বুধবার, ২৯ আগস্ট, ২০১২

যে দেশের মানুষ অশান্তি শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়


 অশান্তি কি? মিথ্যা কি? অসততা কি? জানে না সে দেশের মানুষ। অপরাধ অরাজকতা যেখানে অকল্পনীয়। এমন দেশও আছে পৃথিবীতে? পাহাড়-পর্বত আর সবুজ বনানী ঘেরা ৩৮ হাজার
বর্গমাইলের সে এক দেশ। যেখানে পথে পথে আপেল আঙুর আর কমলার বাগান। হিমালয়ের শীতল জলধারা সেখানে আলো দেয়। দেয় স্নিগ্ধতা। দেয় সুশীতল বায়ু। যেখানে নাগরিকদের ছুটোছুটি নেই। নেই অস্থিরতা। মহামতি বুদ্ধ যাদের টপ হিলে বসে খেয়াল রাখছেন সবকিছু। সাত লাখ মানুষের বাস। বাংলাদেশের পাশেই সে দেশ। ভুটান। পুরোনাম কিংডম অব ভুটান। প্রাচীন নাম দ্রুক ইয়ল। ইংরেজিতে বলে ‘দ্য ল্যান্ড অব থান্ডার ড্রাগন’। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে ড্রাগনের পাখায় ভর করে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিচ্ছে সেই দেশ। যেখানের শতভাগ মানুষই সুখী। প্রাচীন মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ভুটানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জাতিগতভাবে তারা কতটা সুখী তার ওপর। দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ, নাগরিকদের জাতীয় সুখ, পরিবেশ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এক অনন্য দেশের মর্যাদায় টিকে আছে দ্রুক ইয়ল। জাতীয় শুমারি জরিপে সে দেশের নাগরিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা কি সুখী? ৯৭ ভাগ নাগরিক এক কথায় জবাব দিয়েছেন, সুখী। জরিপে মোট প্রশ্ন সংখ্যা ছিল ৩০০। তার বেশির ভাগই ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে। মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের উত্তর ছিল অস্পষ্ট। আর তা নিয়েই ভুটান রাজার যত দুশ্চিন্তা। কেন এই তিন ভাগ নাগরিক সুখী নন। তারই উত্তর খোঁজা হচ্ছে দেশটির ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস কমিশন’-এর মাধ্যমে। জরিপে দেখা যায়, ভুটানের তিরিশ ভাগ মানুষেরই দৈনিক উপার্জন এক ডলারের বেশি নয়। অথচ তারা সুখী। কারণ, এরা বিশ্বাস করে অর্থ কাউকে সুখী করতে পারে না। ভুটানের সরকারি করপোরেশন প্রকাশিত পত্রিকা কুয়েনশেলের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাইয়ের প্রথম ১৫ দিনে পুরো ভুটানে পুলিশের নথিভুক্ত অপরাধ হয়েছে মাত্র ১৪টি। পুরো মাসে হয়েছে ৫১টি। এই চিত্রটিও সেখানে অস্বাভাবিক। এতে কোন বয়সীরা জড়িত, কেন এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা নিয়ে দেশটিতে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
পেছনে ফিরে তাকালে আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। চারদিনের ভুটান সফরে জাতীয় সুখ যেভাবে জাতীয় প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করে তা জানার চেষ্টা করেছি। দর্শনীয় স্থানসমূহে, রাজধানীর সিটি সেন্টারে একাধিক স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের এই সুখ তত্ত্ব। বর্তমানে পঞ্চম রাজার শাসন চলছে। ক্ষমতায় আছেন জিগমে খেসাড় নামগেল ওয়াংচুক। সমপ্রতি তার অভিষেক হয়েছে। ২৫ হাজার ভুটানের উপস্থিতিতে নতুন রাজা ঘোষণা করেন, আমি পিতার মতোই রক্ষা করবো, ভাইয়ের মতো যত্ন নেবো এবং সন্তানের মতো সেবা করবো। আমি আজন্ম সেবা বিলিয়ে দেবো, বিনিময়ে নেবো না কিছুই। নিঃশর্ত এই সেবা বিলিয়ে দিতেই আমি আপনাদের রাজার দায়িত্ব নিয়েছি। নতুন রানী জেটসান পেমাকে নিয়ে সুখেই দিনাতিপাত করছেন ২৬ বছর বয়সের অক্সফোর্ডে পড়ুয়া এ রাজা। পূর্ববতী তৃতীয় ও চতুর্থ রাজার রেখে যাওয়া তত্ত্বের ঝাণ্ডা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস তত্ত্বের উদগাতা প্রয়াত দ্রুক ইয়ল্পো জিগমে দর্জি ওয়াংচুক। তিনি তৃতীয় রাজা। বর্তমান রাজার পিতামহ ও পূর্বতন রাজা জিগমে সিগমে ওয়াংচুকের পিতা। সত্তরের দশকে তৃতীয় রাজা দর্জি ওয়াংচুক এই তত্ত্ব প্রথম জনগণকে জানান। জাতিসংঘের অধিবেশনে ১৯৭১ সালে দেয়া ভাষণেও তিনি এ বিষয়টির উল্লেখ করেন। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। হয়েছে অনেক হাসি-তামাশাও। দুনিয়ার বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদগণ ভুটান রাজার এই বক্তব্য নিয়ে তর্ক করেছেন। খোদ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা জাতীয় প্রবৃদ্ধির মানদণ্ড নির্ণয়ে জাতীয় সুখকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ায় প্রশ্নও তুলেছিল। কিন্তু প্রয়াত এই রাজা ছিলেন একাট্টা। তার জাতিকে তিনি এক অনন্য দর্শন উপহার দিয়েছেন, যা তাকে দিয়েছে বিশ্ব দরবারে অমরত্ব। প্রয়াত পিতা জীবদ্দশায় এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন না দেখে গেলেও পুত্র চতুর্থ রাজা জিগমে সিগমে ওয়াংচুক পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় এর বাস্তবায়ন করেছেন। ১৯৭২ সালে ক্ষমতায় এসেই অভিষেক গ্রহণের দিনই ঘোষণা দিয়েছেন এটাই ভুটানের মূল রাষ্ট্রীয় নীতি। জাতীয় উৎপাদন নয়, জাতীয় সুখই হবে আমাদের মূল নীতি। তিনি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, কোন ব্যক্তি কতটা ধনী তা দিয়ে সুখ নির্ধারিত হতে পারে না। প্রচুর ধনসম্পদ সবসময় সুখ বয়ে আনে না। বরং অন্তর্গতভাবে প্রতিটি নাগরিক কি পরিমাণ সুখী তা দিয়ে জাতীয় সুখ নির্ধারণ করা যায়। ওয়াংচুক নীতি বাস্তবায়নে করলেন কমিশনও। নাম দিলেন গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস কমিশন। চারটি মূল নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এই কমিশন। সমতার ভিত্তিতে আর্থ-সমাজিক উন্নয়ন, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনা সংরক্ষণ এবং প্রচার, পরিবেশ রক্ষা, সৌজন্যবোধ-বিনয়-সঙ্গতিপূর্ণ জীবনধারা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এই চার নীতি বাস্তবায়নে রাজা ছুটেছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ভুটানের জাতীয় ভিত্তিকে সামগ্রিক সুখের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। চার দশক আগেও যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন তারাই আজ তার প্রচার-প্রসারে এগিয়ে এসেছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় অনেক দেশ এই তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার শিক্ষা নিচ্ছেন। যে দেশের শিল্প বলতে কিছু নেই, যাদের অর্থনীতির মৌল ভিত্তি বেশির ভাগই ভারত নির্ভর। তাতেও সে দেশের নাগরিকদের সুখের কমতি নেই। তীব্র নিয়মানুবর্তী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় নাগরিক মাত্রেই সচেতন। জাতীয় পোশাক পুরুষদের গো ও নারীদের কিড়া পরিধান বাধ্যতামূলক। না করলে সাড়ে সাত রুপি জরিমানা। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা যে কোন প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পোশাক পরাই রীতি। পরিবেশ রক্ষায় কঠোর আইন রয়েছে ভুটানে। দেশটির ৬০ ভাগ ঘন বৃক্ষে ছেয়ে আছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে হইচইয়ের বাইরে যায়নি ভুটান সরকার। গ্রিন হাউজ এফেক্ট থেকে দেশ রক্ষায় সপ্তাহে একদিন করে ভুটানের সব শহরেই গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। কথা থাকে, সে সময় বেড়াতে আসা পর্যটকদের দুর্ভোগে পড়তে হবে কিনা। না, ভুটান সরকার এ বিষয়েও সচেতন। একটি নির্দিষ্ট নম্বরের গাড়ি সেদিন চলাচলের জন্য সীমিত সংখ্যায় অনুমতি দেয়া আছে। জ্বালানি নির্গমনে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তাই এ ব্যবস্থা। বিস্তীর্ণ পাহাড়ে অসংখ্য পাম গাছ দাঁড়িয়ে আছে শ’ শ’ বছর ধরে। গাছ কাটায় রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। নাগরিকদের গৃহনির্মাণ ও অন্য কোন প্রয়োজনে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনের যৌক্তিকতা বিবেচিত হলেই গাছ কাটা যাবে না। সেখানে আইনের লোকজনের উপস্থিতিতে তবেই গাছ কাটা যাবে। তামাক বিক্রয় ও সেবন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিমান পথে পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার আগেই লিখে জানাতে হয়, তিনি কোন গাছ অথবা গাছের বীজ বহন করছেন কিনা? কারণ, ভুটান থেকে যে কোন ধরনের গাছ বা বীজ বাইরে নেয়ায় রয়েছে নিষিধাজ্ঞা। পর্যটক নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে নানা বিধি-নিষেধ। ভুটানে অবাধে পর্যটক প্রবেশ বন্ধে সার্কভুক্ত দেশসমূহের বাইরের পর্যটকদের জন্য রয়েছে ট্যারিফ। একেক দিন ভুটানে অবস্থানের জন্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ দুনিয়ার তাবৎ পর্যটকদের ২০০ ডলার করে দিতে হয়। অবাধে পর্যটকরা ভুটানে এলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই এই সংরক্ষণ নীতি। তাছাড়া বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থানগুলো ভ্রমণে নিতে হয় বিশেষ অনুমতি। পর্যটক আকর্ষণে নেই অবাধে নাচ-গানের ব্যবস্থা। হিমালয় কন্যা নেপালে যেমনটি রয়েছে। সেখানের রীতিই সুরিয়া অস্ত, নেপাল মস্ত। কিন্তু ভুটান একেবারেই ভিন্ন। নিজস্বতায় বিশ্বাসী অনন্য এক জাতি। দুনিয়ার সর্বত্র ভারতীয় ছবি দর্শক মাতালেও ভুটান একেবারেই ভিন্ন। স্থানীয়রা সিনেমা হলে কোন ভারতীয় ছবি দেখে না। কেবল বিশেষ কোনও প্রদর্শনী বা দিবসে এর ব্যতিক্রম ঘটে। কোন শহরেই ভারতীয় ছবির পোস্টার বা সিডি বিক্রয় হচ্ছে- তেমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়েনি। নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি নিয়েই তারা সগৌরবে এগিয়ে চলেছে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads