রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

যে কারণে দেশ আজ চরম সঙ্কটে



মহাজোট সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা আড়াল করতে নাস্তিক বামপন্থী কিছু আধাশিক্ষিত ও মূর্খ এমপি, অনভিজ্ঞ মন্ত্রী ও ইসলাম বিদ্বেষী পরান্নভোজী উপদেষ্টা আর তথাকথিত কতিপয় বুদ্বিজীবীর পরামর্শে এক একটি নতুন ইস্যু তৈরি করে সরকার দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে ৯০% ভাগ মুসলমানের দেশে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নাস্তিক মুরতাদ ও ইসলাম বিদ্বেষীদেরকে তৌহীদি জনতার প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে। পক্ষান্তরে সরকার ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে ইসলামের দুশমন নাস্তিক ও মুরতাদদের পক্ষ নিয়ে পরিস্থিতি সংঘাতময় করে তুলেছে। সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলীতে এযাবৎ প্রায় দুইশত ধর্মপ্রাণ ও ইসলামপ্রিয় মানুষ নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালের একটি মীমাংসিত যুদ্বাপরাধ ইস্যুকে সামনে এনে সংঘাত ও সংঘর্ষকে উসকে দিয়ে জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও ঘোলাটে করা হয়েছে।
সর্বশেষ সরকারের সকল অপকর্মের গ্লানি মুছে দিতে কতিপয় নাস্তিক পরিবারের নষ্ট ও ভ্রষ্ট তর”ণ-তর”ণীদের নর্তন কুর্দন ও বেলেল্লাপনা আর সরকারের তাঁবেদার কতিপয় ধর্মদ্রোহী মিডিয়ার সহযোগিতায় ও হলুদ সাংবাদিকদের মিথ্যা প্রচারণায় আল্লাহ, তাঁর রাসূল (স.), ইসলাম, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও আলেম-ওলামার প্রতি কটূক্তি ও ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে সরকারই দেশকে এক চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কোরআন-স্ন্নুাহ তথা ইসলাম বিরোধী কোন আইন পাস করবে না বলে ঘোষণা দিলেও সরকার গঠনের সাথে সাথে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যটুকু মুছে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপন করে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার লঙ্ঘনের মাধ্যমে দেশে সর্ব প্রথম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থি নারী অধিকার আইন করেছে। ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। নারীর সম্মানের প্রতীক ও ফরজ পর্দার বিধান বোরকাবিরোধী রায় ও পরিপত্র জারি করেছে। দ্বিতীয়ত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার প্রয়াসে আরো একটি সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কথা থাকলেও সেনা সমর্থিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীল নক্সার নির্বাচনের মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত বিজয় লাভের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে মহাজোট নেত্রী ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসংগে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে গেছে, মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফকে সাংবাদিকগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে কিনা এ প্রসংগে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেছিলেন, হ্যাঁ! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, তবে এ বিচার হবে প্রতিকী ।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মহাজোট সরকারের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হতে থাকে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন, শেয়ার মার্কেট লুট-পাট, ডেসটিনি, যুবক, গ্রামীণ ব্যাংক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি বিষয়গুলোর ব্যর্থতা ঢাকতে নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে ৪০ বছরের পুরানো ও মীমাংসিত ঘটনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুর” করে। আর এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে জাতি আজ বিভক্ত হয়ে সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক প্রশ্ন ওঠেছে। প্রশ্ন ওঠেছে কথিত যুদ্বাপরাধীদের বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়েও।
দেশ বরেণ্য আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ্ আহমদ শফি, শাহ আহমদ উল্লাহ আশরাফসহ দেশের বিশিষ্ট আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখগণ ও সচেতন মহল মনে করেন বর্তমান সরকার বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের দমনের ল্েক্ষ্য ও সরকারের ইসলাম বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমদের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। আর প্রতিবেশি একটি দেশের ইঙ্গিতেই গঠন করেছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। নাম ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ হলেও আন্তর্জাতিক কোন আইন বা পরামর্শও এখানে গ্রহণ করা হয়নি। এতে দার”ণ ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের নামে গঠিত ট্রাইব্যুনাল।
১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর, বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়, আর ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা বহাল হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের এযাবৎ পনেরটি সংশোধনী আনা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম সংশোধনী আনা হয়েছে সংবিধান কার্যকর হওয়ার ছয় মাস পর যখন আওয়ামী লীগ একক ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছিল ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। উক্ত সংশোধনী আনা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে যারা যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত সে সকল পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের সহযোগিদের বিচারের জন্যে।
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সিমলা চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যকে ছেড়ে দিয়ে ও হানাদারদের এদেশীয় দোসরদের অর্থাৎ রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর বাহবা নিয়েছিলেন। তবে মাত্র সাইত্রিশ হাজার আটশত চুয়াত্তর জন লোকের বির”দ্ধে মামলা হয়েছিলো, যারা হত্যা, ধর্ষণ লুট-পাট ও জ্বালাও পোড়াও এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলো। তাদের মধ্যথেকেও অধিকাংশ লোকই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলো আর সামান্য হাতে গোণা সাতশ চৌত্রিশ জনের শাস্তি হয়েছিলো তাও আবার ৫-৭ বছর সাজা ভোগ করে তারা এখন মুক্ত জীবন যাপন করছে।
মূল আসামীদের ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে যাদের বিচার করা হচ্ছে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের, তারা কেহই মূল আসামী, সহযোগি বা অভিযুক্তও ছিলেন না। আজ যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের বির”দ্ধে বাংলাদেশে কোন থানায় বা আদালতে কোন মামলা বা অভিযোগ ছিলো না বা নেই। তারা হানাদারদের সহযোগি বলেও কোন দালিলীক তথ্য প্রমাণ এখন পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি। এমনকি আজকে যারা বিচারের জন্যে কারার”দ্ধ আর যাদের বির”দ্ধে বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়েছে স্বাধীনতার পর ৪২ বছর অতিবাহিত হয়েছে, তারা বাংলাদেশে বিগত ৩৩/৩৪ বছর যাবৎ জামায়াতে ইসলামীর নামেই রাজনীতি করে আসছে।
বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সহ আইডিয়েল নামে নির্বাচন করে ২০টি আসন লাভ করেছিলো। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক ভাবে অংশ গ্রহণ করে ১০ টি আসনে জিতেছিলো। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বৈরাচারী এরশাদ হটাও আন্দোলন ও কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করেছিলো। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে ১৮টি আসনে জয় পেয়েছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ও বিএনপির অধীনে জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ সহ সকল দল ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিলো। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি হটাও আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সাথে থেকে আন্দোলন করে ও তাদের পরামর্শে তিনশ আসনে নির্বাচন করে তিনটি আসন লাভ করেছিলো। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৭টি ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুইটি আসনে জিতেছে।
জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে দেশের কোথাও কোন থানায় বা আদালতে তাদের বির”দ্ধে একটিও হত্যা, ধর্ষণ, লুট-পাট, জ্বালাও পোড়াও বা দুর্নীতির অভিযোগ কেউ দায়ের করেনি। বরং তাদের সততার দৃষ্টান্ত দেশবাসীর নিকট স্পষ্ট। চারদলীয় জোট সরকারে জামায়াতে ইসলামীর দু‘জন মন্ত্রী ছিলেন। সেনা সমর্থিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সকল মন্ত্রী এমপি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তুু জামায়াতে ইসলামীর এই দুই মন্ত্রী চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, যদি এক টাকারও দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারে তা হলে রাজনীতি ছেড়ে দেবো আর যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নেব। কারো পক্ষে তাদের দুর্নীতি প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মাওলানা আবুল কালাম আজাদের অনুপস্থিতিতে তার বিচার সম্পন্ন করে তার বির”দ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বির”দ্ধে একই রকম অপরাধের বিচারের রায় হয়েছে যাবজ্জীবন ও পনের বছরের কারাদণ্ড! আবার তথাকথিত অপরাধের ধরন একই রকম হওয়ার পরও বিশ্ব নন্দিত আলেমে দ্বীন, মুফাস্সিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায়ে শাস্তি হয়েছে মৃত্যুদণ্ড! অবশ্য ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান রায়ের সার সংক্ষেপ পাঠ করার আগে বলেছেন, আমরা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বা সাবেক সংসদ সদস্য, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় দিচ্ছিনা, রায় দিচ্ছি ৪২ বছর পূর্বে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ের দেলওয়ার সিকদারের অপকর্মের বিচারের রায়!? এ সকল রায়ে কি প্রমাণ হয়নি যে বিচার বিভাগ বিতর্কের উর্ধ্বে নয়?
বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভারতের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান উভয়দেশের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে ও সিমলা চুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিলেন। বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের ঐক্যের জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন আর যারা গুর”তর অপরাধে অপরাধী তাদের বিচার করলেন, শাস্তি দিলেন। ঐ তিন শ্রেণীর বা ক্যাটাগরীর মধ্যে যাদের নাম ছিল না, বাংলাদেশের কোথাও কোন থানা বা আদালতে যাদের বির”দ্ধে কোন মামলা বা অভিযোগ নেই বা ছিল না। ৪২ বছর পর শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে বিচারের নামে রাজনৈতিক হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাকে বলে ঔঁফরপরধষ শরষষরহম.
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশসহ গোটা বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, আন্তর্জাতিক জুডিস কাউন্সিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সংস্থার পাশাপাশি তুরস্ক, মিশর, ইরান, সৌদী আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ড, জার্মান, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্র সহ আরো অনেক দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের মৌলিক অধিকার ও জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। আর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ এর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখারও আহ্বান জানিয়েছে। সরকার অবশ্য এদেরকেও প্রতিপক্ষ ভাবতে শুর” করেছে। সরকার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর বির”দ্ধে অভিযোগ তুলে বলছে এরা একপেশে ও সরকারের বির”দ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। শুধুমাত্র প্রতিবেশী একটি দেশের আশ্রয়ই যেন সরকারের শেষ ভরসা বলে মনে হচ্ছে। আর প্রতিবেশী দেশও যেন বাংলাদেশে সংঘাত আর সংঘর্ষ জিইয়ে রাখতেই চাইছে। তা না হলে বর্তমান সংঘাত ও সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে তাদের উচ্চমহলের আনা-গোনার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে কেন? ভারতের রাষ্ট্রপতি তার সফরের মাধ্যমে কি বুঝাতে চেয়েছেন?
ঔঁফরপরধষ শরষষরহম এর মাধ্যমে একটা আদর্শবাদী দলের শীর্ষ নেতাদের ধ্বংস করা করা হবে আর কর্মীরা চুপচাপ বসে থাকবে তা হয় না। যেমন বিশ্ব নন্দিত আলেমে দ্বীন, মুফাসস্েির কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় ঘোষণার আগে অবশ্য ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের রায়ের সার সংক্ষেপ পাঠ করার আগে বলেছেন, আমরা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বা সাবেক সংসদ সদস্য, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় দিচ্ছিনা, আমরা রায় দিচ্ছি ৪২ বছর পূর্বে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ের দেলওয়ার সিকদারের অপকর্মের বিচারের রায়! এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে এই দেলওয়ার সিকদার? রাজাকার দেলওয়ার সিকদার ওরফে দেইল্লা, পিতা রসুল সিকদার, গ্রাম- চিলা সিকদার বাড়ী, থানা, সদর জেলা, পিরোজপুর। যিনি একজন প্রকৃত রাজাকার ও বর্তমান আওয়ামী ওলামা লীগের নেতা মোছলেম মাওলানার একনিষ্ঠ সহযোগি ও অনেক অপকর্মের নায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করেছেন। সেই দেলওয়ার সিকদার ওরফে দেইল্লা রাজাকারের অপকর্মের দায়ভার আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ঘাড়ে চাপানো হয়েছে! এটা মেনে নেয়া যায় না।
মিরপুরের বিহারী আকতার বাহিনীর সদস্য বিহারী কাদের ওরফে কাদের কসাইয়ের ১৯৭১ সালের সকল অপকর্মের দায় ভার চাপানো হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ঘাড়ে। আবদুল কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়ই তার গ্রামের বাড়ীতে মুদি দোকান করে কাটিয়েছেন। তিনি তার এলাকায় সদরপুরে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংও নিয়েছিলেন।
সরকারের এধরনের উদ্ভট ঔঁফরপরধষ শরষষরহম এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রায় আদায়ের লক্ষ্যে আর মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে শাহবাগে নাস্তিকদের রঙ্গ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। যেখান থেকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল (স.) ও আলেম ওলামাদের বির”দ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর বির”দ্ধে আলেম ওলামা তৌহীদি জনতা যখন সোচ্চার তখন সরকারের কুটকৌশল বাস্তবায়ন করতে হিটলার আর চেঙ্গিস খানের মতো মানুষ হত্যার নেশায় মেতে ওঠেছে। গোয়েবলসের মতো মিথ্যাচার করছে। মেকিয়াভেলীর মতো ধোকা-প্রতারণা আর যেখানে যেমন খুশি সাজছে।
গত ১১ মার্চ নয়াপল্টনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে। সমাবেশ চলাকালিন হঠাৎ ককটেল বিস্ফোরণ! পরে রাস্তায় আগুন? এরপর পুলিশের এ্যাকশন! সভা পন্ড। বিএনপির দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের তাণ্ডব। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে অফিসের বিভিন্ন কক্ষের দরজা ভেঙ্গে নেতা-কর্মীদের যেভাবে আটক করা হলো পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশে তা কি কল্পনাও করা যায়? এ ঘটনাটি ফ্যাসিবাদী ও নাৎসি শাসনকে ম্লান করে দেয়নি?
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে বিরোধীদল বিএনপি পাবলিক সেফটি কমিটি গঠন করার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের বিশিষ্ট জনেরা এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট কলামিষ্ট ফরহাদ মাজহার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন সাংগঠনিক রূপ দিয়েছেন। বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যাপারে সাবেক সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড: আকবর আলী খান বলেছেন, সঙ্কট নিরসনে বড় দুই দলকে অবশ্যই সমঝোতায় আসতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমান সংঘাত, সংঘর্ষ ও সঙ্কটের কারণে দেশের স্বাধীনতা টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ডাকসুর সাবেক জিএস ও ছাত্রনেতা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে জটিল উল্লেখ করে বলেন, উত্তরণের জন্যে সম্মিলিত ভাবে চেষ্টা করতে হবে। বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড: তৌহীদ সিদ্দিকীর মতে, যারা জ্ঞানী ও জিনকে জানে তারা আল্লাহকে মানে। আর যারা আল্লাহকে মানে তারা মাতৃভূমিকে ভালোবাসে। অতএব এ মূহুর্তে সকল ঈমানদারদের ঐক্য প্রয়োজন। কারণ সরকার দেশে অঘোষিত কারফিউ জারি করে মসজিদ মাদরাসা অবর”দ্ধ করে রেখেছে। রাজপথের তৌহীদি জনতার ওপর গুলী চালিয়ে পাখির মতো গণহত্যা করে দেশকে চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের তৌহীদি জনতা আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ সহ বিরোধীদলের প্রাণের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের পরামর্শে সরকার পারে এ সংঘাত সংঘর্ষ ও সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নাস্তিকতা এখন চরমপন্থার নাম



 নাস্তিকরা নিজেদেরকে মুক্তমনের অধিকারী, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, পরমতসহিষ্ণু, উদার ইত্যাদি গুণের অধিকারী বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় নাস্তিকরা চরমভাবে আত্মকেন্দ্রিক, হতাশ, সংশয়বাদী, পরমত বিদ্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তারা কোনোভাবেই ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চরমপন্থা গোঁড়া ধর্মীয় মৌলবাদী চরমপন্থিদেরকেও হার মানায়। এর বাস্তব উদাহরণ হলো বর্তমান শাহবাগী নাস্তিক ব্লগারদের চরমপন্থি কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ কোনোদিনই বামধারার রাজনীতি বন্ধের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি। কিন্তু বাম রাজনীতিবিদরা সবসময়ই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের পাঁয়তারা করেছে। শাহবাগীরা প্রথমে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে রাজপথে নেমে এলেও শেষ পর্যন্ত তা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ এবং এর সাথে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবিকে মুখ্য করে তোলে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে দেশছাড়া করার মতো জাতিদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শাহবাগীরা শুধু মানবতাবিরোধীদের বিচার নয়; বরং সকল ইসলামী ব্যক্তিত্বকে নির্মূলের ষড়যন্ত্রে উঠেপড়ে লাগে। তারা সহিংস শ্লোগানের মাধ্যমে  দেশব্যাপী সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়। তারা কোমলমতি শিশু-কিশোরদেরকে জবাই করার মন্ত্র শেখায়। তাদের প্রতিটি কথা ও কাজ চরমপন্থাকে এমনভাবে উস্কে দেয় যে বিগত কয়েক দিনেই বাংলাদেশে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। তাদের চরমপন্থি আন্দোলনের কারণেই দেশে সাম্প্রতিক গণহত্যা, মসজিদ তালাবদ্ধ করা, দেশের বিভিন্নস্থানে ১৪৪ ধারাসহ রাজধানীতে অঘোষিত কারফিউ জারি করা থেকে শুর” করে সংখ্যালঘুদের প্রতি আক্রমণের মতো ঘটনাও ঘটে যায়।
বাংলাদেশে নাস্তিকদের দুটি রূপ দেখা যায়। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি গ্র”প রয়েছে যারা ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিকতা অনুশীলন করে। তারা নিজেদের নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা দিতে লজ্জাবোধ করে না। আর একটি গ্র”প রয়েছে রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা নাস্তিকতা চর্চা করে কিন্তু জনগণের ভোটের আশায় নিজেদের নাস্তিকতা প্রকাশ করে না। এরাই মুনাফিক। এরা অন্তরে নাস্তিকতা পুষে মুখে নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে দাবি করে। এরা ইসলামের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ। এরূপ নাস্তিকরাই বর্তমানে শাহবাগে জমায়েত হয়েছে। তারা ব্লগ, মিডিয়া, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করেও দেশের অধিকাংশ মানুষের ঈমান হরণ করতে পারেনি। তাই তারা এখন চরমপন্থা বেছে নিয়েছে। সাধারণ ঈমানদারদেরকে হত্যা করে দেশে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার খেলায় মেতে উঠেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে নাস্তিকদের এরূপ চরমপন্থার হাজারো প্রমাণ হাজির করা যাবে।
নাস্তিকরা বলে বেড়ায় যে, গোঁড়া ধার্মিকরা নাকি অনেক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। এটা ইতিহাস না জানার ফল। এককালে খৃস্টান চার্চ বিজ্ঞানীদের হত্যা করে কিন্তু ইসলাম বিজ্ঞানের জ্ঞানকে বিকশিত করে। কিন্তু নাস্তিকরাই ধার্মিক বিজ্ঞানীদেরকে বয়কট করছে, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে এবং তাদেরকে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে। এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে টিউলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ জে. টিপলারের ওপর তাদের জঘন্য আচরণের কথা। ধর্ম সম্পর্কে টিপলারের সাহসী উচ্চারণের ফলে নাস্তিকরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। জ্যোতিঃপদার্থের ওপর বক্তব্য রাখার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মিউনিখ-এর ম্যাক্স প্ল্যাংল্ক ইনস্টিটিউটের এক সেমিনারে। কিন্তু তার ‘দি ফিজিক্স অব ইমমর্টালিটি’ গ্রন্থটি প্রকাশের পর তারা সে আমন্ত্রণ বাতিল করেছিল। এ হলো নাস্তিকদের সৌজন্যবোধ ও ভদ্রতা! তারা স্বাধীন মতপ্রকাশের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্মকাণ্ড মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্ব করছে।
টিপলার যখন জ্যোতিঃপদার্থবিদ হিসেবে ক্যারিয়ার শুর” করেন তখন ছিলেন কট্টর নাস্তিক। তাকে দিয়ে ধর্মতত্ত্বের মূল দাবিগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হবে, এ কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। অথচ বাস্তবে তাই দেখা গেল তার ‘দি ফিজিক্স অব ইমমর্টালিটি’ গ্রন্থে। তিনি বললেন, ‘বিজ্ঞানীদের এখন বাতিল ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়ে পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। এখন সময় এসেছে ধর্মতত্ত্ব¡কে পদার্থবিদ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার।’ তিনি ‘ওমেগা পয়েন্টে’ স্বীকার করলেন, ‘স্বর্গ আছে, আছেন আল্লাহ’।

অতীতে আইন করে ধর্মপালনে বাধ্য করার কথা শোনা গেলেও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত অবস্থা। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা আইন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মপালনে বাধা সৃষ্টি করছে। ধর্মের নামে যেমন কারো স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে ক্ষুণ করা যায় না, তেমনি বিজ্ঞানের নামেও কারো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ভ্রƒকুটি করা উচিত নয়। কিন্তু নাস্তিকরা পরিকল্পিতভাবে ধর্মের বির”দ্ধে যুদ্ধে নেমেছে? তারা যুক্তি দিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে ধর্মের কাছে হেরে গেছে, ফলে বিকল্প উপায়ে আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছে। তারা ধর্মের বির”দ্ধে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞানই মানুষকে আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনের যৌক্তিক উপাদান সরবরাহ করছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার ও  উন্নতির ফলে ধর্মের অনেক জটিল বিষয় এখন মানুষের বোধগম্য হচ্ছে, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে যা এতোদিন সবার বোধগম্য ছিল না।
সমাজতন্ত্র হলো নাস্তিকতার সামাজিক ফল। মার্কস, এ্যঙ্গেলস ও লেনিনসহ কমিউনিস্ট শাসকরা নাস্তিকতাকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তারা সবাই ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে নিরীশ্বরবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং আর কোনো নতুন কৌশল না পেয়ে বিশ্বাসীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়েছিলেন। মসজিদ-মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
লেনিন সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা নিয়ে ধর্মকে নির্মূলে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি পৃথিবীকে স্বর্গ বানাতে ও ধর্মকে নির্বাসনে পাঠাতে প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিল। কিন্তু তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল যে, পৃথিবীতে তারাই স্বর্গ রচনা করতে পারে যারা আকাশমার্গে স্বর্গ রচনা করতে চায়। যারা আকাশমার্গে স্বর্গ রচনা করতে চায় না, তারা শুধু পৃথিবীতে নরকই রচনা করে। লেনিনের ফাঁকাবুলিতে পৃথিবীতে স্বর্গ রচিত হয়নি, বরং আশ্চর্যজনকভাবে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। এ পতনের প্রধান কারণ ছিল ‘বিশ্বাসের সংকট’। এ প্রসঙ্গে প্যাট্রিক গ্লাইন লিখেছেন, কমিউনিজমের পতনের কারণগুলো খুঁজতে গেলে ঐতিহাসিকদের কাছে এটা আরো স্পষ্ট হবে যে, সোভিয়েত অভিজাতশ্রেণী নিরীশ্বরবাদী ‘বিশ্বাসের সংকটে’ ভুগছিল। একটি নিরীশ্বরবাদী আদর্শের অধীনে বাস করে, যে আদর্শ অনেকগুলো মিথ্যার ওপরে এবং ওই মিথ্যাগুলো একটি ‘বড়’ মিথ্যার ওপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিলÑ সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা সকল অর্থেই নীতিভ্রষ্টতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছিল। দেশটির জনগণ-শাসকগোষ্ঠীসহ হারিয়ে বসেছিল সব ধরনের নীতি-নৈতিকতার ধারণা এবং আশা।
অতীতে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে ধর্মীয় চেতনা বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার যাঁতাকলে ধর্মীয় চিন্তা-চেতনাকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও এই চেতনাকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখা গেলেও একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। খোদ রাশিয়াতে ধর্মবিরোধী অভিযান ব্যাপকভাবে পরিচালনা করা সত্ত্বেও মানুষের মনে ধর্মীয় চেতনা প্রবল হয়েছিল। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ রীতিমত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা ধর্মপালনের অনুমতি দিয়েছিল। এটা আরো স্পষ্ট হয়েছিল মিখাইল গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচিতে। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি নৈতিক সংস্কার কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট শব্দমালা ব্যবহার করে জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারছেন না। তাই তিনি ধার্মিক না হয়েও জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ভাষণে স্রষ্টার নাম উল্লেখ করতে শুর” করেছিলেন। বর্তমানে কমুনিস্ট চীনেও এই নীতি অনুসৃত হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সরকারিভাবেই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
তুরস্কে ইসলামী সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে ধ্বংস করার জন্য কামাল আতাতুর্ক ঐতিহ্যবাহী খেলাফত ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে ধর্মহীনতার মোড়কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রবর্তন করেছিল। নিজের খায়েশ পূরণের জন্য মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বিচারের নাটক মঞ্চস্থ করে প্রতিপক্ষের অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী চিন্তাবিদকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছিল। অনেককে নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সামরিক জান্তার হাতে প্রদান করা হয়েছিল। ইসলামী রাজনীতিকে ঠেকাতে গিয়ে কামাল আতাতুর্ক মানুষের প্রার্থনার ভাষা কেড়ে নিয়েছিল। তার সময় থেকে ও পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তুরস্কে আরবি ভাষায় কুরআন পড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নামাজে কুরআন অনুবাদ করে পড়া হত। সেসময় নামাজকে বলা হত ‘ফাইভ টাইমস অব প্রেয়ার্স’, আজানকে বলা হত ‘কল ফর প্রেয়ার’। শুধু আরবিতে আজান দেয়ার অনুমতি দানের জন্য সাবেক এক তুর্কি প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েব এরদুগানকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তখন তিনি আঙ্কারার মেয়র ছিলেন।
নাস্তিকরা এতোই অসহিষ্ণু যে, অন্য মতকে তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। যুক্তির দৌড়ে হেরে গেলে পরমত দমনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালায়। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ গ্রন্থে যখন বললেন, আল্লাহ আমাদের মতো প্রাণী সৃষ্টি করবেন বলেই তিনি মহাবিশ্বকে এমন করে সাজিয়েছেন। তার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাস্তিকরা প্রতিবাদ করলেন এ বলে যে, ‘তারা বিজ্ঞানী হলেও মাঝে-মধ্যে অন্ধ-বিশ্বাসে নতজানু।’ আইনস্টাইনের ঈমান নিয়েও কথা তুলেছিল তারা। আজো তার লেখার বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর দিয়ে নাস্তিকতার দলিল খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদকে টেনেটুনে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রকৃতপক্ষে চার্লস ডারউইন একজন ‘ক্রিয়েটারে’ (স্রষ্টায়) বিশ্বাস করতেন।
নাস্তিকদের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে অনেক বিজ্ঞানী ঈমানকে গোপন রাখতে হয়েছিল কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে আল্লাহর অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছেন এবং জীবনের সব কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা ও দুঃখ প্রকাশ করছেন। ইংল্যান্ডের এমনি একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ‘রোমানেস’। তিনি মৃত্যুর আগে স্বীকার করে গেছেন যে, তার বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক চিন্তাধারা মূলত ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর অস্তিত্বকে মেনে নেয়া ছাড়া এ মহাবিশ্বকে কোনোভাবেই বুঝানো যায় না।’
প্রখ্যাত ইংরেজ রসায়নবিদ ও পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে এক্ষেত্রে আরো একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সারা জীবন নিজস্ব থিউরি নিয়ে কাজ করেছেন এবং সৃষ্টি সম্পর্কে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অথচ কোনো এক সহকর্মী তাকে মৃত্যুশয্যায় যখন প্রশ্ন করলেন, ‘ফ্যারাডে’ এখন আপনার ধারণা কি? মৃত্যুপথযাত্রী প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘ধারণা’? না আমার কোনো ধারণা নেই। আল্লাহকে ধন্যবাদ আমাকে আর কোনো ধারণার উপর নির্ভর করতে হবে না। আমি জানতে পেরেছি যাকে বিশ্বাস করতাম। জানতে পেরেছি, আমি যা কিছু করেছি তিনি তা সংরক্ষণ করবেন। এমনিভাবে উল্লেখ করা যায় অসংখ্য বিজ্ঞানীর কথা, যারা আল্লাহর প্রতি অত্যন্ত বিনয়ী। অন্ধবিশ্বাস নয়, বংশ-সূত্রে নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাই তাদেরকে এ পথে নিয়ে এসেছে।
নাস্তিকরা নিজেকে যুক্তিবাদী বলে দাবি করলেও আসলে তারা তা নয়; বরং তারা সংশয়বাদী ও হতাশাবাদী। নাস্তিকতার পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এ প্রসঙ্গে সহস্রাধিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের রচয়িতা বিশ্বের অন্যতম ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আনড্রু কনওয়ে আই. ভি. বলেন, ‘আল্লাহ নেই’ এ প্রকল্পকে প্রমাণ করা যায় না। নাস্তিকরা আল্লাহকে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু তাদের অস্বীকারের পক্ষে কোনো যুক্তি পেশ করতে পারেননি। এমনকি আল্লাহর অনস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো গুর”ত্বপূর্ণ আলোচনাও আমার নজরে পড়েনি। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে অনেক যুক্তিসমৃদ্ধ ও তথ্যনির্ভর রচনা আমি পড়েছি এবং তা নিয়ে গবেষণা করেছি। আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপনের কারণে মানুষের কল্যাণ এবং তাকে অস্বীকার করার কারণে মানুষের অকল্যাণ আমি প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব বিজ্ঞানকে নাস্তিকতার পক্ষে ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং আধুনিক বিজ্ঞানের নিত্যনতুন গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণকেই সুদৃঢ় করছে।
নাস্তিকদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ডঃ মরিস বুকাইলি বলেন, বস্তুত, সব যুগে সব দেশেই ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ ধরনের লোক থাকে। ‘জ্ঞানপাপী’ বা ‘পণ্ডিতমূর্খ’ বলে পরিচিত লোকদেরকেও সমাজে সদম্ভে বিচরণ করতে দেখা যায়। কিন্তু মুষ্টিমেয়সংখ্যক ওই ধরনের লোক যাই বলুন বা যাই ভাবুন, আধুনিক যুগের তথ্য-উপাত্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে এমন যুক্তিপ্রমাণই প্রদান করছে, যা মানুষকে অবিশ্বাসী করা তো দূরে থাক বরং আল্লাহর প্রতি অধিকতর বিশ্বাসী হওয়ারই শিক্ষা দিচ্ছে। এটি আরো বেশি সম্ভব হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব গবেষণা ও আবিষ্কারের দর”ন।
নাস্তিকরা শত জুলুম ও নির্যাতন দিয়ে কোনোকালেই ধর্মীয় চেতনাকে মুছে দিতে পারেনি। কেননা, প্রত্যেক মানুষ ধর্মীয় চেতনা (ফিতরাত) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ইসলামের এই অমোঘ বাণীর সঙ্গে পাশ্চাত্যের মনস্তত্ত্ববিদরাও একমত হয়ে স্বীকার করেছেন যে, ধর্মীয় চেতনা মানবাত্মার ‘চতুর্থ দিগন্ত’।, মানবদেহের যেমন চারটি দিগন্ত রয়েছে : দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা ও গতি, তেমনি মানবমনেরও রয়েছে তিনটি স্বভাবগত প্রবণতা : যৌনতা, মান-সম্মান ও ধন-সম্পত্তি লাভের বাসনা এবং ধর্মীয় চেতনাবোধ।’ মানুষের মনে ধর্মবিশ্বাস কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়নি, তা পুরোহিতদের বানানোও নয়, বরং তা হলো মানুষের স্বভাবগত বিষয়। ফলে কোনোদিনই ধর্মীয় চেতনাকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এমন অভয় পতনের বড় কারণ হতে পারে



দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। অনুরাগ-বিরাগের বদলে সুশাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ব্যাপারে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ক্ষমতার শেষ বছরটিতে এসেও সরকার অঙ্গীকারের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। বরং সরকারের প্রশ্রয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাত্রা বেড়েই চলেছে। সংখ্যালঘুদের ওপরও চলছে আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতন। নির্বাচনের এই বছরটিতে যেখানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গণবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, সেখানে তারা গণবিরোধী ও দৃষ্টিকটু তৎপরতায় এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে কেমন করে? দেশটা যে কোনো দল বা পরিবারের নয়, বরং ষোল কোটি মানুষের সে কথা কি তারা ভুলে গেছেন ক্ষমতার দম্ভে? বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা জনগণের ভোটের ওপর নির্ভরশীল। এমন বাস্তবতায় নির্বাচনের ওপর আস্থাশীল কোনো গণতান্ত্রিক দলের নেতা-কর্মীরা আচার-আচরণে এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে কেমন করে?
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন ন্যায়নিষ্ঠার বদলে চাতুর্যের কৌশলকেই মুখ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টিও উল্লেখ করা যেতে পারে। একদিকে তারা সংখ্যালঘুদের ভয়-ভীতি ও নির্যাতনের মাধ্যমে নিজেদের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করছে, অপরদিকে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের দায় জামায়াত-শিবির বা বিএনপি’র উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের ইমেজ নষ্ট করতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কুমারখালীতে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খানের সশস্ত্র লোকজন সংখ্যালঘু পরিবারের উপর হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাংচুর, নির্যাতন ও লুটপাট করেছে। গত মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগের এ হামলার পর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দয়ারামপুর গ্রামে চার শতাধিক লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পত্রিকার পাতায় সংখ্যালঘুদের উপর সরকার্ িদলের লোকজনের হামলা, জুলুম ও নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের উপর জুলুম-নির্যাতনের ঘটনায় চোখ বন্ধ করে জামায়াত-শিবির বা বিএনপি’র উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে থাকে, আর নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিবাদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে যায়। কথা ও কাজে গরমিলের এমন উদাহরণ সরকার কিংবা সরকারি দলের জন্য মোটেও কল্যাণকর বলে বিবেচিত হতে পারে না।
ক্ষমতার দম্ভ কিংবা চাতুর্য যে সবকিছুর নিয়ামক হতে পারে না, এ কথা বোধ হয় এখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভুলে গেছেন। জামায়াত-শিবির কিংবা বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়ন ও নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে তারা হেনস্তা করতে চান সে কথা আমরা জানি। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বা বন্ধুদের উপর হামলা চালাতেও তারা কুণ্ঠিত নয়। কোথাও কেউ মতের বিপরীতে গেলে কিংবা কোনো স্বার্থে হানি ঘটলে তারা যে কোনো নিষ্ঠুর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এমন ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে কেরানীগঞ্জে। কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা ইউনিয়নের পূর্বপাড়ায় এক কলেজ ছাত্রসহ দুই যুবককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে চোখ তুলে নিয়েছে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আলী হাসান উজ্জ্বল। এ ঘটনায় পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘ছাত্রলীগ বন্ধু হলে অন্ধ হতে হয়’।, আওয়ামী লীগ বা ছাত্র লীগের মধ্যে নেতা-কর্মীদের জন্য আদর্শিক, নীতি-নৈতিকতা কিংবা কর্মকৌশলের ব্যাপারে প্রশিক্ষণের কি কোনো ব্যবস্থা নেই? নেতা-কর্মীদের মনোনয়ন কিংবা পদোন্নতির ভিত্তি কি? প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও বিভিন্ন অপকর্মের যেসব খবর মুদ্রিত হয় তাতে তো সরকার ও সরকারি দলের লজ্জা পাওয়ার কথা। ভোটের সময় জনগণের কাছে মুখ দেখানোর বাধ্যবাধকতার কারণেও তো সরকারি দলের সংস্কারমূলক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। বরং আত্মপক্ষ সমর্থনের সাথে সাথে বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাই অব্যাহত রয়েছে। আইন-আদালত, পুলিশ কিংবা প্রশাসনকে সরকারি দলের লোকজন এখন মোটেও ভয় পায় না। এমন অভয় যে তাদের পতনের বড় কারণ হতে পারে, সে বিষয়টি সরকারি ঘরানার লোকজন এখন উপলব্ধি করতে পারছে না। ফলে জনগণের সাথে তাদের দূরত্বই শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে না, জনসমর্থন থেকেও তারা হচ্ছে বঞ্চিত। বিষয়টি তারা যত দ্র”ত উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অপরাধের বিচার ও শাহবাগ মঞ্চ


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা ছিল ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। অথচ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতেও এ অঙ্গীকার ছিল না। ২০০৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে একটি প্রস্তাব পাস করে। সে মোতাবেক সরকার বিচারপ্রক্রিয়া আরম্ভ করে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ বিচারপ্রক্রিয়াকে দলীয়করণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনি প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলে আওয়ামী লীগ। তারা এককভাবে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়ক বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়। তারা এককভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, বিচারপতি, তদন্তকারী ও প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহায়ক ব্যক্তিদের যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য দু’টি আইন প্রণয়ন করা হয়। একটি ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আইন ’৭৩ এবং অপরটি হলোÑ দালাল আইন। প্রথম আইনে বিচারের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের মধ্য থেকে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। দালাল আইনে এ দেশের বেসামরিক সহায়তাকারীদের প্রায় লাখখানেক মানুষকে আটক করা হয়েছিল। তাদের প্রায় ৩৫ হাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ১০ হাজারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযোগ গঠন করা হয়। প্রায় সাত হাজার ব্যক্তির বিচার করা হয়; ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় একজনকে। এরপর বঙ্গবন্ধু চারটি অপরাধে অভিযুক্তদের ছাড়া বাকি সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন।
বর্তমানে সংশোধিত যুদ্ধাপরাধী আইনটি আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য বারবার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার কোনো কারণ ছাড়াই এসব প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে। সরকার এসব নিরপেক্ষ ও খ্যাতিসম্পন্ন সংস্থাকে উপেক্ষা করে তাদের কথিত ‘আন্তর্জাতিক’ বিচারকে অভ্যন্তরীণ বিচার এবং যুদ্ধাপরাধকে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধ বলে ঘোষণা দেয়। এসব কারণে বিচারিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়। সরকার বিচারব্যবস্থাকে এই দলীয়করণ এবং একলা চলো নীতি গ্রহণ সত্ত্বেও এখন তারা বিএনপির প্রতি আবদার করছে তাদের কার্যক্রমে সমর্থন করার। তাদের ধামাধরা মিডিয়া আর দলান্ধ সুশীল ব্যক্তিরা বিএনপিকে নানাভাবে নিন্দিত করতে সচেষ্ট দেখা যায়। নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে তাদের শক্তিশালী মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
যেসব গুরুতর অপরাধের জন্য কিছু ব্যক্তিকে বিচারাধীনে আনা হয়েছে, তা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শেখ মুজিব চারটি গুরুতর অপরাধের অপরাধী ছাড়া আর সবাইকে মাফ করে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এসব অভিযুক্ত ব্যক্তির মাধ্যমে খুন, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্য অপরাধ হয়ে থাকলে স্বাধীনতার প্রথমলগ্নে এসব অভিযোগ উত্থাপন হওয়ার কথা পূর্বোক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এদের অনেকে বারবার বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং বিপুল ভোটে জিতেছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীও হয়েছেন।
স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের পর প্রমাণিত হয়েছে, কিভাবে সরকার অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে সচেষ্ট। তারা এমনকি বিচারকদের প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট ছিল। স্কাইপ কেলেঙ্কারির হোতা বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সরকার একটি ফাঁসির রায় চায়।’ আসামিপক্ষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। সেফহোমের কর্মকাণ্ড, সাক্ষীদের দীর্ঘ দিন সেখানে অবস্থান এবং ১৫ জন সাক্ষীর অনুপস্থিতিতেই তাদের সাক্ষ্য হিসেবে পুলিশ ইনস্পেক্টরের পেশ করা লিখিত বক্তব্য গ্রহণ, আসামিদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী গুম হয়ে যাওয়া (আদালতের সামনে থেকে) এবং এ ব্যাপারে সরকারের রহস্যময় নিঃস্পৃহতা ইত্যাদি কারণে সচেতন মানুষের মনে নানা সন্দেহের উদ্রেক স্বাভাবিক।
এত দিন দু’টি ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কাজ চলছিল। প্রথম ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হকের বিদেশে অবস্থানরত কোনো এক জিয়াউদ্দিনের সাথে স্কাইপ সংলাপের দরুন এবং তাদের এ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে প্রথম ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর রায় দিতে দেরি হয়ে যায়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল একটি রায়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে ফাঁসি দেন। অন্যটিতে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়। এ রায় আওয়ামী ও বাম মহলের পছন্দ হয়নি, তাই তারা তাদের ব্লগারদের মাধ্যমে শাহবাগ চত্বরে একটি আন্দোলনের সূত্রপাত করে। প্রথমে বামপন্থী গোষ্ঠী প্রধান ভূমিকা রাখে, পরে ছাত্রলীগ মঞ্চ দখল করে নেয়। তারা তাদের এ নাটককে ‘বাংলার মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলন’ হিসেবে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হলো। এতে তাদের পক্ষের সব টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এসব মিডিয়ার প্রপাগান্ডায় একটি অতিরঞ্জিত ইমেজ সৃষ্টি পরিকল্পিত হয়। পরে ব্লগারদের নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আসল চেহারা জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চে সরকারের সর্বাত্মক সহায়তা, ফ্রি খাবার এবং গানবাজনা, নাটক দিয়ে বেশ কিছু মানুষকে সেখানে উপস্থিত করাতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ লোকসংখ্যা বাংলার ১৬ কোটি মানুষের কত শতাংশ! ফাঁসি চাই, জবাই করোÑ দাবিগুলোর মাধ্যমে সরকার নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রশ্রয় দিয়েছে। উসকানি দিয়ে দেশে হানাহানি ও সহিংসতার ব্যাপ্তি ঘটাচ্ছে। ছোট শিশুদের দিয়ে এসব হিংসাত্মক স্লোগান উচ্চারণ করিয়ে তাদের সহিংসতায় দীক্ষা দেয়া হচ্ছে। ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে দুই শিশু প্রাণ হারিয়েছে।
কোনো কোনো মন্ত্রী পর্যন্ত গণজাগরণ মঞ্চের সাথে তাল মিলিয়ে বিরোধী সংবাদপত্রকে হুমকি দিচ্ছেন। নাস্তিক ব্লগারের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে বিভ্রান্তি ছড়াতে নানারকম মিথ্যা যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। কে ইসলামবিরোধী এবং কে ইসলামের পক্ষের, তার ফতোয়াও দেয়া শুরু করে দিয়েছেন মন্ত্রীরা।
কয়েকজন ব্লগারের সাম হোয়ার ইন, মুক্তমনা, ধর্মকারী, নূরানীচাপা সমগ্র প্রভৃতি ব্লগে ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মক আঘাত এবং আদালত অবমাননার কারণে এসব ব্লগ বন্ধ করে চিহ্নিত ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রাতুল সারওয়ার ও ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন। শুনানির পর গত বছর ২১ মার্চ রিট আবেদনটি গ্রহণ করে উচ্চ আদালত ‘মহান আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারী ব্লগগুলো কেন স্থায়ীভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হবে না’ মর্মে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। আদালত ওই সব ব্লগ ও ব্লগারের বিষয় অনুসন্ধান করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিটিআরসি, র‌্যাব, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতি নির্দেশনা এবং রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পিটিশনে উল্লেখ করা ওয়েবসাইট ব্লগগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশও দিয়েছিলেন। আওয়ামী সরকার এ ব্যাপারে একবছরেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এখন উল্টো এদের রক্ষার্থে নানা রকম অপকৌশল আঁটছে। অন্য দিকে সরকার আলেম-ওলামা ও ধর্মবিশ্বাসীদের এ ব্যাপারে প্রতিবাদের জন্য হতাহত করছে। ঢিলের বিপরীতে গুলি ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে। স্বঘোষিত নাস্তিকের প্রতি ‘শহীদ’ খেতাব আরোপ করতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একটুও ইতস্তত করছেন না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনীতির নতুন লাঠিয়াল


বাংলাদেশের একশ্রেণীর গণমাধ্যম সাংবাদিকতার নীতিবর্জিত এমন সব উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে, যা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। কয়েক সপ্তাহ ধরে পুলিশের গুলিতে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। যারা হত্যার শিকার হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে ‘তাণ্ডবের’। তাণ্ডবকারীরা নিজেরা কিভাবে মারা যাচ্ছে তার উত্তর নেই কোথাও। অন্য দিকে কথিত তাণ্ডবকারীদের কেউ হত্যার শিকার হচ্ছে না; এরা ‘মৃত্যুবরণ’ করছে। অর্থাৎ পুলিশের গুলিতে মারা গেলে সেটা হত্যা নয়; তাদের ভাষায় ‘মৃত্যু বা নিহত’ হওয়া।

‘তাণ্ডব’ শব্দটি যখন স্বরূপে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেড়ে নিলো ৩০ জনের প্রাণ। মিডিয়ার ‘তাণ্ডব’ শব্দের গোমর ফাঁস করে দিলো শক্তিশালী টর্নেডো। টর্নেডোয় নিহত মানুষের প্রতি সারা দেশের মানুষের মতো আমরাও শোকাভিভূত। আমরা প্রার্থনা করি এ ধরনের নির্মম টর্নেডো আর যেন বাংলাদেশে কখনো কোনো জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে না যায়। শব্দটি এবার উপহাস করল বাংলাদেশের টোটাল মিডিয়ার কপটতাকে। ইট-পাটকেল নিক্ষেপকারী, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া এবং ভাঙচুরকারী রাজনৈতিক কর্মীদের কর্মকাণ্ডকে বর্তমান সরকারের আমলে মিডিয়া ‘তাণ্ডব’ বলে চিহ্নিত করে। অথচ এর আগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে গাড়ি পুড়িয়ে ডজন মানুষ হত্যার ঘটনাও ছিল। সে ঘটনা মিডিয়া ‘তাণ্ডব’ বলে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করেনি। তখন সেটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে প্রকাশ করেছে। এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টর্নেডো মিডিয়াকে শিক্ষা দিয়ে গেল ‘তাণ্ডব’ কাকে বলে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পুলিশ পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্যতম এলাকা। সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানোদের মধ্যে একটি শিশু হোটেল শ্রমিকও রয়েছে। শিশুটি বিুব্ধ মানুষের মিছিল দেখার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছিল। পুলিশের নির্বিচার গুলি তার ছোট্ট শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। দেশের প্রধান একটি দৈনিক সাতকানিয়া হত্যাকাণ্ডের ফলোআপ স্টোরি করেছে ‘২০ হাজার গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা’ শিরোনামে। পুলিশের গুলিতে নিহত মানুষ, তাদের আত্মীয়স্বজন এবং আহত হওয়া শত শত মানুষকে বাদ দিয়ে গাছের স্টোরিটি পাঠককে অবাক করেছে। গাছেরও প্রাণ আছে। তারাও কষ্ট পায় প্রমাণ করেছেন আমাদের বিজ্ঞানী জগদিশ চন্দ্র বসু। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার গাছ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু গাছ কখনো মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে মানুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে এ প্রথম আমরা দেখলাম। কিন্তু সে স্টোরিটির বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
শিরোনামে বলা হয়েছে ২০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর সাথে যে ছবিটি দেয়া হয়েছে তা সন্দেহ সৃষ্টি করবে। দুইটি গাছ মাটি থেকে ফুটখানেক ওপরে করাত দিয়ে কাটা। এর এক পাশে বড় একটি গাছ সমূলে দণ্ডায়মান। অন্য পাশে দু’টি গাছ সমূলে দণ্ডায়মান। শিরোনামে ২০ হাজার গাছ নিধনের খবর জানার পর পাঠক ছবিতে পাঁচটি গাছের মাছখানে দু’টি কাটা গাছ দেখছে। তার মনে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ২০ হাজার গাছের মধ্যে এমন একটি ছবিও পাওয়া গেল না যেখানে অন্তত ডজনখানেক গাছ কাটা হয়েছে তা দেখা যাচ্ছে।
একই পত্রিকা সাতক্ষীরায় ১৩ জন মানুষ প্রাণ হারানোর পর ফলোআপ স্টোরি করে এক আহত আওয়ামী লীগ নেতার করুণগাথা নিয়ে। বগুড়ার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে অফিস আদালত ভাঙচুর। এ জেলায়ও এক ডজনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। একই পত্রিকা পুলিশের নির্বিচারে মানুষ হত্যার পর থেকে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপসনালয়ে হামলা ও আগুন দেয়ার খবর নিয়মিত ছবিসহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে একই ছবি ও ঘটনা একাধিকবার প্রথম পাতায় প্রকাশ করেছে। কিন্তু এসব খবর তৈরিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক ভাব যতটা প্রকাশ পেয়েছে তার ধারেকাছেও ছিল না নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের আর্তি। ছিল না অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আহ্বান। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই মন্তব্য করে বসেছে জামায়াত-শিবির এসব কাজ করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করা হচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অনেক অভিযোগ খোদ এ দলটির বিরুদ্ধে এসেছে। সংখ্যালঘু নিয়ে যে খেলা তাতে মিডিয়ার বড় অংশটিকে সরকারের পক্ষের খেলোয়াড় হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ পাঠক-দর্শক-শ্রোতার চোখ আরো স্পষ্ট করে চোখ খুলে দিয়েছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দল ঢাকায় কোনো কর্মসূচি পালন করলে মিডিয়ার প্রধান খবর হয় রাজধানীর মানুষের দুর্ভোগ। কর্মসূচিতে যত মানুষই হোক না কেন যানজট থেকে সৃষ্ট দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে মিডিয়া। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মানুষের উপস্থিতির কারণে সেই যানজট সৃষ্টি হতো। অন্য দিকে মাওলানা মাসউদ যে ‘মহাসমাবেশ’ করেছেন সেখানে মানুষের বিপুল উপস্থিতির কারণে নয়; পুলিশ ঢাকা শহরের বড় একটি অংশকে ফ্রিজ করে দেয় সেটিকে নির্বিঘেœœ সম্পন্ন করার জন্য। প্রথম আলো প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে বলেছে মাসউদের ‘মহাসমাবেশে’ দুই হাজার মানুষ হয়েছে। মানবজমিন এ সংখ্যাকে কোনোরকমে এক হাজারের বেশি হবে না বলে জানিয়েছে। ঢাকা শহরের বিশাল একটি এলাকাকে পুলিশিবলয় তৈরি করে যানচলাচলে যে সমস্যা সৃষ্টি করা হলো তা নিয়ে ওই সব মিডিয়াকে সংবাদ করতে দেখা গেল না। মাসউদের ‘মহাসমাবেশকে’ টিভি চ্যানেল লাইভ কাভার করেছে। যদিও তাদের ক্যামেরার চোখ ওপরের দিকে ওঠাতে পারেনি। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে সৃষ্ট যানজটকে জনভোগান্তি হিসেবে যেসব মিডিয়া বাড়িয়ে দেখায় তারা মাসউদের জনসমর্থনহীন ‘মহাসমাবেশ’ থেকে পুলিশের সৃষ্ট জনভোগান্তির কোনো সংবাদই করল না। একই অবস্থা দেখা গেছে শাহবাগ নিয়েও। দু’টি বড় হাসপাতালের রোগীদের দেড় মাস ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে শাহবাগের কারণে। দিনের পর দিন শ’কয়েক ব্লগারের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে রাজাধানীর প্রাণকেন্ত্রের ট্রাফিক ব্যবস্থা।
এখন পাঠক জনমিতি পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শাহবাগ প্রকৃতপক্ষে পাঠকের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী একটি উপাদান হিসেবে কাজ করছে। শাহবাগ কপট ও ভণ্ডদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। বেশির ভাগ মিডিয়া যাদের বিরুদ্ধে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনতে চাচ্ছে পাঠক সেসব মিডিয়ার দিকেই ঝুঁকছে। টেলিভিশনের টিআরপি (পাঠক দর্শক জরিপ) ফলাফলে এ ইঙ্গিত পাওয়া যচ্ছে। কাগজ খারাপ দাম বেশি যেসব পত্রিকার সেগুলোর পাঠক হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। দাম কম চমৎকার কাগজ ও বেশি পৃষ্ঠা দিয়েও অনেক পত্রিকার সার্কুলেশন পড়ে যাচ্ছে দ্রুত। পাঠকেরা একটা জিনিস জানিয়ে দিলো তারা সত্যিটা জানতে চায়। সে ক্ষেত্রে তারা পচা কাগজের পত্রিকা অনেক বেশি দাম দিয়েও কিনতে প্রস্তুত।
ঘটনার সঠিক বর্ণনা তুলে ধরা সংবাদমাধ্যমের কাজ। পরিস্থিতি বর্ণনার পর সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরবে তারা। এ কাজটি করার সময় কোনো পক্ষের অংশ হবে না তারা। শাহবাগের কথিত আন্দোলনকে ঘিরে মিডিয়ার বড় অংশ স¤পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। খবর প্রকাশের ধারেকাছে না গিয়ে বেশির ভাগ মিডিয়া একটি অযাচিত আবেগ দেখিয়েছে। কয়েক শ’ অ্যাক্টিভিস্টের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দাবিকে জাতির আকাক্সা বলে ঢালাও সংবাদ প্রচার করে। শাহবাগ ও মিডিয়ার একাকার হয়ে যাওয়ার দুটো দিক ছিল অত্যন্ত লজ্জার। একটি হচ্ছে, উগ্র কাভারেজ প্রদান। এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রচারণা পৃথিবীতে কখনো দেখা যায়নি। অনেকে হয়তো হিটলারের প্রপাগান্ডা ওয়ারের কথা বলবেন। এক মাসব্যাপী দৈনিক পত্রিকা শাহবাগ নিয়ে ব্যানার হেডিং করেছে। প্রথম পাতার ওপরের অংশে টানা শাহবাগের ছবি ছাপিয়েছে। একটি পত্রিকা প্রথম পাতার পুরোটি পোস্টার ছাপায়। মোমবাতি প্রজ্ব¡লনের ছবি ছিল সেটি। অর্ধপাতা ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হওয়ার ঘটনা বিরল। সেখানে প্রতিদিন আমরা ছাপিয়ে গেলাম।
এখন একজন সিটিং রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর কাভারেজ পাঠকের চোখ খুলে দিলো। ফাঁসি দাও, খতম করো, উৎখাত করোÑ এ স্লেøাগানে আন্দোলনকারীদের এক মাসেরও বেশি সময় উগ্র কাভারেজ দেয়ার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর কিভাবে দিলো পাঠকেরা সেটি ভালো করে লক্ষ করেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর প্রথম পাতায় আড়াই কলাম জায়গা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান সুশীল পত্রিকা যারা বলেছিল, ‘শাহবাগ বাংলাদেশের প্রাণভোমরা’ তারা দিলো তিন কলাম জায়গা। পত্রিকার আট কলাম জমিনের মধ্যে সিটিং রাষ্ট্রপতি মরে গিয়ে যদি তিন কলাম পান তাহলে সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর নাই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এর মাধ্যমে এ সম্ভাবনাও দেখা গেল আসল ইস্যু বাদ দিয়ে মিডিয়া যেকোনো সময় একটা অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক ইস্যুকে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে। মিডিয়া নিয়ে দেশের মানুষ এখন রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত।
শাহবাগের ঘটনাটি দুটো পক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। এখন মানুষ এসব মিডিয়াকে চিহ্নিত করেছে ষড়যন্ত্রের অংগ্রহণকারী মিথ্যুক হিসেবে। বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এ ধারণার জন্ম নিয়েছে সরকার ব্যর্থতা ঢাকতে সস্তা আবেগ উসকে দিয়ে শাহবাগ সৃষ্টি করেছে। জনগণের দাবি দাওয়ার পরিবর্তে কিছু সাম্প্রদায়িক দাবি সেখান থেকে উচ্চারিত হওয়ায় এ ধারণা জনগণের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে। মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল এ যড়যন্ত্র জনগণের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া। উল্টো এরা এ ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়ে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধুলায় মিশিয়ে দিলো।
অন্য বিষয়টি আরো বিস্ময়কর। সংবাদমাধ্যমের অর্থনীতি ব্যতিক্রম। দৈনিক পত্রিকার কপি বিক্রি করে এর খরচ ওঠে না। পত্রিকার দাম এবং এর উৎপাদন খরচের মধ্যে বড় ফারাক থাকে। সরকার পত্রিকায় ব্যবহৃত কাগজের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে। আবার সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেকটা সহযোগিতা করে। বর্তমান সরকারের আমলে আমার দেশ, নয়া দিগন্তসহ ভিন্নমতের পত্রিকা এ সুবিধা পায় না। এসব পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন না দিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপরও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর বাইরেও পত্রিকাকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপন আয় প্রয়োজন হয়। মিডিয়া লাভজনক ব্যবসায় হয়ে ওঠা কঠিন। দেশের দুই ডজনের মতো টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অতীব সত্য। শুধু উগ্র কাভারেজ দিয়ে নয়, অবিশ্বাস্যভাবে কয়েকটি মিডিয়াকে শাহবাগ জমায়েতে আর্থিক সহযোগিতা দিতেও দেখা গেছে। পাঠকেরা এখন সন্দেহের মধ্যে পড়েছে মিডিয়ার অর্থের উৎস নিয়ে।
কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল শাহবাগকে দিনের পর দিন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। লাইভ অনুষ্ঠানের স্পন্সর কারা তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। পাঠকের ওপর জোর করে তারা শাহবাগীদের চাপিয়ে দিয়েছে। কথিত প্রজন্ম কী করছে তা দেখতে পাঠকদের বাধ্য করা হয়। খবর প্রচারে এমন রঙ চড়ানো হয় যা ছিল উদ্ভট ও অবিশ্বাস্য। মানবজমিন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মাত্র কয়েক শ’ মানুষের সমাগমকে লাখ মানুষের সমাবেশ বলে চালিয়ে দেয় মিডিয়া। টেলিভিশন অবশ্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শান্তশিষ্ট সৎ নির্মোহ চরিত্রকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। খুনিদের মাফ করে দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার পরও তাদের কাভারেজ উগ্র পত্রিকাগুলোর চেয়ে ভালো বলতে হবে। তবে ২৪ ঘণ্টা লাইভ প্রচার করে কয়েক শ’ মানুষকে লাখো মানুষ বলে জালিয়াতি করা এসব টিভিকে একজন সিটিং রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর কয় ঘণ্টা প্রচার করা উচিত ছিল সেই প্রশ্নটি পাঠক করতে পারে।

মিডিয়ার বড় অংশটি এখানে থেমে থাকেনি। শাহবাগের ফ্যাসিবাদী আচরণের সহযোগী হয়ে সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও ভিন্নমতের সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছে। আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, দিগন্ত টেলিভিশন কথিত আন্দোলনকারীদের মনঃপূত সংবাদ কাভারেজ দেয়নি। টোটাল সংবাদমাধ্যমের একটি ুদ্র অংশ এরা। শাহবাগ থেকে নির্দেশ দেয়া হয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চড়াও হওয়ার জন্য। এরপর নয়া দিগন্ত অফিসে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। দৈনিকটির গাড়ি পুড়িয়ে দেয়, আগুন দেয় প্রেসে। আমার দেশ ও নয়া দিগন্তের কপিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পত্রিকা দু’টি বিক্রি করতে গিয়ে হকাররা মারধরের শিকার হন। দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় দেশের অনেক জায়গায়। দুর্ভাগ্য এ সময় মিডিয়ার বড় পক্ষটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ছিল একেবারে চুপ। পাঠক, হকার ও সংযোগদাতারাই দুর্বৃত্তদের রুখে দিয়েছে। সাংবাদিক কমিউনিটির বড় অংশটি বরং শাহবাগীদের অপরিণামদর্শী জঘন্য কার্যক্রমের পক্ষে অবস্থান নেয়।
সরকার ও মিডিয়ার সহযোগিতা নিয়ে শাহবাগে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় আমার দেশ প্রথম তা খোলাসা করে প্রকাশ করে দেয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে চরমভাবাপন্ন ব্লগারদের ব্যবহার করা হয় শাহবাগ আয়োজনে। আয়োজকদের মধ্যে ছিল খুনি ও নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য এবং রাজাকার পরিবারের সদস্যও। পত্রিকাটি তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। সরকার এবং মিডিয়ার বড় অংশ এ অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বদলে তাদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা নেয়। এমনকি মিডিয়া জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে যে, শাহবাগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। অপপ্রচারটা কী সে তথ্যপ্রমাণ অবশ্য হাজির করতে পারেনি তারা।
বাপ্পাদিত্য বসু লাশের ওপর নৃত্য করছেন এমন ছবি প্রকাশ করে আমার দেশ। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হাজির করে নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়ার। তার আগেই কয়েকজন ব্লগারের ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের প্রমাণ প্রকাশ হয়। অভিযুক্তরা কেউ নিজেদের নির্দোষ দাবি করেনি। তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে আদালতে যায়নি। কিন্তু শাহবাগ মঞ্চকে ব্যবহার করে সরাসরি সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে খতম করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। এক দিন-দু’দিন নয়; কয়েক সপ্তাহ ধরে এরা এ অপরাধটি করেছে। মঞ্চটিকে সব সময় ঘিরে রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য। এরা কেউ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারও মঞ্চের অপরাধী নেতাদের সাথে সুর মিলিয়েছে। শাহবাগের ব্লগাররা মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়ার পরিবর্তে অপরাধীদেরই আশ্বাস দেন যে, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার জন্য সরকার আইনি প্রক্রিয়া খুঁজে দেখছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো যখন দেখা গেল মিডিয়াও সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিলো সরাসরি। আরো অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটালেন কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। তারা অপরাধীদের অপরাধ বিষয়ে কোনো সংবাদ করলেন না। বরং তারা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। তারা এ সাহসী সংবাদিককে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করল।
আন্দোলনকারীদের ব্যানারে সংগঠিত হওয়া অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করছে যে গুটিকয় মিডিয়া তাদের বিরুদ্ধে এখন হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনার চেষ্টা আমরা দেখলাম। একটি শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক এ ধরনের একটি অভিযোগ নিয়ে দিনের প্রধান সংবাদ করে বসে। যে সংবাদটিকে হলুদ সংবাদ বলছে সেটি স্ক্যান করে বসিয়ে দেয় তারা। তাদের অভিযোগ যুদ্ধারপাধের বিচার বিঘিœœত করার জন্য এসব মিডিয়া হলুদ সাংবাদিকতা করছে। সরকার সাধারণত ঢালাওভাবে সব আন্দোলন সংগ্রামকারীদের যুদ্ধাপরধের বিচার বিঘিœœত করার জন্য অভিযুক্ত করে আসছে। এ কৌশলটি তিন বছর ধরে দেশের মানুষ দেখছে। যে সংবাদটি প্রকাশের জন্য হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনা হয় সেটি ভুলবশত ঘটেছে বলে একটি সংশোধনীও মাস কয়েক আগে অভিযুক্ত পত্রিকাটি প্রকাশ করে। এরপরও সেই খবরটি নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনা কতটা সঙ্গত। যারা ‘উৎখাত করো’ স্লেøাগানের আন্দোলনকারীদের মাসাধিককাল ব্যানার হেডিং করল, অর্ধেক পৃষ্ঠাজুড়ে ছবি ছাপিয়ে উগ্র কাভারেজ দিলো তাদের নিজেদের নৈতিক অবস্থান এর মাধ্যমে আরো ধসে গেল।
হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ উত্থাপনকারী ইংরেজি পত্রিকাটি নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যা নিয়ে এমন বানোয়াট প্রতিবেদন প্রকাশ করল যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথটিও খোলা রাখল না। আমার দেশ ত্বকী হত্যা নিয়ে পত্রিকাটির স্টোরিগুলো ছাপিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার ন্যক্কারজনক অপচেষ্টা প্রমাণ করে দিয়েছে। যে তথ্যপ্রমাণ আমার দেশ উপস্থাপন করেছে তার বিরুদ্ধে ইংরেজি পত্রিকাটি কোনো যুক্তিপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বেগম জিয়ার বক্তব্য নিয়ে কুতর্ক


‘দু’জন ইংরেজ এক হলে গড়ে একটি কাব, দু’জন স্কচ একত্র হলে খোলে একটি ব্যাংক, দু’জন জাপানি করে একটি সিক্রেট সোসাইটি। দু’জন বাঙালি একত্র হলে করে কী? দলাদলি? তা করে এবং বোধ হয় একটু বেশি মাত্রায়ই করে।’Ñ এই কথাগুলো আমার নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যে যাযাবর নামের এক লেখকের আবির্ভাব হতে দেখেছি। বলা যায়, এই লেখকের আবির্ভাব ছিল বাংলা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় ঘটনা। এ লেখকের প্রথম বই ‘দৃষ্টিপাত’ প্রকাশিত হওয়া মাত্র বাঙালি শিক্ষিত সমাজে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি অভূতপূর্ব। তার বিমুগ্ধ পাঠক সম্প্রদায়ের অনেকেই আজো এই বইয়ের অনেক লাইন, অনেক অংশ প্রসঙ্গক্রমে উদ্ধৃত করেন। বস্তুত, তার নতুন গদ্যরীতি ও অভিনব রচনাশৈলী ও সেই সাথে তার সমাজদর্শনের চমৎকারিত্বে ভরপুর, ‘দৃষ্টিপাত’ বাংলা রম্যরচনার ক্ষেত্রে এক ট্রেন্ডসেটার পথিকৃতের আসন দখল করে আছে। ওপরের লাইন কয়টি যাযাবরের সেই ‘দৃষ্টিপাত’ বই থেকেই নেয়া। তার এই লাইন কয়টি বাঙালি চরিত্রের যথার্থ উন্মোচন বললে ভুল হবে না।

এই লাইন কয়টি মনে পড়ল সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার সেনাবাহিনী সম্পর্কিত একটি বক্তব্য নিয়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এর অহেতুক দলান্ধ প্রতিক্রিয়া আর বিতর্কের ঝড় দেখে। ঘটনার সূত্রপাত গত ২৪ মার্চ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এতে সাঈদী ভক্তরা এই রায় ঘোষণার পরপর সারা দেশে বিুব্ধ হয়ে ওঠেন। দলমত নির্বিশেষে সাঈদী ভক্তরা রাস্তায় নেমে এলে সারা দেশে দেড় শতাধিক মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছয়-সাতজন পুলিশও মারা যায় পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের সময়। এ সময় পুলিশের গুলিতে বগুড়ায় ১৪ জন এবং জয়পুরহাটে সাত জন নিহত হন। বিুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে পুলিশের গুলি চালিয়ে এই দেড় শতাধিক মানুষ হত্যাকে বিরোধীদলীয় নেতা গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। পুলিশি নির্যাতন এখনো থামেনি। তখন এসব বিক্ষোভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাতনামা কয়েক লাখ সাধারণ গ্রামবাসীকে আসামি করে বিুব্ধ এলাকায় চলছে পুলিশের মামলা-হামলা ও ধরপাকড়ের বাণিজ্য। সাথে সরকারি দলের ক্যাডারদের উপস্থিতিও রয়েছে সেখানে। এভাবে গণহারে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর পুলিশি হামলার ফলে এখনো অনেক স্থানে গ্রামবাসী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। নিহত হচ্ছে নিরীহ গ্রামবাসী। সর্বশেষ ঘটনায় গত পরশু চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে তিনজন এবং সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের নির্বিচারে ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধের সময় তারা পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানাতে সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া উত্তরাঞ্চল সফর করেন। তিনি গত ২৪ মার্চ বগুড়া ও জয়পুরহাটে বেশ কয়েকটি শোকসভায় যোগ দেন। ওই দিন দুপুর ১২টায় বগুড়ার মাটিঢালি বিমান মোড়ে এক বিশাল শোক সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, গত ৩ মার্চ এ সরকারের পেটুয়াবাহিনী নৃশংসভাবে এই এলাকার নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ যাদের হত্যা করেছে, তারা কোনো দলের নয়। তারা সাধারণ মানুষ। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৭০ জনকে হত্যা করেছে। এ এক গণহত্যা।
আমরা জানি, মার্চের প্রথম সপ্তাহে বগুড়ায় এই জনবিক্ষোভ ছিল খুবই পরিব্যাপক। সরকারের র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। মূলত বগুড়ার জনসভায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করতে গিয়েই খালেদা জিয়ার সেদিনের ভাষণে সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গটি আসে। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘এ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বগুড়ার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। মা-বোনেরা লাঠি-ঝাড়– নিয়ে নেমেছিল। তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। সেনাবাহিনী এসেছিল। তারা জনগণের পক্ষে ছিল। তাই তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। কারণ তারা গুলি করেনি। দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব আছে। এভাবে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। তারা সঠিক সময়ে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করবে। বিদেশে শান্তি মিশনে তারা দায়িত্ব পালন করেছে। অন্য দেশের শান্তি রক্ষায় তারা বিদেশে যায়। যে দেশের সেনাবাহিনী অন্য দেশের শান্তি রক্ষায় বিদেশে যায়; কিন্তু নিজ দেশে শান্তি নেই বিষয়টি দেখে বিদেশীরা বলবে, তারা শুধু বিদেশীদের শান্তি রক্ষা করতে পারে। কাজেই চিন্তার বিষয় আছে। সবাইকে চিন্তা করতে বলব। সেনাবাহিনী দেশের শান্তি রক্ষায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় না থেকে সঠিক সময়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করবে।’
সেদিন সেনাবাহিনী সম্পর্কে বেগম জিয়ার এটুকুই বলা। এখানে বেগম জিয়ার বক্তব্যের মর্মার্থ হচ্ছে, সম্প্রতি সারা দেশে পুলিশ ও র‌্যাবের গুলিতে দেশের দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণ গেল, সেখানে বগুড়ায় বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী নামলেও তারা জনগণের ওপর পুলিশের মতো গুলি চালায়নি। তারা সঠিক ভূমিকা পালন করে জনগণের ওপর গুলি না চালিয়েও সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। বেগম জিয়া বলেছেন, সেনাবাহিনী সঠিক কাজটিই করেছে। এ জন্য তিনি সেনাবাহিনীর প্রশংসাও করেছেন এবং তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, সেনাবাহিনী দেশের শান্তি রক্ষায় সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করবে। তার এ আশাবাদ প্রকাশে দোষটা কোথায়? কিন্তু সরকারি দলের নেতারা এবং সেই সাথে সরকার-সমর্থক কিছু গণমাধ্যম বেগম জিয়ার বক্তব্যের মনগড়া মর্মার্থ উদঘাটন করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নানা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা বলছেন, বেগম জিয়া তার এ বক্তব্যের মাধ্যম সেনাবাহিনী উসকে দিচ্ছেন। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানল শুধু এই বিষয়টিকে টকশোর একমাত্র অনুষঙ্গ করে শুধু সরকার সমর্থক আলোচকদের এনে একতরফাভাবে এ কথা প্রমাণ করার অপপ্রয়াসও চালিয়েছে যে, বেগম জিয়া তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়েছেন। জনৈক আওয়ামী ভক্ত লেখক একটি ইংরেজি দৈনিকে কলাম লিখে বলার চেষ্টা করছেন, বেগম জিয়া স্পষ্টত ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের ৩১তম বর্ষপূর্তির এই সময়ে সেনাবাহিনীকে বর্তমান নির্বাচিত সরকারের ওপর হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জালিয়েছেন এবং এটি ডেমোক্র্যাসির জন্য একটি প্যাটেন্ট থ্রেট। তার ভাষায়  Khaleda Zia tells the courts that the army is there to sort out the present elected government ….. This pretty clear invitation to the army to step in, and that too on the thirty first anniversary of the coup d’etat which brought general Hussein Mahammed Ershed to power in 1982, is a patent threat to democracy.)। তিনি এখানেই থামেননি। তিনি আরো লিখেছেনÑ গণতন্ত্রের প্রতি এ ধরনের হুমকি ১৯৭৫ সালে উচ্চারণ করেছিলেন ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ জয় প্রকাশ নারায়ণ। তখন গান্ধীবাদী এই রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য। এই লেখকের মতে, কোনো পপুলার ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার এ ধরনের হুমকি উপেক্ষা করতে পারে না। তাই মিসেস গান্ধী প্রয়োজনীয় কাজটি করেছিলেন। তিনি এই হুমকির কারণে জরুরি অবস্থা জারি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি জয় প্রকাশ নারায়ণকে গ্রেফতার করেছিলেন। অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা সঠিক ছিলেন। সে ব্যক্তি যত বড়ই হোন, কোনো বিবেচ্য নয়। (এ কথাগুলো তিনি বলার চেষ্টা করেছেন এভাবেÑ  It was just such a threat to democracy which the elderly Joyprokash Narayan held out in India in 1975 that impelled Indira Ghandi in to impose a state of emergency in the country. JP, as the Gandhian was popularly known, had publicly used the Indian army to act against the government. Since no government based on a popular mandate and underpinned by self esteem can ignore such a threat, Mrs. Gandhi did what she needed to do : She placed JP under arrest. There were many who protested the action, butIndia’s Prime Minister was right; no matter highly placed, how powerful a historical icon, the moment he incited on organised force against a legitimate government, he had to be stopped. Joyprakash Narayan was stopped to every ones relief.)।
এটুকু লিখে এই লেখক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্পষ্টত দু’টি ব্যাপারে প্ররোচিত করেছেন কিংবা উসকে দিয়েছেন: এক. এই মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাতে হবে এবং দুই. আর দেরি না করেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে। জয়প্রকাশ নারায়ণের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে জয়প্রকাশ নারায়ণকে গ্রেফতার করে এবং ভাবতে জরুরি অবস্থা জারি করে যেমন সঠিক কাজটি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, ঠিক তেমনি শেখ হাসিনাকেও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার ও জরুরি অবস্থা জারির কাজটি করতে হবে। খালেদা জিয়াকে অবশ্যই থামাতেই হবে। জয়প্রকাশকে থামিয়ে ইন্দিরা গান্ধী যেমন জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনাকে খালেদা জিয়াকে থামিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার তাগিদটিই দিলেন। ওই লেখকের উদ্দেশে বলা দরকারÑ ইন্দিরা গান্ধীর ওই জরুরি অবস্থা জারি ও জয়প্রকাশ নারায়ণের গ্রেফতারের কাল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ইন্ধিরা গান্ধীর কংগ্রেসের কী ধরনের ভরাডুবি ঘটেছিল, তা কী ওই লেখকের স্মরণে আছে। তখন তার ‘পপুলার ম্যান্ডেট’ জনরোষে ভেসে গিয়েছিল। আজ ওই লেখক বর্তমান সরকারের পপুলার ম্যান্ডেটের জনপ্রিয়তার পারদমাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে; তা উপলব্ধিতে আনলে ভালো হয়। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, কুমিল্লা আইনজীবী সমিতি ও এলেঙ্গা পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল চিত্র লক্ষ করলে সে উপলব্ধি করার বিষয়টি সহজ হবে। এসব নির্বাচনের ফলাফল দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না সরকারের জনপ্রিয়তা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আরেকটি বিষয়, ওই লেখক এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রসঙ্গটি এখানে টেনে এনে তিনি বোঝাতে চাইছেন,  এরশাদ তখন ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রের ওপর যে আঘাত করেছিলেন, আজ এর ৩১ বছর পর বেগম জিয়া সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে গণতন্ত্রের ওপর তেমনি হুমকি সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ওই লেখকের স্মরণে থাকা উচিত, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরশাদ সরকারের ক্ষমতা দখলের সময় তিনি অখুশি নন বলে দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন।
এই লেখক আরো অনেক কিছুর মাঝে সবশেষে বলতে চেয়েছেন, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এ ধরনের উসকানিদাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। সেই সাথে তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশকে এটুকু নিশ্চিত করা যে, তারা চান কোনো দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ যেন দায়িত্বহীন বক্তব্য না দেন কিংবা কোনো দায়িত্বহীন কাজে লিপ্ত না হন। ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যে বেগম খালেদা জিয়া ‘সেনাবাহিনীকে দেশের শান্তি রক্ষায় নীরব দর্শকের ভূমিকা না থেকে সঠিক সময়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করবে’ এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে কোনো অপরাধ করেছেন বলে মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, তিনি এখানে সেনাবাহিনীকে শান্তি রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা পালনের প্রত্যাশাটুকুই কামনা করেছেন। কিন্তু আমরা দেখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী নিয়ে কিংবা সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ করে যেসব কথা মাঝে মধ্যেই বলেন, তাতে এক ধরনের উসকানির উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। গত ২৮ মার্চ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাকুঞ্জে সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় বলেছেনÑ ‘আর যেন কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তি সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকার সশস্ত্রবাহিনীকে কোনো অবস্থাতেই কোনোরূপ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার হতে দেবে না। আপনারা দেখেছেন, কিছু রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সমগ্র দেশে হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে একাত্তরের মতো তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র চাই, নাকি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্র চাই।’
বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের বিরোধী দলগুলো সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির জন্য এক ধরনের উসকানি দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর জেনারেল কনফারেন্সে সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধীদের যেকোনো কর্মকাণ্ড সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে। তিনি সেনাকর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, স্বার্থান্বেষীরা যেন আপনাদের পিঠে সওয়ার হতে না পারে।
এ ধরনের বক্তব্য সেনাবাহিনীতে বিরোধী দল সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই অনাকাক্সিত। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কী করে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এ ধরনের বক্তব্য রাখতে পারেন? আসলে এ ধরনের বক্তব্য কার্যত সেনাবাহিনীকে দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের খোলাখুলি আহ্বানের শামিল নয় কি? তার এ ধরনের বক্তব্য সেনাকর্মকর্তাদের বিরক্তির কারণ হয়নি, তাই বা কী করে বলা যায়। তবে এটুকু আন্দাজ করা যায়। সেনাবাহিনী একটি পেশাদার, সুশৃঙ্খল বাহিনী বলেই সেনাকর্মকর্তাদের কারো পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অনাকাক্সিত বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই।
দেশের মানুষ চায় দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক। সেনাবাহিনী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পেশাদারির ভিত্তিতে পালন করুক। রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ কারো কাম্য নয়। সেনাবাহিনী কোনো দলের পক্ষে নয়, আবার কোনো দলের বিপক্ষেও নয়! তাই সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল কারো পক্ষেই সেনাবাহিনী নিয়ে এমন কিছু বলা উচিত নয়, যা সেনাবাহিনী নিয়ে অহেতুক কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
কখনো কখনো গণমাধ্যমে কিছু কিছু অতি উৎসাহীজনেরাও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা চালান। বেগম জিয়ার বগুড়ায় দেয়া সেনাবাহিনী সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক তেমনি একটি অপপ্রয়াস। এ ক্ষেত্রে সমালোচনার উপাদান প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে থাকলেও সে সম্পর্কে তারা নীরব। স্পষ্টত সেনাকর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন সব বক্তব্য রাখেন, যার মাধ্যমে তিনি সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন যে, বিএনপি একটি অগণতান্ত্রিক শক্তি। এই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেকাতে সেনাবাহিনীকে সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ধরনের বক্তব্য সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের পরোক্ষ আহ্বান বললে ভুল হবে না। গত ২৮ মার্চ ও ৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এর প্রতিফলন রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আওয়ামীপন্থী বিভিন্ন মহল সব সময় নানাভাবে তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে জনমনে এমন একটি ধারণা দিতে চেষ্টা করেন, এ দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তি হচ্ছে বিএনপি আর একমাত্র গণতান্ত্রিক শক্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা বলার চেষ্টা করে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এ দেশে সামরিক শাসন আনার জন্য দায়ী শহীদ জিয়াউর রহমান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন তার নিজ দলের লোকদের হাতেই। তখন জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানও ছিলেন না। সেনাপ্রধান ছিলেন এমন ব্যক্তি, যিনি এখন আওয়ামী লীগের শীর্ষসারির নেতা। বঙ্গবন্ধু হত্যা-উত্তর সময়ে তাদের দলের লোকেরাই সরকার গঠন করে, দেশে সামরিক শাসন জারি করে। আর বঙ্গবন্ধুই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করে কার্যত গণতন্ত্রের ওপর কুঠারাঘাতের সূচনা করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের পটপরিবর্তনের আরো পরে সিপাহি জনতার এক অভ্যুত্থানের সূত্রে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। উত্তরাধিকার সূত্রে কার্যত তিনি সামরিক শাসনের অংশে পরিণত হন। এরপর তিনিই তার প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এ দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনেন। অবসান ঘটান সামরিক শাসনের। তবুও আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের কাছে জিয়াউর রহমান ও তার অনুসারীরা অগণতান্ত্রিক শক্তি। কারণ, তিনি জাতিকে শুদ্ধ রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ভুল জাতীয়তাবাদের বেড়াজাল থেকে জাতিকে বের করে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের শুদ্ধ সূত্রের সূচনা করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির শুদ্ধায়নের নেতা।
আজ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকেও চিহ্নিত করার প্রয়াস চলছে অগণতান্ত্রিক শক্তির চর্চাকারী এক নেত্রী হিসেবে। বলা হচ্ছে, বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর পিঠে চড়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন। বেগম জিয়া সামরিক শক্তিকে রাজনীতিতে ডেকে আনছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। তিনি আপসহীন নেত্রী বলে খ্যাত হয়েছেন জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের আপসহীন বিরোধিতা করে। অথচ যে আওয়ামী লীগ আজ নিজেকে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে প্রমাণ করতে ব্যস্ত, সেই আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার হাত মিলিয়েছেন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের সাথে। আগের দিন ‘যারা এরশাদের নির্বাচনে যাবে’ তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ উক্তি করে পরের দিন এরশাদের নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার ইতিহাস তো শেখ হাসিনারই সৃষ্টি। তা এ দেশের মানুষের কাছে এখনো জায়মান উদাহরণ। আর আজ যখন বলা হচ্ছে, বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর পিঠে চড়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন, তখন জনধারণা হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বেগম জিয়া ক্ষমতাসীন হবে। তা ছাড়া এর আগেও তিনি তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তো নির্বাচনের মাধ্যমেই। অতএব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑ বেগম জিয়া কেন সেনাবাহিনীর পিঠে চড়ে ক্ষমতায় যেতে চাইবেন? আজ যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বেগম জিয়া ও তার দল বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার মুখে, তখন তিনি কেন সেনাবাহিনীকে উসকে দেবেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আছে কি? অতএব সেনাবাহিনীকে অনুষঙ্গ করে কেন নানামাত্রিক অপপ্রচার বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে?
সবশেষে একটি ছোট্ট কথা, আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের য়িষ্ণু জনপ্রিয়তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা সত্যি সত্যিই শঙ্কিত। তাই তাদের মুখে আজ উচ্চারিত হচ্ছে, কেয়ামত হয়ে গেলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া হবে না। দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। অথচ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আজ পরিণত হয়েছে এক জনদাবিতে। জনদাবি উপেক্ষিত হচ্ছে বলে আজ চার দিকে সরকারের বিরুদ্ধে লক্ষ করা যাচ্ছে জনপ্রতিরোধ। জনতা গুলি খেয়ে মরছে, তবু তাদের প্রতিরোধ থামছে না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণ


প্রতি বছরের মতো এ বছরও ২৬ মার্চে শেখ মুজিবের ১৯৭১-এর ৭ মার্চের রেকর্ড করা বক্তৃতা বাজানো হলো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। যার লক্ষ্য, এ দেশের মানুষকে ১৯৭১-এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। এই ভাষণ নিয়ে এ যাবৎ অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনা যে বস্তুনিষ্ঠভাবে হতে পেরেছে তা নয়। শেখ মুজিব তার এই বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কিন্তু সেই সাথে আবার এ কথাও দাবি করেছিলেন যে, তিনি (শেখ মুজিব) হলেন পাকিস্তানের  মেজোরিটি পার্টির নেতা। তিনি বলতে চাননি, তিনি কেবলই বাঙালিদের নেতা। এখন তার এই ভাষণ থেকে কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। তার এই ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু এই অংশটা এখন আর মানুষকে শোনানো হচ্ছে না। ভাষণটি ছিল বেশ কিছুটা স্ববিরোধী। তবুও অনেক বুদ্ধিজীবী বলছেন, এটি খুবই অর্থবহ ভাষণ। এর মধ্যে নাকি ফুটে উঠেছে হাজার বছরের বাঙালি চেতনা। ৭ মার্চ খুব সকালে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফার্ল্যান্ড। শেখ মুজিবকে ফার্ল্যান্ড বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যদি স্বঘোষিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন দেবে না। ফার্ল্যান্ডের এই বক্তব্য শেখ মুজিবকে প্রভাবিত করেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ৭ মার্চের ভাষণ দেয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে। ভাষণ দেয়ার পর শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা স্থগিত করে দেননি। ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা কেন ভেঙে গিয়েছিল, তা নিয়ে এখনো কেউ সেভাবে আলোচনা করছেন না। বিষয়টি হয়ে আছে রহস্যঘেরা। শেখ মুজিব আসলে গ্রেফতার হয়েছিলেন, না নিজেই চেয়েছিলেন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে, সেটা পরিষ্কার নয়। শেখ মুজিবের পরামর্শদাতা এবং আওয়ামী লীগের একজন প্রথম শ্রেণীর নেতা ড. কামাল হোসেন ভারতে না গিয়ে ইচ্ছা করেই চলে গিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ড. কামাল হোসেনকে ঘোষণা করা হয়েছিল পাকিস্তানের চর বা এজেন্ট হিসেবে। এম আর আখতার মুকুল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘চরমপত্র’ নামে ঢাকার আঞ্চলিক বাংলায় কথিকা প্রচার করতেন। এতে তিনি ড. কামাল হোসেনকে, যত দূর মনে পড়ছে, কয়েকবার উল্লেখ করেছিলেন- ‘কামাল্ল্যা’ নামে। যেটাকে আমার কাছে মনে হয়েছিল খুবই অশিষ্ট। কিন্তু পরে দেখা গেল শেখ মুজিব দেশে ফিরে ড. কামাল হোসেনকে করলেন তার মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম সদস্য। আর তাকে দিলেন সংবিধান রচনার ভার। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, মরহুম জিল্লুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু তিনি এই বেতার কেন্দ্র পরিচালনায় কতটা সক্রিয় ছিলেন, আমি তা বলতে পারি না। এই বেতার কেন্দ্র থেকে অনেকবার বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে ভিয়েতনামের গেরিলা যোদ্ধাদের মতো। কিন্তু পরে এটা বলা বন্ধ হয়। কারণ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভিয়েতনাম সম্পর্কে এভাবে বলা ভারত সরকার অনুমোদন করতে পারে না। ভারত সরকার কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিতে পারে না, ভারতের ভূভাগ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রচারণায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল কলকাতায়। যদিও দাবি করা হতো, এর অবস্থিতি হলো মুজিবনগরে। বলা হচ্ছে, মরহুম জিল্লুর রহমান সাহেব ছিলেন জয়বাংলা পত্রিকার সাথে যুক্ত। তিনি জয়বাংলা পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকলেও জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদনা করতেন না। জয়বাংলা ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকাটি চলত বেশ কিছুটা স্বাধীনভাবে। এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য অর্থের জোগান দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক গাজী উল হক। গাজী সাহেব বগুড়ায় অবস্থিত পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের শাখা থেকে প্রায় ৩২ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। এ থেকে সামান্য কিছু টাকা তিনি প্রদান করেছিলেন জয়বাংলা  পত্রিকা প্রকাশনার জন্য, এই জয়বাংলা  পত্রিকার অফিস ঘরের সাথে লাগোয়া একটা ছোট ঘরে বাস করতেন জিল্লুর রহমান। জয়বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল কলকাতার পার্ক সার্কাস নামক এলাকার বালু হক্কাক লেনে। এখানে আসতেন আওয়ামী লীগের অনেক এমএনএ। আলোচনা হতো নানা বিষয়ে। এমন এক আলোচনার কথা মনে পড়ছে আমার। ১৯৭১ সালের ৮ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জার এসেছিলেন রাওয়ালপিন্ডি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। রাওয়ালপিন্ডি থেকে কোনো একভাবে জিল্লুর রহমান সাহেবের কাছে এই বার্তা এসে পৌঁছেছিল। তিনি চাচ্ছিলেন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। কিন্তু তাজউদ্দীন এতে রাজি ছিলেন না। বেশ কিছু এমএনএ কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে চান ঢাকায়। কিন্তু ভারত সরকার তাদের আসতে দেয়নি। জিল্লুর রহমান সাহেবও কার্যত হয়ে পড়েন নজরবন্দী। আমি এসব কথা বলছি এই কারণে যে, শেখ হাসিনা বলছেন, জিল্লুর রহমান সাহেব ছিলেন তার একজন উপদেষ্টা। জিল্লুর রহমান সাহেবকে চিহ্নিত করা চলে না একজন চরমপন্থী নেতা হিসেবে। মনে হয়, শেখ হাসিনার নীতি আজ দেশকে এনে ফেলেছে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। আমার মনে হয় না, মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনাকে এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। একটি দেশে উদার গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আইন পরিষদ, প্রশাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে থাকতে হয় ক্ষমতার ভারসাম্য। কিন্তু বর্তমানে আমারা বিচার বিভাগের ওপর যেন চাচ্ছি অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে। এটা হয়ে উঠতে চাচ্ছে উদার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আমরা ভাবছি আইনের সার্বভৌমত্ব (Legal Sovereignty) নিয়ে। কিন্তু রাজনীতি শাস্ত্রে লোকায়ত সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty) বলেও একটি কথা আছে, যা শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চায় একটি দেশের রাজনীতির ধারাকে। আদালতের রায় গণসার্বভৌমত্বকে অতিক্রম করতে পারে না।

দেশে হরতাল হচ্ছে। হরতালকে বলা চলে গণযুদ্ধ। যুদ্ধ ভালো জিনিস নয়। যুদ্ধে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তবুও যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমাদের দেশেও যাচ্ছে না। আইন করে এই সমস্যার সমাধান আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কোনোখানে পড়েছিলামÑ ধর্মঘট অর্থনীতির ক্ষতি সাধন করে। কিন্তু যে ধর্মঘট অর্থনীতির কোনো ক্ষতি সাধন করে না, তা পেতে পারে না সাফল্য। ধর্মঘটের সাথে তার ক্ষতিকারিতা অনিবার্যভাবে জড়িত। যে ধর্মঘট অধিক ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা রাখে,  সেটাই পেতে পারে অধিক সাফল্য। আমরা এখন মানবাধিকার নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি। ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে লিখিতভাবে মানবাধিকারের যে দলিল ঘোষিত হয়, (declaration des droits de l`homme et du citoyen) তাতে বলা হয়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পবিত্র অধিকার জনগণের আছে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর জনগণের জন্য শান্তি ((Gverre Aux Tyrans. Paix Aux Peuples), এগুলো মানবাধিকারের সাথে একত্রে গ্রথিত। অত্যাচারীকে প্রশ্রয় দিয়ে শান্তি বজায় রাখার প্রয়াস মানবাধিকারের পরিপন্থী। মানবাধিকারকে আমাদের দেশে তথাকথিত সুশীলসমাজ করছেন অপব্যাখ্যা। অত্যাচারীকে প্রশ্রয় দিলে কেবল হতে পারে অত্যাচারের সম্প্রসারণ, যা শেষ পর্যন্ত মানবাধিকারকে খর্ব করে। পত্রিকার খবরে দেখলাম, মরহুম জিল্লুর রহমান তার ছাত্রজীবনে ১৯৪৭ সালে গিয়েছিলেন সাবেক সিলেটে। তিনি সেখানে সিলেটের গণভোটে জনমত সৃষ্টিতে নিয়েছিলেন অংশ। সিলেটে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাবেক সিলেট জেলা ভারতের আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত থাকবে না যুক্ত হবে পাকিস্তানের সাথে, সেটা ঠিক করার জন্য। জিল্লুর রহমান চেয়েছিলেন সিলেট জেলার পাকিস্তানভুক্তি। অর্থাৎ এ সময় তিনি ছিলেন বিশেষভাবেই পাকিস্তানপন্থী। সিলেট জেলায় বেশ কিছু দেওবন্দি মাওলানা ছিলেন। দেওবন্দ হলো ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জায়গা। এখানে আছে একটি বিরাট ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র। এই শিক্ষাকেন্দ্র থেকে সনদপ্রাপ্ত মাওলানাদের বলা হয় দেওবন্দি। দেওবন্দি মাওলানারা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী। তারা ছিলেন কংগ্রেস দলের পক্ষে। সিলেটে গণভোট হয়েছিল থানাকে একক ধরে। সিলেটে করিমগঞ্জ থানায় ছিল দেওবন্দি মাওলানাদের বিশেষ প্রভাব। এই প্রভাবের কারণেই করিমগঞ্জের বেশির ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন ভারতে যাওয়ার পক্ষে। করিমগঞ্জ থানা যুক্ত হয় আসামের কাছাড় জেলার সাথে। বিষয়টি এখন মনে রাখা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। কারণ, দেওবন্দের ঐতিহ্যবাহী মাওলানারা এখন বাংলাদেশে করছেন হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের বিরোধিতা। দেওবন্দি মাওলানারা জিন্নাহ সাহেবকে পছন্দ করতেন না। কারণ, জিন্নাহ ছিলেন শিয়া। দেওবন্দি মাওলানারা মনে করতেন, মুসলিম লীগ হলো শিয়া পরিচালিত একটি দল। তাই এই দলকে উচিত নয় সুন্নি মুসলমানদের সমর্থন দেয়া। চট্টগ্রামের সুন্নি জামাত বলে পরিচিত সংস্থার মাওলানারা সবাই করছেন ভারতঘেঁষা আওয়ামী লীগের সমর্থন। এ বিষয়ে আমাদের হুঁশিয়ার হতে হবে। কারণ এসব মাওলানা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে পুরোপুরি আস্থাশীল নন। এদের আনুগত্য হলো মূলত ভারতমুখী।
দেশে এখন হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়ছে। ভাঙছে হিন্দু দেবমন্দির ও তাতে রক্ষিত বিগ্রহ। এটা কারা করছে আমরা তা জানি না। তবে হতে পারে এটা ভারতের পক্ষের শক্তির দ্বারা পরিচালিত। এর দ্বারা মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদেশি সৈন্য পাঠানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার চেষ্টা হচ্ছে। হয়তো বলা হবে, বাংলাদেশে হিন্দু নিধন বন্ধের জন্য সৈন্য প্রেরণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাইরের সৈন্য এভাবে বাংলাদেশে পাঠাতে চাইলে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারবে না। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছেন; কিন্তু সেটা সত্য নয়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জাতির প্রতি তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।
আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে। কিন্তু ১৯৭১ আর বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি আদৌ এক নয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশ বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু এখন আছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। কোনো জাতির জীবনে একটা যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ নয়। একটা জাতির জীবনে অনেক যুদ্ধই করতে হতে পারে। শান্তি কামনা করতে যুদ্ধের জন্য সব জাতিকেই প্রস্তুত থাকতে হয়। আমাদেরও থাকতে হবে। অহিংসার আদর্শ খুবই মহৎ। কিন্তু এখনো বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা সত্য হয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশে যারা অহিংস হওয়ার কথা বলছেন, তারা আসলে সেটা বলছেন জাতি হিসেবে আমাদের দুর্বল করে তোলারই লক্ষ্যে, যেটাকে আমরা অনুমোদন দিতে পারি না।

শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলাদেশ আজ মৃত্যুপুরী : আপীল বিভাগের নিয়োগে জেষ্ঠ্যতা লংঘন



বেশ কয়েক বছর আগে, সম্ভবত জেনারেল এরশাদের আমলে, গুলীতে ২ ব্যক্তি মারা যান। তখন এরশাদের জুলুম ও পুলিশের বর্বরতা জনগণকে বোঝাতে এবং তাদের মাঝে প্রচার করার জন্য বিভিন্ন গণসংগীত রচিত ও গীত হয়। সে রকম একটি গণসংগীতের প্রথম লাইন হলো, ‘‘চারিদিকে দেখি আজ লাশের মিছিল।’’ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রচয়ারি পুলিশের গুলীতে ৪ জন (মতান্তরে) ৫ জন শহীদ হন। তখন একটি গণসংগীত রচিত হয়। এটির প্রথম কয়েকটি কলি হলো :
ঝরাও রক্ত ছড়াও রক্ত
যত খুশী তুমি পার
রাজপথে আজ জনতা জেগেছে
যত খুশী তুমি মার।
এরশাদের পুলিশের গুলীতে ঐ দুই জনের মৃত্যুর খবর অবশ্যই হৃদয় বিদারক, দুঃখজনক এবং ভয়াবহ। ২১ শে ফেব্রচয়ারি পুলিশের গুলীবর্ষণ ও ছাত্র জনতার শহীদ হওয়ার খবরের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় গুরচত্ব নতুন করে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নাই। সে দিনের সেই ২ জন বা ৫ জনের মৃত্যু যদি হয়ে থাকে লাশের মিছিল তাহলে ফেব্রচয়ারি ও মার্চ মাসে যা ঘটে গেল সেটিকে কি বলবেন? এতদিন পর্যন্ত আমরা সাহিত্যের ভাষায় কিছু কথা শুনেছি। সেগুলো হলো, ‘রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া’, ‘রক্তের বন্যায়/ভেসে যাবে অন্যায়’ ইত্যাদি। যে সব পুলিশী জুলুমের কথা উলে­খ করলাম সে গুলো যদি হয়ে থাকে রক্তগঙ্গা বা রক্তের বন্যা তাহলে এখন প্রায় প্রতিদিন যা ঘটছে সে সব রক্তপাতকে কি বলবো? গত বৃহস্পতিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরচল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে ফেব্রচয়ারি এবং মার্চ মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলীবর্ষণে ২০০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। লাশের মিছিল খোঁজার জন্য আর কোথায় যেতে হবে? যেখানে দুই শতাধিক লাশ পড়ে যায় সেটিকে লাশের মিছিল বলাই কি যথেষ্ট হবে? যে দেশে বা যে জনপদে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে শত শত মানুষের লাশ পড়ে যায়, সেই জনপদকে কি বলবো? মৃত্যুর উপত্যকা বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে সেটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আওয়ামী সরকারের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ আজ যেন এক প্রেতপুরী। এমন কি যখন এই কলামটি লিখছি, সেদিন অর্থাৎ শুক্রবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের গুলীতে মারা গেছেন ৩ জন এবং সিরাজগঞ্জে ২ জন। খুলনায় ২ জন। অর্থাৎ গত শুক্রবার দেশে কোনো আন্দোলন ছিল না, ছিল না কোনো উত্তেজনা। তারপরেও একজন দু’জন নয়, ৭ জন মানুষ মারা গেলেন।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশ এবং গ্রামবাসীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ৩ জন গ্রামবাসী নিহত হন এবং পুলিশের গুলীতে আহত হন আরো ৩০ জন। যারা নিহত হয়েছেন, তারা হলেন ওমরপুর গ্রামের ১৪ বছরের কিশোর ওয়ালিউল­vহ, ২৫ বছরের যুবক রবিউল এবং ৪৫ বছর বয়স্ক মতিউর রহমান মতি। গ্রামবাসীর অভিযোগ, কানসাট পল­x বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েক ব্যক্তিকে আসামী করে এবং তাদেরকে হয়রানি করে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত অর্থাৎ শুক্রবার রাত ৩টায় কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ র‌্যাব ও বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) একটি যৌথ দল ঐ এলাকায় পৌঁছলে গ্রামবাসী প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। তখন পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চার্জ শুরচ করে। গ্রামবাসীও পাল্টা ইটপটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এই পর্যায়ে পুলিশ কোনরূপ পূর্বাহ্নিক সতর্কতা ছাড়াই গ্রামবাসীকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়তে থাকে। পুলিশের বেপরোয়া গুলীবর্ষণের ফলে ঘটনাস্থলেই ৩ জন নিহত, ২০ জন গুলীবিদ্ধ এবং ৫০ জন আহত হন। ঘটনার পর গ্রামবাসী শিবগঞ্জ থেকে সোনা মসজিদ স্থল বন্দর পর্যন্ত ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেন। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আজ রোববার চাঁপাইনবাবগঞ্জে হরতাল আহবান করা হয়েছে। একইদিন সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে সকাল ৮টায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ বাহিনীর সাথে জামায়াতে ইসলামী ও যুবদলের সংঘর্ষে ২ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ২০ জন। যারা নিহত হয়েছেন তারা হলেন যুবদলের ফরিদুল ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর ইউনুস।
বেলকুচিতেও ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই ঘটনা। এখানেও পুলিশ স্থানীয় এলাকা ভিত্তিক গণঅভ্যূত্থানের কর্মীদেরকে আসামী করে মামলা দায়ের করে। সে মামলায় তারা আসামী ধরতে গেলে গ্রামবাসী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য পুলিশের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব আনা হয়। অন লাইন বার্তা প্রতিষ্ঠান ‘আরটিটি এনের’ খবরে প্রকাশ, শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে বেড়া ইউনিয়নের জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। খবর পেয়ে মৌপর, কল্যাণপুর, কান্দাপাড়া, সর্বতুলী ও ধুলদিয়া গ্রামের কয়েক হাজার গ্রামবাসী এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। গ্রামবাসীর এই বিক্ষোভের মুখে পুলিশ ও র‌্যাব গুলীবর্ষণ করলে ফরিদুল ও ইউনুস নিহত হন। এরপর পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
দুই.
এই দুইটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে গুলী করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এবং সিরাজগঞ্জের বেলকুচি - এই দুটি এলাকায় পুলিশ ও র‌্যাবের গুলীতে ৫ জন নিহত এবং অন্তত ৭০ জন আহত হয়েছেন। স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে যে গ্রামবাসী জেগে উঠছেন। বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় এলাকা ভিত্তিক গণঅভ্যূত্থান ঘটছে। প্রগতির বকন্দাজরা এটাকে বলছেন জামায়াতের তান্ডব। সারা বাংলাদেশে মাত্র দেড় মাসে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি পাখী শিকার করার মত গুলী করে দুই শতাধিক লোককে হত্যা করার পরেও সেটি পুলিশী বর্বরতা বা পুলিশী হত্যাকান্ড হয়নি। অর ২০০ লোক পুলিশের গুলীতে প্রাণ দেয়া সত্ত্বেও তাদের কাজটি হয়ে গেল তান্ডব। পাকিস্তান আমলেও দেখেছি যে পুলিশ বিক্ষোভ সমাবেশ বা মিছিলের ওপর গুলী করাতো দূরের কথা, লাঠি চার্জ করলে বা টিয়ারসেল মারলেও আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী পন্থীদের চোখে সেটি বিবেচিত হয়েছে পুলিশী জুলুম বা পুলিশী বর্বরতা হিসেবে। আর এখন জামায়াত-শিবির বা বিএনপির ক্ষেত্রে শত শত লোককে হত্যাকরার পরেও সেটি বিবেচিত হচ্ছে পুলিশের ওপর হামলা হিসেবে। প্রিয় পাঠক, আপনারাই বলুন, যারা হামলা করে তারা কি মারা যায়? নাকি যারা হামলার শিকার হয় তারাই মারা যায়? মানুষের বিচার বুদ্ধি কতখানি বিদ্বিষ্ট হলে যারা খুন হচ্ছে তাদেরকেই নিন্দা করা হয় এবং খুনীকে নির্যাতিত হিসেবে চিত্রিত করা হয়। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক প্রমুখ ভুলে যাচ্ছেন যে ‘এক মাঘে জাড় যায় না।’ উত্তরবঙ্গের অনেক এলাকায় শীতকে বলা হয় ‘জাড়’। অর্থাৎ এক মাঘে শীত যায় না। এক বছর পর শীত আবার ঘুরে আসে। আওয়ামী লীগ এদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে উপাদান চালু করেছে, ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই সবগুলো উপাদানেরই তারা নিন্দাবাদ করেছে। হরতাল বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন থেকে শুরচ করে বেগম জিয়ার আমলে ১৭৩ দিনের হরতাল দিয়ে বিএনপি সরকারকে কাবু করেছে। বর্তমানে তারা যখন ক্ষমতায় তখন সেই ৪ বছর ৩ মাস অর্থাৎ ৫১ মাসে জামায়াত এবং বিএনপি মাত্র ২৫/২৬ দিন হরতাল দেয়ায় আওয়ামী ঘরানার লোকজন হরতালের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়েছে।
তিন.
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং আব্দুল কাদের মোল­vর রায়ের বিরচদ্ধে সরকার এবং অভিযুক্ত উভয়পক্ষই উচ্চতর আদালতে আপীল করেছে, তখন আপীল বিভাগের বিচারকে প্রভাবিত করার জন্য সরকার আপীল বিভাগে ৪ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। আপীল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৭ জন। বর্তমানে সেখানে কর্মরত রয়েছেন ৬ জন। এই সরকার কিছুদিন আগে ঐ সংখ্যা বাড়িয়ে করেছে ১১ জন। সেদিন ৪ জন নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার ফলে আপীল বিভাগে বর্তমানে বিচারপতির সংখ্যা দাঁড়ালো ১০ জন। বিচার বিভাগে বিশেষ করে উচ্চ আদালতে বিচারপতি হিসেবে কাকে নিয়োগ দেয়া হলো আর কাকে নিয়োগ দেয়া হলো না সেটা নিয়ে মানুষ সাধারণত মাথা ঘামান না। কিছু দিন আগে পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল যে উচ্চ আদালতে নিয়োগের ভিত্তি হলো জেষ্ঠ্যতা এবং মেধা। কিন্তু আওয়ামী সরকার ক্ষতমায় আসার পর থেকেই বিচারক নিয়োগে এই দুটো মাপ কাঠিকেই জলাঞ্জলি দিয়েছে। এবার যে চার জনকে নিয়োগ দেয়া হলো তার ভিত্তি হলো ‘জোর যার মুল­yক তার’। তা নাহলে জেষ্ঠ্যতার তালিকায় যাদের অবস্থান ৪১ এবং ৪২ নাম্বারে তাদেরকে আগের ৪০ জনকে ডিঙ্গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে প্রমোশন দেয়া হয় কিভাবে? উলে­খ করা যেতে পারে যে আওয়ামী সরকার হাইকোর্ট বিভাগের ৪ জন বিচারপতিকে আপীল বিভাগে প্রমোশন দিয়েছেন। এরা হলেন, বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ারচল হক, বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক। এই নবনিযুক্ত ৪ জনের মধ্যে বিচারপতি আনোয়ারচল হকের জেষ্ঠ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা বিতর্ক নাই। বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়ার অবস্থান পঞ্চম স্থানে। তার মাথার ওপরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন বিচারপতি নজরচল ইসলাম চৌধুরী। নজরচল ইসলামকে তিন ধাপ এগিয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান মিয়া। আর যে ২ জন আপীল বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। জেষ্ঠ্যতার বিচারে তার অবস্থান ৪১ নম্বরে। অপর জন হলেন শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক। তার অবস্থান ৪২ নম্বরে। হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও শামসুদ্দীন চৌধুরীকে জেষ্ঠ্যতার নিরিখে তাদের মাথার ওপর অবস্থানকারী ৪০ জনকে ডিঙ্গিয়ে আপীল বিভাগে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। ছোটখাট জেষ্ঠ্যতা অতীতেও যে একেবারে লংঘিত হয়নি, এমন নয়। কিন্তু তাই বলে ৪০ জনকে ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন দেয়ার এই ভয়াবহ খারাপ কাজটি করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকার।
এ রকম অশ্রচতপূর্ব এবং নজিরবিহীন জেষ্ঠ্যতা লংঘনে দেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ বিস্মিত হলেও হাল আমলের রাজনীতির ওপরে যারা নজর রাখছেন তারা মোটেই বিস্মিত হন নাই। কারণ তারা দেখছেন যে জামায়াতের শীর্ষ নেতা মওলানা সাঈদী এবং কাদের মোল্লার দন্ডাদেশের বিরচদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ এবং সরকার পক্ষ উভয় পক্ষই আপীল করেছে। আইন মোতাবেক আগামী ২/৩ মাসের মধ্যেই এই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় দেয়ার কথা। এ ব্যাপারে সরকারের মনোভাব অত্যন্ত পরিষ্কার। তারা জামায়াতে ইসলামীর সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। সে জন্যই যখন কাদের মোল­vর আদেশ হয় তখন সরকারেরই ইঙ্গিতে শাহ্বাগ মঞ্চ বানানো হয় এবং সেখানে কতিপয় নাস্তিক ব­গারকে দিয়ে ফাঁসির দাবি উত্থাপন করানো হয়। এই ফাঁসির দাবি উত্থাপনের পেছনে সরকারের একটি জিঘাংসাবৃত্তি কাজ করেছে। তারা দেখেছে যে ট্রাইব্যুনালের বিদ্যমান আইনে যাবজ্জীবনের আদেশ দেয়া হলে সেটিকে ফাঁসির আদেশে রূপান্তরের কোনো বিধান নাই। সেটি করতে হলে আই সংশোধন করতে হবে। সে জন্যই শাহবাগের মঞ্চ থেকে যখন ফাঁসির দাবি তোলা হয় তখন সেই দাবি বাস্তাবায়নের জন্য সরকার তড়িঘড়ি করে আইন সংশোধন করে। সেই সংশোধিত আইন অনুযায়ী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি চেয়ে সরকার আপীল করেছে। আপীল শুনানির আগেই এমন ৪ জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে যাদের বিরচদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বার সমিতির এবং আগের দুইটি বার সমিতির প্রেসিডেন্টগণ মারাত্মক পক্ষপাত দুষ্টতার অভিযোগ এনেছেন। এদের মধ্যে শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিকের বিরচদ্ধে দৈনিক ‘আমার দেশ’ এবং ‘নয়া দিগন্তে’ অনেক গুরচতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তারা অভিযোগ করেছেন যে সরকারের ইচ্ছা মাফিক উচ্চ আদালতের রায়কে প্রভাবিত করার জন্যই জেষ্ঠ্যতা লংঘন করে হাসিনা সরকার নিজেদের পছন্দ মাফিক ব্যক্তিবর্গকে উচ্চতর আদালতে নিয়োগ দিয়েছে। এর শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটি দেখার জন্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ গভীর আগ্রহ নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য অর্থখাতকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট



অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক কর্তৃক সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও ব্যাংকারদের সাম্প্রতিক মতামতকে রাবিশ ও বোগাস বলে মন্তব্য করেছেন বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী গত ২৯ মার্চ সিলেট মহানগরীর মদিনা মার্কেটে রূপালী ব্যাংকের ৫১৩তম শাখা উদ্বোধনকালে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে ভাল সময় অতিক্রম করছে বলে উলে­খ করে অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন, সারা পৃথিবীতে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি হয়, বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে এটা ভয়ঙ্কর কিছু নয়।
অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে আমরা দেশের অর্থখাত বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির সুস্থ বিকাশের পথে একটি ধ্বংসাত্মক ও ভয়ংকর অবস্থান বলে মনে করি। হলমার্কের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পর থেকে তার প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করলে তিনি ও তার সরকারের যে অবস্থানটি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে তা হচ্ছে তাদের প্রতারণা ও জালিয়াতিবান্ধব একটি অবস্থান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টে সর্বপ্রথম এই জালিয়াতিটি যখন ধরা পড়ে তখন তারা বিষয়টি সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছিল। অর্থমন্ত্রণালয় এই তথ্যের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঐ সময় এই তথ্যটিও প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে এই কেলেঙ্কারির সাথে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সম্পৃক্তি রয়েছে। সরকার এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও তদন্ত করেননি কিংবা সংশি­ষ্টদের বিরচদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে একটি প্রস্তাব পাঠায়। অর্থমন্ত্রী এই পত্র পাবার পর প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তাব করে আইন ও ক্ষমতাবহির্ভূত কাজ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রস্তাবে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশি­ষ্ট ধারা উলে­খ করেই প্রস্তাবটি করেছিল। এই অবস্থায় অর্থমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতমুখী অবস্থান পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটায়। দুর্নীতিবাজ ও জালিয়াতরা উৎসাহিত হয়ে পড়ে। এই জালিয়াতির সাথে অর্থমন্ত্রণালয় ও সরকারের শীর্ষ মহলের সম্পৃক্তি এতই নিবিড়ভাবে ধরা পড়ে যে সোনালী ব্যাংক এবং হলমার্কের সংশি­ষ্ট কর্মকর্তাদের বিরচদ্ধে মামলা করা হবে কিনা তা নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। দুদক এর দায়ভার সোনালী ব্যাংকের দিকে ঠেলে দেয়, আবার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা কর্তৃপক্ষ এর দায়িত্ব তার নয় বলে ঘোষণা করেন। আবার সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কেউ এ কথাও বলতে থাকেন যে মামলা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, সরকার অর্থ আদায়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে এই মর্মে মন্তব্য করেন যে সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা একটি সামান্য ব্যাপার মাত্র। ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের মধ্যে এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র। তার এই ঘোষণা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং সংসদ অধিবেশনে তার অর্থাৎ সরকার দলীয় সাংসদরা অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। তার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পান। পরবর্তীকালে তিনি বেশকিছু কাল এ ব্যাপারে চুপ ছিলেন এবং এক পর্যায়ে দুই মাসের মধ্যে হলমার্কের কাছ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আদায় হয়ে যাবে বলে জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। হলমার্কসহ দুর্নীতি ও জালিয়াতির আরো অসংখ্য ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন ইস্যুর সৃষ্টি করে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন এবং সোনালী ব্যাংক ও হলমার্কের কিছু কর্মকর্তার বিরচদ্ধে সরকারকর্তৃক মামলার নাটক করে প্রতারণার নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়ারও প্রশ্ন উঠেছে। অর্থমন্ত্রী এখন নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি বলছেন যে, হলমার্ককে নতুনভাবে ঋণ দেয়া প্রয়োজন এবং হলমার্ক নিয়ে যেসব ব্যাংকার ও বুদ্ধিজীবী পত্রপত্রিকার প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং টেলিভিশন চ্যানেলের টকশো’তে বিরূপ মন্তব্য করছেন তারা দেশের শত্রচ, তাদের মন্তব্য রাবিশ ও বোগাস। যারা জালিয়াতি-দুর্নীতির বিরচদ্ধে কথা বলেন এবং এর অবসান চান তারা যদি দেশের শত্রচ হন তা হলে বন্ধু কারা আমরা জানি না। তবে অর্থমন্ত্রী যে তার আচার আচরণ ও দেশের অর্থনীতি পরিচালনায় যে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন তাতে তিনি ও তার সরকার দুর্নীতি ও জালিয়াতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলেই মনে হয়। এই অবস্থান দেশের বন্ধু হবার অবস্থান হতে পারে না। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য এবং পদক্ষেপ অর্থখাতকে ধ্বংস করবে বলেই আমরা মনে করি। এই দুর্নীতির বিচার না হলে দাবানলের ন্যায় তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে যা কারচরই কাম্য নয়।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সর্বব্যাপী সর্বনাশের ঘণ্টা বাজছে


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জাতীয় গৌরব, সর্বত্র সরকার সর্বনাশের ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। ফলে অনেক ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বই আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সবাই যেন আজ এক নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে আজ যাদের রুখে দাঁড়ানোর কথা, তারা তরুণসমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। কিন্তু তারা একেবারে চুপ মেরে আছেন। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তরুণসমাজ অচেতন। তাদের এমন অচেতন করে তোলার আয়োজনও বহু দিনের। সে আয়োজন এখন সাফল্যের পথে। আর উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী শ্রেণী যেন আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছেন। আগে তো দেখেছিলাম মরুভূমির গুল্মের মতো হুটহাট গজিয়ে উঠেছিল এক সুশীলসমাজ। এরা ছিলেন স্বঘোষিত। তাদের দলে নাম লেখানো অন্যদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার ছিল। সেখানে মতলব ছিল ভিন্ন। সমাজের কল্যাণ তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল না। রাষ্ট্রের স্বার্থচিন্তার ভেতরে ছিল না। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা ছিল না। তাদের মতলব ছিল চারদলীয় জোট সরকার হটিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করে দেশে এক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করা এবং তার মাধ্যমে ফায়দা হাসিল করে সটকে পড়া। কার্যত তারা করেছিলও তাই।
কোনো দেশের প্রকৃত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এমন মতলব-তাড়িত হতে পারে, এমন নজির বোধকরি কমই পাওয়া যাবে। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে গজায় এই সুশীল শ্রেণী। তাদের মতলব অস্পষ্ট ছিল না। তারা জোট সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকটি পত্রিকা আর বিদেশী মতলবিদের ঢালা অর্থে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা শুরু করে। তাদের বিবেচনায় রাজনীতিবিদেরা সব চোর। ফলে দেশ থেকে রাজনীতিই উৎখাত করতে হবে। তার বদলে কায়েম করতে হবে তাদের নির্বাচিত ‘সৎ লোকের শাসন’। এ নিয়ে তারা সারা দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েছিল। সৎ লোক খুঁজতে শুরু করেছিল। কেমন সৎ লোক? যে লোক তাদের মতো পরজীবী, কোনো রাজনীতির ধার ধারে না, যাদের সমাজের প্রতি দেশের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট নেই, তাদের বিবেচনায় সেই সব লোকই ‘সৎ লোকে’র সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য। সেভাবেই চলছিল। কিন্তু বহু জেলায় তারা ধাওয়া খেয়ে ফিরে আসে ঢাকায়। তাদের সৎ লোকের সন্ধান প্রয়াস তাই খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। কিন্তু তাদের যে মতলব ছিল সেটা সাময়িকভাবে হাসেল হয়ে যায়। দেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর এই সুশীলেরা চুটিয়ে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অবিরাম গিবত গাইতে থাকে। তার পুরস্কার হিসেবে সেনা সরকার তাদের দিকে একটু আধটু হাড্ডি ছুড়ে দেয়। আর ওরাও আনন্দে কোঁ কোঁ করতে থাকে।
কিন্তু তাদের আহাদের সামরিক সরকার অচিরেই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় এবং সর্বাত্মক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। আর স্বঘোষিত ওই সুশীলেরা হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই ম্যাগটের মতো মিলিয়ে যায়। তারপর থেকেই দেশে ধারাবাহিক স্বৈরশাসন চলছে। রাষ্ট্র ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। কিন্তু সেই কচ্ছপ সুশীলেরা এখন খোলের ভেতরে মুখ লুকিয়ে নিস্পন্দ পড়ে আছেন। এরা যা চেয়েছিলেন, সেটা অর্জন করা হয়ে গেছে। দেশ থেকে গণতন্ত্র বিতাড়িত করা সম্ভব হয়েছে। আর দেশ ধ্বংসের যে ষড়যন্ত্র তারা করেছিল, তাও সাফল্যের পথে। কী মজা!
তা হলে আর কে থাকে? থাকে এই বৃত্তের বাইরের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। দেখা যাচ্ছে, তারা ফ্যাসিবাদী শাসকদের রুদ্ররোষের ভয়ে কেমন যেন গুটিয়ে আছেন। মাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোক সামান্য প্রতিবাদ তুলতে পারছেন সচেতন মিডিয়ার মাধ্যমে। এটুকুই ভরসা। কিন্তু এরাও সংগঠিত নন। তবু এই সীমিত কণ্ঠস্বর যদি আরো একটু পরিসর বাড়াতে পারে ধীরে ধীরে, সেটাও হবে আশার কথা। তবে লক্ষণীয়, এই যে সীমিত উচ্চারণ, তা অনেকখানি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এখানে আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। আমরাও আশা করি, এ আলো আরো পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠবে।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তা হলো সর্বব্যাপী সর্বনাশের দিকে যাচ্ছে দেশ। সরকার সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। একের পর এক ঘটছে লুণ্ঠনের ঘটনা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ভাড়া বিদ্যুৎ কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, রেলের বস্তা বস্তা টাকার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সরকার দলের লোকেরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। কিন্তু এই দুর্নীতির জন্য আজ পর্যন্ত একটি লোকেরও সাজা হয়নি। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজির মহোৎসব চলছে। সেখানেও সরকার চু বন্ধ করেই আছে। হোক লুট। নিজেদের লোকেরাই তো করছে, করুক। এর সব ক্ষেত্রেই সরকার দুর্নীতিবাজ প্রশ্রয় দিয়েই যাচ্ছে। রেলের কালো বিড়াল সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত রেলের বস্তা বস্তা টাকা দুর্নীতির দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি-বান্ধব সরকার পর দিনই তার মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দিয়ে জানান দিলো যে, চালিয়ে যাও, চিন্তা করো না। শেয়ারবাজার থেকে সরকারের লোকদের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের একটি তদন্ত করেছিল সরকার। কিন্তু তাতে দোষী সাব্যস্ত লোকদের সরকার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি। বরং শেয়ার মার্কেটের ুদ্র বিনিয়োগকারীদের ফটকাবাজ বলে অভিহিত করেছে সরকার। বিনিয়োগকারীদের লাঠিপেটা করেছে। সর্বস্বহারা বিনিয়োগকারীদের কাউকে কাউকে সরকার জেলের ঘানি টানিয়ে এনেছে। কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। সরকারের হৃদয় কাঁপেনি।
পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বটে, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে ডিফেন্ড করে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন, তিনি সাচ্চা দেশপ্রেমিক, এমন সার্টিফিকেট তাকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকার বিরাট ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসেছে। শেখ হাসিনা আবুল হোসেনকে রক্ষার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি বিশ্বব্যাংকের অডিট রিপোর্ট তলব করে বসেছিলেন। এরপর হলমার্ক কেলেঙ্কারি। হলমার্কের তানভীর মাহমুদ সরকারি সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে এক উপদেষ্টার সহায়তায় আত্মসাৎ করে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। তানভীর আওয়ামী লীগের লোক। অতএব আত্মসাতের অধিকার তার আছে। আর তাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল প্রায় সাথে সাথে বলে বসলেন যে, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ কোনো ঘটনাই নয়। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য কোনো ব্যাপার না। তারপরও তানভীর ও তার স্ত্রীকে লোক দেখানোর জন্য জেলে পোরা হয়। কিন্তু এখন সরকারের সুর বদলেছে। আবুল মাল গত ২৭ মার্চ বলেছেন যে, তানভীর ও তার স্ত্রীকে জামিন দেয়া হবে। জামিনে এসে তারা আবার কারখানায় উৎপাদন শুরু করবে। ফলে তাদের আত্মসাতের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। আর কারখানা চালু করার জন্য তাদের আরো ঋণ দেয়া হবে।
এই না হলে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী! এর ফলে দুর্নীতির অভিযাত্রা কি ব্যাপক হবে, সে বিষয়ে এই আনাড়ি লোকটার কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। হলমার্ক সম্পর্কে এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে এ রকম আরো ডজন ডজন চালিয়াত-জালিয়াত সরকারি ব্যাংক থেকে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেবে। সরকার সে টাকার গন্তব্য খুঁজবে না। হলমার্ক যে এই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিলো, সে টাকা গেল কোথায়? হুন্ডির মাধ্যমে কি বিদেশে পাচার হয়ে গেছে? সেটি কিন্তু সরকার অনুসন্ধান করতে চাইছে না। আবুল মালের ধারণা গেলে গেছে। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কোনো ব্যাপারই না। এখন কোনো দুর্মুখ যদি প্রশ্ন করে, হদিসবিহীন টাকা কি তবে আবুল মালের কোনো দেশী-বিদেশী অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেছে? তাহলে মাল সাহেব তার কী জবাব দেবেন? প্রথম থেকেই তিনি হলমার্কের প্রতি বড় বেশি দুর্বল ছিলেন। এখন তার ভালোবাসা ছলাৎ ছলাৎ করে রঙিন পেয়ালা উপচে বাইরে পড়ে যাচ্ছে।
এই হলো সরকার। যত খুশি দুর্নীতি করো। সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রাখো। আর কিছুই ভাবার দরকার নেই। তা শত কোটি, হাজার কোটি টাকা হলেও না। হাজার হাজার কোটি টাকা হলেও না। এমন আজব অর্থমন্ত্রী পৃথিবীতে মেলা ভার। দুর্নীতিকে এভাবে আপন করে নেয়া এবং যৌক্তিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ঘটনা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।
এখানে থামতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ধিকস্য ধিক বলার আরো অনেক কাণ্ড এই সরকার করেছে। আর তা হলো, এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়েছে। ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে তারা যা লিখেছে, তা মুখে উচ্চারণও করা যায় না। কিন্তু তার বিবরণ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেখানে ষষ্ঠ বা অষ্টম শ্রেণীর কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জন্য যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে তাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ও লেখকদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নির্লজ্জ দীনতা মুখ ব্যাদান করে বেরিয়ে এসেছে। এরা কারাÑ সে প্রশ্ন এখন সমাজে উচ্চারিত হচ্ছে। এই সরকার সম্ভবত বাংলাদেশের একটি পরিশীলিত সমাজকে আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।
সরকার পাঠ্যপুস্তকে যা করেছে, তা নিভৃতই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় তার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু আমি জানি না, সরকারের আট গাড়ি দাবড়ানো এই শিক্ষামন্ত্রীর ছেলেপুলে বা নাতি নাতকুর আছে কি না। এরা যদি ব্লুফিল্ম, পর্নোগ্রাফি, বীর্যপাত, রজঃপ্রবাহ, এসব বিষয়ে মন্ত্রীকে প্রশ্ন করে তবে তিনি ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী জনৈক রমেশচন্দ্র সেন ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ভারত আগে বাঁধ দিক। তারপর দেখা যাবে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হয় বা না হয়। তারপর প্রতিবাদ করা হবে কি না হবে ভেবে দেখা যাবে। তখন সাবেক পানিসম্পদ সচিব আসাফউদৌল্লাহ বলেছিলেন, ওকে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দেয়া উচিত। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সম্পর্কে যদি একই কথা কেউ বলে তবে কি তা খুব বেশি দোষের হবে?
এমনি আরো অসংখ্য সর্বনাশের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেই চলেছে। এই সরকার মাত্র কয়েক দিনে ১৭০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ড আমাদের ভিয়েতনামের মাইলাই হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৭০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যার ঘটনাকে বিরোধীদলীয় নেত্রী গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। শুধু তিনি কেন, আমরাও বলি, এটা গণহত্যাই। কিন্তু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, পুলিশ বুক বরাবর গুলি করার অধিকার রাখে।
অতএব এখন সর্বগ্রাসী, সর্বনাশী সঙ্কটের মধ্যে বাংলাদেশ। কোথায়ও আশার আলো নেই। কোথায়ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা নেই। যে বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ মানিক বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন, যাকে ইমপিচ করার জন্য স্পিকার রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, তাকেও সরকার আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করেছেন আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো এই যে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী মানিককে আপিল বিভাগে নিয়োগ দিয়েছেন। এসব বিবেচনায় নিয়েই আমরা বলছি যে, দেশে এখন সর্বব্যাপী সর্বনাশের ঘণ্টা বাজছে। এই সর্বনাশ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা নাগরিকদেরই করতে হবে সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে। এর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

Ads