বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শাহবাগের নর্তন-কুর্দনের অন্তরালে


শাহবাগের নর্তন-কুর্দনের অন্তরালে
 দেশের রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ বা গবেষণা করার যেমন আমার যোগ্যতার অভাব রয়েছে তেমনি রয়েছে আগ্রহের ঘাটতি। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে দেশের বর্তমান রাজনীতির অঙ্গনের বেহাল দেখে মনটা বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছে। ভাবনায় পড়েছি তা হলে কি বাংলার মুসলমানরা এখনও রাহু গ্রাস মুক্ত নই? এতোদিন জামায়াত-শিবির নিয়ে শোরগোলে বেশি মাথা ঘামাইনি। ভেবেছিলাম, এটি একটি রাজনৈতিক কোন্দল। কিন্তু শাহবাগ চত্বর ঘিরে যুবক-যুবতীদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের চিৎকার, তাদের সাথে কতিপয় ইসলামবিরোধীর সম্পৃক্ততা ও দেশের সমস্ত মসজিদের মুসুল্লিদেরকে জামায়াত-শিবির কর্মী হিসাবে লাঠিপেটা ও গুলী চালিয়ে নির্মম হত্যা নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
প্রথম চিন্তা ‘নতুন প্রজন্ম' নিয়ে। নতুন প্রজন্ম বলতে কাদেরকে বুঝায়? যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে জন্মগ্রহণকারী সন্তানদেরকে বুঝায় তাহলে দেশের আপামর সন্তানদেরকে বাদ দিয়ে শাহবাগে জমায়েত একটি বিশেষ চিন্তা-চেতনা লালনকারী গুটিকতক কিশোর-কিশোরীকে ‘নব প্রজন্ম' পরচয় করিয়ে দিয়ে জাতিকে ধোঁকায় ফেলার চক্রান্ত কেন? বর্তমান প্রজন্মের এক বিরাট জনশক্তি ‘ছাত্র শিবির' নব প্রজন্মেরই সন্তান। তারা কী চায়, কী বলে তা কেন উপেক্ষা করে তাদের উপর গুলী চালান হয়, পাখির মতো নির্বিচারে তাদেরকে রাস্তায় লুটিয়ে দেয়া হয়। অপরদিকে নব প্রজন্মের দোহাই দিয়ে এক গোষ্ঠীকে নির্মূল আর এক বিশেষ গোষ্ঠীকে ফুল দিয়ে বরণ করার প্রচেষ্টা জাতির জন্য অমঙ্গলই বয়ে আনবে।
বাংলা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক গতি ধারার অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের চক্রান্তের পেছনে রয়েছে এদেশ থেকে মুসলমানদের বিদায় করণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অবস্থান পাকাপোক্তকরণ। ভেবেছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এ দেশের মানুষ নিজস্ব চিন্তা আকিদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কিন্তু এ ধারণা দিন দিন বদলে যাচ্ছে।
ভারতে মুসলিম বিজয়ের পর থেকে ইসলাম বিরোধী বৈরী শক্তি তাদেরকে পরাভূত ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। গোড়া থেকে যেভাবে বিভিন্ন পথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেগেছিল আজও তারা তেমনি আছে।
এ জন্য তারা প্রাথমিকভাবে বেছে নিয়েছে তথাকথিত নব প্রজন্মকে। তিনটি রাজনৈতিক উপায় গ্রহণ কররার ফলে নব প্রজন্মকে বিপথে পরিচালনা করা তাদের জন্য সহজতর হয়েছে।
সেগুলো হলো :
১. ইসলাম সম্পর্কে তাদেরকে অজ্ঞ রাখা
২. মুসলমান জাতি ও পাক ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদেরকে অন্ধকারে রাখা এবং
 ৩. আলেম সমাজের মধ্যে অনৈক্য বিরাজমান রাখা
 ১. পৃথিবীর অন্যান্য বিজয়ী জাতিসমূহ যেমন বিজিত জাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তেমনি এদেশের এক শ্রেণীর মুসলমানও পাকিস্তান বিরোধী হিন্দু জাতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আচার-আচরণ, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী এমন কি বিশ্বাসের দিক দিয়ে যে হিন্দু জাতির প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি তার উজ্জ্বল প্রমাণ নব প্রজন্মের বিভিন্ন কর্ম তৎপরতা। তথাকথিত নব প্রজন্মের মনে ইসলামবিরোধী ভাবধারা অনুপ্রবেশের প্রধানতম কারণ হলো, এ প্রজন্মকে ইসলাম সম্পর্কে না বুঝতে দেয়া। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও সে সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোন সরকারই যুব সমাজকে ইসলামী প্রশিক্ষণ প্রদান ও চিন্তাধারার পরিশুদ্ধিকরণের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে ইসলামের সত্যতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভের সুযোগ তাদের হয়নি। আমরা দেখেছি বিংশতি শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত মুসলিম সমাজের একটি অংশকে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার বিষক্রিয়ায় জর্জরিত করে রেখোছিল। তাই ১৯১১ সালের ঈসায়ী সালের আদম শুমারিতে দেখা যায় কিছু লোক নিজেরা স্বীকারোক্তি করেছে যে, তারা হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়। একই ভাবে এত বছর পরেও নবপ্রজন্মের কতিপয় সন্তান নিজেদেরকে হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয় বলে ঘোষণা দিতে গৌরব বোধ করছে। হিন্দু পরিবেশে লালিত-পালিত হওয়ার কারণে শাহজাহান পুত্র দারা শিকোহ হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন। আর বর্তমানকালে নব প্রজন্মের সন্তানেরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এক চরম অশুভ শক্তি মুসলমানদের তৌহিদী আকীদাহ বিশ্বাস ও ইসলামী তমুদ্দুন ধ্বংসের জন্য এক শ্রেণীর মুসলমানদের প্রতিভাকে ব্যবহার করেছে যেমনটি করেছিল তাদের পূর্বপুরুষেরা। ব্যবহার করেছিল আকবরের প্রাতিভাকে।
২.-নব প্রজন্মকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে বা মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত কারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে তুলতে ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী যে মারাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে তা হলো তাদেরকে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস জানতে না দেয়া এবং সাথে সাথে মু&&ক্ত যুদ্ধ সম্পর্কে অসত্য তথ্য ও ইতিহাস শিক্ষা দেয়া। তারা এ কৌশল গ্রহণ করেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে যে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সব সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ইচ্ছা করেই অসত্য ও বিকৃত তত্ত্ব সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ফলে এসব কম বয়সী ছেলেমেয়েরা আবেগতাড়িত হয়ে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে মাঠে নেমে পড়েছে। সে সময়ের প্রকৃত ইতিহাস অনেকেই সাহস করে রচনা না করার ফলে এবং তাদের সামনে বিকৃত ইতিহাস পেশ হওয়ার কারণে তাদেরকে ভুল পথে পরিচালনা করা খুব সহজ হয়ে পড়েছে। সঠিক ইতিহাস পেশ করার অযোগ্যতা নব প্রজন্মকে উদ্বেলিত করার জন্য প্রধান ভাবে দায়ী বলে আমার মনে হয়।
কিন্তু বর্তমান সরকারতো নব প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস পেশ করছেই না বরং অসত্য বানোয়াট তথ্য পেশ করে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে, ইসলামপন্থীদেরকে নির্মূল করার জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ ইসলামপন্থীরাই একটি বিরাট শক্তির অন্যায় স্বার্থ রক্ষার বিরোধী শক্তি। সুতরাং তাদেরকে তো দমাতে হবেই।
৩- আলেম সমাজের অনৈক্য ইসলাম বিরোধীদের একটি ধারালো হাতিয়ার। অতীতে যেমন মুহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহ্হাবের কার্যকলাপকে ইসলাম বিরোধী এবং মতবাদকে ইসলাম থেকে পৃথক মতবাদ রূপে গণ্য করে ওহাবী মতবাদ রূপে প্রচার করা হলো তেমনি ইসলামী আন্দোলনের সঠিক ধারাকে মওদূদী মতবাদ রূপে আখ্যায়িত করে কিছু আলেমকে এর প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করাতে সক্ষম হলো। এই সুযোগ গ্রহণ করে এতদিন তারা সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে মুখ খুলেনি। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে দেখছে ইসলামী জনতার নাড়ির গতি। তারা দেখেছে যে কিছু ধর্মীয় নেতা জামায়াত-শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করলেও কিছু বলছে না। ইসলামী চেতনায় বিভেদ সৃষ্টি করতে পেরে তারা তাদের চক্রান্তে সফল হয়ে এখন গোটা আলেম সমাজের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গোটা আলেম সমাজের ইসলামবিরোধী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য বাংলাদেশের সমস্ত মসজিদের মুসুল্লীদেরকে জামায়াত-শিবিরের জনশক্তি আখ্যায়িত করে গোটা দেশে নারকীয় তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। সরকারের কাছে দাবি তুলতে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকারের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যখন দেশের সমস্ত মসজিদের মুসুল্লি জামায়াত-শিবিরের জনশক্তি তখন তাদের বিরুদ্ধে যারা স্লোগান দিচ্ছে তাদেরকে আস্কারা না দিয়ে আল্লাহ ওয়ালাদের বিরাট জনশক্তির  দাবির প্রতি সম্মান জানানো।
আসলে আওয়ামী সরকারেরর ঘাড়ে চেপে বসেছে নাস্তিক গোষ্ঠী। সে কারণে তাদের চক্রান্ত জাল ছিন্ন করে বের হয়ে আসা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নব প্রজন্মের চিৎকার দেখে স্মরণ হয় কোলকাতার যুগান্তর পত্রিকার আহবান। ১৯০৮ সালে ৩০শে মে কোলকাতার যুগান্তর পত্রিকা হিন্দুদের প্রতি এক উদাত্ত আহবান জানিয়ে বঙ্গ মাতার সমর্থকদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। বলা হয়, ‘‘ মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছে, একমাত্র কোন বস্তু তার পিপাসা নিবারণ করতে পারে। মানুষের রক্ত ও ছিন্ন মস্তক ব্যতিত অন্য কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না।’’ ঐ একই সুরে ইসলামবিরোধী যুগান্তর দলের কিছু নব প্রজন্মের সন্তানরা তাদের মা জননীকে খুশি করতে ইসলামী নেৃতৃবৃন্দের ফাঁসির দাবিতে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। আর তাদের আন্দোলনের পালে হাওয়া যোগাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের ইসলামের চির শত্রুরা। এখনও যদি তৌহিদী জনতার বিবেকোদয় না হয় তা হলে হয়তো কয়েক শতাব্দীর জন্য আবার তারা হারিয়ে যেতে হতে পারে ইতিহাসের পাতা থেকে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যখন কোন রাষ্ট্রে যাবতীয় ঐশ্বরিক ও মানবিক আইন এবং ন্যায়-নীতির প্রতি মানুষের সীমাহীন অশ্রদ্ধা সৃষ্টি হয় তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয় বিশৃক্মখলা।, খুন রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকার যে ভাবে নব প্রজন্মকে উস্কিয়ে দিয়ে কাল্পনিক গণজাগরণের দোহাই টেনে ঐশ্বরিক ও মানবিক আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর তৎপরতা শুরু করেছে  এভাবে এ প্রবণতা বেশি দিন চললে দেশের জন্য এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। জন লকের কথা, ‘‘ধর্ম সম্বন্ধে সরকার যেখানে অনুদার, নিয়ন্ত্রণ ও দমন যেখানে শাসনের অঙ্গ, সেখানে শান্তির আশা দূরাশা মাত্র।’’
নব প্রজন্মের সন্তানরদেরকে দোষ দিয়ে আমরা বুড়ারা দোষ মুক্ত হতে পারি না। কারণ লক বলেছেন ‘‘শিশু কোন দশের বা সরকারের প্রজা হয়ে জন্মায় না। সে থাকে পিতার অভিভাবকত্বে ও ক্ষমতাধীনে যতদিন না সে সাবালক হচ্ছে-’’ আমরাই তো শিশু-কিশোরদেরকে দীর্ঘ প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে কুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি, তাদের হাতে বিকৃত ইতিহাস তুলে দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি। আধো আধো বোলের শিশুদেরকে অমুকের ফাঁসি চাই স্লোগান শিখাচ্ছি। এসব সন্তান ভবিষ্যতে যখন বিখ্যাত ‘শাহনামা'র বীর সোহরাবের মতো সঠিক পিতৃপরিচয় লাভ করবে তখন ইতিহাস অনেক দূর গড়িয়ে যাবে।

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ফ্যাসিবাদের অশুভ পদচারণ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে


সিরাজুর রহমান

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জোসেফ ম্যাকার্থি ছিলেন বিধ্বংসী সাইকোনের মতো। যুদ্ধের আগে ও পরে বহু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা না পেয়ে খুবই তিক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন ম্যাকার্থি। অবশেষে রিপাবলিকান দলের হয়ে সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সর্বক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে অভিযোগ শুরু করেন। এমনকি তিনি অভিযোগ করেন যে ডেমোক্র্যাট-দলীয় প্রশাসনেও কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গোড়ায় খুব বেশি লোক তার প্রচার-প্রচারণাকে আমল দেয়নি। কিন্তু কোরিয়ার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লেজে-গোবরে অবস্থা এবং চীনে কমিউনিস্টদের জয়যাত্রায় বহু মার্কিনি তাদের দেশেও কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ঘাতের আশঙ্কায় ভয় পেয়ে যায়।
তারপর থেকে ম্যাকার্থির তাণ্ডব বেড়ে গেল। তিনি তখন সিনেটের নিরাপত্তা কমিটির সদস্য। সে সূত্রে তিনি সন্দেহভাজনদের তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। কেউ কোথাও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো নির্বিবাদ কথা বললেও ম্যাকার্থির কোপে পড়ে যান। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকেও বহু লোককে তিনি গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করেছেন। এর জের ধরে মার্কিন প্রশাসনও ঠগ বাছার মতো করে কমিউনিস্ট বাছতে শুরু করে। উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে বহু মার্কিন চিন্তাবিদ জীবিকার সন্ধানে ইউরোপে চলে আসেন। দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগ করেন অনেকে। বহু সরকারি চাকুরে, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, এমনকি হলিউডের তারকাও কর্মহীন হয়ে পড়েন। কূটনৈতিক মিশনগুলোতে বহু কূটনীতিক চাকরি হারান। অন্যেরা স্বাগতিক দেশেও কমিউনিস্ট প্রভাবের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
আমি নিজেও ম্যাকার্থির ‘উইচ-হান্টের’ শিকার হয়েছিলাম। কলেজজীবনে কেউ একজন একটা বই ধার দিয়েছিলেন। বইটা আমার ভালো লেগেছিল। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস গিডিয়ন জ্যাকসন কিভাবে নিজের চেষ্টায় উন্নতি করে অবশেষে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন; ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্টের উপন্যাসের উপজীব্য ছিল সে কাহিনী। হাওয়ার্ড ফাস্ট সিনেটর ম্যাকার্থির কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এসব আমার জানা ছিল না, থাকার কথাও ছিল না। পাকিস্তান তখন সিটো এবং সেন্টো সামরিক জোটের সদস্য এবং প্রচণ্ড রকম মার্কিন প্রভাবাধীন। সম্ভবত মার্কিন দূতাবাসের ইঙ্গিতে পাকিস্তানি পুলিশের ফেউরা আমার পেছনে লাগে। আমার একাধিক চাকরি পাবার, এমনকি বিবিসিতে যোগ দিতে পাসপোর্ট পেতেও খুবই অসুবিধা হয়েছিল।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকার জোসেফ ম্যাকার্থির মতোই ব্যর্থ। সে কারণে ক্রুদ্ধ ও তিক্ত। ভেবেচিন্তে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সরকার। মত্তহস্তীর মতো যেখানে পায় সেখানেই ঢু মারে। কতকগুলো অকর্মণ্য ও বেকার যুবককে ক্ষেপিয়ে দিয়ে তারা শাহবাগের মোড়ে সমাবেশ ঘটায়। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে পাশের দেশের গোয়েন্দা সংস্থার চরেরা। কিছুকাল পরে ধরা পড়ে যায় পাণ্ডাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল ধর্মদ্রোহীÑ যারা ব্লগে আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলাম নিয়ে পর্নোগ্রাফি প্রচার করছিল। সরকার যেসব কাজ করতে চায়, অথচ সমর্থনহীনতার কারণে করতে পারছে না, সেসব কাজ করার জন্য সমাবেশকে দিয়ে স্লোগান তোলানো হচ্ছে দিনের পর দিন। ফাঁসি, গলাকাটা ইত্যাদি দিয়ে তাদের স্লোগান শুরু করেছিল। তারপর থেকে সরকারের ইঙ্গিতে অথবা সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে সমাবেশ থেকে দাবির সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
 মুসলমানদের ভোটাধিকার রহিত করার ষড়যন্ত্র?
তারা জামায়াতে ইসলামীকে (একটি সুপ্রাচীন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল) নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে এবং সীমিত মেয়াদ দিয়ে সরকারকে আলটিমেটাম দিতে শুরু করে। শুধু মতামতই নয়, ঢালাওভাবে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিও তারা তুলেছে। অর্থাৎ যারা টুপি পরে, দাড়ি রাখে এবং যারা মসজিদে নামাজ পড়তে যায় তাদেরকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। এই যদি আইন হয় তাহলে বাংলাদেশে যে রাজনীতি করার যোগ্যতা বেশি লোকের (সরকারের ভোটব্যাঙ্ক হিন্দু ভোটাররা ছাড়া) থাকবে না সেটা পরিষ্কার।
নয়া দিগন্ত এবং আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন কলামে আমি আগেও বলেছিলাম, শাহবাগের গড্ডলিকার মধ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী র-এর বহু চর আছে। ভারত থেকে এখন তার স্বীকৃতি মিলেছে। ভারতের নেতৃস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৬ ফেব্রুয়ারি স্পষ্টই ঘোষণা করেছে সে কথা। এক প্রতিবেদনের শুরুতেই টাইমস অব ইন্ডিয়া বলেছে : ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত সড়ক-সন্ধি শাহবাগের প্রতিবাদকারীরা সবচাইতে জোরালো সমর্থন পাচ্ছে প্রতিবেশী ভারত থেকে।’
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে আরো বলা হয় : ‘ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন শুক্রবার বলেছেন (শাহবাগের) প্রতিবাদীরা বাংলাদেশের তরুণদের ‘মুক্ত মনের’ লক্ষণ এবং তারা গণতন্ত্রের মৌল মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখছে। শিবশংকর মেনন বলেন, ‘ঢাকার শাহবাগ মোড়ে হাজার হাজার তরুণের উগ্রবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চলমান সমাবেশ বাংলাদেশী তরুণদের অনুভূতির তীব্রতা, রাজনৈতিক সংগঠনের সামর্থ্য এবং মুক্ত মনের পরিচয় দেয়।’ উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদও শাহবাগের তাণ্ডব সৃষ্টিকারীদের অনুরূপ সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়েছিলেন।
 অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপ
আমাদের দেশের তরুণদের মন মুক্ত কি না অথবা শাহবাগে যা ঘটছে তার মধ্যে মুক্ত মনের সামান্যতম চিহ্নও আছে কি না, সেটা আমাদের ব্যাপার। তারা যে অত্যন্ত বিতর্কিত সে সম্বন্ধে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রশ্নের জবাব এখনো কেউ দেয়নিÑ এত দিন ধরে এই দঙ্গলকে খাবার ও মিনারেল ওয়াটার জোগানোর ব্যয়ভার কে বহন করছে। এখন জানা গেছে, সমাবেশের সংগঠকদের মধ্যে এমন লোকও ছিল যারা আল্লাহ, রাসূল সা: আর ইসলাম নিয়ে পর্নোগ্রাফি প্রচার করেছে এবং জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর সরকার তাদের তিন স্তরের নিরাপত্তার নির্দেশ দিয়েছিল। তরুণদের কাঁচা মনে শাহবাগীরা ঘৃণা ও সহিংসতার বীজ বপন করে দিয়েছে, শিশুদের গালে তারা ফাঁসি চাই, জবাই করো ইত্যাদি কথা লিখে দিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানায়ক কাদের (টাইগার) সিদ্দিকীকে রাজাকার ঘোষণার দাবি জানিয়েছে এবং যাকে তাকে রাজাকার বলে গালি দিচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতা থেকে গুণ্ডা পর্যন্ত সবাই। বাংলাদেশ যেন ম্যাকার্থির যুগের আমেরিকায় ফিরে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমান কাদের সিদ্দিকীকে টাইগার বলে সম্বোধন করতেন, তাকে বীর উত্তম উপাধি ও সম্মাননা দিয়েছিলেন। যুদ্ধে তার নিজের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। অন্য দিকে এই অসামরিক ব্যক্তিটি (কাদের সিদ্দিকী) নিজের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গোষ্ঠী গঠন করেছিলেন এবং তাদের নিয়ে অমিতবিক্রমে যুদ্ধ করেছেন।
টাঙ্গাইল অঞ্চলে তিনি পাকিস্তানিদের জন্য বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিলেন। তিনি যদি রাজাকার হন তাহলে কোন বিচারে অন্যরা রাজাকার নন? তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলেই যদি রাজাকার হয়ে যেতে হয় তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই বরং রাজাকার হতে রাজি হবে। জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে গালিগালাজ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রসারিত করে বর্তমান সরকার জামায়াতের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। যাকে তাকে রাজাকার বলে এখন শাহবাগীরা রাজাকার কথাটাকে অর্থহীন করে ফেলেছে।
মিথ্যা অপবাদ, গালিগালাজ ইত্যাদি আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র না হওয়াটাই বিচিত্র ছিল। কেননা এ দলের নেত্রী মিথ্যা অপবাদ, গালিগালাজ, অশ্রাব্য কটূক্তি ইত্যাদির ব্যাপারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এ দলের নেতারাও এখন মিথ্যা বলা, অপবাদ দেয়া এবং গালি ও হুমকির ব্যাপারে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব হানিফের কথাবার্তা একজন অশিক্ষিত লাঠিয়ালের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ সম্বন্ধে বলা হয় দিনরাত্রির কোনো কোনো সময় তার কল্পনা অতিমাত্রায় প্রবল হয়, তার সে সময়কার কথাবার্তাকে গ্রাহ্য করতে নেই। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর যাবেন চিকিৎসা করাতে। সৈয়দ আশরাফ বিবৃতি দিয়ে বললেন, আসলে খালেদা জিয়া যাচ্ছেন বিদেশী শক্তিদের সাথে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করতে। তিনি আরো দাবি করেছিলেন, তার কাছে প্রমাণ আছে। সৈয়দ আশরাফ এখন সে প্রমাণ জাতির সামনে পেশ করুন। নইলে বাংলাদেশের মানুষের চোখে তিনি বরাবরই মিথ্যাবাদী হয়ে থাকবেন।
 হট্টগোলের অন্তরালে করিডোর
এখন আমরা জেনে গেলাম শাহবাগের নৈরাজ্যের আসল অনুপ্রেরণার উৎস কোথায়। কিন্তু পেছনের কারণটা কী? শাহবাগ সমাবেশ এবং একজন মানুষকে ফাঁসির দাবি নিয়ে যখন মানুষের মনোযোগ ভিন্নমুখী তখন শোনা যাচ্ছে যে ভারতকে করিডোর দেয়ার আয়োজন পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সৈন্য ও অস্ত্র পাঠানো, চীনের সাথে অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হলে সৈন্য ও অস্ত্র সরবরাহের অবাধ পথ হিসেবে এসব করিডোর ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপস করে বিনা ফিতে ভারতকে করিডোর দেয়ার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে করিডোর দিতে রাজি হয়ে দিল্লির সাথে গোপন চুক্তি করে এসেছিলেন। ভারত এখন বুঝে গেছে নির্বাচন হলে শেখ হাসিনার আর কখনো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তারা করিডোরগুলো পাকাপাকি করে ফেলতে চায়। এখনই যেমন শাহবাগের ব্যাপারেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপ করছে ভারত, করিডোর তৈরি হয়ে গেলে বাংলাদেশকে তারা বাড়ির পেছনের বাগান কিংবা পুকুরের মতো দেখবে। অন্য দিকে শেখ হাসিনাও জানেন ভারতের যেকোনো দাবি মেনে নিতে তিনি বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের শহীদানের আত্মা কি এখন বিমর্ষ হয়ে ভাবছে না তারা কেন এই চরম ত্যাগ স্বীকার করলেন?
একদল তরুণকে ক্ষেপিয়ে তুলে অ্যাডলফ হিটলার তার নাৎসিবাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন। তারা বেছে বেছে চিন্তানায়ক, লেখক, সাংবাদিকদের জার্মান জাতির শত্রু বলে অপবাদ দিয়েছে; তাদের নির্যাতন ও হত্যা করেছে। তারা সংবাদপত্র সাময়িকী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে প্রকাশ্য স্থানে স্তূপাকার করে পুড়িয়ে দিয়েছে। এর জের ধরে তারা জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগও পুড়িয়ে দিয়েছিল। শাহবাগের নৈরাজ্যকে এখনই নিবৃত্ত করা না হলে বাংলাদেশেও ত্রিশের দশকের জার্মানির মতো ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির আশঙ্কা অত্যন্ত বাস্তব। হিটলারের পরিণাম শুভ হয়নি। সস্ত্রীক আত্মহত্যা করতে হয়েছিল তাকে। মাঝখানে তিনি একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, কয়েক কোটি লোক হত্যা করেছিলেন এবং মানব সভ্যতাকেই বিপন্ন করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টদের পরিণতি তার চেয়ে ভালো হওয়ার কথা নয়। মাঝখান থেকে তারা আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকেই বিপন্ন করে তুলেছে। (লন্ডন, ২৭.০২.১৩)
serajurrahman34@gmail.com

বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শাহবাগ-মঞ্চের বিপক্ষে গেল জনমত জরিপ


শাহবাগ-মঞ্চের বিপক্ষে গেল জনমত জরিপ
ক্ষমতা লিপ্সার রাজনীতি কি মাদকের চাইতেও ভয়ংকর নয়! মাদকের ক্ষতি সম্পর্কে তো আমরা সবাই সোচ্চার। তাই আমরা বলি মাদককে ‘না' বলুন। কিন্তু ক্ষমতা লি≈vর রাজনীতি যখন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির জীবনযাপন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে তখনও অনেকে এভাবে চুপ করে আছেন কেমন করে? যারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন তারা না হয় এক ধরনের মাদকতায় বুঁদ হয়ে আছেন, কিন্তু অন্যরা? যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শুরু করা শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলন এখন যে রূপ গ্রহণ করেছে তা ক্ষমতা লি≈vর ভয়ংকর চিত্রটি প্রকট করে তুলেছে। সরকারের সহযোগিতায় ব্লগারদের সাথে জোট সরকারের ছাত্র সংগঠনের নেতারা সমবেত কণ্ঠে গত কিছুদিন ধরে যেভাবে- ফাঁসি, জবাই, গ্রেফতার, জ্বালাও-পোড়াও ও হুমকি-ধমকির কোরাস গেয়ে চলেছে তাতে দেশে সৃষ্টি হয়েছে হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মহননের এক বাতাবরণ। এমন বাতাবরণের করুণ শিকার হয়েছে কোম্পানীগঞ্জের এক শিশু। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, নোয়াখালির কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় কাদের মোল্লার প্রতীকী ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে আবদুর রহমান শাকিলের। শিশুটি বসুরহাট পৌরসভার ব্যাপারী বাড়ির মৃত আবদুল বারিকের ছেলে। জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ সাজিয়ে রোববার রাতে শিশু-কিশোরদের ‘ফাঁসি-ফাঁসি খেলা' উপভোগ করছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ কিছু লোকজন। এ ক পর্যায়ে রাত ৮টায় ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে গলায় ফাঁস লেগে মারা যায় শাকিল। শাকিলের বাবা-মা কেউ নেই। সে থাকতো নানার বাড়িতে। এতিম এ শিশুটির মৃত্যুর দায় কে নেবে? শিশুটি ক্ষমতার রাজনীতি ও শাহবাগ মঞ্চের দায়িত্বহীন প্রোপাগান্ডার করুণ শিকারে পরিণত হলো। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শাহবাগ মঞ্চের কুশীলবরা রাজনীতির মাদকতায় এতটাই উন্মাতাল হয়ে পড়েছে যে, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্কুলের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শাহবাগে জড়ো করে হিংসা-বিদ্বেষ, জবাই ও ফাঁসির শ্লোগান মুখে তুলে দিয়েছে। এরপ্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার একটা খন্ড চিত্র যেন জাতি অবলোকন করলো শিশু-শাকিলের মৃত্যুর ঘটনায়।
এরপর শাহবাগ মঞ্চের নায়কদের মধ্যে কোনো বোধোদয় লক্ষ্য করা যায়নি। একটি এতিম শিশুর করুণ মৃত্যুতে কার বা কি এসে যায়!
আদালত একের পর এক যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায়ের পরে ব্লগার এক্টিভিস্টদের নামে হঠাৎ করে শাহবাগ মঞ্চে যে নাটক মঞ্চস্থ করা হলো তাতে গোলক ধাঁধার সৃষ্টি হলো জনমনে। জনমনে প্রশ্ন জাগলো যুদ্ধাপরাধ বিচারের আদালত তো সরকারই গঠন করেছে, রায় প্রদানও শুরু হয়েছে, তারপরেও আবার এ মঞ্চ কেন? আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যে সরকার এ আদালত গঠন করেছে সে সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা পর্যন্ত শাহবাগে এসে রায় মানি না, মানি না শ্লোগানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। এভাবেই সরকার গঠিত আদালতের রায় সরকারি প্রশ্রয়েই বিতর্কিত করার এক বিরল উদাহরণ লক্ষ্য করা গেলো। এসব ঘটনা থেকে এখন পর্যবেক্ষক মহল উপলব্ধি করছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার মূল লক্ষ্য নয়, সরকারের মূল লক্ষ্য হলো, নির্বাচনের এ বছরটিতে তরুণ প্রজন্মের নামে একটি নাটক মঞ্চায়ন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা। সরকার হয়তো ভাবছে, এর মাধ্যমে সরকারের ব্যর্থতাগুলো ঢেকে রেখে আগামী নির্বাচনে বিজয়ের পথকে মসৃণ করা যাবে। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে এতটা বোকা ভাবলে সরকার ভুলই করবে। শাহবাগ মঞ্চকে রাজনীতিকীকরণের ফলে গণ সমর্থনে ভাটা লেগেছে। আর শাহবাগ মঞ্চের নায়কদের পরিচিতি প্রকাশ পাওয়ায় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শাহবাগ মঞ্চে ক্ষমতার রাজনীতির মুখোশ ছাড়াও আরো একটি মুখোশ লক্ষ্য করা গেছে। ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগাররা যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী সংগঠন নিষিদ্ধ করার কৌশল অবলম্বন করেছে। তাদের স্মারকলিপিতে তেমন অভিপ্রায় লক্ষ্য করা গেছে। এখন বলা হচ্ছে, ব্লগাররা ধর্মপরায়ণ। কিন্তু ইসলামী জনতা মাঠে না নামার আগ পর্যন্ত তাদের ইসলাম প্রবণতার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এখন তো সরকারও ইসলাম ও নবীর পবিত্রতা রক্ষার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ মহান আল্লাহ, মহানবী (সঃ), নামাজ, রোজা, হজ্জসহ পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিধি-বিধানকে কটাক্ষ করে কুৎসিত ও উগ্র মন্তব্যকারী ব্লগারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ আমলে নেয়নি সরকার। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার স্বার্থে ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত প্রদানকারী ব্লগারদের বিরুদ্ধে প্রায় এক বছর আগেই সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পাশাপাশি ঐসব ব্লগারের ব্যবহার করা ব্লগ ও ফেসবুক স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লিখেছিল বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)। উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনার ভিত্তিতে এই সংস্থাগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে ওই ধরনের সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উল্টো সরকার শাহবাগ মঞ্চের নেতৃত্ব প্রদানকারী ধর্মবিদ্বেষী ব্লগারদেরকে প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। এছাড়া ফেসবুক ও ইন্টারনেটে সরকারের অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী আচরণের যারা সমালোচনা করছেন তাদের ধর-পাকড় করা হচ্ছে। পাশাপাশি যেসব ব্লগে সরকার ও নাস্তিক ব্লগারদের সমালোচনা করা হয় সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আরো মজার তথ্য হলো, ধর্ম ও রাষ্ট্রদ্রোহী ব্লগারদের নেতৃত্ব প্রদানকারী আসিফ মহিউদ্দিনকে ২০১০ সালের ১ অক্টোবর তারিখে একবার আটক করেছিলো ডিবি পুলিশ। তখন সরকারের বিরুদ্ধে না লেখার মুচলেকা নিয়ে ও বিয়ে করে সংসার করার পরামর্শ দিয়ে তাকে গ্রেফতারের ১৮ ঘণ্টা পরেই ছেড়ে দেয়া হয়। এসব আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায় সরকার ইসলাম ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় কতটা আন্তরিক ও সচেতন।
শাহবাগ আন্দোলনের হঠাৎ বিস্ফোরণ দেখে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন জেগেছিল, মাত্র কয়েকজন ব্লগারের পক্ষে এত সুসজ্জিত ও বর্ণাঢ্য আন্দোলনের আয়োজন করা কিভাবে সম্ভব হলো? ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হলো ব্লগাররা একা নয়, তাদের সাথে যুক্ত ছিল সরকারি ঘরানার ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু এখন জানা গেলো, শাহবাগ আন্দোলনের পেছনে মদদ ছিলো আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেরও। এটা জামায়াত-শিবিরের বর্ণনা নয়, এ তথ্য প্রকাশ করেছে ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া'। গত মঙ্গলবার দৈনিকটির ‘প্রোটেস্টারস অ্যাট শাহবাগ ইন বাংলাদেশ ব্যাকড বাই ইন্ডিয়া' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম শাহবাগ মোড়ের আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রতিবেশী ভারতের জোরালো মদদ রয়েছে। মদদের প্রমাণ হিসেবে ভারতের অন্যতম দুইজন নীতি-নির্ধারকের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এদের একজন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন এবং অন্যজন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ। এসব কিছুর পরেও কি বাংলাদেশের কোনো সচেতন নাগরিক একথা বিশ্বাস করবেন যে, শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলন দল ও রাজনীতি নিরপেক্ষ কিছু ব্লগারের একটি নিাপ ও মহৎ আন্দোলন? ভারত আসলে তার স্বার্থ ছাড়া কোনো কথা বলে না, কোনো কাজও করে না। দেশের সচেতন সাংবাদিকরা বিষয়টি খুব ভালো করেই জানেন। এ কারণেই হয়তো পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘শাহবাগের আড়ালে ভারতকে করিডোর দেয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত।' এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং' চুক্তির আওতায় ভারতকে বাড়তি ফি ছাড়াই করিডোর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত উপকূলীয় সমুদ্র সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে এরই মধ্যে যৌথভাবে প্রতিবেদন, খসড়া চুক্তি ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রোসিডিউর (এসওপি) তৈরি করেছে। এর আগে দু'দেশের প্রতিনিধি দল উপকূলীয় সমুদ্র এলাকা ও সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলো পরিদর্শন করেছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারে এ সংক্রান্ত বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য আসাম, মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সরাসরি চলে যাবে। ভারতীয় বিভিন্ন ক্যাটাগরির জাহাজ বাংলাদেশী উপকূলীয় সমুদ্র সীমা অবাধে চলাচলের সুযোগও পাবে। এতে পণ্য পরিবহনে ভারতের সময় ও অর্থ উভয় দিকেই সাশ্রয় হবে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সুবিধা না দেয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ সরকারের একটি সংস্থা। তারপরেও এসব আপত্তি উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ভারত সরকারের আবদার পূরণে এ সুযোগ দিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এটি তো মাত্র একটি উদাহরণ। গত কিছু দিনের শাহবাগ আন্দোলনের আড়ালে সরকার নিজেদের ব্যর্থতার আরো অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখতে চাইছে। গত কিছু দিনের ডামাডোলে শাহবাগ মঞ্চের লোকজন যেন একথাই বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে চাইছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিটাই এখন বাংলাদেশের জন্য সবকিছু। কিন্তু সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন যে, সরকারের প্রতিশ্রুতির মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় ছিলো। সরকারের শেষ বছরে সেই সব বিষয়গুলোরও তো হিসেব নিতে হবে। কিন্তু শাহবাগ মঞ্চের বাতাবরণ যেন অন্য সব বিষয়কে ঢেকে ফেলতে চাইছে। কিন্তু ঢেকে ফেলতে চাইলেই কি সব ঢেকে ফেলা যায়? চাতুর্য ও কৌশলেরও তো একটা সীমা আছে। শাহবাগ মঞ্চের নায়করা আদালতের ওপর নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা কি একটা ঔদ্ধত্য নয়? সরকারের প্রশ্রয় ছাড়া প্রকাশ্য রাজপথে দিনের পর দিন যান চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এমন ঔদ্ধত্য প্রকাশ তো সম্ভব নয়। ফাঁসির দাবির সাথে এখন তারা আবার যুক্ত করেছে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি। সরকারও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চাইছে। সরকারের মন্ত্রী মহোদয়গণ সে কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। তারা বলছেন, সমগ্র জাতি আজ জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে। কিন্তু তারা যে ঠিক কথা বলছেন না তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জনমত জরিপে। সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গণমাধ্যম তাদের অনলাইনে পাঠকদের মধ্যে জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ৭৯ শতাংশ পাঠকই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। পাঠকরা হয়তো মনে করতে পারেন ঐসব গণমাধ্যম জামায়াত সমর্থক। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, ঐসব গণমাধ্যম জামায়াত-শিবিরের সমালোচক হিসেবেই পরিচিত। জরিপ পরিচালনাকারী গণমাধ্যমগুলো হলো- দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম, বাংলা নিউজ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যায়যায়দিন, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নিউ এজ ও দৈনিক সমকাল। লক্ষণীয় বিষয় হলো- সরকার ও শাহবাগ মঞ্চসহ বিভিন্ন মহল থেকে যখন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ডাক দেয়া হচ্ছে, তখন আলোচ্য নয়টি গণমাধ্যমের জরিপের ফলাফল কি ভিন্ন কথা বলছে না? বিষয়টি উপলব্ধির জন্য গণতান্ত্রিক চেতনা প্রয়োজন কিন্তু সরকার ও শাহবাগ মঞ্চের কর্তাদের মধ্যে তেমন কোনো চেতনা আছে কি না সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কোন পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ


বাংলাদেশ ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল অনেক সমস্যায় কণ্টকিত হয়ে। ভাত-কাপড়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তো ছিলই; আর সব সমস্যা ছিল দেশটাকে প্রায় পুরো বেস্টন করে রাখা ভারতের সঙ্গে।
অতীতের খবর যারা রাখেন, তারা জানেন, শেখ মুজিবের সময় থেকেই ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিরোধীয় বিষয়গুলো নিত্তি নিয়ে টালবাহানা চলেছে। কিন্তু কোনো সমস্যারই সমাধান তখন হয়নি। সমাধান হয়নি গঙ্গার পানি বন্টনের, দহগ্রাম-তিনবিঘা করিডোরের, ট্রানজিটের, দক্ষিণ তালপট্টির, অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়ের। বলতে দ্বিধা নেই, মুজিব ভারতের কোনো ‘আবদার'ই রক্ষা করেননি। তিনি সেই সময় ভারতের প্রধান দাবি গ্যাস দিতেও সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। তখন বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনো নিত্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। যেগুলো ছিল বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরার সমস্যা, সেগুলো ভারতের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। তারা গুরুত্ব দিয়েছিল, তারা বাংলাদেশ থেকে যা পেতে চায়, সেগুলোর ওপর। তারা পেতে চেয়েছিল বাংলাদেশের গ্যাস, পেতে চেয়েছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে যাতায়াতের ট্রানজিট, পেতে চেয়েছিল ছিটমহল বেরুবাড়ি, দক্ষিণ তালপট্টি। মুজিব অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন এসব ব্যাপারে। তিনি সতর্ক ছিলেন ভারতের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাওয়ার বিষয়েও। কিন্তু তারপরও সামাল দিতে পারেননি-ছিটমহল, বেরুবাড়ি-দহগ্রামের বিষয়টিকে।
মুজিব পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসার প্রায় পরপরই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করে নিয়েছিল ভারত। চুক্তিটি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত বেরুবাড়ি দখল নিয়ে সমস্যায় ফেলে রাখে দহগ্রাম-তিনবিঘাকে। এ বিষয়ে মুজিবের সময় বার বার বৈঠক হয়েছে ভারতের সঙ্গে। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। তিনবিঘা করিডোর কথাটির ব্যাখ্যা নিয়েই সেসব বৈঠক ভেঙ্গে গেছে। এ বিষয়ে ভারত যা পেতে চেয়েছে এবং বাংলাদেশকে যা বোঝাতে চেয়েছে মুজিব তা মানেননি।
আওয়ামী লীগ কোন পথে হাঁটছে আজ, এটি একটি সরব প্রশ্ন। বর্তমান পথ তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত পথ?  আজ যখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তার মন্ত্রীরা ভারতের পক্ষে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন, তখন তাদের দেশপ্রেমই বা কি আছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
মুজিব বিদ্বেষীদের কাছে টেনে আস্থায় নেওয়া, অন্যদিকে দল ও নেতার প্রতি আজীবন অনুগত অবিচল নেতা-কর্মীকে অবিশ্বাস করে অনাস্থায় দূরে ঠেলে দেওয়া অবিশ্বাস্য। অসংখ্য মুজিব অন্তঃপ্রাণ কর্মী আজ পরাহূতই নন, অবিশ্বাসের পাত্রও। প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আছেন দেউলিয়া মুজিব বিদ্বেষী, আওয়ামী লীগ বিরোধী, স্তাবক ও মোসাহেব।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এমন অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নূরে আলম সিদ্দিকি। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২)
শেখ মুজিব সব সময়ই সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রাদর্শের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সে সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তিনি কখনো খুলে বলেননি এবং এটাও পরিস্কার যে, মুজিবের সমাজতন্ত্রে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর কোনো স্থান ছিল না। হাই কমান্ড গোড়া থেকেই একদলীয় পদ্ধতি চেয়েছিলেন। ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দেবো' তিনি জাসদকে লক্ষ্য করেই বলেছিলেন। লাল ঘোড়াকে দমনের কোনো চেষ্টারই ত্রুটি হয়নি।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা সহিংসতা ও অসাধুতা দ্বারা অন্তত চারটি আসনে (জাসদের কাছ থেকে) বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। মনে রাখতে হবে সে সময় বাংলাদেশে জাসদ ছাড়া অন্য কোনো সুসংগঠিত সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে জাসদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। (সূত্রঃ মুজিব হত্যায় জাসদের কোন ভূমিকা ছিল কি?, সিরাজুর রহমান, দৈনিক নয়াদিগন্ত ৩০ নবেম্বর ২০১২)
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে রক্ষীবাহিনী যে কম বেশি ৪০ হাজার লোককে হত্যা করেছিল তাদের প্রায় সবাই ছিল জাসদের কর্মী কিংবা সমর্থক। জাসদের প্রভাবমুক্ত একদলীয় সংসদ গঠনের উদ্দেশ্যেই ১৯৭৩ সালে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। সে নির্বাচনে জাসদ অল্প কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকেরা সেটাকে বেয়াদবি বলেই তাকে বুঝিয়েছিল। অথচ জাসদের হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনা সরকারের তথ্য মন্ত্রী হয়েছেন।
নির্বাচন সস্পর্কে মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘.....নির্বাচনের পরও দেখা গেল প্রশাসনযন্ত্রের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা তাদের ফলাফল পরিবর্তন করে ফেলেছেন। মেজর (অবঃ) জলিল, শাহজাহান সিরাজ, নূরুদ্দিন জাহিদ, নুরুল ইসলাম মাষ্টার ও মোহাম্মদ ইসমাইলকে তাদের আসনে নিশ্চিত বিজয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে....বেতার ও টিভিতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা যায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রথম সারির নেতা নির্বাচনে পরাজিত হতে চলেছেন। তখন তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রচারের জন্য গণভবনে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলেন.....এমনকি ভোট গণনা ও ফলাফলের প্রবণতা যখন কয়েকজন বিরোধী দলের নেতার সুনিশ্চিত বিজয়ের ইংগিত দিচ্ছিল, তখন অন্ততঃ পক্ষে ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। তারা সমস্ত ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানে ব্যালট ভর্তি বাক্স রেখে আসে.......আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা শুধু নির্বাচিত হবারই চিন্তা করেননি বরং নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের প্রতিযোগিতায় নেমে নির্বাচনের পরিবেশকে উত্তপ্ত করেছেন। নিজেদের মধ্যেই একটি অকথিত প্রতিযোগিতা ছিল কে বেশী ভোট লাভ করতে পারেন। ঢাকা-১৩ আসনে দেখা গেল গাজী গোলাম মোস্তফা প্রদত্ত ১,৬২,৩০৬ ভোটের মধ্যে ১,১০,২৮৪ ভোট পেয়েছেন, অথচ শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা-১৫ আসন থেকে পেয়েছেন ১,০৫,৯৫৮ ভোট। তখন তাঁর (শেখ মুজিবের) ভোট বাড়িয়ে ১,১৪,৯২৮ টি করা হয়। এসব এলাকায় সত্তরের স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনেও এত বিপুল ভোট পড়েনি.......।'
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ভাষায়, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রী ছিলেন বলে ইনুদের দাবি অনুযায়ী বিপ্লবী সরকার গঠন না করে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করতে যান। সে সময় ইনুরা মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করে গণবাহিনী গঠনের মাধ্যমে গোপন রাজনীতিতে গিয়ে অন্ধকারের কর্মকান্ডে সরকারকে নাস্তানাবুদই করেননি, দলের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে জুতা বানানোর কথাও বলেছিলেন। এমনকি বিপ্লবী সরকার গঠনে তাহেরের নেতৃত্বে নিষ্ফল যে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন তার তৎপরতা মুজিব শাসনামলেই শুরু করেছিলেন। তাই সেদিন সংসদে কী বলবেন জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনুকে বলে বসেন, সংসদে তোমার বক্তব্য রাখা যত সহজ, আওয়ামী লীগ নেতাদের তত সহজ নয়। তুমি সংসদে বলবে, যে বঙ্গবন্ধুকে যৌবনে উৎখাত করতে পারিনি, আজ জীবনসায়াহ্নে তার কন্যার শাড়ির অাঁচল ধরে সংসদে আসায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
মঞ্জু বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ ইরাক আক্রমণ ও সাদ্দামকে হত্যা করার জন্য অনেক কারণের মধ্যে একটি উল্লেখ করেছিলেন যে সাদ্দাম তার পিতাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তাই পিতার শত্রুকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সেখানে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিশোধ নয়, এমপি-মন্ত্রী বানিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন। আমরা সবাই বলি, রাজনীতিতে চিরশত্রু বা চিরমিত্র বলে কিছু নেই, সেটি প্রধানমন্ত্রী বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২)
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার গুটি কয়েক সদস্য ছাড়া অধিকাংশেরই রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে দেশবাসীর কোনো ধারণা নেই। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় তারা কতটা যোগ্য বা পারদর্শী, তা নিয়েও মন্তব্য করা কঠিন। আসলে এদের সম্পর্কে জানার সুযোগই তো আগে কখনো হয়নি। এদের অনেককেই আগে মন্ত্রী হিসেবে তো দূরের কথা, একটি সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হিসেবেও মিডিয়ায় নাম দেখা যায়নি।
রাজনীতির ময়দানেও কি ডা. দীপু মণি, ফারুক খান, খন্দকার মোশাররফ হেসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাকদের কখনো দেখা গেছে? এরাই তো আজ বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন!
জোট সরকারের শাসনামলে বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকার সময় বোমাবাজির অজুহাতকে পুঁজি করে শেখ হাসিনার জন্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দাবিটি এতো শিগগির কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এক একটি বোমাবাজি হয়েছে বা ঘটানো হয়েছে এবং সাথে সাথেই দলীয়ভাবে প্রকাশ্যেই দাবী করা হয়েছিল যে, শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন; তাই বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় খরচেই করতে হবে।
তিনি যখন দেশে থাকবেন, তখন যেমন বিশেষ সরকারী ভবন তার জন্য ছিদ্রহীন নিরাপত্তাসহ সংরক্ষণ করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে তিনি যখন বিদেশে-ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে এমনকি বেসরকারীভাবে ভ্রমণ করবেন, অবস্থান করবেন, তখনও প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয় করে তার নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
নজিরবিহীন এমন দাবীর ঘটনা কোন সভ্য দেশে কেন, অন্য কোন দেশেই খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও এই নজিরবিহীন বিশেষ নিরাপত্তার জন্য ওরা নিজেদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে বিশেষ বিধানও তৈরি করেছে। শুধু কি তাই? এই আইনী নিরাপত্তার জন্য দেশের গরীব জনগণের ট্যাকসের টাকার কোষাগার থেকে কোটি কোটি ডলারের খরচাদিও বরাদ্দ হয়েছে।
শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলেই সরকারী বিশাল গণভবন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও নেয়া হয়েছিল। জাতীয় সংসদে আইন তৈরি করে হাসিনার আজীবন বসবাসের জন্য নিশ্চিত করেছিল। জোর জবরদস্তিমূলকভাবে জনগণের সম্পত্তি ব্যক্তিগতভাবে কুক্ষিগত করার জঘন্য নজির এই বাংলাদেশেই আওয়ামী লীগ সম্ভব করেছিল। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি যে অসংখ্য প্রপাগান্ডা আমরা শুনতাম, তাকি এতদিনে নিছক উদ্দেশ্যমূলক প্রপাগান্ডা বলে প্রমাণিত হয়নি?
সংবাদপত্রে প্রকাশ, ভারতের সঙ্গে নাকি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় দু'দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি হতে থাকে ও অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দিল্লির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন আশ্বাস না পাওয়ায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। মনমোহনের ঢাকা সফরকালে যে অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তিতে রাজি হননি, সেই অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেননি তিনি। বরং ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তিস্তা চুক্তি না করতে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে রাজি করাতে একাধিকবার চেষ্টা করেছে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লিকে বোঝানোর জন্য পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেন মমতা ব্যানার্জি। মমতা এক সদস্যের এই কমিশনকে দায়িত্ব দেন তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে। কমিশন তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে কোন প্রতিবেদন পেশ করেনি। রুদ্র কমিশনের প্রতিবেদন তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী পানি দেয়ার জন্য অনুকূল নয়। তাই এই কমিশনের প্রতিবেদনটি আর আলোর মুখ দেখেনি। মনমোহনের ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিট চুক্তিতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিটের ব্যাপারেও বাংলাদেশ আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি।
সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই মহাজোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। মহাজোটের ভোটের বাক্সে যে উলম্ফন ঘটিয়েছিল গেল বার, আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার ব্যত্যয় ঘটবে; উল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব-নিকাশ।
শেয়ারবাজারে পুঁজি খোয়ানো ক্ষুদে বিনিয়োগকারীরা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। বৈদেশিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে অসস্তুষ্টি রয়েছে। বেসামাল আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক মহলে ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ। এ ধরনের অস্বস্তি, বিব্রতকর ও উৎকণ্ঠাময় পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ঘটনা।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের ‘অনুরোধ' সত্ত্বেও ড. ইউনূস ইস্যুর সম্মানজনক নিত্তি না হওয়ায় দূরত্ব তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে। ড. ইউনূস ইস্যুতে সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ঢাকায় এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে দূরত্ব। এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়। শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র।
দূরদৃষ্টিমূলক সিদ্ধান্ত না থাকায় উদার হয়ে পড়া মিয়ানমারের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ এখনও গড়ে উঠছে না। স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বক্তৃতা হলেও কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারগুলোতে এখন প্রতিদ্বনদ্বী দেশগুলোর প্রাধান্য। তছনছ হয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে খুব একটা ভালো করতে পারছে না বাংলাদেশ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস-ইউপিডিএফের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একে অপরকে ঘায়েল করতে তারা মরিয়া। পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটির কুদুকছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১০০ জন নিহত হয়েছেন।
 নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি। প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থানে নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হচ্ছে। পুলিশ ও র‌্যাব স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় অপরাধ কর্মকান্ড চালাচ্ছে। বেপরোয়া সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। খুন, ডাকাতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জবরদখল ও নারী নির্যাতনসহ সব ক্ষেত্রেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামাল। সাধারণ মানুষের মধ্যে অপহরণ বা নিখোঁজ আতংক বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তেষ্টি রয়েছে ঘরে-বাইরে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রায়ই তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা তুলে ধরেন। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও পিছিয়ে নেই। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী জীবিত না মৃত কেউ বলতে পারছেন না। মহাজোট সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭ হাজার ৩২ জনকে মামলা থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় যাদের নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে অধিকাংশই সরাসরি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত।
বর্তমান সরকার চাঞ্চল্যকর দুটি হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ২২ আসামির দন্ডাদেশ মওকুফ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
 সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ড, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা, সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার ও এমপি হোস্টেলের ভেতরে অজ্ঞাত এক মহিলার গলিত লাশ উদ্ধারের রহস্য উদঘাটিত হয়নি।
আন্তর্জাতিক বাজারে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় সরকারের খরচ বেড়েছে। শুধু অতিপ্রয়োজনীয় নয়, শৌখিন পণ্যের দামও বেড়েছে। সোনার দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
গ্যাস সংকটে দেশের শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। রাজধানীর আশপাশের এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট বেশ প্রকট হচ্ছে। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সফিপুর, কোনাবাড়ী এলাকায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দিনরাতে কারখানাগুলো ৩০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছে না। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট খুব শিগগির কাটবে এমন কোন সংবাদ জানা যায়নি।
দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না গেলে অনেক বিনিয়োগ রুগ্ন হয়ে পড়বে। মাত্র কয়েক বছর আগে বলা হয়েছিল দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। এ অফুরন্ত গ্যাস ভান্ডারের ফর্মুলা দিয়ে তখন গ্যাস রফতানির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল সরকার। আর এখন গ্যাস মিলছে না। বিদ্যুৎ সংকটে শিল্প ইউনিটগুলোর শত শত কোটি টাকার চলমান প্রকল্প মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
দেশে যেভাবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি চলছে তাতে ক্ষমতাবানদের অবৈধ সম্পদ বাড়বেই। তাই সম্পদ অর্জনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হিসাব দাখিল করতে হবে।  শুধু মন্ত্রী কিংবা এমপির  সম্পদ বিবরণী নিলে হবে না, তাদের ওপর নির্ভর কিংবা নির্ভরশীল নয়-পরিবার ও পোষ্যদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরও সম্পদ বিবরণী দিতে হবে। কেননা মন্ত্রী-এমপিদের সন্তান ছাড়াও পরিবারের নিকটতম বিভিন্ন সদস্যদের নামে অঢেল সম্পত্তি থাকার প্রমাণ এরই মধ্যে মিলেছে। এছাড়া শুধু একবার সম্পদ বিবরণী নিলে কাজ হবে না, নিয়মিত প্রতি বছর নিতে হবে এবং তা মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকতে হবে
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিভেদের রাজনীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, ঠিক এই মুহূর্তে, মানে এই লেখাটি তৈরি করার সময় আমি মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ। কলম দ্বারা আমার মনের অবস্থা বুঝানো একেবারেই অসম্ভব। মন বা হৃদয়ের অবস্থা লিখে বা বলে মানুষ বিশ-পঁচিশ ভাগ প্রকাশ করতে পারে। তাই আমার প্রিয় কবি মাওলানা রুমি বলেন, শব্দহীনতার শব্দ। সময়হীনতার মাঝে বসবাস করা। আমার মালিক মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, তোমরা সময়কে গালি দিয়ো না, আমিই সময়।’ যা হোক, চলমান সময়ের ঘটনাবলি আমাকে কাহিল করে ফেলেছে। বহু দিন ধরেই প্রিয়জনদের বলে যাচ্ছিলাম, আমার এখানে কোনো কাজ নেই। আল্লাহ পাকের কাছ থেকেও কোনো নির্দেশ পাচ্ছি না। এখানে থেকে চলে যাওয়া মানে, এই বয়সে আরো গোনাহের ভাগীদার হওয়া।

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাছ থেকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। ’৭১ সালে আমার বয়স ৩১। ২৫ মার্চ রাতে মতিঝিলের অবজারভার হাউজে আটকা পড়েছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গেলে বাসার দিকে রওনা হলাম দৌড়াতে দৌড়াতে। মনে হচ্ছিল, রিকশায় গেলে দেরি হয়ে যাবে। রাস্তায় তেমন রিকশাও ছিল না। সবাই আতঙ্কে দৌড়াচ্ছে। আমার বাসা ছিল           শান্তিনগরে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে। রাতেই জানতে পেরেছিলাম, সেনাবাহিনী রাজারবাগ আক্রমণ করেছে। সেখানে আগুন দিয়েছে। অবজারভারের ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছিল সারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় আগুন জ্বলছে। বিশেষ করে সব বস্তিতেই সেনাবাহিনী আগুন দিয়েছিল। ভাবছিলাম, বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রী আর প্রিয় সন্তান রনিকে দেখতে পাবো কি না। রাতের আগুনে পুড়ে গেছে কি না। বাসায় গিয়ে দেখলাম, দুই বছরের রনি আর তার মা খাটের নিচে লুকিয়ে আছে। ২৫ মার্চ রাত থেকেই তারা ওই খাটের নিচে ছিল। আমার ডাকাডাকিতে সাড়া দিচ্ছিল না। ভয়ে হুঁশহারা হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, আমি ফিরে এসেছি। রনির জন্য একটা ট্রাইসাইকেল কেনার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর কেনা হয়নি। বলেছিলাম, সব কিছু ঠাণ্ডা হলে তোমাকে সাইকেল কিনে দেবো। পরে রনি জানতে চাইত সব কিছু ‘ঠান্না’ হয়েছে কি না। ও ঠাণ্ডা শব্দটি উচ্চারণ করতে পারত না।
অবজারভার অফিসে আর ফিরে যাইনি। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে কিভাবে কোন পথে পালাব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মিলিটারি টহল দিচ্ছে। রাস্তায় চেকপোস্ট বসেছে। জীবন তো আর থেমে থাকে না। মানুষ বাঁচার তাগিদেই ঘরের বাইরে আসে বা যায়। যারা দিনমজুর, তাদের তো বের হতেই হবে। এর আগে অবজারভার অফিসে থাকতেই ২৬ মার্চ রাতে শুনেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে কোনো এক মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা রেডিওতে টিউনিং করে অনেক চেষ্টা করেও ঘোষণা শুনতে পাইনি। ২৭ মার্চ রাতে প্রথম নিজ কানে শুনতে পেলাম মেজর জিয়ার ঘোষণা। তিনি সংসদের মেজরিটি দলের নেতা এবং তখনকার একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধকে সমর্থন দেয়ার জন্য।
জানুয়ারি থেকেই একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে রাজধানী ঢাকার রাজনৈতিক ঘটনাবলি দেখেছি। ’৭০-এর নির্বাচনে মওলানা ভাসানী নির্বাচন না করার ফলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার দু’টি সিট ছাড়া বাকি সব সিট মানে, ১৬৭টিতে জয় লাভ করে। ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট খুবই প্রকট হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সিট পায়নি। একই ভাবে, ভুট্টোর দল পূর্ব পাকিস্তানে কোনো সিট পায়নি। মতায় আছে সামরিক জান্তা। নির্বাচনে জয় লাভ করেছে দু’টি রাজনৈতিক দল, যারা কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। সমঝোতার ব্যাপারে ভুট্টো ছিলেন খুবই অনমনীয়। ফলে পুরো বিষয়টার ভেতর ‘তৃতীয় শক্তি’ ঢুকে পড়ে। তৃতীয় শক্তির খেলাতেই সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। শেখ মুজিব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতার চেষ্টা করে গেছেন। শুনেছি, ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত শেখ সাহেব সমঝোতার দলিলে স্বার করার জন্য অপো করেছিলেন। তিনি ২৬ মার্চ হরতাল ডেকেছিলেন বলে শুনেছি। না, জেনারেল ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সারল্যের সাথে বেঈমানি করে পূর্ব বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে ইসলামাবাদ চলে যান। ২৫ মার্চ রাতেই ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করে চলে গেলেন।
মেজর জিয়ার ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশবাসী জানতে পারেনি, পূর্ব বাংলার ভাগ্যে কী ঘটেছে। শেখ মুজিব চলে গেলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনী তাকে ২৫ মার্চ রাত ১২টার দিকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায়। আর আওয়ামী লীগ নেতারা কোনো উপায় না দেখে দিশেহারা হয়ে ভারতের দিকে চলে যান। দেশে থেকে গেলে সেনাবাহিনী তাদের গ্রেফতার করবে, না হয় হত্যা করবে। তাই ভারতে না গিয়ে উপায় ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে নির্বিচারে সারা ঢাকায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। ২৭ মার্চ সকালে আমরা রাস্তায় বহু লাশ দেখেছি। জিয়ার ঘোষণার পর দেশবাসী বুকে সাহস পেল। আস্থা ফিরে পায়। বুঝতে পারল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করা হবে। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলো, শেখ মুজিব তাদের হেফাজতে আছেন এবং পাকিস্তানের ইংরেজি কাগজ দৈনিক ডনে তার ছবি ছাপা হলো সম্ভবত ৪ এপ্রিল। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল ১৭ এপ্রিল। অপর দিকে মেজর জিয়া তার অধীনস্থ সৈনিক ও অফিসারদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তের ঘটনার সামান্য কিছু কথা লিখলাম আমাদের সন্তানদের জন্য। এখন শুনতে পাচ্ছি, মেজর জিয়া ছিলেন ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এজেন্ট’ বা চর। তিনি গোয়েন্দা হিসেবেই নাকি কাজ করেছেন। বঙ্গবীর বাঘা সিদ্দিকী নাকি ’৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এখন নব্য রাজাকার। আর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, তিনি যদি রাজাকার হয়ে থাকেন তাহলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের কমান্ডার। নব্য রাজাকার কারা, তার ঘোষণা দিচ্ছে প্রজন্ম চত্বর থেকে আমাদের সন্তানেরা। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগকে হেডকোয়ার্টার করে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। এ যুদ্ধে ‘চেতনা’ই নাকি হাতিয়ার। তরুণেরা বলছে, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; তাই চেতনা দেখার জন্য চত্বরে যাচ্ছে। মাথায় ব্যান্ড বেঁধে, স্লোগান দিয়ে, গান গেয়ে নেচে নেচে তারা মুক্তিযুদ্ধ করছে। নাম দিয়েছে গণজাগরণের মঞ্চ। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতেই তারা মঞ্চ সাজিয়েছে। শুরুতে তাদের দাবি ছিল শুধু একটিÑ কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। আদালতের রায় মানি না। এখন তাদের অনেক দাবি। দিন দিন দাবির তালিকা বাড়ছে। এমনকি একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করার জন্যও তারা ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগে নতুন প্রজন্মের দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ শোনা গেল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সিপাহসালার বা জেনারেলদের কেউ কেউ নাস্তিক এবং আল্লাহ পাক সুবহানাহু তায়ালা, তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল সা:, ইমামুল মুরসালিন ও কালামে পাক আল কুরআনের বিরুদ্ধে অকথ্য, অশ্লীল ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। খবরটি নাকি প্রথম ফাঁস করে দেয় ভারতের ইংরেজি কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া। হেডিং ছিলÑ ‘অ্যান্টি-ইসলামিক ব্লগার কিল্ড’। ব্লগার রাজীব নিহত হওয়ার পর ওই খবরটি ছাপা হয়। এর পরে তা ছাপা হয় সরকারপন্থী কাগজ দৈনিক ইনকিলাবে। তার পর ছাপা হয়েছে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত ও সংগ্রামে। আসলে প্রজন্ম চত্বরের নেতা ব্লগাররা অনেক দিন ধরেই ধর্মহীনতার পে লিখে যাচ্ছে। তাদের কাছে ধর্ম মুক্তমনের ও প্রগতির বিরোধী। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে ধর্মহীনতা। ’৭১-এ নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সেকুলার বা ধর্মহীন। যাদের চেতনা এখন সেকুলার বা ধর্মহীন নয়, তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে পারবে না। মনে প্রশ্ন জেগেছেÑ তাহলে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি বা করেছি, তারা কি ভুল জেনেছি? আমি তো দেখেছি, বহু মুক্তিযোদ্ধা নামাজের সময় হলে বা আজান শুনলে সাথে সাথে অজু করে নামাজ আদায় করেছেন। যারা নামাজ পড়েননি, তারা কখনোই বলেননি, নামাজ পড়া যাবে না। সেক্টর কমান্ডারেরাও বলেননি মুক্তিযুদ্ধ সেকুলার বা ধর্মহীন। বহু মাদরাসার ছাত্রও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে এ কথা সত্যি, যারা সেকুলার বা ধর্মহীন বা ধর্মনিরপে; তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে দেখেন বা ব্যাখ্যা করেন। মুক্তিযুদ্ধ কখনোই বাংলাদেশের মানুষকে সেকুলার বানানোর যুদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ধর্মহীন বা ধর্মবিরোধী ছিল না। বরং ’৭১-এ দেখেছি পাকিস্তানি সৈনিকেরা কারফিউর সময় মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের গুলি করেছে। তখন আমি সমাজে এবং বন্ধুদের কাছে বামপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলাম। ছাত্রাবস্থায় অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। পরে মওলানা ভাসানীর ন্যাপকে সমর্থন করতাম। বামপন্থীসংবাদে চাকরি করেছি অবজারভারের  চাকরি ছেড়ে দিয়ে। এখন আমাদের সন্তানেরা জানতে চায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে কি না। আমরা সেকুলার কি না। প্রজন্ম চত্বরের সাথে একাত্মতা ঘোষণা না করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে না। তাই শুরুতেই নিজের আবেগের কথা প্রকাশ করেছি। ১৫-১৬ বছরের ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে প্রশ্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে কি না। চেতনা না থাকলে কাদের সিদ্দিকীর মতো নব্য রাজাকার হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি শাহবাগ যাও, মাথায় ব্যান্ড বা পট্টি বাঁধো। লাল-সবুজের জামা গায়ে দাও। আমার সন্তানদের সারল্য ও নিষ্পাপ অবুঝ আবেগকে ভালোবাসি। কিন্তু তাদের কে বা কারা অমন পথে পরিচালিত করছে হেমিলনের বংশীবাদকের মতো? কারা আজ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা তুলেছে? নাস্তিক-আস্তিকের কথা তুলেছে। কারা নতুন প্রজন্মকে ধর্মহীনতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে?
সামান্য একটু পেছনের দিকে যেতে চাই। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময় ১১ দফা ও ৮ দফার কথা মনে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দিয়েছিলেন ১১ দফা দাবি। ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ দিয়েছিল ৮ দফা। ফলে ধর্মবাদীরা বা ধর্মপন্থীরা ৮ দফার পে চলে গেল। আমি ছিলাম ১১ দফার প।ে সারা জেলায় ঘুরে ঘুরে ১১ দফার পে জনসভা করেছি। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব এবং অনেক রাজনৈতিক দল ১১ দফাকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রতিদিনই এ নিয়ে সারা দেশে চলছিল প্রচণ্ড টেনশন। কোথাও কোথাও মারামারি। সে সময় শুনেছি পতাকার অবমাননার কথা, কুরআন পোড়ানোর কথা। তখন ১১ দফার সমর্থকদের বিরুদ্ধে সরকার ও ইসলামপন্থী দলগুলো এসব অভিযোগ এনেছিল।
এবারো শুনতে পাচ্ছি সেসব পুরনো কথা। পুলিশ মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গোলাগুলি করেছে। শুনতে পাচ্ছি, পুলিশ এ পর্যন্ত ১৯ জন আলেম ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। আসামি করে গ্রেফতার করছে। ‘জামায়াত’ আখ্যা দিয়ে ইসলামি নেতাদের গ্রেফতার করছে সরকার। ব্লগার বলে পরিচিত ইসলামবিরোধী নাস্তিক প্রজন্ম নেতাদের প নিয়েছে সরকার। সংসদে    নাস্তিককে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে সরকার সব সময় ইসলামের ধুয়া তুলত। তখন আমেরিকানরাও ইসলামি দলগুলোকে কৌশলগত সমর্থন করত প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর সরকার কৌশলে প্রজন্ম চত্বর বানিয়েছে, নাস্তিকদের প নিয়েছে, ধর্মের পরে মিডিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমরা কখনোই শুনিনি কোনো গণজাগরণ সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে হতে পারে।
সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এ দেশে কোনোভাবেই বিভেদ উসকে দেয়া যায় না। বিভেদ সৃষ্টিকারীরা দেশের বাইরে থেকে খেলছে। তারা চায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তাদের ফায়দা লুটতে। এ দেশে কেউ কারো শত্রু নয়। এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক চেহারা, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এক ধর্ম। তাহলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে বাধা কোথায়? আসুন, একমত হওয়ার জন্য আমরা যাত্রা শুরু করি। রাজনৈতিক সুবিধা আদায় কিংবা নির্বাচনে জয় লাভের জন্য নিজের দেশকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করবেন না। প্রজন্ম চত্বরের নেতাদের বলব, তোমরা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ডাক দাও, দেশের ১৬ কোটি লোকই তোমাদের সাথে থাকবে। এখন যা করছ তা ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। ইসলামি দল ও ১৮ দলীয় জোট তোমাদের বিপে অবস্থান নিয়েছে। গায়ের জোরে, কিছু আবেগপূর্ণ স্লোগান দিয়ে তোমরা বেশি দূর এগোতে পারবে না।
তোমরা শুধু একবার দণি আফ্রিকার মানবতাবাদী বিশ্বনেতা, নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ভাবো। সাদা শাসকদের জেলে তিনি ২৬ বছর ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে জগদ্বিখ্যাত ভাষণ দিলেন। বললেন, সাদারাও এ দেশের সন্তান। তাদেরও সমান অধিকার। যে লোকটি তাকে জেলে রেখেছিলেন, তাকে নিয়েই ম্যান্ডেলা সরকার গঠন করলেন। তিনি যদি শুধু ইশারা করতেন তাহলে লাখ লাখ সাদা দাঙ্গার শিকার হতো। ম্যান্ডেলা তা করেননি। কারণ তিনি খুবই উঁচুমানের একজন মানবতাবাদী নেতা।
তোমরা স্মরণ করো আমাদের মহানবী সা:-এর কথা। তাঁর ‘মদিনা সনদ’ বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে। তিনিই জগতে প্রথম গণমানুষের রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। মদিনায় তিনি ছিলেন মুহাজির। তিনি ছিলেন মাইনরিটি। শুধু মেধা-মনন ও নেতৃত্বের গুণে তিনি মদিনার ইহুদি ও খৃষ্টানদের মদিনা চুক্তিতে আবদ্ধ করেছিলেন। মদিনা রাষ্ট্রের সব নাগরিক রাসূল সা:কে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। খুবই ধ্বংসাত্মক এই বিভক্তি। বিভাজনের এই মানসিকতা থাকলে বাংলাদেশ টিকবে না। তখন বঙ্গবন্ধু বা জিয়া কেউই থাকবেন না। দেশবাসীকে বলব, আপনারা জাতি হিসেবে আপনাদের বায়া দলিল খুঁজুন। আসল দলিল ছাড়া নকল দিয়ে বেশি দিন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। আপনাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আপনাদের পূর্বপুরুষের ৯০ ভাগই এক সময় মনুসংহিতায় বর্ণিত অচ্ছুৎ, হরিজন বা আনটাচেবল ছিলেন। দেখতে মানুষ হলেও ধর্মীয়ভাবে তাদের মানবিক মর্যাদা ছিল না। তারা ছিলেন দাসের চেয়েও অধম। এক সময় তারা অমানবিক জীবন থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাম্যবাদী ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটা ছিল তাদের জন্য একটা বিপ্লব। মানুষ হয়ে ওঠার বিদ্রোহ। তাই আজ আপনারা স্বাধীন একটি ভূখণ্ডের মালিক। শত শত বছর অপোর পর আপনাদের পূর্বপুরুষের সীমাহীন ত্যাগের ফলেই আজ আপনারা একটি স্বাধীন দেশের সম্মানিত নাগরিক। পূর্বপুরুষদের ত্যাগকে জানুন, মানুন এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রা করুন। আবারো বলছি, খুবই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছি, জাতি হিসেবে নিজেদের বায়া দলিল রা করুন। মিষ্টিকথায়, ‘বন্ধু’দের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পুরস্কার এখন অপরাধীদের


বাংলা ভাষায় ‘শাহবাগ সিনড্রম’ নামে একটি লোককথা প্রচলন হওয়ার জোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একদল ব্লগার হঠাৎ শাহবাগের ব্যস্ত রাস্তা দখল করে নিলো। ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই করো’ স্লোগান দিলো। পুলিশ ত্বরিত এসে তিন বর্গকিলোমিটার জায়গা কর্ডন করল। মেটাল ডিটেক্টর, কোজ সার্কিট ক্যামেরা ফিট করে ব্লগারদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করল। আর কী কী সুযোগ সুবিধা চাই, যেচে জিজ্ঞেস করল পুলিশ। ওয়াসা-ডেসা এগিয়ে এলো জরুরি পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও বিদ্যুৎ নিয়ে। অনেকে এগিয়ে এলো খাদ্যপানীয় ও বিনোদন সহযোগিতা নিয়ে।

ড্রাম-ঢাকঢোল বসিয়ে উচ্চ নিনাদে মাতম তুলল তারা। হাজার হাজার মোমবাতি জ্বালিয়ে আলো-আঁধারিতে তৈরি করা হলো রহস্যময় এক টুকরো বাংলাদেশ। মোমবাতির নানা কসরত, কারুকাজ প্রতিদিন ছিল। তবে একটি দিন ছিল বিশেষ। সেটি মোমবাতি প্রজ্বলনের মহাদিন। সে দিন শাহবাগের পাশাপাশি সারা দেশে জ্বলে উঠল লাখ লাখ মোমবাতি। হেফাজতে ইসলাম যাকে চিহ্নিত করেছে মূর্তিপূজকদের রেওয়াজ হিসেবে।
একটি ঘৃণিত চরিত্র থাকল। মাথায় টুপি, থুঁতনিতে দাড়ি। দাড়ি কখনো বা চাপা হয়ে কানের লতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। এ চরিত্র যখন প্ল্যাকার্ড, ব্যানার-ফেস্টুনে বিকট চেহারা নিয়ে থাকল; সেখানে যুৎসইভাবে সেঁটে দেয়া হলো ঘৃণা উদ্রেককারী স্লোগান। কোনো যুবক আবার টুপি দাড়ি পাঞ্জাবি নিয়ে জীবন্ত চরিত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়তি হিসেবে গায়ে জড়িয়ে দেয়া হলো আরবীয় আলখেল্লা। এবার তরুণীরা ঝাঁটা নিয়ে দাড়ি-টুপিসহ সারা শরীরে  সজোরে আঘাত করতে থাকল।
ফাঁসির মঞ্চ তৈরি হলো। দাড়ি-টুপিধারীদের ফাঁসি দেয়ার অভিনয় হলো। এক কিশোর নকল করতে গিয়ে প্রাণ হারাল। উৎসাহী ওই তরুণের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে জানা যায়, প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে রোববার রাতে শিশু-কিশোরদের ‘ফাঁসি ফাঁসি খেলা’ উপভোগ করছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। একপর্যায়ে আবদুর রহমান শাকিল নামের ওই কিশোরের গলায় ফাঁসি লেগে যায়। তার গলা থেকে দ্রুত ফাঁসির দড়ি খোলা হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
সন্ধ্যায় জড়ো হওয়া তরুণেরা ‘মহান’ বিপ্লবী। পরদিন প্রায় সব পত্রিকায় ব্যানার হেডিং হলো। প্রথম পাতার অর্ধেকজুড়ে আকর্ষণীয় ছবি। অনেকের চেহারা সেখানে দেখা গেল। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর সেই ছবি পত্রিকা পোস্টার আকারে প্রথম পাতার পুরোটা জুড়ে ছাপাল। টেলিভিশন চ্যানেল ‘শতাব্দীর সেরা’ সুযোগ হিসেবে শাহবাগকে লাইভ কাভার করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ২৪ ঘণ্টা কতটা আর টানা যায়। উপস্থিত ব্যক্তিবিশেষকে আলাদা করে দেখানো হলো। সাক্ষাৎকার দেয়া হলো। চেহারা দেখিয়ে ‘বিপ্লবী’ হয়ে যাওয়ার এক বিরল সুযোগ আকর্ষণ করল অনেককে। তারা এলো হাজারে হাজারে এক সীমাহীন প্রদর্শনেচ্ছার উদগ্র বাসনা নিয়ে।
পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে গর্জে উঠল ‘বাঙালিরা’। সরকারি আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত শাহবাগকে অভিহিত করল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে। সংবাদপত্রের নিউজ, ভিউজ, ফিচার সব পাতায় এক কথা। সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন দুই ডজন ব্লগার। তারা হুকুম দিলেন অমুক প্রতিষ্ঠান, তমুক ব্যক্তির দেশে থাকার অধিকার নেই। পরদিনই সেই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হাওয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। রাজপথে এমন সমান্তরাল দানবীয় সরকার পৃথিবীতে এর আগে দেখা যায়নি। মহান আন্দোলন সংগ্রামের পরিবর্তে ভবিষ্যতে এটি ‘শাহবাগ সিনড্রম’ নামে নেতিবাচক পরিচিতি পেয়ে বাংলা ভাষায় স্থান করে নিতে পারে।
ব্লগারদের বায়োডাটা জনগণের সংশয় কাটিয়ে দিলো। আয়োজকদের অন্যতম একজন ব্লগার নৃশংসভাবে খুন হলেন। তিনি আল্লাহ বিশ্বাস করেন না। আপত্তি করার কারো সুযোগ ছিল না। কারো মনের ওপর অন্য কারো হাত নেই। বিশ্বাস না থাকাটা কেবল একটি ধর্মের প্রতি ঘৃণা জন্ম দেয়ায় বিস্ময় সৃষ্টি করে। সেটি তিনি উগরে রেখেছিলেন ব্লগে। জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব উঠল। বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ‘শহীদ’ বলে আখ্যা দিলেন। আরো কয়েকজন ব্লগারেরও একই পরিচিতি। তাদেরও ঘৃণা কেবল একটি ধর্মের প্রতি। আলেমরা এর প্রতিকার চাইলেন।
‘হেফাজতে ইসলাম’ আল্লাহ ও নবী সা:-এর অবমাননার প্রতিবাদ জানাল। এ প্রতিবাদে শরিক হওয়ার আহ্বান জানালেন আলেম-ওলামা, মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রতি। একটি বিজ্ঞাপনে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নিজেদের অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে তাদের কার্যক্রমের বর্ণনা দেয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে একটি সামাজিক আধ্যাত্মিক ও আত্মসংশোধনমূলক সংগঠন। …মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইসলামের বিধান ও প্রতীকগুলোর হেফাজত সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করে তোলা এবং ধর্মীয় ইস্যুতে সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রাখা হেফাজতে ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশে প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাকুল মাদারিস) চেয়ারম্যান শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির।
সরকারের পক্ষ থেকে ব্লগারদের জন্য নিরাপত্তার ত্বরিত উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় গানম্যানের। শুধু ব্লগার নয়, যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্লগারদের নিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়ে সরকার প্রশংসনীয় কাজ করেছে। একইভাবে আলেম-ওলামাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। পুলিশ তাদেরকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সহযোগিতার পরিবর্তে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করল। মিছিল দেখামাত্র তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল। লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দিলো। টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করল নির্বিচারে। গুলি চালাতেও দ্বিধা করেনি তারা। এতে প্রমাণ হলো সরকার নাগরিকদের একটি অংশকে অপরাধের অভিযোগ থাকার পরও দিচ্ছে নিরাপত্তা; অন্য দিকে যারা এসব অভিযোগ তুলছেন তাদের বিরুদ্ধে নিচ্ছে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা।
দেশের কোনো জায়গায় আলেমরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। পুলিশের গুলিতে গাইবান্ধায় তিনজন, সিলেটে একজন ও ঝিনাইদহে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন চার হাজার। যাকে যেখানে পাওয়া গেছে পুলিশ নির্বিচারে গ্রেফতার করেছে। পরদিন পাবনায় হরতাল পালনের সময় গুলি করে আরো দু’জনকে হত্যা করা হয়। রোববার দেশব্যাপী ডাকা হরতালের দিন মানিকগঞ্জে আরো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। হরতাল সমর্থকদের বাধা দিলে মাদরাসাছাত্রদের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে নির্বিচারে ছাত্রদের গুলি করে। এলাকাবাসী মাদরাসাছাত্রদের পক্ষ নিয়ে এগিয়ে আসেন। এবার বেপরোয়া গুলি চালালে গ্রামবাসীসহ পাঁচজন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। পত্রিকা খবর দিয়েছে, শাহবাগ জমায়েতের ১৯ দিনে ২৩টি প্রাণ ঝরে গেছে।
ব্লগার রাজীব ছাড়া অন্য খুনের ঘটনা নিয়ে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান নিপীড়িতদের বিরুদ্ধে। প্রায় সবগুলো প্রাণহানি ঘটেছে পুলিশের গুলিতে। সরকার সে বিষয়ে তদন্তের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো অনেক দূরের বিষয়। বরং প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে। এ পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক আলেম-ওলামাকে দায়ী করে দেশে শত শত মামলা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ হত্যায় পুলিশ আরো উৎসাহিত হবে। হত্যাকারীরা দেখছে, ভবিষ্যতে তাদের বিচারের কোনো সম্ভাবনা নেই। এটাকে তারা এক ধরনের পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করবে নিশ্চয়ই।
শাহবাগকে কেন্দ্র করে অপরাধীদের পক্ষে সরকারের অবস্থান অরো আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। আয়োজক ব্লগারদের অন্যতম বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু। বাম-চরমপন্থীদের নিয়ে একটি বিশাল জঙ্গি গ্রুপ লালন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যশোর অঞ্চলে খুন, লুটপাটের সাথে তারা জড়িত। তার মামা জীবন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) দুর্ধর্ষ ক্যাডার। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর সেই ভয়ঙ্কর খুনিদের মধ্যে বসুও একজন। লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ খুন করার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছিলেন তিনি। লাশের ওপর নৃত্যদৃশ্যের অনেক ছবি রয়েছে। দৈনিক আমার দেশ  এ ছবি দিয়ে তার নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরেছে ১২ ফেব্রুয়ারির পত্রিকায়।
বাপ্পাদিত্যের পক্ষ থেকে আমার দেশের  এ প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তিনি দাবি করেননি পত্রিকায় প্রকাশিত লাশের ওপর নৃত্যরত ছবিটি তার নয়; বা এ নিয়ে তিনি পত্রিকাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের শরণাপন্ন হননি। কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিদিন আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জীবন নাশের হুমকি দিতে। শাহবাগ আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে তিনি মঞ্চ থেকে সরাসরি এ হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। অপরাধ লালনে সরকারের এ আশকারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনবে।
প্রতিদিন যখন খুনিদের পক্ষ থেকে মাহমুদুর রহমানকে খতম করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে; সরকারের পক্ষ থেকে এই সম্পাদকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে তার উল্টো ব্যবস্থা। পুলিশকে দিয়ে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করা হলো। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রপন্থা উসকে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে ওইসব মামলায়। ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে পবিত্র দায়িত্ব পালন হয়ে যাচ্ছে ‘উগ্রপন্থা উসকে দেয়া’। ব্লগারদের আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম তথ্যপ্রমাণসহ ইসলাম অবমাননার অভিযোগ এনেছে। ব্লগাররা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডাতে আসেননি। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীনÑ এ দাবি করছেন না তারা।
অভিযুক্ত ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়ও ছিল ব্লগারের বিরুদ্ধে। সে দায়িত্বও সরকার যথাসময়ে পালন করেনি। সরকার কি মনে করছে তাদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন? বিশ্বাস এমনটি হলে অভিযোগের অসত্যতা প্রমাণ করে দেয়াই তো সরকারের জন্য সবচেয়ে উত্তম। এই বিষয়ে সরকার ও ব্লগারদের অবস্থান একই। অপরাধ, অপরাধীÑ এসব নিয়ে তারা কোনো কথা বলতে এখন রাজি নয়। সরকারের মন্ত্রী বলছেন, হেফাজতে ইসলামকে প্রতিরোধ করা হবে। শাহবাগ জমায়েতের সাথে তাল মিলিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পথ খুঁজছে সরকার। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম ও মাহমুদুর রহমান কী অপরাধ করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে তা উল্লেখ করছেন না। এ এক আজব সভ্য রাষ্ট্র!

মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলাদেশে বিপন্ন গণতন্ত্র ও মানবতা


বাংলাদেশে বিপন্ন গণতন্ত্র ও মানবতা
পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। কিন্তু দেশে কতটুকু গণতন্ত্রের চর্চা আছে তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। অতীতে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থেকে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতার হাল ধরেন। তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে গণতন্ত্র বিদায় দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতা শুরু হয়।
স্বাধীনতা উত্তর কালে দেশে রক্ষীবাহিনী সহ বিভিন্ন ঠ্যাংগাড়ে বাহিনী গঠন করা হয় এবং তাদের মাধ্যমে বিরোধী দলের উপর নিপীড়ন নির্যাতন চালান হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করে ভিন্ন সকল দলের অস্তিত্ব বিলোপ, চারটি সংবাদ পত্র ব্যতিত অন্য সকল সংবাদ পত্রের বিলুপ্তি সহ জেলা গভর্নর নিয়োগের মাধ্যমে দেশে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
এ দেশে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী যখন নির্দেশ দেন একটির বদলে ১০টি লাশ ফেলাতে, যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী তাদের দলের পেটুয়া বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ‘জামাত শিবির যেখানে দেখ শেষ কর', তখন দেশে গণতন্ত্র আছে কেমন করে বিশ্বাস করা যায় ? যদি কেউ অপরাধ করে তার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে; কিন্তু পুলিশের সাথে দলীয় জনশক্তিকে নিরস্ত্র নিরীহ জনতার দিকে লেলিয়ে দেয়া কোন গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে বলে কেউ মনে করে না। এ গুলোতো নাৎসীবাদী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের কাজ।
ফ্যাসিবাদী শাসক মুসোলিনী যেমন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নৈশ প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে না'  ফ্যাসিবাদী ঐ একই সুর বেজে উঠেছে বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর কণ্ঠে। সাংবাদিক দম্পতি নিহত হওয়ার পরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ‘‘আমি কারও বেডরুমের পাহারার দায়িত্ব নেইনি।’’ তাই মুসোলিনী ও আমাদের প্রধান মন্ত্রীর কথায় পার্থক্যটা কোথায়?
ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী রূপে গণ্য করা হয়। ফাসিবাদে দমন পীড়নের মাধ্যমে জনসাধারণকে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে। আমাদের বর্তমান সরকারও তেমনি হকের পথে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জামায়াতসহ বিরোধীদলীয় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্বাধীনতাবিরোধী নামে অভিহিত করে তাদের উপর বছরকে বছর ধরে জুলুম নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরকে মিথ্যা মামলায় জেলের অভ্যন্তরে শাস্তি দিচ্ছে , তাদের দলীয় অফিস জ্বালিয়ে দিচ্ছে, প্রায় দু'বছর ধরে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও মহানগরী অফিস এবং ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস পুলিশ দিয়ে অন্যায় ভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছে, এমনকি তাদের কথা বলার জন্য রাস্তায়ও দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে ফ্যাসিবাদী তৎপরতার সাক্ষাৎ নমুনা হিসাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এমনকি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হাসপাতালে আগুন লাগানো হচ্ছে, ভাংচুর চালানো হচ্ছে। পাঁয়তারা চলছে বিরোধীদলের সমস্ত কর্মকান্ড স্তব্ধ করে দেবার। এর পরেও যদি এ সরকার গণতান্ত্রিক সরকার হয় তা হলে ফ্যাসিবাদী সরকার কোনটি?
নির্বাচনের মাধ্যমে কোন সরকার ক্ষমতায় এলেই তারা গণতন্ত্রী সরকার হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। জার্মানিতে হিটলার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে হয়ে গেল ফ্যাসিস্ট।
হাসিনা সরকারের অবস্থাও এ থেকে ভিন্ন নয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহকে তারা দেশের জন্য বৈরী শক্তি মনে করে তাদেরকে দমনের জন্য তাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাদেরকে দমনের জন্য খাহেশ অনুযায়ী সমস্ত নিয়ম নীতি লংঘন করে রাতারাতি আইন প্রণয়ন করছে। আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাৎক্ষণিক ভাবে বা স্বল্পমেয়াদী কোন পরিকল্পনা নিয়ে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি এবং ঘাটতিগুলো দূর করা সম্ভব নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নতুন আইন তৈরী করে বিরোধী দলকে ফাঁসাবার ফন্দি করছে। এর পরেও যদি এ সরকার নিজকে গণতন্ত্রী হিসাবে দাবি করেন তা হলে তার চেয়ে আর বড় মিথ্যাচার আর কী হতে পারে? 
অতীত ও বর্তমান সব আওয়ামী সরকারের আমলে এক অভিন্ন কৌশলে দেশে হিটলারী শাসন প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে।  আওয়ামী সরকারের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় পুলিশ আর ছাত্রলীগ এক দেহে বিলীন হয়ে গেছে। তাইতো দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ নিরীহ ছাত্রদের শিবির বলে পুলিশের সামনে পিটাচ্ছে আর পুলিশ সে নারকীয় যজ্ঞ নীরবে উপভোগ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ শিবিরের উপর হামলাসহ বর্তমানে শিবিরের উপরে আওয়ামী ক্যাডারদের নির্যাতন পুলিশ নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে দেখছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাস কাল ধরে যে ভাবে পুলিশ শিবিরের উপর গুলীসহ নানা বীভৎস নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে মনে হয় ওদের দৃষ্টিতে শিবির কোন মানুষের স্তরে নেই। পুলিশের এমন নীচ আচরণ এদেশের বিবেক জাগ্রত জনতাকে নাড়া দিয়েছে। যে কারণে পুলিশের উপর ঘৃণা জমে উঠতে শুরু করেছে।
একটি সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে নাগরিকদের জান-মালের হেফাজত করা, তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক শান্তি শৃক্মখলা সুনিশ্চিত করা। নিয়ন্ত্রণহীন কোন শক্তি দ্বারা যদি সামাজিক শৃক্মখলা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয় তা হলে সরকারকে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার স্বয়ং নিয়ন্ত্রণহীন। সরকার দলের নেতাকর্মী ও আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রদের সমস্ত অন্যায়, জুলুম, হত্যা, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্যকে বে মা'লুম উপেক্ষা করে চলছে। অপর দিকে পরীক্ষিত উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছাত্র সংগঠনকে দেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। একটি ছাত্রের হত্যার অপরাধকে ছুতা হিসাবে গ্রহণ করে তারা সারা দেশ থেকে শত শত নিরিহ ছাত্রদেরকে ধরে জেলে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের রাজনীতি বন্ধ করার অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। অপর দিকে দেশময় বিভিষিকা সৃষ্টিকারী, বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পক্ষে ছাফাই গাওয়া হচ্ছে। কি বিচিত্র এই দেশ!
আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য এ দেশ থেকে ইসলামের উৎখাত। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রথম পর্যায়ে বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন ,‘‘আওয়ামী লীগতো এখনও কিছু শুরুই করেনি। শুরু করলে বুঝতে পারবেন যে আওয়ামী লীগ কী জিনিস।’’ আওয়ামী মন্ত্রীর এ দম্ভোক্তির তাৎপর্য ও আওয়ামী চরিত্র আজ দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। আওয়ামী লীগ চায় এ দেশ থেকে ইসলামের ঊৎখাত। এজন্য আওয়ামী লীগ প্রাথমিক পর্যায়ে বেছে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। আওয়ামী সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যু তৈরী করে জামায়াত নেতা কর্মীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে ফারুক হত্যাকে কেন্দ্র করে ৬৪টি জেলা থেকে জমায়াত শিবিরের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে তাদের উপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো শুরু হয়, যা এখনো চলছে। আবার জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে প্রহসনের বিচার বন্ধ ও মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন কালে ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ বিনা উস্কানিতে জামায়াতে ইসলামীর মিছিলে হামলা চালালে এক অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে রমনা থানার এস আই ১২০ জনকে আসামী অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। অভিযুক্তদের অনেকেই কারাগারে আবার অনেকে এখনও গা ঢাকা দিয়ে আছেন। চলতি সরকারের আমলে জামাত শিবিরের ২০ হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুলেটের আঘাতে পঙ্গু করা হয়েছে শতশত জামাত ও শিবির কর্মী। শহীদ করা হয়েছে বেহিসাবে। ২ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ অত্যাচার মিসরের ফেরআউন জামাল আবদুন নাসের ও হোসনী মোবারকের অত্যাচারকে যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। 
এখানেই শেষ নয়। তারস্বরে রাম বাম দলের হাতে গোটা জনগণ কর্তৃক উপেক্ষিত কয়েকজন নেতা চিৎকার করছে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। এ যেন নানীর কাছে মোয়া খাওয়ার আবদার। জামায়াতে ইসলামী ও শিবির রাজনৈতিক ভাবে স্বীকৃত দল, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বৈধ দল। শুধু কি তাই, জামায়াতে ইসলামী গত নির্বাচনগুলোতে এ দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেয়ে সংসদে আসন করে নিয়েছে। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ও শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩শ' ৬১ ও ৪.২৮%, প্রাপ্ত আসন ১৭টি। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ও শতকরা হার যথাক্রমে ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৯শ' ৬৭ ও ৪.৭০%। এ উপাত্ত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের জামায়াত বিরোধী প্রচারণার ফলে জাতির কাছে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা মোটেই হ্রাস পায়নি বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাইতো আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে উঠেছে জামায়াত নিধন নিসূদন যজ্ঞে। বর্তমান সংসদেও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছে। এমন একটি গণতান্ত্রিক সুশৃংখল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি প্রকৃতপক্ষে এদেশের তৌহীদী জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
জামায়াতে ইসলামী সংবিধান পরিপন্থী কোন দল নয়। দেশের প্রথম সংবিধানে রাজনীতির ভিত্তিতে ইসলামী দল করা নিষিদ্ধ ছিল। পচাত্তরের পর সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলামিক রাজনৈতিক দল করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক অধিকার প্রাপ্ত এমন একটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি পাগলের প্রলাপ মনে করা ঠিক নয় বরং তা প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শক্তির নির্মূল চক্রান্ত।
ছাত্রশিবির নয় বরং ছাত্রলীগই প্রকৃত সন্ত্রাসী। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ইতিহাস বহুত লম্বা। সমস্ত আলোচনায় না এনে সাম্প্রতিককালের তাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে শিবিরের উপর আক্রমণ, সিলেট এমসি কলেজ আগুন দিয়ে পোড়ান, বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকদের উপরে ন্যক্কারজনক হামলা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ শিক্ষক পেটানোসহ নিজদের অভ্যন্তরীন কোন্দলের জেরে ছাত্রলীগ নেতা রুমান ফকির নিহত, সত্যজিত হত্যাসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যা ও ছাত্রী ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক অপরাধ করেও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী নয় , অন্যদিকে সৎ, খোদা ভীরু, চরিত্রবান ও মেধাবী সংগঠন ছাত্র শিবিরকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাকে নির্মূল করার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্দেশ জাতিকে হতবাক করে দিয়েছে। জাতি মুক, বিমূঢ় হয়ে যায় যখন দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতা ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে শাস্তির বদলে পুরস্কার লাভ করে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে দেখতে হাসপাতালে যায়। এমন পক্ষপাত দুষ্ট সরকার কর্তৃক জামাত শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করার তান্ডবতা দেখে জাতি  বিস্ময় বোধ করে না, শুধু লজ্জায় মাথা নিচু করে।
 আজ জামাত শিবিরকে স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে আওয়ামী লীগ, এই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগই ১৯৭০ সনের ১৮ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে জামায়াতের ১২ শত কর্মীকে আহত এবং ২ জন কর্মীকে শহীদ করে। তখনতো স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল না, জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী ছিল না, তা হলে তখন কেন এই আক্রমণ? জবাব একটাই, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামের সর্বনাশ সাধন করতে আগ্রহী। আওয়ামী লীগের জন্মই তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। ১৯৪৯ সনে আওয়ামী লীগ তার যাত্রা শুরু করে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। এ পরিচয়েই আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। পরবর্তী আমলে কংগ্রেসী সদস্যদের সমর্থন আদায়ের প্রয়োজনে আওয়ামী মুসলিম লীগ হতে ‘মুসলিম ' শব্দটি তুলে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ তার দলের শীর্ষ থেকে ‘মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়েই খুশি নয়, দেশ থেকে ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য তারা আজ ব্যস্ত। প্রজন্ম চত্বরের নামে গুটি কতক নাস্তিক যুবক যুবতীর নর্তন কুর্দনকে গোটা জাতির চেতনার উন্মেষ মিথ্যা আখ্যা দিয়ে জাতিকে বোকা বানাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করতে যখন যা প্রয়োজন তা করতে বড়ই পারঙ্গম আওয়ামী লীগ। ১৯৭২-৭৫-এর শাসন কালে জনগণের উপর চরম নিপীড়ন ও অত্যাচার করে পরবর্তী নির্বাচনের আগে তারা লোক দেখানো ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করেনি।  প্রয়োজনে তারা ধর্মীয় লেবাস ও আচরণের মাধ্যমে মানুষকে ধোকা দিতে মোটেই কসুর করে না। '৯৬-এর নির্বাচনের কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনাকে দেখান হয়েছে মোনাজাতরত অবস্থায়। এমনকি যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করতে আসেন তখন তাকে তসবিহ জপতে দেখা গেছে। তার এ ধর্মীয় ভাবমূর্তি তৈরির জন্য তথা কথিত ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা কোন প্রতিবাদ করেনি। প্রয়োজনের খাতিরে তারা গোলাম আযমের বাড়িতে ধর্ণা দিতে লজ্জা পায় না। নিজামীর সাথে বৈঠক করতে দ্বিধা বোধ করে না।
জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরকে তারা দেশদ্রোহী বলে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে। রাজাকার আলবদরদের ফাঁসির দাবিতে জামাত নেতাদের প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ফাঁসির দাবি তোলার আগে প্রকৃত অপরাধীদের খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের তৈরি ট্রাইব্যুনাল, তাদের নিয়োগকৃত বিচারক সাক্ষী সবাই ব্যর্থ হয়েছে জামাত নেতাদেরকে শাস্তি দেয়ার মতো আপরাধ খুঁজে বের করতে। নৈতিকভাবে পরাজিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা তাই তারস্বরে চিৎকার দিয়ে বলছে, তখনকার জামায়াতের লোকেরাই ছিল রাজাকার আলবদর। তাই তাদেরকে ফাঁসি দিতে হবেই। এ এক গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচার।
রাজাকার আল বদর সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস ঃ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড' গ্রন্থের ৮১ পৃষ্ঠায় বলেন, রাজাকার বাহিনী ছিল সরকারি বাহিনী এবং এর পরিচালনার দায়িত্বে নিয়েজিত জনাব আবদুর রহীমকে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটের প্রধান নিয়োগ করেছিলেন। এই গ্রন্থের ৮৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, ১৯৭০ সাল থেকে ই পাকিস্তান আর্মীর প্যারা মিলিটারি হিসাবে গঠিত হয়েছিল আলবদর বাহিনী। এর অন্যতম সংগঠক জনাব মুসলেহ উদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুই এনএসআই-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। একই গ্রন্থের ৫০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শান্তি বাহিনী প্রধান খাজা খয়ের উদ্দিনকে জেল থেকে বের করে এনে নিজ বাসায় খাইয়ে দাইয়ে টিকেট কাটিয়ে পাকিস্তান প্রেরণ করেছিলেন। যে খাজা কায়সার চীনস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত হিসাবে মাওসেতুঙ ও চৌ এন লাই-এর সংগে হেনরী কিসিঞ্জারের বৈঠকের বন্দেবস্ত করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন দুই বৈরী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চীনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই খাজা কায়সার কে বঙ্গবন্ধুই বার্মার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেছিলেন। তাই রাজাকার আল বদরদের শাস্তি দেয়ার আগে তাদেরকে যারা এদেশে পুনর্বাসিত করেছে তাদের বিচার হওয়া আইনের দাবি।
শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু স্বয়ং ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে সাজা প্রাপ্ত ও বিচারাধীন সকল ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তারই ব্যক্তিগত নির্দেশে সকলকে এক সপ্তাহের মধ্যে মুক্ত করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর এসব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কর্মকান্ডকে বর্তমান আওয়ামী সরকার ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শেখ সাহেব থেকে আগ বাড়িয়ে বর্তমান আওয়ামী সরকার মূল অপরাধীদেরকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়ে রাজাকার আলবদরদের দায়দায়িত্ব ইসলামপন্থী বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর নানা নির্যাতন চালাচ্ছে কোন শক্তির ইঙ্গিতে তা জাতির পক্ষে বোঝা কঠিন নয়। আশঙ্কা হচ্ছে আওয়ামী লীগ কখন না জানি বঙ্গবন্ধুকেও দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদেরকে ক্ষমা করার অপরাধে? যুদ্ধাপরাধী বলে তোহমৎ লাগায়।
এখন আবার আইন করা হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলিকে শাস্তি দিতে হবে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষাকারীদের যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে যারা পকিস্তান সৃষ্টির নায়ক ছিলেন তাদের প্রথমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে তো মুক্তিযুদ্ধেরও প্রয়োজন হতো না। আমাদের জনপ্রিয় জাতীয় নেতারা-শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাষাণী, শহীদ সোহরায়ার্দীসহ প্রত্যেকেই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম লীগতো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অন্যতম রাজনৈতিক দল। তাই পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণের অপরাধে আওয়ামী লীগের সূত্র মতে তারাও কি অপরাধী?
যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রহসন ইসলামী শক্তিকে কোনঠাসা করার এটি একটা অজুহাত মাত্র। কারণ স্বাধীনতার বিরোধীতা দেশদ্রোহীতা নয়, রাজনৈতিক মতভিন্নতা মাত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগের দিন পর্যন্ত অনেক হিন্দু মুসলিম ব্যক্তি ও পাটি পাকিস্তানের বিরোধীতা করেছিলেন। ভারত স্বাধীন ও পাকিস্তান হাছিল হওয়ার পরে ঐ কারণে কেউই দন্ডিত হয়নি। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে হল উল্টাটা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যেসব নেতারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, দেশের কল্যাণের জন্য নিজদেরকে নিবেদিত রেখেছেন, যাদের চারিত্রিক পদস্খলন বা জনস্বার্থ বিরোধী কোন তৎপরতা কেউই লক্ষ্য করেনি, যাদের বিরুদ্ধে কোন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত হয়নি, এমনকি যাদের সাথে নিয়ে বর্তমান আওয়ামী সরকার রাজনীতি করেছে, আন্দোলন করেছে তাদের জব্দ করার জন্য এখন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে কঠিন শাস্তির পায়তারা চালাচ্ছে। এই মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হচ্ছে তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাদেরকে নির্বিচারে জেলের প্রকোষ্ঠে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, প্রকাশ্যে তাদেরকে নির্মূল করার জন্য পুলিশসহ নিজস্ব বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর তা ঠেকাতে গিয়ে নিজদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঈমানী চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে  যখন তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন দেশময় তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালান হচ্ছে যে তারা পুলিশ পিটাচ্ছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শাসকদের প্রবৃত্তি পূজা ও জনগণের অধিকর হরণে তাদের দুঃশাসন ও সীমালংঘনের কারণে সমাজে বিভিন্ন সময় উগ্রপন্থীর আবির্ভাব ঘটে। সরকারের দুঃশাসন ও সীমালংঘনের কারণে ছাত্রশিবিরকে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। শিবিরের উপর সন্ত্রাসী মিথ্যা অজুহাতে তাদের নির্মূল করার জন্য তাদের উপর বেপরোয়া অত্যাচার চালান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রীদেরও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। এ সত্য উপলদ্ধি করে দেশের আপামর জনতা বিরক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর প্রতি সহানুভুতি হারিয়ে ফেলছে। সমাজের এ অস্থিরতার জন্য সরকারই দায়ী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরকে তাদের স্বাভাবিক কর্মকান্ড পালনে বাধা প্রদানের কারণেই পুলিশের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকার জামায়াত- শিবিরের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্র পক্ষের কার্য কলাপে উদ্বেগ প্রকাশ করে বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, ‘‘সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলামিক রাজনৈতিক দল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তা হলে কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যুবলীগকে দায়িত্ব দিলেন যেখানে জামায়াত পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিহত করতে হবে।’’ এ আহবানের পরিণতি কি হতে পারে এ আশঙ্কা করে এক জাদরেল সাংবাদিক সাবধান করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘ইচ্ছে করলে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি করতে তাদের তিন মিনিটও লাগবে না। কিন্তু পরে কী হবে ভেবে দেখার মতো বিজ্ঞতা কিংবা দূরদৃষ্টি সুরঞ্জিত- হানিফদের আছে কি? এখন তারা পুলিশ আর গুন্ডা দিয়ে জামায়াত- শিবিরকে পেটাচ্ছে , ধরে ধরে জেলে পুরছে। কিন্তু নিষিদ্ধ হলে তারা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাবে সামনা সামনি সংঘাতে আসবে না, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করবে।’’ পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে নির্যাতনের মাধ্যমে কোন গোষ্ঠীর পিঠকে দেয়ালে ঠেকালে তারা টিকে থাকার জন্য ফিরে দাঁড়ায়। তাই দেশকে এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের গণতন্ত্রের চর্চা ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে। অসুয়া ও বিদ্বেষ দ্বারা কখন সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। হিন্দু পুরাণে আছে, বেদবতীকে ভোগ করার জন্য রাবণ হাত বাড়াতেই সে তপস্বিনী বললো, তিষ্ঠ। সে তিষ্ঠ বলতেই ব্যস, রাবণ আর এগোতে পারে না। এ কাহিনী থেকে রাবণের অনুচরদের শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন, 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শহীদের রক্তে ভাসছে জমিন

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: 

ইসলামের পক্ষে, মুসলমানের পক্ষে দাঁড়িয়ে গত এক সপ্তাহে ২৩ জন লোক শাহাদাত বরণ করেছেন। সরকারের পুলিশ বাহিনী মুসলমানদের সমাবেশ মিছিল দেখলেই নির্বিচারে গুলী করে তাদের হত্যা করতে কুণ্ঠা বোধ করছে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ না পেলে পুলিশের পক্ষে এমন নিষ্ঠুর কাজ করা সম্ভব হতো না। নববই শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত দেশে মুসলমানরা এমন বিপদে পড়বে, তা বোধকরি কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। জ্ঞানপাপী কিংবা মূর্খরা যে যাই বলুক না কেন, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি মুসলমান না হতো তা হলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক কোনো রাষ্ট্রের জন্মই হতো না। আমরা মুসলমান না হলে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দিতাম না। আমরা বৃহত্তর বাংলা হিসেবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকতাম। পাকিস্তানে না থাকলে, হিন্দু জনগোষ্ঠী থাকলে স্বাধীনতার অনুভূতি আমাদের হতো কিনা সন্দেহ আছে। প্রথমবার কলকাতা যাই ১৯৮৭ সালে। ভিসা পাই না। শেষ পর্যন্ত মুচলেকা দিলাম যে, পশ্চিম বঙ্গের বাইরে ভারতের আর কোনো প্রদেশে যাবো না। এতো কিছু করতাম না। করেছিলাম চিত্রশিল্পী বন্ধু সৈয়দ লুৎফুল হকের পীড়াপীড়িতে। তিনি কলকাতা যাবেন, কিন্তু ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আমাকে তার চাইই চাই। লুৎফুল হকের ভিসা হয়ে গিয়েছিল এক দিনেই। কিন্তু আমার ভিসা নিয়ে টানাপোড়েন চললো প্রায় একমাস। শেষে আমি দূতাবাসে গিয়ে বললাম, ভাই আমি আপনাদের দেশে বেড়াতে আর যাবো না। দয়া করে আমার পাসপোর্টখানা ফেরত দিন। তখন রাষ্ট্রদূত নিজেই কথা বলতে চাইলেন। দেখা করলাম। তিনি বললেন, ভিসা দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির কখনও কখনও প্রয়োজন হয়। আপনি কি শুধু কলকাতা সফর করতে চান, নাকি তার বাইরে আর কোথায়ও যাবেন? আমি বললাম, কলকাতার বাইরে দীঘা যেতে পারি। তিনি একটা টাইপ করা কাগজ বের করে দিলেন। বললেন, এই কাগজটায় সই করতে আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে দয়া করে সই করে দিন। এখনই ভিসা হয়ে যাবে। কাগজটায় লেখা ছিল আমি শুধু পশ্চিম বঙ্গ সফর করতে চাই। এর বাইরে কোথায়ও যাবো না। সই করে দিলাম। ভিসা হয়ে গেল। সেই ১৯৮৭ সালে আমি ভারতের কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম এবং এখনও আছি, সেটা শ্লাঘার কারণ। নিজের প্রয়োজনে আর কোনোদিন ভারতীয় ভিসার চেষ্টা করিনি। সরকারি দায়িত্বে থাকার সময় আরও কয়েকবার ভারত গিয়েছি। তখন ভিসার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তাদের ইতর আচরণ মনে থাকবে বাকি জীবন। এসব ঠিকুজি দিতে প্রসঙ্গের অবতারণা করিনি। প্রসঙ্গের অবতারণা কলকাতা নিয়ে। ঢাকায় ফেরার আগের দিন কলকাতার বাজারে গেলাম কিছু শপিং করতে। একটি দোকানে গেলাম। সেলসবয় একজন বিশ-বাইশ বছরের যুবক। তাকে যতই বাংলায় কথা বলি, সে ততোই হিন্দিতে জবাব দেয়। আমি বললাম, ভাই, আপনি কি বাঙ্গালী। সে স্বীকার করলো, বাঙ্গালী। আমি বললাম, তা হলে হয় বাংলা বলেন, নয়তো ইংরেজী বলেন, আমি হিন্দি বুঝি না। যুবকটি বাংলায় কথা বলতে অস্বীকার করলো। বললো, হিন্দি আমার রাষ্ট্রভাষা। অতএব আমি হিন্দিই বলবো। আমি বললাম, আমি বিদেশী, আমি তো হিন্দি নাও বুঝতে পারি, তাহলে আপনি কি আমার কাছে কিছুই বিক্রি করবেন না? সে কোনো জবাব দিলো না। আমিও ঐ দোকান থেকে কিছু না কিনেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। হিন্দুত্বের এই দেশপ্রেম নিয়ে তারা বেড়ে উঠেছে। আমরা যদি মুসলমানিত্বের দেশপ্রেম নিয়ে বেড়ে উঠি, তা হলে দোষের কী আছে, সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু সরকার ইসলামের নাম শুনলেই অাঁৎকে উঠছে। আমি নিশ্চিত যে এ দেশে ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠী থাকবে, ইসলামবিরোধী সরকার অধিককাল স্থায়ী হতে পারবে না। শাহবাগে এই সরকার ইসলামবিরোধী নাস্তিকদের কী চমৎকার পাহারা দিয়ে তথাকথিত আন্দোলন স্থায়ী করছে। লাখ লাখ ডায়াবেটিক ও অন্যান্য রোগী চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লাখ মানুষ যাতায়াতে অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আধা ঘন্টার পথ পার হতে আড়াই ঘণ্টা-তিন ঘণ্টা সময় লাগছে। কুম্ভকর্ণ সরকার নির্বিকার ঘুমাচ্ছে। আর ধারাবাহিকভাবে মুসলমানদের পশু-পাখির মতো হত্যা করছে। এটা সম্পূর্ণভাবে এক বিশাল বৈপরীত্য। শাহবাগে ধর্মদ্রোহীরা উল্লাসে নৃত্য করছে। সেসব নাচাগানা দেখতে লোকজন সমবেত হচ্ছে। সেখানে গান হয়, নাচ হয়, লাঠি খেলা হয়, যুবতীরা টিভি স্টার হতে ওড়নাহীন সংক্ষিপ্ত পোশাকে লাফালাফি করে। মজাই তো বটে। এ মজা দেখতে তরুণরা ভিড় করেন। আমিও যুবক বয়সে এসব মজার অনুষঙ্গে গিয়েছি। কিন্তু শেখ মুজিব আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই ইসলামবিরোধীরা এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এমনটা আমি দেখিনি। আর কোনো সরকার তাদের এভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে, তেমনও দেখিনি। কেউ যদি নাস্তিক হয়, হোক। সে বিষয়ে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু আস্তিক আমার আল্লাহ-রসুলকে গালি দেয়ার অধিকার কারও নেই। এ পর্যন্ত কোনো নাস্তিকও তা করেনি। আমার শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ নাস্তিক ছিলেন। তার সঙ্গে আমার মেলামেশা ঘনিষ্ঠ ছিল। আমরা একসঙ্গে লেখক শিবির করেছি। নানা আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমাকে নাস্তিকতায় তিনি কখনও উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেননি। বা কোনো আস্তিক বা ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার মতো একটি কথাও বলেননি। আমিও কোনোদিন এ নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেইনি। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা যা করছে, তা হলো বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ। বিচার বিভাগ বা বিচারপতিগণ স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা আদালতকে যে নির্দেশ দেবে, সে নির্দেশ বিচারপতিদের মেনে নিতে হবে। তা না হলে সারা ঢাকা নগর অচল হয়ে থাকবে। সরকারের এ এক দারুণ খেলা! আদালতের রায় মানি না। আমরা যা চাই আদালতকে সে রায়ই দিতে হবে। এ কেমন মামার বাড়ির আবদার। কিন্তু সরকার এমন আবদারের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাবনত হয়ে এই নাচাগানাকে মদদ দিয়ে লাখ লাখ মানুষের জন্য ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। ঢাকা এখন এক স্থবির অচল নগরীতে পরিণত হয়েছে। দেড়-দুই শ' মতলবি লোক শাহবাগ চত্বর আটকে দিয়ে কোটি মানুষের ভোগান্তির সৃষ্টি করছে, আর সরকার তাদের চার স্তরের নিরাপত্তা দিয়ে জামাই আদর করছে। আর ট্রাইব্যুনাল কী করছে। গত পরশু দিনও ট্রাইব্যুনাল খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে শাসিয়ে দিয়েছে, ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বেফাঁস মন্তব্যের জন্য। তবে কি শাহবাগীরা এসবের ঊর্ধ্বে? এদিকে সরকারের অবস্থানের বৈপরীত্যও মুখ ব্যাদান করে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। শাহবাগীদের জন্য সরকারের যে দরদ তার লেশমাত্রও আমরা দেখতে পেলাম না সাধারণ মানুষের জন্য। আল্লাহ-নবী-ইসলামের অবমাননায় সরকার যেন ধারাবাহিকভাবে মদদই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেই না ধর্মপ্রাণ মানুষ তার প্রতিবাদ করতে গেল, অমনি তাদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে তাদের হত্যা করতে শুরু করল সরকার। সেভাবে এ পর্যন্ত ২৩ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। জানি না, সামনে আরও কী আছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ব্লগে লেখা ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু কোনো সংবাদপত্র যদি তা প্রকাশ করে দেয়, তবে তার বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। তথ্যমন্ত্রীর কোনো ধারণাই নেই যে, ব্লগে কত সংখ্যক মানুষ শরিক হয়। সে সংখ্যা অনেক সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার চেয়েও বেশি। সুতরাং একে উপেক্ষা করা যায় না। এও যোগাযোগের আর এক বড় মাধ্যম। আবার উপেক্ষা যদি করা যেত, তাহলে সোনার বাংলাদেশ ব্লগটি শাহবাগীদের দাবি অনুযায়ী বন্ধ করতে গেল কেন সরকার? সে ব্লগে কিছুই আপত্তিকর ছিল না। তারা দেশের সকল সংবাদপত্রে প্রকাশিত জনপ্রিয় লেখকদের লেখা এক জায়গায় প্রকাশ করতো। তাতে পাঠকদের সুবিধা ছিল এই যে, সকল সংবাদপত্র না কিনেও তাতে প্রকাশিত লেখাগুলো তা থেকে পড়ে নিতে পারতো। তাতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা যেমন স্থান পেতো, তেমনি স্থান পেতো সিরাজুর রহমানের লেখাও। সরকার ব্লগটি বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং এর এক কর্মকর্তাকে আটক করে নিয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি । নিখোঁজ আছেন তিনি। জানি না, তার ভাগ্যে কী ঘটেছে। এসবের মাধ্যমে সরকার কার্যত ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে। প্রথম দিকে ধুয়া তোলা হচ্ছিল যে, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ তারা যুদ্ধাপরাধী। এও পানি ঘোলা করার মতো তত্ত্ব। এখন যারা জামায়াত-শিবির করেন, তাদের বয়স তিরিশের ঘরে। এখন যাদের বয়স ৬০ বছরের কম, তাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হাস্যকর ব্যাপার। আর শিবিরের যারা সদস্য তাদের কেউই স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেনওনি। তাদের সবার জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। তারাও অন্যদের মতো বাপ-দাদাদের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনেছেন। তারা কেমন করে যুদ্ধাপরাধী হন, বোঝা দায়। এ যাবৎ সরকার জামায়াত-শিবির নিয়েই ব্যস্ত ছিল। যারা জামায়াত শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তারা দূর থেকে তা দেখেছেন। হয়তো ব্যথিত হয়েছেন। সহানুভূতিশীল হয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেননি। কিন্তু সরকার যখন ইসলামবিরোধীদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে বসলো, তখন সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন। তখন সরকার দেশের গোটা মুসলমান সমাজের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খুন করেছে ২৩ জন মুসলমানকে। এর পরিণতি কী হতে পারে সেটা বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। ডান্ডা মেরে গোটা দেশবাসীকে ঠান্ডা করে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সরকার চন্ডনীতি অবলম্বন করেছে। ফলে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, এমন কোটি কোটি মানুষও সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সরকার শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে বাধা দিয়েছে মুসলমানদের। মসজিদের দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে। তার পুলিশ বাহিনী মসজিদের ভেতরে ঢুকে মুসল্লীদের ওপর সরাসরি গুলী চালিয়েছে। মুসলমানের রক্তে ভেসেছে মসজিদের পবিত্র প্রাঙ্গণ। ঝরে গেছে প্রাণ। তারপর আটক, পিটুনি, রক্তাক্ত করে দেয়া হয়েছে মুসলমানদের। তাছাড়া আরও মর্মান্তিক দৃশ্যও দেখলাম। পুলিশী এই হামলার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিলেন একজন বয়োবৃদ্ধ মুসল্লী। পুলিশের এক সদস্য তার মুখে পরপর দুবার সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারল। রক্তাক্ত হয়ে তিনি পড়ে রইলেন মসজিদের মেঝেতে। এসব দৃশ্য দেখে বেদনায় মুখ কুঞ্চিত হয়ে গেছে। পুলিশ বাহিনীর এই সদস্যরা কি আমাদের সন্তান নয়? তারা কি কোনো বাপ-দাদার ঘরে জন্মগ্রহণ করেনি? নাকি এরা কোনো উপনিবেশবাদী শক্তির প্রতিভূ? আমরা কি তবে কোনো উপনিবেশে বসবাস করছি? আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক নই? কিন্তু সরকার এর কোনো কিছুরই প্রতিবাদ করেনি। সংশ্লিষ্ট কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও বাড়াবাড়ির কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। সরকারের মনোভাব সবসময় গোপন থাকেনি। স্বযং প্রধানমন্ত্রী যখন বলে বসেন যে, মা দূর্গার কৃপায় শস্যের ফলন ভালো হয়েছে, তখন ইসলাম ধর্মের প্রতি তার মনোভাব আর অস্পষ্ট থাকে না। সে রকম একজনের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছ থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন আচরণই বোধকরি স্বাভাবিক। এই সরকারের যে যুদ্ধ আগে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা ছড়িয়ে গেছে গোটা মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে সরকারের জয়ী হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তা আমরা আলজেরিয়ায় দেখেছি। তুরস্কে দেখেছি। মিসরে দেখেছি। এখন বোধকরি বাংলাদেশেও দেখার সময় হয়ে এসেছে। যে মুসলমান শহীদের রক্তে এদেশের জমিন ভিজেছে, সে রক্ত কখনও বৃথা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও তা যায়ওনি।

Ads