বুধবার, ২২ আগস্ট, ২০১২

সাংবাদিক নির্যাতন কুষ্টিয়া স্টাইল



সাংবাদিক নির্যাতনের নতুন স্টাইল চালু হয়েছে কুষ্টিয়ায়। সংবাদ প্রকাশিত হলে বা সংবাদ প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলেই মামলা, হামলা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, প্রশাসনকে ব্যবহার করে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ, পত্রিকা বন্ধের জন্য নোটিশ দেয়া হচ্ছে। চলতি মাসেই কুষ্টিয়াতে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫ সাংবাদিককে। প্রকাশনা বাতিল করা হয়েছে একটি স্থানীয় দৈনিকের। কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত আরেকটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদককে নোটিশ দেয়া হয়েছে পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করতে। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে থানার ভেতরে ওসির সামনে। এখানকার সাধারণ মানুষ এটাকে আখ্যা দিয়েছে সাংবাদিক নির্যাতনের কুষ্টিয়া স্টাইল হিসেবে। 
১৪ই আগস্ট। রাত সাড়ে নটায় ভেড়ামারা থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে দৈনিক মানবজমিনের ভেড়ামারা প্রতিনিধি শাহজামালকে। গ্রেপ্তারের সময় তাকে জানানো হয়, তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের হয়েছে থানায়। ১২ই আগস্ট দুপুর বেলায় শাহজামাল ও কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দিনের খবর পত্রিকার ভেড়ামারা প্রতিনিধি ওয়ালিউল ইসলাম একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করতে যান। ওই তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি মনঃপূত হয়নি কর্তাব্যক্তিদের। ১৩ই আগস্ট ওই প্রকল্পের ভেড়ামারা উপজেলা কর্মকর্তা তহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে ভেড়ামারা থানায় সাংবাদিক শাহজামাল ও ওলিউল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করলে পুলিশ শাহজামালকে গ্রেপ্তার করে। ওলিউল ইসলাম এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। 
ঈদুল ফিতরের আগের দিন ১৯শে আগস্ট রাতের বেলা কুষ্টিয়া সদর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কুষ্টিয়ার খবর পত্রিকার সম্পাদক এম যোবায়ের রিপন ও ওই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক লুৎফর রহমান কুমারকে। পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করার পর থানায় মামলা রেকর্ড করে বলে অভিযোগ আছে। ওই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির মামলা করেছেন কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা হাজী রবিউল ইসলাম। মামলা দায়ের করার একদিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাদের সম্পাদিত পত্রিকায়। ওই দুই সাংবাদিক এখন কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। কেবল তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সাংবাদিক যোবায়ের রিপনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। 
এ ঘটনার সাত দিন আগে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখনও হাজতবাসে আছেন মোহনা টিভির কুষ্টিয়া প্রতিনিধি মওদুদ রানা ও কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দিনের খবরের সম্পাদক ফেরদৌস রিয়াজ জিল্লু। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেছেন আসিবুর রহমান রিজু। দৈনিক দিনের খবরের সম্পাদক ফেরদৌসকে কেবল গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হননি কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক, দৈনিক দিনের খবর পত্রিকাটির প্রকাশনাও বাতিল করেছেন। জেলা প্রশাসক পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করতে নোটিশ দিয়েছেন ড. আমানুর রহমানকে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক কুষ্টিয়া থেকে ডেইলি কুষ্টিয়া নামে একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশ করে আসছিলেন। এর আগে কুষ্টিয়া সদর থানার অভ্যন্তরে ওসির সামনে সন্ত্রাসীরা হামলা করে মারধর করে দৈনিক সমকাল পত্রিকার কুষ্টিয়া প্রতিনিধি সাজ্জাদ রানাকে। গত শবেবরাতে কুষ্টিয়া সদর থানায় ৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজ। ওই মামলার শিকার হন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম, সমকালের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি সাজ্জাদ রানা, স্থানীয় দৈনিক দেশ তথ্যের সম্পাদক হালিমুজ্জামান এবং ওই পত্রিকার সাংবাদিক মোমেসুর রহমান। 
হাজী রবিউল ইসলামের ও আসিবুর রহমানের দায়ের করা মামলায় নাম উল্লেখ না করে আরও  অজ্ঞাত কয়েক জনের নাম উল্লেখ থাকায় আতঙ্কে আছেন কুষ্টিয়ার সাংবাদিকরা। অনেকই জানিয়েছেন, তারা রাতে বাড়িতে ঘুমান না। দিনের বেলায় চলেন সতর্ক হয়ে শহরের অলিগলি দিয়ে। তাদের আশঙ্কা- যে কোন সময় চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার হতে পারেন তারা। তাদের ওপর নেমে আসতে পারে নির্যাতন। 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক মানবজমিনকে বলেন, আমার জানা মতে চাঁদাবাজি মামলায় মাত্র একজন সাংবাদিক জেলে আছে। অন্য চার জনের কথা আমি জানি না। তাছাড়া আমি তো মামলা করি না, পাবলিকে মামলা করলে আমি কি করতে পারি? মানবজমিনের ভেড়ামারা প্রতিনিধি শাহজামালের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তার নাম তহিদুল ইসলাম। একজন সরকারি কর্মকর্তাকে মামলা করতে হলে তো বিভাগীয় অনুমতি নেয়ার বিধান আছে। জেলা প্রশাসক বলেন, আমি ওই তহিদুল ইসলামকে চিনিই না। তিনি বলেন, দৈনিক দিনের খবরের প্রকাশনা বাতিল করা হয়েছে তার কাগজপত্র জাল বলে। এখানে সাংবাদিকদের ওপর কোন নির্যাতন হচ্ছে না। সাংবাদিকরা ভাল আছে। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশি তদন্ত শেষে মামলা গ্রহণ করার কথা? কিন্তু কুষ্টিয়াতে তদন্ত ছাড়াই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা নেয়া হচ্ছে? জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, আমরা তদন্ত করেই মামলা নিচ্ছি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, মামলার বাদী আওয়ামী লীগ নেতা বলে রাজনৈতিক চাপে মামলা নিয়েছেন কিনা? এসপি বলেন, ঠিক তা নয়। আমরা আমাদের গতিতেই কাজ করছি। তবে আমি বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখবো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads