বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৩

একচুলও না নড়ার নেপথ্যে ২১টি কারণ


প্রধানমন্ত্রী একচুলও নড়বেন না। অনির্বাচিত ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনদের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এলেও এখন অনির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার একেবারেই অপছন্দ। শেখ হাসিনা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ীই তথা আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। আরো স্পষ্ট করে বললে তার সরাসরি তত্ত্বাবধানেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। তার এই সিদ্ধান্ত থেকে তিনি একচুলও নাকি নড়বেন না। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক তোলপাড় হচ্ছে। মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আসলেই কী ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা তো সংবিধানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। এটি ছিল একটি সর্বব্যাপী গণ-আন্দোলনের ফল। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার দাবিকে কেন্দ্র করে দেশে এক ব্যাপক রাজনৈতিক ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছিল এবং সকল দলের দাবির প্রেক্ষিতেই এটি বাংলাদেশের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি বিরাট অর্জন। এই ব্যবস্থার অধীনে যে কটি নির্বাচন হয়েছিল সবগুলোই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার আগে দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে কখনই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। মূলত সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম কেয়ারটেকার সরকারের এই ফর্মুলা উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ এটি হাইজ্যাক করে জামায়াতকে সাথে নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করে। আজকের বামপন্থীরাও কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার দাবিতে ছিল সোচ্চার। পরবর্তীতে বিএনপির আমলে এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। মোটকথা শুধুমাত্র সামরিক শাসক এরশাদ ছাড়া বাদবাকী সকল দল ছিল কেয়ারটেকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সুতরাং ব্যাপক গণআন্দোলনের ফসল যেই কেয়ারটেকার সরকার, যেটি ছিল সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ সরকার সেই নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাটিকে কেন ২০১১ সালের ৩০ জুলাই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান তৈরি করল এবং কেনই বা তারা আজ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের নিজেদের দলীয় তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন এবং রহস্যের জন্ম দিয়েছে। দেশের বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের চুলচেরা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের এই মরিয়া ভাবের পেছনে অন্তত একুশটি কারণ রয়েছে।
১.       কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার অধীনে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রীকে তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতা ত্যাগ করে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকতেন এবং অন্যান্য দলের মতই সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার না করে নির্বাচনী আচরণ বিধি মেনেই নির্বাচন করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে বিধান তৈরি করেছে তাতে শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকবেন। শুধু তাই নয়, তার এমপি অর্থাৎ পার্লামেন্টও বহাল থাকবে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতায় থেকেই প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রীরা সরকারি খরচে নির্বাচনী প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে পারবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী খরচের কোন সীমারেখা থাকবে না। ইতোমধ্যে তিনি সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়া শুরুও করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিশ্বাস, দলীয় তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করতে পারলে তারা নির্বাচন এমনকি ফলাফলকে প্রভাবিত করে হলেও বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে।
২.       দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগও চায় বিরোধী দল নির্বাচনে না আসুক। একতরফা নির্বাচনে যেহেতু কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না, সেক্ষেত্রে বিজয় একেবারে সুনিশ্চিত। কাজেই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকতে পারবেন।
৩.       বিরোধী দল বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। তাতে সরকারের আরো লাভ। কারণ, বর্তমান সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কোন অনির্বাচিত সরকার প্রধানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না, তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন পরবর্তী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কাজেই নির্বাচনই যদি না হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে তো আর কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হচ্ছে না। আবার যতদিন নির্বাচন না হবে ততদিন বর্তমান সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ বহাল থাকবে। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও লাভ, বিরোধী দল না আসলেও লাভ, বিশৃংখলা বা নির্বাচনী পরিবেশ না থাকার কারণে নির্বাচন না হলে আরো বেশি লাভ। সর্বাবস্থাতেই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।
৪.       বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, দলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে। সে অবস্থায় কী হবে? তারও বিধান আছে। নির্বাচনে পরাজিত হলেও প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রীদের সাথে সাথে ক্ষমতা ছাড়তে হবে না। পরাজিত হওয়ার পরও অন্তত ছয় মাস তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন, যাতে তারা নিরাপদে আখের গুছিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেন। কিন্তু এটি আওয়ামী লীগ মোটেই পছন্দ করবে না। তাই পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখলে নির্বাচনে একটা গ-গোল বা নির্বাচন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
৫.       ক্ষমতায় থাকলে প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার, ভোট ডাকাতি ও কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বংশানুক্রমে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার এবং গণতন্ত্র তথা জনগণের সার্বভৌমত্বকে নির্বাসনে পাঠিয়ে পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার চমৎকার সুযোগ রয়েছে।
৬.       ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, একতরফা নির্বাচন কিংবা নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার বিরুদ্ধে যাতে কোন আন্দোলন গড়ে না ওঠে তারও বিধান রয়েছে বর্তমান সংবিধানের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বা নির্বাচন ভ-ুল হওয়ার পরবর্তী সময়ে যদি সরকার বিরোধী কোন আন্দোলনের চেষ্টা করা হয় তাহলে তা হবে ‘অসাংবিধানিক’ পথে ক্ষমতায় আসার অপচেষ্টা এবং এটি হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ, যার নিশ্চিত শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ-। নতুন ৭(ক) এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদ। সেখানে যা বলা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্বলিত ‘সংবিধান কিম্বা তার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত’ করবার চেষ্টা, বদলাবার কোন চেষ্টা হলেই তা অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে। অসাংবিধানিক পথ বলতে প্রথমত বোঝায় সশস্ত্র অভ্যুত্থান। কিন্তু সেটাই একমাত্র অসাংবিধানিক পথ নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে অসাংবিধানিক পথ বলতে শুধু শক্তির ‘প্রদর্শন’ বা শক্তির ‘প্রয়োগ’ বোঝানো হয়নি। অন্য কোন ভাবেও হতে পারে, ‘অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়’ ! যেমন গণঅভ্যুত্থান। পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে শুধু যে সেনা অভ্যুত্থান ও গণঅভ্যুত্থান ঠেকানোর জন্য তাই নয়। এমনকি কাউকে শক্তি প্রদর্শন, শক্তি প্রয়োগ বা গণঅভ্যুত্থানও করতে দেয়া হবে না। ‘সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে’ সেটাও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হবে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ’ শাস্তি। মৃত্যুদ-। তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।
৭.       নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে, সব দলের জন্য সমান নির্বাচনী প্রচারণার সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কিন্তু হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো দূরের কথা, নির্বাচন কমিশন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ কোন কিছুই আর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। তাছাড়া ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে একচেটিয়াভাবে সরকারি অর্থ ব্যবহার ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণসহ সকল সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগানো যাবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব খুনি-সন্ত্রাসী-ক্যাডারকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে তারা নির্বিঘেœ নির্বাচনের সময় ভোট ডাকাতির সময় কাজ করতে পারবে। অন্যদিকে বিরোধী দলকে ঠ্যাংগানিসহ তাদেরকে মাঠ ছাড়া করা যাবে।
৮.       উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেখানে নির্বাচন কমিশন সরকারের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনকে একান্ত অনুগত সাক্ষীগোপালে পরিণত করেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনকে হয়তো প্রভাবিত করা যাবে না এই ভয়েই আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অধীনেই নীলনকশার নির্বাচন তথা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চাচ্ছে। এই নির্বাচন কমিশন এমএ আজিজের চেয়ে অনেক বেশি দলীয় অনুগত।
৯.       নির্বাচন কমিশন সরকারকে বলছে ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স’ তথা আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিল করে দেয়ার জন্য। উল্লেখ্য, এই ধারাবলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা রয়েছে, কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করলে তার প্রার্থিতা বাতিল করার। এর আগে যখন নির্বাচন কমিশনকে আমরা বলতে শুনেছি কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে, সেখানে বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই ধারা বাতিল করে কমিশনের নিজের ক্ষমতা কমানোর এ স্ব-উদ্যোগে দেশবাসী বিস্মিত হয়েছে। কেন কমিশন নিজের এই ক্ষমতা নিজ উদ্যোগে কাটছাঁট করার উদ্যোগ নিলো তা বলাই বাহুল্য।
১০.     নির্বাচন কমিশনের আরপিওর এই ৯১(ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তের আগে ইসির আরেকটি পদক্ষেপের কথা শোনা গিয়েছিল, যা বিরোধী দলের প্রতিবাদের মুখে পড়ে তা অস্বীকার করা হয়। এ পদক্ষেপের আওতায় ইসি আগামী নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী ও ২০ জন মন্ত্রীর জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিল।
১১.      সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আচরণবিধির যে খসড়া তৈরি করেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের জন্য এ সুযোগ রাখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে করে সরকারি দল নির্বাচনী প্রচারণায় বাড়তি সুযোগ পাবে। নষ্ট হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
১২.      আরেকটি উদ্বেগের খবর প্রকাশিত হতে দেখা গেছে একই সময়ে। খবরটি হলো, নির্বাচন কমিশন বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিএনএফ নামে একটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, এ দলটির লোগোতে থাকবে ধানের শীষ অথবা গমের শীষ যা দেখতে হবে অবিকল ধানের শীষের মতই। বিএনপি বিষয়টিকে ইসি তথা সরকারের বিএনপিবিরোধী ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছে। বিএনপি বলেছে, বিএনএফের নিবন্ধন দেয়া হলেও দলটিকে লোগোতে ধানের শীষ বা একই ধরনের প্রতীক ব্যবহার করতে দিলে বিএনপি ইসির বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করবে। এর ফলে ইসি বিষয়টিকে আপাতত স্থগিত করে রেখেছে, তবে বিষয়টি এখনো বাতিল করেনি। একদিকে ইসি সরকারের সাথে যোগসাজশে অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার পাঁয়তারা করছে, অপর দিকে নামধামহীন বিএনএফের নিবন্ধনে প্রবল আগ্রহী।
১৩.     এই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আরো একটি বড় অভিযোগ, ইসি সরকারের সাথে যোগসাজশ করে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য অনেকগুলো নির্বাচনী আসন ওলটপালট করেছে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের কোনো আপত্তি সরকারপক্ষ বা ইসি আমলে নেয়নি। এভাবে আওয়ামী লীগের পছন্দের বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের চাওয়া-পাওয়া একে একে পূরণ করে যাচ্ছে। ফলে এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়Ñ এমন মন্তব্য বিএনপি, বিকল্প ধারা ও জাতীয় পার্টিসহ (এরশাদ) প্রায় সব বিরোধী দলের।
১৪.      এই নির্বাচন কমিশন এক মেরুদ-হীন নির্বাচন কমিশন। সরকার যা বলছে এ নির্বাচন কমিশন একান্ত বাধ্যগতের মতো তাই করে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন তিনটি পৌরসভার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেও পরে তা সরকারের ইচ্ছায় বাতিল করে দিয়েছে। ইসি গত ৩১ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুর, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া ও রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে বলে, ৮ সেপ্টেম্বর এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; কিন্তু গত ১৩ আগস্ট এলজিআরডি মন্ত্রীর এক চিঠি পেয়ে ইসি এ নির্বাচনী তফসিল বাতিল করে। আরো এলজিআরডি এ ধরনের ১০টি পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত করার কথা ইসিকে জানায়, যেগুলোর মেয়াদ ইতোমধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। প্রশ্ন আসে কেন এসব পৌরসভার নির্বাচন বন্ধ করে দিলো সরকার? গত ১৩ আগস্ট এই তিন পৌরসভার নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের কথা ছিল।
১৫.      নির্বাচন কমিশনের সচিবালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, এভাবে এলজিআরডি মন্ত্রীর অনুরোধে কোনো নির্বাচনে ঘোষিত তফসিল বাতিল হওয়ার ঘটনা এর আগে তার জানা নেই। নির্বাচন কমিশন যখন নিশ্চিত হয় যে, এ তিনটি পৌরসভার নির্বাচন আয়োজনে কোনো ধরনের বাধা বা জটিলতা নেই, ঠিক তখনই কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, এভাবে এই তিন পৌরসভার নির্বাচনী তফসিল বাতিল করে দিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বাজে নজির সৃষ্টি করল।
১৬.     আসলে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা এখনো মনে করেন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের ভরাডুবির পর, ওই তিনটি পৌর নির্বাচনেও সরকারি দলের প্রার্থীরা একই ধরনের ফলাফলের মুখোমুখি হতে পারে। সে ধরনের ভাবনা-চিন্তা থেকেই সরকার নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে এসব নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, এসব নির্বাচনে আগের চেয়েও বড় ধরনের ফল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে সরকারি দল। এর ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ দশটি পৌরসভার নির্বাচন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
১৭.      সরকারের ইচ্ছা পূরণে সাক্ষীগোপাল নির্বাচন কমিশন এখানে অসহায়। মেয়াদোত্তীর্ণ পৌরসভাগুলোতে নতুন নির্বাচন দিতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হলেও যে নির্বাচন কমিশন সরকারের চিঠি পেয়ে চুপ হয়ে যায়, সে নির্বাচন কমিশন দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটুকু সম্ভব, সে প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এক দিকে বলছে, এরা নির্বাচিত ছাড়া অনির্বাচিতদের হাতে দেশ শাসনের ভার ছেড়ে দেয়ার বিপক্ষে; মেয়াদোত্তীর্ণ পৌরসভা ও অন্যান্য সংস্থার নির্বাচন বন্ধ করে রাখছে। অর্থাৎ এসব সংস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরিচালনা করুক, তা সরকার চায় না। চায় না বলেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে সেখানে অনির্বাচিত আমলা দিয়ে সিটি করপোরেশন চালাচ্ছে। নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করেছে। এখন আবার নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দেয়ার সাহস দেখাতেও পারছে না। সরকারের ইচ্ছায় নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে এর নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়েছে।
১৮.     শুধু এখানেই শেষ নয়, ইউনিয়ন পরিষদে যেসব চেয়ারম্যান ও সদস্য বিরোধী দলের সমর্থক বলে চিহ্নিত, তাদের মাঝে মধ্যেই সরকারবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত থাকার অভিযোগ তুলে বরখাস্ত করে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করছে এ সরকার। গত জুন মাসে এ ধরনের অভিযোগ তুলে ৩১ জন ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আবার গত আগস্টের দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংস ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ইউনিয়ন পরিষদের আরো ৫৫ জন চেয়ারম্যান ও সদস্যকে সরকার বরখাস্ত করে। এদের বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয়পর্যায়ের নেতা-সমর্থক। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে এদের বরখাস্তের কথা জানিয়ে তিন দিনের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়। সরকারের ভয়, আগামী নির্বাচনে এসব জনপ্রতিনিধি সরকারবিরোধী জনমত গঠনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবেন। অতএব এদের ক্ষমতাহীন করে রাখতে হবে। এদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে হবে জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট।
১৯.      সরকার এখন কাজ করছে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনের পরবর্তী ছয় মাস ক্ষমতায় থাকার জন্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি নির্বাচনে হেরে যায়, তবে নির্বাচনের পরপর তাদের ওপর আসা সম্ভাব্য আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর রক্ষাকবচ হিসেবেই সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিতে চাইছে। নির্বাচনের পরের এই ছয় মাস এরা নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শুধু দলীয় সঙ্কীর্ণ চিন্তাভাবনা থেকে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তাড়িয়েছে, এখন নিজেদের জান বাঁচানোর চিন্তায় নির্বাচনে পরবর্তী ছয় মাস ক্ষমতায় থাকার জন্য আবার সংবিধান সংশোধন করবে। এভাবে দলীয় সঙ্কীর্ণ চিন্তা থেকে সংবিধানকে আর কত ক্ষত-বিক্ষত করা হবে?
২০.     ইসি শুধু আরপিওর ৯১(ই) ধারাই সংশোধন করছে না, ইসি সম্প্রতি আরপিওর যে খসড়া তৈরি করেছে তাতে ৪১টি অনুচ্ছেদে ৫৭টি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে। এসব সংশোধনীর মূল লক্ষ্য বিরোধী দলের তুলনায় সরকারি দলকে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া। এরই একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও ২০ জন মন্ত্রীকে সরকারি সুবিধা ভোগ করে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার প্রস্তাব। দলীয় প্রধানের নির্বাচনী প্রচারের ব্যয়ের কোনো সীমা বেঁধে দেয়া হবে না। প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ইসির হাতে না রেখে আদালতের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাবও করেছে ইসি। এভাবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেন নিজেদের ক্ষমতা সমর্পণ করতেই অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের সন্দেহ, এগুলো কার্যত সরকারের ইচ্ছায়ই করা হচ্ছে; যাতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করে সরকার যা ইচ্ছা তা করতে পারে অবাধে।
২১.      এ সরকারের আমলে প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণের বিষয়টিও দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। এই দলীয় প্রশাসন বহাল রাখার মাধ্যমে ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করতেই হাসিনার অধীনে নির্বাচন চায় আওয়ামী লীগ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads