রবিবার, ৫ আগস্ট, ২০১২

রাহুগ্রস্ত বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিকার সরকার



রাহুগ্রাসের আবর্তে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সৃষ্ট অস্থিরতা ও সঙ্কট কাটছে না। ভিসিদের দলবাজি, দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, নৈরাজ্য এবং সরকারের নীরব ভূমিকায় অশান্ত ক্যাম্পাস। একের পর এক অচল ও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সূত্রমতে, ঈদুল ফিতরের পর বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্কট ও অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ধূমায়িত হচ্ছে। ঈদের ছুটির পর তা তীব্রতা পেয়ে কঠোর আন্দোলন, এমনকি সহিংসাতায় রূপ নিতে পারে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববদ্যালয় গ্র্যান্টস কমিশন (ইউজিসি) এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সঙ্কট ও সমস্যা নিরসনে সরকারেরও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না; বরং সমস্যা জিইয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষাবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দখলবাজ ক্ষমতাসীনদের রাহুগ্রাসে। ভিসিদের দলবাজি ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা, সঙ্কট, অচলাবস্থা এবং একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
রাহুগ্রাসে বিশ্ববিদ্যালয়, অস্থিরতা-সঙ্কট কাটছে না : শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতে, দেশের সবক’টি অর্থাত্ ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই ক্ষমতাসীনের দখলে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই একে একে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম দলবাজ প্রশাসনে বসিয়েছে। নির্বাচনে জয়ের রাতেই ছাত্রলীগ ও মহাজোটের অন্য শরিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে রামরাজত্ব কায়েম করে। চর দখলের মতো হল দখল, অব্যাহত সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী- সাংবাদিক নির্যাতন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ এহেন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করছে না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারারসহ প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রশাসনের সব শীর্ষ পদ ক্ষমতাসীনদের দখলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষক সমিতি, ডিন, সিন্ডিকেট, সিনেট নির্বাচনে জয় বাগিয়ে নিতে দলীয় পরিচয় ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক ফান্ড থেকে অর্থ তছরুপ করেও নিচ্ছেন শীর্ষ কর্তারা।
সাম্প্রতিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসির একাধিক পর্যাবেক্ষণ বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা ও সঙ্কট নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছে। তাতেও ভিসিদের গদি রক্ষা, ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ-বাটোয়ারা, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বেচ্ছাচারী স্টাইলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসের বিষয়টি উঠে এসেছে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা ও সঙ্কটে শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও গোয়েন্দা সূত্রমতে, ঈদুল ফিতরের পরে বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগরের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। গত বৃহস্পতিবার ইউজিসির পর্যালোচনা বৈঠকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সৃষ্ট শিক্ষা সঙ্কটের ব্যাপার এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা ও সঙ্কট চলছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। বুয়েটের ইতিহাসে নজিরবিহীন সব ঘটনা ও সঙ্কট চলে আসছে পাঁচ মাস ধরে। এ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে ভিসি ও প্রোভিসির বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের অপসারণ দাবি নিয়ে। ৫ মাস ধরে তীব্র আন্দোলন করে আসছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর কাছেও শিক্ষক সমিতি একাধিকবার অপসারণ দাবি করেছে, কিন্তু সরকার নির্বিকার। শিক্ষকদের অভিযোগ—ভিসি, প্রোভিসির গদি রক্ষায় সরকার ব্যস্ত; নিচ্ছে না কৌশল। আন্দোলন ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তারপরও আন্দোলন ঠেকাতে না পারায়, কৌশলে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া বয়েছেও বলেন অভিযোগ শিক্ষকদের। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদের পর অপসারণ দাবিতে পরবর্তী করণীয় চিন্তা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আদালতের রায়ের কারণে আমরা চলমান আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছি। কিন্তু আমাদের দাবি থেকে সরে যাইনি। আদালতের রায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মনে করি না যে, আমাদের আন্দোলন অগণতান্ত্রিক ছিল। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার—কিন্তু আদালত আমাদের আন্দোলনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ওই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে ইউজিসি সূত্র জানায়, ইউজিসি বুয়েটসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটি ৯ আগস্ট বুয়েট পরিদর্শন, আন্দোলনরত শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্কটাপন্ন অবস্থার নতুন মোড় নিচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে আগের ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরকে সরানোর পরও সঙ্কট দূর হয়নি। কারণ হিসেবে শিক্ষকরা মনে করেন, প্রশাসনের অন্যান্য পদে সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ মনোনীত ব্যক্তিরাই অধিষ্ঠিত রয়েছেন—যাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাত্, প্রশাসনিক কাজে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তাদের অপতত্পরতার কারণেই ডিন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, অধ্যাপক শরীফ গঠিত ভিসি লীগের কর্মীরা ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালিয়ে ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য করেছে। ওই ঘটনায় পরবর্তী আন্দোলন ঠেকাতে ২০০ ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। ঈদের পরে ক্যাম্পাসে এ নিয়ে আবারও নানা সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে ক্যাম্পাসে সর্বদলীয় শিক্ষকদের মোর্চা সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ গতকালও এক বিবৃতিতে ক্যাম্পাসের সার্বিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ছাত্র আহত হয়েছে, পুলিশ গুলি চালিয়েছে, সাধারণ ছাত্রদের যেখানে সেখানে নির্বিচারে পিটিয়েছে এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের সহকর্মীদের বাসা আক্রান্ত হয়েছে—যা এর আগে কখনোই ঘটেনি। ডিন-নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীদের প্রতি আপনাদের বিপুল সমর্থনের সম্ভাবনাই এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার অন্যতম কারণ হতে পারে। এ ঘটনা সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ প্রশাসনের কাছে সামগ্রিক ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি, অবিলম্বে ডিন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ও অপরাপর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার দায় স্বীকার, সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলাকারী নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিচার এবং বিপুলসংখ্যক ছাত্রকে অভিযুক্ত করে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার দাবি করেছে। সম্মিলিত শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেন জানান, তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলে ঈদের পর আবারও প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিরও সার্বিক অবস্থা এখন পর্যাবেক্ষণ করছে ইউজিসি। ঈদুল ফিতরের আগেই তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শন করবে। চলমান অস্থিরতা নিয়ে প্রশাসন এবং শিক্ষকদের সঙ্গে তারা বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
ডাকসু, ভিসি প্যানেল, শিক্ষক সমিতি, ডিন, সিনেট নির্বাচন, ক্যাম্পাসে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের প্রবেশসহ ইস্যুগুলোতে ঈদের পর অস্থিরতা ও উত্তপ্ত হতে পারে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয় ভূমিকায় কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠন। শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ প্লাটফর্মে তারা প্রায় এক বছর ধরে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এরই মধ্যে তারা গণস্বাক্ষর অভিযান, মানববন্ধন, প্রচারপত্র বিলি, অবস্থান ধর্মঘট ও ভিসি অভিযোগ ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। তবে এসবে কোনো কর্ণপাত করছে না প্রশাসন। বিষয়টিকে অবশ্য ভিসি অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক ক্যাম্পাস পরিস্থিতি অশান্ত করতে বাইরে থেকে ইন্দন চালানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন।
অন্যদিকে গোয়েন্দাও ডাকসু নির্বাচনের দাবিকে বাইরের ইন্ধন হিসেবে মনে করে। তবে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের মুখপাত্র নূর বাহাদুর প্রশাসনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বরং উল্টো অভিযোগ এনে বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে মূলত প্রশাসনের কোনো সদিচ্ছা নেই। তারা এখন আদালতের দোহাই দিচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো দোহাই দিয়ে লাভ হবে না, ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের চিন্তা করছি আমরা।
অন্যদিকে এক রিটের প্রেক্ষিতে ডাকসু নির্বাচন কেন দেয়া হবে না তা প্রশাসনের কাছে জানতে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। জানা গেছে এর জবাব দিতে এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে ভিসি বিগত সাড়ে ৩ বছর স্বেচ্ছাচারী কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করায় খোদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদেরও বিরাগভাজন হয়েছেন। তারই কারণে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাবেক অধ্যাপক হারন অর রশিদ এবং অধ্যাপক মীজানুর রহমানকে যথাক্রমে প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। অভিজ্ঞ শিক্ষক ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো মনে করছে, প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষকদের এখনও টানাপড়েন চলছে। তার প্রভাব পড়বে সামনে শিক্ষক সমিতি, ডিন ও সিনেট নির্বাচনে। আর ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন, ক্যাম্পাসে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের প্রবেশসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ঈদের পর অস্থিরতা ও উত্তপ্ত হতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাছাড়া ভিসি প্যানেল নির্বাচন ও ডাকসু নির্বাচন এবং চলমান মামলা নিয়েও প্রশাসন চাপে রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও ঈদের পর আন্দোলন দানা বাধতে পারে। প্রশাসনের সঙ্গে সরকারপন্থী ও বিরোধী মতাদর্শের শিক্ষকের সঙ্গে রয়েছে চরম বিরোধ। সরকারপন্থী বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রশাসনের চলছে এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই। ভিসি নিজের ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করার জন্য একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধিভুক্ত ইনস্টিটিউটে পরিণত করেছেন। এর ফলে ডিগ্রি পাস ব্যক্তিরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বনে গেছেন। এছাড়া নিজের শ্যালিকা, আরেক ছেলেকে অ্যাডহক ভিত্তিতে কর্মকর্তা বানিয়েছেন। বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ শিক্ষকরা এসবের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে হুমকিও উচ্চারণ করেছেন, ভিসি স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি বন্ধ না করলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভয়াবহ আন্দোলন শুরু হবে।
অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকরাও নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্ছার হচ্ছে। উভয়পক্ষই ঈদের পর বিভিন্ন কর্মসূচি দিতে পারে। এদিকে ক্যাম্পাস সূত্র মনে করছে, ঈদের পর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ জুলাই এক ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনায় এখনও চাপা উত্তেজনা রয়েছে। ক্যাস্পাস সূত্র জানায়, ঈদের পর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে। ক্যাম্পাসে এখনও শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে। তা ঠেকাতে মরিয়া থাকবে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষ লেগে যেতে পারে।
অন্যদিকে ভিসির দলীয়করণ, নিয়োগবাণিজ্য ও স্বৈরাচারী আচরণের জন্য প্রতিষ্ঠানে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা মাঠে থাকবেন।
এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চরম স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। গত সাড়ে তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বেশকিছু সহিংস ঘটনা ঘটলেও তাতে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি তিনি। সূত্র জানায়, ঈদের ছুটির পর এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির ছাত্রলীগ নিয়ে ‘ফাও খাওয়া’ সংক্রান্ত কটূক্তি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতি, ছাত্রছাত্রীদের সেশনজটসহ নানা কারণে আন্দোলন দানা বাধার সম্ভাবনা রয়েছে। সমস্যা রয়েছে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবিপ্রবি)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভিসির চরম দলীয়করণের প্রতিবাদে ঈদের নতুন করে আন্দোলনে নামবেন শিক্ষকরা। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা। সেখানে ভিসি নিজ প্রতিষ্ঠান ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার লোকদের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদে নিয়োগ দিচ্ছেন লাগামহীনভাবে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ থাকলেও ভিসি বেপরোয়া। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও রসাত্মক গল্প, যা ক্যাম্পাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউজিসি ও মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর বাইরে আরও বিভিন্ন ধরনের অন্যায়-অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোজার মধ্যেও একদফা আন্দোলন হয়। ঈদের পর বড় ধরনের আন্দোলনেরও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিসির স্বেচ্ছাচারী আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া ছাত্রলীগ- বিরোধী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে ক্যাম্পাস সূত্র।
একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ : ক্ষমতাসীন মহাজোটের গত সাড়ে তিন বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সংঘর্ষ, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে প্রশাসন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বন্ধ করে দেয়। এ সরকারের আমলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ, খুলনা প্রকৌশল, কুমিল্লা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সুলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, এমসি কলেজসহ অর্ধশতাধিক বড় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান ৪০০ দিনেরও বেশি বন্ধ থাকে। প্রায় চার মাস ধরে অচলাবস্থা চলে আসা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) ৯ জুলাই রাতে ৪৫ দিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমান ভিসি ও প্রো-ভিসির বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ এনে তাদের অপসারণ দাবি করে আসছে বুয়েট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ তাদের গদি রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়। সরকার এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ এবং ছাত্রের ওপর পুলিশের গুলির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টি গতকাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আগামী ২৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়টি খুলে দেয়া হবে। তবে এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈরাজ্যের প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের আন্দোলন-সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ না হলেও ৫-৬ মাস ধরে এক ধরনের অচলাবস্থা চলে আসছে। ছাত্র সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের ঘটনায় এ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দু’দফায় ৯০ দিন (তিন মাস) বন্ধ ছিল। শিবির নেতা নোমানি হত্যার ঘটনায় ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ওই ঘটনায় ৮০ দিন বন্ধ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগ কর্মী ফারুখ হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আবার বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় ১০ দিন বন্ধ থাকে। এই ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ৬ দিন বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ছিল। ছাত্রলীগ-ব্যসসায়ী সংঘর্ষে এ বছর ২১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টি আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগকর্মী আজিজ হত্যার ঘটনায় এ বছর ১৬ মার্চ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৯ মার্চ পর্যন্ত ১৮ দিন বন্ধ ছিল। এ সরকারের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬ দিন বন্ধ ছিল। আসাদুজ্জামান নামের এক ছাত্র খুনের ঘটনায় ২০১০ সালের ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থী-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় ২০১০ সালের ২ আগস্ট বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি ৪৬ দিন বন্ধ ছিল। ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই শিবির নেতা নিহতের ঘটনায় বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ৭ দিন বন্ধ ছিল। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় ২০০৯ সালের ৪ মে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ২৫ দিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় হাজী দানেস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০ সালের ৩০ জুন বন্ধ করে দেয়া হয়। ৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ছিল। ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ২৯ এপ্রিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ৬ দিনের জন্য বন্ধ থাকে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি একাধিকবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়।
ইউজিসির উদ্বেগ : গত বৃহস্পতিবার ইউজিসিতে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, এতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান সমস্যা নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিকে ৯ আগস্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরিদর্শন, আন্দোলনরত শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। ঈদুলফিতরের আগেই তদন্ত কমিটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিদর্শন করবে বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্র আরও জানায়, এ কমিটি আগামীতে দেশের যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বা শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টের মতো কোনো সমস্যা দেখা দিলে সরেজমিন পরিদর্শন করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে পরিস্থিতি নিরসনে। কমিশনের বৈঠকে বলা হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান পরিস্থিতি ও সৃষ্টি শিক্ষা সঙ্কটের ব্যাপার উদ্বেগজনক। কমিশন মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতার কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীর ব্যর্থতা : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মনে করেন, গত সাড়ে ৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। বিএনপি সরকারের সময় শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন বলেন, ভিসিদের দলবাজি ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে আজ ছাত্র-শিক্ষকরা জিম্মি। শিক্ষামন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। দেশে এখন অপশিক্ষাব্যবস্থা চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সঙ্কট এখনও চলছে। বুয়েটেও একই অবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভিসি ও ট্রেজারকে সরিয়ে দেয়া হলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নৈরাজ্যের পাশাপাশি চলছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকরের মতো মেধাবী ছাত্র নিহত হলো। সম্প্রতি সিলেটে এমসি কলেজ ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দিল ছাত্রলীগ। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব কিছুতে শিক্ষামন্ত্রীকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা গেল না। অচথ উদাসীন ও নির্বিকার সরকারের একটু আন্তরিক হলেই ওইসব সঙ্কট ও অস্থিরতা হতো না।
প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্তরের বই বিতারণ ও ছাপা প্রসঙ্গে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকারের সময় সবকিছু একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী করতাম। অথচ এই সরকারের সময় বই ছাপতে এখন ২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। অথচ দুর্নীতি করতে আমাদের দেশি ছাপাখানা থাকতে ভারত থেকে বই ছাপা হচ্ছে। এমপিওভুক্ত নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আ ন ম এহছানুল হক মিলন। তিনি বলেন, আমরা এমপিও ভুক্ত নিয়ে নানা অনিয়ম দুর্নীতির খবর আমরা পাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে এসএসসি, এইচএসসিতে পাসের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরীক্ষকদের নম্বর বেশি দিয়ে পাসের হার বাড়াতে নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করে যাচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, কোনো ধরনের ট্রেনিং ও অবকাঠামো সুবিধা ছাড়াই সরকার সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু করেছে। সাবেক এ মন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার একটি শিক্ষা কমিশনও নীতিমালা করল। কিন্তু কার্যকারিতা নেই। তিনি বলেন, আসলে সরকার কোনো কাজ করছে না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াকে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী, প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয় প্রশাসন ও ছাত্র সংগনকে দায়ী করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নগ্ন দলীয়করণ করা হয়েছে। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দলীয়করণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিতে নিয়োগ না দিয়ে অনুগত লোক নিয়োগ দেয়ায় সদস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষকদের কাছে প্রশাসন আস্থাভাজন হতে পারছে না। যদি যোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে থেকে ভিসি, প্রোভিসি নিয়োগ দেয়া হতো তাহলে বুয়েটের মতো জায়গায় ওই সঙ্কট সৃষ্টি হতো না। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের ব্যাপারে বলেন, ক্যাম্পাসে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এমন সমস্যা সৃষ্টির কারণে অস্থিরতা বাড়ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস শান্ত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অধ্যাপক এমাজউদ্দিন বলেন, এসবই রাজনৈতিক ও দলীয়করণের ফল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মামনুনুল কেরামত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দরভাবে চলুক সেটা সরকারের উদ্দেশ্য নয়। তাদের উদ্দেশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অব্যাহত সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যার ঘটনায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশাল সেশনজটে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এসব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। বুয়েট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রী বার বার বুয়েট সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেন। কিন্তু সঙ্কটের সমাধান দিলেন না। শিক্ষাঙ্গন অস্থিরতার জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাহাঙ্গীনরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মুস্তাহিদুর রহমান বলেন, দলীয়করণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা চলছে। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষামন্ত্রীর ব্যর্থতা সম্পর্কে তিনি বলেন, সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রণালয়ের। অতএব যুক্তিসঙ্গত কারণে সার্বিকভাবে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হবে।
সরকারের সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলমান সঙ্কট ও অস্থিরতা সম্পর্কে জানতে সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি হলেও পরক্ষণেই এখন মিটিংয়ে রয়েছি আজ কথা বলতে পারছি না এমন ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দেন। তবে সম্প্রতি আমার দেশ-এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পস্থিরিস্থতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শান্ত রাখতে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি অসুস্থ জানিয়ে অসম্মতি জানান।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads