাপারে তিনপক্ষের মধ্যে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এ বৈঠকসমূহে জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী বরাবর উপস্থিত ছিলেন। এক্ষেত্রে এই বৈঠকসমূহে মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিসেবে যা স্থান পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে আগামী সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ। জামায়াত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, আঠারো দলীয় জোট থেকে বিশেষ করে বিএনপি বলয় থেকে সংগঠনটি বেরিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শর্ত অনুযায়ী কেয়ারটেকার সরকারের দাবি প্রত্যাহার করবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। বিএনপি এবং আঠারো দলীয় জোটের অন্যান্য শরীকরা যদি নির্বাচনে না যায় এবং কেয়ারটেকার সরকারের প্রশ্নে অনড় থাকে তাহলেও জামায়াত, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচন করে ফেলবে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিনিময়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সকল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং যে সমস্ত মামলায় ইতোমধ্যে দ-াদেশ ঘোষিত হয়েছে সে সমস্ত মামলাও কিভাবে সুরাহা করা যায় সে সম্পর্কে সরকারি দলের তরফ থেকে কৌশল অনুসন্ধান করে দেখা হবে। এক্ষেত্রে জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা করার জন্য যে যুক্তিটি উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে জামায়াতের দুর্দিনে বিএনপি’র নির্লিপ্ততা’। বলা হচ্ছে যে, একটা অন্যায় এবং প্রতিহিংসামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার গত সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার ও অবিচার চালাচ্ছে শরীক দল হিসেবে বিএনপি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি আবার যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে সম্পৃক্ত করার যে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক অভিযোগ সংগঠনটি ও তার নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা মিথ্যা জেনেও বিএনপি চুপ থেকেছে এবং আছে। জামায়াত কর্মীদের মধ্যে বিএনপি বিরোধী এই সেন্টিমেন্ট তৈরির কাজে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
পাঠকরা হয়ত স্মরণ করতে পারেন যে, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিএনপিকে জামায়াত থেকে এবং জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সরকারের ধারণা বিএনপি এবং জামায়াত যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে সরকারের পক্ষে নির্বাচনে জেতা খুবই কঠিন। আর যদি এই দুটি দলকে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে নিয়ে আসা যায় তাহলে নির্বাচনে জেতা তাদের জন্য নস্যি মাত্র। এই প্রেক্ষিতে সরকারের সর্বশেষ উদ্যোগকে অস্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়ত যায় না। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না, অন্তত জামায়াতের ন্যায় একটি আদর্শবাদী দল হিসেবে। কেননা আমি ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতকে রাজনীতিতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত আদর্শের সাথে আপোষ করতে দেখিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী পর্যন্ত সকলের ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন, জুলুম-নির্যাতন, গ্রেফতার-রিমা- প্রভৃতি পৈশাচিক কর্মকা- চালিয়েছে তা ফেরাউনী নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে। শুধু দৈহিক নির্যাতন নয় আর্থিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রেও এই সরকার স্মরণাতীতকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় সবকিছু ভুলে গিয়ে জামায়াত তারই হাতে গড়া আঠার দলীয় জোট ভেঙে আওয়ামী লীগের ন্যায় একটি অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী, বিশ্বাসঘাতক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ দলের সাথে আঁতাত করে আওয়ামী লীগের নীল নকশা অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবে একথাটি বিশ্বাস করার মতো কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমি খুঁজে পাই না। জামায়াতের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সরকার প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দিচ্ছেন না। দলটির কেন্দ্রীয়, মহানগর এবং অধিকাংশ জেলা অফিস বন্ধ। বহু কেন্দ্রীয় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এখন হয়ত জেলে, না হয় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা অমানবিক জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন। দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকা সম্প্রতি তার এক রিপোর্টে বলেছে যে, সরকার জামায়াতের নাড়িভুড়ি বের করে ফেলেছে। পত্রিকাটির এই মন্তব্য যদি সত্যও হয় তথাপিও আমি জামায়াতের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কোন লক্ষণ এখনো পর্যন্ত দেখিনি। তারা বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ এবং পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের মধ্যে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করার কোন প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় যে গুজবটি বাজারে রটেছে তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং যুক্তরাজ্য থেকে বেশ কিছু টেলিফোন আমি পেয়েছি। টেলিফোনকারীরা জানিয়েছেন যে, ঐ সমস্ত দেশেও ইে গুজবটি ছড়িয়ে পড়েছে এবং পক্ষে-বিপক্ষে পত্র-পত্রিকায় নানারকম মন্তব্য প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোও এ থেকে বাদ পড়েনি।
রাজনীতি জামায়াতের মৌলিক অধিকার। জামায়াত যে রাজনীতি করে তা ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনীতি এবং এই রাজনীতিতে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করার কোন বিধান নেই। জামায়াতের দু’জন মন্ত্রী বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছর মন্ত্রিত্ব করেছেন এবং অত্যন্ত সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তারা একটি রেকর্ডও সৃষ্টি করেছেন। দল ও স্বজনপ্রীতির অবৈধ কোন রেকর্ড তারা রাখেননি। তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের মন্ত্রিত্ব থেকে কোন বেনিফিট পায়নি। অভ্যন্তরীণ সফরে তারা রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তায় এন্টাইটেল্্ড্্ হলেও তারা তা গ্রহণ করেননি। দলীয় আতিথেয়তায় তারা সরকারি কাজ করেছেন। যেখানেই গেছেন দল তাদের খরচ বহন করেছে। সরকারি খরচ কমেছে। বিগত সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমান সরকার তন্ন তন্ন করেও তাদের দুর্নীতি অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারের কোন নজির খুঁজে পাননি। এতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং তাদের এই প্রতীতি জন্মেছিল যে জামায়াতকে যদি স্বাভাবিক গতিতে তার আদর্শিক রাজনীতি চালিয়ে যেতে দেয়া হয় তাহলে আগামী নির্বাচনসমূহে দলটি প্রথম সারিতে চলে আসবে এবং তাদের রাজনীতি অচল হয়ে পড়বে। কেননা মানুষ সৎ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিক পেলে অসৎ, অযোগ্য ও ভাঁড়দের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নির্বাসনে পাঠাতে ভুল করবে না। জামায়াতও ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যত ক্ষোভ, ঘৃণা বিদ্বেষ, নির্মূল অভিযান, জুলুম, নির্যাতন তার সবকিছুর পেছনে রয়েছে এই তত্ত্বটি। মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রতিদিন শত শত রেকর্ড সৃষ্টি করে তারা জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চালাচ্ছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অন্যায় আল্লাহ তায়ালা খুব বেশি দিন সহ্য করবেন বলে মনে হয় না। একজন মুসলমান হিসেবে এটা আমি বিশ্বাস করি।
সম্প্রতি  আরেকটি কথা বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ের আলোকে শিগগিরই প্রশাসনিকভাবে জামায়াতকে শুধু বেআইনী নয় একটি সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন হিসেবে সরকার ঘোষণা করতে যাচ্ছে। জামায়াতের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং জামায়াতের যত অঙ্গ সংগঠন আছে, জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে পরিচালিত যতগুলো ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক ও সেবামূলক সংগঠন রয়েছে সরকার সেগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে এবং জামায়াত ও তার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ফতুর করে ফেলবে। তাদের ভাষায় তারা মৌলবাদী অর্থনীতির মূলোৎপাটন করেই মৌলবাদকে এ দেশের বুক থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠাবেন। কথাটি শুনতে বেশ ভাল লাগে। আমি যতদূর অনুধাবন করতে পারি ইচ্ছা আর বাস্তব এক হওয়াটা কঠিন। অর্থনীতিতে একটি কথা আছে ‘ওভ রিংযবং বিৎব যড়ৎংবং ঃযবহ নবমমধৎং সরমযঃ ৎরফব. অর্থাৎ ইচ্ছা যদি ঘোড়া হতো তাহলে ভিখারীরাও তাতে চড়ত। তবে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কিছু বলা মুশকিল। কেননা তারা করতে পারে না এমন কোন কাজ নাই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭১-৭২ সালে অবাঙ্গালী বিহারী এবং তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান তারা বাজেয়াপ্ত ও দখল করেছিল। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সৈয়দপুর, যশোর, চট্টগ্রাম, নাটোরসহ বাংলাদেশের বিশাল এলাকার অবাঙ্গালী বিহারীদের হত্যা করে তারা তাদের বাড়ি ঘর, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছিল। আজকের কোটিপতি আওয়ামী লীগারদের সম্পদের যদি হিসাব নেয়া হয় তাহলে অনেকে বিশ্বাস করেন তার ৮০ ভাগ সম্পদশালী ব্যক্তির সম্পদের উৎস এই লুটপাট। এফবিসিসিআই ১৯৯২ সালে একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা গেছে যে, এই আওয়ামী লীগ সরকারিভাবে অধিগ্রহণকৃত অবাঙ্গালীদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে পঞ্চাশ হাজার প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্মীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। একই কায়দায় ৫ হাজার ঊনিশটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান তারা ভাগাভাগি করেছেন। অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তারা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ  ট্রাস্ট এবং বিভিন্ন সেক্টর কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করেছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহ লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শিল্প কারখানাগুলো একটির পর একটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকার লুটপাট, দুর্নীতি বন্ধ করতে পারছেন না। এই অবস্থায় বেসরকারি খাতে পরিচালিত ব্যবসা সফল বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিগ্রহণ করে অথবা সেগুলো বন্ধ করে দিয়ে সরকার কার স্বার্থ হাসিল করতে চান তা পাঠকরা আমার মনে হয় নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারেন। তবে একটি কথা সম্ভবত স্মরণ করা প্রয়োজন যে, সরকার যদি জামায়াতের ন্যায় একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে চান তাহলে হয়তো তার পক্ষে তা অসম্ভব হবে না কেননা তাদের পক্ষে জনসমর্থন না থাকলেও এখন পুলিশ, র‌্যাবসহ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী এবং অস্ত্রধারী দলীয় বাহিনী রয়েছে। কিন্তু সবকিছুরই একটি শেষ আছে। এই সরকার অবশ্যই এদেশের শেষ সরকার নয়। এক মাঘে শীত যায় না। জামায়াত গণবিচ্ছিন্ন শিকড়বিহীন কোন দল নয় যে সামান্য বাতাসে তার মূল উপড়ানো যাবে। কাজেই এই সংগঠনটিকে সরকার সহজে ধ্বংস করে ফেলবেন এবং দেশের মানুষ বসে বসে তামাশা দেখবে এটা নাও হতে পারে। আবার শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা ফাঁসির দ- দিয়ে কিংবা দলকে বেআইনী করে, দলীয় সম্পদ ও দল সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে সরকার যদি রাজনৈতিক সমঝোতা করতে চান তাহলে তা অত্যন্ত হাস্যাস্পদ ও অবাস্তব একটি প্রস্তাব হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনীতির জন্য ভোট, নাকি ভোটের জন্য রাজনীতি


রাজনীতি’ অর্থ রাজনৈতিক কাজকর্ম। রাজকার্য পরিচালনাও রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। তবে সাধারণ অর্থে আমরা ‘রাজনীতি’ বলতে বুঝি রাজার নীতি। ভারত বিভাগ-পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক শাসনামলে আমাদের উপমহাদেশের রাজ্যগুলো বিভিন্ন মহারাজা, রাজা ও সামন্ত রাজা দ্বারা শাসিত হতো। এর আগে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন সম্রাট ও নবাবেরা। মূলত উভয়ই মহারাজা বা রাজার সমার্থক। মহারাজা বা রাজা বংশানুক্রমিকভাবে ক্ষমতায় আরোহণ করায় তার প্রতি জনসমর্থন আছে কি না সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না। রাজা দুই ধরনের। একটি হচ্ছে নামমাত্র বা আলঙ্কারিক এবং অপরটি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা সাংবিধানিক প্রধান। যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি রাষ্ট্রে রাজা নামমাত্র বা আলঙ্কারিক। অপর দিকে সৌদি আরব, জর্ডান, মরক্কো, ব্রুনাই প্রভৃতি রাষ্ট্রে রাজা প্রধান নির্বাহী বা সাংবিধানিক প্রধান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। গঠনতন্ত্রে দলের গঠন কাঠামো, অভ্যন্তরীণ নির্বাচনপদ্ধতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রভৃতির উল্লেখ থাকে। প্রতিটি দলের নিজস্ব ঘোষণাপত্র থাকে। ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান বিভাগ যথা আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস নির্মূল, দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি মোকাবেলাসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক বিষয়ে সবিস্তারে উল্লেখ থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তারা সাধারণত নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কী ধরনের জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিলে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায়, তা বিবেচনায় নিয়ে দলগুলো নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করে থাকে। এই ইশতেহার ঘোষণাপত্রের সমরূপ হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে একটি দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে চার বা পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে থাকে। প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা অর্থাৎ পেশাগতভাবে যারা রাজনীতিবিদ তারা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে ভোট প্রার্থনা করে থাকেন। পেশাগত রাজনীতিবিদেরা সাধারণত ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মতৎপরতায় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ধাপ অতিক্রম করা এবং অতঃপর রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ করেন। রাজনৈতিক নেতা দুই ধরনের। একটি হচ্ছে সাধারণ কর্মী থেকে ধীরে ধীরে যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়া এবং অপরটি হচ্ছে, ঘটনার আকস্মিকতায় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ। পেশাগত রাজনীতিবিদেরা যে দলের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা আমৃত্যু সে দলের নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকেন। আমাদের দেশে নানামুখী লোভ, মোহ ও প্রলোভনে পড়ে কিছু পেশাগত রাজনীতিবিদকে এক বা একাধিকবার দল পরিবর্তন করতে দেখা যায়। আবার দেখা যায়, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দলে সঠিকভাবে মূল্যায়িত না হওয়ার কারণে অথবা অবমূল্যায়িত হওয়ায় দল পরিবর্তন করছেন। এমনও দেখা যায়, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে দল ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করছেন। আমাদের দেশের মতো পাশ্চাত্যে এবং উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দল ত্যাগের ঘটনা বিরল। যখন কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদ নিজ নীতি ও আদর্শের আলোকে নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে ভোটের জন্য আবেদন জানায়, তাকে বলা হয় ‘রাজনীতির জন্য ভোট’। অপর দিকে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদ দলের ও নিজের নীতি ও আদর্শের জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু ভোটপ্রাপ্তির আশায় যখন কোনো দল বা গোষ্ঠীকে সমর্থন করে তাকে বলা হয় ‘ভোটের জন্য রাজনীতি’। এরূপ সমর্থনের মূল উদ্দেশ্য, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।Ñ আমাদের দেশে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দলের তুলনায় অনেক বেশি থাকায় তখন দল ও দলের নেতারা রাজনীতির জন্য ভোটÑ এ মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে তাদের ভোটের একটা বড় অংশ তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ভোটবাক্সে পড়েছিল বলে মনে করা হয়। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা যায়Ñ বিএনপি দুই তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে এবং সে নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনপুষ্ট ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ ২০টি আসন লাভ করেছিল। ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ও বিজিত দলগুলো আক্ষরিক অর্থে রাজনীতির জন্য ভোটÑ এটিকে মুখ্য বিবেচনায় নিজ নিজ নীতি ও আদর্শ জনগণের সামনে উপস্থাপন করে ভোট প্রার্থনা করেছিল। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭৬টি আসন লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এবার সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী নিজ পরিচয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১০টি আসন লাভ করে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ না করায় এ নির্বাচন অনেকটা একতরফা ছিল এবং জন-আকাক্সার প্রতিফলন না হওয়ায় নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই এ সংসদকে অবলুপ্ত করতে হয়েছিল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত, যথাক্রমে ৫ম, ৭ম, ৮ম ও ৯ম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ৮৮, ১৪৬, ৬২ ও ২৩০টি আসন পেয়েছিল। উপরিউক্ত চারটি নির্বাচনে বিএনপি যথাক্রমে ১৪০, ১১৬, ১৯৩ ও ৩০টি আসন পেয়েছিল। এ চারটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৫, ৩২, ১৪ ও ২৭। অপর দিকে ওই চারটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮, ০৩, ১৭ ও ০২। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট প্রদত্ত ভোটের যথাক্রমে শতকরা ৩০.০৮, ৩৭.৪৪, ৪০.১৩ ও ৪৮.০৪ ভাগ ভোট পেয়েছিল। উপরিউক্ত চারটি নির্বাচনে বিএনপির ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল যথাক্রমে ৩০.৮১, ৩৩.৬০, ৪০.৯৭ ও ৩২.৫০ শতাংশ। এ চারটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল যথাক্রমে ১১.৯২, ১৬.৪০, ০৭.২৫ ও ০৭.০৪ শতাংশ। ওই চারটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল যথাক্রমে ১২.১৩, ০৮.৬১, ০৪.২৮ ও ০৪.৭০ শতাংশ। উপরিউক্ত চারটি নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের ভোটপ্রাপ্তি বহুলাংশে হ্রাস পায়। শেষোক্ত দু’টি নির্বাচনে জামায়াত যথাক্রমে ৩১টি ও ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং অবশিষ্ট আসনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, শেষোক্ত দু’টি নির্বাচনে জামায়াতের শতকরা ভোটপ্রাপ্তির হার হ্রাসের এটিই মূল কারণ। অনুরূপভাবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৪৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং অবশিষ্ট আসনে তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। বিশ্লেষকেরা সীমিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জাতীয় পার্টির ভোটপ্রাপ্তির হ্রাসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আলোচ্য চারটি নির্বাচনের প্রতিটিতে দেখা গেছে, সামগ্রিক জনমতের প্রেক্ষাপটে জামায়াতের প্রতি নির্দিষ্ট সমর্থনের হার দেশের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে জামায়াত একবার আওয়ামী লীগের সাথে সহাবস্থান করে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। অপর তিনটি নির্বাচনের একটিতে জামায়াত বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ না হলেও আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর মানসে যেসব আসনে তাদের প্রার্থীর বিজয় অনিশ্চিত ছিল সেসব আসনে নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিয়ে বিএনপিকে সর্বাধিক আসন প্রাপ্তিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জামায়াত দেশের দু’টি বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কখনো মিত্র আবার কখনোবা শত্রু। কোনো কোনো নির্বাচনে দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট জামায়াতের ভোটের চেয়ে বেশি, আবার কোনো কোনো নির্বাচনে জামায়াতের ভোটের চেয়ে কম। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনী ইশতেহারের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই জামায়াতের বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু উভয় দলকে দেখা গেছে, নির্বাচনে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াতের সাথে সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। শুধু নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য এ ধরনের সমঝোতা ‘ভোটের জন্য রাজনীতি’ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সম্প্রতি ঢাকায় নানামুখী প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ দেশের স্মরণকালের ইতিহাসের বৃহত্তম গণসমাবেশ করায় এই সংগঠনটির জনসমর্থনকে মাথায় রেখে নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলে সম্মিলিতভাবে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সমর্থন যেকোনো দলের বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হিসেবে দেখা দেবে। এ কারণেই বর্তমানে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে নতুন ভাবনা। হেফাজতে ইসলামের সমর্থন পাওয়ার দৌড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টিও পিছিয়ে নেই। হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা সরকারের কাছে দিয়েছে, তার সাথে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আদর্শে কোনো মিল নেই। কিন্তু মিল এখানে গৌণ, মুখ্য হচ্ছে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন। তাই অতীতের মতো আবারো দেখা গেল রাজনীতির জন্য ভোট নয়, ভোটের জন্য রাজনীতি। আর ভোটের জন্য রাজনীতির এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির বিকাশ ঘটবে কি-না সে সংশয় থেকেই যায়। 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্র : আওয়ামী স্টাইল

গত ১১ জুন ডেনমার্কের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ করতে গেলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে। সঠিক কথা। এ দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকার জন্যই এসেছে। এ দেশে গণতন্ত্র আনা ও টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি আন্দোলন সংগ্রামে জনগণের ত্যাগ কোরবানি অপরিসীম। সুতরাং এ দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মুখে গণতন্ত্র রক্ষার অমিয় বাণী শুনলে মানুষ আনন্দিত হয়, আতঙ্কিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হঠাৎ প্রেসিডেন্ট হয়ে ‘বাকশাল’ গঠন করলে স্বাধীন দেশে প্রথম গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। শেখ হাসিনার দলের কর্মীরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দিনদুপুরে রাজধানীর পল্টনে মিডিয়ার সামনে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে কয়েকজন মানুষ খুন করে গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছিল। এভাবে ১/১১ এর ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। দেশে আসে মইন উদ্দিন ফখরুদ্দীনের উদ্ভট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর শেখ হাসিনা স্বস্তির সাথে বলেছিলেন, ‘এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল।’ বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ে ১৯৮৬ সালে এক রাতে দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের বহু ছাত্র আহত হয়েছিল। অনেক রুমে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়। সব জাতীয় দৈনিকে খবরটি ছবিসহ ফলাও করে প্রচার করা হলো। ভাবলাম, এ খবর বাড়িতে আমার ভাইয়েরা জানলে চিন্তিত হবেন, মা আমার জন্য অস্থির থাকবেন। তখন মোবাইল ছিল না। সেই অজপাড়াগাঁয়ে কোনো টেলিফোন ছিল না। ঐদিনই আইঅ্যাম ওয়েল ( আমি ভালো আছি), লিখে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিই। দুই দিন পর বড় ভাই কুমিল্লার গ্রামের বাড়ি থেকে বরিশাল গিয়ে হাজির হন। ভোরবেলায় বড় ভাইকে হোস্টেলে দেখে আঁতকে উঠি, না জানি মায়ের কোনো অঘটন ঘটেছে কি না। বড় ভাই বললেন, তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে বাড়িতে সবাই অস্থির, মা শয্যাশায়ী। ভাবলাম নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই তোমার খোঁজ নিতে আমার আসা। বুঝলাম ‘আমি ভালো আছি’ এ খবরই ‘আমি ভালো নেই’ এ আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। প্রথম টার্মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৮ সালে যেদিন আওয়ামী লীগ নেত্রী ঘোষণা দিলেন, এ দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, ঠিক পরের দিনই বৃষ্টির মধ্যে কমলাপুর বস্তি উচ্ছেদ করে শত শত নারী, শিশু, অসহায়কে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল তার সরকার। আজ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। অথচ ১৯৯৪-৯৫ সালে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে উপর্যুপরি হরতাল দিয়ে, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও করে দেশের জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে। এখন সে আন্দোলনের নেত্রী বলছেন, ‘তত্ত্বাবধায়কের দাবি জানালে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ সেদিন আমার চেম্বারে আট বছরের একটি শিশু মেয়ে এসেছিল। তার চোখে একটা ছোট অপারেশন প্রয়োজন। আমরা চোখের ডাক্তারেরা সাধারণত লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়েই চোখের অপারেশন করে থাকি। সেই ক্ষেত্রে রোগীর সহযোগিতার খুব প্রয়োজন। তার অপারেশনটিও লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। রোগীকে অপারেশনের সময় ধৈর্য ধরার জন্য ভালোমতো কাউন্সেলিং করে রেডি করি। সেও কান্নাকাটি করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরা চার পাঁচজন ওটি স্টাফ। ক্যাপ, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস ও গাউন পরা অবস্থায় আমাদের শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় মেয়েটিকে ওটিতে আনা হয়। প্রথমে সে একটু ঘাবড়ে গেলেও চুপ করে থাকে। আমার এক স্টাফ সাহস দেয়ার জন্য বলে, ভয় পেয়ো না, এরা সবাই মানুষ। আর যায় কোথায়। ভয়ে চিৎকার দিয়ে দরজা ঠেলে বাইরে এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, অপারেশন করাব না। অবস্থা দেখে ওর মারও অজ্ঞান হওয়ায় জোগাড়। যার বাপকে কুমিরে খেয়েছে সে ঢেঁকি দেখলেও ভয় পায়। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের সব উপাদান ধ্বংস করেছে। বিরোধী দলকে দেখামাত্র গুলি কিংবা নির্যাতন, বিরোধী দলের বেশির ভাগ নেতা জেলখানায়, তাদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি মামলা, সভা-সমাবেশের ওপর বেআইনি নিষেধাজ্ঞা, বিরোধী দলের প্রচারমাধ্যম বন্ধ, প্রশাসনে নজিরবিহীন দলীয়করণ, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে গণতন্ত্র ও সুশাসন রোধের। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো বিদেশী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে, তখন সংুব্ধ জনগণের মনে এ আশঙ্কা জাগা খুবই স্বাভাবিক যে, দেশে হয়তো গণতন্ত্র থাকবে না। না থাকলে টেকা-না টেকার প্রশ্ন আসে না।

Ads