বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১২

খালেদা জিয়াকে এক্ষুনি সতর্ক হতে হবে



॥ সিরাজুর রহমান ॥

রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। একই সাথে আত্মসমীক্ষার মাসও বটে। ব্যক্তি এ মাসের সংযমের মধ্যে নিরুত্তাপভাবে নিজ জীবনের মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণের সুযোগ পায়। আন্দোলন প্রভৃতি রাজনৈতিক উত্তেজনা সাধারণত বন্ধ থাকে। নেতারা এবং দলগুলো সুস্থির চিন্তা করে এ মাসে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণ করার চেষ্টা করেন।
উত্তাল ঘনঘটা এবং গভীর অন্ধকারে বাংলাদেশ এখন নিমগ্ন। সাতচল্লিশে একবার আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে গণতান্ত্রিক গতিপথে উত্তরণ ছিল আমাদের লক্ষ্য। সে আশার সলিল সমাধি ঘটিয়েছে স্বদেশী উপনিবেশবাদীরা। আরো একবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের অস্ত্র ধরতে হয়, সংগ্রাম করে দ্বিতীয় দফা স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।
বাংলাদেশের চরম দুর্ভাগ্য। আমরা দেখলাম, গণতন্ত্রের কথা বলে যারা আমাদের মুক্তির সংগ্রামে আহ্বান জানিয়েছিলেন, শেষে তারাই গণতন্ত্রকে হত্যার প্রয়াস পান। ১৯৪৬-৪৭ সালে উত্তর ভারতীয় এবং পাঞ্জাবি মুসলিম লীগ নেতাদের ডাকে আমরা স্বাধীনতার আন্দোলন করেছিলাম। পরবর্তীকালে তারাই আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। ’৭২ থেকে ’৭৫ সালের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বৈরতন্ত্রের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সামরিক স্বৈরতন্ত্রী বলে বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতারা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন। কিন্তু সেই জিয়াউর রহমানই ’৭৫ সালে নিহত গণতন্ত্রকে আবার পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেই আওয়ামী লীগকেও আবার নতুন জীবন দেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। এমনকি আওয়ামী লীগের দু’জন শীর্ষ নেতাকে দিল্লিতে পাঠিয়ে শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে দেশে ফিরিয়ে আনেন, দলের নেতৃত্ব হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ দেন তাকে। সেই শেখ হাসিনা এবং সেই আওয়ামী লীগ এখন আবার বাকশালী স্বৈরতন্ত্র ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছে।
অন্য দিকে মুক্ত এবং অবাধ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল)। এ দলের নেত্রী খালেদা জিয়া ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লে. জে. এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসবিমুখ আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। এখন আবার বাকশালী চক্রান্ত থেকে রক্ষা করে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। আরো ১৭টি অপেক্ষাকৃত ছোট দল এখন সে সংগ্রামে তাকে সমর্থন দিচ্ছে।
রমজানের আগে বেগম জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, ঈদুল ফেতরের পর পর্যন্ত তিনি আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচি দিচ্ছেন না, কর্মসূচি দেয়া হবে ঈদের পরে। গত রোববার তিনি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ইফতার অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঈদের পরে তিনি সরকারের অপশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করার কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। ১৮ দলের পক্ষ থেকে আহূত সে আন্দোলনে যোগ দিতে তিনি দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জে. এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় থেকে খালেদা জিয়ার ভাবমর্যাদা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে আছে। ১৯৯১ সালের কিছু স্মৃতি আমার মনে অত্যন্ত তাজা। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে বহু নরনারী আমাকে বলেছিলেন, তারা কোনো দল চেনেন না, তারা খালেদা জিয়াকে ভোট দিতে এসেছেন। খালেদা জিয়া মানুষের কথা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, সেটাই তার বড় পরিচয়।
তারপর থেকে বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বিএনপি দলকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে, সে সুযোগে নতুন নতুন নেতা প্রবেশাধিকার পেয়েছেন বিএনপিতে। সব মানুষের মতো সব নেতারই ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভিমত থাকে। গণতন্ত্রে সে জন্যই ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রায়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। গণতন্ত্রকে সে জন্যই কেউ কেউ বস্তাভর্তি ছুঁচোর সাথে তুলনা করেছেন।

রাজনীতি বানর আর তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্ক নয়
এ উপমাটা গণতন্ত্র রক্ষার বর্তমান আন্দোলনে প্রায়ই আমার মনে হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া এ আন্দোলন শুরু করেছেন প্রায় এক বছর হলো। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে বলেই মনে হচ্ছিল। খালেদা জিয়া অনেক সভা-সমাবেশ করেছেন, চারটি সড়ক-যাত্রায় তিনি দেশের সব এলাকায় গেছেন, মূল সমাবেশগুলো ছাড়াও অনেক পথসভা করেছেন তিনি। লাখ লাখ মানুষ সেসব সভায় যোগ দিয়েছে, অধীর আগ্রহে তার মুখে গণতন্ত্রের কথা তারা গোগ্রাসে গিলেছে। ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি শান্তি রক্ষার প্রয়োজনে শেষ মুহূর্তে ১২ মে থেকে এক দিন পিছিয়ে দেয়া হলেও রেকর্ডসংখ্যক মানুষের সমাবেশ হয়েছিল সে দিন।
বর্তমান পর্যায়ের গণন্ত্রের আন্দোলনে একাধিকবার মনে হয়েছে আন্দোলন আরো দু-চার দিন চললে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ঠিক তখনই কর্মীদের পিছুডাক দেয়া হয়েছে, আন্দোলনে ঢিলে দেয়া হয়েছে। ফলটা হয়েছে পাটীগণিতের সে তৈলাক্ত বাঁশ আর সেই বানরটির মতো। বানরটি এক মিনিটে যতটা ওপরে উঠছে পরের মিনিটে ততোটাই নিচে নেমে যাচ্ছে। স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়নি, অত্যাচারী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ আর তার কুশাসন এখনো বহাল তবিয়তে আছে। শুধু তা-ই নয়, গণতন্ত্রের শেকড়গুলো তারা একে একে কেটে দিচ্ছেন, নতুন শেকড় যাতে গজাতে না পারে সে জন্য মাটিতে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছেন তারা।
আগেও একাধিকবার লিখেছি, বর্তমান আন্দোলনের সাফল্য সম্বন্ধে খালেদা জিয়ার দল ও নেতৃত্বের সব নেতাই কিন্তু অঙ্গীকারবদ্ধ নন। কর্মসূচি কিংবা হরতাল দেয়া হবে কি না, হলেও সে হরতাল লাগাতার হবে কি নাÑ এসব নিয়ে বিতর্ক বিএনপির ভেতরে লেগেই আছে মনে হয়। কেউ কেউ প্রায়ই বলে থাকেন, তাদের হরতাল-কর্মসূচিতে না গিয়ে ‘সংবিধান পন্থায়’ আন্দোলন করা উচিত। কোন সংবিধানের কথা তারা বলছেন আমি বুঝে উঠতে পারি না।
সংবিধান একটা অবশ্যই ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার অনেক কারিগরি করেছে এ সংবিধান নিয়ে। সংবিধানের খোলনলচে পুরোপুরি পাল্টে দেয়া হয়েছে। রায়ের ভুল ব্যাখ্যার দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। দলীয়কৃত প্রশাসনের অধীনে এবং দলীয় পরিচালনায় সাজানো নির্বাচন দিয়ে একটা বাকশালী স্বৈরতন্ত্র পোক্ত করাই যে সংবিধানের উদ্দেশ্য, সে সংবিধান অনুযায়ী ‘আন্দোলন’ করে গণতন্ত্র পাওয়া যাবে বলে যারা যুক্তি দেখান, তারা অবশ্যই নিজেদের এবং জাতিকে প্রতারণা করছেন। তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, নিমগাছে লিচু কিংবা আম ফলে না। এ জন্যই কোনো কোনো মহলে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে যে, খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের আন্দোলনে কিছু কুইসলিংয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যারা ভেতরে থেকে আন্দোলনকে স্যাবোটাস করার চেষ্টা করছেন। বেগম খালেদা জিয়া রোববার বলেছেন, ঈদের পরই তিনি কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন। প্রায় সাথে সাথেই স্যাবোটাসকারীরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে মনে হয়। ‘দলীয় সূত্রগুলোর’ বরাত দিয়ে মিডিয়ার একাংশ প্রচার শুরু করেছে, কঠোর আন্দোলনে যেতে বিএনপি আরো সময় নেবে। শোনা যাচ্ছে, কেউ কেউ ছয় মাসের প্রস্তুতির কথাও বলছেন।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আর বাকি আছে দেড় বছরেরও কম সময়। আন্দোলনের প্রস্তুতিতে আরো ছয় মাস কেটে গেলে নির্বাচনের ভিত্তিপদ্ধতি স্থিরিকৃত হতে আরো কত সময় নেবে কে জানে। অথচ আদর্শ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের মধ্যেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে আগামী বছরের শুরু থেকেই দল ও জোটগুলো প্রস্তুতির কাজ হাতে নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, তার সরকারের মেয়াদের শেষ তিন মাসের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন হবে। বর্তমান সরকার নির্বাচনী পদ্ধতিসহ বহু ব্যাপারে বিশ্বসমাজের চাপে আছে। সফরে লন্ডনে এসেও এ ব্যাপারে তাকে বহু প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয়েছে। সে জন্যই বিবিসিকে তিনি বলে গেছেন, একটা ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং ইচ্ছা করলে বিএনপি সে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। বেগম খালেদা জিয়া প্রত্যাশিতভাবেই সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। 

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়
প্রশাসন, শান্তিরক্ষী বাহিনীগুলো, এমনকি নির্বাচন কমিশনকেও যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এমনকি বিরোধী দল সে সরকারে যোগ দিলেও নয়। আমলাদের সুচতুর বিন্যাসের দ্বারা ২০০১ সালের নির্বাচনেও সাজানো জয়ের ষড়যন্ত্র করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র ১২ জন আমলাকে বদলি করে সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। আগামী নির্বাচনেও সে রকম একটা ষড়যন্ত্রের আয়োজন করে রেখেছে সরকার। বেগম খালেদা জিয়া সে জন্যই এই ফাঁদে পা দিতে পারেন না। তবে প্রধানমন্ত্রীর উক্তির মধ্যে সরকারের একটা বেকায়দা পরিস্থিতির সুর আছে, এ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনা অথবা সরকারের পতন ঘটানোর এটাই উপযুক্ত সময়। 
বেগম খালেদা জিয়াকে এখন লৌহকঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা ভেতরে থেকে আন্দোলন সাবোটাস করার চেষ্টা করছেন, তাদের দল থেকে, অন্তত আন্দোলন থেকে বাদ দিলে আন্দোলন বেগবান হবে, ফল লাভও দ্রুততর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিএনপি নেত্রীকে রবীন্দ্রনাথের বাণী মনে রাখতে হবে: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। এ নীতি অতীতে তার বহু কাজে লেগেছে। এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কেউ কেউ, বিশেষ করে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও তার আওয়ামী লীগ বেশির ভাগ সময়ই আন্দোলনে ছিল না। তিনি বেশির ভাগ সময়ই এরশাদকেই সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু সঙ্কল্পের দৃঢ়তা এবং উদ্দেশ্যের অবিচলতার দ্বারা বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন। ঠিক একই মনোভাব নিয়ে বর্তমানেও তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তা হলে তিনি দেখবেন, আবারো জনতা তার সাথেই থাকবে।
প্রসঙ্গত, বিবিসির সাথে শেখ হাসিনার উপরি উক্ত সাক্ষাৎকারের একটা বক্তব্য আমার হাস্যকর মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি, সরকার নাকি বারবার তাগিদ দিয়েও তাদের কাছ থেকে কোনো প্রমাণ আদায় করতে পারেনি। প্রকাশিত খবরাদি থেকে মনে হয়, সরকারের কাছে লেখা ব্যাংকের সর্বশেষ চিঠিতে প্রমাণগুলো সংবলিত রয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধীদলীয় নেতারা বারবার সে চিঠি প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিজ এলেন গোল্ডস্টেইন বলে দিয়েছেন, সে চিঠি প্রকাশে ব্যাংকের কোনো আপত্তি নেই। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ অপরিবর্তিতভাবে সে চিঠি প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে পারেন। তাহলে কে সত্য বলছেন আর কে বলছেন না সেটা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

লন্ডন, ০১.০৮১২
serajurrahman34@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads