মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জীবনের চেয়ে ভাবমর্যাদা বড় হতে পারে না


‘রানা প্লাজা বিপর্যয়’ বাংলাদেশের ইতিহাসে মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। এ দেশে অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এত বিশাল ভবন ধসের ধ্বংসস্তূÍপ থেকে উদ্ধার কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন। ‘একজন মানুষ প্রাণ হারানো মানে পুরো মানবতার মৃত্যু ঘটা’। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে যদি একজন মানুষের প্রাণ যায়, তাহলেও মানবতার অবমাননা ঘটল। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার যে অবস্থান নিয়েছে তা কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সরকার কয়েকটি উন্নত দেশের সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘ভাবমর্যাদা নষ্ট হওয়া’র যে কারণ দেখিয়ে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো, ভবনে আটকে পড়া শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারির প্রতি এর মাধ্যমে নিদারুণ অবজ্ঞার প্রতিফলন ঘটল।

রোববার ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফ খবর দিয়েছে, উদ্ধার অভিযানে সাহায্য করতে ব্রিটেনসহ কয়েকটি উন্নত দেশের প্রস্তাব সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। দুর্ঘটনার পরপরই জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তারা যখন বুঝতে পারলেন, বিপুলসংখ্যক লোক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছেন, তখন বাংলাদেশ নিজের সামর্থ্যে উদ্ধারকাজ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাথে পরামর্শ করা হয়। তারা একমত হন, বাংলাদেশ এই কাজ করতে পারবে না। তারা তখন ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশকে বিষয়টি অবগত করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বিদেশী সাহায্য না নিয়ে সাভারের উদ্ধার কার্যক্রমে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভর করা হয়। তাদের সুরক্ষাদায়ক পোশাক ছিল না, এমনকি অনেকে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরেও কাজে নেমেছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধারে সরকারের প্রস্তুতির অভাব এর মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
পত্রিকাটি শনিবার প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদনে লিখেছে, চিকিৎসকেরা স্বেচ্ছাসেবককে এক নারী গার্মেন্ট শ্রমিকের এক হাত কেটে উদ্ধারের নির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্য দিকে একজন অভিজ্ঞ উদ্ধারকারী হলে হয়তো সে মেয়েটির হাতও রক্ষা পেত। চাপা পড়া অনেক শ্রমিক দিনের বেলার ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় বেঁচে ছিলেন নিজের প্রস্র্রাব পান করে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ উদ্ধারকারীরা মৃত্যুপথযাত্রীদের কাছে পৌঁছাতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যা অবশ্যই কমে আসত। আরো সহজে উদ্ধারকাজ চালানো যেত। সরকার মানুষের জীবন রক্ষার চেয়ে ভাবমর্যাদাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছে। সাহায্যকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাবও দেয়া হয় যে, সাহায্যের বিষয়টি প্রকাশ করার দরকার নেই। তারপরও সরকারের এক কথা, নিজেদের মানমর্যাদা বেশি।
রানা প্লাজা ধসে প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশে বিরাট বিরাট ইমারত তৈরি হচ্ছে। সেগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকার কঠোর হাতে মান নিয়ন্ত্রণ করছে না। এমনকি এত বড় ভবন ধসে গেলে তখন উদ্ধার অভিযান কেমন হতে পারে সে ধারণা নেই সরকারের। মানুষকে যদি না বাঁচানো যায়, তাহলে ভাবমর্যাদা দিয়ে কী হবে? এই ভাবমর্যাদা কি সরকারের একা?  গরিব মেহনতি মানুষ ও শ্রমিকদের কোনো ভাবমর্যাদা নেই? এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে। ক্ষমতাসীনদের বলতে হবে, সবাইকে একই পাল্লায় মাপুন। মানুষের মর্যাদার ক্ষেত্রে এ ধরনের বিভাজন করবেন না। রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে একজন সাধারণ শ্রমিকের জীবনের সমান মূল্য রাষ্ট্র দেবেÑ গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই সবার প্রত্যাশা।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শুধু দিবস পালনে শ্রমিকদের কল্যাণ নেই


প্রতি বছর পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়। শুধু শ্রমিক দিবস নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বহু ধরনের দিবস পালনের সংস্কৃতি আমাদের দেশসহ সারা পৃথিবীতে চালু আছে এবং বিভিন্ন রকমের দিবস সৃষ্টিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা হোক, আমরা দেখতে পাচ্ছি পয়লা মে শ্রমিকদের নিয়ে যে দিবসটি পালন করা হয়, এটা শুধুই লোক দেখানো বা প্রতারণাও বলা যায়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের দিন জাতীয় পর্যায়ে কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার লোকজন এদিনে অনুষ্ঠান করেন,  বক্তৃতা করেন, র‌্যালি করেন ইত্যাদি। এরকম লোক দেখানো গতানুগতিক রীতির ধারাবাহিকতা চালিয়ে রেখে হাজার বছরেও শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি; সেটাকে বাস্তবতায় রূপ দেয়ার জন্য সরকারের ন্যায়ভাবে কাজ করা উচিত। আশির দশক থেকে শুরু করে আমাদের দেশে গজিয়ে উঠেছে নব্য কয়েক হাজার পয়সাওয়ালা বা তথাকথিত শিল্পপতি। এরা লাখ লাখ শ্রমিককে চরমভাবে ঠকিয়ে রাজকীয় জীবনযাপন করছে।

যে শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তাদের এত বিপুল অর্থবিত্ত, বিলাসিতা সেই শ্রমিকদের জীবনে তেমন পরিবর্তন আসেনি। সেসব শ্রমিকের জীবনে হতাশা আর বিষণœতা লেগেই আছে। সেসব শ্রমিকের চেহারায় এখনো দারিদ্র্যতার ছাপ। আর এই নব্য গজিয়ে ওঠা তথাকথিত শিল্পপতিদের বেশির ভাগই পোশাক শিল্প ব্যবসায়ী। এদের বিদেশী ব্যাংকে প্রচুর অর্থ জমা আছে। দুই কোটি পাঁচ কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল একাধিক গাড়ি এদের মধ্যে অনেকেরই আছে। উন্নত দেশের প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি তাদের রয়েছে একাধিক রাজকীয় বাড়ি। তাদের সন্তানেরা ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে লেখাপড়া করছে। ঈদ বাজারসহ বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা তাদের বিদেশী মার্কেটে। অনেকে তো দেশীও পানি পর্যন্ত পান করেন না। হালকা পাতলা দাঁতে ব্যথা, পেটে ব্যথা বা আমাশয় হলেও তারা চিকিৎসা নিতে চলে যান সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, অটোয়া। বহু রকমের আমোদ ফুর্তির অনুষ্ঠানে তারা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমান তাদের জন্য রিকশার মতো সহজ। অপর দিকে তাদের শিল্প কারখানায় শ্রমিকেরা তিনবেলা ভালোভাবে খেতে পারে না। সামান্য ক’টি টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে তাদের হতাশা। তারা পারছে না দেশীও হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসা নিতে। তাদের সন্তানদের দেশীয় সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাতে পারছে না অর্থের অভাবে। ছোট নোংরা কোনো বাসার ভাড়া দিতেও তাদের কষ্ট হয়। গাড়ি ভাড়া (বাস ভাড়া) দিয়ে তাদের বসত ভিটায় যাওয়ারও অর্থ তাদের কাছে থাকে না।
রক্তচোষা ওইসব শিল্পপতি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতায় বড় বড় কথা বলেন। এদের মধ্যে অনেকে রাজনীতি করেন। কেউ এমপি কেউবা মন্ত্রী-উপদেষ্টা। এদের মধ্যে যারা রাজনীতি করেন না তারা রাজনৈতিক নেতাদের বস্তায় বস্তায় টাকা চাঁদা দিচ্ছেন। উপঢৌকন দিচ্ছেন। তবে এসব সুবিধা পাচ্ছেন যারা সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ তারা। টাকা দিয়ে মাস্তান ও সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনী পুষে রাখছেন। পুলিশকেও দুধ-কলা দিয়ে পুষে রাখছেন। কিছুসংখ্যক অসৎ সাংবাদিককে খামে ভরে টাকা দিচ্ছেন। ভণ্ড প্রতারক বহু শ্রমিক নেতাদের নিয়মিত চাদা দিচ্ছেন। এসব কিছুই সাম্রাজ্যবাদী কুকর্ম। আর এই কর্ম বা সংস্কৃতিই আমাদের দেশে দেখতে পাচ্ছি। এগুলোই চলছে। যা আমি নিজে কয়েক বছর সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০০৭ সালের ৫ মে পর্যন্ত আমি দেশের বড় মাপের একজন শিল্পপতির কোম্পানির করপোরেট অফিসে ছোট একটি পদে চাকরিতে ছিলাম। ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিশাল অট্টালিকায় সেই অফিস। এরপর ২০০৭ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১১ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত অন্য একটি শিল্প কারখানায় অফিসিয়াল স্টাফ ছিলাম। সেখানেও প্রত্যক্ষ করলাম যৌথ ব্যবসায়ী ওই মালিকদের বিভিন্ন শয়তানি কর্মকাণ্ড। মাস্তানদের টাকা দিয়ে নিরীহ শ্রমিকদের বাসায় তারা হামলাও চালিয়েছিল।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন আপনারা শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করবেন না। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করুন। সামান্য কয়েকজন কারখানা মালিকের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেয়ে লাখ লাখ শ্রমিকের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা জ্ঞানীদের কাজ। তবে কারখানা মালিকদের সাথেও সুসম্পর্ক রাখুন কিন্তু শ্রমিকদের পেটে লাথি মেরে নয়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এই ফাটল শুধু ভবনের নয়, জাতির ভাগ্যেরও


বুধবার ২৪ এপ্রিল। নয়া দিগন্তের ১৫ পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় কলামে একেবারে নিচে, ছোট টাইপের হেডিং দেয়া একটি খবর। ‘সাভারে রানা প্লাজার ফাটল আতঙ্ক : গার্মেন্ট কারখানা ও ব্যাংক ছুটি ঘোষণা।’ সাভার সংবাদদাতার এই ছোট রিপোর্টটা পড়ে অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন, এমন আতঙ্কের ঘটনা নতুন নয়। আসলে ব্যাপার এত মারাত্মক কিছু নয়। বিশেষ করে একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা যখন সার্টিফিকেট দিলেন দুর্ঘটনার কোনো আশঙ্কা নেই, তখন তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাই স্বাভাবিক।

শুধু সাভার কেন, মাঝে মধ্যে অন্যান্য স্থানেও ভবনে ফাটল ধরার খবর ও ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়ে থাকে। বুধবারের সে খবরটি নি¤œরূপ : সাভারে গতকাল বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় দেয়ালের প্লাস্টারে ফাটল দেখা দেয়। এ সময় ভবনটিতে থাকা একাধিক গার্মেন্ট কারখানায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভবনের তৃতীয় তলা থেকে অষ্টমতলা পর্যন্ত নিউ ওয়েভ বাটনস লি., গার্মেন্ট টিওসি লি. ও নিউ ওয়েভ স্টাইল লি. নামে তিনটি গার্মেন্ট কারখানায় কর্মরত প্রায় দুই হাজার শ্রমিককে ছুটি ঘোষণা করে গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া দ্বিতীয় তলায় থাকা ব্র্যাংক ব্যাংক সাভার শাখার সব কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় মার্কেটের সব দোকান খোলা ছিল। সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সাভার থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
ুদ্র রিপোর্টটির পরবর্তী অংশটুকুই এখন অনেক বৃহৎ গুরুত্ব নিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। তা হলোÑ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার জানান, ‘ফাটলের অবস্থা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেয়ালের প্লাস্টার ধসে গেছে ও একটি পিলারে সামান্য ফাটল দেখা গেছে। এ ঘটনায় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই।’
ইউএনওর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বললেন কিভাবে? কোনো প্রকৌশলী তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটি পরীক্ষা করলে তা রিপোর্টে জানা যেত। তাহলে ইউএনও কেন এমন কথা মুখ থেকে বের করলেন, যার পরিণতি পরদিনের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। এতগুলো মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও জখম, আর্থিক ক্ষতি এসব কিছুর দায়ের একাংশও কি তিনি নিতে রাজি হবেন? যদি না হন, তাহলে বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে দুর্ঘটনা না ঘটার নিশ্চয়তা দিয়ে ‘বিশেষ অজ্ঞে’র ভূমিকায় নেমেছিলেন কী কারণে? বিস্ময়ের ব্যাপার, তাকেই তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে রানা প্লাজা ধসের ব্যাপারে। মিডিয়ার সমালোচনায় পরে নাকি তার নাম বাদ দিতে বলা হয় ঊর্ধ্বতন মহল থেকে।
 জাতি ট্র্যাজিক সেঞ্চুরি চায় না
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার ভিত ছিল ছয়তলার। অসৎ মালিক আরও তিনতলা তুলেছে এর ওপর। বিরাট এই ভবনে কয়েকটি পোশাক কারখানার পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংক শাখা এবং বহু দোকানপাট। ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ধসে পড়ে দেশের ইতিহাসের বেনজির ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। এই লেখা তৈরি করা পর্যন্ত প্রায় চার শ’ লাশ বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। নিখোঁজ আট শ’রও বেশি। জীবিত উদ্ধার হয়েছেন আড়াই হাজার। অনেককে উদ্ধারের সময় হাত বা পা কেটে ফেলতে হলো। শত শত আহত গার্মেন্টকর্মী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বজনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাসও যেন কাঁদছে।
বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ম্যাচে আমাদের সাকিব, মুশফিক, তামিম সেঞ্চুরি করলেন কি না, গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সে দিকে দেশবাসীর তেমন আগ্রহ ছিল না। কারণ সাভারে মানবসৃষ্ট মহাবিপর্যয়ে তখন ট্র্যাজিক সেঞ্চুরি তৈরি হচ্ছিল। রানা প্লাজা ধসের প্রলয়ে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা প্রায় চার শ’ হয়ে গেছে। মাত্র কয়েক মাস আগে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তুলেছিল। তখন নিহতের সংখ্যা এক সেঞ্চুরি পার হয়েছিল। এর আগে এই সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধসে মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের ট্র্যাজেডি পৌনে এক সেঞ্চুরি অতিক্রম করে দাঁড়িয়েছিল ৭৬-এ। দেখা যাচ্ছে, দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাতের শিল্পে একের পর এক প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয় ঘটছে। এসব নারকীয় ঘটনার কোনোটার প্রতিকার এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের কোনো শাস্তিই হয়নি। ফলে আগের ঘটনার চেয়ে পরেরটাতে মারা গেছে আরও বেশি মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আরও ব্যাপক। এখন বাংলাদেশ সরকার এবং সেই সাথে বিজিএমইএকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা এসব মর্মান্তিক সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ব, নাকি গার্মেন্টকর্মীদের অন্য সবার মতো মানুষ মনে করে তাদের জন্য মৃত্যুকূপ বানানো বন্ধ করব?
 সোনার ছেলে ও কানামাছি ভোঁ ভোঁ
ভবন ধসের পরপরই মিডিয়ার খবরে জানা যায়, ধসে পড়া ৯ তলা ভবনটির মালিক সোহেল রানা। এই যুবক যুবলীগের স্থানীয় নেতা। সে যুবলীগের পরিচয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এমনকি হিন্দুর সম্পত্তি দখল করেছে বলেও পত্রিকা খবর দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। তার হাতের তালিকায় রানার নাম নেই। প্রধানমন্ত্রী এর পরই বলেছেন, ‘অন্যায়কারী আমার দলের হলেও শাস্তি পেতে হবে। যদি দলের দোহাই দিয়ে পার পেতে চায়, পার পাবে না।’ তার এই বক্তব্য প্রশংসনীয়। তবে এ কথা থেকে এটাও ধরে নিতে হয় যে, যুবলীগের কমিটির তালিকায় সোহেল রানার নাম থাকুক না থাকুক, সে যে বিরোধী দল নয়, বরং আওয়ামী লীগের লোক, তা দলের নেতাদেরও জানা। কোনো কোনো পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পাশে একটি পোস্টারের ছবি, যা সাভারের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়। শোক দিবসের পোস্টারে বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ছবির পাশে বড় ছবি সাভারের এমপি তৌহিদ জং মুরাদের। নিচে সবচেয়ে বড় ছবিটি সোহেল রানার। সাথে তার দলীয় পরিচয় লেখা ‘সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, সাভার পৌর যুবলীগ’।
এই পরিচয় যদি মিথ্যা হয়, তাকে কি বহিষ্কার করা হয়েছে? কিংবা দল এর কোনো প্রতিবাদ জানিয়েছে কি? এমন কোনো খবর পত্রিকায় আসেনি। এ অবস্থায় মানুষ ধারণা করছে, গার্মেন্টে আগুন কিংবা ভবন ধসের আগের ঘটনাগুলোর মতো এটারও হোতাদের হয়তো শাস্তি হবে না। বড় ভাইরা দলের ‘দুষ্টু ছেলেদের’ বাঁচিয়ে দেয়াকে এক ধরনের দায়িত্ব মনে করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের হম্বিতম্বি এবং প্রশাসনের তোড়জোড়ের মাঝে শোনা গেল, ‘রানা প্লাজার মালিক এবং যুবলীগের দখলবাজ ‘সোনার ছেলে’ সোহেল রানার খোঁজ মিলছে না।’ আমরা প্রায় সময়ই পত্রপত্রিকায় দেখি, অমুক তমুক সন্ত্রাসী পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ হলেও তাদের নাকের ডগা ও চোখের পাতার সামনে দিয়ে অবাধে ঘোরাফেরা করছে। কার্টুনে দেখা যায়, চোখে কাপড় বাঁধা পুলিশ ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’ খেলছে আর কুখ্যাত অপরাধী আশপাশে ঘুরছে হাসিমুখে। সরকারি দল করে বলে তার ক্ষমতা পুলিশের চেয়ে বেশি। অতএব, তাকে ছোঁয়ার সাধ্য কারো নেই। সাভারের রানা প্লাজার অসৎ ও লোভী মালিক সোহেল রানার হদিস পেতে মাসুদ রানার মতো গোয়েন্দার দরকার হয় না। জনগণ মনে করেছে, সে লুকিয়ে বা পালিয়ে থাকলে ক্ষমতাসীন মহলের আশ্রয়েই থাকবে। সে তার অন্যায়-অপকর্ম ও দৌরাত্ম্য চালাতে পেরেছে একই মহলের প্রশ্রয়ে। গত বুধবার রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর কে সোহেল রানাকে গণরোষ থেকে দ্রুত উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন? পত্রিকার খবর, আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি (তার বাবাও অতীতে আওয়ামী এমপি ছিলেন) তাকে সরিয়ে নিয়ে যান ছুটে এসে। পত্রপত্রিকা লিখেছে, সে ওই এমপির ঘনিষ্ঠজন। এই ঘনিষ্ঠতা কত গভীর, তা তো তাকে উদ্ধার করা থেকেই প্রমাণিত। অথচ এমপির বড় দায়িত্ব ছিল, সর্বাগ্রে ভবন ধসে আটকা পড়া মানুষ এবং হতাহতদের উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সোহেল রানা বেনাপোলে ধরা পড়েছে। সে পালাচ্ছিল ভারতে।
সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ল বুধবার সকালে। ভবনটির মালিক আর সেখানকার গার্মেন্ট মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলো দুই দিন পরে। শুক্রবার সন্ধ্যায় জানা গেল, বিজিএমইএ ওইসব গার্মেন্ট মালিককে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে। একই সময়ে মিডিয়া প্রচার করেছে, প্রধানমন্ত্রী ভবনমালিককে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। রানাা প্লাজা ট্র্যাজেডি ঘটার পর তৃতীয় দিনে এর মালিক যুবলীগ নেতা রানাকে গ্রেফতারের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ এসেছে। কেন এত বিলম্বে, এ প্রশ্ন জেগেছে সাথে সাথেই। আওয়ামী এমপি তাকে গণরোষ থেকে বাঁচাতে তড়িঘড়ি সরিয়ে এনেছেন। একইভাবে খুব ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মহল তাকে আশ্রয়, এমনকি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া অসম্ভব ছিল না।
সরকারের পিলার ও সাভারের পিলার
সরকারকে একটা ভবনের সাথে তুলনা করলে এর একটি প্রধান পিলার বা স্তম্ভ বা খাম্বা হচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের মতো অঞ্চলে এ পদের গুরুত্ব কত বেশি, তা বলার দরকার পড়ে না। বর্তমান সরকারের একটি বড় ‘পিলার’ যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি সাভারের ভবন ধসের ঘটনা প্রসঙ্গে ‘পিলারতত্ত্ব’ দিয়েছেন। সারা দেশে এ নিয়ে ক্ষোভ ও কৌতুকÑ দুটোই সৃষ্টি হয়েছে বলে পত্রপত্রিকা জানিয়েছে। বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শোনা গেছে, মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, ‘এই দুর্ঘটনার আগে কিছু মৌলবাদী এবং বিএনপির ভাড়াটে লোক ভবনটির গেট এবং বিভিন্ন পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছিল। ভবন ধসের এটাও কারণ হতে পারে।’ স্বরাষ্ট্্রমন্ত্রী ডক্টরেটধারী যে বিষয়ে, তাকে অনেকে এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মনে করতে পারেন। কিন্তু তিনি তো প্রকৌশলী বা নির্মাণ বিশেষজ্ঞ নন মোটেও। আসলে গরুর ওপর রচনা না লিখে গরুকে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে নদীর ওপর রচনা লেখার ব্যর্থ প্রয়াস এটা। সরকার মৌলবাদ আর বিএনপি আতঙ্কে যে কত বেশি ভুগছে, এসব উদ্ভট উক্তি তার প্রমাণ। মন্ত্রী দেখাতে চেয়েছেন, সাভারের এই ট্র্যাজেডির পেছনেও বিরোধী দলÑ বিশেষ করে জামায়াত-শিবির জড়িত। বাস্তবে এই মর্মান্তিক বিপর্যয় ঘটল মন্ত্রীর দলেরই এক যুবনেতার চরম লোভ ও অসততার কারণে।
আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বচনামৃত এতই বিস্বাদ যে, তা আওয়ামী লীগের ফ্রি স্টাইল কটুভাষী নেতাদেরও গলাধঃকরণ করা সম্ভব হয়নি। মাহবুব-উল আলম হানিফ এ ধরনের ‘উল্টাপাল্টা’ কথা বলা বন্ধ করতে বলেছেন। আর ক্ষমতাসীন জোটের দ্বিতীয় বড় শরিক দলের প্রধান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। আগের দিন বৃহস্পতিবার একই দাবি জানালেন নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে এর আহ্বায়ক ফরহাদ মজহার। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার মিডিয়াম্যানদের এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী দাবি করেন, মিডিয়া তার বক্তব্যে বিকৃতি ঘটিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি ‘হরতালকারীরা ওই ভবনের ফাটা পিলারে ধাক্কাধাক্কি না করলেও পরতেন। সেই ধাক্কাধাক্কি ভবনটা ভেঙে পড়ার কারণ এমন কথা বলিনি।’
 বিজিএমইএ : আইন কি কাজীর গরু?
বৃহস্পতিবার রাতে টিভি চ্যানেল কোনোটা খবর দিয়েছে, বিজিএমইএ সাভারের রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্টের মালিকের সদস্যপদ ‘বাতিল’ করেছে; কোনো চ্যানেল বলেছে, ‘স্থগিত’ করেছে। আসলে ব্যাপারটা কী? বাংলাদেশে ‘স্থগিত’ মানে, বাস্তবে পুনর্বহালের সুযোগ। আর ‘বাতিল’ করার আদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাতিল হয়ে যায় আপিলের সুবাদে কিংবা ‘বিশেষ’ বিবেচনায়। বিজিএমইএ ভবিষ্যতে কী করবে, জানি না। অতীতে তারা যে ভূমিকা রেখেছে তাকে দায়িত্বে অবহেলা কিংবা উদাসীনতা বা ব্যর্থতা বললে অনেক কম বলা হয়।
বিজিএমইএর সবচেয়ে বড় দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো Compliance, অর্থাৎ গার্মেন্ট শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অনুসরণীয় ও বাধ্যতামূলক সব আইনকানুন, বিধিবিধান, শর্ত ও নির্দেশ যথাযথভাবে কার্যকর করা হচ্ছে কি না। Compliance ছাড়া নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এবং অবস্থান বজায় রাখাÑ কোনোটাই সম্ভব নয়। শেষোক্ত কারণটি না থাকলে গার্মেন্ট মালিকেরা Compliance-কে কতটা গুরুত্ব দিতেন, তা নিয়ে অনেক সন্দেহ। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং পেশাগত সুরক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের দেশে আজো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিবেচিত হয় না; বরং এটা অবহেলা ও অবমূল্যায়নের বিষয়। মালিকদের আইডিয়া হলো, ‘শ্রমিকের জানের চেয়ে আমার মুনাফার গুরুত্ব বেশি।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত, তৈরী পোশাক শিল্প। এর Compliance বিষয় নিশ্চিত করার জন্য বিজিএমইএর কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্বশীল তো বটেই, এ বিষয়ে সাব-কমিটিও থাকে নিয়মিত তত্ত্বাবধানের জন্য। সাভারের রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বিজিএমইর আপত্তি সত্ত্বেও কারখানা চালু রেখেছিল বলে এখন দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের কারখানাগুলোর ব্যাপারে নিয়মিত কেন মনিটরিং করে যথাসময়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না? Compliance প্রতিপালনে ব্যর্থতার দরুন এ যাবৎ ক’টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে, কিংবা অন্যবিধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা বিজিএমইএর প্রকাশ করা উচিত। আইন, বিধি, নিয়ম-নির্দেশ অমান্যকারী সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী কী পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে এবং সেগুলো পর্যাপ্ত কি না, তা জানার অধিকার আছে জনগণের।
শুক্রবার নয়া দিগন্তের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম, ‘রানা প্লাজার মতো অসংখ্য মৃত্যুকূপ ঢাকার আশপাশে।’ এ রিপোর্টে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এতে জানানো হয়েছে, সাড়ে চার হাজার পোশাক কারখানার বেশির ভাগ ভবনের নির্মাণ ত্রুটিযুক্ত। ফলে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। কথা হলো, বিজিএমইএ কি এসব খবর রাখে না? তাদের যদি দায়িত্ববোধ থাকে, এ ক্ষেত্রে গার্মেন্ট মালিকেরা আদালতের বিধিনিষেধ ও নির্দেশনা কী করে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন? চোর পালালে বুদ্ধি যদি বাড়েও, তবুও যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। আর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে ‘বারবার চুরি করে চোর পালাচ্ছে’, তবুও মালিকদের সংগঠন এবং সরকারের বুদ্ধি গজায় না। এভাবে আর কত দিন জাতি শত শত প্রাণ হারিয়ে খেসারত দেবে?
বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্ট পণ্য সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত না থাকলে আমাদের খুব অসুবিধায় পড়তে হবে। Generalized System of Preference  বা GSP সুবিধা যাতে বাংলাদেশ ভবিষ্যতেও পায়, সে জন্য আলোচনা করতে একটি প্রতিনিধিদল আমেরিকা গেছে। কয়েক মাস আগে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে ৭৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ এমনিতেই বেকায়দায় রয়েছে। তার ওপর এখন সাভারে চার শ’ গার্মেন্টকর্মীর মৃত্যু জিএসপি ভাগ্য অনিশ্চিত করে দিতে পারে। খোদ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বৃহস্পতিবার ঢাকায় বলেছেন, এ ঘটনা জিএসপি সংক্রান্ত শুনানিতে প্রভাব ফেলবে।
 সুন্দর দেশ, হতভাগ্য জাতি
আমাদের দেশটি শস্য শ্যামল। এ দেশ সবুজ নিসর্গের অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ভূমির এই পললপ্রান্তরে উর্বরতা এত বেশি যে, বীজ থেকে আপনাআপনি বৃক্ষ গজায়। এটা দেখে বিদেশীরা বিস্মিত হন। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে ভূগর্ভস্থ সম্পদভাণ্ডারও কম নয় আমাদের। গোটা দেশের মানুষের ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রায় এক। অন্তত ৮৫ ভাগ মানুষ একই ধর্মের। এমন সমস্বত্ব বা Homogeneous রাষ্ট্র বিশ্বে খুব কম। ১৬ কোটি মানুষ বোঝা নয় আদপে। তারা উদ্যমী ও কর্মঠ অপরিমেয় জনসম্পদ।
এমন সম্ভাবনাময় দেশটির মানুষেরা সুখে-শান্তিতে থাকার কথা। কিন্তু আমাদের ফাটা কপাল। প্রধানত মানবসৃষ্ট কারণে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব এই দুরবস্থার জন্ম দিয়েছিল। এমন এক প্রেক্ষাপটে গার্মেন্ট শিল্প বিরাট সুযোগ বয়ে এনেছে আমাদের দুর্ভাগা জাতির ফাটা কপাল জোড়া লাগানোর। কিন্তু অসৎ, অপরিণামদর্শী কিছু লোকের অপকর্মে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ আগুনে পুড়ছে। ভবন ধসের অঘটন এই শিল্পে ধস ডেকে আনছে। গার্মেন্ট শিল্পের পতন ঘটলে লাখ লাখ বস্ত্রবালিকাসহ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষের জীবিকা রুদ্ধ হবে। জাতীয় অর্থনীতি পড়বে মুখ থুবড়ে। দেশে বেকারত্ব হবে প্রকট; সামাজিক অশান্তি দেখা দেবে। বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার অনেকটা ফাঁকা হয়ে যাবে। বারবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর ভবন ধসে যে বৈরী বার্তা বিশ্বাঙ্গনে পৌঁছে যাচ্ছে, এতে দেশের শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তারা হারাবেন বিদেশের আস্থা। ফলে আমাদের গার্মেন্ট পণ্য হারাবে আন্তর্জাতিক বিপণন। ওঁৎ পেতে থাকা কয়েকটি বড় দেশ এ সুযোগে দখলে নেবে সে বিরাট বাজার। সুযোগ একবার হারালে পুনরুদ্ধার সহজ নয়। তখন গার্মেন্টের কোয়ানটিটি ও কোয়ালিটি আমরা যতই বাড়াই, ফায়দা হবে না। এই বিবেচনায় বলা যায়, সাভারে ছয়তলার ভিত্তির ওপর বানানো নয়তলা রানা প্লাজার ফাটল আসলে আমাদের জাতির ভাগ্যের বা কপালেরই ফাটল। এই ভবন ধসে পড়ে লাখো লাখো মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ধরনের ঘটনাগুলোর জের ধরে অর্থনীতির ধস নেমে যাতে দেশের কোটি কোটি মানুষকে বিপন্ন না করতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে হবে এখনই।
‘চিরদিন সমান নাহি যায়’। এটি জাতীয় কবি নজরুলের একটি বিখ্যাত গান। এতে প্রথমেই উল্লেখ আছে সাভারের প্রাচীনকালের রাজা, দাতা হরিশ্চন্দ্রের ভাগ্যবিপর্যয়ের। আমরা এখন দেখছি সেই সাভারে অসংখ্য অসহায় গার্মেন্টকর্মী ও তাদের আপনজন, সেই সাথে গোটা জাতির ভাগ্যবিপর্যয়। দরিদ্র শ্রমিকদের ঘাম ঝরিয়ে, শ্রমশোষণের মাধ্যমে বিত্তের পাহাড় গড়েছে শোষক লুটেরা মালিক ও পুঁজিপতিরা।
এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই, যেখানে অজস্র মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে কোনো অসৎ অর্থগৃধ্নু নিজের ভাগ্য গড়তে পারবে না। যারা সাভারের ঘটনার মতো বিপর্যয়ের কারণ সৃষ্টি করে, তাদের এবং ওদের আশ্রয়দাতাদেরও ‘চিরদিন সমান নাহি যায়’Ñ এমন পরিস্থিতি কি অবিলম্বে সৃষ্টি করা উচিত নয়?

সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এর নামই কি গায়েবি বিষয়


ব্যক্তিগতভাবে অদৃষ্টবাদী কিংবা নিয়তিবাদী নই। তবে ভাগ্যের ভালো-মন্দের ওপর বিধাতার নিয়ন্ত্রণ ষোলআনা কবুল মানি। আজাব-গজব বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। তবে এটা মানুষের পদস্খলিত জীবনের অর্জন। দুর্বিনীত শাসক যেমন আপদ, তেমনি নির্লিপ্ত জনগণও বিপদ। জালেম অধ্যুষিত জনপদে অসহায় মজলুম নিপীড়িত হবে, শোষিত হবে, অত্যাচারিত হবে, জুলুমের শিকার হবেÑ এটা মেনে নিয়ে অগ্রসর হওয়াই ভালো। তবে অদৃষ্টবাদী সেজে মুখ বুজে বসে থাকা কোনো বিশ্বাসী মানুষের কাজ নয়। চোখ কান খোলা রেখে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে পথ চলাই সময়ের দাবি। তাছাড়া অজ্ঞতাই অভিশাপ। এ অভিশাপের আগুনে নিজে পুড়ে মরলে কোনো কথা ছিল না। লাখো মানুষকে যখন পুড়ে মারে কিংবা বিভ্রান্তির ঘোরে ফেলে দেয়, তখন সমূহ ক্ষতি হয়ে যায়। এ ক্ষতি থেকে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্বেষ মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধ্বংস করে দেয়। তখনই চার দিকে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে, যা আজ সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।

তার পরও আমাদের সমাজে সবজান্তা ভাব দেখানোর লোকই বেশি। আবার অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করীদের দৌরাত্ম্যও সর্বত্র। কুরআন-কিতাবকে সেকেলে ভাবেন এমন জ্ঞানপাপীরাও আজকাল প্রায় দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দু’ছত্র কুরআনের অনুবাদ পড়ে শোনাচ্ছেন। কুরআন যেন চড়–ইভাতির খেলার উপাত্ত। পূর্বাপর সঙ্গতি নেই, বলে দিলো সুবিধামতো একটা দুইটা লাইন। ওরা নিজেদের ছাড়া সবাইকে ভাবে বোকার হদ্দ। এমন জ্ঞানপাপীরাই প্রজ্ঞাবান আলেমদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে।
একজন জাঁদরেল ও হাইব্রিড নেতা হেফাজতে ইসলামকে নিন্দাবাদ দেয়ার আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে বলে দিলেন, ১৩ দফা মধ্যযুগীয় বিষয়। নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ বটে তবে ইতিহাসজ্ঞানে গণ্ডমূর্খ। যুগের ভাগ-বিভাজনই তিনি জানেন না। ইসলামের মধ্যযুগ সোনালী যুগ। ইউরোপের মধ্যযুগ অন্ধকারময়। যদিও রোমানরা তখনও একটা সভ্যতা ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। গ্রিস পুরনো সভ্যতা ধরে রাখতে পারছিল না। আফ্রিকাও অন্ধকারে ডুবেছিল। চীন মধ্যযুগেও অপাঙক্তেয় ছিল না। বিশ্বাসের ভ্রান্তি বাদ দিলে পারস্যও ছিল সমৃদ্ধ। মধ্যযুগের যে সংজ্ঞায়ন, এটাও ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের। শিল্প বিপ্লব ও রেনেসাঁর পথ ধরে পনেরো শতকের পর আধুনিকতার পথে এগিয়েছে। ইতিহাসের প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক ও উত্তর আধুনিক যুগের ধারণা ভারতীয়, আরবীয়, চৈনিক ও গ্রিক-রোমান ধারণায় একেবারে অনুপস্থিত। কারণ ইউরোপীয় সংজ্ঞা মতো মধ্যযুগ ধরা হয় পাঁচশত বছর থেকে পনেরো শ’ শতক পর্যন্ত। এটা ঠিক পোপ-পাদ্রি ও যাজকেরা ইউরোপের মধ্যযুগে বিজ্ঞানচর্চায় অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। বৃদ্ধাকে ডাইনি সাজিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। ধর্মের নামে অনাচার করেছে। অপর দিকে অন্ধকার যুগ বা আইয়ামে জাহিলিয়াতের ওপর হেরার জ্যোতি ছড়িয়ে ইসলাম বিশ্বকে নতুন সভ্যতা উপহার দিয়েছে। ইসলামের যা বুৎপত্তি, অর্জন কথিত মধ্যযুগেই হয়েছে। কারণ মহানবী সা:, সাহাবা, চার খলিফা, ওমাইয়া, আব্বাসীয় শাসনের কোনো জুড়ি নেই। এ সময় অর্ধজাহানজুড়ে মুসলিম সভ্যতা পৃথিবীকে সবক দিয়েছে। সভ্যতা বিলিয়েছে। এ সময় বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে। স্পেনে গেছে। ভারতজুড়ে তো বটেই, বলকান-ককেসাস অঞ্চলেও ইসলামি সভ্যতার হাতছানি পড়েছে। মক্কা-মদিনার আলোছটা বাগদাদ-দামেস্ক-স্পেন-কর্ডোভাকে রাঙিয়ে তুলেছে। ইউরোপ যখন অন্ধকারে, আস্তাবলে ঘোড়াÑমানুষ যখন একসাথে বাস করছিল, তখন মক্কা-মদিনা নগর রাষ্ট্র, আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন প্রক্রিয়াও তারা রপ্ত করে নিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় তখন মুসলিম বিজ্ঞানী, জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ, অঙ্কবিশারদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সমুদ্র বিজ্ঞান থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্ব তখন মুসলিম বিজ্ঞানীদের নখদর্পণে। যে জ্ঞান বিজ্ঞান মুসলিমদের হারানো সম্পদ, তা ছিল মধ্যযুগের অর্জন।
ভারতীয়রা কেমন ছিল তা জানার জন্য আল বিরুনীর ‘ভারত তত্ত্ব’ পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। হিন্দুরা মুসলমানদের মতোই ইউরোপীয় ধারণায় ইতিহাস ব্যাখ্যা করে না। তারা সত্য, ত্রেতা, দাপর, কলি ও ঘোরকলিÑ এভাবেই বৈদিক যুগ থেকে যুগ ভাগ করে বুঝে আসছে। তাছাড়া ইসলামের বাস্তবতা মেনেই ইতিহাসচর্চা করেছেন ইশ্বরী প্রসাদ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নেহরু প্রমুখ। পিকে হিট্টি, উইলিয়াম মুইরকেও এ ইস্যুতে সাক্ষী মানা যায়।
আজ প্রধানমন্ত্রীর সারিন্দা মধ্যযুগের নিন্দাবাদ গাইছেন। অপর দিকে খোদ প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদের মাহাত্ম্য প্রচার করছেন। অনেকেই আজ হোদায়বিয়ার সন্ধি, মদিনা সনদ, মক্কা ডিকলারেশন ও বিদায় হজের বাণীর কথা বলেন। তারা এসব বলেন, নিজেদের ধর্মপ্রীতি থেকে নয়, ধর্মভীতি ও বিদ্বেষ থেকে। তারপরও সাধুবাদ যে অজ্ঞতা অভিশাপ হলেও মাঝে মধ্যে অজ্ঞতা থেকে অকপট সত্য বেরিয়ে আসে। শয়তানও বিধাতার ইচ্ছায় কিছু ভালো কাজের জোগান দিতে পারে। ইসলামকে ইউরোপের মধ্যযুগীয় বর্বরতার সাথে তুলনা না করলে নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা সম্ভব হতো না। এ ব্যাপারে তাদেরও অনুসন্ধিৎসু মন সত্য জানার জন্য প্রস্তুত হতো না। প্রধানমন্ত্রী আবেগের আতিশয্যে মদিনা সনদের প্রশ্ন না তুললে এ যুগে মদিনা সনদ এতটা পঠিত হতো না। যদিও বিশ্বের কোনো সন্ধি, চুক্তি, দলিল, যুদ্ধনীতি, শ্রমনীতি-সংবিধান রচনায় মদিনা-সনদ, হোদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা ডিকলারেশন ও বিদায় হজের বাণীকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, মানবাধিকার, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানুষের মানবিক মর্যাদা ও নৈতিক ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রেও। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখার জন্য এবং আন্তঃধর্ম সম্পর্ক রক্ষা করার তাগিদেও ইসলামের শিক্ষার বাইরে পাওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা ভালোভাবেই জানেন, কুরআনকে এড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা হবে খণ্ডিত। পাক-পবিত্র হওয়া, হালাল-হারাম বিবেচনা ও নৈতিক শিক্ষার উৎস সন্ধানে ইসলামকে বাহ্যিকভাবে এড়ানো সম্ভব, অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের উৎস ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাড়াবাড়ি করে ইসলামকে টার্গেট বানিয়ে এতটা প্রচার প্রপাগান্ডা না হলেও জিজ্ঞাসু মনেরই জন্ম হতো না। নাইন-ইলেভেনের পর শুধু টুইন-টাওয়ার নিশ্চিহ্ন হয়নি। ইসলাম নিশ্চিহ্ন করার ইস্যু সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম-মুসলমান আক্রান্ত হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হলেও লাদেন চরিত্র আলোচিত হয়েছে। বহু লোককে আলোড়িত করেছে। সেই সাথে সবার অজান্তে কুরআন চর্চার হিড়িক পড়েছে পাশ্চাত্যে। ইসলাম গ্রহণের মাত্রা হাজার গুণ বেড়েছে। বিশেষত তারুণ্য ও মহিলারা সত্যের সন্ধানে উৎসুক হতে গিয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। একটি নেতিবাচক ঘটনা-দুর্ঘটনার আড়ালে অনেক শিক্ষা লুকিয়ে থাকে। যারা জ্ঞানী, ধীমান ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ তারা এভাবেই সঠিক পথ পেয়ে যায়।
একটা অকপট সত্যের স্বীকৃতি জরুরি। শাহবাগে কিংবা অন্যত্র ইসলামের প্রতি এতটা বিদ্বেষ না ছড়ালে হেফাজতে ইসলামীর উপস্থিতি তাৎপর্যহীন হতো। একটি প্রতিক্রিয়ার অনিবার্যতায় নতুন প্রজন্ম ইসলামকে গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে খতিয়ে দেখার দায় বোধ করল কিংবা উৎসাহিত হলো। আগেও উল্লেখ করেছি, আল্লাহ চাইলে শয়তানকে দিয়েও কাজ আদায় করে নিতে পারেন। নেতিবাচক কাজের মাধ্যমেও মিথ্যার বেসাতির বিপরীতে সত্যকে আড়াল থেকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের সবক’টি ঘটনাই যেন ঘটছে গায়েবী ইশারায়। আর গায়েবের সাহায্য চেয়েছেন আল্লামা শফী। মানুষ যা ভাবে বিধাতা ভাবেন ভিন্ন কিছু। জাতীয় কবি বলেছেনÑ আধমরাদের ঘা মেরে জাগিয়ে দিতে। মনের অজান্তেই আজ আধমরাদের জাগিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও সমাজনীতি বিশ্লেষণে সবাই যখন অক্ষম হয়ে পড়েছেন, তখন ব্যাখ্যাতীত কিংবা স্বব্যাখ্যাত ঘটনা-দুর্ঘটনাগুলোই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এর নাম গায়েবি সাহায্য কি না জানি না, তবে অনেক ঘটনাই ঘটছে যা প্রচলিত নিয়মে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এর সাথে লৌকিক নয়, অনেক অলৌকিক ধারণাই যুক্ত হচ্ছে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কবে কিভাবে আওয়ামী সরকার বিদায় নেবে-২


শফিক রেহমান

আওয়ামী লীগ সরকর ক্ষমতায় আসার পরে গত চার বছর চার মাসে যে পনেরটি বড় মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয় ঘটেছে তার মধ্যে বারোটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীÑমন্ত্রীÑপ্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টা-নেতাদের বিভিন্ন মাত্রায় সম্পৃক্তির অভিযোগ উঠেছে। এই বারোটি ঘটনার লিস্ট এর আগের লেখাটিতে দেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি ঘটনা হলো মুন্সিগঞ্জে লঞ্চডুবিতে ১১২ জনের মৃত্যু (১৪.৩.২০১০) ঢাকায় নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ড ১২৪ জনের মৃত্যু (৩.৬.২০১০) এবং নরসিংদিতে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২০ জনের মৃত্যু (১০.১২.২০১০)।
যে এক ডজন ঘটনায় আওয়ামী মন্ত্রীÑনেতারা সম্পৃক্ত ছিলেন তার মধ্যে সর্বশেষটি হচ্ছে ২৪ এপৃল ২০১৩-তে সকাল পৌনে নটায় সাভারে নয়তলা বিশিষ্ট রানা প্লাজা ধস। এই দুর্ঘটনায় এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ৩৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় ২,৪৩৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এবং এখনো অজানা সংখ্যক ব্যক্তি, ধ্বংসস্তুূপে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় আছেন। ইনডিয়ার ভূপাল, মধ্যপ্রদেশে, ইউনিয়ন কারবাইড ফ্যাকটরিতে গ্যাস লিকেজের ফলে ২ ডিসেম্বর ১৯৮৪ দিবাগত রাতে যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, এখন পর্যন্ত সেটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনডাস্টৃয়াল অ্যাকসিডেন্ট। এ মুহূর্তে ওয়ার্ল্ড মিডিয়া মনে করছে সাভার দুর্ঘটনা তার পরেই দ্বিতীয় স্থানটি অধিকার করবে। শেখ হাসিনার উৎসাহে সরকারের বহু ট্যাকটিকস সত্ত্বেও সুন্দরবনকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন অতি সহজেই বাংলাদেশ যে একটি বিশ্ব রেকর্ডের কাছাকাছি পৌছালো তার জন্য হাসিনা সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।
সাভার ট্র্যাজেডি একদিনে ঘটেনি। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার ৪১ দিন পরেই পিলখানায় বিডিআর-আর্মি ট্র্যাজেডি থেকে শুরু করে পরপর আরও দশটি ট্র্যাজিক ঘটনায় পূঞ্জিভূত আওয়ামী অযোগ্যতা, অদক্ষতা, স্বজন ও দলপ্রীতি এবং দুর্নীতি প্রভৃতির ফলেই বারো নাম্বার ট্র্যাজেডি অর্থাৎ সাভার দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
মূল্যবোধের অভাব
তাই সাভার ট্র্যাজেডিকে এককভাবে বিবেচনা করলে চলবে না। বুঝতে হবে আওয়ামী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মূল্যবোধের যে বিরাট অভাব রয়েছে, ন্যায় ও নীতির যে বিপুল ঘাটতি রয়েছে এবং সততার যে বিশাল শূন্যতা রয়েছে তারই পরিনামে সাভারে এত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, এত মানুষ পঙ্গু হয়েছে এবং এত মানুষ নিখোজ হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নৈতিক দেউলিয়াত্ব আওয়ামী সরকার ও দলের মধ্যে প্রতিটি পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। ফ্রম শেখ হাসিনা ভায়া ম. খা. আলমগীর টু মুরাদ জংÑসোহেল রানা। ফ্রম পিলখানা টু সাভার Ñ সব ঘটনাই এই একই অন্তর্নিহিত দেউলিয়াত্বের কদর্য মর্মান্তিক বিকাশ। তাই দৃঢ়ভাবে বলা চলে সাভার ট্র্যাজেডি অপরিকল্পিত হলেও ছিল অবধারিত, অভাবনীয় হলেও ছিল অবশ্যম্ভাবী।
সোজা কথায়, আওয়ামী সরকার ও দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সৃষ্ট ও চর্চিত নীতি হত্যার কালচার সর্বনি¤œ পর্যায় পর্যন্ত অবাধে গড়িয়ে গিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে মানুষ হত্যার কালচারে। আরও সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়, এই আওয়ামী সরকার, হত্যাকারী সরকার। বিবেচনা করুন, সাভার হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী নেত্রীÑনেতাদের সংশ্লিষ্টতার পরিমান। বিবেচনা করুন, এসব খল নায়িকাÑনায়করা ২৪ এপৃল ২০১৩-তে কি করেছিলেন।
২৪ এপৃল সকালে বিএনপি নেতা-কর্মীরা
বুধবার ১১ বৈশাখে ছিল নির্মেঘ আকাশ। সকাল থেকে রোদে ঝলসে যাচ্ছিল রাজধানী ঢাকা এবং প্রায় পনের মাইল দূরে সাভার শিল্প এলাকা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আহূত দুই দিন ব্যাপী ছত্রিশ ঘণ্টা হরতালের এটা ছিল দ্বিতীয় দিন। পথে প্রাইভেট কার, কোচ ও লরির সংখ্যা কম থাকলেও ছিল রিকশা, সিএনজি, কিছুৃ সরকারি ও বেসরকারি বাস। অধিকাংশ দোকানপাট ছিল বন্ধ। সরকারি অফিস ছিল খোলা। কিছু প্রাইভেট অফিসে ছিল সীমিত সংখ্যক স্টাফ। এই হরতাল শেষ হবার কথা ছিল বিকেল ছ’টায়। তারপর হতো নিয়ম মাফিক বিরোধী দলের প্রেস কনফারেন্স, সরকারি দলের দাবি “হরতাল অসফল” এবং আওয়ামী মিডিয়ার প্রচার “হরতাল ঢিলেঢালা।”
সেদিন সকালে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা এবং নেতা-কর্মীরা ভাবছিলেন ছত্রিশ ঘন্টার হরতাল শেষে কিভাবে তাদের আন্দোলন চলমান রাখা সম্ভব হবে? পরবর্তী সপ্তাহে আরও হরতাল? কোন যুক্তিতে? ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ কি সেসব যুক্তি বুঝবে? মেনে নেবে? এসব চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছিল বিএনপি নীতি নির্ধারকদের মনে।
২৪ এপৃল সকালে সোহেল রানা
সেদিন সকালে বিপরীত চিন্তাধারায় চলছিলেন সাভারের এমপি তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ ও তার স্নেহধন্য স্থানীয় যুব লীগ নেতা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা। তারা ভাবছিলেন সেদিনের হরতাল কিভাবে ব্যর্থ করা যায়। তাদের দুজনারই আরও একটি মিশন ছিল। তারা ভাবছিলেন কিভাবে সরকারের ইংগিতে কতিপয় এনজিও আহূত শনিবার ২৭ এপৃলে মতিঝিল ও প্রেস কাবের সামনে নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের সম্মেলনে সাভারের বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে নারী শ্রমিকদের নেওয়া যাবে। হেফাজতে ইসলামি-র তের দফা দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং হেফাজতে ইসলামি আহূত আসন্ন ৫ মে “ঢাকা অবরোধ” কর্মসূচির বিরুদ্ধে শক্তি দেখাতে সরকারের চাপে ঢাকায় নারী গার্মেন্টস কর্মীদের সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছিল, আওয়ামী সরকার গার্মেন্টস মালিকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার তাদের হুমকি দিয়েছে ২৭ এপৃল যদি নারী গার্মেন্টস কর্মীদের সম্মেলন বিশাল না হয় তাহলে হাতির ঝিলে বিজেএমইএ-র বিতর্কিত ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা হবে।
রানা প্লাজার মালিক সোহেল জানতেন আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার ২৩ এপৃলে ওই ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা গিয়েছিল। সেজন্য শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে চান নি। সোহেল রানা জানতেন ভবনের দোতলায় ব্র্যাক ব্যাংকের ব্রাঞ্চ অফিস মঙ্গলবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভবনে ফাটলের খবর পেয়ে মঙ্গলবারেই সাভার থানার ওসি আসাদুজ্জামান পুলিশের একটি দল নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। তারা ভবনের প্রতিটি ফোর পরীক্ষা করে সব ফোর খালি করে দেন। এতে সোহেল রানা ক্ষুব্ধ হন। ওসি আসাদুজ্জামান নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি সোহেল রানাকে নির্দেশ দেন উপযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ইনসপেকশনের আগে ভবনের ভেতরে যেন কেউ না ঢোকে।
এরপরে রানা প্লাজাতে আসেন ইউএনও। সোহেল রানা তাকে “ম্যানেজ” করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রানা প্লাজাতে এসে হাজির হন সোহেলের কয়েকজন বন্ধু। ওই ভবনে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষের লোকজনকে ডেকে আনেন সোহেল রানা। তিনি মালিকপক্ষকে বলেন, “ওরা ইঞ্জিনিয়ার। ভালোভাবে ভবন পরীক্ষা করেছে। একশ বছরেও ভবনের কিছু হবে না। কোনো ভাবেই গার্মেন্টস বন্ধ রাখা যাবে না। হরতালের দিন গার্মেন্টস বন্ধ রাখলে নেগেটিভ ইমপ্যাকট পড়বে। তাই গার্মেন্টস খোলা রাখতে হবে।” এই হুমকি দেয়ার সময়ে ইউএনও উপস্থিত ছিলেন। (মানবজমিন ২৮.০৪.২০১৩)
হুমকি যেন ফলপ্রসূ হয় সেটা নিশ্চিত করতে বুধবার ২৫ এপৃল সকালেই রানা গিয়েছিলেন তার ভবনে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন হরতাল বিরোধী মিছিলের জন্য একদল মাস্তান যারা আগের দিনেও গিয়েছিল। সকাল থেকে এদের সঙ্গে প্লাজার বেইসমেন্টে রানা মিটিং করছিলেন। ওই সময়ে ভবন ধস শুরু হয়। রানা সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু নয়তলা প্লাজার অন্যান্যরা রানার মতো লাকি ছিলেন না। বিকট শব্দে রানা প্লাজা পেছনের দিকে হেলে গিয়ে ধসে পড়ে পেছনের একটি বাড়ির ওপর। প্লাজার এক তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত একাকার হয়ে যায়। সাত, আট ও নির্মীয়মান নয় তলায় ধ্বংসযজ্ঞের পরিমান কম হয়। বিধ্বস্ত রানা প্লাজায় আহতদের চিৎকারে সঙ্গে যখন মিশে যেতে থাকে কংকৃটের ধূলাবালি তখন সোহেল রানা গিয়ে আশ্রয় নেন তার রাজনৈতিক মুরুব্বির কাছে।
২৪ এপৃল সকালে নতুন রাষ্ট্রপতি
সেদিন সকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে সদ্য প্রমোটেড স্পিকার আবদুল হামিদের মন ছিল দুঃখ ও আনন্দে মেশানা। দুঃখ ছিল এই কারণে যে তার ছোট ভাই আবদুর রাজ্জাক দুদিন আগে সোমবার ২২ এপৃলে পিজি হসপিটালে পরলোকগমন করেছিলেন। তার মরদেহ মর্গে ছিল এবং স্থির হয়েছিল বুধবার ২৫ এপৃলে মিঠাইমনের কামালপুরে গ্রামের বাড়িতে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার ২৪ এপৃল সকালে আবদুল হামিদের মনে অনেক আনন্দও ছিল। কারণ শেখ হাসিনার বান্ধবী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে হতাশ করে সেদিনই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি পদে বঙ্গভবনে তিনি শপথ নেবেন। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী রাজনৈতিক দলের নেতারা বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীরা, ডিপ্লম্যাটরা, সবাই আসবেন বঙ্গভবনে। শপথ গ্রহণের পর খানাপিনা হবে। সেই প্রস্তুতি সেখানে চলছিল। আবদুল হামিদ সেই খোজখবর নিচ্ছেলেন। তিনি একটি ধোপ দুরস্ত কালো বঙ্গবন্ধু কোট এবং পায়জামা-পাঞ্জাবি রেডি রেখেছিলেন। এ সবের পাশাপাশি আবদুল হামিদের স্টাফরা যোগাযোগ রাখছিলেন বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কারণ শপথ গ্রহণের পরদিন সকালে হেলিকপটারে নতুন রাষ্ট্রপতি প্রথমেই যাবেন টুঙ্গিপাড়াতে শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থলে তার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। তারপর তিনি যাবেন কিশোরগঞ্জ কামালপুরে তার ভাইয়ের জানাযায় অংশ নিতে। বুধবার ২৪ এপৃল সকালেই আবদুল হামিদ খবর পেয়েছিলেন সাভারে রানা প্লাজায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জ্ঞান যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ এবং তার নিজের নির্বাচনী এলাকা ও তার নিজ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেহেতু তিনি জানতেন না সাভারের চাইতে বিদেশে অনেক ছোট দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রপতিরা তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে গিয়েছেন অকুস্থলে। যেমন, অক্টোবর ২০১২-তে হারিকেন স্যান্ডি যখন নিউ ইয়র্কে আঘাত হানে তখন প্রেসিডেন্ট ওবামা তার নির্বাচনী ক্যামপেইন ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন উদ্ধার কাজে অংশ নিতে। যেমন এপৃল ২০১৩-তে বস্টন ম্যারাথন দৌড়ে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলার সংবাদে প্রেসিডেন্ট ওবামা ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। যেমন, ৫ আগস্ট ২০১০-এ কোপিআপো, উত্তর চিলিতে একটি খনি ধসে ২,৩০০ ফিট নিচে ৩৩ খনি শ্রমিক আটকে পড়লে প্রেসিডেন্ট পিনেরা বিদেশে সফর ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। ৬৯ দিন পরে আটক সবাইকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। যেমন, ৭ জুলাই ২০০৫Ñএ লন্ডনে পাতাল রেলপথের তিনটি অংশে সন্ত্রাসীদের বোমা বিষ্ফোরণে আটকে পড়েছিল শত শত অফিসযাত্রী। এই রেলপথগুলোর একটি অংশ ছিল ১০০ ফিট গভীরে। অকুস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন তদানীন্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী।
এই জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে বর্তমানে ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছেন তাদের জ্ঞান টুঙ্গিপাড়া ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ইতিহাসে সীমাবদ্ধ। তারা জানেন না লন্ডন, কোপিআপো, বস্টন, নিউ ইয়র্ক কোথায়? তারা জানেন না অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা দুর্যোগেÑদুর্ঘটনায় কি করেন। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান উৎসাহী এই দেশের নেতাদের চরম অজ্ঞতা ও নিষ্ঠুর অবহেলার শিকার হচ্ছে এই বাংলারই মানুষ এবং সেই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ।
২৪ এপৃল সকালে প্রধানমন্ত্রী
বুধবার ২৪ এপৃল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবছিলেন কোন পোশাকে তিনি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাবেন ঢাকাÑনারায়ণগঞ্জ রুটে নতুন ধরনের ডিজেল ইলেকটৃক মালটিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ট্রেন উদ্বোধন করতে। সাধারণত তিনি চেষ্টা করেন সময় এবং অনুষ্ঠানের সঙ্গে ম্যাচিং পোশাক পরতে। ১৯৯৬ Ñএর জুনÑজুলাইয়ে নির্বাচনের আগে তাকে দেখা যেত হিজাবÑতসবিহ ও ফুল সিøভ ব্লাউজ পরতে।
নির্বাচনে জয়ী হবার সেই পোশাকে তাকে আর দেখা যায়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে তাকে সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে দেখা গিয়েছে। সেদিন বুধবার সকালে তিনি বেছে নেন শাদা জমিনে সবুজ কাজ করা জামদানি শাড়ি যার আনুমানিক দাম হতে পারে বিশ হাজার টাকা। এর বিপরীতে পাঠকরা বিবেচনা করতে পারেন রানা প্লাজায় হতাহত নারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরনে কি ছিল। তাদের পরনে ছিল সবচেয়ে শস্তা প্রাইড অথবা জনি পৃন্টার্সের শাড়ি। সবচেয়ে শস্তা সালওয়ার কামিজ। এই বাংলাদেশে যারা ক্ষমতা ও সমাজের শীর্ষে আছেন, তাদের সঙ্গে শ্রমজীবনের সবচেয়ে নিচে যারা আছেন, তাদের মধ্যে তফাৎ কতো লাইট ইয়ার্স? এই পার্থক্য কতো ভালগার? কতো অসহ্য অশ্লীল?
এই ট্রেন উদ্বোধনের সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জনগণকে এই সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে।… বিরোধী দলের আন্দোলন মানেই মানুষ হত্যা। এরা পাকিস্তানিদের মতো মানুষ হত্যা করছে। ইট দিয়ে মাথা থেতলে মানুষ হত্যা করছে। কি জঘন্য তাদের মনোবৃত্তি! … হরতাল ডাকছেন। এটা আপনাদের অধিকার। কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায় Ñ তাদের কি সুবিধা হচ্ছে? উৎপাদিত পণ্য তো বাজারজাত হচ্ছে না।… এরা হরতাল ডেকে এয়ারকনডিশন্ড ঘরে মুরগির ঠ্যাং চিবান আর সিনেমা দেখেন।” (আমাদের অর্থনীতি ২৫.৪.২০১৩)
এসব মন্তব্যের সময়ে শেখ হাসিনা ভুলে যান ১৯৯৬-এ বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালে চট্টগ্রামে নতুন নির্মিত গোটা রেলস্টেশনই পুড়িয়ে দিয়েছিল আওয়ামী হরতালকারীরা। কেন? তারা তখন আসন্ন নির্বাচনের আগে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করছিলেন। শেখ হাসিনা এখন ভুলে গিয়েছেন কেন সেই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি আন্দোলনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করছিল। শেখ হাসিনা হয়তো ভুলে গিয়েছেন চট্টগ্রামে যখন রেলওয়ে স্টেশন পুড়ছিল তখন তিনি কি খাচ্ছিলেন? গরু, খাসি অথবা মুরগির ঠ্যাং?
প্রধানমন্ত্রী জঘন্য ভাষার সিনড্রোমে ভুগছেন? একই সঙ্গে দুর্বল স্মৃতিশক্তির সিনড্রোমেও ভুগছেন। এই ধরণের ভাষা নিয়তই যার মুখ নি:সৃত হয় তিনি কোনো সম্মানিত ব্যক্তি হতে পারেন না। তিনি মাননীয় হতে পারেন না।
কমলাপুর স্টেশনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে খবর পান সাভার দুর্ঘটনার। কিন্তু তিনি সেখানে যাননি।
দুপুরে প্রধানমন্ত্রী যান সংসদ অধিবেশনে। ইতিমধ্যে সাভার দুর্ঘটনার আরও কিছু খবর তার কাছে পৌছায়। শেখ হাসিনা বলেন, “এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। তাই সরকারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার ২৫ এপৃলে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হচ্ছে।… উদ্ধার কাজে দুই একদিন লাগবে।… হরতালের কারণে অনেক ক্ষতি হওয়ায় ছুটি হওয়ায় ছুটি দেয়া হবে না। কিন্তু সব জায়গায় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।… হরতালের কারণে উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত ঘটছিল। কিন্তু বিরোধী দল হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক সুবিধা হচ্ছে। তাই বিরোধী দলকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”
ওদের স্থান মাটির নিচে
শেখ হাসিনা সম্ভবত এই প্রথম বিরোধী দলের প্রতি সৌজন্যসূচক কিছু বললেন। কেন? আসলে তিনি বিরোধী দলের হরতাল ডাকার প্রতি কটাক্ষ করতে চেয়েছিলেন। সত্যটা হচ্ছে এই যে, সেদিন হরতালের ফলে সকালে ট্রাফিক চলাচল কম ছিল এবং সেজন্য ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত সাভারে পৌছাতে পেরেছিলেন। হরতালের কারণে প্লাজার শপিং মলে কিছু দোকান বন্ধ থাকায় হতাহতের সংখ্যা কিছু কম হয়েছে।
তবে জাতীয় শোক দিবস ঘোষনায় দুপুরের মধ্যে সাভারে সমবেত উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। আর শোকের দিনে ছুটি না দেয়ার প্রসঙ্গে সবারই মনে পড়ে যায় আওয়ামী সরকারের আমলে প্রতি বছরের পনেরই আগস্টে শোক দিবস পালিত হয এবং ছুটিও দেয়া হয়।
বাংলাদেশে শুধু একজনের মৃত্যুর কাস উচুতে এবং সংরক্ষিত। সেই মৃত্যু নিয়ে চলে শোকের মাস এবং আওয়ামী মাতম। অন্য কোনো ঘটনায় এক দিনে এক হাজার মানুষের মৃত্যুর কাস একেবারেই আলাদা। তাই সাভারে মৃত্যুর কাস আলাদা এবং সবচেয়ে নিচে। ওরা জনগণ (শেখ হাসিনারই অতি ব্যবহৃত শব্দ)। ওদের স্থান মাটিতে এবং এখন ওদের স্থান মাটির নিচে।
সেদিন সংসদে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “রানা প্লাজা ধসে পড়ার বিশ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ শুরু করে। বিশ্বের ইতিহাসে এত দ্রুত কেউ উদ্ধার কাজ করেছে কিনা, তা বলতে পারবে না।”
বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বিলম্বিত
সরি। বিশ্বের ইতিহাসে এর চাইতে অনেক দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে এবং জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় মানুষ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত মানুষের পঙ্গুত্বকে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বৃটেন, চিলি ও আমেরিকার যে চারটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী পড়ে দেখতে পারেন।
বস্তুত সাভার দুর্ঘটনায় অদক্ষভাবে যে উদ্ধার কাজ পরিচালিত হয়েছে সেটা বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বিলম্বিত রূপে পরিগণিত হবে। এই বিলম্বের ফলে এবং উদ্ধারকাজে আওয়ামী সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে অসংখ্য হতভাগ্য এখন পর্যন্ত নিখোজ রয়েছেন।
বিদেশি সাহায্য নেয়নি
আওয়ামী সরকারের এই হঠকারিতা আজকের লন্ডনের দৈনিক পত্রিকা দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত হয়েছে। পড়–ন :
গত বুধবারে রানা প্লাজা ধসে ইট সিমেন্ট সুরকির একটি বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে মারা গেছে ৩৭০ জনেও বেশি। স্থানীয় উদ্ধারকারী দলগুলোর কাছে উপযুক্ত সরঞ্জাম ছিল না। তারা কোনোক্রমে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে মানুষ বের করার চেষ্টা করছিল।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিদেশিরা অভিজ্ঞ উদ্ধারকারীর দল পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। এর ফলে হয়তো অনেক মাুনষের প্রাণ বাচতো। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ যেসব ডকুমেন্ট দেখেছে তাতে বোঝা যায়, বিদেশিদের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা আশংকা করেছিলেন বিদেশি সাহায্য নিলে জাতীয় গর্ব ক্ষুন্ন হবে। এসব ডকুমেন্ট জানিয়েছে, বিদেশিরা তাদের সাহায্য নিতে বারবার অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের। এমনকি বিদেশিরা এটাও বলেছিলেন, বিষয়টিতে বাংলাদেশ সরকারের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে তারা নিজেদের উপস্থিতি লো প্রোফাইলে (যথাসাধ্য কম দেখিয়ে) রাখবেন।
যখন জাতিসংঘের কর্মচারিরা বোঝেন যে ধ্বংস্তূপের নিচে বহু মানুষ চাপা পড়েছে তখন তারা পশ্চিমি ডিপ্লম্যাটদের নিয়ে মিটিং করেন। তারা বিবেচনা করেন এত বড় দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামর্থ আছে কিনা। তারা সবাই একমত হন যে সেই সামর্থ নেই। তখন তারা বৃটেনসহ বহু দেশের সরকারের কাছে আবেদন করেন, তারা যেন উদ্ধারকারীদের এবং হেভি লিফটিং ইকুইপমেন্ট (ভার উত্তোলনের ভারি যন্ত্র) পাঠান।
জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বলেন, বৃটেনসহ আন্তর্জাতিক কমিউনিটি ধ্বংসস্তূপে তল্লাশী এবং উদ্ধারকাজে সাপোর্ট দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়।
পরিবর্তে উদ্ধারকাজে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভর করা হয়। যাদের কোনো প্রটেকটিভ কোদিং (নিরাপত্তামূলক বুট, পোশাক ও হেলমেট) ছিল না। তাদের পায়ে ছিল প্লাস্টিক স্যানডাল! এক শ্রমিককে বাচানোর জন্য তার হাত কেটে যখন ফেলতে হয় তখন সেটা উপস্থিত কোনো ডাক্তার করেননি। বরং হাত কাটতে ডাক্তাররা নির্দেশ দেন অন্য আরেক শ্রমিককে!
আগেভাগেই উদ্ধারকাজ শেষ করার চেষ্টা সরকার করেছে এমন সমালোচনা এসেছে সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারি কর্মচারিরা বলেছিলেন ৭২ ঘন্টার বেশি কেউ বাচবে না। এই বলে তারা হেভি যন্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু উপস্থিত আত্মীয় স্বজনদের তীব্র ক্ষোভের মুখে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। তারপর যখন আরও মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয় তখন জনতা তাদের দাবি আরও জোরালো করে। তারা বলে আরও মানুষকে জীবিত পাওয়া যাবে।
বৃটিশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)-এর জনৈক মুখপাত্র স্বীকার করেছেন, তারা যে “স্পেশালিস্ট টেকনিকাল এডভাইস” দিতে চেয়েছিলেন সেটা বাংলাদেশ সরকার নাকচ করে দিয়েছে।”
এই হলো দি ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্ট।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিসের জন্য গর্ব করেন?
নিজেদের বংশ মর্যাদা? সেটা কি খুব বেশি? দুই পুরুষ পিছনে তাকিয়ে দেখুন। উত্তরটা পাবেন।
আভিজাত্য? নিজেদের ভাষা ও চালচলন প্রকৃত অভিজাতদের সঙ্গে তুলনা করুন। উত্তরটা পাবেন।
শিক্ষা? বাজারে কেনা অনারারি ডক্টরেট এবং খালখননের ডক্টরেটের বিপরীতে বিবেচনা করুন ড. ইউনূসের ডক্টরেট। উত্তরটা পাবেন।
জ্ঞান? আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং চিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পিনেরা-র সঙ্গে তুলনা করুন। উত্তরটা পাবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে এই অজ্ঞ, অপদার্থ এবং অহমিকাপূর্ণ শাসকদের গর্ব নয়, ফুটানি-র জন্য রানা প্লাজায় কতো মানুষ মারা গেল?
হয়তো এত মানুষ মারা যেত না। যদি সেই সকালে রানা প্লাজায় একটি বিশেষ পরিবারের কোনো সদস্য চাপা পড়তেন।
১৯ জুলাই ৬৪ খৃষ্টাব্দে গোটা রোম শহরে আগুন লেগেছিল। ছয় দিন জুড়ে সেই আগুনে রোম পুড়েছিল। কথিত আছে সেই সময়ে রোমের অত্যাচারী সম্রাট নিরো মঞ্চনাটকের পোশাক পরে গান গেয়েছিলেন এং বাশি বাজিয়ে ছিলেন। অন্য একটি সূত্রের মতে নিরো এক ধরনের হার্প লায়ার বাজিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে সাভারে রানা প্লাজা যখন ধ্বংসস্তুূপে পরিণত হচ্ছিল তখন শাসক কোথায় ছিলেন তা জানানো হয়েছে।

রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সাভার ট্র্যাজেডি নানা প্রশ্ন


গত ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাংলাদেশে নেমে এলো এক ট্র্যাজেডি। এ ট্র্যাজেডির নাম সাভার ট্র্যাজেডি। মানুষের লোভ আর অবহেলা জন্ম দিলো এ ট্র্যাজেডির। সাভারের রানা প্লাজার ৯তলা ভবন ধসে পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। এর ফলে এই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক তৈরির কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়েন। বুধবার সকালে ধসে যায় এ ভবন। এর ঠিক চার দিন পর রোববার সকালে এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত ধসে যাওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হয় ৩৬২ জনের লাশ। আর বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরী থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আড়াই হাজারের মতো মানুষকে। উদ্ধারকারীরা বলছেন, এখনো সেখানে আরো অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। নানা জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করা যায়নি। তবে তারা বলছেন, জীবিত একটি মানুষের সম্ভাবনা থাকা পর্যন্ত তাদের উদ্ধারকাজ চলবে। এখনো অনেক লাশ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এমনভাবে চাপা পড়ে আছে যাদেরকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। পুরো ভবনটি ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে না ভেঙে সেসব লাশ উদ্ধারের সম্ভাবনা কম। ধারণা করা হচ্ছে, এখনো কয়েক শ’ লাশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি  লোকের সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে এক তথ্যে জানানো হয়েছে। অনুমান করা যায়, নিখোঁজ লোকগুলোর বেশির ভাগই এরই মধ্যে পচাগলা লাশে পরিণত হয়েছে। কিছুসংখ্যক মানুষ এখনো আধমরা হয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকতে পারেন।

অনেকে বলছেন এটি একটি দুর্ঘটনা। কেউ বলছেন ট্র্যাজেডি। কেউ বলছেন মহাবিপর্যয়। কেউ বলছেন এ এক মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। আবার কেউ বলছেন এটি রীতিমতো এক হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা। এই হত্যাকাণ্ডের, গণহত্যার জন্য দায়ীদের ফাঁসি দাবি করে তৈরী পোশাক শিল্পের সাধারণ শ্রমিকদের ও বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভও আমরা চলতে দেখেছি। চলেছে সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুরসহ নানামাত্রিক সহিংসতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ট্র্যাজেডি-গণহত্যার জন্য দায়ী কে?
এ পর্যন্ত জানা তথ্যানুযায়ী সাভারের রানা প্লাজা নামের এই ভবনটিতে বিপণি কেন্দ্র, ব্যাংক ও অন্তত পাঁচটি পোশাক তৈরির কারখানা ছিল। সকালে এ ভবনটি ধসে পড়ার সময় এ ভবনের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই খোলা ছিল। পুরোদমে কাজ চলছিল পোশাক কারখানাগুলোতে। আর এই ট্র্যাজেডির সবচেয়ে বড় শিকার এসব পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না, সে ব্যাপারে কোনো বিতর্কের আকাশ নেই। কারণ আগের দিনের একাধিক পত্রপত্রিকায় আমরা খবর প্রকাশ হতে দেখেছি, এই ভবনের ফাটল ধরার কথা জানিয়ে। বলা হয়েছিল, ফাটল ধরায় এই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিএমইএসংশ্লিষ্ট সবাইকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়েছিল। ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভবনটি আগের দিন পরিদর্শনও করেন। সর্বোপরি বিজিএমইএ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশও দেয়া হয়েছিল। এ-ও বলা হয়েছিল, বুয়েটের প্রকৌশলীরা পরীক্ষা করে বলবেন এই ভবনটি চালু রাখা যাবে কি যাবে না। পোশাক কারখানার শ্রমিকেরাও বারবার মালিককে তাগাদা দিয়েছিল কারখানা বন্ধ রাখার জন্য। এই অবস্থায় আগের দিন মঙ্গলবার থেকে এই ভবনে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের শাখাটি বন্ধ রাখা হয়। ভবনটি ধসে যাওয়ার চরম ঝুঁকিতে থাকলে ভবনমালিক ও পোশাক কারখানার মালিকেরা এক হয়ে শ্রমিকদের মারধর করে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এমনও বলা হয় বুধবারে যারা কাজে আসবে না, তাদের বেতন দেয়া হবে না। যারা কাজে আসবে তাদের বেতন দেয়া হবে। স্থানীয়দেরও অভিযোগ, পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হওয়ার সুবাদে সোহেল রানা অনেকটা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি চালু রাখেন। ঘটনার দিনও শ্রমিকদের জোর করে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করায়ও তার ভূমিকা ছিল। পোশাক কারখানার মালিকেরা বলছেন, সোহেল রানার চাপাচাপিতে এরা কারখানা খোলা রাখতে বাধ্য হয়েছেন। অতএব এ গণহত্যার দায় সোহেল রানা কিছুতেই এড়াতে পারেন না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঘটনার সময় তিনিও এই ভবন এলাকায়ই ছিলেন। পরে স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি মুরাদ জং তাকে এখান থেকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। সরকারদলীয় লোকজন ও প্রধানমন্ত্রী নিজে সোহেল রানাকে বাঁচানোর জন্য নানা ধরনের হাস্যকর মন্তব্য উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। গোটা সাভারবাসী যেখানে বলছেন সোহেল রানা সাভার পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক, সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেনÑ সোহেল রানা আওয়ামী লীগের কেউ নন। এর পরপরই আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা টকশো ও গণমাধ্যমের কাছে একই ধরনের মন্তব্য করতে থাকেন। কিন্তু পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন পোস্টার ছাপিয়ে ও সোহেল রানার কপালে মুরাদ জংয়ের চুমোর দৃশ্য ছাপিয়ে সুস্পষ্ট করে দেয়া হয় সোহেল রানা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন ও সাভার পৌর আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। সোহেল রানাকে বাঁচানোর আরেক ব্যর্থ প্রয়াস দেশবাসী দেখল স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। তিনি আবিষ্কার করলেন খাম্বাতত্ত্ব। বললেন, হরতাল সমর্থকের খাম্বা ধরে নাড়াচাড়া করা হতে পারে এই ভবন ধসের একটি সম্ভাব্য কারণ।
কে এই সোহেল রানা? একদম নিঃস্ব অবস্থা থেকে সোহেল রানা এখন কোটিপতি। তার এই কোটিপতি হওয়ার পেছনে রয়েছে অপরের জমি দখল, খুন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়সহ চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। জানা গেছে, জনৈক রবীন্দ্রনাথ সরকারের জায়গা দখল করেই রানা প্লাজা ভবনটি নির্মাণ করেন সোহেল রানা। রবীন্দ্রনাথ সরকার দৈনিক কণ্ঠকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন; ‘ওরা যখন আমার জায়গা দখল করে তখন আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। আর তা করতে গিয়ে আমাকে সাভারছাড়া হতে হয়েছিল। সাত মাস সাভারে আসতে পারিনি। ঢাকায় হোটেলে ও আত্মীয়ের বাসায় থাকতে হয়েছে। লোক ধরাধরি করে সাভার ফিরতে হয়েছে। এসব নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাই না। সত্য কথা বললে এবার ওরা আমাকে পৃথিবীছাড়া করবে।’ সাভারের মানুষ তাকে চেনেন এমপি তৌহিদ জং মুরাদের ডান হাত বলে। কখনো নিজের নামে, কখনো এমপি মুরাদ জংয়ের নামে অবলীলায় চলে এসেছে তার যাবতীয় অপরাধ কর্মকাণ্ড। রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর তার চাঞ্চল্যকর নানা অপরাধ কাহিনী এখন সাভারবাসীর মুখে মুখে। আর গণমাধ্যমের সুবাদে তা এখন জানতে পারছে সারা দেশের মানুষ। এক সময় সাভার থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আজকের সাভার পৌর আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানার পাপের ভার বোধ হয় সইতে পারল না রানা প্লাজা। এখন প্রশ্নÑ সোহেল রানার বিচার কি শেষ পর্যন্ত হবে? বিচার কি হবে সেইসব পোশাক কারখানার মালিকের, যারা জোর করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন? ভবিষ্যতেও ঘটবে এমনই নতুন কোনো ট্র্যাজেডি?
এসব প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। এ ধরনের ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার হয় না, গত ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার পরও এর জন্য দায়ী কারো শাস্তি হয়নি। কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেন কিছু দিন পলাতক থাকার পর এখন প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০০৫ সালের সাভারের বাইপাইলে স্পেকট্রাম ভবন ধসে পড়ে মারা যান ৬৪ জন শ্রমিক। এ ঘটনায় দায়ী কারো বিচার হয়নি। এসব ঘটনায় যারা দায়ী তারা বিজিএমইএর সদস্য হলে তাদের বাঁচানোর জন্য এই অ্যাসোসিয়েশনও একটি বাধা, এমন অভিযোগ আছে। যেমন, অভিযোগ আছে তাজরীন ফ্যাশনের মালিককে বাঁচাতে তৎপর ছিল বিজিএমইএ। এর বিপরীত চিত্রটিও রয়েছে, গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে স্মার্ট ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে মারা যান সাতজন শ্রমিক। ওই প্রতিষ্ঠানের দুই মালিক শরিফ আহমেদ ও জাকির হোসেন এখনো কারাগারে রয়েছেন। সমালোচনা এসেছে এই প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএর সদস্য নয় বলে এর মালিকদের আজ কারাগারে থাকতে হচ্ছে। সদস্য হলে তাদের পাশে দাঁড়াত বিজিএমইএ।
রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি থেকে আরেকটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভবনটি ধসে পড়ার চার দিন পরও যখন উদ্ধারকারীদের মধ্য থেকে আমাদের জানানো হচ্ছিল, তারা বিভিন্ন কক্ষে আটকা পড়া জীবিত লোকদের সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু উপযুক্ত সরঞ্জামের অভাবে তারা সেখানে পৌঁছতে পারছেন না। সামান্য ৯তলা ভবন ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধারকাজ পঞ্চম দিনেও সম্পন্ন করতে পারিনি। ফলে যাদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব ছিল, তাদেরকে আমরা কার্যত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলাম। এ আমাদের জন্য বড় মাপের এক জাতীয় অসহায়ত্ব। আমরা যখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি উদ্ধার তৎপরতা দেখছিলাম, তখন উদ্ধারকারীদের বলতে শুনেছি ছোটখাটো যন্ত্রপাতিও পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের মতো ছোট আকারের অক্সিজেন চেম্বারের অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীর। ফলে অনভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণহীন সাধারণ মানুষকে শুধু সাহসের ওপর ভর করে উদ্ধারকাজে নামতে হয়েছে সেনাবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড, র‌্যাব, পুলিশবাহিনীর সদস্যদের সাথে। অনেকেই আজ বলছেন, বেসামরিক সাধারণ উদ্ধারকারীদের সাহসী উদ্ধার তৎপরতার ফলে অনেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন। এরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে অনেককে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উদ্ধার করে এনেছেন। দেশবাসীর কাছে মনে হয়েছে, এরাই প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাতীয় বীর। জাতীয়ভাবে তাদের স্বীকৃতি জানানো উচিত। এদের অনেকের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা আজ গণমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন সাধারণ উদ্ধারকারীর কথা জানি, যিনি প্রথম দিকেই ধসে যাওয়া ভবনটি ওপরের দিকে উঠে বিপন্ন মানুষদের উদ্ধারের জন্য ভাঙা ভবনের অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকতে থাকেন। এক সময় তিনি নিজেও
ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েন। ৫১ ঘণ্টা
পর তিনি অন্য উদ্ধারকারীদের সহায়তায়
উদ্ধার পান।
চতুর্থ দিনে আমরা শুনলাম, অনেকে আটকা পড়া অবস্থায় কয়েক দিন থাকার পর পাগলের মতো আচরণ করছেন। এরা উদ্ধারকারীদের দেখলে ভয় পাচ্ছেন, কেউ একে অন্যকে জাপটে ধরছেন, কেউ উদ্ধারকারীদের শরীরে কামড় দিচ্ছেন। ফলে কোনো উদ্ধারকারী একা আর তাদের কাছে যেতে পারছেন না। এ এক দুঃসহ মানবিক বিপর্যয়। অথচ আমরা যদি দ্রুত এদের উদ্ধার করতে পারতাম, তবে এমনটি হতো না। হাসপাতালে থাকা একজনকে দেখলাম, তিনিও পাগলের মতো আচরণ করছেন। হারিয়ে ফেলেছেন মানসিক ভারসাম্য। প্রয়োজন ছিল এদের দ্রুত উদ্ধার করা। প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলে, প্রশিক্ষিত পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী দল থাকলে তা সম্ভব ছিল, কিন্তু আমাদের যে সেসব নেই তার প্রমাণ মিলল এই সাভার ট্র্যাজেডিতে। আমরা বলতে কেউ-ই কম যাই না। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলি, শত শত কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র কিনি, কিন্তু একটা ধসে পড়া ভবন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েক শ’ মানুষ উদ্ধার করার যন্ত্রপাতি কিনি না। এর চেয়ে বড় প্রহসন জাতির কাছে আর কী হতে পারে? এসব ব্যর্থতা ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস ঢাকতে টকশোতে জনৈক এমপিকে বলতে শুনি, জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলে ৯তলা ভবনে পৌঁছে আগুন নেভানোর মতো মই কেনা হয়েছে।
শুনেছি, বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। এ ব্যাপারে দেশবাসীর কোনো আগ্রহ নেই। হয় এসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে না, নয়তো তা হবে দায়সারা গোছের কিছু; যা কারো জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না। মানুষ চায় যারা আজ পঙ্গু, যারা আজ স্বজনহারা তাদের আজীবন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসা দেয়া। আর দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা। সরকারকে এটুকুই নিশ্চিত করতে হবে। জানি না, সরকার তা করবে কি না, সেটাও অভিজ্ঞতার আলোকে আজ এক বড় প্রশ্ন।
এসব নানা প্রশ্নের মধ্যেও আমরা দেখতে পেয়েছি এক ইতিবাচক বাংলাদেশকে। বিপর্যয় মোকাবেলায় আমরা যেসব বিভেদ-বিভাজন ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, বিপর্যয় ঠেকাতে পারি, বিপর্যয় মোকাবেলায় নিজেদের মধ্যে এক ইতিবাচক সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে পারি, তার এক বড় উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে এই সাভার বিপর্যয় উত্তরণের মধ্যে। আমরা যদি অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে এই ইতিবাচকতাকে সক্রিয় রাখতে পারতাম, তবে আমাদের এগিয়ে চলা ঠেকায় কে? আর অগ্রগতিই বা কেন থমকে দাঁড়াবে? কেন জমবে সমস্যার পাহাড়?
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মন্ত্রীর ঝাঁকিতত্ত্ব এবং সাভার বিপর্যয়ের বিষয়-আসয়



শিল্পী সুলতানের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের মানুষ হবে অমিত শক্তিধর, একদিন। তাই তার প্রতিটি চিত্রেই দেখা যায় মানুষগুলো পেশিবহুল, বলশালী, কি পুরুষ কি মহিলা। শত শিল্পকর্মের মাঝখানেও সুলতানের চিত্র শনাক্ত করতে অসুবিধা হয় না। সম্প্রতি শিল্পীর স্বপ্নের মানুষগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে ঢাকার সাভারে। আবিষ্কারক আর কেউ নন, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মখা আলমগীর। কতকজন মৌলবাদী এবং হরতাল সমর্থক লোক নাকি সাভারের রানা প্লাজা নামক আটতলা দালানটি ঝাঁকি দিয়ে ধসিয়ে দিয়েছে। চমৎকার আবিষ্কার। শিল্পী সুলতান জীবিত থাকলে হয়তো মখাকে জড়িয়ে ধরতো তার স্বপ্নের মানবগুলোকে চিহ্নিত করার বাহাদুর মনে করে। আধুনিক বিশ্বে যেখানে এমন বিশাল দালান ধ্বংস করতে প্রয়োজন হয় ডিনামাইট বা আধুনিক প্রযুক্তির, সেখানে কয়েকজন মৌলবাদীই যথেষ্ট। এমন সংবাদ বিদেশীদের প্রলুব্ধ করাটাই স্বাভাবিক। এই অপরিমেয় শক্তির মানুষগুলো তারা ধার চাইতেও পারে। এতে করে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি নতুন দরজা খুলে যাবে হয়তো। তাছাড়া আবিষ্কারক হিসাবে ম খা আলমগীরের নামটি গ্রিনিজবুকে স্থান করে নেয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। নব আবিষ্কৃত তত্ত্বটি ‘ঝাঁকিতত্ত্ব’ রূপেই বিবেচিত হবে ভবিষ্যৎ মানবকুলের তত্ত্ব-তালাশিতে। যদিও দেশের জনগণ বলছেন এটি একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের প্রলাপ বৈ কিছু নয়। এমন ‘উন্মাদ’ লোক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকতে পারে না। তার অপসারণ জরুরী। অবশ্য তাকে যারা এই পদে নিয়োগ দিয়েছেন সেটি তাদের বিবেচনার বিষয়। তবে প্রবাদ আছে রতনে রতন চেনে।
খ. যে দিনটিতে সাভারের রানা প্লাজার উপর কিয়ামত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিনটি ছিল পঁচিশ এপ্রিল। মুহূর্তে থেমে গেল শত শত ফুঁসফুঁস। হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়লো মরণকূপে। চিৎকার আর বাঁচার আহাজারিতে বাতাস ভারি হলো সে এলাকার। এই হত্যার জন্য দায়ী কে বা কারা ইতোমধ্যে দেশবাসী জেনে গেছে। এই জানা পর্যন্তই বুঝি শেষ। নানা কায়দা কৌশলে হত্যাকারীদের মুক্তি মিলবে।
অপরাধ চাপা দেয়ার প্রধান এবং প্রথম বিবেচনার নাম তদন্ত কমিটি। যে কমিটির সুপারিশ বা তদন্তের মর্ম কোনদিন আলোর মুখ দেখে না। কোনদিন দেখলেও তা হয় প্রশ্নবিদ্ধ। মূল অপরাধী থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে, প্রায়শই। যদি সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ শাসক দলের আশ্রয় বা প্রশ্রয়ভুক্ত হয় তখন তার জন্য সাত খুন মাফ। বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা এখন জামিনে অর্থাৎ কাহিনী খতম। পরাগ অপহরণকারীর মূল ব্যক্তি চার্জশিটের বাইরে। কারণ দলের আশীর্বাদপুষ্ট। সাভারের রানা প্লাজার মালিক রানাও সেই রকমেরই এক শক্তিধর ব্যক্তি। তাই হম্বিতম্বি যে যাই শোনাক না কেন আখেরে সব পরিষ্কার। তাছাড়া এই রানার মুরুব্বী স্থানীয় সরকারি দলের এমপি মুরাদ জং। যদিও তিনি জোরের সাথে এই খবর অস্বীকার করেছেন। তবে তার সাথে রানার সখ্যের চিত্র পত্রিকাগুলো ছেপে দিয়েছে। রানার কপালে সোহাগের চুম্বন দিচ্ছেন এমপি সাহেব। পত্রিকাগুলো কাহিনী ছেপেছে তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ের। এই প্রশ্রয়ই সামান্য কলু থেকে শত কোটি টাকার মালিক রানা। পত্রিকার হেডিং  এসেছে এমপি সাহেব রানাকে কোথায় নিয়ে গেলেন। রানাও আটকা পড়েছিল, উদ্ধারের পরপরই সে লাপাত্তা। এভাবেই পার পেয়ে গেছে অনেক সোহেল রানা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। এই তো কদিন আগে তাজরীন গার্মেন্টসে আগুনে মারা গেল দুশ’র মতো মানুষ। সে জন্য দায়ী ছিল ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ। তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এরপরও তাজরীনের মালিককে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এমনটাই ঘটছে হামেশা। বিজিএমইএ বক্তৃতা-ভাষণ এবং আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস বা ব্যবস্থা করেই খালাস। বিপর্যয় রোধ করতে চাইলে প্রয়োজন সুষ্ঠু তদারকী এবং অপরাধীর যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা। পঁচিশ এপ্রিল আরো একটি কারণে স্মরণীয়। সে দিনটিতে বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট এডভোকেট আবদুল হামিদ শপথ গ্রহণ করছিলেন। একদিকে আনন্দ উচ্ছ্বাস অন্যদিকে বিপর্যয়, হাজারো মানুষের বাঁচার আকুতি। এই শপথ অনুষ্ঠানটি আপাত স্থগিত করলে জনস্বস্তিতে তেমন কোন ব্যাঘাত ঘটতো বলে মনে হয় না। শত শত মানুষের মৃত্যু এবং হাজারো মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এমন অনুষ্ঠান কোনভাবেই বিবেচনাপ্রসূত হয়েছে কি না তা ভবিষ্যতই চিহ্নিত করবে। নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন এখন থেকে তিনি আর কোন দলের লোক নন। তিনি দেশবাসীর সবার। কিন্তু তিনি যখন হাতাকাটা কালো কোট পরে শপথবাক্য পাঠ করছিলেন তখনই প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল তিনি ‘কাহাদের’ ‘লোক’। নতুন প্রেসিডেন্ট উড়ে গেলেন মালা হাতে টুঙ্গিপাড়ায়। পেছনে রেখে গেলেন শত শত লাশ, তাদের স্বজনদের আহাজারি, দুঃখ-বেদনা আর কান্নার বিশাল সাগর। সাভারে না এসে টুঙ্গিপাড়া যাওয়াটা কি এতটাই জরুরি ছিল। এইসব বিপর্যস্ত মানুষজন গরীব-শ্রমিক শ্রেণীর, এটাই কি তাদের অপরাধ? নাস্তিক ব্লগার রাজিবের আকস্মিক দুর্ঘটনায় উড়ে এসেছিল প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সমবেদনা জানাতে, রাজিবের স্বজনদের কাছে। সাভারের বিধ্বস্ত মানুষগুলো কি সমবেদনা পাবারও যোগ্য নয় দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। হয়তো একেই বলে রাজনীতির জিলিপি। একে বলে জনগণের দুর্ভাগ্য।
(গ) বুদ্ধির জাহাজ যারা নিজেদের ভাবেন বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে, যারা দেশের কোণাকামছায় মৌলবাদী আর সাম্প্রদায়িক শক্তি খুঁজে বেড়ান, তারা বর্তমানে কোথায়। এমন প্রশ্ন দেশবাসীর। সাভারে এত লাশ এত কান্না কিন্তু এমন দৃশ্যে এরা কুলুপ এঁটেছে ঠোঁটে। এখানে রাজনীতি থাকলেও তা বিপরীতে যেতে পারে। অর্থের খবরাখবর শূন্য ডিগ্রিতে। তাই স্বঘোষিত বুদ্ধিবিক্রেতারা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায় নয়, ঘরে। কথিত নারী বুদ্ধিজীবীরাও নিরাবেগ। যদিও সাভারের অসহায় মানুষের অধিকাংশই নারী। তাছাড়া সড়কে শুধু শুধু অসহায় দাঁড়িয়ে থেকে কি ফায়দা, রাজনীতিও যেমন জমবে না পাশাপাশি অর্থকড়ির বিষয়টিও ঝুটঝামেলায় নিপতিত। তাই নীরব থাকাই বেহতের। প্রশ্ন উঠেছে শাহবাগী এবং তাদের সাথে যে সব চিহ্নিত ব্যক্তি সংহতি জানাতে আসতো দেশবাসির বিভেদ-বিভাজনের ক্ষতটিকে প্রশস্ত করতে, অহরাত্রি কুসল্লায় মশগুল থাকতো নানান কিসিমের সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে, তারা কোথায়? মানুষের কান্না-আহাজারী বিপদগ্রস্ত মানুষের হৃদয়ভরা বেদনা প্রশমিত করার ব্যাপারে শাহবাগীদের উপস্থিতি তো অনুবীক্ষণীকও নাই সাভারে। শাহবাগী এবং তাদের নেপথ্য শক্তি তাহলে এরা কারা! তারাযে বেগানা কোন শক্তির বরকন্দদাজ এই সত্যটি আবার নতুনভাবে প্রকাশিত হলো। বিপদগ্রস্ত মানুষের বেদনা এদেরকে স্পর্শ করে না। কারণ এরা নিয়োজিত দেশ এবং জাতির অবনতিকে তরান্বিত করার কর্মে। বিদ্বেষ-বিভক্তিকে জাগরুক রাখার আয়োজনে। নানা ব্যানারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বা প্রেস কনফারেন্সে একে কতল কর, ওমুককে নিষিদ্ধ কর এসব বলনেওয়ালারা হয়তো ভেবে নিয়েছে লাশের পাশে দাঁড়িয়ে লাভ কি। পচাগন্ধ আর রোদের ঝাঁঝ; অর্থকড়ির বিষয়টিও লবডঙ্কা। কথায় আছে বুদ্ধি থাকলে নাকি হাত পাততে হয় না, ঘরেই চলে আসে। বাংলাদেশে তো এমন রেওয়াজই চালু হয়ে গেছে এরি মধ্যে। শাহবাগের চেয়ে সাভারের দূরত্বটা অতিরিক্তই বটে।
(ঘ) সাভার বিপর্যয় বোধ হয় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য। কোন কোন পত্রিকায় এসেছে ভারতের ভুপালের পর সাভারই বেদনাদায়ক পরিস্থিতির শিকার যা এলাকার আলোচিত এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারি ঘটনা। তাই বিদেশী গণমাধ্যমগুলোও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তা প্রচার করছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। সেসব চ্যানেলগুলোর মালিক-কর্মকর্তাদের হৃদয়ে এতটাই আনন্দ উছলে পড়ছে যে তারা তাদের চ্যানেলের পর্দায় আমোদফূর্তি জমজমাট রেখেছে। কেউ সিনেমা, তাও বেশির ভাগ অশ্লীল, নাটকে প্রেমের পেনপেনানি, কোন কোন চ্যানেলে নারী উপস্থাপিকার হাস্য এবং লাস্যময়ী চেহারা, এদের আচরণে কেউ ভাবতে পারবে না দেশ একটা ভয়ানক দুর্যোগের ভেতর দিয়ে হাঁটছে। চ্যানেলগুলোর উচিত ছিল তাদের সব বিনোদন  প্রোগ্রাম বাতিল করে সেখানে বিষয়ভিত্তিক আয়োজন এবং এই আকস্মিক বিপদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা করা। অতীতে দেশবাসী দেখেছে ঝড়-ঝঞ্ঝা বা জলোচ্ছ্বাসের মতো বিপদের সময় সব আয়োজন বাতিল করে কুরআন তেলাওয়াত এবং হামদ নাত চলত অবিরত। আর প্রতিমুহূর্তে থাকতো সাম্প্রতিক খবর। এখনতো দেশে বেশুমার চ্যানেল। যেখানে উচিত ছিল বিপর্যয়ের দৃশ্যের সাথে দেশবাসীকে একাত্ম করা, সেখানে দেখা গেছে কোন কোন টিভি এমন ধুমধারাক্কা নৃত্য দৃশ্য উপস্থাপন করছে নাচনেওয়ালীর অঙ্গভঙ্গি এবং পদভারে টিভি পর্দা ফেটে যাবার যোগাড়। কোন কোন টিভি মালিক এবং কর্মকর্তা সাভারের দৃশ্য সরাসরি না দেখালেও তারা তাদের দর্শকদের ব্যাডমিন্টন খেলার দৃশ্য সরাসরি দেখাতে ভুল করেনি। কি চমৎকার বদান্যতা। কি চমৎকার বুদ্ধি বিবেচনা। তবে তারিফ করতেই হয় হাতেগোনা তিন থেকে চারটি টিভির। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে সাভার ট্রাজিডিকে সরাসরি সম্প্রচার করে দেশবাসীর সাথে নিজেদেরকেও একাত্ম করেছেন। প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি উদ্ধার কর্ম, ব্যথিতের বেদনার সাথে নিজেদের বেদনাকে মিশিয়ে দিয়ে তারা মহীয়ান হয়েছেন। মিডিয়ার কাছে জনগণের প্রত্যাশা এমনটাই। যেসব টিভি সরাসরি প্রচার করেছে, মৃত এবং উদ্ধারকৃত ব্যক্তির প্রতিটি ক্ষণ, রোদ এবং অন্ধকার কোনটাই তাদের দায়িত্বকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। তাদের সেই সাহসিকতা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ববোধ প্রতিটি দর্শককেই মুগ্ধ করেছে। কৃতজ্ঞতায় করেছে আপ্লুত। বাংলাদেশের মানুষ সেসব টিভি এবং টিভি সাংবাদিকদের স্মরণ রাখবে দীর্ঘ সময়।
যেসব টিভি মালিক এবং কর্মকর্তা বাংলাদেশের সকল বিপর্যয়ের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে স্বইচ্ছায়, অবশ্যই দেশবাসী এবং বেদনাযুক্ত মানুষগুলোর ঘৃণা তাদেরকে বহন করতে হবে বহুকাল। সরাসরি প্রচার না করতে পারলেও এত মানুষের দুঃখবোধটিকেও কি ধরা সম্ভব ছিল না? খবরে দুএকটি দৃশ্যের বয়ান এরা প্রচার করেছে অবশ্য। এতেই বোধ হয় তারা ভাবছে বাপের কাজ করে ফেললাম। তাছাড়া বিটিভি তো মাশাআল্লাহ। শাসকদের পুঁথিপাঠ করতে করতেই এরা ঘর্মাক্ত কলেবর।
উল্লেখ্য পত্রিকায় একজন কিশোরীর পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে এমন একটি ছবি। কিশোরীর এই উদ্ধত পায়ের পাতাটি কি সেইসব টিভি মালিক এবং কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যেই তাক করা আছে যারা এতবড় বেদনাকে অবজ্ঞা করল। অর্থ কামাইয়ের স্বপ্নে থাকল বিভোর।
(ঙ) হয়তো লাশের সংখ্যা বাড়বে, আরো নিখোঁজের তালিকাও দীর্ঘ হবে, সাথে স্বজনদের বিলাপ ভারি করবে কেবল সাভার নয় সমগ্র দেশের বাতাস, পরিবেশ। মা হারা, সন্তান হারা, স্বামী হারা, স্ত্রী হারার কান্না দীর্ঘ সময় ধরে অনুরণিত হবে। কিন্তু কান্নার এই অনুরণন কি ভাঙ্গতে পারবে গার্মেন্টস মালিকদের পাষাণ হৃদয়ের দেয়াল? শাসকশ্রেণীর কূটকৌশলের জঞ্জাল। তাই বিপদগ্রস্ত অভাজনদের একমাত্র ভরসা সেই সর্বশক্তিমান। এমন বিপদে নজরুলের ভাষায় উচ্চারণ করতে হয় ‘দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য, হে উদার নাথ। দাও অমৃত জনে/ দাও ভীত চিত জনে/ শক্তি অপরিমাণ/ হে সর্বশক্তিমান।’
শেষ কথা : খবর এসেছে রানা প্লাজার রানা বেনাপোল সীমান্তে ধরা পড়েছে। ধরাতো অনেকেই পড়ে। ক’জনেরই অপরাধ পরিমাপ করা হয়। যদি সেই অপরাধীর পরিচয় থাকে যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত; স্মরণযোগ্য ধৃত এই সোহেল রানা সাভার যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক। এমনটাই পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভুল পথে যাত্রা আর কতোকাল



সাভার ট্র্যাজেডির কারণে রানা প্লাজার মালিক ও সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক সোহেল রানার আলোচনা এখন সবার মুখে মুখে। সামান্য একজন কলু কী করে এতটা ক্ষমতাবান ও বেপরোয়া হয়ে উঠলো সেই রহস্য জানতে এখন মানুষ উদগ্রীব। অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে সেই কাহিনী। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, রানার ক্ষমতাবান ও কোটিপতি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে জমি দখল, খুন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-। রানা প্লাজার আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল তার টর্চারসেল। এখানে বসেই সে সাভার-আশুলিয়ার সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করতো। জমি কেনাবেচার নামে নিরীহ লোকদের ধরে এনে জোর করে জমির দলিল হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রানা প্লাজার বেসমেন্টে টর্চার সেলের পাশাপাশি ছিল রানাবাহিনীর মনোরঞ্জনের আয়োজন। গার্মেন্টের কর্মীসহ ওই এলাকার অনেক মেয়ে সতীত্ব হারিয়েছেন সেখানে। নিজের ভগ্নীপতি জাকির এবং রাজিবÑসমর বাহিনীর ক্যাডার আব্দুল্লাহ হত্যা, জমি দখল, অস্ত্র-মাদকসহ আট মামলার আসামি এই সোহেল রানা। সাধারণ মানুষ যেখানে এক মামলার চাপেই অস্থির থাকে, সেখানে আট মামলা মাথায় নিয়ে কী নির্বিকারভাবে একের পর এক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল রানা! এর রহস্য কী?
রানার বেপরোয়া কর্মকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও প্রশাসনের আশীর্বাদের বিষয়। সাভারের আওয়ামী লীগ এমপি তৌহিদ জং মুরাদ নিজে প্রশাসন ও পুলিশের কাছে রানাকে ‘রাজনৈতিক ছোটভাই’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এ কারণে সাভারের মানুষ রানাকে চেনেন এমপির ডান হাত হিসেবে। এমপির আশ্্কারা পেয়েই সামান্য কলু থেকে সে হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। কখনো নিজের নামে, কখনো এমপির নামে অবলীলায় অপরাধ করে যায় সে নির্বিকারভাবে। তার বেপরোয়া আচরণ দেখে মনে হয়েছে দেশে পুলিশ বা প্রশাসন বলে কিছু নেই্ কিন্তু আসলেই কি দেশে পুলিশ বা প্রশাসন নেই? আমরা তো জানি দেশে পুলিশ আছে, প্রশাসনও আছে। তাদের কলেবরও বৃদ্ধি হচ্ছে। সরকারও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে এখানে বলার বিষয় হলো, এ পুলিশ প্রশাসন যেন জনগণের পুলিশ-প্রশাসন নয়, শুধুই সরকার ও সরকারিদলের লোকজনের পুলিশ-প্রশাসন। এমন পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে তো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন সম্ভব নয়। বরং এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এখন বেড়ে উঠছে সোহেল রানার মত সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা। জাতির জন্য যাদের অবদান সাভার ট্র্যাজেডির মত মর্মান্তিক ঘটনা।
আমরা জানি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। জনগণ তাদের ট্যাক্সের পয়সায় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রচুর ক্ষমতা ও সক্ষমতা দিয়ে যাচ্ছে সরকারকে। সরকারও কারো প্রতি অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে বরং ইনসাফের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার কি ওয়াদা পালনে আন্তরিক? আন্তরিক হলে দেশের এমন চিত্র কেন? দলীয়করণের কারণে আজ ভরে গেছে দেশের মানচিত্র। একটু অক্সিজেনের জন্য নাগরিকরা আজ কাতরাচ্ছে, যেমনটি কাতরাচ্ছে রানা প্লাজার মৃত্যুপুরীতে। আসলে ওয়াদা পালন তথা সুশাসনের বদলে এখন দেশে চলছে শঠতা ও ধূর্ততার শাসন। এমন শাসনে জনগণ ভাল থাকে না। শোষণ ও জুলুমের মাত্রা বেড়ে গেলে জনগণ রাজপথে নেমে আসে। তখন শাসক ও তল্পীবাহকরাও ভাল থাকতে পারেন না। শ্রমিক-জনতা এখন রাজপথে নেমে এসে সোহেল রানা ও এমপি তৌহিদ জং মুরাদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে সরকার কি কোনো বার্তা পেলো? সোহেল রানা ও তৌহিদ জং ভুল কাজ করেছেন, সরকারও ভুল পথের যাত্রা অব্যাহত রাখে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

উন্মাদ আর কাকে বলে


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, সে ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কমই ঘটেছে। আওয়ামী যুবলীগ নেতার মালিকানাধীন এই নয়তলা ভবনটি সম্পূর্ণ ধসে পড়ায় সহস্র গার্মেন্টশ্রমিকের জীবন সংশয়াপন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত সেখান থেকে প্রায় তিন বিশ শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আরো প্রায় হাজার দুয়েক লোক। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২৪ এপ্রিল ধসে পড়া ওই ভবনটিতে এখনো আরো কয়েক শ’  মানুষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এখনো ভবনের ভেতর থেকে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ এমন আকুতিও জানাচ্ছে যে, একটা কিছু দেন, আমার হাতটা, পাটা কেটে ফেলে বেরিয়ে আসি। কেউ কেউ বলছেন, হাত-পা কেটে হলেও আমাকে জীবন্ত উদ্ধার করুন। কেউ কেউ কিছুই বলছেন না। আর্তচিৎকার কিংবা ফোঁপানো কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। উদ্ধারকারীদের চোখে বইছে অশ্রু। এই উদ্ধারকাজে এলাকার হাজার হাজার মানুষ অংশ নিচ্ছে। স্যান্ডউইচের মতো চুপসে যাওয়া ভবনের ছাদ কেটে বিপন্ন মানুষকে বের করে এনেছে। তারপর দ্রুত তাদের হাসপাতালে স্থানান্তর করছে। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশের মানুষ পরস্পর বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু বর্তমান সরকার এক আজব সরকার। এটা কী ধরনের সরকার তা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। সরকারের কর্ণধারেরা সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছেন কি না তা এখন সবার ভাবার বিষয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যাকে ‘রাজাকার কমান্ডার’ হিসেবে অভিহিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বিপদে পড়েছেন, সেই মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাভারের গার্মেন্ট দুর্ঘটনা নিয়ে এক চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিকদের সামনে। ২৪ এপ্রিল বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই অতি উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকটি কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে জানান দিয়েছেন, হরতালকারীরা এসে এই ভবনে ধাক্কাধাক্কি করেছিল বলেই ভবনটি ধসে পড়েছে। একটি নয়তলা ভবন, তার মধ্যে ইট-কাঠ-রড থাকার কথা। কতগুলো লোক এসে ধাক্কা দিলো, আর ভবনটি ঝুরঝুর করে ধসে পড়ে গেল। এ-ও কি সম্ভব! সম্ভব কি অসম্ভব, তা বিবেচনা করার মতো বোধবুদ্ধি এই ‘বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ভাষায় রাজাকার কমান্ডারের’ নেই। মানুষে ধাক্কা দিলে কোনো বিল্ডিং পড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তা এই প্রথম শোনা গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এ কথা বলতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেননি। মূর্খতা ও অজ্ঞানতারও তো বোধ করি একটা সীমা আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কী বলে যে বিশেষায়িত করব, বুঝতে পারছি না।
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সারা দেশে ছি ছি রব উঠেছে। রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, হাটবাজারে, চায়ের দোকানে একটিই আলোচনার বিষয়Ñ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলে গেলেন? এ কথা বলতে পারলেন? এ কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, কোনো উন্মাদই কেবল এ রকম কথা বলতে পারেন। মানসিকভাবে সুস্থ কোনো মানুষের পক্ষে এ কথা বলা সম্ভব নয়। আরেকজন খ্যাতিমান সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, আমি বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে চাই, তিনি গিয়ে কোনো নয়তলা ভবনের পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করে দেখুন ভবনটি ফেলতে পারেন কি না। এ দিকে আবার সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ব্যাটালিয়নের প্রধান লে. কর্নেল মোহাম্মদ মইনউদ্দিন বলেছেন, আগের দিনে ভবনটির কংক্রিটের পিলার দুর্বল ছিল। তার ওপর এতে লোকজন ওঠে এবং জেনারেটর চলায় কম্পনের সৃষ্টি হয়। এতে ভবনটি ধসে পড়ে। দমকল বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান বলেন, জনগণ এর গেট ধরে ধাক্কাধাক্কি করলেই কোনো ভবন ধসে পড়তে পারে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে শুরু করলাম বটে, কিন্তু শুরু করা উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বিরাট জনদরদি লোক। জনগণের দুঃখ-কষ্টে তার হৃদয় বড় বেশি ভারাক্রান্ত হয়। তিনি এসব সহ্য করতে পারেন না। তাই যারা টিভি টকশোতে এই ভবনমালিক ও গার্মেন্টমালিকদের সমালোচনা করছিলেন, তিনি তাদের ওপর একেবারে খড়গহস্ত হয়ে উঠলেন। ভবন মালিক আওয়ামী যুবলীগ নেতা। নয়তলা ভবন করেছেন পুকুরের ওপরে রাজউকের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই। আর আজব ব্যাপার এই যে, এসব স্থানে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমোদনের দরকার হয় না। পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদও অনুমোদন দিতে পারে। আর যদি প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে, তাহলে এসব অনুমোদনেরও কোনো প্রয়োজন হয় না। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সিমেন্ট-বালুর তোয়াক্কা না করে ইট গেঁথে উঠে গেলেই হয়।
প্রধানমন্ত্রী টকশোর আলোচকদের ওপর বিরক্ত হয়ে বলেছেন, একে ধরো তাকে মারো এসব কথা না বলে আলোচকেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে যদি একজন মানুষকেও উদ্ধার করেন, তাতে লোকজন উপকৃত হবেন। যেন সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে খুবই সীমিত। কিন্তু আমরা দেখেছি, এ উদ্ধারকাজে সরকারের লোক যতটা না অংশ নিয়েছেন তার  চেয়ে বেশি ছিলেন বেসরকারি লোক ও এলাকাবাসী। আহতদের চিকিৎসার দায়ও নেয় সাভার ও ঢাকার কমলাপুরের দু’টি বেসরকারি হাসপাতাল। আহতদের জন্য রক্ত দিতে হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। সরঞ্জামের অভাবে শেষ পর্যন্ত রক্ত আর গ্রহণ করা যায়নি। বহু লোক ফিরে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একেবারে একই সুরে গীত গেয়ে গিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সকালবেলা হরতালকারীরা এসে বিল্ডিংয়ের পিলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করে। সেই কারণে ভবনটি ধসে পড়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিল্ডিংয়ে ফাটল ধরার কারণে সরকার সব লোককে ভবন থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সকালবেলা এই ভবন থেকে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী নেয়ার জন্য কিছু কর্মচারী এসে হাজির হন এবং তারা ভবনের ভেতরে ঢোকেন। সে কারণে তারা এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
সব কর্মচারীর জন্য এটা কর্মক্ষেত্র। সেখানে এরা স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা বা অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য কোনো আয়োজন করেন না। তাদের সম্পদ যদি কিছু থাকে তবে সেটা তারা বাসায়ই গচ্ছিত রাখেন, অথবা অন্য কোনো আপনজনের কাছে রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য মানলে বিশ্বাস করতে হয়, এই যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক, যারা রানা প্লাজায় ঢুকলেন, তারা সবাই কারখানার মূল্যবান সামগ্রী চুরি করতে ঢুকেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বোধ হয় কোনো ধারণাই নেই যে, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে শ্রমিকেরা কিভাবে ঢোকেন এবং কিভাবে বের হন। এদের দেহ তল্লাশি করে ঢোকানো হয় এবং দেহতল্লাশি করে বের করা হয়, যাতে তারা কোনো গার্মেন্টসামগ্রী নিয়ে বের হতে না পারেন। সেখানে এরা মূল্যবান সামগ্রী আনার জন্য ফ্যাক্টরিতে ঢুকলেন এবং সব দুয়ার খোলা থাকল, আর তিন শতাধিক লাশ উদ্ধার হলো, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর জবাব কী? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য যে সারবত্তাহীন সেটির আরো প্রমাণ পাওয়া গেল হাসপাতালে চিকিৎসাহীন আহত কর্মীদের কাছ থেকে। তারা জানান, আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দেয়ায় সে দিন কর্মীরা কাজে যোগ দিতে চাননি। কিন্তু কারখানার কর্মকর্তারা তাদের বাসা থেকে ফোন করে ডেকে আনেন এবং জানান যে, এরা ইঞ্জিনিয়ার এনে পরীক্ষা করে দেখেছেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর কর্মকর্তারাও তাদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে চলে যাবেন না। তাদের সাথেই থাকবেন। তারা তা ছিলেনও। তাদের অনেকেই এই দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন। এ থেকেও প্রমাণিত হয়, প্রধানমন্ত্রীর দাবি অসার অনুমানপ্রসূত ও অসত্য।
কিন্তু বাস্তবতা হলো রানার এই ভবন প্রাঙ্গণ সরকার সমর্থক ও বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিহত করার একটি কেন্দ্র ছিল। সাভারে হরতালবিরোধী যেসব মিছিল-সমাবেশ আওয়ামী লীগ করে, তারা প্রথমে এসে সমবেত হয় এই রানা প্লাজার সামনে। তারপর বিরোধী দলের কর্মসূচির বিরুদ্ধে এরা শোডাউন শুরু করে। সে দিনও হরতালের দিন ছিল এবং সোহেল রানা যথারীতি সকালবেলা এসে সেখানে কর্মী বাহিনীকে সমবেত করতে থাকেন। বিল্ডিং ধসের সময় তিনি নিজেও ভবনের নিচতলায় তার অফিসকক্ষে অবস্থান করছিলেন। এতে তিনি সামান্য আহতও হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি মুরাদ জংয়ের সহায়তায় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো তার সন্ধান মেলেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে নিজেকে বদ্ধ উন্মাদে প্রমাণিত করেছেন। এর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্পর্কে নানা ধরনের বাজে কথা চালু হয়েছে। এখন দেখছি সেই তালিকায় আরেকজন যুক্ত হলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর যখন বললেন, ১৮ দলীয় জোটের কর্মীরা তার অন্তরের অন্তস্তলের রানা প্লাজার কলাপসিবল গেট ও পিলার ধরে নাড়াচাড়া করছেন, তখন সংবাদপত্রের রিপোর্ট ছিল ভিন্ন। সরকার সমর্থক পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো সে দিনই রিপোর্ট করে, ভবনের মালিক সোহেল রানা পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে বললেন, রানা যুবলীগের কেউ নয়। কিন্তু সে কথাও শেষ পর্যন্ত অসত্য বলে প্রমাণিত হলো। সাভারের অলিগলিতে স্থানীয় এমপি মুরাদ জং ও সোহেল রানার ছবি সংবলিত পোস্টারে ভরা। তাতে নানা আহ্বানÑ শোক দিবস পালন করুন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুন। মুরাদ জংয়ের এমন সব পোস্টারের নিচে লেখা আছে ‘সৌজন্যে মোহাম্মদ সোহেল রানা, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, সাভার পৌর যুবলীগ’।
কিন্তু কেন এ  ধরনের এক ঘাতককে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতটা মরিয়া হয়ে উঠলেন? তার কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। এর আগেও আমরা দেখেছি, এই সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া খুনিদেরও কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। একই বিবেচনায় হাজার হাজার খুনি-ডাকাত, ধর্ষক, লুটেরাকে দায়মুক্তি দিয়েছে। সুতরাং সোহেল রানাই বা বাদ যাবেন কেন? আর তাই প্রথম থেকে সরকারের শীর্ষস্থানীয় লোকেরা তার পক্ষ নিয়েছেন। কিন্তু এই পক্ষপাত যে শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিরোধের মুখে ধুলায় মিশে যায়; ইতোমধ্যে দেশের প্রান্তে প্রান্তে সে রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। সুতরাং এ দিয়ে সরকারের শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সরকারের উচিত এখনই ভালোয় ভালোয় বিদায় নেয়া


সিরাজুর রহমান

এরা দেশ শাসন করছে, কিন্তু দেশের মানুষের জন্য দয়ামায়া নেই বর্তমান সরকার আর শাসক দল আওয়ামী লীগের। মানুষ মরল কি বেঁচে রইল, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই তাদের। লুটেপুটে দেশটাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে এরা। দেশের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশের শ্রমিকের রক্ত পানি করা শ্রমের বিনিময়ে তৈরী পোশাক রফতানি আর লাখ লাখ শ্রমিক রফতানির বিনিময়ে অর্জিত বিদেশী মুদ্রায় সরকার চলছে, সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বিদেশে বেড়াতে যাচ্ছেন, ফুটানি করছেন। কিন্তু যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে সে হাঁসটিকে মেরে ফেললে কী হবেÑ একবারও ভেবে দেখছে না এ সরকার।
বৈধ ও অবৈধভাবে বহু লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছেন। পথে অবৈধদের অনেকে কনটেইনারে দম বন্ধ হয়ে অথবা অথৈ সমুদ্রে হাড়জিরজিরে হয়ে নৌকা ডুবে মারা গেছেন। যারা বেঁচে ছিলেন তারা লুকিয়ে আর গা-ঢাকা দিয়ে বিভিন্ন দেশে কোনোমতে বেঁচে থেকেছেন। এই তো সে দিন গ্রিসের স্ট্রবেরি ক্ষেতে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় মালিকেরা। একবার রোমের রাস্তায় কুমিল্লার এক ছেলে আমার কাছে এসেছিল। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সে ছাতা বিক্রি করে। আমার পরিচয় বুঝতে পেরে লজ্জায় পালিয়ে গেল। পাতাল রেলের স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে ফুল কিংবা সস্তা অলঙ্কার বিক্রি করতে দেখেছি বাংলাদেশী কিশোর ও তরুণদের। বছরের পর বছর প্রায় ভিখিরির জীবন যাপন করে কেউ কেউ বৈধ হয়েছে, পড়ন্ত শিল্পকারখানায় চাকরি পেয়েছে। এই কষ্টলব্ধ অর্থের যত বেশি সম্ভব দেশে ফেলে আসা পরিবার-পরিজনকে পাঠিয়েছে তারা। তাদের পাঠানো বিদেশী মুদ্রার সব সুবিধা ভোগ করছে সরকার।
কিন্তু এই অসম সাহসী আর কঠোর পরিশ্রমী বাংলাদেশীদের স্বার্থের দিকে সরকার নজর দেয়নি। বর্তমান সরকারের ইসলামবিরোধী নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশ এবং অন্যান্য অঞ্চলেরও কোনো কোনো দেশ আর বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ করছে না। সৌদি আরব বাংলাদেশী শ্রমিকদের বহিষ্কার করছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিসা দিচ্ছে না বাংলাদেশী শ্রমিকদের। প্রায় দুই কোটি বাংলাদেশী শ্রমিকের আয়-উপার্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো দেশ সামান্য কিছু বাংলাদেশী নিতে চাইলে সরকারি প্রচারযন্ত্র এমন ঢাকঢোল পেটাতে শুরু করে, যেন তারা লঙ্কা জয় করে ফেলেছে।
সরকারের একই ধরনের উদাসীনতা তৈরী পোশাক শিল্প সম্বন্ধে। বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক রফতানিকারক দেশ। চীনের পরই এ স্থান। এ শিল্প থেকে মণ্ডামিঠাই খাচ্ছে সরকার, কিন্তু শিল্পের ভালো-মন্দের দিকে তাদের নজর নেই। ওদিকে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিদেশে এবং দেশে যে লাল সঙ্কেত জ্বলে উঠেছে, সে দিকেও খেয়াল নেই সরকারের। বর্তমান সরকার এবং তাদের এলিট গোষ্ঠীর মনোভাব এই। যত দিন তারা ক্ষমতায় আছে সব কিছু লুটপাট করে তারা পেট ভরবে, পকেট ভারী করবে। এর পর দেশটা গোল্লায় গেলেও তাদের কিছু এসে যাবে না।
গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের যেভাবে শোষণ করা হচ্ছে, যে ন্যক্কারজনক পরিবেশে তারা কাজ করছে, আমেরিকা ও ইউরোপের আমদানিকারকেরা অনেক দিন থেকেই এর সমালোচনা করছে। সমালোচনা না করে উপায় নেই। সেসব দেশের মিডিয়া বহু দিন ধরে বাংলাদেশী গার্মেন্ট কারখানাগুলোর দুরবস্থা এবং শ্রমিকদের নিরপত্তা ও মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি মালিক ও সরকারের উদাসীনতার সমালোচনা করে আসছে। সেসব দেশের টেলিভিশনে বহু প্রামাণ্য ভিডিও দেখানো হচ্ছে, পত্রপত্রিকায় বহু ফিচার ছাপা হয়েছে।
নিজেদের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরার জন্য শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন করতে দেয়া হচ্ছে না, সেটাও বিদেশী ক্রেতাদের একটা বড় অভিযোগ। শ্রমিকদের নেতা আমিনুলের হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপে বারবার তাগিদ উঠছে। এরা বলছে, বাংলাদেশ সরকার এসব অবিচারের প্রতিকার না করলে তারা বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের আমদানি সীমিত করতে বাধ্য হবে। কেননা সচেতন ক্রেতারা এখন বাংলাদেশে তৈরী পোশাক কিনতে খুঁতখুঁত করছে।
গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি মালিকদের সাথে সরকারের যোগসাজশ এবং শ্রমিকদের মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি মালিক ও সরকারের যৌথ অবহেলার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। যুবলীগের একজন স্থানীয় নেতা সোহেল রানা হিন্দু জমিসহ দখলী করা জমিতে (যার মধ্যে একটা পুকুরও ছিল) আটতলা ভবন রানা প্লাজা তৈরি করেছিলেন। এ নির্মাণে রাজউকের এবং রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে চলা হয়েছে কি না, এখনো জানা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার গদিতে থাকতেই সাততাড়াতাড়ি ভবনটি তৈরি করে টাকার পাহাড় তৈরি করা ছিল মালিক সোহেল রানার উদ্দেশ্য।
 রানা প্লাজায় যা ঘটেছিল
সে ভবনে দোকানপাট ও একটি ব্যাংক বসেছিল। সবচেয়ে বড় কথা পাঁচটি গার্মেন্ট কারখানা স্থাপিত হয়েছে সে ভবনে। আগের দিন মঙ্গলবার রানা প্লাজার গায়ে ফাটল দেখা যায়। সে ফাটল টেলিভিশনেও দেখানো হয়েছিল। দুয়েকটি দৈনিকে এর খবর আরে দিন ছাপা হয়েছিল। স্বভাবতই পোশাকশ্রমিকেরা শঙ্কিত হয়েছিলেন। বুধবার কারখানা বন্ধ রাখতে তারা আকুতি-বিকুতি করেছেন। পুলিশও দাবি করছে, তারা রানা প্লাজার ফাটল সম্বন্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। কিন্তু এক দিন কাজ বন্ধ থাকলে মালিকদের মুনাফা কিছুটা কমে যায়। এরা কিছুতেই কারখানা বন্ধ করতে রাজি হননি। এরা বলেন, রানা প্লাজা সম্পূর্ণ নিরাপদ। সরকারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও দেখেশুনে রায় দিয়েছিলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
চাকরি হারালে শ্রমিকদের পরিবার-পরিজন না খেয়ে থাকবে। তাই এরা কাজে গিয়েছিলেন। আর তাদের মাথার ওপরই ভেঙে পড়ে আটতলা ভবন রানা প্লাজা। যখন এ কলাম লিখতে বসেছি, তখনকার খবর অনুযায়ী ৩০৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আরো বহু লাশ এবং জীবিত শ্রমিক ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া শ্রমিকদের বুক ফাটানো আর্তনাদ আমি ব্রিটিশ টেলিভিশনেও শুনেছি। আহত হয়েছেন শত শত শ্রমিক। এদের সবার পরিবারে চলছে মাতম আর আহাজারি।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার এটাই একমাত্র নজির নয়। মাত্র পাঁচ মাস আগে তাজরীন ফ্যাশনের কারখানায় আগুন লেগে ১১২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গিয়েছিল। সে ঘটনার জের ধরে আমেরিকার বৃহত্তম চেইনস্টোর ওয়ালমার্ট তাজরীন ফ্যাশনের তৈরী পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল। সে রকম ঘটনা গত চার-পাঁচ বছরে আরো কয়েকটি ঘটেছে। সেসব ঘটনায় দেখা গেছে, আপদকালে কারখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খোলা না থাকায় মৃতের সংখ্যা এত বেশি হয়েছে। তা ছাড়াও অনেকগুলো অশান্তি ঘটেছে পোশাক তৈরির কারখানাগুলোতে। সব ক্ষেত্রেই কারণ ছিল শ্রমিকদের পাওনা বেতন ও ভাতা পরিশোধ, ন্যায্য বেতন ও কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দাবি ইত্যাদি।
শ্রমিকদের দিক থেকে হয়তো কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা ঘটেছিল। বিক্ষিপ্তভাবে যেখানে জনরোষ ফেটে পড়ে, অসংগঠিত শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেন, তখন উচ্ছৃঙ্খলতা ঘটতেই পারে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে দেয়া হয় না বলেই এরা বিক্ষিপ্ত এবং স্থানীয়ভাবে আন্দোলন করতে বাধ্য হন। শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার এখন বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের তূণেও সে আইন আছে। সমস্যা হচ্ছে যে সরকার সেসব আইন প্রয়োগ করছে না। তারও কারণ আছে।
পোশাক নির্মাতাদের অনেকে বর্তমান সরকারের অনুগ্রহভাজন ও সমর্থক। তাদের কাছ থেকে সরকার বহু রাজনৈতিক সুবিধা পায়। যেমন শুনেছি যে ২৭ এপ্রিল মতিঝিলে তাদের নারী সমাবেশে পোশাক কারখানায় কর্মরত নারীশ্রমিকদের হাজির করতে সরকার মালিকদের নির্দেশ দিয়েছিল। সরকার নাকি তাদের টোপ দিয়েছিল যে নারীশ্রমিকদের দিয়ে মতিঝিলে ‘বিরাট নারী সমাবেশ’ দেখানো হলে হাতিরঝিলে মালিকদের সমিতির অবৈধ ভবনটি সরকার ভেঙে ফেলবে না। অবশ্য রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির পর মতিঝিলের সমাবেশ এখন স্থগিত করা হয়েছে। সরকার ও কারখানা মালিকদের গোপন যোগসাজশের কারণে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং রানা প্লাজার মতো ট্র্যাজেডি ঘটতে পারছে।
 প্রধানমন্ত্রীর উক্তি বাস্তববিবর্জিত
বিগত চার বছরে অনেকগুলো নতুন তৈরী সুউচ্চ ভবন ধসে পড়ার খবর মিডিয়ায় পড়েছি এবং দেখেছি। সরকার তাদের সমর্থন ও পেশিশক্তি সংগ্রহের লক্ষ্যে দলীয় লোকদের অবৈধভাবে জমি বরাদ্দ করছে। বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার বাসনায় আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই সুউচ্চ ইমারত গড়ে তুলছে। এমন অবৈধভাবে তৈরী ভবনের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার হবে বলে অনুমান মিডিয়াতেই দেখেছি। একটি খবরে দেখেছি, গত আট বছরে ভবন ধসে পড়ে ৩৫০ জন মারা গেছে। তার মধ্যে অবশ্য গত বুধবার রানা প্লাজায় নিহতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। মাঝারি শক্তির একটি ভূমিকম্পও যদি আঘাত হানে তাহলে এসব অবৈধ ভবনের বেশির ভাগ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাতে কত প্রাণহানি হবে শুধু অনুমানই করা যায়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়েই উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য খালেদা জিয়া ১৮ দলের আহূত ৩৬ ঘণ্টার হরতালের বাকি অংশ প্রত্যাহার করেন। তিনি নিজেও উদ্ধারকাজ দেখতে সাভারে যান। অন্য দিকে সে ঘটনার পরই একখানি ট্রেন উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছিলেন, ফাটলের কারণে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল, শ্রমিকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আনতেই কারখানায় ঢুকেছিল। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ভবনের মালিক সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। কিন্তু স্থানীয় যুবলীগের নেতা হিসেবে তার ছবি সংবলিত পোস্টার মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ইস্রাফিল আলম এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষও বলছেন, সোহেল রানা যুবলীগের কর্মকর্তা।
যেকোনো সভ্য দেশে এ ঘটনা ঘটলে সোহেল রানা ও পাঁচটি গার্মেন্ট কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে অন্তত নিহতের সংখ্যার সমানসংখ্যক হত্যা মামলা হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ সভ্যতার মাপকাঠিতে উতরাবে বলে মনে হয় না। দেশের শোকাপ্লুত মানুষ দায়ীদের কঠোর শাস্তি দানের দাবি জানাচ্ছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শাস্তির চেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রাণ বাঁচানো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি একবারও গিয়েছেন সাভারে? উদ্ধারকাজেও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবকেরাই মূল ভূমিকা নিচ্ছে বলে মনে হয়। তাদের মধ্যে স্থানীয় জনসাধারণ, মাদরাসাছাত্র ও হেফাজতে ইসলামের লোকজনদেরই বেশি দেখতে পাচ্ছি ভিডিও ছবিতে। ওদিকে সোহেল রানা ও গার্মেন্ট কারখানাগুলোর মালিক ও কর্মকর্তারা সবাই নিখোঁজ। হেফাজতে ইসলাম থেকে দাবি করা হয়েছে, সরকার সোহেল রানাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা তাদের জন্য অস্বাভাবিক হবে না। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিক দম্পতি রুনি ও সাগরের নৃশংস হত্যার পরও শোনা গিয়েছিল, সরকার অতি দ্রুত ঘাতকদের বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। সরকারের পুলিশ আজ পর্যন্ত এই দুই সাংবাদিকের হত্যাকারীদের হাজির করতে পারেনি। সুতরাং শোনা কথাগুলো বিশ্বাস না করে উপায় কী?
 সরকার বেপরোয়া, বিকৃত মস্তিষ্ক
আজ যারা ক্ষমতায় আছেন তারা মনে করেন, আর বেশি দিন তারা ক্ষমতায় থাকবেন না। হয়তো এ দেশেই থাকবেন না তারা। হয়তো সে কথা মনে করেই এমন ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ব্যাপারেও ক্ষমতাসীনেরা এমন ‘ক্যাভালিয়ার’ (প্রগলভ, দাম্ভিক) উক্তি ও আচরণ করতে পারেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই শত শত মানুষের মৃত্যু নিয়েও রসিকতা করতে পারেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, ভবনের পিলারে বিএনপি-জামায়াতের ধাক্কাধাক্কির কারণেই হয়তো আটতলা রানা প্লাজা ধসে পড়ে থাকতে পারে। হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধারণায় বাঁশের খুঁটির ওপরই আটতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
এই সুদূর প্রবাস থেকে যা জানতে পেরেছি, চাপা পড়া লোকদের অনেককেই হয়তো জীবিত উদ্ধার করা যাবে না। ভবনটির নিচের দু’টি তল মাটির নিচে দেবে গেছে। সেখান থেকে ধ্বংসস্তূপ ও লাশ উদ্ধার করার মতো ভারী যন্ত্রপাতিও বাংলাদেশে আছে বলে আমার জানা নেই। এ দিকে শোকে-ক্রোধে গার্মেন্টশ্রমিকেরা বেসামাল হয়ে উঠেছেন বলেই মনে হয়। এরা প্রতিবাদ করছেন, মিছিল করছেন, সড়ক অবরোধ করছেন। রাজধানী ঢাকা এবং আশপাশের এলাকাগুলো এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হয় না।
প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণক্ষমতাই এই সরকারের নেই। এ সরকার দেশে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে না, যেসব শ্রমিক উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দেশের জন্য সম্পদ উপার্জন করেন, সরকার তাদের প্রাণের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এমনকি সরকার ও মালিকদের অবহেলা ও উদাসীনতায় বেঘোরে মারা গেলে তাদের লাশ উদ্ধারেও সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এ অবস্থায় এই সরকারের আর এক দিনও গদিতে থাকার অধিকার আছে বলে দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এ সরকার আর কালবিলম্ব না করে ভালোয় ভালোয় বিদায় নিলেই সবার স্বস্তির কারণ ঘটবে।

Ads