সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জাতীয় গ্রীডে ভারতীয় বিদ্যুৎ : একটি বিশ্লেষণ


হঠাৎ করে মানবদেহে রক্ত কণিকার প্রয়োজনীয়তার কথা আমার মনে পড়ল। আমাদের দেহে যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তাতে দু’ধরনের রক্ত রয়েছে; একটি হলো লোহিত কণিকা এবং অপরটি হলো শ্বেত কণিকা। লোহিত কণিকাকে ইরিথ্রোসাইটসও বলা হয়। এর কাজ হচ্ছে সারা শরীরে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়া এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে শরীরকে মুক্ত রাখা। এই কণিকাগুলোর মধ্যে কোন নিউক্লিয়াস নাই এবং তারা ১২০ দিন বেঁচে থাকে। পক্ষান্তরে শ্বেত কণিকার কাজ হচ্ছে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে শরীরকে সুরক্ষা প্রদান করা যাতে করে রোগ-ব্যাধি আক্রমণ করতে না পারে। আমাদের প্রতি ফোঁটা রক্তে লাখ লাখ লোহিত কণিকা এবং সাত থেকে পঁচিশ হাজার শ্বেত কণিকা রয়েছে। শ্বেত কণিকা রোগ-জীবাণুর সাথে লড়াই করে। রোগ-জীবাণু যদি শক্তিশালী হয় এবং এই লড়াইয়ে শ্বেত কণিকা পরাজিত হয় তাহলে আমরা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কথাটা মনে পড়ল ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির পর দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দুরবস্থা দেখে। ভারত থেকে কয়েকদিন আগে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাব-স্টেশনে ভারতীয় বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয়েছে। এটা দেখে নাকি সেদিন বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়াররা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। খুশীতে কারো কারোর অবস্থা বেহুঁশ হয়ে যাবার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
এখন আমার নিজের কথা বলি। ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির আগে আমার এলাকায় দৈনিক গড়ে প্রায় ৫ বার ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হতো, যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আগের আমলের বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা স্মরণ রাখার জন্যে’ দৈনিক দু’বার লোডশেডিং করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জাতির উদ্দেশে তার প্রদত্ত বক্তব্যে ঘোষণা করেছিলেন। ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির পর কয়েক দিন ধরে আমার এলাকায় ৮-১০ বার লোডশেডিং হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে রক্তকণিকার কথা আমার মনে পড়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের জাতীয় গ্রীডে ভারতীয় ভাইরাস প্রবেশ করেছে এবং এই ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তার জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে দেশে লোডশেডিং-এর ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পেয়েছে। বলাবাহুল্য দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ সংকট সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি করছে এবং দেশটিকে সঙ্কট উত্তরণে সহায়তা করছে বলে জানা গেছে। অনেকের কাছেই এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। কেউ কেউ মনে করেন যে, এর ফলে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হবে। তাদের এই ধারণা কতদূর সত্য হয় তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত একথাই বলা যথেষ্ট যে, গঙ্গা, তিস্তাসহ বাংলাদেশের উজানে আরো ৫২টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রত্যাহার, নদীসমূহের উপর বাঁধ তৈরি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জলাধার ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ক্ষতিসাধন করে চলেছে তাতে দু’দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে চলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহলসমূহ হস্তান্তরে ভারতীয়দের অব্যাহত অনীহা, যদিও বাংলাদেশ চুক্তির পরপরই বাংলাদেশী ভূখ- ভারতকে হস্তান্তর করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার গত পৌনে পাঁচ বছরে ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর, বন্দর, গ্যাস ও কয়লা সুবিধা দিয়ে তাকে ক্ষমতায় বসানোর কৃতজ্ঞতা ঋণ পরিশোধ করেছে। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিরোধিতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচ্ছন্ন অনীহার দরুন তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি চরম ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। তাদের এই ক্ষোভ বিস্ফোরনোন্মুখ বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে আরেকটি কারণে এবং সেটা হচ্ছে ভারতীয় নির্দেশনা ও পরামর্শে এই দেশের আলেম-ওলামা, দেশপ্রেমিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে জঙ্গি আখ্যায়িত করে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা। এই অবস্থায় আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীর পা-চাটা নওকর হিসাবে মানুষ সরকারের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত এবং তা নিরসনের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ দিয়ে ভারত বাংলাদেশের মানুষের কিছুটা মন ভোলাতে চায়। কিন্তু ওয়ালস্ট্রীট পত্রিকা সম্প্রতি এই বিদ্যুতের আসল তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। ওয়াল স্ট্রীট পত্রিকা বলেছে, উত্তর-পূর্ব ভারতে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ গ্রীডলাইনের অভাবে ঐ দেশের সরকার দেশের বিদ্যুৎবঞ্চিত এলাকাসমূহে প্রেরণ করতে পারেন না। এই অবস্থায় তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে তা রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় স্টেট ইউলিটি এনটিপিসি’র সহযোগী বিদ্যুতের ব্যাপারে নিগমের সাথে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ইস্টার্ন গ্রীড থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এই বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক। এ বছরের শেষের দিকে ভারতীয় সরবরাহকারীদের দরপত্র মূল্যায়নের পর আরো ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানির একটি বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদিত হবে এবং পর্যায়ক্রমে তা ৫ বছরে ১০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। এই রফতানির মাধ্যমে ভারত বার্ষিক ৩৫ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। এতে দেশটির ক্রম সম্প্রসারণশীল ঈড়ৎৎবহঃ অপপড়ঁহঃ ফবভরপরঃ নিয়ে যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে তার কিছুটা অবসান ঘটবে। অক্টোবর থেকে এই রফতানি শুরু হবে। বলাবাহুল্য ইতঃপূর্বে ভারত, নেপাল ও ভুটানের কাছেও বিদ্যুৎ বিক্রয় করেছে তবে তার পরিমাণ ছিল ২০-৩০ মেগাওয়াট। শোনা যাচ্ছে যে, ভারত পাকিস্তানের কাছেও ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ বিক্রির পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের কাছে যে বিদ্যুৎ তারা তৈরি করছে তার ইউনিট প্রতি মূল্য নিয়ে বাজারে বিভিন্ন রকমের কথা আসছে। যতদূর জানা গেছে যে, এই বিদ্যুৎ ভারত বাংলাদেশকে ৭ টাকা দরেই দিতে চাচ্ছে এটা তাদের উৎপাদন ব্যয়ের সমান। তবে সরকারিভাবে এই মূল্য সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে, বাংলাদেশের জাহাজগুলো যেখানে নৌরুট ও বন্দর ব্যবহারের জন্যে সরকারকে কর দেয় সেখানে বিনা পয়সায় ভারত বাংলাদেশের নৌ করিডোর/ট্রানজিট ব্যবহার করছে এবং স্থল ট্রানজিট ব্যবহার বাবদ বাংলাদেশকে কোন প্রকার চার্জ বা কর পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করছে। এই অবস্থায় ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয়ের সমমূল্যে বাংলাদেশকে তারা বিদ্যুৎ দেবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়, দিলেও তাদের মধ্যে সিনসিয়ারিটির অভাব রয়েছে। অতি সম্প্রতি আরেকটি ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে টন প্রতি ৩০০ ডলার মূল্যে পিয়াজ আমদানি করছিলেন এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই মূল্যে পিয়াজ সরবরাহের জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধও হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তারা পিয়াজের টন প্রতি মূল্য প্রথমে ৫০০ এবং পরে ৯০০ ডলারে উন্নীত করলেন এবং তাদের প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করলেন। এতে করে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব এক সঙ্কটে নিপতিত হলো। এর ফল হলো এই যে, আমাদের এই ভারত নির্ভরতা পিয়াজের কেজি প্রতি মূল্য ৮০-১০০ টাকায় তুলেছে এবং মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়েছে।
আমি আগেই বলেছি ভারতে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ সঙ্কট রয়েছে এবং এই দেশটির কোন কোন এলাকায় ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। তথাপিও অক্টোবর মাস থেকে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির ভারতীয় সিদ্ধান্ত অনেককেই বিস্মিত করেছে। আমি মনে করি, এতে বিস্ময়ের কিছু নাই। কেননা অক্টোবর মাস থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে এবং নভেম্বর মাসে পুরোপুরি শীত এসে যাবে। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই শীতের তীব্রতা অব্যাহত থাকবে। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে সময়ে অফিস ঐ আদালত ও বাসাবাড়িতে পাখা চলে না, এসি/এয়ারকুলার চলে না। ফলে বিদ্যুৎ খরচা হয় কম। এই অবস্থায় লোডশেডিং নি¤œতম পর্যায়ে নেমে আসে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের বেলায়ও প্রযোজ্য। কাজেই ভারত শীত মওসুমে যদি বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এবং তার বিপরীতে পর্যাপ্ত পয়সা পায় তাহলে মন্দ কি! এ রফতানির পেছনে আরো কিছু কৌশল আছে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ভারতের একটি আজ্ঞাবহ সরকার। গত ৫ বছরে এই সরকার জাতিকে প্রদত্ত তার কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বরং দুঃশাসন, নির্যাতন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ, দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, প্রশাসনের নির্লজ্জ দলীয়করণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ধর্ম, ধর্মভিত্তিক দলসমূহ এবং শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর তাদের নির্যাতন, আল্লাহ, তাঁর প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর সহধর্মীনিগণ এবং সাহাবায়ে কেরামের ওপর নাস্তিক মুরতাদদের অশালীন ও অশ্লীল মন্তব্য ও গালাগাল এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের প্রশ্রয় দান ও একজনকে জাতীয় বীর আখ্যাদান এই সরকারের জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। বিদ্যুৎ খাতের ব্যর্থতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের ভ্রান্তনীতি, দুর্নীতি, বেগম জিয়ার ভাষায় কুইক রেন্টাল, কুইক মানি উপার্জন ও বিদেশে তা কুইক পাচারে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই খাতের দায়মুক্তি আইন মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি অনিবার্য। ভারতীয় বিদ্যুৎ এক্ষেত্রে তাদের ডুবন্ত ইমেজকে হয়তো কিছুটা রক্ষা করতে পারবে বলে সরকার মনে করছেন এবং নির্বাচনের এই ক্রান্তিকালকেই বিদ্যুৎ আমদানির জন্য চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এই বিদ্যুৎ শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। ভারতীয় বিদ্যুৎ আসার পর লোডশেডিংয়ের ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির কথা তো আগেই বললাম। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখানে কিছুটা কৃতজ্ঞতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে। দেশ ও জাতিকে প্রদত্ত সকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেও শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর, বন্দরসহ তার চাহিদার অতিরিক্ত অনেক কিছুই দিয়েছে। বিপুল এই দানের কিছুটা প্রতিদান। আরেকটি উদ্দেশ্যও এক্ষেত্রে আছে; তা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ থেকে গ্যাস ও কয়লাপ্রাপ্তি। ভারতীয় বিদ্যুতের ওয়েবসাইটগুলো ভিজিট করুন, বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। অবশ্য এ রফতানি কতদিন অব্যাহত থাকে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যদি থাকেও তা বাংলাদেশের জন্য শুভ হতে পারে না। বিদ্যুৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিদ্যুতের চাবি ভারতের কাছে রেখে আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তা করতে পারি না। আর আমাদের গ্যাস ও কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভারত ঐ বিদ্যুৎ আমাদের কাছে রফতানি করবে তা হয় না। এটি একটি কূটকৌশল। এজন্য জাতির ম্যান্ডেট নেয়া উচিত ছিল। এখন ভারতের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন।
ভারত বাংলাদেশকে যে বিদ্যুৎ দিচ্ছে এই ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রয়েছে। ভারতীয় দলিলপত্রের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, উত্তর-পূর্ব ভারতে তাদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আছে। কেননা সেখানে গ্রীড লাইনের অভাবে বিদ্যুৎ বঞ্চিত এলাকাসমূহে তারা বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পারেন না বলেই তারা তা বাংলাদেশে রফতানি করছেন। আবার অন্য জায়গায় বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবাংলার শিল্পায়ন তৎপরতা শ্লথ হয়ে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ চাহিদা কমে গেছে এবং বর্তমানে ঐ রাজ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রয়েছে। গত এক বছরে পশ্চিমবাংলায় ৩০ হাজার মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ তাদের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত রয়েছে এবং তারা প্রায় মাত্র তিন হাজার মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছে। এই হিসাবটি মিলানো মুশকিল। তথাপিও পশ্চিমবাংলা থেকেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসছে বলে মনে হয়। পশ্চিমবাংলার শিল্প-কারখানার চাহিদা যখন বৃদ্ধি পাবে তখন কি হবে? এই রাজ্যটির ৬০ শতাংশ বাসিন্দা বিদ্যুৎ থেকে বর্তমানে বঞ্চিত রয়েছে। তারা বঞ্চিত থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহে রাজী থাকবে কি? শিল্প-কারখানায় চাহিদা বৃদ্ধি এবং জনগণের চাপ অব্যাহত থাকলে রফতানির এই ধারাবাহিকতা কখনো নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পারে না এবং বাংলাদেশের পক্ষেও তাদের সাধারণ ভোক্তা এবং শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চাহিদা উপেক্ষা করে আগামী দিনগুলোতে ভারতকে ক্যাশ দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া যায় বলে আমার মনে হয় না। ভারতের ব্যাপারে আরো কয়েকটি কথা বলা দরকার। সেখানে গড়ে পল্লী এলাকায় ৪৪ শতাংশ ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে। কিন্তু এই সংযোগ পাওয়ার অর্থ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নয়। দৈনিক ১২ ঘণ্টা তারা লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা ভোগ করে। দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, বিহার, উড়িস্যা, আসাম, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও অন্ধ্রপ্রদেশে একই অবস্থা বিরাজ করছে। পাঞ্জাব, গোয়া, গুজরাট এবং কেরালা রাজ্য লোডশেডিং-এর দিক থেকে অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। পশ্চিম বাংলার অবস্থা আগেই বলেছি এবং তা ক্ষণস্থায়ী। ভারতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার বেশিরভাগ হয় কয়লা (৫৭%) থেকে। দ্বিতীয় অবস্থান হচ্ছে জলবিদ্যুতের (১৯%); তৃতীয় অবস্থান বায়োমাস ও অন্যান্য পদার্থ (১২%) থেকে। এখানে গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয় শতকরা (৯%) বিদ্যুৎ এবং নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত হয় (২%) এবং (১%) হয় ডিজেল থেকে। তাদের কয়লার সরবরাহ কমে গেছে এবং গ্যাসের রিজার্ভও মাত্র ৪৩.৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এই অবস্থায় তারা গ্যাস ও কয়লা সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের নামে যদি তারা বাংলাদেশ থেকে গ্যাস ও কয়লা নিতে পারে তাহলে সঙ্কট উত্তরণ তাদের  জন্য সহজতর হবে। বাংলাদেশকে এই বিষয়টি ভালোভাবে ভেবে দেখে তার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কাঙ্ক্ষিত অভিযাত্রার অপেক্ষায়


রাষ্ট্র পরিচালনায় মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও রাজনীতিবিদদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেই নয়, তাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণের প্রতিও লক্ষ্য রাখে দেশের জনগণ। জনগণ চায় তারা হবেন কর্তব্যপরায়ণ, নীতিনিষ্ঠ ও সুন্দর আচরণের ধারক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও রাজনীতিবিদরা শুধু জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণেই ব্যর্থ হননি, হতাশ হওয়ার মতো উদাহরণও সৃষ্টি করেছেন। এমন উদাহরণ জাতির জন্য লজ্জাকর। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনের গত ২৯ সেপ্টেম্বরের একটি খবরের কথা উল্লেখ করা যায়। খবরটির শিরোনাম হলো, ‘সরকারের টাকা মেরে দিলেন উপদেষ্টা, মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ’।
খবরটিতে বলা হয়, কোনো লোকসান না হলেও পুরো টাকা মেরে দেয়ার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদরা বকেয়া ফেলেছেন ১২০০ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন চুপ থাকলেও বিটিআরসি শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতার মালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তাদের ১০টি আইজিডব্লিউ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা উদ্ধার কিভাবে হবে তা কেউ জানেন না। বিষয়টিকে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না ট্্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনীতি ও ব্যবসাকে একাকার করে ফেলা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও প্রভাব খাটিয়ে রাজনীতিবিদরা ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। আর প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো রাজস্ব পাচ্ছে না কিংবা রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। তাই ব্যবসা থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসতে পারেন কিন্তু তারা যদি অধিক মুনাফার জন্য রাজনীতিতে আসেন, তখন রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে না। এতে শাসন ব্যবস্থাও ক্রমাগত ভেঙ্গে পড়বে।
উল্লেখ্য যে, প্রশ্নবিদ্ধ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে রয়েছেন সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। শুরু থেকে তাদের মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিটিআরসির পাওনা বকেয়া রেখে আসছে। এর ফলে ধীরে ধীরে পাওনার পরিমাণ ১২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অর্থ পরিশোধের জন্য বিটিআরসির পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে পাওনা পরিশোধ না করে সময় ক্ষেপণ করে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সরকারের শেষ সময়ে এসে পাওনা পরিশোধ না করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার পরিবর্তনের পর  কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে। এ কারণেই হয়তো তারা পুরো টাকা মেরে দেয়ার উদ্দেশ্যে পাওনা পরিশোধ থেকে বিরত রয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাওনা পরিশোধ না করায় আগস্ট মাসে ৪টি আইজিডব্লিউ’র সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলো বিটিআরসি। কিন্তু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাপে এদের ছেড়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে ২৬ আগস্টের মধ্যে ৬টি অপারেটরকে ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে সময় বেঁধে দেয় বিটিআরসি। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি।
বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক জেনেছেন, বকেয়া পরিশোধ না করা প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রী, উপদেষ্টা এমপিসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মালিকানাধীন হওয়ায় এদের ওপর বিটিআরসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রাজনৈতিক বিবেচনায় পাওয়া এসব লাইসেন্সের মালিক বিটিআরসিকে টাকা দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা কলের পুরো টাকাই রেখে দিচ্ছেন, যার ফলে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব চলে যাচ্ছে আইজিডব্লিউ’র প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেটে। এই যদি হয় সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও রাজনীতিবিদদের আচরণ, তাহলে দেশ এগুবে কিভাবে? আর জনগণই বা ভরসা রাখবে কাদের ওপর? রাজনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে এমন মন্দ উদাহরণ থেকেই চলে আসে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রসঙ্গ। দুর্বৃত্তায়নের এমন চক্র ভাঙ্গার ক্ষমতা কি সরকারের নেই? রাষ্ট্র ও সমাজ কি দুর্বৃত্তায়নের এমন দৌরাত্ম্য চেয়ে চেয়ে দেখতেই থাকবে? রাষ্ট্র এবং সমাজে যখন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করে তখনই অনিবার্য হয়ে ওঠে গণআন্দোলন কিংবা গণজাগরণের অভিযাত্রা। আমাদের সামনে হয়তো অপেক্ষা করছে এমন অভিযাত্রাই।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংসদ নির্বাচনের একটি বড় ফ্যাক্টর

গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের পর পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনের টকশোতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে সব আলোচনাকে টেক্কা মেরেছে আওয়ামী লীগ দলীয় তরুণ এমপি গোলাম মাওলা রনির মন্তব্য। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘কোথায় আমাদের দলীয় আমলরা ও পুলিশ কর্মকর্তারা, যারা আমাদের জয়ের স্বপ্ন দেখাত? কোথায় আমাদের তথাকথিত চামচারা, যারা বলত, সব কিছু ঠিক আছে? গাজীপুরে জয় নয়, সম্মানজনক পরাজয়টুকু কেন পেলাম না? প্রার্থী আজমত উল্লাহর কী দোষ ছিল? কেন গাজীপুরে গেলেন না ব্যবসায়ী নেতারা? যাদের এতগুলো টেলিভিশন, কুইক রেন্টাল, ব্যাংক, বীমা ও শেয়ারবাজার দেয়া হলোÑ তারা আজ কোথায়? দেশপ্রেমিকদেরই বা কী হলো? যারা আগুন লাগাল তারা মীরজাফর না, যারা আগুনের ব্যাপারে সতর্ক করল তারা দোষী। সেলুকাস, তুমি কোথায়। দেখ, বঙ্গের মীরজাফরেরা কিভাবে মালয়েশিয়া ও কানাডা পালাচ্ছে।নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনপীড়ন, আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু, মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, জনশক্তি রফতানিতে জটিলতা, শেয়ারবাজার, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট এবং শেষ সময়ে জনপ্রিয়তায় ধস প্রভৃতি নিয়ে এক কঠিন সময় পার করছে মহাজোট সরকার। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম-খুনের ব্যাপক অভিযোগ, বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব খাটানোয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করা, পররাষ্ট্র নীতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচ্যুতিসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সরকার। বিশ্বমিডিয়ায় বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল এসব চিত্র সবিস্তার উঠে আসছে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেই সরকারের। একই সাথে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোন্দল, সঙ্ঘাত ও বিভক্তি এবং ঈদের পর বিরোধী দলের লাগাতার কঠোর আন্দোলনের হুমকিতে ঘরে-বাইরে অস্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। চাপ সইতে না পেরে দল ও সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের পদত্যাগের গুঞ্জন উঠেছে একাধিকবার। তাদের একেকজন একেকভাবে কথা বলায় ভারসাম্যহীনতাই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। সরকার এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের কোনো পরিস্থিতিই সামাল দিতে পারছে না সরকার। বিশেষ করে কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক মাঠ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রায়ের পাশাপাশি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস চলছে। বিরোধী দল দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে করে তুলেছে ুব্ধ। জনগণের মতো দলের ভেতরে ও বাইরে সৃষ্টি হয়েছে এ নিয়ে চরম ক্ষোভ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের লুটপাট, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার বিপরীত কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে জবাব দিতে পারছেন না সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা। অনেক মন্ত্রী-এমপি এলাকায় যেতে পারছেন না। গেলেও লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। বিশ্বমিডিয়ায় এখন সরব আলোচনা চলছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত ছাড়া তেমন কোনো দেশকে পাশে পাচ্ছে না সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেয়া হলেও আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ১২ সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের ৬২ ভাগ ভোটার তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে, ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ৬৩ ভাগের।উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেও সরকারের এই কাজে খুশি নয় দেশের প্রায় ৮১ শতাংশ ভোটার। ওই রায়ে আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরামর্শ থাকলেও তড়িঘড়ি করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংসদে ব্রুট মেজরিটির জোরে বাতিল করে লেজে-গোবরে অবস্থায় ফেলেছে দেশের রাজনীতিকে। অন্য দিকে মাত্র ১৫ শতাংশ ভোটার তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত সাংবিধানিক পরিবর্তনের পক্ষে রয়েছে। তারা হার্ড লাইন আওয়ামী লীগার বলে জানা গেছে। দেশী-বিদেশী নানা চাপের মুখেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো অনড় অবস্থানে সরকার। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত গোঁয়ার্তুমি ত্যাগ করে সমঝোতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। বর্তমান অবস্থায় যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে তা দেশ-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। পুনরায় নির্বাচন করতে হবে। আর আওয়ামী লীগ ও মহাজোট চাইলেও শান্তিতে যে নির্বাচন হবে না, তা নিশ্চিত। মহাজোটের কোনো কোনো দল সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য উপায়ে নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। অন্য দিকে বিরোধীদলীয় জোট নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণাও দিয়েছে তারা। দেশ অচল করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতারা। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামও তাদের ১৩ দফা দাবি আদায়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে ইসলামি দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে। আওয়ামী লীগ বিদেশীদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে খুশি করতে চায় এই জঙ্গিবাদের কথা বলে। কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক মহল আওয়ামী লীগের এ গোঁজামিলের রাজনীতি পছন্দ করে না। তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অন্যান্য রাষ্ট্র তাদের কূটনীতিক চ্যানেলে হাসিনা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। হাসিনা সরকার ভালোভাবে জানে, ইসলামপন্থীরা তাদের ভোট দেবে না। তাদের আক্রোশটা সেখানেই। বাংলাদেশ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। এখানকার অধিকাংশ মুসলমান ধর্ম-কর্ম নিষ্ঠার সাথে করে থাকেন। সেই দেশে যখন অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড দেখে তখন তারা তা মেনে নিতে পারেন না। সরকার শাহবাগে জনগণের মঞ্চ বলে তিন মাস ধরে যে নাটক করেছে তা বাংলার মানুষ ভোলেনি। ব্লগাররা ইসলাম ও রাসূল সা:-এর প্রতি যে কটূক্তি করেছে, তার কঠোর প্রতিবাদ সারা দেশের মানুষ করেছে। শাহবাগ মঞ্চ সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। অথচ মঞ্চের নায়কদের সরকার জামাই আদরে রেখেছিল। হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। ইসলামের বাণী সাধারণ মুসলমানদের কাছে পৌঁছানো এবং কেউ বা কোনো সংগঠন ইসলামবিরোধী কাজ করলে তার প্রতিবাদ করা এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। তাদের ১৩ দফাতে এর উল্লেখ আছে। দেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তারা কঠোর। শাহবাগের জনতার মঞ্চে ইসলামবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করায় সারা দেশ থেকে তারা বিপুল সাড়া পান। তারা এপ্রিল মাসে সারা দেশে সমাবেশ করে তা দেখিয়ে দিলেন। ৫-৬ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে তারা যে মহাসমাবেশ করেছেন তার নজির বাংলাদেশে আর নেই। সরকার এতে ভীত হয়ে রাতের আঁধারে নিরীহ জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পাশবিক হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনায় সারা দেশ স্তম্ভিত। মুসলমানেরা বুঝতে পেরেছে বর্তমান সরকারের অধীনে ইসলাম নিরাপদ নয়। যে সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে ইসলামপ্রিয় জনগণ ভোটের ক্ষেত্রে নীরব বিপ্লব ঘটাবে। কারণ তারা দেখেছে সরকার ইসলামবিরোধী কাজই করে যাচ্ছে। অধিকন্তু ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা গত সাড়ে চার বছরে জাতীয় সম্পদ দেদার লুট করেছে। সরকার লুটের পথ খোলাসা করে দেয়ায় অর্থনীতি আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে। সিন্ডিকেটের কর্মকাণ্ডে ব্যবসায়-বাণিজ্য রসাতলে গেছে। চাষি তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য না পেলেও শহরে এসে তার মূল্য হয়ে যায় তিন-চার গুণ। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে মানুষ দিশেহারা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ৩৩ লাখ ুদ্র শেয়ার ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। তাদের পোষ্য দেড় কোটি মানুষ ভীষণ দুর্ভোগে আছে। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, ডেসটিনি ও অন্যান্য রক্তচোষা কোম্পানি সরকারি মদদে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ করে ছাড়ছে। এতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা কি আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? হেফাজতে ইসলামের যে বিরাট জনসমর্থন আছে তারা এবং ইসলামি দলগুলোর সমর্থকেরা কেউ আওয়ামী প্রার্থীকে ভোট দেবেন বলে আশা করতে পারে? সব কিছু মিলিয়েও রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার জন্য আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটকে মূল্য দিতেই হবে। 


0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জিন্নাহর হারানো ভাষণে কী ছিল?

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি ভাষণের নাকি রেকর্ড করা ভাষণ পাকিস্তানের কাছে ছিল না। তাই পাকিস্তান অনেক দেনদরবার করে আকাশবাণীর মহাফেজখানা (আর্কাইভ) থেকে ওই ভাষণ সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে খোলা চোখ কলামে নিউ ইয়র্কের হাসান ফেরদৌস একটি কলাম লিখেছেন, যা ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট জিন্নাহ পাকিস্তানের গণপরিষদে ভাষণটি দিয়েছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে ১৪ আগস্ট। একই ঘোষণা স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের জন্য ১৫ আগস্ট। ব্রিটিশ সরকারের ওই ঘোষণার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। হাসান সাহেব সন্দেহ করেছেন পাকিস্তানিরা সম্ভবত ওই ভাষণ নষ্ট করে ফেলেছেন। সন্দেহের কারণ হয়তো ফেরদৌস সাহেব মনে করেন পাকিস্তানিরা তার ধারণার সেকুলারিজমে বিশ্বাস করে না। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। মানে ভারতে মুসলমানেরা একটি জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী নয়। ভারতের হিন্দুরাও ধর্মীয়ভাবে আলাদা একটি জাতি। যদিও ভারতের বড় বড় জ্ঞানীগুণী বলেছেন, হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়। এটা ভারতের আচার অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি। ভারতবাসী মানে হিন্দুদের আচার অনুষ্ঠানের মূল উৎস হলো বেদ, উপনিষদ ও গীতা। এসব চলে আসছে পাঁচ হাজার বছর ধরে। আর মুসলমানদের জীবনবোধ ও জীবনচর্চার মূল উৎস হলো আল কুরআন। একই ভৌগোলিক এলাকায় বাস করেও দুটি জীবনধারা পাশাপাশি বয়ে গেছে বা চলছে হাজার বছর ধরে। হিন্দু জীবনধারায় বর্ণবাদ রয়েছে। মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয়ভাবে কোনো ধরনের বর্ণবাদ নেই। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনী যারা পাঠ করেছেন তারা জানতে পেরেছেন তিনি স্কুলজীবনে কী ধরনের বর্ণবাদ বা অস্পৃশ্যতা দেখেছেন। হিন্দুবাড়িতে মুসলমানেরা প্রবেশ করতে পারত না। কিন্তু হিন্দুরা অবলীলাক্রমে মুসলমান বাড়িতে থাকতে ও খেতে পারত। ভারতের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. অম্বেদকার শেষজীবনে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বর্ণবাদব্যবস্থার কারণে। প্রাচীন ভারতের আইনপ্রণেতা মহাজ্ঞানী মনু তার রচিত সংহিতায় বর্ণবাদের বিশেষ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি শূদ্রদের (নিম্নবর্ণ) বলেছেন অর্ধমানব। এখনো ভারতে প্রতি বছরই নানা অপরাধের কারণে সমাজপতিরা শূদ্রদের পুড়িয়ে মারে। ভারতীয় সভ্যতায় মানে হিন্দুসভ্যতায় গরুকে গো-মাতাবলা হয় এবং গরুকে পূজা করা হয়। মুসলমানেরা গরু কোরবানি করে এবং খায়। ভারত কেন বিভক্ত হলো এ নিয়ে হাজার বই রচিত হয়েছে। একইভাবে জিন্নাহ এবং পাকিস্তানকে নিয়েও বহু বই রচিত হয়েছে। বহু মানুষ জিন্নাহকে বা গান্ধীজীকে পছন্দ করেন না। গান্ধীজীকে যারা হত্যা করেছেন তারা বলেছেন, গান্ধী একজন ভণ্ড। গান্ধীজীর পরম ভক্ত কে কে বিড়লা বলেছেন, ÔBirlas used to spend millions to keep bapuji poor.Õ মানে বাপুজীকে গরিব রাখার জন্য বিড়লারা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করত। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্টের ভাষণের শুরুতে জিন্নাহ কেন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে বা কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে তার প্রেতি বর্ণনা করেছেন। তখন তিনি বলেছেন, এটা অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য ছিল। জিন্না তো রাজনীতির শুরুতে অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা ছিলেন। তাকে তো হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত বলা হয়েছে। ১৮৮৫ সালে যে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা কালক্রমে হিন্দুদের সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথার পরিবর্তে তা হয়ে ওঠে শুধু হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। ফলে বাধ্য হয়ে ভারতের মুসলমানেরা ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে জিন্নাহ কিন্তু মুসলিম লীগের সাথে জড়িত হননি। একপর্যায়ে তিনি কংগ্রেসের ওপর বিরক্ত হয়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। জিন্নাহ কখনোই গোঁড়া ছিলেন না। তিনি ভারতের স্বার্থে উদার রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা ছিলেন সাম্প্রদায়িক এবং নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে অন্য কারো স্বার্থ চিন্তা করার মতা ছিল না। একটা কথা আমাদের সবাইকেই মনে রাখতে হবে, ইংরেজরা পুরো দখলে নিয়েছিল হিন্দুদের হাত করে। দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছতে তাদের ১০০ বছর লেগেছিল। এই পুরো ১০০ বছরই মুসলমানেরা ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। ভারত বিভক্তির পেছনের ইতিহাস যারা জানেন না তারা মনে করেন জিন্নাহ বা মুসলমান নেতাদের সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় চিন্তাধারার কারণে এমনটি হয়েছে। আসলে ভারত বিভক্তির প্রধান কারণ হচ্ছে কংগ্রেস নেতাদের একগুঁয়েমি ও ভারতে মুসলমানদের উপস্থিতিকে অস্বীকার করা। যদি ভারতকে আদলে একটি সত্যিকারের ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টা কংগ্রেস মেনে নিত তাহলে হয়তো ভারত ভাগ হতো না। এখন, মানে চলমান সময়ে ভারতের নেতারা বুঝতে পেরেছেন ৪৭ সালে কংগ্রেস ভুল করেছে। জিন্নাহ কখনোই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তখনকার কংগ্রেস নেতাদের মনোভাবের কারণে কংগ্রেস একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। মুসলমানেরা ভারতে একটি আলাদা জাতিÑ এ কথা ভাবতে হিন্দু নেতারাই মূলত দায়ী। কিন্তু এ বিষয়টি পরবর্তীপর্যায়ে মানে ৪৭ সালের পরে তথাকথিত কিছু মুসলমান বুদ্ধিজীবী, যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করে তারা পাকিস্তান সৃষ্টিকে অবাস্তব ও সাম্প্রদায়িক বলে প্রচার করতে শুরু করে। এমনকি ভারত থেকে বিতাড়িত হয়েছেন বা সুবিধা পাওয়ার আশায় পাকিস্তানে চলে এসেছেন, এমন কিছু শিতি লোকও পাকিস্তানের বিরোধিতা করতে শুরু করে। প্রসঙ্গত সেকুলার (Secular) শব্দটির ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। বহুকাল ধরে আমাদের সমাজে এই ইংরেজি শব্দটির ভুল অনুবাদ বা ব্যাখ্যা দিয়ে আসা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সেকুলার মানে ধর্মনিরপে। মানে যারা ধর্মের ব্যাপারে কোনো প গ্রহণ করেন না। কিন্তু এ অনুবাদ বা ব্যাখ্যা ভুল। কারণ, সেকুলার মানে ধর্মহীন। যিনি বা যারা ধর্ম মানেন না, যারা শুধু ইহজগতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু জগতের সব ধর্মের লোকেরাই পরকাল, পরলোকে বিশ্বাস করেন। শুধু অবিশ্বাসী ধর্মহীন লোকেরাই জাগতিক বিষয় নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। বাংলাদেশে বহু শিতি লোক নিজেদের সেকুলার বলে প্রচার করেন এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য নিজেদের ধর্মবিশ্বাসী বলে দাবি করেন। এদের অনেকেই মনে করেন সেকুলার হলেই প্রগতিশীল হওয়া যায়। এরাই ধর্মবিশ্বাসীদের ফান্ডামেন্টালিস্ট (Fundamentalist) বা মৌলবাদী বলে গাল দেন। শব্দটির জন্ম হয়েছে ব্রিটেনে যখন খ্রিষ্টধর্মে বিভাজন দেখা দেয়। একদল আরেক দলকে মৌলবাদী বলে গালাগাল দিতে শুরু করে। এখন খ্রিষ্টধর্মে দুটি প্রধান বিভাজন রয়েছে; একটি ক্যাথলিক আর অপরটি প্রটেস্ট্যান্ট। ক্যাথলিক গির্জার সদর দফতর হলো ইতালির ভ্যাটিকানে আর প্রটেস্ট্যান্টদের সদর দফতর ইংল্যান্ডে। ব্রিটেনের রাজপরিবারই এর প্রধান। এখন মৌলবাদ শব্দটি মুসলমানদের েেত্র ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমারা তো করেই, কিছু প্রগতিশীল আরবি নামধারী মানুষও মুসলমানদের মৌলবাদী বলে গাল দেয়। আরবি নামধারী তথাকথিত মুসলমানেরা নিজেদের মানবধর্মী, প্রগতিশীল, নন-পারফর্মিং বা নন-প্র্যাক্টিসিং মুসলমান বলে দাবি করেন। এরা কেউই মুসলমান নয়। এরা মুনাফেক বা বিশ্বাসঘাতক। এদের ব্যাপারে কুরআন শরিফে সুস্পষ্ট বক্তব্য ও ঘোষণা রয়েছে। এরা রাসূল সা:-এর জমানায়ও ছিল, এখনো আছে। উল্লিখিত দৈনিকটি প্রগতিশীল, সেকুলার, মানবতাবাদীদের কাগজ। তাই সুযোগ পেলেই আকার-ইঙ্গিতে ইসলাম, মুসলমান ও মুসলিম রাষ্ট্রকে আঘাত করে। উপমহাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টিকে সেকুলার (ধর্মহীন) চিন্তাধারার লোকেরা মানতে পারেনি। তাই পাকিস্তানকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বলে গালাগাল দেয়। এরা মুসলিম লীগের সৃষ্টিকেই মানতে পারে না। জিন্নাহর ১১ আগস্টের ভাষণ সব মহাফেজখানা বা আর্কাইভসে মূল্যবান দলিল হিসেবে আছে। কোনো পাঠাগার বা লাইব্রেরিতে যেতে হবে না। ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। আগেই বলেছি, ওই ভাষণে জিন্নাহ কেন পাকিস্তান বা মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়েছিল তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। অখণ্ড হিন্দু ভারতে (যদিও কাগজ-কলমে হিন্দু রাষ্ট্র বলা হয় না) মাইনরিটি বা সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমানদের কী অবস্থা হবে তার কথাও তিনি বলেছেন। এখনো ভারতে প্রতি বছর ছোটখাটো এক হাজার দাঙ্গা হয়। ভারত কথায় কথায় মানবতা, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞানমনস্কতা বললেও কার্যত এটা একটা বর্ণবাদী হিন্দুরাষ্ট্র। হাসান ফেরদৌস নিশ্চয়ই এমন একটি রাষ্ট্র চান যেখানে ধর্ম থাকবে না। এক সময় চীন-রাশিয়াসহ বহু দেশে ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ ছিল। ৭০-৮০ বছর পরে এখন আবার মসজিদ, গির্জা ও সিনাগগের দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে। কারণ ধর্মচর্চা করা মানুষের মৌলিক অধিকার। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো এই অধিকারকে অস্বীকার করেছিল। আমাদের বাংলাদেশেও রাষ্ট্রের ওপর তথাকথিত সেকুলার প্রগতিশীলদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খুবই বেশি। এরা গোপনে বা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের সব জায়গা দখল করে রেখেছে। জিন্নাহ কিন্তু কখনো এ কথা বলেননি যে পাকিস্তান একটি সেকুলার রাষ্ট্র হবে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানে সবাই পাকিস্তানি হবে। কেউ বাঙালি, সিন্ধি, বালুচ, পাঞ্জাবি বা হিন্দু মুসলমান থাকবে না। সবার রাষ্ট্রীয় পরিচয় হবে পাকিস্তানি। ভারতে যেমন সবাই ভারতীয়। ভারতেও বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু গোত্র বা জাতি রয়েছে। কিন্তু সবার রাষ্ট্রীয় পরিচয় ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান। বাংলাদেশেও বহু ধর্মের, বহু গোত্র বা উপজাতি রয়েছে। কিন্তু সবার পরিচয় বাংলাদেশী। সবার পাসপোর্টে লেখা থাকে বাংলাদেশী। কিন্তু সেকুলার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বাংলাদেশী বলতে নারাজ। তারা নাকি শুধুই বাঙালি। তারা বাংলাদেশী শব্দের ভেতর যেন কিসের গন্ধ পান। একজন বুদ্ধিজীবী বলেই ফেলেছেন, বাংলাদেশী বললে নাকি বাংলাদেশী গরু, ছাগল, গাছপালা, মাছ ইত্যাদি মনে হয়। এ কারণেই নাকি বলতে হবে বাংলাদেশী মানুষ। শুধু বাংলাদেশী বললে নাকি গরু-ছাগল মনে হতে পারে। জিন্নাহ সাহেব ৪৮ সালের জুলাই মাসে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের উদ্বোধন করতে গিয়ে যে ভাষণ দেন তাতে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং-ব্যবস্থার ওপর গবেষণার গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, পশ্চিমা ধনবাদী অর্থনীতির পচন শুরু হয়ে গেছে। তাই ইসলামি অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার সময় এসেছে। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ ভাষণ। সুতরাং জিন্নাহকে ১১ আগস্টের ভাষণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কোনো অবকাশ নেই। ভারত যেমন হিন্দুর দেশ, তেমনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মুসলমানের দেশ। মুসলমানেরা বাংলাদেশে মেজরিটি হলেও সাংবিধানিকভাবে এখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার। এ দেশে কোথাও কোনো ধরনের পৃথক নির্বাচন হয় না। পাকিস্তান বা ভারতেও হয় না। এর মানে নাগরিক হিসেবে সবার সমান অধিকার। মদিনা রাষ্ট্রেও সব সমান অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু কেউ দাবি করেননি যে বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র করা হোক। বাংলাদেশে কোথাও ইসলামি আইন নেই। এ দেশে কুরআন-সুন্নাহ না জানলেও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, প্রধান সেনাপতি হওয়া যায়। এমনকি ধর্ম না মানলেও সব কিছু হওয়া যায়। বাংলাদেশ না বাঙালির রাষ্ট্র, না মুসলমানের রাষ্ট্র। ধর্মমুক্ত আদি অকৃত্রিম বাঙালি রাষ্ট্র বানানোর কোনো চেষ্টা কেউ করেননি। ইসলামি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টাও কেউ করেনি। পূর্ণাঙ্গ সেকুলার রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টাও করেনি। ৫৪ সাল থেকেই বলা হচ্ছে, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না। এ দেশে সংবিধানে লেখা থাকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। শুক্রবারে ছুটি থাকে। আবার সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ ও আল্লাহর নাম তুলে দেয়া হয়। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখন দেশে বাদশাহ আকবরের দ্বীনে ইলাহি চলছে। আকবর শব্দ ব্যবহার করাও অনেকে পছন্দ করেন না। তারা বলেন আল্লাহ সর্বশক্তিমান। এ দেশে সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করা হয় না। বলা হয় জনগণই সার্বভৌম। জনগণকে সার্বভৌম না মানলে বলা হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অবিশ্বাসী।


রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিদ্যুৎ উৎপাদনের বন্যা বয়ে থাকলে ৩/৪ বার লোডশেডিং কেন ?


উন্নয়নের লম্বা লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়ে তার গর্বের সীমা নাই। এই খাতে নাকি দুর্দান্ত উন্নতি হয়েছে। এই উন্নতি কি দুর্দান্ত? নাকি ভয়াবহ? সেটি দেখবার বিষয়। শেখ হাসিনার রাজত্বের ৪ বছর ৯ মাস পার হয়ে গেলো। আর মাত্র ৩ মাস সময় আছে তার হাতে। অর্থাৎ তার রাজত্বের মেয়াদও প্রায় শেষ। এখন তার সেই তথাকথিত উন্নয়নের হিসাব নিকাশ নেয়ার সময় এসেছে। বিদ্যুৎ দিয়ে তিনি যদি দেশকে সয়লাব করেই থাকেন তাহলে খোদ ঢাকার বুকে এই ধানমন্ডিতে কেন দিনে ৩ বার লোডশেডিং হচ্ছে ? তিনি সিংহাসনে বসার পর প্রথমদিকে যখন ধানমন্ডি, গুলশান এলাকায় ৪-৬ বার লোডশেডিং হতো তখন মানুষ কিছু বলেনি। সকলেই বলতেন যে নতুন সরকার এসেছে, তাদেরকে কিছুটা সময় দেয়া যায়। বিরোধী দলও এই কথায় চুপ থেকেছে। তারাও আওয়ামী সরকারকে ডিস্টার্ব করেনি। আন্দোলন, হইহুল্লোড় ইত্যাদি কিছুর মধ্যেই তারা যায়নি। উদ্দেশ্য হলো সরকারকে সময় এবং শান্তি দেয়া।
কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী সরকারের যাত্রায় নাস্তি। আজ বিদ্যুৎ খাত সাফল্যে ভরপুর বলে যে আনন্দ উল্লাস করা হচ্ছে সেখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এখনও যদি ঢাকায় ৩-৪ বার এবং মফস্বলে ৫-৬ বার লোডশেডিং খেতে হয় তাহলে জনগণকে ৩-৪ গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ নিতে হচ্ছে কেন ? যে কথা বলছিলাম। সরকারের যাত্রা নাস্তি। বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে দিন রাত্রির অষ্ট প্রহর বিএনপি এবং জামায়াতের সরকার অর্থাৎ ১৮ দলীয় সরকারের পিন্ডি চটকানো হয়। এখনও সেটি নিরন্তর হচ্ছে। বিএনপি কিছুই করতে পারেনি, বিএনপির ৫ বছর মেয়াদে নাকি এক ফোটা বিদ্যুৎও উৎপাদিত হয়নি। এগুলো সব ডাহা মিথ্যা কথা। সরকারি নথিপত্র বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা এবং বাজেট বক্তৃতার সময় সরবারহকৃত অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। এই সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিএনপির ৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২০০-১০০ মেগাওয়াট নয়, সেটি হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ এসে যেটা করলো সেটি সম্পূর্ণ উল্টা পথে হাঁটা। সমস্যার সমাধান করতে গেলে অনেক গুলো স্থায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দিকে তারা নজরই দিলেন না। একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং সে কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়- ইংরেজীতে এটিকে বলা হয়, এবংঃধঃরড়হ ঢ়বৎরড়ফ. ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারী শেখ হাসিনা দেশের ক্ষমতা নিয়েছেন। ক্ষমতা নেয়ার সাথে সাথেই তিনি যদি কয়েকটি স্থায়ী কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিতেন তাহলে ২০১১ সালের শেষের দিকে ঐ সব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসতো।
অথচ সেটি না করে সরকার হাঁটলো কুইক রেন্টাল স্থাপনের পথে। কুইক রেন্টালের সপক্ষে যুক্তি দেয়া হলো যে বিদ্যুৎ সংকটের আশু সমাধানের জন্য কুইক রেন্টাল ছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই। কিন্তু তখনও মানুষ জানতো না যে আওয়ামী সরকারের আস্তিনের মধ্যে কি লুকিয়ে আছে। এমন জাতের কুইক রেন্টালের পরিকল্পনা পাস করা হলো যেটি শুধুমাত্র তেল দিয়ে চলে। যে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তেল দিয়ে চলে সেগুলোর উৎপাদন খরচ পানি বা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি। শেখ হাসিনার কুইক রেন্টালেও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটলো না। কুইক রেন্টাল চালানো মানে হাতির খাদ্য জোগানো। যেসব কুইক রেন্টাল বসানো হয় সেগুলোর তেল আমদানির জন্য ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকা খরচ হয়। কিন্তু এ টাকা আসবে কোথ থেকে ? অতএব ব্যাংক থেকে ধার এবং ছাপাখানায় টাকা ছাপানো। শুধুমাত্র তেল আমদানির জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ওপর খরচ হলো। ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলো। জনগণ ভুলে যাননি যে এই আওয়ামী সরকার ১ বছরে তেলের দাম ৫ বার বাড়িয়েছে। ফলে অবধারিতভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বহুগুণ বেড়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম কত বেড়েছে সেটি কল্পনারও বাইরে। সব জিনিসের দাম কম করে হলেও ৩-৪ গুণ বেড়েছে। এই সেদিনও যে পেঁয়াজের দাম ছিলো ২০-২৫ টাকা কেজি আজ সেটি ৮০-৯০ টাকা কেজি।
॥দুই॥
কুইক রেন্টালের বিরুদ্ধে যাতে মানুষ কথা বলতে না পারে, বিশেষ করে মামলা মোকদ্দমা করতে না পারে, সে জন্য এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে আইন পাস করে কুইক রেন্টালের সমগ্র ইস্যুকে দায় মুক্তি দেয়া হয়। অর্থাৎ আইনের ভাষায়, কুইক রেন্টালের বিষয়টিকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়। টেন্ডারের বালাই নাই, যাচাই বাছাইয়ের বালাই নাই, সর্বোচ্চ দর দাতা বা সর্বনি¤œ দাতার কোন বালাই নাই, আওয়ামী লীগের অনুগ্রহভাজন ৫০-৬০ ব্যক্তিকে ডেকে কুইক রেন্টাল বসানোর কাজ দেয়া হয়। ঐ সব ভাগ্যবান ব্যক্তি রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যায়। কুইক রেন্টাল স্থাপনের জন্য তারা যে দাম উল্লেখ করে সেটি কম না বেশি সেটিও চ্যালেঞ্জ করার কোন রাস্তা রাখা হয়নি। এই ভাবে ৫০-৬০ জন ব্যক্তিকে শত শত কোটি টাকার মালিক বনার সুযোগ করে দেয়ার পরেও সরকারের পৌনে ৫ বছরের মাথায় এসেও দেখা যাচ্ছে, এখনও ঢাকায় অন্তত ৩ বার এবং মফস্বলে ৪-৫ বার লোডশেডিং হচ্ছে। তাহলে জনগণকে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকার খেসারত দিতে হলো কেন ?
এখনকার লোডশেডিং এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় যে, যতগুলো কুইক রেন্টাল বসানো হয়েছে সবগুলোই নাকি পূর্ণ সংস্থাপিত ক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না। কারণটি হলো, সেটি করতে গেলে তাদের যে পরিমাণ জ্বালানি তেলের প্রয়োজন সেই পরিমাণ তেল সরকার দিতে পারছে না। তাদের প্রয়োজন মতো তেল দিতে গেলে আরও তেল আমদানি করতে হয়। ফলে তেলের মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে জিনিসপত্রের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। আবার তাদেরকে তেল সরবারহ করতে না পারলে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যাবে না এবং লোডশেডিং চলতেই থাকবে। সুতরাং সরকার পড়েছে মহাফাঁপরে। কোন দিকে যাবে তারা? যখন কুইক রেন্টাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় এবং পার্টিগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয় তখন সরকার এসব সমস্যা অগ্রীম চিন্তা করেনি কেন ? সে জন্য কথায় আছে, ‘ভাবিতে উচিৎ ছিলো প্রতিজ্ঞা যখন’।
॥তিন॥
কথায় বলে, নেড়া নাকি এক বারই বেল তলা যায়। কিন্তু আমাদের সরকার দেখছি বেল দিয়ে মাথা ফাটানোর পরেও কোন শিক্ষা পায়নি। নেড়া মাথা এবং ফাটা মাথায় তারা আবার বেল তলা যাচ্ছে। প্রথমে কথা ছিলো যে ৩-৪ বছরের মধ্যে সবগুলো রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল উঠিয়ে নেয়া হবে। কারণ কুইক রেন্টাল সব সময়ই একটি স্বল্পমেয়াদী প্রজেক্ট। এগুলো সাময়িক চাহিদা মেটানোর জন্য চালু করা হয়। এর মধ্যে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পানি, গ্যাস, কয়লা এবং সৌর তাপের সাহায্যে বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। সেই দিক দিয়ে বিচার করলেও কুইক রেন্টাল বন্ধ করার সময় এসে গেছে। কিন্তু ইলেকশনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সরকার চোখ উল্টিয়েছে। এখন বলছে যে, ২০২০ সাল পর্যন্ত কুইক রেন্টাল রাখা হবে। কুইক রেন্টালের আয়ু আরও ৭ বছর বাড়ানোর কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া গেল না। যে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় সেটি বড় অপ্রিয় কথা। পাবলিকের কাছে গেলে এ ব্যাপারে অনেক অকথা কুকথা তথা বাঁ হাতের কারবারের কথা শোনা যায়। এ সবের সত্য মিথ্যা জানেন আল্লাহ্ মাবুদ।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আওয়ামী সরকার যদি বেশি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে সয়লাব করে দিয়েই থাকে তাহলে আর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনতে হচ্ছে কেন ? গত দু তিনদিন ধরে কাগজে আপনারা দেখেছেন যে, ভারত থেকে চূড়ান্ত পরিমাণে ৫০০ শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হবে। প্রথম পর্যায়ে গত শুক্রবার কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রীডে সংযুক্ত করা হয়েছে। আগামী ৫ অক্টোবর ভারতের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধন করবেন যৌথ ভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। তারপর দৈনিক ১৫০ থেকে ১৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে সেটি ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে।
॥চার॥
এমন একটি অবস্থার পটভূমিতে দেশে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে নতুন একটি উপদ্রবের। সেটি হলো সুন্দরবনের অদূরে কয়লা চালিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনের এন্তেজাম। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট জেলার রামপাল নামক স্থানে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। যেখানে উৎপাদিত হবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এটি সম্পূর্ণ কয়লা চালিত হবে বলে প্রজেক্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে। এক মাত্র সরকার ছাড়া সমস্ত মহল এক বাক্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন যে, এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হলে বছরে ৫২ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। এর ফলে সুন্দরবনের বাঘগুলো মরে যাবে এবং সবুজ বনায়ন হলুদ বা ধূসর রং ধারণ করবে। অর্থাৎ আগামী ১০ বছরের মধ্যে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, মাত্র কয়েক বছর আগে আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের ফায়েটি নামক স্থানে অনুরূপ কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। দেখা যায় যে সেখান থেকে ৩০ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। স্বাস্থ্যের পক্ষে এবং জীব-বৈচিত্র্যের জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে টেক্সাসের জনগণ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জনগণের চাপে সরকার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। আমাদের দেশেও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। তেল ও গ্যাস রক্ষা কমিটি রামপাল অভিমুখে একটি লং মার্চ করেছে। তারা এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন।
দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের বিকল্প নেই

রাজনীতিতে কোন কাজটি এখন এ মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটির জন্য করতে হবে অপোÑ এটি নির্ধারণ করা অপরিহার্য। জাতীয় নির্বাচন আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। প্রধানমন্ত্রী সংবিধান থেকে এক চুলও নড়ব নাবলে তার নির্বাচনী কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু বিরোধী দলের রাজনীতি হয়ে আছে এলোমেলো ও দ্বিধাবিভক্ত। এ অবস্থায় কোনো দাবি আদায় অসম্ভব ব্যাপার। আওয়ামী লীগের মতো দলের কাছ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই। এ ল্েয জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, গড়ে তুলতে হবে ইস্পাত কঠিন ঐক্য। এই ঐক্য গড়ার এখনই যথাযথ সময়। জাতীয়তাবাদী শক্তির দাবিদার এ দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক দল। শক্তির পরিমাপে এসব দল বাংলাদেশের রাজনীতির প্রায় ৭০ শতাংশ শক্তির অধিকারী। উল্লেখ্য, কিছু দিন আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাতে ফলও হয়েছে আশাতীত। সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুললে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে পপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাবস্থা করতে সরকার বাধ্য হবে; না হয় একতরফা নির্বাচন তো দূরের কথা, জনরোষে পড়ে লেজ গুটিয়ে তাদের মতা থেকে বিদায় নিতে হবে। চাপ প্রয়োগ ছাড়া কোনো দাবি আদায় হয়েছেÑ এমন নজির রাজনীতিতে নেই। সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়Ñ এখন পর্যন্ত এমন কোনো শক্তিশালী গণ-অন্দোলন বিরোধী জোট গড়ে তুলতে পারেনি। গণ-আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া ছাড়া সরকারের টনক নড়বে বলে মনে হয় না। আসলে যেকোনো গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অপরিহার্য; আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ছাড়া সফলতা আসে না। আর একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে এবং তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে, চার পাশ থেকেই আন্দোলনের পে সাপোর্ট আসতে হয়; শুধু কর্মী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। এর জন্য পেশাজীবী, লেখক-সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও সক্রিয় অংশ নেয়া প্রয়োজন। এই সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই জনমত সংগঠিত হয় এবং একটি গণ-আন্দোলনের প্রোপট তৈরি হয়। কাজেই গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার েেত্র বিরোধী জোটকে সব মেশিনারিজ সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে বিরোধী জোটের সাথে শাসকদলের দূরত্ব এখন চরমে। এ ইস্যুতে সরকারের প থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বিরোধী জোট তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরবে না। সরকারও তার সিদ্ধান্তে অটল। এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায় বসতে চাচ্ছে না। এই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থায় কার্যত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পথ বেরিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় বিরোধী জোটের রাজপথে নামা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। শাসকদলের নেতারা দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছেন, তারা বিরোধী দলকে বলছেন হাসিনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিতে। তাদের কাছে প্রশ্ন, তারা কি ২০০৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে নিয়েছিলেন? মেনে নেননি, তা হলে একজন রাজনৈতিক দলের প্রধানকে (শেখ হাসিনা) বিএনপি মেনে নেবে কোন যুক্তিতে? নির্দলীয় ও নিরপে সরকার শুধু বিরোধী জোটের দাবি নয়, এটি জনদাবি। এটি নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ দাবিতে বিরোধী জোট যেখানে জনসভা ডেকেছে, সেখানেই সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে; মানুষের অভাবনীয় সারা সেখানে ল করা গেছে। রাজনীতির স্বকীয়তা সেখানে ফুটে উঠেছে। কার্যত এটি এখন বাংলাদেশের রাজনীতির মূল বিষয় হয়ে আবির্ভূত হয়েছে, দেশের সব রাজনৈতিক দল একবাক্যে এ দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কেননা একটি সুষ্ঠু, পপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল নির্দলীয় ও নিরপে সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত করা সম্ভব; কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এটি আশা করা অবান্তর। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে মধ্য-আয়ের দেশের দিকে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা জরুরি। কে বা কোন দল মতায় গেল, সেটি বড় করে না দেখে, দেশকে বড় করে দেখতে হবে; গোটা দুনিয়া বাংলাদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দেখতে চায়, কেননা এর মধ্যেই তারা সৃজনশীল, পরিচ্ছন্ন ও অর্থনৈতিকভাকে অগ্রসরমান এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান।


0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচন সংস্কৃতি : বাংলাদেশ বনাম বহির্বিশ্ব

দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রোপট বিবেচনা করে এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি সভ্য দেশে দীর্ঘ প্রবাস যাপনের অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখাটি লিখছি। গত ৭ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগে ও পরে পুরো অস্ট্রেলিয়ায় একজন নাগরিক খুন হওয়া তো দূরের কথা, কোথাও কোনো হানাহানির ঘটনা শুনিনি। শোনা যায়নি একদলের কর্মী অন্য দলের কর্মীকে হুমকি-ধমকি দিতে। ছিল না কোনো ভোটকেন্দ্র দখল বা পুলিশি অ্যাকশানের ঘটনা। এমনকি দেখা যায়নি কোনো পাবলিক স্পটে মিছিল, মিটিং বা মাইকিং হতে। শুধু একটাই সমস্যাÑ ভোট না দিলে ৭২ ডলার জরিমানা গুনতে হবে এবং যথাযথ কারণ দর্শিয়ে চিঠি দিতে হবে। যদিও ভোট দেয় না এমন লোক পাওয়া বেশ কঠিন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দিন থেকে নতুন সরকারের হাতে মতা হস্তান্তরের সময় পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সর্বত্রই নির্বাচনী পরিবেশ থাকে নিজের ঘরের মতোই শান্ত ও শান্তিপ্রিয়। অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচনের দিন অনেকটাই ঈদের ঠিক পরের দিনের ঢাকা শহরে পরিণত হয়। মানুষের কোলাহল খুব একটা চোখে পড়ে না। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সব নির্বাচন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হওয়ায় মানুষের কর্ম ব্যস্ততা চোখে পড়ে না বললেই চলে। অন্যান্য নির্বাচনের মতো এবারো ভোট চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। যাবো যাবো করে অবশেষে কেন্দ্রে গেলাম বেলা আড়াইটার পর। থ্যাঙ্কস গড। দেশে থাকলে ওই সময় নাগাদ হয়তো শুনতাম ইতোমধ্যেই আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। এবারো ভোটকেন্দ্রের সামনে হাতেগোনা চার-পাঁচজন দলীয় এজেন্ট দাঁড়িয়েছিল। এরা বেশ আন্তরিকতার সাথে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে। এরা হাতে নিজ নিজ দলের পোস্টার বা লিফলেট বহন করলেও কোনো ভোটারকে তাদের প্রার্থীকে ভোট দিতে প্রভাব বিস্তার করে না। কিভাবে ব্যালটে ভোট দান করতে হবে সে বিষয়ে বিশেষত পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের লোকজন কোনো দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে কেউ নাক গলাতে আসুক মোটেও পছন্দ করে না। ভোটারেরা বেশ কিছু দিন ধরেই দুই দলের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো পর্যবেণ করে এবং কোন বিষয়গুলো জনগণ ও দেশের উন্নয়নে যুগোপযোগী ভূমিকা রাখবে, অতীতে মতাসীনেরা সরকারে থেকে জনগণের ওয়াদার কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করেই ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উন্নত বিশ্বে জবাবদিহিতার রাজনীতি বিদ্যমান বলেই রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের আস্থা আছে ও তারা নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করার উদ্দেশ্যেই রাজনীতি করেন। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বেসরকারি ফলাফল আসতে শুরু করে। প্রায় তিন ঘণ্টার মধ্যেই বেশির ভাগ আসনের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারণ হয়ে যায় কোন দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। দেশের প্রধান দুটি দল হচ্ছে লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টি। এবার লিবারেল গত এক শতাব্দীতে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে লেবারকে হারিয়ে সরকার গঠন করেছে। দেশের অনেক ভোট কেন্দ্রে যখন অবশিষ্ট ভোট গণনা চলছিল, পরাজিত দলের নেতা ও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বিজয়ী দলের নেতা টনি অ্যাবটকে স্বাগত জানাতে ফোন করেন। এরপর কিছুণের মধ্যেই দলীয় সমর্থকদের সামনে এসে দুই দলের নেতাই পৃথক পৃথক বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে দুই দলের প্রধানই এ ফলাফল বা বিজয়কে জনগণের বিজয় বলে উল্লেখ করেন। কোনো প্রার্থীই নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন বা কারচুপির কোনো অভিযোগ আনেননি। কেউ কারো বিরুদ্ধে সামান্য ােভ নিয়ে কথা বলেননি। বরং দুই দলই আগামী দিনের অস্ট্রেলিয়া কেমন হবে, দেশ শিা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়ন ইত্যাদিতে কিভাবে আরো অগ্রসর হবে সে বিষয়ে কথা বলেন। অপর দিকে আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমেই অন্ধকার যুগে পা রাখছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের টিভির খবর দেখতে বসলেই বুঝে উঠতে পারি না, এটা বাংলাদেশ নাকি আফগানিস্তান, ইরাক, মিসর কিংবা সিরিয়ার মতো কোনো দেশ। আমাদের প্রিয় এ জন্মভূমি তো এমনটি ছিল না। এ অবস্থার জন্য আমি দেশের মানুষের চেয়ে কিছু রাজনীতিবিদের সরাসরি দায়ী করতে চাই। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী রক্তয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে নামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও মানুষের স্থায়ী রূপ এখনো দেখতে পায়নি। প্রতিবারই দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচন তথা মতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে এক ধরনের বলির-পাঁঠায় পরিণত হতে হয়। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসে ততই মতার অপব্যবহার, একে অন্যের প্রতি বিষোদগার, ােভ, ঘৃণা, হুমকি-ধমকি, হরতাল, অবরোধ, বোমাবাজি, মামলাবাজি, মারামারি, কাটাকাটি, খুন ইত্যাদি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কয়েকশ লোক নিহত হয় ও কয়েক হাজার লোক আহত হয়। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। একই সাথে সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে দেশে কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে দেশের মানুষ কমপে দুই বছরের জন্য স্বস্তি পাবে সে আশায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কামনা করে। অবশেষে অনেক জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়ে নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয় না। নির্বাচনের দিন কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে বিভিন্নভাবে দোষারোপ শুরু করে। কেউ বলে নিখুঁত কারচুপি হয়েছে, কেউ বলে সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপি ইত্যাদি বিভিন্ন সংজ্ঞা মিডিয়ায় তুলে ধরে। বিশেষ করে যে দল হারতে বসে তারা সহজে জনতার রায়কে মেনে নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অবশেষে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রায় মানতে বাধ্য হয়। কারণ নির্বাচন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে হয়নি। দেশের প্রায় সর্বেেত্রই অনগ্রসরতা ও স্থিতিশীলতার অভাব, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি ঘটনার ফলে দেশে বিদেশের অনেক মানুষের মুখে প্রায়ই শুনা যায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এর কোনো পরিবর্তন কেয়ামত পর্যন্ত হবে না। তাদের কথায় যুক্তি থাকলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশও কয়েক বছরের মধ্যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মধ্যম আয়ের শান্তিপ্রিয় দেশ হতে পারে। এত সমস্যার পেছনে সাধারণ মানুষের দোষ। সর্বেেত্রই স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ, অদ লোকের হাতে মতায়ন, রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার অভাব, আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং আইন না মানলে মানাতে বাধ্য না করানোই এর মূল কারণ। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের মতো এত জনবহুল দেশে সুস্থ নির্বাচনের পরিবেশ বাস্তবায়ন অসম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা কম, তাই সেখানে সমস্যা কম, ফলে নিরপে নির্বাচন সম্ভব। ইন্দোনেশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্যও বেশ জনবহুল দেশ। তা ছাড়া আমাদের পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা বিভিন্ন দেশেও যদি অপোকৃত সুস্থ ধারার রাজনীতি বিদ্যমান থাকে, তাহলে বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়? দেশের অনেক লোক দেশের বাইরে থাকে ও এ সংখ্যার এক বিশাল অংশ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে অতি সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়ে চলেছেন এবং কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ওই দেশের সরকার থেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন। আবার যারা দেশের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক, প্রবীণ সাংবাদিক এবং প্রথম সারির রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, তাদের বেশির ভাগই উচ্চশিায় শিতি। কাজেই এদের কোনোটাই প্রমাণ করে না আমরা অসভ্য বা বর্বর জাতি। বাংলাদেশের নির্বাচনী হাওয়া বর্তমানে এমন গতিতে বইছে ইতোমধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোতেও এ বাতাস বইতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয় বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে। আজ জাতিসঙ্ঘের প্রধান, কাল ইউরোপীয় প্রতিনিধি দল, পরশু অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দল আসছে বা বার্তা পাঠাচ্ছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের নাক গলানো এক দিকে যেমন দুঃখজনক, অন্য দিকে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা ুণœ হতে যথেষ্ট। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, একটি দেশ যখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে, তখনই বিদেশীরা হস্তপে করে। এ ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্যই জাতিসঙ্ঘের মতো সংগঠনের জন্ম হয়েছে। উন্নত দেশগুলোরও করার কি আছে। তারাও বাংলাদেশের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। ব্যবসায়িক খাতে এরা কয়েকশ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে রেখেছে। দেশের রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে তারাও ব্যবসায়িকভাবে বেশ তিগুস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক দেশ বিভিন্ন খাতে নতুনভাবে বিনিয়োগ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে, এবং কেউ কেউ ব্যবসায় গুটিয়ে নেয়ারও পাঁয়তারা করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমেই হুমকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। অন্য দিকে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তৃতীয় শক্তি আতঙ্কে ভোগে। অথচ এরা একবার চিন্তা করে না এ তৃতীয় শক্তির আগমন এমনি এমনিতেই হয় না। বিশেষ করে, বড় দুই রাজনৈতিক দলের সহিংসতা ও পারস্পরিক সমঝোতার অভাবেই এর সৃষ্টি হয়। রাজনীতিবিদেরা এ তৃতীয় শক্তিকে কুনজরে দেখলেও আমি দেশের জনসাধারণের সাথে সহমত পোষণ করছি। তৃতীয় শক্তি এলে এটা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় কমপে দেশের সাধারণ মানুষ কিছু দিন নিরাপদে চলতে পারে, শান্তিতে ঘুমোতে পারে, নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক মনে করে। কারণ দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীরা হয়তো শ্রীঘরে থাকে অথবা গা ঢাকা দেয়। দেশের অনেক অনিয়মই নিয়মের মধ্যে চলে আসে। তা ছাড়া গত ২৩ বছর ধরে দেখছি বিভিন্ন সরকারের আমলে হাতেগোনা কিছু মন্ত্রী দেশাত্মবোধ থেকে তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে কিছু কাজ করলেও, কোনো বিশেষ সরকার দেশের জন্য এককভাবে এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, জনগণ তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পরপর একই দলকে মতায় দেখতে চায়। আর এখানেই বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দেশের রাজনীতির মধ্যে মৌলিক তফাৎ। এরই এক বাস্তব উদাহরণ আমরা দেখেছি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নির্বাচনে। জনগণের কাছে দেয়া অনেক ওয়াদাই যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি বলে জনগণও সে মোতাবেক রায় দিয়েছে। এবং সে ব্যর্থতার দায় অবশেষে বিদায়ী সরকার হাসিমুখে বরণও করেছে। এ থেকেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছুই এখনো শেখার আছে। গত কয়েক মাস ধরেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছে। আবার বসছেও না। ফলে এখন চলছে একে অন্যের প্রতি দোষারোপের রাজনীতি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কেহই কারো কথা মানতে নারাজ, তাদের সামনে এখন একটি পথই খোলা আছে। দেশের যারা নির্দলীয় বুদ্ধিজীবী ও প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। এর নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। 


Ads