মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করে গদি রক্ষার অপচেষ্টা



সি রা জু র র হ মা ন
এমন কোনো কাজ নেই, তা যত জঘন্য এবং নিকৃষ্টই হোক না কেন, গদি আঁকড়ে থাকার জন্য যেটা প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদ করতে প্রস্তুত নন। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, বিভেদের রাজনীতি ছাড়া আর কিছু জানেন না তিনি। হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা—এগুলো হচ্ছে তার রাজনীতির মূলধন। আজকের বাংলাদেশ যেমন ঘৃণা ও প্রতিহিংসার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, স্বাধীনতার সময় থেকে আর কখনও এমন ছিল না।
ইতিহাসে বহু দৃষ্টান্ত পড়েছি। জাতীয় ঐক্যের অনুপস্থিতি, ভেদাভেদ এবং অন্তর্বিরোধ যেকোনো জাতিকে ধ্বংস করে, নিদেনপক্ষে তাকে দুর্বল ও পরমুখাপেক্ষী করে ফেলে। অমর গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লিস; তার তিনটি ট্র্যাজেডি নাটকের দুটি আমি অনুবাদ করে বিবিসি থেকে প্রচার করেছি। সোফোক্লিসের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৮ সালে, মারা গেছেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৬ সালে। সেই সুদূর অতীতে তিনি লিখেছিলেন, বিভেদ আর অনৈক্য এবং অহেতুক যুদ্ধবিগ্রহ কিভাবে ইউরোপীয় সভ্যতা ও গণতন্ত্রের প্রসূতি সদন গ্রিসের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। ইতিহাসে আরও পড়েছি, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের অমাত্য চাণক্য বিশ্বাস করতেন কোনো রাজ্য ও জাতিকে জয় করার সহজতম উপায় তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। চাণক্য আগে গুপ্তচর পাঠিয়ে কোনো দেশের জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরাতেন, গৃহবিবাদ সৃষ্টি করতেন, সৈন্য পাঠিয়ে দেশটা দখল করতেন তার পরে।
এগুলো ইতিহাসের শিক্ষা এবং সাধারণ বুদ্ধির কথা। ঠিক এ কারণেই আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদের নীতি ও কর্ম বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। জিয়া পরিবার ও বিএনপির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তিনি রাজনীতিতে নেমেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পাওয়ার পর বিবিসির স্টুডিওতে আমাদের বলেছেন, ওরা তার বাবাকে মেরেছে, মাকে মেরেছে, ভাইদের মেরেছে, তাদের জন্য কেউ কাঁদেনি, তার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে নেমেছেন। আমি এবং আমার সহকর্মী জন রেনার তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, এ উক্তি এবং এ জাতীয় মনোভাব রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়।
দু’জন সাধারণ সাংবাদিকের সুপরামর্শ হাসিনা শোনেননি, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি স্বদেশ, গণতন্ত্র, এমনকি নিজের রাজনৈতিক দলেরও অভাবনীয় ক্ষতি করেছেন। অন্য কারো উপদেশ কিংবা সমালোচনা সহ্য করার ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার নয়। নিজ দলের শীর্ষ নেতারাও তার ভুল সংশোধনের চেষ্টার সাহস রাখেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ভবিষ্যতে যখন নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখা হবে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিশেষ প্রশংসা তাতে থাকবে না।
প্রথমেই তিনি ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ কথাটা রাজনীতির ময়দানে ছেড়ে দিয়ে ভীত, ছত্রখান চড়ুই পাখির মতো একটা শঙ্কার পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন। মুক্তিযুদ্ধে আমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারের সমন্বয়ের দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম নির্বাসিত সরকারের প্রধান বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর অনুরোধে—যাকে বহু চেষ্টা করে আন্দোলনে এনেছিলাম আমি। তাছাড়া সেদিন বিবিসির সম্প্রচারে আমার ভূমিকার কথা আশা করি বাংলাদেশে কিছু মানুষেরও মনে আছে। মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা আমি দেখেছি।
মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছিলেন?
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি বর্বররা প্রথমে ২৫ মার্চ রাতে এবং পরে ১২ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে চিন্তানায়কদের যাকে যেখানে পেয়েছে ধরে নিয়ে খুন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান সে তারিখের মাঝ রাতের আগে পাকিস্তানিদের কাছে ধরা দেন। তারা তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের নেতারা সবাই পালিয়ে ভারতে চলে যান। ভারত সরকার কলকাতার বিভিন্ন হোটেল ও গেস্ট হাউসে তাদের জামাই আদরে লালন করে পুরো ৯ মাস। অর্থাত্ দেশ-বিদেশে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কোনো যোগাযোগ ছিল না।
দেখা যাক, কারা যুদ্ধ করেছিলেন। প্রথমে স্বদেশে। শুরুর মুহূর্তে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন সবাই। মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর যুবশ্রেণী কিছুটা হদিস পায়। সাবেক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত অফিসার ও জওয়ানরা মনে মনে আগেই পক্ষত্যাগ করে ফেলেছিলেন। বিডিআর আগে থাকতেই পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে শুরু করেছিল। সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে সব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড গড়ে ওঠে। ছাত্র-যুবকরা দলে দলে কোনো না কোনো কমান্ডে যোগ দেয়। যত্সামান্য প্রশিক্ষণের পর প্রথম মহাযুদ্ধের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে নিয়ে পশ্চিমি মিডিয়ায় ‘লুঙ্গি বাহিনী’ নামে বর্ণিত মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বুদ্ধিজীবীদের ভাগ্যবানরা পালিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে লন্ডনে চলে আসেন আন্তর্জাতিক প্রচারে ভূমিকা রাখার জন্য। এদের অনেকের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আমি বিবিসি থেকে প্রচার করেছি, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারের ব্যবস্থা করেছি। দেশের ভেতরে যেসব বুদ্ধিজীবী লুকিয়ে ছিলেন (বলতে বাধ্য যে তাদের অনেকে পরবর্তী সময়ে জাসদপন্থী হয়ে ছিলেন) তারা দেশবাসীর মনোবল রক্ষায় এবং তরুণ সমাজকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে উত্সাহদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
সাধারণ মানুষ যে যেভাবে পারে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছে। গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তারা। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছে, তাদের উপস্থিতির খবর গোপন রেখে পাকিস্তানিদের বহু অসুবিধা ঘটিয়েছে। এসব কারণে বহু লোককে নির্যাতন, এমনকি হত্যা করেছে শত্রু বাহিনী, বহু বীর নারী আত্মমর্যাদা খুইয়েছেন।
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধ
বিদেশের আন্দোলন মূলত যুক্তরাজ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল। আর কোনো দেশে তখন বড় আকারে বাংলাদেশী অভিবাসন শুরু হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সে দেশে কয়েকজন উচ্চশিক্ষার্থী ছিলেন, তারা নানাভাবে মার্কিন রাজনীতিকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। অনুরূপ চেষ্টা ইউরোপের কোনো কোনো দেশে স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষার্থীও করেছেন।
যুক্তরাজ্যের বহু শহরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী তখনও ছিলেন। আগের বছরের নভেম্বরে মনপুরা ও অন্যান্য দ্বীপে ঘূর্ণিঝড়ের অভাবনীয় ক্ষতির পর ত্রাণ সাহায্যের জন্যে বহু শহরে বাংলাদেশী সমিতি গড়ে উঠেছিল। এ সমিতিগুলো এখন আবার সক্রিয় হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে জনমত সংগ্রহের আন্দোলনে নেমে যায়। তারা রাজপথে মিছিল করত, কোথাও কোথাও সভাসমাবেশ করেছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ দেশের মানুষকে আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলেছেন এই সমিতিগুলোর সদস্যরা। ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাদের আন্দোলনের ছবি ও খবরাদি প্রচার করেছে।
আবু সাইদ চৌধুরী প্রচুর অনুরোধ-উপরোধের পর আমাদের সঙ্গে যোগ দেন ১০ এপ্রিল তারিখে। তারপরই একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয় এবং সারাদেশের সমিতিগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নেমে পড়ে। ভাইদের পাশাপাশি আন্দোলন করার জন্যে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গঠিত হয়। আন্দোলন তখন দুর্বার হয়ে ওঠে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনেকে কাজে না গিয়ে মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিয়েছেন, অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যবিধ ব্যয় বহনের জন্যে অকাতরে চাঁদা দিয়েছেন। কেউ কেউ পুরো সপ্তাহের বেতনই তুলে দিয়েছেন সংগ্রাহকদের হাতে।
স্বাধীনতার পক্ষের প্রকৃত শক্তি কারা?
শেখ মুজিবুর রহমান কি সত্যি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন? ৭ মার্চ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেছিলেন বটে যে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কিন্তু আরও বহু বিষয় নিয়ে সে বক্তৃতায় তিনি আলোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন যে পাকিস্তানি সৈন্যরা ‘আমাদের ভাই’। তাদের তিনি ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। অবিলম্বে মার্শাল ল’ তুলে নিতে বলেছিলেন, বাংলাদেশীদের হত্যার বিচার দাবি করেছিলেন, অবিলম্বে জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করতে এবং ‘জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে’ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে (অর্থাত্ তাকে প্রধানমন্ত্রী করতে) বলেছিলেন। আরও তাত্পর্যপূর্ণ এই যে ২৫ মার্চ বিকাল পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান এবং জুলফাির আলী ভুট্টোর সঙ্গে তিনি ও তার প্রতিনিধিরা আলোচনা চালিয়ে গেছেন, যার মূল বিষয় ছিল মুজিব কি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, না গোটা পাকিস্তানের।
এরপর শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং স্বাধীনতার একমাত্র ‘হিরো’ বলে দাবি করার কোনো সঙ্গত ভিত্তি নেই। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ছিলেন দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ—স্বদেশে এবং প্রবাসে। হাসিনা সম্পূর্ণ অবাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তি’ বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে। প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক এলাকা ও সম্পদ তুলে দিচ্ছেন। দেশের গরিষ্ঠ মানুষ তাকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বলেই মনে করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে জাতীয় ঐক্যের ওপর তিনি বজ্রাঘাত করেছেন। যুদ্ধকালীন বিবাদ-বিসম্বাদ এবং তিক্ততা ভুলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য মুজিব সবচেয়ে জঘন্য যুদ্ধাপরাধী বলে শনাক্ত করা ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে মুক্তি দিয়েছেন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সহায়তার আশায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। একই উদ্দেশ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও পাকিস্তানিদের পক্ষ সমর্থনকারীদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এসবের পরও তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া দিয়ে হাসিনা ৪১ বছর আগের পুরনো ক্ষতগুলোকে জাগিয়ে তুলেছেন।
ধর্মীয় রাজনীতি ও সরকারি নির্যাতন
বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি এদেশে অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রত্যাশিত নয়। পাশের দেশ ভারতেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আছে। মুসলমানদের ওপর নির্যাতন সে দেশে নিত্যকারের ব্যাপার। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার ব্যাপারে হিন্দু ভারতীয় জনতা পার্টির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তার জের ধরে দুই হাজার মুসলমান খুন হয়েছিলেন। গুজরাটে নরেদ্র মোদি কট্টর হিন্দুত্বের প্রতিভূ। তার আমলে ২০০২ সালে সরকারি উসকানিতে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ডে ২০০ মুসলমান নিহত হয়েছেন। বিজেপি দিল্লিতে সরকার গঠন করেছে, শাসন করেছে, আগামী নির্বাচনে তারা আবারও ক্ষমতা পাবে বলে আশা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বাইবেল বেল্ট রাজনীতিতে একটা প্রবল শক্তি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার জের ধরে এখন সবাই জানে বার্মার শাসক জান্তা কট্টর বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ নয় বলেই তাদের বিরুদ্ধে বল্গাহীন নির্যাতন লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জের ধরে বর্তমান সরকার প্রথমে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করেছে। আরও পরে মাদরাসা ছাত্র, মসজিদগামী এবং টুপি-দাড়ি পরিহিত হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে খুন কিংবা গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সরকারের বিশেষ কোপা দৃষ্টি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র খুন হয়েছে, গুম করা হয়েছে আরও অনেককে। এই হত্যা-নির্যাতনকে ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ দমন বলে জাহির করে সরকার প্রথমে বিশ্ব সমাজের বাহবা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বহির্বিশ্বের নেতারা এখন প্রকৃত সত্য জেনে গেছেন। তারা সময় এবং সুযোগ পেলেই র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যার, ইলিয়াস আলীকে এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল হককে গুম করার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
হাসিনা আরেকটা গুরুতর ভুল করেছেন তার ভোটব্যাংক সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে। গত সপ্তাহে তিনি আবার সাম্প্রদায়িক দুষ্টগ্রহের অবতারণা করেছেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরবর্তী কিছু দুঃখজনক ঘটনার উল্লেখ করে বলতে চেয়েছেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী না হলে সংখ্যালঘুদের ওপর ২০০১ সালের মতো নির্যাতন হবে। হাসিনা কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনকে তিনি পাশ কাটিয়ে গেছেন। পুরনো পত্রিকার পাতা খুললেই শাঁখারী বাজার, সূত্রাপুর এবং দেশের অন্যত্র সংখ্যালঘুদের ভীতি প্রদর্শন, তাদের সম্পত্তি গ্রাস করা এবং কিছু সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ ইত্যাদি কাহিনী বেরিয়ে পড়বে। আরও গুরুতর ব্যাপার যে, তার ক্যাডার ও গুন্ডাবাহিনী সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও অকথ্য হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে।
হাসিনা সংখ্যাগুরুর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়। ক্ষমতালাভের প্রথম প্রহর থেকে ডবল-ট্রিপল পদোন্নতি দিয়ে তিনি সংখ্যালঘু আমলাদের শীর্ষ পদে বসিয়েছেন। সেজন্য সাড়ে ৬০০ জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ আমলাকে ওএসডি করে রাখতে হয়েছে। পুলিশে, সরকারি আধা-সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতা ডিঙিয়ে সংখ্যালঘুদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪২টির ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক বলে এক পাঠক আমাকে জানিয়েছেন। যাদের ওএসডি করা হয়েছে, যাদের জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে হাজার হাজার সংখ্যালঘুকে চাকরি দেয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই নিশ্চয় বহু আত্মীয়-বন্ধু আছেন এবং হয়তো তার ভোটদাতা। এ বিষয়টা অবশ্যই নির্বাচনে একটা ব্যাক-ল্যাশ সৃষ্টি করবে।
(লন্ডন, ১২.০৮.১২)
serajurrahman34@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads