বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মুক্তির জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস



 মহাজোট সরকার ডিজিটাল কায়দায় ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল স্টাইলে দেশ পরিচালনা করে  দেশকে অকার্যকর ও তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। স্বৈরাচারী কায়দায় সকল প্রতিষ্ঠানকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছে। বিরোধী দল ও মতের অনুসারীদের উপর যুলুম নির্যাতনের মাত্রাতিরিক্ততা আইয়্যামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। সকল সফলতা সরকারের আর সকল ব্যর্থতার জন্য বিগত সরকার ও বিরোধীদলের উপর চাপিয়ে দেয়ার হীন মানসিকতা আওয়ামী মহাজোটের রীতিমত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা দেশ-বিদেশে জাতিকে পরিণত করেছে নীচু জাতিতে। স্বাধীনতার চেতনার কথা সমস্বরে উচ্চারণ করলেও স্বাধীনতা খর্বের সকল কর্মকান্ডই দেদারছে পরিচালনা করে চলছেন কর্তা ব্যক্তিরা। দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির মানদন্ডের সকল সেক্টর স্থবির। সবাই যে যার আখের গোছাতে অস্থির ব্যস্ত।
১৯৭১ সালে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কাছে অবরুদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের বাকশালের যাঁতাকলে, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত স্বৈরশাসনের কবলে আর ১/১১তে  তত্ত্বাবধায়কের  নামে পুনরায় স্বৈরশাসনের আবির্ভাব। দেশের সচেতন জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে এ সকল অপশক্তির হাত হতে নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করে। ২০০৮ সালে ৯০ দিনের মধ্যে জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা থাকলেও এক অশুভ শক্তির ইশারায় দেশ হাঁটা শুরু করেছিল অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের লগি বৈঠার কাছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দেয়ার কথা থাকলেও তা না করে ফখরুদ্দীন ও মঈন উদ্দীনের সরকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচার শুরু করে। একে একে সবাইকে কারান্তরীণ করা হয়। মঈন উদ্দীন ও  ফখরুদ্দীন ক্লোজ ডোরে তাদের অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়ার নয়া কৌশল খুঁজতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ উপরে উপরে ফখরুদ্দীন ও মঈন উদ্দীনের বিচারের প্রবক্তা হলেও ক্ষমতার জন্য কম্প্রোমাইজ করেছেন ভালোভাবে। যার কারণে অনেক অজনপ্রিয় নেতা ও জননন্দিত নেতা হিসাবে মহীরুহে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
দেশের মানুষ অগণতান্ত্রিক সরকারের যাঁতাকলে পদপিষ্ট হয়ে যখন দিশেহারা ঠিক তখন একটি গণতান্তিক সরকারের কাছে দেশ নিরাপদ মনে করেছিল দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে  দেশের মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন -এবার সম্ভবত দেশ গড়ার পালা, অধিকার নিশ্চিত হওয়ার পালা। কিন্তু সব যে গুড়ে বালি! গণতন্ত্রের লেবাস ধারণ করে আওয়ামী সরকার সকল স্বপ্নসাধ ধূলিসাৎ করে দেশকে এখন ফেইলস্টেটে পরিণত করেছে। অস্থিরতা ও অরাজকতায় দেশ বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।  সম্ভ্রমরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাবে কাতরাচ্ছে সকল বনি আদম। আওয়ামী সরকারের গত চার বছর ছিল দেশের জনগণের জন্য দুঃসহ যাতনার। যার খন্ড চিত্র কারো অজানা নয়।
ব্যক্তি কলহে হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা ও আইনশৃক্মখলা বাহিনীর হাতে খুন, গুম, আইন শৃংখলার চরম অবনতি ঘটেছে। দেশের মানুষ এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছে দেশের জনগণ। মনের মণিকোঠায় প্রশ্ন রয়েই গেল সারা দুনিয়া মানবতা বোধ, শান্তি, নিরাপত্তা বন্ধনে অটুট হচ্ছে আর আমরা কেন উল্টো পথে হাঁটছি? সেন্টার ফর মিডিয়া অ্যান্ড ট্রেনিং (এম আর টির) জরিপ মতে ৪ বছরে খুন হয়েছে ১৬৫৮৯ জন, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ৭৯০ জন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৪৪৯ জন ও গণপিটুনিতে নিহত  হয়েছেন ৫৮৮ জন। বর্তমান সরকারের ৪ বছরের খুনের গড় ১১ জনেরও বেশি। দলীয় পদ, ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের অন্তঃকোন্দল সংঘর্ষ বেঁধেছে জায়গায় জায়গায়। শুধু আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্তঃকোন্দলে নিহত হয়েছেন ১৫৩ জন। এ সরকারের আমলে আইন শৃংখলা বাহিনীকে রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরকে দমনের জন্য অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে সবচেয়ে বেশী। আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারীবাহিনীর হাতে সরকারের চার বছরে মৃত্যু হয়েছে ৪৫৯ অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ১০ জন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই কথিত ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে গুলীবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া শেয়ার বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ও অনিবন্ধিত শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনে বাধা, টিয়ারগ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট ও মরিচগুঁড়া বা পিপার স্প্রে দিয়ে দমানোর ন্যক্কারজনক  প্রচেষ্টা ছিল নজিরবিহীন। ইতোমধ্যে পুলিশের পিপার স্প্রেতে দু'জন শিক্ষক মারা গিয়েছেন। বিরোধী দল দমনে সর্বশেষ পুলিশের গুলীতে নিহত হয় শিবির কর্মী মুজাহিদ। ২০১২ সালের শেষের দিক থেকে বিরোধী দলকে দমানোর জন্য ও সভা সমাবেশ বানচালের জন্য সাউন্ড গ্রেনেড ও গ্যাস গ্রেনেড ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে।  যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে পত্রিকায়  বিশেষজ্ঞ মহল  উদ্বেগ প্রকাশ করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশ তা মানতে নারাজ।
রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের পাশাপাশি এ সরকারের আমলে গুমের ঘটনা ছিল উল্লেখ করার মত। কারো লাশ পাওয়া গেছে আর কারো লাশ মিলেনি। বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, এম ইলিয়াস আলী, শিবির নেতা মোকাদ্দেস ও ওয়ালিউল্লাহকে গুম করার ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে। নাম না জানা অনেক গুম ব্যক্তির প্রিয়জন, সন্তান, মা-বাবা আর কতদিন অপেক্ষা করবেন? তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হবে কি?
মামলা-মোকদ্দমা আর রিমান্ডে নির্যাতন ছিল এ সরকারের আমলে মামুলি বিষয়। সরকারের মতের বিপরীত বক্তব্য বা সমালোচনা করলেই মামলা আর গ্রেফতার। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে মামলা করেন সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগে! জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানকে ককটেল সরঞ্জামাদি পাওয়ায় মামলা দেয়া হয়। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয় মোবাইল ও ভেনিটিবেগ ছিনতাই মামলায়। যে দেশে প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিব মাসের পর মাস জেলে থাকে, যে দেশে আইনের তোয়াক্কা না করে একটি প্রধান ধর্মীয় দলের  শীর্ষ নেতাদেরকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য বিচারের নামে অবিচার করা হয় সেখানে গণতন্ত্র আর আইনের শাসন বলতে কি থাকতে পারে? স্কাইপি সংলাপে বিচারের নামে অবিচারের সব তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আসামী পক্ষেও আইনজীবীরা ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুনরায় বিচার শুরুর জন্য আবেদন জানান। সরকারের পক্ষে প্রসিকিউটর ও আইনমন্ত্রী জানান  ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু। ওনাদের যুক্তি হল বিচারক পরিবর্তন ও বিচারক মারা গেলে যা হয় এখানেও তাই। আইনবিদরা মনে করেন যে এটি মারা যাওয়া বা বিচারক পরিবর্তন হওয়ার মত কোন স্বাভাবিক বিষয় নয়,  যেহেতু এর বিচারকার্য এগিয়েছে সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থীভাবে, যেখানে জজ সাহেব নাগরিকের অধিকার খর্ব করেছেন। আদালতের প্রবেশদ্বার হতে সাক্ষী অপহরণের ঘটনার পর আদালতের কাছে আর কী আশা করা যেতে পারে।
হাজার হাজার মামলায় জর্জরিত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার ভাষ্যমতে কারাগার এখন অপরাধীদের বন্দিশালা নয় বরং বিরোধী দলের নেতা-কর্মী দমনশালায় পরিণত হয়েছে। দেশের ৬৮টি কারাগারে দিনদিন বন্দি সংখ্যা বাড়ছে। সারাদেশের কারাগারগুলোতে বন্দি ধারণ ক্ষমতা ২৯ হাজার ৪শ' জন হলেও কারাগারে বর্তমানে বন্দি সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে পত্রিকায় প্রকাশ-প্রয়োজনে কারাগার বাড়ানো হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে বন্দিশীর্ষে জামায়াত এর পর বিএনপি। এদিকে সরকারের নির্যাতনের গন্ডি বিরোধী পুরুষদের উপর সীমাবদ্ধ থাকেনি; নারী কর্মীদের উপরও নির্লিপ্ত খড়গ হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। মাত্র ক'য়েক দিন আগে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রীসংস্থার কিছু কর্মীকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই একটি বাসা থেকে আটক করা হয়েছে। এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও তারা রেহাই দেয়নি। দফায় দফায় জামিন আবেদন নাকচ করে দেন বিচারক মহোদয়রা। এমনকি আদালতে হাজির করার সময় এ সকল মহিলার জোর করে হিজাব খুলে নেয়া হয়! একটি মুসলিম দেশে সরকারের এ কেমন অমুসলিম সুলভ আচরণ? অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন কারণে-অকারণে বিরোধী দলের ও মতের বিরুদ্ধে মামলা- মোকদ্দমা, জেল-জুলুম ও রিমান্ডের দৃষ্টান্ত আগামীতে যে কোন ক্ষমতাসীন দল অপব্যবহারের জন্য সুযোগ করে নিতে পারে।
সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ১০ মাস পরই ৬৩ জন সচিবের মধ্যে ১১ জনকেই ওএসডি করে। প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকা ১১ সচিবসহ প্রশাসন ক্যাডারের ৪০০ কর্মকর্তা দীর্ঘ দিন ওসডি হয়ে ছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়েছেন ৬৮১ জন। সমসংখ্যক কর্মকর্তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। এত বেশ কিছুদিন প্রশাসনে স্থবিরতা বিরাজ করে। সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর একদিনে সরকারের ৫০৩ কর্মকর্তা ৩ স্তরে পদোন্নতি পেয়েছেন। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের প্রতিটি স্তরে যোগ্যতা দক্ষতার পরিবর্তে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে শ'য়ে শ'য়ে দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে মেধাশূন্য করে দেয়া হচ্ছে।
কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হিসাবে যে সাড়ে ১৩ হাজার নিয়োগ দেয়া হবে; তারা সবাই হবেন আওয়ামীলীগের পরীক্ষিত কর্মী। নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্যতা হবে দলীয় পরিচয় অর্থাৎ আওয়ামীলীগ কর্মী কি না ? গোপালগঞ্জে হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে এ্যানথ্রাক্র নিয়ে বিশেষ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলী এই নিয়োগমালা ঘোষণা করেছেন। এই বিধি প্রয়োগ করা হলে, কমিউনিটি হেলথ সার্ভিসের পুরো ব্যবস্থা রাজনৈতিক এ্যানথ্রাক্রে আক্রান্ত হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নব আঙ্গিকে দানব রূপে আবির্ভাব হয়। গত চার বছরে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হাতে নিহত ছাত্রের সংখ্যা ৩৬ জন। এছাড়া ৯ ডিসেম্বর ২০১২ সালে ১৮ দলের ডাকে হরতাল চলাকালে ছাত্র শিবিরের কর্মী সন্দেহে নির্মমভাবে চাপাতির আঘাতে নিহত হয়েছে টেইলর কর্মী বিশ্বজিৎ। মিডিয়াগুলোতে ছাত্রলীগের একের পর এক অপকর্মের সচিত্র প্রতিবেদন  প্রচার হতে থাকলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। তবে এর পরেও কী প্রতিকার হল। কি বীভৎসতা! চার বছরের সময়কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ নিজদের ও প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে কমপক্ষে পাঁচশতবার। এর মধ্যে ছাত্রশিবিরের ৬ জন, ছাত্রদলের ১জন, ছাত্রমৈত্রীর ১ জন নেতা-কর্মী এবং অরাজনৈতিক তিনজন ছাত্র হত্যাসহ নিজেদের অন্তঃকোন্দলে নিহত হয় অন্তত ৩৬ জন। দেশের সচেতন মহলের প্রশ্ন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারুক হত্যাকান্ডের পর সারা দেশে শিবিরের নির্দোষ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কথিত চিরুণী অভিযানে শত শত ছাত্র গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ ৩৬ ছাত্রের খুনিরা প্রকাশ্যে দিবালোকে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাহলে সরকারদলীয় খুনিরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? মাত্র কয়েক দিন আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভিসি পদত্যাগের আন্দোলন শুরু করলে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর এসিড নিক্ষেপ করে। এতে দু'জন শিক্ষকসহ বেশ ক'জন ছাত্র-ছাত্রী মারাত্মকভাবে এসিডদগ্ধ হন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ছাত্রলীগ কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন। ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ ইবিতে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সজিব পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হামলা করে যা সকল মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন-ভর্তি বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্বসহ নানা অপকর্মের কারণে মহাজোট সরকারের সব অর্জন ম্লান হতে চলছে ; ছাত্রলীগের আগ্রাসী কর্মকান্ডে  স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও অসহায়।।
সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও দশের তরে বাস্তব ও সত্য প্রকাশে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। সত্য প্রকাশের এ অনন্য পেশা পালন করতে গিয়ে জীবন, পঙ্গুত্বসহ অমানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন অনেকে। সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চ অ্যান্ড প্লানিং (এমআরটি) এ সংস্থার মতে গত ৪ বছরে ১৭ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এ সময় আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৮৯৯ জন। এর মধ্যে ৫৮৬ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ২২২ জন লাঞ্ছিত ও ২৬৯ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৬২ জন সাংবাদিকের উপর হামলা ও ৮ জনকে গ্রেফতার, ৩ জনকে অপহরণ ও ৬৫ জন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২ রাজধানীতে নিজের বাসায় খুন হন মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহরুন রুনি। এ সময়ে বেসরকারি চ্যানেল এটিএন বাংলার ‘‘সময়ের ভাবনা’’ টকশো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ আলোচিত নির্মম হত্যাকান্ডের প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজ দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসলেও সরকার বাহাদুর প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।  সময়ের নির্ভিক সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান আলোচিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও বেলজিয়াম প্রবাসী জিয়াউদ্দীনের স্কাইপি কথোপকথন ‘‘দৈনিক আমার দেশ’’ পত্রিকায় ছাপালে সরকারের রোষানলে দীর্ঘদিন পত্রিকা কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন। আমার দেশ পত্রিকায় স্কাইপি  রিপোর্ট প্রকাশ ওয়ালীউল্লাহ নোমান প্রাণ ভয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। কিছুদিন আগেও বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে পরিচালিত টকশো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের আশংকা ১৯৭৫ সালের মত সরকার সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার পথে যাত্রা শুরু করেনিতো ?
সীমান্ত এখম যেন মৃত্যুপুরী। ভারত বন্ধুত্বের প্রশ্নে কোন ভাবেই উত্তীর্ণ নয়। অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে ভারতই বাংলাদেশের অন্যতম একমাত্র বন্ধু। বিএসএফ গত চার বছরে নির্বিচারে হত্যা করেছে ২৫০ জন বাংলাদেশীকে।  সীমান্তে ২০১৩ সালে ১ জানুয়ারি  ২ বাংলাদেশী খুনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরে খুনের নেশায় মত্ত হয় বন্ধুরূপী শত্রুরা। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশীরা জানেনা তাদের মৃত্যুর মিছিল হবে আরো কত দীর্ঘতর। নাম না জানা আরো কত ফেলানীকে ঝুলতে হবে, এ প্রশ্ন রয়েই গেল। লোক দেখানো সীমান্ত পতাকা বৈঠক  আর ভারতের দুঃখ প্রকাশ বন্ধুত্বের ছলে আগ্রাসন ছাড়া কি হতে পারে ? এ সকল হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিকারের পরিবর্তে দেশের বিদেশ মন্ত্রীর সীমান্তবর্তী জনগণকে সতর্ক থাকার উপদেশ নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ বৈ কি বলা চলে? 
শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির ভয়াল জ্বরে অবস্থা ত্রাহী ত্রাহী। পদ্মাসেতু, ডেসটিনি, হলমার্ক গ্রুপের অর্থকেলেংকারী ও শেয়ার বাজারের অর্থ লুণ্ঠন দেশের অগ্রগতির চাকাকে সাময়িকভাবে স্থবির করে দিয়েছে। যেখানে স্বয়ং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী- আমলা ও দলের নেতা কর্মীরা জড়িত। অবশ্য হলমার্ক অর্থকেলেংকারীর পর অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছিলেন- মাত্র ৪০০ কোটি টাকা এটা একটা ব্যাপার হলো! ৪১ বছরেও দক্ষিণ বঙ্গের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে নিঃশেষ করতে হয় এ অঞ্চলের জনগণকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এটিই ছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প। যেখানে অর্থের প্রয়োজন হয় প্রায় ২০৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১০ সালের শুরুতে এ প্রকল্পটি অনুমোদন করে একনেক। কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু কর্তা ব্যক্তিরা শুরুতেই লুটপাট শুরু করে। যা দাতাসংস্থা মহলের দৃষ্টিগোচর হয়। সেতুর দরপত্র আহবান করে ২০০৯ সালে। বিশ্বব্যাংক এতে নারাজ হয়। ২০১০ সালে পুনরায় দরপত্রের আহবান করা হয়। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার আশ্বাসে এগিয়ে চলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ। হঠাৎ উইকিলিকস্ নামক সবজান্তায় বেরিয়ে আসে টাকা পাওয়ার আগেই এর বন্টন পদ্ধতি। সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে স্বয়ং যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনসহ সেতু বিভাগের সচিব মোশারফ হোসেন ভূইয়া ও সেতু প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। সাথে অর্থ উপদেষ্টা মশিউর রহমানেরও। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘুরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক তদন্ত দাবি করে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্ত করার পরিবর্তে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করে। অবশেষে কোন রাস্তা না পেয়ে ৫ জানুয়ারী ২০১২ যোগাযোগ মন্ত্রীকে অপসারণ করে সরকার।  সরকার অভিযোগের পূর্ণ তদন্ত না করে আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিক হিসাবে ঘোষণা করে।  সে যাই হোক  বাস্তবে এর নির্মাণ কাজ আদৌ এ সরকার শুরু করতে পারবে কিনা ? সকলের দৃষ্টি সেদিকে। আর যে দুই আবুলের কারণে এ ঐতিহাসিক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করা হবে কিনা, না দলীয় বিবেচনায় সব মাফ-সাফ হয়ে যাবে এ নিয়ে  সন্ধিহান সারা জাতি।
পদ্মা সেতু  দুর্নীতি চ্যাম্পিয়নশীপ কেলেঙ্কারি শেষ হতে না হতে ধরা পড়ে ডেসটিনি অর্থ কেলেঙ্কারি। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকা বাইরে পাচার করলেও সরকার ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে।  গত মার্চ মাসে ডেসটিনির আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি কো-অপারেটিভ সোসাইটির উপর একটি পরিদর্শন কর্মসূচী পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিদর্শন থেকে বেরিয়ে আসে যে, ডেসটিনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারির মাঝামাঝি জাতির কাছে অর্থলুণ্ঠনকারী আরেক দানব এসে হাজির হয় যার নাম হলমার্ক। সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর যোগসাজশে হলমার্ক এ বছরই সোনালী ব্যাংক থেকে কেড়ে নেয় প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা। হলমার্ক গ্রুপের এসব অপকর্ম ঘটতে থাকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ছত্রছায়ায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে সকলে জানতে পারে। অবশ্য এ সময় সরকারের তরফ থেকে মিডিয়ার সমালোচনা করে। কিন্তু অভিযোগের তীব্রতায় সরকার বাধ্য হয়ে হলমার্ক গ্রুপের এম ডি তানভীর ও চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রীকে গ্রেফতার করে। কিছুদিন আগেও এ গ্রুপটি তাদের সফলতার জন্য সরকারের কাছ থেকে মেডেল গ্রহণ করেছিল। দুর্নীর্তির এসব দলিল দস্তাবেজ থাকার পরও এসব অর্থখেকো দানবরা আইনের ফাঁক ফোকুর দিয়ে বেরিয়ে যাবে না তো ?
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পদ্মাসেতু, ডেসটিনি ও হলমার্কের ঘা শুকাতে না শুকাতে রেল মন্ত্রণালয়ের  থলের বেড়াল বেরিয়ে আসল।  ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের শেষ বেলায় মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ মিলল বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে আবুল হোসেনের সমালোচনায় মুখর ছিলেন এই মন্ত্রী। মন্ত্রী হয়েই বললেন রেলের কালো বিড়াল খুঁজে বের করবেন। কে জানত সে যে নিজেই কালো বিড়াল ! মাত্র স্বল্পদিনের ব্যবধানে নিয়োগ বাণিজ্যেও ৭০ লক্ষ ঘুষের টাকাসহ ধরা পড়ে বিজিবির হাতে। মন্ত্রীর এ পি এস অপসারণ করেও শেষ রক্ষা হলনা, অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। সরকার অদৃশ্য ইশারায় এখন দপ্তরবিহীনমন্ত্রী হিসেবে পুনিরায় নিয়োগ দিয়েছে। দুদক কর্তৃক দুর্নীতি মুক্ত (!) মন্ত্রী হিসেবে সনদও পেয়েছেন! কিছুদিন আগে এপিএস এর গাড়ি চালক আযম একটি বেসরকারী চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রদান করলে বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসে। কে জানে এর সুরাহা কি হবে?
নতুন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক  সবেমাত্র দায়িত্ব নিলেন। রেলের উত্তরাঞ্চলের ৯৮টি নতুন পদের জন্য রেলমন্ত্রী নিজেই ১৮২টি দরখাস্তে চাকরির সুপারিশ করেছেন। প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে  মন্ত্রীর দু'ই বিশ্বস্ত সহযোগী এসব নিয়োগ বাণিজ্য দেখছেন। পত্রিকায় প্রকাশ মন্ত্রীর দলীয়করণ ও নিয়োগ বাণিজ্যের স্বেচ্ছাচারিতায় খোদ আওয়ামীপন্থী রেল কর্মকর্তারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শেয়ারবাজার ট্রাজেডি ছিল বাংলাদেশের  অর্থনীতির আকাশে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা। দেশের শীর্ষ নেতা-নেত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরা এর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। তবে আওয়ামী আমলে শেয়ার বাজারে যে দরপতন ঘটেছে তা রীতিমত বিনিয়োগকারীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ৪০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও তাদের পরিবারসহ ২ কোটি মানুষ আর্থিক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা শেয়ার বাজার থেকে লুট করা হয়েছে। দুদক জানায়, শেয়ার কেলেঙ্কারিরা ২০১০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২০১১ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত ৪৩৬ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। নিঃস্ব বিনিয়োগকারীর বেশ ক'য়েক জন আত্মাহুতি দিয়েছেন। রক্তচোষা অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রাজপথে পাজেরো হাঁকিয়ে বীরদর্পে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াবে ! তাদের বিচার হবে তো?
 বারবার তেল গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃংখলার অবনতি, গণতান্ত্রিক কর্মসুচি, প্রতিবাদে উপর্যপুরি বাধা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য শুভ হতে পারেনা। সরকার নাগরিকদের গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডে বাধা অব্যাহত রাখলে সহিংসতা বাড়তে পারে; এমন কি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন অনেকে। যে দেশে বেতনভাতা বৃদ্ধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের দাবিতে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হয়; আর আইনশৃংখলা রক্ষাকারীবাহিনীর হাতে জীবন সংহার হতে হয়, সে দেশের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে?
তাই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে জেগে উঠতে হবে সকল সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিককে; রুখে দিতে হবে সকল অশুভ শক্তিকে। কাপুরুষের মত হাজার বছর বাঁচার স্বপ্নে বিভোর না হয়ে বীরদর্পে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে  দেশকে সুন্দর নীলিমায় রূপান্তরিত করার দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। যেখানে থাকবেনা কোন ভেদাভেদ, থাকবেনা মজলুমের আহাজারী। এটিই হোক সকল নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি।
zabbarics@gmail.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পথের শেষ কোথায়?



আবার একটি হরতাল পালিত হলো দেশব্যাপী। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে প্রকম্পিত হলো মানুষ। দাবি আদায়ের মিছিলের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হলো সহস্র কণ্ঠ। গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার আর জুলুম-নির্যাতনের অবসানই ছিল জনতার দাবি। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাপ্তি কোথায়? পথের শেষ কোথায়? কোথায় সমন্বয়, পরমত সহিষ্ণুতা? কোথায় গণতান্ত্রিক সমানাধিকারে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস? মুক্তির দিশারী মানুষ আজ নানা প্রশ্নে উত্তর জানতে চাচ্ছে।
যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের একমাত্র পরিণতি ও সমাপ্তির নাম বিজয়। আজ কিংবা পরে সেই বিজয় আসবেই। ইতিহাসের এটাই শিক্ষা। বিজয়ের পথ সহজ নয়; কুসুমাস্তীর্ণও নয়। বিজয়ের পথ হলো সংগ্রামের পথ। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস নতুন নয়। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। সংগ্রামের মহাসড়ক পেরিয়েই স্বাধীন হয়েছে। অতএব সংগ্রাম হলো ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আজকের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ও প্রেক্ষাপট কারও কাছে অজানা নয়। সুশাসন ও সর্বদলীয় গণতন্ত্রের জন্য আজকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সংগ্রাম করতে হচ্ছে হীন চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে। ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে। মানুষের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার ডাকেই মূলত হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। একদলীয় বা বিদ্বেষভরা কলুষিত মনে এই আন্দোলনকে দেখার মাধ্যমে কেউ কেউ এই সংগ্রামের বিরোধিতাও করছে। পক্ষ-বিপক্ষ যে কোনো রাজনৈতিক ঘটনায় থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক। কিন্তু প্রতিপক্ষকে একতরফাভাবে নিধন করার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়ার তো কোনো কারণ নেই? এমন করা হলে জনক্ষোভ বাড়ে বৈ কমে না।
গণতন্ত্রে শাসন হয় সকলের সম্মতিতে। পুলিশ বা শক্তি দিয়ে যে শাসন, সেটা গণতন্ত্রের বিপরীত। গণতন্ত্রে মতপার্থক্যও দূর করা হয় আলাপ-আলোচনায়, সমঝোতায়। শক্তির খেলায় বা প্রতিপক্ষ নিধনের উৎসবে সমঝোতার ধ্বংস অনিবার্য। এ কারণেই সকলের মনে প্রশ্নটি জেগেছে যে, সঙ্কটের শেষ কোথায়?
নাগরিক হিসাবে প্রতিটি মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তা চায়। রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিটি দলই নিজ নিজ বক্তব্য দেয়ার অধিকার চায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। এটাই গণতন্ত্রের রীতি। গণতন্ত্রে একজন মানুষও যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে, সেটার প্রতিও সম্মান জানাতে হয়। বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে কি? সমঝোতা হচ্ছে না; ভিন্নমত শোনা হচ্ছে না। তা হলে কী হচ্ছে?
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই আকাশ থেকে পড়েনি। মুসলিম লীগের পেটের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন নির্বাচনে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অংশও নিয়েছে। আজকে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, একদা তারাও বিরোধী দলে ছিল। বিরোধী দল বিএনপি কখনও প্রধান শক্তি হয়েছে; কখনও প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। জামায়াত, জাতীয় পার্টি সময় সময় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে মজার ব্যাপার। যারা কোনো দিন সংসদে যেতে পারেনি; এমনকি জামানত পর্যন্ত রাখতে পারেনি; এরাই বড় বড় কথা বলছে। শুধু বলছে না, সরকারকেও সেটা মানতে বাধ্য করছে। জনগণ ভোট দেয় না, নিজেদের জনশক্তি ও জনপ্রিয়তা নেই, তারা কি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে? কে বা কোন দল রাজনীতি করতে পারবে; কার কি শাস্তি হবে; কাকে নির্মূল করা হবে; মধ্যযুগীয় রাজার মতো তারা সেটা আগে-ভাগেই ঠিক করে দিচ্ছেন? একদল ফতুর বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে তারা যেটা করছেন, সেটা হঠকারিতা, উস্কানি ও বিশৃক্মখলা। এদের কথা শুনলে যে দেশের বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করা হয়, সে খেয়ালও নেই। সবাই জানতে চায়, এদের শক্তির উৎস কি? জনগণ ও জনইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এরা কার এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চায়?
বন্ধুবেশী স্তাবকের চেয়ে শত্রু ভালো। বাংলাদেশের ইতিহাসই এ কথা বলে। স্বাধীনতার পর কিভাবে দেবত্বারোপ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে আর গণতান্ত্রিক সিংহ পুরুষকে একদলের নেতা বানানো হয়েছিল, সেটা জ্বলজ্বল করছে। সেসব বন্ধুরা পরে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক শ্রমিক হিসাবে খাল কেটেছে। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে লাল-ঝান্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকারের ক্ষমতার বৃত্তে এবং পদ-পদবীতে এরাই এখন এগিয়ে। পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও এদের দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা। এরাই আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগকে বিচ্যুৎ করছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পুরোধা ও বাংলাদেশের প্রধান দলের ঐতিহ্য থেকে অতীতের মতো বিচ্ছিন্ন করছে। আজকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দলের দূরত্ব ও ওয়ার্কিং রিলেশন্স খারাপ করার পেছনে এদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এতে কার কি লাভ হয়েছে কে জানে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে আওয়ামী লীগের। প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে দলটিকে কাজ করতে হচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগ যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাতে সকলকে সঙ্গে রাখলেও কেউ তেমন কিছুই করতে পারতো না। আওয়ামী লীগের সুনাম ও ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হতো।
এখন অবস্থা কি সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। বিদেশী বন্ধুরা পর্যন্ত সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত ও লজ্জিত হয়ে গেছে। যেসব আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বিবেকের কারণে কিছু সত্য কথা ও সদুপদেশ দিচ্ছেন, তারা পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নব্যশক্তিধর নেতাদের দ্বারা। যাকে-তাকে যখন-তখন স্বাধীনতাবিরোধী/মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই যে প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র ঘাপটিমারা মতলববাজরা তৈরি করেছে, সেটা থেকে রাবণের চিতার মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে হিংসার আগুন। সাধারণ মানুষ, শান্তিপ্রিয় নাগরিক এর থেকে বাঁচতে চায়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের, আইনের ন্যায়ানুগ প্রয়োগের নিশ্চয়তা চায়। হরতালে, অবরোধে, মিছিলে, মিটিংয়ে জনতা জানতে চায়, পথের শেষ কোথায়? কোথায় মুক্তি? এই প্রশ্নের উত্তর জানা দিনে দিনে জরুরি হয়ে উঠছে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বপ্নের কুসুম দিয়ে মহাকাশে সেতু তৈরি করবেন প্রধানমন্ত্রী


সিরাজুর রহমান

ভোটের বিনিময়ে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করেছিলেন শেখ হাসিনা। যে প্রতিশ্রুতি দিলে মানুষ খুশি হবে তার কোনোটি উচ্চারণ করতে ভোলেননি তিনি।  ১০ টাকা কেজি দরের চালের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে ভয়ানক অখুশি হন তিনি। কিন্তু আরো প্রতিশ্রুতিও তো ছিল। ক্ষমতা পেলেই বিদ্যুতের সঙ্কট দূর করবেন, বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশে পরিণত করবেন, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস করবেন, প্রতি পরিবারে একজনকে চাকরি দেবেন, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেবেনÑ এসব প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা হরহামেশা দিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল যে, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদ ও সম্পত্তির বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ করা হবে। গদি লাভের কিছুকাল পরেই সে বিধান পাল্টে গেল। ঘোষণা হলো যে, মন্ত্রীরা তাদের সম্পদের বিবরণ দেবেন প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রী সেগুলো প্রকাশ করবেন না। সেসব বিবরণ তারা দিয়েছেন কি না এবং দিয়ে থাকলে প্রধানমন্ত্রী সেসব হিসাব দিয়ে কী করেছেন আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু দেখতে পাচ্ছি, চার বছর ধরে ডিজিটাল দুর্নীতি চলেছে বাংলাদেশে।
শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, বিনা টেন্ডারে কুইক রেন্টালের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার হরিলুট, ডেসটিনি আর হলমার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির সমালোচনা এখন আর সরকার গায়ে মাখে না। হয়তো তারা সেগুলো নিজেদের বিজয়ধ্বজা বলেই মনে করে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ বিশ্বব্যাংক করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেসব সম্বন্ধে এখনো ভয়ানক স্পর্শকাতর। আগেও কয়েকবার লিখেছি, কোনো কোনো বাচ্চা মেয়ে গুটি খেলতে গিয়ে প্রতারণা করে অথবা মিথ্যা কথা বলে ধরা পড়ে গেলে পাল্টা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর। আঁচড়ে, খামচে তাকে একাকার করে দেয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধান সে জাতের মানুষ। হয়তো কাগজ-কলমে প্রমাণ হাজির করেছে বলেই বিশ্বব্যাংকের ওপর তার এত আক্রোশ।
সেতু তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন এখন আটকে আছে দুর্নীতির দায়ে দুই সাবেক আওয়ামী লীগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আর আবুল হাসানের (হাসান-হোসেন) বিচার ও শাস্তির প্রশ্নে। বিশ্বব্যাংক বেঁকে দাঁড়িয়েছিল। বহু দরকষাকষির ওপর ব্যাংক কয়েকজনের একটা তালিকা পাঠিয়েছিল, বলেছিল যে, এদের বিচার হলে ব্যাংক পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১.২ বিলিয়ন (১২০০ কোটি) ডলার ঋণ দেবে। বহু গড়িমসির পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাসান-হোসেনকে বাদ দিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে রাজি হয়। দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান অপূর্ব এক উক্তি করেছেন এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুদক সে সম্বন্ধে তদন্ত করবে। অভিযোগ যদি প্রমাণিতই হলো তাহলে তখন আর তদন্তের কী অবশিষ্ট রইল সহজবোধ্য নয়। জনাব গোলাম রহমান অনেক আগেই প্রমাণ দিয়েছেন যে, গণভবনের ইচ্ছাপূরণ তার প্রথম এবং প্রধান পবিত্র কাজ। সুতরাং ধরে নিতেই হবে যে, গণভবনের নির্দেশেই তিনি আবুল হোসেন সম্বন্ধে তদন্ত করতে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে রাজি নন। বাইনমাছের মতো পিচ্ছিল অঙ্গভঙ্গি করে তিনি পার পাবার চেষ্টা করছেন। আবুল হোসেনের প্রক্সি দুর্নীতির তদন্তে বেশি আপত্তি কার, বাংলাদেশের মানুষের আর বুঝতে বাকি নেই।
শেখ হাসিনার আরেকটা বৈশিষ্ট্য, তিনি মনে করেন খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ‘টিজ’ করতে পারেন তিনি। বিশ্বব্যাংক প্রকৃতই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে চায়। আরো আপস করে তারা শেষ পর্যন্ত বলেছে, আবুল হাসানকে বাদ দিয়ে শুধু আবুল হোসেনের বিচার করলেই তারা সন্তুষ্ট হবে। শেখ হাসিনা তড়াক জবাব দিয়েছেন, সেটা কেন হবে? হোসেনের বিচার করতে হলে হাসানের বিচার করতে  হবে। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন যে, বিচার যদি দু’জনেরই করা হয় তাহলে ব্যাংকের আপত্তি হবে না, গোড়ায় ব্যাংক তো সে দাবিই করেছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব গোলাম রহমান অনুগ্রহ করে রাজি হলেই হাসান-হোসেন উভয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং তাদের বিচার হতে পারে।
 নিজের সম্পদে পদ্মা সেতু?
সেই সঙ্গে আবারো পাল্টা হুমকি দিয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, বাংলাদেশ নিজেই পদ্মা সেতু তৈরি করবে, ছয় মাসের মধ্যেই নকশা তৈরি করতে বুয়েটের প্রকৌশলীদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। গত বছরের গ্রীষ্মকালের কথা আশা করি কেউ ভুলে যাননি। এ কথা প্রধানমন্ত্রী তখনো একবার বলেছিলেন। বলেছিলেন, অর্থায়নের জন্য চাঁদা তোলা হবে, সে বাবদ নাকি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছিল। সেতু তহবিলের নাম ভাঙিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ তখন চাঁদাবাজির সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী নিজেও তখন বাইনমাছের মতো বহু কসরৎ করেছিলেন। নিজেদের সম্পদ থেকে সেতু তৈরির হুমকির পরে তিনি বললেন, অর্থায়নের বিকল্প ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ। জাপান, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নামোল্লেখও করা হয়েছিল তখন। কিন্তু সে সম্ভাবনাও ভেস্তে গিয়েছিল এবং আবারো বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছিল সরকার। কিন্তু প্রথমে হাসান-হোসেনের এবং পরে শুধু হোসেনের বিচার ও শাস্তির প্রশ্নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আবারো আটকে গেছে মনে হয়। বাংলাদেশের সেরা বাকচাতুর্যে অভ্যস্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বারবার বিশ্বব্যাংককে হুমকি দিচ্ছেন : জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাংককে অর্থায়নে রাজি হতে হবে, নইলে…। নইলে যে কী হবে তিনি খুলে বলছেন না। মুহিত সাহেবের বার্ধক্যজনিত খারাপ রোগ হয়েছে বলেই মনে হয়। তিনি ভাবছেন তার হুমকিতে বিশ্বব্যাংকের হাঁটু ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপবে।
বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠছে না। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বহু সড়ক প্রায়ই চলাচলের অযোগ্য থাকে, মেরামত ও সংরক্ষণের অভাবে এখানে-ওখানে সেতু ধসে পড়ার খবর প্রায়ই পড়ি পত্রিকায়। শোনা যায়, মন্ত্রী দফতর থেকে শুরু করে বিভিন্নপর্যায়ে বখরা দিয়ে দিয়ে বরাদ্দ অর্থের সামান্য অংশই প্রকল্পের জন্য অবশিষ্ট থাকে। যত দূর মনে পড়ে, বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তা ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের একটা বড় অংশই প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ইত্যাদি আমদানি বাবদ বিদেশী মুদ্রায় ব্যয় হবে বলে ধরা হয়েছে। বস্তুত বিশ্বব্যাংক এ বাবদই ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছিল।
শেখ হাসিনা আর মুহিত সাহেব অন্য সূত্র থেকে ঋণ নিতে গেলে সুদ দেবেন বিশ্বব্যাংকের ১০ থেকে ১২ গুণ। অবশ্যি প্রধানমন্ত্রীর সেটা গায়ে লাগবে না। গরিব দেশের অর্থে বিদেশীদের দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে তিনি ভালোবাসেন। বেহুদা অস্ত্র কিনে রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিনের কাছ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার তিনি ঋণ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেটা গায়ে লাগেনি, টাকাটা শোধ করবে আগামী কয়েকটি বাংলাদেশী প্রজন্ম।
নিজস্ব সম্পদ ও প্রযুক্তি দিয়ে সেতুটি তৈরি হবে বলে শেখ হাসিনা যে দাবি করছেন, সেটা ‘বাঙ্গালকে হাইকোর্ট’ দেখানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। দেশবাসীকে দেয়া সব প্রতিশ্রুতি পালনেই সরকার ব্যর্থ হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে অন্তত একটা সাফল্যের দাবি করার আশা ছিল সরকারের। কিন্তু যেভাবে বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে তার ওপর দেশে কিংবা বিদেশে বিশেষ কারো আস্থা আছে বলে মনে হয় না। একাত্তরের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ছিনতাই, নির্যাতন ও হত্যার। বিশ্ববাসীর চোখের সামনে ঠিক সেসব অপরাধই অহরহ ঘটছে সরকারের নাকের ডগায় এবং খুব সম্ভবত সরকারের ইচ্ছায়। প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে বিচার নয়, রাজনৈতিক কূটকৌশল আর প্রতিহিংসাই তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারের উদ্দেশ্য।
 বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখানো
শেষ ভরসা ছিল পদ্মা সেতু। সরকারের আশা ছিল সেতু তৈরি সম্ভব না হলেও শেখ হাসিনার নামাঙ্কিত মার্বেল ফলক বসবে পদ্মার এ-তীর আর ও-তীরে। বিভিন্ন মহলের আশা ছিল কয়েক হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরে তারা গোঁফে তা দেবে। ওদিকে জনগণকে তারা ভাঁওতা দেবে, বলবে সেতুর কাজ তো শুরু হয়ে গেছে, আরেকটা দফা ভোট দাও, সেতু তৈরি হয়ে যাবেই। পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ বছরে এসে এটা এখন প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বাঁধা গৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট দাও, ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ভোট দিয়ে দাও, ২০১২ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। চার বছরে তারা শুধু লুট করেছে, কিছুই দিতে পারেনি দেশকে। বাকি ১১ মাসেও কিছু দিতে পারবে না। সুতরাং ভাঁওতাবাজি দিয়ে আবার গদি পাবার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে তারা।
বাংলাদেশের মানুষকে কি তারা পাঁঠা পেয়েছে? তারা কি জানে না যে দেশে আরো একটা দল আছে, তারা চারবার ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেত্রী জনসাধারণের ভোটে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন? তারা কি এ কথা জানে না যে, বিশ্বব্যাংক বিএনপির এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ ও প্রমাণ পেশ করেনি এবং বিএনপি আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে পদ্মা সেতু এবং অন্যান্য প্রকল্পের জন্য ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক দ্বিধা করবে না? অর্থাৎ পরিকল্পিত পদ্মা সেতু নির্মাণের বেশি সম্ভাবনা বিএনপি সরকারের আমলে। তা ছাড়া সম্প্রতি বেইজিং সফরকালে খালেদা জিয়া পদ্মার ওপর দ্বিতীয় একটি সেতু তৈরির অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিও নিয়ে এসেছেন। মনে রাখতে হবে, যমুনা নদীর ওপর বাংলাদেশের বর্তমান বিশাল সেতুটি তৈরি হয়েছিল খালেদা জিয়ার সরকারের আমলেই। পরে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তার কপালে পিতার নামের ফলক লাগিয়ে দেন মাত্র।
‘নিজস্ব সম্পদ’ থেকে পদ্মা সেতু তৈরির কথাবার্তা আকাশ-কুসুম কল্পনামাত্র। আর দেশের জনসাধারণকে হাইকোর্ট দেখানোর অপচেষ্টা। এই হাইকোর্ট দেখানো কথাটার উৎপত্তি বুঝিয়ে বললে রস উপভোগে সহায়তা হবে আশা করি। বহুকাল আগে, তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে এক ‘বাঙ্গাল’ কলকাতায় বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। দেশ থেকেই সঙ্কল্প করে গিয়েছিল যে, ওখানে হাইকোর্ট দেখবে সে। বন্ধু নিজেও কখনো হাইকোর্ট দেখেনি, হাইকোর্ট কোথায় জানেও না। এক দিন যেতে যেতে সে দেখল ট্রাম যাচ্ছে, ট্রামের মাথায় গন্তব্য লেখা ‘হাইকোর্ট’। বন্ধুকে বলল, ওই দ্যাখ হাইকোর্ট। বাঙ্গাল বলল, কোথায়? বন্ধু বলল, ওই যে! ওই দ্যাখ, ঠ্যাং উঁচু করে খট্ খট্ করে চলে যাচ্ছে।
লন্ডন, ২৯.০১.১৩
serajurrahman34@gmail.com

বুধবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পিপার স্প্রে কি অমানবিক নয়?



মুহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন চৌধুরী : ইসরাইলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন্মসূত্রে ইহুদী হেনরি কিসিঞ্জার ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন ২০২২ সালের পর ইসরাইল জাতিটি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ইসরাইল যে আজকের শক্তি ও অবস্থান নিয়ে টিকে থাকবে না, অন্তত এটুকু পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আজকের ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখার মতো আর্থিক ও কূটনৈতিক সামর্থ্য ততদিন যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে না! এ উক্তিটি স্মরণ করতে হচ্ছে ডঃ ফখরুদ্দীন ও মঈন ইউ আহম্মেদ কর্তৃক ক্ষমতা জবরদখল করার পর প্রবীণ সাংবাদিক, রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী মরহুম  আনোয়ার জাহিদ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নিয়ে যে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চালানো হচ্ছে তাদের অস্তিত্বের সংকট হবে এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ইস্কাটন রোডের বাসায় বসে বলেছিলেন। বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক হয়রানি, মামলা ও স্বদলের  রাজনীতিবিদদের মানসিক চাপের মধ্যে রেখে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করানোর অভিযোগ সর্বত্র! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকাল ৪ বছর পূর্ণ হওয়ায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন, মাইনাস টু'র প্রবর্তকরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে! এ বক্তব্য নিয়ে  আমজনতা ব্যাপক বিশ্লেষণমূলক আলোচনা শুরু করেছে। তাদের ভাষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি  উপলব্ধি করেন মাইনাস টু'র প্রবর্তকরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে! তাহলে তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না কেন? নির্বাহী বিভাগের  সকল অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ স্বচ্ছ রাজনৈতিক পরিবেশ বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে  ব্যবস্থা নিতে বিচার বিভাগের অনেকেই নিরপেক্ষ অবস্থায় থাকতে পারছে না এরই বা কারণ কি অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ঝুঁকি নিয়ে আদালতে আসলেও আদালত তাকে আশ্রয় দিতে সাহস পায় নাই। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহম্মেদ বলেছেন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী দমনে পিপার স্প্রে অত্যন্ত কার্যকারী অস্ত্র। এটা লাঠিপেটার বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এ সংবাদ পত্রিকায় পড়ে অনেকেই সমালোচনা করছে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে, তারপর রাজধানীতে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের উপর জলকামান, মরিচগুড়া ও পিপার স্প্রে করায় পটুয়াখালীর একজন শিক্ষক মোঃ সেকেন্দার আলী মৃত্যুবরণ করেছেন। এরা পুলিশের চোখে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত হলেও! অপরদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের উপর এসিড নিক্ষেপ, বিরোধীদলের অবরোধের দিন পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদের সামনে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যা? ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সামনে শিক্ষকের উপর হামলা ও পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ছাত্রকে গুলী করে হত্যা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গুলীতে শিশু হত্যা এগুলো কি পুলিশ কমিশনারের দৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম?  আর যদি তাই না হবে তাহলে তাদের উপর পিপার স্প্রে ব্যবহার করা হতো নিশ্চয়ই।  একজন প্রবীণ আইনজীবী বললেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে না বরং তারা পশুর চাইতেও জঘন্যতমভাবে শান্তিপ্রিয় মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকেই এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে। সরকার কর্তৃক সমর্থন না দেয়ায় বা না নেয়ায় বাম দলের হরতাল চলাকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের উপর পিপার স্প্রে করা হয়। সম্প্রতি শিক্ষক রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিকদের উপরে যে পিপার স্প্রে করা হচ্ছে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর জীবাণু যা চোখ নষ্ট, অঙ্গহানি কিংবা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে এমন সংবাদ ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকা চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তার পরও আবার ঐ বিষাক্ত পিপার স্প্রে ব্যবহার হয়েছে। অনেক স্থানে সেই গ্যানেট চার্জ হয়েছে বলে স্বচিত্র সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান শাসকজোটের মানবাধিকার রক্ষায় বিবৃতি দিলেও সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা শাসকজোটের জাত দুশমনে পরিণত হয়েছে তাদের ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষ থাকার আহবান জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার উহাদরণ হিসাবে এ দেশের রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের দাবিকারীদের কুকুরের সমান মর্যাদাও নেই। সম্প্রতি সিটি করর্পোরেশন কুকুর নিধন অভিযানে উত্তরায় বসবাসকারী জনৈক সচিবের কন্যার কুকুরটি সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধনকারী কর্মীরা হত্যা করায় উক্ত বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ তৈরির কারিগর যদি কুকুরের চাইতেও নিম্ন মর্যাদার অধিকারী হয়! তাহলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কোন সামাজিক, মানবিক মর্যাদাতো থাকার কথা নয়! সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনির হত্যা মামলা নিয়ে কতইনা আশ্বাস দিল সংশ্লিষ্টরা! আসলে কি শাসকদলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যারা সত্য বলে কিংবা প্রচার করে তারা অসভ্য আচরণের শিকার হবে! এমন নীতি কি অনুসরণ হচ্ছে? যে শিক্ষককে ঐ বিষাক্ত গুড়া মরিচ স্প্রের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হলো তার জন্য ঐ স্প্রের আমদানির পরামর্শদাতা ও অনুমতিদাতাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে স্বপ্রণোদিত হয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রুল জারির প্রত্যাশা পূরণ হলেও পিপার স্প্রে বন্ধ হয়নি। জনগণের অর্থে জনগণকে তার ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন স্তব্ধ করতে বিষাক্ত স্প্রে ব্যবহারের কোন জবাবদিহি চাওয়ার কারো অধিকার নেই! এই আলামত জাতিকে সংকীর্ণ করে নেই ভবিষ্যৎ শাসকজোটের জন্য অন্ধকারের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়ার আশঙ্কা করছে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা মহান স্বাধীনতার ঘোষক জেড ফোর্সের অধিনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মীনি তিন তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শহীদ জিয়া বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের আবেদন আদালত কর্তৃক খারিজ। স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ  বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে একের পর এক মামলা দিয়ে শ্যোন অ্যারেস্ট দুই মামলায় ২০ দিনের রিমান্ড আবেদন। বিএনপির যুগ্ম মহাসিচব সাবেক ছাত্রনেতা এডভোকেট রুহুল  কবির রিজভীকে দলীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। স্কাইপি সংলাপের সাথে জড়িত বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বরা প্রতিবাদ না করায় প্রকাশিত সংবাদ সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের গ্রহণকৃত সাক্ষীর যোগ্যতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ! প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থা থেকে গ্রহণযোগ্য করতে পুনরায় বিচার কার্য শুরু না করায় পুরাবিচার কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসাবে জনমনে সন্দেহ ঘনিভূত করেছে। এ বিষয়গুলো যদি সুষ্ঠু সমাধানের উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রহণ করতেন, তাহলে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ মাইনাস টু'র প্রবর্তকরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এটা স্ববিরোধী বলে আমজনতা মন্তব্য করতে পারতো না! আজকে প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি জনগণের জন্য রাজনীতি করবেন, নাকি জনগণের অধিকার হরণকারীদের জন্য রাজনীতি করবেন? যদি জনগণের জন্য রাজনীতি করতে চান তাহলে পিপার স্প্রে আমদানির পরামর্শদাতা ও অনুমোদনকারীকে জনগণের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তা না হলে জনগণ ও বিচার বিভাগের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে জাতির জন্য সংকট ত্বরিত ঘনীভূত হবে। পুলিশ বাহিনীর পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য বাজার মূল্যের চাইতে বেশি মূল্য দিয়ে ওয়ারেন্টিসহ ফোর্ড কোম্পানির কাছ থেকে ১৯ কোটি টাকার ১০৫টি গাড়ি ক্রয়ের ছয় মাসের মধ্যেই নষ্ট হয়ে পড়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর দেখা প্রয়োজন এমন দাবি কেউ করলে তা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়? জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করার সাথে সাথেই চাল, ডাল, তৈলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়নি। মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ চেয়ারের মালিকদের সুযোগ-সুবিধা, চাকরি দিয়ে অর্থ আদায় আর বিদেশে ভ্রমণের ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ অর্থের যোগান দিতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের। তারা যাদের বিচার চায় তাদের মামলা প্রত্যাহার করে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আর যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের অসত্য ও বিচারকদের উপর প্রভাব খাটিয়ে শাস্তি দিয়ে মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের ধ্বংসের পরামর্শদাতা দিল্লী হলেও দিল্লী নিজেদের আর্থিক সংকটের কারণে সাহায্য প্রত্যাহার করলে সব চক্রান্ত গোল্লায় চলে যাবে। আজকে প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রি সেক্স বা মুক্ত যৌনের আইন রয়েছে, সেখানকার একজন নারী বাংলাদেশের এক কিশোরকে তালাক দিয়েছে লম্পটের আর দুর্নীতির কারণে! কে এই কিশোর করিতকর্মা দুর্নীতি দমন কমিশন কি তাকে চিহ্নিত করার যোগ্যতা রাখে কিনা তা এখন যত্রতত্র আলোচনা শুরু হয়েছে। এই কিশোরটির পরিচয় বের করে দুদুক দেশবাসীকে জানতে সক্ষম হবে কি? আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যে বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে! সেটা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তদন্ত পূর্বক অভিযোগ খন্ডন করতে সক্ষম হলে জনগণ বিশ্বাস করবে ৮ জানুয়ারি বিচারক নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।  এতে বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যারা রাজকোষের অর্থের যোগান দেয় তাদের উপর পিপার স্প্রে নিক্ষেপকারীদের বিচার হলে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসাবে তাদের আস্থা ও বিশ্বাস দৃঢ় হবে। তড়িঘড়ি বিচারের পেছনে নিহিত কি রহস্য রয়েছে জনগণ এটাও জানার স্পৃহা বৃদ্ধি পাচ্ছে! নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী কলা-কৌশলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর সকল কার্যক্রম জনগণ সমর্থন করে কি না তা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি আওয়ামী জোট সকল দলের অংশগ্রহণে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে (!) তারপরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নামে দায়ের করা মামলাগুলোর কার্যক্রম শুরু করলে বিচার বিভাগ নিয়ে জনমনে কোন সংশয়ের সৃষ্টি হবে না।  কারণ শাসকগোষ্ঠীকে খুশি করতে মানুষের তৈরি আইনের কারণে সক্রেটিসকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে। অথচ মহান আল্লাহ  পাক ন্যায় বিচারকদের বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর যারা শাসকদের সন্তুষ্ট করতে পক্ষপাতমূলক বিচার করবেন তাদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। আল্লাহ পাক ইজ্জৎ দিতেও পারেন আবার তা ছিনিয়ে নিতেও পারেন এটাই বিধির বিধান। অনেকে দুনিয়ার উপরেই ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তি ভোগ করে আর আক্ষেপ করতেও দেখা যায়। রাজকোষ অর্থ যোগান দানকারী আমজনতার আবেদন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের  অধীনে  নির্বাচন সম্পন্ন যতক্ষণ পর্যন্ত হবে না, ততক্ষণ বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা ও দেশের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের  নামে দায়ের করা মামলা উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিত রাখা, প্রয়োজন বলে শান্তি প্রিয় মানুষ আলোচনা করছে! তাদের ভাষায় রাজনীতিবিদদের নির্বাহী বিভাগ হয়রানি করতে হামলা মামলার রক্ষাকবজ আদালত ও গণমাধ্যম। দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়বে। দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ, সমাজবিরোধী ও সন্ত্রাসীদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা গেলে কারো জন্যই সুখকর হবে না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দলের নিবন্ধনে আমজনতার বিশ্লেষণ অনুযায়ী ভালো লক্ষণ। আবেদনকারী সকল দল নিবন্ধন দেয়ার ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু নতুন নিবন্ধিত দল ও আওয়ামী জোট থেকে বের করে বিরোধী দল বানিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা হলে এ জন্য দেশে কোন বিশৃক্মখলা সৃষ্টি হলে তার দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে বহন করতে হবে বলে সাবধান বাণী উচ্চারণ করতে শুরু করেছে। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে দেশে কলোনিয়াল কায়দায় আইনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যার শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মৌলিক, মানবিক ও নাগরিক অধিকার থেকে এ দেশের সকল মানুষ বঞ্চিত হবে। কামার, কুমার  ও ক্ষেত মজুরের অর্থে রাষ্ট্রের কোষাগার পরিপূর্ণ হয়। তাদের অর্থ বিবেকবানদের জন্য তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা সহায়ক তাদের পেছনে ছাড়া অধিকার হরণকারীদের পেছনে খরচ করার অধিকারতো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় থাকার কথা নয়। দেশ যখন ক্রান্তিকালের মুখোমুখি হয় তখন বিচার বিভাগ ক্রান্তিকাল অতিক্রমের জন্য যারা প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তাদের রক্ষা কবজ হয়। গণমাধ্যম জনগণের অভিমত তুলে ধরে সুস্থ ব্যবস্থাপনা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনকারীদের সাহস জোগায়, প্রয়োজনে দিকনির্দেশনা দেয়। আজকে চাটুকার গণমাধ্যম কর্মকর্তারাও নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্ত নয়। এ থেকে এটা অন্তত পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা অন্যায় এবং ন্যায়বিচার বিঘ্ন ঘটায় এমন কাজের সহযোগিতা করলে কেউই বিপদমুক্ত থাকতে পারে না। আজকে জাতীয়তাবাদের  মূলধারাকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সময় নষ্ট না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে অল্প সময়ের মধ্যে।  হেনরি কিসিঞ্জারের মন্তব্য থেকে পরিষ্কার সন্ত্রাস আর অমানবিক আচরণ করে কোন কিছুর স্থায়িত্ব ধরে রাখা যায় না।  তিন দিক শত্রু বেষ্টিত আর একদিকে বঙ্গোপসাগর! পালানোর জায়গা নেই লড়াই করেই শত্রুদের পরাস্থ করে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।  প্রধানমন্ত্রীকেও প্রমাণ করতে হবে তিনি যা বলেছেন তা বলার জন্য নয়, প্রবক্তাদের থেকে মুক্তি পেতেই বলেছেন। দেশবাসী বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী স্বউদ্যোগে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের চক্রান্ত থেকে জাতিকে মুক্ত করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ওয়ান ইলেভেনের মহাসঙ্কটের সময় কলম সৈনিকদের অন্যতম মাহমুদুর রহমানকে সত্য উদঘাটনের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার দিবেন। তার নামে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার করবেন। যেমন করে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্নজনের বিচারাধীন প্রায় ৭৩০০টি মামলা প্রত্যাহার করেছেন। স্বাধীনতার রূপকার, স্বপ্নদ্রোষ্টা ও প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে পুনর্মুদ্রণ করে ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় উজ্জীবিত করবেন। বিরোধী দলের নেত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দায়ের করা হয়লানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এর পাশাপাশি ১৮ দলীয় জোট নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ও বিচারাধীন মামলা প্রত্যাহারের মধ্যদিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষায় আলোচকদের মর্যাদা প্রদান করেছেন। তাহলেই তার সকল আশঙ্কা অসাড় হয়ে যাবে।
-লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মফস্বল মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম (বামমাসাফো)
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সুশাসন এখন স্বপ্নের বিষয়



সমাজে বসবাসের একটা লক্ষ্য থাকে, সুন্দর সমাজের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন পালন করতে হয়, মূল্যবোধও লালন করতে হয়। কিন্তু এসব কিছু থেকে আমাদের সমাজ যেন মুক্ত হযে গেছে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন সমাজের অধিপতিগণ এবৎং রাজনীতির নায়কগণ। সাধারণ শিষ্টাচারও এখন নির্বাসিত হতে চলেছে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। নিজ মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে কিংবা নিজের পক্ষ অবলম্বন না করলে মুহূর্তেই পরম বন্ধু বিবেচিত হয় চরম শত্রু হিসেবে। এমন পরিবেশকে কি গণতান্ত্রিক পরিবেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়? এরপরও আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কতভাবেই না বর্ণনা করে থাকেন। অথচ প্রতিদিনই আমাদের রাজনীতিবিদদের আচরণে গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হচ্ছে, জনমনেও শঙ্কা বাড়ছে। মানুষ এ বিষয়টি ভালভাবেই উপলব্ধি করেছে যে, গণতন্ত্র আসলে উচ্চারণের বিষয় নয়, আচরণের বিষয়। বিগত বছরগুলোতে মানুষ আরো উপলব্ধি করেছে যে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। গণতন্ত্র আসলে একটি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের নাম, যা থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির নেতা-কর্মীরা এখনো বহু দূরে অবস্থান করছেন।
আমাদের রাজনীতি থেকে যে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার লোপ পেতে বসেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক এক সাংবাদিক সম্মেলনেও। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক এক লিখিত বক্তব্যে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসাকে মানসিক ভারসাম্যহীন ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গত রোববার চ্যানেল আই-এর টকশোতে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা মাহবুব উল আলম হানিফের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাকে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, তাহলে বঙ্গবন্ধু আমাকে এমপি বানালেন কেন? বিটিভির মহাপরিচালক করলেন কেন? সবচেয়ে বড় কথা, এ সরকারের আমলা শেখ হাসিনা আমাকে বিদেশ সফরে নিয়ে গেলেন কেন? একজন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোককে একুশে পদক কেন দেয়া হলো? মজার ব্যাপার, আমি নাকি টেলিভিশন চ্যানেল চেয়ে পাইনি বলে আওয়ামী বিরোধী কথাবার্তা বলছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধাই যদি নেব তাহলে টেলিভিশন কেন, একটা কুইক রেন্টাল নিলেই তো বেশি আয় করতে পারতাম। যারাই বর্তমান সরকারের সমালোচনা করছেন তাদেরই চরিত্র হনন চলছে। আমার বেলায় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে অথচ এক-এগারোর পর শেখ হাসিনা দেশে না ফেরায় নেতা-কর্মীরা যখন হতাশ তখন আমিই তাকে ফোন করে দেশে আসতে বলেছিলাম। খোঁচা মেরে বলেছি, তুমি ওখানে বসে আছ তোমার দলতো শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক-এগারোর পরে মাইনাস টু ফর্মুলার বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি লিখেছি আমি। কারণ শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার যে ফর্মুলা ছিল, কোথায় পরিকল্পনা হতো সে খবর আমি রাখতাম। জেনারেল মইনের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছি আমি। সে আমারই চরিত্র হনন শুরু হয়েছে। যে বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাহবুব উল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলন করেছেন সে প্রসঙ্গে এবিএম মূসা বলেন, আমি শেখ মুজিবকে তৃতীয় সারির নেতা বলেছি, তাও বলেছি তরুণ শেখ মুজিবর রহমানের কথা। তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। বলেছি প্রথম সারিতে মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, দ্বিতীয় সারিতে আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ এবং যুব সমাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন তৃতীয় সারিতে। কিন্তু নিজস্ব নেতৃত্বের গুণে, ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় তিনি দ্বিতীয় সারির নেতাদের ডিঙ্গিয়ে প্রথম সারিতে উঠে আসেন। ৬ দফা দেন। কিন্তু কিছু পত্রিকায় ‘সারিকে' ‘শ্রেণী' বলে, পূর্বাপর সম্পর্ক ঠিক না রেখে সংবাদ প্রকাশ করায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে এর ভিত্তিতে আমাকে মুজিব বিদ্বেষী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফের বক্তব্য ও সাংবাদিক এবিএম মূসার জবাব থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, আমাদের সমাজে এখনও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটেনি। অন্ধ দলপূজা, ব্যক্তিপূজাই এখানে প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, যার যে মর্যাদা প্রাপ্য আমরা দেব না। কিন্তু ইতিহাসের আলোকে কেউ কোনো সময়ের বা বিষয়ের বিশ্লেষণ করতে চাইলে কিংবা কারো কোন সমালোচনা করলে তা শোনার মত ধৈর্য আমাদের থাকবে না কেন? ধৈর্য নিয়ে শোনার সক্ষমতা অর্জন করলে কোন বক্তব্যের কিংবা ভুল মন্তব্যের সঙ্গত জবাব দেয়া সহজ হয় কি? গণতান্ত্রিক সক্ষমতা অর্জিত না হলে মানুষ কোনো ভিন্ন মতের জবাব দিতে গিয়ে মানুষের চরিত্র হননে প্রবৃত্ত হয়। এমন আচরণ জনসমর্থন থেকে বঞ্চিত হয় এবং চরিত্র হননকারীর ইমেজও ক্ষুণ্ণ হয়। যেমনটি লক্ষ্য করা গেছে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফের ক্ষেত্রে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কথা বলছিলাম। এসব বিষয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি বলেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি আইনের শাসন। সুশাসন এখনও আমাদের স্বপ্নের বিষয়। এ কারণেই পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করার পরেই ছাত্র খুন'। গত মঙ্গলবার এমন শিরোনামে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয় নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়রী (জিডি) করার দেড় ঘণ্টা পরেই খুন হলো কলেজ ছাত্র নূরুল আমীন সুহেল। এই ঘটনায় উত্তেজিত জনতা ঘাতকের গাড়ি ও বাড়িতে আগুন দিয়েছে। নিহত নূরুল আমিন সিলেটের মোগলবাজার থানার বাসিন্দা ও মদনমোহন কলেজের বিএ অনার্সের ছাত্র। গত রোববার ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত রোববার এলাকার রফিক বক্স সুহেলের একটি মোরগ ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে রফিক বকস ও তার স্ত্রী সুহেলের বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় সুহেল নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করে। এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রাত ৮টার দিকে সুহেল এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে রফিক বকস ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে গুরুতর আহত করে। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমাদের এই গণতান্ত্রিক (!) সমাজে কথা কাটাকাটির জের ধরে একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এমন ঘটনায় মনুষ্যত্বের অবনতির সাথে সাথে আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্রও লক্ষ্য করা যায়। নিহত সুহেল নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করলেও পুলিশ তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। ফলে তাকে প্রাণ হারাতে হলো। আর আশঙ্কার বিষয় হলো, দেশে সরকার ও থানা-পুলিশ থাকার পরও কোনো মানুষকে হত্যা করতে এখন ঘাতকরা মোটেও কুণ্ঠিত নয়। থানা-পুলিশকে ঘাতকরা এতটা অবজ্ঞা করে কীভাবে? এর কারণ বিশ্লেষণ করলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক বিষয় উঠে আসে। আসলে পুলিশ যখন আইন-শৃক্মখলা রক্ষা তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বদলে বিরোধীদলকে অবদমনে সরকারের পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা থাকে না। কোনো দেশের পুলিশ মূল কাজের বদলে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি রক্ষিত হবে কেমন করে?
পুলিশকে আজকাল পেশাগত দায়িত্ব পালনের চাইতে রাজনৈতিক কর্তব্য পালনে বেশি তৎপর দেখা যায়। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও তেমন চেতনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বিরোধী দলের চিফ হুইপকে পেটানোর কারণে যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়া হয়, তাহলে পুলিশকে রাজনীতিককরণের আর কিছু বাকি থাকে কী? সরকারের এমন চেতনা এবং পুলিশের এমন আচরণ দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা তো সম্ভব নয়। বিষয়টি ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পুলিশ বাহিনীকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের বদলে যেন বিশেষ এক রাজনৈতিক ঘোরের মধ্যে রাখার চেষ্টা চলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের পর ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের গত সোমবারের বক্তব্যে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সামনেই শিবির কর্মীদের দেখামাত্র পুলিশকে গুলী করার নির্দেশ দিলেন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ। একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার এমন নির্দেশে বিস্মিত হয়েছেন নাগরিক সমাজ। শিবিরের কর্মীরা যদি আইন-শৃক্মখলা বিরোধী কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে তো আইনসিদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারে দেশের পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু শিবির কর্মীদের দেখামাত্র গুলী করার নির্দেশ কি দেশের কোনো আইনের মধ্যে পড়ে? আইনের মানুষরাই যদি এমন বেআইনী কথা বলেন, তাহলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে? ডিএমপি কমিশনার যে বক্তব্য রেখেছেন তা কোনো রাজনৈতিক কর্মীর মুখেও শোভা পায় না। জানি না আমাদের মন্ত্রীমন্ডলী তথা সরকার বাহাদুরের দায়িত্ব গ্রহণকালীন শপথের কথা মনে আছে কিনা! তারা তো এই মর্মে শপথ নিয়েছিলেন যে, অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে তারা কোনো কাজ করবেন না। কিন্তু এখন তো তাদের এবং তাদের আজ্ঞাবহ প্রশাসনের আচরণে অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়ই প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শপথ ভঙ্গ করে কোনোদিন সফল হওয়া যায় না, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বিষয়টি তারা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিপজ্জনক একটি খেলা


জসিম উদ্দিন

বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর জন্য পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে পদক দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্য একটি অপরাধ সংঘটনের পর তার বিচার না করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে উল্টো পদক দেয়ায় সাংবাদিকেরা যখন এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীরকে প্রশ্ন করেন, জবাবে তিনি এ তথ্য জানান। ‘অপরাধীকে’ পুরস্কৃত করার পর আবার তার সাফাই গেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কথা বলবেন, তা কেউ বিশ্বাস করেনি। প্রকৃতপক্ষে এটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য না মিডিয়া টুইস্টিং, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বারবার অনেকে বিভিন্ন টিভি ফুটেজে তার স্পষ্ট উচ্চারণটি শুনেছেন। তারপরও কেউ কেউ বিশ্বাস করেননি। একজন ডক্টরেটধারী সাবেক আমলা তার মতোই জাতীয় সংসদের আরেকজন সদস্যকে পেটানোর জন্য ‘অপরাধীকে’ পুরস্কৃত করবেন; কিভাবে তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে! সবাই আশা করছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন এবং ওই বক্তব্যকে ‘স্লিপ অব টাং’ বলে তিনি কলঙ্ক থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করবেন। তা তো হলোই না বরং পরের দিন আরো ভয়াবহ বক্তব্য রেখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন তিনি। হারুনের সমর্থনে দেয়া নিজের বক্তব্যকে একটি ‘সাহসী উচ্চারণ’ বলে নিজেই দাবি করেন। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের ‘সাহসী বক্তব্য’ দেয়ার জন্য অনেকে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নিজের দল বা দলের বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে এমনটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। কারা তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে তিনি নিজেও নামধাম জানাননি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পূর্বোক্ত হারুন নাকি অসাধারণ অবদান রেখে চলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, চিফ হুইপ আইন অমান্য করে মিছিল করায় পুলিশ হারুন তাকে শায়েস্তা করেছেন। ২০১১ সালের সেই ঘটনায় সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন গাড়ি ভাঙচুর করেছেন বা ঢিল মেরেছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। হঠাৎ দেখা গেল হারুন ও বিপ্লব নামে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা তার ওপর চড়াও হলেন। চড়থাপ্পড় মেরে রাস্তায় ফেলে দিলেন তারা জয়নুল আবদিনকে। ততক্ষণে অন্য সহযোগীরা তাকে লাথি-কিল-ঘুসি মেরে কাবু করে ফেলেছে। জীবন বাঁচাতে দৌড়ে সংসদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় আশ্রয় নেন তিনি। এরপরও তাকে ছেড়ে দেয়া হলো না। সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে এনে রাস্তায় ফেলে আবার পেটানো হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় দলীয় সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করেন। হারুন ও তার সহযোগীদের জয়নুলবধের এ নিষ্ঠুরতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদান’! হারুনের পুরস্কার পাওয়ার পেছনে আরো যে কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো লালবাগ এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় হারুনের নিরলস প্রচেষ্টা চালানো। অথচ বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগের খুনিরা প্রকাশ্যে হত্যা করার সময় হারুন পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন। তার একটি মাত্র পদক্ষেপই সেদিন নিরীহ গরিব এই দোকানিকে বাঁচাতে পারত। কোর্ট এলাকায় বিচারপ্রার্থী এক নারীর শ্লীলতাহানি করেছে হারুনের ফোর্স। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে কয়েকজন সাংবাদিকও তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব কুকীর্তি গোপন কিছু নয়। এগুলো ফলাও করে মিডিয়ায় প্রচার পেয়েছে। অনেকেই ক্ষোভের সাথে বলছেন, এসব যদি ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিরলস প্রচেষ্টা’ হয় তাহলে সরাসরি ডাকাতি, লুণ্ঠন, খুন করলে আরো বড় পুরস্কার পাওয়া উচিত! কেউ সাহসের সাথে এমন অপরাধ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এসে পুরস্কার দাবি করলে তিনি কোন নৈতিকতার বলে তা প্রত্যাখ্যান করবেন?
মহিউদ্দীন আলমগীর একজন ‘অপরাধী’র পুরস্কার পাওয়া নিয়ে সাফাই গাইছেন স¤পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। পুলিশের দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা হারুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিল। জয়নুল আবদিন ফারুককে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন বিরোধী নেতা হওয়ার কারণে। চিফ হুইপ বিরোধী দলের ব্যক্তি না হলে ছাত্রলীগের সাবেক এ সদস্য এতটা আগ্রাসী হয়ে পেটানোর প্রেরণা পেতেন না। একজন পেশাদার পুলিশ (তদুপরি কর্মকর্তা) কখনো একজন রাজনৈতিক নেতার ওপর এভাবে চড়াও হওয়ার চিন্তাও করবে না। ওই নেতা যদি কোনোরূপ আইন ভঙ্গ করে থাকেন তাহলে তাকে আইনের অধীনে আনতে পারেন বড় জোর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্বোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই যেন উপহাস করলেন। ২২ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এসব উদ্ভট কথা বলছেন তার আগে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না। পুলিশ বাহিনী শুধু জনগণের নিরাপত্তা সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকবে। যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, পুলিশ আইন ভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনবেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের শত ভাগ বিপরীত কথা বলে লজ্জাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন তা নয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, ‘পুলিশ শুধু জনগণের নিরাপত্তা সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকবে’ এর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন। সাধারণ নাগরিক বিশ্বজিৎ হত্যার খুনিদের বিচারে গড়িমসি করছে তার পুলিশ বাহিনী। কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়ে শিশু রাব্বি হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সন্ত্রাসী বিকাশ তার অনুমতি ছাড়া জেলখানা থেকে সম্প্রতি ছাড়া পেতে পারে না। এ দিকে হত্যা, খুন, গুম চলছে নির্বিচারে। সাধারণ মানুষ রয়েছেন মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে।
প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার সঙ্কল্পে অটল থাকতে পারছেন না। চার বছর ধরে পুলিশের নিয়োগে যে অনিয়ম চলছে এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলে পুলিশবাহিনীতে নিয়োগ নিয়ে এভাবে পুকুর নয়, সাগর চুরির ঘটনা ঘটত না। পুলিশে একচেটিয়া নিয়োগ দেয়া হয়েছে গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে। মহাজোট সরকারের চার বছরে ২৮ হাজার পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরো প্রায় চার হাজারের বেশি সদস্যের নিয়োগপ্রক্রিয়া চূড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক নিয়োগে নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জ থেকে আট হাজার পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সাত হাজার সদস্য নিয়োগ পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের জেলা কিশোরগঞ্জ থেকে। এ জেলাটি অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট নিজ জেলা। ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর থেকে পুলিশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে দুই হাজার সদস্য। এ জেলাগুলোর প্রতি ক্ষমতাসীনদের রয়েছে বিশেষ দুর্বলতা। দেশের ৫৯টি জেলার জন্য বাকি থাকল কী? দেশের বৃহত্তম অংশের জনগণ যদি বৈষম্যের অভিযোগ আনেন তাহলে প্রধানমন্ত্রী কী জবাব দেবেন, জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে এ ধরনের নিয়োগ জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তার জন্য কতটা শঙ্কার, সেটা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছেন।
পুলিশের এ অভিনব নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ ছিল দলীয় নেতাকর্মী, তারপর মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আত্মীয়স্বজন। দলীয় ও আত্মীয়করণ হয়েছে শত ভাগ। এর সাথে যখন অবৈধ উৎকোচের সংশ্লেষ ঘটে, সব মিলিয়ে সেটা ‘শত ভাগের বেশি’ অবৈধ হয়ে যায়। পুলিশের চাকরি এখন একটি লাভজনক লোভনীয় পেশা। গায়ে পোশাকটি জড়ানোর পর যেন সনদ পাওয়া যায় কাঁড়ি কাঁড়ি অবৈধ অর্থ কামানোর। ‘দলীয়’ ও ‘আত্মীয়’ পরিচয়ে নিয়োগ দিয়ে দলীয় আনুগত্য শত ভাগ সন্দেহমুক্ত করা হয়েছে। এরপর করা হয়েছে লাখ লাখ টাকার নিয়োগবাণিজ্য।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ (যেখানে অর্থ বেশি কামানো যায়) সব পদ গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জীদের হাতে চলে যায়। রাজধানীর প্রায় সব থানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বিশেষ জেলায় জন্ম নেয়া। এ কারণে তাদের অসম্ভব দাপট। এখন অবশ্য খবর বের হচ্ছে, এসব কর্মকর্তা রাজধানী ছেড়ে যেন তেন জায়গায় পোস্টিং নিতে তদবির করছেন জোরেশোরে। আত্মীয়তার জোর খাটিয়ে বেশি করে কামিয়ে নিয়ে সরকারের দুঃসময়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা ঢাকা থেকে পালাতে চাইছেন। তাহলে সরকারের কী লাভ হলো, যদি বিপদের সময়েই তারা পাশে না থাকল। একই এলাকার অধিকসংখ্যক পুলিশ সরকার ও জনগণের এবং পুলিশ বিভাগের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের পুলিশ অফিসারদের কারণে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। একই জেলা থেকে মাত্রাতিরিক্ত নিয়োগ বাহিনীটিকে আরো অদক্ষ করে তুলবে। এলাকাগত বিরোধ অন্যদের বিুব্ধ করবে। সুবিধার জন্য যারা অবিবেচকের মতো কাজ করছেন তাদের জন্য এটা হয়ে উঠবে বিপজ্জনক।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন কাজের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি তার শত ভাগ বিপরীত। অর্থাৎ আমরা যা বলছি কাজ করছি ঠিক তার উল্টো। যারা প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেলে পুরো পুলিশ বিভাগে তার প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যেই পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাহলে কিভাবে পুলিশের কাছ থেকে আমরা উন্নত নৈতিকতা ও পেশাদারিত্ব আশা করব?
এর প্রভাব পড়ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও। এর বিষময় ফল ভোগ করছে জনগণ। চোর-ডাকাত, ধর্ষক, খুনি ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে জনগণ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে গাজীপুরে দু’জনকে পিটিয়ে মেরেছে জনতা। অপর দিকে, খুনি ও সন্ত্রাসীরা পুলিশের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে এক দিনে সাতটি লাশ পাওয়া গেছে। এমনকি কথিত প্রেমিক-প্রেমিকারাও কাজে লাগাচ্ছে এ সুযোগকে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী থেকে। স্ত্রীর প্রেমিক সন্দেহে স্বামী খুন করিয়েছে একজনকে। সে রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ধর্ষণের ঘটনা এখন প্রতিদিন ডজন ডজন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে জড়িতরা এসব অপরাধ করতে মোটেও কুণ্ঠিত নয়।
বর্তমান সরকার শেষ সরকার নয়। আজ না হোক, এক বছর বা পাঁচ বছর পর যখন তারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়বেন, সেই সময়ের কোনো সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি হন জয়নুল আবদিন ফারুকের মতো কোনো নেতা, সে সরকারের সময় কোনো এক হারুন-বিপ্লব জুটি যদি রাজনৈতিক নেতা মহিউদ্দীন খান আলমগীরের ওপর একইভাবে চড়াও হন, সে পুলিশ যদি বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে পদোন্নতি পান, ভালো জায়গায় পোস্টিং পান (অর্থাৎ যেখানে বেশি কামানো যায়), বছর শেষে আবার পিপিএম পুরস্কারও পান, কেন তাকে পুরস্কার দেয়া হলো, এমন প্রশ্নের উত্তরে ফারুক যদি বলেন বিরোধী দলীয় এক নেতাকে পেটানোর জন্য এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে তাহলে তখন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কেমন অনুভূতি হবে, তা ভেবে দেখতে পারেন। এ ধরনের ভাবনার মধ্যে সবার কল্যাণ রয়েছে।
jjshim146@yahoo.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আরেকটি গণতন্ত্র বধ কাব্য


মাসুদ মজুমদার

কে নির্বাচনে এলো, কে এলো নাÑ এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবতে চান না। তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং তিনি ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন করতে চান। আগে চেয়েছিলেন ২০১৩ সালের অক্টোবরে। ক’দিন পরে কী বলবেন জ্যোতিষী ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে তিনি এখন ওপরের দিকে যত থুথু ছিটাচ্ছেন সবই নিজের ও দলের গায়ে মাখছেন। সরকার ও মহাজোট নেতাদের অবস্থানও এ ব্যাপারে অস্বচ্ছ এবং গোঁজামিলনির্ভর। এই গোঁজামিল এবং মতলববাজি থেকেই সরকার আবার এক-এগারোর মতো ‘গজব’ নাজিলের আলামত স্পষ্ট করে দিচ্ছে। গভীরভাবে ভাবলে মনে হবে, লেবাস বা খোলসটা আলাদা; কিন্তু আমরা সেই গজব নাজিল করা সরকারের একটা বর্ধিত সংস্করণের ভেতর আছি। যদিও একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো, সেই সরকার চার বছর অতিক্রম করে মেয়াদ শেষ করার দ্বারপ্রান্তে। সংসদ হয়ে পড়ল ভারসাম্যহীন, অকার্যকর। জনগণের মনোযোগ পড়ল না সংসদের দিকে। বিরোধী দল পুরনো সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। সরকারি দলও বিরোধী দলকে সংসদের ভেতরে-বাইরে সহ্য করতে না পারার সব অগণতান্ত্রিক আচরণ প্রদর্শন করে গেল। অবশ্য ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদ পূর্তির একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি সবকিছুর আড়ালে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। আবার সংসদে প্রেসিডেন্টের ভাষণে বিরোধী দলের মণ্ডুপাতের নতুন সংস্কৃতিও চালু হয়েছে।
বিচার বিভাগ নিয়ে জনগণ কখনো ভরসার ওপর দাঁড়াতে পারছেন না। একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে গেলেন বিচারপতি। স্বচ্ছতার সাথে একটি ট্রাইব্যুনাল চালানোর ক্ষেত্রেও বিচার বিভাগ হতাশ করল। এখন চোর অভিযুক্ত হচ্ছে না, কে চুরি করা দেখে ফেলল তাকে দোষী করার তোড়জোড় লক্ষ করছি। প্রযুক্তির জালে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও সরকারের অভিলাষ শুধু প্রশ্নবিদ্ধ হলো না, ধরা পড়ে গেল অনেক অনাকাক্সিত বিষয়-আশয়। জনগণের কাছে প্রতিহিংসার রাজনীতির বর্ধিত সংস্করণের মতোই বিচার বিভাগও দায়মুক্ত থাকল না। তাই একটি-দু’টি ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের রায় কিভাবে গ্লানিমুক্তির বিষয় হয় বোঝা কঠিন। এক দিকে অযোগ্যতা, অন্য দিকে আজ্ঞাবহের ভূমিকাÑ এখন দুদক একটি গোঁজামিল দেয়ার প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছুই নয়। দুর্নীতি পদ্মা সেতুকে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবিয়েছে। আর দুদকের ইমেজ ডুবেছে ভূমধ্য সাগরে। নির্বাচন কমিশন কয়েকটা স্থানীয় নির্বাচন করে বেশ ফুরফুরে মেজাজ দেখালেও ইতোমধ্যে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটিও নির্বাহী বিভাগের কাছে যে জিম্মি, তার স্বাক্ষর রেখেছে। তা ছাড়া এই মেরুদণ্ডহীন কমিশন এখনো গরিষ্ঠ দলের কাছে স্বীকৃতি পায়নি। কিছু সন্ত্রাসীর ফাঁসি মওকুফ করে রাষ্ট্রপতির প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তার ওপর সংসদে বিতর্কিত ভাষণ। এ যেন অভিভাবকত্বের জায়গাটিকেও অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভাসিয়ে দেয়া হলো।
তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে দূরত্ব বেড়েছে। সম্পর্কের টানাপড়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির খেসারত নিয়ে জনগণ এখন কম বিব্রত নয়। সেই অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য এখন পররাষ্ট্রনীতিতে ইউটার্ন নিতে হচ্ছে, যা বাকশালীয় ধারায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনেরই আলামত স্পষ্ট করেছে। ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার সপক্ষ-বিপক্ষ শক্তির মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিচ্ছেন এই ইউটার্নকে সহজ করতে; একই লক্ষ্যে দুরভিসন্ধিমূলক উসকানি দিচ্ছেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এর সহজ সারমর্ম দাঁড়ায়Ñ ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির দিকে ভারত শুধু ইঙ্গিতই দিচ্ছে না; বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটা সস্তা রাজনীতির মুলোও ঝুলিয়ে রাখতে চাচ্ছে। এটাও বাকশালী ধারায় নিয়ে যাওয়ার কূটনৈতিক ফন্দি। হয়তো ঝুলানো মুলা চেখে দেখতে কেউ দিল্লি যাবেন, দিল্লি থেকে কেউ আসবেন ঢাকায়।
হালে নতুন করে বিশ্বব্যাংকের সাথে টানাপড়েন বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সরকার দ্বারা শুধু বিড়ম্বিত হয়নি, অবিবেচনাসুলভ আচরণও পেয়েছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্বকে পাশ কাটানো কিংবা ‘শিক্ষা’ দেয়ার জন্য এ সরকার বাকশাল আমলের মতো রুশ-ভারত অক্ষশক্তির চরণে নিজেকে সোপর্দ করেছে। ধসে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু ছিল না। বন্ধু ছিল তাদের, যারা মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা খুলে আনুগত্য দেখাত। তবে মুক্তিযুদ্ধে তারা ভারতের সাথে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে বাকশাল চাপানো ও গণতন্ত্র হত্যার দায় সেই সোভিয়েত রাশিয়ারও রয়েছে। রুশপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর কাঁধে সওয়ার হয়েছিল সেদিন, ঠিক আজকের মতোই।
একাত্তরই শুধু আমাদের শত্রু-বন্ধু চেনায়নি, ১৭৫৭, ১৮৫৭ ও ১৯০৫-এর পথ ধরে ১৯৪৭ হয়ে আমরা ১৯৭১-এ পৌঁছেছি। সব সময় রাশিয়া আমাদের মিত্র ছিল না, বরং জোটবদ্ধ বিশ্বে তারা ছিল প্রতিপক্ষ। এই পথচলা ও সিঁড়ি ভাঙতে আমরা ভারতকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি মাত্র একবার। প্রতিপক্ষে পেয়েছি সাতবার। এই জনপদের স্বাধীনতার পাটাতনটি এক দিনে তৈরি হয়নি। সেটা পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা আজকের রাশিয়া-ভারত সৃষ্টি করে দেয়নি, বরং প্রতিটি পর্বে রুশ-ভারতের ভূমিকা জনগণ জানেন। বঙ্গভঙ্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপট এখনো তাজা ইতিহাস। শিক্ষামন্ত্রী সিলেবাস পাল্টে ভাসানীকে আড়াল করতে পারেন। পূর্ব বাংলাকে আড়াল করাই ছিল যাদের অভিলাষ, আমাদের জাতীয় নেতাদের নাম উচ্চারণে যারা নাক সিটকাত, তারাই বন্ধু সেজেছেÑ এ সত্য ক’দিন আড়াল করে রাখবেন। একাত্তরে ভারত যা করেছে তার যোগফল ভারতের স্বার্থানুকূলে ছিল বলেই ভারত এগিয়েছে। এত টনটনে দরদ ও স্বাধীনতার ফেরিওয়ালা হলে কাশ্মির, সেভেন সিস্টারসহ মাওবাদীদের কান্না থামে না কেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মদদ দিয়েছে পরাশক্তির অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলে ঢুকতে না দেয়ার শর্তে। তাই বলে এ দেশের মানুষের মাথা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও চীন কেউ কিনে নেয়নি। অসংখ্য মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশের মানুষের আলাদা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। নবাব সলিমুল্লাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানীর মতো জাতীয় নেতারা কাঁধ পেতে দিয়েছিলেন বলেই একটি পরিণত সময়ে বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন দাবির পথ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিতে পেরেছিলেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ কাউকে বড় করার জন্য অনেককে ছোট করা হয়। অনেককে অপাঙ্ক্তেয় করার জন্য কারো কারো পে মিথ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সভাপতি, যাকে তিনি পা ছুঁয়ে কদমবুচি করতেন, সেই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে যান। কারণ তিনি ছিলেন বাংলাদেশপন্থী, ভারত ও রুশপন্থী নন। অথচ কিংবদন্তিতুল্য জাতীয় নেতাদের পথ মাড়িয়ে তিতুমীর, শরীয়ত উল্লাহ, মুনশী মেহেরুল্লাহর মতো সাহসী মানুষের পথচলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আজকের এই বদ্বীপ বাংলা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ নজরুল, জসীমউদ্দীন, ফররুখ, আব্বাসউদ্দীনদের রাজনীতির আড়ালে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সামনে আনা হচ্ছে এমন এক ইতিহাস যার সাথে এ জাতি পরিচিত নয়।
বর্তমান সরকার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অনেক খারাপ বা মন্দ উপমা রেখে যাচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছেন এ সরকার শেষ সরকার নয়। এসব মন্দ কাজ তাদের ওপর প্রয়োগ করা যে হবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে। প্রতিপক্ষ ও জনগণ যখন প্রতিশোধ নেবে, তখন রুশ-ভারত সাথে থাকবে তারও কোনো নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।
অবশ্য রাজনীতির একটি নিজস্ব ভাষা আছে। সেটা সংবিধান সংশোধন করে, প্রশাসন দলীয় মেজাজে সাজিয়ে, এমনকি নিজেদের অধীনে নির্বাচন করেও পছন্দমতো পরিবর্তন আনা যায় না। সব সময় দুয়ে দুয়ে চারের মতো মিলিয়ে দেয়া যায় না। তা ছাড়া এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব যে, ইতিহাসকে আড়াল করে রাজনীতি বেশি দূর এগোয় না। বর্তমান শাসকেরা ইতিহাসকে আড়ালে রেখে হাজার বছরের অর্জনকে ভুলে তাৎক্ষণিক পাওনা বুঝে নিতে ব্যস্ত। সে কারণে শাসনে-শোষণে জাতি এখন জর্জরিত। দুর্নীতি আর অপশাসনে ক্ষতবিক্ষত। সাধারণভাবে জনগণ কখনো দুর্বিনীত হয় না। হঠকারী হয় না। একটি ভালো সময়ের জন্য নাক উঁচু করে অপেক্ষা করে। প্রথম সুযোগেই সরকার পাল্টে দেয়। বিগড়ে যাওয়া জনমতও অনেকটা আশাবাদী করে; যদিও মরিচের গুঁড়া ও মারণঘাতী পিপার গ্যাস ছিটিয়ে জনগণের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। নিপীড়ক পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট পদক পাইয়ে দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আস্ফালন ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালছে। তার পরও আশাবাদী থাকতে চাই। কারণ, শাসকেরা জনগণের কাছে আবার ভোটভিক্ষার সুরে কথা বলছেন। প্রতিপক্ষকে নিন্দাবাদ করে সমালোচনার তীর ছুড়ে জনগণকে কাছে পেতে চাইছেন। এখন জনগণ পরখ করার সুযোগ নেবেন। যদিও সরকারের সামনে বহুদিন ক্ষমতায় থাকার আলাদা রূপকল্প রয়েছে। বর্তমান সরকার স্বচ্ছ নির্বাচনে যে নিজেদের অবস্থান ভালো হবে না এই সত্যটুকু জেনে গেছে। তাই নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য যা যা করার প্রয়োজন করবে। তার পরও অনিশ্চয়তা না কাটলে নির্বাচন করার সব প্রক্রিয়া যে ভণ্ডুল করে দেবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তাদের সামনে পথ খোলা থাকবে- নিরাপদ অবতরণের জন্য একটা ন্যূনতম নিশ্চয়তা নিয়ে তৃতীয় পক্ষকে আমন্ত্রণ করে ডেকে নিয়ে আসা। সে জন্য যেকোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে এ সরকার প্রস্তুত থাকার ঐতিহ্য রয়েছে। সেই সক্ষমতা তারা এখনো হারায়নি। সে কারণেই রাজনীতির ভাগ্য সম্ভবত পদ্মা সেতুর ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে।
সরকার মনে করে, পদ্মা সেতু না হলে একটা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায় জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিয়ে পার পাওয়া যাবে। কিন্তু দুর্নীতি হাতেনাতে প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়ে ধোঁয়াশা অবস্থায় রেখে দিলে পদ্মা সেতু হবে না। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে রাজি হবে না। তাতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের, সরকার হিসেবে বর্তমান সরকারের ভাবমর্যাদা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, জনগণ পদ্মা সেতু করতে না পারার বিষয়টি শুধু ব্যর্থতার দৃষ্টিতে দেখবে। তখনো দুর্নীতির দায় আলো-আঁধারির অন্ধকারে থেকে যাবে। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা মতো তদন্ত না করলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এগিয়ে আসবে না, এটা বোকাও বোঝে। তার পরও সরকার ভাবছে, জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রকে গালমন্দ, বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী আবাসিক প্রতিনিধিকে রাজনীতি শুরু করার নসিহত ও ড. ইউনূসকে দায়ী করে জনগণকে বোকা বানানো সম্ভব হবে। কিন্তু সঠিক তদন্ত হলে সরকার বিশ্বচোরের খ্যাতি থেকে কোনোভাবেই মুক্তি পাবে না। এ দায় নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাওয়া সহজ হবে না। তাই বিশ্বব্যাংক না আসুক, পদ্মা সেতু না হোক, দুর্নীতিও চাপা পড়ে থাকÑ যুক্তরাষ্ট্রও কাছে না ঘেঁষুক, পোশাক ও অন্যান্য খাত ডুবে যাক, তাতে দেশের ক্ষতি হলেও এটা সরকারের নগদ চাওয়া পূরণ হবে, কারণ ক্ষমতা আবার তাদের পেতেই হবে। ইতোমধ্যে রুশ-ভারতের দিকে কেবলা পরিবর্তন করে সরকার ভাবছে সব মুশকিল আসান হলো। দুর্ভাগ্য, রাশিয়া এখন শুধু পশ্চিমা ভাঁড় নয়, অন্যতম দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যও। অবস্থানও বাংলাদেশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিকভাবেও ধরাশায়ী। পরমাণুর কারণে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেও বিশ্বে তাদের প্রভাবের ধস আগেই নেমে গেছে।
যেকোনোভাবে জিতে আসার নিশ্চয়তা না পেলে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টিও পদ্মা সেতুর ধারায় এগোবে। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার দাবি মেনে নির্বাচন করে জেতা সম্ভব নয়Ñ এটি এখন স্পষ্ট, যা আগেও উল্লেখ করেছি। তাই নির্বাচন করে হেরে অতীত অপকর্মের দায় নেয়ার চেয়ে ক্ষমতা তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলে দেয়া অধিকতর নিরাপদ ভাবা অনেকেরই অভিজ্ঞতার ফসল। সরকার যে জবরদস্তির পথ ধরে পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও আইন-আদালত অপব্যবহার করে আবার ক্ষমতা কব্জা করার জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠবে, তা তারা গোপন রাখছে না। সরকার ধারণা করছে, আবার যেভাবেই হোক ক্ষমতা কব্জা করা সম্ভব হলে কম করে আরো আড়াই-তিন বছর পার করে দেয়া সম্ভব। দেশটাকে কারাগারে রূপান্তÍর করে হলেও সেই চেষ্টা এখন শাসক ও তাদের দেশী-বিদেশী মিত্রদের মগজ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবে মানুষ ভাবে এক, বিধাতা ভাবেন অন্যটা। তা ছাড়া পরিবর্তনকামী জনগণকে আর বোধ করি দাবিয়ে রাখা সহজ হবে না।
সত্যাশ্রয়ী ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে জনগণই শেষ ভরসা ও সব পরিবর্তনের নিয়ামক। তাই রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নির্বাচন পদ্মা সেতুর ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে ধরে নিলেও কিছু কথা থেকে যায়। জনগণকে যে পরিমাণ বোকা ভেবে সরকার মাঠ সাজাচ্ছে, বিরোধীদলীয় নেতাকে মামলায় ফাঁসানোসহ বিরোধী জোটকে ছত্রখান করে দেয়ার ফন্দি আঁটছে, জনগণ কি অতটা বোকা? সম্ভবত নয়। ক্ষমতার জোরে রেলের ও পদ্মা সেতুর কালো বিড়াল আড়াল করা হয়তো সম্ভব, বিডিআর ট্র্যাজেডি ভুলিয়ে দেয়াও সহজ, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারিও চাপা দেয়া তেমন অসম্ভব কী। শেয়ারবাজার ধসও ভুলিয়ে দেয়া অসম্ভব নয়। ইলিয়াস আলী, সাগর-রুনিসহ অনেক ক্ষতই কথার প্রলেপে ঢাকা পড়ে যেতে পারে। তাই বলে দিনবদলের নামে পুকুরচুরি ভুলিয়ে দেয়া যাবে কি! দেশের সবাইকে একসাথে বোকা সাজিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব।
এ ধরনের একটি মূল্যায়নের পরও রাজনীতির শেষ ভাষা ফুরিয়ে যায় না। তা ছাড়া সরকারি দল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে, জোটকে সাথে নিয়ে আক্রমণভাগে খেলে ১৮ দলীয় জোটকে রক্ষণভাগে ঠেলে দিতে চাইছে। অংশত সক্ষমও হয়েছে। তাদের এই কৌশল অপশাসন ও দুর্নীতি চাপা দেয়ার একটি বড়সড় পরিকল্পনার অংশ। তাদের ধারণা, বিরোধী দলকে প্রচণ্ড চাপে রাখলেই পরিস্থিতি পাল্টে না গেলেও বাড়তি সুবিধা, সুযোগ ও সময় পাবে সরকারি দল। সম্ভবত সরকারি দলের এমন পরিকল্পনাও বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। ফলে বিরোধী দলের ঐক্য ছাড়া এখন আর হারানোর কিছুই নেই। ইসলামপন্থীদেরও আর ‘বিসর্জন’  দেয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেউ কেউ মনে করছেন, বিরোধী দলকে আলোচনায় বসাতে হলেও কিছু পূর্বশর্তের প্রশ্ন উঠবে। গ্রেফতার, মামলা প্রভৃতি হবে চাপ সৃষ্টি করে আলোচনায় বসানোর ইস্যু। সম্ভবত এই সনাতনী রাজনীতি চর্চাও সরকার করতে চায়।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারের ভেতর একটি উপদল যাদের দুর্নীতি গিলে খায়নি, তারা রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি খেলায় থাকতে চান। তারা মনে করেন, আন্তর্জাতিক চাপÑ বিশেষত জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রের সাথে আর দূরত্ব সৃষ্টি না করাই ভালো। রুশ-ভারতকে দিয়ে এই চাপ মোকাবেলা সম্ভব নয়, বরং আন্তর্জাতিক তদারকি মেনে নিয়ে অবয়ব পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণা মেনে নেয়াই কল্যাণকর হবে। তাতে তারা এবার ক্ষমতায় না আসতে পারলেও বিরোধীদলীয় অবস্থান থেকে ভালোভাবে লড়ে যেতে পারবে। জনমতকে তাদের দিকে আবার টানার সুযোগও সৃষ্টি হবে। তাদের বাড়তি মূল্যায়ন হচ্ছে, বিগত চার বছরে সরকার যত ইস্যু দিয়েছে তার দু-একটি দিয়েই রাজপথের রাজা আওয়ামী লীগ সরকারকে কোণঠাসা করতে সক্ষম; যা বিএনপি-জামায়াত জোট পারেনি। এই মতের প্রভাব আরো বাড়লে শেষ মুহূর্তে সরকার ছাড় দিয়ে বিরোধী দলকে বাগে আনতে সচেষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হামলা, মামলা ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির শর্তও অংশত মেনে নেয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
মতলবি জরিপগুলো সরকারকে আশ্বস্ত করেনি, আত্মবিশ্বাসীও করেনি। গোয়েন্দা সূত্রে সরকার জনমত বিগড়ে যাওয়ার খবর রাখে। একটা পর্যায়ে গিয়ে কীর্তন যে থামাতে বাধ্য হবে তা-ও জানে। তবে শেষ চেষ্টায় তারা ত্রুটি করবে না। খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের পর আওয়ামী লীগ ভড়কে গিয়েছিল। ভেবেছিল এজেন্সি বোধকরি হাতছাড়া হয়ে গেল। তারা সম্ভবত ভারতীয় ভূমিকার ব্যাপারে হতাশও হয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সতর্ক মানুষ। দিল্লি সফরের বাড়তি ডুগডুগি বাজাননি। ‘তেল মারার’ মতো শ্লাঘাও বোধ করেননি। তাতে দিল্লি হয়তো ভেবেছে চিঁড়া ভেজেনি। তাই পরীক্ষিত বন্ধুবিলাস তাদেরকে আবার পেয়ে বসেছে। আওয়ামী লীগ ও ঢাকায় ভারতীয় দূতের ঋজু মন্তব্যকে অনেকেই অনেকটা সরলীকরণ করে দেখছেন এবং উপভোগ করছেন। তাই আশাবাদীও। তবে ভারত যে সর্বত্র জাল ফেলে দিল্লি বসে টানে, তা কেউ ভুলে থাকতে চায় না। রাশিয়াও যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যহীন ও ক্ষয়িষ্ণু শক্তি তাও তারা জানে। সে ক্ষেত্রে কিছু প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের অতীত বিব্রতকর পরিস্থিতিও সামনে রাখার পক্ষে। তাতে আশাবাদ ফিকে হয়ে যায় কি না, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। তা ছাড়া মস্কোপন্থীরা যে আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে প্রধানমন্ত্রীকে মস্কো পর্যন্ত ঠেলে নিয়েছেন, সেটাও সামনে রাখার পক্ষেই রয়েছেন নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগাররা।
এখন বিরোধী দল, পেশাজীবী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর যে পুলিশি তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা ব্রিটিশ যুগ এবং পাকিস্তানি যুগকেও হার মানিয়েছে। অতিউৎসাহী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য হয় ভারতীয় মন্ত্রীর মতো, নয়তো ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের দাম্ভিক আস্ফালনের মতো শোনায়। এ দায়ও মূলধারার আওয়ামী লীগ নিতে চাচ্ছে না। তাই সবাই কান পেতে আছে, কখন কিভাবে পরিবর্তনের দামামা বেজে ওঠে, সেটা শোনার জন্য। কারণ, সামগ্রিক আলামত যে ভালো নয়, সেটা সব মানুষের বিবেককে স্পর্শ করছে। কোন নেত্রী কার সাথে বৈঠক করছেন, কোথায় জল পড়ছে আর পাতা নড়ছে সবাই ঔৎসুক্যের সতর্ক চোখ দিয়ে দেখছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনগণ ফিস ফিস করে অনেক কথাই বলে, তার দু-একটি যে অতীতে ফলে যায়নি তা তো নয়।
এক-এগারোর ছদ্মবেশী সামরিক সরকার এতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল যে, অবতরণের মইটাও সরিয়ে ফেলেছিল। যার ফলে দুই নেত্রীর একজনের সাথে চুক্তি করে, বিদেশী সাহায্য নিয়ে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বর্তমান সরকারও বাড়াবাড়ির সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। এখন ১৮ দলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা চলে যাওয়ার শঙ্কায় এতটা উৎকণ্ঠিত যে, দেশের ও গণতন্ত্রের নাক কেটে হলেও  ১৮ দলীয় জোটের যাত্রাভঙ্গের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত। সেটা সম্ভব না হলে আরেকটি গণতন্ত্র বধ কাব্য লেখার ক্ষেত্র যে প্রস্তুত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
digantaeditorial@gmail.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আইনের দুর্গতি গৃহসঙ্ঘাতকে চরমে নেবে

মামলার নামে মাত্রাছাড়ানো রাজনৈতিক হয়রানি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম সময়গুলোতে গানের একটি কলি মানুষের মুখে মুখে ছিল। সেই কলিটি ছিল, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে অনাস্থা চরমপর্যায়ে পৌঁছে তখন সরকার, কোনো কোনো সময় রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে না। তখন এ ধরনের গানের কলি উচ্চারিত হয়। মাত্রা যা-ই হোক না কেন, আইন-আদালতের প্রতি মানুষের আস্থায় আবার যেন চিড় ধরতে শুরু করেছে। বেশ ক’দিন ধরে রাজনৈতিক স্বার্থে আইন-আদালত, পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহারের ব্যাপারে সংবাদপত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে। যুগান্তরের এক প্রতিবেদন অনুসারে সারা দেশে রাজনৈতিক হয়রানির মামলার সংখ্যা হবে প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মামলা দায়ের হয়েছে। আর এসব মামলার আসামি দুই থেকে আড়াই লাখের মতো। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২৭টি। এর মধ্যে বেশ কিছু মামলার বিচারও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। অন্য দিকে মতায় আসার পর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ ছাড়া দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিগত সরকার ও ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী দায়ের করা প্রায় সব মামলা ও মামলায় দেয়া সাজার রায় হাইকোর্ট থেকে বাতিল হয়ে গেছে। এসব রায়ের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই কোনো আপিল করা হয়নি। নয়া দিগন্তেÍ  প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে হাইকোর্ট জামিন দিলেও তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে এবং শ্যোন অ্যারেস্ট করে তার মুক্তিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। অর্ধশত মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের দায়ের করা মামলায় বিএনপির আরো কয়েক হাজার নেতাকর্মী জেলে রয়েছেন। বিরোধী জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রথম ও দ্বিতীয় সারির প্রায় সব নেতাকে রাজনৈতিক মামলায় আটক রাখা হয়েছে। বর্তমানে তাদের পাঁচ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী রাজনৈতিক মামলায় আটক রয়েছেন। নিম্নœ আদালত থেকে তারা জামিন পাচ্ছেন না। সিনিয়র নেতাদের কেউ জামিন পেলেও অন্য আরো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট করে মুক্তিতে বাধা দেয়া হচ্ছে।

আইনজ্ঞদের অনেকের মধ্যে এ ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বিচার বিভাগ সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ধারণা থাকা অত্যন্ত ভয় ও আশঙ্কার ব্যাপার। রাজনৈতিক ও মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঘরছাড়া করা এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে রাখার কারণে দেশ গৃহসঙ্ঘাতের দিকে যেতে পারে মর্মে আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের ‘সরকার কোনো অবস্থায়ই আদালতের ওপর প্রভাব ফেলছে না আর বিচারকেরা স্বাধীন ও নিরপে থেকে আদেশ দিচ্ছেন’ মর্মে দেয়া বক্তব্য সেভাবে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।
বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারকে ক্ষমতায় এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন-আদালতকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের একটি প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু প্রবণতা একটি মাত্রার মধ্যে থাকলে তা সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য বড় কোনো বিপত্তি সৃষ্টি করে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন আইন-আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে গেছে। আমরা মনে করি না যে, রাজনৈতিক সহিংসতা বা আইন হাতে তুলে নেয়ার কোনো প্রবণতা থাকলে এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। কিন্তু আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় তার গতি নির্ণয় করতে থাকলে তা আইন প্রয়োগে দুর্গতি ডেকে আনতে পারে। আজ যাদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন রয়েছে কাল তারা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে না-ও থাকতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী। এসব প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যমান আইন ও রীতিনীতি অনুসারে চলতে দিলে শেষ পর্যন্ত আইনের আশ্রয় লাভের সুবিধা দল-মত নির্বিশেষে সবাই পাবে। প্রশাসনকে আইনের প্রয়োগ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনিভাবে বাড়াবাড়ি বা অপপ্রয়োগ না হওয়ার বিষয়টিও করতে হবে নিশ্চিত। রাজনৈতিক পরিচয়ের আগে ‘মানুষ’ ও ‘বাংলাদেশের নাগরিক’ পরিচয়কে সামনে রেখে ‘আইনের চোখে সবাই সমান ব্যবহার পাবে’ সংবিধানের এই গ্যারান্টির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

মঙ্গলবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিবেক বিতাড়িত


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসীন হবার পর বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাকে ভয়াবহ বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা দেশকে যেন এক আদিম সমাজে স্থানান্তর করেছে। এখানে আইনের শাসন নেই। আওয়ামী দুর্বৃত্তরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব লীগ এসব ব্যানারে এখন যা খুশি তা করতে পারছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি দেশে সকল কিছুই ঘটছে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে। আওয়ামী লীগ যে করে, আদালতে তার মৃত্যুদন্ড হলেও সদাশয় রাষ্ট্রপতি, আহা, জিল্লুর রহমান তার সাজা মওকুফ করে দেন। খুনের আসামীর সাজা মওকুফ, ধর্ষণের আসামীর সাজা মওকুফ, আওয়ামী লীগের পরিচয় থাকলেই হলো। তিনি খুন, ধর্ষণ, ব্যাংক লুট যাই করেন না কেন তার জন্য সাত খুন মাফ। বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে মোট ২৫ জন খুনী ও দাগী অপরাধীর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করা হয়েছে। মহাপ্রাণ জিল্লুর রহমান তার সাড়ে তিন বছরে ২২ জনের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন অবস্থায় কোনো মামলা দায়ের করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন তো করা যায়।
সে প্রশ্ন করেছিলেন, লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা শাহজাহানের স্ত্রী। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি যদি তার স্বামীর খুনীকে মৃত্যুদন্ড মওকুফ করতে পারেন, তাহলে কোন অধিকারে তিনি তার স্ত্রীকে যারা বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হত্যা করেছিল, তাদের বিচার প্রক্রিয়া ফ্যালফ্যালে চোখে দেখছেন? তার তো উচিত তার স্ত্রীর অভিযুক্ত খুনীদের নিঃশর্তে শাস্তি মওকুফ করে দেয়া। এটি অত্যন্ত সঙ্গত। এ বক্তব্য সম্ভবত এদেশের ১৫ কোটি মানুষের। বস্তুতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই পুতুল নাচের সুতো ধরে আছেন। রাষ্ট্রপতিও সেই সূত্রের বাইরে নয়। ফলে পুতুল নাচের খেলা এই সরকারের আমলে চলছেই। আমাদের আফসোস হলো এই যে, কোথায়ও কি কেউ থাকবে না, যে ঘুরে দাঁড়াবে কিংবা রুখে দাঁড়াবে? বলবে এটা সঙ্গত নয়। এটা হবে না। কিন্তু সম্ভবত কোথায়ও কেউ নেই।
না, আমি বাইরের কাউকে আহবান করছি না। আমি সরকারের ভেতরে সম্মানের আসনে যারা অধিষ্ঠিত আছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাষ্ট্রপতি এর অন্যতম। আওয়ামী লীগের হলেও তিনি যখন রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেছেন, তখন সকলের কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা দরকার ছিল। আমরা কোথায়ও দাঁড়াতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যে প্রধান বিচারপতি ১০ লাখ টাকা অনুদান নেন, তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অবলুপ্ত হয়। এবং কি আশ্চর্য, তিনি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে এমন এক রায় দিলেন যা তার পদমর্যাদায় প্রশ্ন তুলে বসল। আরও ইতর কাজ তিনি করলেন, অবসর নেয়ার পর সেই বিচারের রায় লিখে। এ নিয়ে হাস্যকর সব খবর বেরিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি প্রথমে একটি রায় তৈরি করেছিলেন। সেটি অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে ছিঃ ছিঃ বলে ধুয়া দিলে কিছু অতিরিক্ত বলা হবে না। সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তার লিখিত রায় পরিবর্তন করেছেন। এদিকে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা বলেছেন, তিনি যেহেতু আর বিচারপতি নেই, সে কারণে এই রায় লেখার তার কোনো অধিকার নেই। সংবিধান তা অনুমোদন করে না। কিন্তু নির্লজ্জ অনুদান-খেকো খায়রুল হক এসব পরোয়া করেননি। বেহায়ার মতো কাজ করেই গেছেন। আর সরকার যা চেয়েছে, শেষ পর্যন্ত তিনি তাই করেছেন।
রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাধীন, অনুদান-খেকো প্রধান বিচারপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজ্ঞাধীন, তাহলে আমরা কোথায় যাই? সাধারণ নাগরিকদের তবে আর কি আশ্রয় থাকে। আশ্রয়ের কোনো স্থল নেই। এ রকম রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকরা কি করবে? কার কাছে আশ্রয় বা বিচার প্রার্থনা করবে? না। কোথায়ও কেউ নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এখন আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর কাছে জিম্মি।
কিন্তু এই অবস্থা কি চিরস্থায়ী হয়? হতে পারে? মানব সভ্যতার পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস বলে, হয় না। শেখ হাসিনা ইতিহাস-অচেতন। এখন তার শিক্ষা-দীক্ষা বিষয়েও সমাজের ভেতরে হাজারো প্রশ্ন। তার পিএইচডি-ফিএইচডি নিয়ে নিতান্ত নিকৃষ্ট চামচা ছাড়া কেউ ভাবে না। বর্তমান শাসনকালে তাকে খুব একটা পিএইচডি শিকারি মনে হয়নি। কিন্তু পূর্ববর্তী শাসনকালে তিনি বহুত উচ্চ শিক্ষিত এবং তিনি ডজন ডজন পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী, এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি করেননি হেন কোনো নিম্নমানের কাজ নেই। তাতে, অভিযোগ আছে যে, রাষ্ট্রের কোটি কোটি ডলার ড্রেনে গেছে।
মানুষ তাহলে দাঁড়াবে কোথায়? সেটাও কিন্তু সমাজের ভেতরে ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। খুব সাধারণ মানুষও আত্মরক্ষার্থে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে। একদিকে তারা আওয়ামী ডাকাতদের বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে পাহারা বসাচ্ছে, অপরদিকে নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেরাই নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় ছবি ছাপা হয়। গ্রামের লোকেরা লাঠি-সোটা, সড়কি- বল্লম নিয়ে আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় রাতভর পাহারা দিচ্ছে। এটা এখনও গ্রামে গ্রামে বিস্তৃত। কিন্তু শিগগিরই তা শহরে, নগরে, পাড়া, মহল্লায় বিস্তৃত হবে।
সরকার এই যে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার পথও তারা বন্ধ করে দিতে চাইছে। এই সমাজে কেবলই বিবেকহীন মানুষের বসতি নয়। বিবেকবান মানুষও এ সমাজে আছে। কিন্তু তাদের কি কথা বলার শক্তি ও সাহস আছে? অনেকেরই আছে। কখনও কখনও তারা তা বলেও ফেলছেন। কিন্তু বিবেকের দায়ে কথা বলাও এ সরকারের শাসনামলে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পত্রিকায় লিখে কিংবা টেলিভিশনের টক শোতে কেউ যদি বিবেকতাড়িত হয়ে সত্য কথা বলে ফেলেন, তাহলে তার আর নিস্তার নেই। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সমস্বরে তার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলে শেয়ালের মতো রা রা করে ওঠেন। এদিকে আবার নতুন গজিয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের কিছু হাইব্রিড নেতা। এরা নিজ রাজনৈতিক এলাকায় কোনোদিন কল্কি পায়নি। শেখ হাসিনার কচিকাঁচার মেলায় তারা এখন বড় বড় নেতা হয়ে বসেছেন। যার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই অবলীলায় বলে ফেলছেন। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা ভব্যতার কোনো বালাই থাকছে না। অনেক সময় থাকছে না সীমানা জ্ঞানও। অনেক তাদের কথাবার্তা শুনে তাদের বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়ও মুখ ব্যাদান করে স্পষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় প্রধানমন্ত্রী এসব খিস্তি-খেউড় পছন্দ করেন। তা না হলে বহু আগেই তিনি এদের ধমক দিয়ে খামোশ করে দিতেন।
এখন বিবেককে ধমক দিয়ে, ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সেটা শুরু হয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়ায় তাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করে নোবেল কমিটি। এই নোবেল শান্তি পুরস্কার তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাকেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। তার জন্য তিনি নাকি দেশী-বিদেশী লবিস্টও নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাকে শান্তি পুরস্কার না দিয়ে ড. ইউনূসকে কেন নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো সে জন্য তার ক্ষোভের অন্ত নেই। নোবেল কমিটির ওপরকার সব ক্ষোভ তিনি ঝাড়লেন ড. ইউনূসের ওপর। তাকে সুদখোর রক্তচোষা বলতেও তিনি কুণ্ঠা বোধ করলেন না। আর তিনি যখন ড. উইনূসের বিরুদ্ধে নিজে আক্রমণ করে বসলেন, তখন তার পারিষদবর্গ ও চামচারা শতমুখে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলতে শুরু করল। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি প্রধানমন্ত্রী, ড. ইউনূসকে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিতাড়িত করে ছেড়েছেন। এখনও তার বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি অব্যাহত আছে। সরকারের চুরি-বাটপারি ও সকল ব্যর্থতার দায় চাপানো হচ্ছে ড. ইউনূসের ঘাড়ে। এমনকি সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতির দায়ে যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তার দায়ও চাপানো হলো ড. ইউনূসের কাঁধেই। প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী, চামচা নেতা থেকে হাইব্রিড নেতারা একযোগে এখনও বলতে কসুর করছেন না যে, বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পেছনে ড. ইউনূসের হাত রয়েছে।
এরপর মাহমুদুর রহমান। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গ্যাস সংক্রান্ত সরকারের দুর্নীতির খবর ছেপে বিরাগভাজন হন। অথচ সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে তিনি সঠিক কাজটিই করেছিলেন। সংবাদপত্রের কাজই তো জনগণের সামনে সত্য উন্মোচিত করা। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ঐ দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পরিবার সদস্য জড়িত ছিল। সরকারের উচিত, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কেউ যে জড়িত ছিল না, তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তুলে ধরা। তা না করে সরকার মাহমুদুর রহমানকে এক বছর জেলের ভাত খাইয়ে এনেছে। এরপর আবার তিনি হেনস্থা হচ্ছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিজামুল হকের স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করে। সে সংলাপে বিচারপতির নিরপেক্ষতা একবারে ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। নিজামুল হকও ধরা পড়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমান মাসাধিককাল ধরে নিজ অফিসে অবরুদ্ধ অবস্থায় কালাতিপাত করছেন।  বিচারপতি যে বিচারকের আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন, সেটি মুখ্য হলো না। মুখ্য হলো, মাহমুদুর রহমান কেন তা প্রকাশ করলেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর যে দুই সাংবাদিক আড়ি পেতে প্রকাশ করেছিলেন, তারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন। কেউ প্রশ্ন করেনি, তারা কেন আড়ি পেতেছিল। সে কেলেঙ্কারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশে মাহমুদুর রহমানকে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বিপদে আছেন স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠক  বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। হাইব্রিড আওয়ামী নেতারা তাকে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী বলতে ছাড়েনি। এমনকি এক আওয়ামী নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার বিচার পর্যন্ত দাবি করেছেন। শেখ হাসিনা মনে হয় এসব উপভোগই করেন। তা না হলে ঐ হাইব্রিড নেতাকে তিনি শাসন করতেন। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি।
সত্য বলে সর্বশেষ বিপদে পড়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক, শেখ মুজিব আমলে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জনাব এবিএম মূসা। মূসা ভাই একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ। আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতা হানিফ তাকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে একইভাবে গালাগাল করেছেন। একইভাবে তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ সম্মানীয় আরও অনেকেই।
অর্থাৎ এদেশে ধারাবাহিকভাবে বিবেক লাঞ্ছিত হচ্ছে। এই লাঞ্ছনা যে এক সময় বর্তমান শাসকদেরও কুড়ে কুড়ে খাবে, সেটা উপলব্ধি করার মতো কান্ডজ্ঞানও সরকার হারিয়ে ফেলেছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।

Ads