বুধবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা



মাঈন উদ্দিন জাহেদ
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ’৭১-এর যে মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল তা এ প্রজন্মকে গর্বিত করে। আমরা আরো কিছু অধ্যায় পার হয়ে এসেছি। দুর্ভি-লুট-রাষ্ট্রনায়কের হত্যা-উর্দিধারীদের রাজনীতিতে প্রবেশ-স্বৈরশাসন-গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ছাত্রহত্যা-গুম-মিছিলে ট্রাক তুলে দেয়া-রাজনীতিবিদদের কেনাবেচা-রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট স্বৈরাচারীর স্বপ্ন দেখা, মতায় আরোহণের জন্য আওয়ামী লীগ যখন সহযোগী করলÑ জনগণ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করল। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে কী হচ্ছে?
১. দশ বছরের গণ-আন্দোলনের ফসল নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণাকে বাতিল করা হলো; ২. বর্বরভাবে লাঠিপেটা করা হয়েছে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের; ৩. সব বিরোধী দলের অফিস ও নগরীর মসজিদগুলো অবরুদ্ধ করা হয়েছে; ৪. জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে বিদেশী কোম্পানিকে; ৫. জাতীয় সম্পদের লুটপাট হচ্ছে;  ৬. নির্বিচারে মানুষ হত্যা হচ্ছে কিন্তু সরকার দায় নিচ্ছে না;  ৭. বাকস্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু অনলাইন মিডিয়া ও টকশোকে চোখরাঙানো হচ্ছে।
দলন-নিপীড়ন কোন গণতন্ত্র? রাষ্ট্রের কি ন্যূনতম নৈতিকতা থাকবে না? শুধুই কি মতায় যাওয়া আর টিকে থাকার প্রতিযোগিতা  রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান কি কোনো সভ্যতা অর্জন করবে না? বোধসম্পন্ন মানুষেরা আসুন যে যার অবস্থান থেকে কথা বলি সভ্যভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে। আমাদের বাংলাদেশ অর্জন করুক নাগরিক নিয়মনীতি, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মূল্যবোধ। বর্বর হিসেবে যেন চিহ্নিত না হই বিশ্বসমাজে।
রাজনীতি চলে গেছে দুর্বৃত্তদের হাতে। আশির দশকের পর যারা বুর্জোয়ার রাজনীতিতে এসেছে তারা ক’জন ছাত্রজীবনে ফার্স্ট বেঞ্চারÑ তা আজ গবেষণার বিষয়।
যত আন্দোলন হোক মানুষ ধরে নিত সরকার পরিবর্তন হবে পাঁচ বছর পর। কিন্তু জনগণের এ আস্থা নষ্ট করে দিল মতাসীনরা।
আদালত আরো দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি থাকার পে মতামত দিলেও প্রধানমন্ত্রী জনমতকে উপো করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করলেন। কূটকৌশলে মতায় যাওয়া ও টিকে থাকার বদলে জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা না হবে, তত দিন স্থিতিশীল গণতন্ত্র আসবে না।
রাজনৈতিক দলগুলো কি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল? প্রধান দলগুলোর আচরণ তার স্যা দেয় না। মতায় যাওয়ার আগে গণতন্ত্র, যাওয়ার পর ফ্যাসিবাদী আচরণ পূর্ণ গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা আমাদের হতাশ করে।
দলীয় সরকারের সময় সব নিয়োগে দলের ছোঁয়া থাকে যা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ব্যাহত করছে। পিএসসি, নির্বাচন কমিশন, বিচারপতি নিয়োগ, দুদকসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো যতণ দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না, ততণ গণতন্ত্র আশা করা সোনার পাথরবাটি আন্দোলনের মাধ্যমে যা হবে তা গণতান্ত্রিক পরিবেশ আনবে না, আনবে দলতন্ত্র বা ব্যক্তিতন্ত্র, যা আমরা চর্চা হতে দেখছি। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রত্যেককে আজ  গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার  কাজ করতে হবে। তা না হলে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স জিরিংয়ের মত : ‘বাংলাদেশ স্ববিরোধিতায় জর্জরিত একটি দেশ,’ তা আরো একবার প্রমাণিত হবে।
jahed৩১3@gmail.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

চেতনার লাঠিয়াল ও অচেতন মানবতা


মিনার রশীদ
মওলানা আবুল কালাম আজাদ জীবনসায়াহ্নে মানবতার রূপ দেখে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন। উপমহাদেশের ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ চল্লিশের দশকে জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা। সেই মানবতার জানাজার পর পরবর্তী চল্লিশ বছরে চল্লিশাও শেষ হয়ে গেছে। তারপর নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারে পুনর্জন্ম হয়েছে নতুন বোধের নতুন অবয়বের এক মানবতা। এই ‘মানবতার স্লোগানটি’ কোথাও হয়েছে রাজনীতির হাতিয়ার। কোথাও সেজেছে চেতনার লাঠিয়াল। কোথাও হয়েছে খুদ-কুঁড়ায় আকর্ষিত কিংবা ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত।
সর্প হয়ে যারা দংশন করেন তারাই অনেক সময় এই আজব মানবতার বড় বড় ওঝা সেজে বসেন। জনৈক বৌদ্ধ যুবকের ইসলাম অবমাননাসংক্রান্ত ডিজিটাল পোস্টিংটিকে অ্যানালগ জনতার সামনে এনেছিল আওয়ামী ঘরানার ‘তৌহিদি জনতা’ মিছিলের নেতৃত্বেও দেখা গেছে মৎস্য লীগ ও ছাত্রলীগকে। তার পরও যারা প্রশাসন ও পুলিশের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের আক্কেল দাঁত আদতেই উঠেছে কি না তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
কাজেই কারা এই আক্রমণ করেছে তা বলে দিতে জনতার মঞ্চের মহানায়ক বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটুও সময় লাগেনি। তবে বিএনপি-জামায়াতকে সরাসরি দায়ী করার চেয়ে বরং আশরাফুল ইসলামের ‘শিবির অনুপ্রবেশ তত্ত্ব’ এই জায়গায় অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতো। ছাত্রলীগ ও মৎস্যলীগের ভুট্টোরা নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে গেছেন। এবার দীলিপ বড়–য়া ও আ স ম আরেফিন সিদ্দিকীদের কাজটি শুরু হয়ে গেছে। সুধীদের সমাবেশে দিলীপ বড়–য়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তাতে দারুণভাবে উজ্জীবিত গদ্যলেখক আনিসুল হকেরা পদ্যের মাধ্যমে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভিলেইনের গায়ের রঙ, সাইজ, মুখের অবয়ব, গায়ের পোশাক সব স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা আছে। দেখা গেছে, ভিলেইন মনের মতো না হলে মানবতার এই ওঝারা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। ৭৮ বছর বয়স্ক ভাস্কর রশীদ আহমেদ ও তার পুত্রবধূ আট বছর ভারতের কুখ্যাত তিহার জেলে কাটিয়ে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য রয়েছে। এসব নান্দনিক পরিচয় ভারতের হোটেলে তার মুসলিম পরিচয়টি ঢিম বা অনুজ্জ্বল করতে পারেনি। টাকা জালিয়াতি চক্রের মিথ্যা অভিযোগে জেলে পুড়ে রেখেছে আট-আটটি বছর।
প্রিয় দাদু ও মায়ের এই ভয়ানক বিপদ ও বিরহে পরিবারের কিশোরী মেয়েটিও এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে বিদায় নিয়েছে। বাবা, স্ত্রী ও সন্তান হারিয়ে ভাস্কর্যের ছেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সিলেটের নূরজাহানের চেয়েও এই হতভাগা পরিবারের ট্র্যাজেডিতে মানবিক উপাদান কোনো অংশেই কম নেই। তার পরও এদের নিয়ে দেশের কিংবদন্তিতুল্য কোনো লেখকের কলম কখনোই ঝলসে উঠবে না। কারণ সবই ঠিক ছিলÑ স্থানটিই ঠিক নেই। মানবতার প্রতি দরদ প্রদর্শনের উৎসস্থল এদের মগজÑ হৃদয় নয়।
বিশ্ব প্রোপটে মানবতার চেহারাটিও খুব বেশি ভিন্ন নয়। একবার একটা তিমির বাচ্চা দলছুট হয়ে উত্তর মেরুর কাছাকাছি কোথাও বরফে আটকা পড়ে যায়। এটা নিয়ে সারা বিশ্বে তুমুল হইচই শুরু হয়ে যায়। শেষমেশ বরফকাটা জাহাজ পাঠিয়ে সেই তিমির বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বিশ্বের হৃদয়বান মানুষগুলো।
এবার এই তিমির বাচ্চার চেয়েও জটিল বরফের পাহাড়ে আটকা পড়েছে হাজার হাজার মানুষের বাচ্চা। এক তিমির বাচ্চার জন্য বিশ্ব মানবতার যে পেরেশানি ছিল এই হাজার হাজার মানবসন্তানের জন্য সেই পরিমাণ পেরেশানি ল করা যাচ্ছে না। নিজের দেশ থেকে তাড়া খেয়ে ওরা আমাদের উপকূলে ভিড় করছে। সমুদ্রে ভাসছে। আমাদের কোস্টগার্ড ও বর্ডার গার্ড ওদের ঢুকতে দিচ্ছে না। পৃথিবীতে এমন হতভাগা প্রাণী বোধ হয় আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজের মাতৃভূমিতেই তারা ‘অবৈধ’ হিসেবে গণ্য হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে কষ্টের কথাটি হলো, এদের যারা কচুকাটা করছে সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একটা পিঁপড়া হত্যা করাকেও ‘মহাপাপ’ বলে জ্ঞান করত।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটখাটো নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী কিংবা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে যেকোনো রাজনৈতিক ও সামরিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর সমগ্র বিশ্ব। কিন্তু এ ধরনের কোনো ক্যাটাগরিতেই গ্রহবাসীর সহানুভূতিটি পাচ্ছে না রোহিঙ্গা নামক হতভাগা একটি জনগোষ্ঠী। এদের হাতে তেলের মতো কোনো সম্পদ নেই। ফলে কুয়েতের মতো পেট্রো-ডলার নিঃসৃত মায়াকান্না অনুপস্থিত। ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়ার সম্মুখে শতাব্দীর সুযোগ (Opportunity for the Century ) সৃষ্টি হয়েছিল। এদের বেলায় তেমন ধরনের জিও-পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট নেই। এরা কারোর ভূ-রাজনৈতিক সম্পদ বা এসেট হতে পারছে না। বরং দীপু মনিদের হৃদয়হীন বাংলাদেশসহ ওআইসির জন্য আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ক্ষতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এত দিনে হৃদয়ঙ্গম করেছে। কাজেই বিশ্বজনমতের বাইরে থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। অং সান সু চির ওপরও গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী বিশ্বের একটা সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গা শরণার্থী সৃষ্টির উৎস বা সোর্সটি বন্ধ করার নিমিত্তে চাপের জায়গাগুলো আরো স্পষ্টভাবে বিশ্বশক্তির হাতের নাগালে এসেছে। সেই আসল জায়গায় চাপটি প্রয়োগ না করে বিশ্বশক্তি বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ভোঁতা মানবিক বোধটিকে শাণিত করার নাটক চালিয়ে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও মুসলিম বিশ্বকে কাছে টানার তাগিদটি কখনোই অনুভব করেননি। ইন্ডিয়াকে যতটুকু কাছে টেনেছেন বাদবাকি বিশ্বকে ততটুকু দূরে ঠেলে দিয়েছেন। কাজেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বকে সামনে রেখে বিশ্ব জনমতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো সামর্থ্য, দক্ষতা কিংবা নৈতিক মনোবল কোনোটিই এ সরকারের নেই। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে নিজের আঙিনা থেকে অনেক দূরে ইরান-ইরাকের যুদ্ধ বন্ধের নেতৃত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশ ও তার মাত্র বিয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ বছরের এক রাষ্ট্রপতি। আর এখন ঘরের পাশে চরম মানবিক বিপর্যয়ে নিজের দরজায় খিল এঁটে ‘শান্তির মডেল’ নামে রচনাটি বিশ্বসভায় জমা দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে বাংলাদেশ।
কাজেই সহায়হীনের একমাত্র সহায় হিসেবে এই সরকার রোহিঙ্গাদের সাথে যে আচরণ করছে, তা অত্যন্ত অমানবিক ও নিষ্ঠুর বলে পরিগণিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মীয় চেতনা কিংবা মানবিক চেতনাÑ কোনো চেতনাতেই এই আচরণ ন্যায্য হচ্ছে না। মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলোকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও এর বাইরে মুসলিম উম্মাহর একটা দৃশ্যমান বলয় বা উপস্থিতি রয়েছে। সেই বলয়ে আমরা এক স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক জাতি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছি। এই বলয়ের প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্ব থেকেই বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে এযাবৎ সবচেয়ে বড় সাহায্যের পোঁটলাটি এসেছে। অন্যরা এক টাকা দান করে দশ টাকার কথা শুনিয়েছে কিংবা পাঁচ টাকার কসরত দেখিয়েছে। কাজেই মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের প্রতি এমন ধরনের আচরণ বৈষয়িক বিবেচনাতেও আত্মহত্যার শামিল হচ্ছে।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন ত্রিশ-চল্লিশটি ট্রলারে করে রোহিঙ্গারা (মানুষ নয়) সমুদ্রে ভাসছে। এই তিন হাজার বনি আদম যখন অকূল পাথারে ভাসছে তখন মুসলিম উম্মাহর ৩০ লাখ হাজী লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা বলে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিচ্ছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশের এক লাখ। এই এক লাখ লাব্বাইকার জবাবে সৃষ্টিকর্তা (নিশ্চয় অভাগা রোহিঙ্গাদের তিনিই সৃষ্টি করেছেন) কী জবাব দিচ্ছেন জানি না।
সমুদ্রে একটা প্রাণীও যখন বিপন্ন হয়ে ভাসতে থাকে, তখন তাকে আশ্রয় দেয়া আশপাশে অবস্থানরত অন্য সবার জন্য বাধ্যবাধক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিপন্ন আত্মাকে উদ্ধার করার এই মানবিক বোধ মানুষের মাঝে অত্যন্ত প্রখরভাবে কাজ করে। আর আধুনিক বিশ্বে তা সার্বজনীন আইনে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি চুরি করেও সমুদ্রগামী পরিবহনে উঠে পড়ে (মেরিটাইম পরিভাষায় যাকে বলে Stowaway) তাকে আপদ মনে করে পানিতে ফেলে দেয়া বা মেরে ফেলা সমুদ্র আইনে মারাত্মক অপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের কথা বলে এ সরকার উঠতে-বসতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে চলেছে। নীরবতার জন্য জনগণও সেই অপরাধ শেয়ার করছে।
দুর্ধর্ষ সার্বরা ‘এথনিং কিনজিং’ শুরু করলে বসনিয়ার নির্যাতিত মুসলিম মেয়েরা ওআইসির কাছে শেষমেশ সাহায্য হিসেবে চেয়েছিল জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি। কিন্তু তজ্জন্য ওআইসির প্রস্তুতিটি তখন তেমন ছিল না। সে তুলনায় এবার হাতে বেশ খানিকটা সময় পাওয়া গেছে। কারণ যুগ যুগের অনভ্যাসহেতু ভিক্ষুদের এই কর্মটি শুরু করতে একটু সময় লাগতে পারে। আবুল মাল আব্দুল মুহিতদের জন্যও অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারের সীমান্তজুড়ে শুধু হবে মায়াবড়ির কারখানা। আমাদের প্রতিবেশী আমাদের ডাইল (ফেনসিডিল) খাইয়ে যেভাবে ধনী হচ্ছে; একই কায়দায় আমাদের প্রতিবেশীদের আমরা খাওয়াবো ‘মায়াবড়ি’ রোহিঙ্গা সিস্টাররা চাহিবামাত্রই ওআইসির ব্রাদাররা দ্রুতগামী ইউএস নেভির বোটে চড়ে কন্ট্রাসেপটিভ সাপ্লাই দিতে সক্ষম হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার বা শুধু ‘ওহ আইসি’ করার দুর্নাম এভাবেই ঘুচে যাবে।
ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামি ও নিউকিয়ার দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত জাপানের সম্রাট ও ধর্মরক্ষক তার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে ডাকেননি। আকাশের দিকে তাকিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, এসব কী হচ্ছে? স্যান্ডির ভয়ে পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার দেশের লোকজন ছয়টি শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ক্যাথরিনা, স্যান্ডি প্রভৃতির বাতাসের গতি ও রিখটার স্কেলের মাত্রাটির নিয়ন্ত্রণ কার হাতেÑ এই প্রশ্নটি মনে এলেই আকাশের পানে দৃষ্টি চলে যায়।
কাজেই বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী অবিশ্বাসীর মতো দাম্ভিক, অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হতে পারে না। এ সরকার শুধু সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসটুকুই মুছে ফেলেনি; জাতির আচার-আচরণ থেকেও মানবিক মূল্যবোধের সব রস শুষে নিয়েছে। সমুদ্রে ভাসমান চরম বিপদগ্রস্ত বনি আদমদের আত্মার প্রতি আমরা যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছি তাতে সত্যিই ভয় লাগছে, এর জন্য কোনো কালেকটিভ পানিশমেন্ট আল্লাহ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেন কি না। আল্লাহ আমাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা করুন। দেশের আপামর মানুষ নিষ্ঠুর নয়। একটা নিষ্ঠুর শাসকগোষ্ঠী আমাদের ওপর চেপে বসেছে।
সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় এই পৃথিবী একটা অতি ক্ষুদ্র বালুকণার চেয়েও নগণ্য। এর মধ্যে মানুষ হিসেবে আমরা অতি ক্ষুদ্র একটা জীব। যার বাহাদুরি (আয়ু) একটা কাছিমের চেয়েও অনেক অনেক কম। এগুলো নিয়ে না ভাবলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ে। সাবেক মন্ত্রীর চোখও তুলে ফেলতে চায়।
minarrashid@yahoo.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কী ভয়াবহ চিত্র!



আলমগীর মহিউদ্দিন
বাংলাদেশের মানুষ এখন শঙ্কা, অসন্তোষ ও যন্ত্রণায় ডুবে আছে। তারা শঙ্কায় এ জন্য যে, প্রতিটি দিন তাদের কাছে অজানা হয়ে পড়ছে। জীবনধারণ থেকে স্বস্তিতে, নির্ভয়ে ও নির্বিঘেœ রাস্তা চলাও বিপদসঙ্কুল হওয়ার জন্য এ শঙ্কা। কেবলই অপরাধী ও অপরাধের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যে আইন মানছে, আইনের সপক্ষে বলতে চাইছে অথবা তাকে সহায়তা দিতে চাইছে, সে বিপদে পড়ছে। শঙ্কা এখানেই। যে সত্য বলছে, নৈতিকতার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, সে আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে পড়ছে। সে আক্রমণ শারীরিকভাবেও হচ্ছে। শঙ্কা এখানেই। প্রতিটি মুহূর্তই যেন ভীতিকর।
মানুষের অসন্তোষ যদিও বহু প্রাচীন, এখনকার অসন্তোষ একেবারেই কাছের জিনিস নিয়ে। অসন্তোষ এ জন্য যে, জীবনের নিরাপত্তা একেবারেই ভঙ্গুর হয়েছে পড়েছে। খবরের কাগজ বলছে, প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনকে হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো কখনো রাজনৈতিক হিংসার ফল, কখনো বা নিছক অপরাধবৃত্তি থেকে। সমাজের যে সাধারণ ঐতিহ্যবোধ ও নৈতিকতা সব অপরাধকে বাধা দিত এবং প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে জীবনের নিরাপত্তা দিত, তা যেন বিলীন হয়েছে। এমনকি যারা এসব বিষয় নিশ্চিত করার দায়িত্বে, তারাই এই অপরাধের হোতা হয়ে পড়েছে। জীবনধারণের নিরাপত্তার অভাব ছাড়াও জীবনধারণের উপকরণের অভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এখানেও যাদের এসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব, তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অনাচারে লিপ্ত। অসন্তোষ এখানেই। সমস্যা সমাধানের নামে নতুন সমস্যা সৃষ্টির উৎসাহ জনগণকে অসন্তোষে রেখেছে। নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে অন্যায় পন্থার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবানেরা ক্রমান্বয়ে ধনী হচ্ছে, আর এর ফলে সামাজিক অশান্তি ও অনগ্রসরতাও নিশ্চিত হচ্ছে। অন্যায়ের বিচারপ্রার্থীরা অথবা সমালোচনাকারীরা হচ্ছে নিগৃহীত। সব কিছুই রাজনীতির লাভ-লোকসানের আয়নায় দেখা হচ্ছে। জনগণের অসন্তোষ এখানেই। তারা ভীত এবং শঙ্কিত এ জন্য যে, অন্যায়ের প্রতিকার এবং তার বিচারের অভাব সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবনে কোনো আলোকবর্তিতা জ্বালাচ্ছে না। এমনকি ন্যায়বিচারের কোনো স্থান তারা খুঁজে পাচ্ছে না। স্বার্থলোভী সংখ্যালঘিষ্ঠ ক্ষমতাবানরা সাময়িক লাভবান হলেও পরিণতিতে যে রাষ্ট্রীয়-জাতীয়ভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে। অথচ নেতৃত্বের দাবিদার ও ক্ষমতাবানেরা কেউই এই পরিণতির কথা ভাবতে পারছে না, ভাবছে না। শঙ্কা ও অসন্তোষ এখানেই।
মানুষ, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ এবং তাদের শুভানুধ্যায়ীরা এখন যন্ত্রণায়। সমস্যার পাহাড় ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। প্রতিটি পল যন্ত্রণায় আবিষ্ট। এমন যন্ত্রণার রাজ্যে তারা কখনো বাস করেছে কি না কেউই মনে করতে পারে না। রাষ্ট্রকে ক্ষমতাবানেরা ব্যবহার করছে জনগণকে যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রাখতে। বেশির ভাগ মানুষ এ বিষয়ে একমত যে, এসবের মূলে অনৈতিকতা, যা সৃষ্টি করেছে অভাবনীয় দুর্নীতির সাম্রাজ্য। এটা সার্বজনীন যে, দুর্নীতি দেশের সুস্থ ও সুন্দর উন্নয়নে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে ও পরিচালনায় প্রধান বাধা। একে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বলা হয় এ জন্য। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসঙ্ঘ দুর্নীতির একটি সংজ্ঞায় একমত। ‘অর্পিত ক্ষমতা ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার’ করাকেই দুর্নীতি বলে। এটা বিশ্লেষণ করলে সহজেই এর ব্যাপকতা স্পষ্ট হতে বাধ্য। এ তিন সংস্থা বলেছে, শুধু দু’টি শ্রেণী দুর্নীতিতে জড়িত। তারা হলোÑ আমলা ও রাজনীতিবিদ। সাধারণ মানুষ কখনোই দুর্নীতিতে জড়িত নয়। এ দুই শ্রেণীর জনগণের এক ুদ্রাংশকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে দুর্নীতির দায় থেকে মুক্তি পেতে চায়।
গত চার দশকে দুর্নীতি কেবলই তার আকার প্রসারিত করেছে। দুর্নীতি নির্মূলের নামে যে কর্মকাণ্ডগুলো হয়েছে, তা সেই দুর্নীতির পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করেছে। দুর্নীতিবাজরা প্রধানত ক্ষমতাবান। কেননা তারা আমলা ও রাজনীতিবিদ। তারা দেশ চালায়, সমাজকে তাদের অঙ্গুলি নির্দেশে নতুন নতুন নিয়মকানুন নির্মাণ অথবা তাদের নির্মিত নিয়মকানুন মানতে  বাধ্য করে। উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিবাজেরা প্রায়ই নীতির ও আইনের আবরণে দুর্নীতি করে। এ জন্য তারা ক্ষমতায় গেলে প্রথমেই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী আইন তৈরি করে। তাদের প্রতিপক্ষকে কোনো কথিত অপরাধে শাস্তি দিতে চাইলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় আইন নির্মাণ করে। যেমন, তারা আইন তৈরি করল, অভিযোগই যথেষ্ট, কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে চাুস সাক্ষী। বহু শতাব্দীর প্রচলিত রীতিনীতিও বিশেষ ক্ষেত্রে পদদলিত হতে দেখা যায়। পুরাকাল থেকে সাক্ষীর নৈতিকতার ওপর যে প্রাধান্য দেয়া হতো, তাকে গৌণ করে ফেলা হয়েছে। নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেয়ার কারণ, এটা মিথ্যাকে সহজভাবে প্রতিহত করতে পারে। অথচ মিথ্যা দুর্নীতি ও অনাচারের প্রধান বাহন। তবে এখন বাংলাদেশে এই অনৈতিকতা ও মিথ্যাচার ক্ষমতাবানদের প্রধান শক্তি।
বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালে দুর্নীতির শীর্ষ দেশগুলোর লিস্টে স্থান পায়। এটা সহজেই অনুমেয়, তখন রাজনীতিবিদ-আমলারা কোনো মহোৎসবে লিপ্ত ছিলেন। জাতিসঙ্ঘ-বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুসারে এ দুই শ্রেণী সৎ, শুদ্ধ ও নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ পরিচালনা করলে দুর্নীতি কখনোই সত্য নয়। এবং তেমনটি হলে, গুম-খুন-চুরি-দখলের রাজ্য কায়েম হওয়ার পথ থাকে না। আসলে বাংলাদেশের জন্মের ঊষালগ্নেই ক্ষমতাবানেরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, তাদের জীবন ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড একে অন্যের সম্পূরক হয়ে পড়ে। এ জাল থেকে গত চার দশক পরেও তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি। বরং তা যেন তাদের আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নের সরকারপ্রধান নিজেই এই মহোৎসবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তার বিখ্যাত ‘চাটার দলে চেটে খায়’ উক্তিটি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় দুর্নীতি কোন পর্যায়ে। তিনি অসহায়ভাবে এ উক্তিটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে দুর্নীতি, অনাচার, অবিচারের প্রতি খানিকটা উদাসীনতার সৃষ্টি শুরু হয়।
দুই বাসযাত্রীর মধ্যে সম্প্রতি কথাবার্তা হচ্ছিল। যুবক যাত্রীটি একপর্যায়ে মন্তব্য করল, ‘আমিও তাদের মতো বিক্রি হতে প্রস্তুত।’ এর আগে এ দেশের আমলা, রাজনীতিবিদ আর অপরাধীরা কেমনভাবে কেনাবেচা হচ্ছে, তার ফিরিস্তি যুবকটি দিয়েছিল। বয়স্ক যাত্রীটি এর প্রতিবাদ না করে বলল, ‘কেন এই অন্যায়কে অনুসরণ করবে?’ যুবকটি বলল, ‘কারণ সেও এসব আমলা-রাজনীতিবিদের মতো রাতারাতি ধনীÑ ক্ষমতাবান হতে চায়।’ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ভাবছে না। তারা ধনে ও ক্ষমতার অনুসারী হয়ে পড়েছে। এমন দৃষ্টিভঙ্গি একটি সমাজই শুধু নয়, জাতির জন্যও অত্যন্ত ভয়াবহ। অথচ বাংলাদেশের যুবসমাজের একাংশের মধ্যে এটা এখন প্রধান চালিকাশক্তি। এর অনেক কারণের মাঝে প্রধান কারণটি হলো সমাজপতি ও নেতৃত্বের নৈতিকতার অধঃপতন। আজকের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে যে অস্থিরতা ও অনাচার তা যে এ জন্যই হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধের ধারাটিকে এমন অবস্থার সৃষ্টির মাঝ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। এখন মানুষ ন্যায়ের পক্ষে এগিয়ে আসতে ভয় পায়।
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। এ তথ্য জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে। তারা সংসদে আইন প্রণয়ন করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেন। এক আন্তর্জাতিক সংস্থা এদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখতে পায়, এদের ৯৩ শতাংশ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট আর অর্ধেকের বেশি খুন-গুম-দখলে। সরকারের জবাবটি বেশ রহস্যজনক এবং বহুমাত্রিক। জরিপের পরিপ্রেক্ষিতে যে তথ্য দেয়া হয়, তাকে সরকার বলেছে তৃতীয় অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে এ প্রচেষ্টা। তবে এ কথা বলা হয়নি, যে তথ্যগুলো দেয়া হয়েছে তা একেবারেই মিথ্যা। উল্লেখ্য, যে সংস্থাটি এই জরিপ এবং তথ্য প্রকাশ করেছে, তার অনেক কর্মকর্তা সরকারপন্থী বলে পরিচিত। এ কথা বিবেচনা করে কেউ যদি এ উপসংহার টানে যে, অনাচার, অবিচার, অনৈতিকতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসব কর্মকাণ্ডের হোতাদের শুভানুধ্যায়ীরাও কিছু সত্য বলতে বাধ্য হচ্ছেন। আসলে এত দুর্নীতি, সামাজিক অনাচার, সরকারের নেতৃবৃন্দের লাজহীন অশ্লীল বাচনভঙ্গি অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। অতীতের সব দুর্নীতির রেকর্ড ভেঙেও কেমনভাবে লজ্জাহীন হয়ে জনগণের সামনে কথা বলতে পারা যায়, তার নতুন দিকনির্দেশনা বর্তমানের ক্ষমতাবানেরা প্রদর্শন করছে। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। একজন মন্ত্রীর বাড়িতে বস্তাভর্তি টাকা যাচ্ছিল এবং তা সরকারি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়ার চার ঘণ্টা পরেই তা কেমন করে গায়েব হয়ে যায়, তার সম্ভবত নজির এ দেশে নেই বললেই চলে। দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, মন্ত্রীসহ অনেকেই এই দুর্নীতিতে জড়িত এবং কয়েকটা নাটকীয় অঙ্গভঙ্গির পরে যথা পূর্বং তথা পরং। সরকারের শক্তিশালী অংশ বিষয়টিকে আমলেই নিলো না। জনগণ তাই সন্দেহ করে, দুর্নীতি দমনের নামে যে কর্মকাণ্ড হচ্ছে তা কি শুধু ‘আইওয়াশ’?
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে, জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এবং তাদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে যেন একটি পুরনো খেলায় ক্ষমতাবানেরা আবার মেতে উঠেছে। তা হলো সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির প্রয়াস বৌদ্ধমন্দির পোড়ানো, হামলা এবং তা নিয়ে ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো কর্মকাণ্ড স্পষ্ট করে দেয়, এটা ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ড। ছবি এবং সাক্ষাৎ সাক্ষীদের বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে প্রতিপক্ষকে এ বিষয়ে জড়ানোর অপচেষ্টা যে জনগণের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছে, এটা বুঝতে পেরে ক্ষমতাবানেরা যেন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে।
তবে জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র বর্ণনা করে জরিপের যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তাকে কোনো শাক দিয়েই লুকানো সম্ভব নয়। বলা হয়, নারী যদি একবার সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলে, তার দ্বারা সব কিছুই সম্ভব। তেমনি যদি একজন একবার অনৈতিক কাজ করে পার পেয়ে যায়, তখন তার বিশ্ববেহায়া হতে আটকায় না। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা যদি এই শ্রেণীতে যোগ দেন, অবশ্যই সে দেশ ও জাতির জন্য থাকবে শুধুই যন্ত্রণা। এখানে হজরত আলী রা:-এর একটি অমর বাণী উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘যে দেশের নেতা ও সমাজপতিরা মিথ্যা বলে, অনৈতিকতায় ডুবে যায়, আর জনগণ তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে পিছিয়ে থাকে, সে জাতি ও দেশের জন্য রয়েছে অফুরন্ত যন্ত্রণা এবং শাস্তি।’ বাংলাদেশের মানুষ আজকের অনাচার-অবিচারের রাজ্যে ঠিক এই যাতনায় ভুগছে। যেহেতু অনৈতিকতা সমাজজীবনে দৃঢ়ভাবে শিকড় গেড়েছে এবং তা উৎপাটনের কোনো চেষ্টাও নেই, তাই এ কথা হয়তো মিথ্যা হবে না যে, এ জাতির নিজস্ব সত্তা, স্বাধীনতা এবং বিকাশÑ সবই বিপন্ন হবে। কোনো নকিব এসে সবাইকে জাগিয়ে এ ডুবন্ত জাতিকে আবার বাঁচিয়ে তুলবে কি না, হয়তো তা শুধুই পরম করুণাময় সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আমরা জানি না এ ভয়াবহ চিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি না। কারণ এ দেশের রাজনৈতিক ধারা অনুসারে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন ক্ষমতাবানেরা তাদের প্রতিপক্ষকে যে বিশেষণে অপবাদ দিয়ে থাকে, তারা সে কর্মেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাহলে কি তারা নিজেরাই তৃতীয় শক্তিকে আহ্বান করছে? তৃতীয় শক্তিকে জনগণের কথা ভাবতে হয় না। জনগণের নামে শক্তি দিয়ে তাদের নিজেদের এজেন্ডা সহজেই কায়েম করতে পারে।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভিসিলীগ আর ছাত্রলীগের তাণ্ডবে অশান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়



প্রফেসর ড. মো. হারুনর রশীদ খান
গত ৪ অক্টোবর একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম ছিল ‘আবার শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা’। ওই খবর অনুসারে ছাত্রলীগের তালিকা অনুযায়ী কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় মাসাধিককাল শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ভিসির বিরুদ্ধে জমি বিক্রির অভিযোগ ওঠায় অশান্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত ছাত্রলীগ বনাম শিবির সংঘর্ষে। শুধু ওই দৈনিকটি নয়, দেশের সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ খবরগুলো গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়েছে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। সম্প্রতি খবরের আরেকটি শিরোনাম হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সুকর্ম (!)। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তার গাড়িবিলাস ও অর্থকাণ্ড। ভর্তি পরীক্ষার অর্থ থেকে বড় অংকের অর্থ গ্রহণেরও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। আমার কর্মস্থল যেহেতু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। আমার যৌবনে আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শৈশবে আমি এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। এখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২২ বছর আগে। ছোটখাটো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়টি অতীতে কখনও সন্ত্রাস বা অন্য কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে পত্রিকার শিরোনাম হয়নি। পক্ষান্তরে দেশ-বিদেশে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচিতি লাভ করে রাজনীতিমুক্ত, সন্ত্রাস ও সেশনজটমুক্ত জ্ঞানচর্চার এক অনবদ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এখান থেকে ডিগ্রি অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীরা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রিসহ আরও কিছু শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে বছর দুয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে, যার মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ শ্রেণীতে স্থান পায়। বিশ বছরেরও অধিককাল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, যেখানে জীবনের সব সোনালি সময় নিয়োগ করেছি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন গৌরবের অংশীদার হতে পেরে গর্বে বুক ভরে যায়। কিন্তু কথায় বলে, এক পাতিল দুধে এক ফোঁটা গো-চনাই যথেষ্ট। তেমনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি, কর্ণধার এবং রক্ষক ভিসির বিরুদ্ধে একটি সুকর্মের (!) অভিযোগ আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইশ বছরে অর্জিত সুনাম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। বিগত দিনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাত্, নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা ধরনের বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ভিসির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি প্লট আকারে বিক্রির অভিযোগ ওঠেনি। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীতে মনে হয় এটাই প্রথম যে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি ওই প্রতিষ্ঠানেরই কর্ণধারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এরকম অবিশ্বাস্য ঘটনাটিই ঘটেছে সম্প্রতি আমার কর্মক্ষেত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
মাত্র ১০৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তান এবং পরে খুলনা আর্ট কলেজ স্থাপিত হয়েছিল এখানে। কয়েক মাস আগে অভিযোগ ওঠে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ভিসি মহোদয়ের সংশ্লিষ্টতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাবেষ্টিত কিছু জমি প্লট আকারে বাইরের ভূমিদস্যুদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন কিছু শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতিবাদের মুখে নানা টালবাহানার পর ভিসি বাধ্য হয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। আর এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে জমি বিক্রির সঙ্গে স্বয়ং ভিসির সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ঘটনা আড়াল করার চেষ্টায় নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার জের ধরেই স্থগিত হয়ে যায় ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। প্রশাসন নানা ছুতোয় শোকজের নামে নানা ধরনের হয়রানি করতে থাকেন প্রতিবাদী শিক্ষকদের। ক্যাম্পাসে সচেতন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ভিসিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ ধরনের খবর এখন প্রতিদিন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শিরোনাম হচ্ছে, যা দেখে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। যে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গত বিশ বছর গর্ব করেছি, এখন তা শুধুই অতীত। যা হোক, ভিসি মহোদয়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৫ অক্টোবর। মেয়াদ শেষের আগে কয়েক সপ্তাহ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে অফিসে আসতে পারেননি তিনি। সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে এখনও আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কবে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে, তা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তা মূল্যবোধ আর নৈতিকতারই চরম অবক্ষয়। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের সমাজের নিচু থেকে উঁচু সব জায়গাতেই পচন ধরেছে। দেশের মানুষের মনে নিশ্চয়ই ভিসিদের এমন অবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে। যারা এর আগে বুয়েটের ভিসির একগুঁয়েমি দেখেছেন, তাদের কাছে সেটা তখন নিশ্চয়ই খুব খারাপ উদাহরণ মনে হয়েছিল। কিন্তু তাদের কাছেও এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ যে সর্বকালের সেরা উদাহরণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি ভাবি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি উঠেছে—তার চেয়েও খারাপ আর কি কোনো ঘটনা আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে? অনেক ভেবে দেখলাম, হ্যাঁ এর চেয়েও বড় আরেকটি ঘটনাই কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে, আর সেটা হলো—যদি কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে পারি সরকার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। বোধ করি সেটি কখনোই ঘটবে না বা কোনো সরকারই সেটা করবে না। তার মানে দাঁড়ায়, আমাদের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে, তার মধ্যে জঘন্যতম ঘটনাটিই ঘটে গেছে।
কিন্তু ভিসিলীগ খ্যাত এসব ভিসির মান-সম্মান এত হালকা নয় যে, মাত্র এতটুকু অভিযোগে বা অবাঞ্ছিত ঘোষণায় সেটা চলে যাবে।
যা হোক, এবার দৃষ্টি ফেরাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ছাত্রলীগের তালিকা থেকে কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসাধিককাল ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল আর অবশেষে গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বাস ভাংচুর করে পুড়িয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি বাইরে থাকা নয় হাজার ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, ভিসিসহ প্রোভিসি এবং ট্রেজারার এই নিয়োগবাণিজ্যে জড়িত। অর্থাত্ একথা স্পষ্ট যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অচল অবস্থার জন্য প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বই দায়ী। অভিযোগ উঠেছে, ৯২টি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে ছাত্রলীগের নেতারা কয়েকশ’ ব্যক্তির কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নামে অর্থ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ২০০ জনের একটি তালিকা প্রশাসনকে দিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু দেখা যায়, ৯২টি পদের বিপরীতে যে ১১২ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে ওই তালিকার মাত্র কয়েকজনের চাকরি হয়েছে। এ থেকেই শুরু হয় ছাত্রলীগের তাণ্ডব। পত্রিকার খবরে জানা যায়, ভিসি স্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের নেতারা তার কাছে একটি তালিকা দিয়েছিল যা থেকে কয়েকজনের চাকরি হয়েছে। মাসাধিককালের মধ্যে ভিসি পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাসে গেছেন মাত্র তিন দিন। নিরাপত্তার অভাবে তার গাড়ি রাখা হয় পুলিশ লাইনে। মোদ্দাকথা হলো, ছাত্রলীগের কাছে ১২ হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন তথা পুরো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি।
এবার আসা যাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। গত ২ অক্টোবর ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে ফিল্মি কায়দায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অস্ত্রে গুলি ভরা, অস্ত্র তাক করা এবং গুলি চালানোর দৃশ্য ছাপা হয়। এ সময় পুলিশকে অত্যন্ত অসহায়ভাবে নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। দেখে মনে হয় পুলিশ যেন তাদের সততা, মানবতা, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা সরকারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ছাত্রলীগের এই তাণ্ডবে শিবিরের পাঁচ কর্মী গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ আহত হয় কমপক্ষে ৩০ জন—যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও সাংবাদিকও রয়েছেন। ছাত্রলীগের এই হামলার কারণ শুধুই তাদের আধিপত্য বিস্তার। পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের পরেও কেন তাদের গ্রেফতার করা হয়নি, এর কারণ জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের অভিযান ও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমার বিশ্বাস, তারা আইনের আওতায় আসবে।’ অন্যদিকে ভিসি বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে যে-ই জড়িত থাক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে। এজন্য সময়ের প্রয়োজন।’ যেখানে পুলিশের সামনে অস্ত্র ব্যবহার হলো, তখন হাতে-নাতে না ধরে এখন বলা হচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ বা ভিসির এ ধরনের বক্তব্য কেবলই ‘বক্তব্য’। কোনোদিন এর বাস্তবায়ন যে হবে না, সেটা সবাই জানে। অস্ত্রহাতে যাদের দেখা গেছে, তারা ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডার। তারা নিজ দলের কর্মী হত্যা ও ডাকাতিসহ অনেক অপকর্মের মামলার আসামি। এই ক্যাডারদেরই একজন আবার বাদী হয়ে শিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে, যে মামলায় ভর্তিচ্ছুসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সরকারের উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো নীতিরই যেন আরেকটি প্রমাণ রাখল এই ছাত্র সংগঠনটি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে যা-ই করুক ‘কেষ্টা বেটাই চোর’। সব দোষই শিবিরের আর ছাত্রলীগ হলো সোনার ছেলেদের খনি। শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের ‘গুণ্ডা-বদমাশ’ বলেছেন, দুঃখ প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘দরিদ্র মানুষের টাকায় চলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি অমানুষ তৈরির জন্য?’ একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করলে বেপরোয়া হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ছাত্রীদের ওপরও আছড়ে পড়ে তারা। ছাত্রলীগের যে ক্যাডাররা নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে হামলা চালিয়েছে, তারাই আবার বাদী হয়ে হামলায় আক্রান্তদের নামে মামলা করেছে। পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে প্রক্টর সরাসরি পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক ছাত্রীকে ঘুষি মারছেন। কী দারুণ প্রক্টরিয়াল দায়িত্ব পালন!
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ গত ৮ জুলাই সিলেটে এমসি কলেজের শতবছরের পুরনো ছাত্রাবাসে আগুন ধরিয়ে পুড়ে ফেলে। শিক্ষামন্ত্রী এ দৃশ্য দেখে তখন কেঁদে ফেলেছিলেন। মাননীয় মন্ত্রীর মনের কোমলতায় সাধারণ মানুষ অভিভূত। কিন্তু মন্ত্রীকে তো কাঁদলে চলবে না, হুমকি-ধমকি দিয়ে কিংবা নীতিকথার অমিয় বাণী দিলেও চলবে না। এসব সন্ত্রাসীর কবল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও জনগণের জানমাল রক্ষার কাজটিও তাকেই করতে হবে। মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগ সামলান।’ কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তা করেছেন? বেপরোয়া ছাত্ররাজনীতির কুফলে আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, ফাও খাওয়া, ডাকাতি, খুন, হাইজ্যাক, ছিনতাই, অপহরণ, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা কিংবা ধর্ষণ—এর প্রতিটি অপকর্মেরই অভিযোগ আছে এই সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এদের সন্ত্রাসী হামলায় এ সরকারের মেয়াদে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগাম, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝরে গেছে ২৩টি তরতাজা টগবগে তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন। এদের কারণে ছোট-বড় নানা ধরনের সংঘর্ষে ৭৫টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন এমনকি মাসের পর মাস বন্ধ থেকেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের এমন অপকর্মে এবং দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়ের মধ্যে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন; কিন্তু তার এই ঘোষণা খুব বেশিদিন বলবত্ থাকেনি। ছাত্রলীগের কাউন্সিলে তিনি আবার তাদের আদর করে কাছে টেনে নেন। সরাসরি ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া এই ছাত্রলীগের তাণ্ডবের কাছে অসহায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ এমনকি পুলিশ প্রশাসনও। সারাদেশে ছাত্রলীগ যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, তা দেখলে মনে হয় সরকারি মদতপুষ্ট ছাত্র নামধারী এই বাহিনী সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বর্তমান মেয়াদের চেয়ে কিছুটা কম থাকলেও তখনও তারা সারাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনকি বাইরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। সে সময় ছাত্রলীগের এক ক্যাডার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শততম ধর্ষণের উত্সব পালন করে।
শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির মূলমন্ত্র সামনে রেখে যে ছাত্রলীগের জন্ম—সে ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ড এখন শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির অন্তরায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের নিয়োগবাণিজ্যের খায়েশ পুরো না হওয়ায় তারা গাড়ি ভাংচুর এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে ক্ষতি করেছে তিন কোটি টাকার বেশি; কিন্তু মামলা হয়নি একটিও কিংবা গ্রেফতারও হয়নি কেউ। নিয়োগকেন্দ্রিক সমস্যার কারণে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে যে সময় হারিয়ে যাচ্ছে, তার দায়ভার কে নেবে? এ ব্যাপারে পুরোপুরি দায়ী ছাত্রলীগ এবং ভিসি-প্রোভিসিলীগ যারা—সবাই সরকারেরই মদতপুষ্ট। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক্তভোগী এসব ছাত্রছাত্রী বা তাদের অভিভাবকদের কী জবাব দেবেন? অন্যদিকে সম্প্রতি সন্ত্রাসের আশঙ্কায় দু’দিন ধরে বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। মামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি, নেতাকর্মীদের গ্রেফতারও করা হয়েছে পাইকারিভাবে। ভাবতে অবাক লাগে, এ কোন দেশে বাস করছি আমরা? পত্রিকায় প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ছবি ছাপা হয় এক দলের আর আসামি গ্রেফতার হয় অন্য দলের। গুলিবর্ষণের এই কাজটা যদি শিবির বা ছাত্রদল করত, তাহলে পুলিশের ভূমিকা কি একই ধরনের হতো? যারা গুলিবর্ষণ করল, তারা নাকি ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত ক্যাডার। তাহলে তাদের ক্ষমতার উত্স কোথায়? তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি (!) বলে তাদের জন্য খুন-খারাবি, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট সবকিছু জায়েজ? সাধারণ জনগণ সরকারের এ ধরনের নীরব ভূমিকা দেখে ভেবে নিতে পারে ছাত্রলীগ তাদের ওপর সরকার অর্পিত দায়িত্বই ইমানদারীর সঙ্গে পালন করছে মাত্র।
দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতার এই বরপুত্রদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত এবং জিম্মি। তাদের অপ্রতিরোধ্য কুকর্ম দেখে মনে হয়, গোটা দেশই তাদের হাতে জিম্মি। ক্ষমতাসীনদের হাতে দেশ জিম্মি, ছাত্রলীগের হাতে ভার্সিটি জিম্মি আর মন্ত্রীদের কাছে মন্ত্রণালয় জিম্মি। অন্যদিকে হলমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানের কাজে জিম্মি ব্যাংকিং খাত আর পুলিশের কাছে জিম্মি বিরোধী দলের কার্যালয়। কী চমত্কার গণতান্ত্রিক সুব্যবস্থা! এই কি তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দাবিদারদের আসল চেহারা? রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতেই ছাত্রলীগ আজ এত বেপরোয়া। আর পুলিশ যেন পানি হয়ে গেছে, যখন যে পাত্রে রাখা হয় তখন তার আকার ধারণ করবে। তাদের নিজেদের কোনো আকার বা সত্তা নেই। তারাও হয় অসহায়, নয়তোবা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সরকারের যে পুলিশ বাহিনীর বিকল্প নেই, তা বোধকরি পুলিশরাও ভালো করেই বুঝে গেছে।
এ সরকারের আমলে কোথাও কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে দাবি করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সাধারণ জনগণের তো এটাই চাওয়া ছিল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, রেলের ৭০ লাখ টাকা, হলমার্কসহ অন্যান্য দুর্নীতি যদি আমলে নাও আনি, তারপরও শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত সাড়ে তিন বছরে যে নজিরবিহীন নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা ধরনের দুর্নীতি হয়েছে— সেগুলোর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের ব্যাখ্যা কী তা আমরা সাধারণ জনগণ জানি না। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ আর সেই মেরুদণ্ড ভিসিলীগের ভিসিরা ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতায় শত শত অযোগ্য, অদক্ষ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে বাঁকা করে ফেলেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতীতে এর চেয়ে দুঃসময় আর কখনও আসেনি। নিশ্চয়ই ছাত্রলীগের এসব ক্যাডার একসময় আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতিতে আসবে। তখন দেশের অবস্থাটা কী হবে? সাধারণ জনগণের ছাত্র নামধারী এসব রাজনৈতিক সন্ত্রাসী, তারা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের বয়কট এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা উচিত। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের বেশিরভাগ নেতা, মন্ত্রী কিংবা আমলার ছেলেমেয়েরা এদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে না। তারা বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এদেশেরই অর্থে লেখাপড়া করে। সুতরাং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সন্ত্রাস, দুর্নীতি জিইয়ে রাখায় কিছু যায় আসে না। যত সর্বনাশ সব হবে আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষের। তাই তো দেশের এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্র খুন হয় কিংবা যত দুর্নীতি হয়, তার বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা বসে আছেন, তারা সব দেখেন তবু অন্ধ, সব শোনেন তবু বধির, সব বুঝেও তারা নির্বোধ। ক্ষমতা দুর্নীতি বাড়ায় আর একচ্ছত্র ক্ষমতা দুর্নীতির ভেতরে সারাদেশকে ডুবিয়ে দেয়। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন তাদের অসীম, একচ্ছত্র ও জবাবদিহিমুক্ত ক্ষমতার সুযোগে সারাদেশ আজ দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। তবু আমরা আশা করি, রাষ্ট্র এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, আমরা পাব একটি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক : ডিন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুল,
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা

মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গুণীদের কটাক্ষ করা উচিৎ নয়


কে  অতিকথনপ্রিয় সেটা সবারই জানা। তবে ইদানীং কারো কারো বেফাঁস কথা বলার মাত্রা বেড়েছে, যা ভদ্রতা, শালীনতা, রুচি, কাণ্ডজ্ঞান এমনকি, পদ-পদবিরও মান রক্ষা করা দায় হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশকে যিনি আসমান উচ্চতার মর্যাদায় বিশ্ব দরবারে পরিচিতি দিয়েছেন, সেই ক্ষুদ্রঋণের জনক নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক ড. ইউনূসকে অজানা কারণে যখন-তখন কটাক্ষ করা হয়। এমনকি ড. ইউনূসকে বহুবার ‘সুদখোর’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে এক দলীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশকে ঋণ না দেয়ার জন্য তিনি বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেছেন। আমি ওই ব্যক্তির নাম বলব না। কারণ সবাই তার নাম জানেন।’ নবম সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী ‘বসন্তের কোকিল’ বলে তামাশা করেছেন। দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান আইনজ্ঞ (ওয়ান-ইলেভেনে দুই নেত্রীর সাহসী আইনজীবী), সৎ-সজ্জন-দেশপ্রেমিক ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে নিউ ইয়র্কে বসে ব্যঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘মুই (আমি) কার খালুরে।’ গুণী ও সজ্জন ব্যক্তি সর্বজনশ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা টিভি টকশোর এক অনুষ্ঠানে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রয়াত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার ড. হুমায়ূন আহমদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই সরকারের যাকে যেখানে দেখবেন, তাকেই বলতে হবে তুই চোর, তুই ব্যাটা চোর।’ পরদিন প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে জনাব মূসা বিবৃতি দিয়ে তার টকশোর বক্তব্য থেকে অনেকটা সরে এসে বলেছিলেন, ‘এই সরকারের সবাই চোর না। যারা চুরির সাথে জড়িত, তারাই কেবল চোর। আমার বক্তব্যে কেউ যদি ব্যথা পেয়ে থাকেন, সে জন্য আমি দুঃখিত।’ তারপর বলা হলো তিনি চ্যানেল খোলার লাইসেন্সের জন্য এসেছিলেন। তিনি লাইসেন্স পাননি আর সে কারণে তিনি বলে বেড়াচ্ছেন সরকারের সবাই চোর। তাকে যদি লাইসেন্স দিতাম, তিনি টাকাটা কোথায় পেতেন? চুরি করতেন?! সম্প্রতি বলা হলো ‘আগে মধ্য রাতে যারা জাগত, তারা সিঁদ কাটার জন্য জাগত। এখন যারা মধ্য রাতে জাগেন তারা আমাদের গলা কাটতে চান।’ দেশের সুনামখ্যাত অর্থনীতিবিদ সাবেক সচিব ও উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানকে ইঙ্গিত করে বলা হলো, ‘কেউ কেউ এমনও আছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। তারাই আজ সরকারের সমালোচনা করেন…।’ রামুর ঘৃণিত ও ন্যক্কারজনক ঘটনায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে বিএনপির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ১২ অক্টোবর  বলা হলো, ‘এই নেতার ২০টি নামে ২০টি অ্যাকাউন্ট। ২০টি স্বাক্ষর তারই। এত বড় ফ্রড! অন্যের বাড়ি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে দিলো, আর আইনজীবী হিসেবে মরা মহিলাকে জীবিত করে ভাইয়ের নামে বাড়ি লিখিয়ে নিলো। যে লোক দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রাপ্ত তার রিপোর্ট বাংলাদেশের মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যÑ এটাই বড় প্রশ্ন।’ আরো বলা হলো ‘রামুর ঘটনা বিএনপির কাজ। রামুতে বিএনপির এমপি লুৎফর রহমান কাজলের উসকানিমূলক বক্তৃতা করার কারণেই এ ঘটনা ঘটে। আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যই বিএনপি এ ঘটনা ঘটায়।’
মূলত ইনিয়ে-বিনিয়ে মিথ্যাচার করা, অতিকথন ও অশালীন ভাষা প্রয়োগ, আত্ম-অহমিকা, পরশ্রীকাতরতা, একগুঁয়েমি, অসহিষ্ণুতা, অকৃতজ্ঞতা, মানী লোকের মান হরণ, যেনতেনভাবে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ীকরণের চেষ্টাই দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এখন প্রশ্ন ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন? তাকে কি বিশ্বদরবারে খাটো করা সম্ভব হয়েছে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজ হাতে ড. ইউনূসের গলায় সে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আপনার মতো বিশ্বের অসহায় গরিব মহিলাদের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ একজন মহান ব্যক্তিকে এ পুরস্কার দিতে পেরে আমরা গর্বিত।’ ক্ষুদ্রঋণের সফলতার জন্য নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৩টি দেশ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। ব্রিটেনসহ চারটি দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে চ্যান্সেলর মনোনীত করে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। আমেরিকা, আফ্রিকা, রাশিয়া, ভারতসহ মধ্য ইউরোপের বেশ ক’টি দেশ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ৯৫ লাখ গরিব নারী সদস্যের ৯৭ শতাংশ মালিকানার এ গ্রামীণ ব্যাংক আজ গোটা বিশ্বের দারিদ্র্যবিমোচনের আদর্শ মডেল। আর ‘পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলে ইউনূসের হাত রয়েছে’Ñ এমন বক্তব্যও কাণ্ডজ্ঞানহীন। পানি ঘোলা করে বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত মেনে নেয়ার পর বিশ্বব্যাংক ফিরতে শুরু করেছে। তাদের তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত প্যানেল বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করে গত ১৪ অক্টোবর থেকে দুদকের তদন্ত রিপোর্ট প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করলে কস্মিনকালেও তারা ফিরে আসত না। আসলে ড. ইউনূস কেন শান্তিতে নোবেল জয় করলেনÑ এটাই তার পাপ!
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেলে বন্দী ছিলেন। সেই সময় ড. কামাল হোসেনও পাকিস্তানে ছিলেন। (কেউ বলেন, ড. কামাল পাকিস্তানে শ্বশুরালয়ে ছিলেন, কেউ বলেন, তিনিও সেখানে আটক অবস্থায় ছিলেন) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মি. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, আপনাকে আর কিভাবে খুশি করতে পারি?’ জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমার সাথে ড. কামালকে বাংলাদেশে যেতে দিতে হবে।’ তার পর দু’জন একসাথে প্রথমে লন্ডন, সেখান থেকে ভারত এবং ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে সকাল ১০টায় ঢাকায় বিমান থেকে নেমে সরাসরি অপেক্ষমাণ বিশাল জনতার মধ্যে ফিরে এসে বিজয়মালা গলায় পরেন। সরকার গঠন করার পর তিনি ড. কামাল হোসেনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এমনকি ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার পুরোধা ছিলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি কিনা ‘বসন্তের কোকিল’Ñ দেশের প্রবীণ আইনজীবী, সদালাপী সজ্জন ব্যক্তি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘দেশের স্বার্থে, রাজনীতির স্বার্থে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিতে আমি প্রস্তুত। দায়িত্ব পেলে অবশ্যই নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করব।’ আর যায় কোথায়? ‘মুই কার খালুরে! তিনি কখনোই নিরপেক্ষ না। খালেদা জিয়াকে বহু অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আমাদের নেত্রী, আমার নেত্রী।’ অথচ তিনি চেয়েছিলেন সঙ্ঘাতময় রাজনীতিকে সমঝোতায় এনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সুষ্ঠু সমাধান। বিএনপি তাকে স্বাগত জানালেও প্রধানমন্ত্রী করেছেন তির্যক মন্তব্যে কুঠারাঘাত। ফলে তাকে আগে প্রতিদিন কোনো না কোনো চ্যানেলে দেশ, জাতি, রাজনীতি, আইনের শাসন, সঙ্কট সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে দেখা গেলেও ইদানীং তিনি লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে একদম নীরব হয়ে গেছেন।
বরেণ্য বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা ৬০ বছর ধরে সাংবাদিকতায় আছেন। পেশাগত দক্ষতা ছাড়াও রাজনীতির বাঁকে বাঁকে তার বিচরণ কয়েক দশকের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭০-এর নির্বাচনে মূসাকে ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানিয়েছিলেন। আবার স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব তাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘মূসা, আমাকে সাহায্য করো। তোমার টেলিভিশনের দায়িত্ব নিতে হবে।’ মূসা বললেন, ‘আমি তো প্রিন্ট মিডিয়ার লোক। টেলিভিশন বুঝি না।’ শেখ মুজিব বললেন, ‘আমাকে বুঝলেই চলবে।’ অথচ সেই মূসাই মুজিবকন্যার কাছে দেখা করে বারবার অনুরোধ জানানোর পরও বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পাননি। ‘লাইসেন্স দিলে তিনি এত টাকা কোথায় পেতেন? চুরি করতেন’Ñ সাংবাদিক মূসাকে ইঙ্গিত করে এমন নিষ্ঠুর মন্তব্য মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পেলে তার পরদিন মূসা সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে জানালেন, ‘আমি কোথায় টাকা পাবো, তা প্রধানমন্ত্রী জানতেন। কেননা, আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে বলেছিলাম, ল্যাব এইড গ্রুপ একটি টিভি চ্যানেল চালাতে আগ্রহী। যদি ’৭১-টিভি’ নাম এর লাইসেন্স পাই তবে ল্যাবএইড গ্রুপ আমাকে ১০ শতাংশ শেয়ার দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এ ব্যাপারে আমার সাথে একটি চুক্তিও হয়েছে তাদের। লাইসেন্স পাওয়ার পর চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজ শুরু হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী তার প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদকে বললেন, ‘উনার মাথা গরম হয়ে গেছে। আমাদের সাথে বিদেশে নিয়ে চলো। সমুদ্রের আবহাওয়ায় মনটা ভালো হবে।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘চলেন আমার সফরসঙ্গী হিসেবে। ফিরে এসে আপনার ব্যাপারটা দেখব।’ বিমানে প্রধানমন্ত্রীর পাশের চেয়ারে বসে অনেক গল্প করলেও আমি তাকে এ ব্যাপারে আর কিছু বলিনি। বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর অনেক চেষ্টা করলেও ’৭১ টেলিভিশন’ নামে চ্যানেলটির লাইসেন্স আমাকে দেয়া হয়নি। আমার দেয়ার নামের এই চ্যানেলটি কিছু দিন পর অন্য একজনকে দেয়া হয়…।’
সংবাদপত্রে এবিএম মূসার লেখা প্রকাশ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বা তার পক্ষে অন্য কেউ এর কোনো প্রতিবাদ করেননি। তাহলে? প্রধানমন্ত্রী মূসাকে কেন বললেন, ‘এত টাকা তিনি কোথায় পেতেন? চুরি করতেন?’
মধ্য রাতের টকশোতে যাওয়ার জন্য গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির লোকজন যেমন জেগে থাকেন তেমনি থাকেন সরকারের মন্ত্রী এমপিসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। সেই সাথে জাগেন অন্য দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। কারণ ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া টকশোগুলো প্রতিটি চ্যানেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এসব টকশোতে সাধারণ মানুষের মনের কথাই উঠে আসে। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, সরকারের ভুলত্রুটি ও বিরোধী দলের করণীয় কর্তব্য, ব্যর্থতা ও সমাজ সংস্কারের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। তা ছাড়া মধ্য রাতের টকশোতে যারা আসেন, তারা বিভিন্ন পেশার স্বনামখ্যাত মানুষ। তাদের সিঁদ কাটা চোরের সাথে তুলনা করা কোনোভাবেই মানায় না। দেশের মানুষের মানসম্মান তথা গুণী লোকের হেফাজত করা সরকার ও রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তব্য। আর সেখানে যদি গুণী ও সম্মানী লোকদের নিষ্ঠুর ও নির্যাতনমূলক ভাষায় আক্রমণ করা হয়, তাহলে নীতি-নৈতিকতায় ধস নামবে, এ কথা সহজেই অনুমেয়। তখন সরকার আর জনগণের সরকার থাকে না, সরকার হয় স্বৈরাচার। ভাববার বিষয়, আমরা তবে আছি কোথায়?
সাবেক জাঁদরেল কেবিনেট সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও সঠিক নয়। তখন ড. আকবর আলি খান একা পদত্যাগ করেননি। একসাথে তারা চারজন পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগের আগে উপদেষ্টা সি এম শফি সামি ও সুলতানা কামাল আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে পরামর্শ নিয়েছিলেন। আলোচ্য তিনজন ছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হাসান মশহুদ চৌধুরীও একই সাথে পদত্যাগ করেন। কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পদত্যাগ করেননি আরেক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম। ড. আকবর আলিসহ যারাই টকশোতে যান তারা তো কেবল দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন সংবাদের বিশ্লেষণ করেন। নিজে থেকে গল্প বানিয়ে তো তারা কিছু বলেন না। তাহলে এতটা টচলেন কেন? গণতন্ত্র বিকাশে পরমতসহিষ্ণুতা ও গঠনমূলক সমালোচনা যে কত জরুরি তা কি কারো অজানা?
শতাব্দীর ভয়াবহতম ন্যক্কারজনক রামুর ঘটনায় বিএনপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে প্রধান করে যে তদন্ত মিশন রামুতে পাঠায়, তার রিপোর্ট দলীয় প্রধান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে হস্তান্তর করার পর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু না বলে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয় ব্যারিস্টার মওদুদকে। এমতাবস্থায় ব্যারিস্টার মওদুদ গত ১৬ অক্টোবর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আমি কার কাছে ক্ষমা চেয়েছি, কার বাড়ি দখল করেছি, কোন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়েছি তা স্পষ্ট করে বলতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার নামেও ১৪টি দুর্নীতির মামলা হয়েছিলা; যা ক্ষমতায় এসে কারা তুলে নিয়েছেন… কেন এ অনাকাক্সিক্ষত কুৎসিত বিতর্ক?
প্রধানমন্ত্রী তো বটেই; একজন মন্ত্রী এমপি ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীকে অবশ্যই সততা, নীতি আদর্শ, শালীনতাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা সর্বোপরি কথা বলা ও চলাফেরায় নিজ পদবির ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি জন-আকাক্সক্ষার দিকটিও মাথায় রাখতে হয় প্রতি মুহূর্ত। আক্রান্ত মানসিকতা, অতিকথন, মিথ্যে অহমিকা, পরনিন্দা, পরচর্চা, অপ্রাসঙ্গিক বেশি কথা বলে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া, নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা, সর্বোপরি রাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে দেশের বরেণ্য গুণী লোকদের কটাক্ষ করার যে নৈতিক স্খলনজনিত গ্লানি, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
delwaribneyounus@gmail.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মন্ত্রীর সাথে বেয়াদবির শাস্তি



মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে চোখ। যার চোখ নেই তার কাছে দুনিয়া অন্ধকার। একই সাথে চোখ মানব শরীরের সৌন্দর্যের আধার। চোখ নিয়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে কবির যেমন আবেগী কবিতা আছে, তেমনি উপন্যাস-গল্পে নায়ক-নায়িকার চোখের বর্ণনা নানাভাবে এসেছে। বাংলা ভাষার কবি-লেখকেরা নানা ধরনের চোখের বর্ণনা দিয়েছেন; যেমনÑ মায়াবী চোখ, পটোলচেরা চোখ, হরিণ চোখ, অতলান্তিকের মতো নীল চোখ ইত্যাদি। প্রেম-ভালোবাসার সাথে যেমন চোখের বর্ণনা উঠে আসে, তেমনি এই চোখ কখনো মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। চোখ হয়ে উঠতে পারে মানুষের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
লেখক ও ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের একটি অসাধারণ গল্পের নাম চোখ। খেজুরকাঁটা দিয়ে এক চোরের চোখ তুলে নেয়ার ঘটনার বর্ণনাকে কেন্দ্র করে হুমায়ূন আহমেদ গল্পটি লিখেছেন। পালিয়ে বেড়ানোর কারণে চোর মতি মিয়ার সাথে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়েছে দীর্ঘ দিন। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর খোঁজ পান তিনি। স্ত্রী আছেন গ্রামের এক বাজারে। আড়তদার-ব্যাপারীদের মনোরঞ্জন এখন তার পেশা। তারপরও  স্ত্রীর প্রতি মতি মিয়ার ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই। গোপনে দেখা করার জন্য মতি মিয়া বাজারের পথে রওনা হন। আর সেখানেই দেখা দেয় বিপত্তি। এক ব্যক্তি চিনে ফেলে মতি মিয়াকে, ধরে নিয়ে আসে গ্রামে। মেম্বার-মাতবররা মিলে তার শাস্তি নির্ধারণ করেন চোখ তুলে নেয়ার। সেই শাস্তি কার্যকর হওয়ার আগে মতি মিয়াকে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয়।  এ অবস্থার মধ্যেও কিভাবে মনের জোর ঠিক রাখতে হয় তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। শেষ পর্যন্ত মতি মিয়ার চোখ তুলে নেয়া হয় কি না তা আর উল্লেখ করেননি হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু চোখ তুলে নেয়ার যে বীভৎসতা তার অনুভূতি ঠিকই পাঠক গল্পটি পড়ে অনুধাবন করতে পারবেন।
শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, আগের যুগের রাজরাজড়া অবাধ্য কর্মচারী বা বিদ্রোহী প্রজাদের চোখ তুলে নিতেন এমন অনেক বিবরণও পাওয়া যায়। কিন্তু সভ্য সমাজে চোখ তুলে নিয়ে কাউকে শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। যত বড় অপরাধই হোক, কারো অঙ্গহানি করে শাস্তি দেয়ার বিধান এখন সভ্য সমাজে আর গ্রহণযোগ্য নয়। শাস্তি এখন জেল-জরিমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি দুনিয়ার বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বিলোপ করার দাবি জানাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। ফাঁসির দাবি কিংবা ফাঁসি কার্যকরের পর উল্লাসের নানা খবরও এখন টেলিভিশনে প্রচার হয়। এ ধরনের নিষ্ঠুর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি মনে হয় আরো প্রকাশ্য রূপ পেতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত টকশোতে একজন মন্ত্রী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতার চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এই হুমকি দিয়েছেন বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়াকে। ঠিক হুমকি না বলে মন্ত্রীর শাস্তিও বলা যায়। কারণ মন্ত্রীর মতে এই নেতা তার সাথে বেয়াদবি করেছেন। রফিকুল ইসলাম মিয়াও মন্ত্রী ছিলেন। এখন সাবেক। তিনি একজন ব্যারিস্টারও বটে। আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে থাকেন। এখন তাকে অঙ্গহানি করে শাস্তি দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার কী অপরাধ? অবশ্যই অপরাধ আছে। অপরাধ ছাড়া তো কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে মন্ত্রী মহোদয় শাস্তি দেয়ার কথা বলতে পারেন না। মন্ত্রী মহোদয় যখন টেলিভিশনে তার সরকারের সাফল্য এবং বিগত সরকারের অপকর্মের বিবরণ দিচ্ছিলেন, তখন বিরোধী দলের নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া তার বক্তব্যে বাধা প্রদান করেন। একবার দুইবার নয়, বহুবার বাধা দেন। বর্তমান সরকারও অপকর্ম করছে বলে তিনি ফোড়ন কাটেন। অতীত নয় বর্তমানের কথা বলুন বলে মন্ত্রীর কথার পিঠে কথা চালিয়ে যান । এতে মন্ত্রীর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মন্ত্রীর মেজাজ বলে কথা। রফিকুল ইসলাম মিয়াও মন্ত্রী ছিলেন, তবে ২০ বছর আগে। এখনকার ডিজিটাল যুগের মন্ত্রীদের মেজাজ-মর্জির সাথে তিনি হয়তো অনেক দিন পরিচিত ছিলেন না। মন্ত্রী হুঙ্কার ছাড়েনÑ বেয়াদব। কিন্তু তাতেও থামেন না রফিকুল। তিনিও তো রাজনীতিক। টকশোতে এসেছেন কথা বলতেই। কথা তাকেও বলতে হবে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে উপস্থাপক অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য টেলিভিশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু কথা থামছে না। চেয়ার থেকে উঠে মন্ত্রী মহোদয় তেড়ে গেলেন প্রতিপক্ষ দলের নেতার দিকে। বললেন, তোমার চোখ তুলে ফেলব! তুমি আমাকে চেনো না? হারামজাদা, তুমি জানো না একজন মন্ত্রীর সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়? তোমাকে আজ জুতাপেটা করব। এবার থেমে গেলেন বিরোধী দলের নেতা। হয়তো ভয় পেয়েই চুপ হয়ে গেলেন। মন্ত্রী সফল। বিরোধী দলের একজন সামান্য নেতাই যদি মন্ত্রীকে ভয় না পান, তাহলে কিসের মন্ত্রী।  অনুষ্ঠানের অন্য অতিথি-আলোচকেরা এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও এবার তারাও চুপসে গেলেন (মানবজমিন ২৪ অক্টোবর, ২০১২) মন্ত্রীর উত্তেজনা কমার পর আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়। সবাই শান্তভাবে অনুষ্ঠান শেষ করেছেন। তবে শেষরক্ষা হয়েছে রফিকুল ইসলাম মিয়ার। তার চোখ রক্ষা পেয়েছে। মন্ত্রী তার চোখ তুলে নেয়ার শাস্তি বা হুমকি কার্যকর করেননি।
সংবাদপত্রগুলোতে কয়েকদিন ধরে এই চোখ তুলে নেয়ার হুমকির খবর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি সত্যিই এসব কথা বলেছিলেন কি না? মন্ত্রী অবশ্য শিশুর মতো সরলভাবে জবাব দিয়েছেন রাগের মাথায় কী বলেছি এখন আর মনে নেই। এরপর তিনি বলেছেন, রফিকুল ইসলাম মিয়ার অসদাচরণ সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কোনো স্বাভাবিক ভদ্রলোক এমন আচরণ করতে পারেন না। তিনি আরো বলেছেন, মানুষকে সম্মান দিতে না জানলে সম্মান পাওয়া যায় না (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫ অক্টোবর, ২০১২)খুবই সত্যি কথা। মন্ত্রীর সাথে বেয়াদবি করেছেন, অতএব তিনি তাকে সম্মান দেবেন কেন?
মন্ত্রী শাজাহান খান শুধু মন্ত্রী নন, একজন শ্রমিক নেতাও বটে। শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারে তিনি খুবই সোচ্চার। এ ক্ষেত্রেও তিনি খুবই সহজ সরল। গত বছর ২ জুন ও ১২ জুলাই দুই দফায় নৌমন্ত্রী ২৭ হাজার ৩৮০ জন অদক্ষ চালককে ভারি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার সুপারিশ করেন বিআরটিএর কাছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। কারণ অদক্ষ চালকদের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। এই লাইসেন্সের সুপারিশ করার সময় সাংবাদিক মিশুক মুনীর আর চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। স্বাভাবিকভাবে গণমাধ্যমে মন্ত্রীর এই সুপারিশের তীব্র সমালোচনা হয়। তখনো মন্ত্রীর মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানিয়ে দেন, এই ড্রাইভারদের পরীক্ষা জরুরি নয়। তারা রাস্তায় গরু-ছাগল চিনতে পারে কি না সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
যা হোক, আবার আমরা টকশোতে ফিরে আসি। চোখ তুলে নেয়ার এই হুমকি দেয়ার পর রফিকুল ইসলাম মিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি এখনো মন্ত্রী থাকেন কী করে? এটা অবশ্য অদ্ভুত প্রশ্নÑ এই সামান্য ঘটনায় একজন মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব চলে যাবে তা ভাবাই যায় না। তবে আমরা ধারণা করেছিলাম এই ব্যারিস্টার সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা হয়তো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের না হোক অন্তত থানায় একটি জিডি করবেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। হয়তো ভয়ে কিংবা থানা পুলিশ আর আদালতের অবস্থা বিবেচনা করে। কারণ থানায় মামলা দিতে গেলে উল্টো তার বিরুদ্ধে পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার মামলা হতে পারে। অবশ্য এই ঘটনায় একজন আইনজীবী নৌপরিবহন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। আদালতে দায়ের করা এই মামলার কোনো ভবিষ্যত আছে বলে মনে হয় না।
বিরোধী দলের এই নেতাকে হুমকি দেয়ার প্রতিবাদে তার দল ও সমর্থকেরা প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন করেছেন। নিরীহ এই কর্মসূচি পালন করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এ দলের নেতারা গুম হওয়ার পরও কিংবা দলশুদ্ধ প্রথম সারির নেতাদের লাইন ধরে জেলে পাঠানোর পরও এমন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। মানুষ গুম করার চেয়ে চোখ তুলে নেয়ার হুমকি তো আর বড় হতে পারে না।
যা হোক, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে আমাদের সামনে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো, ডিজিটাল যুগে একজন সফল মন্ত্রীর অন্যতম যোগ্যতা হচ্ছে বিরোধী দলের নেতার চোখ তুলে নেয়ার কলাকৌশল জানা। আর বিরোধী দলের নেতার সফলতা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত চোখ রক্ষা করা। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব ঘটনাস্থল ত্যাগ করা কিংবা আগেভাগেই এসব নেতাকে এড়িয়ে চলা। কারণ কোনো বিরোধীদলীয় নেতা যদি চোখ হারান, তাহলে তিনিও ভবিষ্যতে মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে চোখ হারানো বা অন্ধ কোনো ব্যক্তি কখনো মন্ত্রী হয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। আর যদি মন্ত্রী তাতে সফল হন, তাহলে সুপার ডিজিটাল যুগ অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী থাকতে পারবেন। আলোচিত এই টেলিভিশন টকশোতে আসলে মন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। মন্ত্রী দলের নেতাকর্মীদের কাছে তার আচরণের জন্য সাধুবাদ পেলেও দেশের মানুষ তার চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনের ব্যর্থতায় হতাশ হয়েছেন। আর বিরোধী দলের এই নেতা কোনোমতে চোখ রক্ষা করতে পারলেও মানববন্ধন করে যে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছেন, তাতে মানুষ তার সাহসিকতার অভাব দেখতে পাচ্ছে। এমন দুর্বল লোকেরা যদি দেশের মন্ত্রী হন, তাহলে দেশের অগ্রগতি আরো থেমে যেতে পারে। ডিজিটাল যুগের ভোটারদের এখন প্রধান কর্তব্য হচ্ছেÑ আগামী নির্বাচনে আরো সাহসী জনপ্রতিনিধি খুঁজে বের করা, যারা চোখ তুলে নেয়ার হুমকি না দিয়ে সাথে সাথেই চোখে আঙুল বসিয়ে দেবেন অথবা টকশোর মতো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে পকেটে খেজুরকাটা নিয়ে যাবেন।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন বন্ধ কর : আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ জরুরি



মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংস আক্রমণ চলছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের আক্রমণ ও বিতাড়ন একটি চরম মানবিক বিপর্যয়। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের লক্ষ্য যদি বাংলাদেশ হয়, তাও উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ বটে। সম্প্রতি আবার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশী অভিবাসী বলে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এদিকে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে নিষ্ঠুরভাবে বাধা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সমস্যায় পড়তে চান না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ অবস্থায় মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে এবং তাদের অন্যায়ভাবে বিতাড়ন বন্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসাই সমস্যা নিরসনের জন্য জরুরি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত সপ্তাহে শুরু হওয়া দাঙ্গায় অন্তত ৮৮ জন নিহত এবং ২৮ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়েছে বলে জাতিসংঘের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে। এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতিগত দাঙ্গায় ধ্বংসযজ্ঞের স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশের পর মিয়ানমার সরকারও সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
২৯ অক্টোবর মিয়ানমারে জাতিসংঘ দফতরের প্রধানও নিহত ও গৃহহীনদের প্রসঙ্গে বলেছেন, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেননা, সহিংস আক্রমণে উপকূলীয় এলাকার অনেক লোক নৌকাযোগে পালিয়ে গেছে, যাদের হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের সব গ্রাম ও শহরের কিছু অংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে। কিন্তু ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ : দাঙ্গাকারীদের সহায়তা করেছে মিয়ানমার পুলিশ, এমনকি তারা গুলিও ছুড়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে গত মে মাসে একজন বৌদ্ধ নারীকে কয়েকজন মুসলমান ধর্ষণ করেছে বলে পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে পড়লে জাতিগত দাঙ্গা বাধে এবং মারা যান ৯০ জন। সহিংসতা থামাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় রাখাইন রাজ্যে। এরপরেও নতুন করে দাঙ্গার কারণ কী?
বরাবরের মতো এবারও রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণ সব হারিয়ে বাংলাদেশের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। হাজার হাজার নির্যাতিত ক্ষুধার্ত মানুষ ভাসছে নদীতে, সমুদ্রে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।
এই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি যে কোনো বিবেচনায় মিয়ানমারের সৃষ্ট। এজন্য সমস্যা মেটানোর দায় তাদেরই নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী নয়। কেননা, রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন কিছু নয়। এই সমস্যার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর কী মন্দ প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কেও মিয়ানমার সরকার অবহিত। তারপরও দফায় দফায় জাতিগত দাঙ্গার শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কেন—এর জবাব মিয়ানমার সরকারই ভালো জানে। সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনা সমর্থিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এই জাতিগত দাঙ্গাজনিত সমস্যার একটি ভয়াবহ সমাধানের কথা জানিয়েছেন। তার ভাষায়, রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার থেকে বিতাড়ন’ এর সমাধান। এ থেকে স্পষ্টতই আঁচ করা যায় যে, রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষেই উগ্র বর্ণবাদী আচরণের কবলে পড়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিয়ানমারের এক সময়ের আরাকান রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত তারা সে দেশের নাগরিক ছিল। অথচ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করছে। এই অস্বীকৃতি ইতিহাসের বিচারে যেমন তেমনি আধুনিক আইনের দৃষ্টিতেও স্ববিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষজাত। সম্প্রদায়বিশেষের ওপর এভাবে দফায় দফায় মানবিক বিপর্যয় চাপিয়ে দিয়ে সে দেশের সরকার যে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের অভিসম্পাত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দাই কুড়াচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
যে কোনো বিচারেই রোহিঙ্গা বিতাড়নের কারণ হচ্ছে জাতিগত বৈরিতার ফলাফল। এর সমাধান বস্তুত মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। তবে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকেও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, রোহিঙ্গা সমস্যার স্বরূপ তুলে ধরতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের কেন বাংলাদেশী অভিবাসী বলছে, কেন এমন প্রচারণা চালাচ্ছে—তার বিরুদ্ধেও বাংলাদেশকে নিতে হবে কঠোর অবস্থান।
আমরা মনে করি রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের বেদনার্ত ঘটনা। আগুনে ভস্মীভূত জনপদের পর জনপদে গণহত্যার শিক্ষার শত শত নিরাপরাধ মানুষের লাশ ফেলে রেখে বিশ্ববাসী উদাসীন থাকতে পারেন না। এর দ্রুত সমাধান জরুরি। মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাবে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থেকেই বেরিয়ে আসবে এ সমস্যার সমাধান। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের বর্তমান হৃদয়হীন শাসকরাও হয়তো তখন তাকে স্বাগত জানাবে
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ঠিকানার জন্য রিমান্ড এবং বিপর্যস্ত গণতন্ত্র



মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
খবরটি পড়ে একে সরকারের অসহিষ্ণু নীতি ও কূটকৌশলের বহিঃপ্রকাশ বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এমন আরেকটি নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। সোয়া দুই বছর আগে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তার অফিস থেকে গ্রেফতার করার বিরুদ্ধে পত্রিকাটির কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীরা তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানান। তাদের এ প্রতিক্রিয়াকে সরকারি কাজে পুলিশকে বাধা দেয়া হয়েছে বলে অভিহিত করে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ৪০০ সাংবাদিক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করা হয়। গত তিন বছর ১০ মাসে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগসহ প্রায় আট হাজার মামলা তুলে নেয়া হলেও এ মামলাটি এখনও ঝুলে আছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খুনের আসামি হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছে। শত শত খুনি অবৈধ অস্ত্রধারী চারদিকে কিলবিল করছে। এদের কারও কারও হাতে পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তা চড়-থাপ্পড় খেয়েছেন। পাবনার ডিসিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই সরকারি দলের ক্যাডার-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু তাদের দেখে পুলিশ সালাম দেয়। তারা খুন করেও মাফ পেয়ে যায়। দুর্নীতির কারণে পদত্যাগ করেও ‘দেশপ্রেমিক’ খেতাবে ভূষিত হয়। কারণ তারা সরকারের বরকন্দাজ।
অন্যদিকের দৈনিক আমার দেশ-এর সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে ভিন্নমতাবলম্বী। এদের কোণঠাসা ও অকেজো করতে হবে, এদের মুখ তথা দৈনিক আমার দেশ কৌশলে বন্ধ করতে হবে। তাই আজগুবি অজুহাত। ৪০০ সাংবাদিক-কর্মচারীর সঠিক ঠিকানা সংগ্রহের জন্য জামিন বাতিল করে তাদের রিমান্ডে নিতে হবে। কেমন জঘন্য যুক্তি? রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য ৩৪ আসামির কাউকেই রিমান্ডে নেয়া হয়নি। পাকিস্তান আমলে আমার মতো হাজার হাজার ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একাধিকবার কারারুদ্ধ করা হয়, কিন্তু কাউকেই রিমান্ড নামক টর্চার সেলে নেয়া হয়নি। জিজ্ঞেস করা হয়নি—কেন কিংবা কার প্ররোচনায় তুমি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগিয়েছিলে।
এখন স্বাধীন দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ছুতা-নাতা অজুহাতে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার-অপমান করা হয়, তাদের ‘সোজা’ (?) করতে। সে পন্থার অংশ হিসেবে সোয়া দুই বছর আগে দায়ের করা মামলায় জামিনপ্রাপ্তদের জামিন বাতিল করে তাদের আবার রিমান্ডে নেয়ার অজুহাতে আবার খোঁয়াড়ে ঢোকাতে হবে। ওই অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে কী ধরনের বাধা দেয়া হয়েছে, কীভাবে বাধা দিয়েছে, তাদের হাতে কোনো অস্ত্র কিংবা লাঠিসোটা ছিল কিনা? ওই বাধায় কোনো পুলিশ আহত হয়েছিল কিনা, বাধা দেয়া হলে মাহমুদুর রহমান কীভাবে গ্রেফতার হয়েছিলেন? যদি তাদের কর্মকাণ্ড বেআইনিই হয়ে থাকে, তবে তাদের সঙ্গে সঙ্গে কেন গ্রেফতার করা হয়নি, কিংবা আদালত জামিন দেয়ার সময় কেন তাদের রিমান্ড চাওয়া হয়নি। এ ধরনের অজুহাতে রিমান্ডের দাবি অহেতুক বলেই আদালত তাদের রিমান্ডে দেয়নি।
দ্বিতীয়ত, ৪০০ সাংবাদিক তথা আসামিদের নাম-ঠিকানা জানার জন্য তাদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন আজগুবি চক্রান্ত। আড়াই বছর পরে তাদের নাম-ঠিকানার কেন প্রয়োজন হলো? যদি একান্তই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে কি তাদের সঠিক ঠিকানা প্রদানের জন্য কখনোই তাগিদ দেয়া হয়েছিল? তারা কি তেমন তাগিদে সাড়া দেননি? দৈনিক আমার দেশ কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলেই তো ঠিকানা পাওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ তেমনটি করেছে বলে মনে হয় না। যদি করেও থাকে তথাপি তাদের রিমান্ডে নেয়ার কোনো যুক্তি নেই। পুলিশ বিষয়টি আদালতের গোচরে এনে আদালতের মাধ্যমেই তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারত। এ তিনটি বিকল্পের কোনোটাই না করে পুলিশ কর্তৃক তাদের জামিন বাতিল করার আবেদন জানানোকে নিছক চক্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বললে অত্যুক্তি হবে না।
শেখ হাসিনা সরকারের মানবতাবিরোধী দমননীতির কূটকৌশল সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন, এমন তথ্যাভিজ্ঞমহল মনে করে, রিমান্ডের আবরণে জামিন বাতিল করা গেলে তাদের প্রসঙ্গে অজানা ও সাজানো অভিযোগ এনে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের করা হতে পারে, কিংবা বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক রাখা হবে এবং তাদের অনেককেই আগামী নির্বাচনের আগে আর ছাড়া নাও হতে পারে। উদ্দেশ্য হলো দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাকে অচল করে দেয়া, যাতে সরকারের ব্যর্থতা ও গণবিরোধী কার্যক্রম জনগণের সামনে তুলে ধরার সামান্যতম সুযোগও না থাকে।
পুলিশ বিভাগসহ সর্বত্র দলীয় বিবেচনায় দলীয় ক্যাডার-কর্মীদের নিয়োগ দিয়েও শেখ হাসিনা সরকার পরবর্তী নির্বাচনে যে ক্ষমতায় ফিরে আসবে, তা নিশ্চিত হতে পারছে না। বিরোধী দলকে পুলিশি হামলা ও সাজানো মামলার পর মামলা দিয়ে কোণঠাসা করা গেলেও দৈনিক আমার দেশকে সেভাবে দমানো যাচ্ছে না। মাহমুদুর রহমানকে দীর্ঘদিন জেলে রেখে এবং নির্যাতন চালানোর পরেও তিনি আরও নির্ভীক ও সোচ্চার হচ্ছেন দেখে সরকার উদ্বিগ্ন। সরকারের এখান থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। শুধু মাহমুদুর রহমান কেন, পৃথিবীতে যুগে যুগে যারা অকারণে নির্যাতিত হয়েছেন, যারা সত্যের জন্য দেশের জন্য লড়েছেন, তারা কখনোই নির্যাতনের মুখে সত্যকথন থেকে পিছপা হননি। আর বাংলাদেশের মানুষ যে হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে গণবিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করেছে, তেমন হাজার হাজার নজির রয়েছে। সরকার সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে, দেশে সবাইকে কথা বলার লেখার মত প্রকাশের সুযোগ দেবে—সে প্রত্যাশিত পথকে সঙ্কুুচিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে সরকার দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে।
আরও উদ্বেগজনক খবর হলো দৈনিক আমার দেশ-এর বাউফল সংবাদদাতা জলিলুর রহমানকে লাঞ্ছিত করেছে বাউফল উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হারুন অর রশিদ। জলিলুর রহমানের অপরাধ, ২৩ অক্টোবর রাতে পটুয়াখালীর বাউফলে সর্বজনীন কালীমন্দিরে প্রদত্ত ভাষণে জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় হুইপ আ স ম ফিরোজ এমপি সাংবাদিকদের ‘কুলাঙ্গার’, ‘মোনাফেক’ ও ‘বেইমান’ বলে ধিকৃত করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, জলিলুর রহমানের পাঠানো সে খবর ২৫ অক্টোবর (২০১২) দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত হয়। এ খবর প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে আ স ম ফিরোজ এমপির সতীর্থ হারুন অর রশিদ ও তার সঙ্গীরা ওই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেয়ারও হুমকি দেয়। এ ঘটনা বাউফল থানার সামনেই ঘটে। কিন্তু পুলিশবাহিনী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই গ্রেফতার করেনি, কিংবা মামলাও দায়ের করেনি। যদিও অতি তত্পর ও দক্ষ পুলিশ ঠিকানা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় কথিত বাধা দেয়ার অভিযোগে ৪০০ সাংবাদিককে রিমান্ডে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। কারণ পুলিশ সরকারের একান্ত সেবক—জনগণের নয় এবং পুলিশ সরকারের অ্যাজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে, তাই তাদের এমন পরস্পরবিরোধী দ্বিমুখী আচরণ।
সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিডিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য মন্ত্রীদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, মিডিয়া মন্ত্রীদের ব্যাপারে কোনো অসত্য খবর প্রচার বা প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দেবেন। সুতরাং দৈনিক আমার দেশ-এর বাউফল সংবাদদাতা মিথ্যা কিংবা অতিরঞ্জিত খবর দিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা করাই ছিল আইনগত ব্যবস্থা, তাকে লাঞ্ছিত করা নয়। কিন্তু মামলা দেয়া হয়নি, কারণ ফিরোজ এমপি যথার্থ এ ধরনের মন্তব্য করেছেন, যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবর যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা কিন্তু শেখ হাসিনা বলেননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন মন্তব্য এবং তার সরকারের কর্মকাণ্ড এমন ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে মু্ক্তচিন্তা তথা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ তথা অধিকার দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের একহাত দেখিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, বরং সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের কুপোকাত করতে নানা ধরনের গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী অপকৌশল অবলম্বন করছেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে টিভি চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয়া হয় দৈনিক আমার দেশ। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে অপমান-নির্যাতন করা হয়। ১০ মাস কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়। আর ওই মামলার হাজিরা দেয়ার জন্য তাকে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করা হয়। বন্ধ করা হয় শীর্ষ কাগজ ও শীর্ষ নিউজকে। আটক করা হয় এর সম্পাদক একরামূল হককে। কারারুদ্ধ করা হয় দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক আবুল আসাদকে। ডিবি অফিসে গোয়েন্দাদের সামনে হাজির করা হয় একই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নুরুল আমিনকে। আদালতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ডেইলি নিউএজ-এর সম্পাদক নুরুল কবিরকে, কলামিস্ট আসাফ উদ-দৌলা ও আবুল মকসুদকে। তিন বছর ১০ মাসে প্রাণ দিতে হয় ১৭ সাংবাদিককে।
অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য ‘তথাকথিত সম্প্রচার আইন ১৯১১’ নামক খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, ১৯১৪ সালে আবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার তা বাস্তবায়ন করার অভিলাষ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ স্পষ্ট করে বলেছেন, তারা বাকশালী আদর্শ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাকশালী আদর্শ মানে একদলীয় একব্যক্তির শাসন। দেশে অঘোষিতভাবে এক ব্যক্তির শাসনই চলছে। সরকারি নীতির প্রতি সদয়শীল নন, এমন পত্র-পত্রিকা তো বটেই, ভিন্ন মতাবলম্বী হিসেবে পরিচিত কাউকেই সহ্য করা হবে না। এ নীতি অনুসারে সরকারি নিয়ন্ত্রণে সীমিতসংখ্যক পত্রিকা থাকবে। সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব ক্ষেত্র দলীয় ক্যাডারে সয়লাব হয়ে যাবে। ক্যাডারদের ব্যবহার করে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোণঠাসা তথা নির্মূল করা হবে। পুলিশি কাজে বাধার অভিযোগে সোয়া দুই বছর আগে দায়ের করা দৈনিক আমার দেশ-এর চারশ’ সাংবাদিক-কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে উদ্দেশ্যমূলক মামলার আসামিদের জামিন বাতিল করে তাদের সঠিক ঠিকানা সংগ্রহের জন্য রিমান্ডে নেয়ার পুলিশের আবেদন একত্ববাদী শাসনের অশনি সংকেতের আরেকটি নজির।
সরকারের যেসব নীতিনির্ধারক বিভিন্ন অজুহাতে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ড নামক নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে অপমানিত করছেন, তারা অবশ্যই জানেন, তত্কালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহ আগরতলা মামলার কোনো আসামিকেই রিমান্ডে নেয়া হয়নি। আজকে স্বাধীন দেশে আমাদের সরকার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যেসব জঘন্য পন্থা অবলম্বন করছে, তা কেবল মরহুম সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিনীয় যুগকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিন্নমতাবলম্বীদের উচ্ছেদকল্পে তাদের গ্রেফতার, অভ্যন্তরীণ অন্তরীণ, পাগল চিকিত্সা কেন্দ্রে আটক, কিংবা সাইবেরিয়ার শীতলতম স্থানে পাঠিয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে অন্যদের ভীতির মধ্যে রাখত। এদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি সোভিয়েট ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পুরোধা আঁদ্রে শাখারভের মতো পদার্থবিজ্ঞানী, সলজেনিিসনের মতো লেখকসহ হাজার হাজার সরকারবিরোধীরা নির্যাতনের শিকার হন।
এ নির্যাতনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে হেলসিংকি ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী সদস্য হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবাধিকার বাস্তবায়ন দাবি জানানোর অপরাধে সোভিয়েত ইউনিয়নে হেলসিংকি গ্রুপের ১১ প্রতিষ্ঠাতা এবং তাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে যোগদানকারী আরও দশ সদস্য চরম নির্যাতনের শিকার হন।
সোভিয়েত একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও নিপীড়ন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের গণমানুষের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও দাবি হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ দাবিতে পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষ বারবার রাস্তায় নেমেছে। কারাবরণ করেছে। জীবন দিয়েছে। সর্বোপরি, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙে না এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয় না, যদি পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিত। ওইটাই ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে একমাত্র মুক্ত ও অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতেই মানুষ তাত্ক্ষণিক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এ কারণেই গণআন্দোলন শুরু হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তান ভাঙা তথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে। অর্থাত্ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এদেশের মানুষ তাদের বাবা-দাদাদের প্রতিষ্ঠিত দেশ পাকিস্তান ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, ৩০ লাখ মানুষ তাদের জীবন উত্সর্গ করেন।
গণতন্ত্রের বাইরে কোনো কৌশল আমাদের দেশে প্রযোজ্য নয়। আজকে দেশে সরকার যা করছে, তা পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্রের হোতা আইউবি শাসনকেও হার মানিয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের এমন বিকট চেহারা বিশ্বের কোথাও এর আগে দেখা যায়নি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেই যে একটি সরকার গণতান্ত্রিক হয় না, শেখ হাসিনার চেয়ে সারা বিশ্বের অন্য কোনো সরকার এমন উত্তমভাবে তা প্রমাণ করতে পারেনি। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এর অবসান হওয়া উচিত।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক
noa@agni.com
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

শেখ হাসিনার রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং বিরোধী দলের ভূমিকা



অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে ২০০৮ সালের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আসীন হয়ে প্রায় চার বছর পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে আনীত ১৪টি মামলা হয়েছিল দুর্নীতি/অর্থ কেলেঙ্কারির। বিরোধী দলের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, হাসিনা ক্ষমতায় গিয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছেন অন্যথায় নির্ঘাত তার ১০৮ বছরের জেল হতো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা। শেখ হাসিনা তার বিগত রাজক্ষমতায় রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ হয়েছেন। অর্থনীতির ফাঁক-ফোকর তিনি খুঁজে পেয়েছেন। এবার ক্ষমতায় এসে সেই পথটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এগিয়ে গেছেন। তার দলের সোনার বান্দাদের অর্থ আত্মসাত্জনিত যাতে মামলা না হয় তার জন্য কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিষয়ে ইনডেমনিটি বিল পার্লামেন্টে পাস করিয়েছেন। কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিরুদ্ধে জনগণ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না সত্য, কিন্তু মানুষের মনের ক্ষোভ কি শান্ত করতে তিনি পারবেন। কোটি কোটি টাকার অর্থ আত্মসােক এভাবে বৈধ করার জুটি আর কেউ কি আছে?
জননেত্রীর সোনার ছেলেদের ব্যাংক লুটের ঘটনা পরিকল্পিত। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে হলমার্কের কতিপয় ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সোনালী ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে জননেত্রীর দলীয় সন্তানদের পরিচালক বানিয়ে ব্যাংক লুটের ব্যবস্থা করা হলো। বলির পাঁঠা হলো অশিক্ষিত তানভীর মাহমুদ। নাটের গুরুরা সটকে পড়তে চেয়েছে। এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের সহায়তা দেবেন, অন্যথায় বেমক্কা সব ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ হলো, তার তদন্ত হলো, কিন্তু দোষীদের ধরা হলো না? কী কৈফিয়ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবাঙালিদের শিল্প-কলকারখানা রাষ্টায়ত্ত করার নামে আওয়ামী সোনার ছেলেরা লুটপাট করেছিল। ধ্বংস করে দিয়েছিল বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থাপনা।
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত বাবু একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। এক সময় তিনি হাওর-বাঁওড়ের একজন পাকা ব্যবসায়ী ছিলেন। সেজন্য তাকে স্থানীয়ভাবে বলা হতো কৈবর্ত ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ জাতে কুলীন এবং কৈবর্ত জাতে নমশূদ্র। চর্চাপদে একটা ধারা ‘নগর বাহিরে ডম্বি তোহারি কুড়িয়া, ছোঁছো জায়সি ব্রাহ্মই নাড়িয়া।’ এটি বাংলা ভাষার আদিরূপ। অর্থ হলো—নগরের বাহিরে ডোমনির কুঁড়েঘর, নেড়ে বামুন তার ঘরের পাশে ঘুরঘুর করে। রাজনীতিতে আওয়ামী দলের অচ্ছুত থেকে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। শেষমেশ অর্থ কেলেঙ্কারিতে পড়ে একেবারে নাজেহাল। প্রধানমন্ত্রী কেন তাকে সাহায্য করছেন না বুঝলাম না। তার সঙ্গে কি বাবুর যোগাযোগ হয়নি। ‘ব্ল্যাক ক্যাট’ হয়েই কি তিনি নির্বাসনে যাবেন! তবে সুরঞ্জিত বাবুর একটি আত্মপ্রসাদ হচ্ছে আওয়ামী দলসহ একসঙ্গে বিসর্জন হতে যাচ্ছে আগামীতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব দুদক প্রধান গোলাম রহমান একজন প্রভুভক্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি বিশ্বব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সরকারের দু’জন মন্ত্রী ও মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিত্বকে নিখুঁত ব্যক্তি বলে ঘোষণা দিলেন। কোনো দুর্নীতি ঘটেনি সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। কিন্তু যখন দুর্নীতির কারণে তাদের পদচ্যুতি ঘটে, তখন সেবা দাসের ভূমিকা গ্রহণ করে বলেন, আন্তর্জাতিক তদন্ত হলে দুদক তাতে সহায়তা করবে এবং তা হবে বাংলাদেশের জন্য গৌরব। এ ধরনের অথর্ব কমিশন ব্যক্তি কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে? সরকারপ্রধান সুরঞ্জিত বাবুকে, আবুল হোসেন ও অন্য অপরাধী ব্যক্তিদের বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন; কিন্তু দেশের মানুষ বিষয়গুলো ভেবেছেন—তবে কি প্রধানমন্ত্রীও এদের সঙ্গে একই কাজের শরিক?
সত্য কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক জগতের অতুজ্জ্বল নক্ষত্র মাহমুদুর রহমানকে ৬০টির অধিক মামলায় জড়িত করা হলো। মাহামান্য সুপ্রিমকোর্ট তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাস জেল ও ২০০০ টাকা অর্থদণ্ডের পরিবর্তে ছয় মাস জেল এবং ১,০০,০০০ টাকা অর্থদণ্ডের এবং অর্থদণ্ড জমা না দিলে আরও এক মাস জেলের রায় দিলেন। রায় ঘোষণা হলো সত্য, কিন্তু দীর্ঘ সাত মাস রায় আদালতের নথিতে এসে পৌঁছল না।
বাংলাদেশের অপর প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার ওপর বিশ্লেষণ করে রায় দিলেন. কিন্তু দীর্ঘ ১৩ মাস অতিক্রান্ত হলো। তিনি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। দু’বার রায় লিখলেন। পরে যখন রায় আদালতে এসে পৌঁছল, তার ১১ মাস আগেই হাসিনা সরকার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অবসান ঘটালেন। বিচার ব্যবস্থার এই ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রবাহে দেশের বিচার ব্যবস্থার এক কলঙ্কজনক অধ্যায় যেমন সূচিত হলো, তেমনি রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
রাজশাহীতে মার্ডার কেসের ১ নম্বর আসামিকে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে মামলা প্রত্যাহার আদেশ দিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি বানানো হলো প্রধানমন্ত্রীর নেপথ্য ইশারায়। থার্ড ডিভিশন পাস করা নিম্নমানের আইনজীবীদের কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ জাতির জন্য কলঙ্কজনক ঘটনা। ফলে বিচার বিভাগের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বারবার। দলীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে সেসব বিচাপতির বাইরে আসার যোগ্যতা নেই। অর্থ কেলেঙ্কারি, মানিলন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত করে যখন বিচারপতিদের সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার পরও সরকার ও বিচার বিভাগ নিশ্চুপ থাকে, তখন স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ওপর দেশবাসীর কি আস্থা থাকে? মাহমুদুর রহমান ও অলিউল্লাহ নোমানের সাংবাদিকতা তখন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়। ভিয়েতনামের হো চি মিন সাংবাদিকতায় এক সময় সাড়া জাগিয়েছিলেন। রুমানিয়ার ভার্জিল তানাসের দুঃসাহসিকতা, পলি লুন্দ্রর সাংবাদিকতার সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের নাম বিশ্বে সমাদৃত হবে। দেশের দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যখন গণতন্ত্র বিপন্ন হয় তখন সাহসিকতার সঙ্গে দেশপ্রেমিকদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তাতে দুঃখকষ্ট জীবনকে অতিষ্ঠ করলেও দেশের জন্য কণ্ঠ উচ্চকিত করার সময় এসেছে।
বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার একটি জঘন্যতম মানসিকতা হাসিনার মধ্যে লক্ষণীয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীসহ বাংলাদেশের জামায়াত ও শিবিরের নেতাদের আসামি করা, রিমান্ড লওয়ার তাণ্ডবতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমি একজন আইনজীবী হিসেবে ঘটনাপরম্পরা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করা, প্রশাসনকে সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ রাখা, পুলিশ বিভাগের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণজনিত বিষয়গুলো অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও দুঃখজনক। এরূপ অবস্থা সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সরকারি দলের লোক, ছাত্র-যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চর দখল, জমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে চলে গেলে এবং দলীয় প্রধানের তাদের অপরাধের প্রতি সমর্থনজনিত কারণে দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। দেশের মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। কিন্তু কীভাবে? দেশের বিরোধী দলের নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রধানত এর জন্য দায়ী। জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রচণ্ড জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি জেলা শহরে অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে এমনকি কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় বিরোধী রাজনীতি জনগণের প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ। রাজধানী শহরে বিরোধী দল পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কেন? সত্ লোকের অন্তর্ভুক্তি দলে ঘটছে না কেন? দলীয় কোন্দল এখন প্রকাশ্যে বিদ্যমান। ভাবটা যেন এমন, আওয়ামী দল ব্যর্থ অতএব জনগণের বিকল্প কিছু নেই। বিএনপি ক্ষমতায় এলো বলে? রাজনীতি কি এতই সহজ। দলের মধ্যে অন্তর্কলহ ও বিভেদ থাকায় দল মানুষের ঈপ্সিত আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ।
আওয়ামী দলের প্রধান শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে মামলা দিয়ে কেবল ক্ষান্ত নয়, পুলিশ দিয়ে গুম, খুন ও হত্যার কাজ করানো হচ্ছে। বিচারকরা অসহায়ের মতো রিমান্ড প্রার্থনা মঞ্জুর করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে একটি সত্য হলেও প্রতিবাদী কণ্ঠ হওয়ার জন্য রাজনীতিবিদকে ভূমিকা নিতে হবে। এ ব্যাপারে বিএনপি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
দেশের বিবেকবান ব্যক্তিরা সরকারের বিরুদ্ধে টোলভিশনে কথা বলছেন, সাংবাদিকরা তাদের অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন; কিন্তু বিরোধী দলের ভূমিকা নগণ্য। যদি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন না করে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে কি বিরোধী দল তা প্রতিহত করতে পারবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিরোধী দলের সে ক্ষমতা বর্তমানে নেই। যারা ক্ষমতার প্রত্যাশী হয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছেন, তাদের কি দেশপ্রেমিক আখ্যা দেয়া যায়? একথা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী দুঃশাসনে মানুষ বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত। দেশের অর্থনীতি দিন দিন পরাশ্রিত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্ বিলের যাঁতাকলে মানুষ নিষ্পেষিত। কৃষকদের দেখার কেউ নেই। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, সারের দাম আকাশচুম্বী। ভেজাল সার, ভেজাল বীজ সরবরাহ করে কৃষককে আওয়ামী সরকার ধ্বংস করছে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা নেই। বিরোধী দলের কথন হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী সরকার যাবে, বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসবে। আবার তারা যাবে, আওয়ামী দল আবার আসবে। কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকবে, সুশাসন থাকবে, অকল্যাণ দূরীভূত হবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। দেশে খুন-গুম হবে না। নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কাম্য।
লেখক : সাবেক সভাপতি, রাজশাহী আইনজীবী সমিতি

সোমবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১২

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় ইতিবাচক ভূমিকা চাই

মিয়ানমারে গণহত্যা
মিয়ানমারে জাতিগত সঙ্ঘাত এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। জুন মাসে রাখাইন প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে যে নির্মূল অভিযান শুরু করেছিল, তা সম্প্রতি আরো ব্যাপক রূপ নিয়েছে। কয়েকটি অঞ্চলে এখনো প্রকাশ্যে মুসলমান গণহত্যা চলছে। নতুন করে শুরু হওয়া এই জাতিগত নির্মূল অভিযানে শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। ঘরছাড়া হয়েছেন ২২ হাজার মানুষ। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নৌকায় করে মানুষ সমুদ্রে পালিয়ে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। শত শত রোহিঙ্গা আত্মরক্ষার জন্য বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৪২টি নৌকায় প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার জন্য তিন দিন ধরে সমুদ্রে ভাসছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তাও স্বীকার করেছে, পরিস্থিতি ভয়াবহ। অনেক মানুষ জঙ্গল, দ্বীপ বা পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অহিংস বলে দাবিদার সংখ্যাগরিষ্ঠ এই মানুষ সহিংস আচরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। যেখানে মানুষ হত্যা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রদেশটিতে সব মিলিয়ে গৃহহারা মানুষের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো মহলের মতে এ সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।
জাতিগত নির্মূল অভিযানের শিকার এই অসহায় মানুষদের জন্য আন্তর্জাতিক মহল চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড ও উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ বা মানবিক সাহায্য দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ওআইসি। মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা জাতিসঙ্ঘকে দিয়ে দেশটির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের মতো সক্ষমতাও দেখাতে পারেনি সংস্থাটি। মুসলিম দেশগুলো সম্মিলিতভাবে কোনো পদক্ষেপও নিতে পারেনি। মিয়ানমার আসিয়ানভুক্ত দেশ। দেশটিকে আসিয়ানের সদস্য করতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। অথচ জাতিগত নির্মূল অভিযান বন্ধে আসিয়ান বা অন্য কোনো ফোরামে এই দেশ দু’টি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
পশ্চিমা দেশগুলোও মিয়ানমারে জাতিগত নির্মূল অভিযান বন্ধে কার্যত নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। দেশটির সাথে জ্বালানি ও সামরিক সহযোগিতা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো এখন ব্যস্ত। সামরিক সরকারের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপারে তারা এখন চোখ বন্ধ করে আছে। অথচ এর চেয়েও সামান্য ঘটনায় এরা পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানে অনেক বেশি তৎপর ছিল এবং অল্প দিনের মধ্যে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। অথচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যখন বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা হচ্ছে, তখন তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এসব দেশ মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার দাবি করছে, যা মিয়ানমার সরকারের কৌশলের পরিপূরক।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানাই। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ এসব অসহায় গণহত্যার শিকার নারী-শিশুদের সীমিত আকারে আশ্রয় দেয়া যায় কি না তা সরকার ভেবে দেখতে পারে। একই সাথে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে সোচ্চার হবে বলে আমরা আশা করি। এই সময়ে প্রয়োজন এ গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় ইতিবাচক ভূমিকা।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মুক্তিযুদ্ধে জনগণের প্রত্যাশা ও আজকের বাংলাদেশ



মাহমুদ জামাল কাদেরী
১৯৭১ সালে যারা জীবনবাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের চোখে ছিল এমন এক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন যেখানে কোনো মানুষকে মানবেতর জীবন কাটাতে হবে না। নিজ নিজ কাজের বিনিময়ে সবাই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিত্সা ও ভবিষ্যত্ জীবনের নিশ্চয়তা লাভ করবে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এই স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে মুষ্টিমেয় পাকিস্তানপন্থী ছাড়া আপামর দেশবাসীর মনেও। সে কারণেই সব বিপদ তুচ্ছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতে পিছপা হয়নি কেউ। এজন্য অবশ্য অনেককেই চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আমরা বিপুল সংখ্যক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মতো তাদের আত্মদানও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের ৪১ বছর পর দেশের আজকের অবস্থা আর যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পূরণের কথা বলে না। এই দীর্ঘ সময়কালে দেশের উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মিল নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো আজও অপূর্ণই রয়ে গেছে। জনসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও সে তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে কয়েক কোটি যুবক বেকার। অনেকেই নানা ধরনের অমানবিক কাজ করে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছে। উন্নত জীবনের খোঁজে যারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসার যুক্তি খুঁজে পায় না। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি ক্রমেই বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে। দফায় দফায় জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। যাতায়াত ভাড়া, বাড়িভাড়াসহ জীবনযাত্রার ব্যয়ভার সাধারণ মানুষের সহ্যক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। এসবের পেছনে সরকারের ব্যর্থতা আর ক্ষমতাশালীদের দুর্নীতি, লুটপাট, সিন্ডিকেটবাজি এখন আর কারও কাছে গোপন নেই। শেয়ারবাজার লুট, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, ডেসটিনি-হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো প্রতিটি ঘটনাই যে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার অপব্যবহার আর লুটেরা মনোবৃত্তির ফল সেটাও সবার জানা কথা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ গুম-খুনের নিত্যঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতি প্রকট করে তুলেছে।
এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পর বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৬ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড সবাইকে চমকে দিয়েছিল। একসঙ্গে এতজন সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও উদঘাটিত হয়নি। তবে এর পেছনে দেশি-বিদেশি জাতীয় স্বার্থবিরোধী অপশক্তির হাত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। বিডিআর জওয়ানদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করা এবং ঐতিহ্যবাহী বিডিআরকে ধ্বংসের ফলে কারা লাভবান হয়েছে সেটা না বললেও চলে। সীমান্তে নিত্যদিন বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও দেশের মান-মর্যাদা কীভাবে ক্ষুণ্ন করছে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের মৃত্যু যেন সরকার মেনে নিয়েছে। কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের (৭ জানুয়ারি, ২০১১) পরও কারও টনক নড়েনি। এ বছর অতীতের রেকর্ড ভেঙে গত নয় মাসে ৪৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। ভারতবিরোধী রাজনৈতিক ইস্যু না করে সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ ধরনের উদ্যোগ না নিয়ে সরকার নিজেকেই অকার্যকর প্রমাণ করেছে। একইভাবে নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধির কথা বলে জনমত উপেক্ষা করে শুধু নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) বিভক্ত করা হলেও দেখা যাচ্ছে এখন সবকিছুই ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থাই মানুষের বসবাসের নিরিখে বিশ্বের জঘন্যতম নগরীতে পরিণত করেছে আমাদের রাজধানী ঢাকাকে। এ থেকে পরিত্রাণের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও চোখে পড়ে না। নিজেদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে বিভক্ত ডিসিসি নির্বাচন স্থগিত করে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণই জোরদার করা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি নগরবাসীর ওপর ট্যাক্সের বোঝাও বাড়ানো হয়েছে। জনগুরুত্বসম্পন্ন কোনো সমস্যা সমাধানেই সরকারের আগ্রহ দেখা যায় না। এমনকি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই, বিচারের নামে প্রহসন দেখতে চাই না।
দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও এখন গণতন্ত্র অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার রক্ষায় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। বাস্তবসম্মত রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চার অভাবে রাজনৈতিক দলগুলো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বড় দলগুলোর পারিবারিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের জমিদারতন্ত্র কায়েম করেছে। সুযোগ পেয়ে সামরিক-বেসামরিক আমলারাই দেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে বসেছে। এর ফলে সময়ে সময়ে সরকার পরিবর্তন হলেও জাতীয় ক্ষেত্রে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানসিকতা এখন জাতীয় নির্বাচন নিয়েও গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এক মহাদুর্যোগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া দেশটি কেন এমন অন্ধকারে ডুবে গেল?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে। একথা সত্য যে মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলীয় বিষয় ছিল না। ছিল জনগণের যুদ্ধ। দলমত নির্বিশেষে আপামর জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধজয়ের পর দেখা গেল পাকিস্তান সরকারের স্থলে বাংলাদেশ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলেও রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, সব ব্যবস্থাই অপরিবর্তিত রয়ে গেল। এমনকি একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগে যারা দখলদার প্রশাসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে তারাই স্বাধীন দেশটির প্রশাসনে বহাল রইল। রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বত্রই এমনটি দেখা গেছে। পাকিস্তান ফেরতরাও অতি সহজে পুনর্বহাল হয়ে গেল। অথচ যারা জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনল তাদের পুনর্বাসনে বা দেশসেবার সুযোগ দিতে কার্যকর কিছুই করা হলো না। দলবাজি এবং সার্টিফিকেট বাণিজ্যের পাশাপাশি চাকরিজীবী ও শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলেও রণাঙ্গনের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেলে দেয়া হলো পুরনো জীবনেই। দেশটাই চলে গেল পুরনো পথে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাও পদদলিত হয়ে গেল শুরুতেই। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি কোথায়ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হলো না। সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও নেয়া হয়নি গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলমতের প্রতিনিধিত্ব অস্বীকার করে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের স্থলে গঠন করা হলো পাকিস্তানি কাঠামোয় নির্বাচিত দলীয় সরকার। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রেও ভিন্নমতের যৌক্তিকতা গ্রাহ্য করা হয়নি। এভাবে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অমর্যাদা, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সমাজের পুরনো ঔপনিবেশিক ধারা অক্ষুণ্ন থাকার বিষময় ফল আজকের বাংলাদেশ।
সংবিধানে যা-ই লেখা থাক না কেন, এর রচয়িতারাই সর্বপ্রথম এর মূলে কুঠারাঘাত করে নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় বাকশালী শাসন এবং নির্বাচন ছাড়া রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধির নজিরবিহীন ঘটনাই এর প্রমাণ। স্বেচ্ছাচারিতার এই ধারাবাহিকতা পরবর্তী শাসকরাও ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে। ফলে এখন সংবিধানই কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণে সংবিধানের ব্যর্থতা এখন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারও যে পুরোপুরিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হয়ে গেছে তার একটা প্রমাণ উল্লেখ করা যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে আমরা যখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন সেদেশের সরকার আমাদের আশ্রয় ও সহায়তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে স্থানীয় অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। সময়ে সময়ে তারা সেনাবাহিনীর ধাওয়া খেয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তেমনিভাবে আশ্রয় নেয়া আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বর্তমান সরকার গ্রেফতার করেছে, ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এখন এরকমই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে বলে আমরা জেনেছি। সরকারের এমন ভূমিকা নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। এভাবে সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই কলঙ্কিত করছে না, দেশকেও ঠেলে দিচ্ছে নতুন বিপদের মুখে। রামুর সাম্প্রতিক ঘটনা থেকেও একই সিদ্ধান্তে আসতে হয়। অসাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারী বর্তমান সরকারের দেশ শাসনের প্রায় চার বছরের মাথায় এমন সাম্প্রদায়িক নাশকতার ঘটনা মোটেই স্বাভাবিক নয়। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা এই নাশকতায় ইন্ধন জুগিয়েছে এমন চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন বিষয়টি নিয়ে যে কাদা ছোড়াছুড়ি ও মিথ্যাচার শুরু হয়েছে সেটি প্রকৃত ঘটনাকে আড়ালে ঠেলে দিচ্ছে। নষ্ট রাজনীতি ও নেতৃত্ব এভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়ে কায়েমী স্বার্থ রক্ষায় তত্পর।
দেশের বিদ্যমান এসব সঙ্কট কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হলে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মতো নিঃশঙ্কচিত্তে দেশ ও জনগণের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে। গ্রহণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি পুনর্গঠিত করার পরিকল্পিত পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। তবে এটা যে প্রচলিত নেতৃত্বের কাজ নয় সেটাও পরিষ্কার। একমাত্র গণভিত্তিক নেতৃত্বের পক্ষেই গণতান্ত্রিক পন্থায় এই পরিবর্তনের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
কারণ মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের যে স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে একাত্তরে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে এখনও সে স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। এ যাবত কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল এমন পদক্ষেপ নেয়নি যা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আশাবাদী করে তোলে। প্রভাবশালী নেতানেত্রী, সামরিক-বেসামরিক আমলা-কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ সমাজের ওপরতলার লোকজনই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। ফলে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য কমে আসার পরিবর্তে বহুগুণে বেড়ে গেছে। সমাজ-অর্থনীতির ভিত্তি আশানুরূপ শক্ত ও টেকসই হয়নি। আশপাশের দেশগুলো যখন দ্রুত এগিয়ে গেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়েও তখন আমরা পিছিয়ে পড়েছি। হতাশা-বিভক্তি-বিশৃঙ্খলায় ডুবে আছি। এ রকম একটা দেশ আমরা চাইনি। এমন অবস্থা কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাই মেনে নিতে পারে না। তাই আবারও হৃদয়ের বিশালতা দিয়ে সমগ্র জাতিকে ধারণ করে উঠে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে উঠেছে। নতুন প্রজন্মের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা তুলে ধরতে হবে। সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার নতুন সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে শামিল হতে চাই আমরা। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণের পক্ষের সবার সহযোগিতা কামনা করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক
ভাইস চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা গণপরিষদ

Ads